অধ্যায় ৩: এপ্রিল
সীমান্ত অতিক্রম করার আগে কয়েকবারই তাজউদ্দিন মনে করেছিলেন হয়তবা এই আপকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য উচ্চতর পর্যায়ে কোন ব্যবস্হা ভারত সরকারের সাথে করা হয়েছে। তাঁর এ কথা মনে করার বিশেষ একটি কারণ ছিল। ৫ই অথবা ৬ই মার্চে শেখ মুজিবের নির্দেশে তাজউদ্দিন গোপনে সাক্ষাৎ করেন ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে. সি. সেনগুপ্তের সঙ্গে। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের শাসকেরা যদি সত্য সত্যই পূর্ব বাংলায় ধ্বংসতাণ্ডব শুরু করে, তবে সে অবস্থায় ভারত সরকার আক্রান্ত কর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান বা সম্ভাব্য প্রতিরোধ সংগ্রামে কোন সাহায্য-সহযোগিতা করবে কিনা জানতে চাওয়া। উত্তরের অন্বেষণে সেনগুপ্ত দিল্লী যান। সারা ভারত তখন সাধারণ নির্বাচন নিয়ে মত্ত। সেখানে সরকারী মনোভাব সংগ্রহ করে উঠতে উঠতে তার বেশ কদিন কেটে যায় এবং ঢাকা ফেরার পর সেনগুপ্ত ১৭ই মার্চে ভাসাভাসাভাবে তাজউদ্দিনকে জানান যে, পাকিস্তানী আঘাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে ইসলামাবাদস্ত ভারতীয় হাইকমিশনার সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করেন; তবু আঘাত যদি নিতান্তই আসে’, তবে ভারত আক্রান্ত মানুষের জন্য সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা প্রদান করবে। এই বৈঠকে স্থির হয়, তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের সাথে পরামর্শের পর সেনগুপ্তের সঙ্গে আবার মিলিত হবেন এবং সম্ভবত তখন তাজউদ্দিন সর্বশেষ পরিস্থিতির আলোকে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার প্রকার ও ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট আলোচনা চালাতে সক্ষম হবেন। ২৪শে মার্চে এই বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব এ বিষয়ে কোন আলোকপাত করতে না পারায় এবং নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দিনকে অসহযোগ আন্দোলন-সংক্রান্ত নির্দেশাবলী সংশোধনের মুসাবিদায় ব্যস্ত রাখায়, সেনগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। সীমান্ত অতিক্রমের আগে তাজউদ্দিন ভেবেছিলেন, হয়তবা ২৪শে মার্চের আলাপ অন্য কারো মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে এবং সম্ভবত এই আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার কোন ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই করা হয়েছে।
সীমান্তে পৌঁছুবার পর তাঁর আশাভঙ্গ ঘটে। তিনি দেখতে পান, বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারতের সামরিক ইউনিটসমূহের হস্তক্ষেপ করার কোন ক্ষমতা নেই; এমনকি অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহের কোন এখতিয়ারও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নেই। স্থানীয় ভিত্তিতে দু’একটি জায়গায় ব্যতিক্রম থাকলেও সে সব ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় ছিল অতি সামান্য। মুক্তিফৌজ গঠনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র বরাদ্দ করার আবেদনের জবাবে সীমান্ত রক্ষী (বিএসএফ)-প্রধান রুস্তমজী প্রাঞ্জল ভাষায় তাজউদ্দিনকে জানান: মুক্তিফৌজ ট্রেনিং বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং এই ট্রেনিং সমাপ্ত হবার পরেই কেবল তাদেরকে অস্ত্র সরবরাহের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে; কিন্তু এই ট্রেনিং বাংলাদেশের বিদ্রোহীদের দেওয়া হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্তের সংবাদ এখনও তার জানা নেই; এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবং তাজউদ্দিন চাইলে তাকে দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন মাত্র। তাজউদ্দিন বুঝলেন, ভারতের সঙ্গে কোন ব্যবস্থাই নেই, কাজেই শুরু করতে হবে একদম প্রথম থেকে।
৩রা এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা শুরু করার পূর্বে কয়েকটি মূল বিষয়ে তাজউদ্দিনকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তখনও তিনি দলের নেতৃস্থানীয় অপরাপর সহকর্মীদের সাক্ষাৎ পাননি। তারা জীবিত কি মৃত, পাকিস্তানী কারাগারে বন্দী কি সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টায় রত–এমন কোন তথ্যই তখন অবধি তার কাছে পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় তাঁকে স্থির করতে হয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে তার নিজের ভূমিকা কি হবে? তিনি কি শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা হিসাবে আলাপ করবেন? তাতে বিস্তর সহানুভূতি ও সমবেদনা লাভের সম্ভাবনা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার উপযোগী পর্যাপ্ত অস্ত্র লাভের কোন আশা আছে কি? বস্তুত তাজউদ্দিনের মনে কোন সন্দেহই। ছিল না যে, একটি স্বাধীন সরকার গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে সেই সরকারের দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত হওয়ার আগে, ভারত তথা কোন বিদেশী সরকারের কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট সাহায্য ও সহযোগিতা আশা করা নিরর্থক। কাজেই, সামরিক বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে যদি সরকার গঠন করে থাকেন তবে সেই সরকারের নেতৃস্হানীয় সদস্য হিসাবে তাজউদ্দিনের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সাহায্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে দিল্লীতে আসা এবং সাহায্য সংগ্রহের চেষ্টা করা অপেক্ষাকৃত যুক্তিসঙ্গত ও সহজসাধ্য হবে বলে তাজউদ্দিন মনে করেন। অন্ততপক্ষে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা একটি অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবেই গণ্য হবে বলে তার ধারণা জন্মায়।
ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকের আগের দিন দিল্লীতে তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন পরামর্শদাতা পি.এন. হাকসার তাজউদ্দিনের সাথে আলোচনাকালে জানতে চান, আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে কোন সরকার গঠন করেছে কিনা। এই জিজ্ঞাসা ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা থেকে তাজউদ্দিন বুঝতে পারেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে কি হয়নি সে সম্পর্কে কোন প্রকৃত সংবাদ ভারত কর্তৃপক্ষের জানা নেই এবং সরকার গঠনের সংবাদে তাদের বিস্মিত বা বিব্রত হওয়ারও কোন আশঙ্কা নেই। বরং সরকার গঠিত হয়েছে জানতে পারলে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় পার্লামেন্ট ৩১শে মার্চ যে প্রস্তাব গ্রহণ করে তা এক নির্দিষ্ট ও কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দিনের ধারণা জন্মায়।
এই সব বিচার-বিবেচনা থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দিন জানান যে পাকিস্তানী আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২৫/২৬শে মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই (পরে ‘হাইকমান্ড’ নামে যারা পরিচিত হন) মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেফতারের খবর ছাড়া অন্যান্য সদস্যের ভাল-মন্দ সংবাদ তখনও যেহেতু সম্পূর্ণ অজানা, সেহেতু তাজউদ্দিন দিল্লীতে সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উপস্থিত করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন।
তাজউদ্দিনের এই উপস্থিত সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসামান্যভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী ‘বাংলাদেশ সরকারের আবেদন অনুসারে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সম্ভাব্য সকল প্রকার সহযোগিতা’ দানের প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেন। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাজউদ্দিনের এই একক ও উপস্থিত সিদ্ধান্ত মুক্তিসংগ্রামের জন্য যতই ফলপ্রসূ হয়ে থাকুক, এর ফলে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতৃত্বের দ্বন্দ্বও অনিবার্য হয়ে ওঠে। নেতৃত্বের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দীর্ঘ সময় সমগ্র রাজনীতিকে বিরাটভাবে প্রভাবিত করে রাখে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুকূল সাড়া দেবার প্রধান কারণ সম্ভবত ছিল তিনটি। প্রথম কারণ পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের নিরবচ্ছিন্ন বৈরী সম্পর্ক এবং তৎকারণে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব। দ্বিতীয় কারণ আদর্শের ক্ষেত্রে, বিশেষত সংসদীয় গণতন্ত্র ও অসামপ্রদায়িকতার প্রশ্নে, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় কংগ্রেস দলের দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল। তৃতীয় কারণ ছিল মানবিক–পাকিস্তানী সেনাদের বর্বরতায় সারা দুনিয়ার মানুষের মন আলোড়িত হয়েছিল, ভৌগোলিক নৈকট্য হেতু স্বভাবতই ভারতে মানবিক সহানুভূতি ও সমবেদনায় সাড়া পড়েছিল সব চাইতে বেশী। কাজেই ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার রাজনৈতিক ও মানবিক কারণ ছিল সমভাবে বিদ্যমান।
যে কোন মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনার জন্য প্রধান আবশ্যকীয় শর্ত তিনটি। এক, জনগণের ব্যাপক সমর্থন। দুই, মুক্তিসেনাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এবং তিন, সমরাস্ত্রসহ বিভিন্ন উপকরণের নিয়মিত সরবরাহ। এই তিনটি শর্তের মধ্যে প্রথমটি, তথা ব্যাপক জনসমর্থন, বিপুলভাবেই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও পূর্ব বাংলার স্বল্প আয়তন এবং দখলদার সেনাদের ক্ষিপ্র চলাচল ও আক্রমণ ক্ষমতার দরুন পূর্ব বাংলার কোন অংশই মুক্তিসেনাদের জন্য নিরাপদ ছিল না। কাজেই মুক্তিবাহিনীর সম্প্রসারণ, প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য সীমান্তের ওপারে নিরাপদ ঘাঁটির প্রয়োজন ছিল সর্বাগ্রে। প্রবাসী সরকারের জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় ও অবাধ কাজকর্মের অধিকার লাভের প্রশ্ন ছিল সম পরিমাণেই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়াও ছিল সাধারণ শরণার্থীদের আশ্রয় দানের মানবিক প্রশ্ন। নক্সাল আন্দোলনবিক্ষত জনবহুল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্ত অগণিত বিদেশী শরণার্থীর জন্য, বিশেষত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের জন্য, উন্মুক্ত করা অসামান্য ঝুঁকিপূর্ণ হলেও আশ্রয়দানের ব্যাপারে প্রথম থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর সম্মতি ছিল দ্ব্যর্থহীন। এই সাহসিকতাপূর্ণ সিদ্ধান্তের পিছনে পশ্চিম বঙ্গের সাধারণ মানুষের অবদান সামান্য নয়। ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতিবাদে ৩১শে মার্চ কোলকাতায় যে অভূতপূর্ব হরতাল পালিত হয়, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সম্ভাবনা কোনটিই নয়াদিল্লীর জন্য উপেক্ষণীয় ছিল না।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধী ও তাজউদ্দিনের মধ্যে অনুষ্ঠিত দুই দফা বৈঠকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আশ্রয় এবং বাংলাদেশ সরকারের জন্য অবাধ রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাবার অধিকার প্রদান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস সাধারণভাবে জ্ঞাপিত হয়। এই সব সাহায্য সহযোগিতার প্রকার ও পরিমাণ সম্পর্কে কোন নির্দিষ্ট ধারণা গঠন করা সে মুহূর্তে সম্ভব ছিল না। তৎসত্ত্বেও তাজউদ্দিন এই উপলব্ধিতে পৌঁছান যে: (১) পাকিস্তান শীঘ্র যদি হত্যা, উৎপীড়ন ও গণবিতাড়নের নীতি থেকে বিরত না হয়, তবে গোটা উপমহাদেশে এক অদৃষ্টপূর্ব উত্তেজনা ও সংঘাতের আবহাওয়া বিস্তার লাভ করবেই; এবং (২) সেই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে যদি সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে ভারতের প্রাথমিক সাহায্যের আশ্বাস উত্তরোত্তর সম্প্রসারিত হয়ে সর্বাত্মক রাজনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় পরিণত হতে পারে।
বস্তুত, এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ যে দুটি সিদ্ধান্ত ভারত সরকার গ্রহণ করেন, তার প্রথমটি ছিল ভারত সীমান্ত উন্মুক্ত করার এবং দ্বিতীয়টি ছিল বাংলাদেশ সরকারকে ভারতীয় এলাকায় রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালাবার অধিকার দান করার। এই দুয়েরই তাৎপর্য ছিল সুদূরপ্রসারী। এই কারণে উভয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কেই ভারতীয় মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরে এবং উচ্চতর প্রশাসনিক মহলে-বিশেষত পাশ্চাত্যপন্থী অংশের পক্ষ থেকে জোরাল আপত্তি ওঠে। আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক শালীনতার বিষয় ছাড়াও উপরোক্ত দুই সিদ্ধান্ত ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কিনা সে সম্পর্কে উত্থাপিত প্রশ্ন প্রকাশ্য বিরোধিতার রূপ নেবার আগেই ইন্দিরা গান্ধী মূলত একক সিদ্ধান্ত আরোপ করেই সকল মতবিরোধের অবসান ঘটান। মার্চ মাসের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে বিপুলভাবে জয়যুক্ত না হলে তাঁর পক্ষে এই দুই সিদ্ধান্ত এমনিভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হত কি না বলা কঠিন।
আশ্রয় ও মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার বিষয়ে ভারতীয় সম্মতি আদায়ের পর তাজউদ্দিন মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার সুদৃঢ় ভিত্তি খুঁজে পান এবং সংশ্লিষ্ট সমুদয় বিষয়ে সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন পরিকল্পনার এই পর্যায়ে তাজউদ্দিনের প্রধান বিবেচ্য
বিষয়গুলি ছিল: (ক) মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সীমান্তবর্তী রণাঙ্গন নির্ধারণ, বিভিন্ন রণাঙ্গনের দায়িত্ব অর্পণ এবং অন্তর্বর্তীকালের জন্য সরবরাহ ও সহায়তা ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ; (খ) মন্ত্রিসভা গঠন; (গ) স্বাধীনতার স্বপক্ষে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য সাধনের পন্থা নিরূপণ; (ঘ) দেশের অভ্যন্তরে অসহযোগ আন্দোলন সক্রিয় রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ; (ঙ) বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র থেকে অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের আয়োজন; এবং (চ) শক্তিশালী প্রচারমাধ্যম গঠন।
দিল্লীতে তাজউদ্দিন যখন মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনা শুরু করেন, সেই সময় অর্থাৎ ৪ঠা এপ্রিল সিলেট জেলার তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ইউনিটগুলির কমান্ডারগণ একত্রিত হন প্রতিরোধ যুদ্ধের সমস্যাবলী আলোচনা এবং সম্মিলিত কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে। এ বৈঠকে যোগ দেন ইবিআর-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, লে. কর্নেল আবদুর রব, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর সফিউল্লা, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মমিন চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন। এই প্রথম বিদ্রোহী কমান্ডাররা তাদের আঞ্চলিক অবস্থান ও প্রতিরোধের খণ্ড খণ্ড চিত্রকে একত্রিত করে সারা দেশের সামরিক পরিস্হিতি উপলব্ধি করার সুযোগ পান। কিন্তু যা জানতে পারেন তা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক ছিল না। সব দিকেই পাকিস্তানী বাহিনী দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করেছে, সবখানেই। বিদ্রোহীরা প্রতিরোধের যথাসাধ্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে। এই অবস্থায় ভারী অস্ত্রশস্ত্র আর গোলা-বারুদের অভাব মেটাবার জন্য তারা অবিলম্বে ভারতের শরণাপন্ন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিদেশ থেকে সমর-সম্ভার সংগ্রহ করার জন্য রাজনীতিকদের সমবায়ে যথাশীঘ্র স্বাধীন সরকার গঠনের আবশ্যকতাও তারা অনুভব করেন। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য অপেক্ষা না করে, বাস্তব পরিস্থিতির চাপে তারা সমস্ত বিদ্রোহী ইউনিটের সমবায়ে সম্মিলিত মুক্তিফৌজ গঠন করেন এবং কর্নেল ওসমানীকে তা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সীগুলির মাধ্যমে পূর্ব রণাঙ্গনের প্রতিরোধ সংগ্রামের এই সব ঘটনা ও সিদ্ধান্তের সংবাদ তাজউদ্দিনের কাছে পৌঁছুতে শুরু করে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
এই সব বহুমুখী বিকাশ ও সাংগঠনিক প্রস্তুতির কিয়দংশ প্রতিফলিত হয় তাজউদ্দিনের প্রথম বেতার বক্তৃতায়। এপ্রিলের প্রথম
সপ্তাহে দিল্লী অবস্থানকালে তাজউদ্দিনকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মূলনীতি সম্বলিত এই বক্তৃতা তৈরীর কাজে সাহায্য করেন রেহমান সোবহান এবং আমিরুল ইসলাম। ১১ই এপ্রিল বাংলাদেশের নিজস্ব বেতার কেন্দ্রের অভাবে শিলিগুড়ির এক অনিয়মিত বেতার কেন্দ্র থেকে তা প্রচার করা হয়। পরে তা ‘আকাশবাণী’-র নিয়মিত কেন্দ্রসমূহ থেকে পুনঃপ্রচারিত হয়।
এর আগে দিল্লী থেকে কোলকাতা ফিরে তাজউদ্দিন ৮ই এপ্রিল ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রোডের এক বাড়ীতে কামরুজ্জামানসহ উপস্থিত আওয়ামী ও যুব নেতৃবৃন্দকে দিল্লী বৈঠকের ফলাফল অবহিত করেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনাকালে কোন্ বিবেচনা থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও সরকার গঠনকে অনিবর্তনীয় বিষয় হিসাবে উপস্থিত করেন তাও ব্যাখ্যা করেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যের ব্যাপারে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করার যৌক্তিকতা অথবা দিল্লী আলোচনার উপযোগিতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলেননি। তারা অধিকাংশই বিতর্ক তোলেন মুখ্যত তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের বৈধতা নিয়ে। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণি অবশ্য মন্ত্রিসভা গঠনেরই বিরোধিতা করেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন সরকার ও সামরিক কমান্ড গঠন-সংক্রান্ত তাজউদ্দিনের প্রস্তাবিত বেতার বক্তৃতা বন্ধ করার দাবী জানান। পরে তিনি ৪২ জন উপস্থিত আওয়ামী লীগ ও যুব নেতার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তাজউদ্দিনের বক্তৃতা বন্ধ করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে এক আবেদন পাঠান। তাজউদ্দিন কর্তৃক মন্ত্রিসভা গঠন এবং তার প্রস্তাবিত বেতার ভাষণ রদ করার ক্ষেত্রে বরিশালের সাবেক পরিষদ সদস্য চিত্ত সুতারকে এক উদ্যোগী ভূমিকায় অত্যন্ত তৎপর দেখা যায়। বস্তুত শেখ মণি গ্রুপের সমর্থনে তার তাৎপর্যময় ভূমিকা ১৯৭২ সালের প্রথম অবধি অব্যাহত থাকে।
শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কে বা কারা দেবেন এ বিষয়ে কোন প্রকার সিদ্ধান্ত না থাকায় দলের মধ্যে নেতৃত্ব-কলহ ও বিশৃঙ্খলা একরূপ অবধারিত ছিল। তাজউদ্দিনের আশঙ্কা জন্মায়-মার্চের অসহযোগ আন্দোলন, ২৬শে মার্চ থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, বাঙালী সশস্ত্রবাহিনীর স্বতঃস্ফুর্ত বিদ্রোহ এবং সম্মিলিত সিপাহী-জনতার প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে অবয়ব ফুটে উঠতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব-কলহ ও বিশৃঙ্খলা তাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে; বিশেষত মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রদত্ত আশ্বাস কার্যকর রূপ গ্রহণ না করা পর্যন্ত অস্থায়ী সরকারের গঠনে কোন বড় পরিবর্তন শেখ মুজিব কর্তৃক সরকার গঠিত হওয়ার দাবী সম্পর্কেই সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতে পারে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত ক্ষতিসাধন করতে পারে।২৬ কাজেই রাজেন্দ্র রোডে সমবেত দলের রাজনৈতিক ও যুবনেতা এবং সাধারণ কর্মীদের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও স্বাধীন সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে তাজউদ্দিন অটল থাকেন।
৯ই এপ্রিল সকালে তাজউদ্দিন আমিরুল ইসলামকে সাথে নিয়ে এক পুরানো ডাকোটা প্লেনে করে প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার অবশিষ্ট সদস্যদের খুঁজতে বের হন। মালদহ, বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, রূপসা (ধুবড়ীর কাছে) ও শিলচর হয়ে, পথে ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে সঙ্গে করে, তাজউদ্দিন আগরতলা পৌঁছান ১১ই এপ্রিল। খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং কর্নেল ওসমানী আগরতলায় অপেক্ষা করেছিলেন। এদের মধ্যে দু’দিন ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক চলার পর অবশেষে তাজউদ্দিন কর্তৃক প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার গঠন ও আয়তন বহাল থাকে। অবশ্য এই মতৈক্যে পৌঁছুবার স্বার্থে মন্ত্রিসভার ক্ষমতার পরিসরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করা হয় এবং তা ১৭ই এপ্রিলে ঘোষিত ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়। স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণার প্রধান মূল প্রয়োজন দেখা দেয় নবগঠিত সরকারের আইনগত ভিত্তি বৈধকরণের জন্যই। তাজউদ্দিনের ১১ই এপ্রিলের প্রথম বেতার বক্তৃতাকে বৈধ সরকার গঠনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণা’র তারিখ ১০ই এপ্রিল বলে ঘোষণা করা হয়।
১৭ই এপ্রিলে নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের পক্ষ থেকে প্রচারিত এই ‘স্বাধীনতা আদেশ ঘোষণায়’ শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রের কার্যনির্বাহী ক্ষমতা, আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, প্রধান সেনাপতির ক্ষমতা, এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়োগের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির অথবা তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয় এবং এই আদেশটি ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকারিতা লাভ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে আইন প্রণয়ন ও কার্যকরী ক্ষমতা ন্যস্ত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য বিভিন্ন দাবীদার তাদের আকাঙ্ক্ষার লড়াই স্বল্পকালের জন্য মুলতবি রাখেন। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে এবং বিশেষত পরবর্তী নেতৃত্ব সম্পর্কে কোনরূপ সিদ্ধান্তের অভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বসঙ্কট যেখানে একরূপ অবধারিত ছিল, সেখানে মন্ত্রিসভার গঠন নিঃসন্দেহে ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক অগ্রগতি।
নতুন মন্ত্রিসভা আগরতলা থেকে কোলকাতা আসার পর অন্যতম মুখ্য প্রচেষ্টা হয়ে দাঁড়ায় নতুন সরকারকে এমনভাবে বহির্বিশ্বের কাছে উপস্থিত করা যাতে এর পক্ষে বিভিন্ন দেশ থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। ১৫ই এপ্রিল তাজউদ্দিন গোপনে দেখা করেন কোলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী সঙ্গে। হোসেন আলী এবং ডেপুটি হাইকমিশনে নিযুক্ত সকল বাঙালী যাতে ১৮ই এপ্রিল একযোগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে, তার ব্যবস্হাদি সম্পন্ন হয় দু’দফা বৈঠকে। ১৭ই এপ্রিল বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের সমুখে নবগঠিত মন্ত্রিসভার প্রকাশ্য শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয় বাংলাদেশের দ্রুত সঙ্কুচিত মুক্তাঞ্চলের এক প্রান্তে-কুষ্টিয়ার মেহেরপুর মহকুমার সীমান্তবর্তী গ্রাম বৈদনাথতলায়, যার নতুন নামকরণ হয় মুজিবনগর’। কিন্তু আসন্ন পাকিস্তানী আক্রমণের আশঙ্কায় মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের পর পরই বৈদ্যনাথতলা পরিত্যক্ত হয় এবং ‘মুজিবনগর’ রাজধানী প্রতিষ্ঠার এক বিমূর্ত বাসনা হিসাবে বিরাজ করতে থাকে। বাংলার সশস্ত্র বিদ্রোহ তখন সর্বত্র স্তিমিত। পাকিস্তানী বাহিনীর দ্রুত অভিযানের মুখে সমগ্র বাংলাদেশের পতন প্রায় সম্পন্ন হওয়ায় বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি লাভের আশা অনিশ্চিতকালের জন্য পিছিয়ে যায়। তিন সপ্তাহের অধিককাল ধরে পাকিস্তানের হত্যাতাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ ও বর্বরতার মুখে বাংলার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যখন বিপর্যস্ত, এমনি সময় বিলম্ব সত্ত্বেও মন্ত্রিসভা গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার বিঘোষিত স্বাধীনতা বাস্তবায়নের জন্য সঠিক রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।