অধ্যায় : ছয় – ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার উৎপত্তি যেখানে ধর্মগ্রন্থ থেকে ধর্মগুরু
বেদ, উপনিষদ, গীতা’কে অভ্রান্ত মনে করে অনেকেই সাধারণভাবে এগুলোর থেকে কোনও একটি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করে বলেন—….’তে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যে কথা লেখা হয়েছে, তা কি আপনি মানেন? যদি মানেন, তবে আত্মার অমরত্বের কথা কেন মানবেন না?
উত্তরটাও এ’সব ক্ষেত্রে অতি সহজ সরল। আত্মা বিষয়ে বেদ, গীতা ও উপনিষদে রয়েছে পরস্পরবিরোধী বহু সংজ্ঞা। তাদের কোন্ সংজ্ঞা আপনি সত্যি বলে ধরবেন? যাই হোক—একদল যাঁরা আত্মাকে মন বলে মনে করেন, তাঁদের বলি—মনকে আত্মা বললে সেই আত্মাকে মানব না কেন? তবে মন যেহেতু দেহবহির্ভূত কোনও কিছু নয়, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরই কাজ-কর্মের ফল, তাই মৃত্যুতেই মনের অস্তিত্বেরও মৃত্যু ঘটে। আর একদল, যাঁরা মনের স্রষ্টা মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষকে আত্মা বলে মনে করেন, তাঁদের বলি—কোনও ধর্মগ্রন্থে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষকে আত্মা বললে সেই আত্মার অস্তিত্ব মানব না কেন? সেই সঙ্গে এ’কথাও মানি মৃত্যুর পর মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরও মৃত্যু ঘটে।
“বিভিন্ন প্রশ্নে বার-বার উঠে এসেছে ‘মরণের পারে’ বইটির কথা। লেখক— স্বামী অভেদানন্দ। তাঁর বইয়ের ২৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে—বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যে যন্ত্রটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার ‘ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ’।
“এক আউন্সের তিনভাগ” বলতে সম্ভবত চারভাগের তিনভাগ বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাটাই হল এই—আত্মার ওজন নেওয়ার যন্ত্র যদি আবিষ্কৃত হয়েই থাকে, তাহলে তো ল্যাঠাই চুকে যায়। এর পরেও আত্মার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কোন্ যুক্তিবাদী? কোন্ বিজ্ঞানমনস্ক?
পরিপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে বলছি, বিজ্ঞান কিন্তু এমন কোনও যন্ত্রের অস্তিত্বের কথা আজও জানে না। স্বামী অভেদানন্দও জানাননি যন্ত্রটির নাম। এ’বিষয়ে পরামনোবিজ্ঞানীরাও রা কাড়েননি। অথচ বাস্তবিকই এমন জব্বর আবিষ্কারের খবর শোনার পর আমার অন্তত জানতে ইচ্ছে করে আত্মা অর্থাৎ মনের ওজন মাপা সূক্ষ্ম যন্ত্রটির নাম, আবিষ্কারকের নাম, কত সালে যন্ত্রটি আবিষ্কৃত হয়েছিল, আবিষ্কারক কোন দেশের নাগরিক ছিলেন ইত্যাদি বহু প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু উত্তর কে দেবেন? কোনও পরামনোবিজ্ঞানী? না, ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটির প্রকাশক–শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ? যুক্তিবাদীদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে অধ্যাত্মবাদীদের চরম জয় প্রতিষ্ঠা করতে আত্মার ওজন মাপা যন্ত্রটি নিয়ে এগিয়ে আসছেন না কেন ভাববাদী ও অধ্যাত্মবাদী শিবিরের নেতারা? সত্যিই এ এক পরম বিস্ময়। এ বিষয়ে যাঁরা প্রশ্ন তোলেন, তাঁরা ভাববাদী শিবিরে চাপ সৃষ্টি করুন না—আত্মার ওজন যন্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসতে। চাপ দিলেই বুঝতে পারবেন ওঁদের দাবি কত আসার কত মিথ্যাচারিতায় ভরা।
‘মরণের পারে’ গ্রন্থে প্রকাশিত বিদেহী আত্মার নানা ছবি অনেকেরই মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। ওইসব ছবিই বইটির বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি লিখিতভাবেও একথা জানিয়েছেন আত্মার আলোকচিত্র বা ফটোগ্রাফ নেওয়া যায়। (মরণের পারে, পৃষ্ঠা-২৮)।
এমন ভিত্তিহীন আজগুবি কথার পরিপ্রেক্ষিতে সত্যকে প্রকাশ করতে হলে বলতেই হয়—স্বামীজী এমন কথা লিখেছেন হয় অজ্ঞতা থেকে, নয় তো মিথ্যের দ্বারা আত্মার অমরত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে। ‘বিদেহী আত্মা’র ছবি তুলতে কি বিশেষ কোনও ক্যামেরার প্রয়োজন হয়? আত্মার ছবি তোলা যায়, এমন ক্যামেরার নাম কী? স্বামীজী অবশ্য এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করেছেন। গ্রন্থটি খুব কম করেও চল্লিশ বছর আগে লেখা। আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে একটু ভাল ধরনের ক্যামেরার লেন্সও এমন কিছু শক্তিশালী ছিল না, যার ফলে ক্যামেরার লেন্সে কুয়াশাময় আত্মা ধরা পড়ে, তা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না। ক্যামেরায় ভূতের ছবি তোলার গপ্পো আড্ডায় বা মজলিসে বলা যায়, অথবা ধর্মের মোড়কে বইতে লিখে ফেলা যায় সহজেই, কিন্তু কোনও দিনই সত্য বলে প্রমাণ করা যায় না। সত্য নয় বলেই সত্য প্রমাণ করা যায় না।
‘মরণের পারে’ বইয়ে প্রকাশিত ছবির চেয়ে বেশি ভৌতিক, বেশি জীবন্ত ছবি তুলতে কোন ভূতের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় অতি সাধারণ কৌশলের, যা ছবি তোলার প্রথম পাঠ শেষ করা ফটোগ্রাফারদের অজানা নয়। ‘ডবল এক্সপোজার’, ‘সুপার ইমপোজ’ বা কাচের সাহায্যে রিফ্লেক্স পদ্ধতিতে আলোর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণের দ্বারা বছর তিরিশ-পঁয়তিরিশ আগে আমার মত ছবি তোলায় আনাড়িও অনেক অদ্ভুতুড়ে ছবি তুলেছে। ওই একই পদ্ধতিতে ‘মরণের পারে’র চেয়েও ভুতুড়ে ছবি তোলা তখনও সম্ভব ছিল, এখনও সম্ভব। তবে এখন ছবির কলাকৌশল এতই বেড়েছে যে ‘হরর’ ছবি দেখতে বসে অনেকেই স্থান-কাল ভুলে এয়ারকন্ডিশনড হলে বসেও আতঙ্কে ঘেমে ওঠেন।
স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ গ্রন্থটি যে আত্মা নিয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা, এ কথা গ্রন্থটির প্রথম পৃষ্ঠাতেই বিজ্ঞাপিত। এই আত্মাসংক্রান্ত বিজ্ঞান সম্মত গবেষণার আকর গ্রন্থটির একটা অংশ নিয়ে আলোচনা করে ‘মরণের পারে’ নিয়ে এই পর্যায়ের আলোচনায় ইতি টানতে চাইছি।
বিদেহী আত্মা কিভাবে আবার দেহ ধারণ করে, সে বিষয়ে স্বামী অভেদানন্দ তাঁর ‘গবেষণালব্ধ’ এবং ‘বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী’ থেকে বলছেন, ‘মন’বা ‘আত্মা’ “আকাশের মধ্য দিয়ে বায়ুতে প্রবেশ করে, বায়ু থেকে মেঘ, সেখান থেকে বৃষ্টি বিন্দুর সঙ্গে তারা পড়ে ধরণীতে, তারপর খাদ্যের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করে আবার তারা জন্ম নেয়।” (মরণের পারে; পৃষ্ঠা-৩৮)
স্বামী অভেদানন্দ আরও বলেছেন, পিতামাতা এই দেহ গঠনের সহায়ক মাত্র, তাছাড়া আর কিছু নয়। তাদের সাহায্যেই প্রাকৃতিক নিয়মকে রক্ষা করে দেহ গঠনে সমর্থ হয় সূক্ষ্মশরীর। পিতামাতা আত্মাকে সৃষ্টি করেন না। তা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত না আত্মা পিতামাতার অভ্যন্তরে আবির্ভূত হয় এবং প্রাণীবীজটিকে লালন করে ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের জন্ম অসম্ভাব্যই থাকে।” (ওই গ্রন্থেরই পৃষ্ঠা- ৬২)।
স্বামী অভেদানন্দ মানুষের জন্ম বিষয়ে যে ধারণা তাঁর অন্ধ ভক্ত ও পাঠক- পাঠকাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন, তা হলো, (১) বিদেহী আত্মা আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে এবং খাদ্যের সঙ্গে যখন মানব দেহে প্রবেশ করে তখনই সম্ভব হয় নতুন জন্মের। অর্থাৎ নতুন জন্মের জন্য সঙ্গম অপ্রয়োজনীয়। অর্থাৎ শারীরবিজ্ঞান পড়ে এতদিন আমরা ভুলই জেনেছি যে-সঙ্গমের ফলে নিক্ষিপ্ত পুরুষের শুক্রকীট নারীর জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করে জরায়ুর ভিতর দিয়ে সাঁতার কেটে ফ্যালোপিয়ন টিউবের মধ্যে ঢুকে ওভামের সঙ্গে মিলিত হয়, অথবা টেস্টটিউব শিশুর ক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে নিষিক্ত হয় এবং তার ফলেই গর্ভসঞ্চার হয়। (২) নতুন মানুষ জন্ম নেবে কি না তা সম্পূর্ণই নির্ভর করে বিদেহী আত্মার ইচ্ছের উপর, সুস্থ-সবল জন্মদানে সক্ষম নারী-পুরুষের দেহ মিলনের সাহায্যে কখনই নতুন কোনও জন্ম দিতে পারে না কোনও আধুনিক প্রযুক্তিও।
এমন তত্ত্বকে মানলে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সমস্ত রকম ওষুধপত্তর ও সাজ- সরঞ্জামই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।
আরও একটি প্রশ্নের প্রায়ই মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। প্রশ্নটা হল— বিজ্ঞানীরা আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে পরীক্ষা চালাতে একবার মৃত্যুপথযাত্রী একটি মানুষকে। নিশ্ছিদ্র বন্ধ কাচের বাক্সে রেখেছিলেন। ওই বাক্সে হাওয়া ঢোকা বা বেরিয়ে যাওয়ার সমস্ত পথই ছিল বন্ধ। এই অবস্থায় বাক্সবন্দি লোকটির যখন মৃত্যু হল, তখনই, বাক্সের কাচ গিয়েছিল ফেটে। সাধারণভাবে আপনা থেকে কাচ ভেঙে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই; তবু ভেঙে গেল। কাচের এই ভেঙে যাওয়া আত্মার শারীরিক অস্তিত্ব বা স্থূল আয়তনিক অস্তিত্বই প্রমাণ করে। দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে আসায় বন্ধ বাক্সের বাতাসে বাড়তি চাপের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বাড়তি চাপই কাচ ভাঙার কারণ। এ ছাড়া কাচ ভাঙার আর কোনও কারণ থাকতে পারে না।
এমন প্রশ্ন শোনার পর অনেক পাল্টা প্রশ্নই করা যেতে পারে। যেমন—মৃত্যু পথযাত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাস চালাবার ব্যবস্থা ছিল কি না? থাকলে সেটা ঠিক কি ধরনের ব্যবস্থা? কারণ এ’ক্ষেত্রে বাড়তি বায়ু প্রবেশ ও নির্গমনের সম্ভাবনা থেকে যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কোনও বাড়তি ব্যবস্থা না থাকলে তা শুধুমাত্র অমানবিকই নয়, বে-আইনিও। এমন বেআইনি কাজে শামিল হওয়া ব্যক্তিদের হত্যার অপরাধে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো যায়।
কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাটি হল, এ’তো নেহাৎই এক প্রচলিত গল্প কথা। এমন কোনও পরীক্ষা কিছু বৈজ্ঞানিকদের দ্বারা সংগঠিত হয়েছিল, এমন কথা বলার মত কোনও কারণ ঘটেনি। না, আজ পর্যন্ত কোনও ভাববাদী বা অধ্যাত্মবাদী শিবির থেকেও এ ধরনের কোনও স্পষ্ট বক্তব্য হাজির করা হয়নি। যাঁরা এই ধরনের প্রশ্ন হাজির করেন, তাঁরাও যা বলেন, সবই ভাসা ভাসা। কখনই বলতে পারেন না এমন গবেষণায় যুক্ত থাকা বৈজ্ঞানিকদের নাম, গবেষণা চালাবার স্থান, সময় ইত্যাদি। তাই এই নিয়ে এরপরও কেউ গা-জোয়ারি তর্ক তুলতে চাইলে বিনয় ও দৃঢ়তার সঙ্গেই আমরা বলি, “বেশ তো, আপনারা আপনাদের বক্তব্যের যথার্থতা প্রমাণ করুন, তখন শুধু আমরা কেন তাবৎ দুনিয়াই আত্মার অস্তিত্ব মেনে নেবে।”
অভেদানন্দের পরেই যার নাম ইদানীং নানা প্রশ্নে আমাদের সামনে আসে, তিনি হলেন নিগূঢ়ানন্দ। তাঁর ‘জাতিস্মর’ বইটির কথা তুলে অনেকেই প্রশ্ন করেন— বইটির ১২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, টেপরেকর্ডে পরলোকগত আত্মার কণ্ঠস্বর ধরার কথা। এই বক্তব্যকে কি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দেবেন?
ব্যাপারটা সত্যি না হলে তো মিথ্যেই হয়। বিশ্বাসীদের প্রতি একটি অনুরোধ— তাঁরা নিগূঢ়ানন্দকে তাঁর বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করতে বাধ্য করুন না। আমরা এই বিষয়ে সত্যানুসন্ধানে সমস্ত রকমভাবে নিগূঢ়ানন্দের সঙ্গে সহযোগিতা করব, কথা দিচ্ছি। তিনি তাঁর দাবি প্রমাণ করতে পারলে খাঁটি যুক্তিবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে আমরা অধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা থেকে বিরত থাকব এবং অধ্যাত্মবাদের পক্ষে প্রচারকেই যুক্তিবাদী সমিতির লক্ষ্য করে নেব।
নিগূঢ়ানন্দ সাধনার কোন স্তরে পৌঁছেছেন, এ বিষয়ে তাঁর দাবিগুলো প্রাথমিক স্তরে নেড়েচেড়ে দেখি—আসুন।
যোগে শূন্যে ভাসা বা ভূমিত্যাগ নিয়ে নিগূঢ়ানন্দ কি বলেছেন দেখুন : বইটির নাম “আত্মার রহস্য সন্ধান।”
“মানুষের মধ্যে একটি অদ্ভুত চৌম্বক ক্ষেত্র আছে যাকে বলে কুল অর্থাৎ শক্তির কুণ্ড অর্থাৎ গর্ত। এই কুল কুণ্ড মানুষের দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানে অবস্থিত। এই কুণ্ডের মধ্যে আছে অদ্ভুত একটি চুম্বকক্ষেত্র….এই চুম্বকক্ষেত্রের শক্তি বেড়ে যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের বিশেষভাবে ব্যবহারের ফলে।” বিশেষ ব্যবহার কি? শ্বাস-প্রশ্বাস ক্ৰিয়া যত কমে ততই শক্তির তীব্রতা বাড়ে। তীব্রতা বাড়লে কি হয়? “দেহকুণ্ডে (গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গমূলের মাঝখানে অবস্থিত একটি স্থানে) কার্বন জাতীয় কোন রাসায়নিক পদার্থ আছে”….শ্বাস নিয়ন্ত্রণের ফলে অর্থাৎ কমাবার ফলে “কুণ্ডস্থ .তাপ দেহের উর্দ্ধদিকে উঠতে আরম্ভ করে…মেরুদণ্ডের গাঁটে গাঁটে উর্দ্ধগতি-শক্তির আঘাত যতই বেশি পড়তে থাকে ততই দেহটি কেঁপে ওঠে। তখন সারা দেহে অদ্ভুত শিহরণ হয়। পথ পরিষ্কার হয়ে গেলে সে তখন মস্তিষ্কে উঠে গিয়ে এমন চাপ সৃষ্টি করে যে, মস্তিষ্ককে ফুটবলের ব্লাডারের মত ফুলিয়ে তুলতে চায়….মস্তিষ্কে এই শক্তি বায়ুর সংমিশ্রণে এমন এক গ্যাসীয় অবস্থার সৃষ্টি করে যে দেহের ভার বোধটাই যেন কম বোধ হয়। দেহ শুদ্ধোই তখন উপরে উঠে যায়। তখনই যোগে যাকে ভূমিত্যাগ বলে সেই অবস্থা অর্থাৎ levitation হয়।” (পৃষ্ঠা ৮৭-৮৮)
এতো গেল যোগের গ্যাসে মাথা ব্লাডারের মত ফুলে গ্যাস বেলুনটি হয়ে শরীরটাকে শূন্যে তুলে রাখার যোগ সম্মত তাত্ত্বিক আলোচনা। তা এমন তাত্ত্বিক আলোচনাতেই কি আমাদের তৃপ্ত থাকতে হবে? প্রয়োগের ব্যাপারটা আমাদের একবার দেখার সুযোগ করে দিলে আমরা তামাম দুনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা যুক্তিবাদীরা যোগে মাথা ফুলে ব্লাডার হওয়ার তত্ত্বের প্রচারে আন্তরিকতার সঙ্গেই নেমে পড়তে পারি।
যাঁরাই আমাদের চিঠি দিয়ে বা মুখে বলেন নিগূঢ়ানন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, তাঁদেরই অনুরোধ করি, এমন এক যোগী যখন জীবিত এবং হাতের কাছেই রয়েছেন, তখন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করুন না কেন, যাতে নিগূঢ়ানন্দ যোগে ভূমিত্যাগ করে আমাদের দেখান।
ওই বইটির ১১১ পৃষ্ঠায় লেখক আরও একটি সাংঘাতিক দাবি করেছেন। তিনি তাঁর কাছে যোগশিক্ষা করেন এমন অনেকের প্রসঙ্গে বলেছেন, “সূক্ষ্ম দেহে ভিন্ন ব্যক্তি বা স্থান দর্শনের হুবহু বর্ণনাও তাঁরা দিতে পারেন। বর্তমান লেখকের ব্যক্তিগত এমন অভিজ্ঞতা আছে।”
শিষ্যদের ক্ষমতা থাকলে গুরুর থাকবে, এতো জানা কথাই। সঙ্গে নতুন করে জানলাম মনের আবার দর্শন ইন্দ্রিয় আছে এবং মনের চোখ না থাকলেও দেখার ক্ষমতা আছে। চক্ষুহীনদের দেখার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে যোগের সাহায্যে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার সচেষ্ট হতে পারেন, বিশেষত দু-একজন উদ্যমী মন্ত্রী যখন হাতের কাছেই আছেন। এবং পরবর্তীকালে কেন্দ্র ও তারও পরবর্তীকালে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও যোগের প্রয়োগে তৎপর হতে পারেন, অন্ধত্ব নির্মূলের জন্যেই হতে পারেন।
আত্মা দেখতে পায়—জানলাম। কিন্তু কিভাবে বিভিন্ন স্থানে আত্মা যায়? এ বিষয়েও বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিগূঢ়ানন্দ, “সূক্ষ্ম সত্তা (আত্মা) যদি কুলকুণ্ডলিনীর দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়ে তেজসম্পন্ন হয়, তবে তা এই অভিকর্ষকে এড়িয়ে—রকেটের মত পার্থিব মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে অনায়াসে অতিক্রম করে—ভিন্ন বিশ্বে, বা আমাদেরই বিশ্বের নতুন কোন সৌর জগতের আকাশে গিয়ে ভাসমান হতে পারে।” (ঐ বইয়ের পৃষ্ঠা ৯১)
আত্মা যখন অন্যগ্রহে পর্যন্ত রকেটের মত চলে যেতে পারে, তখন এই গ্রহের যে কোনও জায়গায় প্লেনের গতি প্রয়োগ করলেই যে পৌঁছে যাবে এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে? যোগীর বিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে আত্মা নিয়ে যেতে একটা হিরো হোণ্ডা বা সুজুকি’র স্পিড তুললেই যথেষ্ট।
এরপরও যুক্তিবাদীরা বলতে পারেন, তাত্ত্বিক ব্যাপারটা না হয় হলো। কিন্তু প্রয়োগের ব্যাপারটা? নিগূঢ়ানন্দ যদি বাস্তবিকই আত্মাকে উড়িয়ে ভিন্নস্থানে নিয়ে কিছু বর্ণনা দিতে রাজি থাকেন, তবে অধ্যাত্মবাদের জয়জয়কারে নিজেদের নিয়োগ করতে যে সানন্দে রাজি—এ’কথা নিশ্চয়ই উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না। হে-নিগূঢ়ানন্দ ভক্তবৃন্দ, আপনারা একবার নিগূঢ়ানন্দকে রাজি করিয়ে ফেলুন। সাংবাদিক সম্মেলন ডাকার দায়-দায়িত্ব আমরা বহন করতে এক পায়ে খাড়া।
নিগূঢ়ানন্দকে রাজি করাবার দায়িত্ব আমাদেরই যদি নিতে বলেন, তবে বলি— আমাদের অনুরোধ-টনুরোধকে উনি পাত্তাই দিচ্ছেন না। আমাদের এক ফিচেল সদস্য রজত পাত্রের কথায়—এইকয়েক বছর আগে যুক্তিবাদীদের পাল্লায় পড়ে মহেশ যোগীর শিষ্যরা যোগে শূন্যে ভাসা দেখাতে গিয়ে যেভাবে ন্যাজে গোবরে হয়েছেন, তা কি আর কোনও বাবার অজানা আছে? এমন জানার পর কোন বাবার এমন বুকের পাটা হবে, যিনি তত্ত্ব ছেড়ে প্রয়োগও দেখাতে যাবেন!
আসলে মুশকিল হয়েছে কি—যে বাবাই আমাদের কাছে ক্ষমতা দেখাতে এগিয়ে এসেছেন, তাঁরই বুজরুকি এমনভাবে বেবাক ফাঁস হয়েছে যে চতুর বাবারা এখন তাদের দাবি-টাবিগুলো লেখা-পত্তর ও তত্ত্বকথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান।
হ্যাঁ, আর একটা বড় খবরই উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে যাচ্ছিলাম। লেখক নিগূঢ়ানন্দ তাঁর ওই গ্রন্থেরই ১২৩ পৃষ্ঠায় জানিয়েছেন, আত্মার পক্ষে “পার্থিব সূক্ষ্মস্তরগুলোর অভিকর্ষ এড়িয়ে ভিন্ন গ্রহে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।” তিনি ওই পৃষ্ঠাতেই আরও জানিয়েছেন লেখক “ভিন্নগ্রহে বিভিন্ন মাত্রায় জীব দর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন।”
মহাকাশ গবেষণায় ফি বছর হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ না করে, গ্যালাকসিতে প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রাণান্তকর পরিশ্রমে নিজেদের শরীরপাত না করে নিগূঢ়ানন্দের সাহায্য নিলেই তো পারেন।
সাহায্য না নেওয়ার একটা গুরুতর কারণ হতে পারে নিগূঢ়ানন্দের লেখা জনপ্রিয় আত্মা ও জাতিস্মর বিষয়ক বইগুলোই। তাতে অদ্ভুতুড়ে পাগলামির নিদর্শনের ছড়াছড়ি। যেমন—প্রতিটি অণু-পরমাণুর মধ্যেই রয়েছে চেতনা বা মন (আত্মার রহস্যসন্ধান; পৃষ্ঠা ৮৫)। ঐ গ্রন্থের ৯৮ পৃষ্ঠায় তিনি স্বামী অভেদানন্দের মতই নিজের অজ্ঞানতার পরিচয় দিয়ে ‘এক্টোপ্লাজম’কেই আত্মা ঠাউরেছেন। নিগূঢ়ানন্দের জ্ঞানের গূঢ় তত্ত্ব আরও প্রকাশিত হয়ে পড়ে যখন দেখি তিনি বলেন, “পি. সি. সরকার সকলের ঘড়ির কাঁটার সময় কমিয়ে দিতে পারেন কি করে? এ-বিষয়টি তাঁকেই জিজ্ঞাস্য। অধিমনোবিজ্ঞানে একে বলে সম্মোহন বা PK (psycho Kinesis)।” (জাতিস্মর, নিগূঢ়ানন্দ, পৃষ্ঠা-৮৫)
এত অলৌকিক ক্ষমতা, এত জ্ঞান, বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু জানার পর ঘড়ির গণসম্মোহনের প্রচলিত একটা আষাঢ়ে গল্পকে তিনি সত্যি বলে ধরে নিলেন। ঘড়ির সময় পালটে দেওয়ার এই আষাঢ়ে গল্প বিভিন্ন সময়ে যে সব ভারতীয় জাদুকরদের ঘিরে চালু হয়েছিল, তাদের মধ্যে আছেন জাদুকর গণপতি, রাজা বোস, রয়-দি-মিসটিক এবং পি. সি. সরকার। পৃথিবীতে প্রথম যাঁকে নিয়ে এই আষাঢ়ে গল্পের শুরু, তাঁর নাম হাউয়ার্ড থার্সটন; আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাদুকর। এই ধরনের জাদু বা গণসম্মোহন শুধুমাত্র গল্পেই সম্ভব। সম্মোহন ও জাদুর বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান থাকার দরুন এ’কথা বলছি। নিগূঢ়ানন্দের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভুল সম্মোহনকে Pk (Psycho Kinesis)র সঙ্গে এক করে দেখা। Pk হল পরামনোবিজ্ঞানের এক অদ্ভুতুড়ে বিষয়। পরামনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন বস্তুর উপর মানুষের ইচ্ছাশক্তি ক্রিয়াশীল হতে পারে। যেমন ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে পানীয় জলকে মদে পরিণত করা, বৃষ্টি থামিয়ে দেওয়া, বৃষ্টি নামানো, সমুদ্রের জলকে দু’পাশে সরিয়ে পথ করে নেওয়া ইত্যাদি। এই ধরনের তথাকথিত ক্ষমতাই পরামনোবিজ্ঞানীদের ভাষায় Pk। এবং এ’কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে পরামনোবিজ্ঞান অবিজ্ঞানের বিষয়, বিজ্ঞানের নয়।
সম্মোহন হল সঞ্চারিত ধারণার ফলে মস্তিষ্কস্নায়ুকোষের এক ধরনের বিশেষ প্রতিক্রিয়া। এবং এই প্রতিক্রিয়া মনোবিজ্ঞানের বিষয়, অর্থাৎ বিজ্ঞানের বিষয়, পরামনোবিজ্ঞানের বিষয় নয়।
নিগূঢ়ানন্দ লিখেছেন, “উরি গেলারের কাছে যান, তাকিয়ে থেকে তিনি ধাতব দণ্ড বাঁকিয়ে দিতে পারেন। অধিমনোবিজ্ঞানীরা একে বলেছেন—Pk। লেখকের কাছে যোগ শিখেছেন এমন এক আমেরিকান মহিলা মিসেস রেনে’ও এই ক্ষমতার অধিকারিণী”। (জাতিস্মর, নিগূঢ়ানন্দ, পৃষ্ঠা-৮৬)
নিগূঢ়ানন্দজীর অবস্থাটা পেঁয়াজের মত, যতই ছাড়াচ্ছি একের পর এক শুধু বিস্ময়ের খোসা। উরি গেলারের তাকিয়ে থেকে ধাতুর চামচ বাঁকাবার রহস্য আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগেই উন্মোচিত হয়েছে আমার কলমে। উরি চামচের হাতল তৈরি করতেন দুটি ভিন্ন ধাতুর পাতলা পাত জুড়ে। গ্যালভানাইজ করে দুই ধাতুর জোড়াকে দেওয়া হত ঢেকে। তারপর খুব কাছ থেকে চামচের হাতলে ফেলা হত তীব্র আলো। আলোর উত্তাপে হাতল গরম হত। উত্তাপে দুটি ধাতুর পাতের প্রসারণ হত ভিন্ন রকমের। ফলে হাতল যেত বেঁকে। হে ভূত-ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, বিশ্ব- ব্ৰহ্মাণ্ড চষে ফেলা নিগূঢ়ানন্দ, উরির চামচ বাঁকাবার গূঢ় রহস্যটাই আপনি জানতেন না? বিজ্ঞানের এই কৌশলকে, উরির এই বুজরুকিকে আপনি PK বলে দিব্বি চালিয়ে দিচ্ছিলেন! আপনার এক শিষ্যা উরির মত তাকিয়ে ধাতু বাঁকাবার অধিকারী বলে জানিয়েছেন, তা তিনিও কি উরির মতই দু’ধাতু পাতের-কারবারী? হে আমেরিকান শিষ্যার গুরু, আমাদের প্রতি একবার কৃপা করে তাকিয়ে একটা চামচ কি পেরেক বাঁকিয়ে দেখিয়ে দিন। আপনার এমন ক্ষমতা চাক্ষুষ করে আমরা ধন্য হই। তারপর আপনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রকেট গতি প্রাপ্ত হয়ে মহাবিশ্বে আপনার মাহাত্ম্য প্রচারে ঘুরে বেড়াই।
নিগূঢ়ানন্দজী, সম্মোহন নিয়ে আরও একটা মারাত্মক জ্ঞানের প্রমাণ আপনি রেখেছেন। আপনি লিখেছেন, “টেলিপ্যাথিতে সম্মোহনকারী তাঁর নিজের বিশ্বাস রোগীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেন।” (জাতিস্মর গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৫৩)
ধুর মশাই, এমন উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে ওঁচা ‘মাল’ নামিয়ে জনগণকে চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যাবে ভেবেছন নাকি? লেখার আগে একটা জানার চেষ্টা তো করবেন। জানেন যা, জানবার চেষ্টা তার চেয়ে এতই বেশি যে বারবার ল্যাজে গোবরে হওয়া ছাড়া কোনও গতি নেই।
নিগূঢ়ানন্দজী, অধিমনোবিজ্ঞানী বা পরামনোবিজ্ঞান, যে নামেই ডাকুন, ওই তথাকথিত বিজ্ঞানটি মনে করে চিন্তার সময় মস্তিষ্ক থেকে রেডিও ওয়েভের মতো এক ধরনের তরঙ্গ প্রেরক যন্ত্রের সাহায্যে প্রবাহিত হতে থাকে। দূরের কোনও লোকের পক্ষে তার মস্তিষ্কের গ্রাহক যন্ত্রের সাহায্যে এই তরঙ্গকে ধরে প্রেরকের চিন্তার হদিস পাওয়া কঠিন হলেও অসম্ভব বা অবাস্তব নয়।
এতো গেল পরামনোবিজ্ঞানী নামধারী বিজ্ঞান-বিরোধী অধ্যাত্মবাদীদের ধারণা। কিন্তু তাঁদের ধারণা অনুযায়ী চিন্তা তরঙ্গের অস্তিত্ব আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। পরামনোবিজ্ঞানীরাও চিন্তা তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেননি, যেমনটি প্রমাণ করা যায় শব্দ বা আলোক তরঙ্গের ক্ষেত্রে। শব্দ বা আলোক তরঙ্গ নির্দিষ্ট কম্পাঙ্ক, গতি ও মাত্রায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, এটা প্রমাণিত। রেডিও এবং টেলিভিশন এই শব্দ তরঙ্গ ও আলোক তরঙ্গকে ধরে শব্দ ও দৃশ্যকে আমাদের সামনে হাজির করে। অস্তিত্বহীন চিন্তাতরঙ্গ ধরা নেহাতই অবাস্তব কল্পনা। এবং এই অবাস্তব কল্পনার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা টেলিপ্যাথিও একটা কল্পনা বা বিরাট ধাপ্পা! (টেলিপ্যাথির পৃথিবী বিখ্যাত বহু বুজরুকির রহস্য উন্মোচিত হয়েছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে)।
আর ‘সম্মোহন’ ব্যাপারটা….; না, সে এক বিশাল অধ্যায় নিয়ে তাহলে বসতে হয়। ‘সম্মোহন’ বিষয়ে বিস্তৃত জানতে উৎসাহী পাঠক-পাঠিকারা পড়তে পারেন ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড।
থিওজফিক্যাল সোসাইটির প্রেতচর্চা
থিওজফিক্যাল সোসাইটির রমরমা কমলেও মানুষের মন থেকে যে নির্মূল হয়নি, তার প্রমাণ মাঝে-মধ্যেই পাই উঠে আসা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে। থিওজফিস্টরা প্রেততত্ত্ববিদ্। এক সময় বাংলার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিই ছিলেন থিওজফিস্ট। তাঁদের নানা প্রেতচর্চার বিষয় নিয়ে এবং থিওজফিক্যাল সোসাইটির সবচেয়ে উল্লেখযো্য ব্যক্তিত্ব অ্যানি বেশান্ত (Annie Besant)-এর প্রেতচর্চার সাড়া জাগানো নানা ঘটনা নিয়ে বহু প্রশ্নই উচ্চশিক্ষিত একটি বিশেষ মহল থেকেই সাধারণত উঠে আসে। উঠে আসা প্রশ্নগুলি সাধারণভাবে সব সময়ই এই ধরনের—ওঁরা প্রত্যেকেই কি তবে মিথ্যাচারী ছিলেন। যে থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রেততত্ত্ব নিয়ে চর্চা করত, প্ল্যানচেটে আত্মা নামিয়ে আনত, তাদের সম্বন্ধে সামান্য হলেও কিছুটা আলোচনা করে নেওয়া তাই একান্তই জরুরি বলে মনে করি।
১৮৭৫ সালের ১৭ নভেম্বর থিওজফিক্যাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে হেলেনা পেট্রোভনা ব্লাভাৎস্কিকে সামনে রেখে। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কর্নেল হেনরি অলকট। ব্লাভাৎস্কি প্রেতাত্মাদের বা বিদেহী আত্মাদের খুব প্রিয় ও বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর আহ্বানে আলো-আঁধারী ঘরে প্রেতাত্মারা টেবিল ঠকঠক করত। বিদেহী ‘মহাত্মা’রা রেখে যেতেন নানা লিখিত নির্দেশ, উপদেশ ইত্যাদি। ‘মহাত্মা’ কারা? অলকটের কথায়, ‘মহাত্মা’ এমনই একজন, যিনি নিজের অধ্যাত্মশক্তি ও নিজের ইচ্ছাশক্তিকে উন্নত করে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যেখানে তিনি ক্ষুদ্র বাসনা- কামনার দ্বারা আচ্ছন্ন নন, নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন। পবিত্র, কামনাহীন।” (থিওজফিস্ট পত্রিকা, জুন, ১৯০১ সাল)
মহাত্মারা শুধু যে লেখাই পাঠাতেন, তেমন নয়। মাদাম ব্লাভাৎস্কির সঙ্গে অনেক কথাও বলতেন, এক মহাত্মার ওভারকাটের পকেট থেকে জাপানি টি পট বের করে মাদাম ভক্তদের তা দেখিয়েও ছিলেন।
অলকটের জীবনের এক প্রেতাত্মাঘটিত ঘটনার কথা বলার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। এক প্রেতবৈঠকে অলকট গিয়েছিলেন একটি গোলাপ নিয়ে। ভরগ্রস্ত মিডিয়াম তাঁকে বললেন—গোলাপটি শক্ত মুঠোয় চেপে ধরতে। যখন মিডিয়াম হাত খুলতে বললেন তখন মুঠো খুলে দেখেন গোলাপের ভিতর একটি সোনার আংটি। তারপর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে। সিমলায় অলকট তাঁর এক বান্ধবীকে বলছিলেন বিদেহী আত্মার আংটি দেওয়ার লোম খাড়া করা ঘটনার কথা। ঘটনাটি শুনে বান্ধবী আংটিটি নিজের হাতে নিয়ে দেখার কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। অলকট আঙুল থেকে আংটি খুলে বান্ধবীর হাতে তুলে দিলেন। মাদাম ব্লাভাৎস্কি বান্ধবীর হাতের মুঠোটা চেপে ধরলেন। মুঠো বন্দী হয়ে রইল আংটি। মাদাম আহ্বান জানালেন এক ‘মহাত্মা’কে। তারপর মুঠো খুলতেই অবাক কাণ্ড! সোনার আংটি হয়ে গেছে তিনটে হিরে বসানো আংটি।
থিওজফিস্টদের আত্মা নামিয়ে কাণ্ডকারখানা ঘটানোর কথা সেই সময়ে সারা পৃথিবী জুড়ে বহু পত্র-পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা জেনেছি মাদামের আহ্বানে আত্মাদের ঘণ্টা বাজাবার কথা, শূন্য থেকে জিনিস আনার কথা—ওমনি কত কী!
১৮৮৮ সালে মাদামের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Secret Doctrine’ প্রকাশিত হল। প্রেততত্ত্ব বিষয়ক গুপ্ত বিদ্যা শিখতে বহু মানুষের আগ্রহ জাগিয়ে তুলল এই গ্রন্থটি।
১৮৯১ সালে মাদাম মারা গেলেন। তাতে কিন্তু থিওজফিক্যাল সোসাইটির রমরমা একটুও কমল না। কারণ ইতিমধ্যে বহু বিশিষ্টরাই তখন মাদামের বিশাল ভক্ত। ১৮৮২ সালে মাদাম ও অলকটের আশীর্বাদ নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বেঙ্গল থিওজফিক্যাল সোসাইটি’। সভাপতি হলেন প্যারীচাঁদ মিত্র, যেই প্যারীচাঁদ এক সময় চিহ্নিত হয়েছিল, ‘ডিরোজিয়ান হিসেবে’, বুদ্ধিবাদী-যুক্তিবাদী হিসেবে। সোসাইটির সহ-সভাপতি হয়েছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর ও রাজা শ্যামাশংকর রায়। সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ—নরেন্দ্রনাথ সেন। সহ-সম্পাদক—বলাইচাঁদ মল্লিক ও মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেও মাদাম ও অলকটের পায়ের ধুলো পড়ত প্রায়ই।’ ৮২ সালেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে স্বর্ণকুমারী দেবীকে সভানেত্রী করে গড়ে উঠেছিল ‘লেডিস থিয়োজফিক্যাল সোসাইটি’। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা হয়ে উঠেছিল থিওজফি প্রচারের এক পত্রিকা। ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এক সময়ের ‘নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত শিশিরকুমার ঘোষও এক সময় ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে পরে একই সঙ্গে পরম বৈষ্ণব ও ঘোর থিওজফিস্ট বা প্রেততত্ত্ববিদ হয়ে উঠেছিলেন। অমৃতবাজারও সেই সময় থিওজফিস্টদের প্রশংসা করে অনেক লেখা প্রকাশ করেছে। এবং তারই পরম্পরা বজায় রেখে আজও ‘অমৃতবাজার’ ও তাদের গোষ্ঠীরই বাংলা দৈনিক ‘যুগান্তর’ অক্লান্তভাবে প্রচার করে চলেছে বৈষ্ণব ও থিওজফিস্ট ভাবধারা।
থিওজফিক্যাল সোসাইটি যে কি বিপুলভাবে প্রধানত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে প্রভাব ফেলেছিল, তারই উদাহরণ—১৯০০ সালে সোসাইটির আমেরিকাতে শাখা ছিল ছ’শো এবং ভারতে তিনশো। আমেরিকায় সোসাইটি বিস্তৃতি লাভ করেছিল যার কাঁধে ভর দিয়ে, তিনি থিওজফিক্যাল সোসাইটির অন্যতম প্রাণপুরুষ উইলিয়ম জাজ।
থিওজফিস্ট অ্যানি বেশান্ত
আইরিশ রমণী অ্যানি বেশান্ত ভারতে আসেন ১৮৯৩ সালে। মাদামের ‘সিক্রেট ডকট্রিন’ পড়ে তিনি মাদামের ভক্ত হয়ে ওঠেন, সেই সঙ্গে থিওজফিস্ট। অ্যানি ছিলেন সুবক্তা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ব্লাভাৎস্কির মৃত্যুর পর বেশান্ত ও জাজ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মধ্য দিয়ে সোসাইটির কাজকর্ম চালাতে থাকেন। অলকট ছিলেন সোসাইটির সভাপতি। সহ-সভাপতি ছিলেন জাজ। মাদামের জায়গা দখলের লড়াইয়ে এক সময় আমরা নামতে দেখলাম জাজ ও বেশান্তকে। এক সময় বেশান্ত জাজকে উদ্দীপ্ত করতে চেষ্টা করেছিলেন অলকটকে হটিয়ে দেবার কাজে সহযোগিতা করার জন্য। জাজ এগিয়ে না আসায় বেশান্ত অলকটের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নামেন জাজকে অপদস্থ করার কাজে।
জাজ এই সময় মাদামের জায়গা দখল করার জন্য ‘মহাত্মাদের’ নানা লিখিত নির্দেশ হাজির করে থিওজফিস্টদের দেখতে লাগলেন। এইসব চিঠিতে সোসাইটি ভালমত পরিচালনার নির্দেশও দিতেন বিদেহী মহাত্মারা। এমন মহা বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বেশান্ত ও অলকট জাজের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন। ‘৯৪তে। জাজ জানালেন—আমি বলছি মহাত্মাদের কাছ থেকে চিঠিগুলো পেয়েছি, এটাই কি যথেষ্ট নয়?
থিওজফিক্যাল সোসাইটি থেকে জাজকে বহিষ্কার করা হল। কিন্তু থিওজফিক্যাল সোসাইটির আমেরিকার শাখাগুলো জাজের সঙ্গেই রয়ে গেল, কারণ আমেরিকার থিওজফিস্টদের কাছে উইলিয়ম জাজের সততা মাদাম ব্লাভাৎস্কির সততার মতই প্রশ্নাতীত ছিল।
অ্যানি বেশান্ত থিওজফিস্টদের কাছে নিজের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে জানালেন, ‘মহাত্মা’রা পৃথিবীর যে মানুষটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, নির্দেশ পাঠান, তিনি জাজ নন, অ্যানি বেশান্ত। বেশান্ত আরও জানালেন ঈশ্বর বা পরমপিতা অথবা আল্লা যে নামেই তাদের ডাকি না কেন, সেই সর্বশক্তিমান পৃথিবী শাসন ও পরিচালনা করেন মহাত্মাদের সাহায্যে। ঈশ্বরের মুখ্য প্রতিনিধি সনৎকুমার। তাঁর বাস গোবি মরুভূমিতে। জগৎসংসার চালাচ্ছেন মনু। তাঁকে সাহায্য করছেন অগস্ত্য, কুথুমি, মোরিয়া, বুদ্ধ, খ্রিস্ট, জরথুস্ট্র ইত্যাদি মহাত্মারা।’
বেশান্ত তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতায়, প্রচারযন্ত্র, বুদ্ধিজীবীদের কাজে লাগানোর সফলতায় দেশ-বিদেশে বিপুল সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি অতি দৃঢ়তার সঙ্গে শ্রোতাদের সামনে বক্তব্য রাখতেন, “আমার সামনে আপনারা যেমন আছেন, মহাত্মারাও তেমনইভাবে আছেন—আছেন—আছেন”।
অ্যানি বেশান্ত প্রেতচক্রের আসর বসাতেন। আত্মাদের দিয়ে ঘণ্টা বাজাতেন, বাজনা বাজানো, ফুল নিয়ে আসা—এমনি অনেক অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা দেখাতেন। সাংবাদিকদের কাছে আত্মাদের ঘটানো অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানার গল্প বলে চমক লাগিয়ে দিতেন। সে সব গল্পের কিছুটা হদিস দিতে বহু থেকে একটি উদাহরণ এখানে হাজির করছি।
১০ জুন ১৮৯৪ ‘মাদুরা মেল’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অ্যানি বেশান্ত বলেন—বিদেহী আত্মার সাহায্যে শূন্য থেকে কতই না জিনিস আনা যায়। টেবিল, বই বা অন্য কিছুর প্রয়োজন হলে সেগুলোর কাছে না গিয়ে সেগুলোকেই নিজের কাছে আনা যায় আত্মার সাহায্য নিয়ে। মাদাম ব্লাভাৎস্কি পেসেন্স তাস খেলতে ভালবাসতেন। আমি দেখেছি, তিনি যখন খেলতে চাইতেন তাসগুলো আপনা থেকে তাঁর কাছে এসে যেত।
বেশান্ত আত্মার অমরতার পাশাপাশি জন্মান্তর ও কর্মফলের পক্ষেও প্রচার চালান। নীচবংশে জন্মান ও গরিবির জন্য তিনি দ্বিধাহীনভাবে কর্মফলকেই দায়ী করেছিলেন। বোম্বাইয়ে ভয়াবহ প্লেগ দেখা দেওয়ায় বেশান্ত ঘোষণা করেছিলেন- কর্মফলই এই রোগভোগের কারণ। বেশান্ত আরও ঘোষণা করলেন পূর্বজন্মে তিনি ছিলেন হিন্দু পণ্ডিত, এই জন্মে পাশ্চাত্যে জন্মে সেখান থেকে বস্তুবাদের বা জড়বাদের বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন উদ্দেশ্য বস্তুবাদ বা জড়বস্তুবাদের অসারতা প্রমাণ করা। এখন তিনি জড়বাদকে নস্যাৎ করে দেওয়ার শক্তি অর্জন করে ফিরে এসেছেন আপন বাসভূমিতে। নিজের নাম ঘোষণা করলেন আন্নাবাঈ, অ্যানি থেকে আন্নাবাঈ। তাঁর এমনতর হিন্দু সেন্টিমেন্টকে সুড়সুড়ি দেওয়া ঘোষণায় ভারতের প্রচুর মানুষ আবেগে আপ্লুত হলেন।
১৮৯৩-এর শেষে আন্নাবাঈ বিশাল প্রচারের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে বক্তৃতাসফর শুরু করলেন। থিওজফি বা ‘প্রেততত্ত্ব’ বা ‘মহাত্মা’দের বিষয়ে যত বললেন, তারচেয়ে বেশি বললেন হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য নিয়ে। ভক্ত ভারতীয় হিন্দুদের মন তাতে সিক্ত হল।
ভারতের নানা জায়গায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে অ্যানি থিওজফিস্ট ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতির জগতেও প্রবেশের দিকে পা বাড়ালেন। অ্যানি ‘পায়োনিয়ার’ পত্রিকায় চিঠি লিখে জানালেন—হিন্দুধর্ম রাজভক্তি আনুগত্য বজায় রাখার অতি সহায়ক। চিঠিতে বেশান্ত পাশ্চাত্যে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন অমানবিক ও ভয়াবহ বলে বর্ণনা করে লিখলেন-এ’সব কারণেই ইংলন্ড এখন আরও বেশি বেশি করে রাজতন্ত্রকেই আঁকড়ে ধরছে। অ্যানি এও জানালেন, ভারতবর্ষ সফর করে এই দেখে খুশি যে ভারতবাসীরা শাসক রাজশক্তির প্রতি শাসিত প্রজাদের প্রাচীন ঐতিহ্যে উজ্জীবিত। তিনি এও জানালেন—প্রাচীন হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান যে শুরু হয়েছে, তার শুভময় ফলেই পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথ থেকে শিক্ষিত হিন্দুরা সরে গিয়ে রাজভক্ত হচ্ছে।
পায়োনিয়ার পত্রিকায় প্রকাশিত এই চিঠি ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রধান খবরের কাগজেই প্রকাশিত হয়েছিল।
ইংরেজ রাজতন্ত্রের প্রতি ভারতবর্ষের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের ভক্তি ও আনুগত্য বাড়িয়ে তুলতে হিন্দুধর্ম আন্দোলন ও হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়ে ছিলেন বেশান্ত। সেকথা প্রকাশিত হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ এর ইংরেজি দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় ও ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ ‘মাদ্রাজ টাইমস’ পত্রিকায়।
১ এপ্রিল ১৮৯৯-এ ‘মাদ্রাজ মেল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হল অ্যানি বেশান্তের আরও ভয়াবহ বক্তব্য। প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল, “Hinduism and Loyalty”। সেখানে এক জায়গায় তিনি বলেছেন, আমার মতে গণতন্ত্রের পথ ভাল ফল দেবার মত নয়।…..গণতন্ত্র ভারতীয় মানসিকতার পক্ষে অনেক দূরের জিনিস। গণতন্ত্রের ফলে প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষিত মুষ্টিমেয় ভারতবাসীরা কারণ তাদের অশিক্ষিত সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় গ্রাস করবে।
“My view is that demoeratic methods are ill-fitted to bring about good results ………. I believe them to be alien from the spirit of the Indian people, and that the comparatively small class of edu- cated Indians would be first to suffer from their successful introduc- tion here, since they would be swamped by the uneducated.”
অ্যানি বেশান্তের রাজভক্তির পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য যখন সভায় ও পত্রিকার পাতায় এসে হাজির হচ্ছে, তখন বালগঙ্গাধর তিলকের পত্রিকা ‘মারাঠা’য় সম্পাদকীয় লিখে জানানো হল—তাঁরা থিওজফিস্টদের মত মানুন না মানুন অ্যানি বেশান্তের উপর যে কোনও ধরনের আক্রমণ হলে তার প্রতিবাদে সরব হবেন, কারণ বেশান্তের প্রচারের ফলে ভারতবাসীদের মনে জাতীয়তাবোধ বেড়েছে।
বেশান্তের উপর আক্রমণ তখন সত্যিই শুরু হয়ে গিয়েছিল। বেশান্তের ও অন্যান্য থিওজফিস্টদের আত্মা ও মহাত্মা নামানোর ব্যাপারটা যে পুরোপুরি বুজরুকি এবং জালিয়াতি, এ বিষয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল ‘স্টেটসম্যান’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘মাদ্রাজ মেল’, ‘মাদ্রাজ টাইমস’ ইত্যাদি পত্রিকায়। এ’সব লেখাগুলো অবশ্য কোনও বুদ্ধিবাদী যুক্তিবাদী বা বস্তুবাদী যুক্তিবাদীদের কলম থেকে উৎসারিত হয়নি, উৎসারিত হয়েছিল মিশনারিদের সমর্থকদের কলম থেকে।
‘মর্ডান রিভিউ’এর ১৯১১ সালের নভেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয়টির শিরোনাম ছিল ‘Mrs Besant Lifts Her Veil in London’। তাতে লেখা হল –শ্রীমতী বেশান্ত ইংলন্ডে গিয়ে ‘ইন্ডিয়ান আনরেস্ট’ বিষয়ে বক্তৃতায় ইংরেজ বিচারপতিদের নিরপেক্ষতার কথা বলে একদিকে যেমন প্রশংসা করেন, অপরদিকে তেমনই ভারতীয় বিচারপতিদের পক্ষপাতদুষ্টতা বিষয়ে সমালোচনা করেন।
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো এমন এক প্রতারক, বুজরুক, ইংরেজ রাজতন্ত্রের স্বার্থরক্ষাকারী দেশীয় ধনী ও শিক্ষিতদের স্বার্থরক্ষাকারী মহিলা অ্যানি বেশান্তকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদে বসানো হলো ১৯২০ সালে। আমরা আরও দেখলাম অ্যানি বেশান্তের মৃত্যুর পর তাঁর নামে রাস্তা করতেও কোনও সরকারের বিবেক সামান্যতম কাঁপেনি। কে জানে, হয় তো প্রতারককে জাতীয় সম্মান জানাবার একটা পরম্পরা গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রতারণাকেও সম্মানজনক করে তুলতেই এমন অনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল।
থিওজফিস্ট বনাম জাদুকর
উনিশ শতকের শেষ দিকে আমেরিকার বিখ্যাত থিওজফিস্ট শ্রীমতী ডিস- ডেবার’এর প্ল্যানচেটে আত্মা আনা নিয়ে নিউ ইয়র্ক শহর উত্তাল হয়ে উঠেছিল। প্ল্যানচেট? না, প্লেন-চিট্? এই বিতর্ক শেষ পর্যন্ত এসে পড়েছিল আদালত কক্ষে।
কাহিনীর নায়িকা সম্ভ্রান্ত ডিস-ডেবার প্রেতচক্রের আসরে মাদাম ব্লাভাৎস্কির মতই প্রেতাত্মা ও মহাত্মাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। প্ল্যানচেটের আসরে রাফায়েল, লিওনার্দো-দ্য-ভিঞ্চি প্রমুখ পৃথিবী বিখ্যাত শিল্পীদের আত্মাকেই তিনি শুধু নিয়ে আসেননি, তাঁদের আত্মাকে দিয়ে ছবিও আঁকিয়ে নিয়েছেন। শেক্সপিয়ারের আত্মা তাঁর প্রকাশিত রচনার অংশবিশেষ আবৃত্তি করেছেন। শুনিয়েছেন আত্মার রচিত নতুন কবিতা। নিয়ে এসেছেন—অষ্টম-নবম শতাব্দীর দিগ্বিজয়ী সম্রাট শলেমন বা শার্লেমেন-এর আত্মাকে। সাদা একটুকরো কাগজকে চার ভাঁজ করে শ্রীমতী ডিস-ডেবারের কপালে ছোঁয়াতেই ঘটে গেছে অলৌকিক ঘটনা। সাদা কাগজ খুলতেই দেখা গেছে, আত্মা এসে লিখে রেখে গেছে। সাদা-পাতার রাইটিং-প্যাড প্ল্যানচেট চক্রে রেখে দেখা গেছে পাতার পর পাতা লেখায় ভর্তি করে গেছে আত্মারা।
নিউ ইয়র্কের ধনকুবের আইন-ব্যবসায়ী লুথার মার্শ তাঁর ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ- এর সমস্ত সম্পত্তি তাঁর কন্যার বিদেহী আত্মার অনুরোধে শ্রীমতী ডিস-ডেবারকে দানপত্রের দলিল করে অর্পণ করতেই মার্শের নিকট আত্মীয়রা ডিস-ডেবারের বিরুদ্ধে মার্শকে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন আদালতে।
ডিস-ডেবার এতে সামান্যতম বিচলিত তো হলেনই না, বরং, এই ঘটনাটিকে প্রচারের বিরাট সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলেন। স্থানীয় সমস্ত পত্রিকা যখন এমন একটা অসাধারণ পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগকারী মিডিয়ামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে নানা খবরে পাতা ভরিয়ে পাঠক-পাঠিকাদের গোগ্রাসে গেলাতে ব্যস্ত, তখন সাংবাদিকদের কাছে ডিস-ডেবার ঘোষণা করলেন, তিনি এই মামলায় লৌকিক উকিল ছাড়াও দশজন বিখ্যাত আইনজ্ঞ ও রাজনীতিবিশারদের আত্মার পরামর্শ নিচ্ছেন। ডিস-ডেবার ঘোষণা করলেন—তিনি আজ পর্যন্ত আত্মাদের এনে যতগুলো ঘটনা ঘটিয়েছেন,তার প্রতিটিই ঘটিয়েছেন নিজের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দ্বারা। এগুলোর পেছনে কোনও ফাঁকি ছিল না।
আদালতে আরও অনেক ঘটনাই জানা গেল। জানা গেল শ্রীমতী ডিস- ডেবারের প্রথম জীবনে নাম ছিল এডিথা শলেমন। জন্মেছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি মার্কিন দেশের কেনটাকি প্রদেশে। বাবা ছিলেন বেপরোয়া ও ছন্নছাড়া। জীবনযাপনের তাগিদে অনেককে নির্বিবাদে ঠকিয়েছেন।
কুড়ি বছর বয়সে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের কার্লিমোর শহরে এডিথা নিজেকে হাজির করলেন এক লাস্যময়ী রমণী হিসেবে। প্রচার করলেন, তিনি হলেন ব্যাভেরিয়ার রাজা প্রথম লুই-এর অবৈধ কন্যা, তাঁর মা ছিলেন বহুবল্লভা নর্তকী লোলা। অমনি হৈ-হৈ পড়ে গেল, স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে এডিথার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো ফলাও করে।
এডিথা বিয়ে করলেন তরুণ যুবক ডাঃ মেসান্টকে। বছর ঘুরল না, এডিথা বিধবা হলেন। সেই সময় আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়ে সম্মোহন বিদ্যার বেশ রমরমা। এডিথা সম্মোহন বিদ্যা শিখে তার সঙ্গে জুড়ে দিলেন একটু লাস্য ও একটু কূটবুদ্ধি। পসার জমে উঠতে দেরি হলো না। এমনি সময় অভিজাত বংশের ডিস-ডেবারের সঙ্গে আলাপ হলো। ডিস-ডেবারকে বিয়ে করে নিজেকেও অভিজাত মহিলা করে তুললেন এডিথা।
এমনি সম্মোহন করতে করতেই একদিন সম্মোহনের আসরে শ্রীমতী ডিস- ডেবারের শরীরে বিদেহী আত্মার আবির্ভাব ঘটল। সেদিনের আসরে উপস্থিত ছিলেন নিউ ইয়র্কের সেরা ধনী আইনব্যবসায়ী লুথার মার্শ। বিদেহী আত্মা হিসেবে সেদিন হাজির হয়েছিলেন মার্শেরই মত পত্নী। কণ্ঠস্বর না মিললেও, বাচনভঙ্গি যথেষ্ট মিলে গেল, সেই সঙ্গে মিলে গেল কথা বলার সময়কার কয়েকটি মুদ্রাদোষ। শ্রীমতী ডিস- ডেবারের ‘মিডিয়াম’-খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল অভিজাত মহলে। নিত্য বসতে লাগল প্ল্যানচেটের আসর। মোটা অর্থের বিনিময়ে প্রিয়জনদের বিদেহী আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে লাগলেন শ্রীমতী ডিস-ডেবার।
একসময় শ্রীমতী ডিস-ডেবারের আমন্ত্রণে বিখ্যাত শিল্পীদের আত্মারাও হাজির হতে লাগলেন। বিশাল অর্থের বিনিময়ে অতীত দিনের শিল্পীদের বিদেহী আত্মা কয়েক দিনের মধ্যেই এঁকে দিতে লাগলেন ছবি। আরও যে-সব বিখ্যাত বিদেহী আত্মারা প্ল্যানচেট-চক্রে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটিয়েছেন, তা আগেই বলেছি।
গণ্ডগোল পাকাল মার্শের মত মেয়ের আত্মা এসে বাবাকে তাঁর ম্যাডিসন অ্যাভেনিউ-এর সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিতে বলায়। মার্শও দানপত্র করে দিলেন, আদালতেও শ্রীমতী ডিস-ডেবারের নামে প্রতারণার অভিযোগ এলো। অভিযোগ যাঁরা আনলেন, তাঁরা বলতে চাইলেন শ্রীমতী ডিস-ডেবারের গোটা প্ল্যানচেটের ব্যাপারটার মধ্যেই রয়েছে একটা ফাঁকি। আর, এই ফাঁকি প্রমাণ করতে আদালতে হাজির করা হলো আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত জাদুকর কার্ল হার্টজকে (Carl Hertz)।
আদালতে একদিকে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী মিডিয়াম ডিস-ডেবার অন্য দিকে বিখ্যাত জাদুকর কার্ল হার্টজ, সে এক অভাবনীয় ব্যাপার। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক ও দর্শকদের ভিড়ে ঠাসা আদালত কক্ষে কার্ল এক টুকরো সাদা কাগজ নিয়ে দেখালেন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীমতী ডিস-ডেবার এবং মাননীয় জুরিদের। কাগজটি এবার ডিস-ডেবারের হাতে দিয়ে বললেন ওটা চার ভাঁজ করতে। ডিস-ডেবার আর একবার কাগজটি পরীক্ষা করে চার ভাঁজ করলেন। জাদুকর কার্ল এবার কাগজটি নিয়ে শ্রীমতী ডিস-ডেবারকে কায়দায় নিজের কপালে বসিয়ে শ্রীমতী ডিস-ডেবারকে বললেন, “কাগজটা এবার আমার কপালে চেপে ধরে থাকুন।” শ্রীমতী ডিস-ডেবার কপালে কাগজটা চেপে ধরলেও কাগজের একটা কোণ ছিঁড়ে চিহ্ন দিয়ে রাখলেন; একসময় জাদুকর কার্ল বললেন, “এবার কাগজটা কপাল থেকে তুলে ভাঁজ খুলুন।
আর ভাঁজ খুলতেই চমকে গেলেন শ্রীমতী ডিস-ডেবার, ভেতরে অনেক কিছু লেখা রয়েছে, অবাক হলেন জুরিরা এবং সেই সঙ্গে অবাক হলেন শ্রীমতীর এই খেলা দেখেই এতদিন যাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন, তাঁরাও।
জাদুকর কার্ল এবার একটা রাইটিং-প্যাড দেখালেন, প্যাডের সব পাতাই সাদা। প্যাডটি খবরের কাগজে জড়িয়ে একদিক ধরতে দিলেন এক সাংবাদিককে, আর একদিক ধরলেন নিজে। একটু পরেই খখস্ করে লেখার আওয়াজ পেলেন সাংবাদিক। আওয়াজ থামতে খবরের কাগজ থেকে প্যাডটা বের করতেই দেখা গেল প্যাডের সবগুলো পৃষ্ঠা লেখায় ভরে গেছে।
বিস্মিত জুরিদের ও দর্শকদের যখন কার্ল বললেন—এই দুটো খেলার কোনটাই আত্মার সাহায্যে ঘটানো হয়নি, ঘটানো হয়েছে কৌশলের সাহায্যে – তখন আদালত কক্ষ বিস্ময়ে হতবাক্।
জাদুকর কার্ল দর্শকদের কৌতূহল মেটাতে নিজের গোপন কৌশলগুলো ফাঁস না করলেও আপনাদের কৌতূহল মেটাতে আমিই ফাঁস করছি—শ্রীমতী চার ভাঁজকরা সাদা কাগজটা কার্লের হাতে দিতেই কপালে ঠেকাবার মুহূর্তে কার্ল তাঁর হাতে লুকিয়ে রাখা লেখায় ভরা চার ভাঁজ করা একটা কাগজের সঙ্গে পালটে নিয়েছিলেন।
রাইটিং-প্যাডও বদলে নিয়েছিলেন ঠিক সময় ও সুযোগমতো। প্যাডে লেখার খস্থস্ আওয়াজ তুলেছিলেন নিজের আঙুলের একটা নখকে ছুঁচলো করে মাঝামাঝি ফেড়ে রেখে।
শ্রীমতী ডিস-ডেবারের জেল হয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছিল বিখ্যাত আত্মাদের আঁকা ছবিগুলো ছিল জাল।
উনিশ শতকের সেরা মিডিয়ামদ্বয় ও দুই শৌখিন জাদুকর
উনিশ শতকে যে সব থিওজফিস্ট আত্মার মিডিয়াম হিসেবে যাঁরা সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁরা হলেন আইরা ইরাসটাস ড্যাভেনপোর্ট (Ira Erastus Davenport) এবং উইলিয়াম হেনরি ড্যাভেনপোর্ট (Willam Henry Davenport)। এঁরা দুই ভাই জন্মেছিলেন যথাক্রমে ১৮৩৯ এবং ১৮৪১ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো শহরে। ১৮৫৫ সালে জন কোল্স (John Coles) নামে এক প্যারাসাইকোলজিস্ট ও থিওজফিস্ট এই দুই ভাইকে নিউইয়র্ক নিয়ে আসেন। অতি দ্রুত জন কোল্স-এর সহায়তায় নিউইয়র্ক জয় করলেন ওঁরা। প্ল্যানচেটের বিভিন্ন আসরে দু-ভাই এমন ভয় ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করলেন যা সত্যিই অভূতপূর্ব। প্ল্যানচেটের আসরগুলোতে দু-ভাইকে দু-পাশে দুটো চেয়ারের সঙ্গে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে রাখতেন দর্শকরা। একটা টেবিলের ওপর রাখা থাকত গিটার, ড্রাম, বিউগল, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি। দর্শকরা আত্মাকে আসার সহায়তা করতে আলো নিভিয়ে দিতেই ঘটে যেত অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার। টেবিলের বাজনাগুলো আপনা থেকেই একে-একে বেজে উঠত (মাদাম ব্লাভাৎস্কির আত্মা এনে ঘণ্টা বাজানোর মত ব্যাপার।) আলো জ্বালতেই দেখা যেত শক্ত করে বাঁধা দু-ভাই বসে রয়েছেন দু- দিকের দুই চেয়ারে। অতএব এই রটনার পেছনে যে ওঁদের কোনও চতুরতা নেই, সেই বিষয়ে কারওরই কোনও সন্দেহ থাকত না। কখনো কখনো অদৃশ্য আত্মারা নেমে এসে টেবিলে টোকা মেরে আওয়াজ করে বিভিন্ন প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তর দিতেন। এই সময়ও দু-ভাই টেবিল থেকে দূরে দুটো চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা থাকতেন।
কিছুদিনের মধ্যেই দু-ভাইয়ের প্ল্যানচেট আরও আকর্ষণীয় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হলো। নিউইয়র্কের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঘুরে বেড়াতেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিটি শহরে। প্রতি শহরেই ওঁরা হাজির হতেন খাঁটি প্ল্যানচেট মিডিয়াম হিসেবে। শহরে পৌঁছেই স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো মারফত শহরবাসীদের কাছে আবেদন রাখতেন—আপনারা শহরবাসীদের মধ্যে থেকে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে একটা কমিটি করুন, যে কমিটির সদস্যরা আমাদের কাছ থেকে লক্ষ্য রাখবেন, যাতে আমরা কোন কৌশলের সাহায্য গ্রহণ করতে না পারি।
প্রতিটি শহরেই তৈরি হয়েছে কমিটি এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিটি কমিটিই ড্যাভেনপোর্ট ভাইদের সত্যিকারের প্ল্যানচেট মিডিয়াম হিসেব স্বীকার করে নিয়েছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিজয় শেষ করে দু-ভাই গেলেন কানাডায়। কানাডার প্রতিটি বড় শহরকেই একইভাবে মজালেন, তারপর পাড়ি দিলেন ইংল্যান্ডে। ১৮৬৪- তে এলেন ইংলন্ডে। ২২ সেপ্টেম্বর বসল এক অভূতপূর্ব প্ল্যানচেটের আসর। প্রধান বক্তা হিসেবে হাজির হলেন প্রখ্যাত ধর্মযাজক ডাঃ জে.বি. ফার্গুসন। সেদিনের আসরে আত্মারা এসে অদ্ভুত সব কাণ্ড-কারখানা ঘটিয়ে গেল। ইংলন্ডের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হলো রোমাঞ্চকর ভৌতিক ঘটনার পূর্ণ বিবরণ এবং সেই সঙ্গে ধর্মযাজক . ডাঃ ফার্গুসনের মতামত—এঁরা দুজনে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন খাঁটি মিডিয়াম, পরলোকগত আত্মাদের নিয়ে আসার ক্ষমতা এঁদের ঈশ্বরদত্ত।
এমন একটা জব্বর খবরে ইংলন্ডে হৈ-চৈ পড়ে গেল। এ-শহর ও শহর ঘুরে ড্যাভেনপোর্ট ভাইয়েরা এলেন চেলটেনহ্যাম শহরে। সেখানেও দুই ভাই একই ঘোষণা রাখলেন, শহরবাসীদের মধ্য থেকে একটা কমিটি তৈরি করে তাঁদের মিডিয়াম ক্ষমতার পরীক্ষা নিতে অনুরোধ করলেন।
শহরবাসীরা যে কমিটি গড়লেন তাতে রাখলেন শহরের দুই শখের জাদুকর জন নিভিল ম্যাকেলিন (John Nevil Maskelyne) এবং জর্জ কুক’কে ( George Cooke)। দু’জনেই তখন বয়সে যুবক।
শহরের টাউন হলে প্ল্যানচেটের আসর বসল। হল ভর্তি। মঞ্চের পর্দা উঠতে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন ডাঃ ফার্গুসন। আবেগপ্রবণ গলায় ঘোষণা করলেন, তাঁর ঈশ্বর- দত্ত ক্ষমতার দ্বারা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন উইলিয়াম হেনরি ও আইরা ইরাস্টাস-এর রয়েছে অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, যার দ্বারা তারা দু’-ভাই মুহূর্তে নিয়ে আসতে পারেন পরলোকের আত্মাদের।
দু’ভাই মঞ্চে আসার আগে হলের প্রতিটি দরজা ও জানলার পর্দা টেনে দেওয়া হলো, যেন বাইরের আলো না আসে। আহ্বান করা হলো শহরবাসীদের পরীক্ষা- কমিটিকে। কয়েকজন পরীক্ষকের সঙ্গে মঞ্চে উঠলেন ম্যাকেলিন ও কুক।
মঞ্চে এলেন দু’ভাই। দুজনের পরনেই কালো পোশাক, মঞ্চে নিয়ে আসা হলো আলমারি বা ওয়ার্ডরোবের মতো একটা কাঠের ক্যাবিনেট। ক্যাবিনেটের ভেতরটায় আলমারির মতো কোনও তাক নেই। তবে দরজা রয়েছে। ক্যাবিনেটের ভেতরে পাতা হলো একটা লম্বা বেঞ্চ। বেঞ্চের দু’প্রান্তে দু’ভাইকে বসিয়ে পরীক্ষকরা তাদের শক্ত করে বেঁধে ফেললেন। বেঞ্চের মাঝখানে, দু’ভাইয়ের থেকে যথেষ্ট দূরে রাখা হলো শিঙা, ঘণ্টা, বেহালা, গিটার ইত্যাদি। ক্যাবিনেটের দরজা ভেজিয়ে দেওয়া হল। নিভিয়ে দেওয়া হলো স্টেজের আলো, সারা হল জুড়ে অন্ধকার নেমে আসতেই বেজে উঠল ঘণ্টা, শিঙা, বেহালা ও গিটার। তারপর আওয়াজ পাওয়া গেল ক্যাবিনেটের দরজা খোলার। বাদ্যযন্ত্রগুলো এক এক করে ছিটকে এসে পড়ল স্টেজের ওপরে।
আলো জ্বালতেই দেখা গেল দু-ভাই একইভাবে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় বেঞ্চের দু-কোণে বসে রয়েছেন। ওঁরা এমনভাবে বাঁধা যে, সামান্য নড়াচড়ারও উপায় নেই। হাতের নাগালের বাইরে রাখা বাদ্যযন্ত্রগুলো তবে বাজাল কে? কে- ই বা দরজা খুলে ওগুলোকে ছুড়ে ফেলল? হলের প্রতিটি দর্শক মুগ্ধ, বিস্মিত, শিহরিত। এমন অসাধারণ খাঁটি আত্মার খেলা অচিন্ত্যনীয়। দুই ভাই সত্যিই অনবদ্য ‘মিডিয়াম’। একটু ভুল বলেছি, বিস্মিত ও শিহরিত হয়েছিলেন দুজন দর্শক ছাড়া আর সব দর্শকই। এই দুজন হলেন শহরের শখের জাদুকর ম্যাকেলিন ও কুক। ম্যাকেলিন স্টেজে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, “গোটা ব্যাপারটাই বুজরুকি। দুই- ভাই এতক্ষণ আপনাদের যা দেখালেন, সেটা কিছু কৌশল ও অভ্যাসের ফল,এর সঙ্গে বিদেহী আত্মার কোনও সম্পর্ক নেই।”
ম্যাকেলিন-এর ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করলেন শ্রদ্ধেয় ধর্মযাজক ডাঃ ফার্গুসন ও দুই মিডিয়ামের ম্যানেজার। তাঁরা বললেন, “যদি কৌশলেরই ব্যাপার হয়ে থাকে, আপনি এমনি ঘটিয়ে দেখান না।”
ঠিক কথা। অনেক দর্শকই সমর্থন করলেন কথাগুলো।
ম্যাকেলিন একটুও ঘাবড়ে তো গেলেনই না, বরং দৃপ্তকণ্ঠে আবারও ঘোষণা করলেন, “দেখুন, এই খেলা দেখাতে গেলে কৌশল ছাড়া অনুশীলনেরও প্রয়োজন। আপনাদের কথা দিচ্ছি আজ থেকে তিন মাসের মধ্যে এদের সবগুলো ভৌতিক খেলাই ভূত ছাড়া করে দেখাব।”
ম্যাকেলিন যদিও তিন মাস সময় নিয়েছিলেন, কিন্তু দু’মাসের ভেতরেই চেলটেনহ্যাম শহরবাসীদের সামনে হাজির হলেন ভূতহীন ভুতুড়ে খেলা দেখাতে। গোটা শহর প্ল্যাকার্ডে ছেয়ে গেল—ড্যাভেনপোর্ট ভাইদের চেয়েও অদ্ভুত কাণ্ড অন্ধকারের বদলে আলোতে ঘটিয়ে দেখাবেন এই শহরের দুই জাদুকর ম্যাকেলিন ও কুক।
ড্যাভেনপোর্ট ভাইদের খেলাগুলো আরও সুন্দর করে পরিবেশন করলেন এই দুই তরুণ জাদুকর। এমনকি দর্শকদের মধ্যে থেকে একজনকেও ডেকে এনে ক্যাবিনেটের মধ্যে বসালেন। দর্শকটির চোখ বেঁধে দেওয়া হলো কাপড় দিয়ে আর হাত দুটি বেঁধে দেওয়া হলো দু’পাশে বসে থাকা ম্যাকেলিন ও কুকের উরুর সঙ্গে। জাদুকর দুজন অবশ্য আগের মতোই অষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা ছিলেন। ক্যাবিনেটের দরজা বন্ধ করতেই শুরু হয়ে গেল বাজনা বাজা। এক সময় ক্যাবিনেটের দরজা আপনা থেকেই গেল খুলে। দেখা গেল উৎসাহী দর্শকটি ও জাদুকর দুজন আগের মতোই বাঁধা রয়েছেন।
এই অদ্ভুত খেলা দেখিয়েই তাদের খেলা শেষ করলেন না দুই জাদুকর। আগের বাঁধনের ওপর আবার নতুন করে দড়ি বেঁধে গালা দিয়ে শীলমোহর করে দিলেন দর্শকরা। দুই জাদুকরের চার হাতের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো শুকনো ময়দা। এবার আপাত গ্রাহ্য কোনও কৌশল করার সুযোগ রইল না দু’জনের। কিন্তু কী আশ্চর্য। ক্যাবিনেটের দরজা বন্ধ হতেই ক্যাবিনেটে রাখা বাজনাগুলো বাজতে শুরু করল। বাজনা থামতেই দরজা খুলে দেখা গেল, দুই জাদুকর আগের মতোই বসে আছেন। বাঁধনের শীলমোহর অটুট। চার হাতের চাপানো ময়দার একটুও তলায় পড়ে নেই।
ঐ অবস্থাতেই জাদুকরদের কথামতো ক্যাবিনেটের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। একটু পরেই জাদুকর দু’জন বন্ধনমুক্ত অবস্থায় ক্যাবিনেটের বাইরে বেরিয়ে এলেন। চার হাতের ময়দা ঠিক তেমনই হাতেই রয়েছে।
সম্পূর্ণ হতভম্ব দর্শকদের সামনে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল। এবার স্টেজে আনা হলো একটা কাঠের বাক্স। স্টেজে এসে দর্শকরা বাক্সটাকে ভালোমতো পরীক্ষা করলেন। বাক্সটার ভেতর ঢুকে কোনোমতে হাত-পা গুটিয়ে বসলেন ম্যাকেলিন। ডালা বন্ধ করে তালা এঁটে দেওয়া হলো। তালাবন্ধ বাক্সটি দড়ি দিয়ে বেঁধে শীলমোহর করে দেওয়া হলো। শীলমোহর করা বাক্সটি ঢুকিয়ে দেওয়া হল ক্যাবিনেটের মধ্যে। ক্যাবিনেটের দরজা বন্ধ করতেই বেজে উঠলো ভেতরে রাখা ঘণ্টা। এক সময় ক্যাবিনেটের দরজা খুলে গেল। দেখা গেল, ম্যাকেলিন বসে রয়েছের বাক্সের বাইরে। ম্যাসকেলিনের অনুরোধে দর্শকরা এসে বাক্সটা পরীক্ষা করলেন। ডালার তালা তেমনই বন্ধ রয়েছে, অটুট রয়েছে বাঁধন আর শীলমোহর।
রাতের আঁধারে যে খেলা দেখিয়েছিলেন ড্যাভেনপোর্ট ভাইয়েরা, তার চেয়েও অনেক বেশি গা-ছম-ছম, লোম খাড়া করা অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটিয়ে একদিনে শহরবাসীদের বিস্ময়ে পাগল করে ফেললেন, দুই শৌখিন জাদুকর।
পরবর্তীকালে এই দুই জাদুকর বিভিন্ন শহরে ঘুরে তাঁদের অদ্ভুত জাদুর খেলাগুলো দেখিয়েছেন। তবে প্রতিটি প্রদর্শনীর আগেই দর্শদের সামনে বিনীতভাবে নিবেদন করেছেন—বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মার মিডিয়াম সেজে ঠকবাজেরা যে- সব বুজরুকির আশ্রয় নিচ্ছেন ও লোক ঠকাবার খেলা দেখাচ্ছেন, সেগুলোই এখন আপনাদের সামনে কোনও ভূতের সাহায্য ছাড়াই করে দেখাচ্ছি।
অলৌকিক বিশ্বাসে কোনও কিছু দেখার যে রোমাঞ্চ ড্যাভেনপোর্ট ভাইদের ‘অলৌকিক’ প্রদর্শনীতে ছিল, ম্যাকেলিন ও কুকদের খেলায় তা ছিল না। এই দুজন তো বলেই দিচ্ছেন, তাঁরা মিডিয়াম নন, লৌকিক কৌশলের সাহায্যে খেলাগুলো খোচ্ছেন। কৌশলগুলো ধরতে না পারলেও পুরো ব্যাপারটাই ধাপ্পা, অতএব অলৌকিক মিডিয়ামদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দুই জাদুকরের বছর দুয়েকের মধ্যে পিছু হঠতে হলো। মিডিয়ামদের অলৌকিক কাণ্ড-কারখানা দেখতে ভিড় বাড়তে লাগলেও দুই জাদুকরের ভূতহীন ভুতুড়ে খেলায় দর্শক কমতে লাগল।
বুজরুকির বিরুদ্ধে এই সংগ্রাম তাদের প্রচন্ড বিপদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন এই দুই জাদুকর ও ম্যাকেলিনের নবপরিণীতা বধু।
লন্ডনের বিখ্যাত ‘কৃস্টাল প্যালেস’ থিয়েটারে কয়েক সপ্তাহব্যাপী জাদুর খেলা দেখাবার চুক্তিতে সই করলেন ম্যাসকেলিন। কৃস্টাল প্যালেসে প্রদর্শনীর আগে একটা মফঃস্বল শহরে জাদু প্রদর্শনী চলছিল। সেই শহরের গির্জার পাদ্রী ওঁদের জাদুর খেলা দেখে ঘোষণা করলেন—ওরা শয়তান। মানুষ কখনও এমন অলৌকিক খেলা দেখাতে পারে না।
খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। দু’দিন পরেই জাদু প্রদর্শনী শুরু হবার মুখে আক্রান্ত হলো থিয়েটার হল। বিশাল ক্ষিপ্ত জনতাকে সঙ্গে নিয়ে ওই পাদ্রী সাহেবও হাজির হয়েছিলেন দুই শয়তান নিধন করতে। সেদিন থিয়েটার হলের ম্যানেজার দুই জাদুকর ও নববধূকে ছদ্মবেশে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন বলেই বিশ্ব পেয়েছিল দুই মহান জাদুকরকে, বিশেষত ম্যাকেলিনকে, পৃথিবীর জাদুচর্চার ইতিহাসে যার অসামান্য অবদান আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়।
থিওজফিস্টদের ওপর আঘাত হেনেছিল যে বই
ভৌতিক-চক্রের থিওজফিস্ট ও পেশাদার মিডিয়ামরা সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছিল ১৮৯১ সালে মিডিয়ামদের তাবৎ কৌশলের ওপর একটি বই প্রকাশিত হওয়ায়। বিশ্বের ভৌতিক চক্রের মিডিয়ামদের ইতিহাসে এতবড় আঘাত করা সম্ভবত হয়নি। লেখক হিসেবে কোনও নামের পরিবর্তে ছদ্মনাম ব্যবহৃত হয়েছিল—’জনৈক মিডিয়াম প্রণীত’। বইটির নাম – Revelations of a Spitit Medium, or Spiritualistic Mysteries Exposed-A Detailed Explanation of the Methods used by Fraudulent Mediums-by a Medium ।
বইটির নাম বাংলায় অনুবাদ করলে এই রকম দাঁড়াবে—”এক ভৌতিক মিডিয়ামের গোপন রহস্য উদ্ঘাটন, অথবা ভৌতিক রহস্য ফাঁস – প্রতারক মিডিয়ামদের ব্যবহৃত কৌশলগুলোর বিস্তৃত ব্যাখা।—জনৈক মিডিয়ামের লেখা।”
বইটিতে ভৌতিক মিডিয়ামদের সমস্ত রকম আত্মা আনার কৌশল নিয়েই আলোচনা করা হয়েছিল এবং অবশ্যই তার সঙ্গে ছিল প্রতিটি কৌশলেরই ব্যাখ্যা। বিদেহী আত্মা নামিয়ে বোর্ডে, শ্লেটে বা কাগজে লেখানো, বিভিন্ন প্রশ্নের লিখিত উত্তর পাওয়া, টেবিলের ওপর টোকা মেরে আওয়াজ করে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, টেবিল, চেয়ার বা অন্য কোনও কিছুকে শূন্যে তুলে দেওয়া, দূর থেকে ভেসে আসা আত্মার কণ্ঠস্বর ইত্যাদি মিডিয়ামদের ভৌতিক (?) কাণ্ড-কারখানা গুপ্ত কৌশলের সঙ্গে বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল কী করে যে কোনও রকম বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নানারকম বাজনা বাজিয়ে আবার বাঁধনের ভিতর ফিরে যেতে হয়।
বইটি প্রকাশিত হতেই পেশাদার লোক-ঠকানো মিডিয়ামদের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। তারা উদ্ধারের উপায় হিসেবে বিভিন্ন বইয়ের দোকান থেকে ও প্রকাশকের কাছ থেকে যতগুলো বই পেল সব কিনে পুড়িয়ে ফেলল। তবে, এই বই যেমন একদিকে পেশাদার মিডিয়ামদের আঘাত হেনেছিল, তেমনি, অন্যদিকে বইটি পড়ে কিছু কিছু লোক নিজেরাই মিডিয়াম বনে লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমে গিয়েছিল।
মিডিয়ামদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মনীষা হ্যারি হুডিনি এককালে সফল মিডিয়াম ছিলেন।
ধোঁকাবাজ মিডিয়ামদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী এক চরিত্র বিশ্বের সর্বকালের এক সেরা জাদুকর হ্যারি হুডিনিও (Harry Houdini) কিন্তু একসময় ওই বইটি পড়ে বন্ধনমুক্তি এবং আত্মা আনার নানারকম কৌশল রপ্ত করে তাঁর স্ত্রী বিয়াট্রিস-এর সহযোগিতায় দারুণ মিডিয়ামের ব্যবসা ফেঁদেছিলেন। পরবর্তী জীবনে হুডিনি অবশ্য মৃতের আত্মীয়দের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের সঙ্গে মৃত আত্মার যোগাযোগ ঘটিয়ে দেবার নাম করে অর্থ লুটবার এই চেষ্টাকে অতি ঘৃণ্য বলে মনে করেন এবং অতি লাভজনক এই খেলা তিনি যে শুধু দেখানোই বন্ধ রেখেছিলেন তাই নয়, মিডিয়ামদের বুজরুকির বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ ঘোষণাই করেছিলেন, এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি জয়যুক্ত হয়েছিলেন।
আঠারো বছর বয়সে হুডিনির বাবা মারা গেলেন। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁরই ঘাড়ে। হুডিনি তখন সদ্য মিডিয়াম রহস্যের বইটি পড়েছেন। ছোট ভাই থিয়োডোরকে নিয়ে জাদু দেখিয়ে রোজগারে নেমে পড়লেন। জাদু কোম্পানির নাম দিলেন ‘হুডিনি ব্রাদার্স’। জাদুর খেলা হিসেবে হাজির করতে লাগলেন বন্ধনমুক্তির খেলা। ছোট ভাইয়ের হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে বাক্সটা তালা বন্ধ করে দেওয়া হতো। হ্যারি হুডিনি বাক্সটির সামনে একটা পর্দা টেনে দিয়ে মুখটুকু শুধু পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে রেখে গুনতেন “এক…দুই…তিন…” মুহূর্তের জন্যে মুখটাকে নিয়ে যেতেন পর্দার আড়ালে, পরমুহূর্তে পর্দার ফাঁক দিয়ে যে মাথাটা বেরিয়ে আসত সেটা থিয়োডোরের মাথা। থিয়োডোর ঝটতি পর্দা সরিয়ে ফেলতেন। কিন্তু হ্যারি হুডিনি তো কোথাও নেই! দর্শকরা এসে বাক্সের তালা খুলতেই দেখতে পেতেন বাক্সের ভেতর দড়ি বাঁধা জোড়া হাতদুটি নিয়ে শুয়ে রয়েছেন হ্যারি।
উনিশ বছর বয়সে হ্যারি বিয়ে করলেন বিয়াট্রিস রাহানার’কে। বিয়াট্রিসদের স্কুলে ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে দু’জনের আলাপ। সেই আলাপই গাঢ়তর হয়ে বিয়েতে পরিণত হলো। বিয়াট্রিস রাহানার হলেন, ‘বেসি হুডিনি’।
এবার নতুন জুটি তৈরি হলো—হ্যারি ও বেসি। পেট চালাবার তাগিদে হ্যারি ও বেসি পানশালাগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জাদুর খেলা দেখিয়ে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করতেন। পরে হুডিনি দম্পতি সার্কাসে যোগ দিলেন। সার্কাসে খেলা দেখাতে বেশিদিন ভালো লাগল না। এই সময় মাথায় এলো নতুন ফন্দি, বিদেহী আত্মার ভর হওয়া মিডিয়াম হলে কেমন হয়? হ্যারি ও বেসি দু’জনেরই স্মরণশক্তি ও বুদ্ধি ছিল প্রখর, অভিনয় দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ছোট ছোট শহর ও শহরতলিতে এবার হুডিনি দম্পতি হাজির হলেন ‘সাইকিক’ বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার অধিকারী এবং আত্মার মিডিয়াম হিসেবে।
হ্যারি আগে থেকেই সেই সেই শহরের সমাধিক্ষেত্র ঘুরে সমাধিস্তম্ভের লেখাগুলো পড়ে শহরের মৃত লোকদের সম্বন্ধে খবর যোগাড় করতেন, সেই সঙ্গে ক্যানভাসার সেজে পানশালা, বিভিন্ন আড্ডা ও বাড়ি বাড়ি ঘুরে সংগ্রহ করতেন আরও নানা রকমের খবর। অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় লোকদেরও নিয়োগ করতেন। এরা বিভিন্ন পরিবারের নানা খবর যোগাড় করে দিত, সেই সঙ্গে প্রচার করে বেড়াত, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সে হুডিনি দম্পতির কী অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় পেয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করা এবং আবার বাঁধনের মধ্যে ফিরে যাওয়ার নানা পদ্ধতির প্রয়োগে হ্যারি ও. বেসি আগেই ছিলেন সিদ্ধহস্ত। অতএব আত্মার ভর হওয়া মিডিয়াম হিসেবে বেসি যখন শহরে আগন্তুক হয়েও বিভিন্ন পরিবারের অনেক গোপন খবর বলে যেতেন, অথবা বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে নানা রকম তথ্য হাজির করতেন তখন প্রত্যেকেই এ-গুলোকে বিদেহী আত্মার কাজ বলেই বিশ্বাস করতেন। এরই সঙ্গে হ্যারি যখন চেয়ারের সঙ্গে হাত-পা বাঁধা অবস্থাতেই নানা রকম ভৌতিক কাণ্ড ঘটিয়ে দেখাতেন, তখন বিস্মিত, শিহরিত ও ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো তাঁদের লোকান্তরিত প্রিয়জনদের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য এঁদের কৃপাপ্রার্থী হতেন। অর্থের বিনিময়ে কৃপা করতেন হুডিনি দম্পতি। পরবর্তীকালে হুডিনি দম্পতি এই লোক-ঠকানো মিডিয়ামের অভিনয় ছেড়ে দিয়ে পেশাদার মিডিয়ামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন, তা তো আগেই বলেছি।
বন্ধনমুক্তির খেলায় নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে হ্যারি হুডিনি এমন সব অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটিয়েছেন যে, ঘটনাগুলোর পেছনে লৌকিক কৌশল আছে জানা সত্ত্বেও দর্শকদের বিস্ময়ের সীমা থাকত না।
দুটি ঘটনার উল্লেখ করে হ্যারি হুডিনির বন্ধনমুক্তির কৌশলগত ক্ষমতার পরিচয় রাখছি। সেই সঙ্গে এও বলে রাখি, হ্যারি কিন্তু তাঁর জীবনে এই ধরনের বন্ধনমুক্তির খেলা দেখিয়েছেন বহুবার, বহু বিচিত্র পরিস্থিতির মধ্যে।
১৮৯৮ সালে শিকাগো শহরে পুলিশ বিভাগকে চ্যালেঞ্জ জানালেন হ্যারি হুডিনি-”আমাকে বন্ধ রাখার মতো কয়েদখানা শিকাগো শহরে তৈরি হয়নি।”
খবরটা পত্র-পত্রিকায় প্রচারিত হতেই শিকাগো পুলিশ গ্রহণ করল সেই চ্যালেঞ্জ। একগাদা সাংবাদিকের সামনে হ্যারি হুডিনির শরীর, পোশাক তন্ন তন্ন করে খানা-তল্লাশি করে হাত-পা বেঁধে পুরে দেওয়া হলো জেলের সেরা সেলটিতে।
১৯০০ সালের কথা। সে সময় লন্ডনের ‘আলহামরা’ থিয়েটার হল যে কোনও শিল্পীর কাছেই মক্কা-মদিনা-কাশী-জেরুজালেম। আলহামরা থিয়েটার হলের কর্মকর্তা ডান্ডাস স্লেটার-এর সঙ্গে দেখা করলেন হ্যারি, দু-সপ্তাহের জন্য ওই হলে জাদু দেখাবার সুযোগ চাইলেন। স্লেটার বললেন, “তোমার ওই বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসার খেলাগুলোর যা বর্ণনা দিলে, তার ওপর আমার তেমন আস্থা নেই। তুমি যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতকড়া থেকে নিজের হাত দুটো মুক্ত করতে পার, আমি নিশ্চয় তোমাকে দু-সপ্তাহের জন্য হল ছেড়ে দেব।”
স্লেটারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন হ্যারি। দুজনে গেলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সুপারিনটেন্ডেন্ট মেলভিন-এর কাছে। স্লেটারের মতো নামী-দামী লোককে আসতে দেখে এবং আসার কারণ শুনে মেলভিন হ্যারি হুডিনিকে বললেন, “আমার হাতকড়ার মুখোমুখি হয়ে তুমি বড়ই ভুল করেছ, এ তোমার জাদু দেখাবার হাতকড়া নয়, তাছাড়া চাবিটা থাকবে আমার কাছে।”
হ্যারি হাসলেন। বললেন, “দেখাই যাক না, এতেও জাদু দেখাতে পারি কি না!”
মেলভিন এবার হ্যারির দুটো হাত একটা থামের দুপাশ দিয়ে নিয়ে এসে হাতকড়া আটকে দিয়ে স্লেটারকে বললেন, “ও এখানে থাক, চলুন আমরা বরং একটু ঘুরে আসি। ফিরে এসে ওকে মুক্ত করা যাবে।”
মেলভিন ও স্লেটার কয়েক পা এগোতেই দেখলেন, তাঁদের পাশে এসে হাজির হয়েছেন হ্যারি হুডিনি।
এর পরে কী হয়েছিল নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? ফল হয়েছিল এই, হ্যারি একদিকে যেমন ‘আলহামরা’ হলে দু-সপ্তাহের জন্য যাদু দেখাবার সুযোগ পেলেন আর একদিকে তেমনি পেলেন অসামান্য প্রচার-স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতকড়াও হার মেনেছে মার্কিন মুল্লুকের তরুণ জাদুকর হ্যারি হুডিনির কাছে। ঘটনাটা আরও একটু গড়িয়েছিল। দু সপ্তাহের বদলে জনতার দাবিতে একনাগাড়ে ছ’মাস আলহামরাতেই খেলা দেখিয়ে যেতে বাধ্য হলেন হ্যারি হুডিনি দম্পতি।
ওই অবস্থাতেই জেলের সেল ভেদ করে বেরিয়ে এলেন হুডিনি।
পেশাদার মিডিয়ামদের লোক ঠকানোর মূল কৌশল হলো অন্ধকার বা চোখের আড়ালের সুযোগ নিয়ে দর্শকদের বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত কিছু ভৌতিক ঘটনা ঘটানো ও আবার আগের বাঁধনের মধ্যে ফিরে আসা।
থিওজফিস্টদের প্রতি লেখা বিজ্ঞানী হাক্সলের মজার চিঠি
পাশ্চাত্যের থিওজাফিস্টরা শুধু যে আত্মা নামানো এবং ভূতপ্রেতদের নানা উদ্ভট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ব্যস্ত থাকতেন তাই নয়, তাঁরা নিজেদের কাজকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী, পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের আমন্ত্রণ জানাতেন প্রেতচক্রের আসরে যোগদান করার জন্য। একবার ডারউইনের বন্ধু ও তাঁর তত্ত্বের বিশিষ্ট সমর্থক প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী টি. এইচ. হাক্সলে’র কাছে প্রেতচক্রের আসরে উপস্থিতি হওয়ার আমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছলে তিনি থিওজফিস্ট ভুতুড়ে গবেষকদের প্রতি প্রত্যুত্তরে লেখেন, “এই ভূতপ্রেতের গবেষণার একটিমাত্র ভাল দিক আমি দেখতে পাই, তা হল এতে করে আত্মহত্যার বিপক্ষে আরো একটি জোরালো যুক্তি পাওয়া যায়। আত্মহত্যার দরুন ভূত হওয়ার পরে প্রেতচক্র-প্রতি এক গিনি হারে ভাড়া করা মিডিয়ামের মুখ দিয়ে ভ্যাজর ভ্যাজর করার চেয়ে রাস্তার ঝাড়ুদারগিরি করে কষ্টেসৃষ্টে কোনওমতে বেঁচে থাকাও অনেক ভাল”।
(এঙ্গেলস তাঁর ‘ডায়লেকটিকস অফ নেচার’ গ্রন্থের ‘ন্যাচারাল সায়েন্স ইন দ্যা স্পিরিট ওয়ার্ল্ড’ প্রবন্ধে এটি উদ্ধৃত করেন।)
পাশ্চাত্যে থিওজফিস্টদের বুজরুকি ফাঁসে জাদুকরেরা এগিয়ে এসেছিলেন এবং বুজরুকদের চূড়ান্ত নাস্তানাবুদ করেছিলেন। ভারতবর্ষে সে সময়কার জাদুকরদের অনেকেই মাদাম ব্লাভাৎস্কি ও বেশান্তের মতই অনেক অদ্ভুতুড়ে সব কাণ্ড-কারখানা যদিও মঞ্চে এবং সার্কাসের এরিনায় দেখাতেন, (সে সময় সার্কাসেও খেলার মাঝে মাঝে ম্যাজিক দেখাবার চল ছিল) কিন্তু তাঁরা কখনই মাদাম বা বেশান্তের বুজরুকির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেননি। থিওজফিস্ট মুখোশ ছিঁড়ে সর্বসমক্ষে প্রতারকের মুখটা বে-আব্রু করে দেননি। তার একটা কারণ হতে পারে লড়াকু মানসিকতার অভাব। হতে পারে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে না যাওয়ার প্রবণতা। হতে পারে, এই সুযোগে কেউ কেউ জাদুকরদের বিজ্ঞানের কৌশলকে ভুতুড়ে ব্যাপার বা অলৌকিক ব্যাপার ভাবলে বাড়তি কিছু নাম বা কামিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া। যাই হোক, এটা ঐতিহাসিক সত্য সেদিন প্রাচ্যের জাদুকররা থিওজফিস্টদের বুজরুকির বিরুদ্ধে আঘাত হানতে পারতেন, কিন্তু আঘাত হানেননি।
অধ্যাত্মবাদী ঋষি অরবিন্দ
উচ্চশ্রেণীর হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের এক বৃহৎ অংশের কাছে ‘অধ্যাত্মবাদের শেষ কথা ঋষি অরবিন্দ’। ঋষি অরবিন্দের লেখা ‘লাইফ ডিভাইন’ আজও বহু বুদ্ধিজীবী ও ভাববাদী দার্শনিকদের কাছে এক বিরাট ধোঁয়াশা, এক বিরাট রহস্য। আর শ্রীঅরবিন্দের যোগ যে ‘রাজযোগ’, ‘বৈদান্তিক জ্ঞানযোগ’ ও ‘তান্ত্রিক যোগ’-এর চেয়ে অনেক উচ্চমানের, সেকথা শ্রীঅরবিন্দ নিজেই লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘SRI AUROBINDO ON HIMSELF’ গ্রন্থে। গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ ‘নিজের কথা’র (প্রকাশক : শ্রীঅরবিন্দ আশ্রম, পন্ডিচেরি) ১৯৯০ সালের সংস্করণের ১১২-১১৩ পৃষ্ঠায় চোখ বোলালেই সে লেখা দেখতে পাবেন। ‘নিজের কথা’র ১১৮ পৃষ্ঠায় শ্রীঅরবিন্দ তাঁর অতিমানস অবস্থার সঙ্গে অন্যান্য কিছু আধ্যাত্মিক নেতাদের তুলনা দিতে গিয়ে বলেছেন : “দিব্য চেতনার যেমন বিভিন্ন পর্যায় আছে। রূপান্তরের ও তেমনি বিভিন্ন পর্যায় আছে। প্রথম হলো চৈত্য রূপান্তর, যাতে ব্যক্তিগত চৈত্যচেতনার মাধ্যমে সমগ্র সত্তা ভগবৎ সংস্পর্শ লাভ করে। তারপর আধ্যাত্মিক রূপান্তর, যাতে বিশ্বচেতনার মধ্যে সত্তা ভগবানে মিলিত হয়ে যায়। তৃতীয় হলো অতিমানস রূপান্তর, যাতে সব কিছুই দিব্য বিজ্ঞানময় চেতনাতে অতিমানসগত হয়ে যায়। এতেই হবে মন প্রাণ দেহের পূর্ণ রূপান্তর শুরু—আমার মতে তাই পূর্ণ রূপান্তর।…..কৃষ্ণের মন ছিল অধিমানসগত, রামকৃষ্ণের ছিল বোধিগত, চৈতন্যের ছিল চৈত্য-আত্মগত, বুদ্ধের ছিল উচ্চ মানসিক দীপ্তিগত। বিজয় গোস্বামীর সম্বন্ধে আমি জানি না —সম্ভবত সমুজ্জ্বল কিন্তু অনির্দিষ্ট। সবগুলিই অতিমানস থেকে স্বতন্ত্র।”
(আমি তো আগাপাশতলা বুঝিনি, আপনারা যাতে নিজেরা চেষ্টা করতে পারেন, তাই হুবহু তুলে দিলাম।)
শ্রীঅরবিন্দের এই অতিমানস যোগের ফল কী? বহু উদাহরণ এ নিয়ে হাজির করা যায় গ্রন্থটি থেকে। আমরা এখানে শুধু একটি উদাহরণ টানছি। আমরা এবার শ্রীঅরবিন্দের আত্মজীবনী ‘নিজের কথা’র ৩৭-৩৮ পৃষ্ঠা থেকে সামান্য অংশ তুলে দিয়ে কৌতূহল মেটাব। তার আগে উদ্ধৃতিটি বোঝার সুবিধের জন্য একটা কথা জানিয়ে দেওয়া জরুরি। গ্রন্থটির প্রস্তাবনার শেষ পংক্তিতে লেখা আছে—শ্রীঅরবিন্দ নিজের সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে সরাসরি “আমি” না বলে তৃতীয় ব্যক্তিরূপে বা উত্তমপুরুষে (Third person) “তিনি” বা নিজের নাম “শ্রীঅরবিন্দ” দিয়ে লিখেছেন। সে ভাবেই বইটি মুদ্রিত হয়েছে, যদিও কথাগুলো শ্রীঅরবিন্দের নিজেরই লেখা।
শ্রীঅরবিন্দ লিখেছেন, “যখন সকলেই মনে করছে যে এবার ইংলন্ডের পতন আসন্ন ও হিটলারের জয় অবশ্যম্ভাবী, তখন হঠাৎ দেখা গেল যে জার্মান বিজয়লাভের গতি থেমে গেছে, যুদ্ধের ফললাভ বিপরীত দিকে মোড় নিয়েছে। একাজটি তিনি করেছিলেন কারণ তিনি দেখলেন যে হিটলারের পশ্চাতে রয়েছে মারাত্মক সব আসুরিক শক্তি, সুতরাং তাদের জয় হওয়া মানেই জগতের মানুষকে অশুভ শক্তির অত্যাচারের দাস হয়ে থাকতে বাধ্য করা,”……. “শ্রীঅরবিন্দ আতায়ীদের বিরুদ্ধে আপন অধ্যাত্ম শক্তি প্রয়োগ করতে থাকলেন, তাতে দেখলেন যে এতদিন পর্যন্ত জাপানীরা যে দ্রুত জয়ের পর জয়লাভ করেছিল তা থেমে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে সব কিছু উল্টে গিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের চরম ও মারাত্মক পরাজয় ঘটল।”
অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধে হিটলারের অবশ্যম্ভাবী জয়কে পরাজয়ে রূপান্তরিত করেছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। জাপানের জয়যাত্রাকে থামিয়ে চরম পরাজয় ঘটিয়ে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দ। এ’সবই ছিল অরবিন্দের অতিমানস শক্তি, অধ্যাত্মশক্তির করিশ্মা। মূর্খ যুদ্ধবিশারদ ও ঐতিহাসিকরা চরম অজ্ঞতার জন্যই জার্মান ও জাপানের পরাজয়ের জন্য নানা লৌকিক কারণ হাজির করে থাকেন।
বড় বিস্ময় জাগে, যখন দেখি বিশ্বত্রাস সেনাশক্তিকে যিনি অধ্যাত্মশক্তির সাহায্যে মারাত্মকভাবে পরাজিত করতে পারেন ও করেন, তিনি জার্মান, জাপানের তুলনায় হীনবল ব্রিটিশ শক্তিকে পরাজিত করে কেন ভারতের স্বাধীনতা এনে দিলেন না?! অথচ বাস্তবিকই তাঁর দাবি মত আধ্যাত্মিক শক্তি থাকলে ভারতকে পরাধীনতা মুক্ত করতে সেই শক্তিকে প্রয়োগ করাই ছিল তাঁর মত এক ‘স্বাধীনতা যোদ্ধা’ ‘দেশভক্তের পক্ষে স্বাভাবিক! কেন তিনি এমন অসার দাবি করলেন? তবে কি তাঁর মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছিল, জেলে থাকাকালীন অলীক-দর্শনের মধ্য দিয়ে যার সূচনা? না কি সমস্ত দাবিই ছিল নেহাতই সাদা-সাপ্টা মিথ্যাচারিতা?
‘অতুলনীয়’ ও ‘অনন্য’ এই আধ্যাত্মিক নেতা গ্রন্থটির ৮৮ পৃষ্ঠায় ঘোষণা করেছেন, “আমি আর মাথা বা মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করি না—মাথার উপরদিকে যে উদার বিশালতা রয়েছে সেখান থেকেই চিন্তাগুলো আসে।”
এমন বক্তব্য পড়ে আক্ষরিক অর্থেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক মনোরোগ চিকিৎসক মন্তব্য করেছিলেন, “এযুগে এমন কথা কোনও শিক্ষিত মানুষ বললে যে কোনও চিকিৎসকই তার মানসিক সুস্থতা বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেন।”
ঐ গ্রন্থের ২৭৪ পৃষ্ঠায় একটি প্রশ্ন আমরা দেখি, “বেশি পড়াশোনা করলেই মাথা টনটন করে….পড়তে পড়তে কিন্তু তা মনে রাখতে চেষ্টা করলে মনে হয় যেন বুকের মধ্যে কাজ হচ্ছে, মাথার মধ্যে নয়, তবু মাথাতেই কষ্ট হয় কেন?”
উত্তরে শ্রীঅরবিন্দ জানাচ্ছেন, মন দু’রকম! একটা ‘প্ৰাণগত মন’, ‘যে মন আছে বুকের মধ্যে। কিন্তু পড়া ও স্মরণ রাখা দৈহিক মনের কাজ। তবে মস্তিষ্কই এসব কাজের পরিচালনা করে, সুতরাং কিছু কষ্ট হলে সেখানেই তা হবে। মস্তিষ্কের পক্ষে সবচেয়ে আরামের কাজ হবে, চিন্তা এলে যদি দেহ ছেড়ে মাথার উপর থেকে তা করা যায় (আকাশ থেকে বা দেহের বাইরে অন্য স্তর থেকে)। অন্তত পক্ষে আমি তাই করতাম, তাতে বেশ আরাম পেতাম।”
ব্রাকেটের মধ্যে “আকাশ থেকে……” বলে যে বাক্যটি লেখা আছে, তা আমার কোনও টীকা-টিপ্পনী নয়, শ্রীঅরবিন্দ লিখিত। যাই হোক আমরা শ্রীঅরবিন্দের কাছ থেকে জানতে পারলাম এক : মন দু’রকম? দুই : একটি মন থাকে বুকে। তাই পড়তে থাকলে মনে হয় বুকের মধ্যে কাজ হচ্ছে!! তিন : মাথাব্যথা হবে না যদি মস্তিষ্ক থেকে চিন্তা না করে আকাশ থেকে করা যায়!!! বাঃ, বা-হঃ, বা-হাঃ!!!!
সত্যিই, অধ্যাত্মবাদ এমন চমকপ্রদ বিস্ময়করবাদ বলেই বোধহয় অনেকে বলে থাকেন, “যেখানে বিজ্ঞানের শেষ, সেখানেই অধ্যাত্মবাদের শুরু”। বাস্তবিকই কথাটা বড় খাঁটি। যেখানে বিজ্ঞানের শেষ, অর্থাৎ বিজ্ঞান অনুপস্থিত, অজ্ঞানতার অন্ধকারের শুরু, সেখান থেকেই আরম্ভ হয় অধ্যাত্মবাদের জয়যাত্রা।
শ্রীঅরবিন্দ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না, বরং আকর্ষণীয় হতে পারে বিবেচনায় এখানে তুলে দিচ্ছি।
১৯৩৮ সালে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও যুক্তিবাদী শ্রীমেঘনাদ সাহা (‘ডক্টর’ কথাটা মেঘনাদ সাহার নামের আগে ব্যবহারে বা না ব্যবহারে শ্রীসাহার অনন্যতার সামান্যতম হের-ফের হবে না বিবেচনায় এবং বহু ‘ডক্টর’দের ভিড় থেকে আলাদা করতে তাঁকে ‘ডক্টর’হীন রাখলাম) শান্তিনিকেতনে একটি বক্তৃতা দেন। শিরোনাম ছিল, “একটি নূতন জীবনদর্শন”। সেখানে তিনি সুন্দর সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে অধ্যাত্মবাদের অপ্রয়োজনীয়তা, নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। বক্তৃতাটি ঐ বছরই বিশ্বভারতী নিউজে প্রকাশিত হয়। তারপর বক্তৃতাটি বেশ কয়েকটি বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এরই সূত্র ধরে সেই সময়কার বিখ্যাত পত্রিকা ‘ভারতবর্ষ’-এর বৈশাখ ১৩৪৬ সংখ্যায় পন্ডিচেরির শ্রীঅনিলবরণ রায় শ্রীমেঘনাদ সাহার বস্তুতান্ত্রিক যুক্তিবাদী ও অধ্যাত্মবাদ বিরোধী মনোভাবকে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে এক দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন। সেখানে স্বভাবতই গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে পন্ডিচেরি আশ্রমের প্রাণপুরুষ শ্রীঅরবিন্দের ‘মহামূল্যবান’ গ্রন্থ ও মতের কথা, আধ্যাত্মিক চর্চার সঙ্গে বিজ্ঞান চর্চার প্রাসঙ্গিকতার কথা। ততোধিক দীর্ঘ এক উত্তর দেন শ্রীমেঘনাদ সাহা। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যা ভারতবর্ষে শ্রীসাহার ঐ ‘প্রতিবাদ-প্রবন্ধ’ প্রকাশিত হতে বিতর্ক আরও প্রসারিত হয়। চৈত্র সংখ্যায় শ্রীমোহিনীমোহন দত্ত, বি.এ. শ্রীসাহার বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে এবং শ্রীঅনিলবরণ রায়কে সমর্থন জানিয়ে এক দীর্ঘ সমালোচনা লেখেন। সেখানেও অনিবার্যভাবেই এসে পড়েছে শ্রীঅরবিন্দ ও তাঁর দর্শন প্রসঙ্গ। বহু বছর পর ‘মেঘনাদ রচনা সংকলন’-এর সম্পদক শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়কে অনিলবরণ রায় একটি চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন, “মোহিনীমোহনের নাম দিয়ে আমি ঐ উত্তরটি লিখিয়াছিলাম,যাহাতে বাদানুবাদ করিয়া ডঃ সাহার সহিত personal bitterness না হয়”। ওই চৈত্র সংখ্যার ভারতবর্ষতেই শ্রীমেঘনাদ সাহার ‘উত্তর-নিবন্ধ’ প্রকাশিত হয়েছিল। উত্তর নিবন্ধ থেকে একটিমাত্র অনুচ্ছেদ এখানে তুলে দিচ্ছি।
“সমালোচক দুই-একজন পরলোকে বিশ্বাসবান্ বৈজ্ঞানিকের নাম করিয়াছেন, যেমন Sir William Crookes ও Sir Oliver Lodge। ক্রুস্ এককালে Psychical Society-র সদস্য ও সভাপতি ছিলেন। তিনি বহু Psychical experience সম্বন্ধে নানাবিধ গবেষণা করিতেন এবং বলা বাহুল্য, এই সব গবেষণামূলক বৃত্তান্ত সম্পূর্ণ লিখিয়া রাখিতেন। তিনি একজন কৃতী বৈজ্ঞানিক এবং বিশ্ববিখ্যাত Royal Society-র সভাপতি পর্যন্ত হইয়াছিলেন। সুতরাং ইহা আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, অধ্যাত্মবাদিগণ দাবী করিবেন যে তাঁহারা খুব একটি “বড় কালা” কে বঁড়শীতে গাঁথিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। কিন্তু Crookes-কে যে সমস্ত অধ্যাত্মবাদী নিজেদের দলভুক্ত বলিয়া প্রচার করেন, তাঁহারা খুব সততার পরিচয় দেন না,কারণ তাঁহারা Crookes-এর অধ্যাত্মবিদ্যা চর্চার ইতিহাস পরবর্তীকালে জানাইতে ভুলিয়া যান। Crookes একদিন অধ্যাত্মবিদ্যা বিষয়ক তাঁহার যাবতীয় গবেষণা ও অভিজ্ঞতার কাগজপত্র অগ্নিসাৎ করেন এবং যতদিন বাঁচিয়াছিলেন ততদিন এই সম্বন্ধে কোন কথাই মুখে আনিতেন না। লোকে কল্পনা-জল্পনা করে- “He was the victim of some confidence trick.” বিলাতের ওয়াকীবহাল মহলে জনশ্রুতি এই যে, Sir Oliver Lodge “ভুতুড়ে” (Spiritualist) হওয়ার পর তিনি খাঁটি বৈজ্ঞানিক মহলে অনেকটা প্রতিপত্তি হারাইয়াছেন। তিনি প্রায় অর্দ্ধশতাব্দী পূর্বে কিছু গবেষণা করিয়াছিলেন, কিন্তু তৎপরে তিনি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে কিছু দান করেন নাই, “ভুতুড়ে বিজ্ঞানে” কি দান করিয়াছেন, তাহা আমার জানা নাই।”
ভিড় করে আসা প্রশ্নমালার ঝাঁপি এ’বার আমরা বন্ধ করব, তার আগে এটুকু আরও একবার মনে করিয়ে দেব—কোনও বিখ্যাত ব্যক্তি ভূতে বিশ্বাস করলে, কোনও বিখ্যাত বিজ্ঞানী জ্যোতিষে বিশ্বাস করলে, তার দ্বারা ভূত বা জ্যোতিষ শাস্ত্রের সারবত্তা আদৌ প্রমাণিত হয় না। শুধু এইটুকুই প্রমাণিত হয়—অমুক বিখ্যাত ব্যক্তি প্রমাণ ছাড়াই দিব্যি ভূতে বিশ্বাস করেন, আর তমুক বিখ্যাত বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের আবশ্যিক শর্ত ‘প্রমাণ’কে অগ্রাহ্য করে আকাট অজ্ঞানীর মতই জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন, কিংবা টেলিপ্যাথিতে; বিজ্ঞানের দরবারে কারও ব্যক্তি-বিশ্বাসের এক কানাকড়িও দাম নেই, সে ব্যক্তিটি যত নামী-দামীই হোন না কেন। দাম নেই কোনও গ্রন্থে ছাপার অক্ষরে কি প্রকাশিত হল এবং কত মানুষ তাতে বিশ্বাস স্থাপন করল, তার উপর। সংখ্যাধিক্যের মতকে গ্রহণ করতে হলে আজও আমাদের পৃথিবীর চারপাশে সূর্য পাক খেয়ে বেড়াত। বিজ্ঞান সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের পথ ধরে; এর কোনও বিকল্প নেই।
ঝাঁপি বন্ধের প্রাক্কালে যে কথাগুলো লিখলাম, সেগুলো নতুন কোনও কথা নয়। অনেক ব্যক্তি, অনেক সংগঠন, অনেক বিজ্ঞান মনস্ক-সমাজমনস্ক বলে চিহ্নিত পত্রিকা এ-জাতীয় কথা নানাভাবে প্রচার করে আসছেন। কিন্তু মজাটা হল এই যাঁরা এ’জাতীয় কথা বলেছেন, প্রচার করেছেন, তাঁরা অনেকেই প্রগতিশীল সাজতে এ’জাতীয় কথা বললে বা লিখলেও কাজে মানেন না। অত্যন্ত শঙ্কা ও দুঃখের সঙ্গেই এ’কথা বলতে হচ্ছে—কাজে মানেন না।