অধ্যায় : দশ – হিন্দু ছাড়া কেউ জন্মান্তর মানে না
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে আত্মা ‘অজ’, অর্থাৎ জন্মহীন; ‘নিত্য’ অর্থাৎ অমর; এবং পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর ক্ষেত্রেই ধর্ম-জাত-ভাষা নির্বিশেষে আত্মার এই ধর্ম চিরন্তন সত্য।
প্রাচীন আর্য-বা হিন্দুরা একটিমাত্র স্বর্গে বিশ্বাসী ছিলেন, এই স্বর্গের নাম ছিল ‘ব্রহ্মলোক’, অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মের রাজ্য। প্রাচীন হিন্দুরা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পর আত্মা ব্রহ্মলোকে যায়।
পরবর্তী কালে হিন্দুধর্মে এল কর্মফল। বলা হল, যারা ইহলোকে ভাল কাজ করবে, তারা তাদের ভাল কর্মফল শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রহ্মলোকে থাকবে, তারপর আবার ফিরে এসে জন্ম নেবে পৃথিবীতে আপন কর্মফল অনুসারে। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, চন্দ্রলোকেই পিতৃপুরুষের আত্মারা থাকে। চাঁদ থেকেই প্রাণের বীজ ঝরে পড়ে পৃথিবীর বুকে। হিন্দুরা গোড়ার দিকে নরক বিশ্বাস করতেন না। পরে, ভয়ের দ্বারা মানুষকে ধর্ম মেনে চলতে, ভাল কাজ করতে, গোষ্ঠীজীবনের পক্ষে প্রয়োজনীয় কিছু নীতি মেনে চলতে বাধ্য করার জন্য সৃষ্টি হল নরকের। প্রাচীন যুগের ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের মানুষদের শোষণ করার ব্যবস্থাকে কায়েম করতে সৃষ্টি করল কর্মফল অনুসারে জন্মগ্রহণ তত্ত্বের। এই তত্ত্বে বলা হল— সামাজিক বৈষম্য অন্যায় কিছু নয়, কারণ বঞ্চিত মানুষটির গতজন্মের কর্মফলেই এ জন্মে এই অবস্থা। বলা হল—সামাজিক বৈষম্য না থাকলে তোমার এ’জন্মের কষ্টকে রমণীয়ভাবে বরণ করে নেওয়ার পুরস্কার আগামী জন্মে পাবে কি করে? পুনর্জন্ম নিয়ে ভারতীয় সাহিত্য ছান্দোগ্যতে বলা হয়েছে, “যাঁরা রমণীয় স্বভাবসম্পন্ন তাঁরা অবশ্যই রমণীয় যোনি, ব্রাহ্মণ যোনি, ক্ষত্রিয় যোনি বা বৈশ্য যোনি প্রাপ্ত হবেন এবং যারা দূরাচারী (অর্থাৎ ধর্মীয় আচার-অনুশাসন মান্য করে না) তারা অবশ্যই সারমেয়, বরাহ অথবা চণ্ডাল যোনি প্রাপ্ত হবে।” [ ছান্দোগ্য; ৫/১০/ ৭]
কৃষক ও দাস সম্প্রদায়ের মাথায় ঢোকানো হল এ’জন্মে প্রতিবাদহীনভাবে বঞ্চনা নামক কর্মফলকে মেনে নিলে আগামী জন্মে মিলবে বৈভব। উচ্চবর্ণের মানুষ এক সময় বুঝতে পেরেছিল কৃষক ও দাস সম্প্রদায়কে পুনর্জন্ম ও কর্মফলের আশার কুহকে ভুলিয়ে রাখতে পারলে ওরা বঞ্চনাকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না।
ইতিপূর্বে বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করেছিল ধর্মের অনুশাসন, বর্ণাশ্রম মানে, বর্ণ অনুসারে তাদের নির্দিষ্ট ছিল কাজ। শূদ্রদের কাজ ছিল উচ্চতর তিনটি বর্ণের সেবা। এই শূদ্রদের মধ্যে পড়ত কৃষক, শ্রমিক ও দাস। কৃষক, শ্রমিকদের পারিশ্রমিক দানের ব্যবস্থা ছিল। দাসদের পারিশ্রমিক বা বেতন দেওয়া হত না। কৃষি শ্রমিক ও শিল্প শ্রমিকদের বেতন এমনই ছিল যাতে তারা অতি মোটা কাপড়ের দ্বারা যৎসামান্য লজ্জা নিবারণের নামে প্রায় উলঙ্গ থাকে এবং আধপেটা খেয়ে শুধু জীবনটা ধরে রাখে। শূদ্রদের এই ধরনের অর্ধউলঙ্গ ও আধপেটা খাইয়ে রাখার স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় আইন-কানুনের বিভিন্ন গ্রন্থে—যাদের সাধারণভাবে বলা হয় ‘স্মৃতিগ্রন্থ’। প্রায় বিনাখরচে শ্রমশক্তি বিনিয়োগের প্রয়োজনেই উচ্চবিত্তেরা সৃষ্টি করেছিল ‘শূদ্র’ নামের বর্ণটি। উচ্চবর্ণের লোকেরা শূদ্রদের ‘মানুষ’ বলে বিবেচিত হওয়ার সব অধিকারই কেড়ে নিয়েছিল। তাদের না ছিল নাগরিক অধিকার, না ধর্মীয় অধিকার, না অর্থনৈতিক অধিকার। এই অধিকারহীনতার ফলে শূদ্ররা প্রভুশ্রেণীর উপদেশ ও নির্দেশ দ্বারাই পরিচালিত হত। ‘স্মৃতি গ্রন্থ’গুলোর উপদেশ প্রভুরা শোনাত শূদ্রদের—তারা ঈশ্বরের বিধান মত বর্ণ মেনে প্রভুর সেবা করলে, প্রভুর সম্পদে লোভ না করলে মৃত্যুর পর যে জন্ম হবে, সেই জন্মে সুখ ভোগ করবে। তারা এ’জন্মে যে কষ্টভোগ করছে, তা পূর্বজন্মের কর্মফল মাত্র।
ভারতবর্ষে দাস প্রথা ছিল, কিন্তু কর্মফল ও জন্মান্তরবাদের মগজ ধোলাইয়ের কল্যাণে এই বিরাট দেশের কোথাও দাস বিদ্রোহ হয়নি, যেমনটা হয়েছে অন্যান্য বহু দেশে। এর ঐতিহাসিক কারণটি হল—পৃথিবীর আর কোনও ধর্ম বিশ্বাসেই জন্মান্তর ও কর্মফল অনুসারে অতীত জন্মের কর্মফল লাভের কথা প্রচলিত নেই।
খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন—বিশ্বের যে কোনও ধর্মের প্রতিটি মানুষের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর পর বিদেহী আত্মা পাপ বা পুণ্যফল হিসেবে অনন্ত দুঃখ বা অনন্ত সুখ ভোগ করে। এখানে অনন্ত মানে, সীমাহীন, যার শেষ নেই। যীশু আত্মাকে অমরত্ব দান করেছেন। যীশুর জন্মের আগে মানুষের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মাদেরও মৃত্যু হত। খ্রিস্টধর্ম হিন্দুদের পুনর্জন্ম তত্ত্বকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস করে।
প্রাচীনপন্থী গোঁড়া খ্রিস্টানরা মনে করেন, অমরত্ব ও নিত্যতা আত্মার স্বভাব ও ধর্ম নয়। এঁরা মনে করেন অমরত্ব লাভ করা যায় ভাল কাজ ও যীশুর প্রতি বিশ্বাসের পুরস্কার স্বরূপ। এঁরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করেন না।
মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন আল্লাহ্ সমস্ত মানুষ তৈরি করে শ্বাসের মধ্য দিয়ে তাদের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আত্মা (নফস) ও প্রাণশক্তি (রূহ)। আত্মা থাকে হৃদয়ে। যাঁরা আল্লার নির্দেশ মেনে চলেন, তাঁদের আত্মাকে আল্লাহ নিয়ে এসে বেহেস্তে স্থান দেন। বেহেস্তে আছে গাছের ছায়া, বয়ে চলেছে জলের নদী, দুধের নদী,মধুর নদী ও সুরার নদী। বেহেস্তের চিরযৌবনা হুরী-পরীরা পুণ্যাত্মাদের পেয়ালা পূর্ণ করে দেয় সুরায়। যাঁরা আল্লার নির্দেশ অমান্য করেন, তাঁদের আত্মা স্থান পায় ‘দোজখ’ বা নরকে। আত্মারা এই স্বর্গসুখ বা নরকযন্ত্রণা ভোগ করবে শেষ বিচারের দিন (কেয়ামত) পর্যন্ত। হাজার হাজার বছর ধরে যত মানুষ মারা গেছে, সব ধর্মের সব মানুষদের বিদেহী আত্মার পুনরুত্থান হবে শেষ বিচারের দিনটিতে। মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাস আত্মার পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে না।
ইহুদীরা বিশ্বাস করেন সমস্ত কিছুর স্রষ্টা জেহোভা। আত্মা ও প্রাণবায়ু তাঁরই সৃষ্টি। আত্মা কখন কোথায় জন্মাবে, কখন দেহত্যাগ করবে, সবই জেহোভার ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। মানুষ ও জেহেভার মাঝখানে আছেন দেবদূতরা। দেবদূতরা জেহোভার বার্তাবহ। কোনও রমণী গর্ভবতী হলে দেবদূত প্রাণের বীজ ও আত্মা নিয়ে হাজির হন জেহোভার কাছে। জেহোভা হবু জাতকের ভাগ্য নির্ধারিত করে দেন। ইহুদীরা তাই বিশ্বাস করেন ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত এবং কোনওভাবেই তার পরিবর্তন সম্ভব নয়। ইহুদীরা মনে করেন, মানুষের জীবনের লক্ষ্য হল জেহোভার গুণগানে সময় কাটানো। মৃত্যুর পর আত্মা ও প্রাণবায়ু ফিরে যায় জেহোভার কাছে। ইহুদীরা জন্মান্তরবাদে ও কর্মফলে বিশ্বাস করেন না।
বৌদ্ধ দর্শনে আত্মা ও ঈশ্বরের নিত্যতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। বৌদ্ধ দর্শনের বৈশিষ্ট্য অনিত্যতা। বেদ শাস্ত্রের উপর বৌদ্ধধর্ম বিশাল আঘাত হেনেছিল। আর্য ও হিন্দুরা বেদকে অপৌরুষেয় অর্থাৎ কোনও মানুষের রচনা নয় বলে ঘোষণা করেছিল। তাদের মতে বেদ অনাদি, এর কোনও আরম্ভ নেই। কোনও কালে পরিবর্তিত হবে না। বেদ সত্যপ্রতিষ্ঠ, স্বতঃপ্রমাণ। বেদ যা বলেছে, সবই চিরন্তন সত্য। বেদের উক্তি সম্পর্কে সামান্যতম সন্দেহ প্রকাশও অপরাধ। বেদ মানুষের রচিত নয়, তাই এতে ভুল বা প্রতারণা নেই।
বেদান্ত শব্দের অর্থ বেদের শেষ। বেদের শেষাংশ উপনিষদ। উপনিষদভিত্তিক যে দর্শন, তাই বেদান্ত-দর্শন। বৌদ্ধ-দর্শন বেদের নিত্যতা, অনাদিত্য অপৌরুষেয়ত্ব সব কিছুকেই অস্বীকার করল। বৌদ্ধ দর্শন বলল—সত্যকে জানতে হবে জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে—যুক্তি-তর্ক-বিচারের মাধ্যমে।
বেদের চাতুর্বর্ণ-ভেদ, ব্রাহ্মণের প্রাধান্য, যজ্ঞের প্রয়োজনীয়তা, আত্মাতত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার হল বৌদ্ধ-দর্শন। বলল, মানুষের জীবনে আছে ব্যাধি জরা মৃত্যু। এগুলো অনতিক্রম্য। অনিত্য এই ক্ষণিক জীবনে শান্তি আনতে পারে সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালবাসা এবং সংযমী ও নৈতিক জীবনযাপন। তবে এ কথাও ঠিক—দুঃখবাদকে বৌদ্ধধর্ম বড় বেশি রকম গুরত্ব দিয়েছিল, এবং দুঃখের মূল কারণগুলোকে গুলিয়ে ফেলেছিল। বুদ্ধের মতে দুঃখের কারণগুলো ছিল জৈবিক— জন্মের সূত্র ধরেই মানুষের জীবনে আসে জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু। বুদ্ধের সময় যে দাস প্রথা ছিল, শূদ্র নামক নিম্নবর্ণের শোষণ ছিল তাদের দুঃখের কারণ যে জৈবিক নয়—সামাজিক, সেবিষয়ে বৌদ্ধ-দর্শন ছিল নীরব।
বুদ্ধের মৃত্যুর পর একশ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ধর্ম স্থবিরবাদী ও মহাসাঙ্ঘিক নামে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়। পরবর্তীকালে এই দুটি শাখা আরও বহুভাগে বিভক্ত হয়। বৌদ্ধধর্মের উপর হিন্দুধর্মের প্রভাবেরই ফলস্বরূপ এসেছে জাতক কাহিনী ও জন্মান্তরে বিশ্বাস। কিন্তু আদি বৌদ্ধ দর্শনে জন্মান্তরের কোনও প্রশ্নই নেই, যেহেতু আত্মাই অনিত্য।
এই আলোচনার মধ্য দিয়ে এটুকু বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হয়নি, জন্মান্তরবাদ হিন্দুধর্মের একটি অন্ধ ও আরোপিত বিশ্বাস, পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণহীন, প্রমাণহীন বিশ্বাসমাত্র।
এখনও জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, একটু গভীরভাবে ভাবুন তো, আপনার এই বিশ্বাসের পিছনে কি যুক্তি আছে? আপনার কি মনে হচ্ছে— গীতা, বেদ, উপনিষদ, বিবেকানন্দ, অভেদানন্দ প্রমুখ অধ্যাত্মবাদীদের সব কথাই কি তবে মিথ্যে? যদি এমন সংশয়ে আপনি দীর্ণ হন, তবে আর একবার ভাবুন তো—আপনি যদি জন্মাতেন কোনও খ্রিস্টান, মুসলিম, বৌদ্ধ বা ইহুদী পরিবারে, তবে পরিবারের পরিবেশ থেকে এই বিশ্বাসের মধ্যেই বেড়ে উঠতেন—পুনর্জন্ম একটি ভ্রান্ত ধারণা। বাইবেল, কোরান, ত্রিপিটক, খিস্ট, মহম্মদ, বুদ্ধ এঁদের সবার কথাই কি তবে মিথ্যে?
আত্মা ও পুনর্জন্ম নিয়ে বিভিন্ন ধর্মমতের বিভিন্নতা ও বিরোধই প্রমাণ করে— এ’সবই প্রমাণহীন বিশ্বাসমাত্র।