অধ্যায় ১৮: অক্টোবর – নভেম্বর
নভেম্বরের শুরু থেকেই উপমহাদেশের আবহাওয়া বেশ উত্তপ্ত। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান এবং তৃতীয় সপ্তাহে ভারত পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সীমান্তেই নিজ নিজ সৈন্য সমাবেশ সম্পন্ন করে। পূর্বাঞ্চলে সেই মার্চ থেকে পাকিস্তান যে গণহত্যা ও সন্ত্রাসের শাসন শুরু করেছিল তখনও তার কোন বিরাম ঘটেনি, কিন্তু অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে তাদের প্রাধান্য আর প্রশ্নাতীত নয়। সীমান্তেও তারা ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর বৃহত্তর চাপের সম্মুখীন। পাকিস্তান মালদহ ও ত্রিপুরা রাজ্যের দিকে অসফল কিছু প্রতি-আক্রমণের প্রচেষ্টা চালাবার পর ভারতীয় কাশ্মীরকেই তারা পাল্টা চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্র হিসাবে বেছে নেয়। পূর্বাঞ্চলে সীমান্তে তাদের ভূমিকা মূলতই আত্মরক্ষামূলক-অবশিষ্ট সীমান্ত ঘাটি (BOP) গুলিকে নির্ভর করে তাদের সৈন্যবল সীমান্ত বরাবর বিস্তৃত। যদি ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী মুক্তাঞ্চল গঠনের জন্য কিছুটা ভিতরের দিকে অগ্রসর হয়, তবে তা প্রতিরোধ করার জন্য ইতিমধ্যেই পাকিস্তান সীমান্তবর্তী শহরগুলির সামরিক ঘাঁটি ‘দুর্গের’ মত সুরক্ষিত করে তুলেছে। সেখানেই যাতে তাদের সীমান্তবর্তী সৈন্যরা পুন: একত্রিত হয়ে বৃহত্তর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
বস্তুত জুন-জুলাই মাসে, মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ তৎপরতার সময় সীমান্ত এলাকায় মুক্তাঞ্চল গঠন প্রতিরোধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান যে বিওপিভিত্তিক সীমান্ত প্রতিরক্ষার কৌশল অবলম্বন করে তা বিগত তিন মাসে পরিস্থিতির ব্যাপক পরিবর্তন এবং ভারতীয় বাহিনীর বৃহত্তর চাপ সত্ত্বেও মূলত অপরিবর্তিত থাকে, এর সঙ্গে কেবল তাদের পিছনের ঘাঁটিগুলির অবস্থান যুদ্ধের উপযোগী করে সুদৃঢ় করে তোলা হয়। জানা যায়, অক্টোবরের শেষ অবধি পাকিস্তানী সমরনায়কদের এই ধারণা ছিল যে, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর চাপ কমানোই ভারতীয় বাহিনীর সীমান্ত তৎপরতা বৃদ্ধির কারণ। সম্ভবত এই আংশিক উপলব্ধি থেকে তারা ঢাকার জন্য স্বল্প সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন রাখে। অবশ্য গোটা সীমান্ত জুড়ে অন্যন নব্বইটি বিওপি প্রহরা, সীমান্তবর্তী দশটি শহরে ‘দুর্গ’ ও আরো কিছু সংখ্যক শহরে ‘মজবুত ঘাঁটি’ তথা ‘Strong Point’ প্রতিষ্ঠা এবং তদুপরি সীমান্তের বিভিন্ন অংশে ভারতীয় ও বাংলাদেশের বাহিনীর ব্যাটালিয়ান অথবা বৃহত্তর আঘাত মোকাবিলায় নিযুক্ত থাকার পর ঢাকা বা তার চারপাশে সর্বশেষ লড়াইয়ের মত উদ্বৃত্ত সৈন্য কতটুকু তাদের ছিল, তাও বিচার্য। উদ্বৃত্ত সৈন্যের অভাব হেতু সীমান্ত থেকে প্রতিপক্ষের জোরাল আক্রমণের মুখে পশ্চাদপসরণ করে ‘দুর্গের’ মধ্যবর্তী ভূভাগ নিয়ন্ত্রণ করা তাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। সে ক্ষেত্রে নিয়াজীর তথাকথিত ‘দুর্গ’ পাকিস্তানী সেনাদের আত্মহননের খেদায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনাই ছিল সমধিক। পাকিস্তানের সামরিক পরিকল্পনার এই বিভ্রান্তি ও অবাস্তবতা কেবল তাদেও সৈন্যের সংখ্যাল্পতা থেকে উদ্ভূত ছিল না, প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্য উপলব্ধিতে তাদের অক্ষমতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।
পক্ষান্তরে, অক্টোবর মাসে দু’একটি সীমান্তবর্তী ‘মজবুত ঘাঁটি’র সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার ফলে ভারত ও বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্বের পক্ষে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ঢাকা অভিমুখে দ্রুত সামরিক অভিযান সম্ভব করার জন্য এই সব ‘মজবুত ঘাঁটি’ ও ‘দুর্গকে পাশ কাটিয়ে যাওয়াই উপযুক্ত কৌশল। এই উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই কৌশল কার্যকর করার জন্য মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় অজানা বিকল্প পথঘাট, নদীনালা ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বিশদ তথ্যাদি সংগৃহীত হতে শুরু করে। বস্তুত এপ্রিল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ বাহিনীর অফিসার এবং নন-কমিশন্ড অফিসারগণ পাকিস্তানের সামরিক বিষয়াদি সম্পর্কে, যথা–সংগঠন, শক্তিমত্তা, অবস্থান, অস্ত্রসম্ভার, গোলা-বারুদ, অবকাঠামো, লজিস্টিকস্, পরিকল্পনা, কৌশল, নেতৃত্ব, তথ্য, যোগাযোগ, ট্রেনিং, মনস্তাত্ত্বিক গঠন প্রভৃতি বিষয়ে এবং সামরিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজে প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয় যথা–স্থানীয় বৈশিষ্ট্য, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক উপাদান, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পথঘাট, নদীনালা, সেতু-ফেরী, শক্তি ও জ্বালানী ইত্যাকার বিষয়ে যে সমুদয় তথ্য ভারতীয়পক্ষকে সরবরাহ করে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও অভিযান পরিচালনার কাজে তার মূল্য ছিল অপরিসীম। কেবল তা-ই নয়, মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানী ইউনিটসমূহের সর্বশেষ অবস্থান, আয়তন, গতিবিধি এবং সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য নিয়মিত সরবরাহ করে তাদের বিরুদ্ধে আসন্ন অভিযানকে অসামান্যভাবে সাহায্য করে।
নভেম্বরের শুরুতে প্রত্যক্ষ তৎপরতার ক্ষেত্রেও তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা আগের তুলনায় অনেক বেশী সক্রিয়। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুনরায় তাদের যে তৎপরতা আরম্ভ হয়, নভেম্বরের শুরুতে সেই তৎপরতার মান অধিকতর পরিপক্ক এবং তৎপরতার পরিধিও অনেক বিস্তৃত। কোন এলোপাতাড়ি আক্রমণ নয়, বরং লক্ষ্য ও কৌশল সম্পর্কে যথোপযুক্ত পরিকল্পনার ভিত্তিতেই তারা দখলদার সৈন্যদের চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে শুরু করে। ইতিপূর্বে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত শক্তি বৃদ্ধির ফলে এবং অংশত কোন কোন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল পরিবর্তিত হওয়ার ফলে রাজাকার বাহিনীর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও সুবিধাবাদী অংশটি ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়তে থাকে এবং এই অবস্থায় এই বাহিনীর আয়তন বৃদ্ধির জন্য দখলদার সামরিক শাসকেরা জামাতে ইসলাম ও বিহারী সম্প্রদায়ের সমবায়ে গঠিত ‘আল-বদর’ ও ‘আল-শামস বাহিনীদ্বয়ের গোড়া সদস্যদের উপর অধিকতর নির্ভর করতে শুরু করে। এই সমুদয় বাহিনীর সম্মিলিত তৎপরতা সত্ত্বেও স্থানীয় জনসাধারণ তাদের পূর্ববর্তী ভয়ভীতি ও জড়তাকে অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করতে শুরু করে। ফলে দখলদার সৈন্য, তাদের স্থানীয় দোসর এবং সামরিক ও আধাসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ক্ষমতা বিরাটভাবে বৃদ্ধি পায়, দখলদার সেনাদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বাড়তে থাকে এবং ক্রমশ দখলদার সৈন্যদের মধ্যে হতাশা, অবসাদ ও আতঙ্কের আবহাওয়া বিস্তার লাভ করতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের এই সব তৎপরতার মূল্য ছিল অপরিসীম। দখলদার সেনাদের হতোদ্যম ও যুদ্ধ-পরিশ্রান্ত করে তুলে চূড়ান্ত আঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুতের যে সামরিক দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের উপর ছিল, সেই লক্ষ্য অর্জনের দিকে তারা এখন দ্রুত ধাবমান। এই তৎপরতার রাজনৈতিক গুরুত্ব এর সামরিক মূল্যের চাইতে কোন অংশে কম ছিল । অক্টোবর-নভেম্বরের তৎপরতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সশস্ত্র ছাত্র ও তরুণের দল অনন্য প্রত্যয়ের সাথে স্বদেশবাসীর কাছে, বিশ্বের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। বিশ্বের সকল সংবাদমাধ্যমের কাছে এ কথা স্বীকৃতি লাভ করে যে, এই অকুতোভয় তরুণেরা নিজেদের সীমিত শক্তি ও অস্ত্রবল নিয়ে দেশের সকল অঞ্চলে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে চলেছে এক শক্তিশালী দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তার নিজস্ব শক্তির মহিমায় আত্মপ্রতিষ্ঠিত না হলে, পরবর্তীকালে ভারতের অংশগ্রহণের পর এই যুদ্ধকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা বিশ্ববাসীর পক্ষে যেমন কঠিন হত, তেমনি ভারতও সম্ভবত রাজনৈতিক ও সামরিক উভয়বিধ কারণে সর্বাত্মক সাহায্য প্রদানের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হয়ে থাকত। অন্তত ডি. পি. ধর ১৬ ও ১৭ই অক্টোবরে প্রাঞ্জল ও বিশদভাবেই তাদের এই দ্বিধার কথা আমার কাছে প্রকাশ করেন।
দেশের ভিতরে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক তৎপরতার মুখে পাকিস্তানী বাহিনীর অবস্থা যখন ক্রমশ খারাপের দিকে, তখন পাকিস্তানের মোট সৈন্যসংখ্যার যে চার-পঞ্চমাংশ সীমান্তে মোতায়েন ছিল তারা ক্রমবর্ধিত সামরিক চাপের সম্মুখীন হয়। সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় বাহিনী যে ভূমিকা পালনে নিযুক্ত ছিল সেই ভূমিকা অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। নভেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানী জান্তার পক্ষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব যে, ভারত ও বাংলাদেশের মিলিত ও ক্রমবর্ধিত সামরিক চাপের মুখে পাকিস্তানের ক্লান্ত, হতোদ্যম চার ডিভিশন সৈন্য, যৎসামান্য বিমান ও নৌবহর এবং ৭৩,০০০ আধা-সামরিক জনবল নিয়ে দীর্ঘদিন পূর্বাঞ্চলের উপর ঔপনিবেশিক দখল রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের এই সংঘর্ষকে পাক-ভারত যুদ্ধে পরিণত করে ভারতীয় কাশ্মীরের কিয়দংশ দখল করা, মিত্ররাষ্ট্রদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পূর্বতন স্থিতাবস্থা কায়েম করার জন্য সচেষ্ট হওয়াই পাকিস্তানী শাসকদের কাছে অপেক্ষাকৃত গ্রহণযোগ্য পন্থা হিসাবে বিবেচিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল। ভারতীয় কাশ্মীরের কিয়দংশ দখলের জন্য সামরিক প্রস্তুতি ও ক্ষমতা পাকিস্তানের নিজস্ব আয়ত্তেই ছিল। বরং বৃহত্তর যুদ্ধের জন্য মিত্ররাষ্ট্রদের সামরিক হস্তক্ষেপ সংগঠিত করা পাকিস্তানের জন্য অপেক্ষাকৃত দুরূহ ছিল। স্পষ্টতই চীন হস্তক্ষেপে অপারগ ছিল ভারত সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি, উসূরী নদী বরাবর চল্লিশ ডিভিশন এবং সিংকিয়াং সীমান্ত বরাবর আরও ৬/৭ ডিভিশন সোভিয়েট সৈন্যের উপস্থিতি প্রভৃতি
বিষয় বিবেচনা করেই। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অক্ষমতা ততটা ছিল না; যদিও ইয়াহিয়া জান্তার বিরুদ্ধে সৃষ্ট প্রবল মার্কিন জনমত ছিল একটি প্রবল রাজনৈতিক বাধা।
তৎসত্ত্বেও নভেম্বরে বিভিন্ন ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয়, যুক্তরাষ্ট্র যদি সম্ভাব্য সোভিয়েট প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে চীনকে কোন কার্যকর সামরিক নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় তবে সেই নিশ্চয়তার ভিত্তিতে চীনা বাহিনী সিকিম সংলগ্ন চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর সীমান্ত থেকে স্বল্প দূরে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে সীমিত সংঘর্ষে লিপ্ত হতে অথবা সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করতে সম্মত হতে পারে। সেই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সপ্তম নৌবহরের জাহাজবাহিত বিমানের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ভাগ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের উপর বিমান আচ্ছাদন (Air cover) বিস্তার করে নৌসেনা অবতরণের মাধ্যমে সামরিক পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের অনুকূলে আনার কাজে উদ্যোগী হতে পারে বলে মনে হয়। চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে চীনা সৈন্য এবং বঙ্গোপসাগর দিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের আগমনের ফলে ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনিশ্চিত হয়ে পড়া এবং অমীমাংসিতভাবে যুদ্ধ শেষ হওয়া অসম্ভব নয় বলে মনে হয়। কিন্তু চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সম্ভব করে তোলার ক্ষমতা পাকিস্তানী শাসকদের সামান্যই ছিল। অবশ্য ৭ই অক্টোবর ইয়াহিয়া খান ‘পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি রোধকল্পে’ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ‘ব্যক্তিগত উদ্যোগে’র উপর নিজের সার্বিক নির্ভরশীলতার কথা ব্যক্ত করার পর থেকে নিক্সনের নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী কিসিঞ্জারকেই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক দখল রক্ষার জন্য উত্তরোত্তর তৎপর হয়ে উঠতে দেখা যায়। বিশেষত ২৬শে অক্টোবর চীন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর কিসিঞ্জারের কর্মব্যস্ততা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে, যখন মনে হয় ইয়াহিয়া জান্তার স্বপক্ষে উপমহাদেশের ঘটনাধারা নিয়ন্ত্রণের প্রধান দায়িত্ব ‘হোয়াইট হাউসে’ স্থানান্তরিত হয়েছে। মুখ্যত কোন দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে এত অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ব সংঘাতে রূপান্তরিত করার এমন নাটকীয় দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহ অবধি মার্কিন কূটনৈতিক উদ্যোগের অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল সীমান্ত থেকে ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য প্রত্যাহার এবং জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে সোভিয়েট ইউনিয়নকে সম্মত করানো। কিন্তু এই সব মার্কিন প্রস্তাব মূল সমস্যা সমাধানের দিকে না গিয়ে যে কেবল পাকিস্তানী দখলকেই দীর্ঘায়িত করার প্রয়াসী, সোভিয়েট ইউনিয়নের কাছে তখন তা আর অস্পষ্ট নয়। একদিকে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং শরণার্থী ফেরৎ নেওয়ার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উদ্যোগের অভাব, এবং অন্যদিকে ভারতের উপর শরণার্থী সমস্যার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দৃষ্টে সোভিয়েট ভূমিকা তখন মার্কিনী প্রত্যাশার বিপরীতগামী। ভারতকে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েট অসম্মতি দৃষ্টে মার্কিন প্রশাসন সম্ভবত উপলব্ধি করেন–যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্মক আয়োজন বন্ধ করার জন্য মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা এবং পাকিস্তানের একক সামরিক উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়, সেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া পাকিস্তানের আসন্ন বিপর্যয় রোধ করার কোন উপায়ই আর অবশিষ্ট নাই। এ ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ ঘনীভূত হয় নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সংঘটিত দু’টি স্বতন্ত্র ঘটনা দৃষ্টে। ৩রা নভেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট সীমান্ত অঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে ভারতের অসম্মতির তীব্র সমালোচনা করেন এবং অযাচিতভাবেই ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে মার্কিন অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান ‘যে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পর এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের অস্ত্র ও সৈন্যবলসহযোগে পাকিস্তানকে সাহায্য করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি থেকে দু’টি আঞ্চলিক সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান যে কোন কমিউনিস্ট দেশ কর্তৃক আক্রান্ত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক সহায়তা লাভের অধিকারী ছিল। কিন্তু অন্য কোন চুক্তির অধীনে কোন অকমিউনিস্ট দেশের ‘আক্রমণের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যে অনুরূপ মার্কিন সহায়তা লাভের অধিকারী, তদ্রূপ তথ্য তখন অবধি ছিল অজানা। ব্যাপারটি সন্দেহজনক মনে হয় এ কারণেই যে, এ ধরনের কোন গোপন চুক্তি বলবৎ থাকলে পাকিস্তান। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তা প্রয়োগ করার জন্য চেষ্টার বোধহয় কার্পণ্য করত না। ১৯৫৯ সালের দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে এ জাতীয় মার্কিন অঙ্গীকার সত্যই ছিল কি না সে সম্পর্কে তখন নিশ্চিত না হওয়া গেলেও বাংলাদেশে প্রত্যাসন্ন চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই ব্যর্থ করার জন্য এই চুক্তিকে ব্যবহার করার সুযোগ বা বাসনা যে মার্কিন প্রশাসনের রয়েছে এমন ইঙ্গিত ওয়েলার্টের বিবৃতি থেকে পাওয়া যায়। ওয়েলার্টের বিবৃতি উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে হলেও স্বভাবতই যে প্রশ্নটি আমাদের জন্য মুখ্য হয়ে ওঠে তা ছিল: কিভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ কার্যকর হওয়া সম্ভব। এ সম্পর্কে অন্তত আমার নিজের কোন সন্দেহ ছিল না যে, পাকিস্তানের শেষরক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যদি সশস্ত্র হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্তই নেয়, তবে তা কার্যকর করার জন্য প্রয়োজন এই ধরনের কোন চুক্তি অথবা সেই চুক্তির কোন অস্পষ্ট ধারার সুবিধাজনক ব্যাখ্যা। তেমনি প্রয়োজন তাদের ছিল ভারত-সোভিয়েট চুক্তির সতর্কবাণী সত্ত্বেও চীনা সশস্ত্রবাহিনীকে তিব্বত-ভারত সীমান্তে সীমিত হস্তক্ষেপের জন্য সম্মত করানো। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সে দিকেও আর একটি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়।
গণহত্যা শুরুর পর পাকিস্তানকে যদিও চীন নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করে এসেছে, তবু মে থেকে উপমহাদেশীয় প্রশ্নে চীন কোন প্রকাশ্য মতামত ব্যক্ত করেনি। অনুমান করা হয়েছিল, স্বাধীনতার পক্ষে মওলানা ভাসানী ও চীন-সমর্থক কোন কোন বামপন্থী গ্রুপের ভূমিকা, পাকিস্তানী বাহিনীর বিরামহীন বর্বরতা, আগস্টে ভারত-সোভিয়েট মৈত্রীচুক্তি প্রভৃতি ঘটনা চীনকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কে অধিকতর বাস্তববাদী করে তুলেছে। হঠাৎ জানা গেল, সেই চীনের ‘আমন্ত্রণক্রমে উচ্চ সামরিক প্রতিনিধিদের সমবায়ে গঠিত পাকিস্তানের এক প্রতিনিধিদল ‘পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং উপমহাদেশের সাম্প্রতিক বিকাশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য পিকিং উপস্থিত হয়েছে। পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে চীনের নিজস্ব আগ্রহ কতটু ছিল তা অজ্ঞাত। তবে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের সফর শেষে দেখা যায়, চীন ভারতের জন্য চিরাচরিত নিন্দাজ্ঞাপন ছাড়া পাকিস্তানের জন্য বেশীদূর অগ্রসর হতে আগ্রহী নয়–এমনকি আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে প্রথাগত যুক্তইশতেহার প্রকাশের স্বার্থেও। বিভিন্ন ঘটনাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয়, পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে চীনের আগ্রহ ছিল সামান্যই, সম্ভবত অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে পিকিং-এ অনুষ্ঠিত চৌ-কিসিঞ্জার আলোচনা থেকেই এর উৎপত্তি। পূর্ব পাকিস্তানের সুরক্ষার জন্য চীনা সেনাবাহিনীর সীমিত হস্তক্ষেপের পক্ষে সকল যুক্তিজাল বিস্তার এবং সমূহ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি উচ্চারণের পরেও পিকিং-এ কিসিঞ্জার যদি স্বভাবত সাবধানী চীনা নেতৃত্বকে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল অথচ সামরিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত দেখতে পান, তবে তাদের কাছে আর এক প্রস্থ ধরনা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানীদের পাঠানোর প্রয়োজন কিসিঞ্জারেরই প্রথম উপলব্ধি করার কথা। পাকিস্তানীদের জন্য চীনের আমন্ত্রণপত্র সংগ্রহ করা, বা চীনের কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ভুট্টোর মত ব্যক্তিত্বকে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে সুপারিশ করা কিসিঞ্জারের পক্ষে ছিল অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ।
পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলে বিমানবাহিনীর প্রধান রহিম খান, সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ গুল হাসান ও নৌবাহিনীর প্রধান রশীদ আহমদ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এই সফরের সামরিক উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব প্রতিফলিত হয়। কিন্তু এই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বপদে ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি’ হিসাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নিয়োগ বেশ কিছু বিস্ময়ের উদ্রেক করে। কেননা ২৬শে মার্চ আওয়ামী লীগ। বেআইনী ঘোষিত হওয়ার পর থেকে ভুট্টো ‘৭০-এর নির্বাচনের বিজয়ী দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের প্রধান হিসাবে ক্ষমতা লাভের জন্য যতই ব্যাকুল হয়ে ওঠেন ততই ক্ষমতাসীন জান্তা তার ক্ষমতারোহণের পথ দুরূহ করতে থাকে। বস্তুত ইয়াহিয়ার ‘বিশেষজ্ঞ-প্রণীত’ খসড়া শাসনতন্ত্র এবং জাতীয় পরিষদের তথাকথিত ‘উপনির্বাচনে’ দক্ষিণপন্থী প্রার্থীদের ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ ঘোষণা করার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভুট্টোকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত রাখা। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে এক অজ্ঞাত অথচ অত্যন্ত প্রভাবশালী মধ্যস্থতায় ইয়াহিয়া-ভুট্টো সম্পর্কে হঠাৎ উন্নতি ঘটে। ১লা নভেম্বর ঘোষণা করা হয় আওয়ামী লীগের শূন্য ঘোষিত আসনের উপনির্বাচনে ভুট্টোর পিপলস্ পার্টির পাঁচজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে এবং অন্তত আরও ছ’জনের অনুরূপভাবে ‘নির্বাচিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর চারদিন বাদে ভুট্টো পাকিস্তানী সামরিক প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে পিকিং যান।
চীনকে ভারতের উত্তর সীমান্তে সামরিক হস্তক্ষেপে সম্মত করানোর ক্ষেত্রে এই মিশনের ব্যর্থতার সংবাদ একাধিক সূত্রে প্রকাশিত হওয়া সত্ত্বেও এর ‘সাফল্য সম্পর্কে ভুট্টোর দাবী ও দ্ব্যর্থক কথাবার্তায় চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু সংশয় আমাদের মধ্যে বিরাজ করতে থাকে। চীনের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভুট্টোর সচেতন অতিশয়োক্তি পাকিস্তানী জান্তার জন্য সমূহ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে বলে পরবর্তীকালে জানা যায়। ইতিপূর্বে চীনের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভের জন্য ইন্দিরা গান্ধী যে অভিনন্দন বার্তা পাঠান তার জবাবে ভুট্টো-মিশনের প্রত্যাবর্তনের পর চৌ এন লাই ভারত ও চীন উভয় দেশের জনগণের বন্ধুত্ব বন্ধন উন্নত হওয়ার আশা প্রকাশ করে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে–আমেরিকা ও পাকিস্তানের উপর্যুপরি প্রচেষ্টার জন্যই হোক, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর ক্রমবর্ধিত চাপের মুখে পাকিস্তানের হতদ্দশা দৃষ্টেই হোক, অথবা চীনের অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে আসায় চীনের নেতৃত্ব পুনরায় নিজেদের সবল মনে করার জন্যই হোক–চীন পাকিস্তানের সমর্থনে সক্রিয় হয়ে ওঠে।
বেঞ্জামিন ওয়েলার্ট যখন পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যায় ব্যস্ত এবং অপরদিকে ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী প্রতিনিধিদল যখন সামরিক হস্তক্ষেপে চীনা নেতৃত্বকে সম্মত করার জন্য পিকিং গমনে উদ্যত, সেই সময় ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে মার্কিন প্রশাসনের উপমহাদেশীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার সুযোগ অতি সামান্যই ছিল। যে কারণে ইন্দিরার এই দূরযাত্রা, সেই শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে নিক্সন তার প্রকাশ্য বিবৃতি-বক্তৃতায় সম্পূর্ণ নিরব থাকেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিন ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকেও তিনি শরণার্থী সংক্রান্ত সমস্যা এড়িয়ে যান, সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহাস্য বন্ধ করার প্রয়োজন উল্লেখ করেন, এবং পাকিস্তানকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা অত্যন্ত সামন্য বলে দাবী করেন। নিক্সনের একমাত্র ‘কনসেশন’ ছিল পাকিস্তানকে দেয় ৩.৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সাহায্য বন্ধ ঘোষণার। শেখ মুজিবের মুক্তি ও সঙ্কটের নিরস্ত্র সমাধানে নিক্সনের সহযোগিতা লাভের কোন ক্ষীণ আশা তখনও যদি ইন্দিরা গান্ধীর থেকে থাকে, তবে তা সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে, কোন যুক্তইশতেহার ব্যতিরেকেই, তিনি স্বদেশের পথে পাড়ি জমান ফ্রান্স এবং পশ্চিম জার্মানী হয়ে। প্যারিসের বহুলাংশে সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ইন্দিরা এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করেন: পূর্ব বাংলার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, শীঘ্রই হোক আর দেরীতেই হোক এ স্বাধীনতা আসবেই। নভেম্বরের প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহে কেবল ইন্দিরা গান্ধীই নন, আরো অনেক মহল থেকে একই পরিণতির কথা উচ্চারিত হয়েছিল প্রাঞ্জল ভাষায়।
ইন্দিরা গান্ধীর আরেমরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ সফরের পর সঙ্কটের নিরস্ত্র সমাধানের শেষ আশাটুকুও যখন নিঃশেষিত, তখন শরণার্থী সমস্যা থেকে ভারতের নিষ্কৃতির পথ ছিল মাত্র একটিই। এই পথ ছিল, সামরিক পন্থায় পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী দখলের সম্পূর্ণ বিলোপসাধন করে সেখানে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের উপযোগী নিরাপদ রাজনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করা। এপ্রিলে পাকিস্তানী গণহত্যার ভয়াবহ শুরুতে, সর্বাংশেই এক হতচকিত অবস্থার মাঝে, ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সাফল্যের জন্য তাজউদ্দিনকে যে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেছিলেন তার আন্তরিকতা ও গুরুত্ব লঘু করা চেষ্টা না করেও বলা যায়, মূলত পাকিস্তানী জান্তার সামরিক সমাধানের’ অনিবার্য ফল হিসাবে সৃষ্ট অবিরাম শরণার্থী স্রোত ভারতের উপর অশেষ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ ছাড়াও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে তা সমাধানের অপর কোন পন্থা ভারতের ছিল না। এই পরিণতির দিকে ভারতের সর্বোচ্চ মহলের বক্তব্য ক্রমশ যেমন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়, তেমনি দখলকৃত বাংলাদেশের সীমান্তে নিয়মিত বাহিনীর পক্ষে ভারতের সামরিক চাপ বৃহৎ থেকে বৃহত্তর হতে থাকে। মার্চে পাকিস্তানী গণহত্যা শুরুর জবাবে পূর্ব বাংলার অকুতোভয় ছাত্র, যুবক ও বিদ্রোহী সৈন্যের দল সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার পর তারই পর্যায়ক্রমিক বিকাশের চূড়ান্ত পর্বে পাকিস্তানের নির্মম সুসংগঠিত সামরিক যন্ত্রকে বিচূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর অংশগ্রহণ যেরূপ অত্যাবশ্যক গণ্য করা হয়েছিল, বিগত কয়েক মাসে রাজনৈতিক আপোস-মীমাংসা ও কূটনৈতিক মধ্যস্থতার বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি নিঃশেষ করার পর শরণার্থী উপদ্রুত ভারতের জন্যও তদ্রপ ভূমিকা গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
কিন্তু প্রত্যক্ষ সামরিক ভূমিকা গ্রহণের পথে তখনও ভারতের একটি বড় সমস্যা ছিল। বাংলাদেশের জন্য ভারতের সর্ববিধ সহযোগিতা প্রদান, এমনকি মুক্তিবাহিনীর সমর্থনে সীমান্ত সংঘর্ষে অংশগ্রহণ করা ছিল এক কথা, আর পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানকে সম্পূর্ণভাবে পরাভূত করার উদ্দেশ্য নিয়ে ভারতের সর্বাত্মক যুদ্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ভারতের জন্য শেষোক্ত পদক্ষেপের অনিবার্য পরিণতি ছিল বিশ্বের কাছে নিজকে আক্রমণকারী দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশ সঙ্কটের চাপে সোভিয়েট ইউনিয়নের সাথে নিরাপত্তা বিষয়ক মৈত্রীচুক্তি স্বাক্ষরের পর জোট-বহির্ভূত দেশ হিসাবে নিজের পূর্বতন ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখার ক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যেই যে সমস্যার মোকাবিলা করতে শুরু করে, তা পাকিস্তান আক্রমণের উদ্যোগ নিয়ে অনেক বেশী জটিল করে তোলা এবং অন্তত বেশ কিছু কালের জন্য অবশিষ্ট বিশ্ব থেকে নিজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা একটি অত্যন্ত দুরূহ সিদ্ধান্ত ছিল। একদিকে উদ্ভূত সঙ্কট নিরসনে প্রত্যক্ষ সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের মৌল প্রয়োজন এবং অন্যদিকে সামরিক উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গুরুতর আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা–এই পরস্পরবিরোধী বিবেচনার মধ্যে ভারতের সিদ্ধান্ত নির্দিষ্টভাবে প্রকাশিত হবার আগেই পাকিস্তানী জান্তাই ভারতকে এই উভয় সঙ্কট থেকে মুক্ত করে। পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সীমান্তে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত ও ক্রমবর্ধিত চাপের বেসামাল প্রতিক্রিয়া হিসাবেই হোক, কিংবা পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হবার পর তা অমীমাংসিতভাবে শেষ করার ক্ষেত্রে অন্তত একটি মিত্র রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশ্বাস বা স্বকল্পিত আশাকে অবলম্বন করেই হোক, কিংবা ক্ষমতাসীন জান্তার অভ্যন্তরে ক্ষমতা বদলের জন্য কোন ষড়যন্ত্রমূলক প্ররোচনার কারণেই হোক, অথবা এই সমুদয় কারণ কমবেশী সংমিশ্রিত হওয়ার ফলেই হোক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নিজেই যুদ্ধ শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২৩শে নভেম্বর পাকিস্তান ‘জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে এবং ঐ দিন তক্ষশীলায় চীনা সাহায্যে নির্মিত ভারী যন্ত্রপাতি কারখানার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনা মন্ত্রীর উপস্থিতিতে ইয়াহিয়া খান ‘দশ দিনের মধ্যে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেন। যথাসময়ে সম্ভাবনাটি বাস্তবায়িত হয়।