অধ্যায় ১০: আগষ্ট
পরবর্তীকালে কিসিঞ্জার নিজে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির সংবাদকে ‘bombshell’ হিসাবে অভিহিত করেছেন। সেই চুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা কেবল যে বহির্বিশ্বের কাছেই অভাবনীয় ছিল তা নয়, এমনকি ভারতের খোদ ক্ষমতাসীন মহলেও এ সম্পর্কে সামান্যতম ধারণা যাদের ছিল, তাদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত অল্প। ভারতের মন্ত্রিসভার প্রবীণ সদস্যরাও (রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির গুটিকয় সদস্য বাদে) এই চুক্তির বিষয় জানতে পারেন চুক্তি স্বাক্ষরের দিন সকালে। জুলাইয়ে পাকিস্তানের সহায়তায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ফলে ভারতের নিরাপত্তাহীনতাবোধ যখন চরমে পৌঁছে তখন ভারতীয় মন্ত্রিসভার ‘রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটি’ দু’বছরের পুরাতন এক খসড়াকে ভিত্তি করে ভারত-সোভিয়েট চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে উসুরী নদী বরাবর চীন ও সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর সোভিয়েট ইউনিয়ন ভারতসহ কয়েকটি এশীয় দেশের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্দেশ্যে মস্কোতে এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সপ্তাহে দু’বার, বুধ ও শনিবারে, ভারত ও সোভিয়েট প্রতিনিধিদের নিয়মিত আলোচনা অনুষ্ঠিত হত। কিন্তু ঐ আলোচনার সময়ে ইয়াহিয়া সরকার পেশোয়ারের অদূরে বাদবেরে মার্কিন ঘাঁটির চুক্তি নবায়ন না করায় সোভিয়েট ইউনিয়ন পাকিস্তানকে কিছু সামরিক সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহে সম্মত হয়। অংশত এর ফলে প্রস্তাবিত মৈত্রীচুক্তি সম্পর্কে ভারতের আগ্রহ হ্রাস পায় এবং আলোচনায় ছেদ পড়ে। ১৯৬৯ সালের আলোচনায় ভারতের পক্ষে অংশগ্রহণকারী ছিলেন তদানীন্তন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ডি, পি. ধর। কাজেই ‘রাজনৈতিক বিষয়ক কমিটির সিদ্ধান্তের পর তিনিই পুনরায় নিযুক্ত হন মৈত্রীচুক্তির সেই পুরাতন খসড়াকে পরিবর্তিত প্রয়োজনের আলোকে চূড়ান্ত করার দায়িত্বে।
স্বাক্ষরিত মৈত্রীচুক্তির সমূহ গুরুত্ব ছিল এর নবম ধারায়। এই ধারা অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ দুই দেশের কারো বিরুদ্ধে যদি বহিঃআক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তবে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে ‘পারস্পরিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। পাকিস্তান ও চীন উভয়ের জন্যই এই ঘোষণার মর্ম ছিল অতিশয় প্রাঞ্জল এবং সম্ভাব্য শরৎকালীন অভিযানের পথে প্রতিবন্ধক। পাকিস্তান ও চীনের আসন্ন আক্রমণ সম্ভাবনা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে এই চুক্তির উপযোগিতা অসামান্য হলেও এর পিছনে ভারতের পক্ষে সম্ভবত আরো দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা সক্রিয় ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করার কোন এক পর্বে পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠা অসম্ভব ছিল না এবং এই আশঙ্কাবোধ থেকে ভারত নিশ্চিত হতে চেয়েছে যাতে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রারম্ভে বা মাঝপথে সোভিয়েট সামরিক সরবরাহ মন্থর বা বন্ধ না হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যদি পূর্বতন স্থিতাবস্থা বজায়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব গ্রহণ করতে উদ্যত হয়, তবে সেখানেও যাতে সোভিয়েট ভূমিকা ভারতের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই সহায়ক থাকে। মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর এই সব প্রতিরক্ষামূলক চিন্তাভাবনা ছাড়াও ভারতের নীতি-নির্ধারকদের মনে ক্রমশ এই আস্থার সঞ্চার ঘটে যে, নিজেদের সামরিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করার পর এবং শীতকালে উত্তরের গিরিপথগুলি তুষারাবৃত হওয়ার ফলে চীনা তৎপরতার আশঙ্কা সম্পূর্ণ তিরোহিত হওয়ার পর–সশস্ত্র অভিযানের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানী দখলের অবসান ঘটিয়ে শরণার্থীদের সেখানে ফেরৎ পাঠানো সম্ভব।
কিন্তু আগস্টে ভারতের এ জাতীয় প্রত্যাশার প্রতি রাশিয়ার যে সম্মতি ছির তা বলার উপায় নেই। বরং বিশ্ব শক্তি হিসাবে রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি মৈত্রীচুক্তি সম্পর্কে কিছুটা আলাদা থাকাই ছিল স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন ক্ষমতায় আসার পর ১৯৬৯ সাল থেকে বৃহৎশক্তি পর্যায়ে উত্তেজনা হ্রাস প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় এবং বিশেষত ‘SALT -1’ মারণাস্ত্র সীমিতকরণ আলোচনায় উভয় পক্ষের স্বার্থ অসামান্যভাবে জড়িত থাকায় সোভিয়েট মার্কিন পারস্পরিক সম্পর্ককে মূলত একটি আঞ্চলিক ইস্যুতে পুনরায় উত্তেজনাময় করে তোলার ইচ্ছা সম্ভবত কোন পক্ষেরই ছিল না। তা ছাড়া আঞ্চলিক পর্যায়ে তাসখন্দ চুক্তির মধ্যস্থতাকারী দেশ হিসাবে রাশিয়া, পাকিস্তানী জান্তার গণহত্যার নীতিকে জোরাল ভাষায় নিন্দা করা সত্ত্বেও, তদন্তেই পাকিস্তান সম্পর্কে ভারতের মত যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে, এ প্রত্যাশা বাস্তবধর্মী ছিল না। তবু জুলাই মাসে কিসিঞ্জারের চীন সফরের ফলে যে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাকে রাজনৈতিক ও সামরিক ভারসাম্যের একটি অবাঞ্ছিত পরিবর্তন হিসাবে গণ্য করা রাশিয়ার পক্ষে ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক। তাদের নিজেদের জন্য চীন-মার্কিন আঁতাতে সৃষ্ট বিড়ম্বনা অপেক্ষাকৃত দূরবর্তী ব্যাপার হলেও তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের নিরাপত্তার জন্য এই আঁতাত ছিল তাৎক্ষণিক হুমকিস্বরূপ। সম্ভাব্য চীনা আক্রমণের বিরুদ্ধে ভারতের উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা সম্পর্কে পূর্ব-প্রদত্ত মার্কিন প্রতিশ্রুতি নাকচ করার সমূহ তাৎপর্য এবং যুদ্ধের জন্য পাকিস্তানের উপর্যুপরি হুমকি থেকে ভারতের নিরাপত্তা সম্পর্কে রাশিয়ার চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এই দুশ্চিন্তাই ছিল সম্ভবত মৈত্রীচুক্তির নবম ধারায় সম্মত হওয়ার পিছনে তাদের অন্যতম মুখ্য বিবেচনা। কিন্তু পাক-চীন হুমকির মুখে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করা ছাড়াও ভারতের প্রয়োজন ছিল শরণার্থী সমস্যার বাস্তব সমাধানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে জয়যুক্ত করা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জন্য ভারতের ক্রমবর্ধমান সহায়ক ভূমিকা সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট জড়তা অতিক্রম করাই তাই ভারতের চুক্তি–পরবর্তী কূটনৈতিক প্রচেষ্টার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের এই প্রচেষ্টাকে সফল করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐক্য তখনও একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান।
কাজেই আমাদের পূর্ববর্তী পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর দিন অর্থাৎ ১০ই আগস্ট বিকেল চারটায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আমি দেখা করি দুটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব নিয়ে। সূচনাতেই তিনি মৈত্রীচুক্তির ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম লাভবান হবে এই মর্মে কিছু মন্তব্য করেন। ফলে কোন ভূমিকা ব্যতিরেকেই আমার বলা সহজ হয় যে, এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে ভারত ও রাশিয়ার উষ্ণভাব বজায় থাকতে থাকতেই আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের দুটি জরুরী উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। আভ্যন্তরীণ উদ্যোগের ক্ষেত্রে মস্কোপন্থী নামে পরিচিত দুটি দলসহ স্বাধীনতা সমর্থক সব ক’টি দলের সমবায়ে একটি ফ্রন্ট গঠন করা সম্ভব হলে, তত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠনের পদক্ষেপ হিসাবে রাশিয়ার কাছে তা আদত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কাজেই খোন্দকার মোশতাক নিজে এই ফ্রন্ট গঠনের কাজে উদ্যোগী হলে, এর ভিত্তিতে এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সম্ভাব্য সহযোগিতায় তার মস্কো যাওয়ার পথ সুপ্রশস্ত হতে পারে। বেসরকারীভাবে হলেও মস্কোর সঙ্গে যদি তার তথা বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা এবং ভারতের উপর সার্বিক নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার পথে তা সহায়ক হতে পারে। সে দিনের মত এই সব চিন্তাভাবনা তার কাছে রেখে আমি ফিরে আসি।
পরদিন দুপুর সাড়ে তিনটায় আবার খোন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি সে দিন মস্কো ছাড়াও আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনকালে নিউইয়র্ক গিয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন। তিনি এ ব্যাপারে দিল্লীতে পি. এন. হাকসারের সমর্থন সংগ্রহ করা সম্ভব কি না, তা জানতে চান। ১৪ ও ১৬ই আগস্ট আরো দু’ দফা আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয় পরিষ্কার করা সম্ভব হয়, তিনি যে অবস্থানে রয়েছেন সেখান থেকে নিউইয়র্ক পৌঁছুতে হলে তাকে অতিক্রম করতে হবে দিল্লী ও মস্কোর পথ এবং এই দুই অন্তর্বর্তী গন্তব্যস্থল সুগম হতে পারে, যদি জাতীয় মোর্চা গঠনে তাঁর সক্রিয় সমর্থন থাকে। তবু এই সব আলোচনার শেষে আমার ধারণা জন্মায়, নিউইয়র্ক অবধি নিজের যাত্রাপথ সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে জাতীয় মোর্চা গঠনের প্রতি তাঁর মৌখিক সমর্থন থাকলেও মন্ত্রিসভার অন্য কোন সদস্য যদি এই প্রস্তাবকে ভণ্ডুল করেন, তবে তিনি অখুশী হবেন না; পক্ষান্তরে, তার যাত্রার ব্যবস্থা যদি পাকাপাকি রূপ নেয়, তবে তিনি মোর্চা গঠনকেও হয়ত সমর্থন দিতে পারেন। যেভাবেই হোক মস্কো হয়ে তার নিউইয়র্ক যাবার কথা সেই সময় এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার আকারেই আলোচিত হতে থাকে। ওদিকে তাজউদ্দিনও অস্থায়ী প্রেসিডেন্টকে মোর্চার ব্যাপারে সম্মত করার ক্ষেত্রে প্রায় একই রকম অনিশ্চিত অবস্থার সম্মুখীন হন। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে প্রিয়ভাজন থাকার প্রচেষ্টাই সৈয়দ নজরুলের দোদুল্যমানতার মূল কারণ বলে অনুমান করা হয়।
এ দিকে মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর দিল্লী থেকে অন্তত দুবার ফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে অগ্রগতির কথা জানতে চাওয়া হয়েছে। কাজেই তাজউদ্দিন স্থির করেন, মন্ত্রিসভার ফ্রন্ট প্রসঙ্গে এই অনিশ্চিত সমর্থন সম্পর্কে বরং দিল্লীকে আভাস দেওয়া ভাল; যদি তারা এ ক্ষেত্রে কোন সাহায্য করতে নাও পারেন তবু অন্তত কোন অবাস্তব অনুমানের উপর নির্ভর করে পদক্ষেপ গ্রহণের বিড়ম্বনা থেকে তাঁরা মুক্ত থাকবেন। ১৯শে আগস্ট পি. এন. হাকসারকে সংক্ষেপে পরিস্থিতি জানিয়ে আমি উল্লেখ করি, জাতীয় মোর্চার পক্ষে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের সম্ভাবনা যদিও বর্তমান, তবু এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে বলার সময় এখনও আসেনি। ২২শে আগস্ট দিল্লী থেকে হাকসার আমাকে সংবাদ পাঠান যে, ২৯শে আগস্ট ভারতের প্রাক্তন মস্কোস্থ রাষ্ট্রদূত ডি. পি. ধর কোলকাতা আসবেন এবং অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে জাতীয় মোর্চা গঠনের বিষয়েও তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে আলাপ করবেন। ইতিপূর্বে মৈত্রীচুক্তির স্বাক্ষরের ৫/৬ দিন বাদে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ যখন আলাপ আলোচনার জন্য দিল্লী আমন্ত্রিত হন, তখন ইন্দিরা গান্ধী তাদের জানান যে, এরপর থেকে তার সবিশেষ আস্থাভাজন প্রতিনিধি হিসাবে ডি. পি. ধর ভারতের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতি ও কর্মতৎপরতার সমন্বয় সাধনে নিয়োজিত থাকবেন।
আগস্ট মাসে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি সম্পাদন এবং সেই চুক্তিকে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে সম্প্রসারিত করার প্রচেষ্টা ছাড়াও এই সময়ের অন্তত আর একটি ঘটনা-বিকাশ উল্লেখ করা প্রয়োজন। আগস্টে দিল্লী সফরকালে তাজউদ্দিন প্রথমবারের মত RAW-এর সাহায্যপুষ্ট ‘মুজিব বাহিনী’র ক্রমবর্ধমান উচ্ছঙ্খলা ও সরকারবিরোধী দৌরাত্মে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এ ব্যাপারে পি. এন. হাকসার ও RAW-প্রধান রামনাথ কাও-এর সহযোগিতা কামনা করেন। আগস্টের প্রথম দিকে কয়েকটি সেক্টর থেকে খবর পৌঁছাতে শুরু করে যে, বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, ‘মুজিব বাহিনী’ (সূচনায় যার নাম ছিল ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’, সংক্ষেপে BLF) বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে তাদের বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য নিরন্তর চাপ প্রয়োগ করছে, কোথাও কোথাও অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে এবং এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু কিছু সংঘর্ষও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অবশ্য গোড়া থেকেই ‘মুজিব বাহিনী’ বাংলাদেশ সরকার গঠনের তীব্র বিরোধিতা করে এসেছে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচারণা চালিয়ে এসেছে যে, তারা এ সরকারকে স্বীকার করে না। বস্তুত এই বাহিনীর সদস্যভুক্তির জন্য সর্বাধিনায়ক হিসাবে শেখ মুজিবর রহমান এবং তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মণির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেই শপথনামা পাঠ করা হত।
সূচনায় অবশ্য বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন নিয়েই এই বাহিনীর গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথমার্ধে সীমান্ত অতিক্রমকারী ছাত্র ও যুবকের সংখ্যা ছিল অল্প। কাজেই মুক্তিবাহিনী গঠনের উদ্দেশ্যে ১৮ই এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা দেশের ভিতর থেকে ছাত্র ও যুবকর্মী সংগ্রহ করে আনার দায়িত্ব অর্পণ করেন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাকের উপর। এক অজ্ঞাত কারণে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট এই তরুণ নেতাদের ক্ষমতা সম্প্রসারিত করে রিক্রুটিং-এর দায়িত্ব ছাড়াও সশস্ত্রবাহিনী গঠন ও পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এই অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানের প্রশ্নে তাজউদ্দিনের সম্মতি ছিল না, বস্তুত মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে এদের তীব্র বিরোধিতা তিনি অতিক্রম করতে চলেছেন মাত্র। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে দিয়ে তৎপরিবর্তে এই তরুণ নেতাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠনের দাবী তখনও অব্যাহত। এদের নিয়ন্ত্রণে একটি বিশেষ সশস্ত্রবাহিনী বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’ গড়ে তোলার প্রচেষ্টার খবরও তাজউদ্দিনের কানে এসে পৌঁছেছিল। কিন্তু দলের মধ্যে তার অতিশয় নাজুক অবস্থার দরুন এই তরুণ নেতাদের ক্ষমতা সমপ্রসারণের বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওসমানী নিজেও সৈয়দ নজরুল প্রদত্ত এঁদের এই সম্প্রসারিত ক্ষমতা সম্পর্কে সংশয়মুক্ত ছিলেন না।
মে মাসে এক রকম প্রকাশ্যেই আলোচিত হতে থাকে যে, RAW-এর এক বিশেষ উপসংস্থার অধীনে শীঘ্রই দেরাদুনের অদূরে চাক্রাতায় এদের জন্য বিশেষ ট্রেনিং শুরু হতে চলেছে। জুন থেকে এদের ট্রেনিং শুরু হয় এবং পর্যায়ক্রমে নভেম্বরের প্রথম দিক অবধি তা অব্যাহত থাকে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এদের প্রথম দল আত্মপ্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও স্পষ্ট হয় যে এই বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কর্নেল ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোন এখতিয়ার নেই। ফলে তাজউদ্দিন ও ওসমানী উভয়েরই সন্দেহ ঘনীভূত হয়। কিন্তু এ বিষয়ে মন্ত্রিসভার অপরাপর সদস্যের ভূমিকা ছিল দোদুল্যমান। অনেক সময় ‘মুজিব বাহিনী’র ক্ষমতা সম্পর্কে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলেও প্রত্যেকেই তারা পৃথক পৃথকভাবে ‘মুজিব বাহিনী’র’ নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ছিলেন আগ্রহী। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিরও দুর্বলতা এ ব্যাপারে ছিল যথেষ্ট। ফলে মন্ত্রিসভা এই বাহিনীকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন। এমনিভাবে দু’মাস আগে যাদেরকে কেবল ছাত্র ও যুবকর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতা ও এখতিয়ারের সম্পূর্ণ বাইরে তারাই হয়ে ওঠে এক সশস্ত্রবাহিনীর স্বয়ং নিয়ন্ত্রিত অধিনায়কবৃন্দ।
মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করা ‘মুজিব বাহিনী’র’ লক্ষ্য বলে প্রচার করা হলেও এই সংগ্রামে তাদের নির্দিষ্ট ভূমিকা, কার্যক্রম ও কৌশল কি, কোন্ এলাকায় এরা নিযুক্ত হবে, মুক্তি বাহিনীর অপরাপর ইউনিটের সাথে এদের তৎপরতার কিভাবে সমন্বয় ঘটবে, কি পরিমাণে বা কোন শর্তে এদের অস্ত্র ও রসদের যোগান ঘটছে, কোন প্রশাসনের এরা নিয়ন্ত্রণাধীন, কার শক্তিতে বা কোন্ উদ্দেশ্যে এরা অস্থায়ী সরকারের বিশেষত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধাচরণ করে চলছে, এ সমুদয় তথ্যই বাংলাদেশ সরকারের জন্য রহস্যাবৃত থেকে যায়। ক্রমে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ পায়, ‘মুজিব বাহিনী’র’ কেবল প্রশিক্ষণ নয়, অস্ত্রশস্ত্র ও যাবতীয় রসদের যোগান আসে RAW-এর এক বিশেষ উপসংস্থা থেকে এবং এই উপসংস্থার প্রধান মেজর জেনারেল উবান গেরিলা প্রশিক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসাবে মুজিব বাহিনী’ গড়ে তোলার দায়িত্বে নিযুক্ত রয়েছেন।৮৯ এ সব কিছুই হয়ত মেনে নেওয়া সম্ভব হত, যদি এই বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হত।
প্রথম দিকে মুজিব বাহিনী’র স্বতন্ত্র অস্তিত্বের তিনটি সম্ভাব্য কারণ অনুমান করা হয়: (১) শেখ মণির দাবী অনুযায়ী, সত্যই কেবল মাত্র তারাই সশস্ত্রবাহিনী গঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কর্তৃক মনোনীত প্রতিনিধি এবং এই সম্পর্কে ভারত সরকারের উধ্বর্তনমহল কেবল অবহিতই নন, অধিকন্তু এদেরও সহায়তা প্রদানের ব্যাপারে ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; (২) যদি কোন কারণে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা নেতৃত্বদানে ব্যর্থ হন, তবে সেই অবস্থার বিকল্প নেতৃত্ব হিসাবে এদেরকে সংগঠিত রাখা; এবং (৩) বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম কোন কারণে দীর্ঘায়িত হলে বামপন্থী প্রভাব যদি বৃদ্ধি পায়, তবে তার পাল্টাশক্তি হিসাবে এদের প্রস্তুত করে তোলা। কিন্তু কেবল শেষোক্ত এই দুই আশঙ্কা থেকেই প্রথম দিকে যদি ‘মুজিব বাহিনী’কে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে থাকে, তবে বলা যায় আগস্ট নাগাদ দুটো আশঙ্কাই প্রায় অমূলক হয়ে পড়েছে। পক্ষান্তরে ‘মুজিব বাহিনী’ কর্তৃক ক্ষেত্রবিশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, তাদের আনুগত্য পরিবর্তনের জন্য চাপ প্রয়োগ করা ও মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহের প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে কেবল যে মুক্তিযুদ্ধকেই ভিতর থেকে দুর্বল করে ফেলা হচ্ছিল তা নয়, অধিকন্তু আশ্রয়দাতা সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও এক সন্দেহের আবহাওয়াকে উৎসাহিত করে তোলা হচ্ছিল।
তাজউদ্দিন আগস্টের মাঝামাঝি দিল্লীতে এই অবস্থার সত্বর প্রতিবিধানের দাবী তোলেন, কিন্তু হাকসার এবং কাও দু’জনই নীরব থাকেন। ক্ষুব্ধ তাজউদ্দিন কোলকাতা ফিরে ‘মুজিব বাহিনী’কে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এই অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপকে খর্ব করার জন্য আমাকে আলোচনাধীন বিকল্প পদক্ষেপ জরুরীভিত্তিতে চূড়ান্ত করতে বলেন। এ সম্ভাবনা তখন স্পষ্ট যে, যদি অবিলম্বে তাদের নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তবে স্বাধীনতার যুদ্ধ অচিরেই এক রক্তাক্ত আত্মঘাতী লড়াইয়ে পরিণত হতে পারে। তা ছাড়া জাতীয় মোর্চা গঠনের প্রশ্নে ‘মুজিব বাহিনী’ আওয়ামী লীগের ভিতরের বিরুদ্ধ শক্তিকে যদি প্ররোচিত করে তোলে, তবে তার ফলে জাতীয় মোর্চার গঠনই কেবল দুঃসাধ্য হবে তাই নয়, এর ফলে মুক্তিযুদ্ধকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসাবে উপস্থিত করে সোভিয়েট সহযোগিতা অর্জনের প্রচেষ্টাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতায় বিশ্বাসী কর্নেল ওসমানী এই সব রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা ছাড়াই ‘উচ্ছঙ্খল ও অন্তর্ঘাতী কার্যকলাপের জন্য রিক্রুটিং-এর ব্যাপারে এপ্রিল মাসে যে অধিকারপত্র তিনি শেখ মণি ও তার সহকর্মীদের দিয়েছিলেন, তা প্রত্যাহার করেন এবং ‘মুজিব বাহিনী’কে’ শীঘ্রই তাঁর কমান্ডের অধীনে না আনা হলে পদত্যাগ করবেন বলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে জানিয়ে দেন।
এদিকে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর মুক্তিযুদ্ধের এক নতুন ও আশাব্যঞ্জক অধ্যায় শুরু হয়। এতদিন অবধি মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও চীনের যৌথ প্রতিক্রিয়ার কথা ভারতকে সর্বদা স্মরণ রাখতে হত। সেই ঝুঁকিকে এড়িয়ে চলার জন্য ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহে ভারত সীমিতভাবে সহযোগিতা করে এসেছে মূলত বাংলাদেশ ইস্যুকে ‘রাজনৈতিকভাবে জীবিত রাখার উদ্দেশ্যে। মৈত্রীচুক্তির ফলে এই ঝুঁকি হ্রাস পাওয়ায় ভারতের সহযোগিতা দ্রুত সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল দশ হাজারের কাছাকাছি। অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে স্থির করা হয়, সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে কুড়ি হাজার করে মোট আরও ষাট হাজার মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং দেওয়া হবে এবং বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর জন্য গঠন করা হবে আরো নতুন তিনটি ব্যাটালিয়ান। এতদিন যাবত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে যে অসুবিধা বিরাজমান ছির, তারও দ্রুত উন্নতি ঘটতে থাকে আগস্টের শেষ দিক থেকে। এমনকি, সোভিয়েট কর্তৃপক্ষও হাল্কা অস্ত্রশস্ত্রের ক্ষেত্রে ভারতের অসুবিধাদষ্টে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে দখল করা জার্মান ও পশ্চিম ইউরোপীয় পুরাতন অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে ব্যবহৃত হবে তা জেনেই জুলাই-আগস্টে ভাতের হাতে তুলে দেন।
ট্রেনিং ও অস্ত্রসরবরাহ বৃদ্ধি ছাড়াও ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ড’ আগস্টের শেষ দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের অপারেশনস পরিকল্পনায়, বিশেষত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে তৎপরতার লক্ষ্য (Ops target) নির্ধারণের ক্ষেত্রে, সহযোগিতা শুরু করায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দুর্বলতা অংশত দূর হয়। ঐ সময় বাংলাদেশ সামরিক সদর দফতরে নিযুক্ত অফিসারের নিদারুণ সংখ্যাল্পতা এবং সংশ্লিষ্ট সহায়ক সার্ভিসের অশেষ দৈন্যের জন্য ‘Ops target’-এর সুযোগ ছিল সামান্য। এই সব বিষয়ে অভাব পূরণ ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে-বিশেষত টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল ও নোয়াখালীতে-যে সব স্বতন্ত্র গেরিলা গ্রুপ প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত ছিল তাদের কাছে অস্ত্র পৌঁছুনোর ব্যবস্থা গৃহীত হয়। স্বাভাবিকভাবেই ট্রেনিং ও অস্ত্রের এই সব বর্ধিত সহায়তার ফল সঞ্চার অক্টোবরের আগে ঘটে ওঠেনি।
ইতিমধ্যে আগস্ট থেকে মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা পূর্ববর্ণিত কারণে ক্রমশই নিম্নাভিমুখী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যথাসম্ভব প্রচার সত্ত্বেও দেশের ভিতরে সাধারণ মানুষের মনোবলও ক্রমাগত নীচের দিকে ধাবিত। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের এই অধোগতি কিয়দংশে ঢাকা পড়ে ১৫ই আগস্ট থেকে বাংলাদেশ নৌকমান্ডো বাহিনীর দুনিয়াকে চমক লাগানো নৌবিধ্বংসী তৎপরতায়। ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশের মাত্র ৩০০ জন ছাত্র ও যুবককে ঐতিহাসিক পলাশীর অদূরে ভাগীরথী নদীতে নৌবিধ্বংসী ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই নৌকমান্ডোরা ১৫ই আগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে সর্বমোট ৫০,৮০০ টন জাহাজ নিমজ্জিত করে, ৬৬,০৪০ টন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী নৌযান দখল করে নেয়। ফলে বিশ্বের বাণিজ্যিক বহরে ত্রাসের সঞ্চার হয় এবং চট্টগ্রাম ও চালনায় বাহিত পণ্যের ইনস্যুরেন্স প্রিমিয়াম কুড়ি গুণ বৃদ্ধি পায়। সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও সঠিক রিক্রুটমেন্ট, উপযুক্ত ট্রেনিং, পর্যাপ্ত অস্ত্র, সুস্পষ্ট লক্ষ্য এবং নির্ভুল পরিকল্পনা কি বিরাট সাফল্য ঘটাতে পারে-এ তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি জোরদার করার পক্ষে ভারত সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তির প্রভাব অত্যন্ত ইতিবাচক হলেও চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় সাথে সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ নেতৃত্বের দক্ষিণপন্থী অংশ ভারতের দক্ষিণপন্থী মুখপাত্রদের সঙ্গে সমস্বরে প্রচারণা চালাতে শুরু করে যে, এই চুক্তির মাধ্যমে মস্কো বাংলাদেশের প্রতি কূটনৈতিক স্বীকৃতি জ্ঞাপন থেকে নয়াদিল্লীকে নিবৃত্ত করেছে এবং এর পরে ভারত কখনই আর বাংলাদেশের পক্ষে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে সক্ষম হবে না। মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের দিন দিল্লীতে এক উল্লসিত জনসমুদ্রের কাছে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাফল্যের জন্য এবং ৭০ লক্ষ শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য ভারত সকল কিছু করতে প্রস্তুত এই মর্মে ইন্দিরা গান্ধীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা সত্ত্বেও মৈত্রীচুক্তির বিরুদ্ধে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টির জন্য এক জোর প্রচারণা শুরু হয়। এই প্রচারণার অন্যতম মূল উৎস ছিল ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় পরিবেশিত এক ‘সংবাদ’। এই ‘সংবাদ’ অনুসারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা CIA এক ‘গোপন’ সমীক্ষায় নিক্সনকে অবহিত করেছে যে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি বাংলাদেশকে সাহায্য প্রদান থেকে ভারতকে নিবৃত্ত করবে। ভারতে এবং বিশেষত ভারতে অবস্থানকারী বাংলাদেশ রাজনৈতিক মহলে এই উদ্দেশ্যমূলক অসত্য প্রচার (disinformation campaign) যখন পূর্ণমাত্রায় চলছিল, তখন অন্তরালে যুক্তরাষ্ট্রের খোদ প্রেসিডেন্ট সঠিক পরিস্থিতি জানিয়েই ইয়াহিয়া খানকে নমনীয় হবার পরামর্শ দেন।
বিগত চার সপ্তাহের যুদ্ধ হুঙ্কার বন্ধ করে ইয়াহিয়াচক্রও হঠাৎ খোল পাল্টানোর কৌতুককর মহড়ায় অবতীর্ণ হয়। এমনিভাবে ১৪ই আগস্টে ‘দেশ সেবার জন্য জেনারেল টিক্কা খানকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব দিয়েও মাত্র সতের দিনের মধ্যে তাকে গভর্নর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া, তদস্থলে ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য’ বাঙালী গভর্নর হিসাবে আবদুল মালেককে নিয়োগ করা, নির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত নয় এমন সব ‘দুষ্কৃতিকারীর’ জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে ইচ্ছুক শরণার্থীদের জন্য ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন করা, ‘দেশদ্রোহের অপরাধে’ অভিযুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বনির্ধারিত বিচার ১১ই আগস্ট একদিনের জন্য শুরু করেও সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধানের জন্য তা পিছিয়ে দেওয়া ইয়াহিয়ার ইত্যাকার নমনীয়তা ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকেই ঘটতে শুরু করে এবং নিক্সনের চিঠির পর তা আরও ত্বরান্বিত হয়। এই সব বাহ্যিক পরিবর্তনের অন্তরালে ইসলামাবাদের ক্ষমতার কেন্দ্রে কি ঘটছিল তা জানার কোন উপায় তখন আমাদের ছিল না। তবে পাকিস্তান আসন্ন বিপর্যয়কে এড়াবার জন্য পূর্বাঞ্চলে তার বাহ্যিক ভূমিকা পরিবর্তন করলেও বৃহত্তর পাক-ভারত যুদ্ধে বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে নিমজ্জিত করার অন্যান্য প্রস্তুতি অব্যাহত রাখে।