অধ্যায় : নয় – সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন্-ঝন্ বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”

অধ্যায় : নয় – সিস্টেম’কে পুষ্ট করতেই টিনের তলোয়ার ঝন্-ঝন্ বাজে “আত্মা থাক, কুসংস্কার দূর হোক”

যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে আমাদের সমাজ কাঠামোর, আমাদের ‘সিস্টেম’-এর শরিক শক্তিগুলো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হুংকার-টুংকার দিচ্ছে, এমন কি কুসংস্কার- বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেও এগিয়ে আসছে। বেতারে, দূরদর্শনে,পত্র- পত্রিকায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, যুক্তির পক্ষে অনেক কিছু প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু সবটাই ‘বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। এরা প্রত্যেকেই একই সঙ্গে যুক্তির পক্ষেও বলে, আধ্যাত্মিকতার পক্ষেও বলে। এইসব সরকারি ও বাণিজ্যিক প্রচারমাধ্যমগুলোর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি—’কুসংস্কার’ ও ‘অধ্যাত্মবাদ’কে দুটি অসম্পর্কিত, ভিন্নতর বিষয় হিসেবে মানুষের সামনে নানাভাবে লাগাতার প্রচার রাখা। এরা চায় কুসংস্কার, অধ্যাত্মবাদী চিন্তার (যা ভক্তিবাদী ও বিশ্বাসবাদী চিন্তার জনক) মূলস্রোত বা অন্যতম মূল শিকড় আত্মার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে। এরা জানে, আত্মার অমরত্বকে মানুষের চিন্তায় বাঁচিয়ে রাখতে পারলে কুসংস্কার বিদায়ের নামে যতই অলৌকিক বাবাদের রহস্য উন্মোচিত হতে থাক না,তবু বহু মানুষই ভাববে—এরা বুজরুক হলেও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান, ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান মানুষও নিশ্চয়ই আছেন। আর বিভূতি দেখানো অবতার যদি নাও থাকেন, তাতেই বা কি প্রমাণিত হয়? বিভূতি দেখানোকে ঘৃণা করা রামকৃষ্ণের মত অবতারও তো আছেন? (রামকৃষ্ণদেব বিবেকানন্দের কপালে আঙুল ঠেকিয়ে যা দেখিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানে থাকলেও অধ্যাত্মবাদীদের সংজ্ঞা অনুসারে তাকে বিভূতি না বলে উপায় কী? রামকৃষ্ণদেব যা করেছিলেন তেমনটি শুধু রামকৃষ্ণদেবের মত আধ্যাত্মিক নেতাদের পক্ষেই দেখানো সম্ভব, এমনটি যাঁরা মনে করেন, তাঁরা মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজ- কর্ম বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন বলেই এমন ভুল ধারণা পোষণ করেন। অনেক মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর পক্ষেই কারুকে অলীক কিছু দেখানো, অলীক কিছু শোনানো ইত্যাদি সম্ভব, বিজ্ঞানের সাহায্যেই সম্ভব। জাহির করার তাগিদে নয়, বক্তব্যের প্রতি পাঠক-পাঠিকাদের প্রত্যয় আনতে বিনয়ের সঙ্গেই বলছি এমনটা বার বার ঘটাতে আমিও পারি। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার ইচ্ছে আছে ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ নামে প্রকাশিতব্য বইটিতে। শ

আত্মা অমর হলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভের হাতছানি থাকে; থাকে পরের জন্মে অপার সুখের প্রতিশ্রুতি। আর তার জন্য এই জন্মে যেটুকু করতে হয়, তা হল— হাসি মুখে গতজন্মের কর্মফলকে মেনে নেওয়া।

আমাদের সমাজ কাঠামোর শরিক শক্তিগুলো ও প্রচার মাধ্যমগুলোর এমনতর বিচিত্র-দ্বিচারী ভূমিকার সঙ্গে কারও স্পষ্টতর পরিচয় না থাকলে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, বা আমার কথাকে ‘তিলকে তাল বানানো মনে হতে পারে; কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য। প্রচারমাধ্যমগুলোর কাজ-কর্মকে অনেক বছর ধরে খুব কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়ার সুবাদে আজ এই কথাগুলো বলা। একের পর এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা লিখলে একটা নধর বই-ই হয়ে যাবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিকতম ঘটনাটির কথা বলছি।

আকাশবাণীর করিশমা

৩০ আগস্ট ’৯৪ আকাশবাণী কলকাতা ‘ক’ থেকে সকাল ৭-২০ মিনিটে আমার একটি কথিকা প্রচারিত হওয়ার কথা স্থানীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। কথিকার শিরোনাম ছিল, ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার’। কিন্তু সেদিন কথিকাটি প্রচারিত হয়নি। কেন হয়নি? কারণ রেকর্ডিং হয়নি। কেন রেকর্ডিং হয়নি? সে কথাতে আসছি এবার।

প্রথামত রেকর্ডিং-এর আগে ‘স্ক্রিপ্টটা পড়তে নেন আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগের সহ-প্রযোজক সুনীলরঞ্জন দত্ত। স্ক্রিপ্টের শুরুতে ছিল ‘বিজ্ঞান’ ও ‘কুসংস্কার’ শব্দ দুটির আভিধানিক সংজ্ঞা। সেখানে লিখেছিলাম, “কুসংস্কার শব্দের অর্থ—ভ্রান্ত ধারণা, যুক্তিহীন ধারণা, যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস”। এই অংশটি নিয়ে সুনীলবাবু আপত্তি জানালেন এবং “যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস” লাইনটা কাটতে বলে বললেন, যতগুলো অভিধানেই এ’কথা লেখা থাক না কেন, এমন কথা তাঁর প্রচার করতে দেবেন না।

প্রযোজক নুরুল আলম ইতিমধ্যে লেখাটায় তাঁদের পক্ষে অস্বস্তিকর কিছু আছে অনুমান করে স্ক্রিপ্টে নিজেও চোখ বুলিয়ে বললেন, “যেখানে এ’দেশে রাষ্ট্রপতি মাথা ন্যাড়া করে আসছেন ধর্মীয় বিশ্বাসে, সেখানে আমরা তারপর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলি কি করে?”

স্ক্রিপ্টের আরও একটি অংশে ছিল,

“‘কুসংস্কার মানি না,’ বলতে পারাটা আজকাল স্মার্ট হওয়ার ভান হয়ে দাঁড়িয়েছে, এঁদের অনেকেই বিশ্বাস করেন—আত্মা অমর! মা-বাবার মৃত্যুর পর তাই শ্ৰাদ্ধ করেন, পিণ্ড দেন। এই শ্রাদ্ধকারীদের অনেকেই আবার ‘ভূতে ভর’কে ‘গেঁয়ো ধারণা’ বলে নাক সিঁটকোন!”

সুনীলবাবু এই লাইনগুলো কাটতে বলে বলেন, ‘আজকে প্রাইমমিনিস্টার স্পেশাল প্লেনে করে গিয়ে কি এক মাতাজীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করছেন; সেখানে আমরা শ্রাদ্ধকে কুসংস্কার বলে প্রচার করতে পারি না।”

সুনীলবাবু আমার লেখা থেকে ধর্ম ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কথা বাদ দিতে অনুরোধ করে বলেন, “আমাদের সাবজেক্টটা আছে ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার’। আমরা যেটাকে হাইলাইট করি বারবার, সেটা যেমন—গ্রহণের সময় খাবার-দাবার ফেলে দেওয়া হয়; আমরা বলছি, এটা ঠিক নয়। আমরা বলব- আজকে অমুক তারিখ পূর্ব দিকে যাত্রা নিষেধ বা পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে শুলে শরীর খারাপ হবে, এগুলো কুসংস্কার; কারণ এই ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। আমি বলছি— এই কথাগুলোকে আপনি হাইলাইট করুন।”

নুরুল আলম অনুরোধ করলেন স্ক্রিপ্টে ওসব পাল্টে হাঁচি-টিকটিকি- অযাত্রাদর্শন ইত্যাদি প্রসঙ্গ আনতে। শ্রীআলমের মতে—এইসব কুসংস্কারই মানুষের বেশি ক্ষতি করছে। আত্মা অমর কি না, তাতে মানুষের ক্ষতি-বৃদ্ধি কী?

উত্তরে বলেছিলাম, আমি ওঁদের সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি—’আত্মা অমর’ এই চিন্তার সূত্র ধরেই কর্মফল, ভাগ্য, পরজন্ম, স্বর্গ-নরক, পরলোক, পরলোকের বিচারক ঈশ্বর ইত্যাদি অলীক বিশ্বাস টিকে আছে। তার ফলে বঞ্চিত মানুষ বঞ্চনার কারণ হিসেবে সমাজের দুর্নীতি চক্র কিছু মানুষ বা সিস্টেমকে দায়ী না করে দায়ী করেছেন ভাগ্য, কর্মফল, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়া, ইত্যাদিকেই। আরও একটা কথা কি জানেন, কোনও বড় মাপের মন্ত্রী-টন্ত্রী মঘা ত্র্যহস্পর্শ-হাঁচি-কাশি- টিকটিকির ডাক ইত্যাদি মানেন, খবর পেলে আপনারা তো রেকর্ডিং-এর পরেও তার প্রচার বন্ধ করে দেবেন। অতএব আমি আমার স্ক্রিপ্টটাই তুলে নিচ্ছি। প্রচার করতে চাইলে এই অপরিবর্তিত স্ক্রিপ্টই আপনাদের প্রচার করতে হবে।

ঘটনাটা জানার পর কেউ বলতে পারেন—সুনীলরঞ্জন এবং নুরুল আলম তো প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও পিছ-পা হননি! আসলে এই সরকারের রেডিও পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তো ওঁদের চাকরি করতে হবে! এইজাতীয় বক্তব্যের উত্তরে জানাই, নুরুল আলম, সুনীলরঞ্জন সরকারি আমলা, যাঁরা জানেন সরকারের চাওয়াটাকে যে কোনও কৌশলে পাইয়ে দেওয়াটাই আমলার কার্যদক্ষতার মাপকাঠি। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে কিছু বলে আমার আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে যদি আমাকেও সরকারি নীতি বা কৌশলকে কার্যকর করার কাজে লাগানো যেত—তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণই হত ভারী। ক্ষতির কথাটা লেখাই আমার ভুল হয়েছে। ক্ষতিটা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির এইজাতীয় কুসংস্কার পালনের খবরটা আমার কাছে নতুন নয়—এটা সুনীলবাবু, নুরুলবাবুর অজানা থাকার কথাও নয়। সুনীলবাবু ও নুরুলবাবু বাস্তবিকই আন্তরিকতার সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানদ্বয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাইলে আমার কাছে ফিসফিস না করে তাঁদের হাতের প্রচার মাধ্যমগুলোকেই কাজে লাগাতে সচেষ্ট হলেন না কেন?

কেন উল্টে আমার বক্তব্যকে ‘সেনসর’ করতে চাইলেন? কারণ একটিই—তাঁরা আমাদের সমাজ-কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে স্থিতিশীল ও গতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় সহায়ক শক্তি। এ’ভাবেই সহায়ক শক্তিগুলো কাজ করে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন— এই সরকারের ভূমিকাটাই এমন প্রগতিবিরোধী। অন্য সরকার এলে অন্য রকম হত।

এর উত্তরে জানাই—সমাজে অসাম্য থাকলে যে সরকারই আসুক এমনটাই ঘটে চলবে। এবং যতদিন ধরে ঘটে চলবে, ততদিন সাম্যও আসবে না।

সমাজ কাঠামোবা সমাজের সিস্টেম’কে জানুন সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থে

এই অধ্যায়ের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত যা বললাম, সেই বক্তব্যকে স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে বুঝতেই হবে বর্তমানের এই অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে, যার প্রচলিত নাম ‘সিস্টেম’। আর অসাম্যের এই সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে বুঝতে গেলে বুঝতে হবে এই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্তা ধনকুবের গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকার, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনী, প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক।

সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অসাম্যের এই সমাজ কাঠামো বা সিস্টেমকে ভাঙতেই হবে। সিস্টেমে আঘাত করার অর্থ কি, বর্তমান সরকারকে আঘাত করা? সরকারি কাজ-কর্মকে সমালোচনায় সমালোচনায় নাস্তানাবুদ করা? সরকারের বিভিন্ন কাজ-কর্মের বিরোধিতা করা?

না, শুধু তা নয়। সরকার যায়, সরকার আসে। রাজনৈতিক নেতারা গদিতে বসেন, আবার বিদায়ও নেন—কেউই অপরিহার্য নন। কিন্তু অসাম্যের এই সমাজ ব্যবস্থা টিকেই থাকে, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সাম্যের সমাজ গড়ার সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে বিশাল এক ঠাট্টা ও ধাপ্পা বলে বার বার প্রমাণ করে দিয়েই টিকে থাকে। এই সমাজ কাঠামোকে বজায় রেখে কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতার সাধ্য নেই শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার মুখের কথাকে কাজে পরিণত করা। অসাম্যের এই সমাজ কাঠামোয় যে-ই শাসকের আসনে বসবে, সেই অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে, শোষনের সমাজ কাঠামোকে, দুর্নীতির সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রেখেই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। সুতরাং শুধুমাত্র কোনও একটি সরকারের বিরোধিতা অথবা তাকে নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাজ কাঠামোকে পাল্টে ফেলা যায় না, ‘সিস্টেম’কে বদলে দেওয়া যায় না। কারণ এরা রাম, শ্যাম, যদু কি মধু, যেই হোক, গদিতে পাছা ঠেকালেই বলে ‘হালুম’। তারপরই দুর্নীতির থাবা বসিয়ে গরিবের হাড়-মাংস চিবিয়ে খায়।

আমাদের দেশে শোষণ ও বৈষম্যের সমাজ-কাঠামো টিকে আছে দুর্নীতির হাত ধরে। সমাজ কাঠামোটা একটা বিশাল যন্ত্রের মত। এই যন্ত্র গতিশীল রয়েছে, কাজ করে চলেছে যন্ত্রের ভিতরের নানা আকারের চাকার ঘূর্ণনের সাহায্যে। একটি চাকা ঘোরা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে চাকার দাঁতে দাঁত চেপে গতি পাচ্ছে আর একটি চাকা। তার থেকে আর একটি, তার থেকে আর একটি, আর একটি….। চলছে যন্ত্র। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার গোটা যন্ত্রটি যে চলছে, তার নানা মাপের প্রতিটি চাকা ঘোরাচ্ছে দুর্নীতির দাঁত।

আমাদের সমাজ কাঠামোয় শোষণ দুর্নীতির সাহায্যে টিকে থাকলেও তত্ত্বগতভাবে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি ছাড়াও শোষণ সম্ভব, অর্থাৎ আইন মেনেও শোষণ সম্ভব। কারণ অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থায় শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দেশের আইনের মূল ধারাগুলো তৈরি করা সম্ভব, এবং প্রায়শই তেমনটা হয়।

আমার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে, উপরের পংক্তি দু’টিতে আমি যে বক্তব্য রেখেছি, তাতে আপাত স্ব-বিরোধ আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন শোষকদের পক্ষে রচিত হলে আইন মেনেই তো শোষণ চলতে পারে। দুর্নীতি মানেই তো আইন না মানা—সেটা এ’দেশে চলছে কেন?

উত্তরটা কিন্তু সহজ ও সরল। দুনীয়ার ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির মধ্য থেকে তথ্য সংগ্রহ করলেই দেখতে পাবেন, উন্নত দেশে ধনীক শ্রেণী আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি স্বাবলম্বী। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশের শোষণ প্রক্রিয়া অনেক সুশৃঙ্খল, এ’দেশের মত ব্যাপক দুর্নীতির লুঠ-তরাজ নেই।

এ’দেশের সমাজ কাঠামোয় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শোষক ও শোষিত দুই শ্রেণীই। দুর্নীতিগুলো কি ভাবে দুই বিপরীত শ্রেণীর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে, কেন ছড়িয়ে পড়েছে, এ নিয়ে অতি সংক্ষেপে একটু আলোচনা করে নিই আসুন।

(এক) : শোষক ও শাসকশ্রেণী নিরপেক্ষতার মুখোশ পরার জন্য বা জনগণের লড়াইয়ের জন্য যেটুকু ছিঁটেফোঁটা অধিকারের প্রতিশ্রুতি শোষিত জনগণকে দিতে বাধ্য হয়, সেগুলো তারা নিজেরাই ভঙ্গ করে সমাজে দুর্নীতির পরিমণ্ডলের সাহায্য নিয়ে। সুতরাং এ’দিক দিয়ে দুর্নীতির পরিমণ্ডল টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি। স্থানী

(দুই) : নির্দিষ্ট আইনকানুন মেনে শোষণ করে যত দ্রুত ধনী হওয়া সম্ভব, তার চেয়ে, অনেকগুণ তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া সম্ভব আইন-কানুন ভেঙে। এ ভাবেই আম্বানি, হর্ষদ মেহেতাদের মত অখ্যাত মধ্যবিত্তরা কয়েক বছরে দেশের সেরা ধনী হয়ে উঠেছে। এ’ভাবেই উঠে আসছে ঝাঁক-ঝাঁক ধনী, যারা কয়েক বছর আগেও ছিল অজ্ঞাত কুলশীল। এ ভাবেই ছাপড়ার বেড়ার ঘরে বাস করা রাজনৈতিক নেতা কয়েক বছরে কোটিপতি হয়েছে, কোটিপতি হয়েছে দাউদ ও রশিদের মত বস্তি থেকে উঠে আসা সমাজবিরোধীরা। এভাবেই পুলিশ ও বিভিন্ন প্রশাসনের অনেক বড়-মেজ কর্তারা মধ্যবিত্তের খোলস ছেড়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে। এদের দ্রুত ধনী হয়ে ওঠার মূল-মন্ত্র একটিই—’দুর্নীতি’।

(তিন) : শোষিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তুঙ্গে উঠলে তাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য প্রয়োজন হয় অবাধ বলপ্রয়োগ ও নিপীড়নের। আইনের কাঠামোর মধ্যে তা সম্ভব নয়। সুতরাং দুর্নীতির সাহায্য নিয়েই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়।

এ’সবই শোষক ও তার সহায়ক শক্তির মধ্যেকার দুর্নীতি। কিন্তু শোষিতদের মধ্যেও যে দুর্নীতির ব্যাপক গণভিত্তি থাকে, তার কার্য-কারণ এ’বার সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

(এক) : শোষিতদের কাছে দুর্নীতির সুযোগ তীব্র শোষণের মধ্যেও খানিক ‘উপশম’ ও ‘আনন্দ’-এর দখিনা হাওয়া বয়ে আনে। অচেনা লোক দেখে রিক্সাওয়ালা দু’টাকা ভাড়াকে চার টাকা বলে, ট্যাক্সি ড্রাইভার নতুন যাত্রী পেলে দু’কিলোমিটারের পথ যেতে কুড়ি কিলোমিটার ঘোরে, ‘ঋণ-মেলা’ থেকে ঋণ নিয়ে সুযোগ থাকলেও ঋণ শোধ করতে ব্যাঙ্কের দরজার দিকে আর পা মাড়ায় না অনেক গরিবই। এমন উদাহরণ অবিরল ধারায় হাজির করা যায়। এই ধরনের দুর্নীতি তাই অনেক সময় শোষিত মানুষদের শোষণজনিত ক্ষোভকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করে। এই দুর্নীতি শোষিতদের প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের গ্লানিময় বিকল্প হিসেবে কাজ করে। [ফল : স্থায়ী সমাধানের কষ্টকর সংগ্রাম থেকে বিচ্যুতি]

(দুই) : দমন-পীড়ন-শোষণের দুর্নীতি চালাতে শোষকদের যে লোকবলের প্রয়োজন হয়, তার একটা অংশ সংগ্রহ করা হয় শোষিতদের মধ্যে থেকেই। আর এটা সম্ভব হয়, শোষিতদের মধ্যে দুর্নীতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলার ফলে। এই প্রক্রিয়ার ফলে আরও সুবিধে হল, এর ফলে শোষকশ্রেণী নিজেদের পরিবর্তে শোষিতদের ওই অংশকে জনগণের সামনে দমন-পীড়ন-দুর্নীতির মূর্ত প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়, তাদের বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে জোরাল বক্তব্য রাখা হয়, মাঝে- মধ্যে নেওয়া হয় জোরাল ব্যবস্থা। এ ভাবেই ভাঙা হয় বে-আইনি মদের ঠেক, ধরা পড়ে কোটি টাকার সোনা কি হেরোইন, ভাঙা হয় প্রমোটারের বেআইনি কনস্ট্রাকশন। এ’সব ধরা পড়া দুর্নীতি শতাংশের একাংশও নয়। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি শোষকশ্রেণী এ’ভাবে শোষিতদের বিভ্রান্ত করে। [ফল : সংগ্রামের লক্ষ্যে বিভ্রান্তি তৈরি]

(তিন) : দুর্নীতির দ্বারা অতি সফলভাবে শোষিতশ্রেণীর মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও ভোগবাদের সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলা সম্ভব হয়। [ফল : শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে না গিয়ে শোষকশ্রেণীকে সাহায্য করে আখের গোছাতে ব্যস্ত হওয়া]

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই মানেই অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। জ্বলন্ত উদাহরণ তো সামনেই রয়েছে—শেষন; টি. এন. শেষন। তিনি এ’দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁর এই লড়াই চালিয়ে যাওয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে এবং সম্মান জানিয়েও আমরা বলতে পারি, তাঁর এই লড়াই কখনই অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও লড়াই নয়। বরং তাঁর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াকু মেজাজের সঙ্গে মিলে-মিশে একাকার হয়ে থাকা ঈশ্বর, অবতার, ভাগ্য, কর্মফল ইত্যাদিতে প্রবল বিশ্বাস বহু শোষিত মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, লক্ষ্যচ্যুত করবে।

অনেক সময় দুর্নীতি সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণভাবে শোষণকে চালাতে দেয় না। অনেক সময় ব্যাপক দুর্নীতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভও তৈরি করে। ফলে অনেক সময় শোষকরা এবং তাদের তল্পিবাহকরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিবাদের পার্থক্যটা তাই স্পষ্ট করে তোলা একান্তই জরুরি। শোষকশ্রেণী ও তাদের তল্পিবাহকরা দুর্নীতির তথাকথিত বিরোধিতা করলেও অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রেখেই তা করেন। আমরা দুর্নীতির বিরোধিতা করি, অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে ভাঙার লক্ষ্যে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের বুঝতে হবে, কেন তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তাঁদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে মনে করবেন।

এই চিন্তার আলোকে আসুন আমরা দেখি, শোষক ধনকুবের গোষ্ঠী যে সিংহাসনে বসে তাদের শোষণ চালায়, সেই সিংহাসনকে দাঁড় করিয়ে রাখা চারটি পায়ার ভূমিকা কে কি ভাবে পালন করে চলেছে।

সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের চারটি পায়া কারা

এক : সরকার বা শাসক গোষ্ঠী।

আমাদের দেশের সংসদীয় নির্বাচনের চেহারাটা আমাদের কারুরই অজানা নয়। সংসদীয় নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দল শাসনক্ষমতা দখলের দিকে এগোতে চাইলে, লোকসভায় বা বিধানসভায় উল্লেখযোগ্য আসন পেয়ে দাপট বজায় রাখতে চাইলে সেই রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে বিপুল অর্থ ঢালতেই হবে। বর্তমানে নির্বাচন মানেই এক-রাজসূয় যজ্ঞ। বিশাল প্রচার-ব্যয়, রিগিং, বুথদখল, ছাপ্পা ভোট এ- সব নিয়েই এখনকার নির্বাচন। এ এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও মাসলম্যানদের পিছনেও বইয়ে দিতে হয় অর্থের স্রোত। এই শত- সহস্র কোটি টাকা গরিব খেটে খাওয়া মানুষদের এক-টাকা দু-টাকা বা পাঁচ-টাকা চাঁদায় তোলা যায় না। তোলা হয়ও না।

নির্বাচনী ব্যয়ের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি টাকা যোগায় ধনকুবেররাবিনিময়ে তারা এইসব দলগুলোর কাছ থেকে পায় স্বস্তিতে শোষণ চালাবার গ্যারান্টিবড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো কৌশল হিসেবে খেটে খাওয়া মানুষদের কাছ থেকে নির্বাচনী তহবিলের জন্য চাঁদা আদায় করেত দেখাতে চায় মোরা তোমাদেরই লোক

এইসব রাজনৈতিক দলের নেতারা যখন মাঠে-ময়দানে, পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে গরিবি হটানোর কথা বলেন, শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের কথা বলেন, মেহনতি মানুষের হাতিয়ার বলে নিজেদের ঘোষণা করেন, তখন কিন্তু এইসব তর্জন-গর্জনে শোষকশ্রেণীর সুখনিদ্রায় সামান্যতম ব্যাঘাত ঘটে না। শোষকশ্রেণী জানে তাদের কৃপাধন্য, তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের এইসব বজ্রনির্ঘোষ স্রেফ ছেলে-ভুলনো ছড়া; সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষকে ভুলিয়ে রাখার এ এক কৌশল। হজুরের দল চায় এ-ভাবেই তাদের ক্রীড়নক রাজনৈতিক দলগুলো শোষিতদের আপনজনের মুখোশ পরে শোষিতদের বিভ্রান্ত করুক, যাতে তাদের সম্মিলিত ক্ষোভ দানা বেঁধে বিস্ফোরিত হতে না পারে। এই সমাজ-ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শোষণ কায়েম রাখার স্বার্থেই শোষণকারীদের দালাল রাজনৈতিক দলগুলো শোষিত সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নানা ভাবে।

হুজুরদের কৃপাধন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার মধুর লোভে সব সময়ই চায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে।

ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই চায় মানুষ অদৃষ্টবাদী হোক, বিশ্বাস করুক পূর্বজন্মের কর্মফলে, ঘুরপাক খাক নানা সংস্কারের অন্ধকারে। এমন বিশ্বাসগুলো শোষিত মানুষগুলোর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পারলে শোষিত মানুষ তাদের প্রতিটি বঞ্চনার জন্য দায়ী করবে নিজের ভাগ্যকে, কর্মফলকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে।

দেশের আর্থিক ক্ষমতার লাগাম যে ধনকুবের গোষ্ঠীর হাতে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতিকদের, রাজনৈতিক দলগুলোকে। ধনকুবেররা সেই সব রাজনৈতিক দলগুলোকেই অর্থ দিয়ে লালন-পালন করে, যারা গদি দখলের লড়াইয়ে শামিল হওয়ার ক্ষমতা রাখে, অথবা ক্ষমতা রাখে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে দাপট প্রকাশের। বিনিময়ে এইসব রাজনৈতিক দলগুলো শোষণ প্রক্রিয়াকে সমস্ত রকম ভাবে মসৃণ রাখবে।

বিভিন্ন ধনকুবেরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বাড়াবার প্রতিযোগিতা। তারই ফলে কোনও রাজনৈতিক দল ক্ষমতা দখল করার পরও প্রধানমন্ত্রী থেকে বিভিন্ন মন্ত্রী বাছাই নিয়েও চলে ধনকুবেরদের নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। উল্টো দিক থেকে রাজনীতিকরাও বড় বড় কুবেরদের সমর্থন পেতে গোলাম থাকার দাসখত লিখে দেন।

বিষয়টা স্পষ্টতর করতে চলুন আমরা ফিরে তাকাই ১৯৯১-এর জুন মাসটির দিকে। এই সময় আমরা দেখলাম, শ্রীনরসিমহা রাও যিনি কিনা নিজেকে একনিষ্ঠ জ্যোতিষ বিশ্বাসী ও ঈশ্বর বিশ্বাসী বলে ‘প্রজেক্ট’ করেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রীর গদিটি বাগাবার জন্য ভাগ্য ও ঈশ্বরের ইচ্ছার দোহাই না দিয়ে, ‘অবতার’ নামক ঈশ্বরের এজেন্টদের শুকনো আশীর্বাদের উপর ভরসা না করে ধনকুবেরদের কৃপাপ্রার্থী হতে দোরে দোরে দৌড়চ্ছেন। অন্য দিকে শ্রীশরদ পাওয়ারকেও আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর গদি বাগানোর লড়াইতে শামিল হতে এবং একইভাবে ধনিকদের দোরে ধরনা দিতে।

তারপর যা ঘটল, তা সবই ভারতের বিভিন্ন ভাষাভাষি পত্রিকায় চাটনি হিসেবে পরিবেশিত হলো। শ্রীপাওয়ারকে পরাজিত করে নিজের পাওয়ারকে বজায় রাখতে শ্রীরাও বিড়লা, হিন্দুজা, আম্বানিদের মতো বিশাল শিল্পপতিদের বোঝাতে সক্ষম হলেন, তিনি গদিতে বসলে এইসব শিল্পপতিদের স্বার্থেই এবং এইসব শিল্পপতিদের অঙ্গুলি হেলনেই নির্ধারিত হবে ‘ভারত’ নামক দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতি। দেশের রাজা ওইসব শিল্পপতিরাই হবেন, প্রধানমন্ত্রীর পদ ও সেই পদের ক্ষমতায় যেটুকু সম্পত্তি স্বআত্মীয়ে কাচিয়ে তুলতে পারবেন, তাতেই তিনি বিলকুল খুশি থাকবেন।

পত্র-পত্রিকা পাঠে আমরা জানতে পেরেছি, শ্রীরাও নিজের পিছনে সাংসদদের সমর্থন আদায় করতে নাকি নিজের দলের সাংসদ পিছু ৫০ লক্ষ টাকা করে ভেট দিয়েছিলেন। টাকা যুগিয়েছিলেন ‘মিনিস্টার মেকার’ শিল্পপতিরা।

শ্রীপাওয়ারের পিছনেও ছিল একগুচ্ছ শিল্পপতির সমর্থন, তাঁর শিবিরে শামিল ছিলেন কির্লোস্কার, বাজাজ, নাসলি ওয়াদিয়া, গুলাবচাঁদ প্রমুখ শিল্পপতিরা। তাঁরাও শুধু হাতে নামেননি। টাকার থলির ভেট তাঁরাও পেশ করেছিলেন সাংসদদের। কিন্তু বেশি সাংসদদের কিনে ফেলেছিলেন শ্রীরাও সমর্থক শিল্পপতিরা। এইসব খবর প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১-এর ২০, ২১, ২২ জুনের বিভিন্ন ভাষাভাষি দৈনিক পত্রিকায়।

পত্রিকাগুলো কি তবে সেই দিনগুলোতে সিস্টেমকে আঘাত হেনেছিল? আদৌ তা নয়। কারণ তারা পত্রিকার বিক্রি বাড়াতে রসালো চাটনি সরবরাহ করেছিল মাত্র। এইসব সাংসদ কেনা-বেচার হাটে শিল্পপতিদের দালালের ভূমিকায় সেদিন অনেক নামি-দামী সাংবাদিকও অবতীর্ণ হয়েছিলেন, এমন খবরও পত্র-পত্রিকাতেই আমরা দেখেছি বরং এই ধরনের খবর প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রচার মাধ্যম কয়েকটি ধারণা সাধারণ মানুষের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিল : (ক) রাজনীতি ও দুর্নীতি সমার্থক শব্দ। ফলে অসাম্যের রাজনীতিকে (যা দুর্নীতির উপর নির্ভর করেই টিকে থাকে) হটাতে সাম্যের সমাজ গড়ার রাজনীতিতে শামিল তরুণ-তরুণীদের সামাল দেবেন তাদের মা-বাবা ও অভিভাবকরাই। যুক্তি দেবেন, “রাজনীতির মধ্যে ঢুকিস না, যত সব নোংরা ব্যাপার”। (খ) স্বার্থপর একটি শ্রেণী গড়ে উঠবে ও বিস্তৃতি লাভ করতে থাকবে যারা মনে করবে বেঁচে-বর্তে থাকতে গেলে, চাকরি জোটাতে গেলে, মস্তানি করে ‘টু-পাইস’ কামাতে গেলে, প্রমোটর হয়ে সাচ্ছল্যের জীবন কাটাতে হলে, ধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে হলে, নিরুপদ্রবে ব্যবসা করতে হলে, স্কুল-কলেজে অ্যাডমিশন পেতে হলে রাজনৈতিক ছত্র-ছায়ায় থাকতেই হবে। (গ) খোলাখুলিভাবে দেশের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এমন দুর্নীতি এবং তারও পর নেতাদের বুক চিতিয়ে চলা, এবং এই দুর্নীতিগ্রস্তদের ঘৃণা ছুড়ে দেবার পরিবর্তে দেশের সম্মানিত সব বুদ্ধিজীবীদের, শিক্ষাবিদদের গদগদ ভক্তি-প্রকাশের যে ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরে প্রচার মাধ্যমগুলো, তাতে দুর্নীতিকে ঘৃণা করা সাধারণ মানুষ, সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা মানুষ নিরাশার শিকার হয়ে পড়েন। এমন দুর্নীতির সঙ্গে, অসাম্যের সঙ্গে আগাপাশতলা জড়িত থাকা সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টানো এক অসম্ভব চিন্তা মনে করেই আসে নিরাশা, অবদমিত বিষণ্ণতা। এমন নিরাশা ও অবদমিত বিষণ্ণতা বর্তমান সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখতেই সহায়তা করে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনারা ভাবুন, বাস্তবিকই কি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীগুলো সততার সঙ্গেই এই রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতেই এমন খবর প্রকাশ করছেন? না কি, এই সংবাদ প্রকাশের পিছনে ছিল সেই সব উদ্দেশ্য, যেগুলো নিয়ে এতক্ষণ আমরা আলোচনা করলাম। ভাবুন প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনাদের শাণিত যুক্তিই আপনাদের সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে।

বহু কোটি টাকার মূলধন বিনিয়োগের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এক একটি বৃহৎ সংবাদ-পত্র, এক একটি প্রচার মাধ্যমের সাম্রাজ্য। এই সব সাম্রাজ্যের মালিক কোটিপতিদের কাছে এই সব পত্র-পত্রিকা ও প্রচার-মাধ্যমগুলো সাধারণভাবে স্রেফ একটা রোজগারের মাধ্যম, একটা ব্যবসা মাত্র; যেমন ব্যবসা করেন শেয়ার দালাল, বিল্ডিং প্রমোটার, ফিল্ম প্রডিউসার কিংবা বস্ত্রশিল্পের মালিক। এঁরা নিশ্চয়ই অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে লাটে তুলে দিয়ে লোটা-কম্বল নিয়ে নিজেদের বঞ্চিত মানুষদের সারিতে দাঁড় করাতে চাইবে না, চাইতে পারে না। এই সত্যটুকু আমাদের বুঝে নিতেই হবে, সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থেই বুঝে নিতে হবে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একটু চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাবেন— আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নির্বাচনী প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শোষকশ্রেণীর দালালির অধিকার লাভের প্রতিযোগিতা।

গণতন্ত্র মানে কী শুধুই ভোট দেওয়ার অধিকার? সেটাই বা ক’জনের আছে? ছাপ্পা ভোট, বুথ দখল, চতুর রিগিং সেই অধিকারে তো অনেক দিনই থাবা বসিয়েছে।

তারপরও যদি ভোট দেওয়ার অধিকারের প্রসঙ্গ টেনে কেউ বলেন এই দেশের মানুষই কখনও ইন্দিরাকে তুলেছেন, কখনও নামিয়েছেন, কখনও রাজীবকে সিংহাসনে বসিয়েছেন, কখনও বা ছুড়ে ফেলেছেন, কখনও এনেছেন ভি. পি-কে, কখনও পি. ভি-কে, তাঁদের আবারও মনে করিয়ে দেব পরম সত্যটি, অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে বলব কথাটি—মন্ত্রী যায় মন্ত্রী আসে, এদের বহু অমিলের মধ্যে একটাই শুধু মিল—এঁরা প্রত্যেকেই শোষকশ্রেণীর কৃপাধন্য, পরম সেবক। এঁরা শোষকদের শোষণ বজায় রাখার ব্যবস্থা করে দেবার বিনিময়ে আখের গোছান।

দুই : প্রশাসনপুলিশসেনা।

আমাদের দেশ পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ বলে পরিচিত। এদেশে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার। সংবিধানের দেওয়া এই অধিকার রক্ষায় সদা সর্তক কেন্দ্রীয় সরকারের ও রাজ্য সরকারের প্রশাসন বিভাগের আমলারা ও পুলিশরা। এখানে লৌহযবনিকার অন্তরালে মানুষের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয় না। এ’দেশের মানুষ খাঁচার পাখি নয়, বনের পাখির মতই মুক্ত। এ’দেশে সর্বোচ্চ পদাধিকারী রাষ্ট্রপতি আর ওড়িশার কালাহান্ডির মানুষগুলো একই অধিকার ভোগ করে, চুলচেরা সমান অধিকার।

এই ধরনের প্রতিটি কথাকে বর্বর রসিকতা বলেই মনে হয় যখন দেখি, কালাহাণ্ডির মানুষগুলো দিনের পর দিন ক্ষুধার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে প্রতিবাদহীনভাবে মৃত্যুকে মেনে নিল, আর তারই সঙ্গে মৃত্যু ঘটল একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকারের। এ-সব আপনজন হারা বহু মানুষের হৃদয়কে দুমড়ে- মুচড়ে রক্তাক্ত করে। এই রক্তাক্ত হৃদয়গুলোই দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে, যখন দেখে শোষকশ্রেণীর কৃপায় গদিতে বসা কতকগুলো রাজনীতিক ওই একই সময় রাষ্ট্রপতির গণতান্ত্রিক অধিকারসম্মতভাবে দেওয়া ছত্রিশ কোর্সের ভোজসভায় কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে করতে ভারতবর্ষকে ‘সুমহান গণতন্ত্রের দেশ’, ‘সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ’ ইত্যাদি বলে কদর্য বর্বর রসিকতা করছে।

প্রতিটি গণতান্ত্রিক অধিকারই বিড়লা, আম্বানিদের সঙ্গে সঙ্গে দেওয়া হয়েছে রাস্তার ভিখারীটিকে পর্যন্ত। পার্থক্য শুধু রাষ্ট্রশক্তির অকরুণ সহযোগিতায় বিড়লা, আম্বানিদের অধিকারের হাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছেওদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে গিয়ে ভিখারীর অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করতেই শুধু ভুলে গেছে রাষ্ট্রের প্রশাসনএই যা

এদের আইন-কানুন ও নাগরিকদের অধিকারগুলো তৈরি করেছেন ধনিকশ্রেণীর দালাল সাংসদ ও বিধায়করা, রাজনৈতিক দলগুলো। স্বভাবতই সাধারণভাবে আইনের ধারাগুলো তৈরি হয়েছে ধনকুবেরদের স্বার্থকে পরিপূর্ণভাবে রক্ষা করতে।

সংবিধান এ’দেশের মানুষদের খাতায়-কলমে যেটুকু অধিকার দিয়েছে সেই অধিকারগুলো বহিরঙ্গের দিক থেকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংসদ ও বিধায়কদের একটা নিরপেক্ষ চরিত্র খাড়া করতে সচেষ্ট হলেও বাস্তব চিত্র কিন্তু তা নয়। আইনগুলোর মূল, ঝোঁক ধনীদের স্বার্থকে রক্ষা করা। এই মূল ঝোঁককে আড়াল করতেই নিরপেক্ষতার ভান।

সংবিধান এ’দেশের মানুষদের যে অধিকার দিয়েছে, সেই অধিকার বাস্তবিক পক্ষে কতটুকু সংবিধানের পাতা থেকে বাস্তবে নেমে এসেছে?

আমাদের দেশের সংবিধান অনুসারে নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের অন্যতম কর্তব্য হলো জনজীবনের মানোন্নয়ন, জনগণের জন্য খাদ্য, পানীয়-বাসস্থান-শিক্ষা ও পুষ্টির ব্যবস্থা এবং এসবের মধ্য দিয়ে ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্যের উন্নতি। ভারতীয় সংবিধানের ৪৭ নম্বর ধারা-এর ২৪৬ নম্বর সম্পর্কিত ৭ নম্বর তপশিলের রাজ্য তালিকায় ৬ নম্বর সূত্রে আছে, জনজীবনের মানোন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতির কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন করবে রাজ্য সরকারগুলি। সরকারের এই নীতি অনুসারে রাজ্যসরকারগুলো নিজ উদ্যোগে বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য কিছু হাসপাতাল স্থাপন করেছে। জনগণের প্রয়োজনের তুলনায় এই সরকারি বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা খুবই কম। জনগণ যখন বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণের সরকারি ব্যবস্থাকে আপন অধিকার হিসেবে ভাবতে শুরু করল, তখন দুর্নীতি ও ভুল অর্থনীতির জালে জড়িয়ে পড়া দেউলিয়া সরকার প্রমাদ গুনল। জনসাধারণের সংখ্যাগুরু অংশ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার দাবি করলে এই আর্থিক কাঠামোয় সে অধিকার দেওয়া যাবে না। কারণ, একদিকে অর্থসংকট, আর এক দিকে শোষণ প্রক্রিয়াও কিছুটা ব্যাহত হয়। আবার জনগণ যেভাবে উত্তরোত্তর বিনামূল্যে সরকারি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার দাবি করছে, সেই দাবিকে পুরোপুরি অমর্যাদা করলে ভোট-নির্ভর রাজনীতিতে গদি বাঁচানোই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই সংকট শুধু ভারতে নয়, ভারতের মত অবস্থা তৃতীয় বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই। এইসব দেশের শোষিত জনগণ যাতে চিকিৎসা গ্রহণের অধিকার আদায়ের দাবিতে অতিমাত্রায় সোচ্চার না হয়ে ওঠে এবং সেই অধিকার আদায়ের লড়াই অন্যান্য অধিকার আদায়ের লড়াইতে নামতে যাতে উদ্বুদ্ধ না করে, সে দিকেই লক্ষ্য রেখে বিশ্বের শোষকদের একচ্ছত্র নেতৃত্বের অধিকারী দেশগুলো (যারা সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত) নিপীড়িত জনগণের চেতনাকে অন্য দিকে ঘোরাতে চাইল। আর চাওয়ার প্রয়োজনেই

শোষিত জনগণের মগজ ধোলাইয়ের উদ্দেশ্যে রচিত হলো চিকিৎসা নীতির বদলে সবার জন্য স্বাস্থ্য নীতি। ঘোষিত হলো জনস্বাস্থ্য আন্দোলন কর্মসূচি— ২০০০ সালে সবার জন্য স্বাস্থ্য

ঘোষিত জনস্বাস্থ্য নীতি নিশ্চয়ই সুন্দর। ভারত সরকার ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সরকার জন স্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ করছেন এবং কার্যকর করতে চাইছেন—এ খুবই ভালো কথা। কিন্তু আশংকা থেকেই যায়, জনগণের দৃষ্টি চিকিৎসা গ্রহণের অধিকারের দিক থেকে ঘোরাতেই, চিকিৎসার দায়-দায়িত্ব রাষ্ট্রের ঘাড় থেকে কমাতেই স্লোগান- সর্বস্ব এই জনস্বাস্থ্য নীতি হাজির করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারের অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি অবশ্যই স্বাগত জানাবার মত—কারণ, শোষিত জনসাধারণের সার্বিক দাবি খাদ্য, পানীয় জল, শিক্ষা, বস্ত্র, বাসস্থানের দাবি। কিন্তু একি বাস্তবিকই বিশ্বাসযোগ্য যে সরকার জনগণের এই সার্বিক দাবিগুলো মিটিয়ে দেবে? তাহলে তা শোষণের মজাটাই বিদায় নেবে। যুক্তি-তর্কের বাইরে যদি ধরেও নেওয়া যায় সরকার জনস্বাস্থ্যের নীতিকে সার্থকরূপ দেবে, তবুও কিন্তু এর ফলে সরকারের চিকিৎসা নীতি কখনই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে না। কারণ, দেশে রোগী থাকবে, চিকিৎসার প্রয়োজনও থাকবে। রোগীকে রোগমুক্ত করতে চিকিৎসারই প্রয়োজন এবং ‘জনস্বাস্থ্য’ কখনই ‘চিকিৎসা’র সমার্থক নয়।

৯৪-এর শেষ ভাগে পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকার এক ঐতিহাসিক ঘোষণা রাখলেন সরকারি ও সরকার সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে এবং প্রাইভেট স্কুলগুলোতে পর্যায়ক্রমে চালু হবে ক্লাশ ওয়ানে লটারি করে ভর্তির ব্যবস্থা। গত কয়েক বছর ধরে যে ভাবে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মার্কসবাদী মন্ত্রী শান্তি ঘটক থেকে অসীম দাশগুপ্ত পর্যন্ত জ্যোতিষ সম্মেলনগুলোতে গদগদ শুভেচ্ছাবাণী পাঠাচ্ছিলেন, তা যে ওই সব মন্ত্রীদের কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল না, তা পরিষ্কার হয়ে গেল শিক্ষার শুরুতেই শিশু মনে ভাগ্য বিশ্বাসকে মাথায় পেরেক ঠুকে ঢুকিয়ে দেওয়ার এই মার্কসীয় বিপ্লবী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে।

মাননীয় মার্কসবাদী মন্ত্রীরা সাধারণ মানুষকে দেওয়া সংবিধানের অধিকারকে লঙ্ঘন করলেন বললে কম বলা হবে, আসলে বলাৎকার করলেন। সংবিধানের দেওয়া অধিকার মতই রাজ্য সরকার বাধ্য, হ্যাঁ অবশ্যই বাধ্য প্রতিটি নাগরিক ও ভবিষ্যৎ নাগরিকের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে।

সংবিধান স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছে, কোনও ক্ষেত্রেই, হ্যাঁ কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশের অধিকার নেই কোনও মানুষকে হত্যা করার, আইন স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, কোনও আন্দোলন, মিছিল বা বিক্ষোভ দারুণ রকম উগ্র হয়ে উঠলে, জাতীয় বা নাগরিকদের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন করলে পুলিশ শূন্যে গুলি চালাতে পারে, উত্তেজিত জনগণের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে ছত্রভঙ্গ করার জন্য। পুলিশ যদি সরাসরি শারীরিকভাবে আক্রান্ত হয়, যে আক্রমণে প্রাণহানির আশংকা আছে, শুধুমাত্র সেইক্ষেত্রেই পুলিশ আক্রমণকারীদের শরীর লক্ষ্য করে গুলি করতে পারে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে অবশ্যই পুলিশের গুলির লক্ষ্য হবে শরীরের নিম্নভাগ। উদ্দেশ্য পরিষ্কার—যাতে গুলিতে প্রাণহাণী না ঘটে। শরীরের উপরের দিক গুলি চালানোর ফলে মৃত্যু ঘটলে গুলি যে পুলিশ চালিয়েছে তাকে সরাসরি হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হবে।

গুলি চালানোর ক্ষেত্রে সংবিধানের এই অধিকার কবে কোথায় আন্দোলনকারীদের রক্ষা করতে পেরেছে? শিয়ালদহ স্টেশনে শাটার বন্ধ করে যাত্রীদের শরীরগুলোকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়ার পর গুলি চালাবার আদেশ দেওয়া সুলতান সিং গর্বিত ঘোষণা করেন—বেশ করেছেন। সুলতান সিংও হত্যাকারী অন্যান্য পুলিশদের ক’জনকে হত্যার অপরাধে ফাঁসিতে চড়াতে পেরেছে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করতে পেরেছে আমাদের সংবিধান?

আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হত্যা করা আজ পুলিশের অধিকারে পরিণত হয়েছে। এই অসাংবিধানিক অধিকার কি করে লাগাতারভাবে তাদের কাজ করে চলে? রাষ্ট্রযন্ত্র কি তবে সংবিধানকে হাগা-মোছার কাগজের বাড়তি কোনও গুরুত্ব দেয় না?

এ’ দেশের সংবিধানের অনেক অধিকারই এমনি এমনি আসেনি। সংগ্রাম ছাড়া আসেনি। যে সব অধিকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আদায় করা গেছে তার বাইরেও বহু

অধিকারই অধরা রয়ে গেছে, যেগুলো পাওয়ার জন্য মানুষ লড়াই চালিয়েই যাচ্ছে। মানবিকতার বিকাশের জন্য মানুষের যে যে অধিকার একান্তই প্রয়োজন, তা আজও দেয়নি আমাদের দেশ ভারত-এর রাষ্ট্রশক্তি বা সরকার। আজও এ- দেশের মানুষের অধিকার নেই মাথা গোঁজার ছোট্ট ঠাঁইটুকু পাওয়ার। দু-মুঠো ভাত— দু’টো রুটি—একটু ত্যানা জোটাবার জন্য চাকরির অধিকারও আমাদের সংবিধানে নেই। অধিকার নেই সাংসদরা বা বিধায়করা জন-বিরোধী কাজে জড়িত থাকলে বা অঞ্চলের দিকে বিন্দুমাত্র দিকপাত না করলেও তাকে ফিরিয়ে আনার। আমরা আজ যে মানুষের অধিকারগুলো রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছি তা স্পষ্টতই খর্বিত অধিকার।

(রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে আপনার অধিকারকে জানতে পড়ুন ‘সংস্কৃতি : সংঘর্ষ ও নিমাণ’। আপনার অধিকার না জানলে আপনি অধিকার রক্ষা করবেন কি করে?)

এই খর্বিত অধিকার রক্ষার কাজ প্রশাসনের। প্রশাসনকে সাহায্য করতে জনসেবার জন্যই পুলিশ। কিন্তু এই আদায় করা খর্বিত অধিকারের কতটুকু সাধারণ মানুষ ভোগ করেন? কতটুকু আপনি ও আপনার পরিচিত সাধারণ মানুষজন ভোগ করেন? আপনার অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে আপনি কাঁটায় কাঁটায় বিচারে নামুন, দেখবেন আপনার অধিকার প্রতিটি দিন কি বিপুলভাবে খর্বিত হচ্ছে। এই ‘মেরা ভারত মহান’ স্লোগানের দেশটিতে রাস, মিনিবাস, লরির চাকা ঘোরাবার অধিকার কিনতে প্রথমেই উপুড়হস্ত করতে হয় মটোর ভেহিকলস্-এর দপ্তরে, তারপর রফায় আসতে হয় পুলিশের সঙ্গে। কোনও মানুষের অধিকার নেই পুলিশ ও রাজনৈকিত মস্তানদের সঙ্গে রফা না করে ফুটপাত দখল করে আনাজ বেচে, কি কামিজ বেচে নিজের বেঁচে থাকার খোরাক তুলবে। এখানে শেষ সম্বল ভিটে-মাটিটুকু বাধ্য হয়ে বিক্রি করতে গেলেও রাজনৈতিক দাদাদের হাতে কিছু তুলে দিতে হবে। ভাড়াটে তুলবেন, ভাড়াটে বসাবেন, সর্বত্র আপনার আইনি অধিকার ছেঁটে ছোট করতে হবে পাড়ার রাজনীতিকদের সঙ্গে আপোষ করতে গিয়ে। আপনি আপনার আইনি অধিকারে কাজ পাবেন না ইনকামট্যাক্স অফিসে, সেলসট্যাক্স অফিসে, মহাকরণে, মিউনিসিপ্যালিটিতে, কর্পোরেশনে, বিচারালয়ে। সর্বত্র দুর্নীতির বিশাল হাঁ। এ’দেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, হাইকোর্টের আইনজীবীরা হাইকোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে আন্দোলন করেন— আত্মীয় আইনজীবীদের কেসগুলোকে পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে জিতিয়ে দেওয়ার। এদেশে আইনি অধিকার ছেঁটে কিঞ্চিত মুদ্রা হাজির করলে তবেই কাজ মেলে, মেলে ব্যাঙ্ক লোন, টেণ্ডার, পারমিট, পাস হয় বিল, পাস হয় দূরদর্শনের কাহিনী, স্কুল-কলেজে অ্যাডমিশন, কি নয়? জনগণের পাঁচ হাজার কোটি শেয়ার ব্রোকারদের ছোঁয়ায় আদৃশ্য হওয়ার পিছনে অর্থ দপ্তরের ও ব্যাঙ্কের প্রশাসকদের অকুণ্ঠ সহযোগিতা যে কাজ করেছিল, সে প্রমাণ মেলার পর অনেক প্রশাসক বিদায় নিয়েছেন, অনেকে নেননি।

কোথায় প্রশাসন, যারা রক্ষা করবে নাগরিকদের অধিকার? প্রতিটি অফিসেই প্রশাসকদের প্রায় একই চেহারা। ‘সোনায় সোহাগা’র মতই দুর্নীতির সঙ্গে প্রশাসকদের অপূর্ব সহাবস্থান।

এইসব প্রশাসকদের কাজ হলো ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করা। আর সেই ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিটি গোটা বা আধা-মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। এঁরা মন্ত্রীর অনুরোধকে ‘আদেশের বাপ’ মানেন। আর তেমন অনুরোধ রাখতে কোন্ ব্যাটার অধিকার কতটা কাটা পড়ল, দেখতে বয়েই গেছে প্রশাসকদের। প্রশাসক নীতিবাগীশ হলে মন্ত্রীর চলে না। ঠোকাঠুকি অবশ্যম্ভাবী। পরিণতিতে ‘দশচক্রে ভগবান ভূত’! প্রশাসক আউট অথবা কোণঠাসা। মন্ত্রীর দপ্তরের বশংবদ প্রশাসকরা তাই করেন, যা মন্ত্রী চান। মন্ত্রী তাই করেন, যা ধনকুবেররা চান। আপোষ আর দেওয়া নেওয়ার শাঁসে-জলে পুষ্ট হন প্রশাসকরা।

এ’দেশে বহু বিত্তবানই, বহু জোতদারই প্রশাসনকে ট্যাকে গুঁজে রেখে নিজেদের অধিকারের হাতকে দীর্ঘতর করতে সেনা বা বাহিনী পোষে। এইসব বিনা লাইসেন্সের আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীর নামগুলিও নানা বিচিত্র ধরনের—ভূমিসেনা, লোরিকসেনা, ব্রহ্মর্ষিসেনা, এমনি আরও কত নাম। সেইসব বাহিনীর হাতে নিত্যই নিপীড়ত, খেটে খাওয়া মানুষদের গণতান্ত্রিক অধিকার লুণ্ঠিত হচ্ছে। সামান্য ইচ্ছায় এরা গ্রামকে গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, লুটে নেয় মহিলাদের লজ্জা। আর নির্লজ্জের মত সরকার প্রশাসন দেখেও অন্ধ হয়ে থাকে। এই উগ্রপন্থী নরখাদকদের কঠোর হাতে দমন করতে কখনই তো এগিয়ে আসে না সরকার, প্রশাসন, পুলিশ, সেনা? কোন্ গণতান্ত্রিক অধিকারে এই সব সেনাবাহিনী পুষে চলেছে হুজুরের দল? নিপীড়িত মানুষদের দাবিকে দাবিয়ে রাখতে ওদের সেনাবাহিনী পোষা যদি গণতন্ত্র- সম্মত হয়, উগ্রপন্থা না হয়, তবে অত্যাচারিত মানুষদের অধিকার রক্ষার জন্য সেনা গঠন অগণতান্ত্রিক ও উগ্রপন্থা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।

আমাদের দেশের গণতন্ত্র—বীরভোগ্যার গণতন্ত্র। যার যত বেশি ক্ষমতা, যত বেশি অর্থ, যত বেশি শক্তি, তার তত বেশি বেশি গণতন্ত্র। শোষকদের অর্থে গদিতে আসীন হয়ে শোষক ও শোষিতদের সমান গণতান্ত্রিক অধিকার বিলানো যায় না। শাসক ও শোষকরা শুধু এই অধিকারের সীমা ভঙ্গই করে পরম অবহেলে; আর শোষিতদের অধিকার বার বার লাঞ্ছিত হয়, লুণ্ঠিত হয়-এ অতি নির্মম সত্য। আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দেখুন; তাহলেই দিনের আলোর মতন পরিষ্কার হয়ে যাবে ‘গণতন্ত্র’ আছে দেশের সংবিধানে ও বইয়ের পাতায়, গরিবদের জীবনে নয়।

যে দেশের মানুষের দু’বেলা পেট ভরে খাওয়ার অধিকার নেই, বেঁচে থাকার অধিকার নেই, চিকিৎসার সুযোগ সুবিধে গ্রহণের অধিকার নেই, শিক্ষালাভের সুযোগ সুবিধে গ্রহণের অধিকার নেই সেখানে বিড়লা, আম্বানি, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী আর গরিব মানুষগুলোর সমান গণতান্ত্রিক অধিকার এই সমাজব্যবস্থায় কোনও প্রশাসকই দিতে পারবে না

‘মেরা ভারত মহান’ স্লোগানকে বিশাল এক ঠাট্টায় পরিণত করেছে নাগরিক অধিকারের রক্ষক, জনগণের সেবক এ’দেশের পুলিশ বাহিনী। পুলিশ বাহিনী অতি স্পষ্টতই আজ সবচেয়ে সংগঠিত গুণ্ডা বাহিনী। এই বাহিনী প্রতিটি সংগঠিত অপরাধের পৃষ্ঠপোষক। প্রতিটি থানাতেই আড্ডা দিতে আসে মস্তান, খুনে, ছেনতাইবাজ, ওয়াগন বেকার, চোর, ডাকাত, ধর্ষক, ভেড়ির লুটেরা, জমির বেআইনি দখলদার, বাড়ির প্রমোটার, নানা শ্রেণীর দালাল, সিনেমার ব্ল্যাকার ও রাজনীতি জগতের মানুষগুলো। পুলিশ আজ প্রতিটি অপরাধের আঁতি-পাতি খবর রাখে। ‘হিস্যা আদায়ের জন্যেই এলাকার প্রতিটি অপরাধীদের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতে হয়। হিস্যা’র বিনিময়ে তাদের অপরাধের পথ নিষ্কণ্ঠক রাখতে সর্বতোভাবে সাহায্য করে। এমন কি এও হয়, অপরাধের পথ থেকে ফিরতে চাওয়া অপরাধীদের ভয় দেখিয়ে আবার অপরাধ করতে বাধ্য করে। ওরা সীমান্ত চোরাকারবারিদের দেখভাল করে। কোনও ব্যক্তি বা সংগঠন চোরাকারবারিদের কাণ্ড-কারখানা ও মস্তানি দেখে একটু ট্যাঁ-ফোঁ করলে পুলিশ তাদের সারা জীবনের মত চুপ করিয়ে দিয়ে আসে।

পুলিশকে জনগণের সেবক মনে করে, এদেশে এমন একটি মানুষও খুঁজে পাবেন না।

আমাদের, সাধারণ মানুষদের বিশ্বাসের অণুতে পরমাণুতে মিশে রয়েছে “পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা”। পুলিশ অভিযুক্তকে থানায় নিয়ে গিয়ে পেঁদিয়ে বাবার নাম না ভুলিয়ে ছেড়েছে, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের দেশের শহর-গাঁয়ের মানুষদের হয়নি। গোটা দেশেরই একটি রাজ্য পশ্চিমবাংলাকে প্রতীক হিসেবে ধরে নিয়েই গত কয়েকটা বছরের ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বোলাই আসুন। পশ্চিমবাংলায় শুধুমাত্র বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৯৯২-এর নভেম্বর পর্যন্ত পুলিশ কাসট্যাডিতে (custody) বা হেফাজতে অভিযুক্ত মারা গেছেন ১৩৬ জন। Custody কথার অভিধানগত অর্থ ‘নিরাপদ তত্ত্বাবধান’, ‘নিরাপদ রক্ষণ’। সন্তান যেমন পিতা-মাতার নিরাপদ তত্ত্বাবধানে বা হেফাজতেই বড় হয় পরম নিশ্চিন্তে, তদন্ত চলাকালীন তেমন নিশ্চিতেই পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তের থাকাটা আইনমাফিক স্বাভাবিক। সেই আইনকে ভঙ্গ করে পুলিশ যে বর্বরোচিত নির্যাতন অভিযুক্তদের ওপর চালায়, তা অভিজ্ঞতাহীন মানুষদের পক্ষে কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব। অথচ ১৬৩ নম্বর ফৌজদারী দণ্ডবিধি মত পুলিশ কখনই কোনও অভিযুক্তকে মারধর তো করতে পারেই না, এমন কি হুমকি বা ভয় পর্যন্ত দেখাতে পারে না। এই আইনটি-সহ প্রতিটি আইনের রক্ষক হলো পুলিশ। একই সঙ্গে সংবিধান অনুসারে পুলিশ আইনের অধীন। অর্থাৎ কোনও অবস্থাতেই সে আইনকে ভঙ্গ করতে পারে না। ভঙ্গ করলে সেও অবশ্যই অপরাধী, শাস্তি-যোগ্য অপরাধী। কিন্তু আপনার-আমার অভিজ্ঞতা কি বলে? পুলিশ নিজেই আইন মানে না। প্রতিটি মুহূর্তে আইনের রক্ষকদের হাতেই আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। লরি আর বাসের ঘুসে সন্তুষ্ট নয়। চোরাকারবারি, ভেজালদার, ডাকাত, মস্তান, ড্রাগ ব্যবসায়ী, বিল্ডিং প্রমোটার, সবার সঙ্গেই আজ থানা ও পুলিশের দেয়া- নেয়ার সম্পর্ক। আইন ভঙ্গকারীরা আইনের রক্ষকদের ছত্র-ছায়ায় আইন ভাঙছে। আইনের রক্ষকরা আইনের মুখে নিত্য প্রতিটি প্রহরে লাথি কষিয়ে বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের রক্ষকের ভূমিকা নিচ্ছে। বার-বার তাই পুলিশকে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ বয়কট করেছে জঘন্য সমাজবিরোধী বিবেচনায়, চূড়ান্ত ঘৃণায়। এলাহাবাদ আদালতের বিচারপতির ভাষায় “পুলিশ মানে সবচেয়ে সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী।”

প্রসঙ্গতে ফিরি-পুলিশ হেফাজতে মৃত ১৩৬ জনের জন্য কতজন পুলিশকে সরকার শাস্তি দিয়েছে? একজনকেও না। তবে কি ওইসব মৃত্যুর জন্য পুলিশ দায়ী নয়? সকল অভিযুক্তই কি তবে আত্মহত্যা করেছিলেন? একটু চোখ বোলান পৃথিবীর আরও কিছু দেশে, এই যেমন সাউথ আফ্রিকা থেকে শুরু করে ফৌজি একনায়ক শাসিত দেশগুলোতে, দেখবেন ও-সব দেশেও পুলিশ হেফাজতে অত্যাচার সহ্য করার শক্তি হারিয়ে লোকে মারা যায়। ও’সব দেশের সরকারও এদেশের সরকারের মতই পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তো দূরের কথা, কোনও অভিযোগই আনে না।

পুরনো প্রসঙ্গে একটু ফিরে তাকাই। এ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে পুলিশ হেফাজতে ১৩৬ জন অভিযুক্তকে হত্যা করা হলো। আইনের রক্ষকদের হাতেই আইন ধর্ষিত হলো, মানবাধিকার একটা বিশাল তামাশায় পরিণত হলো, তবু রাজ্য সরকার একজনকেও শাস্তি দিল না। যেখানে শাস্তি হয়েছে, সেখানেও দেখা গেছে অত্যাচারিতের আপনজনেদের চেষ্টায় আইনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পথে এই শাস্তি দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

গত দশ বছরে পশ্চিমবাংলায়, কেবল মাত্র পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণ ও নারীর শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে ৪৩টি। ১৯৮৭-র জুলাইতে তারকেশ্বর থানার কনস্টেবল তারই সহকর্মী মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। এদের কতজনের শাস্তি হয়েছে? শুধুমাত্র একজনের কথা জানি, ৯১ সালে মেদিনীপুর জেলার ভগবানপুরের কায়দা বিবিকে থানায় এনে শ্লীলতাহানির প্রমাণে বড়বাবুর একবছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছে। বাকিদের?

শিক্ষিকা অৰ্চনা গুহকে পুলিশ লালবাজারে নিয়ে এসেছিল। উদ্দেশ্য—অৰ্চনাকে জেরা করে তাঁর নকশাল ভাইয়ের খোঁজ জানা। আইনের রক্ষকরা জেরা করতে পারেন, কিন্তু কোনও ভাবেই পারেন না জেরা করে কথা আদায় করার নামে, কোনও মানুষকেই মারধর করতে, ভয় দেখাতে, এমন কি লোভনীয় কোনও টোপ দিতে। ভারতীয় সংবিধানের ফৌজদাড়ি দণ্ডবিধি অনুসারেই এ-সবই বেআইনি। আইন ভাঙলে পুলিশ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করবে। কিন্তু আমরা অভিজ্ঞতায় কি দেখলাম? বর্বরোচিত ও অশ্লীল অত্যাচারে অর্চনা পঙ্গু হয়ে গেলেন। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে তিনি অত্যাচারী পুলিশ অফিসার রুণু গুহনিয়োগীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চালাচ্ছেন ন্যায়বিচারের আশায়, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আশায়। কলকাতা পুলিশের ‘রেগুলেশন’ অনুসারে এই ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে সাসপেণ্ড করার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেই নির্দেশকে অবহেলা করে রাজ্য সরকার ক্রমান্বয়ে রুণু গুহনিয়োগীর পদোন্নতিই ঘটিয়ে গেছে। এ সবই কি মানবাধিকারকে সরকার কর্তৃক লঙ্ঘনেরই প্রমাণ নয়?

৯২-এর শেষ অর্ধে রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় পাঞ্জাব পুলিশ কলকাতার একবালপুর অঞ্চল থেকে দু’জনকে গ্রেপ্তার করলেন “সন্ত্রাসবাদী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ নিবারক আইন” (TADA)-এ। ওদের বিমানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হলো পাঞ্জাবে। দুই নিরস্ত্র মানুষকে বিমান থেকে নামিয়ে পুলিশ তাদের গুলি করে হত্যা করলো। এই তো এই দেশের মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। হত্যাকারী পুলিশদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, হবে না। রাষ্ট্রশক্তি স্বয়ং আজ সন্ত্রাসবাদীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, আইন ভঙ্গকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ, মানবাধিকার ধর্ষণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ।

লেখার এই অংশটা পড়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন—শিখ উগ্রপন্থীরা যখন নিরীহ মানুষদের হত্যা করে, তখন? সে বিষয়ে কি মতামত দেবেন? না কি মুখ বুজে থাকবেন?

এ-জাতীয় প্রশ্ন ওঠে, বার-বারই ওঠে। প্রশ্নকর্তারা কখনও ব্যক্তি, কখনও বুদ্ধিজীবী, কখনও রাজনীতিক, কখনও পত্র-পত্রিকা, কখনও রাষ্ট্রশক্তি। হুজুরের দল ও তার কৃপাধন্যেরা বারবার এমন প্রশ্ন তুলে সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করে নিজেদের বেআইনি কাজের প্রতি জনমত তৈরি করতে চায়, জন-বিক্ষোভ এড়িয়ে মানুষের অধিকারকে ছিনিয়ে নিতে চায়। যারা সরকার-ঘোষিত সন্ত্রাসবাদী, তারা যখনই কোনও নিরীহ বা অ-নিরীহকে হত্যা করছে তখনই দেশের আইন ভঙ্গকারী। শাস্তির স্পষ্ট বিধান দেওয়াই আছে। এবং সেই আইনমাফিক শাস্তি দেওয়ার অধিকার রাষ্ট্রশক্তির আছে। রাষ্ট্রশক্তি সেই আইন মাফিক না চলে আইনকে ভঙ্গ করে যা করছে তা অবশ্যই বে-আইনি, তা অবশ্যই রাষ্ট্র-সন্ত্রাস, তা অবধারিতভাবেই মানবাধিকার লঙ্ঘন।

পুলিশ বার বার দুর্নীতি চালিয়েও পার পেয়ে যায়, কারণ পুলিশ সমাজ কাঠামো বা সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। পুলিশরা আইনের রক্ষার জন্য পরিচালিত না হয়ে, প্রশাসনকে দেশ শাসনে সাহায্য না করে সরকারের ইচ্ছের দ্বারাই পরিচালিত হয়, সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দলের ইচ্ছের দ্বারা পরিচালিত হয়। নির্বাচনে রিগিং হলে কখনও চোখ বুজে থাকে, কখনও বা সরকারের পক্ষে রিগিং পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে—এ’সবই তো আপনি, আমি, আমাদের অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছি।

এইসব জঘন্যতম কাজ-কর্ম, অত্যাচার ও দুর্নীতি ‘পুলিশ’ নামক সবচেয়ে সংগঠিত সরকারী গুণ্ডাবাহিনীকে চালাতে দেওয়া হয়, বিনিময়ে তারা এই অসাম্যের ও দুর্নীতির পক্ষে বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত ব্যক্তিদের হত্যাকারীর ভূমিকায় বার-বার তাদের নিষ্ঠুরতা ও দক্ষতাকে প্রমাণ করেছে।

শোষকশ্রেণীর ও রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিটি আন্দোলনের গতি- প্রকৃতির ওপর যথেষ্ট নজর রাখে রাষ্ট্রশক্তি। সরকারের গোয়েন্দা দপ্তরের রয়েছে বহু বিভাগ। আমাদের রাজ্য সরকারের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টেরই রয়েছে তিরিশের ওপর বিভাগ বা সেল। ছাত্র, রাজনৈতিক দল, দেশের মানুষের যথার্থ স্বার্থ রক্ষায় সংগ্রামী সংগঠন ইত্যাদি প্রত্যেকটা বিভাগের উপর নজর রাখার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা সেল। গোয়েন্দারা এইসব সংগঠনগুলোর উপর নজর রাখেন।

প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীরা গোয়েন্দাদের সাহায্যে তাদের নিজেদের দলের ও বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের উপর নজর রাখেন, নিজের গদিটিকে নিষ্কণ্টক রাখতে। বিভিন্ন দাবি আদায়ের আন্দোলনের হাল-চালের খবর রাখেন, প্রয়োজনে কৌশল হিসেবে কোনও কোনও আন্দোলনকে বাড়তে দেন। অনেক ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলন শোষিত মানুষদের ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার সেফটি ভাল্বের কাজ করে। কিন্তু যখন গোয়েন্দা দপ্তর থেকে খবর মেলে কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা সংগঠন বর্তমান সমাজ-কাঠামো বা সিস্টেমের পক্ষে বিপজ্জনক, তখন পুলিশ হয়ে ওঠে আইন লঙ্ঘনকারী, চরম নিষ্ঠুর অত্যাচারী ও হত্যাকারী। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে প্রথম যাদের সন্ত্রাসকারীর ভূমিকায় নামানো হয়, তারা হলো পুলিশ।

বিরোধী আসনে বসে পুলিশের বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলা রাজনীতির মানুষগুলোই গদিতে বসার অধিকার যখনই পেয়েছে, তখনই আন্তরিকতার সঙ্গেই চেয়েছে, পুলিশ থাক সংগঠিত গুণ্ডাবাহিনী হয়েই, পুলিশ থাক দুর্নীতির নেশায় মশগুল হয়ে। আর এই দুর্নীতিই পুলিশকে করে তুলবে জনগণের সেবকের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের সেবক। ইতিহাস বার বার সেই সত্যকেই আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। আসুন ইতিহাস থেকে এক-আধটা উদাহরণ একটু নেড়ে চেড়ে দেখি।

১৯৭০ থেকে ৭৬-এ কংগ্রেস সরকারের আমলে জেলখানায় ৪০০ বন্দী হত্যা হয়েছিল। কলকাতার কাশীপুর বরাহনগরে এক দিন-রাতের অভিযানে হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছিল। স্থানীয় মানুষ দেখেছে ঠেলায় চাপিয়ে গাদা করে কিভাবে গঙ্গায় ঢেলে দিতে চাপানো হচ্ছে মানুষের দেহগুলোকে। ৭৭-এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের জামানা (‘৭০–৭৭)-র নায়কদের শাস্তি দেবেন। ‘৯২-এর শেষে দাঁড়িয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলেন—কতজন হত্যাকারীর শাস্তি হয়েছে? উত্তর পাওয়া যাবে না।

ক্ষমতার সিংহাসনে যে চারটি পায়া, তারই একটি হলো পুলিশ। অতএব বিরোধী পক্ষে থেকে আইনভঙ্গকারী পুলিশদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যতটা সোজা, ক্ষমতার সিংহাসনে বসে শাস্তি দেওয়া ততটাই কঠিন

অতীত ইতিহাসের দিকে একটু চোখ বোলালে দেখতে পাব, ব্রিটিশ সরকারের বিনা-বিচারে আটকের বিরোধিতা করেছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস বই প্রকাশ করেছিল, “পুলিশরাজ আন্ডার ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া”। ব্রিটিশ বিদায় নিতে ক্ষমতার সিংহাসন বসে কংগ্রেস সেই ‘পুলিশ-রাজ’-কেই বরণ করল।

মূলায়েম সিং যাদব সরকারের আমলে উত্তরপ্রদেশ সরকার সরকারি সিমেন্ট কারখানা বেসরকারি হাতে তুলে দিতে চাইল। প্রতিবাদ জানাল শ্রমিকেরা। পুলিশ গুলি চালিয়ে ১৫ জন শ্রমিককে হত্যা করলো। ভারতীয় জনতা পার্টি ঘোষণা করল, “কাল আমরা শাসন ক্ষমতায় এলে যারা গুলি চালিয়ে নিরীহ শ্রমিকদের হত্যা করেছে, তাদের শাস্তি দেবই।” তারপর উত্তরপ্রদেশের ক্ষমতার সিংহাসনে বসলো ভারতীয় জনতা পার্টি এবং সিংহাসনের একটি পায়া পুলিসরাজকে ঠিক-ঠাক রাখতে জনগণের সামনে ঘোষিত প্রতিশ্রুতিকে ছুড়ে ফেলে দিল আঁস্তাকুড়ে।

এই সিস্টেমে এমনটাই ঘটবে, তা সিংহাসনে প্রতিবিপ্লবী বসুক, কি অতিবিপ্লবী।

প্রায় প্রতিটি দেশই সেনাবাহিনী পোষে প্রতিরক্ষার নামে। জাতীয় আয়ের একটা বিরাট অংশ সেনা-খাতে ব্যয় করে। এবং ইতিহাস থেকে লাগাতার ভাবে দেখেই চলেছি, কি ভাবে সরকার বার বার তার সেনাবাহিনীকে দেশের মানুষদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়েই চলেছে। ইংরেজি পত্র-পত্রিকা ও টিভিতে বি. বি. সি. দেখার সুযোগ যাঁরা পান, তাঁরা প্রায়ই এই ধরনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হন।

এ’দেশের দিকে তাকান, দেখতে পাবেন সেনাবাহিনী সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে বিদ্রোহী দেশবাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছে পুবে, পশ্চিমে, উত্তরে, দক্ষিণে। বাস্তবিকই তাই, নাগাল্যান্ড-মেঘালয় ও তার আশেপাশের অঞ্চলে, পাঞ্জাবে, জম্মু-কাশ্মীরে ও অন্ধ্রে, সর্বত্রই সেনা-সন্ত্রাস। আমি এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে পুব- পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণের আন্দোলনগুলোর প্রতি কোনও ভাবেই সমর্থন বা অসমর্থন প্রকাশ করছি না। এই ঘটনার উল্লেখের মধ্য দিয়ে প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের সামনে তুলে ধরতে চাইছি একটি বাস্তব সত্যকে—সেনাবাহিনী হল ‘সিস্টেম’ বা ‘সমাজ- কাঠামো’ রক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ও শেষ শক্তি প্রয়োগের ধাপ।

‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ জাতীয় অনেক সভা-সমিতি অনেক মিছিল-টিছিল আমরা দেখেছি। তাতে শামিল হতে দেখেছি সংসদের বহু বিরোধী দল ও তাদের ছাত্র- যুব সংগঠনগুলোকে। নামতা পড়ার মত আউড়ে যেতে দেখেছি যুদ্ধের বিপক্ষে ও শান্তির পক্ষে গরম গরম কথা। ওরা শুনিয়েছেন, ধনবাদী-রাষ্ট্রশক্তি ও অস্ত্রব্যবসায়ীদের আপন প্রয়োজনে কি ভাবে নির্ধন মানুষগুলোর উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত ভেঙে দেবার, গুঁড়িয়ে দেবার শপথ-বাক্যগুলো দু’কান দিয়ে ঢোকে বটে, কিন্তু মস্তিষ্ক কোষকে প্রভাবিত করতে পারে না, ভাসা-ভাসা থেকে যায়।

কারা সাম্রাজ্যবাদী? কারা সম্প্রসারণশীল? কাদের চিহ্নিত করব ধনবাদী- রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে? যুদ্ধবাজ দেশ হিসেবে কাদের গায়ে মারব শিলমোহর? প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধ খাতে যারা বাজেট বাড়িয়েই চলে, তাদের বিরুদ্ধে কতখানি সোচ্চার হবো?

এইসব সোজা-সাপটা প্রশ্নের উত্তর দিতেও হাঁস-ফাঁস করেন। ‘যুদ্ধ-শান্তি’র প্রবক্তা নেতারা। এইসব নেতাদের ভোটার তোষণের কথা মনে রাখতে হয়, তাই সদা সত্য কথা বলার বিলাসিতা এঁরা দেখান না। ফলে এইসব কেন্দ্রের তখৎ- এ না বসা শান্তির পায়রা ওড়ানো নেতারা কোনও দিনই সত্যের খাতিরেও উচ্চারণ করতে পারেননি, মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের চক্রান্ত শুধু মার্কিন হামলাবাজরাই করছে না, করছে প্রতিটি অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার সিংহাসনে বসা সরকারই। নিরন্ন মানুষ প্রতিনিয়ত বহুমুখী হামলার সম্মুখীন হচ্ছে। এই হামলা নেমে আসে অর্থনীতির মধ্য দিয়ে, সাংস্কৃতিক চেতনা ও মূল্যবোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মধ্য দিয়ে। এমন কথা বিরোধী পক্ষের নেতারা উচ্চারণ করতে পারেন না, কারণ কেন্দ্রের গদিতে বসলে তাদেরও যে এই সেনাবাহিনীকেই কাজে লাগাতে হবে বেয়াদব দেশবাসীদের শায়েস্তা করতে।

তিন : প্রচার মাধ্যম

আমাদের দেশে প্রচার মাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্রগুলো, দূরদর্শন ও বেতার। ঠিক তার পরের ধাপেই আছে বিপুল প্রচারিত কিছু সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা এবং তারও পরের ধাপে বিদেশী টেলিভিশন।

প্রধানত ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে এবং কিছুটা আঞ্চলিক ভাষার সংবাদপত্র ও দূরদর্শনকে খবর সরবরাহের কাজ করে কিছু এদেশী ও বিদেশী সংবাদ সরবরাহ সংস্থা।

দূরদর্শন জনগণের টাকায় শাসকশ্রেণীর প্রচার মাধ্যম

দূরদর্শন সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। যে দল যখনই গদিতে বসুক, দূরদর্শন তার মূল চরিত্র কিন্তু অপরিবর্তিতই রাখে। নানারূপে, নানাভাবে ভোগবাদী ও অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতির প্রচার চালিয়ে যায়। ভোগে-ত্যাগে মিলিয়ে সব মানুষের মাথাই একই সঙ্গে চিবিয়ে খাওয়া যায় বলেই আমাদের দেশের দূরদর্শন ও বেতার বিপুল বিক্রমে একই সঙ্গে প্রচার করে সাঁইবাবা আর বাবা সায়গলকে। একদিকে ঋষি অরবিন্দের বাণী স্মরণ, আর এক দিকে শারন প্রভাকরের চিত্তহরণ—বস্ত্রহরণ। একদিকে ‘এসো পড়াই’, আর এক দিকে—ধর্ষণ করে দেখাই। একদিকে ‘হে ভারত ভুলিও না’, আর একদিকে ভারতবাসীদের ভুলিয়ে রাখার বিশাল আয়োজন। একদিকে গৈরিক আর নামাবলি জড়িয়ে ভোগের মুখে মুগুর, আর একদিকে ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ দেখতে ভাদ্দুরে কুকুর। একদিকে সতীত্বে- মাতৃত্বে-ত্যাগে নারী মহাশক্তির লীলা, আর একদিকে ফ্যাসান প্যারেডে আধা-ন্যাংটো নারীর মেলা। একদিকে রামকৃষ্ণ মিশনের ‘বিশ্ব ধর্মসম্মেলন’, আর একদিকে সামান্থা ফক্স-ম্যাডোনা-মাইকেল জ্যাকসনের উদোম নৃত্যের ‘মহামিলন’। দূরদর্শনের এমন ভুবন জোড়া ভোগ ও ত্যাগের ফাঁদ থেকে বাঁচা বড়ই কঠিন হে!

আমার এমনতর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কেউ বলতেই পারেন. “দোষটা একা সরকার বাহাদুরের নয়, দোষটা আমাদেরও।”

যিনি এ-ধরনের বক্তব্য রাখেন, তিনি বুদ্ধিজীবী না হয়ে সাধারণ মানুষ হলে বলতে পারি—দোষটা একা তাঁর নয়, দোষটা মগজধোলাইকারী বুদ্ধিজীবীদেরও। বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে মগজধোলাই শুরু করেন বোঝাতে একটা উদাহরণ টানা যায়। ৮ ডিসেম্বর ৯৩ ‘বর্তমান’ দৈনিক সংবাদপত্রের ‘হামলোগ’ কলমে সমর বসু লিখলেন, “বোম্বাই-এর টাকার থলির ক্ষমতা যে কত প্রচণ্ড সে আমরা আঁচও করতে পারি না। সমস্ত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি চলছে কালো টাকায়। সরকার বাহাদুর জানেন না? কিছু করতে পেরেছেন? সামান্য অশ্লীল পোস্টার ছাপা বন্ধ করতে পারেন না যাঁরা তাঁরা কিনা অশ্লীল ফিল্ম বন্ধ করবেন? তাও আবার শীল নাটক করে? দোষটা অবশ্য একা সরকার বাহাদুরের নয়, দোষটা আমাদের রুচিরও। আমরাই চাই এই ধরনের ফিল্ম উপোসি ছারপোকা যেমন চায় সেক্স।”

সমরবাবুর এইটুকু বক্তব্যের দিকে আরও একটু সতর্ক দৃষ্টি দিন। তাহলেই পরিষ্কার দেখতে পাবেন সমাজে অশ্লীল ফিল্মের উপস্থিতির জন্য সরকারকে জোর একহাত নেওয়ার পরই দোষের একটা ভাগ এবং বড় ভাগটাই চাপিয়ে দিয়েছেন জনগণেরই উপর। সরকারকে গাল পেড়ে একদিকে নিজের প্রতিবাদী ইমেজ তৈরি করেছেন, আর একদিকে ‘আমাদের’ কথাটা প্রয়োগ করে ‘জনগণের আপনজন’ মার্কা ইমেজও তৈরি করেছেন। দুয়ের ফাঁদে পড়ে জনগণ আরও বেশি বিভ্রান্ত হবেনই। মারাদোনার সূক্ষ্ম পায়ের কাজের মতই সমরবাবুর কলমের সূক্ষ্ম কাজে জনগণ টালমাটাল হয়ে যান। সমাজ কাঠামোর প্রয়োজনই সমরবাবু অশ্লীলতা দূর করতে চান না। আর তাই তিনি একবারের জন্যেও জনগণের কাছে আহ্বান রাখেন না –আসুন এই অশ্লীল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলি। সুস্থ সাংস্কৃতিক চেতনা জনমানসে ছড়িয়ে দিতে আন্দোলন গড়ে তুলি। সমরবাবুর মতো বুদ্ধিজীবীরা চান, আন্দোলন গড়ে সমস্যার মূলে না পৌঁছে, জনগণ সমাজের বর্তমান অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে নিজেদের বুকের দিকেই আঙুল তুলে দেখাক। সমরবাবু মানুষের মতস্তত্ত্ব বোঝেন। জানেন অন্যায়বোধের দ্বারা সংগ্রামী মানুষেরও মন স্তিমিত হয়।

দূরদর্শন এ’ছাড়া আর একটি কাজ করে থাকে, সেটা হলো, যে দল গদিতে বসে, সেই দলকেই দেয় বাড়তি প্রচার। শাসক দলের গোটা, আধা, পোয়া মাপের নেতাদের প্রতিটি ফিতে কাটাকে টি. ভি. স্ক্রিনে হাজির করতে ‘জো হুজুর’ বলে হাজির থাকে দূরদর্শনের ক্যামেরা।

এ’সবের বহিরাবরণ সরালে আমরা দেখতে পাব, দূরদর্শনের ও বেতারের প্রচারের মূল সুরে রয়েছে শাসকশ্রেণীর মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা (এবং যে দলই শাসন ক্ষমতায় আসুক, প্রতিটি শাসকদলের মতাদর্শের ‘নিউক্লিয়াস’ একই)। শাসকশ্রেণীর মতাদর্শ অবধারিতভাবে এই সিস্টেমের মতাদর্শেরই অংশ।

B.B.C-র নিরপেক্ষতা নেহাৎই ভান

অনেকেরই ধারণা (এই ধারণা বিশেষ করে উচ্চ-শিক্ষিত ও উচ্চ-বিত্তের মানুষদের মধ্যে প্রবল) British Broadcasting Corporation অর্থাৎ B.B.C খুবই নিরপেক্ষ প্রচার মাধ্যম। শাসকশ্রেণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত এই প্রচার মাধ্যম কখনই দূরদর্শনের মত শাসক ও শোষকশ্রেণীর মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে সত্যকে বিকৃত করে না।

বাস্তব সত্য কিন্তু আদৌ তা নয়। B.B.C.-র নিরপেক্ষতার ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, বিশ্বের এই এক নম্বর প্রচার-মাধ্যমটিও বর্তমান সমাজ কাঠামোর (অর্থাৎ অসাম্যের সমাজ কাঠামোর) স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে বিশ্ব জনমতকে পরিচালিত করে। পার্থক্য এইটুকু এই B.B.C.-র নিরপেক্ষতার মুখোশে আছে সূক্ষ্ম তুলির টান।

একটি উদাহরণ টানলে বাস্তব চিত্রটা পরিস্কার হবে আশায় একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি।

B.B.C.-র টেলিভিশন ইউনিটের চ্যানেল-ফোর সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে জনপ্রিয়। চ্যানেল ফোর-এর জন্য যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে একটা তথ্য চিত্র করার ইচ্ছেয় ডিরেকটর, প্রডিউসর রবার্ট ঈগল আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এই নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে দীর্ঘ কিছু মাস ধরে মত বিনিময় চলতে থাকে ফ্যাক্স ও ফোন মারফত।

ভারতে যুক্তিবাদী আন্দোলন নিজেদের বিশ্লেষণী চোখ দিয়ে দেখতে লন্ডন থেকে উড়ে এলেন ঈগল ও তাঁর সহকারী অ্যানা সাইমন। ‘৯৪-এর সেপ্টেম্বরে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ঘুরলেন, দেখলেন, শুনলেন, অনেকের সঙ্গে কথা বললেন, এবং অনেক সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কয়েকজনের পক্ষে ওকালতি করে বোঝালেন, যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে ফিল্ম করতে গেলে ওঁদের ফিল্মে রাখা কতটা জরুরি। এই কয়েকজন তথাকথিত ‘জরুরি যুক্তিবাদী’দের ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি। এঁদের কাউকে দেখেছি বৃহৎ পত্রিকায় অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মের পক্ষে এবং যুক্তিবাদের বিপক্ষে কলম চালাতে অথবা নিজেকে ‘নাস্তিক’ বলে ঘোষণার পাশাপাশি নাস্তিকতা একটা উচ্চকোটির মানুষদের ব্যক্তিগত ব্যাপার-স্যাপার, যা সাধারণ মানুষের বুদ্ধির অগম্য—বলে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে আকাশে নাক ঠেকিয়ে বসে থাকতে। কিংবা, ঈশ্বর-ভূত-জ্যোতিষ—অলৌকিক ক্ষমতার অস্তিত্বের পক্ষে জোরাল সওয়াল করার পাশাপাশি নিজেকে বুক বাজিয়ে ‘যুক্তিবাদী’ বলে জাহির করতে। রবার্ট ঈগলদের নিয়ে এঁদের আদিখ্যেতা ও হ্যাংলামির গোটা ব্যাপারটার উপর আমরা সতর্কতার সঙ্গে নজর রাখছিলাম।

আমরা ঈগলের সঙ্গে এই পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার টেবিলে বসলাম। জানালাম, তোমরা দেখলে, B.B.C-র অনুষ্ঠানে মুখ দেখাবার জন্য কতজন তোমাদের এয়ারকন্ডিশন গাড়িতে চাপাল, পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দিল। আমাদের সেই সংগতি নেই। আমরা কেন্দ্রীয় বা রাজ্যসরকারের কাছ থেকে কোনও আর্থিক সাহায্য নেই না, নেই না কোনও বিদেশী সাহায্য। আমরা সংসদীয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়া কোনও রাজনৈতিক দল নই, যারা ধনীদের থেকে দালালি আদায় করে। আমাদের শক্তি অর্থে নয়, প্রভাবে। আমাদের সংগঠন চলে আমাদেরই চাঁদার টাকায় ও আমাদের লেভি’র অর্থে। তাই তোমাদের আলোচনায় বসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি হোটেলের বার বা কফি-শপ ছেড়ে আমাদেরই এক সদস্যের বাড়িতে। আমরা বর্তমান সমাজ কাঠামোতে আঘাত হানতে চাই, তোমরা এই সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখতে চাও। এই দুই বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়েও আমরা তোমাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা যে কারণে সুযোগ পেলেই বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখি, দূরদর্শনে হাজির হই, সেই একই কারণে তোমাদের সহযোগিতা করতে চাই। কারণটা হল, আমাদের দর্শনের ও আদর্শের প্রচার। আমরা জানি, বৃহৎ পত্রিকাগুলো কখনই আমাদের আদর্শের কথাকে ততদূর পর্যন্ত জনগণের কাছে পৌঁছে দেয় না, যা এই সমাজকাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে আঘাত করতে পারে। কিন্তু ওসব পত্রিকায় লেখার সময় আমরা একটা বিষয়ে সচেতন থাকি, যেন আমাদের বক্তব্যের মূল সুর সম্পাদকের কাঁচির ছোঁয়ায় অন্য কিছু না হয়ে যায়। একইভাবে আমরা নিশ্চিত হতে চাই, তোমরা যে ভাবেই কাঁচি চালাও, আমাদের আদর্শের মূল সুর যেন তাতে বজায় থাকে, তথ্য না বিকৃত হয়।

এই আলোচনার সূত্রেই আমরা ঈগলকে জানিয়েছিলাম, তোমরা নিশ্চয়ই তোমাদের ইচ্ছে মতই ছবি বানাবে। যাকে খুশি নিয়ে, যে ভাবে খুশি তোমাদের ছবি বানাবার স্বাধীনতা যেমন আছে, তেমনই আমাদেরও স্বাধীনতা আছে, তোমাদের ছবিতে আদৌ আমরা মুখ দেখাব কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। তোমাদের এ ব্যাপারটা স্পষ্ট করে দেওয়া ভাল, আমাদের আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য রাষ্ট্রশক্তি একটা সুগভীর চক্রান্ত চালাচ্ছে। এই চক্রান্তেরই ফলস্বরূপ আরও দুটি যুক্তিবাদী আন্দোলনের ধারা আমরা দেখতে পাচ্ছি। একটি বিদেশী সহযোগিতা পুষ্ট, অপরটি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পুষ্ট। এই দুই ধারাই গত কয়েক বছর ধরে নানাভাবে প্রচার করে চলেছে—অধ্যাত্মবাদ অর্থাৎ আত্মা, পরমাত্মা ইত্যাদি বিষয়ক বিশ্বাস কোনও কুসংস্কার তো নয়ই, বরং এ’সব বিশ্বাস নাকি মানুষের মানবতা বিকাশের পক্ষে প্রয়োজনীয় শর্ত। এই দুটি ধারাই প্রভাবে ক্ষীণ হলেও অর্থ বলে বলিয়ান এবং সর্বপরি ওদের পিছনে রয়েছে এ’দেশ ও বিদেশের ধনকুবের গোষ্ঠী। আমরা এটাকে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলে মনে করি। কারণ এ’দেশের সমাজ কাঠামোর উপর আঘাত হানায় আমাদের সাফল্য অন্যান্য দেশের অসাম্যের সমাজ কাঠামোর নিয়ন্তকশক্তিগুলোর কাছে আতঙ্কের কারণ বই কী। এই দুই মেকী যুক্তিবাদী আন্দোলনের ক্ষীণ ধারাকে পুষ্ট করতে নানাভাবে নিরন্তন যে চেষ্টা চলছে, তারই একটি হল—অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী একটি চরিত্র হিসেবে পশ্চিমবাংলার জনগণের সামনে হাজির করা। সরকার নিজেকে যেমন কুসংস্কার বিরোধী চরিত্র বলে হাজির করছেন, তেমনই সুযোগ পেলেই পত্র-পত্রিকায় সগর্ব ঘোষণা রাখছেন—তিনি ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য এবং অলৌকিক ক্ষমতায় পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেন। এটা অবশ্যই সাধারণ মানুষদের মগজ ধোলাই করার একটা চক্রান্তের একটি অংশ বই কিছু নয়। প্রচারের ব্যাপকতায় বহু মানুষই ভাবতে শুরু করবেন—ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য ও অলৌকিকত্বে বিশ্বাস রেখেও যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব। আমরা স্পষ্টভাবে জানিয়ে রাখছি, তোমরা যদি এই আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শরিক হিসেবেই এসে থাক, তাহলে তোমাদের তরফ থেকে নিরপেক্ষতার ভানের আড়ালে কুসংস্করাচ্ছন্ন সরকারকেও একজন যুক্তিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কীত ব্যক্তিত্ব হিসেবে হাজির করার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সরকারের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তুমি যদি জিজ্ঞেস কর—আপনি কি আজ পর্যন্ত কোনও অলৌকিক ক্ষমতাবান মানুষ দেখেছেন? উত্তরে উনি নিশ্চয়ই বলবেন— না। তোমরা ফিল্মে সরকারের এই কথাটুকু রেখে, ওঁর ভূত—ঈশ্বর—ভাগ্য— অলৌকিকে গভীর বিশ্বাসের কথা যদি প্রচার না কর, সে ক্ষেত্রে তোমার এই সত্য গোপনের ফলে কুসংস্কার-বিরোধী যুক্তিবাদী সমিতি ও কুসংস্কারে আগা-গোড়া ডুবে থাকা সরকারের অবস্থান তোমার ফিল্মে একই লেভেলে থাকবে। এই পরিস্থিতিতে পরিষ্কার জানিয়ে দিচ্ছি—তোমরা তোমাদের এই ফিল্মে সরকারকে রাখলে, আমাদের এই ফিল্মের বাইরে রেখ।

মিস্টার ঈগল রাজি হলেন আমাদের শর্তে আমাদের নিয়ে কাজ করতে। বাধ্য হয়েই রাজি হলেন। কারণ স্পষ্ট—বর্তমান পৃথিবীতে একটি দেশেই যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছে, ব্যাপকতা পেয়েছে, মানুষকে আন্দোলিত করেছে। দেশটির নাম—ভারত। একটি মাত্র দলের নেতৃত্বে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে। দলটির নাম— ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি। সুতরাং যুক্তিবাদী আন্দোলন নিয়ে একটা ভাল বাণিজ্যিক ফিল্ম করতে গেলেও আমাদের সমিতির উপস্থিতি অপরিহার্য।

বর্তমান পৃথিবীতে যুক্তিবাদী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সমিতির যে অবস্থানের কথা বললাম, তা ‘কুয়োর ব্যাঙ’-এর চিন্তার ফসল নয়। বরং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যারা পৃথিবী জুড়ে কাজ করছে, তাদেরই মতামতেরই প্রতিধ্বনি। (মূলত মানবাধিকার সংক্রান্ত কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংগঠন নিয়ে গঠিত এক ‘ফেডারেশন’ হ’ল “COUNCIL FOR DEMO- CRATIC & SECULAR HUMANISM,’ সংক্ষেপে” CODESH’। এই CODESH ‘এর অন্যতম সদস্য হ’ল ‘ভারতের মানবতাবাদী সমিতি’ বা ‘HUMANISTS’ ASSOCIATION OF INDIA’। মানবতাবাদী সমিতি হ’ল ‘যুক্তিবাদী সমিতিরই একটি ‘Wing বা শাখা। CSICOP এবং এইজাতীয় যুক্তিবাদী কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত কিছু সংস্থাও ‘CSICOP’ এর সদস্য। সুতরাং এইসব সংস্থার কাজ-কর্ম, জনগণের উপর তাদের প্রভাব ও বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন সংগঠন বিষয়ে তাদের মতামত সব সময়ই জানার সুযোগ আমাদের আছে এবং সে সুযোগ আমরা নিয়েও থাকি।) অতি সম্প্রতি নেওয়া B.B.C.-র মতও এর চেয়ে ভিন্নতর কিছু নয়। আমাদের ‘যুক্তিবাদী’ পত্রিকার জন্য ভিডিও ক্যামেরার সামনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (১৯. ১২. ৯৪) B.B.C-র পক্ষ থেকে রবার্ট ঈগল জানান, পৃথিবীর বহু দেশে বহু আন্দোলন কাছ থেকে দেখার সুবাদেই বলছি, তোমাদের সমিতি যে ভাবে এ’দেশে যুক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলেছে, পৃথিবীর কোনও দেশেই তার ধারে-কাছে থাকা কোনও যুক্তিবাদী আন্দোলনের দৃষ্টান্ত নেই। ইউরোপ ও আমেরিকায় C.S.I.CO.P-র নেতৃত্বে যে যুক্তিবাদের প্রচার প্রচেষ্টা চলছে, তা পুরোপুরি জেমস র‍্যান্ডির ব্যক্তিগত প্রয়াস বই কিছু নয়। ওসব দেশে C.S.I.CO.P- র নাম যত মানুষ জানে, তার একশগুণ মানুষ তোমাদের সমিতির নাম জানে। জেমস র‍্যান্ডি মাঝে-মধ্যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে হাজির হয় বটে, কিন্তু সেও বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনার ব্যাখার কথা বলতে গিয়ে তোমাদের সমিতির নাম টেনে আনে, প্রবীর ঘোষের নাম টেনে আনে। ভারতে বি. প্রেমানন্দ যা করছে, একজন ব্যক্তি হিসেবেই করছে। ওর কর্মস্থল কেরালায়ও ওর সংস্থা Indian C. S. I.CO.P- র কোনও শাখা দেখিনি। ও দু’চার জনকে অলৌকিকতার বিরুদ্ধে কিছু কিছু কৌশল শেখাচ্ছে। ওর কাজ-কর্মের সঙ্গীও একজন কি দু’জন। তোমাদের যে শাখাতেই যাচ্ছি, সেখানেই দেখতে পাচ্ছি প্রচুর টগবগে, মিলিট্যান্ট আদর্শে নিবেদিত

তরুণ- তরুণী। তোমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানে মানুষের ভীড় দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। বুঝতে পারছি তোমাদের ছেলেমেয়েরা মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের আন্দোলিত করে বলেই মানুষের এই স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। তোমাদের আন্দোলনের আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল-তোমাদের লক্ষ্য সাম্যের সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা। অন্য কোনও দেশেই যুক্তিবাদী আন্দোলনে এমন লক্ষ্য রাখার নজির আমি দেখিনি। তোমাদের লক্ষ্য, আমার মনে হচ্ছে, কিছুটা রাজনৈতিক। অন্যান্য যুক্তিবাদী সংস্থার কিন্তু স্পষ্ট একটিই লক্ষ্য—অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপারের ব্যাখ্যা হাজির করা।

আমাদের সঙ্গে মিস্টার ঈগলের ফ্যাক্স মারফত লিখিতভাবে মত আদান- প্রদানের সময়ও আমরা স্পষ্টভাবে আমাদের অংশ গ্রহণের ক্ষেত্রে শর্ত হিসেবে জানিয়েছিলাম, কুসংস্কারাচ্ছন্ন পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে যুক্তিবাদী আন্দোলনের এই ফিল্মে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে, আমাদের ফিল্মের বাইরে রেখ।

ফ্যাক্সে ঈগলের খবর এলো, আমাদের সব শর্তই মেনে নেবার খবর।

ডিসেম্বর ‘৯৪-এ ভারতে এলেন রবার্ট ঈগল চার সঙ্গী নিয়ে ফিল্ম তুলতে। কেরল ও বাঙ্গালোর হয়ে কলকাতায় এলেন। কেরল, বাঙ্গালোরে দু-এক দিনে ছবি তোলা শেষ করলেও আমাদের সমিতির জন্য বরাদ্দ রেখেছেন চোদ্দটি দিন। মাঝখানে দুটি দিন বিশ্রাম। প্রতিটি দিনের প্রতিটি মুহূর্তে ঠাসা প্রোগ্রামে ভরিয়ে দিলাম। নিয়ে গেলাম দুর্গম ও প্রত্যন্ত গ্রামে, আধা শহরে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল। পনের, কুড়ি, পঁচিশ হাজার মানুষ মাঠ-ঘাট ভেঙে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে হাজির হয়েছেন। কি-ইনা দেখানো হয়েছে সে সব অনুষ্ঠানে! চড়কে ঘোরা, কাঁটায় ও খাড়ায় ঝাঁপের মত গ্রামীণ অলৌকিক বিশ্বাস থেকে আধুনিকতম প্যারাসাইকোলজিস্টদের তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতা—সবেরই ব্যাখা দেওয়া হয়েছে, রহস্য ফাঁস করা হয়েছে। হাজির হয়েছি বিখ্যাত বিখ্যাত অবতারদের সামনে সরাসরি চ্যালেঞ্জ নিয়ে। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁদের নিত্যনতুন বুজরুকি B.B.C.-র ক্যামেরার সামনেই ফাঁস করেছি। এরই মধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে এক ফকিরবাবার সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়েছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অতি দক্ষতার সঙ্গে।

বিশ্রামের দুটি দিন রবার্ট ঈগল সদলবলে ছিলেন কলকাতার একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওঁদের কাজকর্মের উপর আমরা নজর রেখেছিলাম। সেই নজর রাখার অঙ্গ হিসেবেই ওঁরা কার সঙ্গে কখন কোথায় দেখা করছেন, কি বলছেন, কোনও কিছুই আমাদের নজরের বাইরে ছিল না। আর তাইতেই আমরা B.B.C.-র এক মিথ্যাচারিতা ও চক্রান্তের হদিস পেলাম। আমরা দেখলাম নিরপেক্ষতা ও সততার প্রতিমূর্তি B.B.C.-র প্রতিনিধি রবার্ট ঈগল একতরফা ভাবে আমাদের দেওয়া তাঁর লিখিত ও মৌখিক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলেন। অতি গোপনীয়তার সঙ্গে সরকারের ছবি তুললেন। কেন এই মিথ্যাচারিতা? কেন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে আইন ভাঙার ঝুঁকি নিলেন? কেন এই নিশ্ছিদ্র গোপনীয়তা রক্ষার প্রয়াস? তবে কি ‘তথ্য গোপন’ অথবা ‘তথ্য বিকৃতি’র মধ্য দিয়ে আমাদের ধসিয়ে মেকী আন্দোলনকে তুলে আনতে এ’এক আন্তর্জাতিক চক্রান্ত?

সে রাতেই আমরা রবার্ট ঈগল ও তাঁর সহকারী অ্যানা সাইমনের বিরুদ্ধে সরাসরি মিথ্যাচারিতা, চুক্তিভঙ্গ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলাম, তাঁদেরই কাছে। প্রথমে এই ষড়যন্ত্রের ও চুক্তিভঙ্গের ব্যাপারটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু যখন একের পর এক প্রমাণগুলো ওঁদের সামনে মেলে ধরে বললাম, “তোমাদের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’কে আমাদের সমিতির কাছে পাঠিয়ে দিও, আমাদের ইনটেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট ওদের ট্রেনিং দিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে”, তখন ওঁরা স্বীকার করলেন, বলতে কী, স্বীকার করতে বাধ্য হলেন—চুক্তি ভেঙেছেন। এও বার বার বোঝাবার চেষ্টা করলেন—পি. সি. সরকার এতই ছোট জাদুকর যে, ইউরোপ- আমেরিকায় ওকে কেউ চেনেই না। তোমাদের মুখেই প্রথম ওর নাম শুনি এবং তোমাদের বিরোধিতার জন্যই আমরা যুক্তিবাদী আন্দোলনকে বিতর্কিত করে তুলতেই ওর ছবি তুলেছি। এটুকু কথা দিচ্ছি তোমরাই প্রায় পঞ্চান্ন মিনিটের ফিল্মের শতকরা নব্বই ভাগ জুড়ে থাকবে। বাকিরা দশ ভাগ। আর সরকার থাকবে মিনিট দু’য়েকের মত।

আমরা জানালাম, তোমাদের এই একতরফা চুক্তি ভঙ্গের জন্য আমরা আর তোমাদের কোনও মুখের কথাতেই বিশ্বাস করছি না। এই যে ‘স্ট্যাম্প পেপার’- এ চুক্তির বয়ান করে এনেছি। মিস্টার ঈগল, তুমি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে তবেই আবার কাজ করব আমরা, নতুবা কাজ বন্ধ।

একদিকে মিস্টার ঈগল আমাদের বোঝাতে চাইলেন, আজ পর্যন্ত কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার উপর তথ্যচিত্র তোলার ক্ষেত্রে B.B.C. কোনও ভাবেই তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় না। B.B.C. বরং যাদের সাক্ষাৎকার নেয় একতরফাভাবে তাদের দিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়, সাক্ষাৎকারটিতে ইচ্ছে মত কাঁচি চালাবার সমস্ত অধিকার B.B.C.-র থাকবে। এই অবস্থায় কোনও ভাবেই আমাদের পক্ষে তোমাদের সঙ্গে কোনও রকম আইনি চুক্তিতে আসা সম্ভব নয়। এলে সেটা হবে B.B.C.-র ইতিহাসে প্রথম ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে তোমরা আইনি চুক্তির জন্য জোরাজুরি করলে আমরা এই চুক্তিপত্রের প্রতিলিপি B.B.C.তে পাঠিয়ে দিতে পারি। B.B.C.-র আইনজ্ঞরা এই চুক্তিপত্র পড়ে যে মতামত দেবেন, আমরা সেই মতই চলব।

আর এক দিকে অ্যানা বোঝাতে লাগলেন, তোমরা ফিল্মের বাইরে থাকলে কী? বরং ফিল্মে থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তোমরা তোমাদের কথা সবচেয়ে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবে।

ওঁরা দু’জন যখন নানা ভাবে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই কথাগুলোই আমাদের কাছে বলে চলেছেন, তখন আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অনড হয়ে রইলাম — হয় চুক্তি, নতুবা আমাদের বাদ দাও। এমনকি যেদিন আমাদের নিয়ে ছবি তুলেছ, তাও ফিল্ম থেকে বাদ দিতে হবে। এটুকু বুঝতে অসুবিধে হয়নি আমাদের এই অনমনীয়তা ঈগল ও অ্যানার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত।

চুক্তিপত্রে স্পষ্ট করে বলা ছিল, আমরা যে সব ঘটনা ঘটিয়ে দেখিয়েছি, এবং আমাদের অনুষ্ঠানে যে জনসমাবেশ হয়েছে, তা অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠান বা জনসমাবেশ বলে দেখানো চলবে না। এমন একটা ‘ক্লজ’ বা ‘ধারা’ চুক্তিপত্রে আনার কারণটিও আমরা স্পষ্ট করেই ঈগলকে ব্যাখ্যা করেছিলাম। বলেছিলাম—তোমরা সত্য সাঁইয়ের কাছে আমাদের সমিতির সদস্যের সঙ্গে ঘুরে এসে স্পষ্ট বুঝে নিয়েছ, সত্য সাঁইয়ের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিভূতির বদলে রসগোল্লা আনার গপ্পোটা সত্যি হবার সম্ভাবনা কতখানি! তোমরা গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসের বিস্তৃত রিপোর্ট পড়ে ট্রেন ভ্যানিসের সত্যতা বিষয়েই জেনে নিয়েছ। এরপরও তোমরা যখন চুক্তি ভঙ্গ করার সমস্ত রকম ঝুঁকি নিয়েও সরকারকে ফিল্মে নিচ্ছ, তখন আমাদের ভাবতেই হচ্ছে, তোমাদের সদিচ্ছায় ও সততায় কতটা বিশ্বাস করব? আগামী দিনে আমাদের ঘটানো ঘটনাগুলো দেখানর পাশাপাশি তোমরা যদি সরকারের মুখ থেকে ব্যাখ্যাগুলো প্রচার করতে থাক! অথবা আমাদের অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া জনতার ঢলকে সরকারের বা বি. প্রেমানন্দের অনুষ্ঠানের দর্শক হিসেবে হাজির কর!

আমরা জানি, তোমরা সরকারের নেওয়া সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করেছ, তুমি কি কোনও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সাধু দেখছ? উত্তরে সরকার বলেছেন, না, আজ পর্যন্ত তেমন কোনও সাধুর দেখা তিনি পাননি।

মিস্টার ঈগল স্বীকার করলেন, হ্যাঁ, সাক্ষাৎকারে এই প্রশ্ন করা হয়েছে।

আমরা বললাম, কেন তারপর তোমরা সরকারকে প্রশ্ন করলে না– তুমি কি ঈশ্বর, ভূত, ভাগ্য ও অলৌকিকের অস্তিত্বে বিশ্বাস কর?

ঈগল বললেন, আসলে ওকে তো যুক্তিবাদী হিসেবে আমরা হাজির করছি না। হাজির করব জাদুকর হিসেবে। সাক্ষাৎকারটা এতটা ছোট ও অকিঞ্চিৎকর যে, সেখানে এই ধরনের প্রশ্ন আনা অবান্তর।

জানালাম, আমরা তোমার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না, ঈগল। সরকারের এই উত্তরটুকু প্রচারিত হলে শ্রোতারা ভুল করে ভাববেনই সরকারও একজন প্রকৃত যুক্তিবাদী। তুমি বাস্তবিকই যদি সরকারকে জাদুকর হিসেবেই প্রজেক্ট করতে চাও, তাহলে এ প্রশ্ন তাকে করতে তো কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়?

ঈগল জানালেন, আসলে সরকারের জন্য এতই কম সময় রেখেছি যে, আবার এইসব প্রশ্ন ও উত্তর হাজির করতে দু’মিনিট চলে গেলে, ওর সাক্ষাৎকার প্রায় পুরোটাই বাদ চলে যাবে। এই বাস্তব অসুবিধের জন্যই আমি আর নতুন করে ওর সাক্ষাৎকার নিতে চাই না।

বললাম, বেশ তো, ওঁর এইসব প্রশ্নোত্তরের জন্য আমাদের থেকেই না হয় সময় কেটে নিও।

 বি. বি. সি. যুক্তিবাদী সমিতির উপর তথ্যচিত্র তুলছে
 বি. বি. সি. যুক্তিবাদী সমিতির উপর তথ্যচিত্র তুলছে

না, বহু লক্ষ কথা চালাচালির পরও ঈগলকে দিয়ে চুক্তিপত্রে সই করাতে পারলাম না। অতএব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম, তোমাদের সঙ্গে আমাদের এখানেই ইতি। কাল থেকে আমরা আর তোমাদের চিনি না।

ফিরে এসে মধ্যরাত পার করে দিয়েও আমরা ভীষণভাবে ব্যস্ত রইলাম আমাদের সমিতির আইনি উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে। শেষ পর্যন্ত ঠিক হলো রাত পোহালে কলকাতা হাইকোর্টে মিস্টার ঈগলদের বিরুদ্ধে চুক্তি ভঙ্গের মামলা আনা হবে, এবং ওদের সমস্ত ক্যাসেট বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টার পাশাপাশি মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ওদের ভারত ত্যাগের প্রচেষ্টা রোখার চেষ্টা করা হবে।

মধ্যরাতের পরও আসতেই লাগল রবার্ট ঈগল ও আরো বহু বিশিষ্ট নাগরিকদের ফোন। রবার্ট কাল দুপুরে আবার আলোচনায় বসতে চান। জানিয়ে দিলাম—দুপুরে? খুব দেরি হয়ে যাবে। চুক্তিপত্রে ঈগলের আগের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও নীতিগত সততার বাইরে কোনও প্রশ্ন আমরা তুলিনি, অতএব সকালের মধ্যে ঈগল চুক্তিপত্রে সই না করলে আইন তার নিজের পথে এগুবে। শেষ পর্যন্ত রবার্ট ঈগল সেই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটালেন – চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করলেন। সাক্ষী হিসেবে সই দিলেন অ্যানা।

চুক্তি মত আমরাই মুখোশধারী যুক্তিবাদীর প্রসঙ্গ টেনে এনে হাজির করলাম সরকার প্রসঙ্গ। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর লেখা ও সাক্ষাৎকার ক্যামেরার সামনে হাজির করে দেখিয়ে দিলাম—তিনি যুক্তিবাদী তো ননই, বরং ভূত-ভগবান-ভাগ্য- অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী কুসংস্কারে আগাপাশতলা ডুকে থাকা একটি মানুষ।

সৎ ও নিরপেক্ষতার প্রতীক B.B.C.-র প্রতিনিধি মিস্টার ঈগল দ্বিধাহীন ভাবে বার বার জানিয়েছিলেন, B.B.C.-র আইনজ্ঞদের মতামত ছাড়া তাঁর পক্ষে চুক্তিতে আসা অসম্ভব। তাহলে আইনজ্ঞের মতামত ছাড়া তিনি চুক্তিপত্রে সই করলেন কেন? এই গোটা ঘটনা কি এ’কথাই স্পষ্ট করে তোলে না, B.B.C.-র নিরপেক্ষতাও একটি ভান মাত্র? ওরাও প্রয়োজনে মিথ্যে কথা বলে, সত্য গোপন করে, সত্য বিকৃত করে, অনাদর্শকে আদর্শ বলে প্রচার করতে সচেষ্ট, সচেষ্ট তথ্য গোপনের সাহায্যে কুসংস্কারে ডুবে থাকা মানুষকেও যুক্তিবাদী বলে প্রজেক্ট করতে। কেন এই মিথ্যাচারিতা? কেন এত ষড়যন্ত্র। প্রিয় পাঠক-পাঠিকা – একটু গভীরে ডুব দিলে দেখতে পাবেন, ওদের এত আয়োজন শুধু অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে।

জানি, এই বই প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার ঈগলের কাছে এই অংশটি অনুবাদ করে পাঠিয়ে দেবার মত বুদ্ধিজীবী এ’বাংলায় কম নেই। জানি, পরিণতিতে আমাদের বিরুদ্ধে B.B.C.-র মত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম নিরপেক্ষতার আড়ালে লুকিয়ে রাখা নখ-দন্ত বিস্তার করতে পারে। কিন্তু তবু সবই লিখলাম। কারণ, বিশ্বাস করি জনগণই শেষ কথা বলে।

এদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা একচেটিয়া মিথ্যে ছাপাবার ও সত্যকে ব্ল্যাক আউট করার স্বাধীনতা

এ’দেশের প্রতিটি বৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র ও প্রতিটি অতি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক, পাক্ষিক বা মাসিক জাতীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর পিছনে মূলধন হিসেবে খাটে কোটি কোটি টাকা। কোটিপতি পত্র-পত্রিকার মালিকদের কাছে ‘পত্রিকা ব্যবসা’ আর পাঁচটা ব্যবসার মতই ব্যবসা। উৎপাদন কর, খদ্দের ধর, বিক্রি কর। আর পাঁচটা ব্যবসার মতই এখানেও – যত বেশি উৎপাদন, যত বেশি বিক্রি, তত বেশি লাভ। অন্যান্য ব্যবসায় বড় ভাবে পুঁজি নিয়োগ করার আগে প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিল্পপতিরা বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা চালান। প্রাথমিকভাবে বুঝে নেন মার্কেটের অবস্থা। তারপরে নামেন উৎপাদনে। বৃহৎ পত্র-পত্রিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সম্ভাব্য পুঁজি বিনিয়োগকারী বিশেষজ্ঞ দিয়ে সমীক্ষা চালান। সমীক্ষকরা কয়েক মাস- ব্যাপী সমীক্ষা চালান নানাভাবে, যার একটা বড় অংশ জনমত যাচাই। তারপর তাঁরা রিপোর্ট পেশ করেন। রিপোর্টে পত্রিকার চরিত্র কি কি ধরনের হলে সম্ভাব্য পাঠক কতটা হতে পারে, তার একটা হদিস দেওয়া হয়। এই সমীক্ষা রিপোর্টের ভিত্তিতে পুঁজিপতি ঠিক করেন তার পত্রিকার চরিত্রের রূপরেখা, ঠিক করেন পেপার পলিসি। কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন সম্পাদক থেকে সংবাদিক। এঁরা প্রত্যেকেই বুঝে নেন পত্রিকার চরিত্রের রূপরেখা, এই রূপেরেখা ভাঙার কোনও স্বাধীনতাই থাকে না সম্পাদক থেকে সাংবাদিক কারুরই। ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা’ বলে যে শব্দটি আমরা অহরহ শুনে থাকি, যে শব্দটি নিয়ে ফি-বছর গোটা কয়েক সেমিনার হয় দেশের বড়-মেজ শহরগুলোতে, সেই শব্দটি একটিই মাত্র অর্থ বহন করে; আর তা হলো সংবাদপত্র মালিকের পত্রিকা- চরিত্রকে বজায় রাখার স্বাধীনতা, যা খুশি লেখার স্বাধীনতা, এবং এই স্বাধীনতা নামের স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে সব সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠিত ভাবে আঘাত হানার স্বাধীনতা।

সম্পাদক থেকে সাংবাদিকরা মালিকের কাছে ‘পেপার পলিসি মেনে লেখার ও তা প্রকাশ করার অলিখিত চুক্তির বিনিময়েই চাকরিতে ঢোকেন। পেপার পলিসিকে অমান্য করার মত ধৃষ্টতা কেউ দেখালে, পরেই দিনই তার স্থান হবে পত্রিকা অফিসের পরিবর্তে রাস্তায়।

সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের এই সীমাবদ্ধতার কথা স্পষ্টভাবে না জানা থাকার দরুন এবং পত্রিকা চরিত্র গড়ে ওঠার কাহিনী অজানা থাকার কারণে পাঠক- পাঠিকাদের মধ্যে একটা বিপজ্জনক ধারণা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে—অমুক পত্রিকা প্রতিক্রিয়াশীল, তমুক পত্রিকা প্রগতিবাদী। ধারণাটা আগপাশতলা ভুল। সমস্ত বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিকরাই এক একটি ধনকুবের, এবং সবারই মূল চরিত্র একই। সমাজ-কাঠামোকে আঘাত না দিয়ে আমি আপনি যত খুশি লম্ফ-ঝম্ফ দিতে পারি। চাই কি, তার জন্য প্রচারও পেতে পারি। কিন্তু ‘সিস্টেম’কে আঘাত দেওয়ার চেষ্টা করলে ওরা প্রত্যাঘাত হানবে সর্বশক্তি দিয়ে। আর প্রচার মাধ্যমের সে শক্তি এতই বিশাল যে সাধারণের কল্পনাতীত। জনগণকে প্রভাবিত করার এই বিশাল শক্তিই তাকে দিয়েছে ‘সিস্টেম’-এর বনিয়াদের এক গুরুত্বপূর্ণ পিলারের ভূমিকা। প্রচার মাধ্যমের অকল্পনীয় শক্তির প্রসঙ্গে পরে আসব, আপাতত প্রসঙ্গে ফিরি।

বৃহৎ পত্রিকাগুলো তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের খদ্দের ধরতে বহিরঙ্গকে সাজায় নানাভাবে। এদের কেউ সি. পি. এম-এর প্রতি জনগণের ক্ষুব্ধতাকে পুঁজি করে খদ্দের ধরতে পত্রিকার চরিত্রকে খাড়া করে। কেউ বা সি. পি. এম-এর জনসমর্থনকে পুঁজি করে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে। কেউ বা জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা বা নেত্রীকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে এবং তারই সঙ্গে পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ইমেজ বা সরকার-বিরোধী ইমেজ তৈরি করে কাগজের বিক্রি বাড়িয়ে চলে। এইসব পত্রিকাগুলোর সম্পাদক থেকে সাংবাদিকদের অবস্থান মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গল, মহামেডানের ফুটবল টিমের কোচ ও খেলোয়াড়দের মতোই—যখন যে দলে খেলবেন, সেই দলকে জয়ী করতেই সচেষ্ট থাকেন। প্রতিক্রিয়াশীল পত্রিকা বলে যাকে আপনি গাল পাড়েন, তারই অতিক্ষমতা সম্পন্ন দুদে বার্তাসম্পাদক কিংবা ঝান্টু সাংবাদিক আপনার মনে হওয়া প্রগতিবাদী পত্রিকায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবিকার স্বার্থে কলম থেকে ঝরাতে থাকেন বিপ্লবী আগুন। একই ভাবে বিপরীত ঘটনাও ক্রিয়াশীল। প্রগতিশীল পত্রিকার বিপ্লবী কলমও টিম পাল্টাবার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবিপ্লবী কলম হয়ে ওঠে। এই জাতীয় উদাহরণ কিন্তু ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত নয়, বরং সাবলীল গতিশীল। এইসব বিপ্লবী, প্রতিবাদী, প্রতিবিপ্লবী, বুর্জোয়া প্রভৃতি প্রতিটি বাণিজ্যিক পত্রিকার মালিকদের মধ্যে অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে। একজনকে ধন-সম্পদে আর একজনের টপকে যাওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু নিজেদের অস্তিত্বের পক্ষে বিপজ্জনক কোনও শক্তির বিরুদ্ধে মোকাবিলার ক্ষেত্রে ওরা দারুণ রকম এককাট্টা।

সংবাদপত্রগুলোর ভানের মুখোশটুকু সরালে দেখতে পাবেন, প্রতিটি সংবাদপত্রই বর্তমান সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে জনমতকে পরিচালিত করে এবং বহিরঙ্গে এরা সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের কিছু কিছু দুর্নীতির কথা ছেপে সিস্টেমকে টিকিয়ে রাখার মূল ঝোঁককে আড়াল করে। এমন সব দুর্নীতির কথা ‘পাবলিক খায়’ বলেই পত্রিকাগুলো ছাপে। এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার চাবিকাঠি যাদের হাতে, তারা জানে, এমন দু-চারটে দুর্নীতি ধরার লালিপপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে কি ভাবে অত্যাচারিতের ক্ষোভের আগুনে জল ঢালতে হয়। তারা জানে, সিস্টেমের প্রেসার কুকারে নিপীড়িতদের ফুটন্ত ক্ষোভকে বের করে দেওয়ার ‘সেফটি ভালভ’ হলো মাঝে-মধ্যে দু-চার জনের দুর্নীতি ফাঁস। পরে অবশ্য শাস্তি- টাস্তি না দিলেও ক্ষতি নেই। জনগণের স্মৃতি খুবই দুর্বল। ভুলে যাবে প্রতিটি ঘটনা, যেভাবে ভুলেছে বফর্স কেলেংকারি, শেয়ার কেলেংকারি। আর এর ফলে এক- আধটা রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ বা প্রশাসক যদি বধ হয়, তাতেও অবস্থা একটুও পাল্টাবে না। ফাঁকা জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না, থাকবে না। এক যায়, আর এক উঠে আসে।

আমার বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে একটা দৃষ্টান্ত বেছে নিতেই পারি। বরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্যের সময় শ্মশানে স্বপন নামের জনৈক রাজনৈতিক মস্তানের হাতে লাঞ্ছিত হন মন্ত্রী থেকে যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার, বুদ্ধিজীবী থেকে প্রাক্তন সাংসদ পর্যন্ত। পুলিশ স্বপনকে গ্রেপ্তার করলো। প্রচার মাধ্যমগুলোর হৈ-চৈ’ তে স্বপন-বিরোধী একটা জনমত সৃষ্টি হলো। স্বপনকে রাজনৈতিক নেতারাও বাঁচাতে পারলেন না। স্বপনের ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল। সরকার এমন দৃষ্টান্তমূলক দৃঢ়তা দেখানোয় অনেকে তুষ্ট হলেন। যে-সব রাজনৈতিক ও পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা স্বপনের বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে কৃতার্থ হতেন, তাঁদের নাম প্রকাশ পাওয়ায় পত্রিকার এমন মহান ভূমিকায় অনেকেই উদ্বাহু হলেন, আমন্ত্রণ-গ্রহণকারীদের নামে টি-টি পড়ে গেল।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, আপনারা এবার একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, কালীঘাট এলাকার মস্তান স্বপন ধ্বংস হলো বটে, কিন্তু কালীঘাট মস্তানমুক্ত হলো না। স্বপনের জায়গা নিল স্বপনের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক-মস্তান শ্রীধর।

স্বপন এক বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি ও প্রচারমাধ্যমগুলোর সামনে এমন অশালীন তাণ্ডব ও হামলা চালানোয় জনগণের মধ্যে যে তীব্র ক্ষুব্ধতা দেখা দিয়েছিল, সেই ক্ষুব্ধতার আগুনকে প্রশমিত করতেই স্বপনের শাস্তির চুষিকাঠি জনগণের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লাখো স্বপনের স্রষ্টারা থেকে গিয়েছিল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

স্বপনের মতো হাজারো, লাখো সমাজবিরোধী তো একদিনে গজিয়ে ওঠেনি। রাজনীতির প্রয়োজনেই এদের সৃষ্টি। সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টা চিরকালই মহৎ। তাই স্বপনের স্রষ্টারা অন্তরালে থেকে এক স্বপন গেলে আর এক স্বপন সৃষ্টির আনন্দে মেতে ওঠে। স্বপনদের জায়গা কোনও দিনই ফাঁকা থাকে না। এক যায়, আর এক উঠে আসে।

আরো একটু তলিয়ে দেখুন, স্রষ্টা রাজনীতিকরা শেষ হয়ে গেলে সে জায়গা কখনও ফাঁকা থাকে না। যেমনভাবে স্বপনের সমর্থক রাজনৈতিক দলের জায়গা দখল করেছে স্বপনের বিরোধী রাজনীতিকরা—শ্রীধরকে দিয়ে। রাজীব গান্ধীর জায়গা দখল করেছেন রাজীবেরই দলের পিভি নরসিমা। রাজা যায়, রাজা আসে। আসন ফাঁকা থাকে না। আসন ফাঁকা থাকতে দেয় না আমাদের সমাজ কাঠামো, আমাদের ‘সিস্টেম’।

এইভাবে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্তরা আসে এবং বিদায়ও নেয়, কিন্তু দুর্নীতি টিকেই থাকে। এই দুর্নীতির সূত্রেই বাঁধা পড়ে থাকে ‘সিস্টেম’কে টিকিয়ে রাখার সহায়ক শক্তিগুলো।

কখনও কখনও বিশাল বাণিজ্য সাম্রাজ্যের অধিকারীরা রাজনীতিকদের উপর প্রভাব বিস্তার করে নিজের ক্ষমতা রক্ষা ও বর্ধিত করতে পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হয়। এখানেও কিন্তু বাণিজ্য-সম্রাটের পক্ষে পত্রিকার বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকা সম্ভব হয় না। যে পত্রিকা বিক্রি হয় না, তাকে কোন রাজনীতিক পাত্তা দেবে?

যে-সব সাংবাদিক বা সংবাদপত্রকর্মী সমাজের প্রতি দায়বন্ধতা অনুভব করেন, দুর্নীতির শিকল ভেঙে সুসংস্কৃতির সমাজ গড়তে চান, তাঁদের পক্ষেও কলমকে হাতিয়ার করে পত্রিকাকে রণভূমি করা সম্ভব হয় না। কারণ পত্রিকায় ব্যক্তি ইচ্ছে বা ব্যক্তি আবেগের স্থান সীমাবদ্ধ। পত্রিকার পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একজন সাংবাদিককে কলম চালাতে হয়। কোনও সাংবাদিকের পক্ষে একজন ব্যক্তি বা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ততক্ষণই সহযোগিতা করা সম্ভব যতক্ষণ না পেপার পলিসি ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিপক্ষে যায়।

পেপার পলিসি কাউকে ব্ল্যাক-আউট করতে চাইলে বা কারও বিপক্ষে গেলে তাকে পত্রিকার প্রচারে আনা বা তার পক্ষে লেখা কোনও সাংবাদিকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। কিন্তু পত্রিকা মালিক যদি দেখেন কাউকে ব্ল্যাক-আউট করার ফলে অথবা কারও বিপক্ষে লেখার ফলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, পত্রিকা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মুখে, তখন ব্যবসার স্বার্থেই তাঁরা পলিসি পাল্টে ফেলেন, ডিগবাজি খান। এই ডিগবাজি খাওয়াটাও ততক্ষণই সম্ভব, যতক্ষণ না ওই ব্যক্তি বা সংস্থা পত্রিকা মালিকের অস্তিত্বের পক্ষে চূড়ান্ত সংকট হিসেবে হাজির হচ্ছে।

বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকার বাস্তব কাঠামো বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, ভুল বোঝার অবকাশ বেশি থাকে। আর এই ভুলই বহু সৎ ও গতিশীল আন্দোলনে ধস্ নামাতে পারে। সত্যিকারের আন্দোলনের পাল থেকে জনসমর্থনের হাওয়া কেড়ে নিতে মেকি আন্দোলনকারী খাড়া করে তথাকথিত প্রগতিশীল পত্রিকা যখন ময়দানে নামে, তখন পত্রিকা-চরিত্র বিষয়ে ভ্রান্ত ধারণা বহু সমর্থককে, বহু আন্দোলন-কর্মীকে, বহু নেতাকে আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

বিভিন্ন প্রচার-মাধ্যম বা পত্র-পত্রিকা যেমন বিভিন্ন শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্বকে ‘পেপার পলিসি’র পক্ষে কাজে লাগায়, নিজস্ব ছাঁচের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ার পক্ষে কাজে লাগায়, তেমনই শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও সংগঠনের নেতৃত্ব বা আন্দোলনের নেতৃত্ব কেন পারবে না পত্র-পত্রিকা ও প্রচার- মাধ্যমগুলোকে যতদূর সম্ভব কাজে লাগাতে? কাজে লাগানো সম্ভব। অবশ্যই সম্ভব। সৎ, নিষ্ঠাবান, নির্লোভ ও লক্ষ্য সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তিত্ব চেষ্টা করলে দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ না করে, প্রচার মাধ্যম দ্বারা ব্যবহৃত না হয়ে প্রচার-মাধ্যমকেই ব্যবহার করতে পারেন।

যে পত্রিকার পাঠক সংখ্যা যত বেশি, জনগণকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাও তার তত বেশি।

বাংলা ভাষার সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকার দিকে একটু সচেতনতার সঙ্গে ফিরে তাকান, দেখতে পাবেন ওই পত্রিকা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে মানুষের মাথায় ঢোকাতে চায়, সমাজের সেরা লেখক, সেরা শিল্পী, সেরা বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের পত্রিকায় লেখেন, আঁকেনফলে ওই পত্রিকায় স্থান পাওয়া, জনগণের কাছে শ্রেষ্ঠত্বের ছাপ পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়এর পর ওরা ইচ্ছে মতন একজনকে প্রচারের তুঙ্গে তুলে নিয়ে যান, একজনকে ব্ল্যাক আউট করে জনগণ থেকে নির্বাসিত করেনজনপ্রিয় সব পত্রিকাই কমবেশি একই মানসিতার দ্বারা পরিচালিত হয়

আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপনের দিকে আপনাদের দৃষ্টিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। “কোনো সমকালীন বিখ্যাত লেখকের নাম মনে করতে পারেন যিনি দেশ শারদীয় সংখ্যায় লেখেন নি?” (২৮ আগস্ট ৯০, আনন্দবাজার পত্রিকা)

এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে গর্বিত ঘোষণা স্পষ্ট—যাঁরা দেশ শারদীয় সংখ্যায় লেখার সুযোগ বা সম্মান পাননি, তাঁরা কেউই প্রকৃত অর্থে লেখকই নন।

জানি না, আনন্দবাজার গোষ্ঠী (‘দেশ’ পত্রিকা আনন্দবাজার গোষ্ঠীর সাহিত্য পত্রিকা, যা একশ্রেণীর তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে, সাহিত্যের শেষ কথা বলার পত্রিকা) অমিয়ভূষণ মজুমদারের নাম শুনেছেন কি না—যিনি মননশীল পাঠক- পাঠিকাদের কাছে সাহিত্যিক হিসেবে অগ্রগণ্য। শারদীয় দেশ কি আজ পর্যন্ত অমিয়ভূষণের লেখা ছাপাবার সম্মান ও যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন? বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মন, তপোবিজয় ঘোষ কোনও দিনই আনন্দবাজার গোষ্ঠীর পত্রিকায় না লিখেও বাংলা সাহিত্যে তাঁদের অবদানের জন্য সমঝদার পাঠক-পাঠিকাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছেন। যতদূর মনে পড়ছে মিহির আচার্য, দেবেশ রায়, উদয়ন ঘোষ শারদীয় ‘দেশ’-এ কোনদিন লেখেননি। যে কমলকুমার মজুমদারকে আজ আনন্দবাজার গোষ্ঠী নিজেদের ‘আপনজন’ হিসেবে প্রচার করতে অতিমাত্রায় সচেষ্ট, সেই কলমকুমারও ‘দেশ’ শারদীয়ের লেখক ছিলেন না। কিন্তু এই ধরনের গর্বিত বিজ্ঞাপনও সরলমতি পাঠক-পাঠিকাদের মাথা খায়। অবশ্য মাথা খাবার জন্যই এমন বিজ্ঞাপনের সৃষ্টি। একথা বলার জন্যই আমি উদাহরণগুলো টানলাম যে, ‘দেশ’-শারদীয়’তে না লিখেও এঁরা লেখক হিসেবে খ্যাতির অধিকারী।

হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। পত্রিকার সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কি তবে কোনও স্বাধীনতা নেই? ক্ষমতা নেই? নিশ্চয়ই আছে। ওদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা আছে, পেপার পলিসির সঙ্গে সংঘর্ষে না নামা কাউকে প্রচার দেওয়া, বা বিশেষ কোন সুযোগ- সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আইনি অধিকার বা বে-আইনি সুবিধে আদায়ে সহযোগিতা করা, অপছন্দের মানুষ বা সংস্থাকে কিঞ্চিত টাইট দেওয়া। এবং স্বভাবতই এই ক্ষমতা একটু বেশি পরিমাণেই থাকে সম্পাদকের ও তাঁর প্রিয় সাংবাদিকদের। অনেক সময় ওদের কৃপায় অনেক ‘না’ ‘হ্যাঁ’ হয়ে যায়, অনেক ‘মিথ্যে’ হয়ে ওঠে ‘সত্যি’, অনেক জোনাকি মিথ্যে প্রচারের আলোতে নক্ষত্র হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে কিংবদন্তি।

এই বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে একটা দৃষ্টান্ত বেছে নিতেই পারি।

স্বাধীনতার নামে হলদে সাংবাদিকতা ও প্রতারণার এক অন্যন্য নজির ট্রেন ভ্যানিশ’

আপনারা প্রায় প্রত্যেকেই শুনেছেন জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর যাত্রী বোঝাই অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশের কথা। জেনেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা পড়ে, অথবা অন্য কারও মুখ থেকে। ঘটনাটা দেখেছেনও অনেকে, দূরদর্শনের পর্দায়। কিন্তু অল্পজন জেনেছেন, এই ট্রেন ভ্যানিশের প্রচারটা ছিল চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতা, ইয়লো-জার্নালিজিমের এক ক্লাসিক প্যাটার্ন।

যাত্রী বোঝাই গোটা একটা অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশের সুবাদে সরকার আজ কিংবদন্তি-মানুষ। কিন্তু ওই জাদুর খেলায় না ছিল অমৃতসর এক্সপ্রেস, না হয়েছিল ভ্যানিশ। আসলে আদপেই ওটা ম্যাজিক ছিল না। কারণ, ম্যাজিকটা কেউই দেখেননি। দেখানো হয়নি বলেই দেখেননি। দূরদর্শনে ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে যে গ্রামবাসীদের দেখা গিয়েছিল, তাঁদের বলা হয়েছিল—সিনেমার শ্যুটিং হবে। ওঁরা শ্যুটিং দেখার দর্শক হতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছিলেন। কারণ, ওঁদের একজনও অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ হতে দেখেননি। অথচ ওঁদের যাত্রীবোঝাই ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে দূরদর্শনের পর্দায় হাজির করা হয়েছিল। কোনও বিশিষ্ট দর্শকও সেদিন প্যাসেঞ্জার ঠাসা অমৃতসর এক্সপ্রেস ভ্যানিশ হতে দেখেননি। কারণ অমৃত এক্সপ্রেসও ছিল না, ভ্যানিশও হয়নি। দূরদর্শনের পর্দায় যা দেখানো হয়েছিল সেটা ছিল দর্শকদের প্রতারিত করার এক নির্লজ্জ দৃষ্টান্ত।

এটা জাদুর ক্ষেত্রেও এক ঐতিহাসিক অনৈতিক ঘটনা। যে জাদু কেউ দেখল না, যে জাদু কেউ দেখাল না, সে জাদু দেখানো হয়েছে বলে প্রচার করাটা একটা বড় মাপের সংগঠিত প্রতারণার দৃষ্টান্ত বই কিছু নয়।

এসব শোনার পরও আমার পরিচিত এক সাংবাদিক বলেছিলেন, “জাদুর ব্যাপারটাই তো কৌশল”। বলেছিলাম, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই কৌশল, কিন্তু তারও একটা নির্দিষ্ট নীতি আছে। জাদুকর যখন দেখান একটা মানুষ শূন্যে ভাসছে, তখন তা দেখানোর পিছনে যে কৌশলই থাকুক, দর্শকরা কিন্তু তাদের চোখের সামনে দেখতে পায়, একজন শূন্যে ভাসছে। আমরা এই শূন্যে ভাসার দৃশ্য না দেখে কখনই বলব না, জাদুকর আমাদের সামনে একটা মানুষকে শূন্যে ভাসালেন। ট্রেন ভ্যানিশের ঘটনার যে প্রচার হয়েছে, সেখানে কোনও দর্শকই যখন ট্রেন ভ্যানিশ হতেই দেখলেন না, তখন এটাকে শুধু জাদুর নীতি মতই নয়, কোনও নীতিতেই ‘দেখানো হয়েছে বলে প্রচার করা যায় না।”

“আবার দেখুন, দেখা এবং দেখানরও একটা নীতি আছে। যে খানা জংশনের কাছে তথাকথিত জাদুটি দেখানো হয়েছিল, সেখানকার অবস্থানগত কারণে প্রতিটি ট্রেনই ঢাল বেয়ে নেমে যাওয়ার কারণে এক সময় দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। কেউ কোনও ফেস্টুন দিয়ে আড়াল করে ট্রেনকে চলে যেতে দিলে যদি সেটা ট্রেন ভ্যানিশ হয়েছে বলে বিবেচিত হয়, তাহলে আগামী যে কোনও দিন একই পদ্ধতিতে শিয়ালদা স্টেশনে আপনার চোখের সামনে দশ ঘণ্টায় শ’খানেক ট্রেন ভ্যানিশ করে দেখাতে পারি। আর সে জন্য আমাকে এমন কিছু করতে হবে না, একটা করে ট্রেন ছাড়বে, আপনার দৃষ্টির সামনে মেলে ধরব একটি রুমাল। মিনিট খানেকের মধ্যেই বাঁক নিয়ে ট্রেনগুলো দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে থাকবে, আর আপনি ভ্যানিশ হওয়া ট্রেনের সংখ্যা গুনতে থাকবেন, পরের দিন আপনার কাগজের প্রথম পাতায় খবরটা ছাপাবেন বলে।” সব শুনে সাংবাদিক বন্ধুটি বললেন, ও এই ব্যাপার! কিন্তু এই করেও তো উনি দিব্বি কিংবদন্তি বনে গেলেন।”

হ্যাঁ কিংবদন্তি বনে গেলেন, সংবাদ মাধ্যমের মিথ্যাচারিতাতেই বনে গেলেন। আসল ঘটনা কি? আসুন সেদিকে আমরা ফিরে তাকাই।

সে-দিন ট্রেন ভ্যানিশ হতেও কেউ দেখেননি। কোনও আমন্ত্রিত বিশিষ্ট দর্শকও অমৃতসর এক্সপ্রেসকে যাত্রী-সহ ভ্যানিশ হতে দেখেননি। তবু এই না দেখা, না ঘটা ঘটনার খবরই প্রকাশিত হলো ১২ জুলাই, ১৯৯২। খবরের সঙ্গে দূরদর্শন দেখাল সেই না ঘটা ঘটনার ছবি। পরের দিন একটিমাত্র পত্রিকা ‘আনন্দবাজার’- এ প্রকাশিত হলো খবরটি। তারপর সরকার খবর থেকে কিংবদন্তি।

ঘটনাটা খুবই সাদামাঠা। সরকার ইস্টার্ন রেলের কাছ থেকে ভাড়া করেছিলেন একটা ইঞ্জিন ও ছ’টা কোচ। ইঞ্জিনটা ডিজেল চালিত, ইঞ্জিনের নম্বর 1/405। ছ’টা কোচের পাঁচটা সাধারণ, একটা A.C.। ইঞ্জিন এলো আন্দুল লোকোশেড থেকে। ছ’টা কোচ নিয়ে নকল ‘অমৃতসর এক্সপ্রেস’ এসে দাঁড়াল খানা জংশনের অনতিদূরে, খানা লিংক কেবিনের কাছে। ডাইভার ছিলেন অনিলবরণ দত্ত। কোনও গার্ড বা টিকিটচেকার ছিলেন না। দর্শকরা জানতেন, ওই ছ’কোচের ট্রেনটি ‘অমৃতসর এক্সপ্রেস’ নয়, শ্যুটিং-এর জন্য ভাড়া করা। ট্রেনে যাঁরা যাত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তাঁরা সরকারের কর্মী ও রেল কর্মী। দর্শকদের বসানো হয়েছিল নিচু খেতে ও তার কাছাকাছি। কোচ নিয়ে ইঞ্জিন যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে চার জোড়া লাইন চলে গেছে। চার জোড়ার দু’জোড়া লাইন হঠাৎ গেছে নেমে। এই লাইন দিয়ে ট্রেন একটু এগুলোই উঁচু মাটির আড়ালে চলে যায়।

ওই অনুষ্ঠান দেখতে একটি মাত্র পত্রিকার সাংবাদিক আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি হলেন, আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপের শংকরলাল ভট্টাচার্য। ভিডিও রেকর্ডিং-এর জন্য উপস্থিত ছিলেন দূরদর্শনের সংবাদ পাঠিকা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য। ইন্দ্রাণী শংকরলালের জীবনসঙ্গিনীও।

‘ট্রেন চলার পূর্ব মুহূর্তে ট্রেনকে আড়াল করতে তুলে ধরা হলো ব্যানার। দর্শকদের সামনে ব্যানার, কানে জেনারেটরের বিশাল শব্দ। সঙ্গে বাজি-পটকার ঘন- ঘন শব্দ ও ঘন ধোঁয়া। ছবি রেকর্ডিং-এর দায়িত্বে ছিলেন ইন্দ্রাণী। ইশারা পেয়ে ইঞ্জিন চালু করলেন অনিলবরণ। নিচে নেমে যাওয়া লাইন ধরে এগুলো তাঁর ট্রেন। রেকর্ডিং-এ ট্রেনের আওয়াজ যাতে ধরা না পড়ে তারই জন্য জেনারেটরটাকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। উত্তেজনাহীনভাবে ট্রেনটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই ব্যানার সরিয়ে দেওয়া হলো। শেষে হলো ‘ট্রেন ভ্যানিশ’-এর খেলা।

ঘটনাটা এখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু হয়নি। ট্রেন ভ্যানিশের নেপথ্য দুর্নীতি জানাতে গিয়ে আমাদের সমিতি-সহ বহু বিশিষ্ট ও শ্রদ্ধেয় জাদুকরদের অভিজ্ঞতাই খুব তিক্ত। বহু সংবাদপত্রের সাংবাদিকরাই আমাদের ও জাদুকরদের কাছ থেকে সব কিছু শুনেছেন, জেনেছেন, তথ্যপ্রমাণ নিয়েছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবরটির উপর প্রতিবারই নেমে এসেছে ব্ল্যাক-আউটের থাবা। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধ ক্ষমতায় ‘যুক্তিবাদী’ ও ‘কিশোর যুক্তিবাদী’ পত্রিকায় ট্রেন ভ্যানিশ নামক শতাব্দীর সেরা সাংস্কৃতিক দুর্নীতির খবর প্রকাশ করেছি। কলকাতার অতি শ্রদ্ধেয় জাদু সরঞ্জামের নির্মাতা ও পরিবেশক শ্যাম দালাল লিখেছেন একটি ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত জাদু পত্রিকায়, লিখেছেন বিশিষ্ট জাদুকর সুবীর সরকার ও ভারতের অসাধারণ জাদুশিল্পী কে. লাল। কিন্তু এসব লেখা বৃহৎ পত্রিকায় প্রকাশিত না হওয়ায়, প্রতারক হিসেবে যাঁর ঘৃণা কুড়োবার কথা, তিনি কুড়িয়েছেন কিংবদন্তির সম্মান।

‘সানন্দা’ একটি জনপ্রিয় পাক্ষিক। প্রকাশ করেন আনন্দবাজার গ্রুপ। সানন্দা’র ৫ আগস্ট ১৯৯৪ সংখ্যায় চিঠিপত্তর বিভাগে ট্রেন-ভ্যানিশের নেপথ্য কাহিনী দু- চার লাইনে লেখার একটা সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার প্রকাশিত চিঠিটির তলায় লেখা ছিল : “চিঠিটির উত্তর দিচ্ছেন পি. সি. সরকার, আগামী সংখ্যায়”। পত্রিকার তরফ থেকে এই ধরনের ঘোষণা, অবশ্যই ব্যতিক্রম।

যাই হোক, ১৯ আগস্ট ৯৪ সংখ্যার সানন্দায় সরকারের উত্তর প্রকাশিত হলো। সরকার লিখলেন, “ট্রেন ভ্যানিশের ম্যাজিকটা আমি একটা বিশেষ এবং বিশাল কমিটির সামনে দেখিয়েছিলাম…..”

সেই কমিটির এক নম্বর নাম হিসেবে সরকার যাঁর উল্লেখ করেছিলেন, তিনি হলেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায়। উপস্থিত ভি. আই. পি’দের তালিকায় ছিলেন, “সর্বভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা ইউ. এন. আই, এ-পি’র প্রতিনিধি। ছিলেন আনন্দবাজার গ্রুপ, আজকাল, গণশক্তি, ওভারল্যান্ড পত্রিকার সাংবাদিক ও প্রতিনিধি। দূরদর্শনের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডাইরেক্টর-সহ ছিলেন দূরদর্শনের সাংবাদিক ক্যামেরাম্যানদের বিরাট টিম তো বটেই….” “আপামর জনসাধারণকে দেখাবার জন্য দূরদর্শন নিউজ কভার করেছে।” “কুচুটে মনোবৃত্তির লোকেরা যত কুৎসাই রটাক না কেন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ইজ্জত বেড়েছে।”

উত্তর পাঠিয়েছি ‘সানন্দা’র দপ্তরে, কলকাতা জেনারেল পোস্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি ডাকে। পাঠাবার তারিখ : ৮.১০.১৯৯৪। রেজিস্ট্রেশন নম্বর জি-৩৩৪৪। ওরা যে চিঠি পেয়েছেন, তার প্রাপ্তিস্বীকারের কার্ডও পেয়ে গেছি। এই প্রসঙ্গে সানন্দার সম্পাদকীয় দপ্তরের সঙ্গে কথাও হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৪ পেরিয়ে এখন ১৯৯৫ জানুয়ারি। এখন পর্যন্ত সানন্দা আমার চিঠিটি প্রকাশ করেননি। চিঠিটিতে লিখেছিলাম :

“কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মাননীয় মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায় ৩ সেপ্টেম্বর ‘৯৪ প্রকাশ্য সভায় দ্বিধাহীন জানালেন—পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর ট্রেন ভ্যানিশের আমি একজন দর্শক ছিলাম। সেদিন অমৃতসর এক্সপ্রেসকে ভ্যানিশ করা হয়নি। একটা ইঞ্জিন ও কয়েকটা কম্পার্টমেন্ট ভাড়া করে আনা হয়েছিল, সেগুলো রেললাইন ধরেই চলে গিয়েছিল। দূরদর্শনের তরফে ছবি তুলেছিলেন ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য। পি. সি. সরকার (জুনিয়র) এ বিষয়ে আমাকে মুখ না খুলতে অনুরোধ করেছিলেন।

সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের ৮ নম্বর কোর্টে, দুপুর ২ টো থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত। সভার শিরোনাম ছিল ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’। ব্যবস্থাপক : হাইকোর্ট লেডিজ ওয়েলফেয়ার কমিটি। সহযোগিতায় হাইকোর্ট কর্মচারী সমিতি। সভার প্রধান অতিথি ছিলেন মাননীয় মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায়। মূল বক্তা প্রবীর ঘোষ। হল উপচে পড়া ভিড়ে বিশিষ্টদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার শ্রী এস. এস. পাণ্ডে, অ্যাডিশনাল রেজিস্ট্রার শ্রী মলয় সেনগুপ্ত ও শ্রী পি. কে. সেন, ডেপুটি রেজিস্ট্রার শ্রীনিরোধবরণ হালদার, স্টেট কোঅর্ডিনেশন কমিটির প্রেসিডেন্ট শ্রীচুনিলাল চক্রবর্তী, কলকাতা হাইকোর্ট এমপ্লয়িজ অ্যাসোশিয়েশন্-এর জেনারেল সেক্রেটারি শ্রীসিদ্ধেশ্বর শূর এবং হাইকোর্ট এমপ্লয়িজ অ্যাসোশিয়েশনের এক্সজিকিউটিভ কমিটির সদস্যবৃন্দ।

৮মে ’৯৪ বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল বিভিন্ন দাবিসহ দূরদর্শনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডেপুটেশন দিয়েছিলেন কলকাতা দূরদর্শনের ডিরেক্টর শ্রীঅরুণ বিশ্বাসের কাছে। তাতে দুর্নীতির একটি অভিযোগ ছিল ‘ট্রেন ভ্যানিশ’ দেখিয়ে কলকাতা দূরদর্শন ১২ জুলাই ‘৯৪ যে সংবাদ প্রচার করেছিল, সেই ট্রেন আদৌ কোনও কৌশলেই ভ্যানিশ করা হয়নি। গোটাটাই করা হয়েছিল ক্যামেরার কৌশলে। এমন একটি মিথ্যে খবর প্রচার করে একদিকে একজনকে রাতারাতি কিংবদন্তি বানানো হয়েছে। অন্যদিকে কোটি কোটি দর্শককে প্রতারিত করা হয়েছে।

ডিরেক্টর শ্রীবিশ্বাস সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার দায়িত্ব অর্পণ করেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর শ্রীঅমলেন্দু সিনহার ওপর।

শ্রীসিনহা তদন্ত রিপোর্টে জানান, দূরদর্শন কেন্দ্রের কোনও কর্মী বা টিম জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র)-এর অমৃতসর এক্সপ্রেসের ছবি তুলতে যাননি। খবরে যে ছবিটি দেখানো হয়েছিল তা তুলে এনেছিলেন শ্রীমতী ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য। শ্রীসিনহা আরও জানান, শ্রীমতী ভট্টাচার্য দূরদর্শন কেন্দ্রের কর্মী নন। ক্যাজুয়াল কর্মী হিসেবে মাঝে-মধ্যে তিনি খবর পড়ে থাকেন মাত্র।

‘অল ইন্ডিয়া ম্যাজিক সোসাইটি’-এর সভাপতি ভারতবর্ষের বিখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা গ্লোব-ডিটেকটিভ সার্ভিসেসকে দিয়ে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত করান। ওই সংস্থার ডিরেক্টরের স্বাক্ষর-সম্বলিত (রেফারেন্স নং-জি ডি এস/২৫৪০/৯২, তারিখ ১৮/৮/৯২) দীর্ঘ তদন্ত রিপোর্টে দ্বিধাহীনভাবে জানানো হয়েছে :

(১) অমৃতসর এক্সপ্রেস আদৌ ভ্যানিশ করা হয়নি। (২) তথাকথিত ট্রেন ভ্যানিশের জন্য একটি বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছিল, যার ডিজেল ইঞ্জিন নং- ১/৪০৫। ড্রাইভারের নাম অনিলবরণ দত্ত। (৩) গ্রামবাসীদের বলা হয়েছিল সিনেমার স্যুটিং হবে। শেষ পর্যন্ত তাঁদের ট্রেন ভ্যানিশের দর্শক হিসেবে দেখিয়ে প্রতারিত করা হয়েছে। (৪) ভাড়া করা ট্রেনটি লুপ লাইন দিয়ে তার নিজের মতোই চলে গেছে। (৫) ম্যাজিকের নামে ট্রেন ভ্যানিশের ঘটনাটি ছিল নিছকই একটি ক্যামেরা ট্রিক। (৬) আনন্দবাজার পত্রিকা গ্রুপ ছাড়া আর কোনও পত্রিকা প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সাংবাদিক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দু’জন—একজন আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠীর সাংবাদিক শঙ্করলাল ভট্টাচার্য এবং অপরজন দূরদর্শনের ক্যাজুয়াল নিউজ রিডার শ্রীমতী ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য যিনি শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের স্ত্রী। প্রাথমিক প্রমাণ হিসেবে ‘গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসেস’-এর তদন্ত রিপোর্টের জেরক্স কপি পাঠালাম। প্রয়োজনে আরও স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দিতে পারব, আর কোনও পত্রিকাগোষ্ঠীই যায়নি; এবং মাননীয় বিচারপতি মুকুলগোপাল মুখোপাধ্যায় ও দূরদর্শনের ডিরেক্টর প্রসঙ্গে যে ব্যক্তব্য রেখেছি তাও কাঁটায় কাঁটায় সত্যি।

সানন্দার মতো জনপ্রিয় পত্রিকায় জাদুকর জুনিয়র সরকারের এই চূড়ান্ত মিথ্যাচারিতার নিদর্শন প্রকাশিত হওয়ায় আমার ও আমাদের সমিতির সম্মান ও মর্যাদা বিশালভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। যতদিন না এই চিঠির মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হচ্ছে, ততদিন এই মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা আমাকে এবং আমাদের সমিতিকে বয়ে বেড়াতে হবে। যুক্তিবাদী আন্দোলনের ওপর এই ষড়যন্ত্রমূলক আঘাত ইতিহাস কোনও দিনই ক্ষমা করবে না, ক্ষমা করবে না ‘মিথ’ হতে শ্রীসরকারের মিথ্যাচারিতাকে। বিষয়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিঠি প্রকাশ করুন—অনুরোধ।”

চিঠিটির সঙ্গে গ্লোব ডিটেকটিভ সার্ভিসেস’-এর তদন্তের সম্পূর্ণ প্রতিলিপিও পাঠিয়েছিলাম।

কিন্তু তারপর? প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা, একবার ভাবুন, ১৯৯২-এর ১২ জুলাই কি ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র)? সংস্কৃতির জগতে দুর্নীতির ইতিহাস? প্রচার মাধ্যমের অকুণ্ঠ সহায়তায় ও মিথ্যাচারিতায় প্রতারকের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার ইতিহাস? নাকি প্রচার মাধ্যমের হলদে সাংবাদিকতার অনন্য নজির স্থাপনের ইতিহাস? ভারতের ইজ্জত কেমনভাবে বেড়েছে? হর্ষদ মেহেতা, দাউদ ইব্রাহিমের দুর্নীতির পাশাপাশি আরও একটি নাম উচ্চারিত হওয়ার সুবাদে ইজ্জত বেড়েছে?

আরও একটি প্রবল ক্ষমতা সংবাদ মাধ্যমগুলোর কর্তাব্যক্তিদের আছে। আর তা হলো, কাউকে ‘ব্ল্যাক আউট’ করার ক্ষমতা। সরকার ও একাধিক প্রচার মাধ্যমের বোঝাপড়ায় যে ‘মিথ্যে’ ‘সত্যি’ হয়ে গেল, তাকে ‘চিরন্তন সত্যি’ করে রাখতে আমাদের প্রতিবাদকে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করা তো একটি দৃষ্টান্ত মাত্র। আমাদের সমিতি যে কতবার এমন অনৈতিক ক্ষমতার শিকার হয়েছে এবং হয়েই চলেছে, তার পুরো হিসেব রাখতে কম্পিউটরের প্রয়োজন হয়ে পড়বে।

সংবাদ মাধ্যমগুলো বাস্তবিকই পারে ‘জোনাকি’কে ‘নক্ষত্র’ বানাতে, সত্যের সূর্য ঢাকতে পারে ‘ব্ল্যাক-আউট’-এর মেঘে। এই দুই ক্ষমতাই ‘নামী’ হতে চাওয়া, ‘জনপ্রিয়’ হতে চাওয়া, ‘দামি’ হতে চাওয়া, ‘পুরস্কৃত’ হতে চাওয়া, ‘সম্মানিত’ হতে চাওয়া বুদ্ধিজীবীদের (যাদের মধ্যে সাধারণভাবে ফেলা হয় সাহিত্যিক, নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সংগীত শিল্পী, চিত্রকর, ভাস্কর, নৃত্যশিল্পী, শিক্ষাবিদ, চলচিত্র পরিচালক-সহ অধুনা ক্রিড়াবিদদের পর্যন্ত) সংবাদ মাধ্যমগুলোর কাছাকাছি নিয়ে আসে। ‘নামী’, ‘দামি’ হওয়ার একটা পর্যায় অতিক্রম করে আরও ‘নামী’ ‘দামি’ হতে গেলে সাধারণভাবে সংবাদ মাধ্যমগুলোর সঙ্গে আপোষ করা প্রায় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবীদের এই আপোষকামিতাকে, কৃপাপ্রার্থী মানসিকতাকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগায় প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রক শক্তি ধনকুবের পুঁজিপতিরাই।

নিরপেক্ষতা’র মোড়কের আড়ালে লুকোন শোষকশ্রেণীর মূল্যবোধ

রাজা ধনকুবেরের দল চায়, বঞ্চিত মানুষরা যেন বঞ্চনার কারণ হিসেবে বঞ্চনাকারী ধনকুবেরদের দায়ী না করে দায়ী করে নিজেদেরই ভাগ্যকে, পূর্বজন্মের কর্মফলকে, আকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে, ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়াকে। বঞ্চনাকারীরা, শোষণকারীরা জানে, দেশের সিংহভাগ বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষ তাঁদের বঞ্চনার প্রকৃত কারণ হিসেবে ধনকুবের গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করলে তারই পরবর্তী পর্যায়ে এক সময় পায়ের নীচের মানুষগুলোই ধনিকগোষ্ঠীর পায়ের তলার জমি কেড়ে নেবেই। শোষকরা এও জানে, শোষিতদের ঘুম ভাঙলে, তারা শোষণের কারণগুলোকে উৎপাটিত করতে লড়াইতে নামলে সে লড়াই জেতার মত পুলিশ ও সেনা শোষকদের হাতে নেই। দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি বিক্ষুব্ধ হলে, বিদ্রোহ বা বিপ্লবের পথে পা বাড়ালে পৃথিবীর কোনও শক্তিশালী সেনা বাহিনীরও সাধ্য হয়নি, সে লড়াই জেতার—ইতিহাস বার বার এই সত্য আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরেছে। এই সত্যই সমাজের অর্থনৈতিক নীতি ও আর্থিক কাঠামোর নিয়ন্তা ধনিকগোষ্ঠীর কাছে মগজ ধোলাইয়ের প্রয়োজনীয়তাকে অনিবার্য করে তুলেছে। এই প্রয়োজনই ধনিককুলের কাছাকাছি এনেছে প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের। আর তারই ফলস্বরূপ প্রচার মাধ্যমগুলোর সংবাদ সরবরাহের ‘নিরপেক্ষ’ মোড়কের আড়ালে থাকে শোষকশ্রেণীর পক্ষে প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ ও মতাদর্শগত কর্তৃত্বকে সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেবার দৃঢ় প্রচেষ্টা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে নানা রঙে, ননা ঢঙে, বিভিন্ন বৈচিত্র্যে তাদের বহিরঙ্গকে সাজালেও, মূলগত ভাবে এরা প্রত্যেকেই বর্তমান অসাম্যের সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থার দিকেই ঝুঁকে থাকে। কেউ অসাম্যের সমাজ কাঠামো পাল্টে সাম্যের সমাজ কাঠামো তৈরির পক্ষে মূল্যবোধ ও মতাদর্শ প্রচারের জন্য বৃহৎ পত্র-পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হলে (এখানে তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিলাম, কোটি-কোটি টাকার পুঁজি বিনিয়োগকারী উদ্যোগী মানুষটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাজ্য-পার্ট বঞ্চিতদের হাতে তুলে দিয়ে পথে এসে দাঁড়াবেন) সেই পত্রিকাকে কোণঠাসা করে লাটে তুলে দেবে এই সমাজ ব্যবস্থাই। আমরা তো দেখেছি, ইন্দিরা গান্ধীর জমানার বিরুদ্ধে সমালোচনার জন্য বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর মালিকের বাড়িতে এ’বেলা-ও’বেলা, পুলিশ, কাস্টমস, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তরদের ‘রেড’। আমরা দেখেছি, সাংবাদিকদের নানা অজুহাতে কারাগারে নিক্ষেপ। আমরা দেখেছি, নিউজপ্রিন্টের কোটা ও সরকারি বিজ্ঞাপন দেওয়া ও না দেওয়ার চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারিতা। এ’সব তো এক শাসকের বিরোধিতা করার ফল, গোটা সমাজ কাঠামোর বিরোধিতার ফল অবশ্যই এর চেয়ে বহুগুণ ব্যাপক। কারণ তখন আপনার শত্রু শুধু একটি রাজনৈতিক দলের নেতা নয়, শত্ৰু সমগ্র ধনী সম্প্রদায়, বর্তমান সমাজ কাঠামোর ক্ষমতার মধুভোগী প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ধনিককুলের কুক্ষিগত প্রচার-মাধ্যমগুলো ও বুদ্ধিজীবীরা, প্রশাসন-পুলিশ-প্রত্যেকেই।

প্রচার মাধ্যমগুলো বর্তমান সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই ভোগবাদ ও অধ্যাত্মবাদের পক্ষে নানা ভাবে মগজ ধোলাই করে, শোষিত শ্রেণীকে এক কাট্টা হতে না দেওয়ার প্রশ্নাতীত প্রয়োজনে মানুষে মানুষ বিভাজন সৃষ্টি করে নানা ভাবে। এ’দেশের মানুষ যে আজ ধর্মের ভিত্তিতে, ভাষার ভিত্তিতে, প্রদেশের ভিত্তিতে, জাত-পাতের ভিত্তিতে বিভক্ত, তা তো এমনি এমনি হয়নি। সাংস্কৃতিক প্রভাবের ফলেই এমনটা হয়েছে। আর, সমাজে সাংস্কৃতিক প্রভাব ফেলতে প্রচার- মাধ্যমগুলোর ভূমিকা অবশ্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রচার মাধ্যমের হাত ধরে মানুষকে আরও একটি ভাগে বিভাজিত করার চেষ্টা এবং একটি সঠিক আন্দোলনকে চেপে দিয়ে মেকি আন্দোলনকে তুলে আনার প্রয়াসের একটি সাম্প্রতিকতম উদাহরণ এই প্রসঙ্গে আপনাদের সামনে পেশ করছি।

বিপন্নতাবোধেই প্রথা ভেঙে মানবতাবাদী নারীবাদ‘-এর উপর আনন্দবাজারী আক্রমণ

গত কয়েক বছরে দেখলাম ‘নারীবাদ’, ‘নারীমুক্তি’, ‘নারী-স্বাধীনতা’ ইত্যাদি নামে পুরুষশাসনের মূলোচ্ছেদের দিশা দেখানোর পরিবর্তে মানুষকে আরও একটি নতুন ভাগে ভাগ করার কাজে নামতে একটি বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীকে। নতুন ভাগটি হলো—’নারী’, ও ‘পুরুষ’। তৎপর পত্রিকাগোষ্ঠী তার সহযোগী বুদ্ধিজীবীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে বেছে নিয়ে তাদের ‘নারীবাদী’ ও ‘প্রতিবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে লাগাতার প্রচার নেমেছে। পত্রিকাগোষ্ঠীর বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা নানাভাবে নাচন- কোঁদন করে জনগণকে বোঝাতে চেয়েছেন ‘নারীবাদী হো তো এ্যাইসা’। পত্রিকাগোষ্ঠীর চাওয়াকে হাতের মুঠোয় পাইয়ে দিতে তৎপর বুদ্ধিজীবীরা পুরুষ শাসনের বিরোধিতার নামে পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর ঘৃণাকে সৃষ্টি করতে ও তীব্র করতে তৎপর হয়েছে।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়। পত্রিকাগোষ্ঠীর এই বিভাজন ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচেষ্টা যখন অশ্বমেধের ঘোড়া, তখন তার গতিরোধ করে অসাম্যের মূল্যবোধ ভাঙতে সুচেতনার দখিনা হওয়ায় মেঘ ওড়াবার লড়াই করতেই হাজির হলো ‘যুক্তিবাদের চোখে নারী মুক্তি’ নামের বইটি। যুক্তিবাদের উপর ভিত্তি করে নতুন এক নারীবাদ ‘মানবতাবাদী নারীবাদ’-এর রূপরেখা এই বইটিতে স্পষ্টতর হতেই অশ্বমেধের ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়ল।

কিন্তু, এ যেন—’মরিয়া না মরে রাম’। শেষ কামড় দিতে পত্রিকাগোষ্ঠী যা করলেন, তাও এক ইতিহাস তৈরি করল।

ওই পত্রিকার প্রচলিত প্রথা-পুস্তক সমালোচনার জন্য অনুরোধসহ বই ঐ পত্রিকায় দপ্তরে না পাঠালে আলোচিত হবার সুযোগ লাভ করে না। অবশ্য, অনুরোধসহ বই পাঠালেই যে পুস্তকটি আলোচিত হবে—এমনটি নয়। বরং অতি ক্ষুদ্র অংশের অনুরোধই রক্ষিত হয়। ওই পত্রিকার পাতায় আলোচনা লাভের সুযোগের জন্য ‘যুক্তিবাদের চোখে নারীমুক্তি’ বইটির লেখক হিসেবে আমি মোটেই উৎসাহী ছিলাম না। সুতরাং বইটি আমি দিইনি। এবং বইটির প্রকাশক আমার এই মানসিকতার সঙ্গে পরিচিত থাকার দরুন কোনও পত্র-পত্রিকাতেই সমালোচনার জন্য আমার লেখা কোনও বই পাঠান না। এবং এই বইটিও পাঠাননি। তা সত্ত্বেও সমস্ত ঐতিহ্য ও প্রথা ভঙ্গ করে ওই পত্রিকাগোষ্ঠী বইটির সমালোচনা প্রকাশ করলেন। পত্রিকাগোষ্ঠীর তীব্র বিপন্নতাবোধই যে এই ধরনের ইতিহাস তৈরিতে বাধ্য করেছিল— বইটি পড়লে এটুকু বুঝতে কারও অসুবিধে হবে না।

বইটির সমালোচনার দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছিল আর এক ‘নারীবাদী’ বলে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী চিহ্নিত মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়ের হাতে। যদিও বইটি পড়ে ইতিপূর্বে প্রকাশ্যেই প্রচুর প্রশংসা করেছিলেন মৈত্রেয়ী, তবুও নতুন দায়িত্ব পেয়ে তাঁর বীর বক্ষ একটুও কাঁপলো না। বরং বাবুদের তুষ্ট করতে সত্যি-মিথ্যের সীমারেখা ভেঙে, আমার ওই বইয়ের কথা বলে এমন সব কথা লিখলেন, যেগুলো তিনি কোনও দিনই আমার বইটি খুঁজে দেখাতে পারবেন না। ‘দেখাতে যেতে বয়েই গেল, আমার দরকার বাবুদের তুষ্ট করা’ ভেবে মৈত্রেয়ী বইটির বিরুদ্ধে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি করতে কুৎসা ছড়াতে সচেষ্ট হলেন, সেই সঙ্গে তিনি তীব্র ক্ষোভ সোচ্চারে প্রকাশ করলেন, বইটিতে “বারে বারে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীকে আক্রমণ” করায়।

মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় ও এই বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠীর ক্ষোভ আমাদের কাছে স্পষ্ট করে দেয়—আমরা ঠিক পথে এগুচ্ছি, ঠিক জায়গাতেই আঘাত দিচ্ছি, তাই সততা, নীতি, সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে ওরা পাল্টা আঘাত হানার চেষ্টায় পাগল। বৃহৎ পত্রিকায় আমাদের আন্দোলনের খবরও নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়। এই খবর প্রকাশের দ্বারা আর কিছু না হোক, আমাদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও শক্তি যে প্রমাণিত হয়, সেটা সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায়। ‘কলম বেচে’ পত্রিকায় জায়গা পাওয়ার চেয়ে নীতি বজায় রেখে জায়গা পাওয়াটা যে ভাল, সেটা বুঝতে খুব একটা কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োজন হয় না।

আলোচনার জন্য অনুরোধসহ বইটি না পাঠানো সত্ত্বেও সমালোচনার নামে মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে একটি চিঠি পাঠাই আনন্দবাজারে। চিঠিটা পাঠিয়েছিলাম রেজিস্ট্রি ডাকে। পাঠাবার তারিখ ৭.১০.১৯৯৪ কলকাতা জি. পি. ও থেকে। রেজিস্ট্রেশন নম্বর জি. ১২৮৮। ওরা যে চিঠি পেয়েছেন, তার প্রাপ্তিস্বীকারের কার্ডও পেয়ে গেছি। কিন্তু উত্তরটি ছাপা হয়নি। একচেটিয়া মিথ্যে ছাপাবার অধিকার ও ‘সত্য’-কে ‘ব্ল্যাক-আউট’ করার স্বাধীনতাই কি তবে ‘পত্রিকার স্বাধীনতা’ বলে বিবেচিত হবে? প্রিয় পাঠক-পাঠিকা সংবাদপত্রের এই তথাকথিত স্বাধীনতার স্বরূপকে চিনে আপনাদের নিতেই হবে। নতুবা এই স্বাধীনতা এমনি করেই বারবার প্রতিটি সৎ আন্দোলনকে, প্রতিটি অসাম্য বিরোধী সঠিক আন্দোলনকে ধ্বংস করতে গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসবে।

সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদানের নিয়ন্তা ও তাদের দালালদের মগজধোলাইয়ের দু’চারটি উদাহরণ

আজকের সমাজ কাঠামোয় এ দেশের সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর একছত্র নিয়ন্তা ধনকুবেরগোষ্ঠী, তা সে বস্তুগত বা অবস্তুগত—যাই হোক না কেন।

সংস্কৃতির ‘বস্তুগত উপাদান’ কথার অর্থ—একটি মানবগোষ্ঠীর জীবনযাপন প্রণালীর সঙ্গে সম্পর্কিত বস্তুসমূহ। যেমন— ঝুপড়ি থেকে আকাশচুম্বী প্রাসাদ, গরুরগাড়ি থেকে মহাকাশযান, হাতপাখা থেকে এয়ার কন্ডিশনার, প্রদীপ থেকে জেনারেটার, টিনের চোঙ থেকে স্যাটেলাইট, ধুতি থেকে জিনস, ছাতু থেকে শ্যাম্পেন, শিলনোড়া থেকে গ্রাইন্ডার, ঝাঁটা থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, আলপথ থেকে রেড-রোড, ফোঁড়া কাটার নরুন থেকে মাইক্রোসার্জারির যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সব কিছুই।

অবস্তুগত উপাদানের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, ধর্মগ্রন্থ থেকে যুক্তিবাদী গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা, প্রচারমাধ্যম হিসেবে লিফলেট থেকে স্টার-টিভি, অন্ধবিশ্বাস থেকে বিজ্ঞানমনস্কতা, পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতা, আস্তিক্যবাদ” থেকে নাস্তিক্যবাদ, ভাববাদ থেকে যুক্তিবাদ, নীতিহীনতা থেকে নীতিবোধ, চাটুকারিতা থেকে ঠোঁটকাটা স্পষ্টবাদিতা, দ্বিচারিতা থেকে আপোষহীনতা ইত্যাদি সব কিছুই।

বস্তুগত এবং অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলো নিয়েই একটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, চলমান সংস্কৃতি।

এই বস্তুগত ও অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর নিয়ন্তা যে, ধনকুবেরগোষ্ঠী, এ-টুকু বুঝতে আপনার দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টিভি, স্টার-টিভি, সিনেমা ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমগুলোর চিন্তার সর্বগ্রাসী প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। সাহিত্য, সংগীত, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা, নাটক, যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে স্বার্থান্ধ, ভোগসর্বস্ব উত্তেজক সংস্কৃতির গন্ধ তৈরি করে মানুষের চেতনায় পাঠানো হচ্ছে। একই সঙ্গে ‘ঈশ্বর’ জাতীয় সেরা গুজবের ঘাস-বিচুলিকে কুশলী হাতে পরিবেশন করে মানুষকে ‘হাম্বা রবের চতুষ্পদীতে পরিণত করা হচ্ছে ফলে তৈরি হচ্ছে নারী-পুরুষের পরস্পরকে ভোগ করার সংস্কৃতি, উচ্ছৃঙ্খলতার সংস্কৃতি, ধর্ষণের সংস্কৃতি, গুছিয়ে নেবার সংস্কৃতি, পেশীশক্তির সংস্কৃতি, ইভ-টিজারের সংস্কৃতি, ব্লু-ফিল্মের সংস্কৃতি, ব্যবসায়ী-মন্ত্রী- আমলা-পুলিশের অশুভ চক্রের দেওয়া-নেওয়ার সংস্কৃতি। পর্নো-পত্রিকা, সিনেমা পত্রিকা, সিনেমা ও টিভির বিজ্ঞাপনে শরীরকে অনাবৃত রাখার, যৌন আবেদনকে তীব্র করার যে অশুভ প্রতিযোগিতা—একে শুধুমাত্র পুরুষতান্ত্রিকতার ফলে বলে চিহ্নিত করা যায় কি? যায় না। এঁরা কেউই বেঁচে থাকার তাগিদে দেহ বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া নারী নন। এঁরা সাধারণত আসেন উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে। এঁরা ক্ষুধার অনিবার্য ফল নন, অপসংস্কৃতির অনিবার্য ফসল—যে অপসংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্রশক্তি ও তাদের উচ্ছিষ্টভোগীরা।

ভোগবাদী ও ভাববাদী চিন্তার সাঁড়াশি আক্রমণের পরও অনেক সময় প্রতিবাদী মানুষের চিন্তা এক থেকে বহুকে উদ্দীপ্ত করতে থাকে। শুরু হয় প্রতিবাদী সংস্কৃতির বিজয় অভিযান। শোষক ও শাসককুলের অজানা নয়, এমন প্রতিবাদী সংস্কৃতির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাদের সর্বনাশের বীজ। আর তাই প্রতিবাদী সংস্কৃতিকে, সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে রোখার মসৃণ কায়দা হিসেবেই হুজুরের দল, রাষ্ট্রশক্তি ও তাদের সহায়ক প্রচারমাধ্যমগুলো প্রচারের আলোকে তুলে আনে মেকি প্রতিবাদীদের। এইসব ভণ্ড প্রতিবাদীরা চিন্তার প্রোটিনের ছদ্মবেশে চিন্তার বিনাশকারী ভাইরাস। একটু সচেতনভাবে লক্ষ্য করলেই কিন্তু চেনা যায়। এইসব ভণ্ড প্রতিবাদী শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগীতকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ইত্যাদি বুদ্ধিজীবীদের স্পনসরের ভূমিকায় সর্বত্রই দেখবেন রয়েছে রাষ্ট্রশক্তি, ধনকুবের বণিকশ্রেণী বা প্রচারমাধ্যম— যার মালিক অবশ্যই বণিকশ্রেণীই।

বর্তমান সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে রাষ্ট্রশক্তি ও প্রচার মাধ্যমগুলোর তুলে আনা এক-আধটি তথাকথিত প্রতিবাদী চরিত্রগুলোর প্রকৃত স্বরূপ একটি দেখি আসুন।

জাদুকর পি. সি. সরকার (জুনিয়র) কে কুসংস্কার বিরোধী এক সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব হিসেবে ‘প্রজেক্ট’ করার জন্য বেশ কয়েক বছর ধরেই লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ভাষাভাষি পত্রিকা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের CSICOP নামক একটি তথাকথিত যুক্তিবাদী সংস্থার (যারা বিভিন্ন দেশের অসাম্যের সমাজ কাঠামোর স্থিতাবস্থা বজায় রেখে অলৌকিক রহস্যের অনুসন্ধানকেই যুক্তিবাদী কাজ-কর্ম বলে মনে করেন) সহযোগী এক বাংলা মাসিক (যারা বর্তমানে গণবিজ্ঞান আন্দোলন নামক এক ধরনের বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং মানুষের মনের উৎসে একই সঙ্গে যুক্তিবাদ ও অধ্যাত্মবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে দারুণ সোচ্চার) পত্রিকা এবং পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় সরকার বাহাদুর। আমরা সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রকাশিত সংবাদ সূত্র থেকে জেনেছি কলকাতার মাননীয় মেয়র মার্কসবাদী আন্দোলনের নেতা প্রশান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয় শ্রীসরকারের কুসংস্কার-বিরোধী সংগ্রামী প্রয়াসকে বাহবা দিয়ে সমস্ত রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।

শ্রীসরকার কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। খুবই ভাল খবর। কুসংস্কারের বিরুদ্ধে একটি মানুষের যুদ্ধে নামা মানেই যেখানে সামান্য হলেও অগ্রগমন, সেখানে শ্রীসরকারের মত জনপ্রিয় মানুষটির অংশগ্রহণ তো একটা বড়- সড় অগ্রগতি। এবার একটু খতিয়ে দেখা যায় শ্রীসরকারের যুদ্ধ-বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে? না, যাত্রার আসরে? হাতের তলোয়ার ইস্পাতের? না, টিনের?

শ্রীসরকার সত্যিই বেপরোয়া অকুতোভয় মানুষ। তিনি একই সঙ্গে ঘোষণা করেছেন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, এবং সেই সঙ্গে সোচ্চারে ঘোষণা রেখেই চলেছেন—আত্মা, ভূত ও ঈশ্বরে তাঁর গভীর বিশ্বাসের কথা। যে কোন বিন্দুতে বিশ্বাস বা গভীর বিশ্বাস যে কোনও মানুষের থাকতেই পারে, এবং থাকেও। আমার কাছে বিভিন্ন মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেকেই আসেন-টাসেন, যাদের এক একজন এক- এক রকম গভীর বিশ্বাস থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। এঁদের কেউ ভাবেন তাঁর মাথার সমস্ত চিন্তাকে ধরে নিতে আমেরিকা নাকি আকাশে একটা উপগ্রহ ছেড়ে রেখেছে কেউ বা ভাবেন, তাঁর মাথার শক্তিকে কাজে লাগিয়েই এ’দেশের সরকার সমস্ত বিদ্যুৎ বানিয়ে নিচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এমন প্রমাণহীন আত্মা- ভূত-ঈশ্বরের অস্তিত্বে গভীর বিশ্বাস রাখার জন্য শ্রীসরকারকে যখন কুসংস্কারের আচ্ছন্ন মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা ছাড়া আরও কোনও উপায় নেই, তখন তাঁকে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী হিসেবে ‘প্রজেক্ট’ করা নিশ্চয়ই অসততা ও দুর্নীতি। প্রকৃত যুক্তিবাদী আন্দোলনের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেবার প্রয়োজনীয়তাই প্রচারমাধ্যম ও সরকারকে দুর্নীতির পথটি বেছে নিতে বাধ্য করেছে। এদের সম্মিলিত সমর্থনে শ্রীসরকারের স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়েছে। তিনি তাঁর বিশ্বাসের পাশাপাশি গর্বিত ঘোষণা রেখেছেন, আগামী দিনে আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বরের অস্তিত্ব পরিষ্কার বিজ্ঞান বলে পরিচিত হবে।

সুমন চট্টোপাধ্যায় জনপ্রিয় গায়ক। প্রচার মাধ্যম তাঁকে ‘প্রতিবাদী’ গায়ক হিসেবে প্রচার দিয়েছে এবং সে প্রচার বহুজনের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সুমন দিব্বি গাইছিলেন। ভালই গাইছিলেন। তারপর জনপ্রিয় হয়ে উঠতেই তাঁর ব্যাপার-স্যাপারই গেল পাল্টে। গানের ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চে দাঁড়িয়েই লুম্পেনকেও লজ্জা পাইয়ে দেওয়া ভাষায় নোংরা খিস্তি-খেউড়ের এক নতুন সংস্কৃতি তৈরির চেষ্টায় রত হলেন। সফলও হলেন। গানের আসরে (সময় : সন্ধ্যা, ২১ মার্চ ‘৯৩; স্থান : কলকাতার নজরুল মঞ্চ) এক সাংবাদিককে ‘মাদার ফাকার’ অর্থাৎ ‘মা’কে সঙ্গমকারী’ বলে খিস্তি দিয়েও দর্শকদের কাছ থেকে পেলেন তীব্র ঘৃণার পরিবর্তে হাততালি। দর্শক-চিত্তে বিকৃত উত্তেজনার পরশ লাগানোর ফসলই এই হাততালি। প্রিয় পাঠক-পাঠিকরা, একবার গভীরভাবে ভাবুন—’সংস্কৃতির পীঠস্থান’ বলে পরিচিত কলকাতায় থাবা বসিয়েছে এ কোন্ চতুর শৃগাল ও লোভী নেকড়ে? একই অঙ্গে দুই রূপ! সুমনের খিস্তি-খেউড় এখানেই থেমে থাকেনি, বদ্ধ পচা জলার মত দুর্গন্ধ ছড়াতেই থাকে তাঁর রেওয়াজি খিস্তির দূষণ। এরপরও সুমন যখন গান ধরেন, “পাল্টে দেবার স্বপ্ন আমার এখনো গেল না”, তখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, পাল্টে কোন সংস্কৃতি আনতে চান সুমনবাবু?

সুমনের এমন অশ্লীল সাংস্কৃতিক দূষণের বিরুদ্ধে, ভোগবাদী চিন্তার প্রসার প্রয়াশের বিরুদ্ধে একটি বাণিজ্যিক পত্রিকাও সোচ্চার হয়নি।

প্রতিবাদ আমাদের সমিতি করেছিল। অতীতে সুমন আমাদের কতটা প্রশংসা করেছেন, কতটা তোল্লাই দিয়েছেন, সেই সমস্ত আবেগ ও কৃতজ্ঞতাকে বিদায় করে দিয়ে সুমনের বর্তমান সুচতুর অবস্থান আমাদের দেশের সংস্কৃতির পক্ষে ক্ষতিকারক বিবেচনায় তাঁর কদর্য অশ্লীল ধ্বংসাত্মক শক্তির গতি রুদ্ধ করতে জনচেতনাকে সচেতন করতে সচেষ্ট হয়েছি। কারণ, আমরা বিশ্বাস করি—শেষ কথা বলেন জনগণ।

সুমনকে আমরা আরও নানা রূপে পেতে লাগলাম। ভোগবাদী সুমনের পাশাপাশি অধ্যাত্মবাদী চিন্তার প্রচারক হিসেবেও সুমনকে আমরা পেলাম, তিনি গানের আসরে আত্মা নামাতে লাগলেন, ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কথা বারবার গানের ফাঁকে ফাঁকে কথোপকথনের মাঝে মাঝে গুঁজে দিতে লাগলেন। দুর্নীতির সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ঘুষ নেওয়ার পক্ষে জেরালো বক্তব্য হাজির করলেন (বসুমতী; ১৯৯৩-এর মহালয়ার বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে)।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকরা,একবার ভাবুন তো, ‘প্রতিবাদী’ সুমনের প্রতিবাদ কার বিরুদ্ধে? অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে? না কি, তাঁর প্রতিবাদের ভানগুলো আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কিছুটা হাওয়া কেড়ে নেওয়ার প্রয়োজনে? এই ভানের খোসা ছাড়ালে আমরা সেই সুমনকে পেয়ে যাব, যিনি চান, সামজিক স্থিতাবস্থাকে জনগণ প্রশ্নহীনভাবে মেনে নিন আবেগের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে।

যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে সিস্টেমের সহযোগী পত্রপত্রিকার উপদেশামৃত

সম্প্রতি আমরা কয়েকটি বৃহৎ বাণিজ্যিক পত্রিকাকে দেখতে পেলাম যুক্তিবাদী সমিতির কাজ-কর্ম কি হওয়া উচিত, কিভাবে হলে ভাল হয়, বিজ্ঞান আন্দোলনের সঠিক রূপ রেখা কি হওয়া উচিত, ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয় পর্যন্ত প্রকাশ করতে। প্রবন্ধগুলির লেখকরা প্রতিটি ক্ষেত্রেই নামী-দামি।

প্রবন্ধগুলোতে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা হয়েছে (এক) : বিজ্ঞান আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হওয়া উচিত বিজ্ঞানের সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দেওয়া (প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখতে পাবেন, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক এই সুরে, এই কথাই বলেন সরকারি সাহায্যপুষ্ট ও নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা হিসেবে গড়ে ওঠা প্রতিটি বিজ্ঞান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংস্থাই)। (দুই) : ঈশ্বর বিশ্বাস, জ্যোতিষ বিশ্বাস জাতীয় মানুষের গভীর বিশ্বাসকে আঘাত দেওয়া অনুচিত (এ’বিষয়ে গণবিজ্ঞান সমন্বয় কেন্দ্রের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যাণ্ড গাইড’-এর ভূমিকায় নামা CSICOP-এর লেজুড় ‘উৎস মানুষ’ও একই কথা বলে। ওদের অক্টোবর-নভেম্বর ১৯৯৪ সংখ্যায় ২৫৯ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে—ঈশ্বর বিশ্বাসকে কুসংস্কার বলব না। “যেহেতু এই সংস্কার সমাজের সার্বিক উন্নয়ন ও অধ্যাত্মিক বোধ উন্মেষের কাজে সাহায্য করে, তাই এই সংস্কারকে আমরা কুসংস্কার বলব না”)। (তিন) : বিজ্ঞান আন্দোলনের সঠিক প্রয়োগ হলো—মডেল প্রদর্শনী, জমির উর্বরতা পরীক্ষায় সাহায্য, মৌমাছির চাষ, মাছ চাষ ইত্যাদির ক্ষেত্রে জনগণের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া (অর্থাৎ সমাজের বর্তমান অবস্থার বিরুদ্ধে কোনও আঘাত না করে, তাকে টিকিয়ে রেখে সরকারি প্রশাসনকে সাহায্যের মধ্যেই বিজ্ঞান আন্দোলনকে বন্দি করে রাখা। এমন আন্দোলনই করেন জনবিজ্ঞান ও গণবিজ্ঞান নামের সরকারি সাহায্যে হৃষ্টপুষ্ট ও প্রভাবে ক্ষীণ সংগঠনগুলো)। (চার) : যাঁরা বিজ্ঞান আন্দোলনের অর্থ করেছেন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলন, যুক্তিবাদী আন্দোলন, তারা তাদের আন্দোলনকে রাস্তায় নামিয়ে আনতে চান রাজনৈতিক দলগুলোর মত (অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা গড়তে, অর্থাৎ বর্তমান ‘সিস্টেম’ ভেঙে নতুন ‘সিস্টেম’ গড়তে আমাদের যা যা প্রয়োজন হবে, তার প্রতিটিই করব। তার জন্য রাস্তায় নামতে হয়, রান্নাঘরে ঢুকতে হয়, এবং শেষ পরিণতিতে যদি প্রাণও দিতে হয়, তাও আমরা দেব। নির্বাচন নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলোর মত বর্তমান সমাজ কাঠামো জিইয়ে রেখে আখের গোছাতে আমরা আসিনি, আমরা এসেছি ভাঙা ও গড়ার এই খেলায় জীবনটুকুকে পর্যন্ত ‘বাজি’ রেখে শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে। এই আন্দোলন, আমাদের কাছে আনন্দের উৎসব, তাই তো, একটা লেখা প্রকাশ না করলে বর্তমান বাজার দরে কোটি টাকার উৎকোচ দেবার প্রস্তাব হেলায় ঠেলতে পারি আমরাই। এই ঘটনার ঐতিহাসিক পূর্ণ বিবরণ রয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে, বারবার হত্যার হুমকি ও আক্রমণ মুখোমুখি হই আমরাই। (পাঁচ) : যুক্তিবাদী সমিতির উচিত অধ্যাত্মবাদ ও ধর্মকে আঘাত না দিয়ে জনসেবায় নিজেদের শক্তিকে ব্যয় করা, যেমন সেবার কাজ করে থাকেন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো (আমরাই তো জনগণের প্রকৃত সেবা করি, কারণ আমরা চাই শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা। আর সেই লক্ষ্যেই তো আমাদের প্রতিটি কাজ-কর্ম। কুসংস্কার মুক্তির কাজের পাশাপাশি নিপীড়িতদের আইনি সাহায্যও তো ‘যুক্তিবাদী সমিতি’ ও ‘মানবতাবাদী সমিতি’ নামের আমাদের এই সংগঠন দুটি দিয়ে থাকে। এরই পাশাপাশি আমাদের এই দুটি সংগঠন রক্তদান, মরণোত্তর দেহদান, ফ্রি কোচিং-সেন্টার, বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা ইত্যাদিও করে থাকে। আরও বহু সংগঠনই সেবামূলক কাজ-কর্ম করে থাকেন। তাঁদের এইসব কাজ-কর্মের প্রতি পূর্ণ-সম্মান জানিয়েও বলতেই হয়, শেষ পর্যন্ত সেবা শোষিত জনতার শোষণমুক্তি ঘটাতে পারে না। শোষণমুক্তি ঘটাবার প্রাথমিক ও আবশ্যিক ধাপ অবশ্যই যুক্তির আলোকে সমাজচেতনা বোধ। হাজারটা রামকৃষ্ণ মিশন, হাজারটা ভারত সেবাশ্রম সংঘ, হাজার মাদার টেরিজা ভারতের শোষিত জনতার শোষণমুক্তি ঘটাতে পারবে না। বরং এইসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সেবা পারবে জনসেবার আবেগে সিক্ত, কৃতার্থ জনগণের হৃদয়ে ধর্মীয় কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ, কর্মফল ইত্যাদি ভ্রান্ত চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত সাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অর্থাৎ নিপীড়িত জনগণকে সাহায্যের নামে, শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করতে শোষক ও শাসকগোষ্ঠীকেই ওরা সাহায্য করে। অনেক সময় শাসক ও শোষকগোষ্ঠী এবং বিদেশী ধনকুবেরদের বিপুল অর্থ সাহায্যও বিভিন্ন সেবামূলক কাজ-কর্মের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। জনসেবার আড়ালে এরা সেবা করে শোষক ও শাসকশ্রেণীরই এবং ভর্তি করে নিজের পকেট। (ছয়) : সম্পাদকীয় প্রবন্ধে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী জিজ্ঞাসা ছুড়েছেন, মুক্ত বাণিজ্য ও মুক্ত সংস্কৃতির খোলা হওয়া যখন সমস্ত মানুষ, সংগঠন ও দেশ গ্রহণ করেছে, তখনও যুক্তিবাদীরা কেন নমনীয় না হয়ে হেতুহীন কট্টর! (আসলে যুক্তিবাদীরাই সবচেয়ে নমনীয়। যেখানে যুক্তি, সেখানেই যুক্তিবাদীরা নতজানু। কাল পর্যন্ত তথ্য, প্রমাণের ভিত্তিতে জানা যে বিষয়কে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গ্রহণ করেছিলেন, আজ এই মুহূর্তে সেই তথ্য প্রমাণকে অসম্পূর্ণ বলে বাতিল করে দিয়ে অন্য কোনও তথ্য যদি প্রমাণসহ হাজির হয়, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষরা নিশ্চয়ই তা গ্রহণ করবেন। যুক্তিবাদীদের কট্টরতা, অনমনীয়তা তাদের আদর্শের প্রতি। মুক্ত বাণিজ্য, মুক্ত সংস্কৃতি, কাদের স্বার্থে বাণিজ্য? কাদের স্বার্থে সংস্কৃতি? এ’সব না জেনে মুক্তকচ্ছ হওয়াটা শুধুমাত্র যুক্তিহীনই নয়, নির্বুদ্ধিতারও পরিচয়)।

হ্যালডেনসত্যেন্দ্রনাথরাহুল সাংকৃত্যায়নকে সিস্টেমের স্বার্থে কাজে লাগাবার চেষ্টা

সম্প্রতি প্রচার মাধ্যমগুলোর কল্যাণে আমরা এক নিশ্বাসে জেনে ফেলেছি তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও ‘যুক্তিবাদী’ ব্যক্তিত্বের জন্মশতবর্ষ পালনের নানা খবর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেই এই তিন বিজ্ঞানীর নানা কাজকর্ম নিয়ে, তাঁদের নানা চিন্তাকে নিয়ে, তাঁদের যুক্তি-মনস্কতাকে নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে এবং হয়ে চলেছে নানা প্রবন্ধ। এঁরা হলেন, প্রশান্ত মহলানবিশ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং জে. বি. এস. হ্যালডেন।

এই তিন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের জন্মশতবর্ষ মহাসাড়ম্বরে পালনে মেতেছেন আমাদের রাজ্য সরকার এবং তৎসহ বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন ও বিজ্ঞান পত্রিকা। এদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন করলে সরকারি অর্থ সাহায্যও মিলছে। একটা লক্ষণীয় বিষয় প্রত্যেকেই এঁদের ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এমনভাবে প্রজেক্ট করছেন যেন এই তিন বিজ্ঞানী বিজ্ঞান আন্দোলন বা যুক্তিমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত মহান নাম। এঁরা বাস্তবিকই যদি আন্তরিকতার সঙ্গে, প্রত্যয়ের সঙ্গে মনে করতেন—যুক্তি দিয়ে বিচার করে শুধুমাত্র তারপরই গ্রহণ বা বর্জন করা উচিত— তবে এভাবে প্রজেক্ট করা থেকে নিশ্চয়ই বিরত থাকতেন।

প্রশান্ত মহলানবিশ ‘নিষ্ঠাবান’ ব্ৰহ্ম। ব্রহ্ম বা পরমপিতায় বিশ্বাসী। আবার ব্রাহ্মধর্ম প্রেতচর্চা ও প্ল্যানচেটে বিশ্বাসী না হলেও প্রশান্ত মহালানবিশ বিশ্বাসী ছিলেন এবং প্ল্যানচেটের আসরে উপস্থিতও থাকতেন। হাতের কাছে প্রমাণ পেতে রবীন্দ্র- জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা রবীন্দ্র-জীবনী গ্রন্থ আগ্রহী পাঠক- পাঠিকারা নেড়ে চেড়ে দেখতে পারেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঈশ্বরে ও অলৌকিকত্বে পরম বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক অলৌকিকবাবাদের চরণে মাথা ঠেকাতে তিনি যেতেন। সেসব তাঁর ছাত্র-ছাত্রী বহু বিজ্ঞানীদেরই অজানা হয়। কিছু কিছু অলৌকিকবাবারা সত্যেন্দ্রনাথ বাসুর ভক্তি- গদগদ সার্টিফিকেট ও ছবি নিজেদের প্রচারমূলক বইতে ছেপে থাকেন।

জে. বি. এস. হ্যালডেন সম্পর্কে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যা বলা হয় তা হল- “হ্যালডেন শুধুমাত্র একজন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী সামাজিক দায়বদ্ধ এক মহান পুরুষ। সমাজতন্ত্রের প্রতি আমরণ তাঁর আস্থা ছিল। “….একদিকে বিজ্ঞানের গবেষণা অন্যদিকে সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের শিক্ষাকে পৌঁছে দেওয়া, এই ছিল তাঁর আদর্শ।” (কথাগুলো হ্যালডেনের The Inequality of Man and other Essays” নামের প্রবন্ধ সংকলন থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ ‘মানুষের বিভিন্নতা’য় প্রকাশিত ‘প্রকাশকের নিবেদন’-এর অংশ বিশেষ) যে কলম থেকে উৎসারিত হয় হ্যালডেনের সমাজতন্ত্রের প্রতি আমরণ আস্থার কথা, সেই কলমই কিন্তু হ্যালডেনের ই. এস. পি. ও টেলিপ্যাথি বিশ্বাসে আমরণ আস্থা বিষয়ে নীরব থাকে। হ্যালডেনের নিজের কথায়, “আমি বুঝি না যে একজন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী কেন পূর্বসিদ্ধভাবে টেলিপ্যাথি বা আলোকদৃষ্টির ঘটনা বলে যা দাবি করা হয় সেগুলির সম্ভাবনা অস্বীকার করবেন। আমি নিঃসন্দেহে যেসব ঘটনার কথা বলা হয় সেগুলোর অধিকাংশ সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে প্রতারণার ঘটনা।” [The Marxist Philosophy and the Sciences গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘বিজ্ঞান ও মার্কসীয়দর্শন; জে. বি. এস. হ্যালডেন। প্রকাশক চিরায়ত প্রকাশন,; ১৯৯০; পৃষ্ঠা-১০৭]

চা অর্থাৎ, হ্যালডেন বস্তুবাদীদের টেলিপ্যাথিসহ বিভিন্ন অতীন্দ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার না মানায় যথেষ্টই বিস্মিত এবং কিছুটা ক্ষুব্ধও। তাঁর মতে এ’সব বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণা হতে পারে, কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। কি সর্বনাশ! হ্যালডেন একই সঙ্গে মার্কসবাদ ও অতীন্দ্রিয়বাদে বিশ্বাস রেখেছিলেন, এই বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করেছিলেন।

হ্যালডেনকে আরও একটু নেড়ে চেড়ে দেখলে আশা করি আরও কিছু বিস্মিত হওয়ার খোরাক আমরা পাব। হ্যালডেন দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করতেন, “মন হলো দেহের একটি দিক এবং দেহ ছাড়া মন থাকে একথা মনে করবার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই।” আবার সেই সঙ্গে এও মনে করতেন, “মনের প্রকৃতি যদি শরীরের প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত হয় তার অনুসিদ্ধান্ত হবে প্রত্যেক ধরনের মানবমন ইতিপূর্বে অনন্তবার সৃষ্টি হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শরীর যদি মনের নিয়ামক হয় তাহলে বস্তুবাদ অনন্তজীবনের ধারণা থেকে বিশেষ কিছু পৃথক নয়। আমার নিজের মন বা আত্মার অনুরূপ মন বা আত্মা অনন্তকাল ছিল এবং ভবিষ্যতেও অনন্তকাল ধরে থাকবে।” [মানুষের বিভিন্নতা, হ্যালডেন; চিরায়ত প্রকাশন; ১৯৯৩, পৃষ্ঠা-৭৭]

হ্যালডেনের এই অমর মন ও অনন্তবার সৃষ্টিতত্ত্ব (যা জন্মান্তরজাতীয় চিন্তা মাত্র) কোনও পরিপ্রেক্ষিত—বিচ্ছিন্ন চিন্তা নয়। বরং স্পষ্টতই এই উক্তি তাঁর মূল চিন্তাধারার সঙ্গে অতিমাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ।

হ্যালডেনকে যখন বিভিন্ন মহল থেকে ‘বস্তুবাদী’ বলে প্রচার করা হচ্ছে, তখন হ্যালডেনের লেখায় আমরা পচ্ছি, “আমি নিজে বস্তুবাদী নই, কারণ বস্তুবাদ যদি সত্য হয় তাহলে আমার ধারণা আমরা জানতে পারি না যে সেটা সত্যি। আমার মতামতগুলি যদি আমার মস্তিষ্কের মধ্যে চলতে থাকা রাসায়নিক ক্রিয়ার ফলে হয় তাহলে সেগুলি নির্ধারিত হয় রসায়নের নিয়মে, যুক্তিশাস্ত্রের নিয়মে নয়।” [মানুষের বিভিন্নতা, হ্যালডেন, পৃষ্ঠা-৬৮] এর পরেও হ্যালডেনকে বস্তুবাদী, মহান মার্কসবাদী বলে প্রজেক্ট করা কি নীতিগর্হিত নয়? মিথ্যাচারিতা নয়? উদ্দেশ্যমূলকভাবে বস্তুবাদের সঙ্গে অধ্যাত্মবাদের মেলবন্ধনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস নয়?

রাহুল সাংকৃত্যায়নের জন্ম শতবর্ষ উদ্যাপনে এগিয়ে এসেছে বহু সংগঠন, প্রধানত বাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নৈকট্য অনুভব করা সংগঠনগুলো। রাহুল সাংকৃত্যায়নকেও একইভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ‘মার্কসবাদী’ ‘বস্তুবাদী’ ইত্যাদি বলে। এ কথাও ঠিক, রাহুল সাংকৃত্যায়ন ভারতীয় দর্শনে ও মার্কসীয় দর্শনে সুপণ্ডিত। কিন্তু কেউ কোনও বিষয়ে সুপণ্ডিত হওয়ার অর্থ এই নয় যে সে সেই বিষয়ে আস্থাশীল। ধনবাদী আমেরিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ অনেক বুদ্ধিজীবীই মার্কসবাদে সুপণ্ডিত। এই পাণ্ডিত্য তাঁরা মার্কসবাদকে উৎখাত করার কাজেই নিয়োজিত করেছিলেন। রাহুল সাংকৃত্যায়নের মার্কসবাদে পাণ্ডিত্যকে যাঁরা মার্কসীয় দর্শনের প্রতি ও বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি গভীর আস্থার নিদর্শন বলে মনে করেন, তাঁরা হয় এটা ভুলে যান, নতুবা ভুলে থাকতে চান যে রাহুল বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন এবং বৌদ্ধধর্মে আস্থাশীল ছিলেন। রাহুল একই সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনে আস্থাশীল এবং বৌদ্ধদর্শনে আস্থাশীল—এটা হয় কি করে? আমার মাথায় ঢোকে না। কারণ বৌদ্ধদর্শন অতি স্পষ্টতই অ-বস্তুবাদী দর্শন।

আজ ভেবে দেখার সময় হয়েছে—কেন এই সমাজ ব্যবস্থার সহায়ক প্রচার মাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমগুলোর বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা এমন কিছু চরিত্রকে ‘আদর্শ’ হিসেবে জনসাধারণের কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে তুলে ধরছেন, যাঁরা একই সঙ্গে ‘বিজ্ঞানী ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘বিজ্ঞান-আন্দোলক ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘বস্তুবাদী ও অধ্যাত্মবাদী’ ইত্যাদি! আমরা নিশ্চয়ই এইসব বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদদের মূলগতভাবে অশ্রদ্ধেয় মনে করি না, বা অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতি প্রচারের ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলেও মনে করি না। বরঞ্চ স্ব-স্ব ক্ষেত্রে তাঁদের কাজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার ও স্মরণ করাই একজন যুক্তিবাদীর পক্ষে উচিত বলে মনে করি। কিন্তু তাঁদের যা যা সীমাবদ্ধতা (এবং আমরা দেখলাম, যেগুলো প্রত্যেকটাই মারাত্মক) সেগুলোকে পাশে সরিয়ে রেখে তাঁদেরকে একতরফাভাবে ‘যুক্তিবাদী’, ‘বিজ্ঞানমনস্ক’, ‘সমাজসচেতন’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে ভক্তিগদগদ প্রচারের কারণ কি হতে পারে? এই ধরনের প্রচারের ফলে সমাজ সম্পর্কে স্বচ্ছ-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির ক্ষেত্রে যেমন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হবে, তেমনই নির্বিচারে ব্যক্তিপুজোর মইতে চড়ে ঐ সীমাবদ্ধতাগুলোই চরম যুক্তিবাদিতা ও বিজ্ঞানমনস্কতার নিদর্শন হিসেবে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াবে। ফলে যুক্তিবাদী ধ্যানধারণা তথা আন্দোলন তাতে করে পিছিয়ে যাবে হাজার বছর। কেন এই অসুস্থ প্রবণতা? এই অসুস্থ প্রবণতা কি সমাজ-বিচ্ছিন্ন ঘটনা? অস্বচ্ছ চিন্তার ফসল? নাকি বৃহত্তর কোনও সুগভীর চক্রান্ত বা পরিকল্পনারই অঙ্গ? ‘ব্রেন-ওয়্যার’ বা চিন্তা-যুদ্ধের সাহায্যে সাম্য-চিন্তাকে নিঃশব্দে ধ্বংস করার যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে ধনবাদী দেশের বিত্তবানেরা, এইসব অসুস্থ চিন্তার বপন কি সেই স্বপ্নেরই ফলশ্রুতি নয়? যুক্তিবাদী দর্শনকে আটকাতেই কি এমন বিভ্রান্তিতে ভরা চরিত্রগুলোকে ‘মহান্’, ‘যুক্তিবাদী’, ‘বস্তুবাদী’ ইত্যাদি বলে ব্যাপকভাবে প্রচার করার চেষ্টা হচ্ছে না? ভাববার সময় এসেছে বন্ধু। শত্রুর শক্তিকে হালকা ভাবে না নিয়ে গভীরভাবে ভাববার সময়।

শুধু অতীতে চরিত্রগুলোকেই এভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে না, বর্তমান সময়ের একই অঙ্গে যুক্তিবাদী ও অধ্যাত্মবাদী’, ‘ঈশ্বরবিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘ভূত বিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘জ্যোতিষে বিশ্বাসী যুক্তিবাদী’, ‘ঘুষের দুর্নীতিতে বিশ্বাসী প্রতিবাদী’, ‘পুরুষকে ঘৃণা করা মানবতাবাদী’ ইত্যাদির উপর প্রচারের আলো ফেলা হচ্ছে— এটাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। (এক্ষুনি কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন—আপনারও তো প্রচার চান! উত্তরে বলব—নিশ্চয়ই চাই। তবে তা আদর্শের প্রচার; আমাদের মতাদর্শের প্রচার। এবার কেউ কেউ বলবেন—আপনারা প্রচার তো পানও! উত্তরে বলবো, আদর্শ বেচে, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতাসর্বস্ব শ্রেণীর তাঁবেদারি করার সুবাদে প্রচারের আলোয় থাকার চেয়ে আদর্শ না বেচে প্রচার পাওয়া যেমন অতি কঠিন, তেমনই অতি উত্তম। আমরা বার-বার এই কঠিন পথ ধরেই প্রচারের ছিঁটেফোঁটা পেয়েছি। আদর্শে আপোষহীন থাকার পরও আমাদের খবর প্রচার-মাধ্যমগুলো যখন প্রচার করে, তখন তার মধ্য দিয়ে আমাদের আন্দোলনের গুরুত্ব ও শক্তি যে প্রমাণিত হয়, সেটা যে কেউ বুঝবেন।) প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, বানভাসি আবেগ ও নির্বিচার ভালোবাসা, ব্যক্তিশ্রদ্ধা ইত্যাদিকে বিদায় দিয়ে শাণিত যুক্তির নিরিখে বিষয়টিকে আগাপাশতলা বিশ্লেষণ করুন।

দূরদর্শন—বেতার—পত্রপত্রিকা—জুনিয়র—মৈত্রেয়ী—সুমন—বিজ্ঞানমঞ্চ—গণবিজ্ঞান — পথ নাটিকার নামে প্যান্ট খুলে বাস্তবানুগ ধর্ষণ দৃশ্য—যুক্তিবাদী হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ—হ্যালডেন-রাহুল সাংকৃত্যায়ন তুলে আনা—বুদ্ধ দর্শনকে প্রগতিশীল দর্শন বলে আবার জাগিয়ে তোলার চেষ্টা (যে দর্শন অবশ্যই বস্তুবাদী দর্শনের বিরোধী, সাম্যের সমাজের বিরোধী। এই প্রসঙ্গ নিয়ে ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ গ্রন্থের পরবর্তী ‘ধর্ম’ খণ্ডে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করব)—এগুলো কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজ কাঠামোকে পালন ও পুষ্ট করার প্রয়োজনেই নানাভাবে, নানারূপে এদের হাজির করে চলেছে প্রচার মাধ্যমগুলো।

চার : বুদ্ধিজীবী

আমাদের সমাজের জীবনধারাই এই রকম—’নামী’ হওয়ার একটা পর্যায় অতিক্রম করে আরও নাম কিনতে সাধারণভাবে বিভিন্ন স্পনসরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শক্তির সঙ্গে আপোষ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। এইসব স্পনসরদানকারী প্রতিষ্ঠান ও শক্তিগুলো বুদ্ধিজীবীদের স্বাতন্ত্র্যকে পিষে মেরে নিজের ছাঁচে ঢালাই করতে চায়। আমরা কি ধরনের গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা পড়ব, তা ব্যাপকভাবে নির্ধারিত করে দিচ্ছে বৃহৎ পত্রিকাগোষ্ঠী ও প্রকাশকরা। আমরা দূরদর্শনে কতটা মারদাঙ্গা দেখব, কতটা যৌনতা, কতটা ভক্তিরসে আপ্লুত হবো, ধর্মগুরুদের বাণীর দ্বারা কতটা আচ্ছন্ন হবো, আদর্শ নারীর গুণ হিসেবে পতিসেবা, পতির পরিবারের সেবা, লজ্জা ইত্যাদি নীতিবোধকে কতটা আমাদের মগজে ঠাসবো—এ সবই ঠিক করে দিচ্ছে বিভিন্ন ধনকুবের স্পনসররা ও রাষ্ট্রশক্তি। পত্র-পত্রিকা ও দূরদর্শনের প্রচার শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন ভোগ্যবস্তুর প্রতি ক্ষুধা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। পোশাক-আশাক পাল্টে যাচ্ছে। আসছে বারমুডা, শটগান, ওয়াশ-জিন্। চিঁড়ে-মুড়িকে বিদায় নিতে হচ্ছে ‘কর্নফ্লেক্স’, ‘ফানমাঞ্চ’, ‘বিনিজ মাঙ্গতা’র স্বপ্নময় স্লোগানের ঠেলায়। পিপাসার্তকে জলের পরিবর্তে ‘থামস্-আপ’, ‘পেপসি’, ‘সেভেন- আপ’, ‘সিট্রা’ ইত্যাদি পানে প্রলোভিত করছে বিজ্ঞাপনের স্বপ্ন-সুন্দরী ও সুঠাম সুন্দররা। কোন্ ধরনের সিনেমা দেখব, তা নির্ণয় করে কোটিপতি চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সেন্‌সর-ক্ষমতার অধিকারী সরকার। এ-সবের দ্বারাই তো আমাদের রুচি, চাহিদা, চেতনা, মূল্যবোধ নির্ধারিত হয়, গড়ে ওঠে জীবনধারা।

বুদ্ধিজীবীরা আজ স্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, শুধু প্রতিভা জনপ্রিয়তা আনতে পারে না, বসায় না সম্মানের সিংহাসনে। এর জন্য চাই প্রচার-মাধ্যমগুলোর অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও শাসকদলের স্নেহ (যাতে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার-টার পাওয়া যায়)। বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে প্রচার মাধ্যম ও তারপরই স্পনসর হিসেবে উল্লেখযোগ্য দুই শক্তি—শাসক ও ধনকুবের গোষ্ঠীর সম্পর্ক পরস্পরের স্বার্থেই সব সময় দেওয়া- নেওয়ার মধ্য দিয়ে সুন্দর। পত্র-পত্রিকাগুলোয় চোখ বোলালেই দেখতে পাবেন, ‘গল্পপাঠের আসর; ‘কবিতাপাঠের আসর’, ‘আবৃত্তির আসর’, ‘গানের আসন’, ‘নাচের আসর’, ‘নাটক’ সবের বিজ্ঞাপনের তলাতেই ‘সৌজন্যে’ লিখে জ্বলজ্বল করে স্পনসরকারী সংস্থার নাম।

বুদ্ধিজীবীরা বর্তমান সমাজ কাঠামোর বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক শক্তিগুলোর কাছ থেকে নেন সরকারি জমি, সরকারি ফ্ল্যাট, সরকারি পুরস্কার, বিদেশে দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ, পত্র-পত্রিকা বেতার দূরদর্শনে প্রচার, বে-সরকারি নানা পুরস্কার ও একটা ‘বাজার’ যা তাদের দেয় অর্থ (অন্যান্য শাখার বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও ঘুরিয়ে- ফিরিয়ে প্রায় একই ব্যাপার)। বিনিময়ে বুদ্ধিজীবীরা তেমনই সিনেমা বানান, নাটক লেখেন, গল্প-কবিতা-উপন্যাসকে চিত্রিত করেন (এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা অন্যান্য কিছু করেন), যেমনটা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক ধনকুবেরা চান। এই ধনকুবেরা চান, এই সমাজ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে ও সবল করতে প্রয়োজনীয় একটি সাংস্কৃতিক বাতাবরণ। এই বাতাবরণ প্রধানত ভোগবাদ ও অধ্যাত্মবাদ-নির্ভর।

শিল্পসাহিত্যের পুরস্কার কি প্রতিভার স্বীকৃতি? না দালালির বিনিময় মূল্য?

পুরস্কার দেওয়া ও পাওয়া নিয়ে একটা মজাদার ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটা আমাকে বলেছিলেন কথা সাহিত্যিক সমরেশ বসু। এই ঘটনাটাই বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘ড্যাফোডিল’-এর পাতায় প্রকাশ করেছিলেন সম্পাদক ওয়াহিদ রেজা, জানুয়ারি, ১৯৯১ সংখ্যায়।

সমরেশ বসু’র নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘ড্যাফোডিল’ পত্রিকার তরফ থেকে কবি বাপী সমাদ্দার প্রশ্ন করেছিলেন, “আচ্ছা, সাম্প্রতিক পুরস্কারের বিষয়ে আমাদের কিছু বলুন না—এই, দাতা ও গ্রহীতাদের কথা, অন্দরমহলের কেষ্টবিষ্টুদের কথা।”

সমরেশ বসু : ভাই দেখ, এই পুরস্কারের ব্যাপারটা আমাকে প্রশ্ন করে তোমরা আমাকে একটু বিপদে ফেলেছো, এই কারণে যে, পুরস্কার সম্পর্কে আমার নিজের কোনো—আমি পুরস্কার পেয়েছি, পাইনি তা নয়, কিন্তু একটি বিশেষ সংবাদপত্রের প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কার পেয়েছি। সেইজন্য, আমার নামে দুর্নামও আছে আমি বোধহয় সেই সংস্থার সঙ্গে এমনভাবে জড়িত যে সেইজন্য তারা বুঝি আমাকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। তারা যে-বছর প্রথম, আমি আনন্দবাজার পত্রিকার কথাই বলছি, তারা যে-বছর প্রথম পুরস্কার দিলেন, সেই বছর আমি-ই প্রথম পুরস্কার পাই আমি এবং বিভূতি মুখোপাধ্যায়। সেটি আমি পেয়েছিলাম ‘গঙ্গা’ উপন্যাসের জন্য।

আমি জানি না এর মধ্যে কোথায় কি অপরাধ – কি অন্যায় লুকিয়ে আছে—

যাই হোক, তবে পুরস্কার ব্যাপারটা আমার কাছে স্বচ্ছ ব্যাপার বলে মনে হয় না। এ বিষয়ে তোমাদের একটা মজার গল্প বলি তাহলে বোধহয় আমাকে আর জবাব দিতে হবে না। তাহলে খুব, আমি নিজের দিক থেকে বেঁচে যাই। এক সময় বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিনে, এখানে আমাদের নৈহাটিতে, কাঁঠালপাড়ায়, রেললাইনের ওপারে তিনজন বিখ্যাত সাহিত্যিক এসেছিলেন—তিনজনই এখন মৃত। এসেছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। এসেছিলেন বনফুল—এসেছিলেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। প্রথম বক্তা ছিলেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তখন সদ্য রাশিয়া প্রত্যাগত এবং তোমরা বোধহয় জানো ওঁর কথাবার্তার মধ্যে বরাবরই বীরভূমি টান ছিল। উনি বীরভূমের লোক। উনি প্রথমে উঠেই ওঁর বলবার মধ্যে একটা ভীষণ ফোর্স কাজ করতো, যখন বলতেন সে কথাটাকে খুব জোর দিয়ে বলতেন—উনি প্রথমে বললেন : আজকে এখানে এসে প্রথমেই আমার বলতে ইচ্ছে করছে যে, আমি যে-দেশে গেসলাম আমি সেই দেশে দেখে এলাম যে সে দেশে সাহিত্যিকদের রাজার সম্মান দেওয়া হয়। আমি সোভিয়েট রাশিয়ার কথা বলতেসি। আমি বলছি সেখানে সাহিত্যিকদের রাজার সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু আমাকে দুঃখের সঙ্গে বইলতে হবে যে আমাদের দেশে সাহিত্যিকদের সেই সম্মান দেওয়া হয় না। তারপরে তিনি আরও কিছু কিছু কথা বল্লেন। তার পরবর্তী বক্তা, ইতিপূর্বে কিন্তু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের ভারতবর্ষে মোটামুটি যতগুলো, মানে, রিজিওন্যাল পুরস্কার পাওয়া উচিত সাহিত্যিকদের তার সবগুলোই পেয়েছেন, কিন্তু বনফুল কোনোটাই পাননি। এর পরবর্তী বক্তাই বনফুল এবং বনফুলের একটা ব্যাপার ছিল, তিনি, মানে, এমনিতে তৈরি করে হঠাৎ বক্তৃতা করতে পারতেন না। তিনি বক্তৃতা লিখে আনতেন সবসময়। তিনি উঠলেন, উঠে বল্লেন যে, আমি তো এমনিতে বক্তৃতা করতে পারি না, সেইজন্য আমি আমার বক্তব্য লিখে এনেছি। কিন্তু আমার পূর্ববর্তী বক্তা যা বলে গেলেন, তাঁর কথার জবাবে আমি একটি কথা বলে পরে আমি আমার বক্তৃতাটি পাঠ করছি আপনাদের সামনে। তিনি বিদেশে গেছলেন এবং সেখানে তিনি দেখে এসেছেন সাহিত্যিকদের রাজার সম্মান দেওয়া হয় এবং আমাদের দেশের সাহিত্যিকদের সেই রাজার সম্মান দেওয়া হয় না, কথাটা হয়তো. খুবই ঠিক, খুবই সত্য—কিন্তু যে- দেশের সাহিত্যিক পুরস্কারের জন্য মন্ত্রীর কাছে ছুটে যায়, যে-দেশের সাহিত্যিক পুরস্কারের উমেদারি কারবার জন্য দিল্লিতে গিয়ে মন্ত্রীর বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত করে, মন্ত্রীর বন্ধুত্ব এবং মন্ত্রীর সেবা করতে চায়, সেই সাহিত্যিকদেরও কি রাজসম্মান দিতে হবে? আমার এটাই একমাত্র জিজ্ঞাসা। এবং আরও মজার কথা হলো তারাশঙ্করবাবু বক্তৃতার পর ভেতরঘরে গিয়ে চা খাচ্ছিলেন – আমাদের নৈহাটিরই এক বন্ধু, অধ্যাপক বন্ধু, কবি বন্ধু, প্রাবন্ধিক বন্ধু, তিনি বল্লেন আপনি কি শুনেছেন আপনার সম্পর্কে বনফুল কি বল্লেন। আপনার বক্তৃতার পরে বল্লেন কি, না একথা বলেছে। তারাশঙ্করের গাড়িতে বনফুল এসেছিলেন। বনফুলের গাড়ি ছিল না। তারাশঙ্করবাবু অত্যন্ত রেগে উঠে বল্লেন, ও! ও এই কথা বলেছে! ঠিক আছে, আমি চল্লাম আমার গাড়ি নিয়ে, আমার সঙ্গে ওকে যেতে হবে না। তোমরা এখন বুঝতে পারছ যে পুরস্কার ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। এটা আমার জবানী নয়, তোমরা বড় দুই দিকপাল সাহিত্যিকের জবানী থেকেই শুনতে পেলে যে পুরস্কার ব্যাপারটা কি। অতএব আমি আর এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছি না।

এই ট্রাডিশন আজও বহমান সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই। সরকারি পুরস্কারের ব্যাপারে একটি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা শোনাই। তখন সদ্য ১৯৯৩- এর ‘রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার’ ঘোষিত হয়েছে। সংকর্ষণ রায়ের সঙ্গে খোলা-মেলা আড্ডা দিতে গিয়ে দেখলাম, আড্ডা তেমন জমছে না। বার বার কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছেন, বার বারই আড্ডার রেশ যাচ্ছে কেটে। সংকর্ষণ রায় এক সময় সম্ভবত অস্বস্তিটা ঝেড়ে ফেলে কিছুটা হালকা হতে বললেন, তিনি এবার রবীন্দ্র পুরস্কার বিচারক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। সেখানে ঘটে যাওয়া অন্যায়কে ঠিক মত মেনে নিতে পারছেন না বলেই ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হচ্ছেন। বিচারক মণ্ডলীর বেশির ভাগ সদস্যই যদিও একটি বইকে সেরা মনে করে পুরস্কার দেওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু সে মতামত বাতিল করে দিল মাত্র দু’জনের মতামত। দু’জন সদস্যই নাকি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ক্ষমতাবান মানুষ। তাঁরা নাকি মত দিয়েছিলেন বইটির লেখক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের বিরোধী, অতএব ওঁকে পুরস্কার দেওয়া চলবে না। তাঁদের গোঁ’র কাছে বহুর মতামত বাতিল হয়ে গেল। বিচারক মণ্ডলীর প্রায় প্রত্যেকেই সরকারি বড় বড় পদাধিকারী। ওইসব পদে থেকে সরকার পক্ষের মতামতের বিরোধিতা করা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই প্রত্যেককে দুয়ের মতের পক্ষে স্বাক্ষর দিতে হল—’সর্বসম্মতভাবে আমরা নির্বাচিত করছি’ বলে।

দুই ক্ষমতাবান বিচারক, যাঁরা নাকি বহুর মতকে অগ্রাহ্য করতে পারেন, পাল্টে দিতে বাধ্য করতে পারেন, তাঁদের নামও সংকর্ষণ রায় জানালেন। দু’জনই আমার কম-বেশি পরিচিত। একজন, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি বিভাগের ডিরেক্টর অপরজন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রো-ভাইসচ্যান্সেলার। আর, বইটির নাম, ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ ২য় খণ্ড।

এই খবরটা আমার কাছে আকস্মিক বা অভাবনীয় ছিল না। খবরের আগাম আভাস আগেই পেয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন উপাচার্য দিন কয়েক আগে আমাকে ফোনে বলেছিলেন, আমার পুরস্কার লাভের সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল। তবে এ বিষয়ে ওই ডিরেক্টরের সঙ্গে যেন কথা বলে নিই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার—সিস্টেমের সোনার শিকল পছন্দ হয়েছে, ডিরেক্টরকে জানান। ফোন করিনি! তাইতেই….কিন্তু আমি তো দুই বিচারকের পার্টির বিরোধী নই? (কোনও পার্টির কোনও ভাল কাজেরই বিরোধী নই) আমি দুর্নীতির বিরোধী। ওঁরা কেন যে ওঁদের পার্টি = দুর্নীতি ভাবলেন, কে জানে?

এইজাতীয় উদাহরণ কিন্তু কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এবং এই উদাহরণ দুটি আমাদের সমাজ কাঠামোয় পুরস্কার দাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যেকার একটা আপোষ- সম্পর্কের বহমান ধারাবাহিকতারই দৃষ্টান্ত মাত্র। যাঁরা পুরস্কার পান, তাঁরা নিশ্চয় সাধারণের চেয়ে প্রতিভাবান, তা কমই হোক, কি বেশি। কিন্তু প্রতিভাই এদেশে পুরস্কার পাওয়ার একমাত্র মানদণ্ড নয়। সঙ্গে চাই দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে কিঞ্চিত দেওয়া-নেওয়া, গাঁ শোঁকাশুঁকি, পিঠ চাপড়া-চাপড়ি, আপোষ ইত্যাদি জাতীয় সম্পর্ক। যা প্রকারান্তরে দুর্নীতি। কখনও কখনও এই দুর্নীতি বিশাল হয়েও ওঠে।

বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতা

লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীন? এ প্রসঙ্গে সমরেশ বসু’র একটি উক্তি হাজির করছি : “আমি আমার নিজের একটা জগৎ সৃষ্টি করছি এবং সেখানে আমি আমার স্বাধীনতাকে প্রতিফলিত করছি। সেটা কবিতা হতে পারে, সাহিত্যে গদ্য হতে পারে, ছবি হতে পারে, গান হতে পারে— যে কোনোদিকে তুমি তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারো। সুতরাং আমি আগেই বলেছি, তোমাদের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার স্বাধীনতা যে আদৌ আমার কাছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। কারণ তার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আছে সংসারের (সমাজের) এমন সমস্ত ব্যক্তি, এমন সমস্ত সংস্থা, যে হয়তো আমার পক্ষে স্বাধীনভাবে সবকথা বলা, তাদের সম্পর্কে, সম্ভব হবে না।” (“ড্যাফোডিল’ সাহিত্য পত্রিকাটিতে প্রকাশিত সমরেশ বসু’র ওই সাক্ষাৎকারটির একটি অংশ)।

এই প্রসঙ্গে সমরেশ বসু উদাহরণও টেনে এনেছেন। শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ও “সাহিত্য নিয়ে যারা মনোপলি বিজনেস করে, আজকে আমাদের ভারতবর্ষে, এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই কথা নয়, এটা সারা ভারতবর্ষেরই কথা, যে, যে কোনো সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকই কোনো-না-কোনো ভাবে বিগ বুর্জোয়া মনোপলি বিজনেস সাহিত্যে যাদের আছে, তাদের সঙ্গে আঁতত করেন…”

৬২-র চীন-ভারত যুদ্ধের সময়ে দেশ পত্রিকায় ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ শিরোনামে বিভিন্ন লেখকদের দিয়ে লেখানো হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারেই সেই প্রসঙ্গে টেনে এনে সমরেশ বসু আমাদের, শুনিয়েছেন, সেখানে বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের বন্ধু হিসেবে বুক ঠুকে প্রচার করা সাহিত্যিকদের ডিগবাজি খেয়ে উল্টো গাওয়ার গল্পো। সেখানে ‘বিগ প্রেস’-এর সঙ্গে আঁতাত করতে এগিয়ে এসেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়….। সেদিন সমরেশ বসু আমন্ত্রণ পেয়েও লেখেননি, ভারতের তৎকালীন রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না বলেই লেখেননি।

বুদ্ধিজীবীদের ডিগবাজি খাওয়ার ব্যাপক এক প্রবণতা দেখা গিয়েছিল ১৯৬২তে চিন ভারত-যুদ্ধের সময়। চিনের বিরুদ্ধে উগ্র জাতীয়তাবোধ জাগিয়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়োগ করল রাষ্ট্রশক্তি। সমস্ত প্রচার মাধ্যমগুলোকে কাজে লাগাল জাত্যভিমানের ঝড় তুলতে। আর অমনি ঝাঁকে ঝাঁকে কমিউনিস্ট ও কমিউনিস্ট- ঘেঁষা শিল্পী-সাহিত্যিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘দেশপ্রেমিক’ প্রমাণ করে অনুকূল স্রোতে গা ভাসাতে। গণনাট্যের লড়াকু লোকসঙ্গীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী গানের কথা পাল্টে ফেলে রাতারাতি নেমে পড়লেন দেশপ্রেমের জোয়ার আনতে। ভূপেন হাজারিকা তাঁর “ভারত সীমানায়” গানের কথাই পাল্টে দিয়ে কমিউনিস্ট অপবাদ কাটিয়ে ‘দেশপ্রেমিক’ হয়ে গেলেন। গানের কথা ছিল, “চীনের জনতার জয়ধ্বনি শুনি”। এ-জায়গায় তিনি নতুন করে কথা বসালেন, “গাঁয়ের সীমানায় নিশীথ রাত্রির পদধ্বনি শুনি।” গণনাট্য সংঘের বিশিষ্ট সংগঠক অভিনেত্রী নিবেদিতা দাস চীন-বিরোধী নাটক মঞ্চস্থ করলেন—পাছে পুলিশ তাঁকে চীনপন্থী বলে ঝামেলা করে। মহারাষ্ট্রের বিশিষ্ট গণনাট্য সংগীতকার ওমর শেষও রাতারাতি ভোল পাল্টালেন। ডিগবাজি খাওয়ার ব্যাপারে কমিউনিস্ট কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কমিউনিস্টদরদী নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কেউই পিছিয়ে রইলেন না। গণনাট্য সংঘের পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি নাট্যকার দিগীন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সীমান্তের ডাক’ নামে চীন-বিরোধী একটা নাটকই রচনা করে ফেললেন। এমন ডিগবাজিকারদের সংখ্যা এতই বিপুল যে তাঁদের নামের ফিরিস্তি দিয়েই একটা গোটা বই লিখে ফেলা যায়। তবে এ-কথা বাস্তব সত্য যে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বড় অংশই ডিগবাজির খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এমন এক হুড়োহুড়ি পড়ে যাওয়া আত্মবিক্রির মধ্য দিয়ে গণনাট্য সংঘের নাটক- গান ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে নতুন সংস্কৃতি গড়ার আংশিক চেষ্টাটুকুও বিশাল ধাক্কা খেয়েছিল। অসাম্যের সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে ওঠার শুরুতে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় নামা পুরোহিত সম্প্রদায় রাজশক্তির সঙ্গে আঁতাতের যে সূচনা করেছিল, এযুগের বুদ্ধিজীবীরা সেই ‘ট্রাডিশন’ আজও বজায় রেখে চলেছেন। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে আমরা দেখলাম, বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সরকারকে মদত দিতে প্রায় তামাম বুদ্ধিজীবীই ভাঙা কাঁসির মত বাজিয়ে চলেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ‘মহান বাণী’, যা অবশ্যই আমাদের দেশের সংবিধানের বিরোধীতারই নামান্তর। কারণ, ভারতীয় সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) শব্দের অর্থ করা হয়েছে—ধর্মের ক্ষেত্রে ভারত থাকবে নিরপেক্ষ, অর্থাৎ কোনও ভাবেই কোনও ধর্মের পক্ষেই নয়। রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষানীতি ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মুক্ত থাকবে। অর্থাৎ

(১) ভারতীয় সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষ (Secular)’ শব্দটির অর্থ করা হয়েছে—ধর্মের ক্ষেত্রে ভারত থাকবে নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষানীতি ধর্মীয় অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত থাকবে। সংবিধানকে মর্যাদা দিতে সরকারকে ধর্মনিরপেক্ষতার যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ :

(ক) রাষ্ট্রীয় সমস্ত রকম কার্যকলাপে ধর্মীয় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।

(খ) শিক্ষায়তনগুলোতে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় প্রার্থনা, ও পঠন-পাঠনে ধর্মীয় নেতাদের জীবনী এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচেতনা বৃদ্ধিকারী বিষয়ের অন্তর্ভুক্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

(২) ধর্মীয় কার্যকলাপে রাজনৈতিক নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা নিষিদ্ধ করতে হবে।

(৩) যে রাজনৈতিক দলের নেতা ধর্মীয় কার্যকলাপে পৃষ্ঠপোষকতা করবেন অথবা প্রকাশ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন, সেই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে, নতুবা গোটা দলকেই সাম্প্রদায়িক হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

(৪) সরকারি প্রচার-মাধ্যমে ধর্মীয়-প্রচারকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

(৫) কোনও আবেদনপত্রে আবেদনকারীর ধর্ম জানতে চাওয়া চলবে না। কোনও রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত থাকলে বা সাম্প্রদায়িকতাকে পালন করার কাজে বা উসকে দেওয়ার কাজে যুক্ত থাকলে সংবিধানের ১৯৮৯ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল্ (আমেন্ডমেন্ট) অ্যাক্টের ২৯(এ) ধারা বলে ওই রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি খারিজ করার বিধান আছে।

উপরোক্ত ধারা মতে, দেশের সংবিধানে যে মৌলিক নীতিগুলি আছে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে সেই মৌলিক নীতিগুলির প্রতি লিখিতভাবে আস্থাজ্ঞাপন করতে হবে নির্বাচন কমিশনের কাছে। কোনও ক্ষেত্রে কোনও দল এই নীতিগুলি অমান্য করলে নির্বাচন কমিশন ২৯(এ) ধারা বলে সেই রাজনৈতিক দলের রেজিস্ট্রেশন কেড়ে নিতে পারে।

বুদ্ধিজীবীরা কেন নেমেছিলেন আমাদের সংবিধানে দেওয়া ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ব্যাখ্যাকে পাল্টে দেওয়ার কাজে? কারণ শাসক ও শোষকরা তেমনটাই চেয়েছিলেন। দেশবাসীকে নানা ধর্মের নামে নানাভাবে বিভক্ত করার স্বার্থেই চেয়েছিলেন। নির্বাচনে ধর্মকে নিয়ে দাবা খেলার স্বার্থেই চেয়েছিলেন ধর্মীয় বিভাজন থাকুক।

গত বছরখানেকের ‘দেশ’ পত্রিকাটির দিকে লক্ষ্য রাখলেই দেখবেন, ‘ধর্ম’ নিয়ে কতই না লেখা অফুরন্তধারায় প্রকাশিত হয়েই চলেছে। ধর্মের অমানবিক দিকগুলো যত বেশি বেশি করে আমরা, যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদীরা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেছি, এবং ধর্ম ও ধর্মীয় নেতারা যখন সাধারণ মানুষদের কাছে প্রশ্নাতীত আনুগত্যের আসন থেকে চ্যুত হচ্ছে, তখন ‘অশনি-সংকেত’ দেখতে পেয়েছে সিস্টেমের মধুপানে পুষ্ট শোষক-শাসক প্রচারমাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীরা। বুদ্ধিজীবীদের পত্রিকা হিসেবে চিহ্নিত ‘দেশ’ পত্রিকাই অবস্থা ফেরবার মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। কাজে লাগিয়েছে অম্লান দত্ত’দের মত সিস্টেমের নির্ভরযোগ্য কুশলী কলমগুলোকে, যাঁরা ধর্ম ও যুক্তির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কথা লেখেন, এই সমাজ ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতেই লেখেন।

ট্র্যাডিশনের স্রোতে মগজবেচা বুদ্ধিজীবী

রাষ্ট্রীয় কাঠামোর, সমাজ কাঠামোর সহায়ক শক্তিগুলো প্রতিটি প্রয়োজনের মুহূর্তেই নানা ভাবে তাদের স্বার্থের উপযোগী একটা সাংস্কৃতিক বাতাবরণ তৈরির চেষ্টা করেই চলে, বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায়। এমন চেষ্টার মধ্যে রয়েছে নানা কূট-কৌশল, অনেক খুঁটিনাটি, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপার-স্যাপার। বুদ্ধিজীবীরা একদিকে এইসব পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকেন পরামর্শদাতা হিসেবে, আর এক দিকে পরিকল্পনাকে সার্থক করে তোলার কাজে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এই ‘নির্দিষ্ট ভূমিকা’র মধ্যে সিংহভাগ জুড়ে থাকে তাদের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ভোগবাদ ও অধ্যাত্মবাদক নানাভাবে জনগণের কাছে হাজির করা ও তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।

শুধু ‘ফরোয়ার্ড’-এর শক্তির উপর নির্ভর করে যেমন ফুটবল কি হকি খেলা জেতা যায় না, তার জন্য প্রতিপক্ষের আক্রমণের সামাল দিতে শক্তিশালী ‘ডিফেন্স’- এরও প্রয়োজন; ঠিক একই ভাবে দুর্নীতির এই সমাজ-কাঠামোর উপর আছড়ে পড়া হামলা রুখতে প্রয়োজন হয় শক্তিশালী একটি ডিফেন্স লাইনের। এই ডিফেন্স লাইন হিসেবে দুটি পদ্ধতি বর্তমান সমাজ কাঠামোর নিয়ন্ত্রক শক্তির কাছে খুবই জনপ্রিয়। এক : যে সংস্থা বা সংগঠন এই সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে আঘাত করছে, সেই সংস্থার আদলে বহিরঙ্গকে সাজিয়ে কিছু সংস্থা তৈরি করে মেকি আন্দোলন গড়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা ও সমাজ-কাঠামো বিরোধী আন্দোলনের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেওয়া। অথবা সমাজ-কাঠামো বিরোধী আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত সংস্থাগুলোর নেতৃত্বকে লোভ বা ভয় দেখিয়ে কিনে নিয়ে নিজেদের স্বার্থে তাদের কাজে লাগানো। দুই : ‘প্রগতিশীল’, ‘বিপ্লবী’, ‘প্রতিবাদী’ ইত্যাদি পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের কিনে নিয়ে তাদেরকে দিয়ে সমাজ কাঠামো বিরোধী আন্দোলনের বিরোধিতা করানো। এগুলো পুরনো, কিন্তু যথেষ্ট কার্যকর কৌশল। উদাহরণ হিসেবে এখানে শুধু একটি ঘটনার দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এককালের যুক্তিবাদের চরম সমর্থক আজিজুল হককে আমরা দেখেছি। তাঁর অনেক বক্তব্য যুক্তিবাদের সমর্থকদের উদ্দীপ্ত করেছে। তিনি একথাও সোচ্চারে ঘোষণা করেছিলেন, যুক্তিবাদী সমিতিই সেই মিছরি তৈরির প্রথম দানাটি, যাকে ঘিরে সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানুষ এক হবেন।

তারপর সময় গড়িয়েছে। রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতার রোদে তিনি লাল থেকে গোলাপী হয়েছেন। এবং কৃতজ্ঞতা শোধ করতে তিনি কলম ধরেছেন। এবং তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছে, “যুক্তির একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে, এটা যুক্তিবাদ, যে-কেউ মেনে নেবে, কিন্তু এটা তো সত্য নয়। সূর্য ওঠেও না, ডোবেও না, আসল সত্য হল এটাই। সুতরাং ‘যুক্তিবাদী’ আর ‘সত্যবাদী’ এক ব্যক্তি নন। যুক্তিবাদ শেষ বিচারে টুপি পরানোর প্রতিক্রিয়াশীল মতবাদ।” [উবুদশ, বর্ষ ৭, সংখ্যা ৪]

আজিজুল সাহেব, আপনি যখন বলেন, “সূর্য ওঠে না, ডোবেও না, আসল সত্য হল এটাই,” তখন একথা মানুষের কাছে গ্রহণীয় করতে আপনি যুক্তিরই আশ্রয় নেন। সেই সঙ্গে এও জানি যাঁরা আত্মার অমরত্বের সমর্থনে বলেন, তাঁরাও যুক্তিরই আশ্রয় নেন, এবং উভয় ক্ষেত্রেই দু’জনের যুক্তিতেই থাকে যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর। যার জন্য এগুলো শেষ বিচারে কু’যুক্তি হিসেবেই শেষ হয়ে যায়।

মাননীয় আজিজুল সাহেব, পৃথিবীতে অবস্থানকারী মানুষদের চোখে সূর্যের ‘ওঠা’ ও ‘ডোবা’, দুইই বাস্তব সত্য। সূর্যের এই ‘ওঠা’ ও ‘ডোবা’ পৃথিবী যে নিজের মেরুদণ্ডের চারপাশে লাটুর মত ঘুরে চলেছে, তারই ফল। আপনি এমন সহজ যুক্তিটা বুঝলেন না কেন, মাননীয় আজিজুল সাহেব? জ্ঞানের খামতির কারণে? কিন্তু আপনি তো যথেষ্ট শিক্ষিত বলেই জানি। অতএব, স্কুলের থ্রি-ফোর-এর জ্ঞানটুকু আপনার নেই, মেনে নেওয়া মুশকিল। তবে কি রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সমঝোতাই আপনার এজাতীয় পাগলামোর কারণ? আর এই শেষ সম্ভাবনাটারই সত্যি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা সবচেয়ে প্রবল? কারণ, আপনি লেখাটিতে ‘যুক্তিবাদী সমিতি’র বিরোধিতা না করে গোটা ‘যুক্তিবাদী’-এর চূড়ান্ত বিরোধিতায় নেমেছেন। দুঃখ হয়, সত্যিই দুঃখ হয় আপনার এমন ভিক্ষাপাত্র ধরা চেহারা দেখে।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা, আপনারাই পারেন বুদ্ধিজীবীদের টিনের তলোয়ার নিয়ে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে ‘ঝন্-ঝনা-ঝন’ নাটুকে লড়াইকে বন্ধ করতে, অথবা তাঁদের কথায় ও কাজে এক হতে বাধ্য করে বাস্তবিকই লড়াইতে নামাতে।

সব আন্দোলনই সিস্টেম ভাঙার আন্দোলন নয়

গত কয়েক বছরে আমরা বিভিন্ন ধরনের দাবি আদায়ের আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখেছি। ‘চিপকে’, ‘নর্দমা বাঁচাও’র মত বিভিন্ন দাবি বা ইস্যু-ভিত্তিক আন্দোলনের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, এইসব আন্দোলনের নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়তা আছে, সুন্দর সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে এদের নিশ্চয়ই উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে এবং থাকবে। কিন্তু এইসব আন্দোলন যেহেতু অসাম্য বজায় রাখার সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’ পাল্টে দেওয়ার লক্ষ্যে জনমানসকে সমাবেশিত করতে পরিচালিত নয়, তাই সমাজ কাঠামো জিইয়ে রাখার অংশীদার রাজনৈতিক দল, প্রচারমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদিরা দলগত-স্বার্থ, ব্যক্তিগত-স্বার্থ, ব্যক্তি-ইমেজ ইত্যাদির দ্বারা পরিচালিত হয়ে এই জাতীয় আন্দোলনকে সমর্থন বা অসমর্থন করেন।

অসাম্যের সমাজকাঠামো ভাঙতে…..

প্রিয় আন্তরিক ও সহানুভূতিশীল পাঠক-পাঠিকারা, আপনারাই পারেন ‘সিস্টেম’ নামের শোষক-শাসক-প্রচারমাধ্যম- বুদ্ধিজীবীদের দুর্নীতির আঁতাতকে আঘাতে আঘাতে গুঁড়িয়ে দিতে। আপনাদের ঘৃণাই পারে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার পা’গুলোকে ভেঙে ফেলতে। আপনাদের তীব্র ঘৃণাই পারে রাষ্ট্রশক্তির সিংহাসনকে ফেলে দিতে। এবং আপনারাই পারেন, পরম মমতায় যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠা করতে—যা বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের প্রাথমিক ও আবশ্যিক ধাপ।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা ও সংগ্রামের সাথীরা, এরই সঙ্গে মনে রাখতে হবে একটি অতি প্রয়োজনীয় কথা—অতীত ইতিহাস আমাদের অতি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিটি রাষ্ট্রক্ষমতা বদলের ক্ষেত্রে, সমাজ কাঠামো পাল্টে দেবার ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে তুলনামূলকভাবে সহজে, যখন সমাজ কাঠামোর সমর্থক শক্তির মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে টেনে আনা গেছে তাদেরই একটা অংশকে।

আমরা সাম্প্রতিক উদাহরণে দেখেছি, নকশালপন্থী দলের সদস্য না হয়েও তাদের আদর্শকে সমর্থন করতে এগিয়ে আসা বহু শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের। সে’দিন নকশালপন্থীদের পরিকল্পনার মধ্যে একটা বড় ভুল ছিল, এই শিল্পী- সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটি প্রয়োজনীয় সাংস্কৃতিক বাহিনী গড়ে তোলা হয়নি। ভুল, কারণ, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করতে চাইলে সশস্ত্র আঘাত হানার জন্য সংগ্রামী মানুষের বাহিনী নামাবারও আগে প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বাহিনীকে নামানো। এ’কথা সমস্ত শ্রেণীর ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রেই বাস্তব সত্য।

আমরা দেখেছি, পূর্ব ইউরোপের মার্কসবাদী দেশগুলোতে দীর্ঘ দিন ধরে মগজ ধোলাই প্রক্রিয়া চালিয়ে গিয়েছিল মার্কসবাদ-বিরোধী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই প্রক্রিয়াকে সাফল্যের সঙ্গে চালাতে তারা সহযোগিতা নিয়েছিল সেইসব মার্কসবাদী দেশের বুদ্ধিজীবীদের, প্রচার মাধ্যমগুলোর, শাসক শ্রেণীর ও প্রশাসনের মধ্যেকার কিছু কিছু দুর্নীতির ঘুণপোকায় কাটা মানুষের, ওইসব দেশে ধৈর্যের সঙ্গে লাগাতার ভাবে মার্কিন সংস্কৃতির গন্ধ পাঠানো হয়েছে। ভোগসর্বস্ব সংস্কৃতির গন্ধ পাঠানো হয়েছে, মানুষের চেতনায় নিরন্তর উত্তেজনাপূর্ণ জীবন যাপনের খোরাক পাঠানো হয়েছে। সে উত্তেজনা একান্ত সুখের উত্তেজনা, বহুর থেকে বাড়তি সুখ ভোগের উত্তেজনা, নাচ, গান, যৌনতা, যুদ্ধ, ধর্মীয় নেশা ইত্যাদি নানা ভাবে পাওয়া উত্তেজনা। এই সব উত্তেজনার এইসব ভোগসর্বস্ব চিন্তার এমনই মাদকতা, মানুষ তখন আত্ম-সুখের বাইরে কিছু ভাবতেই চাইবে না। ‘যেন তেন প্রকারেণ’ নিজের আখের গোছানোর এই চিন্তার মধ্য দিয়েই তারা পরিচালিত হবে। বৃহত্তর সমস্যার প্রতি, অন্যের সমস্যার প্রতি তাকিয়েও দেখবে না, দেখতেই চাইবে না।

সেই সঙ্গে ওইসব দেশ অধ্যাত্মবাদী চিন্তাকেও পাঠানো হয়েছে। কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, খ্রিস্ট সবাই এসে আসর জাঁকিয়েছে। ক্ষমতার ঘুণপোকায় শাসকদের সাম্য-চিন্তাকে কখন যে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, টেরই পাওয়া যায়নি। সাংস্কৃতির আন্দোলনের অভাবেই টের পাওয়া যায়নি, চেতনা কখন লোভী হয়েছে। লোভী চেতনার কিছু শাসকই নিজ স্বার্থকে চরিতার্থ করতে, অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার দিকে সমাজের চাকাকে ঘোরাতে এইসব ভোগবাদী ও অধ্যাত্মবাদী সংস্কৃতি আমদানি করতে দিয়েছে। তারপর এক সময় আমরা দেখলাম মার্কিন সংস্কৃতির গন্ধে মাতাল হতে মার্কসবাদী দেশের পুলিশ ও সেনাকে। ফলে মার্কসবাদীদের হাত থেকে ক্ষমতা দখল করতে মার্কিন গোয়েন্দা সি. আই. এ’রা বোমা, গোলা, বারুদ কিছুই প্রয়োগ করল না। প্রয়োগ করল ‘মগজ ধোলাই’ ও সমাজ কাঠামোর সিংহাসনের পায়াগুলোর মধ্যে সরাসরি বিভাজন করার ব্রহ্মাস্ত্র। আর তাইতেই হুড়মুড় করে একের পর এক মার্কসবাদী সাম্রাজ্য বসে পড়ল।

অস্বীকার করার উপায় নেই সর্বত্র নাক গলানোর ব্যাপারে সি. আই. এ-র যেমন জুড়ি নেই, তেমনই চিন্তাকে একমুখী করে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার ব্যাপারেও তারা অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সবার কাছ থেকেই আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। চিন্তার অন্ধত্বে আবদ্ধ না থেকে শেখার মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হলে অবশ্যই অনেক কিছুই শেখা যায়। সি. আই. এ-র ঘটানো ঘটনাগুলো থেকে আমরা অবশ্যই একটা শিক্ষা নিতে পারি, একটা সত্যে পৌঁছুতে পারি—জনচিন্তাকে একমুখী করে ও অসাম্যের সমাজ কাঠামোর সহায়ক শক্তিগুলোর মধ্যে থেকেই আমাদের আদর্শের সমর্থক বন্ধু সংগ্রহ করে, এই সমাজ কাঠামোকে ধসিয়ে দেওয়া যায়। বিশ্ব-ত্রাস রাষ্ট্রশক্তির মধ্যেও ত্রাসের সঞ্চার করা যায়।

এই শিক্ষাকে আমরাই বা কেন কাজে লাগাতে পারব না। আমরাও যদি জন- চেতনাকে বঞ্চিত মানুষদের পক্ষে একমুখী করি তবে, আমাদের দেশের সরকারই বা গণেশ উল্টোবে না কেন, ভারতবর্ষের তুলনায় বহুগুণ শক্তিশালী সামরিক শক্তির সাহায্য নিয়েও যখন গণ-বিদ্রোহের মুখে পূর্ব ইউরোপের মার্ক্সবাদী দেশগুলোকে পিছু হটতে হয়েছে, তখন ভারতের ক্ষেত্রেও একমুখী গণ-বিক্ষোভের মুখে সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করা যাবে না কেন?

সাংস্কৃতিক চেতনাকে একমুখী করে অপসংস্কৃতির দ্বারা, অর্থাৎ ভোগবাদী চিন্তার দ্বারা প্রভাবিত করে জনগণকে যদি রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামে নামানোর কাজটি সি. আই. নিখুঁত ও সার্থকভাবে পালন করতে সমর্থ হয়, তবে আমরাই বা কেন বঞ্চিত মানুষদের চেতনাকে সুস্থসংস্কৃতির খাতে বইয়ে বঞ্চনার প্রকৃত কারণগুলোর দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জনগণকে রাজনৈতিক সংগ্রামে নামাতে পারব না?

যাঁরা তোতাপাখির মতই আউড়ে যান—”সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়, রাজনৈতিক সংগ্রামই আনতে পারে শ্রেণী-মুক্তি”, তাঁরা অবশ্যই বিশ্বের তাবৎ ঘটনার থেকে নিজেদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখেন শুধুমাত্র বইয়ের পাতায়। জীবন থেকে শিক্ষা নেবার পরিবর্তে এঁরা শিক্ষা নিতে চান শুধুই ছাপার অক্ষর থেকে। পৃথিবীতে কোনও কিছুই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে থাকে না। ভাববাদও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে নেই শোষণের প্রক্রিয়াগুলো। জিততে গেলে বঞ্চিত মানুষদের স্বার্থেই শোষণের আধুনিকতম কৌশলগুলোকে বুঝতে হবে, শোষকদের বিরুদ্ধে আধুনিকতম কৌশলগুলোরই প্রয়োগ করতে হবে। লক্ষ্য যতই স্থির থাকুক, আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে মান্ধাতার আমলের অস্ত্র নিয়েই লড়াই চালানো যায় না। এখানে অস্ত্র বলতে বোঝাচ্ছি—’মগজ-ধোলাই’ নামক শক্তিশালী অস্ত্রের কথা,যে অস্ত্রের কার্যকারিতা ও সাফল্য প্রশ্নাতীত বলেই আজ তাতে কোনও শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তিই প্রশ্নাতীত গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

যাঁরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মাঝে একটা বিভেদের পাঁচিল তুলে দেন, তারা চোখটি খুলে দেখতে চাননি সাংস্কৃতিক আন্দোলন কর্মী ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে কাল্পনিক বিভেদের পাঁচিল বার বারই ভেঙে পড়েছে, দুই আন্দোলনকর্মীরাই মিলে-মিশে একাকার হয়ে গেছে, যখনই বঞ্চিত মানুষের চেতনা মুক্তির জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীরা ময়দানে নেমেছেন।

একটা বিপ্লবের আগে জনগণকে মানসিকভাবে ক্ষুধার্ত করে তুলে, মোটিভেট করে তুলে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে চালিত করা যায় এবং রাষ্ট্রশক্তির কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা যায়, এটা যেমন আজ বহুবার পরীক্ষার দ্বারা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তেমনই এও সত্য—বিপ্লব-পরবর্তী পর্যায়ে নেতৃত্বকে বিশেষ সুবিধাযোগী শ্রেণীতে পরিণত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে, বিচ্যুত নেতাদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে এবং জনগণকে ভোগসর্বস্ব চিন্তা থেকে রক্ষা করতে, ভাববাদী চিন্তা থেকে বাঁচাতে একান্তভাবেই যুক্তিবাদী আদর্শবাদী চিন্তার এক বাতাবরণ সৃষ্টির প্রয়োজন। এই যুক্তিবাদী, আদর্শবাদী চিন্তার বাতাবরণ সৃষ্টির যে প্রক্রিয়া, তাই তো সাংস্কৃতিক আন্দোলন।

এমন একটা লাগাতার সাংস্কৃতিক আন্দোলন না থাকলে নেতারা বিশেষ সুবিধাভোগী হয়ে উঠতেই পারে। আখের গোছানো, স্বজনপোষণ ইত্যাদি দুর্নীতি ঘাড়ে চাপতেই পারে, যা পূর্ব ইউরোপের মার্ক্সবাদী দেশগুলোর নেতাদের ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল।

সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলে মানুষের চিন্তাকে একমুখী করে তোলা সম্ভব, মানুষকে মোটিভেট করা সম্ভবএটা আজ প্রমাণিত সত্যএই সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা অবশ্যই বলতে পারি— বিপ্লবের আগে, বিপ্লব কালে এবং বিপ্লব পরবর্তী পর্যায়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা অপরিসীম

নিপীড়িত মানুষদের চিন্তাকে একমুখী করতে, দ্রুত ও সফলতার সঙ্গে করতে বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমাদের আদর্শের খবর পৌঁছে দিতে হবে, তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। চেষ্টা আন্তরিক হলে কিছু বুদ্ধিজীবী, কিছু প্রচার মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত মানুষকে এই কাজে সঙ্গে পাওয়া যাবেই, যেমন আমরা পেয়েছি। আমাদের সমিতির অভিজ্ঞতা বলে, শাসক, প্রশাসন, পুলিশ সবার মধ্যে থেকেই অসাম্যের সমাজ গড়ার আদর্শের সমর্থক পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় বলেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়তে নেমে অনেক অসম লড়াই আমরা জিতে চলেছি।

শেষ লড়াইও জেতা যায়, এবং তা আমরা জিতবই। অসাম্যের এই সমাজ কাঠামো ভেঙে, নতুন সমাজ কাঠামো আমরা গড়বই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *