অধ্যায় : পাঁচ – ভিড় করে আসা প্রশ্নমালা

অধ্যায় : পাঁচ – ভিড় করে আসা প্রশ্নমালা

এই যে এতকিছু আলোচনা করলাম, এর পরেও ভিড় করে আসে নানা প্রশ্ন। এইসব প্রশ্নকারীদের মোটামুটিভাবে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা যায়। এক : আন্তরিকভাবেই জিজ্ঞাসু। দুই : আত্মার অমরত্ব অলীক চিন্তা বুঝেও অধ্যাত্মবাদীদের নানা কূট প্রশ্নের মুখোমুখি হলে তার উত্তর কি হওয়া উচিত—জানতে আগ্রহী। তিন : আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী, অথবা আত্মার অমরত্ব প্রচারে আগ্রহী। তাই এঁরা আত্মার মরণশীলতা বিষয়ক বিভিন্ন যুক্তি (যে’সব যুক্তি ইতিপূর্বে আপনাদের সামনে হাজির করেছি) হাজির করার পর, সেই যুক্তিগুলোকে খণ্ডণ করা অসাধ্য বুঝে সে বিষয়ে নীরবতা দেখিয়ে, অন্য প্রসঙ্গ তোলেন। উদ্দেশ্য—কূটপ্রশ্নে উত্তরদাতাকে অস্বস্তিতে ফেলে আত্মার মরণশীলতা বিষয়ে এ’যাবৎ দেওয়া যুক্তিগুলোকে শ্রোতাদের কাছে নড়বড়ে করে দেওয়া। চার : সবটা না জেনেই সবজান্তা হওয়াটাই লক্ষ্য। এরা জানতে চায় যতটুক, জানাতে চায় তার চেয়ে বেশি। ফলে শ্রোতাদের সামনে জাহির করার মানসে পূর্বযুক্তি বোঝার চেষ্টা না করে, পূর্বযুক্তিকে খণ্ডণ করার চেষ্টা না করে, সবটা না জেনেই বিদ্যে জাহির করতে ব্যস্ত। এঁরা বিবেকানন্দ না পড়েই বিবেকানন্দের রচনা নিয়ে বেজায় তর্ক করতে ভালবাসেন। এরা অধ্যাত্মবাদের সংজ্ঞাটুকুও না জেনে অধ্যাত্মবাদ নিয়ে ভাসাভাসা বক্তব্যের ধোঁয়াশা তৈরি করেন। আসলে এঁরা যা করেন, তা হল অজ্ঞতা জাহিরের ভাঁড়ামো। পাঁচ : ‘বাঙালি কাঁকড়া’ জাতীয় প্রাণী। ‘বাঙালি কাঁকড়া’র গল্পটা অনেকেরই জানা। সকলের জানা নেই ভেবে ছোট্ট করে বলছি। প্লেন তখন আকাশে। এয়ার হোস্টেস হঠাৎ ‘হাউ-মাউ’ করে চিৎকার সহযোগে লাফিয়ে উঠলেন। কি হয়েছে? কি হয়েছে? চিৎকার শুনে সহকর্মী এয়ার হোস্টেস ও স্টুয়ার্ডরা দৌড়ে এলেন। ভীত বিড়ালাক্ষী সুন্দরী কাঁপা- কাঁপা তর্জনী তুলে দেখালেন একটা মুখ খোলা বড়সড় টিনের পাত্র। সেদিকে তাকিয়ে সমস্বরে সকলেই চিৎকার করে উঠলেন। পাত্র বোঝাই এক গাদা কাঁকড়া। কাঁকড়াগুলো খড়খড় আওয়াজ তুলে যে ভাবে ওপরে উঠে আসছে, তাতে যে কোনও সময়….। আতঙ্কের কারণ বুঝে কাঁকড়ার মালিক বললেন, “কিছু ভয় নেই ম্যাডাম। এরা কেউই টপকে আসতে পারবে না। এ’সবই বাঙালি কাঁকড়া। দেখছেন না, একটা উঠলেই বাকিরা কেমন টেনে নামাচ্ছে।” এরা কখনও কুমার শানুর সঙ্গে গান শেখা নীতিশ দত্ত। শানুর গলা স্কেলে পর্যন্ত থাকে না, কপালগুণে করে খাচ্ছে— বলে নিজের ঈর্ষাকে প্রকাশ করেন। এরা কেউ মফস্বল কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও সেই সঙ্গে শখের জ্যোতিষী পারুল ভট্টাচার্য। উত্তর কলকাতার গা ছুঁয়ে থাকা শহরতলিতে কলেজে যেতে যেতে প্রায়শই এক বাসযাত্রীকে দেখছেন। সেই সাধারণ বাসযাত্রী আজ তাঁরই পরিচিত অনেকের চোখে অসাধারণ হয়ে ওঠায় পারুল বলেন—”তোরা কেন যে ওকে অত পাত্তা দিস বুঝি না।” আসলে পারুলই বোঝার চেষ্টাই করেননি কেন ওই বাসযাত্রীর প্রবন্ধের বই ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে রেফারেন্স বই হিসেবে স্থান পায়, কেন কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডের মত বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিও রেফারেন্স বই হিসেবে তাঁর বইকে স্থান দেয়।

এই ‘বাঙালি কাঁকড়া’ মার্কা প্রাণীরা গুরুত্ব দেয় কে কথাটা বলছে তার উপর। এরা যুক্তির বিরোধিতা করতে পারে সহকর্মী হওয়ার সুবাদে, পড়শি হওয়ার সুবাদে, আত্মীয় হওয়ার সুবাদে। ঈর্ষাকাতরতা থেকে উঠে আসে এদের গোটা বিরোধিতা, এদের সমস্ত কূটপ্রশ্ন।

আসুন এ’বার খোলা মনে দেখা যাক—এরা মোটামুটিভাবে কি কি ধরনের প্রশ্ন তুলে থাকেন।

এঁদের অনেকেই দাবি করেন, নিজে প্ল্যানচেটের আসরে আত্মা আনায় অংশ নিয়েছেন। কখনও বা দাবি করেন ওঁর বাবা-কাকা জাতীয় শ্রদ্ধেয় আপনজন প্ল্যানচেটে আত্মা এনেছিলেন। কখনও বা এঁরা দাবি করেন, ভূতে ভর হওয়া মানুষকে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটাতে দেখেছেন তিনি নিজে, অথবা তাঁর বিশ্বস্ত কোন আপনজন। এঁরা উল্লেখ করেন রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা প্রসঙ্গে। এঁরা আত্মার অমরত্বের প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেন বেদ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদি গ্রন্থের কথা ছাড়াও কিছু কিছু বইয়ের কিছু কিছু কথা। বইগুলোর লেখক প্রধানত অভেদানন্দ, নিগূঢ়ানন্দ ও ডাঃ মরিস রলিংস। এই প্রশ্নকর্তাদের কেউ কেউ বলেন ও চিঠি লেখেন, আমি যেন নিগূঢ়ানন্দের সঙ্গে দেখা করে আত্মা বিষয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শুনি। আজকের ডাকে যে-সব চিঠি এসেছে তারই মধ্য থেকে একটা চিঠির একটু অংশ তুলে দিচ্ছি। পত্রলেখক শ্রীশৈলেনচন্দ্র ঘোষ। নিবাসঃ গৌরবাজার, বর্ধমান। তিনি লিখেছেন, “নিগূঢ়ানন্দের বইগুলো পড়লে বুঝবেন উনি সাধনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছেছেন। আমরা যাকে শ্রেষ্ঠ সাধক বা অবতার বলি, উনি তাই। আপনি আত্মা ও ভূতের অস্তিত্ব, দূরশ্রবণ,দূরদর্শন, অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি, যোগে ভূমিত্যাগ, অলৌকিক ক্ষমতায় রোগমুক্তি ইত্যাদি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। নিগূঢ়ানন্দ বর্তমান কালেরই মানুষ। আপনি দয়া করে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে আপনার সন্দেহের নিরসন ঘটবেই, এই বিশ্বাস রাখি।” আর একদল আছেন, যাঁরা বলেন—”কে এলোরে, রামকৃষ্ণ, অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, বেদ, গীতা, বাইবেল, কোরান সবাই ভুল বলছে, আর উনি ঠিক বলার ঠাকুরদাদা। অধ্যাত্মবাদ বোঝা অতই সোজা! জীবন কেটে যাবে রে!”

‘সানন্দা’র দপ্তরে প্ল্যানচেটের আসর

প্ল্যানচেটে আত্মা আনার কথা ওঠায় মনে পড়ে গেল দুটি ঘটনা। প্রথম যে ঘটনাটার কথা বলছি, সেটা ঘটেছিল ১৬ মে, ১৯৯২। গিয়েছি পাক্ষিক পত্রিকা ‘সানন্দা’র দপ্তরে। কথা প্রসঙ্গে সম্পাদক সহযোগী দীপান্বিতা ভট্টাচার্য জানালেন- আগামী সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী হবে প্ল্যানচেট নিয়ে। তুমি তো প্ল্যানচেটে বিশ্বাসই কর না, বিশ্বাস কর না প্ল্যানচেটে আত্মা আসে, তারা উত্তর দেয়। আমরা প্ল্যানচেটে বিশ্বাসীদের কথাই এবার হাজির করব। তাই সংখ্যাটা প্ল্যানচেট নিয়ে হলেও এ ব্যাপারে তোমার কোনও সাহায্য নিচ্ছি না।

বললাম—কে বলল তোমাকে, আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজে বিভিন্ন প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে দেখেছি, কি অদ্ভুতভাবে মিডিয়ামদের হাত দিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসে।

—তুমি নিজে করে দেখছ?

—হ্যা।

—করে দেখাতে পারবে?

—নিশ্চয়ই।

—কবে দেখাবে? দু’চার দিনের মধ্যে একটা ব্যবস্থা কর, তাহলে এই ইস্যুটাতেই ম্যাটারটা দিতে পারি।

—আজই দেখাতে পারি।

—কোথায় দেখাবে?

—তোমাদের অসুবিধে না থাকলে এখানেই

—কখন দেখাবে?

—এখুনি।

অমনি মুহূর্তে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। সানন্দার সম্পাদকের ঘরেই প্ল্যানচেটের আসর বসানো হবে ঠিক হল। মুহূর্তে ছোট ঘরটি ভর্তি হয়ে গেল সানন্দার সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক ও সম্পাদক সহযোগীদের ভিড়ে।

মিডিয়াম কে হবেন। এগিয়ে এলেন নিবেদিতা মজুমদার। কার আত্মাকে ডাকা হবে? ঠিক হল উত্তমকুমারের আত্মাকেই ডাকা হবে। সকলেই ব্যস্ত মানুষ। তাড়াতাড়ি উত্তর জানতে আগ্রহী। ঠিক হল, দর্শকরা প্রশ্ন করবেন এবং উত্তরগুলো আসবে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’র মধ্য দিয়ে। একটা সাদা কাগজে একটা বৃত্ত আঁকলাম। তারপর গোটা বৃত্ত জুড়ে, পরিধি ছুঁয়ে এঁকে ফেললাম একটা যোগ চিহ্ন। বৃত্তটার চার ভাগের দুই বিপরীত দিকে লিখলাম ‘হ্যাঁ’ অপর দুই বিপরীত দিকে ‘না’। তারপর চেয়ে নিলাম একটু সুতো ও একটা আংটি। আংটিতে বেঁধে ফেললাম সুতো। এবার বৃত্ত আঁকা কাগজটা টেবিলে পেতে টেবিলের দু’প্রান্তে মুখোমুখি বসলাম আমি ও নিবেদিতা। আমার কথা মত নিবেদিতা তাঁর ডান হাতের কনুইটা টেবিলে রেখে তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের সাহায্যে আংটিবাঁধা সুতোটাকে এমনভাবে ধরলেন, যাতে আংটিটা ঝুলে রইল যোগ চিহ্নের কেন্দ্রে, অর্থাৎ বৃত্তেরও কেন্দ্রে।

এ’বার শুরু হল প্ল্যানচেটের দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়। প্রত্যেককে চুপ করতে বললাম। নিস্তব্ধ ঘর। ঘরে গোটাকয়েক ধূপকাঠি জ্বেলে দেওয়া হল। কথা বলছিলাম শুধু আমি—নিবেদিতা, এক মনে ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের কথা। গভীরভাবে ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের কথা। ভাবতে থাকুন, উত্তমকুমারের আত্মা আসছে। উত্তমকুমারের আত্মা এলে আংটিটা আপনা থেকে দুলতে থাকবে——হ্যাঁ’ লেখাকে নির্দেশ করে দুলতে থাকবে।

দু’মিনিটও কাটল না,আংটি কেঁপে উঠল, তারপর দোলা শুরু করল। দুলতে লাগল ‘হ্যাঁ’ শব্দ দুটির দিকে। এরপর শুরু হল দস্তুর মত প্রশ্নবান। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরও মিলছে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। একাধিক হাতের ছোট্ট খাতায় খস্থ করে লেখা হচ্ছে প্রশ্ন ও উত্তর। ছবি তোলা চলছে। এক সময় নিবেদিতার চোখ বুজে এল। নিবেদিতা এলিয়ে পড়ার আগে ধরে ফেললেন সুদেষ্ণা রায়। আমি গম্ভীর, মৃদু ও টানা-টানা সুরে বলতে লাগলাম—নিবেদিতা, এক মনে শুধু আমার কথা শুনতে থাকুন। উত্তমকুমারের আত্মা চলে গেছে। আপনি জেগে উঠছেন। আপনি জেগে উঠছেন। চোখ খুলুন। একটু একটু করে চোখ খুলুন।

চোখ খুললেন নিবেদিতা। বললেন, খুব ঘুম পাচ্ছে। অনিরুদ্ধ ধর ও শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় দৌড়লেন নিবেদিতার জন্য গরম দুধের পরিবর্ত হিসেবে গরম চা আনতে।

উপস্থিত সবার আগ্রহ তখন তুঙ্গে। তাঁরা আবার প্ল্যানচেটের আসর বসাতে চাইলেন। মিডিয়াম হিসেবে চাইলেন সুদেষ্ণাকে। সুদেষ্ণা ওঁদের চোখে প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্না মানুষ। মজা ভালই!

সুদেষ্ণা বসলেন। ঠিক হল সত্যজিৎ রায়ের আত্মাকে আনা হবে। নিবেদিতার সময় যা যা ঘটেছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। আবার প্রশ্নমালা। এমন অনেক প্রশ্ন এল, যেগুলো কৌতূহল থেকে উঠে আসা, কিন্তু কখনই লেখায় প্রকাশ করা যায় না। উত্তরও আসতে লাগল।

প্রশ্নোত্তর পালা শেষ হতেই দীপান্বিতা বললেন—আত্মাকে দিয়ে রাইটিং-প্যাডে লেখানো যায় না?

বললাম—কেন যাবে না; নিশ্চয়ই যায়।

রাইটিং প্যাড এল। ডপেন এল। এবারও সুদেষ্ণাই মিডিয়াম। আহ্বান করা হল রাজীব গান্ধীর আত্মাকে। এ’বারও মিনিট দু’য়েক লাগল। কাঁপতে লাগল সুদেষ্ণার হাতের ডটপেন।

এবার ইংরেজিতে প্রশ্ন—রাজীব, আপনি কি এসেছেন? উত্তর এল-Yes. তারপর উত্তেজিত প্রশ্ন একের পর এক আসতেই লাগল। ডটপেন রাইটিং প্যাড থেকে না তুলে কাঁপা কাঁপা লেখায় উত্তর দিয়েই চললেন সুদেষ্ণা রায়।

উত্তরপর্ব শেষ হতে ওঁদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার উত্তেজনার আগুনে ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিয়ে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম—এতক্ষণ যা হল সেটা আদৌ প্ল্যানচেট নয়, সম্মোহন। উত্তরগুলো আত্মা দেয়নি, দিয়েছে দুই মিডিয়ামের অবচেতন মন। আমি যখন প্ল্যানচেটে আত্মা এনে দেখাবার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছি, তখন দুই মিডিয়ামই আমার কথায় প্রভাবিত হয়েছেন। প্রভাবিত হয়েছিলেন প্ল্যানচেটের আসরকে যেভাবে সাজিয়েছিলাম, যেভাবে পরিবেশটা তৈরি করেছিলাম, তার দ্বারাও। সবচেয়ে বড় কথা নিবেদিতা ও সুদেষ্ণা সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন, বা আত্মা অমর, কি মরণশীল—এই নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। ‘আত্মা মরণশীল’ যুক্তি ও বিজ্ঞানের সূত্র ধরে আসা প্রত্যয় তাঁদের চিন্তাতে দৃঢ়বদ্ধ থাকলে কখনও অলীক আত্মা তাঁদের উপর ভর করত না, যে ভরটা অবশ্যই একটা মানসিক অবস্থামাত্র—এর বাড়তি কিছু নয়। ‘ভূতে ভর’, ‘জীনে ভর’ বা ‘মনসার ভর’ ইত্যাদির জন্য কখনই ভূত, জীন বা মনসার বাস্তব অস্তিত্বের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় সচেতন বা অচেতন মনের গভীরে ভূত, জীন, ঈশ্বরে বিশ্বাস বা দ্বিধা—”এদের বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে থাকতেও বা পারে”। আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসটা কোন ‘আনস্মার্ট’ হওয়ার ব্যাপার নয়। একটি মানুষ ছোটবেলা থেকে আত্মীয়-বন্ধু-শিক্ষক-বইপত্তর থেকে একটু একটু করে শিখেছেন, বিশ্বাসকে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে স্থান দিয়েছেন—আত্মা অমর; এই বিশ্বাসের সঙ্গে স্মার্ট বা আনস্মার্ট হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।

আমার প্রতি বিশ্বাস, আমি আত্মা এনে দেখাব—এই কথায় দ্বিধাগ্রস্ত মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং পরিবেশগতভাবে ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা আত্মার প্রতি বিশ্বাস বা আধা বিশ্বাস এই তিনের প্রভাবের ফলে আমি সহজেই নিবেদিতা ও সুদেষ্ণার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে ধারণা সঞ্চার করতে পেরেছি। আমি যে কথাগুলো ওঁদের বলেছি সেই কথাগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘suggestion’ বা নির্দেশ’ অথবা ‘ধারণাসঞ্চার’। suggestion বা ধারণাসঞ্চার সম্মোহনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্ত বা আবশ্যিক প্রথম ধাপ। আত্মা আসছে—আমার এই সঞ্চারিত ধারণার প্রভাবে তাঁরা সম্মোহিত অবস্থায় নিজেদের অজ্ঞাতে উত্তর দিয়ে গেছেন।

এরপরই যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অধিক—সেটা হল, তাহলে কি ধরে নেব, প্ল্যানচেটের আসরে সম্মোহনবিদের উপস্থিতি একান্তই প্রয়োজনীয়?

না, না, আদৌ তা নয়। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী কেউ যদি সেই সঙ্গে বিশ্বাস করে বসেন—এই পদ্ধতিতে প্ল্যানচেটে আত্মা আনা সম্ভব, তবে সেই পদ্ধতি পালন করলে নিজের অজ্ঞাতে নিজের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে নির্দেশ পাঠান (যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘স্বনির্দেশ’ বা ‘auto-suggestion’) এবং নিজের অজ্ঞাতে সম্মোহিত হয়ে আত্মা তাঁর উপর ভর করেছে বলে বিশ্বাস করে বসেন। ফলে নিজের অজান্তেই উত্তর দিতে থাকেন, যেগুলো সাধারণ চোখে অস্বাভাবিক কাণ্ডকারখানা বলেই মনে হয়।

দ্বিতীয় যে ঘটনাটির উল্লেখ করছি, তাতে স্বনির্দেশ বা auto-suggestion- এ প্ল্যানচেটের বিষয়টা পরিষ্কার হবে বলে আশা করি।

ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা

১৯৮৭ সালের কথা। ভূতে পাওয়া একটি গোটা পরিবার এসেছিলেন আমার কাছে। প্ল্যানচেটে নামানো আত্মা চেপে বসেছিল গোটা পরিবারের উপর।

গৃহকর্তা ইকনমিক্সে এম.এ.। মফস্বল শহরের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। বয়স পঞ্চান্নর আশে-পাশে। গৃহকত্রী বাংলা সাহিত্যে ডক্টরেট। কলকাতার একট মহিলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। দুই ছেলে। বড় ছেলে চাকরি করেন। ছোট তখনও চাকরিতে ঢোকেনি। বেশ কিছু ভাষা জানেন। একাধিকবার বিদেশ গিয়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই ভূতের (?) খপ্পরে পড়ে এমনই নাজেহাল অবস্থায় পড়েছিলেন যে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। ১৯৮৭-এর ৭মে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেন। বিজ্ঞাপনের বক্তব্য ছিল—এক অশরীরী আত্মার দ্বারা আমাদের পারিবারিক শান্তি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। কোনও সহৃদয় ব্যক্তি এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলে আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

বিজ্ঞাপনটি দেখে আমাদের সংগঠনের জনৈক সদস্য নেহাতই কৌতূহলের বশে একটি চিঠি লিখে জানায়—বিস্তৃতভাবে ঘটনাটি জানান। হয়তো সাহায্য করা সম্ভব হবে।

ইনল্যান্ডে উত্তর এলো, পত্রলেখিকার নাম প্রকাশে অসুবিধে থাকায় আমরা ধরে নিলাম তাঁর নাম মঞ্জু। মঞ্জু দেবী জানালেন—’প্ল্যানচেট’ নামে একটা বই পড়ে ১৯৮৪ সনের ২৫ আগস্ট শনিবার তিনি, স্বামী ও দুই ছেলে প্ল্যানচেট করতে বসেন। প্রথমে একটি বৃত্ত এঁকে রেখার বাইরের দিকে A থেকে Z পর্যন্ত এবং রেখার ভিতরের দিকে ১ থেকে ৯ এবং ০ লিখে বৃত্তের কেন্দ্রে একটা ধূপদানিতে ধূপ জ্বেলে সবাই মিলে ধূপদানিকে ছুঁয়ে থেকে এক মনে কোনও আত্মার কথা ভাবতে শুরু করতেন। এক সময় দেখা যেত ধূপদানিটা চলতে শুরু করেছে এবং একটি অক্ষরের দিকে যাচ্ছে। অক্ষরগুলো পরপর সাজালে তৈরি হচ্ছে শব্দ। শব্দ সাজিয়ে বাক্য। এক একটি বাক্য হতে এত দীর্ঘ সময় লাগছিল যে ধৈর্য রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।

তাই প্ল্যানচেট বইয়ের নির্দেশমতো একদিন ওঁরা বসলেন রাইটিং প্যাড ও কলম নিয়ে। প্রথম কলম ধরেছিলেন মঞ্জু দেবী। প্রথম দিন বেশ কিছুক্ষণ বসার পর এক সময় হাতের কলম একটু একটু করে কাঁপতে শুরু করল। মঞ্জু দেবীই প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কে?’ উত্তর লেখা হল – রবীন্দ্রনাথ। আরও কিছু প্রশ্নোত্তরের পরে একে একে প্রত্যেকেই কলম ধরেন। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন আত্মারা এলে রাইটিং প্যাডে লিখে তাদের উপস্থিতির কথা জানিয়ে যায়। আত্মা আসার জন্য বেশ কিছুক্ষণ গভীরভাবে চিন্তা করতে হত বটে, কিন্তু একবার আত্মা এসে গেলে হুড়মুড় করে লেখা বের হত। প্রথম দিন ভোররাত পর্যন্ত কলম চলতে থাকে। তারপর থেকে প্রতিদিনই গভীর রাত পর্যন্ত চলত আত্মা আনার খেলা। এ এক অদ্ভুত নেশা।

এমনিভাবে যখন আত্মা আনার ব্যাপার প্রচণ্ড নেশার মত পেয়ে বসেছে সেই সময় ’৮৫-র জানুয়ারির এক রাতে ছোট ছেলে নিজের ভিতর বিভিন্ন আত্মার কথা শুনতে পান। ‘৮৫-র ৫ মার্চ থেকে মঞ্জুদেবীও একটি আত্মার কথা শুনতে পান। আত্মাটি নিজেকে স্বামী স্বরূপানন্দ বলে পরিচয় দেয়। সেই আত্মার বিভিন্ন কথা ও নির্দেশ আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই শুনতে পাচ্ছেন মঞ্জুদেবী, সেই সঙ্গে আত্মার স্পষ্ট স্পর্শও অনুভব করছেন, আত্মাটি তাঁর সঙ্গে চূড়ান্ত অশ্লীলতাও করছে। মঞ্জুদেবী স্বামী স্বরূপানন্দের শিষ্যা। স্বরূপানন্দ মারা যান ১৯৮৪-র ২১এপ্রিল। মঞ্জুদেবী আমাদের সদস্যটিকে চিঠিটি লিখেছিলেন ২ জুলাই ’৮৭।

চিঠিটি আমার কাছে সেই সদস্যই নিয়ে আসে। আমাকে অনুরোধ করে এই বিষয়ে কিছু করতে।

আমার কথামতো জুলাইয়ের একটি তারিখ উল্লেখ করে সে-দিন পরিবারের সকলকে নিয়ে মঞ্জুদেবীকে আসতে অনুরোধ করেন সদস্যটি।

এলেন মঞ্জুদেবী ও তাঁর স্বামী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম প্ল্যানচেটের আসরে চারজনের কলমেই কোন না কোনও সময় বিভিন্ন আত্মারা এসেছেন। আত্মাদের মধ্যে নেপোলিয়ন, রবীন্দ্রনাথ, সেক্সপিয়ার, আলেকজান্ডার থেকে স্বরূপানন্দ অনেকেই এসেছেন, মঞ্জুদেবীর স্বামীর সঙ্গে বা বড় ছেলের সঙ্গে কোন দিনই কোন আত্মাই কথা বলেনি। অর্থাৎ তাঁরা আত্মার কথা শুনতে পাননি। আত্মার কথা শুনতে পাচ্ছেন মঞ্জুদেবী ও তাঁর ছোট ছেলে। আত্মার স্পর্শ পেয়েছেন শুধু মঞ্জুদেবী।

পরের দিনই আমার সঙ্গে দুই ছেলেই দেখা করলেন। কথা বললাম। সকলের সঙ্গে কথা বলার পর বুঝলাম, চারজনই ‘প্ল্যানচেট’ বইটা পড়ে প্ল্যানচেটের সাহায্যে সত্যিই মৃতের আত্মাকে টেনে আনা সম্ভব এ-কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। তারই ফলে অবচেতন মন সচেতন মনের অজ্ঞাতে চারজনকে দিয়েই বিভিন্ন মৃতের কথা লিখিয়েছে। ছোটছেলে সবচেয়ে বেশিবার মিডিয়াম হিসেবে কলম ধরার জন্য প্ল্যানচেট নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করেন, তাঁর হাত দিয়ে কেন লেখা বের হচ্ছে, এই রহস্যের সমাধানের চেষ্টা করতে গিয়ে বার বারই চিন্তাগুলো এক সময় তালগোল পাকিয়ে গেছে। রহস্যের জাল খোলেনি। বুদ্ধিমান ছোট ছেলে নিজেই নিজের অজান্তে স্কিটসোফ্রেনিয়ার রোগী হয়ে পড়েছেন। ফলে শ্রবণানুভূতির অলীক বিশ্বাসের শিকার হয়ে অলীক সব কথাবার্তা শুনতে শুরু করেছেন।

মঞ্জুদেবী সাহিত্যে ডক্টরেট, ভক্তিমতী আবেগপ্রবণ মহিলা। স্বামী স্বরূপানন্দের শিষ্যা হওয়ার পরবর্তীকালে গুরুর কিছু কিছু নারীর প্রতি অশোভন আসক্তির কথা শুনেছিলেন। প্ল্যানচেটের আসরে অংশ নেওয়ার পর থেকে অতি আবেগপ্রবণতা ও অন্ধ বিশ্বাসের থেকেই তাঁর মধ্যে এসেছে শ্রবণানুভূতি ও স্পর্শানুভূতির অলীক বিশ্বাস।

২৬ জুলাই মঞ্জুদেবী ও ছোট ছেলেকে আসতে বললাম। ওঁরা এলেন। ওঁরা যেমনভাবে কাগজ-কলম নিয়ে প্ল্যানচেটের আসরে বসতেন তেমনিভাবেই একটা আসর বসালাম। দুজনের অনুমতি নিয়ে সে-দিনের আসরে ছিলেন একজন সাংবাদিক, একজন চিত্র-সাংবাদিক ও আমাদের সমিতির দুই সদস্য।

আসর বসবার আগে মঞ্জুদেবী ও তাঁর ছোটছেলের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কিছু কথা বললাম। টেবিলে বসলেন মঞ্জুদেবী ও তাঁর ছেলে। রাইটিং-প্যাড আর কলম এলো। তিনটে ধূপকাঠি জ্বালানো হলো। মঞ্জুদেবীর কথা মত ছেলেই কলম ধরল। মিনিট দুয়েক পরেই দেখা গেল ছেলেটির হাত ও কলম কাঁপছে। মঞ্জুদেবী বললেন, —উনি এসে গেছেন। তারপর তিনিই প্রশ্ন করলেন,–আপনি কে?

কলম লিখল—স্বামী স্বরূপানন্দ।

এর পর মঞ্জুদেবী অনেক প্রশ্নই করলেন, যার মধ্যে ছিল—আপনি আমাকে ছাড়ছেন না কেন? আমাকে ছেড়ে দিন! ওঁরা বলছেন, আপনি আজ থেকে আমাকে ছেড়ে যাবেন, তা হলে ছাড়ছেন না কেন? ইত্যাদি।

ছোটছেলের কলম বেশ দ্রুতই চলছিল। মঞ্জুকে আত্মা ছেড়ে যাচ্ছে তাও লিখে এক সময় কলম ইংরিজিতে লিখল : লিভ দ্যা পেন। কলম ছাড়লেন ছোট ছেলে।

মঞ্জুদেবী খুঁতখুঁত্ করতে লাগলেন। দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে তিনি যে আত্মাটিকে তাড়াতে আঠারো হাজার টাকার ওপর খরচ করেও কৃতকার্য হননি, সে কিনা এত দ্রুত এককথায় চলে যেতে চাইছে!

মঞ্জুদেবী তাঁর সন্দেহের কথাটি স্বভাবতই প্রকাশ করলেন। বললেন, – আপনি ওকে সম্মোহন করে লিখতে বাধ্য করছেন না তো?

মা’য়ের এমনতর কথা ছেলের ‘ইগোতে আঘাত করল। ছেলে খুবই ক্ষুব্ধ হলেন। কিছু তপ্তকথা বলে ক্ষিপ্ত ছেলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। মঞ্জুদেবীর মস্তিষ্ক কোষে আত্মা ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরোপুরি গেঁথে দেওয়ার জন্য ছেলেকে ঠাণ্ডা করে আবার এনে তথাকথিত প্ল্যানচেটের আসরে বসালাম। আমাদের অনুরোধে ছেলে কলমও ধরলেন। এবার মঞ্জুদেবী আত্মার উপস্থিতির যথার্থতা সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হতে এমন অনেক প্রশ্ন করলেন, যে সব প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কলমের উত্তরে সন্তুষ্ট হলেন মা। বিশ্বাস করলেন এ-সব সত্যিই আত্মারই লেখা। স্বরূপানন্দের আত্মাই কথা দিচ্ছেন, মঞ্জুদেবীর পরিবারকে আর বিরক্ত করবেন না।

মৃতের আত্মার কোনও অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও অবচেতন মনের যে বিশ্বাস সচেতন মনকে চালিত করে অলীক কিছু লিখিয়েছে, অলীক কিছু শুনিয়েছে, অলীক কিছুর স্পর্শ অনুভব করিয়েছে, আমি আমার কথাবার্তা এবং ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সেই অবচেতন মনে এই বিশ্বাস গড়ে তুলতে বা ধারণা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আত্মা আজই তাঁদের ছেড়ে যাবে। ফলে ওঁর মস্তিষ্ক কোষে সঞ্চারিত আমার দৃঢ় ধারণাই তাঁদের দিয়ে লিখিয়েছে—’আমি ছেড়ে যাচ্ছি। আর বিরক্ত করব না’…..এইসব কথাগুলো।

এই লেখাগুলো ছিল অবচেতন মনের প্রভাব।

অনেক প্ল্যানচেটের আসরেই মেঝেতে বৃত্ত আঁকা হয়। বৃত্তের ভিতরে লেখা হয় 1 2 3 4 5 6 7 8 90। বৃত্তের বাইরে লেখা হয় A থেকে Z পর্যন্ত। বৃত্তের মাঝখানে বসানো হয় একটা ধূপদানি। ধূপদানিতে গুঁজে দেওয়া হয় সাধারণভাবে তিনটি জ্বলন্ত ধূপকাঠি। এক, দুই বা তিনজন মিডিয়াম ধূপদানিটি স্পর্শ করে আত্মার কথা ভাবতে থাকে। এক সময় ধূপদানি চলতে থাকে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে ধূপদানি যে যে অক্ষর ও সংখ্যার দিকে চালিত হয়, সেগুলোকে পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় উত্তর। ধূপদানি যে অবচেতন মনই চালনা করে—এ’কথা আর নতুন করে বলার ও বোঝাবার কোন প্রয়োজন নেই।

রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট-চর্চা

আমাকে মাঝে-মধ্যে বহু পরিচিতজনের কাছেই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে—রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় উল্লেখ পাই, তিনি প্ল্যানচেটের সাহায্যে তাঁর প্রিয়জনের বিদেহী আত্মাদের নিয়ে এসেছিলেন, বিদেহী আত্মারা লিখিত উত্তরও রেখে গেছেন, এরপরও কি বলবেন, রবীন্দ্রনাথের সব কথা মিথ্যে?

যদিও রবীন্দ্রনাথ বাঙালি তথা ভারতীয়দের কাছে অতি স্পর্শকাতর বিষয়, তবু এই সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রায় ক্ষেত্রেই বাঙালিরা রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতটা গর্ব করেন ততটা রবীন্দ্রনাথকে জানার, তাঁর রচনা পড়ার চেষ্টা করেন না। রবীন্দ্রনাথ তাঁদের কাছে অনেকটাই গান, গীতিনাট্য ও বইয়ের তাকের শোভা বর্ধনে আবদ্ধ। যাঁরা রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা বিষয়ে এই ধরনের প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা নিজেরা যদি রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করার বিষয়ে কিছুটা পড়াশুনো করে নিতেন বা জেনে নিতেন তবে ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন আদৌ করতেন না।

রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চার পেছনে ছিল অজানাকে জানার কৌতূহল। কিন্তু তিনি এই বিষয়ে অন্ধ-বিশ্বাসী ছিলেন না। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা: রবীন্দ্রজীবনী গ্রন্থ থেকে জানতে পারি—”রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং প্ল্যানচেট লইয়া বহুবার পরীক্ষা করিয়াছেন। কখনও কৌতুকছলে, কখনও কৌতূহলবশে।”

১৯২৯ সালের (রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৬৮ অতিক্রান্ত) পুজোর ছুটির শেষভাগে শান্তিনিকেতনে এলেন মোহিতচন্দ্র সেনের মেয়ে উমা সেন বা বুলা। পরের উমাদেবী শিশিরকুমার গুপ্তের সঙ্গে বিবাহসূত্রে গুপ্তা হন। উমাদেবী বা বুলা ছিলেন শিক্ষিতা ও সাহিত্যরসে আপ্লুতা। উমা গুপ্তার লেখা দুটি কবিতার বইও আছে, ‘ঘুমের আগে’ ও’বাতায়ন’।

রবীন্দ্রনাথ জানতে পারলেন ‘বুলা’র মধ্যে রয়েছে মিডিয়াম হওয়ার অতীন্দ্রিয় শক্তি। রবীন্দ্রনাথের অশেষ আগ্রহে বসল প্ল্যানচেট-চক্র, নভেম্বর ৪, ৫, ৬, ৮, ২৮ ও ২৯ এবং ১৬ ডিসেম্বর। প্ল্যানচেট-চক্রে মিডিয়াম বুলা ও রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে অন্যান্যদের সঙ্গে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ, অলোকেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, ডঃ অমিয় চক্রবর্তী এবং প্রশান্ত মহলানবিশ।

শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ উমাদেবী বা বুলাকে পেয়ে পরলোকের তথ্যানুসন্ধানে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছিলেন। ৬, ২৮, ২৯ নভেম্বর এবং ১৬ ডিসেম্বর প্ল্যানচেটের পুরো বিবরণ লিপিবদ্ধ করা রয়েছে, ৪, ৫ ও ৮ নভেম্বরের প্ল্যানচেটের কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের লেখা বিভিন্ন চিঠি-পত্র থেকে।

প্ল্যানচেট-চক্রগুলোতে উমাদেবীর ওপর বিদেহী আত্মার ভর হতেই উমাদেবী লিখতে শুরু করতেন। প্রায় সব সময়ই প্রশ্নকর্তা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

উমাদেবীর কাছ থেকে বিদেহী আত্মাদের লিখিত উত্তর (?) পেয়েও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বিদেহী আত্মার আবির্ভাব বিষয়ে নিঃসংশয় ছিলেন না। উমাদেবীকে মিডিয়াম করার পর ৬ নভেম্বর, ১৯২৯ রানী মহলানবিশকে একটি চিঠি লেখেন। যাতে লিখেছিলেন, “উত্তরগুলো শুনে মনে হয় যেন সে-ই (মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদেহী আত্মা) কথা কইছে। কিন্তু এসব বিষয়ে খুব পাকা প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার প্রধান কারণ মন তো সম্পূর্ণ নির্বিকার। তার যা ধারণা হয়, সে ধারণার হেতু সব সময় বাইরে থাকে না, তার নিজের প্রকৃতির মধ্যেই থাকে।

প্ল্যানচেট প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ী দেবীকে যা বলেছিলেন, তারই কিছু পাই ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ বইতে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “এই তো (বুলা) কী রকম করে সব লিখত বল তো? আশ্চর্য নয় তার ব্যাপারটা?….ও (বুলা) কেন মিছে কথা বলবে? কী লাভ ওর এ ছলনা করে?

মনোবিজ্ঞান কিন্তু বলে—অপরের চোখে নিজেকে বিশিষ্ট করে তোলার তাগিদেও মানুষ ছলনার আশ্রয় নেয়, মিথ্যাচারী হয়, বড়দের, বিখ্যাতদের মিথ্যাচার কি আমরা কোনও দিন দেখিনি? উমাদেবীর ক্ষেত্রে এমনটা হতে পারে, না-ও হতে পারে। উমাদেবী যদি ছলনার আশ্রয় না নিয়ে থাকেন, তবে মিডিয়াম হিসেবে তাঁর হাত দিয়ে লেখাগুলো কী করে এলো? এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকের মনে জাগতে পারে। এই বিষয়ে উত্তরও খুব স্বচ্ছ এবং সরল, সম্মোহন ও স্ব-সম্মোহন নিয়ে যে আলোচনা আগে করেছি সেটুকু থেকেই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, উমাদেবীর ক্ষেত্রে বিদেহী আত্মার প্রতি অন্ধ-বিশ্বাস ও তীব্র অনুভূতিপ্রবণতা তাঁকে আংশিকভাবে সম্মোহিত করেছিল। বিদেহী আত্মা তাঁর ওপর ভর করেছে এই বিশ্বাসের দ্বারা নিজেকেই নিজে সম্মোহিত করে উত্তর লিখে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “খুব শক্ত সবল জোরাল মানুষ বোধহয় ভাল মিডিমায় হয় না।” (মংপুতে রবীন্দ্রনাথ : মৈত্রেয়ী দেবী)

একজন ভালো মিডিয়াম হওয়া প্রসঙ্গে স্বামী অভেদানন্দ লিখছেন, “কোন লোক যদি তার নিজের কর্তৃত্ব মনের ওপর রেখে দেয় তবে ভালো একজন মিডিয়াম হওয়া তার পক্ষে সম্পূর্ণ অসম্ভব।” (মরণের পারে, পৃষ্ঠা-১৪২)

স্বামী অভেদানন্দ এই প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, “মনে রাখা উচিত যে, মিডিয়াম হবার ভাবটি হলো একজন মানুষের দেহ ও মনের স্থির তন্দ্রাবিষ্ট অবস্থা।” (মরণের পারে, পৃষ্ঠা-১৩৬)

মিডিয়াম অবস্থা উমাদেবী এমন কোনও উত্তর লিখে রাখতে সক্ষম হননি যার দ্বারা অভ্রান্তভাবে বিদেহী আত্মার আগমন প্রমাণিত হয়। বরং দেখতে পাই বিভিন্ন আত্মা উমাদেবীকে দিয়ে লেখালেও সব আত্মারই হাতের লেখা ছিল একই রকম।

একবার সন্তোষচন্দ্র মজুমদারের বিদেহী আত্মা এলেন উমাদেবীর পেনসিলে। রবীন্দ্রনাথের প্রিয় বন্ধু শ্রীশচীন্দ্র মজুমদারের ছেলে সন্তোষচন্দ্র। আমেরিকায় গিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা পড়তে। ফিরে এসে শান্তিনিকেতনের কাজে নিজেকে নিয়োগ করেন। মৃত্যুর সময় ছিলেন শ্রীনিকেতনের সচিব। মারা যান ১৯২৬ সালে।

সন্তোষচন্দ্রের বিদেহী আত্মাকে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করেছিলেন : রবীন্দ্রনাথ—তুমি ওখানে কোন্ কাজে প্রবৃত্ত আছ?

সন্তোষচন্দ্র—আমি একটা বাগান তদারকি করি। কিন্তু সে পৃথিবীর ফুলবাগান নয়।

রবীন্দ্রনাথ—এখানে যেমন গাছপালা থাকে, সে কি সেইরকম?

সন্তোষচন্দ্র-একটি গাছের আত্মার একটি বিশেষ ফুল ক্রমেই শুকিয়ে উঠছে। ঠিক বুঝতে পারছিনে।

২৮ নভেম্বর প্ল্যানচেটে এলেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মা। মণিলাল অবনীন্দ্রনাথের জামাতা। সাহিত্যে, অভিনয়ে, সঙ্গীতে যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিলেন। ১৯২৯ সালেই মারা যান।

মণিলালের বিদেহী আত্মাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন :

—আমি একটা কথা বুঝতে পারিনি সন্তোষের। সেখানে বাগান আবার কী? বুঝতে পারছি না।

মণিলাল উত্তর দিয়েছিলেন—গাছের কি আত্মা নেই? আছে।

রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে-চক্রে গাছ-পালা শাক-সবজি, ঘাস, খড়, সবেরই বিদেহী আত্মার অস্তিত্বের খবর আমরা পাই, যে আশ্চর্য খবরটা স্বামী অভেদানন্দের আত্মারা একবারের জন্যেও উচ্চারণ করেনি।

বিদেহী আত্মা রবীন্দ্রনাথকে তাদের দেহের আকারের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছে—”কারও বা ঝড়ের হাওয়ার মতো কারও বা ফুরফুরে হাওয়া।”

আত্মা বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দের কুয়াশার মতো বর্ণনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘হাওয়ার মতো’ বর্ণনা মেলে না। বিদেহী আত্মার অস্তিত্ব থাকলে দু’জনের বক্তব্যে মিলটুকু নিশ্চয়ই প্রথম সত্ত্ব হতো।

এর পরও আর একটা বিখ্যাত প্ল্যানচেটের কথা বারবারই উঠে আসে। সেখানে একেবারে অন্যরকম প্ল্যানচেট। একেবারে অন্যরকম ব্যাপার-স্যাপার। সে বিষয়টা নিয়ে আসুন এবার বিশ্লেষণে ঢুকি আমরা।

স্বামী অভেদানন্দের সামনে আত্মা লিখল শ্লেটে

ঘটনাস্থল নিউ ইয়র্ক। কাল–১৮৯৯ সালের ৫ আগস্ট। সকাল ১০টা। প্ল্যানচেটের আসর। মিডিয়াম মিস্টার কিলার। মুখোমুখি দু’টি চেয়ার অভেদানন্দ ও কিলার। মাঝখানে একটা ছোট টেবিল। কিলার দুটি শ্লেট বার করলেন। অভেদানন্দ নিজের হাতে শ্লেট দুটির দু-পিঠই মুছে দিলেন। কিলার এবার একটা শ্লেটের ওপর আর একটা শ্লেট রেখে তার ওপর রাখলেন একটা চক। অভেদানন্দকে অনুরোধ করলেন, যাঁর আত্মাকে আনতে চান,তাঁর নাম এক টুকরো কাগজে লিখে শ্লেটের ওপর রাখতে। অভেদানন্দ লিখলেন, স্বামী যোগানন্দজির নাম। এবার কিলার একটা রুমাল দিয়ে আলগা করে জড়ালেন শ্লেট দুটি। রুমালের আড়ালে ঢাকা পড়ল চক্ ও কাগজের টুকরোটা। কিলার ও অভেদানন্দ দু-হাত দিয়ে প্লেট ছুঁয়ে রেখে টেবিল থেকে কিছুটা উঁচুতে তুলে রাখলেন শ্লেট জোড়াকে। কিলার বললেন, আপনি যাঁকে চান তাঁকে হয়ত আনতে পারব না। তবু চেষ্টা করছি। এক সময় শ্লেটে চক্ দিয়ে লেখার খস খস শব্দ শোনা গেল। কিলার বললেন, চকের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন? অভেদানন্দ বললেন, হ্যাঁ। তারপরই একসময় রুমাল সরিয়ে শ্লেট খুলতেই দেখা গেল শ্লেট লেখায় ভর্তি, সঙ্গে যোগানন্দজির নাম, অভেদানন্দ বিস্ময়ে বাক্যহারা। পরে জেনেছিলেন শ্লেটে গ্রিক ভাষাও লেখা হয়েছে। গ্রিক লেখা এলো কি করে? যোগেন তো গ্রিক জানতেন না? বিস্মিত অভেদানন্দের প্রশ্নের উত্তরে কিলার জানালেন অন্য কোনও আত্মা লিখে গেছে। কিলারের কথায় অবিশ্বাস করার মতো কিছুই পাননি অভেদানন্দ।

অনেক আলোচনাচক্রে ‘শ্রোতা-দর্শকরা এই ঘটনাটির উল্লেখ করে ব্যাখ্যা চেয়েছেন। মুখের কথায় বোঝানোর চেয়ে হাতে-কলমে দেখালে যে শ্রোতা-দর্শকের মাথায় বিষয়টা বেশি ভালোমতো প্রবিষ্ট হবে, এই কথাটা চিন্তা করে স্বামী অভেদানন্দের পদ্ধতিতেই দর্শকদের নির্বাচিত তথাকথিত আত্মাকে এনে শূন্য শ্লেট লেখায় ভরিয়েছি, নাম লিখিয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্লেট ধরার সঙ্গী হয়েছেন দর্শকদেরই একজন। হ্যাঁ, শ্লেটে লেখার খস্ খস্ আওয়াজ শুনেছেন। শূন্য শ্লেটে দাবিমতো আত্মার স্বাক্ষর দেখে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শ্রোতা-দর্শকরা অভেদানন্দর মতোই বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়েছেন। তবে পার্থক্যটুকু এই, অভেদানন্দ বিস্মিত হয়েছিলেন আত্মাকে লিখতে দেখে, আর দর্শকরা বিস্মিত হয়েছেন, এমন অসাধারণ ঘটনাও সামান্য লৌকিক কৌশলের সাহায্যেই করা সম্ভব জেনে।

এমন একটা অসাধারণ প্ল্যানচেট করার জন্য প্রয়োজন একটি শ্লেট। টিনের শ্লেট হলেই ভাল হয়। ফ্রেমে আটকানো কালো টিনটার মাপের দু-পিঠ কালো একটা টিনের শিট। টিন-শিটের একটা কোনা ছবির মতো করে কেটে রাখুন। এক টুকরো চক্। একটা রুমাল বা খাম। যিনি আত্মা আনবেন, তাঁর হাতের একটা আঙুলের নখ রাখতে হবে একটু বড়। নখটা সামান্য ফাড়া থাকলে আরও ভাল হয়।

শ্লেটে আগে থেকেই একজন সম্ভাব্য আত্মার নাম চক দিয়ে লিখে রাখতে হবে। আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিবেশ অনুসারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, ইন্দিরা গান্ধী, কার্ল মার্কস, লেনিন বা অন্য কারও নাম স্বাক্ষর করে রাখি। এ-বার লেখার ওপর চাপিয়ে রাখি কালো টিনের শিট। লেখাটা শিটের তলায় চাপা পড়ে যায়। দর্শকরা দেখেন শ্লেটের পরিষ্কার দুটি দিক। এরপর শ্লেটটা চাপিয়ে রাখি অন্য একটা শ্লেটের ওপর। এমনভাবে চাপাই, আলগা টিনের শিটটা তলার শ্লেটের ওপরে গিয়ে পড়ে। এ-বার ওপরের শ্লেটটা তুললেই দর্শকরা দেখতে পান, আত্মার লেখা। খস্ খস্ আওয়াজটা করি ফাড়া নখ শ্লেটে ঘষে।

যা লিখেছি সে নাম যদি দর্শকরা না চান? শত শত অনুষ্ঠানে শ্লেট-লিখন দেখিয়েছি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখেছি আমার লেখা নামটি দর্শকদের মধ্যে কেউ না কেউ চেয়েছেন। প্রয়োজনে লটারি করে নাম নির্বাচন করেছি। কাগজের টুকরোয় দর্শকরাই নাম লিখেছেন, পাত্রে নাম লেখা কাগজ ফেলে নিজেরাই লটারি করে নাম তুলেছেন। এটুকু দর্শকরা বুঝতে পারেননি হাতের কৌশলে তাঁদের কাগজগুলো পালটে গিয়ে আমরাই লেখা কতকগুলো কাগজের টুকরো সেখানে এসে গেছে। ফলে, আমার নির্বাচিত নামই তুলতে বাধ্য হয়েছেন দর্শক।

স্বামী অভেদানন্দ যে যোগানন্দেরই নাম লিখবেন সেটা কিলার জানলেন কি করে? এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকের মধ্যে উঁকি-ঝুঁকি দিচ্ছে। উত্তরে জানাই— অভেদানন্দ ও কিলার এই প্ল্যানচেটে বসার আগের দিন অর্থাৎ ৪ আগস্ট আর এক প্ল্যানচেটের আসরেও অভেদানন্দ তাঁর গুরুভাই যোগানন্দর আত্মাকে আনতে অনুরোধ করেছিলেন। যোগানন্দের নাম শ্লেটে লিখে রেখেও কিলার ঝুঁকি নিতে চাননি বলেই অভেদানন্দকে বলেছিলেন—আপনি যাকে চান তাঁকে হয়ত আনতে পারব না।

শ্লেটে আত্মার স্বাক্ষরের গোপন কৌশল
শ্লেটে আত্মার স্বাক্ষরের গোপন কৌশল

ভূতের ভরে পটকা মেয়েও পেয়ে যায় হাজার হাতির বল

‘ভূতে ভর’ মানেই শাশ্বত আত্মার প্রমাণ। এমনও কিছু লোক আমি দেখেছি, যাঁরা জ্যোতিষশাস্ত্র বিশ্বাস করেন না, সাধু-সন্তদের অলৌকিক ক্ষমতায় আস্থাশীল নন, কিন্তু ভূতের অস্তিত্বে পরম-বিশ্বাসী। কারণ এঁরা নিজেদের চোখে ভূতে পাওয়া মানুষের অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা দেখেছেন।

এমনই একজন গোবিন্দ ঘোষ। কিছুদিন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। এখন স্টেট ব্যাঙ্কের অফিসার। তিনি সব কিছুকেই যুক্তি দিয়ে বিচার করে তারপর গ্রহণ করতে বা বর্জন করতে ভালবাসেন। আর সেই কারণেই ভূতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেন না। তারই সুবাদে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী। তবু মনের কোণে কোথাও বোধহয় খটকা একটা ছিল। তাই আমাকে বলেছিলেন নিজের চোখে দেখা কাকিমাকে ভূতে পাওয়ার ঘটনা। আমার কাছে ব্যাখ্যার প্রত্যাশাতেই তিনি ঘটনাটা বলেছিলেন।

সালটা সম্ভবত ‘৫৬। স্থান—হাসনাবাদের হিঙ্গলগঞ্জ। গোবিন্দবাবু তখন সদ্য কিশোর। একান্নবর্তী পরিবার। গোবিন্দবাবুর কাকার বিয়ে হয়েছে বছর দেড়েক। কাকিমা সদ্য তরুণী এবং সুন্দরী। অনেকখানি জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক ঘর, ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, আঁতুরঘর নিয়ে বাড়ির চৌহদ্দি। বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে পুকুরপাড়ে পায়খানা। পায়খানার পাশেই একটা বিশাল পেয়ারাগাছ। গাছটায় ভূত থাকত বলে বাড়ির অনেকেই বিশ্বাস করতেন। তাই সন্ধের পর সাধারণত কেউই, বিশেষ করে ছোটরা ও মেয়েরা প্রয়োজনেও পায়খানায় যেতে চাইত না। এক সন্ধের ঘটনা, কাকিমা পায়খানা থেকে ফেরার পর অস্বাভাবিক ব্যবহার করতে লাগলেন। ছোটদের দেখে ঘোমটা টানতে লাগলেন, কথা বলছিলেন নাকি গলায়। বাড়ির বড়রা সন্দেহ করলেন কাকিমাকে ভূতে পেয়েছে। অনেকেই কাকিমাকে জেরা করতে লাগলেন, ‘তুই কে? কেন ধরছিস বল?’ ইত্যাদি বলে। একসময় কাকিমা বিকৃত মোটা নাকি গলায় বললেন, ‘আমি নীলকান্তের ভূত। পেয়ারা গাছে থাকতাম। অনেকদিন থেকেই তোদের বাড়িতে ছোট বউয়ের উপর আমার নজর ছিল। আজ সন্ধেরাতে খোলা চুলে পেয়ারাতলা দিয়ে যাওয়ার সময় ধরেছি। ওকে কিছুতে ছাড়ব না।”

পরদিন সকালে এক ওঝাকে খবর দেওয়া হল। ওঝা আসবে শুনে কাকিমা প্রচণ্ড রেগে সক্কলকে গাল-মন্দ করতে লাগলেন, জিনিস-পত্র ভাঙতে লাগলেন। শেষে বড়রা কাকিমাকে থামের সঙ্গে বেঁধে রাখলেন।

ওঝা এসে মন্ত্রপড়া সরষে কাকিমার গায়ে ছুড়ে মারতে লাগলেন, সেই সঙ্গে বেতের প্রহার। কাকিমার তখন সম্পূর্ণ অন্যরূপ। মুখে অশ্রাব্য গালাগাল। প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে ক্লান্ত নীলকান্তের ভূত কাকিমাকে ছেড়ে যেতে রাজি হল। ওঝা ভূতকে আদেশ করল, ছেড়ে যাওয়ার প্রমাণ হিসেবে একটা পেয়ারাডাল ভাঙতে হবে, আর একটা জলভরা কলসি দাঁতে করে পাঁচ হাত নিয়ে যেতে হবে।

সবাইকে তাজ্জব করে দিয়ে বিশাল একটা লাফ দিয়ে কাকিমা একটা পেয়ারা ডাল ভেঙে ফেললেন। একটা জলভরা কলসি দাঁতে করে পাঁচ হাত নিয়ে গেলেন। তারপর পড়ে গিয়ে অজ্ঞান। যখন জ্ঞান এল তখন কাকিমা আবার অন্য মানুষ। চিঁ চিঁ করে কথা বলছেন, দাঁড়াবার সাধ্য নেই।

এরপর অবশ্য কাকিমার শরীর ভেঙে পড়েছিল। বেশিদিন বাঁচেননি।

এই ধরনের ভূতে পাওয়ার কিছু ঘটনা আমি নিজেই দেখেছি। আপনাদের মধ্যেও অনেকেই নিশ্চয়ই এই ধরনের এবং আরও নানা ধরনের ভূতে পাওয়ার ঘটনা নিজের চোখে দেখেছেন বা শুনেছেন। এ সব ঘটনাগুলোর পিছনে সত্যিই কি ভূত রয়েছে? না, অন্য কিছু? বিজ্ঞান কি বলে? এই আলোচনায় আসছি।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে ভূতে পাওয়া কী?

আপনারা যাঁদের দেখে মনে করেন, এঁদের বুঝি বা ভূতে পেয়েছে, আসলে সেইসব তথাকথিত ভূতে পাওয়া মানুষগুলো প্রত্যেকেই রোগী, মানসিক রোগী। এইসব মানসিক রোগীরা এমন অনেক কিছু অসম্ভব ঘটনা ঘটিয়ে দেখান, যে সব ঘটনা সাধারণভাবে স্বাভাবিক একজন মানুষের পক্ষে ঘটানো অসম্ভব।

যেহেতু সাধারণভাবে আমরা বিভিন্ন মানসিক রোগ এবং মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুকোষের স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না, তাই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের বিশৃঙ্খলার জন্য ঘটা অদ্ভুত সব ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা নিজেদের কাছে হাজির করতে পারি না। কিছু কিছু মানসিক রোগীর ব্যাপার-স্যাপার তাই আমাদের চোখে যুক্তিহীন ঠেকে। আমরা ভেবে বসি—আমি যেহেতু এর ব্যাখ্যা পাচ্ছি না, তাই বুদ্ধি দিয়ে বুঝি এর ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিটি ভূতে পাওয়া ঘটনারই ব্যাখ্যা আছে। বুদ্ধিতেই এর ব্যাখ্যা মেলে। বাস্তবিক পক্ষে ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য যা প্রয়োজন তা হল, আগ্রহ, ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়ার আগ্রহ।

চিকিৎসা বিজ্ঞান ‘ভূতে ভর’ বা ‘জীনে পাওয়া’ বলে পরিচিত মনের রোগকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছে।

এক : হিস্টিরিয়া (Hysteria), দুই : স্কিটসোফ্রেনিয়া (Schitzophrenia), তিন : ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ (Maniac-depressive)।

হিস্টিরিয়া থেকে যখন ভূতে পায়

প্রাচীন কাল থেকেই হিস্টিরিয়া নামের মানসিক রোগটির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু তখনকার দিনের ওঝা, গুণিন, বা জাদুচিকিৎসকরা সঠিক শারীর বিজ্ঞানের ধারণার অভাবে এই রোগকে কখনও ভূতে পাওয়া কখনও বা ঈশ্বরের ভর বলে মনে করেছে। আধুনিক মনোবিজ্ঞানের চোখে হিস্টিরিয়া বিষয়টাকে একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক। সাধারণভাবে সংস্কারে আচ্ছন্ন, অশিক্ষিত, অল্প-শিক্ষিত বা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের আলো থেকে বঞ্চিত সমাজের মানুষদের মধ্যেই হিস্টিরিয়া রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সাধারণভাবে এইসব মানুষের মস্তিষ্ককোষের স্থিতিস্থাপকতা ও সহনশীলতা কম। যুক্তি দিয়ে গ্রহণ করার চেয়ে বহুজনের বিশ্বাসকে অন্ধভাবে মেনে নিতে অভ্যস্ত। মস্তিষ্ক কোষের সহনশীলতা যাদের কম তারা একনাগাড়ে একই কথা শুনলে, ভাবলে বা বললে মস্তিষ্কের বিশেষ কিছু কোষ বার বার উত্তেজিত হতে থাকে, আলোড়িত হতে থাকে। এর ফলে অনেক সময় উত্তেজিত কোষগুলো অকেজো হয়ে পড়ে, অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে, ফলে মস্তিষ্কের কার্যকলাপে বিশৃঙ্খলা ঘটে। গোবিন্দবাবুর কাকিমার ক্ষেত্রেও এই ব্যাপার ঘটেছিল।

কাকিমা পরিবেশগতভাবে মনের মধ্যে এই বিশ্বাস লালন করতেন ভূতের বাস্তব অস্তিত্ব আছে। মানুষ মরে ভূত হয়। ভূতেরা সাধারণত গাছে থাকে। সুন্দরী যুবতীদের প্রতি পুরুষ-ভূতেরা খুবই আকর্ষিত হয়। সন্ধের সময় খোলা চুলের কোনও সুন্দরীকে নাগালের মধ্যে পেলে ভূতেরা সাধারণত তাদের শরীরে ঢুকে পড়ে। ভূতেরা নাকি গলায় কথা বলে। পুরুষ ভূত ধরলে গলার স্বর হয় কর্কশ। মন্ত্র- তন্ত্রে ভূত ছাড়ানো যায়। যারা এ সব মন্ত্রতন্ত্র জানে তাদের বলে ওঝা। ভূতের সঙ্গে ওঝার সম্পর্কে সাপে-নেউলে। ওঝা এসে ভূতে পাওয়া মানুষটিকে খুব মার- ধর করে তাই ওঝা দেখলেই ভূত পাওয়া মানুষ প্রচণ্ড গালাগাল করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই জাতীয় অনেক কথাই কাকিমা তাঁর কাছের মানুষদের কাছ থেকে শুনেছেন এবং বিশ্বাসও করেছেন। শ্বশুরবাড়িতে এসে শুনেছেন পেয়ারাগাছে ভূত আছে। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় ভুল করে অথবা তাড়াতাড়ি পায়খানা যাওয়ার তাগিদে কাকিমা চুল না বেঁধেই পেয়ারাগাছের তলায় দিয়ে গেছেন। যাওয়ার সময় তাঁর একমাত্র চিন্তা ছিল তাড়াতাড়ি যেতে হবে। তারপর হয় তো পেট কিছুটা হালকা হতেই চিন্তা এসেছে—আমি তো চুল না বেঁধেই পেয়ারাতলা দিয়ে এসেছি। গাছে তো ভূত আছে। আমি তো সুন্দরী, আমার উপর ভূতটা ভর করেনি তো? তারপরই চিন্তা এসেছে— নিশ্চয়ই ভূতটা এমন সুযোগ হাতছাড়া করেনি। আমাকে ধরেছে। ভূতের পরিচয় কী? ভূতটা কে? কাকিমা নিশ্চয়ই নীলকান্ত নামের একজনের অপঘাতে মৃত্যুর কথা শুনেছিলেন, ধরে নিলেন নীলকান্তের ভূত তাঁকে ধরেছে। তারপর ভূতে পাওয়া মেয়েরা যে ধরনের ব্যবহার করে বলে শুনেছিলেন, সেই ধরনের ব্যবহারই তিনি করতে শুরু করলেন।

গোবিন্দবাবু আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কাকিমা অতি ভদ্র পরিবারের মেয়ে। ভূতে পাওয়া অবস্থায় তিনি ওঝাকে যে সব গালাগাল দিয়েছিলেন সে-সব শেখার কোনও সম্ভাবনাই তাঁর ছিল না। তবে সে সব গালাগাল তিনি দিয়েছিলেন কি ভাবে?’

আমার উত্তর ছিল—শেখার সম্ভাবনা না থাকলেও শোনার সম্ভাবনা কাকিমার ক্ষেত্রে আর দশজনের মতই অবশ্যই ছিল। ভদ্র মানুষেরা নোংরা গালাগাল করেন না। এটা যেমন ঠিক, তেমনই সত্যি, ভদ্র মানুষও তাঁদের জীবনের চলার পথে কারুকে না কারুকে নোংরা গালাগাল দিতে শুনেছেন।

ভরা কলসি দাঁতে করে তোলা বা লজ্জা ভুলে প্রচণ্ড লাফ দেওয়ার মত শক্তি প্রয়োগ হিস্টিরিয়া রোগীর পক্ষে স্বাভাবিক ঘটনা। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত অবস্থায় রোগী নিজেকে অর্থাৎ নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণ ভুলে যায়। গভীরভাবে বিশ্বাস করে ফেলে— তাঁকে ভূতে বা জীনে ভর করেছে। তার মধ্যে রয়েছে ভূত বা জীনের অসাধারণ শারীরিক শক্তি ও ক্ষমতা। ফলে সামান্য সময়ের জন্য শরীরের চূড়ান্ত শক্তি বা সহ্য শক্তিকে ব্যবহার করে, স্বাভাবিক অবস্থায় যা অসাধ্য।

হিস্টিরিয়া রোগ সম্বন্ধে ভালমত জানা না থাকায় হিস্টিরিয়া রোগীদের নানা আচরণ ও কাজকর্ম সাধারণ মানুষদের চোখে অদ্ভুত ঠেকে। তাঁরা এগুলোকে ভুতুড়ে কাণ্ড-কারখানা বলে ধরে নেন।

প্রথম বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় এমন কিছু সৈনিক চিকিৎসিত হতে আসে যারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে অথবা ডান হাত পক্ষাঘাতে অবশ কিংবা অতীত স্মৃতি হারিয়েছে। এদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে চিকিৎসকরা একমত হন এরা কোনও শারীরিক আঘাত বা অন্য কোনও শারীরিক কারণে এইসব রোগের শিকার হয়নি। রোগের কারণ সম্পূর্ণ মানসিক। এরা হিস্টিরিয়ায় ভুগছে। অনবরত রক্তপাত, হত্যা, গোলা- গুলির শব্দ রোগীদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। কিছুতেই তারা এত রক্তপাত, এত হত্যা, এত শব্দ সহ্য করতে পারছিল না। মন চাইছিল যুদ্ধ ছেড়ে পালাতে। বাস্তবে যা আদৌ সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ ছেড়ে পালানো মানেই দেশদ্রোহিতা, ধরা পড়লেই কঠোর শাস্তি। পালাবার ইচ্ছা ও পালাতে ভয়—দুয়ের সংঘাত রূপান্তরিত হয়েছে হিস্টিরিয়ায়।

যে কোনও সমস্যায় দুই বিপরীতধর্মী চিন্তার সংঘাতে শরীরের বিভিন্ন অংশে এই ধরনের অসাড়তা ঘটতে পারে। প্রতি বছরই প্রধানত মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক- জাতীয় পরীক্ষার আগে মনোরোগ চিকিৎসকদের কাছে বেশ কিছু পরীক্ষার্থী চিকিৎসিত হতে আসে যারা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে, দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে বা যাদের ডান হাত অসাড় হয়ে গেছে। পরীক্ষার সময় অনেকে নিজেকে অত্যধিক পড়া ও লেখার চাপের মধ্যে রাখে। চাপ অত্যধিক হলে শরীরে আর সয় না। মন বিশ্রাম নিতে চায় আবার একই সঙ্গে ভাল ফলের জন্য মন বিশ্রামের দরুন সময় নষ্ট করতে চায় না। অর্থাৎ একই সঙ্গে মন বিশ্রাম নিতে চাইছে এবং বিশ্রাম নিতে চাইছে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই হিস্টিরিয়াজনিত সমস্যাগুলো প্রকট হয়। হিস্টিরিয়াজনিত কারণে বাকরোধের সমস্যাতেও কিছু কিছু নবীন আবৃত্তিকারেরা ভোগেন।

যে সব জায়গায় গ্রাম ভেঙে খনি বা শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে, সে সব অঞ্চলের মানুষ কৃষি-নির্ভরতা ছেড়ে খনির কাজে ও শিল্পের কাজে লেগে পড়তে গিয়ে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেক মানসিক দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হচ্ছে। এই মানসিক দ্বন্দ্বের পরিণতিতে ঘটছে তীব্র আলোড়ন। এমন পরিস্থিতিতেই মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা কম থাকার দরুন, যুক্তি-বুদ্ধি কম থাকার দরুন এইসব মানুষদের মধ্যে ব্যক্তি-হিস্টিরিয়ার আধিক্য হওয়ার সম্ভাবনা।

নাম-গান করতে করতে আবেগে চেতনা হারিয়ে অদ্ভুত আচরণ করাও হিস্টিরিয়ারই অভিব্যক্তি। সভ্যতার আলো ব্যক্তি-হিস্টিরিয়ার প্রকোপ কমায়। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সভ্য মানুষগুলোই হিস্টিরিয়াজনিত কারণে দলে দলে অদ্ভুত সব আচরণ করে।

শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বাহাত্তর ঘণ্টায় দিল্লিতে কয়েক হাজার শিখকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হত্যা করা হয়েছিল, হত্যাকারীরা কিছুটা সময়ের জন্য নিশ্চয়ই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।

স্কিটসোফ্রেনিয়া

স্কিটসোফ্রেনিয়া রোগের বিষয়ে বোঝার সুবিধের জন্য একটু বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন। গতিময়তা মস্তিষ্ককোষের একটি বিশেষ ধর্ম। সবার মস্তিষ্ককোষের গতিময়তা অর্থাৎ উত্তেজনা ও নিস্তেজনায় দ্রুত সাবলীলভাবে মানিয়ে নিয়ে কাজ করার ক্ষমতা সমান নয়। যাদের গতিময়তা বেশি তারা যে কোনও বিষয় চট্‌পট্ বুঝতে পারে। বহু বিষয়ে জানার ও বোঝার আগ্রহ ও ক্ষমতা আছে। খুব সাবলীলভাবেই বিভিন্ন ধরনের কাজকর্মে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে পারে এবং সহজেই এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গের চিন্তায় বা আলোচনায় নিজের মস্তিষ্ককোষকে নিয়োজিত করতে পারে।

সাধারণভাবে রাজনীতিবিদ, শিল্পপতি, প্রশাসক শ্রেণীর মানুষদের মস্তিষ্ককোষের গতিময়তা বেশি। এই ধরনের মস্তিষ্ককোষের অধিকারীদের বলা হয় প্রাণচঞ্চল বা স্যাংগুইনাস (Sanguineous) ।

চিন্তাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী শ্রেণীর মানুষরা সাধারণভাবে কোনও বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে ভালবাসেন। সবকিছুকে ভালমতো জানতে চান, বুঝতে চান। এক সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসেন না। এরা আত্মস্থ বা ফ্লেমেটিক (Phlegmatic) ধরনের মস্তিষ্কের অধিকারী।

স্কিটসোফ্রেনিয়া রোগের শিকার হন সাধারণভাবে আত্মস্থ ধরনের মস্তিষ্কের অধিকারীরা। তাঁরা কোনও কিছু গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে সঠিকভাবে চিন্তার মূলে পৌঁছতে না পারলে বা বুঝতে গিয়ে ঠিক মত বুঝতে না পারলে, অথবা কোনও সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেও সমাধানের পথ না পেলে অথবা কোনও রহস্যময়তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অতি আবেগপ্রবণতার দরুন রহস্যময়তার মধ্যে থেকে নিজেকে বের করে আনতে না পারলে তাঁদের মস্তিষ্ককোষের গতিময়তা আরও কমে যায়। তাঁরা আরও বেশি করে নিজেদের চিন্তার মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নেবার চেষ্টা করেন। মস্তিষ্কের চালককেন্দ্র (motor centre) এবং সংবেদনকেন্দ্র cnsorium) ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে থাকে, শ্লথ হতে থাকে, অনড় হতে ধরে। এর ফলে এরা প্রথমে বাইরের কর্মজগৎ থেকে, তারপর নিজের পরিবারের আপনজনদের কাছ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেয়। তারপর এক সময় এরা নিজেদের সত্তা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

পরবর্তীকালে দেখা যায়, রোগীর মস্তিষ্ককোষ ঠিক ভাবে উদ্দীপনা সঞ্চালন করতে পারছে না বা ছড়িয়ে দিতে পারছে না। ফলে একটি কোষের এই বিশৃঙ্খল অবস্থার দরুন রোগীর ব্যবহারে বাস্তববিমুখতা দেখতে পাওয়া যায়। রোগীরা এই অবস্থায় অলীক বিশাসের শিকার হয়। পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে ভিত্তি করে অলীক বিশ্বাসও (Hallucination) পাঁচ রকমের হতে পারে। ১. দর্শনানুভূতির অলীক বিশ্বাস (optical hallucination) 2. শ্রবণানুভূতির অলীক বিশ্বাস (auditory hallucination) ৩. স্পর্শানুভূতির অলীক বিশ্বাস (tactile hallucination) ৪. ঘ্রাণানুভূতির অলীক বিশ্বাস (olfactory hallucination) ৫. স্বাদগ্রহণের বা জিহ্বানুভূতির অলীক বিশ্বাস (taste hallucination)।

‘ঘাড়ে চাপল প্ল্যানচেটের আত্মা’ শিরোনামে যে ঘটনাটির কথা ইতিপূর্বে লিখেছি, সেই ঘটনাটি আর একবারের জন্য আপনাদের মনে করতে বলব। মঞ্জুদেবী ও তাঁর ছেলে স্কিটসোফ্রেনিয়া রোগের শিকার হয়েছিলেন।

ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ
গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা

আমাদের অফিসেরই এক চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীর বাড়ি ওড়িশার এক গ্রামে। একদিন তিনি আমাকে এসে জানালেন, কিছু দিন হলো ওঁর স্ত্রীকে ভূতে পেয়েছে। অনেক ওঝা, তান্ত্রিক, গুণিন দেখিয়েছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই এরা দেখার পর খুব সামান্য সময়ের জন্য ভাল থাকে, অর্থাৎ বাঞ্ছিত ফল হয়নি। সহকর্মীটিকে বললাম, স্ত্রীকে দেশ থেকে নিয়ে আসতে। নিয়েও এলেন।

ওর স্ত্রীকে দেখে মনে হল, স্বামীর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য কুড়ি বছরের কম নয়। বউটির বয়স পঁচিশ। ফর্সা রঙ, দেখতে স্বামীর তুলনায় অনেক ভাল। দেশের বাড়িতে আর থাকে ওর দুই ভাসুর, এক দেওর, তাদের তিন বউ, তাদের ছেলে- মেয়ে ও নিজের দুই মেয়ে এক ননদ ও শাশুড়ী। বিরাট সংসারে প্রধান আয় খেতের চাষ-বাস। স্বামী বছরে দুবার ফসল তোলার সময় যায়। তখন যা স্বামীর সঙ্গ পান। হাত-খরচ হিসেবে স্বামী কিছু দেন না। টাকার প্রয়োজন হলে যৌথ-পরিবারের কর্ত্রী মা অথবা বড় জায়েদের কাছে হাত পাততে হয়।

প্রথম ভূত দেখার ঘটনাটা এই রকম : একদিন সন্ধের সময় ননদের সঙ্গে মাঠ দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ একটা পচা দুর্গন্ধ নাকে এল। অথচ আশে- পাশে দুর্গন্ধ ছড়াবার মতো কিছুই চোখে পড়েনি। সেই রাতে খেতে বসে ভাতে গোরুর মাংসের গন্ধ পান বউটি, খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়তে হল। গা-গুলিয়ে বমি। সেই রাতের এক সময় ঘুম ভেঙে গেল। জানলার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠেন। বীভৎস একটা প্রেতমূর্তি জানলা দিয়ে উঁকি মেরে ওঁকেই দেখছিল। পরের দিন ওঝা আসে। মন্ত্র-টন্ত্র পড়ে। কিন্তু কাজ হয় না। এখন সব সময় একটা পচা দুর্গন্ধ পাচ্ছেন। খেতে বসলেই পাচ্ছেন গোরুর মাংসের গন্ধ। আর মাঝে মাঝে প্রেতমূর্তিটি দর্শন দিয়ে যাচ্ছে।

বউটির মুখ থেকেই জানতে পারি তাঁর মা ও বোনকেও এক সময় ভূতে ধরেছিল। ওঝারাই সারিয়েছে। বউটির অক্ষরজ্ঞান নেই। গোরুর মাংসের গন্ধ কোনও দিনও শুঁকে দেখেননি। প্রতিদিন অন্য তিন বউয়ের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয় ওঁকে। তাদের স্বামীরা দেশেই থাকে, দেখাশুনা করে পরিবারের। অথচ বেচারী বউটিকে কোন সাহায্য করারই কেউ নেই। বরং মাঝে মধ্যে অন্য কোনও বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া হতে কর্তামাও আমার সহকর্মীর বউটির বিরুদ্ধপক্ষে যোগ দেন।

সব মিলিয়ে বউটির কথায় বাংলা করলে এইরকম দাঁড়ায় : অন্য জায়ের স্বামী যে চাষ করে ঘরে ফসল তোলে। আমার বর কী করে? টাকা না ঢাললে সবাই পর হয়। তা আমার উনি একটি টাকাও কস্মিনকালে উপুড়হস্ত করেন না। কিছু বললেই বলেন, দুই মেয়ের বিয়ের জন্য জমাচ্ছি।

বুঝলাম, অবদমিত বিষণ্নতাই মহিলাটির মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, যার ফলে গোরুর মাংসের গন্ধের সঙ্গে পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস করে নিয়েছেন তাঁর নাকে আসা গন্ধটি গোরুরই।

সহকর্মীটিকে তাঁর স্ত্রীর এই অবস্থার কারণগুলো বোঝালাম। জানালাম চিরকালের জন্য স্ত্রীকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখতে চাইলে স্ত্রী-কন্যাদের কাছে এনে রাখতে হবে, তাদের দেখাশুনো করতে হবে, স্ত্রীর সুবিধে-অসুবিধেয় তার পাশে দাঁড়াতে হবে। সহকর্মীটির টাকার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ। মধ্য কলকাতার নিষিদ্ধ এলাকা সোনাগাছিতে ওড়িশা থেকে আসা কিছু লোকেদের নিয়ে সামান্য টাকায় মেস করে থাকেন। চড়া সুদে সহকর্মী ও পরিচিতদের টাকা ধার দেন। দেশের সংসারে সাধারণত টাকা পাঠান না। কারণ হিসেবে আমাকে বলেছিলেন, দেশের চাষের জমিতে আমার ভাগ আছে। চাষ করে যা আসে তাতেই আমার পরিবারের তিনটে প্রাণীর ভাল মতই চলে যাওয়া উচিত। মেয়েমানুষের হাতে কাঁচা টাকা থাকা ভাল নয়, আর দরকারই বা কী? শ্বাশুড়ি, ননদ, জায়েদের সঙ্গে থাকতে গেলে একটু ঠোকাঠুকি হবেই। ও সব কিছু নয়। মেয়েদের ও-সব কথায় কান দিতে নেই।

হয় তো সহকর্মীটি এই মানসিকতার মধ্যেই মানুষ হয়েছে, অথবা অর্থ জমানোর নেশাতেই আমার যুক্তিগুলো ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে। জানে আমার যুক্তিকে মেনে নেওয়ার অর্থই খরচ বাড়ানো।

তবু শেষ পর্যন্ত আমার অনুরোধে বউকে কলকাতার মাস চারেকের জন্য এনে রেখেছিলেন। বউটিকে সম্মোহিত করে তার মস্তিষ্ক কোষে ধারণা সঞ্চারের মাধ্যমে অলীক গন্ধ ও অলীক দর্শনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলাম দু-মাসে, দুটি সিটিং-এ। স্ত্রী ভাল হতেই সহকর্মী তাকে গ্রামে পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বউটি আমাকেও অনুরোধ করেছিলেন, আমি যেন ওঁর স্বামীকে বলে অন্য পাড়ায় বাড়ি নিতে বলি। পাড়াটা বড্ড খারাপ। নষ্ট মেয়েরা খিস্তি-খেউড় করে, ওদের এড়াতে দিন-রাত ঘরেই বন্দী থাকতে হয়।

অনুরোধ করেছিলাম। খরচের কথা বলে সহকর্মীটি এক ফুঁয়ে আমার অনুরোধ উড়িয়ে দিলেন। পরিণতিতে বউটিকে গ্রামে পাঠাবার দেড়মাসের মধ্যেই বউটি আবার অবদমিত বিষণ্ণতার শিকার হয়েছিল। সহকর্মীটিই আমাকে খবর দেন, ‘বউকে আবার ভূতে ধরেছে চিঠি এসেছে। কবে আপনি ওকে দেখতে পারবেন জানালে, বউকে সেই সময় নিয়ে আসবো।’

বলেছিলাম,’আমাকে মাপ করতে হবে ভাই। আমার অত নষ্ট করার মত সময় নেই যে, তুমি দফায় দফায় বউটিকে অসুস্থ করাবে, আর আমি ঠিক করব। তুমি যদি তোমার বউ ও মেয়েদের এখানে এনে স্থায়ীভাবে রাখ, তবেই শুধু ওকে স্থায়ীভাবে সুস্থ করা সম্ভব এবং তা করবও।’

‘সহকর্মীটি আমার কথায় অর্থ-খরচের গন্ধ পেয়েছিলেন, স্ত্রীকে আনেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *