অধ্যায় : তেরো – তবু জাতিস্মর বার বার ঘুরে ফিরে আসে
নেই। তবু আসে। পত্রিকা ব্যবসা করতে নিয়ে আসে। মানুষ অদ্ভুত কিছু ভালবাসে বলেই ওরা নিয়ে আসে। মানুষ চিরকালের জন্য মরতে চায় না বলেই ওরা নিয়ে আসে। মানসিক রোগ ও অজ্ঞতার হাত ধরে ওরা আসে। লোভী মানুষ সম্পত্তির লোভে নিয়ে আসে। শোষক, শাসক ও তাদের সহায়ক বুদ্ধিজীবীরা জন্মান্তর ও কর্মফলের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে নিয়ে আসে। যখন আসে, প্রচার মাধ্যমের সাহায্য নিয়েই আসে। সঙ্গে কখনও সখনও সম্পাদকীয়ও যুক্ত হয় “জন্মান্তরকে যেমন বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া উচিত নয়, তেমনই কোনও গবেষণা না করেই তা উড়িয়ে দেওয়াটাও হবে অযৌক্তিক। জন্মান্তরবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যে সব যুক্তি ও তথ্য এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে তার ভিত্তিতে গবেষণা শুরু করাই হবে আধুনিক বৈজ্ঞানিকদের কাজ।” এক ধাক্কায় তিরিশ হাজার সার্কুলেশন বাড়ে। আহাম্মক বা বদমাইস ছাড়া কোনও বিজ্ঞানীই এমন ওঁচা বিষয় নিয়ে গবেষণায় নামবে না, এই বিষয়ে চূড়ান্ত নিশ্চিত সম্পাদক চূড়ান্ত অনিশ্চয়তা ও দ্বিধার দোলায় দুলিয়ে দেয় জনগণকে। কিন্তু বিক্রি তো বাড়ে! সম্পাদকের কর্মদক্ষতায় তাঁর ওপর একই সঙ্গে বর্ষিত হয় প্রশংসা ও ঈর্ষা।
জাতিস্মররা হয় মানসিক রোগী, নয় প্রতারক
ছোটবেলা থেকেই আমরা পুরাণের গল্প, রামায়ণ-মহাভারতের গল্প এক নাগাড়ে শুনতে শুনতে বিশ্বাস করতে শুরু করি-আত্মা অমর। মৃত্যুতেই সব শেষ হয় না। আমরা আবার জন্মাই। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধার করতে পারে। যারা পারে, তাদেরকেই বলে জাতিস্মর।
আমরা শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের মত দুই দক্ষ কথা-শিল্পীর লেখায় জাতিস্মরের বিস্ময়কর কাহিনী পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। জাতিস্মররা গল্প- উপন্যাসের পাতা ছেড়ে উঠে এসেছে পরামনোবিজ্ঞানী (প্যারাসাইকোলজিস্ট) নামধারী একদল বিজ্ঞান-বিরোধী বোকা বা অসৎ মুখোশধারী বিজ্ঞানীদের তথাকথিত গবেষণায়। ধর্মগুরুদের কণ্ঠে বার বার ধ্বনিত হয়েছে—কর্মফল, জন্মান্তর ও জাতিস্মর সূর্যের মতই শাশ্বত। খবরের কাগজের গল্পের পাতা ছেড়ে খবরে বার বার স্থান করে নিয়েছে নানা জাতিস্মরের আবির্ভাব কাহিনী। আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই হতবাক (?) প্রতিবেদকের একই ধরনের জবানবন্দী, “তার কথার সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাচ্ছে তার অতীত জীবন সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য…..আজগুবি খবর বলে প্রথমে যাকে উড়িয়েই দিতে চেয়েছিল আমার সন্দিগ্ধ মন, পরিপূর্ণ তদন্ত শেষে সেই আমাকে বাধ্য করছে জন্মান্তরবাদকে চিরন্তন সত্য বলে মেনে নিতে…আধুনিক বিজ্ঞানও ওকে নিয়ে গবেষণা করতে গেলে কিছুটা বিমূঢ় হবে” ইত্যাদি প্ররোচিত করার মত নানা বাক্যবিন্যাস।
পূর্বজন্ম বা জন্মান্তরবাদ তাত্ত্বিকভাবেই দাঁড়ায় না। ওদের মিথ্যে সামান্য যুক্তির দখিণা হাওয়াতেই তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ে। তবু পরামনোবিজ্ঞানী নামধারী কিছু অ-বিজ্ঞানী জন্মান্তরে বিশ্বাস করেন, রা বিশ্বাসের অভিনয় করেন। ওঁরা পূর্বজন্মকে প্রতিষ্ঠা করতে, আত্মার অমরত্বকে প্রমাণ করতে বার বার চেষ্টা করেছেন মানুষের কাছে জাতিস্মর’কে হাজির করতে। কারণ জাতিস্মর পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধার করে।
কিছু পরামনোবিজ্ঞানী দাবি করেন, তাঁরা সম্মোহন করে কিছু কিছু সম্মোহিত ব্যক্তির স্মৃতিকে পিছোতে পিছোতে পূর্বজন্মের দিনগুলোতে নিয়ে যেতে পারেন।
মনোবিজ্ঞান মনে করে, কোনও একজন প্রবীন ব্যক্তিকে সম্মোহন করে তার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিকে আবার উদ্ধার করা বহু ক্ষেত্রেই সম্ভব। একটা কথা বললে হয় তো অদ্ভুত শোনাবে, স্বাভাবিক মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের অধিকারী মানুষদের ক্ষেত্রে ‘দুর্বল স্মৃতি’ বলে কিছু নেই। আমাদের স্মৃতি-শক্তির একটা পর্যায় হল সংরক্ষণ (Retention)। শেষ পর্যায়ে আছে স্মরণ (Recall)। যা দেখি, যা শুনি, সে- সব সংরক্ষণের বিষয়ে আমাদের কারুরই কোনও ঘাটতি নেই। যেটুকু ঘাটতি বা ত্রুটি দেখা যায়, তা শুধুই স্মরণের ক্ষেত্রে। মনোবিজ্ঞান সম্মোহনের সাহায্যে স্মরণ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর তত্ত্বকে, বা চলতি কথায় বলতে পারি সম্মোহন করে অতীত স্মৃতি উদ্ধারের তত্ত্বকে মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধারের তত্ত্বকে কখনই মেনে নেয়নি। পরামনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব মতই আত্মার শরীর নেই, মস্তিষ্কও নেই। মস্তিষ্ক না থাকলে মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষও নেই। মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষ না থাকলে স্মৃতি জমা থাকবে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর পরামনোবিজ্ঞানীদের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, এবং তাঁরা দিতেও পারেননি। তাই মনোবিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান পরামনোবিজ্ঞানের পূর্বজন্মের স্মৃতি উদ্ধারের তত্ত্বকে মেনে নিতে পারেনি।
তবে সম্মোহিত করে কাউকে তথাকথিত জাতিস্মর করা সম্ভব। বিষয়টা বুঝিয়ে বলছি। ধরা যাক রাম মণ্ডল নামের মৃত একটি মানুষের জীবনের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে কোনও ব্যক্তিকে সম্মোহিত করে তার মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে এই ধারণা সঞ্চারিত করা হল যে, সে গত জন্মে ছিল রাম মণ্ডল। আঠার বছর বয়সে বিয়ে করেছিল শ্যামাসুন্দরীকে। থাকত বারাসতে। দেওয়াল-ঘেরা বড় বাগানবাড়ি। পুকুর ছিল। পুকুরের সামনের তালগাছে একবার বাজ পড়েছিল। ছেলে ছিল দশটি, মেয়ে দুটি। পেশা ছিল ডাকাতি। বাগানবাড়িতেই ছিল এক কালী মন্দির। লোকে বলত ডাকাতে-কালী। তবে কেউ পুজো দিতে এলে তাদের গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগত না। একবার পা ভেঙেছিল। তারপর সাতান্ন বছর বয়সে পুলিশের গুলিতে প্রাণ যায়।
এ’বার কিছু সাক্ষী-সাবুদের সামনে লোকটিকে আবার সম্মোহন করে তার গত জন্মের বিষয় জানতে চাইলে সে মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে সঞ্চারিত ধারণার কথাই বলে যাবে।
তারপর ওকে নিয়ে বারাসতে ঘোরাঘুরি করলে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে, এবং আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যাবে পূর্বজন্মের বহু ঘটনা।
সম্মোহন জানেন এমন কেউ জাতিস্মরের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য এই ধরনের প্রতারণা করলে করতেই পারেন।
মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষের বিচিত্র কর্মকাণ্ড বিষয়ে অভিজ্ঞতার অভাবে কেউ আমার এই জাতীয় বক্তব্যকে উড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হতে পারেন অনুমান করে বহু থেকে একটিমাত্র উদাহরণ এখানে তুলে দিচ্ছি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মহিলাদের জনপ্রিয় পাক্ষিক ‘সানন্দা’র সহ-সম্পাদক সুদেষ্ণা রায় ও সম্পাদকীয় দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত নিবেদিতাকে সম্মোহিত করেছিলাম সানন্দার বহু সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহকের সামনে সম্পাদকের ঘরে। সঞ্চারিত ধারণা মত সুদেষ্ণা ভেবেছিলেন তাঁর ওপর সত্যজিৎ রায় ও রাজীব গান্ধীর আত্মা ভর করেছেন। এবং সেই বিশ্বাসে তিনি মিডিয়াম হিসেবে উত্তর দিয়েছেন, এমন কি রাইটিং প্যাডে লিখেও উত্তর দিয়েছেন। নিবেদিতা ভেবেছিলেন তাঁর উপর ভর করেছেন উত্তমকুমার। আর সেই বিশ্বাসে তিনি অন্যান্য সাংবাদিকদের হাজির করা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। (এই ঘটনাটি বিস্তৃতভাবে আগেই বর্ণনা করেছি।) সম্মোহন করে আধা-ঘুম, আধা-জাগরণের অবস্থায় একজনকে নিয়ে গিয়ে তাকে দিয়ে কথা বলিয়ে বহু কথা জানা যায়, এমনকি বহু গোপন করে রাখা কথাও। এই নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে। জল-ভূত নিয়ে সে এক বিচিত্র কাহিনী।
সম্মোহনকে কাজে লাগিয়ে একজনকে তথাকথিত জাতিস্মর করে তোলা ছাড়া আরও দু’ধরনের জাতিস্মর দেখা যায়। এক : মানসিক রোগী। দুই : প্রতারক বা প্রতারকদের দ্বারা পরিচালিত।
সম্মোহন করে একজনের মস্তিষ্কে কোনও মৃত মানুষের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্যাদি ঢুকিয়ে না দিলেও দেখা যায় কিছু কিছু মানুষ হঠাৎ দাবি করে, তার পূর্বজন্মের অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষা চালালে দেখা যাবে তথাকথিত পূর্বজন্মের জীবনের অনেক তথ্যই সত্যি। এর কারণ ভূতে পাওয়া বা ঈশ্বরের ভরের মতই জাতিস্মরও একটা মানসিক রোগমাত্র। সাধারণভাবে এইসব জাতিস্মরের দাবিদার মানসিক রোগীরা অল্পবয়স্ক, কল্পনাপ্রবণ এবং আবেগপ্রবণ। এদের মস্তিষ্ক- স্নায়ুকোষের স্থিতিস্থাপকতা বা সহনশীলতা এবং যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা কম। সামাজিক, পারিবারিক ও পরিবেশগতভাবে পুনর্জন্মে বিশ্বাসী। কোনও একজনের মৃত্যুঘটনা এদের বিশেষভাবে নাড়া দেয়। ওই মৃত মানুষটির বাড়ি, পরিবেশ, পরিবার, শৈশব, কর্মক্ষেত্র, পোশাক, মুদ্রাদোষ ইত্যাদির বিষয়ে একনাগাড়ে ভাবতে থাকলে,বিশেষ কিছু মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষ বারবার উত্তেজিত হতে থাকে। এর ফলে অনেক সময় মস্তিষ্ক-স্নায়ুকোষে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এই সময় সে বিশ্বাস করে ফেলে—আমি গতজন্মে ছিলাম ওই মৃত মানুষটি। অর্থাৎ এই সময়ে সে নিজের সত্তার মধ্যে অন্যের সত্তাকে অনুভব করছিল। এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত জাতিস্মরের মা-বাবা যদি ভ্রান্ত ধারণার শিকার না হয়ে মনোরোগ চিকিৎসকদের সাহায্য নেন, তবে রোগী তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
আবার এই পরিস্থিতিতে অনেক মা-বাবা সন্তানকে বিখ্যাত করার তাগিদে এবং নিজেরা বিখ্যাত হবার উৎসাহে অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছেয় কিছু কিছু অসত্য কথা যুক্ত করে প্রমাণ করতে চান, তাঁদের সন্তান বাস্তবিকই জাতিস্মর।
আবার অনেক সময়ই দেখা যায় বিখ্যাত হবার জন্য, অথবা পূর্বজন্মে ধনী পরিবারের সদস্য হিসেবে নিজ সন্তানকে হাজির করে ধনীর কিছুটা ধন টেনে নেবার পরিকল্পনা মাথায় ভেঁজেও কেউ কেউ তাদের সন্তানদের মাথায় মৃত ব্যক্তির ব্যক্তিজীবনের অনেক তথ্য ঢোকায়। তারপর শিশুকে সফল জাতিস্মর হিসেবে হাজির করতে পারিবারের অনেকেই অভিনয় করে, যার আর এক নাম প্রতারণা।
জানি, তাত্ত্বিকভাবেই জাতিস্মরের অস্তিত্ব সম্ভব নয়, যেমনভাবে সম্ভব নয় ঘোড়ার ডিমের অস্তিত্ব, তবু জাতিস্মরের খবর পেলেই বার বার ছুটে যেতে বাধ্য হই। “মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের দেওয়াল ভেঙে যুক্তির আলো আনবই”–এই প্রতিজ্ঞাই আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে যায়। বারবার ওদের অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারিতার মুখোশ খুলতে খুলতে মানুষের মনে জাগিয়ে তুলতে চাই প্রশ্ন। আর বিশ্বাস করি এই প্রশ্নই একদিন মানুষকে সত্যের সন্ধান দেবে।