অধ্যায়-৩৭ মরুর বুকে ধূসর শৈশব

অধ্যায়-৩৭ মরুর বুকে ধূসর শৈশব

চারিদিকে লোক পাঠানো হয়েছে শিশুটিকে খুঁজে বের করার জন্য। মক্কার সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের একটি শিশু যে হারিয়ে গেছে মক্কায় ঢুকবার সময়! দাদা আব্দুল মুত্তালিব লোকবল পাঠাবার বেশ কিছুক্ষণ পর দুজন লোক ফিরে এলো, তাদের সাথে শিশুটি। নাম তাঁর মুহাম্মাদ (সা)। যে দুজন তাঁকে খুঁজে পেলেন, তাঁদের একজনের নাম ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল। তিনি জানালেন,

শিশুটি মক্কার উঁচু অঞ্চলে ঘোরাফেরা করছিল। কিন্তু উপস্থিত মানুষগুলোর কেউই একটি ব্যাপার জানতেন না।

জানতেন না যে, এই শিশুটি বড় হয়ে এই ওয়ারাকারই শ্যালক হবেন! জানতেন না যে, এই শিশুটি পরবর্তীতে নবী হয়ে সবার আগে ওয়ারাকার কাছেই আসবেন, আর একসময় শত শত কোটি মানুষের কাছে আদর্শ হবেন! ইসলাম ধর্মের শেষ নবী মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর এই শিশু থেকে বড় হয়ে ওঠার কাহিনীগুলোই আজকের অধ্যায়ে উঠে আসবে। হয়তো এর বেশ কয়েকটি ঘটনা আপনি আগে শোনেননি!

তবে এখানে একটি বড় ‘কিন্তু’ আছে। সে সময়ের আরবের যেকোনো ঘটনা আত্মস্থ করার জন্য আগে জানতে হবে সে সময় আরব আসলে কেমন ছিল ‘কেমন ছিল’ বলতে আপনি যদি ছোটবেলার ইসলাম শিক্ষা বই পড়ে, পরীক্ষার খাতায় লিখে নম্বর পাবার জন্য মুখস্থ করা কিছু অনুচ্ছেদের কথা মনে করেন, তবে ভুল ভাবছেন। ধর্ম বইতে পড়া সবকিছুই যে সঠিক ছিল না, সেটা আমরা লেখা মাধ্যমেই জানবো। তাই মূল কাহিনীতে যাওয়ার আগে অনুরোধ থাকবে, তৎকালীন আরবের পরিস্থিতিটা ভালো করে বুঝবার।

মহানবী (সা) জন্মের প্রসিদ্ধ সাল হলো ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ। তাই আমাদের অনুসন্ধিৎসার শুরুটা সেখান থেকেই। ঐ সময়টা এখন ইসলামের পরিভাষায় ‘জাহিলিয়া’ বা ‘অজ্ঞানতা’র সময় নামে পরিচিত। কারণ, তখন ইসলামের আলো এসে তাদের পাপাচার থেকে মুক্তির জ্ঞান দেয়নি। আজকের যে আরব আমরা দেখি, সেটি ধনদৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা এক আরব। তবে পেট্রো ডলারের আগে আদৌ এমন অবস্থা ছিল না! তাহলে কেমন ছিল?

৫৭০ সালের কাছাকাছি সময়ে দুই পরাক্রমশালী রাজ্য পারস্য আর বাইজান্টিয়ামের মাঝের আরব কিংবা মক্কা, ইয়াসরিব (মদিনা) নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না। তাদের কাছে এই অঞ্চল বর্বর বেদুইনের দেশ কিংবা বাণিজ্যের কাফেলার রুট নামেই পরিচিত ছিল। তবে হ্যাঁ, আরবের দখল পেলে মন্দ নয়! একটু মনোযোগ দিয়ে নিচের মানচিত্রটি খেয়াল করুন-

তবে দক্ষিণ আরব, বর্তমান ইয়েমেন নিয়ে দুই পক্ষেরই বেশ আগ্রহ ছিল। কারণ, জায়গাটিতে বর্ষায় বৃষ্টি হয় ভালো, উর্বর জমিও রয়েছে। কিন্তু এর উত্তরে? উত্তরের আরব তাদের কাছে সেই বেদুইনদেরই, যারা কি না তাঁবুবাসী এবং গ্রিক ভাষায় যাদেরকে বলা হতো ‘Sarakenoi’। এই শব্দ থেকেই ‘Saracen’ (সারাসিন) শব্দটি এসেছে মুসলিমদের বোঝানোর জন্য। ক্রুসেডের ইতিহাস যারা জানেন, তারা নিশ্চয়ই ক্রুসেডার বনাম সারাসিনদের যুদ্ধের কথা জেনে থাকবেন। পারস্য কিংবা রোমান, কেউই ধারণাও করতে পারেনি যে, এই মরু থেকেই এক জাতি বেরিয়ে আসবে, যারা কি না এই দুই পরাক্রমশালী রাজ্যকেই পরাভূত করবে!

আরব অঞ্চলকে তারা বিবেচনা করতো নিরীশ্বর এক এলাকা হিসেবে। কারণ, এই অঞ্চলে খ্রিস্ট ধর্ম, পারস্যের অগ্নিপূজক ধর্ম বা ইহুদীদের ধর্মের মতো বিশাল কোনো ধর্মের স্থান নেই। এই ধারণা আরবীয়দের মাঝেও ছিল। তারা কোনো নবীর আগমন পায়নি। অন্য বড় ধর্মগুলোর মতো সেটা তাদের জন্য কিছুটা হীনম্মন্যতার ছিল বটে; ঈসা (আ) বা যীশু, মূসা (আ) আর জরথুস্তুর কথা কেবল তারা বাণিজ্যের সময় শুনেই এসেছে। তবে কিছু কিছু আরব ইহুদী বংশ ইয়াসরিবে (মদিনা) বাস করতো, তারা মাঝে মাঝে মক্কাতেও আসতো। খায়বার আর ফাদাকেও তাদের বাস ছিল। এই হীনমন্যতা থেকেই হোক আর অন্য কিছু থেকেই হোক, খ্রিস্টান আর ইহুদীদের প্রতি বেদুইনদের একটা অনাস্থা ছিল।

বলা হচ্ছিল যে, আরবের কিছু অংশের দখল পেলে মন্দ হতো না দুই পরাশক্তির জন্য, এবং সেটি পেয়েও যায় বাইজান্টিনরা। আজকের যে ইথিওপিয়া (আরবের দক্ষিণে), সেটি তখন আবিসিনিয়া নামে পরিচিত ছিল। সেই রাজ্যটি খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে পড়ে। তবে মূল রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম নয়। যেটি তারা পালন করতো, সেটিকে রোমান চার্চ ‘বিচ্যুতি’ (Heretic) হিসেবে দেখতো। এ মতবাদের নাম ছিল Monophysitism। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে শুধু এটুকু বলতে হয়, এত দূরে দক্ষিণে না হয়ে যদি রোমান সাম্রাজ্যের ভেতরে এরা থাকতো, তবে তাদের এ মতবাদ টিকতে দেওয়া হতো না। কিন্তু যখন দেখা গেল, এরা খ্রিস্টান হওয়ায় বাইজান্টিনদের একটি ‘আউটপোস্ট’ এত দূরে পাওয়া যাচ্ছে, তখন তারা বরং খুশিই হয়। আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসকের উপাধি হয় ‘নাজ্জাশী (Negus)। তারা তাকে ইয়েমেন দখল করার পরামর্শও দেয়।

ওদিকে পারস্যের মাথায় হাত। তারা খেয়াল করলো যে, অগ্নিপূজা আরবকে টানবে না। তাই তারা ইহুদী ধর্মে সায় দিতে শুরু করলো। এরপর কী হয়েছিল সেটি প্রথম পর্বেই বলা হয়েছে, যার শেষ হয় হাতির ঘটনা দিয়ে।

আরবের যে প্রান্তে রোমান সাম্রাজ্য রয়েছে, সেখানকার গাসান গোত্র অবশেষে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং পারস্য ও রোমান সাম্রাজ্যের মাঝে একটি ‘বাফার স্টেট’ বা বিভেদী/দেয়াল রাজ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এটি রোমানদের জন্য একটি নিরাপত্তা ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের সময়ও ঘটনা এমনই ছিল। বাইজান্টিন সম্রাট তখন ছিলেন হেরাক্লিয়াস। যা-ই হোক, এখানে আরো অনেক কিছুই ঘটেছিল, যেসবের বর্ণনায় এ বইতে আমরা যাচ্ছি না।

আনুমানিক প্রায় দুই হাজার বছর ধরে বেদুইনদের আরব রীতি গড়ে ওঠে। বেশিরভাগই যাযাবর হলেও, কেউ কেউ আবার আবাসযোগ্য জমি পেয়ে শহর গড়ে তোলে। বেদুইনরাই নিজেদের সংস্কৃতিকে হীন বা নিচু মনে করতে শুরু করে। তবে সেটাই যে তৎকালীন মূল বা বিশুদ্ধ আরব সংস্কৃতি, সেটা কেউ অস্বীকার করতো না। যাযাবর কিংবা শহরবাসী সকল আরবই নিজেদের মরুপুত্র মনে করতো!

পুরো আরব জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই যাযাবরেরা নিজেদের মাঝে দল করে নিত। দলের আকার বেশি বড়ও হবে না, ছোটও হবে না। মরুভূমিতে খাবারের বেশ অভাব আছে, এ কারণে এক দল আরেক দলের সাথে সর্বদা মেতে থাকত কাড়াকাড়িতে। এরকম একেকটি দলকে বংশ (Tribe) বলা হতো। কোনো একজন পূর্বপুরুষের নাম দিয়ে তাদের বংশের নাম হতো। আর উপদলগুলো হতো একেকটি গোত্র (Clan)। একক পরিচয় বলে কোনো কিছুর স্থান ছিল না বেদুইনদের মাঝে। তবে বংশ-গোত্র নির্বিশেষে বলতে চাইলে ব্যবহার করা হতো ‘কওম’ শব্দটি।

আরব বেদুইনদের নির্দয় জীবনে ‘ধর্ম’ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল না। তারা ঈশ্বরে বিশ্বাস ঠিকই করতো। কিন্তু ঈশ্বরকে তুষ্ট রাখতে হবে, এরকম নীতি নিয়ে সময় ব্যয় করা তাদের পোষাত না। শিকার ধরে এনে পেটপূজোতেই দিন পার। আর অন্য গোত্রের সাথে যুদ্ধ তো লেগেই থাকতো। তাহলে কি তাদের কোনো আদর্শ ছিল না, যেটা সবাই মেনে চলত? ছিল। এটাকে ‘মুরুওয়াহ’ বলা হতো, যার মানে ‘বীরত্ব’। একেক বেদুইন বংশের মুরুওয়াহ ছিল একেক রকম। কারো অনেক উন্নত, কারও বা এতটা না। মুরুওয়ার প্রথম কথাই হলো, নেতার কথা মেনে চলতে হবে বিনা প্রশ্নে। পরকাল বলে কোনো কিছুতে বিশ্বাস আরবদের ছিল না। এটি একটি অদ্ভুত ভাবনা ছিল তাদের কাছে। কেউ যদি কোনো দেবতার পূজো করতও, তবে সেটা হতো ইহকালের কোনো সাফল্যের জন্য।

হত্যাকাণ্ড ঠেকাবার জন্য যে প্রথা ছিল সেটা হলো, কেউ কাউকে হত্যা করে ফেললে, দোষ কেবল সেই খুনীর একার নয়, বরং খুনীর পুরো বংশের। যে-ই একটি হত্যাকাণ্ড ঘটলো, তখনই নিহতের বংশের মানুষেরা বেরিয়ে পড়বে প্রতিশোধ নিতে, খুনীর বংশের একজন মারা না যাওয়া পর্যন্ত প্রতিশোধ নেওয়া হবে না। অন্য বংশের কাউকে মারা কোনো অপরাধ ছিল না, নিজের কাউকে না মারলেই হলো কিংবা মিত্র বংশের কাউকে। আর কেউ যদি নিজের পরিচয় গোপন করে মেরে হারিয়ে যেতে পারে, তবে তো প্রতিশোধ নেবার প্রশ্নই আসে না। পুরো বংশের উপর আঘাত এড়ানোর জন্যই এ নিয়ম ছিল। তবে তাতে খুন- খারাবি কমেনি একদমই।

একটি বেদুইন বংশের সম্পূর্ণ অধিকার ছিল অন্য বেদুইন বংশের কাফেলা থেকে মালামাল বা খাদ্য ছিনিয়ে নেবার। এটি অনেকটা জাতীয় খেলার মতোই ছিল। যে বংশ যত ছিনিয়ে আনতে পারে, সে বংশ তত ধনী। তবে কোনো বংশের প্রয়োজন মিটে গেলে আর ছিনিয়ে আনতো না। ফলে যেটা হতো, কোনো বংশ বেশি রাখতে পারতো না। তবে এই কাজ করতে গিয়ে কোনো হত্যাকাণ্ড নিষিদ্ধ ছিল।

বেদুইনরা খুবই অতিথি পরায়ণ ছিল। কারণ, অন্য বংশের কাউকে আজ অনেক অতিথিপরায়ণতা দেখালে, বিপদের দিনে সেই বংশই এগিয়ে আসবে। এটি ছাড়া অন্য কোনো কারণ ছিল না। দেখা যেতো, মেয়ে শিশুদের বেঁচে থাকার হার ছেলেদের থেকে বেশি। একটি বেদুইন বংশে নির্দিষ্ট অনুপাতের বেশি যেন মেয়ে না থাকে, সেজন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের পর হত্যা করা হতো মেয়ে শিশুদের। যে যত বেশি বিয়ে করতে পারবে, সে হতো তত ধনী। কারণ, উত্তরাধিকার হিসাব করা হতো মেয়েদের দিক থেকে। তাই একজনের যত স্ত্রী, তত বেশি উত্তরাধিকার সে নিজের বাগে আনতে পারবে। উত্তরাধিকার পায় বলেই যে তাদের অধিকার থাকবে, এমনটা তখন ছিল না মেয়েদের ক্ষেত্রে। তবে এসব করতে গিয়ে তাদের মনে কোনো অনুতাপ ছিল না। কারণ, এমনই ছিল প্রথা। আর এটাই জীবন। ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সোনালি বালুর বুকে ঘোড়া ছুটিয়ে যাওয়া, হয়তো বা রাতের কনকনে শীতের মাঝেও, আর ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দেওয়া নিজের তাঁবুতে। ঠিক এরকম একটি জীবনই রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন-

“ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন!
চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।”

এসব বেদুইন বংশের মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ছিল মক্কা, তাইফ, ইয়াসরিব (মদিনা)। মক্কা আর তাইফ মোটামুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। দুই জায়গাতেই ভালো মন্দির ছিল। লাত দেবীর শহর ছিল তাইফ, সেখানে তার মন্দির। মক্কা ছিল আরো উপরে, সেখানে আরবের সবচেয়ে পবিত্র ঘনকাকৃতির ‘কাবা’, যেখানে ৩৬০টি মূর্তি সাজানো, প্রধান দেবতা সেখানে হুবাল। সকল আরবই জানতো যে, একদা এখানে ইসমাইল (আ) বাস করতেন, জমজম কূপের কাহিনীও তাদের জানা। কিন্তু হাজার হাজার বছরের বিবর্তনে আদি বিশ্বাস পরিবর্তিত হয়ে পৌত্তলিকতা চলে এসেছে, হারিয়েছে পরকালে বিশ্বাস। একক ঈশ্বর বলে কিছুতে তাদের বিশ্বাস নেই। তবে কা’বার মালিক যে আল্লাহ, তিনি যে সর্বোচ্চ ঈশ্বর এ বিশ্বাস সকলেরই ছিল। কিন্তু এত উঁচু ঈশ্বরকে সাধারণ মানুষ প্রার্থনা করে নাগালে পাবে না বিধায় তাদের মতে দরকার মর্ত্যের দেবতাদের। লাত, উজ্জাহ, মানাত, হুবাল – এদের আবির্ভাব আর তাতে বিশ্বাস এলো এভাবেই।

এরকমই এক সময় মক্কার কুরাইশ বংশের হাশিম গোত্রে জন্ম নিলেন মুহাম্মাদ (সা), যার আরেক নাম রাখা হয় আহমাদ। আমরা আগের অধ্যায়ে শেষ করেছিলাম, যখন তাঁকে হালিমা নিয়ে যাচ্ছিলেন তাদের বেদুইন বংশে।

কেন মক্কার পরিবারগুলো তাদের নবজাতককে পাঠাতো বেদুইনদের কাছে? কারণ, তারা বিশ্বাস করতো, বেদুইন সংস্কৃতি হলো বিশুদ্ধ আরব, তাদের ভাষা বিশুদ্ধ আরবি, তাদের কাছে প্রথম কয়েক বছর কাটালে প্রকৃত মরুসন্তান হয়ে ফিরতে পারবে সন্তানেরা।

ইবনে কাসির (র) রচিত সীরাত গ্রন্থ গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি, নবী মুহাম্মাদ (সা) এর জন্মের পর যাদের দুধ পান করেছিলেন তারা হলেন তাঁর বাবার রেখে যাওয়া দাসী উম্মে আয়মান বারাকা, তাঁর নিজের মা আমিনা, চাচা আৰু লাহাবের মুক্ত করে দেয়া প্রাক্তন দাসী সুওয়াইবা এবং ধাত্রী মা হালিমা। বড় হবার পর মুহাম্মাদ (সা) আয়মান বারাকাকে মুক্ত করে দেন এবং নিজের মুক্ত করা দাস তথা পালক পুত্র জায়দ (রা) এর সাথে তাঁকে বিয়ে দেন।

হালিমা সাদিয়া (সা’দিয়া, কারণ তাদের বেদুইন বংশ সা’দ বংশ) যখন তাঁর স্বামীকে নিয়ে এতিম শিশু মুহাম্মাদ (সা)-কে নিয়ে নিজের মরু এলাকায় ফিরছিলেন তখন তাঁর শীর্ণ গাধার গতিবেগ যেন বেড়ে গেলো অনেকগুণ। এমনকি অন্য শিশু নিয়ে ফেরত বেদুইনরাও অবাক হয়ে বলল, “আবু যুওয়ায়বের কন্যা! একটু থামো অন্তত আমাদের জন্য। এটি কি সেই গাধা যার পিঠে চড়ে তোমরা এসেছিলে?” হালিমা উত্তর দিলেন, “অবশ্যই সেটাই!” তারা বলল, “আল্লাহর কসম, কিছু একটা অস্বাভাবিক ঠেকছে!”

মরুভূমিতে ফেরার পরপরই বদলে গেল হালিমাদের জীবন। যেখানে একসময় ভেড়াগুলোর দুধই হতো না বলতে গেলে, সেগুলো এখন প্রচুর দুধ দেয়। হালিমার ভেড়াগুলোর চড়ানোর জায়গায় অনেক ঘাস উঠল। কিন্তু অন্যদের জায়গায় কোনো ঘাস ছিল না, কারণ তখন চলছিল ভয়াবহ খরা। এমনকি প্রতিবেশীরা পর্যন্ত তাদের রাখালদের এই বলে নির্দেশ দিতে লাগল যে, তারা যেন হালিমার জায়গায় গিয়ে ভেড়া চড়ায়।

দুটি বছর বেড়ে উঠলেন শিশু মুহাম্মাদ (সা) মা হালিমার কাছে। তাঁর দুই দুধ ভাই-বোন তাঁকে জানতো তাদের কুরাইশি ভাই হিসেবে। দুধভাই আব্দুল্লাহ ইবনে আল হারিসও তখন দুধের শিশু। আর বোন ছিল উনাইসা এবং খিজামা (কিংবা হুজাফা)। খিজামার আরেক নাম ছিল শায়মা, বয়স ছিল পাঁচ বছর। খুবই শান্ত শিশু হয়ে বড় হতে লাগলেন শিশু মুহাম্মাদ (সা)। তাঁকে সবচেয়ে বেশি কোলে- পিঠে করে যিনি মানুষ করেছেন তিনি হলেন শায়মা। শায়মা তাঁকে খাওয়াতেন, গোসল করাতেন, কোলে নিয়ে ঘুরতেন। মক্কা থেকে তায়েফ যাবার পথে জায়গাটা পড়ে।

বয়স যখন তাঁর ২ বছর, তখন হালিমা তাঁকে নিয়ে চললেন মক্কায় আসল মা আমিনার কাছে। কারণ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন ফেরত দিতে হবে শিশুকে। বেদুইনদের সাথে চুক্তি এটাই যে, শিশু লালনপালনের বিনিময়ে তারা অর্থ পেত। এজন্যই ধনী ঘরের শিশু তাদের লক্ষ্য থাকতো।

কিন্তু হালিমার মন একদম মানতে চাচ্ছিল না। কী অজুহাতে তাঁকে আরও রাখা যায় সেটাই ভাবতে লাগলেন হালিমা, শায়মা তো তাঁকে ছাড়তেই চাচ্ছিল না। মক্কায় তখন কোনো এক মহামারী চলছিল। সেই রোগের দোহাই দিয়ে শিশু মুহাম্মাদকে আরও কমাসের জন্য নিয়ে আসলেন। মহামারী শেষ হলে পরে ফিরিয়ে আনবেন। আমিনা রাজি হলেন।

এরকম একদিন মুহাম্মাদ (সা) এর দুধভাই দৌড়ে এলো হালিমার কাছে। এসেই অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, “আমার কুরাইশি ভাইয়ের কাছে দুজন সাদা পোশাকের মানুষ এসেছিল। ওরা তাঁকে শুইয়ে দিয়ে তলপেট চিড়ে ফেলেছে! মুহাম্মাদ (সা) মারা গেছে!”

তখন হালিমা আর হারিস দুজনেই দৌড়ে গেলেন ঘটনাস্থলে, যেখানে মেষ চরানো হতো। গিয়ে দেখেন, ফ্যাকাশে চেহারার মুহাম্মাদ (সা) দাঁড়িয়ে আছেন। হারিস জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে, বাছা?” তিনি উত্তর দিলেন, “দুজন লোক এসে আমার বুক চিড়ে ফেলল আর এরপর কী যেন খুঁজল ভেতরে আমি জানি না।” তারা তাঁকে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন।

হারিস খারাপ কিছুর আশঙ্কা করায় এ ঘটনার পর দুজনেই শিশু মুহাম্মদকে (সা) নিয়ে মক্কায় ফেরত গেলেন। ইবনে কাসিরে বর্ণিত, পথে আবিসিনিয়া থেকে আসা একদল খ্রিস্টান তাকে দেখে ছুটে এসে বলল, “এ শিশু কে?”

“কুরাইশি একটা ছেলে মাত্র,” তারা উত্তর দিলেন।

“আমরা একে নিয়ে যেতে চাই। ও বড় হয়ে নিশ্চয়ই বড় কিছু হবে। আমরা বুঝতে পারছি।” পূর্ববর্তী আসমানি কিতাবগুলোতে পাওয়া বিবরণের সাথে মিলে যাওয়ায় তারা আন্দাজ করছিল

হালিমা অবাক হলেন। বেশ কায়দা করেই তাদের পেছনে ফেললেন তারা।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে এর চেয়ে বড় ঘটনা ঘটে গেল। মক্কায় ঢুকার সময় তিনি বাচ্চা মুহাম্মাদ (সা)-কে হারিয়ে ফেললেন। ভিড়ের মাঝেই হারিয়ে গেল। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পেলেন না। তিনি ছুটে গেলেন দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কাছে, ঘটনাটা জানালেন। আব্দুল মুত্তালিব কেবল বললেন, “আরে, ভেবো না, আল্লাহ ওকে ফিরিয়ে দেবেন।” তিনি লোক পাঠালেন।

একসময় দেখা গেল ওয়ারাকা ইবনে নাওফেল শিশু মুহাম্মাদ (সা) কে নিয়ে আসছেন। এসে বললেন, “টিলার উপর ওকে খুঁজে পেলাম।”

তাঁকে পেয়ে আমিনার কাছে নিয়ে গেলেন হালিমারা। আমিনা অবাক হয়ে বললেন, “এত আগ্রহ করে নিয়ে গেলে, এখন এত তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছ যে?”

হালিমা একটু এড়াতে চাইলেন ব্যাপারটা, “আল্লাহ আপনার ছেলেকে বড় করেছেন এবং আমাদের দায়িত্বটুকু আমরা পালন করেছি, আমি তাঁর ব্যাপারে দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছি। তাই আপনার ছেলেকে ভালোয় ভালোয় আপনার হাতে তুলে দিলাম।” কিন্তু আমিনা বুঝলেন, কাহিনী অন্য জায়গায়। বেশি চাপাচাপি করতেই শেষ পর্যন্ত কাহিনী বলতে বাধ্য হলেন দুজন।

আমিনা বললেন, “তোমরা ভাবছো আমার ছেলেকে জ্বিনে ধরেছে?”

তারা বলল, “হ্যাঁ।”

আমিনা হেসে বললেন, “আমার ছেলেকে তোমরা চিনতে পারনি!” জন্মের সময় কী দেখেছিলেন সেই ঘটনা বললেন তাঁকে। এরপর তিনি হালিমাকে আবার দিয়ে দিলেন মুহাম্মাদ (সা) কে রাখতে। [ইবনে হিশাম]

বয়স যখন ৬ বছর, তখন সত্যি সত্যি হালিমা আমিনার কাছে ফিরিয়ে দিলেন প্রিয় মুহাম্মাদ (সা)-কে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বনু সাদ বেদুইন বংশ হাওয়াজিন বংশ সমষ্টির সদস্য ছিল। মক্কা বিজয়ের আগপর্যন্ত ইসলাম নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথাই ছিল না। এই হাওয়াজিন বেদুইনরা মক্কা বিজয়ের ঘটনার পর মক্কার কাছে জড়ো হয় মক্কা আক্রমণ করবার জন্য। তখন মুহাম্মাদ (সা) এর মুসলিম বাহিনী তাদের পরাস্ত করে হুনায়নের যুদ্ধে। যুদ্ধে পরাজিত হয় হাওয়াজিনরা। ধরা পড়ে ছয় হাজার যুদ্ধবন্দী এবং বিপুল পরিমাণ গবাদিপশু হাতে আসে মুসলিমদের।

হাওয়াজিনদের যে অংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদের থেকে একটি দল মুহাম্মাদ (স) এর কাছে এলেন এবং হাওয়াজিনদের ছেড়ে দিতে অনুরোধ করলেন। বললেন, এ বন্দীদের মাঝেই তাঁর শিশুকালে পালন করা ধাত্রীরা আছেন, খালারা আছেন। তারা তো পরিবারের মতোই।

বন্দীদের মধ্য থেকে এক ষাটোর্ধ্ব বয়স্কা নারী এগিয়ে এলেন। এসে বললেন, “চিনতে পারছেন আমাকে? আমি শায়মা। আপনারই দুধ বোন!” মহানবী (সা) দাঁড়িয়ে গিয়ে তাঁর শাল বিছিয়ে দিলেন, পাশে বসতে বললেন।

শায়মা তখন নবীজী (সা) কে যা বললেন সেটা এরকম, “আপনি যখন ছোট ছিলেন, তখন আমার কাঁধের এখানে কামড় দিয়েছিলেন, মনে পড়ে? কামড়ের দাগটা কিন্তু এখনো আমার কাঁধে রয়ে গেছে।” এই বলে তিনি তাঁর কাঁধের দাগটা দেখালেন। দাগটা চিনবার সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সা) এর চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো দিনগুলোর কথা মনে করে।

শায়মা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। নবীজী (স) তাঁকে অনেক উপহার দিয়ে নিজ বংশে পাঠিয়ে দেন। ৬,০০০ যুদ্ধবন্দীর প্রত্যেককে তিনি মুক্ত করে দেন, সবাইকে শাল উপহার দেন। সেদিন ৫ লাখ দিরহামের মতো উপহার দেয়া হয়েছিল বলে ইবনে কাসিরে উল্লেখ আছে।

কথিত আছে, হালিমাও ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি খাদিজা (রা) জীবিত থাকাকালীন একবার বেড়াতে এসেছিলেন মক্কায়, তখন খাদিজা তাঁকে ৪০টি মেষ উপহার দেন। শেষ জীবনে তিনি মদিনায় গিয়েছিলেন। তাঁর কবর হয়েছিল জান্নাতুল বাকিতে। নিচের ছবিটি তাঁরই কবর বলে ধারণা করা হয়।

তবে একটু আগে বলা হচ্ছিল, সাধারণত ধর্ম নিয়ে জাতিগতভাবেই বেদুইনদের মাথাব্যথা নেই তেমন। মুহাম্মাদ (সা) মারা যাবার পর বেদুইনদের অনেক বংশ ইসলাম ত্যাগ করে। হাওয়াজিনও ছিল তাদের অন্তর্গত।

যা-ই হোক, মক্কায় ফিরবার পর মায়ের আদরে বড় হতে লাগলেন তিনি। আমিনার ইচ্ছা, ছেলেকে নিয়ে স্বামীর কবরে যাবেন। কখনও যাওয়া তো হয়নি। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেয়া ভালো, বাবা আবদুল্লাহর কবর ছিল মদিনায় সেখানে আমিনার অন্য আত্মীয়রাও আছেন। মুহাম্মাদ (সা) এর মামার বাড়ি ছিল মদিনার বনি নাজ্জার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা রওনা হলেন মদিনার জন্য। তখন মদিনার নাম ছিল ইয়াস্রিব। দক্ষিণ আরবের ইহুদীদের বড় বসতি সেখানে।

বাবার কবরে দাঁড়িয়ে কী ঝড় চলছিল তাঁর ছোট্ট হৃদয়ে, সেই বর্ণনা আমরা বইগুলোতে পাই না। মদিনার নীল আকাশ, মৌন পাহাড় আর শান্ত প্রকৃতি মুগ্ধ করবার কথা শিশু মুহাম্মাদকে (সা)। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবার মতো ছিল মরুর বুকে এই বাগান (oasis)।

কিন্তু মাঝে মাঝে কোনো কোনো ইহুদী এই বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে থেমে যেতো। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো।

একদিন একজন জিজ্ঞাসা করে বসলো তাঁকে নিয়ে। আবদুল্লাহর রেখে যাওয়া এক দাসী উম্মে আয়মান বারাকা ছিল সাথে। মালিকপুত্রের সম্পর্কে উত্তর দিল, “মক্কার কুরাইশি ছেলে।”

“ওর বাবা?”

“মারা গেছেন।”

চমকে উঠে চলে গেল লোকটি। কিতাব অনুযায়ী প্রতিশ্রুত নবীর তো বাবা- মা দুজনই মারা যাবার কথা।

ইবনে কাসিরে মুহাম্মাদ (সা) জন্মের সময়ই বনু কুরাইজা ও অন্যান্য ইহুদী গোত্রের চলমান কথোপকথন লিপিবদ্ধ করা আছে কয়েকজন শ্রোতার বর্ণনায়। যেমন, একটি বর্ণনা এরকম- বনু কুরাইজার ইহুদী জুবাইর ইবনে বাতা বলছিলেন, “নবীর আগমনের সাথে যে লাল তারকা আকাশে দেখতে পাবার কথা, সেটা উদিত হয়েছে। আর একজনই বাকি ছিল যার নাম হবার কথা আহমাদ, আর এই জায়গাটি হবে সেই জায়গা যেখানে তিনি জন্মেছেন।”

ইবনে কাসিরেই বর্ণিত আছে, একদিন দুজন ইহুদী বললেন, “তোমাদের আহমাদকে নিয়ে আসো তো দেখি।” আহমাদ (সা) আসার পর তারা তাঁকে হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখল খুঁটিয়ে। এরপর একজন আরেকজনকে বলল, “এই ছেলেই এই জাতির নবী। সে একসময় এ জায়গায় (মদিনায়) আসবে আশ্রয় নিতে। এখানেই অনেকে বন্দী হবে, অনেকে নিহত হবে।”

আরেকদিন এক ইহুদী তো বলেই বসলো, “শোন, ওকে নিয়ে চলে যাও। ইয়াস্রিব নিরাপদ না ওর জন্য। প্রাণের শত্রু আছে এখানে ওর।”

ভয় পেয়ে আমিনা আসলেই মদিনা ত্যাগ করলেন তখন। ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। কিন্তু ‘আবওয়া’ নামের এক জায়গা পর্যন্ত আসতেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন! আর মারাও গেলেন। এতিম হয়ে গেলেন মুহাম্মাদ (সা)।

অনেক অনেক বছর পরে নবী (সা) এ জায়গাটিতে আবার আসেন। তবে তখন তিনি নবী। ইবনে কাসির (র) তাঁর গ্রন্থে ইমাম আহমদ (র) ও বায়হাকি থেকে বর্ণনা করেছেন ঘটনাটি। সাহাবীরা ভ্রমণ করতে করতে ওয়াদ্দানে পৌঁছান। সেখানে বাকিদের অপেক্ষা করতে বলে মহানবী (সা) কোথাও গেলেন, এক কবরের খোঁজে।

অন্য সাহাবীরা তাঁকে দূর থেকে ঘিরে ছিলেন। তিনি কিছু বাক্য উচ্চারণ করছিলেন যেন কাউকে, এরপর কাঁদতে লাগলেন অঝোরে। উমার (রা) সাথে সাথে উঠে তাঁর কাছে গেলেন। বললেন, “আপনাকে কী কাঁদাচ্ছে, হে আল্লাহর রাসুল?”

তিনি উত্তর দিলেন, “এ কবরটা আমিনা বিনতে ওয়াহাবের। আমি আল্লাহর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম তাঁর কবর জিয়ারতের, তিনি কবুল করলেন। আমি তাঁর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলাম, কিন্তু তিনি সেই ক্ষমা প্রার্থনা কবুল করলেন না। আমার এত করুণা লাগছে, এত খারাপ লাগছে আমার মায়ের জন্য, যে আমি কান্না থামাতে পারিনি।” হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী জানান, তিনি এর চেয়ে করুণ কান্নার কিছু কোনোদিন দেখেননি। হাদিসটি সহিহ মুসলিম শরিফেও আছে।

জন্মের ছয় মাস আগে বাবাকে হারিয়েছেন। ছয় বছর বয়সে মা-ও নেই। তখন ৫৭৬ কি ৫৭৭ সাল। পুত্রবধূর মৃত্যু সংবাদ শুনে ভেঙে পড়লেন আব্দুল মুত্তালিব। আবদুল্লাহ মারা যাবার পর যে শোকের পাথর বুকে বেঁধেছিলেন সেটা সরতে শুরু করেছিল, পুত্রবধূর গর্ভ থেকে নাতি মুহাম্মাদ (সা) জন্ম নেয়ার পর। সেই পুত্রবধূও নেই। এতিম নাতির ভার নিলেন তিনি। একদম নিজের ছেলের মতো।

কাবার আঙিনায় রোজ বসতো দরবার। প্রভাবশালী আব্দুল মুত্তালিবের বসার জায়গাটি ছিল খুব আরামের। কেউ সেখানে বসতে সাহস পেতো না। একদিন কীভাবে যেন সেখানে মুহাম্মাদ (স) চলে এলো, এরপর শিশুসুলভ দুষ্টুমি করতে করতে বসে পড়লেন সেখানে।

সবাই তো অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন, কী করা যায়? পরে এক চাচা তাঁকে কোলে করে নামালেন। সেই মুহূর্তেই আব্দুল মুত্তালিব চলে এলেন আর বললেন, “আরে কী করো! ও তো আমারই ছেলে!”

এই বলে মুহাম্মাদ (সা) কে তুলে নিলেন, নিজের পাশে বসালেন। আদর করতে লাগলেন। বললেন, “এ ছেলের ভবিষ্যতে অনেক বড় কিছু করবার আছে।” এ রকম ঘটনা প্রায়ই হতো।

আব্দুল মুত্তালিব আয়মান বারাকাকে ডেকে বললেন, “আমার এই নাতির অবহেলা করো না। তাঁকে সেদিন গাছের কাছে দেখলাম কিছু ছেলের সাথে। ইহুদী খ্রিস্টানরা নাকি দাবি করেছে, এই ছেলে নবী হবে পরে।” তাঁকে সাথে না নিয়ে কখনো খেতে বসতেন না আব্দুল মুত্তালিব। [ইবনে কাসির]

সেই আদরও টিকলো না বেশিদিন। তার বয়স যখন ৮ বছর ২ মাস ১০ দিন, তখন দাদা বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। আল হাজুনে তাঁর কবর হয়। মারা যাবার আগে তিনি আবু তালিবের হাতে মুহাম্মাদ (সা) এর দায়িত্ব সমর্পণ করেন। কারণ আবু তালিব আর আব্দুল্লাহ আপন ভাই ছিলেন।

সব চাচাদের উপার্জন আলাদাই ছিল। আবু তালিবের আর্থিক অবস্থা খুব একটা সচ্ছল ছিল না। তবে দিন ভালোই চলে যাচ্ছিল। দাদার মতোই চাচা আবু তালিবও তাঁকে সাথে সাথে রাখতেন। তাঁকে ছাড়া পরিবারের অন্যরা খেতেই চাইতো না। প্রতিদিন সকাল বেলা আবু তালিব বাচ্চাদের জন্য খাবারের ডালি নিয়ে আসতেন। সবাই সেখান থেকে খাবার জন্য কাড়াকাড়ি লাগিয়ে দিত। শুধু মুহাম্মাদ (সা) হাত বাড়াতেন না। এটি দেখে এরপর থেকে আবু তালিব তাঁর জন্য আলাদা খাবার আনতে লাগলেন।

কিন্তু এরপর এমন কিছু ঘটল যেটার জন্য আবু তালিব প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁর ভাতিজার উপর তাঁর অগোচরেই পরিকল্পিত হচ্ছিল এক গুপ্তহত্যা, অচেনা কিছু মানুষের দ্বারা। সে ব্যাপারে কথা হবে পরের অধ্যায়ে!

তথ্যসূত্র সমূহ

ইবনে হিশাম (র) রচিত সীরাত, ইবনে ইসহাক (র) রচিত সীরাত, ইবনে সা’দ (র) রচিত সীরাত তাবাকাত এবং ইবনে কাসির (র) রচিত সুবিশাল সীরাত গ্রন্থ, যেখানে তিনি আদি ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম উভয় গ্রন্থ পড়বার পর প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করেছেন। অনেকে আলফ্রেড গিয়োম অনূদিত ইবনে ইসহাকের ইংলিশ ভার্শনে অনাস্থা প্রকাশ করায় ইবনে ইসহাকের ক্ষেত্রে ইবনে কাসির (র) এর বর্ণনা গ্রহণ করা হচ্ছে। আর মুহাম্মাদ (সা) এর জন্মের পূর্বের আরব ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যার জন্য সাহায্য নেয়া হয়েছে বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক স্কলারের লেখার, যারা প্রাক-ইসলামি আরব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখেন। তবে সেটি মূল জীবনীতে প্রভাব ফেলবে না। মূল জীবনীর জন্য প্রথম দিককার জীবনীকারদের সাহায্যই কেবল নেয়া হয়েছে অবিকৃতির জন্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *