অধ্যায়-১ ইহুদী ধর্মের সূচনা

অধ্যায়-১ ইহুদী ধর্মের সূচনা

‘ইহুদী’ ও ‘ইসরাইল’- এ শব্দ দুটো কোথাও পড়লে, কিংবা দেখলেই ধর্মীয় অনুভূতিগতভাবেই হোক আর যে কারণেই হোক, বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করেন। এর পেছনে কারণ কী?

কারণটি নিহিত রয়েছে ঐতিহাসিক বেশ কিছু দ্বৈরথ, জায়োনিস্ট প্রোপাগান্ডা আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের সদস্য ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল কর্তৃক নিরীহ ফিলিস্তিনিদের উপর নির্মম নির্যাতন- এ সব কিছুর মাঝে। তাছাড়া গাজা বা পশ্চিম তীরের সংঘাত এবং প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের রাজধানী তেলআবিবের বদলে পবিত্র জেরুজালেমকে ঘোষণা করায় এই ইহুদী বিদ্বেষ স্বাভাবিকভাবেই আবার দেখা যায় সাধারণ মুসলিমদের মাঝে। আর এরপর ২০২১ সালে গাজায় নারকীয় আক্রমণ চালানোর ঘটনা তো আছেই।

কিন্তু এ তো গেলো মুদ্রার এক পিঠ। অন্য পিঠে কী আছে? ফিলিস্তিনিরা নির্যাতিত হচ্ছে এটা সর্বজনবিদিত, কিন্তু ইসরাইলের দৃষ্টিকোণটা এখানে কী? ইহুদীরা কীসের ভিত্তিতেই বা জেরুজালেমকে নিজেদের দাবী করে? কীসের জোরে তারা বিশ্বাস করে এই পবিত্র ভূমি কেবলই তাদের? যদি ইহুদীদের দিক থেকে এরকমটা না করা হতো তবে এই সংঘাতের সৃষ্টি হতো না। তাই অরাজকতা, অস্থিরতা, অন্যায়- যে নামেই এ পরিস্থিতিকে ডাকা হোক না কেন, এর পেছনের গভীর কারণ লুকিয়ে আছে ইহুদী জাতির ইতিহাসে, যে ইতিহাসটা তারা নিজেরা বিশ্বাস করে।

পাঠকদের জন্য একদম গোড়া থেকে ধীরে ধীরে এ ঐতিহাসিক সিরিজে তুলে ধরা হবে মুসলিম ও ইহুদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই জাতির ইতিহাসকে, যে জাতি ‘বনী ইসরাইল’ নামেও পরিচিত। শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নয়, পবিত্র ভূমি দখলের আড়ালের বিশ্বাসটুকু জানতেও সাহায্য করবে এ সিরিজটি। হযরত ইয়াকুব (আ) থেকে শুরু করে একদম হযরত ঈসা (আ) এর আগ পর্যন্ত (অর্থাৎ খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হবার আগ পর্যন্ত) ঘটনাগুলো তুলে ধরা হবে, মুদ্রার দু’পিঠ থেকেই। পবিত্র কুরআন, তাফসির ইবনে কাসিরে যে ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করা আছে, সে একই ঘটনাগুলো ইহুদীরা কীভাবে দেখে? যে ঘটনাগুলো তাফসিরে বা মুসলিমদের পবিত্র গ্রন্থগুলোতে নেই, সেই শূন্যস্থান আমরা পূরণ করব ইহুদীদের নিজস্ব ঘটনা দিয়ে, যেগুলোর মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে, তারা কেন জেঁকে বসেছে পবিত্র ভূমিতে। এ সিরিজে জানা যাবে অলৌকিক সিন্দুক ‘তাবুত-এ-সাকিনা’ বা ‘আর্ক অফ দ্য কোভেন্যান্ট’ এর বিস্তারিত- এ ব্যাপারে কুরআন এবং ইহুদী গ্রন্থ কী বলে? মূসা (আ), ইউশা (আ), দাউদ (আ), সুলাইমান (আ) থেকে ঈসা (আ) পর্যন্ত কী কী ঘটনা ঘটেছিল যার মাধ্যমে পবিত্র ভূমির ভবিষ্যৎ রূপরেখা তৈরি হয়? মিসর থেকে লোহিত সাগর বিভক্ত করে কীভাবে ইসরাইল জাতি মুক্তি পেয়েছিল? পবিত্র ভূমিতে পৌঁছাবার আগে কেন বছরের পর বছর তাদের মরুভূমিতে শাস্তি পেতে হয়েছিল? পরবর্তীতে কেন এবং কীভাবে ইহুদীরা নির্বাসিত হয় পবিত্র ভূমি থেকে, কী ছিল তাদের দোষ? কেন তারা ঈসা (আ) বা যীশু খ্রিস্টকে অস্বীকার করেছিল? তারা বিশেষ কার প্রতীক্ষায় ছিল? কীভাবে নির্মিত হলো বাইতুল মুকাদ্দাস? আর এখন এ ভূমিতে এতদিন পরে ফিরেই বা ইহুদী জাতির কী যায়-আসে?

এ প্রশ্নগুলোর উত্তর অল্প অল্প করে আমরা বের করবার চেষ্টা করব ইসলামি উৎসগুলোর পাশাপাশি ইহুদী বিশ্বাসের তাওরাত ও অন্যান্য নবীদের নিয়ে লেখা পুস্তক থেকে; এছাড়াও আমরা ঘেঁটে দেখব ইহুদী ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থসহ হিব্রু বাইবেল বা তানাখ আর তাদের আইনগ্রন্থ তালমুদেও এ ব্যাপারে কিছু রয়েছে কি না।

‘ইহুদী’ বা বহুবচন ‘ইহুদীম’ (প্রা:) শব্দটি হিব্রু। সেমেটিক ধর্মগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ধর্ম হলো ইহুদী ধর্ম (Judaism )। অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন, ইহুদীদের ইংরেজিতে Jew বলে কেন? আরামায়িক শব্দ ‘ইয়াহুদাই’ (YÖhüdāi) থেকে গ্রিক শব্দ loudaios আসে। হিব্রুতে উচ্চারণ ‘এহুদী’ বা ‘ইহুদী’। আর এরপরে শব্দের শুরুর Y স্বরবর্ণ ইউরোপীয় ভাষায় J দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। সেই হিসেবে ইহুদী→ জিহুদি → জিউ (জ্যু)। মূল ‘ইয়াহুদাই’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ আসলে ‘যে বাস করে এহুদিয়া প্রদেশে”, কিন্তু সেই এহুদিয়া-র হিব্রু ‘হুদা’ অর্থ আসলে ‘যে নিজেকে সমর্পণ করে’ (আরবি ‘মুসলিম’ শব্দের অর্থও একই)। এহুদা ছিলেন হযরত ইয়াকুব (আ) বা ইসরাইল (আ) এর চতুর্থ পুত্র। তাঁর বংশধরেরা থাকতেন সেই প্রদেশে। তবে পারিভাষিকভাবে, বনী ইসরাইলকেই ইহুদী বলা হয়। সত্যি বলতে, ‘ইহুদী’ যতটা না ধর্মপরিচয়, তার চেয়ে বেশি বংশপরিচয় কিংবা জাতিপরিচয় (Ethnicity)। এ কারণে, একজন ইহুদী নাস্তিক হতেই পারেন, কিন্তু যেহেতু তিনি ইসরাইলের বংশধর, সেজন্য বংশগত বা জাতিগতভাবে তিনি ইহুদী নামেই পরিচিত হবেন।

মূলত ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে এই ভূমি দখলের সমস্ত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের পক্ষবাদী যে ইহুদীরা তাদেরকে জায়নবাদী বা জায়োনিস্ট (Zionist) বলে। উনিশ শতকের শেষ দিকে শুরু হওয়া এ জায়োনিজমের বাস্তবিক প্রয়োগ আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, এর প্রতিষ্ঠাতা থিওডোর হার্জল নামের একজন ইহুদী। ‘জায়োনিজম’ শব্দটি এসেছে জায়োন থেকে। ‘জায়োন’ বা ‘সিওন’ হলো জেরুজালেমের একটি টিলা, বাইতুল মুকাদ্দাস যে টেম্পল মাউন্টে অবস্থিত তারই দক্ষিণ অংশ। এ জায়গাটি জেরুজালেমের পবিত্রতম জায়গা বিধায় ‘জায়ন’ শব্দ দিয়েই জেরুজালেম বা ‘সিটি অফ ডেভিড (দাউদ)’-কে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে, জায়োনিজম আন্দোলন হলো “জায়ন’ বা ইহুদীদের ‘জেরুজালেম’ পুনরুদ্ধার আন্দোলন, বৃহত্তর অর্থে পুরো পবিত্র ভূমি অধিকার করে নেয়া। এই পবিত্র ভূমি বলতে আসলে কী বোঝায় সেটা আমরা এ বইতে ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেই জানতে পারব।

কিন্তু এ জায়োনিস্টদের নিন্দিত কর্মের জন্য এমনকি নিরীহ ইহুদী পরিবারদেরও ফলাওভাবে ঘৃণা করা হয়, যারা হয়তো এ মতবাদ সমর্থন করে না। যেমন- নিচের ছবিতে ইহুদীদের দেখা যাচ্ছে এই মৌলবাদী গোঁড়া জায়োনিজমের প্রতিবাদ করতে।

সবচেয়ে পুরোনো সেমিটিক ধর্ম হলেও ইহুদীদের সংখ্যা কিন্তু খুবই কম, তবে অনেক প্রভাবশালী জায়গাতেই তাদের অবস্থান রয়েছে। ২০২১ সালের হিসেব মতে, সারা বিশ্বের ইহুদী জনসংখ্যা ১ কোটি ৫২ লক্ষ, যা কিনা বিশ্বের মোট লোকসংখ্যার ০.১৯%। অনেকের পরিবারে ধর্মীয় পরিচয় হিসেবে কেউ কেউ ‘ইহুদী’ ব্যবহার করে না, কিন্তু জাতিগতভাবে তারা ইহুদী। এরকম ‘কানেক্টেড’ লোকদের হিসেবে আনলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৯ লক্ষ। তবে, ইসরাইল যে হিসেব প্রকাশ করেছে, তা অনুযায়ী দেশটির নাগরিগত্ব গ্রহণের সুযোগ আছে বিশ্বের ২ কোটি ৩৭ লক্ষ লোকের, যাদেরকে ইসরাইল ইহুদী পরিবারের সদস্য (যত দূরেরই হোক না কেন) বলে মনে করে। বিশ্বের ৫১% ইহুদী যুক্তরাষ্ট্রে এবং ৩০% ইহুদী বসবাস করে থাকে ইসরাইলে। বাকিরা ফ্রান্স, কানাডা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইউক্রেন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরি প্রভৃতি দেশে বসবাস করে থাকে।

ইহুদীরা মুসলিমদের মতোই বংশ পরম্পরা হিসেব করে হযরত ইব্রাহিম (আ) থেকে। অর্থাৎ পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ)। ইব্রাহিমের (আ) প্রধান দুই ছেলে ইসমাইল আর ইসহাক (ইহুদী তাওরাত অনুযায়ী ইব্রাহিম (আ) এর পরে আরো ছয় পুত্র হয় তৃতীয় স্ত্রী কেতুরার গর্ভে)। এর মাঝে, হযরত ইসহাক (আ) (ইংরেজিতে Isaac) এর ছেলে ছিলেন ইয়াকুব (আ) (Jacob)। ইয়াকুব (আ) এর আরেক নাম ছিল ইসরাইল (আ); এ নামটাই ইহুদীরা গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ইয়াকুব (আ) থেকেই আমাদের এই ইতিহাস শুরু হবে। তবে এই ‘ইতিহাস’ কিন্তু কেবলই ধর্মীয় ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় এগুলো তেমন আমলে আনা হয় না। একদমই যে কিছু পাওয়া যায়নি তা নয়, তবে এত আগের খুব কম জিনিসই পাওয়া গিয়েছে।

ইহুদীদের বর্তমান ভাষা হিব্রু, যদিও দু’হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলে আরামায়িক ছিল কথ্য ভাষা, হিব্রু প্রধানত লিখবার ভাষা (ফর্মাল)। হিব্রুকে তারা বলে ‘পবিত্র ভাষা’; আনুমানিক ২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হিব্রুর ব্যবহার ছিল ভালই। কিন্তু এরপর প্রায় ১৬টি শতাব্দী জুড়ে হিব্রু ছিল কেবলই একটি মৃত ভাষা। কিন্তু ১৮৮১ সালে এলিয়েজার বিন ইয়াহুদা (Eliezer Ben – Yehuda) এ মৃত ভাষাকে পুনর্জীবিত করবার কাজ শুরু করেন এবং বিংশ শতকের প্রথমদিকে পুরোপুরি চালু হয়ে যায় হিব্রু। এখন ইসরাইলের একটি রাষ্ট্রভাষা হিব্রু। মুসলিমদের পবিত্র ভাষা আরবি ও ইহুদীদের পবিত্র ভাষা হিব্রু দুটোই সেমিটিক ভাষা হবার কারণে এদের মাঝে অনেক মিল। দুটোই ডান থেকে বামে লেখা হয়। আরবিতে ২৯/৩০টি বর্ণ থাকলেও হিব্রুতে মাত্র ২২টি বর্ণ; তবে আরবির চেয়ে হিব্রুতে স্বর উচ্চারণ বেশি করা যায়।

‘বেসিক’ যতটুকু জানবার সেটা তো জানা হলোই, আর এছাড়াও যা যা জানবার প্রয়োজন হবে সেগুলো জায়গামতো উল্লেখ করা হবে। এবার কাহিনীতে প্রবেশ করবার পালা। তবে দেরি না করে এখনই শুরু করা যাক, হারিয়ে যাওয়া যাক বহু আগের মধ্যপ্রাচ্যে, যখন ‘ইহুদী’ শব্দটির প্রচলনই হয়নি!

খ্রিস্টের জন্মের প্রায় সতেরশ বছর আগে ‘বীরশেবা’ নামের এক মরু-অঞ্চল থেকে রওনা দিলেন মানুষটি। গন্তব্য তাঁর ‘হারান’, সেখানে যাত্রাবিরতি নেবার পরিকল্পনা।

হারানে পৌঁছালেন যখন তখন সূর্য ডুবে গিয়েছে। রাতের বেলা তিনি ভ্রমণ না করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যেখানে আছেন সেখানেই একটা পাথর যোগাড় করে মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লেন। আর ঘুমে তলিয়ে গেলেন পরক্ষণেই।

একটা খুবই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে তাঁর হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তিনি নিজেই স্বপ্নের কথা মনে করে বলে উঠলেন, “জানতাম না আমি, এটা ঈশ্বরের জায়গা!” তিনি জায়গাটার নাম দিলেন ‘বেথেল’। ‘বেথ’ মানে হিব্রুতে ‘ঘর’, আর ‘এল’ হলো ঈশ্বর বা আল্লাহ। তাই বেথেল মানে ‘ঈশ্বরের ঘর’। আর মানুষটির নাম? হযরত ইয়াকুব (আ)।

ইহুদীদের তাওরাত ও তাফসিরে ইবনে কাসিরে এ ঘটনাটি বলা আছে। কিন্তু কী ছিল সে স্বপ্ন যা দেখে তাঁর এটা মনে হলো? আর কীভাবেই বা এরপর কাহিনী গড়িয়ে তাঁর ছেলে হযরত ইউসুফ (আ) মিসরের এক দাস থেকে মিসর শাসকের ডান হাত হয়ে গিয়েছিলেন? তার চেয়েও বড় কথা, পবিত্র কুরআনে যেখানে বনী ইসরাইলকে তৎকালীন ‘সেরা জাতি’ (বাকারা ২:৪৭ ও ২:1২২) বলা হয়েছিল, এত উচ্চ স্থান থেকে কীভাবে তাদের পতন শুরু হয়? ইসলাম ও ইহুদী ধর্ম উভয় অনুযায়ীই বা কী করেছিল তারা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *