অধ্যায় ৯: জুলাই – আগষ্ট
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কিসিঞ্জারের ভারত সফর এবং দ্বিতীয় সপ্তাহে ইসলামাবাদ হয়ে তার গোপন চীন পরিক্রমার সংবাদ ১৫/১৬ই জুলাই প্রচারিত হওয়ার অব্যবহিত পর এই সব ঘটনার সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনার উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন আমাকে দিল্লী যেতে বলেন। ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে দিল্লীর আবহাওয়া বহুলাংশে পরিবর্তিত। কিসিঞ্জারের গোপন পিকিং সফর এবং ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফর-সংক্রান্ত ঘোষণার পর উপমহাদেশের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব বিবেচনা করে, দক্ষিণ ও বাম নির্বিশেষে দিল্লীর ক্ষমতার অলিন্দ তখন ক্ষুব্ধ, বিরক্ত, চিন্তিত, সন্দিহান অথবা উত্তেজিত। এক অপ্রত্যাশিত ভালো সংবাদ পাওয়া গেল ১৯শে জুলাই সন্ধ্যায়। পি. এন. হাকসার আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনার সূত্র ধরে যথাশীঘ্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যফ্রন্ট গঠনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেন এবং এই প্রসঙ্গে জানান, সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে শীঘ্রই তাদের এক বড় রকমের সমঝোতা’ আশা করা যায়।
পরদিন ২০শে জুলাই কোলকাতা ফিরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে সংবাদটি দেওয়ার পর এ বিষয়ে আলোচনাকালে আমরা উভয়েই পরিস্থিতির এক গুণগত উন্নতির সম্ভাবনা সম্পর্কে একমত হই। বস্তুত মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে ভারতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যকে ভারতের অনুকূলে আনা এবং তদুদ্দেশ্যে ভারত-সোভিয়েট সমঝোতা প্রতিষ্ঠাই ছিল পূর্ববর্তী দুই মাসে আমাদের গোপন দেন-দরবারের মূল লক্ষ্য। অব্যাহত শরণার্থী স্রোত, উদ্ভত সঙ্কটের রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্নে পাকিস্তানী অনমনীয়তা, পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় কিসিঞ্জারের চীন সফর এবং সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের সীমান্ত রক্ষায় পূর্বতন মার্কিন প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার হওয়ার ফলে আমাদের সেই প্রচেষ্টা অসামান্যভাবে সাহায্যপ্রাপ্ত হয়।
প্রত্যাসন্ন ভারত-সোভিয়েট সমঝোতার বিষয়বস্তু ও পরিধি এবং বিশেষত এর ফলে পাক-চীন আক্রমণ আশঙ্কার বিরুদ্ধে ভারতের নিরাপত্তাবোধই কেবল উন্নত হবে, না বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে জয়যুক্ত করার জন্য সর্বাত্মক অর্থে তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে মর্মে নির্দিষ্ট তথ্যাদি তখনও অজানা। তবু ২০শে জুলাইয়ের বৈঠকে আমরা উভয়ে একমত হই যে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের জন্য তখন থেকেই সংশ্লিষ্ট সকল মহলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করা যেতে পারে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত শিলিগুড়ি সম্মেলনে মন্ত্রিসভার অনুসৃত নীতি সম্পর্কে গণপ্রতিনিধিদের সর্বসম্মত আস্থা অর্জনের দরুন তাজউদ্দিন স্বাভাবতই মনে করেন, মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার কোন বাধা নেই। তবে প্রত্যাশিত ভারত-সোভিয়েট চুক্তি সরকারীভাবে জ্ঞাত হওয়ার পরেই এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার অনুমোদন লাভের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব। এ প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভার প্রত্যেক সদস্যের মনোভাব আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা করে দু’জনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি কমবেশী উদ্বেগ প্রকাশ করেন-কম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সম্পর্কে এবং বেশী পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ সম্পর্কে।
সাধারণভাবেই এরূপ মোর্চা গঠনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেকের কাছে তখনও যথেষ্ট অপ্রিয়। তদুপরি সৈয়দ নজরুলের আত্মজ মুজিব বাহিনী’র একজন উৎসাহী সদস্য হওয়ায় এবং বামপন্থী দলসমূহ ও তাজউদ্দিন সম্পর্কে ‘মুজিব বাহিনী’র বিরুদ্ধতা অতিশয় সুস্পষ্ট থাকায়, ঐক্যফ্রন্ট গঠন বিষয়ে?সৈয়দ নজরুলের আপত্তি নিতান্ত কম ছিল না। অন্যদিকে খোন্দকার মোশতাকের সম্ভাব্য আপত্তি অপেক্ষাকৃত প্রবল বলে অনুমান করা হয় এ কারণেই যে, আওয়ামী লীগের মধ্যে দক্ষিণপন্থী হিসাবে তাঁর ভূমিকা বরাবরই সুস্পষ্ট। তৎসত্ত্বেও ক্ষীণ একটি আশার আলো আমরা দেখতে পাই। তাজউদ্দিনের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক চরিত্র এবং দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হিসাবে, এবং বিশেষত প্রধানমন্ত্রিত্বের পদকে কেন্দ্র করে তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে বৈরিতাবোধ খোন্দকার মোশতাকের প্রবাসের জীবনকে বহুলাংশে কর্মভারাক্রান্ত করে রাখত। সে কারণে এবং অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সকল প্রয়োজনীয় সোপান অতিক্রম করার বাস্তব বুদ্ধি তাঁর সহজাত ছিল বলে ভারত সরকারের আস্থা উদ্রেকের স্বার্থে বামপন্থীদের সাথে মোর্চা গঠনের মত অশাস্ত্রীয় কাজও তিনি সমর্থন করে ফেলতে পারেন বলে আমাদের মনে হয়। বস্তুত খোন্দকার মোশতাকের এই বাস্তবতাবোধের নির্ভুল সদ্ব্যবহারের উপর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের গঠন ছিল নাজুকভাবে নির্ভরশীল। তাকে যদি ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্তে শামিল করা যায়, তবে ফ্রন্ট গঠন দূরের কথা, মুজিব বাহিনী’, আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীদের দলীয়মন্যতা এবং বিভিন্ন উপদলীয় স্বার্থের মিলিত আবর্তে খোদ আওয়ামী লীগের জন্যই এক বিরাট সাংগঠনিক সঙ্কটের সৃষ্টি অসম্ভব ছিল না। এই যুক্তিতে এবং তাদের উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তাজউদ্দিন আমার ওপর এই অস্বস্তিকর দায়িত্ব চাপিয়ে দেন, বস্তুত আমার সম্মতির অপেক্ষা না-করেই।
এদিকে ঠিক একই সময়ে, অর্থাৎ জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উপমহাদেশীয় নীতি নানাবিধ স্তরে উন্মোচিত হতে শুরু করে, যেগুলি কার্যকর হলে বাংলাদেশের সদ্যপ্রসূত স্বাধীনতা সম্ভবত সূতিকাগৃহেই নিশ্চিহ্ন হত। বস্তুত পরবর্তীকালে প্রকাশিত তথ্যাদি থেকে দেখা যায়, পূর্ব বাংলার মানুষের নির্বাচনী রায় সামরিক পন্থায় নস্যাৎ করার জন্য জানুয়ারী থেকে পাকিস্তানী জান্তা যে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল, সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র অনেক কিছুই অবহিত ছিল এবং এ ব্যাপারে আপত্তি না করে পরোক্ষভাবে জান্তাকে সমর্থন করে যাওয়াই তাদের সরকারী নীতি ছিল। মার্চে শেখ মুজিবের সঙ্গে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কয়েক দফা বৈঠকের ঘটনা থেকেও অনুমান করা যায় যে, এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ছিল না। মার্চ-এপ্রিলের অনুসৃত মার্কিন নীতির প্রতিবাদ জ্ঞাপন করার ফলে নিজেদের ঢাকাস্থ কনসাল জেনারেল আর্চার বাড়কে এপ্রিল মাসে রাতারাতি বদলী করে মার্কিন সরকার জান্তার অভিযানের প্রতি তাদের গোপন সমর্থনের কথা প্রকাশ করেন। জুনে তাদের ভূমিকা আরও স্পষ্ট হয় পাকিস্তান জান্তার জন্য যুদ্ধাস্ত্রের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। এরপর জুনের শেষে ও জুলাইয়ের প্রথমার্ধে মাত্র ৩/৪ হাজার ছাত্র-যুবক ন্যূনতম অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে সেখানে আভ্যন্তরীণ শক্তির ভারসাম্য যখন দ্রুত দখলদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে পরিবর্তিত হতে শুরু করে তখন মার্কিন পর্যবেক্ষকদের জন্য তার তাৎপর্য খাটো করে দেকার অবকাশ ছিল না।
জুলাইয়ের শেষার্ধে ও আগস্টের প্রথম দিকে মার্কিন সরকারের বাংলাদেশ বিরুদ্ধতার কার্যক্রম মোটামুটি চারটি স্তরে অনুসত হতে দেখা যায়: (১) গণহত্যার শুরু থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর জন্য মার্কিন যুদ্ধাস্ত্র, গোলাবারুদ ও যন্ত্রাংশের যে সরবরাহ শুরু হয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অস্বীকৃতি এবং মার্কিনী জনপ্রতিনিধি ও জনমতের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও এক অদ্ভুত যুক্তিতে তা অব্যাহত থাকে। (২) মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য প্রদান থেকে বিরত করার উদ্দেশ্যে ভারতের উপর যে বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি করা হয়, তারই অংশ হিসাবে ১৭ই জুলাই কিসিঞ্জার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে চীনের সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের মুখে ভারতকে রক্ষা করার অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। (৩) মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পারাপার এবং দেশের অভ্যন্তরে তাদের গতিবিধি ও তৎপরতার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও আমেরিকার উৎসাহের কোন ঘাটতি ছিল না। পূর্ব বাংলার সীমান্তে ‘সাহায্য ও পুনর্বাসন বিশেষজ্ঞ হিসাবে ১৫৬ জন পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার ব্যাপারে জাতিসংঘকে সম্মত করানোর কাজ আমেরিকার ‘আগ্রহ ও ব্যয়ভার গ্রহণে সম্মতির ফলেই সম্ভব হয়। এমনকি মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা রোধ করার জন্য এমন কিছু কিছু উদ্যোগের আভাস পাওয়া যায়, যাতে আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূচনাপর্বের স্মৃতি জাগ্রত হয়। পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে মার্কিন সহায়তা চলছিল এক রকম প্রকাশ্যেই। কিন্তু তাদের গোপন সহায়তার উদ্যোগ ছিল আরও মারাত্মক। যেমন সিনেটর কেনেডী প্রকাশ করেন, ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে গেরিলাবিরোধী তৎপরতায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মার্কিনী ‘পুলিশ বিশেষজ্ঞ’ রবার্ট জ্যাকসনকে ‘প্রয়োজনীয় পুলিশ টিম’সহ ঢাকাস্থ টঝঅওউ নিয়োগ করতে চলেছে। (৪) প্রবাসী সরকারের একাংশের সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ভিতর থেকে বিভক্ত ও লক্ষ্যচ্যুত করার মার্কিনী কার্যক্রম সম্ভবত এ সময় অথবা এর কিছু আগে থেকে শুরু। কিসিঞ্জার তার স্মৃতিগ্রন্থের প্রথম খণ্ডে এই যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার তারিখ যদিও ৩০শে জুলাই বলে উল্লেখ করেছেন, তবু কথিত যোগাযোগকারীর নাম, যোগাযোগের সময় ইত্যাদি যথারীতি প্রকৃত যোগাযোগ ও কার্যকলাপ গোপন করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়। যথাস্থানে এই প্রসঙ্গে ফিরে আসার সুযোগ উন্মুক্ত রেখে আপাতত এটুকুই বলা যায়, প্রবাসী সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের সহযোগিতায় স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল ও দ্বিখণ্ডিত করে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ সম্ভবত তখনই জোরদার করা হয়েছিল, যখন জুলাইয়ে কিসিজ্ঞারের চীন সফরের পর ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে আমেরিকার প্রভাব-প্রতিপত্তি সবিশেষ হ্রাস পায় এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তা বৃদ্ধির সম্ভাবনা স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। এই অন্তর্ঘাতী প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা হয় ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর।
এমনিভাবে নিক্সন প্রশাসন ইয়াহিয়া-জান্তার পক্ষে সক্রিয় হয়ে ওঠার পর এবং বিশেষ করে, চৌ-কিসিঞ্জার আলোচনাকালে পাকিস্তানকে সমর্থন করার ব্যাপারে উভয় পক্ষের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, দখলকৃত এলাকার উপর পাকিস্তান নগ্ন ঔপনিবেশিক শাসন পাকাপোক্ত করার আয়োজন শুরু হয়। ইয়াহিয়া নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রস্তাবিত নতুন শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষার জন্য আরবী হরফ ব্যবহার করার, পূর্ব পাকিস্তানকে দুই থেকে চারটি নতুন প্রদেশে বিভক্ত করে পাঞ্জাবকে। পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশের মর্যাদা দেবার এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের ভোটাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করার সুপারিশ করে। এ অঞ্চলের ওপর সাংস্কৃতিক দখলকে চূড়ান্ত করার জন্য প্রশাসনিক পর্যায়ে ইসলামী নীতির উপর ভিত্তি করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের সিলেবাস প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ইতিহাস বিজড়িত ঢাকার অনেক পথ-ঘাটের নামের ‘ইসলামীকরণ’ সম্পন্ন হয়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত যথাক্রমে ৭৯ ও ১৯৪ জন আওয়ামী লীগ সদস্যদের নাম অন্যায়ভাবে বাতিল করে শুরু হয় গণধিকৃত দলগুলির সংখ্যাগরিষ্ঠতা সৃষ্টির উদ্যোগ। পূর্বাঞ্চলের এই নগ্ন ঔপনিবেশিক রূপান্তর প্রক্রিয়ায় জামাতে ইসলাম, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য সামপ্রদায়িক দলগুলির কর্মীদের সমবায়ে গঠিত ‘রাজাকার বাহিনী’ সন্ত্রাস ও নিপীড়নের মূলযন্ত্রে পরিণত হয়। জুলাইয়ে সশস্ত্র রাজাকারের সংখ্যা দাঁড়ায় বাইশ হাজার দেশে ফেরৎ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা যখন চার হাজারের মত।
সশস্ত্র রাজাকারের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে এর গুরুতর তাৎপর্য সম্পর্কে আমাদের প্রথম সজাগ করে তোলে আমাদের ঢাকাস্থ তথ্য গ্রুপ। মার্চে পাকিস্তানী হামলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে কিছু রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ সহায়তার কাজে সংঘবদ্ধ হন। এরূপ গোপন সহায়তার উদাহরণ দেশে আরো অনেক থাকলেও, একটি কারণে ঢাকা তথ্য গ্রুপের অবদান বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ঢাকা থেকে এই গ্রুপ নির্ভরযোগ্য নানা তথ্য দক্ষতার সাথে সংগ্রহ করে গড়ে তিন সপ্তাহে একবার আমার কাছে পৌঁছাবার ব্যবস্থা করতেন। মোখলেসুর রহমান, তাঁর স্ত্রী রোজ’বু, জিয়াউল হক, আনোয়ারুল আলম, আতাউস সামাদ, জহিরুল ইসলাম, রহমত উল্লাহ এবং আরো কয়েকজন এই গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং প্রশংসনীয় নির্ভুলতার কারণে তাদের পাঠানো তথ্যাদি ও সমীক্ষা প্রধানমন্ত্রীর সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাদির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজাকার বাহিনীর দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে জামাতে ইসলাম প্রভৃতি দলগুলির ‘আদর্শগত উদ্দীপনা’ ছাড়াও, নিয়মিত ভাতা, রেশন, স্থানীয় ক্ষমতার ব্যবহার এবং সর্বোপরি হিন্দু সমপ্রদায় ও আওয়ামী লীগ সদস্যদের ঘরবাড়ী ও বিষয় সম্পত্তি অবাধে লুটপাট ও ভোগদখল করার সুযোগ ছিল যোগদানকারীদের জন্য বিরাট আকর্ষণ। রাজাকার বাহিনীর তুলনামূলক সংখ্যাধিক্য, অস্ত্রশস্ত্রের সুবিধা এবং দ্রুত চলাচল ক্ষমতার দরুন এদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সীমিত অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমশ বেশ বেকায়দায় পড়ে। শান্তি কমিটির গোপন চর ও রাজাকারদের দৌরাত্ম এবং পাকিস্তানী বাহিনীর নির্বিচার প্রতি আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের চমকপ্রদ তৎপরতা মাত্র ৫/৬ সপ্তাহের মধ্যেই হ্রাস পেতে শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধের এই অধোগতি রোধ করার জন্য আগস্টের প্রথম দিকে তাই কয়েকটি বিষয়ের পুনর্বিবেচনা অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। প্রথমত, মে মাসে নিয়মিত বাহিনী বাদে সর্বমোট যে কুড়ি হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দানের সিদ্ধান্ত করা হয়েছিল, তা বাস্তব প্রয়োজনের আলোকে দ্রুত বাড়িয়ে তোলা এবং তাদের অস্ত্রসজ্জার মান উন্নত করার প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভূত হয়। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানী চরদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং রাজাকার বাহিনীর প্রতি আক্রমণ এড়িয়ে সশস্ত্র তৎপরতা চালাবার জন্য ব্যাপক সংখ্যায় শরণার্থী রাজনৈতিক কর্মীদের ফেরৎ পাঠানো এবং তাদের সহায়তায় দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাঁটি গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত হয়। তৃতীয়ত, রিক্রুটের নীতি দলীয় আনুগত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে যোদ্ধা তরুণদের সংগ্রামী যোগ্যতা ও ব্যক্তিগত গুণাগুণের ভিত্তিতে অনুসরণ করার প্রয়োজন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধ ব্যবস্থাপনার এই সব জরুরী প্রয়োজন কিভাবে বা কত তাড়াতাড়ি মেটানো যাবে, সে সম্পর্কে অবশ্য কোন পরিষ্কার ধারণা গঠন আগস্টের প্রথম অবধি আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আলোচ্য সময়ে পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের নব প্রাণ সঞ্চার এবং সীমান্তে মুক্তাঞ্চল গঠিত হওয়ার আশঙ্কায় পাকিস্তান একদিকে যেমন ছিল উদ্বিগ্ন, তেমনি অপরদিকে ছিল চীন-মার্কিন আঁতাতের সম্ভাব্য কার্যকারিতায় আশান্বিত। এই দুই বিপরীতমুখী সম্ভাবনার মাঝে পাকিস্তানী জান্তা জুলাইয়ে সম্ভবত এমন সিদ্ধান্তের কাছাকাছি পৌঁছায় যে, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে উত্তরোত্তর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার পরিবর্তে বরং আরেক দফা পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু করা অধিক যুক্তিযুক্ত। জুলাইয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কিসিঞ্জার ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে পাকিস্তান কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণা এবং সেই যুদ্ধে চীনের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা সম্পর্কে সতর্ক
করে দেওয়ার পর, ১৯শে জুলাই, ৩০শে জুলাই এবং ৪ঠা আগস্ট মোট তিন-দফায় ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধংদেহী ঘোষণা যেমন শূন্যগর্ভ ছিল না, তেমনি আসন্ন যুদ্ধে ‘পাকিস্তান একা থাকবে না’ এই মর্মে তার সতর্কবাণীও তাৎপর্যহীন ছিল না। যুদ্ধোপযোগী ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ সাপেক্ষে শরৎকাল ছিল পাকিস্তানের যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রকৃষ্ট সময়। এর কারণ-প্রথমত, বাংলাদেশে সফল অভিযান চালাবার মত সামরিক অবকাঠামো নির্মাণ অথবা সৈন্য সমাবেশ তখনও ভারত সম্পন্ন করে উঠতে পারেনি; দ্বিতীয়ত, শরৎকালে অসংখ্য খাল-বিল নদীনালা পরিকীর্ণ পূর্ব বাংলা প্রতিরক্ষা যুদ্ধের পক্ষে আদর্শ স্থানীয় বলে এ সময়ে ভারতের পক্ষে দ্রুত ও চূড়ান্ত সামরিক বিজয় সাধন ছিল প্রায় অসম্ভব; এবং তৃতীয়ত, ভারত-তিব্বত সীমান্তের সকল গিরিপথ বরফমুক্ত থাকায় পাকিস্তানের মিত্ররাষ্ট্র চীনের ভারতবিরোধী অভিযানের পথে কোন বড় অন্তরায় ছিল না। শরৎকালীন যুদ্ধে বিপর্যয়ের ঝুঁকি নগণ্য বিধায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান তৎপরতাকে এক বৃহত্তর পাক-ভারত যুদ্ধে নিমজ্জিত করা, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাকিস্তানী প্রবণতা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ অবধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু শরৎকালীন যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের এই প্রবণতা বিঘ্নিত হয় সোভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁন্দ্রে গ্রোমিকোর আকস্মিক দিল্লী সফর এবং ৯ই। আগস্টে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের ফলে।