অধ্যায় : আট – অসাম্যের বিষবৃক্ষের মূল শিকড় অধ্যাত্মবাদ অধ্যাত্মবাদের মূল শিকড় আত্মা
‘অধ্যাত্ম’ ও ‘আধ্যাত্ম’ দুটি শব্দই অর্থবহ এবং এক ও অভিন্ন। ‘অধ্যাত্মিক’ বা ‘আধ্যাত্মিক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘আত্মাবিষয়ক’, ‘প্রেতলোক বা পরলোক বিষয়ক’।
সারা পৃথিবীর প্রধান প্রধান ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো (এখানে আমি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বা পরমপিতাজাতীয়ে নতজানু ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর কথা বলছি। যেখানে ‘ধর্ম’ হিসেবে মানুষ ‘মানবতা’কে চিহ্নিত করেছে, সেই ধর্মের কথা বলছি না।) নিয়ে আলোচনা করলেই দেখতে পাব, এরা প্রত্যেকেই আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী। ‘আত্মা অমর’— এই বিশ্বাসের সূত্র ধরেই এসেছে ‘পরমাত্মা’ বা ‘পরমপিতা’ জাতীয়ের অস্তিত্বে বিশ্বাস। কল্পনা এগিয়েছে। জাগতিক জীবনের কাজ-কর্মের ফল বিচারের দায়িত্ব পেয়েছে পরমপিতা বা ঈশ্বর। ‘মৃত্যুতেই সব কিছুর শেষ নয়’–এই কল্পনা থেকেই একটু একটু করে রূপ পেল ‘প্রেতলোক’ বা ‘পরলোক’। কল্পনায় সৃষ্টি হলো ‘স্বর্গ-নরক’। কল্পনাই এক সময় দৃঢ়বদ্ধ বিশ্বাসে রূপান্তরিত হলো। এ’ভাবেই প্রতিটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের প্রাথমিক ও আবশ্যিক শর্ত হয়ে দাঁড়াল— ‘আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস’, ‘পরমাত্মা বা পরমপিতাজাতীয়ে বিশ্বাস’ ও ‘পরলোকে বিশ্বাস’। ধর্মের এই তিন আবশ্যিক শর্ত’কে নিয়ে যে মতবাদ, তাই হল ‘অধ্যাত্মবাদ’। ‘অধ্যাত্মবাদ’ই সেই ভিত্তিভূমি, যার উপর নানা আচার-সর্বস্ব ব্যাপার-স্যাপার ও নানা যুক্তিহীন সংস্কার চাপিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম।
একান্তভাবে বিশ্বাস-নির্ভর যুক্তিহীন এই অধ্যাত্মবাদ মৃত্যুর পর স্বর্গসুখের প্রলোভন দেখিয়ে বঞ্চিত মানুষদের বঞ্চনাকে সহ্য করার শক্তি যেমন যোগাল, তেমনই বিধাতার দেওয়া (!) বঞ্চনাকে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ও প্রতিরোধহীন ভাবে মেনে নিতেও শেখাল। ঈশ্বরজাতীয়ে বিশ্বাস থেকেই জন্ম নিল ঈশ্বরকে তুষ্ট করার নানা পদ্ধতি-প্রকরণ, তন্ত্র-মন্ত্র, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি। শাস্ত্র-বিশ্বাস ও ধর্ম-বিশ্বাস যেমন একদিকে ধর্মগুরুদের প্রতি বিশ্বাসকে অটল করল, তেমনই ধর্মগুরুরা যে ঈশ্বরের পুত্র, পয়গম্বর, প্রতিনিধি, অবতার বা ঈশ্বরের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগসূত্র—এই বিশ্বাসকেও দৃঢ়বদ্ধ করল। এরই সঙ্গে সম্পর্কিতভাবে মানুষ সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মের পরম প্রতিনিধি এইসব ধর্মগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করল। প্রতিটি গরুত্বপূর্ণ কাজে ধর্মগুরুদের পরামর্শ নেওয়াটা জরুরি বলে মানুষ বিশ্বাস করল। ধর্মগুরুরা একটু একটু করে হয়ে উঠল সবজান্তা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা। ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের প্রচণ্ড প্রভাবের ফলে ও সচেতন প্রচেষ্টায় সমাজে ব্যাপকভাবে সৃষ্টি হল ভাগ্যে বিশ্বাস। এভাবে যতই এগোবেন, ততই বিশ্বাসবাদের ফিরিস্তি দীর্ঘতর হবে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নিই। অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে জড়িত ব্যাপারগুলো আমি ঠিক যে ক্রমে উল্লেখ করলাম, এমন নয় যে সেগুলো ঠিক ঐ ঐতিহাসিক ক্রম অনুযায়ীই একের পর এক সমাজে আবির্ভূত হয়েছিল। এই স্বল্প পরিসর আলোচনায় আমি নিশ্চয়ই ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে চাইনি। আমি চেয়েছি— অধ্যাত্মবাদ, রহস্যবাদ ও বিশ্বাসবাদের নানা পরস্পর সম্পর্কিত দিককে আপনাদের নজরের সামনে নিয়ে আসতে ও চিহ্নিত করতে।
আসুন, এ’বার আমরা বিজ্ঞানের মুখোশ আঁটতে চাওয়া পরামনোবিজ্ঞানের দিকে চোখ ফেরাই। পরামনোবিজ্ঞানের গবেষণার মূল বিষয়ও হল ‘মন’ ও ‘আত্মা’। মনের ইন্দ্রিয়াতীত রহস্য সন্ধান, প্ল্যানচেটে আত্মাকে এনে পরলোক রহস্যের গবেষণা ও জন্মান্তরবাদের সূত্র সন্ধানের মধ্যেই পরামনোবিজ্ঞানের কাজ-কর্ম সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ পরামনোবিজ্ঞানের কাজ-কর্মও আত্মাবিষয়ক বা অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
এ’বার গোটা ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখি আসুন। অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ, পরামনোবিজ্ঞান পুরোপুরিভাবে দাঁড়িয়ে আছে আত্মার অমরত্নের উপর নির্ভর করে, আত্মা মরণশীল প্রমাণিত হলে অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ ও পরামনোবিজ্ঞানের অস্তিত্বটাই তাসের ঘরের মতো হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে বাধ্য।
অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ ও পরামনোবিজ্ঞানের দেওয়া আত্মা বিষয়ক সংজ্ঞাকে মেনে নিয়েও সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করা যায়—আত্মা অমর নয়। একটু একটু করে আমরা যখন পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ‘আত্মা’ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে নামব, তখন আমরা সুনির্দিষ্ট প্রমাণই হাজির করব।
‘আত্মা” অমর না হলে ‘পরলোক’, ‘স্বর্গ-নরক’, ‘পরমাত্মা’ বা ‘পরমপিতা’ ইত্যাদি সবই যে এক লহমায় বাতিল হয়ে যায়; অধ্যাত্মবাদের ভিত হারিয়ে ধর্মের প্রাসাদ গুঁড়িয়ে ধুলো হয় মুহূর্তে—শুধু এই সহজবোধ্য যুক্তিটুকু মাথায় রেখে আমরা লক্ষ্য রাখবো পরবর্তী অধ্যায় ও আলোচনাগুলোয়।
সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা জেনেছি—দর্শনের ইতিহাসে মূল দ্বন্দ্ব অধ্যাত্মবাদ বনাম বস্তুবাদী যুক্তিবাদ। অধ্যাত্মবাদের (যার সঙ্গে প্রগাঢ়ভাবে জড়িত রয়েছে বিশ্বাসবাদ ও ভক্তিবাদ) সঙ্গে যুক্তিবাদের এই দ্বন্দ্ব এক সময় হয় তো বা শুধুমাত্র যুক্তিহীন বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির, অজ্ঞানতার সঙ্গে জ্ঞানের দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু যে সময় থেকে আদিম সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা ভাঙতে শুরু করল, গড়ে উঠতে লাগল অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা, তখন থেকেই অধ্যাত্মবাদ একটু একটু করে হয়ে উঠতে লাগল শোষক-শাসক ও পুরোহিত শ্রেণী নামক বুদ্ধিজীবীদের আঁতাতের হাতিয়ার।
যত সময় এগিয়েছে, ‘অধ্যাত্মবাদ’ নামের হাতিয়ার ততই শাণিত, কার্যকর ও অমোঘ হয়ে উঠেছে। সেদিনের ‘অধ্যাত্মবাদ’ নামের বৃক্ষ-শিশু আজ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বিশাল বৃক্ষ। নানা শ্রেণীর মগজ ধোলাইয়ের জন্য নানা ভাবে, নানা সাজে, নানা মুখোশের অন্তরালে আজ তার সর্বনাশা আবির্ভাব। ফলে বর্তমানে অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যুক্তিবাদের এই দ্বন্দ্বই আজ আর শুধুমাত্র অন্ধবিশ্বাসের সঙ্গে যুক্তির দ্বন্দ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এই দ্বন্দ্বই আজ হয়ে উঠেছে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার চেষ্টার বিরুদ্ধে সাম্যের সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা প্রচেষ্টার দ্বন্দ্ব।
অসাম্যের সমাজ টিকিয়ে রাখতেই অধ্যাত্মবাদ ভোগবাদকে টিকিয়ে রাখতেই অধ্যাত্মবাদ
সময় এগোচ্ছে। অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন থেকে খসে পড়ছে অনেক সংস্কার, অনেক মূল্যবোধ। মানুষ অনেক পুরনো ধ্যান-ধারণাকে বিদায় দিচ্ছে। মানুষের এই অগ্রগতির তালে তাল মিলিয়ে ধনীরাও শোষণের নানা নতুন নতুন কৌশল বের করছে। বের করছে শোষিত মানুষদের মগজ ধোলাইয়ের নিত্য-নতুন পদ্ধতি। ওরা বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি কিনে নিয়ে তাকে নানা ভাবে কাজে লাগিয়েছে। ওরা অর্থের জোরে সংস্কৃতির জগতে, চিন্তার জগতে থাবা বসিয়েছে। ওরাই ঠিক করে দিচ্ছে আমরা কি ধরনের সিনেমা দেখব, দূরদর্শনের পর্দায় কি ধরনের ‘ধামাকা’ অনুষ্ঠানে নিজেদের উত্তেজিত করব, কি ধরনের গল্প-প্রবন্ধ-নাটকে নিজেদের চিন্তাকে আচ্ছন্ন রাখব কি ধরনের খবর পাঠ করব। খবরের কাগজের খবরও আজ আর নিছক খবর নেই। খবরের সঙ্গে মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে কাগজের ‘পলিসি’। খবরের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাগজের নিজস্ব চিন্তাকে, যেভাবে তারা খবরটিকে কাজে লাগাতে চায়। খবরের সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছে আবেগের মাদক যা যুক্তির সবচেয়ে বড় শত্রু। প্রচারে জোনাকি হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্র। নক্ষত্রকে ঢাকতে নেমে আসছে ব্ল্যাক-আউটের মেঘ। মগজ ধোলাইয়ের কার্যকারিতায় শোষিত মানুষরা নিজেদের অজ্ঞাতে নিজেদের ঘৃণা করতে শুরু করেছে। ঘৃণা আজ নেমে এসেছে জাতে-জাতে, ধর্মে-ধর্মে, ভাষায় ভাষায়, প্রদেশে-প্রদেশে, নারী-পুরুষে। যত বেশি বেশি করে শোষিত মানুষদের বিভাজিত করা যাবে, ততই শোষকদের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই দেওয়ার ক্ষমতাও পৌঁছতে থাকবে তলানিতে।
শাসক-শোষক-বুদ্ধিজীবী-আমলা আঁতাতে যে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’ টিকে রয়েছে, তা কিন্তু প্রধানত মগজ ধোলাইকেই সম্বল করে, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক দূষণকে সম্বল করেই। মগজ ধোলাই করে বিভেদনীতি ছাড়া আর যে দুটি নীতিকে এই অশুভ আঁতাত, এই ‘সিস্টেম’ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, তা হল, এক : ভোগবাদী চিন্তার প্রসার, দুই : অধ্যাত্মবাদী চিন্তার প্রসার।
ভোগবাদ মানুষকে স্বার্থপর করে। স্বার্থপর মানুষ কখনও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে জানে না, সাম্যে বিশ্বাস করে না, ‘যেন তেন প্রকারেণ’ নিজের আখের গোছানোকেই জীবনের লক্ষ্য করে নেয়।
অধ্যাত্মবাদী বা ভাববাদীরা ভক্তিরসের আবেগে নিজের দুঃখ-কষ্ট-বঞ্চনাকে ডুবিয়ে রেখে প্রতিবাদ করার ইচ্ছেটুকুও হারিয়ে ফেলে।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ছান্দোগ্যতে আমরা প্রথম পেলাম পুনর্জন্ম কল্পনার কথা। যে কথা এলো কল্পনার হাত ধরে, অজ্ঞতার পিঠে সওয়ার হয়ে, সেই কল্পনাকে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রবলভাবে প্রথম কাজে লাগাল ভারতের ক্ষত্রিয় ও পুরোহিত সম্প্রদায়। পুনর্জন্মের গর্ভে জন্ম নিল ‘কর্মফল’-এর কল্পনা। কর্মফল তত্ত্ব হতদরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের শোনাল— হে বৈশ্য, হে শূদ্র, এই যে প্রতিটি বঞ্চনা, এর কারণ হিসেবে তুমি যদি কোনও ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ বা উচ্চকূলের মানুষকে দায়ী কর, তবে তুমি ভুল করবে। এইসব উচ্চকূলের মানুষরা তো তোমার বঞ্চনার উপলক্ষ মাত্র। তোমার বঞ্চনার মূল কারণ— পূর্বজন্মের কর্মফল।
ভারতে দরিদ্র, বঞ্চিত মানুষদের মধ্যে জন্মান্তর ও কর্মফলে বিশ্বাসের ফল স্বরূপ এ’দেশের বঞ্চিত মানুষ তাদের অধিকার আদায়ের জন্য বিদ্রোহ করেনি, বিপ্লবে শামিল হয়নি।
জন্মান্তর ও কর্মফল বিষয়ে আরোপিত বিশ্বাসের ফল ইতিহাসের নিরিখে বিচার করে আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারি—এই অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টিকারী ও আরোপকারী ভারতীয় ক্ষত্রিয় ও পুরোহিত সম্প্রদায় সমসাময়িক পৃথিবীর যে কোনও অঞ্চলের শাসক ও শোষকদের তুলনায় ছিল অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আর তারই ফলস্বরূপ আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি পৃথিবীর বিশাল বিশাল সেনাবাহিনী-পুষ্ট শক্তিশালী দেশের শাসকদের গদি আন্দোলনে ওলট-পালট হয়ে গেলেও এ’দেশের অভুক্ত, অর্ধনগ্ন, অত্যাচারিত, ধর্ষিত মানুষগুলো কুটোটি নাড়াতে পারে না। অদৃষ্টের ও কর্মফলের দোহাই দিয়ে পড়ে পড়ে মার খায়।
এই বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আমরা সুনিশ্চিতভাবে এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছাই— অধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ, পরামনোবিদ্যা ইত্যাদি স্পষ্টতই ভোগবাদকে সুরক্ষিত করার ‘বাদ’ বা ‘দর্শন’।