অধ্যায় ১৩: সেপ্টেম্বর – অক্টোবর
আওয়ামী লীগের ক্রমাবনত উপদলীয় পরিস্থিতির মাঝে শেখ মণির প্রভাব ও ক্ষমতার কথা বিবেচনা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও ত্রাস সৃষ্টি থেকে তাঁকে বিরত করার বিভিন্ন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলে পুনরায় দিল্লীর সংশ্লিষ্ট দফতরের জরুরী দৃষ্টি আকর্ষণের প্রয়োজন দেখা দেয়। এই উদ্দেশ্যে ডি. পি. ধরের পরামর্শ অনুযায়ী ১২ই সেপ্টেম্বরে তাজউদ্দিন আমাকে দিল্লী পাঠান। ডি. পি. ধর পরদিন বিকেল চারটায় নয়াদিল্লীর প্রধান সচিবালয় “সাউথ ব্লকে’ RAW-এর প্রধান রামনাথ কাও-এর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাম্প্রতিক কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনার আলোকে যথাশীঘ্র ‘মুজিব বাহিনী’কে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার পক্ষে আমার বক্তব্য কাও ভাবলেশহীন মৌনতায় শ্রবণ করেন এবং আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর বিদায় জ্ঞাপনকালে ক্ষণিকের জন্য সে মৌনতা ছিন্ন করেন। চার সপ্তাহ আগে কাও তাজউদ্দিনের বক্তব্যের জবাবে যে নীরবতা প্রদর্শন করেন, তদপেক্ষা কোন উন্নত সৌজন্য আমার প্রাপ্য ছিল না।
পরদিন সকালে ডি. পি. ধরকে আমি জানাই যে, পূর্ববর্তী অপরাহ্নের সাক্ষাৎকারের পরেও পরিস্থিতির কোন উন্নতির সম্ভাবনা যেহেতু দৃষ্টিগোচর নয়, সেহেতু প্রতিশ্রুত সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের এই দ্বৈত কমান্ডের অবসান একান্ত অপরিহার্য। উত্তরে তিনি আমাকে অধ্যাপক পি. এন. ধরের (তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব) সঙ্গে অপরাহ্নে সাক্ষাৎ করে সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতি অবহিত করার পরামর্শ দেন। যথাসময়ে তা আমি সম্পন্ন করি বটে, কিন্তু ক্রমশ এই ধারণা আমার মনে প্রবল হয়ে উঠতে থাকে: ‘মুজিব বাহিনী’র স্বতন্ত্র কমান্ড বজায় রাখার পক্ষে ভারত সরকারের পূর্বেকার সিদ্ধান্ত এমনই জোরাল যে এর পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্র প্রস্তুতের কাজে আমি হয়ত ব্যবহৃত হয়ে চলেছি। সন্ধ্যায় ডি. পি. ধরের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বৈঠকে প্রসঙ্গটি পুনরায় উত্থাপিত হয়; কিন্তু কোন সিদ্ধান্তের আভাস তাঁর বক্তব্যে ছিল না। বরং দু’দিন বাদে কোলকাতা যাওয়ার পর ন্যাপ-সিপিবি কর্মীদের মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম হবেন, এই মর্মে তিনি একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত রাখেন। মুজিব বাহিনী’ প্রশ্নে ভারসাম্য বিধানের জন্য বামপন্থীদের মুক্তিবাহিনীতে নেওয়ার পক্ষে আমাদের অনুক্ত যুক্তি যেমন তার দৃষ্টি এড়ায়নি, তেমনি ভারতীয় প্রশাসনের অভ্যন্তরে প্রতিকূল বিভিন্ন ধারা সত্ত্বেও এ বিষয়ে তার সহযোগিতার প্রয়াস আমাদের অগোচরে থাকেনি।
আমি দিল্লী থেকে ফিরে আসার একদিন পরে অর্থাৎ ১৬ই সেপ্টেম্বরে ডি. পি. ধর তিন দিনের জন্য কোলকাতা আসেন। তাঁর প্রধান আলোচনাই ছিল তাজউদ্দিনের সঙ্গে। বাংলাদেশের সর্বাত্মক মুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও ভারত অদূর ভবিষ্যতে কোন সহযোগিতা চুক্তিতে পৌঁছাতে পারে কি না, সেই সম্ভাবনার অন্বেষণ ছিল এই আলোচনার মূল বিষয়। ভারতের অনুসৃত নীতি তখন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্প্রসারিত ভিত্তিতে সাহায্য করার অতিরিক্ত কিছু নয়। সামরিক পর্যায়ে, ‘অবস্থান অঞ্চল’ গঠনের জন্য লে. জেনারেল কে, কে, সিং-এর পূর্ববর্তী পরিকল্পনা যদিও ম্লান ও পর্যালোচনার অধীন, তবু সরকারীভাবে তখনও তা পরিত্যক্ত নয়। সর্বোপরি আন্তর্জাতিক শক্তির ভারসাম্য তখনও ভারতের সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুপযোগী। ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি ভারতকে পাক-চীন যুগ্ম আক্রমণের আশঙ্কা থেকে মুক্ত করলেও এবং তার ফলে ভারতের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা বাড়ানো সম্ভব হলেও, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক তা সম্ভবত সোভিয়েট ইউনিয়নের কাম্য ছিল না। ভারত যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্বল্প সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত সামরিক বিজয় লাভে সক্ষম তাও ছিল প্রমাণ সাপেক্ষ। ফলে একদিকে আমেরিকা বা জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতি ও স্থিতাবস্থা ঘোষণা এবং অপরদিকে এই ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনিবার্য কূটনৈতিক সংঘাতের মাধ্যমে দাঁতাত প্রক্রিয়া ও নিরস্ত্রীকরণ আলোচনার ক্ষতিসাধন–এই দুই আশঙ্কাবোধ থেকে সোভিয়েট ইউনিয়ন যদি পাক-ভারত যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তখনও সচেষ্ট থেকে থাকে, তবে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। তা ছাড়া, আমেরিকার মাধ্যমে পাকিস্তানী জান্তাকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য চাপ সৃষ্টির সুযোগ যে সম্পূর্ণ নিঃশেষিত, সম্ভবত সে উপলব্ধিতে পৌঁছুতে সোভিয়েট ইউনিয়নের তখনও বাকী।
সোভিয়েট ইউনিয়নের এই মধ্যপন্থী ভূমিকার তুলনায় ভারতের প্রত্যাশা ছিল বেশী। সোভিয়েট নীতিনির্ধারকদের রাজনৈতিক যুক্তিবিন্যাস সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতা থাকার ফলে ডি. পি. ধরের পক্ষে সোভিয়েট অবস্থান আরও কিছু নিকটতর করার সম্ভাবনা আঁচ করা হয়ত সম্ভব ছিল। পাকিস্তানী হামলায় মাত্র পাঁচ মাসে শরণার্থীর সংখ্যা ৮০ লক্ষ অতিক্রম করার পর এবং বিশেষত পাক বাহিনীর ‘কাফের নিধন’ কর্মসূচীর বিশেষ লক্ষ্যে পরিণত হওয়ায় পাকিস্তানী সৈন্যের পূর্ণ অপসারণ ব্যতীত অধিকাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে অক্ষমতা পরিদৃষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া ভারতের কোন সত্যিকার বিকল্প ছিল না। কাজেই সোভিয়েট মনোভাবকে এই প্রশ্নে অনুকূল করার জন্য সর্ব উপায়ে সচেষ্ট হওয়া তাদের জন্য অত্যন্ত সংগত ছিল।
কোলকাতায় ডি. পি. ধরের বহুমুখী ব্যস্ততা ও আলাপ আলোচনার মাঝে যে সীমিত বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে তাঁর আলোচনা হয় সে বিষয়ে রক্ষিত নোটের উদ্ধৃতি সে সময়ের অবস্থা উপলব্ধির পক্ষে সহায়ক হতে পারে:
১৭ই সেপ্টেম্বর
“Met DP at 8:30 am. Now that a consultative committee has been formed, restrictions against recruiting NAP-CPB workers as FF can be waived, if the PM (Bangladesh) gives the clearance, said DP. As I mentioned that such clearance would be readily available, DP wanted to know how many of left workers could be mobilised for recruitment and how fast. Secondly, he wanted the clearance should be communicated to him by Tajuddin himself and if possible by tomorrow before he left Calcutta, so that necessary orders could be issued speedily. With regard to the first point, I said that the total number could… reach between 20,000 and 25,000, and the mobilisation could be made at a rate of 5,000 per week.
“Met Tajuddin at 3:30 pm and told him about the clearance required by DP…. He asked for Group Captain Khondkar’s opinion, since the C-in-C was out of station. Khondkar supported the move. He offered his transport for its use for contacting NAP camps on western sectors. On my way back to DP, I went to NAP and CPB offices, handed over the jeep and gave necessary advice. Met DP at 5 pm as scheduled… DP said that the recruitment and training would begin immediately, usual 3 weeks training and induction under BD command; but he remained silent about the actual size to be recruiteds. He proposed another meeting with me next day to discuss other matters.”
১৮ই সেপ্টেম্বর
“Met Tajuddin at 8 am, and briefed him about the development since previous afternoon. He wanted me to keep the pressure on DP about bringing Mujib Bahini under BD commnad..
“Met DP at 5 pm. He showed anxiety at the decline of FF activity… I explained the difficulty of repoliticising the occupied areas and its consequence on FF activity. He emphasised the need for better co-ordination in selecting the targets for FF ops and wanted to know if there was any insurmountable difficulty in inducting base workers in a few pre-selected areas for ops. He sounded so ad hoc….
“On Mujib Bahini, he felt that his PM’s intervention would be required as it seemed to be a tricky matter…”
আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই নতুন রিক্রুটমেন্ট যথাসম্ভব গোপনে চালিয়ে যাওয়া স্থির হয়। এই সিদ্ধান্তের আর একটি দিক ছিল সবিশেষ লক্ষণীয়। মাত্র সতের দিন আগে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের যুগ্ম সিদ্ধান্তের পদ্ধতি ডি. পি. ধর নিজেই যেখানে প্রবর্তন করেছিলেন, সেখানে বামপন্থীদের মুক্তিবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার মত
অত্যন্ত বিতর্কমূলক প্রশ্নে কেবল তাজউদ্দিনের একক সিদ্ধান্তকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। এই ঘটনা থেকে তাজউদ্দিনের উপর তাঁদের ক্রমবর্ধমান আস্থা সঞ্চার ছাড়াও আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ জটিলতা সম্পর্কে তাদের সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যদিও ডি. পি. ধর পরবর্তীকালে এই সিদ্ধান্তকে ‘মুজিব বাহিনী’র’ প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেন, তবু তাঁদের আসন্ন মস্কো সফরের আগে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার কোন সুবিবেচনা প্রয়োজন থেকেই তাজউদ্দিনের একক সিদ্ধান্তকে তারা হয়ত নিরাপদ মনে করে থাকতে পারেন।
মুক্তিবাহিনীতে বামপন্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে কেবল আওয়ামী লীগের একাংশের নয়, ভারতের দক্ষিণপন্থী মহলের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা কোন অংশে কম ছিল না। জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন প্রসঙ্গে তাঁদের অভিমত থেকেও প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা আঁচ করা চলে। তাজউদ্দিন ও ডি. পি. ধরের সম্মতির ফলে যেদিন বামপন্থীদের রিক্রুট করার সিদ্ধান্ত হয় ঠিক সেদিনই অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বরে দিল্লীর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতীয় পার্লামেন্ট সদস্য এবং ‘বাংলাদেশের জন্য জাতীয় সমন্বয় কমিটির’ আহ্বায়ক অধ্যাপক সমর গুহ ‘জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি’ গঠনের জন্য ডি. পি. ধর এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব টি. এন. কলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন যে, সোভিয়েট সাহায্য ও সমর্থন লাভের নামে জোর করে এই দুই ভারতীয় কর্মকর্তা বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বহুদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন এবং তৃতীয় সপ্তাহে ন্যাপ সিপিবি কর্মীদের মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সংগ্রামের নেতৃত্বে কোন মৌল পরিবর্তন না ঘটলেও পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, তা সমভাবেই আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী এবং ভারতের দক্ষিণপন্থীদের কাছে আপত্তিকর ছিল। কিন্তু ২৩শে সেপ্টেম্বরে ডি. পি. ধরের মস্কো যাত্রাকালে কূটনৈতিক পাথেয় হিসাবে এর মূল্য সম্ভবত কম ছিল না। এর চারদিন বাদে ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েট নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার জন্য মস্কো যান।
ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো যাত্রার আয়োজন চলাকালে তাজউদ্দিন বাদে প্রায় সমগ্র বাংলাদেশ নেতৃত্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল প্রেরণের বিষয়কে কেন্দ্র করে। সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত খোন্দকার মোশতাকের ধারণা ছিল
তিনিই এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করতে চলেছেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের জন আরউইন ভারতের রাষ্ট্রদূতকে প্রবাসী সরকারের একাংশের সঙ্গে গোপন মার্কিন যোগাযোগের বিষয় জানানোর পর, খোন্দকার মোশতাকের আমেরিকা সফরের বিষয়ে যখন নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু হয়, তখন ৮-সদস্যবিশিষ্ট এক প্রতিনিধিদল ২১শে সেপ্টম্বরে নিউইয়র্কের উদ্দেশে রওনা হন। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত আরও তিনজন প্রতিনিধি এদের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এঁদের নেতৃত্ব দান করেন। ইতিমধ্যে পাকিস্তান ও আমেরিকার প্রচেষ্টার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বন্ধের জন্য জাতিসংঘকে পুনরায় যে ভূমিকায় দাঁড়া করানোর চেষ্টা করা হয়, তা নেপথ্য সোভিয়েট প্রচেষ্টায় ব্যাহত হয়। সাধারণ পরিষদের নব-নির্বাচিত সভাপতি আদম মালিক পাকিস্তান ও ভারতকে দ্বিপাক্ষীয় আলোচনা শুরু করায় সম্মত করানোর প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, সাধারণ পরিষদে এই বিতর্ক ফলপ্রসূ না হওয়াই সম্ভব। পাকিস্তানের পক্ষে মাহমুদ আলীর অভিযোগ এবং ভারতের সমর সেনের জবাব ও পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ বিষয়ক বিতর্ক শেষ হয়।
এই সময়ে বাংলাদেশ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয় মস্কোতে এবং তার ফলে পরিস্থিতির মৌলিক উন্নতি ঘটে। ২৮ ২৯শে সেপ্টেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর মস্কো সফরকালে উভয় দেশের নেতৃবৃন্দের আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা এবং শীর্ষ বৈঠকের শেষে প্রকাশিত যুক্তইশতেহার থেকে বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েট ভূমিকার স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যুক্তইশতেহারে মূল অংশে বলা হয়, উপমহাদেশে শান্তি সংরক্ষণের স্বার্থে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অর্জনের লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার মানুষের বাসনা, অবিচ্ছেদ্য অধিকার ও আইনানুগ স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এবং শরণার্থীদের দ্রুতগতিতে ও নিরাপদে, সম্মান ও মর্যাদার পরিবেশে স্বদেশে ফেরৎ পাঠানোর উদ্দেশ্যে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যুক্তইশতেহারে আরও বলা হয় যে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে ওঠায় ভারত ও সোভিয়েট উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে যোগাযোগ ও মতবিনিময় অব্যাহত রাখবে। এই শেষোক্ত ঘোষণা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তিতে বর্ণিত যোগাযোগ ও মতবিনিময় সংক্রান্ত ধারা কার্যকর হবার মত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে বলে উভয় পক্ষ মনে করে।
বাংলাদেশের প্রশ্নে সোভিয়েট ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে ২৮শে সেপ্টেম্বরে মস্কো শীর্ষ বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিন সোভিয়েট নেতা ব্রেজনেভ, পোদগর্নি এবং কোসিগিনের ছ’ঘণ্টাব্যাপী আলোচনার ফলে। এই শীর্ষ বৈঠকের দেড় বৎসর পর বৈঠকের পঞ্চম অংশগ্রহণকারী ডি. পি. ধর আমাকে যে বিবরণ দান করেন, তদ্রপ বিবরণ সম্ভবত আজও অন্যত্র প্রকাশিত নয়। এর ঐতিহাসিক মূল্যের কথা বিবেচনা করে এই বিবরণের লিপিবদ্ধ সংক্ষিপ্তসার হুবহু উদ্ধৃত করা হলো:
“Till now the Soviet side was pre occupied with the need for avoiding war in the subcontinent. In a long, remarkable presentation Mrs. Gandhi narrated the difficulties with the refugees, Pakistan’s intransigence and India’s very limited choice of building up military pressure while keeping the door open for political solution.
“Both sides then had a discussion to assess the stamina of the liberation struggle, its capacity to sustain itself inside Bangladesh, commitment of the Awami League leadership for independence and the extent of its break with West Pakistan. Brezhnev observered that, “there is an element of national liberation in the present situation,” to which Podgorny gave a nod.
“Finally the Soviet leaders wanted to know what India expected them to do. Flexible attitude was adopted by both the sides for both political solution based on Mujib’s release and building up India’s armed preparedness, should she be embroiled in a military conflagration. Soviet arms assistance was assured to be quickened, but not more than normal supplies except for some weapons for freedom fighters, should the struggle prolongs.
“This meeting was the major turning point towards the liberation war.”
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ২৮-২৯শে সেপ্টেম্বর এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। কেননা, এই প্রথম বাংলাদেশের পরিস্থিতির মাঝে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের উপাদান বর্তমান এই স্বীকৃতির ভিত্তিতে এবং ‘এই পরিস্থিতি ভারতকে বৃহত্তর সংঘর্ষে জড়িত করে ফেলতে পারে এই আশঙ্কায় একমত হয়ে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করার পক্ষে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তির সম্মতি বাংলাদেশের মুক্তির জন্য ভারতের সর্বাত্মক সহায়তার পথ উন্মুক্ত করে। ভারতের সামরিক প্রস্তুতির পাশাপাশি যে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সচেষ্ট হওয়ার কথা বলা। হয়, সেই সমাধানের শর্তাবলী–যা যুক্তইশতেহারে ঘোষণা করা হয়–কার্যত ছিল বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবীর নামান্তর। যুক্তইশতেহার প্রকাশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মস্কো শীর্ষ সম্মেলনে অর্জিত সাফল্য সম্পর্কে দিল্লীর সমীক্ষা তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছানো হয়। তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নিকট সংশ্লিষ্ট পটভূমিসহ মস্কো সম্মেলন সম্পর্কে দিল্লীর সমীক্ষা এবং এই ইশতেহার সম্পর্কে তাঁর নিজের অভিমত উপস্থিত করেন। দুই দিনের মধ্যে মস্কোতে যে যুক্তইশতেহার প্রকাশিত হয় তা তিন দিন ধরে আলোচনা করার পর প্রবাসী মন্ত্রিসভা অবশেষে ২০০-শব্দবিশিষ্ট প্রতিক্রিয়ার খসড়া অনুমোদন করেন। বস্তুত মস্কো আলোচনার ফলাফল ও যুক্তইশতেহারের জন্য অপেক্ষা না করেই, কোসিগিনের স্বাগতিক বক্ততাকে উপলক্ষ করে আওয়ামী লীগের অজ্ঞাতনামা ‘প্রভাবশালী জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিক্রিয়া ফলাও করে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং এতে বলা হয়, ‘কোসিগিনের ভূমিকা এতদিন যাবত পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা যা চেয়েছিল তার সঙ্গে সার্থকভাবে মিলে গেছে। কিছুটা এরই জের হিসাবে মন্ত্রিসভার আলোচনাতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার অধিকার যাতে সামান্যতম অর্থেও খর্বিত না হয়, সে সম্পর্কে সতর্ক পর্যালোচনার পর মন্ত্রিসভা যুক্তইশতেহারকে সর্বসম্মতভাবে স্বাগত জানান:
“The joint statement of Indian Prime Minister, Mrs. Indira Gandhi and Soviet leaders reflects a deep understanding of the Bangladesh issue in the Kremlin. While suggesting a political solution of the problem, the joint statement advocates ‘urgent measures paying regard to the wishes, the inalienable rights and lawful interests of the people of East Bengal.’ These three basic principles can only lead to the support of total independence of Bangladesh for which the 75 million people of Bangladesh are shedding blood every moment.
“Due importance has been given in this joint statement with regard to “speediest return of refugees to their homes with honour and dignity.’ This can happen only if the refugees are enabled to return in freedom, which is the avowed policy of the Government of Bangladesh.
“At a time when the destiny of 75 million struggling people of Bangladesh is being discussed all over the world and in the UN, we wish to reiterate and re-emphasise that total independence is our goal. We urge all the power of the world to support this goal. People of Bangladesh and their elected representatives have given irrevocable verdict on this issue.”
মস্কো শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ সঙ্কট সমাধানের মূল নীতি সম্পর্কে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম দিকে তা বাস্তবায়নের উপায় ও পদ্ধতির প্রশ্নে মস্কো ও দিল্লীর ভূমিকায় কিছু পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। যুক্ত ঘোষণার পর পরই সোভিয়েট পত্রপত্রিকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সমালোচনা তীব্রতর হয় এবং বিভিন্ন সোভিয়েট শহরে প্রতিবাদ সভার মত বিরল ঘটনা অনুষ্ঠানের সংবাদ আসতে থাকে। তবু পরবর্তী দুই সপ্তাহ ধরে, অন্তত ইয়াহিয়ার ১২ই অক্টোবরের বক্তৃতার আগে পর্যন্ত, সঙ্কটের নিরস্ত্র সমাধানের পক্ষে তাদেরকে আশা বজায় রাখতে দেখা যায়। দাঁতাত প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার বৃহত্তর স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ভূমিকা গ্রহণের ব্যাপারে তাদের জড়তা ছিল বোধগম্য। ২২শে অক্টোবরে মৈত্রীচুক্তির নবম ধারা অনুযায়ী সোভিয়েট সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফিরুবিন দিল্লী সফর শুরু করার পর সোভিয়েট ভূমিকা সম্পর্কে সংশয়ের নিরসন ঘটতে থাকে। পাকিস্তানী জান্তার মনোভাব ও উদ্দেশ্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে বরং ভারতের নীতি-নির্ধারকগণ আমাদের অভিমতের নিকটতর ছিলেন। বস্তুত শেখ মুজিবের মুক্তি ও আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা জান্তার পক্ষে যে সাধ্যাতীত এ কথা বহির্মহলের অনেকেরই জানা ছিল; যেমন জানা ছিল ক্ষমতা হস্তান্তরের ক্ষেত্রে তাদের প্রবল অনিচ্ছার কথা। এ সব উপলব্ধির ব্যাপার ছাড়াও বিপুল সংখ্যক শরণার্থী রক্ষণাবেক্ষণ সেপ্টেম্বর-অক্টোবর নাগাদ ভারতের জন্য এমন বিপজ্জনক হয়ে পড়ে যে, এর সম্ভাব্য সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় রোধের জন্য দ্রুত ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণই তাদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।