অধ্যায় ২১: ডিসেম্বর
৩রা ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি ঘোষণা করেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ২৩শে নভেম্বর দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ইয়াহিয়ার যে বাসনা ব্যক্ত হয়েছিল এবং ঐ একই দিনে তাজউদ্দিন তার বেতার বক্তৃতায় ঘটনা-বিকাশের যদ্রুপ সম্ভাবনা উল্লেখ করেছিলেন, অবশেষে সেইভাবেই মুক্তিযুদ্ধের শেষ অংকের শুরু হয়। ৪ঠা ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এক জরুরী লিপিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানান, পাকিস্তানের সর্বশেষ আক্রমণের সমুচিত জবাব প্রদানে ভারতীয় বাহিনী এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মিলিত ভূমিকা সফলতর হতে পারে, যদি এই দুটি দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত ও বাংলাদেশ স্থলবাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত, ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চরিত্র ৪ঠা ডিসেম্বর থেকেই আমূল পরিবর্তিত হয়।
পূর্ববর্তী সাত সপ্তাহ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতা এবং ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর তীব্রতর সীমান্ত চাপের ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই পাকিস্তানী বাহিনী বিরামহীন তৎপরতার দরুন পরিশ্রান্ত, বৈরী পরিবেশ ও অতর্কিত গোপন আক্রমণের ভয়ে শঙ্কিত, দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত হওয়ার ফলে দুর্বল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে খণ্ড-বিখণ্ডিত এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সামরিক সাফল্যের অভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল। সাত সপ্তাহ ধরে সংঘর্ষের পরিসর ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া সত্ত্বেও এর পরিণতি ও লক্ষ্য সম্পর্কে পাকিস্তানী নেতৃত্বের উপলব্ধি ছিল ভ্রান্ত, তাদের প্রতিরক্ষার কৌশল ছিল অবাস্তব, বিমান ও নৌশক্তির সামর্থ্য ছিল নগণ্য এবং নেতৃত্বের পেশাগত মান নিম্ন। দখলদার সৈন্যদের যুদ্ধ-পরিশ্রান্ত ও হতোদ্যম করে তোলার পর মুক্তিবাহিনীর আট মাস দীর্ঘ সংগ্রামকে চূড়ান্তভাবে জয়যুক্ত করার লক্ষ্যে ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি
অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-নোয়াখালী অভিমুখে; (২) উত্তরাঞ্চল থেকে দু ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৩৩তম কোর রংপুর-দিনাজপুর-বগুড়া অভিমুখে; (৩) পশ্চিমাঞ্চল থেকে দু ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ২য় কোর যশোর-খুলনা-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর অভিমুখে; এবং (৪) মেঘালয় রাজ্যের তুরা থেকে ডিভিশন অপেক্ষা কম আর একটি বাহিনী জামালপুর-ময়মনসিংহ অভিমুখে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতের বিমান ও নৌশক্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচ্ছন্ন কিন্তু সদা-তৎপর সহযোগিতা এবং স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত সাহায্য ও সক্রিয় সহযোগিতা। এই সমুদয় শক্তির সংমিশ্রণ ও সহযোগিতায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী আধিপত্য স্বল্প সময়ের মধ্যে বিলোপ করার যথেষ্ট ছিল। বস্তুত যুদ্ধারম্ভের সঙ্গে সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর বিজয় সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ কোন মহলেই ছিল না।
পাকিস্তানের উচ্চতর নেতৃত্বের মধ্যেও এ বিষয়ে সংশয় থাকার কোন যুক্তি ছিল না; তৎসত্ত্বেও ৩রা ডিসেম্বর তারাই সংঘর্ষ সম্প্রসারণে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করে। যেভাবেই হোক ইয়াহিয়াচক্রের মাঝে এ বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধকল্পে তার সামরিক শক্তির সম্ভার নিয়ে যুদ্ধবিরতি এবং পূর্বতন স্থিতাবস্থা কায়েম করার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। কার্যক্ষেত্রেও ঘটেছিল তাই। ফলে মার্কিন প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার জন্য পাল্টা আন্তর্জাতিক শক্তির সমাবেশ অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। এইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষ অংকে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত শক্তির প্রত্যাশিত বিজয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে মার্কিন প্রশাসন সৃষ্ট বিশ্ব ভূরাজনৈতিক সংঘাতের ফলে। ৪ঠা ডিসেম্বর বাংলাদেশের রণাঙ্গনে কোন বড় অগ্রগতি ঘটার আগেই ওয়াশিংটনে WSAG-এর বৈঠকে কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের আহূত অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী সম্বলিত মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার জন্য এমনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে, এ ব্যাপারে পাশ্চাত্য মিত্ররাষ্ট্রসমূহের সঙ্গেও আলোচনার কোন সময় তাদের ছিল না। এই ব্যস্ততা ছিল কিসিঞ্জারের নিজের ভাষায়, তাদের ‘বৃহত্তর রণনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট’। WSAG-এর বৈঠকে মার্কিন জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ’ (JCS)-এর পক্ষে এ্যাডমিরাল জুমওয়াল্ট পাকিস্তানের সামরিক সরবরাহ পরিস্থিতি এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যেই সঙ্গীন হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করায় কিসিঞ্জারের ব্যস্ততার কারণ স্পষ্টতর হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ‘উচ্চতর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত এক প্রকাশ্য বিবৃতিতে উপমহাদেশের সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করেন। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমান্তের ভিতরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু এই প্রস্তাবে সমস্যার মূল কারণ তথা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের উপর দীর্ঘ নির্যাতন এবং তার ফলে সৃষ্ট শরণার্থীর ভিড় ও সমস্যা জর্জরিত ভারতের অবস্থা বিবেচনা না করে ভারত ও পাকিস্তানকে একই মানদণ্ডে বিচার করায় সোভিয়েট প্রতিনিধি এই প্রস্তাবকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করেন। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোট দানে বিরত থাকে।
পরদিন ৫ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েট ইউনিয়ন এক প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, পাক-বাহিনীর যে সহিংসতার দরুন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তাও অবলিম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন বাদে পরিষদের অন্য সকল সদস্য ভোটদানে বিরত থাকে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। চল্লিশ দিন আগে জাতিসংঘের সদস্যপদ এবং নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের আসন লাভের পর একটিই ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রথম ভেটো। ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এই প্রস্তাবের মর্ম পূর্ববর্তী মার্কিন প্রস্তাবের অনুরূপ হওয়ায় সোভিয়েট ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়োগ করে।
একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েট সরকার উপমহাদেশের যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানকে সর্বাংশে দায়ী করেন, ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবী জানান, এই সংঘর্ষ সোভিয়েট সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায় এর সঙ্গে সোভিয়েট নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, বলে উল্লেখ করেন এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। উপমহাদেশের সংঘর্ষে পাকিস্তানের সহায়তায় তার মিত্রদ্বয় কি ব্যবস্থা নিতে পারে, স্পষ্টতই তার সঠিক উপলব্ধির ভিত্তিতে এই সোভিয়েট বিবৃতি প্রচারিত হয়েছিল।
৬ই ডিসেম্বরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জ্ঞাপিত হয় বাংলাদেশ সম্পর্কে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত কূটনৈতিক স্বীকৃতি। একই দিনে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের বিমান তৎপরতার ক্ষমতা লুপ্ত হওয়ার ফলে স্থলভূমিতে পাকিস্তানী বাহিনীর অপরিসীম চাপের সম্মুখীন হয়। ৬ই ডিসেম্বর থেকেই পাকিস্তানের সৈন্যরা ঢাকা ও সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলের দিকে পশ্চাদপসরণ শুরু করে। ঐ দিন WSAG-এর বৈঠকে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (CIA) প্রধান রিচার্ড হেলসের সমীক্ষায় বলা হয়, দশ দিনের মধ্যে ভারতীয় বাহিনী পূর্বাঞ্চলে এক চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হবে। মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর সৈন্যাধ্যক্ষমণ্ডলী (JCS)-এর পক্ষে উপস্থিত জেনারেল ওয়েস্টমোরল্যান্ড বরং পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের প্রতিরোধের মেয়াদ তিন সপ্তাহ অবধি স্থায়ী হতে পারে বলে অভিমত দেন। এর পরই শুরু হয় সামরিক হস্তক্ষেপের অনুক্ত পরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে কিসিঞ্জারের সুচিন্তিত প্রশ্নমালা: পূর্ব পাকিস্তানের বিহারীদের হত্যা করা শুরু হয়েছে কি না, এই আসন্ন রক্তপাত বন্ধের উপায় কি, যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা সে দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে কি না, ভারতের নৌঅবরোধ বেআইনী কি না এবং তার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের খসড়া শীঘ্র তৈরী করা যাবে কি না, জর্ডান ও সৌদী আরব থেকে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র পাঠানোর পথে যুক্তরাষ্ট্রের আইনে কোন বাধা আছে। কি না, যদি থাকেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেহেতু পাকিস্তানের পরাজয় রোধ করতে চান, সেহেতু এই বাধাগুলি অপসারণের উপায় কি, ইত্যাদি। সংক্ষেপে, সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে সম্ভাব্য যুক্তি ও উপায় অন্বেষণই ছিল ৬ই ডিসেম্বরের WSAG বৈঠকের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দিক। পাশাপাশি শুরু হয় বাংলাদেশে পাকিস্তানের আসন্ন পরাজয় রোধ করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তীব্র কূটনৈতিক চাপ। প্রেসিডেন্ট নিক্সন সোভিয়েট নেতা ব্রেজনেভের কাছে প্রেরিত এক জরুরী বার্তায় জানান, সোভিয়েট ইউনিয়ন যদি পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য ভারতকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় না করে তবে পরবর্তী মে মাসে প্রস্তাবিত রুশ-মার্কিন শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়া সরাসরি ভারতের উপর জাতিসংঘের চাপ প্রয়োগ করার জন্য মার্কিন প্রশাসন ‘Uniting for Peace’ ধারার অধীনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাবার জন্য তৎপর হন।
৭ই ডিসেম্বরে নিয়াজীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ‘দুর্গ’ যশোরের পতন ঘটে। ভারতের ৯ম ডিভিশন ঐ দিন এক রক্তাক্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে যশোর সেনাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হয়ে দেখতে পায়, বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ ভর্তি সুরক্ষিত বাঙ্কার সম্পূর্ণ জনশূন্য। পাকিস্তানের ‘বীর মুজাহিদ’ চার ব্যাটালিয়ান সৈন্যের এইরূপ অকস্মাৎ অন্তর্ধানে দেশের পশ্চিমাঞ্চল কার্যত মুক্ত হয়। যশোর থেকে ঢাকা অথবা খুলনার দিকে বিক্ষিপ্ত পলায়নপর পাকিস্তানী সৈন্যরাই অন্যান্য স্থানে স্বপক্ষীয় সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে; দু-তিনটি স্থান বাদে সর্বত্রই পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষার আয়োজনে ধস নামে। ৭ই ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনী সিলেটে হেলিকপ্টার যোগে অবতরণ করার পর মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় সিলেট শহর মুক্ত করে। ঝিনাইদহ ও মৌলভীবাজারও মুক্ত হয় একই দিনে। ভারতীয় বেতার কেন্দ্র থেকে পাকিস্তানী জওয়ান ও অফিসারদের উদ্দেশে শুরু হয় ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র মনস্তাত্ত্বিক অভিযান: বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবার আগে বরং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণই পাকিস্তানীদের জন্য অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।
যশোরের পতন পাকিস্তানের সামরিক প্রতিষ্ঠানের মূল কেন্দ্রকে নাড়া দেয় প্রবলভাবে। সাত তারিখেই গভর্নর আবদুল মালেক পূর্বাঞ্চলের সৈন্যাধ্যক্ষ লে. জে. নিয়াজীর অভিমত উদ্ধৃত করে এক দুর্গত বার্তায় ইয়াহিয়াকে জানান, যশোরের বিপর্যয়ের ফলে প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের পতন প্রায় সম্পন্ন এবং মেঘনার পূর্বদিকের পতনও কেবল সময়ের প্রশ্ন; এই অবস্থায় ‘আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি প্রতিশ্রুত বৈদেশিক সামরিক সহায়তা না পৌঁছায়’ তবে জীবন রক্ষার জন্য বরং ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনা শুরু করা বাঞ্ছনীয়। গভর্নর মালেকের এই দুর্গত বার্তা ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষের জন্য আরও বেশী দুর্ভাগ্যজনক ছিল এ কারণে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের দিকে তাদের আকাঙ্ক্ষিত অগ্রাভিযান তখনও কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পারেনি, একমাত্র ছম্ব এলাকায় কিছু অগ্রগতি ছাড়া। উত্তর পশ্চিম ভারতের কোন বড় বা মাঝারি ভূখণ্ড দখল করার আগেই পূর্ব বাংলায় তাদের সামরিক নেতৃত্ব যদি আত্মসমর্পণের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ে তবে সমূহ বিপর্যয়। কাজেই মালেকের দুর্গত বার্তা ঐ সন্ধ্যাতেই ‘হোয়াইট হাউসে’ পৌঁছানো হয় সম্ভবত অবিলম্বে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য মালেকের আবেদনকে আকুলতর করেই। পাকিস্তান যাতে পূর্বাঞ্চলে পরাজিত না হয় তদমর্মে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পেন্টাগণের সুপারিশ কিসিঞ্জারের কাছে পৌঁছানোর কথা ছিল ঐ দিনই। ফজল মুকীম খানের বর্ণনা অনুসারে এরও দু’দিন আগে অর্থাৎ ৫ই ডিসেম্বর থেকে নিয়াজীর মনোবল ঠিক রাখার জন্য পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি আবদুল হামিদ আসন্ন চীনা হস্তক্ষেপের সংবাদ নিয়াজীকে দিয়ে চলেছিল। উত্তরের গিরিপথের প্রায় সব কটিই তখনও বরফমুক্ত। কিন্তু সিংকিয়াং সীমান্তে সোভিয়েট স্থল ও বিমানবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির তাৎপর্য চীনের জন্য উপক্ষেণীয় ছিল না।
নিক্সন প্রশাসনের জন্যেও সমস্যা তখন কম নয়। বস্তুত পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা মার্কিন জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য করানো তখন এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। কি। মানবিকতার যুক্তিতে, কি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা থেকে, মার্কিন প্রশাসনের পাকিস্তান নীতি নিয়ে মার্কিন গণপ্রতিনিধি ও সংবাদমাধ্যমগুলির সমালোচনা তখন তুঙ্গে। মার্কিন সিনেটে এবং হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভে ডেমোক্র্যাট দলীয় কোন কোন সদস্য পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যা, নির্যাতন ও মানবতাবিরোধী নীতির প্রতি মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন এবং জাতিসংঘের বিলম্বিত ও একদেশদর্শী ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। মানবতাবাদী কারণ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরেট জাতীয় স্বার্থের হিসাব-নিকাশ থেকে উপমহাদেশের সংঘর্ষের জন্য ভারতকে এককভাবে দোষী করা, ভারতের উন্নয়ন বরাদ্দ বন্ধ করা প্রভৃতি বিষয়ে মার্কিন সরকারের গৃহীত ব্যবস্থার যৌক্তিকতা সম্পর্কে মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলি নানা প্রশ্ন তোলে। জনমতের এই প্রচণ্ড বিরুদ্ধতা দৃষ্টে ৭ই ডিসেম্বর কিসিঞ্জার নিজেই এক অজ্ঞাতনামা ‘সরকারী মুখপাত্র’ হিসাবে আস্থাভাজন কিছু সাংবাদিকদের কাছে পরিবেশিত এক সমীক্ষার দ্বারা মার্কিন জনমত পরিবর্তনের চেষ্টা করেন।
কিসিঞ্জারের এই বেনামী সমীক্ষা মার্কিন জনমতকে পরদিন কতটুকু বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হত তা অজ্ঞাত থাকলেও, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ উপমহাদেশের যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে সে দিন যে রায় দেন, তা-ই মার্কিন সরকারের পরবর্তী কার্যক্রমের প্রধান মূলধনে পরিণত হয়। সাধারণ পরিষদ ৭ই ডিসেম্বর রাত্রিতে-উপমহাদেশে তখন ৮ই ডিসেম্বর-অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি, উভয় পক্ষের সৈন্য প্রত্যাহার এবং শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের জন্য রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান সম্বলিত এক প্রস্তাব ১০৪-১১ ভোটে গ্রহণ করে। প্রত্যেক বক্তার জন্য সর্বাধিক দশ মিনিট বরাদ্দ করে উপমহাদেশের এই অত্যন্ত জটিল বিষয়কে অসম্ভব তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে সাধারণ পরিষদে আলোচনা করার ফলে অধিকাংশ সদস্য দেশের জন্যই বাহ্যত যুক্তিসঙ্গত এই প্রস্তাবের প্রকৃত মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জন্যই অভ্যন্তরীণ আঞ্চলিক অসন্তোষ এবং বিবদমান প্রতিবেশীর উপস্থিতি এক সাধারণ সমস্যা। ফলে বিপুল ভোটাধিক্যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। সোভিয়েট ইউনিয়ন, সমাজতন্ত্রী কয়েকটি দেশ, ভারত এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানকারী দ্বিতীয় দেশ ভুটান বাংলাদেশের অভ্যুদয় রোধ করার জন্য এই আন্তর্জাতিক কূটবুদ্ধির বিজয়ের মুখেও অটল থাকে। উপমহাদেশের। সংঘাতের জটিলতা সম্পর্কে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উপলব্ধি অপেক্ষাকৃত গভীর ছিল বলে মার্কিন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই দুই দেশ এবং আরো আটটি দেশ ভোট দানে বিরত থাকে।
৮ই ডিসেম্বরের রণক্ষেত্রের অবস্থা পাকিস্তানের জন্য আরও শোচনীয়। পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের মূল ভরসার স্থল ছম্বে উপর্যুপরি চেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের অগ্রগতি প্রায় থেমে যায়। অন্যত্রও অবস্থা বেশ খারাপ। রাজস্থান-সিন্ধু সীমান্তে বরং ভারতের প্রাধান্যই পরিলক্ষিত হয়, করাচীর উপর ভারতীয় নৌ ও বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের অবস্থা ক্রমেই সঙ্গীন–যশোরের মত ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকেও পাক সৈন্যরা পালিয়ে আসে। কুমিল্লার এক অংশের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং অন্য অংশের পাশ কাটিয়ে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনী এগুতে থাকে। কিন্তু পাক বাহিনী এই পশ্চাদপসরণের পর ঢাকার চারপাশে নিজেদের অবস্থানকে পুনর্গঠিত করতে সক্ষম হবে কিনা, তা তখনও অজ্ঞাত। সংক্ষেপে, পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের কোন অগ্রগতি নেই; আর পূর্বে কেবল পশ্চাৎগতি। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের সম্যক বিপর্যয় দৃষ্টে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্তারা নিয়াজীর মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য ‘চীনের তৎপরতা শুরু হয়েছে বলে তাকে জানায়। এহেন শোচনীয় সামরিক পরিস্থিতির মাঝে ইয়াহিয়া খান বেসামরিক প্রতিনিধিদের হাতে তার শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের দীর্ঘ দিনের ‘ওয়াদা’ বাস্তবায়িত করতে শুরু করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে নুরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। অন্যত্র ভারতে একই দিন অর্থাৎ ৮ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় সর্বশেষ সামরিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থতির আলোকে ভারতের সরকারী মুখপাত্র ঘোষণা করেন, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবে অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে; বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই কোন ভূখণ্ড দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই।
এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে ওয়াশিংটন সময় সকাল এগারটায় যখন WSAG-এর বৈঠক শুরু হয়, তখন JCS-এর জেনারেল রায়ান উপমহাদেশের সর্বশেষ সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন যে, পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর জোর এগুবার কোন লক্ষণ নেই, বরং পাকিস্তানের অগ্রাভিযান ঠেকিয়ে রেখেই তারা সন্তষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু WSAG-এর সভাপতি হেনরী কিসিঞ্জার রায়ানের কাছে জানতে চান পূর্ব রণাঙ্গন থেকে ভারতীয় সৈন্যদের পশ্চিম রণাঙ্গনে নিয়ে যেতে কত সময় লাগতে পারে। জেনারেল রায়ান জানান, বেশ কিছু দিন; তবে বিমানবাহিত ব্রিগেড তাড়াতাড়িই নিয়ে যাওয়া সম্ভব, পাঁচ বা ছ’দিনের মধ্যেই। তৎসত্ত্বেও এক সম্পূর্ণ নতুন আশঙ্কার অবতারণা করে কিসিঞ্জার বলেন, “মূল প্রশ্ন হল ভারত যদি আজাদ কাশ্মীর দখলের চেষ্টা চালায় এবং পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর ধ্বংস সাধনে প্রবৃত্ত হয়, তবে তা হবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের ইচ্ছাকৃত উদ্যোগ। কিসিঞ্জার অতঃপর আবেগময় ভাষায় সমবেতদের জিজ্ঞাসা করেন, এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের এক মিত্রকে সম্পূর্ণ পরাভূত হতে দিতে এবং পাকিস্তানকে ‘প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রদান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে নিবৃত্ত রাখার জন্য ভারত যদি ভয় দেখায় তা কি আমরা মেনে নিতে পারি? স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধি সিস্কো বলেই বসেন, ভারতের এমনতর অভিপ্রায় রয়েছে কি না তা সন্দেহজনক। তথাপি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য সামরিক সরবরাহ নিশ্চিত করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন। সঙ্গে সঙ্গে আক্ষেপ করে বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সব কিছুই আমরা করেছি, কিন্তু সবই দু’সপ্তাহ বিলম্বে’।
কিসিঞ্জার তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আজাদ কাশ্মীর দখল এবং পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনী ধ্বংসের ব্যাপারে ভারতের অভিপ্রায়-সংক্রান্ত তথ্য সিআইএ-র এমন এক সূত্র কর্তৃক সংগৃহীত যে এর সত্যতা সম্পর্কে তাদের কোন সন্দেহ ছিল না।বাংলাদেশকে মুক্ত করার পর সেখান থেকে ভারতীয় বাহিনীর একাংশ পশ্চিমের রণাঙ্গনে স্থানান্তরিত করে কথিত লক্ষ্য অর্জনের বাসনা পোষণ ভারতীয় নেতৃত্বের একাংশের পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে বিশেষত ৭-৮ই ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদের ভোটে জোট-নিরপেক্ষ সমস্ত দেশের মধ্যে একমাত্র ভুটানের সমর্থন লাভ করার পর, এই বাসনা যে আর বাস্তবধর্মী নয় সে কথা ভারতের নীতিনির্ধারকদের কোন অংশের কাছেই অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। পক্ষান্তরে, ভারতের এহেন চাঞ্চল্যকর উদ্যোগের উদঘাটন ব্যতীত সাধারণ পরিষদের ভোট এবং কিসিঞ্জারের বেনামী সমীক্ষা সত্ত্বেও মার্কিন জনমতের বিরুদ্ধতা অকিক্রম করে সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে তখনও দুরূহ। এই তথ্যের সূত্র ও নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে ভ্যান হোলেন তার ১৯৮০ সালের প্রবন্ধে যে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেছেন, তা থেকে জানা যায়, সিআইএ-র এই সূত্রটিই আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য প্রণীত এক ‘গোপন সমীক্ষায়’ দাবী করেছিল যে, মৈত্রীচুক্তির ফলে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভারতকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা প্রদান থেকে নিবৃত্ত করবে। স্মরণযোগ্য যে, আগস্ট মাসের এই উদ্দেশ্যমূলক সমীক্ষা নিউইয়র্ক টাইমসে ‘ফাঁস’ হওয়ার পর ভারতের দক্ষিণপন্থী দলসমূহ এবং আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী অংশ একযোগে ভারত-সোভিয়েট চুক্তির বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও আন্দোলন শুরু করে।
সেই একই সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানের বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর ধ্বংস সাধন পাকিস্তানী কাশ্মীর দখলের জন্য ভারতীয় অভিসন্ধির অভিযোগ আনার পর ৯ই ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নিক্সন অপেক্ষমাণ মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা হওয়ার নির্দেশ দেন। ‘প্রত্যাসন্ন হামলা’ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষার করার জন্য সপ্তম নৌবহরকে পাঠানো হয় করাচীর সন্নিকটে আরব সাগরে নয়, বরং তার প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পূর্বে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে। এবং এই মহৎ দায়িত্ব পালনের জন্য কথিত ভারতীয় প্রচেষ্টা উদঘাটিত হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ আগেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় সপ্তম নৌবহরের এখতিয়ার বঙ্গোপসাগর অবধি সম্প্রসারিত করা হয়। ঘটনার ও ব্যাখ্যার এই সব অসঙ্গতি বৃহত্তর যুদ্ধের ডামাডোলে চাপা পড়ে। এই সব অসঙ্গতি অক্ষত রেখেই নিক্সন ও কিসিঞ্জার স্ব স্ব স্মৃতিকথায় পশ্চিম পাকিস্তানের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সতর্ক করে দেবার উদ্দেশ্যে সপ্তম নৌবহর পাঠানো হয়েছিল বলে দাবী করেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মুক্তপ্রায় বাংলাদেশে পাকিস্তানী বাহিনীর সর্বাত্মক পতন রোধের জন্য ‘নৌ, বিমান ও স্থল তৎপরতা চালানোই যে সপ্তম নৌবহরের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল তা অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে সমর্থিত। স্পষ্টতই এই শক্তিশালী নৌবহরের গঠন ছিল বঙ্গোপসাগরে ভারতের নৌঅবরোধ ব্যর্থ করা, পাকিস্তানী স্থল বাহিনীর তৎপরতায় সাহায্য করা, ভারতীয় বিমান তৎপরতা প্রতিহত করা এবং মার্কিন নৌসেনা অবতরণে সাহায্য করার উপযোগী।
কিন্তু মার্কিন নৌবহরের জন্য বঙ্গোপসাগর ছিল ৪/৫ দিনের যাত্রাপথ। সপ্তম নৌবহর যখন যাত্রা শুরু করে তখন অর্থাৎ ৯-১০ই ডিসেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযানের মুখে পাকিস্তানী বাহিনী দ্রুত পশ্চাদপসরণে ব্যস্ত। ৯ই ডিসেম্বরে চাঁদপুর ও দাউদকান্দি থেকে পাকিস্তানী দখলের অবসান ঘটায় মেঘনার সমগ্র পূর্বাঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়। ত্রিপুরার দিক থেকে আগত ভারতের প্রথম স্থল বাহিনী চতুর্থ কোর (IV Corps)-এর অধিনায়ক লে. জেনারেল সগত সিং-এর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে প্রশস্ত মেঘনা ও তার শাখা-প্রশাখার প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ঢাকা কোন সাধ্যাতীত লক্ষ্য নয়। ১০ই ডিসেম্বরে রায়পুরা অঞ্চলে মোট চৌদ্দটি হেলিকপ্টারের সাহায্যে ভারতীয় বাহিনীর অগ্রবর্তী অংশ মেঘনা অতিক্রম করে এবং স্থানীয় জনসাধারণের উদ্দীপ্ত সহযোগিতায় দেশী নৌকার সাহায্যে অবশিষ্ট সৈন্য ও যুদ্ধ সরঞ্জাম মেঘনার অপর পারে আনার কাজ শুরু হয়।
পক্ষান্তরে ৯-১০ই ডিসেম্বরে পাকিস্তানের চতুর্দশ ও ষোড়শ ডিভিশন যথাক্রমে কুমিল্লা ও উত্তরবঙ্গ থেকে পিছু হটতে থাকে। ৯ই ডিসেম্বরে ঢাকাতেও পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ও গভর্নর মালিক সসৈন্যে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ঐ দিন দাউদকান্দির পতনের পর তাদের কাছে এ কথা হয়ত অজ্ঞাত ছিল না যে, ঢাকাই ভারতীয় বাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য। জানা যায়, পাকিস্তানীদের সম্পূর্ণ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত ইয়াহিয়ার পূর্ণ অনুমোদন লাভ করে। ১০ই ডিসেম্বর হেলিকপ্টারযোগে ভারতীয় বাহিনীর রায়পুরা অবতরণের পর এবং প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহের উপর ভারতীয় বিমানের আক্রমণ চলার পর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী ঢাকায় অবস্থানকারী জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরীকে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আয়োজন করে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং সমগ্র পাকিস্তানী বাহিনীকে সসম্মানে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করার আবেদন জানায়। পল মার্ক হেনরী ঢাকাস্থ আমেরিকান, রাশিয়ান, ব্রিটিশ ও ফরাসী কন্সালকে অবহিত করার পর এই প্রস্তাব জাতিসংঘ সদর দফতরে প্রেরণ করেন। নিরাপত্তা পরিষদে যখন রাও ফরমান আলীর এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার উদ্যোগ চলছিল সে সময় হঠাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক এই প্রস্তাব নাকচ হওয়ার সংবাদ পৌঁছায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীর প্রস্তাবের সংবাদ ওয়াশিংটনে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন সরকার এই প্রস্তাব রদ করার পরামর্শসহ ইয়াহিয়াকে জানান যে, পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য সপ্তম নৌবহর ইতিমধ্যেই বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হয়েছে। এর ফলে ইয়াহিয়ার মত পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে নিক্সনের পূর্ববর্তী সতর্কবাণীর জবাবে ৯ই ডিসেম্বরে ব্রেজনেভ নিক্সনকে জানান যে, উপমহাদেশের সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন পূর্বাঞ্চল থেকে পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য ইয়াহিয়াকে সম্মত করানো। রণাঙ্গনের বাস্তব চাপে ১০ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান নিজেই যখন ‘সম্মানজনকভাবে সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে, তখন সেই উদ্যোগকে সমর্থন না করে মার্কিন সরকার বরং তা রদ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অধিকন্তু ভারতকে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সম্মত করানোর তাগিদ দিয়ে ৯ ও ১০ই ডিসেম্বরে নিক্সন ব্রেজনেভকে দু’দফা বার্তা পাঠান। ১০ই ডিসেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর মেঘনা অতিক্রমের সংবাদ লাভের পর যে কোন মূল্যে এই অগ্রাভিযান রোধ করে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী করার মত সময় লাভের উদ্দেশ্যে, ভারতীয় সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শর্ত ছাড়াই, যে যেখানে আছে সেই ভিত্তিতে ‘নিশ্চল যুদ্ধবিরতি’ (standstill cease-fire) কার্যকর করার ব্যাপারে ভারতকে সম্মত করানোর জন্য ব্রেজনেভের উপর চাপের মাত্রা বাড়ানো হয় এবং তাকে জানানো হয় যে, ভারত যদি এর পরেও সম্মত না হয় তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। নিক্সন প্রদর্শিত এই ভীতি জোরদার করার উদ্দেশ্যে কিসিঞ্জার নিজেও ওয়াশিংটনস্থ সোভিয়েট প্রতিনিধি ভোরেন্টভকে ‘ভারতীয় আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গীকার সংক্রান্ত’ ১৯৬২ সালের স্মারকলিপি পড়ে শোনান এবং এই অঙ্গীকার রক্ষার জন্য মার্কিন সরকারের সংকল্প ব্যক্ত করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় কিসিঞ্জার নিউইয়র্কে হুয়াং হুয়ার সঙ্গে সমগ্র পরিস্থিতি আলোচনা করেন এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনী ধ্বংসের জন্য ভারতীয় পরিকল্পনা সম্পর্কে সিআইএ কর্তৃক সংগৃহীত ‘নির্ভরযোগ্য তথ্যের’ উল্লেখ করেন। সম্ভবত এই আলোচনার ফলে তিব্বত ও সিংকিয়াং-এর মত ভূখণ্ডের জন্য ‘ভারত-সোভিয়েট আঁতাত’ কোন তাৎপর্য বহন করে কি না সে সম্পর্কে হুয়াং হুয়ার সন্দেহ গভীরতর হয় এবং হুয়াং হুয়া উপমহাদেশের সংঘর্ষে চীনের সামরিক দায়িত্ব সম্পর্কে যে আবেগপূর্ণ মন্তব্য করেন তা কিসিঞ্জার ‘বিলম্ব’ হলেও চীনের সামরিক হস্তক্ষেপের আভাস’ হিসাবে গণ্য করেন। ফলে উৎসাহিত কিসিঞ্জার একই দিনে অর্থাৎ ১০ই ডিসেম্বরে তৃতীয় বারের মত হুঁশিয়ারিসহ সোভিয়েট ইউনিয়নকে জানিয়ে দেন যে, ভারতকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করানোর ব্যাপারে শীঘ্রি কোন সন্তোষজনক উত্তর যদি সোভিয়েট ইউনিয়ন না দিতে পারে, তবে যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর প্রেরণসহ ‘শক্ত ব্যবস্থা’ গ্রহণ করবে।
উপমহাদেশের সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ‘শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে এই উপলব্ধি স্পষ্টতই সোভিয়েট ইউনিয়নের আগে থেকেই ছিল। কাজেই ৫ই ডিসেম্বরে সকল রাষ্ট্রকে পাকিস্তান বা ভারতের সক্রিয় পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো ছাড়াও তা যাতে সংশ্লিষ্ট শক্তিসমূহ কর্তৃক গ্রাহ্য হয় তজ্জন্য সোভিয়েট সরকার তাদের নৌবাহিনীকে সতর্ক রাখে। মার্কিন নৌবহরের যাত্রারম্ভের আগেই সোভিয়েট পূর্ব উপকূল থেকে আগত রুশ যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন তাদের ভারত মহাসাগরীয় নৌবহরের শক্তি বৃদ্ধি শুরু করে এবং মার্কিন নৌবহর যখন বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী হয় তখন পাঁচটি সাবমেরিনসহ মোট ষোলটি যুদ্ধ ও সরবরাহ জাহাজ বঙ্গোপসাগরে বা তার আশেপাশে সমবেত হয়েছিল বলে জানা যায়। ১০ই ডিসেম্বর মার্কিন সপ্তম নৌবহর চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর সংযোগকারী পাঁচ শ মাইল দীর্ঘ মালাক্কা প্রণালীর ওপারে; ভারত মহাসাগরে সোভিয়েট নৌবহরের সমাবেশও তখন পূর্ণতাপ্রাপ্ত নয়। এই অবস্থায় জানা যায়, সপ্তম নৌবহরের গতিবিধি জানার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন ‘কসমস ৪৬৪’ পর্যবেক্ষণ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করে। তার চারদিন আগে সম্ভবত উপমহাদেশের রণাঙ্গন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ‘কসমস ৪৬৪’ উপগ্রহটি উৎক্ষেপিত হয়। ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিউইয়র্ক থেকে সপ্তম নৌবহরের যাত্রা-সংক্রান্ত প্রথম যে সংবাদ দিল্লী এসে পৌঁছায় তদনুযায়ী কেবল বঙ্গোপসাগরে শক্তি প্রদর্শন নয়, বাংলাদেশের উপকূলের সাথে সংযোগ প্রতিষ্ঠাও ছিল মার্কিন নৌবহরের প্রধান লক্ষ্য। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে প্রথম যাদের কাছে এই সংবাদ এসে পৌঁছায়, তাঁরা মুহূর্তেই ধারণা করে নেন যে, এর পরে যুদ্ধের গতিধারা যে কোন দিকে মোড় নিতে পারে।
রাত্রিতে দিল্লীর সর্বোচ্চ সামরিক মন্ত্রণাসভায় গভীর সঙ্কটের আবহাওয়া বিরাজমান ছিল। প্রত্যাসন্ন বহিঃহস্তক্ষেপের সমুচিত প্রতিবিধান নির্দেশের প্রশ্নে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর উচ্চতর নেতৃবর্গের অধিকাংশ ছিলেন প্রায় নিরুত্তর। পাকিস্তানী বাহিনীর শেষ প্রতিরক্ষার স্থল ঢাকাকে মুক্ত করার আগেই বাংলাদেশের উপকূল ভাগে বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী নৌবহর সমাবেশের আয়োজন এবং সিকিম ভুটানের উত্তর সীমান্তে চীনা সামরিক বাহিনীর অগ্রবর্তী অবস্থানের ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধের পরিধি অসামান্যভাবে বিস্তৃত এবং এর পরবর্তী গতিধারা জটিল, অনিশ্চিত ও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। এই বৃহত্তর সংঘাত থেকে ভারতের পিছিয়ে যাবার পথ উন্মুক্ত রাখার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “নিশ্চল স্থিতাবস্থা এবং ‘সঙ্কটের রাজনৈতিক মীমাংসা’র প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই সম্মানজনক পশ্চাদপসরণের সঙ্গে পরাজয়ের উপাদান প্রচ্ছন্ন থাকলেও উদ্ভত সামরিক পরিস্থিতিতে তা প্রত্যাখ্যান করার মধ্যে যে অদম্য সাহস ও নির্ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্ন জড়িত ছিল, সেই দুরূহ পরীক্ষায় ইন্দিরা গান্ধী সমুত্তীর্ণ হন। সপ্তম নৌবহরের বর্ণিত উদ্দেশ্য ব্যর্থ করার জন্য ভারতের দুর্বল নৌশক্তির সর্বাত্মক ব্যবহার, ঢাকা অভিমুখে সামরিক অভিযানের গতি বৃদ্ধি এবং মৈত্রীচুক্তি অনুযায়ী বহিরাক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোভিয়েট সামরিক সহায়তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ডি. পি, ধরকে মস্কো প্রেরণ-এই তিনটি সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা একে একে ঘোষণা করেন। এর আগে ঐ দিন বাংলাদেশের প্রত্যাসন্ন মুক্তির পটভূমিতে ভারত ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মিলিত অভিযানের জন্য যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু দিবাবসানে যখন দেখা যায় যুদ্ধের পরিধি প্রায় সীমাহীনভাবে বিস্তৃত হওয়ার পথে, তখন ভারতের জন্য মস্কোর পূর্ণাঙ্গ সামরিক সহযোগিতা এবং উচ্চতর পর্যায়ে মস্কোর সঙ্গে সামরিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগের সমন্বয় সাধনই মূল প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
পরদিন ১১ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় শত্রুমুক্ত যশোরের পূর্ব নির্ধারিত সফর থেকে কোলকাতা ফিরে আসার আগে পর্যন্ত তাজউদ্দিন জানতেই পারেননি, মার্কিন হস্তক্ষেপের আশঙ্কা সত্যই বাংলাদেশের আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে চলেছে। ডি. পি. ধর দিল্লী থেকে মস্কোর উদ্দেশে রওনা হন সে দিনই। স্পষ্টতই ইসলামাবাদের নয়া নির্দেশ অনুযায়ী, জেনারেল নিয়াজী পুনরায় ঢাকা রক্ষার জন্য আমৃত্যু যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সংকল্প প্রচার করতে শুরু করেন। কিন্তু ঢাকা রক্ষার জন্য না ছিল তাদের কোন আয়োজন, না ছিল উদ্যম। নদীমাতৃক এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা অনুযায়ী ঢাকা প্রতিরক্ষার জন্য ব্যুহ রচনার সম্ভাবনা দু’টি। একটি দূরবর্তী, অন্যটি ঢাকা নগরীর নিকটবর্তী। আরিচা-কালিয়াকৈর-নরসিংদী-বৈদ্যেরবাজার-নারায়ণগঞ্জ ঘিরে ঢাকার জন্য দূরবর্তী প্রতিরক্ষা বৃত্ত রচনার যে সুযোগ ছিল স্পষ্টতই তা সদ্ব্যবহারের উদ্যোগ পাকিস্তানীদের ছিল না। ঢাকার নিকটবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তোলার সুযোগ ছিল মিরপুর ব্রীজ, টঙ্গী ব্রীজ, ডেমরা ফেরী ও নারায়ণগঞ্জে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। কিন্তু সর্ববিষয়ে বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভর করার দীর্ঘ মনোবৃত্তির ফলেই হয়ত পাকিস্তানী নেতৃত্ব নিজেদের শেষ আত্মরক্ষার জন্যও আমেরিকা ও চীনের সাহায্যের উপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল ছিল এবং সে কারণে ঢাকার নিকটবর্তী প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতাকে জোরদার করার মত কোন ব্যবস্থা তারা অবলম্বন করে ওঠেনি। ১১ই ডিসেম্বরে ঢাকা শহরে ইপিকাফ, পুলিশ, রাজাকারসহ পাকিস্তানী সশস্ত্রবাহিনীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজারের অনধিক। কোন কোন অঞ্চল থেকে–এমনকি নিকটবর্তী ভৈরব বাজার থেকে–ঢাকার জন্য সৈন্য পুনর্সমাবেশের পাকিস্তানী প্রচেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বিমান আক্রমণের ফলে দুরূহ হয়। উত্তরে ময়মনসিংহ থেকে পাকিস্তানের ৯৩ এ্যাডহক ব্রিগেড ঢাকা আসার কালে প্রথমে কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধা এবং পরে ভারতীয় প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ান কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ১১ই ডিসেম্বর বিকেলে ভারতের প্যারাস্যুট বাহিনীর মাত্র ৭০০ জন সৈন্য কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী অধ্যুষিত মধুপুর এলাকায় অবতরণ করে এবং পাকিস্তানী ব্রিগেডের পশ্চাত্বর্তী ইউনিটের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ব্রিগেড দলপতি ব্রিগেডিয়ার কাদিরকে পিছনে ফেলে রেখে, ক্ষয়িত শক্তি নিয়ে পাকিস্তানী ব্রিগেড ঢাকা ফিরে আসে। বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলি ভারতের প্যারাস্যুট বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা পাঁচ হাজার বলে উল্লেখ করায় পাকিস্তানীদের মনোবল আরও হ্রাস পায়।
অন্যত্র পশ্চাদপসরণে ব্যস্ত পাকিস্তানী বাহিনীর লক্ষ্যস্থল ছিল দক্ষিণের দিকে–খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রামের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। উপকূল থেকে জাহাজযোগে–এবং কোন ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশীয় পতাকা ব্যবহার করে–বাংলাদেশ ছেড়ে পালাবার ব্যাপারে তাদেরকে সচে দেখা যায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের অবরুদ্ধ করার পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য এবং অংশত উপকূলভাগে সপ্তম নৌবহরের সংযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ অপেক্ষাকৃত দুরূহ করার জন্য ১১ই ডিসেম্বর থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর এবং উপকূলভাগে অবকাঠামো, জাহাজ, নৌযান প্রভৃতির ধ্বংস সাধনে ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমান ও যুদ্ধজাহাজ ব্যাপকভাবে নিযুক্ত করা হয়। ঐ দিনই ঢাকার উদ্দেশে ভারতের একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান একটি গোলন্দাজ ইউনিটকে সঙ্গে করে নরসিংদীর দিকে এগুতে থাকে। তবে পূর্ব রাত্রিতে যুদ্ধের গতি বৃদ্ধির জন্য দিল্লীতে যে সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়ে থাকুক, বিস্তীর্ণ মেঘনার এই সব অঞ্চলে প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা বড় প্রবল। তদুপরি সর্বত্রই ছিল যানবাহনের তীব্র অভাব, পথঘাট ভাঙ্গা। মন্থর হলেও এই সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ভারতীয় ইউনিটের অগ্রগতি চলতে থাকে স্থানীয় জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত সহযোগিতায়।
প্রয়োজনের তুলনায় ভারতীয় বাহিনীর এই মন্থর’ অগ্রগতিতে সে সময় যারা উদ্বিগ্ন ছিল, সোভিয়েট ইউনিয়ন নিঃসন্দেহে তাদের অন্তর্ভুক্ত। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে তারাই ছিল মার্কিনী চাপের সরাসরি সমুখে। দাঁতাত, SALT I ও প্রভৃতি বিষয়ে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা ছিল সব চাইতে বেশী। অন্য অর্থে তাদের সামরিক ঝুঁকিও ছিল বিরাট। বাংলাদেশের উপকূলভাগের দিকে প্রেরিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরের বিরুদ্ধে সোভিয়েট নৌশক্তির যে দ্রুত সমাবেশ ঘটানো হয় তার ফলে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নৌবহরের মধ্যে যেমন সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটা বিচিত্র ছিল না, তেমনি কোথায় যে তার শেষ হত তা বলা কঠিন ছিল। কাজেই বাংলাদেশ যুদ্ধের দ্রুত পরিসমাপ্তির জন্য এবং এরপর এই যুদ্ধ যাতে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্প্রসারিত না হয়, সম্ভবত তাও নিশ্চিত করার জন্য সোভিয়েট সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কুজনেটসভ দিল্লী অভিমুখে রওনা হন।
উপমহাদেশ থেকে গোলার্ধ পথ দূরে নিউইয়র্কে হুয়াং হুয়ার ‘সর্বশেষ রাইফেল পর্যন্ত লড়াই করার অভিপ্রায় শোনার পরদিন উদ্দীপ্ত কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে ফিরে এসেই সোভিয়েট প্রতিনিধি ভেরেন্টসভকে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি প্রদান করেন: তার পরদিন অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের মধ্যাহ্নের আগে ভারত যদি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা না করে, তবে সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে অগ্রসর হবে।
৭-৮ই ডিসেম্বরে সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিপুল ভোটাধিক্যে অনুমোদিত হওয়ার পর ৮ই ডিসেম্বর WSAG বৈঠকে পশ্চিম পাকিস্তানকে ধ্বংস করার গোপন ভারতীয় প্রচেষ্টা সম্পর্কে সিআইএ পরিবেশিত তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের যৌক্তিকতা আবিষ্কার করা, ৯ই ডিসেম্বরে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া, ১০ই ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চাদপসরণ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পরেও পাকিস্তানী শাসকদের মত পরিবর্তনে বাধ্য করা এবং ভারত অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় সম্মত না হলে ১৯৬২ সালের স্মারকলিপি অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবে বলে সোভিয়েট ইউনিয়নকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া-এ সবই ছিল বাংলাদেশের যুদ্ধে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের জন্য নিক্সন প্রশাসনের বিস্তারিত আয়োজন। ১০ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় হুয়াং হুয়ার সংগ্রামী বিবৃতির পর এই আয়োজন সম্পূর্ণতা লাভ করে। এই সব আয়োজনের মধ্যে তিনটি উপাদান ছিল মার্কিন জনমত তথা রাজনৈতিক অসুবিধা অতিক্রম করার জন্য অত্যাবশ্যক: (১) সাধারণ পরিষদে গৃহীত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের মাধ্যমে ভারতকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা; (২) এমন কোন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আশ্রয় নেওয়া যা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে ‘আক্রান্ত পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে যোগদানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ; এবং (৩) সামরিক হস্তক্ষেপে অংশগ্রহণে চীনকে সম্মত করানো। এই সব ক’টি উপাদান আয়ত্তাধীন হয়েছে বলে মনে করায় কিসিঞ্জার ১১ই ডিসেম্বর ভোরেন্টসভকে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি জ্ঞাপন করে বলেন, পরদিন মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে, অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
কিন্তু কিসিঞ্জার নিশ্চয়ই জানতেন, রণাঙ্গনে আসন্ন বিজয় দৃষ্টে ভারত এই চরমপত্র অগ্রাহ্য করবেই। কাজেই মার্কিন প্রশাসন ঐ দিনই কোন এক সময়ে তাদের আসন্ন হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত পাকিস্তানকে জানিয়ে দেন-উপমহাদেশে তখন অবশ্য ১২ই ডিসেম্বর। এই সংবাদের সঙ্গে সঙ্গে CGS লে. জেনারেল গুল হাসান টেলিফোনযোগে পশতু ভাষায় নিয়াজীকে জানিয়ে দেন, পরদিন অর্থাৎ ১৩ই ডিসেম্বরের মধ্যাহ্নে পাকিস্তানী বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। দক্ষিণের বন্ধু তথা সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর অবধি আসার জন্য মার্কিন নাগরিক উদ্ধারের যে অজুহাত ব্যবহার করে সেই মার্কিন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য নাগরিকদের উদ্ধারকর্ম তিনটি ব্রিটিশ রয়েল এয়ারফোর্সের বিমান কর্তৃক ১২ তারিখেই সম্পন্ন হয়। গুল হাসানের সংবাদের পর ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষ নিজেদের প্রতিরক্ষার আয়োজন নিরঙ্কুশ করার জন্য চব্বিশ ঘণ্টার জন্য কারফিউ জারী করে ঘরে ঘরে তল্লাশী শুরু করে। সম্ভবত এই সময়েই কোন পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের আটক করার সিদ্ধান্ত নেয়; পাকিস্তানীদের পরাজয়ের প্রাক্কালে যাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তানী মহলের এই শেষ লড়াইয়ের প্রস্তুতি সত্ত্বেও রণাঙ্গনে তাদের পশ্চাদপসরণের ধারা তখনও অপরিবর্তিত। ১২ই ডিসেম্বর সকাল আটটায় নরসিংদীর উপর পাকিস্তানী দখলের অবসান ঘটে। বিকেলে ভারতের আর একটি ইউনিট (৪ গার্ডস) ডেমরা ঘাট থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে এসে হাজির হয়। ১০ই থেকে ১২ই ডিসেম্বরের তিন দিনে ভারতীয় বাহিনীর সর্বমোট পাঁচটি ব্যাটালিয়ান, দুটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ও ৫৭ ডিভিশনের ট্যাকটিক্যাল হেডকোয়ার্টার মেঘনা অতিক্রমে সমর্থ হয়। ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের মেঘনা অতিক্রমের প্রচেষ্টা ছিল তখনও অসফল। ১২ই ডিসেম্বর সূর্যাস্তের আগে জামালপুর ও ময়মনসিংহের দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী টাঙ্গাইলে প্যারাস্যুট ব্যাটালিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে ঢাকা অভিযানের সর্বাপেক্ষা সম্ভাবনাপূর্ণ পথের সদ্ব্যবহার শুরু হয়। দক্ষিণে ভারতীয় নৌবাহিনী সপ্তম নৌবহরের আসন্ন তৎপরতা সর্ব উপায়ে বিঘ্নিত করার জন্য চালনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ছোট বড় অবশিষ্ট সকল জাহাজ ও নৌযান, উপকূলীয় অবকাঠামো, কক্সবাজার বিমানবন্দর প্রভৃতি ধ্বংস বা অকেজো করে ফেলে। বঙ্গোপসাগরের জাহাজগামী নৌপথগুলি (sea lane) সঙ্কীর্ণ ও প্রায়শ অগম্ভীর হওয়ায়, অনুমান করা হয়, সপ্তম নৌবহরের বৃহদায়তন জাহাজগুলির পক্ষে উপকূলের নিকটে নোঙ্গর করা অসাধ্য ব্যাপার। তাদের বিমান আক্রমণ ও হেলি উত্তোলন ক্ষমতা যথেষ্ট হলেও, পর্যাপ্ত সংখ্যক উপকূলীয় জলযানের অভাবে স্থলভাগের সঙ্গে সংযোগ প্রতিষ্ঠা অথবা পাকিস্তানী সৈন্য অপসারণের কাজ বহুলাংশে দুরূহ হবে বলে মনে করা হয়।
দিল্লীতে কুজনেটসভ এবং মস্কোতে ডি. পি. ধরের যুগপৎ আলোচনার ফলে দ্রুতগতিতে উভয় সরকার মার্কিন ও চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি মোকাবিলায় যুগ্ম ভূমিকা গ্রহণে সক্ষম হন। সপ্তম নৌবহরের আগমন-সংক্রান্ত খবর তখনও (এবং ১৩ই ডিসেম্বরের সন্ধ্যা পর্যন্ত) ভারতে কেবল স্বল্প সংখ্যক নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সীমিত। তবু মার্কিন প্রশাসনের হুমকির প্রকাশ্য জবাব দান এবং ভারতের জনসাধারণকে আসন্ন বিপদ ও কঠোর সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে ১২ই ডিসেম্বর দিল্লীতে বিশেষভাবে আয়োজিত এক জনসভায় ইন্দিরা গান্ধী ‘সম্মুখের অন্ধকার দিন’ ও ‘দীর্ঘতর যুদ্ধের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক করেন। সেই সঙ্গে সাধারণ পরিষদের সামপ্রতিক আহ্বানের জবাবে এবং পরোক্ষভাবে মার্কিন চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করে জাতিসংঘ মহাসচিক উ থানকে এক বার্তায় ইন্দিরা জানান, ভারত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা এবং ভারতীয় সৈন্য স্বদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রস্তুত আছে, একমাত্র যদি পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছুতে সম্মত হয়।
সোভিয়েট ইউনিয়ন যদিও সপ্তম নৌবহরের অনুসরণ/মোকাবিলা করার জন্য ভারত মহাসাগরে তার নিজের নৌবহর জোরদার করে, তবু এ সম্পর্কে ভারতকে অবহিত রাখা ভিন্ন তা নিয়ে কোন প্রচার, সতর্কবাণী উচ্চারণ বা অন্য কোন প্রকার প্ররোচনামূলক কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন সতর্কবাণী এবং ১২ই ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের পূর্বে ভারতকে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় বাধ্য করার জন্য চরমপত্র লাভ করা সত্ত্বেও সোভিয়েট সরকার সেগুলি সরাসরি অগ্রাহ্য বা প্রতিবাদ না করে বরং সংলাপের ধারা অব্যাহত রাখেন এবং দাঁতাত প্রক্রিয়ার কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখেই আমেরিকান অভিযোগের সমাধান অন্বেষণে দৃশ্যত সচেষ্ট থাকেন। তবে তাদের এই প্রচেষ্টা কার্যক্ষেত্রে কালক্ষেপণের সমতুল্য হয়ে ওঠে-যেন এইভাবে বাংলাদেশ যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির জন্য ভারতকে সময় দেওয়াই তাঁদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু যে দু’টি ক্ষেত্রে শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে নিঃশব্দে, যথোচিত মাত্রাতে এবং মার্কিন উপগ্রহের ক্যামেরার সামনে তা প্রদর্শিত হয়: মার্কিন নৌশক্তি মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে এবং চীনকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে সিংকিয়াং সীমান্তে। সোভিয়েট সামরিক শক্তির নিঃশব্দ প্রদর্শনী দ্বিধান্বিত চীনের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে সম্পূর্ণ অর্থে। বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সংলাপ ও শক্তি প্রদর্শনের এই সমন্বয় সম্ভবত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর সোভিয়েট কূটনীতির সফলতম দৃষ্টান্তসমূহের অন্যতম।
১২ই ডিসেম্বর রবিবার হওয়া সত্ত্বেও মধ্যাহ্নের বেশ আগে থেকেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় ভারতকে বাধ্য করার প্রশ্নে সোভিয়েট ইউনিয়নের চূড়ান্ত জবাব শোনার জন্য ‘হোয়াইট হাউসের খাস কামরা ‘ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরী কিসিঞ্জার এবং তথ্য সহকারী আলেকজান্ডার হেগ উৎকণ্ঠিতচিত্তে অপেক্ষমাণ ছিলেন। নির্ধারিত সময়সীমার প্রায় দু’ঘণ্টার আগে সোভিয়েট ইউনিয়ন আমেরিকার চরমপত্রের উত্তরে কেবল জানায়, পশ্চিম পাকিস্তানে ভারতের কোন আক্রমণাত্মক অভিপ্রায় নেই। কিন্তু মার্কিন প্রশাসন যে উদ্দেশ্যে এই চরমপত্র দেন, সেই মূল বিষয় তথা পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধবিরতি ঘোষণায় ভারতকে বাধ্য করার প্রশ্নে সোভিয়েট ইউনিয়ন নীরব থাকে। কাজেই প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশে পাকিস্তানের পরাজয় রোধ করার আর যে কোন উপায় অবশিষ্ট নেই, তা মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য নিক্সন এবার অভিযোগ করেন যে, সোভিয়েট জবাবে পাকিস্তানী কাশ্মীরের নিরাপত্তা সম্পর্কে কোন নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি নেই (বস্তুত পাকিস্তান ও ভারত উভয় রাষ্ট্রই একে অপরের অধীনস্থ কাশ্মীরকে বিরোধপূর্ণ মনে করে এবং ৩রা ডিসেম্বরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান ভারতীয় জম্মু ও কাশ্মীরের কিছু অংশ দখল করে নেওয়ায় তা পুনরুদ্ধারের পূর্বে ভারত সরকারের পক্ষে এ জাতীয় প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়, তা ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল. কে. ঝা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরকে অবহিত করেন)। নিক্সন সাধারণ পরিষদের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার ব্যাপারে ভারতের অবাধ্যতার কথা তুলে ধরে বাংলাদেশে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য পুনরায় সেই দিন, অর্থাৎ ১২ই ডিসেম্বর বিকালেই নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আয়োজনের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে তিনি আরও কঠোর ভাষায় ‘গুরুতর পরিণতির’ সাবধানবাণী ‘হট লাইন’ মারফত ক্রেমলিনে পাঠান। কিন্তু এবারের সাবধানবাণীতে-ক্রুশ্চভের ভাষায়-‘পারমাণবিক দাঁত বসানো ছিল।
পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানোর ক্ষেত্রে শেষ চেষ্টা করার জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘হট লাইনে’ এই সতর্কবাণী পাঠাবার পর পরই মার্কিন যুদ্ধ-সংকল্পে এক অবিস্মরণীয় উত্থান-পতনের পালা শুরু হয়। নিউইয়র্ক থেকে হুয়াং হুয়া তখনই জানান, পিকিং থেকে এক জরুরী বার্তা এসে পৌঁছেছে এবং তা অবগত হওয়ার জন্য কিসিঞ্জারকে অবিলম্বে নিউইয়র্কে যাওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তাদের মানসিক প্রস্তুতি তখন এমনই তুঙ্গে যে এই বার্তার বিষয়বস্তু কি তা শোনার আগেই নিক্সন ও কিসিঞ্জার সাব্যস্ত করে ফেলেন যে, নিঃসন্দেহে চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করতে চলেছে; এবং চীনের এই সম্ভাব্য অভিযান প্রতিহত করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন শক্তি প্রয়োগ করবে। এই অনুমানের ভিত্তিতে নিক্সন-কিসিঞ্জার তৎদণ্ডে এ-ও স্থির করে ফেলেন যে সোভিয়েট ইউনিয়নের ব্যাপারে তারা ‘নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন না। সম্পূর্ণ অনুমানের উপর নির্ভর করে বিশ্বযুদ্ধের এত বড় ঝুঁকি গ্রহণের এহেন ক্ষমতা সম্ভবত সর্বশক্তিমান মার্কিন প্রেসিডেন্টেরই একান্ত অধিকার। কাজেই মালাক্কা প্রণালী অতিক্রম করে সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দিয়েই নিক্সন সে দিন ক্ষান্ত হননি, সেই সঙ্গে চীনকে এই প্রতিশ্রুতি জানিয়ে দেন যে সোভিয়েট ইউনিয়ন যদি চীন আক্রমণ করে তবে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সমুচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুত ব্যবস্থা যে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া আর কিছু ছিল না, তা ঘটনার প্রায় চৌদ্দ বছর পর নিক্সন ‘টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধির কাছে স্বীকার করেন।
কিন্তু হুয়াং হুয়া নিউইয়র্কে ১২ই ডিসেম্বরের বিকেলে আলেকজান্ডার হেগকে অবহিত করেন, চীন কেবল আরেক দফা নিরাপত্তা পরিষদ অধিবেশনে যুদ্ধবিরতির বিষয় আলোচনার ব্যাপারেই আগ্রহী-উপমহাদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে নয়। সামরিক হস্তক্ষেপ সম্পর্কে চীনের এই ‘অপ্রত্যাশিত ভূমিকার ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় এমন ওলট-পালট ঘটে যে বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার পথের দূরত্বে সপ্তম নৌবহর নিশ্চল করে ফেলা হয়। চীনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমেরিকার হস্তক্ষেপ পরিকল্পনা এবং আমেরিকার পরিকল্পনার সঙ্গে ঢাকার প্রতিরক্ষার সিদ্ধান্ত ও প্রস্তুতির প্রশ্ন ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত থাকায় চীনের মত পরিবর্তন ছিল পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ জন্য দরকার ছিল কিছু সময়ের। সময়ের দরকার ছিল ভারতেরও; কিন্তু তা ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীকে ঢাকার দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই। কাজেই পাকিস্তান ও ভারত উভয় প্রতিনিধির দীর্ঘ বক্তৃতার পর ১২ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন মুলতবি হয়ে যায়। ইতিপূর্বে ঐ দিন মধ্যাহ্নে নিক্সন ব্রেজনেভকে যে চরম সতর্কবাণী পাঠান তার জবাবে ১৩ই ডিসেম্বরের ভোর পাঁচটায় হোয়াইট হাউসের ‘হট লাইনে’ মস্কোর নিরুত্তপ্ত জবাব এসে পৌঁছায়: ভারতে সমস্ত ব্যাপার ভাল করে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে ।
এদিকে উপমহাদেশে ১৩ই ডিসেম্বরে নিয়াজীকে জানানো হয়, ঐ দিন পাক বাহিনীর সহায়তার জন্য ‘মিত্রদের’ যে এসে পৌঁছানোর কথা ছিল, তা আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে রাজী করানোর কাজে ইসলামাবাদে সারাদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যায়। পিকিং-এ পাকিস্তানী দূতাবাসকেও দেখা যায় কর্মতৎপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের এই মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সিকিম-ভুটান সীমান্তে মোতায়েন চীনা সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা তৎপর হতে দেখা যায়, কিন্তু ভারতে যে তা বিশেষ উদ্বেগের সঞ্চার করেছিল এমন নয়। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী সদরদপ্তরে বাংলাদেশকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার এক অসফল প্রয়াস ঠিক একই সময়ে পরিলক্ষিত হয়।
১২-১৩ই ডিসেম্বরে নিউইয়র্কের মধ্যরাত্রির আগে সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে চীনের সম্মতি আদায় সাপেক্ষে সপ্তম নৌবহরকে নিশ্চল করা এবং নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক মুলতবি করার ব্যবস্থা চলছিল, ঠিক সেই সময় কোলকাতায় ১৩ই ডিসেম্বর সকালে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে প্রায় মাসাধিককাল যাবত অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষী যুদ্ধবিরতির এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রস্তাবিত বিবৃতির প্রধান বক্তব্য ছিল: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌঁছার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়, তবে তৎক্ষণাৎ বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করবেন। বাংলাদেশ তখন ভারতের সঙ্গে যুগ্ম-কমান্ডব্যবস্থায় আবদ্ধ, কাজেই বাংলাদেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি যদি একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতেন, তবে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে এককভাবে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া নীতিগতভাবে অসিদ্ধ হত।
সম্ভবত এই বিবেচনা থেকেই সৈয়দ নজরুল উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষর দানে অসম্মত হন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের গোচরে আনেন।
১৩ই ডিসেম্বরে ভারত ও বাংলাদেশের স্থলবাহিনীর অভিযান ঢাকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে অগ্রসর। উত্তর দিক থেকে জেনারেল নাগরার বাহিনী এবং কাদের সিদ্দিকী পরিচালিত মুক্তিযোদ্ধাগণ ঐ দিন সন্ধ্যায় পাক বাহিনীর হাল্কা প্রতিরোধ ব্যর্থ করে কালিয়াকৈর অবধি এসে পৌঁছায়। বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর সর্বপ্রথম ইউনিট হিসাবে ২-ইবি ঢাকার শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড়ে মুরাপাড়ায় উপস্থিত হয় একই দিনে। ঢাকার পূর্ব দিকে ডেমরা ফেরীর দিকে অগ্রসরমাণ ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী প্রতিরোধের সম্মুখীন। ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের মোকাবিলা করার মত ভারতীয় ট্যাঙ্ক তখনও মেঘনা অতিক্রমে অসমর্থ এবং তৎকারণে ঢাকা নগরীতে পাকিস্তানী প্রতিরোধের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত স্থল অভিযানের তখনও দেরী। সমুদ্রপথে পলায়নের সুযোগ লোপ পাওয়ায় ঢাকায় পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ফলে চূড়ান্ত লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসাবে ঢাকার সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু সমগ্র আকাশ জুড়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একচ্ছত্র অধিকার, ঢাকায় পাকিস্তানী সামরিক অবস্থানের বিরুদ্ধে তাদের নির্ভুল ও তীব্রতর আক্রমণ রচনা, ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক পলায়ন উপযোগী সকল সমুদ্রযানের ধ্বংস সাধন, ভারতীয় স্থলবাহিনীর পূর্ব পরিকল্পিত অভিযানের মুখে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খণ্ড-বিখণ্ড পাকিস্তানী বাহিনীর পরাজয়বরণ, ঢাকার ভিতরে সর্বত্র বিরুদ্ধচারী মানুষ, সুযোগের প্রতীক্ষারত অগণিত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকার চারপাশে ভারতের ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনীর ক্রমসঙ্কুচিত বেষ্টনী এবং শেষ ভরসার স্থল আমেরিকা ও চীনের প্রতিশ্রুত হস্তক্ষেপ পুনরায় পিছিয়ে যাওয়া-এই সমস্ত কিছুর একত্র সমাবেশের ফলে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনানায়কদের মনোবল উঁচু রাখার সামান্যতম অবলম্বন কোথাও ছিল না। প্রত্যাসন্ন বিপর্যয়ের মুখে আত্মসমর্পণের জন্য জেনারেল মানেকশ-এর তৃতীয় ও সর্বশেষ আহ্বানে সাড়া দেওয়াই অবরুদ্ধ পাকিস্তানী নেতৃত্বের পক্ষে প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ পাকিস্তানী নেতৃত্বের এই মনস্তাত্ত্বিক বিপর্যয় ঢাকায় তাদের শেষ প্রতিরক্ষার স্পৃহাকে প্রায় নিঃশেষিত করে ফেলে।
১৩ই ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের মুলতবি বৈঠকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব তৃতীয় সোভিয়েট ভোটের মুখে যথারীতি বাতিল হয়ে যায়। যে কারণেই হোক সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে চীনের সম্মতির সম্ভাবনাকে তখনও যুক্তরাষ্ট্র সম্পূর্ণ বাতিল করে উঠতে পারেনি। কাজেই সেই ভরসায় চব্বিশ ঘণ্টা নিশ্চল রাখার পর সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করা হয় বঙ্গোপসাগরের দিকে। কিন্তু সামগ্রিক ঘটনাবলী দুষ্টে এই নৌ-অভিযানের পূর্ব নির্ধারিত লক্ষ্যের কতখানি অবশিষ্ট ছিল তা অজ্ঞাত। চীনকে নিয়ে বিস্তর টানাটানির পরেও সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে তাদের দৃঢ় সম্মতির অভাব, ঢাকা নগরীতে শেষ প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণে পাকিস্তানী বাহিনীর পরিদষ্ট ব্যর্থতা এবং বঙ্গোপসাগরে ও তার আশেপাশে সোভিয়েট রণতরী ও সাবমেরিন বহরের নীরব সম্বর্ধনা দৃষ্টে সপ্তম নৌবহরের সামরিক লক্ষ্য পুনঃনির্ধারণ অসঙ্গত ছিল না। আর কোনভাবে না হোক, শেষ পর্যন্ত পাক বাহিনীর উদ্ধারকার্যে নিযুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা দেখা দিতে পারে, ক্রমশ এই ধরনের এক অস্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
উপমহাদেশে ১৪ই ডিসেম্বর ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল দিন। একমাত্র ঢাকা শহর এবং গুটিকয় ছোট এলাকা বাদে সারা বাংলাদেশ তখন শত্রুমুক্ত। কোন সরকারী নির্দেশ বা আবেদনের আগেই হাজার হাজার শরণার্থী সহজাত প্রবৃত্তির টানে বিগত কদিন ধরে ফিরতে শুরু করেছে যে যার পরিত্যক্ত বসত, ভিটে-মাটির দিকে। অবশ্য বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই তখনও স্বদেশমুখী নন। এদের মধ্যে যারা রাজনীতি সচেতন তারা, এমনকি অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রভাতী সংবাদপত্র থেকে আজকেই প্রথম জানতে পারেন, মার্কিন সপ্তম নৌবহর এক অজানা বিপদের হুমকি নিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছুটে আসছে। সপ্তম নৌবহর আগমনের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সম্ভাব্য ধ্বংসক্ষমতা সম্পর্কে তাদের অধিকাংশই ছিলেন অনবহিত অথবা নিরুদ্বিগ্ন। সকলেই মত্ত আসন্ন বিজয়ের উল্লাসে, ব্যস্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতিতে। কিন্তু ঢাকায় তখন আসন্ন যুদ্ধ ও সম্ভাব্য ধ্বংসের থমথমে আশঙ্কা। শহরের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা এই সময় পনের থেকে কুড়ি হাজারে উন্নীত বলে অনুমিত। ঢাকাকে মুক্ত করার জন্য সমবেত ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর সংখ্যাও দ্রুত উধ্বমুখী। একটি ভারতীয় ব্রিগেড এবং একটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ঘোড়াশাল থেকে টঙ্গী আসার পথে পুবাইলে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অন্য আর একটি ভারতীয় ব্রিগেডের অর্ধাংশ দাউদকান্দি থেকে হেলিকপ্টারযোগে নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণে এসে পৌঁছায়। ঢাকায় পাকিস্তানী ট্যাঙ্কের মোকাবিলায় চূড়ান্ত অভিযান পরিচালনার জন্য ভারতীয় ট্যাঙ্কবহর মেঘনার পশ্চিম পাড়ে আনার চেষ্টা ইতিপূর্বে তিন দিন যাবত ব্যর্থ হয়। অবশেষে ১৪ই ডিসেম্বর ভারতের পিটি-৭৬ উভচর ট্যাঙ্কবহর যখন সাফল্যের সঙ্গে মেঘনা সন্তরণে ব্যস্ত, তখন ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছ’টি মিগ-২১ ঢাকায় গভর্নর ভবনের উপর আক্রমণ চালিয়ে অধিকৃত এলাকায় পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক প্রশাসনকে তৎক্ষণাৎ পদত্যাগে বাধ্য করে, আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীকে মনস্থির করতে সাহায্য করে এবং এমনিভাবে স্থলযুদ্ধের অবধারিত বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও ঢাকা শহরের ধ্বংস ব্যতিরেকেই মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব করে তোলে।
১৪ই ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের কিছু আগে সংগৃহীত একটি পাকিস্তানী সিগন্যাল থেকে দিল্লীর বিমান সদর দফতর জানতে পারে, মাত্র ঘণ্টাখানেক বাদে ঢাকার গভর্নর ভবনে গভর্নরের মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। তৎক্ষণাৎ ঐ বৈঠক চলাকালেই গভর্নর ভবন আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং মেঘালয়ের শিলং বিমান ঘাঁটি থেকে প্রেরিত অর্ধ ডজন মিগ-২১ সঠিক সময়ে গভর্নর ভবনের উপর নির্ভুল রকেট আক্রমণ চালায়। মন্ত্রী পরিষদসহ গভর্নরের তাৎক্ষণিক পদত্যাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শেষ প্রতিরক্ষার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে নিয়াজীর উপর ন্যস্ত হয়। গভর্নর ভবনের পরেও ঢাকার সামরিক লক্ষ্যবস্তুসমূহের উপর ভারতীয় বিমান আক্রমণ অব্যাহত থাকে। সপারিষদ গভর্নর মালেকের পদত্যাগের সংবাদ এবং ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড থেকে ঘন ঘন প্রেরিত দুর্গত বার্তায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবশেষে ইয়াহিয়া খানের চৈতন্যোদয় হয়। বেলা আড়াইটার দিকে গভর্নর মালেক এবং ইস্টার্ন কমান্ডের সেনাপতি লে. জেনারেল নিয়াজীর কাছে ইয়াহিয়ার যে বার্তা এসে পৌঁছায় তাতে পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের সহযোগীদের জীবনরক্ষার জন্য যুদ্ধ বন্ধ করার প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
১৪ই ডিসেম্বর ওয়াশিংটনের ভোর তিনটায় অর্থাৎ ঢাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক গভর্নর ভবন আক্রমণের অন্তত দু’ঘণ্টা পরে সোভিয়েট সরকার নিক্সনের সর্বশেষ চরমপত্রের জবাবে জানান: উপমহাদেশ প্রশ্নে তাদের দুই সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট নিকটতর’ এবং ভারত সরকারের কাছ থেকেও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা তাদের নেই; কিন্তু পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের পরাজয় রোধের জন্য নিক্সনের চরমপত্রসমূহে বর্ণিত সর্বপ্রধান দাবী তথা ভারত কর্তৃক তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রশ্নে সোভিয়েট নোট সম্পূর্ণ নীরব থাকে। নীরব থাকার কারণও ছিল-সে দিনই সন্ধ্যা থেকে সোভিয়েট সংবাদমাধ্যমগুলি মুক্ত এলাকায় প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংবাদ প্রচার করতে শুরু করে।
এদিকে বিমান আক্রমণের ফলে ঢাকার ট্রান্সমিটার কয়েক দিন আগেই অচল হয়ে পড়েছিল। কাজেই ইয়াহিয়ার অনুমতি লাভের পর লে. জেনারেল নিয়াজী কয়েকটি শর্ত সম্বলিত যুদ্ধবিরতির এক প্রস্তাব ভারত সরকারের কাছে পাঠানোর জন্য মার্কিন কন্সাল জেনারেল স্পিভাককে অনুরোধ জানায়। স্পিভাক বার্তাটি দিল্লী না পাঠিয়ে ওয়াশিংটনে পাঠান। যদিও যে কোন বার্তা তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে পাঠাবার মত ব্যবস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল, তবু শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ এই বার্তা-যা অবিলম্বে পৌঁছলে ঢাকায় বন্দী কিছু বুদ্ধিজীবীসহ অনেকের প্রাণ হয়তো রক্ষা পেত-সংশ্লিষ্ট প্রাপকের কাছে পৌঁছাতে প্রায় একুশ ঘণ্টা অতিবাহিত হয়। এই অসাধারণ বিলম্ব থেকে অনুমান করা চলে, বার্তাবাহক মার্কিন প্রশাসন ‘পাকিস্তানকে পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করার’ সকল অবশিষ্ট সম্ভাবনা ইতিমধ্যে অন্বেষণ করেন। ইতিপূর্বে ইয়াহিয়ার পূর্ণ অনুমতি নিয়ে রাও ফরমান আলী ১০ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি, পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহার এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রস্তাব জাতিসংঘের কাছে পাঠিয়েছিল তা কেবলমাত্র মার্কিন সরকারের হস্তক্ষেপের ফলেই বাতিল হয়। সপ্তম নৌবহর তাদের সাহায্য করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে এই মর্মে নিশ্চয়তা লাভ করার পরেই আরও পাঁচ দিনের জন্য এ যুদ্ধ সম্প্রসারিত হয়। তারপর ১৪-১৫ই ডিসেম্বরের এই ২১ ঘণ্টার অধিকাংশ সময় ধরে অবশিষ্ট পন্থার অন্বেষণ ও পর্যালোচনার পর মার্কিন প্রশাসন সম্ভবত নিশ্চিত হন যে, শক্তির পরিবর্তিত ভারসাম্যের জন্য এই উপমহাদেশ তাদের প্রথাসিদ্ধ ‘গানবোট কূটনীতি’ প্রয়োগের উপযুক্ত স্থান নয়।
১৫ই ডিসেম্বর অপরাহ্নে নিয়াজীর যুদ্ধবিরতির বার্তা দিল্লীতে পৌঁছানোর পর দেখা যায়, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ এই প্রস্তাবের অন্তর্গত নয়। তার প্রস্তাবের মূল বিষয় ছিল, যুদ্ধবিরতির পর অস্ত্রশস্ত্র সমেত পাকিস্তানী বাহিনীর কোন পূর্ব নির্ধারিত স্থানে স্পষ্টতই দক্ষিণে উপকূলভাগে-জমায়েত হওয়ার পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা। এ ছাড়া, ১৯৪৭ সাল থেকে যে সব বহিরাগত পূর্ব বাংলায় বসবাস করে এসেছে। এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে যারা ১৯৭১-এর মার্চ থেকে পাকিস্তানী শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে তাদের যাতে কোন ক্ষতি না করা হয় তদ্মর্মে নিশ্চয়তা লাভের অনুরোধ নিয়াজীর বার্তায় জানানো হয়। মার্চে গণহত্যা শুরুর পর স্বেচ্ছায় যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, তাদের কৃতকর্মের গুরুত্ব নিরূপণ করে শাস্তি বিধানের অধিকার ছিল বাংলাদেশ সরকারের একার-কাজেই এ ব্যাপারে ভারতের কোন বক্তব্য ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত দক্ষিণের কোন মনোনীত স্থানে নির্বিঘ্নে জমায়েত হতে দেওয়ার প্রস্তাব এবং বাংলাদেশের উপকূলভাগ অভিমুখে সপ্তম নৌবহরের অগ্রগতির সংবাদ থেকে এই সন্দেহ প্রবল হয়ে ওঠে যে, মার্কিন নৌবহর অন্ততপক্ষে এই অবরুদ্ধ পাক সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করবে। উপকূলভাগে পৌঁছার পর সপ্তম নৌবহর কেবল পাকিস্তানীদের স্থানান্তরের মধ্যেই নিজেদের ভূমিকা আবদ্ধ রাখবে কি না সে নিশ্চয়তারও অভাব ছিল। তা ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে নিয়াজীর প্রস্তাবে কোন উল্লেখ না থাকায়, এই সৈন্যবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানে পৌঁছার পর যুদ্ধের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি কি দাঁড়াবে তা ছিল আর একটি বিচার্য বিষয়।
এই সব অনিশ্চয়তা দূর করার জন্য জেনারেল মানেকশ পাকিস্তানী প্রস্তাব প্রত্যাখান করে নিয়াজীর কাছে দাবী করেন, ভারতীয় বাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর শর্তহীন আত্মসমর্পণই যুদ্ধবিরতি ঘোষণার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে। মানেকশ’র এই দাবীর পিছনে যে শক্তি বিদ্যমান ছিল তা তখন সমগ্র রণাঙ্গনে প্রতিফলিত। ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দক্ষিণ, পূর্ব, পূর্ব-উত্তর ও উত্তর দিক থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত বাহিনী ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে সমবেত। সপ্তম নৌবহরের স্থল সংযোগ প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য স্থান চট্টগ্রাম উপকূলভাগও তখন মিত্রবাহিনীদ্বয়ের করায়ত্ত হওয়ার পথে। সারাদিন ধরে ভারতীয় জঙ্গীবিমান ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থানস্থল, বাঙ্কার, কমান্ড-কেন্দ্র, সামরিক উপদফতর প্রভৃতির উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে চলে।
আক্রমণের মুখে দখলদার সৈন্যরা নানা কৌশল অবলম্বন করে। কোন কোন পাকিস্তানী বাঙ্কারের উপর আক্রমণ চালাতে গিয়ে ভারতীয় বিমান ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায়; কেননা আত্মরক্ষার্থে পাকিস্তানীরা সেই সব বাঙ্কারের তাপদগ্ধ ছাদে হাত-পা বাধা অবস্থায় স্থানীয় জনসাধারণকে শায়িত রেখেছিল। সেনানিবাস থেকে অফিসাররা তাদের দফতর সরিয়ে নিয়েছিল অসামরিক এলাকার বিভিন্ন অংশে। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষই যেখানে বিপক্ষে, সেখানে সরে গিয়েও তাদের পরিত্রাণ মেলেনি। তাদের নতুন আশ্রয়ের খবর সাথে সাথে আশেপাশের মানুষ জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের; মুক্তিযোদ্ধারা খবর পাঠিয়েছে নগরের উপকণ্ঠে ভারতীয় সিগন্যালসকে এবং তার কিছু পরেই ভারতের জঙ্গী ও বোমারু বিমান এই সব নতুন লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে তৎপর হয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর লক্ষ্যভেদী, উপর্যুপরি আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার কাজে ব্যতিব্যস্ত, সন্ত্রস্ত ও সম্পূর্ণ পরিশ্রান্ত পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ড এমনিভাবে শর্তহীন আত্মসমর্পণের দিকে তাড়িত হয়। অবশেষে নিয়াজীর অনুরোধে ১৫ই ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে ন’টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। পরদিন সকালে বিমানাক্ৰমণ বিরতির সময়সীমা শেষ হওয়ার কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলীর মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছ’ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে দিয়ে ভারতের একজন স্টাফ অফিসার পাঠানোর অনুরোধ জানান যাতে অস্ত্র সমর্পণের ব্যবস্থাদি স্থির করা সম্ভব হয়। এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগে অবশ্য মেজর জেনারেল নাগরার বাহিনী কাদের সিদ্দিকী বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর ব্রীজে হাজির হন এবং সেখান থেকে নাগরা নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নিয়াজীর আত্মসমর্পণের ইচ্ছা ব্যক্ত হওয়ার পর সকাল ১০:৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যেকব মধ্যাহ্নে ঢাকা এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ান সৈন্য ঢাকা প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার, এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকা অবতরণ করেন। এর আধ ঘণ্টা বাদে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল হর্ষোৎফুল জনতার উপস্থিতিতে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সমরাধিনায়ক লে. জেনারেল নিয়াজী ‘বাংলাদেশে অবস্থিত’ সকল পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। কিছু পরেই ইন্দিরা গান্ধী পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত।