অধ্যায় : তিন – আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি

অধ্যায় : তিন – আত্মার রূপ নিয়ে বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি

আত্মা দেখতে কেমন? স্বামী অভেদানন্দের মতে মেঘের মত, কুয়াশার মত। [মরণের পারে, পৃষ্ঠা-২৮] স্বামী অভেদানন্দ আরও এক জব্বর খবর জানিয়েছেন— বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, ঐ “বস্তুটির নাম দিয়েছেন ‘এক্টোপ্লাজম’ বা সূক্ষ্ম-বহিঃসত্তা, এটি বাস্পময় বস্তু এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। একে দেখতে একখণ্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার নিতে পারে।” [মরণের পারে, পৃষ্ঠা — ২৮-২৯]

স্বামী অভেদানন্দের এই বক্তব্য বিষয়ে মাত্র দুটি কথা এই মুহূর্তে বলতে চাই। এক : বিজ্ঞান কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করেনি। দুই : বিজ্ঞান ‘এক্টোপ্লাজম’ বলতে মেঘের মত, কুয়াশার মত কোনও বস্তুকেই নির্দেশ করে না। এক্টোপ্লাজম (Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা কোষ-এর (cell) অভ্যন্তরস্থ ‘সাইটোপ্লাজম’ নামের জেলির মত বস্তুর বাইরের দিকের অংশকেই নির্দেশ করে।

আত্মাকে দেখতে যে মেঘের মত, কুয়াশার মত, এই যুক্তির সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে কার্পণ্য করেননি অভেদানন্দ। আর প্রমাণ বলতে রস-কষহীন নিছক যুক্তিজাল বিস্তার নয়, বা কোন অপ্রত্যক্ষ প্রমাণও নয়, হাজির করেছেন এক্কেবারে যাকে বলে ‘হাতে গরম’ প্রমাণ। যারই প্রমাণ পাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, তাকে সামান্য খরচা করে এক্সরে মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলতে হবে শুধু। ভাবছেন, ছবি তুললে কি প্রমাণিত হবে? স্বামী অভেদানন্দের কথায় বলি, “আমার দেহের কোন অংশ যদি এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব—হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণায় পরিপূর্ণ চারিদিকে যেন তারা ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়, তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ।” [মরণের পারে, পৃষ্ঠা-৩২]

হায় স্বামী অভেদানন্দ! যাকে তিনি আত্মার কুয়াশাময় রূপের অকাট্য প্রমাণ বলে মনে করেছিলেন, তা যে তাঁর নিজের অজ্ঞতারই অকাট্য প্রমাণ হয়ে দাঁড়াল।

তিনি যদি শারীর-বিদ্যার স্কুলের গণ্ডির জ্ঞানটুকুও রাখতেন, তবে জানতে পারতেন, শরীরের হাড়, মাংস, পেশী ইত্যাদির ঘনত্বের ভিন্নতার জন্য এক্স-রে’র ছবিতে সাদা-কালো রঙের গভীরতারও বিভিন্নতা দেখা যায়। আর এই রঙের গভীরতার বিভিন্নতাকেই আত্মার কুয়াশারূপের প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন স্বামীজি।

মজাটা কোথায় জানেন? এমন ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে’ চাপানো, বিতিকিচ্ছিরি রকম বিজ্ঞান-বিরোধী এই বইটির প্রথম পৃষ্ঠাতেই লেখা রয়েছে—

মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)

আরও মজা কি জানেন—এমন বস্তাপচা ভুলে ভরা এক্টোপ্লাজমীয় ধারণাকে সগর্বে তুলে ধরলেন আর এক অধ্যাত্মবাদী লেখক নিগূঢ়ানন্দ। তিনি ‘আত্মার রহস্য সন্ধান’ বইটির ১৯৩ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, “বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাতেও ধরা পড়েছে, যে মৃত্যুর পর দেহের চতুর্দিকে ধুঁয়াকৃতি একটা কিছু আবরণ সৃষ্টি করে থাকে। একে আধুনিক বিজ্ঞান একটোপ্লাজম নাম দিয়েছে”। জানি না এঁরা আসলে অজ্ঞ না মতলববাজ?

আত্মার কুয়াশামার্কা রূপের সরাসরি বিরোধিতা করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি বললেন—আত্মার কোনও রূপই নেই। তাঁর কথায়, “কোন অণু-পরমাণুর দ্বারা গঠিত নয় বলে আত্মা অবিনশ্বর…..আত্মা কোনরূপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয়।” [স্বামী বিবেকানন্দ, রচনা সমগ্র অখণ্ড, প্রকাশক : নবপত্র। পৃষ্ঠা-২৫৪]

মজাটা কি জানেন? স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ বইটির প্রকাশক– শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ।

স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ওই জনপ্রিয় বইটির ২৮ পৃষ্ঠায় জানিয়েছেন—আত্মার ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ”। “তিনভাগ’ বলতে চার ভাগের তিনভাগ বলতে চেয়েছিলেন, এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি।

নৈয়ায়িক রঘুনাথ শিরোমণির মতে আত্মা মোটেই অমন বিশাল ওজনদার কোনও বস্তু নয়। আত্মা ত্রসরেণুস্বরূপ ভৌতিক দ্রব্য। [পদার্থতত্ত্বসার—পৃষ্ঠা ১০১ (জয়নারায়ণ তর্কালংকার, কলকাতা সং)]

‘ত্রসরেণু’ শব্দের অর্থ—গৃহমধ্যে সূর্যালোক প্রবেশ করলে তাতে যে সূক্ষ্ম পদার্থ উড়তে দেখা যায়, সেই একটি সূক্ষ্ম পদার্থ। আর একটি অর্থ হল, ছয় ‘পরমাণু’ বা তিন ‘দ্ব্যণুক’-এ এক ত্রসরেণু।

পূর্বমীমাংসকদের দুটি প্রধান সম্প্রদায় প্রভাকরও ভাট্টমীমাংসক। প্রভাকর সম্প্রদায়ের মতে ‘মন’ অণুপরিমাণ দ্রব্যবিশেষ। [প্রকরণপঞ্জিকা—পৃষ্ঠা ১৪৯, (চৌখাম্বা সং)] ভাট্টমীমাংসকদের মতে—মন পরমাণুপরিমাণও নয়, কিন্তু সর্বব্যাপী।

আবার সাংখ্যমত কি বলছে দেখুন—মন বা বুদ্ধি কোনটিই সর্বব্যাপী বা অণু নয়, মধ্যপরিমাণবিশিষ্ট। বুদ্ধি ও মন জড় ও অনিত্য বা নশ্বর। [সাংখ্যকারিকা—পৃষ্ঠা ২০] এখানে সাংখ্যদর্শন সোজাসুজি আঘাত হেনেছে সেইসব মতের উপর, যারা বিশ্বাস করে মন বা আত্মা নিত্য-বা অবিনশ্বর।

মহর্ষি পতঞ্জলির মতে—চিত্ত, মন বা বুদ্ধি সর্বব্যাপী।

আয়ুর্বেদের চরক সংহিতায় মনকে অণুপরিমাণ বস্তু বলে নির্দেশ করা হয়েছে।

শ্রীভাষ্যকার রামানুজনও আত্মাকে অণুপরিমাণ বলে মত প্রকাশ করেছেন।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে—মন হল একই সঙ্গে ‘কর্তা’ ও ‘কর্ম’ অর্থাৎ, একই সঙ্গে করায় ও করে। মনের দেহগঠন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে—মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট। [বৃহদারণ্যকোপনিষৎ—১/২/১, ১/৫/৩]

ছান্দোগ্যোপনিষৎ থেকে আমরা আর এক নতুন তথ্য জানতে পারছি। তাতে বলা হয়েছে—’মন অন্নময়’।

বলা হয়েছে, “ভুক্ত যে অন্ন, অর্থাৎ খাদ্য, তা তিনটি রূপ প্রাপ্ত হয়। স্থূল অংশ মল রূপে দেহ থেকে নির্গত হয়। মধ্যাংশ শরীরকে পুষ্ট করে এবং খাদ্যের যা সূক্ষ্মতম সারাংশ তাই মনকে পুষ্ট করে।” [ছান্দ্যোগ্যোপনিষৎ—৬/৫/১] এই বক্তব্যের সমর্থনে উদাহরণরূপে শ্বেতকেতুর কাহিনী টেনে বলা হয়েছে—শ্বেতকেতু দীর্ঘ দিন কোনও খাদ্য না খেয়ে শুধুমাত্র জল পান করে থাকায় তার মন অত্যন্ত ক্ষীণদশা প্রাপ্ত হওয়ায় ঋক্, সাম, যজু ইত্যাদি কোনও বেদই তাঁর মনে প্রবেশ করছিল না। আবার অন্ন গ্রহণের পর দেখা গেল সবই তাঁর মনে প্রবেশ করছে। এই দৃষ্টান্তের দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, মন খাদ্যের দ্বারা পরিপুষ্ট হয়। ছান্দ্যোগ্যোপনিষৎ মতে—মন সূক্ষ্ম ও জড় পদার্থ।

মৈত্রী-উপনিষদে আছে, বালখিল্যগণ প্রজাপতির কাছে আত্মার স্বরূপ জানতে চাইলে প্রজাপতি বললেন, “দেহের একাংশে অধিষ্ঠিত অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ, অণু হতেও অণীয়ান (সূক্ষ্ম) এই আত্মাকে ধ্যান করে পুরুষ পরমত্ব লাভ করে।”

‘শ্বেতাশ্বতর’ তেরোটি উপনিষদের সর্বশেষ। এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ১০০ বছর। শ্বেতাশ্বতরের ত্রৈতবাদে আত্মার স্বরূপ বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, “কেশ ও নখকে শতভাগ করে যদি প্রতিটি অংশকে পুনরায় শতভাগ করা যায়, তবে তার মাত্রা হবে আত্মার সমান।”

উপনিষদের অগ্রণী দার্শনিকগণের অন্যতম আরুণি শ্বেতকেতুকে উপদেশ দিতে গিয়ে আত্মার স্বরূপ প্রসঙ্গে যা বলছেন, সেদিকে একটু ফিরে তাকানো যাক।

আরুণি : “এই লবণখণ্ড জলপূর্ণ পাত্রে রাখো সৌম্য! কাল সকালে পাত্রটি আমার কাছে আনবে।”

পরের দিন শ্বেতকেতু পাত্রটি নিয়ে প্রবেশ করতে আরুণি বললেন, “লবণখণ্ডটি জল থেকে তুলে দাও।”

শ্বেতকেতু : “লবণ তো দেখতে পাচ্ছি না ভগবন্।”

আরুণি : “এখন জল পান করে দেখ, কেমন স্বাদ?”

শ্বেতকেতু : “লবণাক্ত।”

আরুণি : “সৌম্য? তুমি লবণ দেখতে পাচ্ছ না,কিন্তু লবণ জলে বিলীন হয়ে রয়েছে, তেমনই আত্মাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না, অথচ আত্মা দেহে বিদ্যমান। তিনিই সেই….তৎ ত্বম্ অসি (তত্ত্বমসি)!”

আরুণির মতে আত্মার স্বরূপ, আকারহীন, অদৃশ্য।

স্বামী বিবেকানন্দ আত্মা প্রসঙ্গে যা বলেছেন, তা বোঝা সাধারণ মানুষের কর্ম নয়। এই যেমন ধরুন, উনি একবার বলছেন, “আমি (আত্মা) চৈতন্যস্বরূপ।আর এই বিশ্বাসই হলো যোগের সমস্ত কৌশল, এবং ধ্যান প্রণালী হলো—আত্মার মধ্যে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করার উপায়।” [বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ—প্রকাশক : নবপত্র, পৃষ্ঠা-৫৩৫] অর্থাৎ ঈশ্বর ও আত্মা চৈতন্যস্বরূপ। এই চৈতন্যরূপ আত্মা কেমন দেখতে? রূপহীন, আকারহীন। কারণ, “আত্মা কোন রূপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয়,” [ঐ বইয়ের পৃষ্ঠা—২৬২-২৬৩]। বিবেকানন্দই আবার চেতনা থেকে মনকে পৃথক করেছেন। দুটিকে ভিন্ন সত্তা বলে ধরে নিয়েছেন। এবং ‘মন’ বিষয়ে যে মতামত জ্ঞাপন করেছেন, তা হলো—মন উপাদান দ্বারা গঠিত। মন বিষয়ে বিবেকানন্দের মত আর সব ধর্মগুরু ও আধ্যাত্মিক নেতাদের চেয়ে একেবারে আলাদা, এবং যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক; কৌতুক-উদ্দীপকও বটে। বিবেকানন্দ মনে করতেন, “মন জড়ে রূপান্তরিত হয় এবং জড়ও মনে রূপান্তরিত হয়, এটা শুধু কম্পনের তারতম্য।” তাঁর থিয়োরি অনুসারে, “একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথম তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ—একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত কর, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।” [ঐ বইয়েরই পৃষ্ঠা— 264]

বিবেকানন্দের এইজাতীয় বক্তব্যগুলো থেকে আমরা কি কি জানতে পারলাম একটু দেখা যাক। এক : চেতনাই আত্মা, যা কোনও উপাদানে গঠিত নয়, তাই শরীর নেই। দুই : মন চেতনার থেকে ভিন্ন কিছু। মনের সূক্ষ্ম শরীর আছে। তিন : স্রেফ ইস্পাতে কম্পন সৃষ্টি করেই আলো তৈরি করা যায়। (বিজ্ঞানের এই গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব ও তথ্যের দিকে সরকার একটু মনোযোগ দিলে বিদ্যুৎ ঘাটতির একটা সুরাহা হতে পারে।) চার : এইচ জি ওয়েল্স-এর ‘দি ইনভিজিবল ম্যান’ উপন্যাসটি পড়ে যারা ভেবেছিলেন— অদৃশ্য হওয়া এবং দৃশ্যতে ফিরে আসা গল্পেই সম্ভব, তাঁদের সমস্ত চিন্তাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে বিবেকানন্দের এই যুগান্তকারী কম্পনের দ্বারা অদৃশ্য করার তত্ত্ব। পাঁচ : ‘চিন্তা, চেতনা বা মন মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের ক্রিয়াবিক্রিয়ার ফল’—শারীর বিজ্ঞানের এই জাতীয় সিদ্ধান্ত (তা যতই কেন না বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের পর গৃহীত হোক) বিলকুল ভুল, ছয় : মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের সাহায্য ছাড়াই স্রেফ লোহা লক্কড়কে কাজে লাগিয়েই মন তৈরি সম্ভব। (এমনটা সত্যি হলে, পাষাণকে নাড়িয়েও মন তৈরি সম্ভব হতেই পারে? সম্ভবত কেউ এমনটা তৈরিও করেছিলেন। তাই থেকেই ‘পাষাণ হৃদয়’ কথাটা হয় তো চালু হয়েছে। এই বিষয়ে গবেষণার জন্য উদ্যমী গবেষকরা এগিয়ে আসতে পারেন।)

বিবেকানন্দের এই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ ছাড়া মন তৈরির বৈপ্লবিক-তত্ত্বকে সত্য বলে প্রমাণ করতে উদ্যোগ নিতে পারেন সেইসব বিবেকানন্দভক্তরা, যাঁরা বিবেকানন্দকে ‘বিজ্ঞানীদেরও বিজ্ঞানী’ বলে সোচ্চার-ঘোষণা রাখেন নামী-দামী পত্র-পত্রিকায় ও ঝাঁ-চক্‌চক্ সেমিনারে।

এইসব প্রাজ্ঞ ভক্তরা এই বিষয়ে পরীক্ষা চালাবার জন্য বিবেকানন্দভক্ত বিজ্ঞান পেশার মানুষদের বাছতে পারেন। এই পরীক্ষায় পদার্থবিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়র ও ডাক্তারদের যৌথ উদ্যোগকে কাজে লাগাতে পারলে আরও ভাল হয়। ইস্পাতের পাত তৈরি করা, পাতে কম্পনের সৃষ্টি করা এবং ‘মন’ তৈরি হওয়ার পর ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাম (E.E.G) মেশিনের সাহায্যে ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাফ বা ট্রেসিংটা তৈরি করে ফেলা। আর তাহলেই বিজ্ঞানসম্মতভাবেই প্রমাণিত হয়ে যায়—’মন’ এ’ভাবেও তৈরি করা সম্ভব। তারপর কি হবে? একজন ভারতীয় হিসেবে ভাবতে গেলেই উত্তেজনায় গা শিরশির্ করে উঠছে! গবেষণায় নিযুক্ত গোটা ভারতীয় দলটারই নোবেল পুরস্কার বাঁধা! এবং বিবেকানন্দের মরণোত্তর ভারতরত্ন!

‘উদ্বোধন কার্যালয়’ থেকে প্রকাশিত একটি বই ‘মন ও তার নিয়ন্ত্রণ’ লেখক : স্বামী বুধানন্দ। অনুবাদক : স্বামী ঈশাত্মানন্দ। প্রকাশকাল ১৯৮৬। টাটকা তাজা এই বইটিতে বেদান্ত মতে মন কি–সে বিষয়ে কিছু আলোচনা রয়েছে। ১৩ পৃষ্ঠায় রয়েছে, “মন জড় ও আত্মাই চৈতন্যস্বরূপ”।

পরমহংস পরিব্রাজক শ্রীমৎ কালিকানন্দ স্বামী বারাণসীর ‘কালিকা বেদান্ত আশ্ৰম’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও স্বীকৃত বেদান্ত-পণ্ডিত। তাঁর গ্রন্থ ‘সত্য দর্শন’ এর ১০৯ পৃষ্ঠায় ‘মনস্তত্ত্ব’ শিরোনামে আলোচনা করতে গিয়ে লিখছেন, “মনে কর আমি একটি শব্দ শুনিতেছি; এখানে বাইরের কর্ণ শব্দটিকে গ্রহণ করিয়া মস্তিষ্কস্থ ইন্দ্রিয়ে পৌঁছাইল, তৎপর এই ইন্দ্রিয় উহা বহন করিয়া মনের নিকট পৌঁছাইল। এই মনও কেবল বাহক মাত্র, মন এই শব্দকে আরও ভিতরে বহন করিয়া লইয়া গিয়া বুদ্ধির নিকট পৌঁছাইল। তখন বুদ্ধি উহার সম্বন্ধে নিশ্চয় করে যে, উহা কিসের শব্দ এবং উহা ভাল কি মন্দ। এই বুদ্ধি আবার আরও ভিতরে লইয়া গিয়া সর্বসাক্ষীস্বরূপ সকলের প্রভু আত্মার নিকট উহাকে সমর্পণ করিল। তখন পুনরায় যে যে ক্রমে উহা ভিতরে গিয়াছিল, সেই সেই ক্ৰমে আবার বহির্যন্ত্রে আসিল,—প্রথম বুদ্ধিতে, তারপর মনে, তারপর মস্তিষ্ক-কেন্দ্রে, তৎসহ বহিযন্ত্র কর্ণে।”

১১০ পৃষ্ঠায় বলেছেন—মন ও বুদ্ধির সূক্ষ্ম শরীর আছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার হল ১১৮ পৃষ্ঠাতেই কালিকানন্দ স্বামী লিখছেন—আত্মাই চিত্ত।

মোদ্দা কথায় কালিকানন্দ স্বামীর মনে হয়েছে—মন,বুদ্ধি, চিত্ত বা চেতনা সবই ভিন্ন ভিন্ন বস্তু এবং চিত্ত বা চেতনাই আত্মা। মন ও বুদ্ধির সূক্ষ্ম শরীর আছে। কালিকানন্দ স্বামীর কেন এমন অদ্ভুত সব ভাবনাকে সত্যি বলে মনে হয়েছে? তিনি কি কি পরীক্ষা চালিয়ে এমন ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন? কালিকানন্দ স্বামীর ভক্তদের মধ্যে যাঁরা বিজ্ঞানকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তাঁরাও ধর্মগুরুর মুখের কথাকে বিজ্ঞানের উপর স্থান দিয়েছিলেন। অন্ধভাবে মেনে নিয়েছিলেন। আসলে এইসব বিজ্ঞান পেশার মানুষরাও ভাল ছাত্র হওয়ার সুবাদে অনিশ্চিত এই সমাজে তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত আয়ের আশায় বিজ্ঞানকে নিয়ে পড়াশুনো করেছেন এবং শেষে বিজ্ঞানকে নিছক পেশা হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। তাঁদের কাছে এই পেশা জমির দালালি বা আলু-পটলের দোকানির পেশার মতই একটা পেশা মাত্র। এর বাড়তি কিছু নয়।

তামাম ভারতবর্ষের আর এক দিকপাল অধ্যাত্মবাদী নেতা শ্রীশ্রীসীতারামদাস ওঙ্কারনাথজীর ভক্ত সংখ্যা বিপুল, যাঁরা তাঁকে অবতার জ্ঞানেই পুজো করেন। তিনি একাধিক চিঠিতে ভক্তদের কাছে মত প্রকাশ করেছেন, “প্রত্যেকের আত্মা জাগ্রতে দক্ষিণ চক্ষুতে, স্বপ্নকালে মনেও সুষুপ্তিকালে (গভীর নিদ্রাকালে) হৃদয়ে অবস্থান করে”। [শ্রীশ্রীসীতারাম লীলাবিলাস (শ্রীশ্রীওঙ্কারনাথদেবের জীবনী), কিঙ্কর আত্মানন্দ, ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৪৩]

এই মতামত থেকে আমরা এটুকু অন্তত জানতে পারলাম, আত্মা স্বয়ং মন নয়। আত্মার অবস্থান কখনও দৃষ্টিতে, কখনও মনে, কখনও বা হৃদপিণ্ডে। আমরা এটা ধরে নিলে বোধহয় ভুল হবে না, ওঙ্কারনাথজী মস্তিষ্কস্নায়ুকোষের পরিবর্তে হৃদপিণ্ডকেই ভাবাবেগ বা চেতনার উৎপত্তিস্থল ধরে নিয়েই এমন মত প্রকাশ করেছিলেন। যার ডান চোখ নেই, তার আত্মা মানুষটির জাগ্রতকালে কোথায় থাকে? এ’বিষয়ে তিনি কোথাও আলোকপাত করেননি। তাঁর এই অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করতে তাঁর ভক্ত-বিজ্ঞানীদের এগিয়ে আসা উচিত। আমরা তাঁদের পথ চেয়ে রইলাম।

ব্রাহ্ম ধর্মে বলা হয়েছে—আত্মা নিরাকার। কখনও কোনও আকার ধারণ করে না। মৃত্যুর পর আত্মার প্ল্যানচেটে আসা, ভূত হয়ে ভর করা এসব কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করে না ব্রাহ্ম ধর্ম। তারা মনে করে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্মা পরমব্রহ্মে বা ঈশ্বরে আশ্রয় নেয়।

গত ’৯২ সাল থেকে একটা বইয়ের বিজ্ঞাপন এই বাংলার বুকে দস্তুর মত কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। ডাঃ মরিস রলিংস্-এর লেখা একটা বই নাকি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ভাষায় বিক্রি হয়েছে কোটির উপর। বাংলায় অনুবাদিত বইটির নাম ‘মৃত্যুর পরে ও আত্মার কথা’। বইটির তৃতীয় মুদ্রণের ৯৯ পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে আত্মা বিষয়ে যে পরম সত্য (?) জানতে পারলাম, তা সত্যিই লোমহর্ষক ও রূপকথার মতই। হিন্দু ধর্মের এক পরমপূজ্য মহাপুরুষ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী নিজে যা দেখেছিলেন বলে বইটিতে লেখা হয়েছে, তা সরাসরি এখানে তুলে দিচ্ছি : “পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন মারা যান (কলকাতায়) তখন ৺বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী মহাশয় ঢাকায় অবস্থান করছিলেন এবং সেখানেই তিনি আকাশপথে দেখেন যে, স্বর্ণরথে বিদ্যাসাগর মহাশয় বসিয়া আছেন এর দেবদূতগণ চামর হাতে লইয়া তাঁহাকে ব্যজন করিতেছেন। রথটি চলিয়া যাইতেছে। এই দৃশ্য তিনি সেখানে উপস্থিত শিষ্যগণকে দেখাইয়া ছিলেন।”

এই অংশটি পড়ে অনেকের মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে—বিদ্যাসাগরের আত্মা কি বস্ত্র পরিধান করে ছিলেন? পরিধান করে থাকলে, সেই বস্ত্র পেলেন কি করে? আত্মা কাপড়-চোপড় সহ শরীর ধারণ করলে এমন গুরুতর সন্দেহ দেখা দিতেই পারে— পরিধেয় বস্ত্র সমূহেরও আত্মা আছে! কোনও আত্মা-গবেষক বিষয়টি নতুনভাবে গবেষণাকরার কথা ভেবে দেখতে পারেন।

তাহলে এত আলোচনার পর আমরা আত্মার রূপের বিষয়ে কি সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম?

বাস্তবিক পক্ষে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছন তো সম্ভব হয়নি, বরং সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আলোচনায় যত বেশি বেশি করে ধর্মীয় নেতাদের মতামত গ্রহণ করেছি, ততই বেশি বেশি করে আমরা বিভ্রান্তির জালে জড়িয়েছি। এতো দেখছি ‘বার রাজপুত্তুরের তের হাঁড়ি”।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *