অধ্যায়-২১ দিগ্বিজয়ী সুলাইমানের (আ) প্রতাপ

অধ্যায়-২১ দিগ্বিজয়ী সুলাইমানের (আ) প্রতাপ

সুলাইমান (আ) এর আরেক নাম ছিল হিব্রুতে ইয়েদিদিয়াহ (রাঃ)। তবে মূল নাম দাউদ (আ) রেখেছিলেন শ্লোমোহ (now), যা ইংরেজিতে সলোমন আর আরবিতে সুলাইমান (Lail)। ইসরাইলের সবচেয়ে বিখ্যাত বাদশাহদের একজন তিনি, যার মৃত্যুর পর পতন হয় ইসরাইলের। সুলাইমান (আ) এর জন্ম জেরুজালেমে, তার রাজত্বকাল ছিল আনুমানিক ৯৭০ থেকে ৯৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। ইহুদী ধর্মীয় ব্যাখ্যাগ্রন্থ তালমুদে যে মাত্র ৪৮ জন নবীর কথা উল্লেখ আছে, তার মাঝে নবী সুলাইমান (আ) একজন। তাঁকে বলা হয় বাইতুল মুকাদ্দাসের প্রথম পূর্ণ রূপকার, বা ফার্স্ট টেম্পলের নির্মাণকারী। ইসরাইলের মাবুদ ইয়াহওয়েহ এর প্রতি তিনি এ বাইতুল মুকাদ্দাস উৎসর্গ করেন বলে উল্লেখ আছে তাওরাতে।

কুরআন ও বাইবেলের বাইরেও প্রথম শতকের ‘টেস্টামেন্ট অফ সলোমন’ তাঁকে নিয়ে অনেক কথাই বলে। তবে ধর্মীয় গ্রন্থের বাইরে তাঁকে চিহ্নিত করা হয় একজন জাদুকর হিসেবে, কখনও জ্বিনতাড়ক হিসেবে, যার নামে অসংখ্য তাবিজ ও জাদুমন্ত্র আছে।

বাৎসেবার গর্ভে সুলাইমান ছাড়াও অন্তত আরও তিন পুত্রের জন্ম হয়। আবসালমের যে বিদ্রোহের কথা একটু আগে বলা হয়েছে, এর আগপর্যন্ত অবশ্য দাউদ (আ) ও সুলাইমান (আ) এর মাঝে তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না বলে বলা হয়। কথিত আছে, সুলাইমান (আ) এর বয়স যখন মাত্র ১৫ বছর, তখন তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি রাজত্ব শুরু করেন দাউদ (আ) এর শেখানো কথা অনুযায়ী। বাইবেল বলছে, তিনি রাজ্যের বিভিন্ন পদে জায়গায় জায়গায় তাঁর পরিচিত মানুষ নিয়োগ দিয়ে নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করেন। তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেন তাঁর সেনাবাহিনীর শক্তি বাড়ানোতে। তিনি অনেকগুলো উপনিবেশ স্থাপন করেন যেগুলো ব্যবসার জন্যও ভালো ছিল।

ব্যবসার খাতিরে তিনি দূরদেশ টায়ারের রাজা প্রথম হিরামের সাথেও সম্পর্ক স্থাপন করেন। তারা একত্রে তারশিশ ও অফিরের মতো অনেক নতুন স্থানে ব্যবসা বিস্তার করেন, বিক্রি করতে শুরু করেন আরামদায়ক পণ্য। তিনি সোনা, রূপা, সুগন্ধি, মুক্তা, হাতির দাঁত, শিম্পাঞ্জি আর ময়ূর আমদানি করতেন। সুলাইমান (আ) কুরআন ও বাইবেলে বর্ণিত সবচেয়ে ধনী রাজা।

তবে রাজত্ব চালাবার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে সুলাইমান (আ) এর অতিপ্রাকৃত কর্মকাণ্ডই ধর্মীয় লেখনিতে বেশি আলোচিত। ইসলাম অনুযায়ী, তাঁকে অনেকগুলো অলৌকিক নিদর্শন দেয়া হয়। যেমন- কুরআন বলছে, “সুলাইমান দাউদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। বলেছিলেন, হে লোকসকল, আমাকে উড়ন্ত পক্ষীকূলের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয়েছে এবং আমাকে সব কিছু দেয়া হয়েছে। নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব। সুলাইমানের সামনে তার সেনাবাহিনীকে সমবেত করা হলো। জ্বিন-মানুষ ও পক্ষীকুলকে, অতঃপর তাদেরকে বিভিন্ন সারিতে বিভক্ত করা হলো।” (সুরা নামাল ২৭:১৬-১৭)

আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে বর্ণিত আছে, একদিন সুলাইমান (আ) কোথাও যাচ্ছিলেন, পথে দেখেন একটি পুরুষ চড়ুই পাখি একটি স্ত্রী চড়ুই পাখির পাশে ঘোরাফেরা করছে। সুলাইমান (আ) তার সাথীদেরকে বললেন, “তোমরা কি বুঝতে পেরেছো, চড়ুই পাখিটি কী বলছে?”

তারা বললো, “কী বলছে?”

সুলাইমান (আ) বললেন, “সে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, বলছে, তুমি আমাকে বিয়ে করো, তাহলে তোমাকে নিয়ে আমি দামেস্কের প্রাসাদের যে কক্ষে চাও, সেখানেই বসবাস করব।’

সুলাইমান (আ) পিঁপড়ার ভাষাও বুঝতেন বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, “যখন তারা পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছাল, তখন এক পিপীলিকা বলল, হে পিপীলিকার দল, তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলাইমান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে। তার কথা শুনে সুলাইমান মুচকি হাসলেন এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা, তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও যাতে আমি তোমার সেই নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পছন্দনীয় সৎকর্ম করতে পারি এবং আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মপরায়ন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর।” (কুরআন, সুরা নামাল, ২7:১৭-১৯)

সুলাইমান (আ) মিসরের ফারাওয়ের সাথে আত্মীয়তা স্থাপন করলেন তার মেয়েকে বিয়ে করে। জেরুজালেমের চারদিকে তখন তিনি প্রাচীর তোলা শুরু করলেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত, চলতেন পিতা দাউদ (আ) এর শেখানো পথে। একদিন তিনি গিবিয়োনে যান, সেখানে গিয়ে কোরবানি করেন। সেদিন রাত্রে আল্লাহ তাঁর সাথে স্বপ্নে কথা বললেন, জিজ্ঞেস করলেন, “বলো, আমি তোমাকে কী দেব?”

সুলাইমান (আ) উত্তর দিলেন, “হে মাবুদ, আমার আল্লাহ, তুমি আমার পিতা দাউদের পদে তোমার এই গোলামকে বাদশাহ করলে; কিন্তু আমি ক্ষুদ্র বালকমাত্র, বাইরে যেতে ও ভিতরে আসতে জানি না। আর তোমার গোলাম তোমার মনোনীত লোকদের মধ্যে রয়েছে, তারা একটি মহাজাতি (ইসরাইল), আর তারা সংখ্যায় এত বেশি যে, তাদের গণনা করা যায় না। অতএব তোমার লোকদের বিচার করতে ও কোনটি সঠিক বা কোনটি ভুল তা জানতে তোমার এই গোলামকে বুঝবার জ্ঞান দাও; কারণ তোমার এমন মহা লোকবৃন্দের বিচার করা কার সাধ্য?”

আল্লাহ তার এ চাওয়াটি পছন্দ করলেন, “আমি তোমার অন্তরে এমন জ্ঞান ও বিচারবুদ্ধি দিলাম যে, তোমার আগে তোমার মতো কেউ হয়নি এবং পরেও তোমার মতো কেউ জন্মলাভ করবে না। আবার তুমি যা চাওনি তা-ও তোমাকে দিলাম, এমন ঐশ্বর্য ও গৌরব দিলাম যে, তোমার জীবনকালে বাদশাহদের মধ্যে কেউ তোমার মতো হবে না। আর তোমার পিতা দাউদ যেমন চলতো, তেমনি তুমি যদি আমার সমস্ত হুকুম ও আমার সমস্ত বিধি পালন করে আমার পথে চল, তবে আমি তোমার আয়ু দীর্ঘ করবো।” (১ বাদশাহনামা ৩)

সুলাইমান (আ) এর সময় ইসরাইল প্রচণ্ড রকমের ধনী রাজ্যে পরিণত হয়। কোনো এক বছরে তার খাজনাই এসেছিলো ১৮১২৫ কেজি স্বর্ণ। (১ বাদশাহনামা ১০:১৪)। তিনি জেরুজালেমে অনেকগুলো দালান নির্মাণ করেছিলেন। মধ্য জেরুজালেমের ওফেল এলাকায় তিনি ১৩ বছর ধরে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করান। সুলাইমান (আ) এর সিংহাসন ছিল সত্যিই দেখার মতো। বাইবেলের বর্ণনানুযায়ী, “বাদশাহ হাতির দাঁতের একটি বড় সিংহাসন নির্মাণ করে খাঁটি সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দিলেন। ঐ সিংহাসনের ছয়টি সিঁড়ি ছিল ও সিংহাসনের উপরিভাগ পেছনের দিকে গোলাকার ছিল এবং আসনের উভয় পাশে হাতা ছিল। সেই হাতার কাছে দুই সিংহমূর্তি দণ্ডায়মান ছিল। আর সেই ছয়টি সিঁড়ির উপরে দুই পাশে বারোটি সিংহমূর্তি দণ্ডায়মান ছিল; এরকম সিংহাসন আর কোনো রাজ্যে নির্মিত হয়নি। বাদশাহ সুলাইমানের সমস্ত পানপাত্র সোনার ছিল। লেবানন অরণ্যস্থ বাড়ির যাবতীয় পাত্র খাঁটি সোনার ছিল; রূপার কিছুই ছিল না; সুলাইমানের অধিকারে তা কিছুরই মধ্যে গণ্য ছিল না।”

ইহুদী লোককথা অনুযায়ী, এই সিংহাসন পরবর্তীতে সরিয়ে নেয়া হয় ব্যবিলনে। এবং তাতে বসেন পারস্যের রাজা আহাসুয়েরাস (in1০০8) । সুলাইমানের সিংহাসনকে বলা হয় পৃথিবীর আদিমতম যান্ত্রিক যানের একটি। আহাসুয়েরাসের প্রাসাদে এটি কাজ করা থামিয়ে দেয়। সিংহাসনের ওপরে অনেক কিছুই আঁকা ছিল। যেমন- একটি ছবিতে দেখা যায় ৭০টি চেয়ারে ৭০ জন কাজী বসা। তারা ইহুদী কোর্ট সানহেড্রিনের ( Sanhedrin) কাজী। জেরুজালেমের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অবশ্য সুলাইমান (আ) এর প্রাসাদ বা তার বানানো বাইতুল মুকাদ্দাসের কোনো অবশেষ পাওয়া যায়নি। তিনি অনেকগুলো শহর নতুন করে গড়ে তোলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *