৫. মিজ দ্য মিলার

৫. মিজ দ্য মিলার

লম্বা পা ফেলে ফিরে চলেছে ওরা শেরউডের দিকে। দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়লো রবিন। পথের মাঝখানে কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না জানা কথা, তবু বললো সে, ‘এখন একটা পাউরুটি, বড়সড় এক টুকরো সাদা পনির, আর কয়েক ঢোক হামিং এল হলে কেমন হতো বলতো?’

‘উফ, আর বলো না, মামা, ককিয়ে উঠলো উইল স্কারলেট। মনে হচ্ছে পেটের ভেতর কুস্তি করছে নাড়ীভুঁড়িগুলো। কথা শুনেই জিভে পানি এসে গেছে আমার।’

‘কাছাকাছিই একটা বাড়ি চিনি আমি,’ বললো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড। টাকা দিলে কিনে নিয়ে আসা যায় এসব ওখান থেকে-পাউরুটি; পনির, এল সব।’

‘টাকা তো আছে আমার কাছে,’ বললো লিটল জন, ‘দে নাকি?’

‘ঠিকই তো। তোমার কাছে তো টাকা ছিল,’ বললো রবিন। ‘আমাদের সবার জন্যে খাবার কিনতে কত লাগবে, আর্থার?’

‘আমার মনে হয় ছয় পেনি দিলে যথেষ্ট খাবার পাওয়া যাবে, বারোজন খেয়েও শেষ করা যাবে না,’ বললো আর্থার।

‘ঠিক আছে, ছয় পেনি দিয়ে দাও ওকে, লিটল জন। মনে হচ্ছে তিনজনের খাবার একাই খেতে পারবো আমি। তোমাদেরও নিশ্চয়ই একই অবস্থা? ছয় পেনিই দাও। আমরা রাস্তার পাশে ওই ঝোপের ছায়ায় বসছি, তুমি ছুটে গিয়ে খাবার নিয়ে এসো, আর্থার।’

ছয় পেনি নিয়ে চলে গেল আর্থার। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো সে ইয়া বড় এক পাউরুটি আর বড়সড় এক চাকা পনির নিয়ে, কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে ছাগলের চামড়ার এক মশক বিয়ার। তলোয়ার দিয়ে সমান চার টুকরো করলো উইল স্কারলেট রুটি আর পনির। কালবিলম্ব না করে খেতে বসে গেল সবাই। গোগ্রাসে গিলছে রুটি আর সুস্বাদু পনির, সেই সাথে হাত বদল হচ্ছে বিয়ার ভর্তি মশকটা যার যত খুশি টেনে চলেছে বিয়ার। খাবারও শেষ, বিয়ারও শেষ। শহুরে ব্যবসায়ীর মত পেট-মোটা মশকের অবস্থা দাঁড়ালো অশীতিপর বৃদ্ধের ঝুলে পড়া শিথিল চামড়ার মত।

‘আহ্!’ তৃপ্তির দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রবিন। মনে হচ্ছে জীবনে এত ভাল খাবার খাইনি। যেন নতুন প্রাণ ফিরে এলো ধড়ে। এক্ষুণি যাত্রা করলে নষ্ট হয়ে যাবে আমেজটা। এসো, খানিক বসে যাই। উইল, যতদূর মনে পড়ছে, চমৎকার গলা ছিল তোমার এক কালে। ধরবে নাকি একটা গান?’

‘আমার আপত্তি নেই,’ বললো উইল স্কারলেট, ‘কিন্তু একা গাইবো না আমি।’

‘বেশ তো, সবাই গাইবে তোমার সাথে। নাও, ধরো, শুরু করো।‘

খুক করে একটু কেশে নিয়ে সুন্দর একটা গান ধরলো উইল স্কারলেট।

‘কে আসে রে?’ গানের মধ্যে হঠাৎ বলে উঠলো রবিন। ‘ওই যে, রাস্তা দিয়ে আসছে।’

‘জানি না,’ বিরক্ত কণ্ঠে বললো লিটল জন। যার খুশি আসুক, যাক আমাদের কি? কেউ এলেই একটা ভাল গানের মাঝখানে কথা বলে উঠতে হবে?

‘রাগ করছো কেন, ভাই? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি, পিঠে মস্ত একটা বোঝা নিয়ে বাঁকা হয়ে হাঁটছে লোকটা। তাকিয়ে দেখো না একটু, চিনতে পারো কিনা? কে ও?’

রবিনের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো লিটল জন। ‘ওহ্, এই লোক একজন মিলার ময়দা পেষার জাঁতাকলে কাজ করে। প্রায়ই দেখি আমাদের শেরউডের একটা রাস্তা দিয়ে যায়, আসে। খেটে খাওয়া গরীব এক যুবক। ওর জন্যে ভাল একটা গান নষ্ট করার কোন মানে দেখি না।’

‘মনে হচ্ছে লোকটাকে আমি দেখেছি বেশ কয়েকবার,’ বললো রবিন। ‘নটিংহাম শহর ছাড়িয়ে ওই সেলসবারি রোডের একটা মিলে কাজ করে না?’

‘ঠিক ধরেছো। এ সেই লোক।’

‘লোকটা ভাল,’ বললো রবিন। ‘লাঠিও খেলে ভাল। হপ্তাদুয়েক আগে ব্র্যাডফোর্ডের নেডকে খুব পিটিয়েছে। চাঁদি ছিলে দিয়েছে একেবারে। আমি ছিলাম।’

ইতিমধ্যে অনেকটা কাছে এসে পড়েছে তরুণ মিলার, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ওকে। ময়দা লেগে আছে জামা-কাপড়ে, মস্ত এক বস্তা ভর্তি ময়দা রয়েছে লোকটার পিঠে বোঝার ভারে বাঁকা হয়ে হাঁটছে লোকটা, কিন্তু তাই বলে নিত্য সঙ্গী মোটাসোটা লাঠিটা ত্যাগ করেনি-বস্তার সাথেই বাঁধা আছে সেটা আড়াআড়ি ভাবে। দৃঢ় পদক্ষেপে চলার ভঙ্গি দেখে বোঝা যায়, রীতিমত শক্তিশালী লোক, বোঝার ভারে আরো ফুলে উঠেছে পেশীগুলো, মনে হচ্ছে ছোটখাটো দৈত্য একটা। মুখটা লাল, চুল-দাড়ির রঙ ঠিক শনের মত।

‘খুবই সৎ লোক,’ আবারও বললো রবিন। এরকম একজন নাগরিক যে-কোন দেশের গর্ব।’ হঠাৎ চকচক করে উঠলো রবিনের চোখ দুটো। মৃদু হেসে বললো, এর সাথে খানিক মজা করলে কেমন হয়? চারজন একসাথে ঘিরে ধরবো ওকে, হাঁক-ডাক ছেড়ে ঘাবড়ে দেব, যা আছে সব কেড়ে নেয়ার ভান করবো, তারপর ওকে ধরে নিয়ে যাবো আমাদের আস্তানায়। সেখানে তৃপ্তির সাথে পেট পুরে খাইয়ে ছেড়ে দেব ওর থলেতে যতগুলো পেনি আছে তার বদলে ততগুলো ক্রাউন ভরে দিয়ে। কি বলো তোমরা? কেমন হয়?’

‘খুব মজা হয়, সত্যিই!’ বললো উইল স্কারলেট।

‘মজা তো হয় ঠিকই,’ লিটল জন বললো। ‘কিন্তু খোদা না খাস্তা আজ যদি আরো পিট্টি খেতে হয়, তাহলে নির্ঘাৎ মারা পড়বো। কাজ নেই এসব তামাশায়। আমার সারা শরীরের হাড্ডিগুলো ব্যথায়…’

‘তোমার খালি অলক্ষুণে কথা! ধমক মারলো রবিন। ‘নির্দোষ রসিকতার মধ্যেও তিনি গন্ধ পাচ্ছেন বিপদের! এর মধ্যে মারামারির কথা আসছে কোত্থেকে? মারধোর করতে যাচ্ছে কে? সারাদিনে মারপিট যথেষ্ট হয়েছে, এবার হাসি-তামাশার মধ্যে দিয়ে সুন্দর ভাবে শেষ হোক দিনটা কি বলো তোমরা?’

সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল, কথা বললো না, কারণ একেবারে কাছে এসে পড়েছে মিলার লোকটা। লিটল জন শুধু বিড় বিড় করে বললো, ‘কি বিপদেই যে ফেলতে যাচ্ছে, আল্লাই মালুম!’

‘চুপ!’ ঠোঁটের উপর আঙুল রাখলো রবিন।

ঝোপের কাছাকাছি এসে পৌঁছলো লোকটা। হঠাৎ হারে-রে-রে-রে করে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরলো ওকে ডাকাতের মত চারজন। ‘অ্যাই, দাঁড়াও!’ হুঙ্কার ছাড়লো রবিন হুড।

কাঁধের বোঝা সমেত ধীরে ধীরে ঘুরলো লোকটা, একে একে দেখলো সবাইকে বিস্মিত দৃষ্টিতে। কেমন যেন থতমত খাওয়া চেহারা। বোঝা গেল, গায়ে জোর থাকতে পারে, মগজ ততটা জোরালো নয় লোকটার।

‘কে থামতে বললো আমাকে?’ গুরুগম্ভীর গলা, মস্ত এক কুকুরের চাপা গর্জনের মত শোনালো।

‘আমি বলেছি,’ আর এক পর্দা চড়িয়ে দিল রবিন গলার স্বর।

‘কে তুমি জানতে পারি?’ কাঁধ থেকে ময়দার বস্তাটা ধুপ করে ফেললো সে মাটিতে। ‘তোমার সাথের এরাই বা কারা?’

‘আমরা চারজন ধার্মিক খ্রিস্টান,’ বললো রবিন। এত ভারি বোঝা টানছো দেখে ঠিক করেছি হালকা করে দেব তোমার বোঝা। তোমার হয়ে আমরা চারজন কিছু কিছু করে মোট ভাগ করে নেব।’

‘তোমাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ বললো মিলার। কিন্তু আমার বোঝাটা অতখানি ভারি নয় যে আমি নিজে বইতে পারবো না।’

ঠিক বুঝতে পারনি, ভায়া,’ বললো রবিন। ‘তোমার ওই ময়দার বোঝার কথা বলছি না। বলছি ওই কোমরে গোঁজা থলেটার কথা। মনে হয় ওটা তোমার জন্যে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে গেছে, আমরা ক’জন ভাগাভাগি করে নিলে হালকা হয়ে যাবে তুমি।’

‘হায়!’ বললো মিলার। কি নেবে তোমরা? একটা ফুটো পয়সাও তো নেই আমার কাছে। আমি গরীব মানুষ, কোথায় পাবো টাকা? দয়া করে যেতে দাও আমাকে। আমাকে মারধোর করে কোন লাভ হবে না তোমাদের। তাছাড়া, তোমাদের মনে রাখা দরকার, রবিন হুডের এলাকায় দাঁড়িয়ে আছো তোমরা।’

‘রবিন হুড! সে আবার কে?’ জানতে চাইলো রবিন কৌতুকের সুরে।

‘গরীবের বন্ধু, অত্যাচারীর যম। যদি জানতে পারে আমার মত একজন দরিদ্র শ্রমিককে হয়রানি করেছো, কান কেটে গাছে ঝুলিয়ে দেবে সে তোমাদের।’

‘তাই নাকি? চেনা-জানা আছে নাকি তার সাথে তোমার?’

‘চিনি না, কিন্তু জানি। আমার নালিশও জানাবার দরকার পড়বে না, বাতাসে ভেসে খবর পৌঁছে যাবে তার কানে। দুনিয়ার কোথাও পালিয়ে বাঁচতে পারবে না তোমরা তার হাত থেকে

‘তাহলে তো খুব ভয়ের কথা!’ কপট ভয়ের অভিনয় করলো রবিন, তারপর চোখ-মুখ কুঁচকে নিষ্ঠুর একটা ভাব ফুটিয়ে তুললো চেহারায়। তুমি ভেবেছো রবিন হুডবে ভয় করি আমি? নিজেকে যতটা কেয়ার করি তার চেয়ে এক কানাকড়িও বেশি কেয়া করি না আমি রবিন হুডকে। ভালোয় ভালোয় বের করে ফেলো পয়সা-কড়ি যা আছে সব।’

বস্তার সাথে বাঁধা লাঠিটার দিকে চাইলো একবার লোকটা। সাথে সাথেই ধমব মারলো রবিন, ‘খবরদার! ওদিকে এক ইঞ্চি হাত বাড়ালেই এক বাড়িতে কান ফাটিয়ে দেব!’

‘না, না…মেরো না আমাকে!’ দু’হাত তুলে কান ঢাকলো মিলার। ‘কিন্তু পয়সা পাব কোথায়? ইচ্ছে হয় তালাশ করে দেখো, একটা পয়সাও নেই আমার ‘পকেটে।’

‘বিশ্বাস করি না,’ হুঙ্কার ছাড়লো রবিন। ‘একটা পয়সাও নেই, তা হতেই পারে না। কোনো সন্দেহ নেই, বস্তার মধ্যে হাত দিলেই বেরিয়ে পড়বে আসল সত্য। আর্থার, ঢালো তো। বস্তায় যা আছে সব ঢেলে ফেলো মাটিতে। আমার বিশ্বাস ময়দার মধ্যে কমপক্ষে দুটো শিলিং পাওয়া যাবে।’

‘হায় রে!’ হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো মিলার বস্তার পাশে। ‘খাবার জন্যে নিয়ে যাচ্ছি ময়দাগুলো, সব নষ্ট হবে, সর্বনাশ হয়ে যাবে আমার। ঠিক আছে, মাটিতে ঢালার দরকার নেই, আমি নিজেই বের করে দিচ্ছি ময়দার নিচে লুকানো টাকা।’

‘এই দেখো!’ কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো রবিন স্কারলেটকে। ‘বলেছিলাম না, এই ব্যাটার কাছে অনেক টাকা আছে। টাকার গন্ধ পাই আমি, যেখানেই লুকানো থাক না কেন, ঠিক বের করে দেব চিনে, হ্যাঁ! কি হলো, নিজেই বের করবে, নাকি ঢালবো সব মাটিতে?’

ধীরে ধীরে বস্তার মুখের বাঁধন খুলছে মিলার, যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ধীরে ধীরে কনুই পর্যন্ত দুই হাত ঢুকিয়ে দিল ময়দার ভেতর, খুঁজছে কি যেন। ঝুঁকে এলো সবাই কি বের হয় দেখার জন্যে। বস্তার ভেতর হাতড়াচ্ছে মিলার, হঠাৎ বললো, ‘এই যে, পেয়েছি থলিটা।’

কথা শুনে আরো ঝুঁকে এলো সবক’টা মাথা। হাত বের করে আনছে মিলার। হঠাৎ, কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই, দুই মুঠো ময়দা ছুঁড়ে দিল সে ওদের চোখেমুখে। নাক দিয়ে ময়দা ঢুকে দম বন্ধ হওয়ার দশা হলো সবার, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না চোখে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ডের। হাঁ হয়ে গিয়েছিল ওর মুখটা, শুকনো খসখসে ময়দা ঢুকে গেছে গলায়, অদম্য কাশিতে বাঁকা হয়ে গেল সে।

হাউমাউ করে উঠলো বাকি তিনজন। দুই হাতে চোখ ডলছে, দূরদর করে পানি নামছে গাল বেয়ে-কিন্তু রেহাই নেই, মুঠো মুঠো ময়দা তুলছে আর ছুঁড়ে দিচ্ছে মিলার ওদের চোখ-মুখ-নাক লক্ষ্য করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নটিংহামশায়ারের অন্ধ ভিখারীর মত অবস্থা হলো সবার, চুল দাড়ি জামা-কাপড় সাদা হয়ে গেছে ময়দা লেগে।

এবার মোটা লাঠিটা তুলে নিয়ে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল মিলার। কোন বাছ-বিচার না করে দমাদম পিটিয়ে চললো সে সমানে। মার খেয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে সবাই, কিন্তু না পাচ্ছে কিছু দেখতে, না পারছে আত্মরক্ষা করতে, না পালাতে। এদিক ওদিক এলোপাতাড়ি পা ফেলে গা বাঁচাবার চেষ্টা করছে সবাই, পড়ে যাচ্ছে, উঠে দাঁড়াচ্ছে, কেউ আবার ছুটে গিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে গাছের সাথে।

ধুপ! ধাপ! চড়াৎ! খট!-মনের সুখে মেরে চলেছে মিলার পাইকারি হারে। প্রতিটা বাড়ির সাথে সাথে ময়দার মেঘ উঠছে ওদের জামা-কাপড় থেকে।

‘থামো! থামো!’ আর সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন, ‘মার থামাও, আমি রবিন হুড’।’

‘তাই নাকি?’ হেসে উঠলো মিলার। ‘মিছে কথার আর জায়গা পেলে না?’ এই বলে পর পর কয়েকটা বাড়ি মেরে ধোঁয়া ছুটিয়ে দিল সে রবিনের জামা-কাপড় থেকে। ‘গরীব মানুষের টাকা কেড়ে নেবে মহান রবিন হুড? কী মনে করেছো তুমি তাকে? তোমাদের মত ছ্যাঁচড়া চোর? পিটিয়ে খুন করে ফেলব আজ!’ বলেই কষে আরেক বাড়ি লাগালো সে তার পিঠে। তারপর ফিরলো লিটল জনের দিকে, আরে! তোমার ভাগে তো কম পড়ে যাচ্ছে, ধেড়ে শয়তান! আমার কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে, সমান ভাগে ভাগ করে নেয়া উচিত তোমাদের সবার।’ এই বলে লিটল জনের কাঁধের ওপর এমন এক বাড়ি লাগিয়ে দিল যে টলমল করে কয়েক পা গিয়েই উইল স্কারলেটের পায়ে পা বেধে হুড়মুড় করে পড়লো সে রাস্তার উপর। আর তুমি? এবার তোমার পালা না কালো-দাড়ি?’ বলেই খটাশ করে মারলো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ডের চাঁদির ওপর। কাশতে কাশতেই হাউমাউ করে চিৎকার করে উঠলো আর্থার। ‘এবার লাল মিঞা। কাপড়টা তো সাদা হয়ে গেছে একেবারে। এসো, এসো, ঝেড়ে দিই ময়দাগুলো।’ চড়াৎ চড়াৎ শব্দে ধুলো ঝাড়ছে সে উইল স্কারলেটের জামা থেকে।

এইভাবে মজার মজার মন্তব্য করছে আর একনাগাড়ে মেরে চলছে মিলার, হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে ওদের দুরবস্থা দেখে। যখনই মনে হয় চোখের দৃষ্টি ফিরে পাচ্ছে ওদের কেউ, আরও একমুঠ ময়দা ছিটিয়ে দেয় সে। মারতে মারতে একেবারে কাহিল করে ফেললো সে চার-চারজন তাগড়া জোয়ানকে। টলছে সবাই, দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই।

নির্ঘাৎ মারা পড়বার উপক্রম হয়েছে দেখে শেষ পর্যন্ত শেষ চেষ্টা হিসেবে শিঙাটা তুললো রবিন মুখে। জোরে ফুঁ দিল তিনটে। সম্ভাবনা কম, তবু বলা যায় না, কাছে পিঠে থাকতেও পারে দলের লোকজন।

এদিকে যখন এই পাইকারী পিট্টি চলছে, কাছাকাছিই একটা বুনো পথ ধরে যাচ্ছিল উইল স্টিউটলি এবং রবিন হুডের আরো কয়েকজন অনুচর। কয়েকজনের তারস্বরে চিৎকার আর চড়াৎ চড়াৎ লাঠির আওয়াজ কানে যেতেই থেমে দাঁড়ালো ওরা, কান পেতে শোনার চেষ্টা করছে, বোঝার চেষ্টা করছে ঘটনাটা কি।

‘মনে হচ্ছে, লাঠি খেলা চলছে কাছেই কোথাও। চলো, দেখা যাক মজাটা,’ বললো উইল স্টিউটলি। কিন্তু কয়েক কদম এগিয়েই পরিষ্কার শুনতে পেল সে রবিনের শিঙার সংকেত। মুহূর্তে সম্পূর্ণ বদলে গেল ওর চাল চলন। ‘জলদি! কাছেই কোথাও বিপদে পড়েছে রবিন!’

প্রাণপণে ছুটলো ওরা আওয়াজ লক্ষ্য করে। সবার আগে উইল স্টিউটলি আর ডংকাস্টারের ডেভিড। দৌড়ে এসে রাস্তায় পড়েই থমকে দাঁড়ালো ওরা। যা দেখলো, তাতে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল ওদের। রাস্তার একটা অংশ সাদা হয়ে গেছে ময়দা পড়ে। চারজন ময়দা মাখা ভূতকে বেদম পিটাচ্ছে একজন লাঠি দিয়ে। রবিন হুডকে চিনতে পেরে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো ওরা তার পাশে। ‘কি হয়েছে! এসবের কি অর্থ?’ জানতে চাইলো উইল স্টিউটলি।

চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উইল স্টিউটলির গলা চিনতে পেরে চিৎকার করে উঠলো রবিন, ‘অর্থ পরে বুঝো! পিটিয়ে মেরে ফেললো! আগে জলদি ঠেকাও মিলার ব্যাটাকে!’

কিন্তু কাকে ঠেকাবে, অবস্থা বেগতিক দেখে আলগোছে সটকে পড়েছে মিলার। চারজনকে পাঠিয়ে দিল উইল স্টিউটলি মিলারকে ধরে আনার জন্যে, বাকি সবাই লেগে গেল ওদের জামা-কাপড় থেকে ঝেড়ে মুছে ময়দা সাফ করার কাজে। চোখ কচলাতে কচলাতে সব খুলে বললো রবিন ওদের কিভাবে মিলারকে নিয়ে হালকা রসিকতা করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর মোড় নিয়েছিল ঘটনাটা।

হাসি চেপে রাখা মুশকিল হলো উইলের পক্ষে, বাকি সবারও একই অবস্থা। নিজেকে সামলে নেয়ার জন্যে ধমক মারলো সে বাকি চারজন অনুচরকে, ‘হাঁ করে কি গল্প শুনছো তোমরা? যাও না, ধরে নিয়ে এসো পাজি বদমাশটাকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই পিছমোড়া করে হাত বেঁধে নিয়ে আসা হলো কম্পমান মিলারকে রবিনের সামনে।

‘এখন?’ কটমট করে ওর দিকে চেয়ে ভুরু নাচালো রবিন। ‘পিটিয়েই খুন করে ফেলবে আজ, তাই না? তোমাকে আমি… দাঁত কিড়মিড় করে এইটুকু বলেই থেমে গেল রবিন। চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে ভস্ম করে দেবে মিলারকে।

কিন্তু রবিনের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না, প্রথমে চোখ দুটো চকচক করে উঠলো, তারপর খুক খুক করে হেসে ফেললো সে।

রবিনকে হাসতে দেখে আর সামলে রাখতে পারলো না কেউ নিজেকে, হো হো প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না অনেকে, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। হাসির ঠেলায় পেটে খিল ধরে যাবার অবস্থা।

‘কি নাম তোমার, ভাই?’ হাসি থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো রবিন মিলারকে।

‘মিজ দ্য মিলার, স্যার,’ ভয়ে ভয়ে বললো মিলার।

‘শাব্বাশ!’ ওর পিঠে চাপড় দিল রবিন। নিজ হাতে খুলে দিল ওর বাঁধন। ‘খুব দেখিয়েছো, বাপু। আর একটু হলেই প্রাণটা গেছিল আজ তোমার হাতে। তোমার মত সাহসী লোক পেলে নেব আমি দলে। আসবে তুমি আমাদের সাথে?’

‘আপনি যদি আমার অপরাধ ক্ষমা করেন, হুজুর, না জেনে যা ভুল করেছি মাফ করে দেন; খুশি হয়েই আপনার দলে যোগ দেব আমি। আপনার ঠাট্টা আমি একদম বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে এভাবে…’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ থামিয়ে দিল ওকে রবিন। ‘এমন কিছুই লাগেনি আমার…ওরে বাবারে! যাই হোক, কপালে যা ছিল ঘটেছে, তিন-তিনজন যোগ্য লোক তো পাওয়া গেছে, কি বলো, লিটল জন? চলো রওনা হওয়া যাক। নতুনদের সম্মানে বিরাট ভোজের আয়োজন হবে আজ আমাদের আস্তানায়।’ এই বলে সবার আগে আগে হাঁটতে শুরু করলো রবিন হুড। কিছুদূর এগিয়েই জঙ্গলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল গোটা দলটা।

একই দিনে তিন-তিনটে রোমাঞ্চকর ঘটনার পরিসমাপ্তি হলো এইভাবে। খাওয়া দাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত নাচ-গান, হাসি-তামাশা চললো সেদিন। তারপর যার যার বিছানা পেতে শুয়ে পড়লো সবাই। নিঝুম নীরবতা নামলো শেরউড জঙ্গলে।

বেশ কিছুদিন চেপে রেখেছিল লিটল জন সেদিনের সব কথা। কিন্তু বেশি দিন পারলো না। সবাই জানে, ওর পেটে কথা থাকে না। এক ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে বেরিয়ে পড়লো সব কথা-কিভাবে আর্থারের হাতে মার খেয়েছিল সে, কিভাবে স্কারলেটের হাতে রবিন। আর তাই নিয়ে রচনা হয়ে গেল লম্বা চওড়া গাথা। চারণ কবির মুখে সে-গান শুনে হেসে খুন হয়ে গেল সবাই, এবং আরো অনেক, অনেক বেশি করে ভালবেসে ফেললো রবিন হুডকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *