অধ্যায় : চার – এ দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা

অধ্যায় : চার – এ দেশের কিছু আদিবাসী ও বিদেশের কিছু অধিবাসীদের আত্মা-চিন্তা

ভারত বিরাট দেশ। আদিবাসী-গোষ্ঠীর সংখ্যাও বিপুল। এরই মধ্য থেকে আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে কয়েকটি আদিবাসী-গোষ্ঠীর আত্মাবিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করে দেখাব, গোষ্ঠী ভেদে বিশ্বাসের রকমফের।

নাগাদের উপগোষ্ঠী সেমা-নাগা ও অও-নাগাদের বিশ্বাস, প্রত্যেক মানুষেরই একটি করে স্বচ্ছ-আত্মা আছে। এই স্বচ্ছ-আত্মা থাকে আকাশে। মানুষ ভাল-খারাপ যে সব কাজ করে, সেইসব কাজ-কর্মের ফল তরঙ্গ হয়ে প্রতিফলিত হয় স্বচ্ছ আত্মার বুকে।

অসমের লোখে উপজাতির মানুষরা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি মানুষের আত্মা দেখতে তারই মত, এবং একই আয়তনের।

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি নিগূঢ়ানন্দ’ও সোচ্চারে ঘোষণা করেছেন—আধুনিক অধিমনোবিজ্ঞানও (এই নামের কোনও স্বীকৃত বিজ্ঞান আছে বলে এই প্রথম শুনলাম) বিস্তৃত অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে প্রতিটি মানুষের আত্মা তার স্থূল দেহেরই অনুরূপ এবং একই পরিমাপের। [আত্মার রহস্য সন্ধান পৃষ্ঠা-১৫৯] আমার মত কিছু মানষের দুঃখ রয়ে গেল—এমন একটা পৃথিবী কাঁপানো অনুসন্ধানপ্রাপ্ত সিদ্ধান্তের খবর বিজ্ঞানের দরবারে চেপে গিয়ে প্রকাশ করা হল শুধু এই বইটিতে; তাও আবার অনুসন্ধানের বা পরীক্ষার গৃহীত পদ্ধতি এবং পর্যায়গুলোকে প্রকাশ না করে স্রেফ সিদ্ধান্তটুকু। নিগূঢ়ানন্দের প্রতি অনুরোধ— বিশ্বজনগণের স্বার্থে পরীক্ষাটির বিস্তৃত রিপোর্ট প্রকাশ করুন।

নিগূঢ়ানন্দ ‘আত্মা’ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ-লেখক। তাঁর দাবি-আত্মা, ভূত, প্রেত ইত্যাদির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ‘মানুষে বিশ্বাস হারান অন্যায়’। কিন্তু মুশকিল হল,কার উপর বিশ্বাস রাখি? স্বামী অভেদানন্দও জোরালো দাবি রেখেছেন—অনেক আত্মা-টাত্মার সঙ্গে বহুত যোগাযোগ করে দেখেছেন—আত্মা স্রেফ ধোঁয়াময়, কুয়াশাময়। অন্য সব ধারণাই বিলকুল ঝুট।

একই বিষয় নিয়ে দুটি বিপরীত স্বীকারোক্তিই মিথ্যে হতে পারে, কিন্তু দুটি বিপরীত স্বীকারোক্তি কখনই একই সঙ্গে সত্যি হতে পারে না। অতএব নিগূঢ়ানন্দের ও অভেদানন্দের মধ্যে অন্তত একজন মিথ্যেবাদী, অথবা মিথ্যেভাষী দু’জনেই।

যাক গে। ওঁদের ছেড়ে আসুন আবার আদিবাসীদের আত্মাবিশ্বাসে ফিরে আসি। ছোটনাগপুর ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের বিশ্বাস আত্মা হল মানুষটির ছায়া। কুকি ও মণিপুরের পুরুম সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস, প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি করে আত্মা।

বীরহোড়রা মনে করে মানুষের মধ্যে রয়েছে তিনটি করে আত্মা। তিন আত্মার একটিকে প্রায়ই দেখা যায়, সে হলো— মানুষটির ছায়া।

নীলগিরির টোডা সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশ্বাস অসমের লোখে সম্প্রদায়ের কাছাকাছি। প্রতিটি মানুষের আত্মা মানুষটির সমপরিমাণ না হলেও মানুষটির মতই দেখতে।

এ’বার চলুন, এ’দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিই। ইহুদিরা মনে করে প্রাণই আত্মা; আত্মাই প্রাণ, অর্থাৎ প্রাণময় আত্মা। তাদের বিশ্বাস জেহোবা মানুষের নাকে ফুঁ দিয়ে দেহে প্রাণময় আত্মার সঞ্চার করেছিলেন। আত্মা থাকে কোথায়? দেহ জুড়ে? এ বিষয়ে তাদের বিশ্বাস, আত্মার অবস্থান হৃদপিণ্ডে। সেই উৎপত্তিস্থল থেকেই শক্তি সঞ্চারিত হয় প্রয়োজন মত দেহের বিভিন্ন অঙ্গে। একই সঙ্গে ইহুদী- ধর্ম-বিশ্বাসীরা মনে করে হৃদপিণ্ড থেকেই উৎসারিত হয় মানুষের চিন্তা, চেতনা, ভাবাবেগ, প্রেম ও আনন্দ।

প্রাচীন গ্রিক মহাকাব্যের রচয়িতা হোমারের সময় এবং তারপরও দীর্ঘকাল ধরেই গ্রিস-দেশের অধিবাসীরা বিশ্বাস করতেন—শ্বাসই হল আত্মা। মারা গেলে শ্বাস দেহ থেকে বিচ্যুত হয়। তবে যতক্ষণ মৃতদেহ রক্ষিত থাকবে ততক্ষণ আত্মা থাকবে সেই মরদেহকে স্পর্শ করেই। দেহ বিনষ্ট হলে আত্মা মুক্ত হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারে।

হোমারের কালে ও তৎপরবর্তী একটা দীর্ঘ সময় হোমারের প্রভাবিত চিন্তায় গ্রিসীয়রা বিশ্বাস করতেন, দেহের মৃত্যুর পর আত্মারূপ শ্বাসের অস্তিত্ব থাকলেও সেই আত্মাতে কোনও চেতনা থাকে না। আত্মার চেতনা না থাকার কারণ, চেতনার আধার হৃদপিণ্ড মৃত্যুপরবর্তী আত্মায় হাজির না থাকা।

পরবর্তীকালে নব-প্লেটোপন্থীরা আত্মা বিষয়ে যে বিশ্বাসের কথা প্রচার করেছিলেন, তাই গ্রিসবাসীদের বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাদের মতে— আত্মাই চিন্তা বা চেতনা এবং আত্মা অমর।

প্রাচীন জার্মানরা বিশ্বাস করত, আত্মাই শ্বাস। দেখতে ছায়ার মত। থাকে হৃদপিণ্ডে।

মালয়ের বহু মানুষের বিশ্বাস, আত্মার রঙ রক্তের মত লাল। আয়তনে ভুট্টার দানার মত। প্রশান্ত-মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেকের ধারণা, আত্মা তরল। অস্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীদের অনেকে আজও বিশ্বাস করে আত্মা থাকে বুকের

বাঁ দিকে, হৃদয়ের গভীরে। আয়তনে খুবই ছোট্ট। বহু জাপানি আজও এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আছে—আত্মার রঙ কালো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, প্রত্যেক মানুষের ভিতরে হাত পা ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে আর একটা ছোট্ট মানুষ বাস করে। সেটাই হল ‘দ্বিতীয় সত্তা’ বা ‘আত্মা’। তারা এও মনে করত, শরীরের কোনও অঙ্গহানি হলে আত্মারও অঙ্গহানি হবে।

আত্মার সংজ্ঞা, আত্মার রূপ ও আত্মা বিষয়ক নানা ধর্মবিশ্বাস ও নানা ধর্মগুরুদের বিশ্বাস নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করার পর আসুন এবার আমরা আলোচনাকে গুটিয়ে নিয়ে দেখি আত্মা সম্পর্কে আমরা কি স্পষ্ট ধারণায় পৌঁছলাম? ‘ঢাকাই কুট্টি’র ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, “কচু পাইলাম”। বাস্তবিকই তাই, অধ্যাত্মবাদীদের জ্ঞানের সমুদ্র মন্থন’ করে না বুঝতে পারলাম আত্মার সংজ্ঞা কী, না জানতে পারলাম আত্মা কেমন।

একবার একটু ভাবুন তো। ধর্মীয় বিশ্বাস, ব্যক্তি শ্রদ্ধা ও আবেগকে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য ছুটি দিয়ে ভাবুন তো—এত বিচিত্র সব মত থেকে, বিপরীত মত থেকে, কোনটিকে আপনি গ্রহণ করবেন? হিন্দু হিসেবে হিন্দুদের আত্মা বিষয়ক বিশ্বাসকে? সেখানেও তো ‘বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি’। অথচ দেখুন, স্বামী অভেদানন্দই ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটির ৩১ পৃষ্ঠায় সোচ্চার ঘোষণা রেখেছেন, “আমাদের মনে রাখা উচিত যে, সত্য কখনও দু’রকম বা বিচিত্র রকমের হয় না, সত্য চিরকাল এক ও অখণ্ড’। তবে?

এই তবের উত্তরটাই একটি সভায় দিয়েছিলেন আমাদের সমিতির ঠোঁট কাটা মিষ্টুন দাশগুপ্ত, “মনে রাখলাম, এবং তাই আত্মা-বিষয়ক বিচিত্র রকমের বহু-খণ্ডিত ধর্মী ‘সত্য’টিকে মিথ্যা বলে বাতিল করলাম”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *