অধ্যায় ২২: ডিসেম্বর – জানুয়ারি
১৬ই ডিসেম্বর ঢাকায় যেদিন পাকিস্তানী বাহিনী আত্মসমর্পণ করে, ঠিক সেদিনই কোলকাতায় প্রবাসী সদর দফতর থেকে বাংলাদেশ সরকার সমগ্র দেশে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী পাঠাতে শুরু করেন। শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসনযন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তার জরুরী করণীয় নির্ধারণের জন্য ২২শে নভেম্বরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা সচিবদের সমবায়ে যে সাবকমিটি গঠন করেছিলেন (পরিশিষ্ট ঠ-এ বর্ণিত), সেই সাবকমিটি এবং পরিকল্পনা সেল পাশাপাশি এ যাবত কাজ করে চলেন। ফলে বেসামরিক প্রশাসন এবং আইন ও শৃঙ্খলার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পুনরুজ্জীবন, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, খাদ্য ও জ্বালানিসহ জরুরী পণ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, পাকিস্তানের আধা-সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র সমর্থকদের নিষ্ক্রিয়করণ, সরবরাহকৃত অস্ত্রশস্ত্রের পুনরুদ্ধার, জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়োগ প্রভৃতি বিষয়ে সচিব সাবকমিটি ও পরিকল্পনা সেলের সুপারিশসমূহ মন্ত্রিসভার বিবেচনা ও অনুমোদনের জন্য হাজির করা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে মন্ত্রিসভার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পর জেলা পর্যায়ে জরুরী করণীয় ও দায়িত্ব সম্পর্কে জেলা প্রশাসকের প্রতি নির্দেশপত্র প্রেরিত হয় ৭ই ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর থেকে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে উনিশটি জেলার জন্য জেলা প্রশাসকদের মনোনয়ন ও নিয়োগ সম্পন্ন হয়। ১৭ই ডিসেম্বর ঐ সব জেলার সহকারী প্রশাসক পর্যায়ে নিয়োগ করা হয় আরো ছচল্লিশজন অফিসার।
জেলা প্রশাসকদের কাছে প্রেরিত নির্দেশপত্রে আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব ছিল সর্বাগ্রে। সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে প্রচারিত বিভিন্ন বিবৃতি এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কর্তৃক প্রচারিত আবেদনে মুক্ত এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্থানীয় জনসাধারণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বারংবার আহ্বান জানানো হয়। প্রায় ন’মাস ধরে হানাদার বাহিনীর হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের রাজত্বকালে যে সব স্থানীয় অনুচরদের কার্যকলাপ মানুষের দুর্গতির মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছিল, তাদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত দেশবাসীর পুঞ্জীভূত ঘৃণা, ক্রোধ ও প্রতিশোধ স্পৃহা যে এক ক্ষমাহীন সংকল্পে পরিণত হয়েছে তা কারো অজ্ঞাত ছিল না। একবার এই পুঞ্জীভূত ঘৃণা ও ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটা মাত্র সারা দেশে নতুন করে রক্তের প্লাবন শুরু হওয়ার আশঙ্কা ছিল খুবই প্রবল। এর ফলে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করাও যে সাতিশয় দুরূহ হয়ে পড়ত, সে বিষয়ে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের কোন সংশয় ছিল না। তাই যুদ্ধ চলাকালেই মন্ত্রিসভা পাকিস্তানী অনুচর হিসাবে অভিযুক্তদের বিচার ও শাস্তির আইনসঙ্গত পন্থা উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ ছাড়া এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড যাতে কোনক্রমেই সংঘটিত হতে না পারে তজ্জন্য মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীকে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়।
বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার কর্মসূচী কাগজপত্রে যত নির্ভুলভাবেই ব্যক্ত করা হোক, প্রায় ন’মাস দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের পর সারা দেশের প্রশাসন, অর্থনৈতিক অবকাঠামো, কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রভৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রই তখন সর্বাংশে বিপর্যস্ত। আইন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি ছিল নামে মাত্র। দেশের আয়তন ও সমস্যার তুলনায় বাংলাদেশের নিজস্ব সৈন্যবলও ছিল অতিশয় নগণ্য। দেশের অফিস-আদালত ছিল জনশূন্য, ডাক বিভাগ সম্পূর্ণ বন্ধ; তার বিভাগ প্রায় অচল; অসংখ্য ব্রীজ ও সেতু বিধ্বস্ত হওয়ায় রেল ও সড়কপথে যোগাযোগ প্রতি পদে বিঘ্নিত; সচল অসামরিক বাস ও ট্রাক বিরল বস্তু; যান্ত্রিক জলযান প্রায়শই জলমগ্ন অথবা বিধ্বস্ত; স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই; কলকারখানা সব বন্ধ; বন্দর অচল ও বহির্বাণিজ্য নিশ্চল। অন্যদিকে পাকিস্তানী নির্যাতনের কবল থেকে জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষার প্রচেষ্টায় দেশের ভিতরেই তখন দেড় থেকে দু’কোটি লোকের উদ্বাস্তুর দশা; ভারতে আশ্রয়লাভকারী এক কোটি শরণার্থীকেও সেখানকার সাধারণ নির্বাচনের আগে স্বদেশে ফিরিয়ে আনার তাগিদ রয়েছে। মোট প্রায় আড়াই থেকে তিন কোটি লোকের পুনর্বাসন ছিল দেশের জরুরী সমস্যাগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ। খাদ্যশস্যের ঘাটতি ৪০ লক্ষ টন। স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পরে বাংলাদেশের পরিস্থিতি ছিল এমনই ঘোর দুর্যোগপূর্ণ।
আইন ও শৃঙ্খলার পরিস্থিতি একাধিক কারণেই ছিল সব চাইতে সমস্যা-সঙ্কুল ও বিপজ্জনক। নিয়মিত বাহিনী ছাড়াও গণবাহিনী হিসাবে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল ৮৪,০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে। ‘মুজিব বাহিনী’র সংখ্যা ছিল আরও দশ হাজার। এদের প্রায় সবাইকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। তৎপরতার সময় অস্ত্র খোয়ানো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খুব বিরল ঘটনা ছিল না; এদের মধ্যে যারা মোটামুটি দক্ষ হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল, সেই সব যোদ্ধাদের পুনরায় অস্ত্র দেওয়া হয়। এ ছাড়া টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল, নোয়াখালী, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চলে মূলত স্থানীয় প্রশিক্ষণ ও উদ্যোগের ভিত্তিতে যে সব বাহিনী গ্রুপ এক ধরনের গেরিলা পদ্ধতিতে লড়াই করে চলেছিল তাদেরকেও বিভিন্ন দফায় অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। এক নির্ভরযোগ্য ভারতীয় সূত্র অনুসারে, নিয়মিত বাহিনীর জন্য স্বতন্ত্র বরাদ্দ বাদে, কেবল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরবরাহকৃত মোট অস্ত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সরবরাহকৃত এই বিপুল অস্ত্রশস্ত্রের সম্ভাব্য অপব্যবহারে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গোলাগুলির (ammunition) পরিমাণ এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত করা হত, যাতে যুদ্ধের পর তাদের হাতে উদ্বৃত্ত গোলাগুলি খুব একটা অবশিষ্ট না থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকায়, তাদের অব্যবহৃত গোলাগুলির পরবর্তী ব্যবহার সম্পর্কে কিছু দুশ্চিন্তার উদ্রেক ঘটে। কেন্দ্রীয় কমান্ডকাঠামোবিহীন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদের কারণে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সমস্যাটি ছিল জটিল। ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য মুজিব বাহিনী’র একাংশের কার্যকলাপ এবং চীনাপন্থী হিসাবে পরিচিত কোন কোন উগ্র বামপন্থী গ্রুপের বিঘোষিত ভূমিকার দরুন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণের সমস্যা জটিলতর হয়। সাধারণভাবেই এক বর্বর সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ কয়েক মাস অস্ত্র ধারণের পর এই সব তরুণদের মনোজগতে যে বিপুল আলোড়ন এবং মূল্যবোধের যে বিরাট রূপান্তর ঘটে, স্বাধীনতা অর্জনের পর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার পরেও তা কতখানি প্রবল থাকবে বা কিভাবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটবে, তা ছিল সর্ববৃহৎ প্রশ্ন।
কিন্তু পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পর আইন ও শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে সব চাইতে বড় বিপদ আশঙ্কা করা হয় পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনীসমূহের মধ্যে গোঁড়া ইউনিটগুলিকে নিয়ে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক মিশ্র উপাদানে গঠিত রাজাকার, সশস্ত্র জামাতে ইসলামীদের দ্বারা গঠিত আল-বদর এবং সশস্ত্র বিহারীদের আল শামস-এই তিন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৬০/৭০ হাজার। এ ছাড়া যুদ্ধের শেষ দিকে পাকিস্তানীরা বিহারী ও জামাতে ইসলামী কর্মীদের মধ্যে অকাতরে অস্ত্রশস্ত্র বিতরণ করে বলে জানা যায়। পাকিস্তানের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের অধিকাংশই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আত্মগোপন করার অথবা মফস্বল ও ভারত অভিমুখে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলেও এদের ধর্মান্ধ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ অংশের পক্ষে কোন বেপরোয়া কাজই অসাধ্য ছিল না। পাকিস্তান সমর্থক গোঁড়া অংশকে চিহ্নিত করে তাদের নিবৃত্ত না করা পর্যন্ত ঢাকা শহরকে বিপদমুক্ত হিসাবে গণ্য করা অসম্ভব হত। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের কয়েক ঘণ্টা বাদেই ইয়াহিয়া খান ‘পূর্ণ বিজয় লাভ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প’ ঘোষণা করায় এবং দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পূর্ণ শক্তিতে উপস্থিত থাকায়, নবতর যুদ্ধের আশঙ্কা তখনও সর্বাংশে তিরোহিত নয়।
এই পটভূমিতে ঢাকায় উপনীত ভারতীয় সামরিক কমান্ড শহরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিধানে তাদের সামরিক অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। এর ফলে এবং ভারত সরকারের সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজনে তিন অথবা চার দিন বাদে মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনের সম্ভাব্য দিন স্থির করা হয়। তার আগে ঢাকায় ন্যূনতম প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সরকারের সেক্রেটারী জেনারেল রুহুল কুদুসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের সচিবদের একটি দল ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকা এসে পৌঁছান। একই দিনে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিও ঢাকা আসেন। ১৯শে ডিসেম্বর থেকে স্বল্প সংখ্যক অফিসার ও কর্মচারীদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সেক্রেটারীয়েট প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়।
ঢাকায় আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে কত জটিল তা ১৭ই ডিসেম্বর থেকে ক্রমশ উন্মোচিত হতে শুরু করে। ১৬ই ডিসেম্বর রাত্রি থেকে বিজয়োল্লাসে মত্ত যে সব ‘মুক্তিযোদ্ধা’ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল ১৭ই ডিসেম্বর দেখা যায় তাদের অনেকের হাতেই চীনা AK৪৭ রাইফেল ও স্টেন গান। এই সব অস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করার কোন প্রশ্ন ছিল না। বস্তুত এই সব অস্ত্রধারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কখনো মুক্তিযোদ্ধাও ছিল না-অন্তত মুক্তিযোদ্ধাদের কোন ইউনিট নেতাই এদের সনাক্ত করতে পারেনি। জানা যায়, এতদিন যে সব তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগদান না করে–এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সচ্ছল বা প্রভাবশালী অভিভাবকদের নিরাপদ আশ্রয়ে–বসবাস করছিল তারাও পাকিস্তানের পরাজয়ের পর বিজয় উল্লাসে বিজয়ী পক্ষে যোগ দেয়। মুখ্যত এদের হাতেই ছিল পাকিস্তানী সৈন্য এবং সমর্থকদের ফেলে দেওয়া অস্ত্র অথবা অরক্ষিত পাকিস্তানী অস্ত্রাগার থেকে লুঠ করা অস্ত্রশস্ত্র এবং অঢেল গোলাগুলি। ১৬ই ডিসেম্বর নিয়াজীর আত্মসমর্পণের পর এই বাহিনীর উৎপত্তি ঘটে বলেই অচিরেই ঢাকাবাসীর কাছে এরা ‘Sixteenth Division’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। কালক্ষেপণ না করে এদেরই একটি অংশ অন্যের গাড়ী, বাড়ী, দোকানপাট, স্থাবর ও অস্থাবর বিষয়সম্পত্তি বিনামূল্যে বা নামমাত্র মূল্যে দখল করার কাজে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এদের পিছনে তাদের সৌভাগ্যান্বেষী অভিভাবক বা পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থন কতখানি ছিল বলা শক্ত, তবে ১৯৪৭-৪৮ সালে ভারত বিভাগ ও দাঙ্গার পর এই প্রক্রিয়াতেই অনেক বিষয়সম্পত্তির হাতবদল ঘটেছিল। সুযোগসন্ধানী ‘সিক্সটিনথ ডিভিশন’ সৃষ্ট এই ব্যাধি অচিরেই সংক্রমিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে। তারপর কে যে সিক্সটিনথ ডিভিশনের লোক, কে যে মুক্তিযোদ্ধা আর কে যে দলপরিবর্তনকারী রাজাকার–সব যেন একাকার হয়ে এমন এক লুঠপাটের রাজত্ব শুরু করে যে, ঢাকা শহরে নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক জরুরী দায়িত্ব পালন ছাড়াও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পুলিশী ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানীদের স্থানীয় অনুচরদের বিরুদ্ধে স্বজন হারানো, লাঞ্ছিত ও নিগৃহীত দেশবাসীর পুঞ্জীভূত ক্রোধ এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবাবেগ নিয়ন্ত্রণ করা ছিল এক দুরূহ ব্যাপার। ভারতীয় সেনাবাহিনী রেডক্রসের অভয়াশ্রয় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এবং পাক বাহিনী ও বিহারী-অধ্যুষিত অঞ্চলের চারদিকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটতে থাকে। দৃশ্যত মুক্তিযোদ্ধাদের ইউনিট কমান্ডারদের মধ্যে কারো কারো পক্ষে তাদের সহযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ করাও সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে। এহেন অবস্থার মাঝে ১৮ই ডিসেম্বর রায়ের বাজারে কাটাসুর নামক এক ইটখোলার খাদে হাতবাঁধা অবস্থায় দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীসহ প্রায় দুইশত ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হওয়ায় মানুষের ক্রোধ, ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আবেগ চরমে পৌঁছায়।
ঐ দিন সন্ধ্যায় ঢাকার প্রথম গণজমায়েতে মুক্তিযোদ্ধাদের কতিপয় নেতা শান্তি ও শৃঙ্খলার আবেদন জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করার পর হঠাৎ কি আবেগবশত বিদেশী সাংবাদিক ও টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে অজ্ঞাত অভিযোগে ধৃত চারজন বন্দীকে আধ ঘণ্টাকাল ধরে পিটিয়ে অবশেষে বেয়োনেটবিদ্ধ করে হত্যা করে। স্থলভূমির মুক্তিযুদ্ধে নিঃসন্দেহে সর্বাপেক্ষা সফল অধিনায়ক টাঙ্গাইলের আবদুল কাদের সিদ্দিকী কর্তৃক নিজ হাতে এদের বেয়োনেটবিদ্ধ করার সচিত্র সংবাদ সারা বিশ্বে ফলাও করে প্রচারিত হয়। বুদ্ধিজীবীদের শবদেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর সারা শহরে যখন প্রবল উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তখন সেই অবস্থায় কাদের সিদ্দিকীর এই দৃষ্টান্ত ভয়াবহ রক্তপাতের সূচনা করতে পারে এই আশঙ্কায় ভারতীয় বাহিনী কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ নেয়। বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার অধিনায়ক এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব ও জনপ্রিয়তার অধিকারী কাদের সিদ্দিকীকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ ভারতীয় বাহিনীর জন্য সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। তা ছাড়া ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানী সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির খবর আসছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যেও গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গের সূত্রপাত হয় যখন দৃশ্যত কিছু শিখ অফিসার এবং তাদের অধীনস্থ সেনা যশোর, ঢাকা, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মূলত ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এবং খুলনার ক্যান্টনমেন্ট ও শিল্প এলাকায় লুঠপাট শুরু করে; কিন্তু তা ব্যাপক আকার ধারণ করার আগেই তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃঢ় হস্তক্ষেপে বন্ধ হয়ে যায়। এই সব ঘটনার ফলে ভারতীয় বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কমান্ড এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান, আরও ৩/৪ দিনের আগে ঢাকার ন্যূনতম শৃঙ্খলা আনয়ন করা সম্ভব নয়।
মন্ত্রিসভার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে ঢাকায় ন্যূনতম নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠা করা ভারতীয় বাহিনীর মূল উৎকণ্ঠা হলেও, মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনে বিলম্ব ঘটার প্রধান কারণটি ছিল অন্য। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়ন করেন ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামোর বিপর্যস্ত অবস্থা এবং পাকিস্তানভিত্তিক অর্থনৈতিক সত্তা থেকে সহসা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর অর্থ ও সম্পদের চূড়ান্ত অভাবের দরুন উক্ত পরিকল্পনা ও কর্মসূচী অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করা কার্যত অসম্ভব ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করার মত সম্পদ ও কারিগরি সহায়তার বাস্তব আয়োজন ব্যতীত কেবল মন্ত্রিসভার প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ সরকার কার্যকরভাবে সক্রিয় হতে পারতেন না। দ্বিতীয়ত, যে প্রশ্নকে কেন্দ্র করে উপমহাদেশের এই যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়, সেই এক কোটি শরণার্থীকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনার নির্দিষ্ট আয়োজন না করে ঢাকা প্রত্যাবর্তনের জন্য মন্ত্রিসভার ব্যগ্রতা প্রকাশ সঠিক বা শোভনীয় কোনটাই হত না।
যুদ্ধ শুরু হবার পর উপরোক্ত বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার পূর্ণ সুযোগ ছিল না। বিশেষত, বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়ে সমস্ত কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিযুক্ত ভারতের প্রধান কর্মকর্তা ডি. পি. ধর সপ্তম নৌবহর উদ্ভূত জরুরী পরিস্থিতির জন্য ১১ই ডিসেম্বর থেকে যুদ্ধের সমাপ্তি অবধি মস্কোয় অবস্থান করছিলেন। ১৮ই ডিসেম্বরে ডি, পি. ধর কোলকাতা এসে পৌঁছাবার পর ২১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সকল প্রয়োজনীয় বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে তাঁর আলাপ আলোচনা চলে এবং বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার অনুরোধ ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে। সেই সময় ঢাকা ও দিল্লীর মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থা যা ছিল, তাতে দু’দেশের সরকারের পক্ষে এতগুলি জরুরী বিষয়ে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্রকে সচল করা এবং বিচ্ছিন্ন ও বিপর্যস্ত অর্থনীতির জরুরী পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে ভারতীয় সহযোগিতার পরিসর নীতিগতভাবে স্বীকৃত হওয়ার পর স্থির হয়, বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের নির্দিষ্ট আয়োজন নিরূপণ করা এবং সরবরাহের কর্মসূচী প্রণয়ন করার উদ্দেশ্যে ২৩শে ডিসেম্বর এক উচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় প্রতিনিধিদল ঢাকা পৌঁছাবেন। এই সব ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করার পর অবশেষে ২২শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভা জনতার কাছ থেকে বিপুল সম্বর্ধনা লাভ করেন বটে, তথাপি এই বিলম্বের ফল রাজনৈতিকভাবে মন্ত্রিসভার জন্য শুভ হয়নি–বাংলাদেশের আগ্রহে উদ্বেলিত মানুষের মধ্যে নৈরাশ্যের ভাব সৃষ্টি হয় এবং মন্ত্রিসভা তীব্রভাবে সমালোচিত হন। কিন্তু ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর মন্ত্রিসভা দ্রুতগতিতে যে সব সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার ফলে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে একটি কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজন উপযোগী কেন্দ্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত অগ্রসর হয়, আভ্যন্তরীণ সংঘাত ও বিশৃঙ্খলা হ্রাস পায়, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নত হয়, পরিত্যক্ত কলকারখানাসমূহ সচল করার জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠন করা হয় এবং সাধারণভাবে অর্থনৈতিক জীবন সচল হতে শুরু করে।
দেশ শত্রুমুক্ত এবং জাতীয় সরকার স্বদেশে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রকে সচল ও সংগঠিত করার মুহূর্তে প্রধানতম অনায়ত্ত লক্ষ্য ছিল শেখ মুজিবের মুক্তি। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য তখন আগ্রহে অধীর। ২৫শে মার্চ মধ্যরাত্রিতে প্রত্যাসন্ন আঘাতের মুখে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের চোখে তিনিই ছিলেন মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা; ১৯৬৬ সালে ৬-দফা কর্মসূচী ঘোষণার ফলে কারারুদ্ধ হওয়ার পর ১৯৬৮-৬৯ সালের ছাত্র-জনতার ৬-দফা/১১-দফা দাবীর প্রমত্ত আন্দোলনের মুখে মুক্তিপ্রাপ্ত শেখ মুজিব যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে। ১৯৬৮-৬৯ এবং ১৯৭১ এই দুই যুগান্তকারী সংগ্রামের কোনটিতেই তিনি নিজে যোগ দিতে পারেননি, কেবল সংগ্রামের ডাক দেবার অভিযোগে দু’বারই তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। তৎসত্ত্বেও, এর মাঝখানে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির গণভোটে রূপান্তরিত করে সমগ্র দেশকে তিনি যেভাবে এক ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় সংহত করেন, যেভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তির দাবীর বৈধতা সম্পর্কে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন এবং যেভাবে ১লা মার্চ থেকে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভকে এক দুর্বার অসহযোগ আন্দোলনে পরিণত করে মানুষের সংগ্রামী চেতনায় মৌল রূপান্তর সাধন করেন–তার ফলে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের নেতা হিসাবে সাধারণ গণমানসে তিনি সর্বোচ্চ আসন অধিকার করেন। ২৫শে মার্চের পর ইয়াহিয়ার হত্যাউন্মত্ত সৈনিকেরা যখন এদেশের মানুষকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণে বাধ্য করে, তখন সংগ্রামের লক্ষ্য ও পদ্ধতির মৌলিক পরিবর্তন সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের মনে তার সেই আসন অপরিবর্তিত থাকে; সাধারণ মানুষ হত্যা ও বিভীষিকার মাঝে শেখ মুজিবকেই মনে করেছে তাদের মুক্তিআকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তার এই প্রতীক মূল্য যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, তজ্জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিরবচ্ছিন্ন নিষ্ঠার প্রচার করেছে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ’, প্রচার করেছে তাকে নিয়ে রচিত অজস্র কথা, গাথা ও গান।
অবশেষে এই বাস্তব ও কল্পনার মিলিত উপাদানে গঠিত সেই অপরাজেয় নায়ককে পাকিস্তানী বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করার পালা। তার মুক্তির পণমূল্য হিসাবে সাড়ে একানব্বই হাজার পাকিস্তানী সামরিক ও বেসামরিক বন্দী তখন বাংলাদেশের করায়ত্ত। মুখ্যত শেখ মুজিবের মুক্তির পণমূল্য হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশের অবরুদ্ধ উপকূলভাগ দিয়ে পাকিস্তানী বাহিনীর নিষ্ক্রমণ পরিকল্পিতভাবে বন্ধ করা হয়েছিল। যদি উপকূলভাগ দিয়ে তাদের পলায়নপথ উন্মুক্ত রাখা হত, তবে ৭ই ডিসেম্বর যশোরে তাদের পতনের পর দক্ষিণ দিকে তাদের যেভাবে দৌড় শুরু হয়েছিল তার ফলে সম্ভবত পরবর্তী দু’তিন দিনের মধ্যেই সমগ্র বাংলাদেশ খালি করে সমুদ্রপথে তারা পালিয়ে যেত; ফলে ৯ই ডিসেম্বরে যুদ্ধবিরতির ও সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য মালেকের আবেদন, ইয়াহিয়ার সম্মতি এবং তার পরের দিন রাও ফরমান কর্তৃক সসম্মানে সৈন্য প্রত্যাহারের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের সহায়তা প্রার্থনা–এই সব কোন কিছুর প্রয়োজন হয়ত তাদের হত না। পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে, পাকিস্তানের জন্য নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সমর্থন যত প্রবলই হোক, তারপর বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর কোন সামরিক ভিত্তিই তাঁকে দেখতে পেতেন না। কাজেই সর্বাধিক সংখ্যক যুদ্ধবন্দী পাবার আশায় পাকিস্তানী বাহিনীর পলায়নপথকে রুদ্ধ করে কার্যত সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে যাত্রা করার সুযোগ করে দেওয়া হয়; ফলে যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, প্রাণহানি বাড়ে, বিশ্বের বৃহত্তম দুই শক্তির সামরিক সংঘাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। সপ্তম নৌবহর এসে পড়ার প্রাক্কালে দৈবাৎ পাকিস্তানী সিগন্যালস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকায় গভর্নর ভবনের উপর ভারতীয় বিমানবাহিনীর অভ্রান্ত আক্রমণে এবং স্থল বাহিনীর ক্রম সঙ্কুচিত বেষ্টনীর মুখে পাকিস্তানী কমান্ডের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ায় বাংলাদেশের বিজয় সম্পন্ন হয়। কাজেই এক অসামান্য ঝুঁকি নিয়ে শেখ মুজিবের এই মুক্তিপণ সংগৃহীত হয়। কিন্তু তা সদ্ব্যবহারের জন্য কোন উদ্যোগ নেওয়ার আগেই জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার পরদিন অর্থাৎ ২১শে ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে স্পষ্ট আভাস দেওয়া হয়, শেখ মুজিবকে শীঘ্রই মুক্তি দেওয়া হবে।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে তাদের নির্বুদ্ধিতার মাশুল দিতে হয় নিয়াজীর আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পরেই। বৈদেশিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্থিতাবস্থা কায়েম করার কৌশল হিসাবে ইয়াহিয়াচক্র ৩রা ডিসেম্বর থেকে সীমিত যুদ্ধ শুরু করেছিল। তার পরিণাম ফল হিসাবে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান তো বটেই, তদুপরি তাদেরকে ৯১,৪৯৮ জন অভিজ্ঞ সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিকেও যে যুদ্ধবন্দী হিসাবে হারাতে হবে, তা ছিল ইয়াহিয়াচক্রের চিন্তার অগম্য। ১৬ই ডিসেম্বরে সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া চূড়ান্ত বিজয় অবধি যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প’ প্রকাশ করা সত্ত্বেও পরদিন পাকিস্তানের সর্বত্র গণবিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। ঐ দিন ভুট্টোর সামপ্রতিক চীন সফরের দুই সঙ্গী সামরিক বাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খান-সশস্ত্রবাহিনীর ক্ষোভকে মূলধন করে ইয়াহিয়াচক্রের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা প্রতিহত করেন (ফলে ভারতের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গৃহীত হয়) এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা গ্রহণের জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানানোর পক্ষে সিদ্ধান্ত গঠন করেন।
এই সংবাদ পাওয়ার পর নিউইয়র্কে অবস্থানরত ভুট্টো ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে স্বল্পকালের জন্য সাক্ষাৎ করেন। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রের বিবৃতি অনুসারে নিক্সন ‘উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি’ সেই মুহূর্তে সর্বাধিক প্রয়োজনীয় বলে ভুট্টোর কাছে উল্লেখ করেন। ‘উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা’ প্রসঙ্গে নিক্সন ভুট্টোকে নির্দিষ্টভাবে কি পরামর্শ দিয়েছিলেন তা অজ্ঞাত থাকলেও, ওয়াশিংটন থেকে পাকিস্তান ফিরে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর পরই ভুট্টো ২০শে ডিসেম্বর তাঁর প্রথম বেতার বক্তৃতায় ‘পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে ঘোষণা করেন, সেখানকার জনগণ যে পাকিস্তানের অংশ হিসাবে বসবাস করতে চায় তার এই বিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেন, এবং সর্বোপরি ঘোষণা করেন ‘অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে–বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও ভারতের সৈন্যের উপস্থিতি ব্যতিরেকে–আলাপ-আলোচনাভিত্তিক সমাধানের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য তিনি প্রস্তুত রয়েছেন। ২১শে ডিসেম্বর ভুট্টো ঘোষণা করেন, শেখ মুজিবকে শীঘ্রই জেল থেকে মুক্তি দিয়ে অন্য কোথাও গৃহবন্দী করা হবে। ২২শে ডিসেম্বর ইসলামাবাদ থেকে ঘোষণা করা হয়, কারাগার থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দী করা হয়েছে। ২৩শে ডিসেম্বর সংবাদ পাওয়া যায় তাঁকে আলোচনার জন্য রাওয়ালপিন্ডি আনা হয়েছে। ভুট্টো মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরদিনই। ভুট্টোর এই অসাধারণ গতিবেগ তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়ের অসাধারণ গুরুত্বকেই প্রতিফলিত করে মাত্র।
২০শে ডিসেম্বর ‘অখণ্ড পাকিস্তানের কাঠামোর অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য মিলিত হতে রাজী আছেন এই মর্মে ভুট্টোর ঘোষণা এবং শেখ মুজিবের আসন্ন মুক্তির সংবাদ স্বভাবতই বাংলাদেশের স্বাধীন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নানা জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি করে। লন্ডনের টাইমস্ পত্রিকার প্রতিনিধি কর্তৃক এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাজউদ্দিন স্পষ্ট ভাষায় জানান, কোন শিথিল ফেডারেশনের অধীনে, ‘অখণ্ড পাকিস্তানের অধীনে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে শেখ মুজিবের সহায়তা পাওয়া যাবে এর চাইতে হাস্যকর আর কিছু হতে পারে না এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই তিনি ঘোষণা করেন, যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা আর কিছুতেই পরিবর্তনীয় নয়। পশ্চিমা দেশগুলির চোখে তাজউদ্দিন স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন সব চাইতে আপোসহীন; কাজেই ১৪ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব জানানোর পর এবং নিক্সনের ‘গানবোট কূটনীতি’ বঙ্গোপসাগরের চরাভূমিতে আটকে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর পশ্চিমা ইউরোপীয় মহলে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করে যে, পাকিস্তানের সামরিক আধিপত্য বিলুপ্ত হওয়ার পর পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ এবং পাকিস্তানের সঙ্গে এর ‘ভবিষ্যৎ সম্পর্ক’ নিরূপণের জন্য উভয়পক্ষের মধ্যে যে আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন, সেখানে তাজউদ্দিনের পরিবর্তে শেখ মুজিবকে অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয়।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে যে ক’টি বিষয় নিয়ে আলোচনা করার ছিল তন্মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্ন। বাংলাদেশ সরকার বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী আটকের পর এক জোরাল অবস্থান থেকেই সে আলোচনা চালাতে পারতেন। কিন্তু তার আগেই ক্ষমতাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টো শেখ মুজিবের বন্দিত্বের সুযোগ নিয়ে সরাসরি তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ইত্যবসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের শেষ দু’দিনে সপ্তম নৌবহরের ব্যর্থতা পরিদৃষ্টে ক্রুদ্ধ কিসিঞ্জার যখন নির্মীয়মাণ রুশ-মার্কিন সম্পর্ককাঠামোর ক্ষতিসাধনের হুমকি দেন, তখন এই বাড়াবাড়ির প্রতিক্রিয়া হিসাবে মার্কিন বৈদেশিক নীতির বিষয়ে সেক্রেটারী রজার্স ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। ফলে উপমহাদেশ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গিগত অনৈক্য বহুলাংশে হ্রাস পায়। ২৩শে ডিসেম্বর সেক্রেটারী অব স্টেট রজার্স উপমহাদেশ-সংক্রান্ত তাঁদের নীতির সংশোধন করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নয়, তবে তাঁরা এই ‘দুই অংশের’ বিচ্ছিন্নতারও পক্ষপাতী নন। বিগত নয় মাসের ঘটনা সম্পর্কে বহুলাংশেই অনবহিত বন্দী শেখ মুজিবের সঙ্গে ভুট্টো যে দিন আলাপ-আলোচনা করতে চলেছেন, ঠিক সে দিনই রজার্সের এই বিবৃতি প্রকাশ করা হয়।
‘পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নির্ধারণ’, ‘দেশের দুই অংশের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য নয়’-এ জাতীয় বিবৃতির উদ্দেশ্যে স্পষ্টতই ছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা সত্ত্বেও বাংলাদেশকে কোন না কোনভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কিত রাখার চেষ্টা করা। ভুট্টোও, জানা যায়, একই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সব প্রচেষ্টার পিছনে সম্ভবত একটি মুখ্য বিবেচনা সক্রিয় ছিল: সব। সাফল্যের পরেও ভারত (এবং পরোক্ষভাবে সোভিয়েট ইউনিয়ন) যে উপমহাদেশের ঘটনাধারা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত শক্তি নয় তা প্রমাণ করা। তৎসত্ত্বেও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ভুট্টোর সম্ভবত বৃহত্তর স্বার্থ নিহিত ছিল পাকিস্তানের এই দুই অঞ্চলের ক্ষমতার বিচ্ছেদ স্থায়ী করার মধ্যে। ভুট্টোর জন্য এই উপলব্ধি নিশ্চয়ই নতুন ছিল না যে, একমাত্র পূর্ব ও পশ্চিমের স্থায়ী বিচ্ছেদের মাধ্যমেই পশ্চিম পাকিস্তানে তার ক্ষমতার আসনকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু এ বিষয়ে অশোভন ব্যগ্রতা প্রকাশের রাজনৈতিক সুযোগ ছিল সীমিত। কাজেই বাহ্যত হলেও ভুট্টোকে এই সময় পাকিস্তানের দুই অংশের মাঝে সংযোগসূত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত দেখা যায়। মূলত এই উদ্যোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই দ্বিতীয় স্তরের প্রচেষ্টা–সপ্তম নৌবহর দ্বারা পাকিস্তানকে একত্রিত রাখায় প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরের। শেষ পর্যন্ত যদি এ প্রচেষ্টাও সফল না হয় এবং ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অপরিবর্তিতই থাকে, তবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সূচিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সম্ভাব্য মৌল রূপান্তর রদ করার জন্য এই দেশকে বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনস্থ করার উদ্যোগই সম্ভবত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় স্তরের প্রচেষ্টা। তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দারিদ্র্য-প্রপীড়িত দেশের মত বাংলাদেশকে মার্কিনী উদ্ধৃত্ত খাদ্য, পণ্য ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে পশ্চিমা প্রভাব বলয়ের অধীনস্থ করার চিন্তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অভিনব ছিল না। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ও সামরিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যদি শেষ পর্যন্ত সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে সেই অবস্থায় পণ্য ও অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে এই নতুন দেশকে মার্কিনী প্রভাব বলয়ের অধীনস্থ করার প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনা বস্তুত শুরু হয় বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করারও আগে।
এ কথা সত্য যে মুক্তিসংগ্রামের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ফলে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের নির্মীয়মাণ একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কজা থেকেই কেবল বেরিয়ে আসেনি, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা পাকিস্তানী শাসনের সমর্থক বাঙালী বিত্তশালী ও সচ্ছল শ্ৰেণীকেও দুর্বল করে ফেলে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই কায়েমী স্বার্থের এই অনুপস্থিতি/দুর্বলতার প্রশ্ন ছাড়াও এই শ্রেণীর সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যাবশ্যক হিসাবে বিবেচিত আমলাতন্ত্রের পুঁজিবাদ-তোষণকারী ও দুর্নীতিপরায়ণ অংশের ক্ষমতা ও প্রভাব ছিল দুর্বল এবং সশস্ত্রবাহিনীর আয়তন ও ক্ষমতা ছিল সীমিত। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের উঠতি পুঁজিপতি ও বিত্তাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্তদের প্রভাব প্রবল হলেও, এই দলের মধ্য ও নিম্ন স্তরে, বিশেষত তরুণ অংশের মধ্যে, পুঁজিবাদী বিকাশের বিরুদ্ধবাদী অংশ ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির সাথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের দক্ষিণপন্থী অংশ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ব্যবধান এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, যখন দেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের জন্য আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করা বিশেষ দুরূহ ছিল না। এক্ষেত্রে বরং অপেক্ষাকৃত জটিল সমস্যা ছিল, ভাল ও মন্দের সংমিশ্রণে গঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক শোষণহীন আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠন কর্মসূচীর পিছনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং একটি ঐক্যবদ্ধ বহুদলীয় কমান্ডব্যবস্থার অধীনে এদের সৃজনশীল কর্মোদ্যমকে উৎসাহিত ও ব্যবহৃত করার।
এই অবস্থায় বাংলাদেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবনের দুরূহ কাজটি সম্পন্ন হতে পারত, একমাত্র মার্কিন সাহায্যের প্রভাব ও সমর্থনেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য সম্পদের বিশাল প্রয়োজন মার্কিন পণ্য ও অর্থ সাহায্যে বহুলাংশে সহজ হতে পারত। এই মার্কিন সাহায্যের কাঁধে ভর করে পুঁজিবাদী অথনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজ যাতে কেউ শুরু করতে না পারে, সেই সচেতনতা থেকে ১৯শে ডিসেম্বর বেতার বক্তৃতায় তাজউদ্দিন ঘোষণা করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য মার্কিন সাহায্য গ্রহণে আগ্রহী নয়। ২২শে ডিসেম্বর ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর বিমানবন্দরে এবং ২৩শে ডিসেম্বর ঢাকা সচিবালয়ের সমস্ত অফিসার ও কর্মচারীদের সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা–এই তিন মূল নীতির উপর ভিত্তি করে দেশকে গড়ে তোলা হবে। সচিবালয়ের বক্তৃতায় সরকারী প্রশাসনের সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই মুক্তিযুদ্ধে যারা প্রাণ দিয়েছেন, তারা সংগ্রাম করেছিলেন আইনের শাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সকল ধরনের শোষণ ও বৈষম্য চিরতরে বন্ধ করার জন্য এবং একমাত্র সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এদেশের সকল মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব।
তাজউদ্দিনের এই সকল ঘোষণা প্রায় সর্বাংশেই ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় ঘোষণাপত্রের অধীন। দেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মৌল রূপান্তরের জন্য ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ যে সব লক্ষ্য অর্জনের প্রতিশ্রুতি দেয়, সে সম্পর্কে দলীয় নেতৃবৃন্দের প্রভাবশালী একাংশের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। ‘৭০-এর নির্বাচনে জনসাধারণ বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগকে জয়যুক্ত করার পর সেগুলির বাস্তবায়ন ছিল স্বাধীন সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দলীয় নেতৃবৃন্দের দক্ষিণপন্থী অংশের সহযোগিতা যে সামান্যই পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে তাজউদ্দিনের কোন সংশয় ছিল না। কাজেই তিনি এই সব লক্ষ্য অর্জনের উপায় হিসাবে স্বাধীনতাসমর্থক রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যবোধকে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজে সংহত ও সক্রিয় করা এবং দেশের তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধ ও কার্যকর শক্তিতে রূপান্তরিত করার সংকল্প প্রকাশ করেন। ইতিপূর্বে ১৮ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা গণবাহিনীর সকল সদস্যের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেন। বাস্তব পরিস্থিতির আলোকে ঐ পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর ২৩শে ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সরকার তালিকাভুক্ত ও তালিকা-বহির্ভূত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই ঘোষণায় বলা হয়: ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মনে করেন যে মুক্তিবাহিনী এদেশের মেধার বৃহত্তম আধার, যার মধ্য থেকে এদেশের দ্রুত পুনর্গঠন এবং অবকাঠামো পুনঃস্থাপনের জন্য উৎসর্গিত নতুন নেতৃত্বের উদ্ভব সম্ভব। বাংলাদেশ সরকারের এ সঠিক ঘোষণার পাশাপাশি, মুক্তিযোদ্ধাসহ সকল অনিয়মিত অস্ত্রধারীর কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার করাও ছিল এ স্কীমের অন্যতম প্রধান অঘোষিত লক্ষ্য।
অস্ত্র তখন ছিল মূলত তিন ধরনের লোকের হাতে: (১) পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন আধা-সামরিক বাহিনী ও অসামরিক সমর্থক; (২) মুক্তিযোদ্ধা; এবং (৩) বিজয়কালীন স্বঘোষিত মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। এদের মধ্যে প্রথম গ্রুপের কাছ থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার অপেক্ষাকৃত সহজ প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানী সমর্থকরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেরাই অস্ত্র ফেলে দিয়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। যে সব জায়গায় এরা প্রতিরোধ কেন্দ্র গড়ে তোলে সেখান থেকে অস্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব বলে মনে হয় এবং অস্ত্রধারী পলাতকদের সাধারণ মানুষ চিহ্নিত করার সঙ্গে সঙ্গে বাকী অস্ত্রশস্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজ এগিয়ে চলে। দ্বিতীয় গ্রুপ অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যারা ভারতের ট্রেনিং শিবির থেকে এসেছিল তারা এবং তাদের জন্য সরবরাহকৃত অস্ত্র ছিল তালিকাভুক্ত। দেশের ভিতরে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের জন্য সরবরাহকৃত অস্ত্র এবং নেতৃত্ব পর্যায়ে তাদের পরিচয়, তাদের অধীনস্থ সদস্য সংখ্যা প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভরযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। অগণিত মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সংগ্রামী চরিত্রের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এক সফল মুক্তিযুদ্ধের অভিন্ন গৌরবদীপ্ত পটভূমিতে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করার যে সম্ভাবনা ছিল তার জন্য সঠিক রাজনৈতিক আবহাওয়া ও সাংগঠনিক কাঠামো সৃষ্টির পরিকল্পনা প্রয়োজনীয় চিন্তাভাবনার মাধ্যমেই সম্পন্ন করা হয়।
সমস্যা প্রধানত ছিল, স্বঘোষিত ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। এরা না ছিল রাজাকারদের মত পলায়নপর বা চিহ্নিত, না ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের মত তালিকাভুক্ত। তবু এদের জন্য জাতীয় মিলিশিয়াতে যোগদানের সুযোগ যদি উন্মুক্ত করা হয় তবে তাদের একাংশকে, সম্ভবত বৃহত্তর অংশকেই, জাতি গঠনের নবীন উদ্দীপনার মাঝে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা সম্ভব হবে-এই অনুমানের ভিত্তিতে সরকার সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। স্থির করা হয়, পূর্ণ রাজনৈতিক আস্থা সৃষ্টিকল্পে সকল দল, মত ও গ্রুপ নির্বিশেষে সকল মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে ‘জাতীয় মিলিশিয়া’ গঠন, সকল রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সংগঠন থেকে শুরু করে নিম্নতম ইউনিট পর্যন্ত বহুদলীয় কমান্ড গঠন, এই কমান্ডের অধীনে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি কর্তৃক গৃহীত জাতীয় পুনর্গঠন কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য ‘জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনীর নিয়োগ এবং তাদের বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি, তাদের পেশাগত বিকাশের সুযোগ, সামাজিক সম্মান, সুশৃঙ্খল বিকাশের জন্য পেশাগত নেতৃত্বকাঠামো ও অস্ত্রাগার প্রতিষ্ঠা-ইত্যাকার উপাদান ও আয়োজনের সমন্বয়ে জাতির স্বাধীনতা অর্জনকারী যুবশক্তিকে এক নতুন সমাজ গঠনের পুরোভাগে সংহত করা এবং এই উপায়ে জাতির অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করা সম্ভব।
জাতীয় মিলিশিয়ায় যোগদানের ক্ষেত্রে ‘মুজিব বাহিনী’র সম্ভাব্য বিরোধিতা দূর করার জন্য যে দিন মিলিশিয়া স্কীম ঘোষণা করা হয়, সে দিনই অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বর মেজর জেনারেল ওবানকে ঢাকা আনানো হয়। ‘মুজিব বাহিনী’র ভূমিকা যাতে নতুন স্বাধীনতার জন্য সহনীয় হয়, তদুদ্দেশ্যে বিলম্বে হলেও ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সহযোগিতার নিদর্শন তখন স্পষ্ট। ইতিপূর্বে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মণি গ্রুপের অগ্রাভিযানের পথ নির্ধারিত হওয়ায় ঢাকা পৌঁছাতে তাদের কিছু বিলম্ব হয় বটে। ততদিনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। ওবান ঢাকা পৌঁছানোর পর শেখ মণি এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন, অতঃপর ‘মুজিব বাহিনী’ নামে কোন স্বতন্ত্র বাহিনীর অস্তিত্ব থাকবে না। ২রা জানুয়ারী বাংলাদেশ সরকার যখন জাতীয় মিলিশিয়ার ১১ জন সদস্যের সমবায়ে জাতীয় নিয়ন্ত্রণ বোর্ড গঠন করেন, তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে একজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হলেও মুজিব বাহিনী’র দু’জন সদস্যকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই দিনে প্রকাশ করা হয় যে ইতিমধ্যেই প্রত্যেক জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের জরুরীভিত্তিতে জাতীয় মিলিশিয়া শিবির স্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে সর্বদলীয় কমান্ডকাঠামো গঠিত হতে শুরু করে। এই স্কীম বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মেজর জেনারেল বি. এন. সরকারকে কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
আওয়ামী লীগের ভিতরে যে উপদলীয় উত্তেজনা বিরাজমান ছিল, তার কিছু উপশম ঘটে ২৭শে ডিসেম্বর পাঁচজন নতুন মন্ত্রী নিয়োগের পর। এরা ছিলেন: আবদুস সামাদ আজাদ, ফণিভূষণ মজুমদার, জহুর আহমদ চৌধুরী, ইউসুফ আলী এবং শেখ আবদুল আজিজ। এদিকে বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খোন্দকার মোশতাক দেশ মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যথাসম্ভব সঠিক বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শুরু করেন।৬১ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ রক্ষা করতে পারেননি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই যাতে মন্ত্রিসভায় কোন বিভেদের ছাপ না পড়ে তজ্জন্য অবশ্য খোন্দকার মোশতাককে মন্ত্রী পদে বহাল রাখা হয়। ইতিপূর্বে ২১শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার আবুল ফতেহকে মাহবুব আলম চাষীর কাছ থেকে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা-সমর্থক দলগুলির মধ্যে ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ‘অন্তর্বর্তীকালীন সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে অতিশয় অধৈর্য হয়ে পড়লেও তাজউদ্দিন ‘৭০-এর নির্বাচনী রায় অনুযায়ী মন্ত্রিসভার দলীয় চরিত্র অক্ষুণ্ণ রাখার প্রশ্নে অটল থাকেন। কিন্তু সেই সঙ্গে জাতীয় পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তিনি অন্যান্য দলের সঙ্গে জাতীয় ঐক্যের কাঠামো সুদৃঢ় করে তুলতে শুরু করেন।
অংশত বাংলাদেশ সরকারের এই সব সঠিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে, অংশত ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচ্ছন্ন ও নিরপেক্ষ দৃঢ়তার ফলে এবং সর্বোপরি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাবার জন্য সাধারণ মানুষের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ফলে মন্ত্রিসভা ঢাকা প্রত্যাবর্তনের মাত্র সপ্তাহকালের মধ্যেই ঢাকা ও দেশের অন্যান্য অংশে পরিস্থিতির বিস্ময়কর উন্নতি ঘটে। শহরাঞ্চলে লুঠতরাজ, অপরাধমূলক কার্যকলাপ এবং হিংসাত্মক ঘটনার দ্রুত অবসান ঘটতে শুরু করে। স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই রাষ্ট্র শাসনের একটি সাধারণ ও সুপ্রাচীন নীতির যথার্থতা প্রমাণিত হয়-আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যদি নিরপেক্ষ দৃঢ়তায় আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম ও সতর্ক থাকে এবং তাদের কাজ যদি ঊধ্বর্তন হস্তক্ষেপে বিঘ্নিত না হয়, তবে সমাজ যত বড় অস্থিরতার মাঝেই নিক্ষিপ্ত হোক, তা পুনরায় বসবাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব।
অবস্থার এই ক্রমোন্নতি দৃষ্টে ২৭শে ডিসেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের গতিবেগ ত্বরান্বিত হয়। ঐ দিন জেনারেল মানেকশ ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ থেকে পঁচিশ হাজার সৈন্য ভারতে ফিরিয়ে নেওয়ার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে, আরও পঁচিশ হাজার সৈন্য ১৫ই জানুয়ারী নাগাদ ভারতে ফিরে যাবে এবং মোট সাত থেকে আট ডিভিশন সৈন্যের অবিশিষ্টাংশ আরও কিছুকাল বাংলাদেশে অবস্থান। করবে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় ডি. পি. ধরের উপস্থিতিকালে তাজউদ্দিন এবং ডি. পি. ধরের মধ্যে এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয় যে, শেখ মুজিবের মুক্তির সম্ভাবনাসহ আন্তর্জাতিক ঘটনাধারা ক্রমশ যেভাবে বাংলাদেশের অনুকূলে অগ্রসর হয়ে চলেছে, তার ফলে এবং বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনীকে দ্রুত সংগঠিত করার পরিকল্পনা কার্যকর করার পর আগামী দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে অবশিষ্ট ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এই লক্ষ্যে অর্থাৎ দেশের আইন ও শৃঙ্খলার দায়িত্ব বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর কাছে দ্রুত হস্তান্তরিত করার লক্ষ্যে এই সব বাহিনীর সমপ্রসারণের জন্য নতুন অফিসার প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজন ছিল জরুরী। এই উদ্দেশ্যে ২৬শে ডিসেম্বর বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা জাতীয় দেশরক্ষা একাডেমী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ থেকেও অনুমান করা চলে নতুন সরকারের দৃষ্টিতে দেশরক্ষা বাহিনীর সাংগঠনিক বিকাশ কি পরিমাণ অগ্রাধিকার পেয়েছিল।
একই দিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়। দেশের অর্থনৈতিক তৎপরতার পুনরুজ্জীবন বিশেষত শিল্প ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান পুনরায় সচল করার প্রচেষ্টা যাতে সফল এবং প্রতিশ্রুত নতুন সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়, তদুদ্দেশ্যে মন্ত্রিসভা কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থাদি প্রসঙ্গত স্মরণযোগ্য।
৩১শে ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা কেবলমাত্র পাকিস্তানী ব্যক্তিমালিকানাধীন কলকারখানা ও ব্যবসায়িক সংগঠনকে সরকারী মালিকানাধীনে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বাঙালী ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প ও ব্যবসায়িক সংগঠনকে এই সিদ্ধান্তের বাইরে রাখা হয়। পরিত্যক্ত কলকারখানা পুনরায় সচল করার জন্য নতুন ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠনের সদ্ধান্ত নেওয়া হয় একই দিনে। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে দেশের সমস্ত পরিত্যক্ত শিল্প ইউনিটকে মোট ছ’টি অঞ্চলে ভাগ করে প্রতিটি ইউনিটের পরিচালনার জন্য শিল্প দফতরের উপ-পরিচালক বা সহকারী পরিচালক, ঋণদানকারী ব্যাংকের প্রতিনিধি, মিল ব্যবস্থাপক, রেজিস্ট্রিকৃত শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং সরকার মনোনীত আর একজন সদস্যের সমবায়ে মোট পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠনের ব্যবস্থা ঘোষিত হয়। এই সব ব্যবস্থাপনা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রে স্পষ্টতই কোন রাজনৈতিক দল বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার প্রয়াস ছিল না। প্রধানত যে বিবেচনা থেকে এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয় তা ছিল: নতুন স্বাধীনতার উৎসাহ-উদ্দীপনার মাঝে শ্রমিক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে যদি ন্যায়নীতিভিত্তিক ও গঠনমূলক সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় তবে শিল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাঙালী ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের সংখ্যাল্পতাজনিত তীব্র সমস্যা দূর করার পাশাপাশি এই সব উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানার সামাজিকীকরণ ফলপ্রসূ করে তোলা সম্ভব। বস্তুত রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট আর্থ সামাজিক লক্ষ্য ঘোষণা এবং বাস্তবে তা কার্যকর করার জন্য দলীয় সঙ্কীর্ণতামুক্ত ও ন্যায়নীতিভিত্তিক প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার প্রতি তাজউদ্দিনের অবিচল নিষ্ঠাই নতুন সরকারের অন্তর্বর্তী শিল্প-ব্যবস্থাপনা নীতিতে প্রতিফলিত হয়। ৩১শে ডিসেম্বরে মন্ত্রিসভা ব্যাংকসমূহের প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারী থেকে ব্যাংকসমূহের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হয়। ব্যাংক ও ইনস্যুরেন্স কোম্পানীসমূহ জাতীয়করণ করা হয় ৭ই জানুয়ারী।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তৎপরতা পুনরুজ্জীবনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তার প্রয়োজন নিরূপণের জন্য ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল ঢাকা ছ’দিন ধরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশদ আলাপ-আলোচনা চালান। এই সব আলাপ-আলোচনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য যথাশীঘ্র সচল করা এবং এই উদ্দেশ্যে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয় মুখ্য স্থান অধিকার করে। একই সময়ে বাংলাদেশ সরকার ও সোভিয়েট বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের মধ্যে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় উভয় দেশের মধ্যে অবিলম্বে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য শুরু করার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইত্যবসরে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্মোপযোগী করে তোলা এবং নিমজ্জিত নৌযান ও ভাসমান মাইন পরিষ্কার করে বঙ্গোপসাগরের অবরুদ্ধ নৌপথগুলি উন্মুক্ত করার কাজ পাকিস্তানের পরাজয় বরণের পর দিন থেকেই জরুরীভিত্তিতে অগ্রসর হয়ে চলছিল। ফলে ১লা জানুয়ারী নাগাদ চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের মাল ওঠানো-নামানোর ক্ষমতা শতকরা ৮০ ভাগ পুনঃস্থাপিত হয় এবং এই বন্দর কুড়ি ফিট গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ চলাচলের উপযোগী হয়।
আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সাধিত অগ্রগতিও নগণ্য ছিল না। ২৫শে মার্চের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত মোট ২৪৭টি ছোট-বড় রেলওয়ে ব্রীজের মধ্যে ১৯৪টি ব্রীজের মেরামত সম্পন্ন হওয়ায় ৩রা জানুয়ারী নাগাদ তেইশটি সেকশনে রেল সার্ভিস পুনরায় চালু হয়; যদিও বড় ব্রীজগুলির মেরামত সম্পন্ন হওয়ার জন্য আরও ছ’মাসের মত সময়ের প্রয়োজন বলে সরকারী সূত্রে প্রকাশ করা হয়। একই সূত্র থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মোট ৩১৮টি সড়ক ব্রীজ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অস্থায়ী সংযোগ ও বিকল্প পথের সাহায্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট এবং ঢাকা উত্তরবঙ্গে সড়ক যোগাযোগ মোটামুটিভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সব কটি জেলার মধ্যে ডাক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় ৩রা জানুয়ারী থেকে।
প্রায় ন’মাস দীর্ঘ এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর মন্ত্রিসভা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, নতুন রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, পূর্বতন অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র থেকে সর্বাংশে বিচ্ছিন্ন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার ক্ষেত্রে এবং একই সঙ্গে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচলিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মৌলিক সংস্কার সাধনের জন্য যে সমুদয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে বাস্তব সাফল্য সূচিত হয়-তদ্রূপ দৃষ্টান্ত নিতান্তই বিরল। তৎসত্ত্বেও এই সব উদ্যোগ জনমানসে প্রত্যাশিত উদ্দীপনা সৃষ্টিতে অসফল হয়। এর কারণ ছিল একাধিক। প্রথমত, পাকিস্তানী অত্যাচার ও দখল অবসানের পর বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ তাদের পুনর্বাসন ও জীবিকার সমস্যায় এতবেশী ভারাক্রান্ত ছিল যে অন্য কোন বিষয়ের প্রতি তাদের দৃকপাত করার সময় ছিল না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রভাবশালী-সম্ভবত বৃহত্তর অংশই ছিলেন বহুদলীয় ঐক্যভিত্তিক আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার মৌল রূপান্তর কর্মসূচীর বিপক্ষে-পন্থা ও লক্ষ্য উভয় সম্পর্কেই এদের আপত্তি ছিল সুগভীর। তা ছাড়া নবাৰ্জিত রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর গোষ্ঠী ও দলগত ক্ষমতা বিস্তারের পক্ষে এদের ইচ্ছা এতই প্রবল ছিল যে, তাজউদ্দিনের প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার নীতি রদ করার জন্য এদের বিরুদ্ধতা বৃদ্ধি পেয়ে চলে। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা তো বটেই দেশের সাধারণ মানুষ উদগ্রীব হয়ে ছিল শেখ মুজিবের প্রত্যাসন্ন মুক্তি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রতিক্ষায়। অংশত এই কারণেও অনেকের কাছে তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভার এই সব পদক্ষেপের মূল্য অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার অধিক কিছু ছিল না। অথচ তাজউদ্দিন অবিচল নিষ্ঠায় ১৯৭০ সালে প্রদত্ত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাষ্ট্রীয় নীতি ও সরকারী কার্যক্রম প্রণয়ন করে চলেন। একই সঙ্গে সরকারের কতিপয় আর্থ-সামাজিক কর্মসূচী বাস্তবায়নের পন্থা হিসাবে তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে অর্জিত অভিজ্ঞতা ও বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কাঠামো সদ্ব্যবহারে উদ্যোগী হন।
ওদিকে ভুট্টো পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ মুজিবের মুক্তির প্রশ্নকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করার উপাদান হিসাবে ব্যবহার করার কাজে উদ্যোগী হলেও তিনি এবং তার পাশ্চাত্য পৃষ্ঠপোষকগণ অচিরেই এই উদ্যোগের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেন। ৩রা জানুয়ারী করাচীতে আহুত এক বিশাল জনসভায় প্রেসিডেন্ট ভুট্টো উপস্থিত শ্রোতাদের উদ্দেশে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি যদি শেখ মুজিবকে ‘শর্তহীনভাবে মুক্তি দেন, তবে তারা তা অনুমোদন করবে কি না। সমবেত জনতা সমস্বরে তা সমর্থন করে। ৮ই জানুয়ারী রাওয়ালপিন্ডির বিমানবন্দরে ভোর তিনটায় ভুট্টো শেখ মুজিবকে বিদায় জ্ঞাপন করেন। ঐ দিন সকালে শেখ মুজিব লন্ডনে পৌঁছান।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রায় এক পক্ষকাল ধরে ভুট্টো মার্কিন অভিপ্রায় অনুযায়ী বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাখার যত চেষ্টাই চালিয়ে থাকুন, লন্ডনে পৌঁছানোর পর শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি নিজের সমর্থন ঘোষণা করেন। লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের সঙ্গে আলোচনা এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে দিল্লীতে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা লাভের পর ১০ জানুয়ারী ঢাকায় পৌঁছেই রেসকোর্সের হর্ষোৎফুল বিশাল জনসমুদ্রের সম্মুখে শেখ মুজিব ভুট্টোকে উদ্দেশ করে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অপরিবর্তনীয়, পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বতন সম্পর্ক আর পুনঃপ্রতিষ্ঠার নয়।
এরপর মূল রাজনৈতিক প্রশ্ন ছিল বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব পুনর্নির্ধারণের। ১১ই জানুয়ারী সকালে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিন প্রথম এ বিষয়ে একান্ত আলাপে প্রবৃত্ত হন। এতদিন শেখ মুজিব ছিলেন রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী। পার্লামেন্টারী ব্যবস্থায় সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কোন কার্যকরী ক্ষমতা নেই। সরকার পরিচালনার সর্বপ্রধান ভূমিকা শেখ মুজিব পালন করেন, তা-ই ছিল অধিকাংশ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের ঐকান্তিক কামনা। তাদের এই ইচ্ছার কথা উভয় নেতাই অবগত ছিলেন। কাজেই সরকার পরিচালনার মূল দায়িত্ব শেখ মুজিবের কাছে হস্তান্তরিত করার বিষয়টি স্বল্প আলোচনার মাধ্যমেই স্থির হয়। অবশ্য আলোচনার শুরুতে শেখ মুজিব প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে নিজের মত প্রকাশ করেন। তাজউদ্দিন তখন জানান, পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আওয়ামী লীগের বাইশ বৎসরের দাবী সহসা বাতিল করে প্রেসিডেন্সিয়াল ব্যবস্থা প্রবর্তনের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়; কাজেই এদেশে পার্লামেন্টারী শাসন ব্যবস্থাই গড়ে তুলতে হবে এবং সে গড়ে তোলার দায়িত্ব শেখ মুজিবকেই পালন করতে হবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, ১৯৭০ সালে দেশবাসী বিপুল ভোটে সে রায়ই জ্ঞাপন করেছিল; মাঝখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমণ শুরু করার পর দেশের সেই দুর্যোগকালে রাজনৈতিক কর্তব্যবোধ থেকে তিনি নিজে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন মাত্র।
বাইরে অপেক্ষমাণ অসংখ্য দর্শনার্থীর অধৈর্য ভিড়। সকাল দশটায় আহূত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যোগদানের তাড়া। ফলে দু’জনের আলোচনা আর এগুতে পারেনি। তাজউদ্দিন জানান তার আরও কিছু জরুরী কথা বলার ছিল–মুক্তিযুদ্ধের এই সাড়ে ন’মাসে কোথায় কি ঘটেছে, কোন নীতি ও কৌশলের অবলম্বনে, কোন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে এই রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কি পরিবর্তন ঘটেছে দেশবাসীর মনোজগতে, তরুণদের প্রত্যাশা ও মূল্যবোধে। কেননা এ সব কিছুর মাঝেই নিহিত ছিল দেশের পরবর্তী সংগ্রামের, তথা, দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে সংহত ও স্থিতিশীল করার এবং সাধারণ দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াইকে সাফল্যমণ্ডিত করার মূলসূত্র। কিন্তু তখন এ সব কিছু আলোচনার সময় ছিল না। পরেও কখনো সে সুযোগ তাজউদ্দিনের ঘটে ওঠেনি।
তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একটি সবল জাতি গঠনের জন্য যে বহুদলীয় ঐক্যের কাঠামো গঠন, দেশের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থার সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সকল মুক্তিযোদ্ধা তথা তরুণ সমাজকে একত্রিত ও উদ্দীপ্ত করার আয়োজন এবং সাহায্যের আবরণে দেশকে আশ্রিত পুঁজিবাদের দিকে নিয়ে যাবার সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক প্রয়াস প্রতিহত করার জন্য সাহায্য নির্ভরশীলতা সীমিতকরণের যে সব নীতিমালা তৈরী করেছিলেন, তা অচিরেই পরিত্যক্ত হয়। নির্মীয়মাণ বহুদলীয় জাতীয় ঐক্যকাঠামোর পরিবর্তে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ দলীয় শাসন প্রবর্তন, আর্থ-সামাজিক মৌল রূপান্তরের প্রধান শক্তি হিসাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিবর্তে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাদের কেবল অনুগত অংশের সমবায়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন, এবং দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের জন্য সরাসরি মার্কিন সাহায্য গ্রহণের নীতি মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে গৃহীত হয়। নতুন নেতৃত্বের নিজস্ব প্রয়োজন ও উপলব্ধি অনুযায়ী রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকাশ ও ব্যবহার চলল এগিয়ে। সে ইতিবৃত্ত অন্য এক সময়ের, অন্য এক রাজনৈতিক পর্বের।
পাঠে ঋদ্ধ হলাম