অধ্যায় ৭: জুন – জুলাই
জুন ও বিশেষত জুলাই মাসে বিভিন্নমুখী ঘটনার সমাবেশ ও ঘাত প্রতিঘাতে উপমহাদেশের পরিস্থিতি গভীরতর সংঘাতের দিকে মোড় নেয়। বাংলাদেশ সমস্যার ‘রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে মার্কিন সহায়তা লাভের যে আশাবাদ ভারতের ক্ষমতাসীন দক্ষিণের ছিল, জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তা হ্রাস পেতে শুরু করে। জুলাই মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক নীতির পরিবর্তন সহসা এমনভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে যার ফলে ভারতের নিরাপত্তাহীনতাবোধ চরমে পৌঁছে এবং নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্বেষণ অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠে। অন্যদিকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পুনর্দখলের ফলে সৃষ্ট পাকিস্তানী শাসকদের আত্মপ্রসাদ জুন মাসের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে ম্লান হতে শুরু করে। এই এলাকায় তাদের দখল কায়েম রাখার সমস্যা নতুন করে প্রকট হয়ে ওঠে সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছাত্র ও তরুণদের সশস্ত্র তৎপরতার সূচনাতে। একই সময়ে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার ছোটখাট সংঘাতের ফলে এ অঞ্চলে পাকিস্তানীরা তাদের সামরিক অবস্হানকে সীমান্ত বরাবর এমনভাবে পুনর্বিন্যস্ত করে, যার ফলে তাদের সামরিক শক্তি ক্রমশ খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়তে শুরু করে। আর সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে বিশৃঙ্খলাভাব অনেকটা দূর হয় জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে শিলিগুড়িতে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদেও বৈঠকের পর। এর ফলে অস্থায়ী মন্ত্রিসভা অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল ও সংহত হয়। এ ছাড়া ১০ই জুলাই থেকে সপ্তাহকালব্যাপী বৈঠকের ফলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক বিন্যাস ও কর্মপদ্ধতিতে কিছু শৃঙ্খলার সূচনা ঘটে।
গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে পাশ্চাত্য দেশগুলির অধিকাংশ পত্রপত্রিকা এবং জনপ্রতিনিধিদের উল্লেখযোগ্য অংশ সামরিক চক্রের নীতির বিরুদ্ধে প্রশংসনীয়ভাবে সোচ্চার থাকায় একথা মনে হওয়ার অবকাশ ছিল যে, এই সব দেশের সরকার স্ব স্ব জনমত অনুসারে শীঘ্রই হয়ত সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য পাকিস্তানী জান্তর উপর চাপ প্রয়োগ করবেন। ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশান্বিত হওয়ার কারণ ছিল আরও কিছু বেশী। ২৮শে মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে লিখিত এক চিঠিতে জানান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া সরকারকে এক রাজনৈতিক সমঝোতায় রাজী করানোর জন্য নীরবে কাজ করে চলেছে। পক্ষকালের মধ্যেই ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সর্দার শরণ সিং আমেরিকা পাড়ি দেন পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার অনুরোধ নিয়ে। তার সফর শেষে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের সংযমের প্রশংসা করে বলেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিক পর্যায়ে সমঝোতা স্থাপন ও শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পরেই শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব। তখনও বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বৈদেশিক নীতি ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর ও ‘হোয়াইট হাউসের’ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতের গড়মিল তথা, পররাষ্ট্র সচিব রোজার্স প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরী কিসিঞ্জারের মধ্যে প্রেক্ষিতবোধের তারতম্য এবং ব্যক্তিগত বিরোধ ও সংশ্লিষ্ট বৈরিতা বাইরে ততটা স্পষ্ট নয়। কাজেই মার্কিন মুখপাত্রের ঘোষণা ভারতের সংশ্লিষ্ট মহলে আরও কিছু আশার সঞ্চার করে।
কিন্তু শরণ সিং দেশে ফিরতে না ফিরতেই ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ২১ ও ২২শে জুনে প্রকাশিত হয়, নিরস্ত্র মানুষ হত্যার কাজে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে জেনেও মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের অনুমতিক্রমে পাকিস্তানী দুটি জাহাজ ‘সুন্দরবন’ ও ‘পদ্মা’ সমরাস্ত্রের যন্ত্রাংশ’ নিয়ে যথাক্রমে ৮ই মে ও ২১শে জুন পাকিস্তানের উদ্দেশে নিউইয়র্ক ত্যাগ করেছে। একই সময়ে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সাহায্য অব্যাহত রাখার পক্ষেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অনমনীয়তা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়। বিশ্ব ব্যাংকের ১১ জাতি ‘এইড-টু-পাকিস্তান ক্লাব’ ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ায় এক বছরের মত উন্নযন সাহায্য স্থগিত রাখার সুপারিশ গ্রহণ করে। কিন্তু ২৮শে জুন তারিখে মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, ক্লাবের অন্যান্য দেশ সাহায্য বন্ধ করলেও পাকিস্তানকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে মার্কিন কর্মসূচী অব্যাহত থাকবে। তার পর দিন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস অফিসার চার্লস ব্রে ঘোষণা করেন, পরবর্তী দুই এক মাসের মধ্যেই মার্কিন সমরাস্ত্র নিয়ে আরও চার অথবা পাঁচটি জাহাজ পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা দেবে।
জুনের সবচাইতে খারাপ খবর আসে ইসলামাবাদ থেকে। ২৮শে জুন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের বেতার ঘোষণায় বিশেষজ্ঞ দ্বারা নতুন সংবিধান তৈরী করে বেসামরিক প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আশ্বাস দেওয়া হয় বটে, কিন্তু তাতে প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তরের অথবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার সামান্যতম ইঙ্গিত খুঁজে পাওয়া চরম আশাবাদীর পক্ষেও দুরূহ হয়ে পড়ে। এক মাস আগে পাকিস্তান সরকারকে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছে বলে নিক্সন যে আশ্বাস দেন তদমর্মে অগ্রগতির কোন নিদর্শন ইয়াহিয়ার বেতার বক্তৃতায় ছিল না।
অবশ্য ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশাবাদ চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে হেনরী কিসিঞ্জারের নয়াদিল্লী সফরের দু’সপ্তাহের মধ্যে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে কিসিঞ্জার বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যদান থেকে বিরত হওয়ার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন। পক্ষান্তরে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ শরণার্থীদের দেশে ফেরার পথ সুগম করার জন্য শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছুবার ব্যাপারে পাকিস্তানীদের উপর চাপ দেওয়ার অনুরোধ করেন এবং তদুদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবী জানান। কিসিঞ্জার মুজিবের মুক্তি এবং সামরিক সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে অক্ষমতা ব্যক্ত করলে ইন্দিরা জানান, ভারতের পক্ষেও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য বৃদ্ধি করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এমতাবস্হায় পাকিস্তানের পক্ষে ভারত আক্রমণ করার এবং চীনের তাতে অংশগ্রহণ করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে কিসিঞ্জার অভিমত প্রকাশ করেন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কি হবে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে কিসিঞ্জার জানান ভারত ও পাকিস্তানের বিরোধে আমেরিকা নিরপেক্ষ থাকলেও চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতকে সহায়তা করার পূর্ববর্তী ভূমিকা অপরিবর্তিত থাকবে।
কিসিঞ্জার অতঃপর পাকিস্তান যান। কিন্তু সেখান থেকে তিনি চীনের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য গোপনে পিকিং সফরে যান। কিসিঞ্জারের এই অপ্রত্যাশিত সফরে ভারতের সরকারী মহলের সর্বস্তরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বিরোধে মার্কিন ভূমিকা সম্পর্কে বিরাট সন্দেহের সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট নিক্সন অদূর ভবিষ্যতে চীন সফরে যাবেন, সে সংবাদ সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু সবচাইতে বড় আঘাতের তখনও বাকী। পিকিং থেকে ওয়াশিংটন ফেরার কয়েকদিন পর চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে তাদের পূর্বতন প্রতিশ্রুতির সংশোধন করে কিসিঞ্জার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল. কে. ঝা-কে অবহিত করেন, চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তবে সে ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। ফলে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন সীমান্ত সংঘাতের পর সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের সীমান্ত সুরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি ভারতকে দিয়েছিল, এমনকি মাত্র দশ দিন আগেও কিসিঞ্জারের মুখে যা অংশত পুনর্ব্যক্ত হয়েছিল, তার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। চীনের সাথে নির্মীয়মাণ সম্পর্কের স্বার্থে তাদের পূর্ববর্তী ভূমিকার এত বড় পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, না তার চীন সফরের ফলে সৃষ্ট পরিসি’তিকে মূলধন করে মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করাই কিসিঞ্জারের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, তা ইতিহাস গবেষণার বিষয়বস্তু।
কিসিঞ্জারের নতুন বক্তব্যের আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বা মধ্যস্থতায় শরণার্থী সমস্যা সমাধানের পক্ষে ভারত সরকারের দক্ষিণপন্থী অংশের আশাবাদ টিকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। ভারতে সকল মহলেই উপলব্ধি ঘটে-পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশের মুখে ভারত একা, ভারত নিরাপত্তাবিহীন। এই অবস্থায় কিসিঞ্জারের দাবী অনুসারে বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদান বন্ধ করে আসন্ন যুদ্ধ হয়ত এড়ানো সম্ভব কিন্তু শরণার্থীদের যে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব নয়, তা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। কেননা বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত অধিকাংশ শরণার্থীর জন্য ন্যূনতম নিরাপত্তাবোধ ফিরে পাওয়া অসম্ভব ছিল। কাজেই মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করা এবং তাদের জয়যুক্ত করার ব্যবস্হা গ্রহণ ভিন্ন শরণার্থীদের ফেরৎ পাঠানোর যে উপায় নেই, একথা জুলাইয়ের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় নীতিনির্ধারক মহলে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা প্রদান থেকে ভারতকে বিরত করার জন্য পাকিস্তান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই আঁতাত পরিস্ফুট হওয়ার পর ভারতও তার নিজের উত্তর ও উত্তরপূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সোভিয়েট সহযোগিতা লাভে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। এমনিভাবে আঞ্চলিক সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তনের সূচনা ঘটে।
অন্যদিকে মে মাসে ‘সমস্ত পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার’ পর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি পাকিস্তানী জান্তা তুলনামূলকভাবে নিরুপদ্রবেই ছিল। মার্চ-এপ্রিলের সামরিক নৃশংসতা এবং উপদ্রুত মানুষের অবিরাম দেশত্যাগের ফলে বহির্বিশ্বের বিরূপ প্রচার ও বিরুদ্ধ জনমত মোটামুটি তাদের ধাতস্থ হয়ে এসেছে। কিন্তু জুনের চতুর্থ সপ্তাহে প্যারিস বৈঠকে পাশ্চাত্য সাহায্যদাতা দেশগুলি বাৎসরিক সাহায্য বরাদ্দের সিদ্ধান্ত পিছিয়ে দেওয়ায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা তীব্রতর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি এই সপ্তাহ থেকে তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে, তখন তার নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
জুন মাস অবধি দেশের ভিতরে টাঙ্গাইল ও আরো দু-একটি এলাকায় মূলত স্থানীয় সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে কয়েকটি বিদ্রোহী বাহিনী প্রশংসনীয় দক্ষতার সাথে দখলদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছিল। জুন মাসের শেষ দিকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত দু’হাজারের কিছু বেশী ছাত্র ও তরুণ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে দেশের অন্যান্য অংশেও সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ে। এদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র ছিল নিতান্ত সামান্য। তবু এদের অসীম মনোবল ও দুঃসাহসিক অভিযানে বড় বড় সেতু ধ্বংস হয়, বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতে থাকে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথসহ বিভিন্ন স’ল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, রফতানী হ্রাস পায় এবং পাকিস্তানী সামরিক, আধাসামরিক বাহিনী ও বিশেষত তাদের অসামরিক তাঁবেদারদের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। এপ্রিল মাসে বিদ্রোহী সশস্ত্রবাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মীদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিরোধ থেমে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে স্বেচ্ছাসংগ্রামী এই তরুণদের অকুতোভয় সশস্ত্র লড়াইয়ের ফলে নতুন প্রাণ-সঞ্চার ঘটে স্বাধীনতা সংগ্রামের।
এর জবাবে পাকিস্তানী বাহিনী নৃশংসতার মাত্রা তোলে বাড়িয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার সামান্যতম নিদর্শনেও সংশ্লিষ্ট এলাকা ও আশেপাশের বসতির উপর ঢালাও আক্রমণ চালিয়ে, আগুন জ্বালিয়ে, তরুণদের পাইকারীভাবে আটক ও হত্যা করে সন্ত্রাসের রাজত্বকে আরো বেশী চাঙ্গা করে তোলে। ফলে সৃষ্টি হয় আরও দুঃখ-দুর্দশা, আরও বাস্তুহারা, আরও ক্রোধ এবং ঘৃণা। দখলকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে এ কথা প্রমাণ করার জন্য মে মাসের শেষ দিকে। কিছু সংখ্যক বিদেশী সাংবাদিকদের অধিকৃত এলাকায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছিল। তাদের উপসি’তিতেই সশস্ত্র তরুণদের তৎপরতা শুরু হওয়ায় স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশে ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ শুরু হবার কথা সারা বিশ্বে প্রচারিত হতে থাকে, যেমন প্রকাশিত হতে থাকে। দখলদার সৈন্য বাহিনীর অমানুষিক নিপীড়ন ও নির্যাতনের কাহিনী।
একই সময়ে দেশের অভ্যন্তরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সীমান্ত পারাপারকে সহজ করে তোলার জন্য সীমান্ত এলাকাতেও কিছু সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু করা হয়। জুনের শেষ দিকে এবং বিশেষত জুলাই মাসে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী পাকিস্তানের বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটি (BOP) নিয়মিতভাবে ধ্বংস করার কাজে নিযুক্ত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলকে বাংলাদেশের যুদ্ধ-অনভিজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াতের পথকে সুগম (porous) করে তোলে। সমগ্র দখলকৃত এলাকায় পাকিস্তানী গোলন্দাজ রেজিমেন্টের সংখ্যা ছিল পাঁচের অনধিক। দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে ভারতীয় গোলন্দাজ আক্রমণের জবাব দেবার ক্ষমতাও তাদের ছির সীমিত। ভারতের ১০/১২টি ফিল্ডগানের আক্রমণের জবাব পাকিস্তানীরা দিতে পারত মাত্র ২/৩টি ফিল্ডগানের সাহায্যে। ফলে যে সব অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়া-আসার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেই সব অঞ্চলের পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটির পতন ঘটতে থাকে একের পর এক। জুলাইয়ের শেষে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটির শতকরা প্রায় পঞ্চাশভাগ অকেজো হয়ে পড়ে এবং পর্যাপ্ত সৈন্যবলের অভাবে তার অধিকাংশই শেষ অবধি তেমনি অবস্থাতেই পড়ে থাকে।
ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর এই সীমিত তৎপরতার প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে পাকিস্তানী জান্তা কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। একই সঙ্গে দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং সীমান্তে ভারতীয় গোলন্দাজ আক্রমণের ফলে তাদের সন্দেহ হয় পূর্ব পাকিস্তানের অংশ বিশেষ দখল করে নেয়াই এই তৎপরতার লক্ষ্য। সম্ভবত তাদের এই সন্দেহ আরও জোরদার হয়ে ওঠে ১২ই জুলাই লন্ডনের ‘টাইমস্ পত্রিকায় বাংলাদেশ শরণার্থী সমস্যার সমাধান সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্ট্যাডিজ এ্যান্ড এ্যানালাইসিস’-এর ডিরেক্টর কে, সুব্রামনিয়ামের অভিমত প্রকাশিত হবার পর। সুব্রামনিয়ামের মতে, শরণার্থী সমস্যার প্রতিবিধানের জন্য ভারতের উচিত পূর্ব বাংলার কোন একটি অংশ মুক্ত করে শরণার্থীদের সেখানে স্থানান্তরিত করা, যেখানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকেও সার্বভৌমত্বের মর্যাদাসহ প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে। এই অভিমতের পক্ষে ভারতের DMO লে. জেনারেল কে. কে. সিং-এর সমর্থনের কথা জানা গেলেও, সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিমান প্রতিরক্ষা এবং ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ সামর্থ্য অর্জন করার পূর্বে এরূপ কোন মুক্তাঞ্চলকে পাকিস্তানী প্রতি-আক্রমণ থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত দুরূহ ছিল। একা বাংলাদেশের পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে এ জাতীয় সামর্থ্য অর্জন করার সুযোগ ছিল না। আর ভারত যদি এ ব্যাপারে নিজেরাই দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত হত, তবে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণাও অনিবার্য হয়ে দাঁড়াত। ১৯শে জুলাই ইয়াহিয়ার ঘোষণাতেও স্পষ্ট করে বলা হয়, ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানের কোন অংশ দখলের চেষ্টা করে তবে পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু করবে।
জুন-জুলাইয়ে বাংলাদেশ সামরিক মহলেও মুক্তাঞ্চল প্রতিষ্ঠার পক্ষে কিছু চিন্তাভাবনা চলছিল। জুলাই মাসে ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্তের পিছনে মুক্তাঞ্চল গঠনের বিবেচনাও যে সক্রিয়, তা কিছুটা প্রকাশ্যেই আলোচনা হয়েছে। ফলে জুলাই মাসেই পাকিস্তানী শাসকদের মনে এমন ধারণা প্রবল হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল যে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সহায়তায় সীমান্তের কাছে এক বা একাধিক মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে পারে। এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক তাৎপর্য অনুধাবন করে ইয়াহিয়াচক্র তাদের সেনাবাহিনীর জন্য এক নতুন নির্দেশ জারী করে। এই নির্দেশ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের এক ইঞ্চি ভূমিও যাতে শত্রু কবলিত না হয়, তজ্জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সীমান্ত এলাকার পাহারা জোরদার করতে বলা হয়। এই নির্দেশ পালন করতে গিয়ে দখলদার বাহিনী সীমান্ত বরাবর ছড়িয়ে পড়ে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে। এর ফল দাঁড়ায় মূলত দুটো।
প্রথমত, দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য সংখ্যা হ্রাস পায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য লড়াই চালানো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। যদিও রাজাকার বাহিনীর সংখ্যা বাড়িয়ে পাকিস্তানীরা সৈন্য ঘাটতিজনিত সমস্যার আংশিক সুরাহা করে, তবু তাদের প্রধান বাহিনী সীমান্তের দিকে সরিয়ে না নিয়ে গেলে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকারদের মিলিত শক্তি মোকাবিলা করা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দুঃসাধ্যের হত।
দ্বিতীয়ত, চৌদ্দশ মাইল দীর্ঘ এ সীমান্ত বাবর ছোট ছোট অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ার ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর একীভূত শক্তি সেই অনুপাতেই খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়ে এবং বড়, এমনকি মাঝারি আক্রমণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা সবিশেষ হ্রাস পায়। দেশের সীমান্তে মুক্তাঞ্চল গঠিত হবার আশঙ্কাবোধ থেকে পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে দখলকৃত এলাকায় নিজেদের অবস্থানের পুনর্বিন্যাস সাধন করে, তাতে তাদের সম্ভাব্য পরাজয়ের পথ প্রস্তুত হতে শুরু করে।
জুলাই মাসে স্বেচ্ছাসংগ্রামী ছাত্র ও তরুণদের সশস্ত্র তৎপরতা শুরু হবার অল্প সময়ের মধ্যে দখলকৃত এলাকায় মে-জুনের তথাকথিত স্থিতিশীলতার অবসান ঘটে, আভ্যন্তরীণ শক্তির ভারসাম্যের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয় এবং পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত বরাবর সৈন্যবাহিনী বিস্তৃত হওয়ার ফলে একযোগে আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গেরিলা বিরোধী যুদ্ধ এবং সীমান্তে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ চালাবার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ক্ষমতা হ্রাস পেতে শুরু করে। অন্যদিকে এই জুলাই মাসেই ভারতের ক্ষমতাসীন দক্ষিণকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তান ও চীন উভয়ের সঙ্গে এমনভাবে নিজকে যুক্ত করে যে, ভারতের নিরাপত্তাহীনতাবোধ তার ফলে চরমে পৌঁছায় এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ক চুক্তিতে পৌঁছানো সম্পূর্ণ প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারের উপর মার্কিন প্রভাব হ্রাস পেতে শুরু করায় এবং এর পাশাপাশি, ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্হা সুদৃঢ় করার উদ্যোগ গৃহীত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতের বৃহত্তর সাহায্যের পথ সুপ্রশস্ত হয়।