অধ্যায় ১৯: নভেম্বর
আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ পরবর্তী ঘটনা বিকাশের সম্ভাব্য পথ ছিল দুটি: (১) আসন্ন শীতে ভারত-তিব্বত গিরিপথসমূহ তুষারাবৃত হয়ে পড়ার পর ঢাকার উদ্দেশে মিলিত ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর চূড়ান্ত অভিযান; অথবা (২) শীতের প্রাক্কালে গিরিপথসমূহ উন্মুক্ত থাকতেই আসন্ন বিপর্যয় প্রতিরোধের জন্য আমেরিকা ও চীনের কৌশলী হস্তক্ষেপের (tactical intervention) উপর ভরসা করে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা এবং আন্তর্জাতিক তদারকিতে যুদ্ধবিরতি ও স্থিতাবস্থা নিশ্চিতকরণের প্রচেষ্টা। এই দুই সম্ভাবনার মধ্যে প্রকৃত ঘটনা কোন্ পথে অগ্রসর হতে পারে, তা সুস্পষ্ট ছিল না। তবে কার্যকারিতার দিক থেকে প্রথম সম্ভাবনার সাফল্য উজ্জ্বলতর মনে হয় মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, মুক্তাঞ্চল গঠন প্রতিরোধ করার দীর্ঘ শ্রান্তিকর কাজে পাকিস্তানী বাহিনী সুদীর্ঘ সীমান্ত বরাবর ছড়িয়ে থাকায় তাদের প্রহরার এলাকা সুবিস্তৃত ছিল বটে, কিন্তু তার ফলে বৃহত্তর আক্রমণ প্রতিরোধের গভীরতা সর্বত্রই তাদের লোপ পায়। তাদের প্রতিরক্ষার আয়োজন অনেকটা হয়ে ওঠে স্ফীত বেলুনের মত-এর বহিরাবরণ যতই নিরবচ্ছিন্ন দেখাক, এর ভিতরটা ছিল সর্বাংশেই ফাঁপা। দ্বিতীয়ত, সকল প্রধান সড়ক ও যোগাযোগ কেন্দ্রে পাকিস্তান প্রতিরক্ষার জন্য যে সব ‘দুর্গ’, ‘মজবুত ঘাঁটি’ প্রভৃতি গড়ে তুলেছিল, সে সব পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কৌশল অবলম্বনের দরুন ঢাকার উদ্দেশে দ্রুত অভিযান পরিচালনা ভারত ও বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর পক্ষে সম্ভব বলে মনে হয়।
অবশ্য এক্ষেত্রে আশঙ্কা ছিল এই যে, বাংলাদেশ-ভারতের এই অভিযান দৃষ্টে পাকিস্তান দ্রুত তাদের সৈন্য গুটিয়ে এনে ঢাকা নগরী অবরোধের প্রচেষ্টা চালাতে পারে। পাকিস্তানীদের হাতে ঢাকার জনসমষ্টি পণবন্দী (hostage) হিসাবে অবরুদ্ধ হওয়ার পর তাদের মুক্ত করার প্রচেষ্টায় অকল্পনীয় প্রাণহানী এবং বাড়ীঘর ও সম্পদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তো ছিলই তদুপরি পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয় বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কাও ছিল প্রবল। এই অবস্থায় চীনের সম্ভাব্য ভূমিকা অস্পষ্ট হয়ে থাকলেও, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ যে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের প্রত্যাশিত পরাজয়কে অত্যন্ত অনিশ্চিত করে তুলতে পারে এবং তার ফলে মুক্তিসংগ্রাম যে অধিকতর দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী পর্বে প্রবেশ করতে পারে, সে জাতীয় আশঙ্কা নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী ও আমার মধ্যে আলোচিত হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন হস্তক্ষেপের আশঙ্কা প্রবল বলে গণ্য করলেও আমরা এই উপলব্ধিতে পৌঁছি যে, ঢাকার চতুষ্পর্শ্বে দ্রুত ব্যুহ রচনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের নিজস্ব সামর্থ্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে কোন কার্যকর হস্তক্ষেপ সম্ভব নয়। ঢাকার বুকে ‘সর্বশেষ লড়াই’ সংঘটনের জন্য কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা পাকিস্তানের রয়েছে কি না অথবা ঢাকায় ব্যুহ রচনার মত কোন রিজার্ভ সৈন্যের আয়োজন তাদের আছে কি না, তা আমাদের অজ্ঞাত ছিল। তৎসত্ত্বেও ঢাকা নগরীর সম্ভাব্য অবরোধ, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি ঊর্ধ্বতন ভারতীয় নেতৃত্বের গোচরে আনার বিষয় স্থির হয়।
বস্তুত নভেম্বরে যুদ্ধের সম্ভাবনা যতই নিকটতর ও স্পষ্টতর হতে থাকে, ততই তার অন্তর্নিহিত সমস্যাবলী অধিকতর মুখ্য ও জরুরী হয়ে উঠতে থাকে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের ব্যবস্থাপনা ও আক্রমণধারা উন্নত করার জন্য যে সব বিষয় এতদিন অগ্রাধিকার লাভ করে এসেছিল সেগুলির প্রয়োজন হ্রাস পেতে শুরু করে, এমনকি কোন কোন বিষয়ে অর্জিত অগ্রগতি অংশত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। যেমন, পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানের চার ডিভিশন এবং ভারতের সাত ডিভিশন সৈন্যের শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুতির কাজে বিগত কয়েক মাস ধরে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সর্ববৃহৎ হলেও, এই দুই পেশাদার সশস্ত্রবাহিনীর প্রত্যাসন্ন সংঘাতের পটভূমিতে অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের, এমনকি বাংলাদেশের নিয়মিত ব্যাটালিয়ানসমূহের ভূমিকা পূর্বাপেক্ষা সীমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু সীমিত ভূমিকার অর্থ গুরুত্বশূন্য ভূমিকা নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত অভিযানের মূল দায়িত্ব ভারতীয় কমান্ডের কাছে হস্তান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও শত্রু-অবস্থানের পশ্চাতের তৎপরতা ও সংশ্লিষ্ট কৌশল পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সামরিক কমান্ডের সহায়ক ভূমিকার প্রভূত প্রয়োজন ছিল।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রধান সেনাপতির কাছ থেকে স্বভাবতই যে উদ্যোগ প্রত্যাশিত ছিল, ওসমানী তা থেকে নিজকে বহুলাংশে দূরে সরিয়ে ফেলেন এবং সার্ভিস ম্যানুয়াল রচনার মত এমন সব কাজে নিজকে ব্যস্ত রাখেন যার সঙ্গে প্রত্যাসন্ন চূড়ান্ত অভিযানের কোন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। অক্টোবরের শেষে ওসমানীর আপত্তি সত্ত্বেও যুগ্ম কমান্ডব্যবস্থা গৃহীত হওয়ার পর থেকে ওসমানীর আচরণে কোন স্পষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা অথবা তাঁর বক্তব্যে গ্রহণযোগ্য বিকল্প রণকৌশলের প্রস্তাব ছিল না। বস্তুত ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে নিয়মিত বাহিনীর তৎপরতার ফলে উদ্ভূত নির্দিষ্ট সমস্যাদি প্রতিবিধানের জন্য তাজউদ্দিন যখন যুগ্ম-কমান্ড গঠনের পক্ষে মনস্থির করেন, তখন এ বিষয়ে কোন বিকল্প প্রস্তাব না করেই যুগ্ম-কমান্ড গঠিত হলে নিজে পদত্যাগ করবেন বলে ওসমানী তাজউদ্দিনকে হুমকি দেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন আরো কয়েকটি ইস্যুতে ওসমানী এ ধরনের মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এই প্রথমবার তাজউদ্দিন তাঁকে জানান, লিখিতভাবে এই ইচ্ছা ব্যক্ত করলে, তাজউদ্দিন এই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন। অতঃপর ওসমানী যুগ্ম-কমান্ড অথবা পদত্যাগপত্র সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু ভারতীয় সামরিক নেতৃত্ব সম্পর্কে তার পূর্বসঞ্চিত বিরূপ ধারণা এরপর থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এর প্রভাব রণাঙ্গনে নিয়মিত বাহিনীর উপর কতখানি পড়েছিল বলা শক্ত; তবে সেক্টর অপারেশনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমান্ডের ভূমিকা বরাবরই যতটা দুর্বল ও অনিয়মিত ছিল, নভেম্বরেও তার কোন তারতম্য ঘটেনি বলে মনে করা চলে। চূড়ান্ত অভিযানের প্রাক্কালে ওসমানীর এহেন ভূমিকার ফলে ভারতীয়দের সঙ্গে গৃহীতব্য তৎপরতা ও কৌশলের সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তার অনেকখানি তাজউদ্দিনকেই পূরণ করার চেষ্টা করতে হয়। এই পরিস্থিতিতে ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খোন্দকার বিমানবাহিনীভুক্ত অফিসার হলেও গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামতের স্বচ্ছতার দরুন পেশাগত পরামর্শের জন্য আরও বেশী নিয়োজিত হতেন।
পাকিস্তানের সম্ভাব্য অবরোধ ও ধ্বংসের হাত থেকে ঢাকা নগরীকে রক্ষা করার চিন্তা ছাড়াও অন্য যে একটি উদ্বেগ এ সময় তাজউদ্দিনের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে তা ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশিত সাফল্যের পর প্রতিহিংসা-হত্যার বিপদ থেকে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করার। তাজউদ্দিনের আশঙ্কা জন্মেছিল প্রত্যাসন্ন চূড়ান্ত লড়াইয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর পাকিস্তানের প্রতিহিংসা পরায়ণতা থেকে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, যদিও বাস্তবক্ষেত্রে আগস্ট মাস থেকে তাঁর জীবনের নিরাপত্তা উন্নত হওয়ার লক্ষণ ক্রমশ প্রকাশ পেয়ে চলে। ৩রা আগস্টে ইয়াহিয়া খান যখন ঘোষণা করেন যে দেশদ্রোহিতার অপরাধে শীঘ্রই শেখ মুজিবের বিচার এবং উপযুক্ত শাস্তি বিধান করা হবে তখন শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা কিছুমাত্র রয়েছে বলে মনে করা কঠিন হয়ে পড়ে। ৫ই আগস্টে সামরিক জান্তার যে তথাকথিত ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশিত হয়, তাতে ‘সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ’ সংঘটনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আওয়ামী লীগের ‘ষড়যন্ত্রের আয়োজন সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়। ফলে আসন্ন বিচারের রায় কি দেওয়া হবে, সে সম্পর্কে কার্যত সকল অস্পষ্টতা দূর হয়। ৭ই আগস্টে আওয়ামী লীগের যে ৭৯ জনের নাম জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ থেকে বাতিল করা হয়, তাদের মধ্যে শেখ মুজিবের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৯ই আগস্ট পাকিস্তান থেকে পুনরায় ঘোষণা করা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের শীঘ্রই বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হবে। কিন্তু ঐ দিনই অপ্রত্যাশিতভাবে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নয়াদিল্লীর সঙ্গে ওয়াশিংটনের সময়ের তফাৎ সাড়ে দশ ঘণ্টার মত; ফলে মৈত্রীচুক্তি সংক্রান্ত ঘোষণার পর ঐ দিনই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কোন ‘দ্রুত ব্যবস্থা’ (summary action) গ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয়। ফলে পরবর্তী ঘোষণা অনুযায়ী ১১ই আগস্টে লায়ালপুরে বিশেষ সামরিক আদালতে রুদ্ধদ্বার বিচার শুরু হলেও ঐ দিনই তা মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এই সেপ্টেম্বরে যখন পুনরায় বিচার শুরু হয়, তখন শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের জন্য এ. কে. ব্রোহী এবং তাঁর তিনজন সহকারী আইনজীবীকে নিযুক্ত থাকতে দেখা যায়। ২রা অক্টোবরে পাকিস্তানের সামরিক আদালত শেখ মুজিবকে ‘অপরাধী’ সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের সুপারিশ
করছে বলে একটি কূটনৈতিক সূত্রে প্রকাশ পায়; অবশ্য একই সূত্র থেকে বলা হয় যে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রবর্গকে এই নিশ্চয়তাও দেওয়া হয়েছে যে সামরিক আদালতের এই রায় কার্যকর করা থেকে তারা বিরত থাকবে। এই তথ্যের পরোক্ষ সমর্থন পাওয়া যায় ১০ই অক্টোবরে, যখন জাতীয় পরিষদের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কৃত আওয়ামী লীগপন্থীদের পূর্ববর্তী তালিকা ঈষৎ পরিবর্তিতভাবে প্রকাশিত হয়। এই তালিকা থেকে শেখ মুজিবের নাম বাদ পড়ে। অর্থাৎ ‘মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত’ শেখ মুজিব তার নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ আসনে কার্যত পুনর্বহাল হন। অক্টোবরের শেষে ‘নিউজউইক’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে ইয়াহিয়া খান জানান, শেখ মুজিবকে তিনি খেয়ালখুশী মত ছেড়ে দিতে অসমর্থ হলেও, ‘জাতি যদি তার মুক্তি চায় তবে ইয়াহিয়া ‘তা পূরণ করবেন। পরবর্তীকালে কিসিঞ্জারের বিবরণ থেকেও দেখা যায়, ৩রা নভেম্বরে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত কিসিঞ্জারকে অবহিত করেন, ‘ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের মনোনীত কোন প্রতিনিধির সাথে আলোচনা করার বিষয় বিবেচনা করতে রাজী আছে।
‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার’ অপরাধে মৃত্যুদণ্ড লাভের সম্ভাবনা থেকে শেখ মুজিবের অবস্থার এই ক্রমোন্নতি পরিলক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত অভিযান শুরু করার পর পুনরায় তাঁর জীবনাশঙ্কা দেখা দিতে পারে সে সম্পর্কে তাজউদ্দিনের উদ্বেগ ভিত্তিহীন ছিল না। ইতিপূর্বে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় সচেষ্ট মার্কিন প্রশাসন শেখ মুজিবের প্রাণসংহার থেকে ইয়াহিয়াচক্রকে নিবৃত্ত রাখবে বলে অনুমান করা হলেও, পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের পর সামরিক জান্তাকে শেষ উন্মত্ততা থেকে বিরত রাখা যে সম্ভব হবে, এমন নিশ্চয়তার সত্যই অভাব ছিল। এই আশঙ্কাবোধ থেকে শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার নিশ্চিত উপায় উদ্ভাবন নভেম্বরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে তাজউদ্দিনের অন্যতম প্রধান প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে।
কিন্তু সেই সময় ঢাকা নগরীর ও শেখ মুজিবের জীবনের নিরাপত্তা বিধানের সঙ্গে সামগ্রিক সমর পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির যোগসূত্র প্রায় অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠায় এবং মন্ত্রিসভা তখনও অবধি উচ্চ স্তরের সামরিক গোপনীয়তা রক্ষার মত প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হওয়ায় তাজউদ্দিন প্রায় এককভাবে সংশ্লিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অক্টোবরের প্রথম থেকে মন্ত্রিসভার কাজকর্মে শৃঙ্খলা ও সমন্বয় যদিও উন্নত হতে শুরু করে তবু মোশতাক, মাহবুব আলম চাষী প্রভৃতির কার্যকলাপের বিবরণ সম্পর্কে কমবেশী অবহিত হওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে গৃহীতব্য পদক্ষেপ সম্পর্কে মতপার্থক্যহেতু মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে তথ্যের নিরাপত্তা তখনও এক গুরুতর সমস্যা ছিল। ইতিপূর্বে ২৭শে অক্টোবর অপরাহ্নে কোলকাতায় ৮ থিয়েটার রোড সংলগ্ন লর্ড সিনহা রোডস্থ বিএসএফ ভবনে এক বিশেষ জরুরী ব্রিফিং-এ ডি. পি. ধর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও আমাকে মোশতাকচক্র ও মার্কিন প্রতিনিধিদের মধ্যে গোপন দেনদরবারের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে বিবরণ দান করেন, তাতে অনেক বিষয়ের মধ্যে এ কথাও সুস্পষ্ট হয় যে, মোশতাকের উপস্থিতিতে মুক্তিসংগ্রামের উচ্চতর সামরিক পরামর্শ ও সিদ্ধান্তের জন্য মন্ত্রিসভা আদৌ কোন নিরাপদ ফোরাম নয়। ঐ দিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির মুলতবি বৈঠকের এক ফাঁকে–তাজউদ্দিন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করেন। কিন্তু মোশতাক সম্পর্কে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দোদুল্যমান মনোভাবের ফলে উভয়ের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পর কেবল মাহবুব আলম চাষীর বিরুদ্ধেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের এক অস্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার ভিতরে তথ্যের এই নিরাপত্তার অভাব এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর অভিমানহত আচরণের ফলে নভেম্বরের মাঝামাঝি–পাকিস্তানের সঙ্গে চূড়ান্ত সামরিক বোঝাপড়ার প্রাক্কালে–বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে সকল সামরিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল তার অধিকাংশই তাজউদ্দিন একক দায়িত্বে গ্রহণ করেন। যদিও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যাপারে তিনি মন্ত্রিসভার পূর্ণ সম্মতি এবং দলীয় নেতৃবর্গের মতামত লাভের জন্য সচেষ্ট থাকতেন।
এই সময়ে অর্থাৎ নভেম্বরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানী বাহিনীর দখল থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার বৃহত্তর লক্ষ্যের অধীনে ঢাকা নগরীকে সম্ভাব্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ পর্যায়ে পাকিস্তানী প্রতিহিংসা থেকে মুজিবের জীবন রক্ষা করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আটক বিপন্ন বাঙালীদের মুক্ত করার প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগের বিষয়ে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই তিনটি অধস্তন অথচ অত্যাবশ্যক প্রয়োজন সুনির্দিষ্টভাবে ভারতের বাংলাদেশ-নীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক ডি. পি. ধরের কাছে উপস্থিত করার ফলে এবং ইত্যবসরে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্রমবর্ধিত দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠার ফলে সরাসরি ঢাকার উদ্দেশে দ্রুত অভিযান চালিয়ে সম্ভাব্য পাকিস্তানী অবরোধ প্রচেষ্টা প্রতিহত করার এবং সে সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পাক বাহিনীর সকল পলায়নপথ রুদ্ধ করে পণবন্দী হিসাবে তাদের ব্যবহার করার পক্ষে চিন্তাভাবনা জোরদার হয়। ১৫ই নভেম্বর দিল্লীতে আমি এই সমুদয় বিষয়ের প্রতি ডি. পি. ধরের দৃষ্টি আকর্ষণের পর লক্ষ্য করি অন্তত রাজনৈতিক পর্যায়ে তাদের চিন্তাও সমমুখী। ভারতের সামরিক নেতৃত্বও একই লক্ষ্য অর্জনে আগ্রহী হবেন বলে অনুমান করা হলেও কার্যক্ষেত্রে ঐ সময় তাদের সামরিক পরিকল্পনার রূপান্তর কিভাবে অগ্রসর হয়েছিল সে। সম্পর্কে আমাদের যথার্থ ধারণা ছিল না। পরবর্তীকালে প্রকাশিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, অংশত গতানুগতিক অভিযান-পদ্ধতি ও সামরিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এবং অংশত নদীনালা অতিক্রমের উপযোগী পর্যাপ্ত ইঞ্জিনিয়ারিং সাজ-সরঞ্জামের অভাবে ভারতের সামরিক নেতৃত্ব শেষ মুহূর্ত অবধি ঢাকাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেনি। সৌভাগ্যবশত বঙ্গোপসাগর দিয়ে পাকিস্তানীদের পলায়নপথ সম্পূর্ণ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় নৌ-অবরোধ পরিকল্পনা এবং স্থলভূমিতে পাক-বাহিনীর চলাচল ও পুনর্সমাবেশ বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে ভারতীয় বিমান তৎপরতার সিদ্ধান্ত যথোচিত সম্পূর্ণতার সঙ্গেই গৃহীত হয়। কিন্তু ভারতীয় সামরিক পরিকল্পনায় ঢাকাকে মুক্ত করার বিষয়ে স্পষ্ট সিদ্ধান্তের অভাবহেতু বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর সমাবেশের পর মুক্তি অভিযান বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার যে আশঙ্কা দেখা দেয়, নির্ভেজাল উপমহাদেশীয় রীতিতে পাকিস্তানের বৃহত্তর ভুলের জন্য তার সংশোধনও ঘটে। ডিসেম্বরে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জানা যায়, নভেম্বরের শেষার্ধেও পাকিস্তান ভারতের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে ‘অনবহিত থাকায়, ঢাকার জন্য আলাদা রিজার্ভের ব্যবস্থা তাদের তো ছিলই না, এমনকি সীমান্ত থেকে সৈন্য গুটিয়ে আনারও কোন পরিকল্পনা তাদের ছিল না।
রাজনৈতিক পর্যায়ে ভারতীয় আশ্বাসের তুলনায় ভারতের সামরিক পরিকল্পনা পিছিয়ে থাকার ফলে ঢাকাকে দ্রুত মুক্ত করা তথা বিজয় সম্পন্ন করার পথে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তা পূরণের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বৃহত্তর সামরিক ভুল ছাড়াও আর একটি উপাদান কার্যকর ছিল। নভেম্বরে বাংলাদেশের বাইরে ও ভিতরে স্বাধীনতা-সমর্থক প্রায় সকল অবহিতমহল বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মিলিত অভিযান শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকৃত এলাকার সর্বত্র দীর্ঘ-নির্যাতিত মানুষের বিদ্রোহের শক্তি পুনরায় এমনভাবে প্রজ্বলিত হয়ে উঠবে যে পাকিস্তানের অবশিষ্ট সামরিক ক্ষমতা তাতে সর্বাংশে বিপর্যস্ত না হয়ে পারে না। এই সব আশ্বাস ও বিশ্বাসের ব্যাপার ছাড়াও প্রকাশিত ও সংগৃহীত তথ্য থেকে সে সময়েই জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমবর্ধিত তৎপরতার ফলে পাকিস্তানী সৈন্যদের নৈশ চলাচল ক্ষমতা ইতিমধ্যেই প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী এবং দিনে সম্ভাব্য ভারতীয় বিমান তৎপরতার ফলে ঢাকা অবরোধের জন্য সীমান্ত থেকে সৈন্য পিছিয়ে আনার পাকিস্তানী প্রয়াস যে অসম্ভব হতে পারে তা অস্পষ্ট ছিল না। এই সব উপলব্ধির উপর নির্ভর করে ক্ষিপ্রগতিতে ঢাকা দখল এবং সমস্ত শত্রুসেনাকে বন্দী করে ফেলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান ও অধস্তন লক্ষ্যগুলি একযোগে অর্জন করা সম্ভব বলে মনে হয়।
১৬ই নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধীর আমন্ত্রণক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এই বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর সামপ্রতিক সফরের অভিজ্ঞতা, বিশেষত বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানীর মনোভাব, অধিকৃত অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা, সীমান্ত অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান সংঘর্ষ, কাশ্মীর সীমান্তে পাকিস্তানের সম্ভাব্য অভিযান, ভারতের পাল্টা অভিযানের প্রস্তুতি প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়। সম্ভবত পূর্ববর্তী বৈঠকের অভিজ্ঞতার ফলে এবার চূড়ান্ত অভিযান শুরুর পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী কোন অভিমত প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন; ফলে সৈয়দ নজরুল বরং কিছুটা বিমর্ষ ও চিন্তিত হয়েই এবার কোলকাতা ফিরে আসেন। এই সময়ে তাজউদ্দিনকে জানানো হয়, গত দু’মাস যাবৎ তাঁর ও ডি. পি. ধরের মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের বিষয় নিয়ে যে আলোচনা চলে আসছিল তা ভারত সরকার স্থগিত রাখার পক্ষপাতী; কেননা তাদের মতে ভারতে অবস্থানকালে এ ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর ভারতের চাপের মুখেই সম্পন্ন হয়েছে বলে চিত্রিত হওয়া স্বাভাবিক। তবে এর ফলে বাংলাদেশকে মুক্ত করার ব্যাপারে ভারতের সর্বাত্মক সহায়তার কোন তারতম্য ঘটবে না, এ প্রতিশ্রুতিও পুনরায় তাজউদ্দিনকে দেওয়া হয়।
তাজউদ্দিনও চুক্তির ব্যাপারে ভারতের এই সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসাবেই গ্রহণ করেন। কেননা পাকিস্তানের দখল অবসানের জন্য যে ভূমিকায় ভারতকে সম্মত করানোর উদ্দেশ্যে তাজউদ্দিন এক সময় এই চুক্তির কথা ভেবেছিলেন, তার সকল আয়োজনই এখন সম্পন্ন প্রায়। দিল্লী থেকে ফিরেই তাজউদ্দিন শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের জন্য বেসামরিক প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, জরুরী পণ্য সরবরাহ, যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যকর পরিকল্পনা ও সমন্বিত কর্মসূচী জরুরীভিত্তিতে প্রস্তুত করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা সেল ও সকল প্রশাসনিক বিভাগকে তৎপর করে তোলেন। অবশ্য কোন কোন দফতর নভেম্বরের প্রথম থেকেই শত্রুমুক্ত বাংলাদেশের জন্য তাদের বিভাগীয় কর্মসূচী প্রণয়ন শুরু করেন। পরিকল্পনা সেল যুদ্ধোত্তর অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের বিভিন্ন দিক নিয়ে কাজ শুরু করেন তারও অন্তত একমাস আগে।
তাজউদ্দিন দিল্লী থেকে ফিরে আসার দু’দিন বাদে ডি. পি. ধর কোলকাতা এসে পৌঁছান উপমহাদেশের দ্রুত ধাবমান ঘটনা পটভূমিতে, বিভিন্ন অসমাপ্ত আলোচনাকে সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে এবং সম্ভবত সামগ্রিক আয়োজনের চূড়ান্তকরণ তদারক করার উদ্দেশ্যে। আমাদের দিক থেকে বহুবিধ জটিল সমস্যার মধ্যে একটি প্রধান সমস্যা ছিল সরবরাহকৃত অস্ত্র পুনরুদ্ধার-সংক্রান্ত। যে সব মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল-এবং পাকিস্তান যাদেরকে অস্ত্র দিয়েছিল–তাদের কাছে থেকে প্রত্যাসন্ন বিজয়ের পর অস্ত্র পুনরুদ্ধার করার নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে আলোচনাধীন একটি খসড়া প্রস্তাব এবং সংশ্লিষ্ট আরো কতিপয় বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিযুক্ত করেন। ১৯ থেকে ২১শে নভেম্বরের মধ্যে ডি. পি. ধরের সঙ্গে আমার মোট চার দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে দীর্ঘতম বৈঠক ছিল ১৯শে নভেম্বর এবং এই দিনের আলোচিত বিষয় সম্পর্কে আমার রাখা সংক্ষিপ্ত নোট ছিল:
“Meeting took place at 9 pm at Grand Hotel. DP, (Indian) Defence Secretary K. B. Lal and MH discussed about: (1) the nature of the political problem after liberation; (2) the arrangement for disarming the FF (and other armed elements); (3) the minimum and maximum time-frame for Indian Army to remain in Bangladesh after liberation; and (4) the possibility of intervention by US Seventh Fleet. Reasons given for possible US intervention: (a) with the programme of scaling down the (US) basing arrangements in S.E. Asia,… and when the future of that region looked uncertain, could the US afford the risk of breaking the status-quo of South Asia? (b) particularly when it was being initiated in the background of Indo-Soviet Treaty, could the US accept the rise of Russian influence in South Asia which was about to decapaciate its staunch ally (Pakistan)?….”
এই বৈঠক সম্পর্কে কিছু বর্ণনা আবশ্যক। পাকিস্তানের সঙ্গে নিকটভবিষ্যতে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠার পর দ্রুতগতিতে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী দখল থেকে মুক্ত করা সম্ভব–এই অনুমানের উপর নির্ভর করে বর্তমান ও সম্ভাব্য পরিস্থিতির বিশেষণ এবং এর মাধ্যমে মূল সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলি মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও কাজের পরিসীমা নির্ধারণই এই সব বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে উচ্চতর রাজনৈতিক অনুমোদনের পর বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসনিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা ও প্রোগ্রাম প্রণয়ন সম্ভব হয়। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সম্ভাব্য রাজনৈতিক জটিলতা নিয়ে ঐ সন্ধ্যায় যে আলোচনা হয়, তাতে দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। প্রায় আট মাস ধরে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের স্থানীয় অনুচরবৃন্দ বর্ণনাতীত হত্যা, নির্যাতন ও বিভীষিকার রাজত্ব চালিয়ে এসেছে এবং তার বিরুদ্ধে কার্যত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণবিহীন বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র তরুণের দল মরণপণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ফলে গোটা সমাজ সর্বাংশে আলোড়িত হয়েছে। তারই উপর এক সর্বাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হতে চলেছে। এই সব কিছুর সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় স্বাধীনতার পর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক জীবনে যে অকল্পনীয় তোলপাড় অবধারিত, তা নিয়ন্ত্রণ করা যে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষেই দুঃসাধ্য ব্যাপার। স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র তরুণদের নিয়োগের ফলে পূর্ববর্তী ছমাস কার্যত এক ধরনের সমাজবিপ্লবের সূচনা ঘটে। শত্রুসেনা ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে এই সশস্ত্র তরুণদের ক্রমবর্ধিত তৎপরতা পুরাতন ব্যবস্থার সুবিধাভোগী শ্রেণীর দুর্গতির সৃষ্টি করা ছাড়াও পুরাতন সমাজের খোদ কাঠামোকেই আঘাত করতে শুরু করে। কিন্তু এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তরুণ যোদ্ধাদের কোন নতুন সামাজিক মূল্যবোধে ও বিকল্প সমাজব্যবস্থা গঠনের অঙ্গীকারে উদ্বুদ্ধ করে তোলা, অথবা কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে তাদের সংহত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করে তোলা সম্ভব না হওয়ায় প্রত্যাসন্ন স্বাধীনতার পর সামাজিক পুনর্গঠনের ঐক্যবদ্ধ শক্তির পরিবর্তে বহুধা বিভক্ত সশস্ত্র গ্রুপ ও সামাজিক অরাজকতার শক্তির অভ্যুদয়ের আশঙ্কা ছিল অপেক্ষাকৃত প্রবল। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং প্রচারযন্ত্রের ব্যর্থতা স্বীকার্য কিন্তু তা আর তখন সংশোধনযোগ্য নয়। এই অবস্থায় প্রত্যাশিত স্বাধীনতাকে সম্ভাব্য সামাজিক অরাজকতা ও সশস্ত্র হানাহানির আবর্ত থেকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ফেরত নেওয়ার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ সর্বাপেক্ষা জরুরী বিষয় বলে চিহ্নিত করা হয়। যেহেতু বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল ছিল, সেহেতু দলমত নির্বিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের যে অংশ সততা, সাহস ও কর্তব্যবোধের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, তাদের সকলকে স্বাধীনতা সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলির মিলিত কমান্ডব্যবস্থার অধীনে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের সহায়তায় অস্ত্র পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা চালানো অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। পরবর্তী কয়েক দিন তাজউদ্দিনের সঙ্গে আলোচনার ফলে এই চিন্তার আরও সম্প্রসারণ ঘটে এবং বহুদলীয় কমান্ডব্যবস্থার অধীনে সকল মুক্তিযোদ্ধার সমবায়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে প্রয়োজনীয় স্ক্রীনিং-এর পর নতুন রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন গঠনমূলক প্রয়োজনে তাদের সদ্ব্যবহার করার পক্ষে এক পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরী হতে থাকে। তবে ১৯শে নভেম্বরের ঐ বৈঠকে বহুদলীয় কমান্ডব্যবস্থার অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অস্ত্র পুনরুদ্ধারের কর্মসূচী কার্যকর করার ক্ষেত্রে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি ও পরোক্ষ সহায়তার প্রশ্ন নির্দিষ্টভাবেই উত্থাপিত হয়।
ডি. পি. ধর পূর্ববর্তী তিন মাসে বাংলাদেশের সর্বস্তরের সর্বাধিক সংখ্যক প্রতিনিধির সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা চালানোর ফলে একটি বিষয়ে অত্যন্ত স্বচ্ছ ধারণার অধিকারী হন এবং দু’একবার তা তিনি আমার কাছে ব্যক্তও করেন: বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর ভারতীয় বাহিনী সেখানে যত অল্প সময় অবস্থান করবে, মিত্র হিসাবে ভারতের অর্জিত সুনাম ততবেশী অক্ষুণ্ণ থাকবে। কাজেই ডি. পি. অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় আমার কাছে জানতে চান, সর্বাধিক কতদিন ভারতীয় সৈন্যকে বাংলাদেশে থাকতে হতে পারে বলে আমাদের ধারণা? এ প্রশ্নের উত্তর অংশত নির্ভরশীল ছিল, পলায়ন বা পরাজয় বরণের আগে পাকিস্তানী বাহিনী অধিকৃত প্রশাসন ও অবকাঠামোর কতখানি ধ্বংসসাধন করবে এবং অংশত পরাজয়ের পর পাকিস্তান তার হৃত উপনিবেশ পুনরুদ্ধারের উদ্দেশ্যে কোন নতুন সামরিক উদ্যোগ গ্রহণ করবে কিনা তার উপর। পাকিস্তান যদি পরাজয় বরণের আগে কোন ‘পোড়ামাটির নীতি’ (scorched earth policy) অবলম্বনের সুযোগ না পায় এবং পরাজয়ের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পুনরায় সামরিক অভিযান চালানোর ক্ষমতা হারায়, তবে আশা করা যায়, তিন-চার মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের নিজস্ব সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীকে ন্যূনতম কর্মদক্ষতার মানে উন্নীত করা সম্ভব; এরই পাশাপাশি সম্মিলিত রাজনৈতিক কমান্ডের অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় অস্ত্রশস্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য বহুলাংশেই অর্জন করা সম্ভব। আর যদি শেখ মুজিব তার বিরাট জনপ্রিয়তা নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে সক্ষম হন, এবং সরকারের দায়িত্ব তুলে নেবার পরেও জাতির ঐক্যবোধ এবং সম্মিলিত আস্থার প্রতীক বহুদলীয় কমান্ডকাঠামোকে কার্যকর রাখেন, তবে আরো আগে বা অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ততদিন পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতি বাংলাদেশের সম্ভাব্য অরাজক পরিস্থিতি প্রতিরোধের জন্য আমাদের বিবেচনায় অপরহার্য বলে আমি উল্লেখ করি।
মধ্যরাত্রির পর ডি. পি. ধর যখন আমাকে বিদায় জ্ঞাপনের জন্য হোটেলের লিফটের দিকে এগিয়ে চলেন, তখন পরবর্তী বৈঠকের আলোচ্য বিষয় হিসাবে প্রথমবারের মত আমি উল্লেখ করি, আমাদের বিবেচনায়, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব পাকিস্তানের চূড়ান্ত পতন বন্ধ করার জন্য সপ্তম রণতরী বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে ঢাকার উপর বিমান-আচ্ছাদন বিস্তার এবং নৌসেনা অবতরণের চেষ্টা চালাতে পারে। ডি. পি. ধর পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কংগ্রেসের উভয় পরিষদ এবং সংবাদমাধ্যমসমূহের প্রবল সমালোচনার পটভূমিতে এহেন হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টা ‘রাজনৈতিকভাবে খুবই দুরবর্তী’ বলে মন্তব্য করেন। কিন্তু যে সহজ ও আপাতসিদ্ধ যুক্তি উল্লেখমাত্র তিনি তৎক্ষণাৎ ব্যক্ত আশঙ্কার বিশেষণে প্রবৃত্ত হন তা ছিল: দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে জোট-বহির্ভূত ভারতের প্রভাব ও শক্তিকে সীমিত করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ সতের বছর যাবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে মুসলিম পাকিস্তানকে সবল করার জন্য সাহায্য করে এসেছে, সেখানে সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের মত ঔদ্ধত্য দেখাবার পর, সেই ভারত যদি বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াসে উদ্যোগী হয়, তবে কেবল জনমতের ভয়েই কি যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার আঞ্চলিক স্বার্থ জলাঞ্জলি দেবে? জনমতই যদি মার্কিন প্রশাসনের সামরিক সিদ্ধান্তের একমাত্র নিয়ন্ত্রক হয়, তবে অনেক আগেই কি ভিয়েতনামে শান্তি ঘোষিত হওয়া সম্ভব ছিল না? এরপর এক ঘণ্টারও অধিক সময় ধরে এই হস্তক্ষেপ সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক, সমগ্র অভিযানের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাব, পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ ও পরিসর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আমাদের দু’জনার মধ্যে আলোচনা চলে।
ডি. পি. ধরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরবর্তী তিনটি বৈঠকে বিভি বিষয়ের মধ্যে অস্ত্র পুনরুদ্ধার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে স্বাধীনতা সমর্থক পাঁচটি রাজনৈতিক দলের অভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ এবং জাতীয় উপদেষ্টা কমিটিকে একটি সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার সম্ভাবনা সংক্রান্ত আলোচনা প্রাধান্য পায়। এ ছাড়া পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র অধিকৃত প্রশাসনের সমস্ত বাঙালী অফিসার এবং সর্বস্তরের বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার এক পরিকল্পনা পাকিস্তানীদের রয়েছে বলে অক্টোবরে আমাদের ঢাকা গ্রুপ থেকে যে তথ্য এসে পৌঁছায়, তার তাৎপর্য এবং তা মোকাবিলার্থ বিভিন্ন ধরনের প্রস্তুতির বিষয় আলোচিত হয়। এই সব আলোচনা যখন চলছিল, তখন যশোর শহরের অদুরে চৌগাছায় একটি মুক্তিবাহিনী ইউনিটের অবস্থানের উপর ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ ইউনিটসহ পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের ফলে সীমান্ত সংঘাত সহসা বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী গোলার আঘাত ভারতীয় ভূখণ্ডে এসে পড়ায় যথাযোগ্য শক্তিতে ভারতীয় বাহিনী মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে এগিয়ে আসে। ভারত ও পাকিস্তানের উভয় পক্ষের পদাতিক ব্রিগেড, ট্যাঙ্ক, গোলন্দাজ ও বিমানবাহিনীর অংশগ্রহণ এবং উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের আবহাওয়া নিকটতর হয়ে ওঠে।
একই সময়ে পরিকল্পনা সেল ও বিভাগীয় সচিবদের পর্যায়ে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর পুনর্বাসন, আইন ও শৃঙ্খলা প্রবর্তন, খাদ্য ও জরুরী পণ্য সরবরাহ, বাসস্থান, জনস্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ে যে সব খসড়া পরিকল্পনা ও কার্যক্রম প্রণয়নের কাজ চলছিল, তাকে সমন্বিত করার জন্য ২২শে নভেম্বরে বাংলাদেশে মন্ত্রিসভার এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এই উদ্দেশ্যে সেক্রেটারীদের সমবায়ে এক সাবকমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত করা হয়। দেশ মুক্ত হওয়ার পর বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে মন্ত্রিসভা এই অভিমত প্রকাশ করেন যে, অধিকৃত অঞ্চলে সরকারী অফিসার ও কর্মচারী যারা দৃশ্যত পাকিস্তানীদের সাথে সহযোগিতা করে চলেছেন, তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই প্রাণের ভয়ে তা করতে বাধ্য হয়েছেন এবং প্রকৃতপক্ষে তারা স্বাধীনতাযুদ্ধের গোপন সমর্থক।
স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত অভিযান এবং বিশেষ করে যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন পরিকল্পনা ও কর্মসূচী প্রণয়নের এই প্রচেষ্টার মূল্যায়নকালে একটি কথা স্মরণ রাখা বোধ হয় বাঞ্ছনীয়। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের দিন থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর তাদের আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম চলে নয় মাসেরও কম সময়। চীন, ভিয়েতনাম, আলজিরিয়া, সাইপ্রাসের বা এঙ্গোলার তুলনায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সমগ্র মেয়াদ ছিল সব চাইতে কম। মুক্তিসংগ্রামের নয় মাসের প্রথম অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক শরণার্থীদের আশ্রয়দানের ফলে ভারতের জন্য যে বৈদেশিক আক্রমণের বিপদ দেখা দেয় তার বিরুদ্ধে ভারতের নিজস্ব নিরাপত্তা সুদৃঢ় করার কাজে। আগস্টে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির মাধ্যমে ভারতের নিরাপত্তাবোধ উন্নত হওয়ার পরেই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতীয় সহায়তার উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ ঘটে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিশ্চিতকরণ ব্যতীত শরণার্থী সমস্যার কোন প্রকৃত সমাধান যে একেবারেই নেই, ভারতের এই উপলব্ধির প্রতি সোভিয়েট ইউনিয়নের পরোক্ষ সম্মতি আদায় করতে আরো দু’মাস অতিবাহিত হয়। পাকিস্তানের সঙ্কটের একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সোভিয়েট প্রচেষ্টা নিঃশেষিত হওয়ার পর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের এক সম্ভাব্য সময়সূচী সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে প্রথম ইঙ্গিত দেন। ঐ সময় থেকে ৩রা ডিসেম্বরে পাকিস্তান পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করার দিন পর্যন্ত মোট সময় পাওয়া যায় ছয় সপ্তাহের কম এবং পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের দিন পর্যন্ত আট সপ্তাহের কম। এই ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বল্প সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তুলনাহীন বর্বরতার ফলে সর্বাংশে ছিন্ন ভিন্ন এক সমাজকে একত্রিত করার জন্য, বিচ্ছিন্ন বিপর্যস্ত ও লুষ্ঠিত এক অর্থনীতিকে পুনরায় সচল করার জন্য এবং এই দুই বিশাল প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সম্পূর্ণ নতুন এক রাষ্ট্রের সংগঠনকে দাঁড় করানোর জন্য যে সুবিপুল প্রস্তুতি, পরিকল্পনা ও উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল তা আয়ত্ত করা কোন উপায়েই সম্ভব ছিল না। সময় ছাড়াও অভাব ছিল সংগঠনের উদ্ভাবনী শক্তিসম্পন্ন, কর্মদক্ষ, নিষ্ঠাবান মানুষের। এই অর্থে নভেম্বর ছিল প্রয়োজন ও আয়োজনের মাঝে দুস্তর ব্যবধান উপলব্ধি করার মাস। এই ব্যবধান দুরতিক্রম্য জেনেও যুদ্ধবিধ্বস্ত নতুন স্বাধীনতার তীরভূমির দিকে পাড়ি জমাবার মাস।
ঘটনা-উত্তাল নভেম্বরে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে শহর-বন্দর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, আর এই সংগ্রামেরই সাফল্যজনক পরিসমাপ্তির জন্য আসন্ন শীতে ভারত-বাংলাদেশ মিলিত বাহিনীর সংঘবদ্ধ অভিযানের প্রস্তুতি, এবং অন্যদিকে শীতের পূর্বেই পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের অবস্থা সৃষ্টি করে বৃহৎ মিত্রদের হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক তদারকিতে যুদ্ধবিরতি ও স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অবলুপ্ত করার জন্য পাকিস্তানী সামরিক চক্রের প্রয়াস-এই দুই পরস্পরবিরোধী ঘটনাস্রোতের মাঝে বাংলাদেশের বিঘোষিত স্বাধীনতা যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, তা তাজউদ্দিন ২৩শে নভেম্বরের বেতার ভাষণে সুনির্দিষ্টভাবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন:
“মুক্তিবাহিনী এখন যে কোন সময়ে, যে কোন জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে।… নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত, মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিক জায়গায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। আর সৈন্য সামগ্রী ও মনোবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ ততই হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে।… এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সঙ্কট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এমন একটা যুদ্ধ হলে, বাংলাদেশের রক্ষক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গোপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপোষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযোগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না।… সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে ব্যবস্থাই করে থাকুক না কেন আর এই উপমহাদেশের জন্য যে ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপুত হোক না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা একটিই আর তা হল পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প এবং সে স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। দখলদার বাহিনীর বিনাশ অথবা সম্পূর্ণ অপসারণের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই-এমনকি এক বিশ্ব শক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।
“অশ্রু ও রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতম হয়েছে। কিন্তু তার জন্যে আরো আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবন দানের প্রয়োজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধ অবস্থায় আমরা কি মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কি ব্যবহার করি তার উপর। শত্ৰু সংহারের প্রতিজ্ঞা সঙ্গে সঙ্গে তাই শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজ গঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে যুদ্ধে লিপ্ত তা বিদেশী দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং অসাম্য ও সুবিধাভোগের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম।…
“বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিকচক্রের হাতে বন্দী হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নিষ্ক্রমণের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তা-ই করতে যাচ্ছি ।”…
তাজউদ্দিনের এই বেতার ঘোষণায় কোন অনিশ্চিত প্রতিশ্রুতির আড়ম্বর ছিল না, ছিল কঠোর প্রস্তুতির শেষে আসন্ন ঘটনাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার অটল আত্মবিশ্বাস।