৩. আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড

৩. আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড

বেশ কিছুদিন পরের কথা। দলের সবার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছে লিটল জন। সবাই মিলে বিপুল বিক্রমে ঠেকিয়ে দিয়েছে শেরিফের একের পর এক বেশ কয়েকটা আক্রমণ। অসম সাহস, কূট রণ-কৌশল আর মহান হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে নিজেকে লিটল জন প্রতিষ্ঠা করেছে রবিন হুডের ডান হাত হিসেবে। নেতার প্রতি ভক্তিতেও সে সবার সেরা।

একদিন মে মাসের বিকেলে নিজেদের আস্তানায় গ্রীনউড গাছের নিচে সবুজ ঘাসের গালিচায় শুয়ে-বসে গল্প করছিলো কয়েকজন, গরমে কেমন একটা আলস্য-আলস্য ভাব সবার শরীরে, হালকা হাসি তামাশায় গুলজার হয়ে উঠেছিল আড্ডা। কাছেই ছোট্ট ঝর্ণাটা বয়ে চলেছে কুলকুল শব্দে, তার সাথে মিশে অপূর্ব সুন্দর এক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে কোকিল আর ঘুঘুর উদাস মিষ্টি গান। বিশাল ওকের মস্ত ডালগুলো দুলছে মৃদু মন্দ হাওয়ায়, চিক চিক করছে পাতাগুলো। শেষ বিকেলের রোদে সবুজ ঘাসের ওপর ঝিলমিল করছে আলোছায়ার খেলা।

দলের বেশির ভাগ লোকই ছোট ছোট উপদলে ভাগ হয়ে নানান কাজে চলে গেছে জঙ্গলের এদিক-ওদিকে। আস্তানা পাহারায় রয়েছে কেবল পাচ-ছয়জন। রবিনের পাশেই শুয়ে আছে লিটল জন মস্ত লাঠিটা কোল বালিশের মত করে ধরে; তার পাশে আধ-শোয়া হয়ে বসে আছে সুশ্রী উইল স্টিউটলি, বুদ্ধিতে যার জুড়ি মেলা ভার; রবিনের আরেক পাশে রয়েছে উইল স্কেদলক, পাকানো দড়ির মত শরীর, চোখে হাউণ্ডের দৃষ্টি-দৌড়ে কেউ পারে না ওর সাথে; তার ওপাশে রয়েছে ডংকাস্টারের ডেভিড-বিশাল ধড়, প্রায় লিটল জনের সমান, তেমনি গায়ের জোর, খুবই অল্প বয়স, দাড়ি গোঁফ মাত্র গজাতে শুরু করেছে।

হঠাৎ হাঁটুর উপর একটা চাপড় মারলো রবিন। ‘আরে, কাপড়ের কথা তো ভুলেই গেছিলাম! লিংকন গ্রীন শেষ হয়ে গেছে সেই কবে। সামনেই আসছে কাপড় বিলির তারিখ। এক্ষুণি অ্যাংকাস্টারে লোক না পাঠাতে পারলে বেইজ্জতি কারবার হয়ে যাবে।’ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করলো এক সেকেণ্ড, তারপর কনুই দিয়ে গুঁতো মারলো লিটল জনের পাঁজরে। শুয়ে-বসে মেদ জমে যাচ্ছে তোমার শরীরে, লিটল জন। একটু হাঁটাহাঁটি করে এসো, যাও। সোজা অ্যাংকাস্টারে গিয়ে হিউ লঙশ্যাংক্সকে বলবে যেন যত শীঘ্রি সম্ভব চারশো গজ লিংকন গ্রীন কাপড় পাঠিয়ে দেয়। বুঝতে পেরেছো?’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে বসলো লিটল জন। গল্পগুজব ছেড়ে এক্ষুণি উঠে পড়তে বলায় মনটা বেজার হয়ে গেছে তার। উশখুশ করে বলেই ফেললো, ‘এক্ষুণি যেতে হবে? কাল সকালে রওনা দিলে হয় না? সন্ধে হয়ে আসছে…’

‘সেজন্যেই রওনা হতে বলছি এখুনি। যে রকম ছোটখাট মানুষটা তুমি, দিনের বেলায় পথ চললে ঠিক চোখে পড়ে যাবে কারও। তোমার জন্যে রাতের অন্ধকারে পথ চলাই নিরাপদ।’

কথা না বাড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো লিটল জন, কটিবন্ধ এঁটে নিয়ে হাত পাতলো টাকার জন্যে। কাপড়ের দাম বাবদ যা হয় তার সাথে আরো কিছু হাতখরচের টাকা দিয়ে দিল রবিন। লাঠি হাতে রওনা হয়ে গেল সে।

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে এগিয়ে চলেছে লিটল জন। হাঁটছে আর শিস দিচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এসে হঠাৎ রাস্তার একটা তেমাথায় থমকে দাঁড়ালো সে। বন্ধ হয়ে গেল শিস। একটা রাস্তা চলে গেছে সোজা বহুদূরের শহর অ্যাংকাস্টারের দিকে, আরেকটা দিয়ে কিছুদূর এগোলেই শেরউডের বিখ্যাত সেই ব্লু বোর সরাইখানা। একবার এপথ আরেকবার ওপথের দিকে বার কয়েক চাইলো সে, তারপর টুপিটা একপাশে কাত করে মাথার পিছনটা চুলকালো। দুই টুকরো হয়ে গেছে মনটা। এক টুকরো বলছেঃ একটু এগোলেই তো ব্লু বোর সরাইখানা। খরচের টাকা রয়েছে পকেটে, কয়েক ঢোক ‘অক্টোবর এল,’ সেইসাথে ভাল কয়েকজন লোক পেলে উফ্, দারুণ জমে যাবে আড্ডা! অপর টুকরো বলছেঃ কোন ধানাইপানাই শুনতে চাই না, সোজা পা বাড়াও অ্যাংকাস্টারের পথে, যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেটা পালন করো।

কিন্তু পা আর বাড়ে না। কর্তব্য পালনের চেয়ে ফূর্তির আহ্বান অনেক অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আকাশের দিকে চাইলো সে। পরিষ্কার নীল আকাশে আলস্যভরে ভাসছে উজ্জ্বল সাদা মেঘের ভেলা, সোয়ালো পাখিরা উড়ছে ঘুরে ঘুরে। হঠাৎ ভুরু কুঁচকে ফেললো সে। ভাবলো, মনে হচ্ছে, বৃষ্টি হবে আজ সন্ধ্যায়। এই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে হলে আমার ব্লু বোরে গিয়ে আশ্রয় নেয়া উচিত। যেই থামবে অমনি রওনা হয়ে যাব আবার। কাজ দিয়েছে বটে, কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধাই, এটা নিশ্চয়ই চাইবে না রবিন।’ যেমন ভাবা তেমনি কাজ। দীর্ঘ পদক্ষেপে এগোলো সে সরাইখানার দিকে

বেশ কিছুটা দূর থেকেই সরাইখানার হৈ-হল্লা আর গানের আওয়াজ পেয়ে দ্রুততর হলো ওর চলার গতি। ঢুকেই দেখলো চার পাঁচজনে চমৎকার জমিয়ে তুলেছে আড্ডা, সবার হাতে মদের পাত্র। ওকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো সবাই। চমৎকার খাবার এলো, গ্লাসের পর গ্লাস মদ এলো, হাসি-ঠাট্টা-গল্পে রাত হয়ে গেল মেলা। অত রাতে রওনা হওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে সরাইখানাতেই একটা ঘর নিয়ে রাতটা কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল লিটল জন।

কাজটা ভাল করলো না সে। কারণ কর্তব্যে অবহেলা করলে কোন না কোন ভাবে তার শাস্তি পেতেই হয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই রওনা হয়ে গেল লিটল জন। চারপাশে চেয়ে যখন বৃষ্টির কোন চিহ্নই দেখতে পেল না, শুকনো খটখট করছে মাঠ ঘাট, তখন মনে মনে ভারি লজ্জা পেল সে। সময় কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার জন্যে প্রায় দৌড়ের গতিতে ছুটলো সে অ্যাংকাস্টারের পথে।

.

ব্লাইদ শহরে বাস করতো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড নামে এক দুর্দান্ত সাহসী লোক। চামড়া রঙ করা ছিল তার পেশা। যেমন সাহস, তেমনি গায়ের জোর ছিল লোকটার। কুস্তি ও লাঠি খেলায় আশেপাশে জুড়ি ছিল না তার। কুস্তিতে পাঁচ বছর ছিল সে মিডকান্ট্রি চ্যাম্পিয়ান। একবার লিংকনের অ্যাডামের সাথে লড়তে গিয়ে পাঁজরের একটা হাড় ভেঙে যাওয়ায় কুস্তি ছেড়ে দিয়ে লাঠিকেই আঁকড়ে ধরেছে সে আরো জোরে শোরে। আজ পর্যন্ত আধঘন্টার বেশি কেউ টিকতে পারেনি ওর সাথে লাঠি খেলায়। লাঠি ছাড়া আর একটি ব্যাপারে ছিল তার দারুণ পারদর্শিতা গভীর চাঁদনি রাতে তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়তো সে জঙ্গলে, পায়ের ছাপ দেখে দেখে চিনে বের করতো হরিণের ডেরা, আশেপাশে জঙ্গল-রক্ষী না থাকলে এক-আধটা মেরে নিয়ে যেত বাড়িতে। যদিও ধরতে কোনদিন পারেনি, সন্দেহ ঠিকই করতো, বছরের এই সময়টায় তীক্ষ্ণ নজর রাখতো জঙ্গল রক্ষীরা ওর গতিবিধির ওপর।

লিটল জন যেদিন কাপড় কিনতে রওনা হলো তার আগের দিন গোটা দশেক গরুর পাকা চামড়া বিক্রি করতে গিয়েছিল আর্থার নটিংহাম শহরে। লিটল জন যেদিন ভোরে উঠে আবার রওনা দিল অ্যাংকাস্টারের পথে, সেদিন সে-ও একই পথ ধরে ফিরছে ব্লাইদ শহরে-হাতে প্রিয় লাঠি, মাথায় ডবল চামড়া দিয়ে তৈরি খুবই শক্ত এক টুপি।

পথের ওপর এক জায়গায় হরিণের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়ে থমকে দাড়ালো আর্থার। ‘সাথে ধনুক অবশ্য নেই,’ মনে মনে বললো সে। কিন্তু শুধু কি মারতেই? ওদের দেখতেও তো মজা।’ এই বলে রাস্তা ছেড়ে পায়ের চিহ্ন অনুসরণ করে জঙ্গলে ঢুকলো সে। এ-ঝোপ ও-ঝোপের আড়ালে উঁকি ঝুঁকি মারতে মারতে পায়ের দাগ ধরে এগোলো আর্থার, মনের মধ্যে আশার পুলক-এই বুঝি দেখা মেলে সুন্দর একপাল হরিণের।

এদিকে হাঁটছে আর ভোরের প্রাকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে লিটল জন, গুন গুন করে গান গাইছে এক-আধ কলি। মে সকালের বাতাসে আজ মিষ্টি বুনো ফুলের সুবাস, ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা ক্র্যাব ট্রী, শিশির ভেজা ঘাসের উপর থেকে লাফিয়ে উঠে শূন্যে ঝুলছে লার্ক পাখি-হলুদ রোদ লেগে ঝলমল করছে পাখা, আকাশ থেকে সুধা বর্ষণ করছে তার মিষ্টি সুরেলা গান। কপাল খারাপ, হাঁটতে হাঁটতে আর্থার এ ব্ল্যাণ্ডের কাছাকাছি এসে পৌঁছলো সে, ঝোপঝাড় নড়ার খশ খশ আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালো। ভাল করে লক্ষ্য করতেই খয়েরি চামড়ার টুপি দেখতে পেল সে আর্থারের।

‘করে কি ব্যাটা!’ বিড় বিড় করে বললো লিটল জন। ‘এরকম উঁকিঝুঁকি মারার কি অর্থ? নিশ্চয়ই ব্যাটা হরিণ-চোর। হাতে নাতে ধরতে হয় তো ব্যাটাকে!’ রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকলো সে-ও, অনুসরণ করে চললো আর্থারকে।

বহুক্ষণ ধরে চললো এই রকম-লিটল জন পিছু নিয়েছে আর্থারের, আর আর্থার পিছু নিয়েছে হরিণের। হঠাৎ একটা শুকনো ডাল মাড়িয়ে ফেললো লিটল জন, মট্ করে ভাঙলো ডালটা। সাথে সাথেই পাঁই করে ঘুরে দাঁড়ালো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড।

সিধে হয়ে দাঁড়ালো লিটল জন। হেঁড়ে গলায় হাঁক ছাড়লো, ‘অ্যাই! কে তুমি? চোরের মত উকিঝুঁকি মেরে কি করা হচ্ছে? মতলবটা কি? চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে শয়তানের ধাড়ি!’

কথা শুনে রেগে গেল আর্থার। যদিও হঠাৎ ওর কয়েক হাত পেছনেই এরকম দৈত্যের মত লোক দেখে একটু চমকে গিয়েছিল প্রথমে, কিন্তু সামলে নিল দ্রুত। কারো হাঁক-ডাকে দমবার পাত্র সে নয়। তুমিই বা কি করছো শুনি?’ জানতে চাইলো সে। আর চেহারাটা আমার যেমনই হোক না কেন, জেনে রাখো, তোমাকেও তার চেয়ে ভালো কিছু দেখাচ্ছে না

‘বেশি বড় কথা মানাচ্ছে না ছোট মুখে,’ বললো লিটল জন। ‘জঙ্গল রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে আমার ওপর। কি করছো এখানে, জবাব দাও। সন্তোষজনক উত্তর দিতে না পারলে পিটিয়ে লাশ করবো আজ তোমাকে।’

‘তাই নাকি?’ টিটকারির সুরে জানতে চাইলো আর্থার। তা একা তোমার পক্ষে তো সেটা সম্ভব হবে না, আরো যদি কেউ থাকে, ডেকে নিয়ে এসো তাদের।’

‘আমি একাই একশো!’ হাঁক ছাড়লো লিটল জন। ‘তোমাকে পেটাতে কারও সাহায্যের দরকার পড়বে না আমার।’

‘পড়বে হে, পড়বে। পিট্টি খেলে বাপ-চাচা যত আছে সবাইকে ডাকতে শুরু করবে তারস্বরে। আশে পাশে তাদের কেউ না থাকলে শেষ পর্যন্ত জানে বাঁচাবে কে তোমাকে? লাঠিটা একবার ধরলে আবার হুঁশ থাকে না আমার।’

ভুরু কুঁচকে ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করলো লিটল জন। বললো, ‘পাগল নাকি ব্যাটা! যাই হোক, পাগলই হও আর ছাগলই হও, অনেক বড় কথা উচ্চারণ করে ফেলেছো-আজ তোমার রক্ষা নেই। এমন রাম প্যাদানি দেব আজ, বাপের নাম ভুলে যাবে, ডাকতে গিয়ে দেখবে নাম মনে নেই কারও। ঠিক আছে, ধরো দেখি লাঠি, দেখা যাক কতক্ষণ হুঁশ থাকে।’

‘বেশ!’ লাঠি হাতে তৈরি হলো আর্থার। কাজেই পুরুষের পরিচয়, কথা দিয়ে ছুঁচোও মারা যায় না। তবে আগেই সাবধান করে দিচ্ছি তোমাকে, বাপু, আমার নাম আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড, হাড়গোড় কিন্তু আস্ত রাখবো না।’

‘সে দেখা যাবে!’ রাগে পিত্তিটা জ্বলে গেছে লিটল জনের, কিন্তু তাই বলে লড়াইয়ের নিয়ম ভোলেনি। বললো, দাঁড়াও, তোমার চেয়ে আমার লাঠিটা দেড় ফুট বেশি লম্বা, মাপ দিয়ে আগে কেটে ফেলি বেশিটুকু।

‘কোন দরকার নেই তার,’ জবাব দিল আর্থার। আরো দেড় ফুট বড় হলেও আমার কোন অসুবিধে নেই। এসো!’ আর কথা না বাড়িয়ে লাঠির মাঝামাঝি জায়গা দু’হাতে শক্ত করে ধরে ধীর পায়ে এগোল দু’জন দু’জনের দিকে। দুজনের চোখেই ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ, পারলে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে একে অপরকে।

.

এদিকে রবিন হুডের কানে পৌঁছে গেছে লিটল জনের গাফিলতির কথা। নির্দেশ মত অ্যাংকাস্টারে না গিয়ে ব্লু বোর সরাইখানায় আমোদ-ফুর্তি করে রাত কাটিয়েছে লিটল জন, এই খবর পেয়েই রক্ত চড়ে গেল তার মাথায়। ‘দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি!’ বলে ভোরবেলাই বেরিয়ে পড়লো সে ব্লু বোরের উদ্দেশে। আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন! রাগের মাথায় হন হন করে হাঁটছে, আর মনে মনে কড়া সব বাক্য রচনা করে চলেছে একের পর এক। সামনে পেলে হয়, ধুয়ে ফেলে দেবে আজ সে লিটল জনকে। ব্লু বোরে গিয়ে লিটল জনকে না পেয়ে ছুটলো সে অ্যাংকাস্টারের পথ ধরে। গায়ের ঝাল ঝাড়তে না পারলে কিছুতেই শান্তি আসছে না মনে। বেশ অনেকটা পথ চলার পর জঙ্গলের মধ্যে থেকে চড়া গলার বাকবিতণ্ডা কানে এলো ওর। ঝগড়া করছে দু’জন লোক ধমকের সুরে।

‘আরে!’ থমকে দাঁড়ালো রবিন হুড। আমাদের লিটল জনের গলা না?’ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো সে। ‘নাহ, অপর কণ্ঠস্বরটা চেনা যাচ্ছে না। জঙ্গল-রক্ষীদের হাতে পড়লো না তো আবার ব্যাটা? দেখতে হয়!’

লিটল জন বিপদে পড়েছে ভেবে কর্পূরের মত উবে গেল রবিনের সব রাগ। অতি সন্তর্পণে ঝোপ ঝাড়ের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গেল সে উত্তেজিত কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে। কাছাকাছি এসে আলগোছে একটা ঝোপের কিছু পাতা একপাশে সরাতেই দেখতে পেল সে লাঠি হাতে ধীর পায়ে এগোচ্ছে দু’জন দু’জনের দিকে।

‘আচ্ছা!’ মনে মনে বললো রবিন হুড, ‘চমৎকার একটা খেলা জমেছে দেখা যাচ্ছে! কসম খোদার, তিনটে সোনার গিনি দেব আমি লোকটাকে, যদি আচ্ছামত পিট্টি দিতে পারে ওই বদমাশকে। খুবই খুশি হতাম আমি তাহলে, কিন্তু…সেটা কি সম্ভব? এমন একটা ঘটনা চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য কি হবে আমার? দেখা যাক, বাগাড়ম্বর দেখে তো মনে হয় এ-ও কম যাবে না।’ এই বলে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো সে মাটিতে।

গোল হয়ে ঘুরছে দু’জন একে অপরের চোখে চোখ রেখে, দুজনেই সুযোগ খুঁজছে অপরের অন্যমনস্কতার, সামান্যতম দুর্বলতা পেলেই আঘাত করবে সেখানে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ প্রতিপক্ষের পদক্ষেপে সামান্য একটু দুর্বলতার আভাস পেয়ে প্রথম আঘাত হানলো লিটল জন তড়িৎ বেগে। খটাশ করে আটকে দিল আর্থার সে-আঘাত, এবং সাথে সাথেই পাল্টা আঘাত করলো। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। লাফিয়ে সামনে যাচ্ছে, পিছনে আসছে, ডাইনে যাচ্ছে, বাঁয়ে আসছে দু’জন; পটাপট লাঠির বাড়ি পড়ছে এত জোরে আর এত দ্রুত যে দূর থেকে কেউ শব্দ শুনলে মনে করবে একসাথে মারামারি করছে এক ডজন লোক। ঝাড়া তিরিশ মিনিট ধরে তুমুল লড়াই করে চললো দু’জন, দাপাদাপিতে চষা জমির মত অবস্থা হলো মাটির, লাঙল টানা বলদের মত ফোঁস ফোঁস শ্বাস পড়ছে। দু’জনই মার খাচ্ছে, সুযোগ পেলে কেউ কাউকে ছাড়ছে না, কিন্তু বেশির ভাগ মার পড়ছে লিটল জনের ভাগে, কারণ গভীর রাত পর্যন্ত জেগে আকণ্ঠ মদ খেয়ে শরীরের অবস্থা তার খুব ভাল নয়, তার ওপর রবিনের ভয়ে খুব ভোরে উঠে কিছু মুখে না দিয়েই বেরিয়ে পড়েছে সে অ্যাংকাস্টারের পথে।

একটা করে মার খায় লিটল জন, আর হাসি ফুটে ওঠে রবিনের মুখে। এখনো নিশ্চিত সে, শেষ পর্যন্ত জয় হবে লিটল জনেরই। কারণ, নিজেও পাকা লাঠিয়াল রবিন, আর্থারের খেলার মধ্যে ছোটখাট দু’একটা ত্রুটি যখন ওর চোখে ধরা পড়ছে; ও জানে, ওর চেয়ে অনেক গুণে বেশি পাকা লাঠিয়াল লিটল জনের চোখে দোষগুলো ধরা পড়বেই, ঠিক সময় মত সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে সে। কিন্তু আরো কিছুক্ষণ দেখার পর টের পেল রবিন, আসলে ওগুলো ত্রুটি নয় আর্থারের, ইচ্ছেকৃত ভাবে তৈরি ফাঁদ। একবার একটা ভুলের সুযোগ নিতে গিয়ে বেমক্কা মার খেয়ে মাটিতে পড়ার দশা হলো লিটল জনের, বহু কষ্টে সামলে নিল সে নিজেকে। মনে মনে হাজারবার বাহবা দিল রবিন আর্থারকে।

কিন্তু ঝানু লেঠেল লিটল জন, সুযোগ সে ঠিকই বের করে নিল একবার। ফাঁক পেয়ে প্রচণ্ড জোরে শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে আঘাত করলো সে প্রতিপক্ষের মাথায়। ঐ আঘাত খেয়ে তাগড়া জোয়ান ষাঁড়েরও হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাঁচিয়ে দিল ওকে ওর মাথার ডবল চামড়ার টুপি। টাল সামলাতে গিয়ে উল্টোপাল্টা পা ফেলে কয়েক হাত পিছনে সরে যেতে হলো আর্থারকে। যদি সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে আরো আঘাত করতো লিটল জন, তাহলে জয় ছিল ওর সুনিশ্চিত, কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি সে এই আঘাতের পরেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারে কোন মানুষ। যখন দেখলো দু’পায়ের ওপরই খাড়া আছে লোকটা এখনো, এগিয়ে গেল সে, কিন্তু ততক্ষণে সামলে নিয়েছে আর্থার, লিটল জন কাছে আসতেই কড়াৎ করে মেরে দিলো মোক্ষম মার। মার খেয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল লিটল জন, হাত ফসকে ছিটকে দূরে চলে গেল লাঠি। এগিয়ে এসে কষে আরেক বাড়ি লাগালো আর্থার ওর পাঁজরে।

‘দাঁড়াও!’ চেঁচিয়ে উঠলো লিটল জন। ‘পড়ে যাওয়া মানুষকেও মারবে তুমি?’

‘নিশ্চয়,’ আরেক বাড়ি লাগালো আর্থার। ‘পড়ে যাওয়া না বলে বলো ফেলে দেয়া প্রতিপক্ষকে মারবো কিনা। নিশ্চয় মারবো, একশোবার মারবো। তুমি হলেও তাই করতে।

‘থামো! থামো, প্লীজ!’ আর্তনাদ করে উঠলো লিটল জন। হার মানছি। হার মেনে নিচ্ছি আমি!’

‘পিট্টিটা যথেষ্ট হয়েছে বলে মনে করো?’ খুশি খুশি গলায় জানতে চাইলো আর্থার। আবার তুললো লাঠি।

‘যথেষ্ট, যথেষ্ট! সত্যি বলছি, যথেষ্ট হয়েছে।’

‘উচিত শিক্ষা হয়েছে তোমার? ঠিক জানো?’ হালকা করে আরেক বাড়ি লাগালো সে লিটল জনের পিঠে।

‘হয়েছে। দোহাই তোমার, হার মেনে নিয়েছি আমি।’

‘হুম। মেনে নিচ্ছো যে আমি তোমার চেয়ে ভাল লাঠিয়াল?’

‘মেনে নিচ্ছি। সর্বান্তঃকরণে। ব্যাটা পাজির পা-ঝাড়া কোথাকার!’ প্রথম অংশটুকু জোরে, শেষের অংশটুকু নিজের দাড়িকে শুনিয়ে বললো লিটল জন।

‘ঠিক আছে। এবার সিধে রাস্তায় নিজের কাজে চলে যাও। খোদার কাছে হাজার শোকর করো যে খুবই দয়ালু এক লোকের পাল্লায় পড়েছিলে আজ। যাও, ছেড়ে দিলাম।’

‘তোর দয়ার নিকুচি করেছি আমি!’ বিড় বিড় করে বললো লিটল জন।

‘কি বললে?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো আর্থার।

‘না, বলছিলাম কি, মনে হচ্ছে চুর চুর হয়ে গেছে পাঁজরার হাড়গুলো। আমার ধারণা ছিল গোটা নটিংহামশায়ারে আমার সমান লাঠিয়াল আর একজনও নেই।’

‘আমারও তাই ধারণা ছিল,’ বলেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো রবিন হুড। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা হয়েছে ওর, পানি এসে গেছে চোখে। ‘বাহবা, বাহবা! কী মার!’ হতভম্ব আর্থারের হাতে তিনটে গিনি গুঁজে দিলো সে। ‘কাজের কাজ করেছো, ভাই, একটা!’ ফিরলো লিটল জনের দিকে। ‘পুরোটা মারপিট প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখেছি আমি ওই ওখানে শুয়ে শুয়ে। বেড়ে মার খেয়েছো, যাই বলো। এক্কেবারে হামাগুড়ি দিইয়ে ছেড়েছে। তোমাকে খুঁজছিলাম আমি কিছুটা ঝাল ঝাড়বো বলে, আমার নির্দেশ অমান্য করার জন্যে নতুন নতুন গালাগালি তৈরি করতে করতে ছুটছিলাম তোমার পিছন পিছন। কিন্তু এই পরম দয়ালু ব্যক্তিটি সব সাধ মিটিয়ে দিয়েছে আমার। তোমার যা পাওনা কড়ায় গণ্ডায়, সুদে আসলে মিটিয়ে আরও কিছু বেশি দিয়ে দিয়েছে।’

উঠে বসেছে লিটল জন, মুখের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে চিরতার পানি খাওয়ানো হয়েছে ওকে দুই গ্লাস। আর্থারের দিকে ফিরলো আবার রবিন হুড। ‘তোমার নামটা কি, ভাই?’

‘লোকে আমাকে আর্থার এ ব্যাণ্ড বলে ডাকে,’ বললো আর্থার। ‘তোমার নাম কি? আর এই গিনি দেয়ারই বা কি অর্থ?’

‘পুরস্কার বা মজুরী, যাই বলো-ওটা তোমার। একে কষে পিট্টি লাগাতে পারলে তোমাকে দেব বলে ঠিক করেছিলাম মনে মনে,’ ভুরু কুঁচকে চিন্তা করলো রবিন। ‘কি বললে? আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড? আরে, তোমাকে তো আমি চিনি বলে মনে হচ্ছে। গত অক্টোবরে ইলির মেলায় তুমি নটিংহামের জকের চাঁদি ফাটিয়ে দিয়েছিলে না? ওই জক হচ্ছে আমাদেরই এক লোক, উইল স্কেদলক। কিন্তু আজ তুমি যা দেখালে তার তুলনা নেই। এই যে ভদ্রলোক, মাটিতে বসে গা-হাত-পা টিপছেন, চেনো একে? আজ একটু বেকায়দায় পেয়ে মারধোর করেছো বটে, কিন্তু সারা ইংল্যাণ্ডে লাঠি খেলায় এর জুড়ি নেই। সত্যিই নেই। এর নাম লিটল জন। আমি রবিন হুড।’

‘অ্যা!’ ছানাবড়া হয়ে গেল আর্থারের চোখ দুটো। ‘তু-তুমিই সেই মহান রবিন হুড? আর এ সেই বিখ্যাত লিটল জন-যাকে আমি পীরের মত ভক্তি করি? ছি, ছি, ছি,. ছি! পরিচয়টা আগে জানলে তোমার বিরুদ্ধে লাঠি ধরার দুঃসাহস হতো না আমার,’ ছুটে গেল সে লিটল জনের পাশে। সাহায্য করার জন্যে হাত বাড়ালো। ‘এসো, ভাই লিটল জন, ওঠো, জামা কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে দিচ্ছি আমি।’

‘থাক, থাক-লাগবে না. আমি নিজেই উঠতে পারবো, ঝাঁঝিয়ে উঠলো লিটল জন। সাবধানে উঠে দাঁড়ালো। এতই সাবধানে, যে দেখে মনে হচ্ছে ওর হাড়গোড় সব কাঁচ দিয়ে তৈরি, ভেঙে যেতে পারে যখন-তখন। ব্যথায় বিকৃত চোখ মুখ। বললো, ‘খেলেছো ভাল, তবে জেনে রাখো, মাথায় ওই চামড়ার টুপিটা না থাকলে কপালে খারাবী ছিল আজ তোমার।’

লিটল জনের আড়ষ্ট নড়াচড়ার নমুনা দেখে আর এক পেট হাসলো রবিন, তারপর ফিরলো আর্থারের দিকে।

আমাদের দলে যোগ দেবে, আর্থার? তোমার মত সাহসী লোকের দরকার আছে আমার। আসবে আমাদের সাথে?’

‘নেবে আমাকে?’ লাফিয়ে শূন্যে উঠলো আর্থার এ ব্ল্যাণ্ড। ‘যোগ দেব না মানে? একশোবার যোগ দেব। তোমাদের ওই মুক্ত জীবন তো আমার স্বপ্নের জীবন। দুর্গন্ধের মধ্যে বসে চামড়ার কাজ করি, সেটা আমার ভালো লাগে মনে করেছো? মোটেও না। তোমার অনুচর হতে পারা আমার জন্যে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

আবার লিটল জনের দিকে ফিরলো রবিন। মুখে মৃদু হাসি। ‘সোজা অ্যাংকাস্টারের পথে রওনা হয়ে যাও, বাছা। যাতে ডাইনে-বাঁয়ে অন্য কোনদিকে যেতে না পারো সেজন্যে আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে। ব্লু বোর ছাড়াও আরো অনেক সরাইখানা আছে শেরউডে। বলা যায় না, সেগুলো হয়তো আবার হাতছানি দিয়ে ডাকবে তোমাকে, তাই একেবারে জঙ্গল পার করে দিয়ে তারপর ফিরবো আমরা ডেরায়।

রাস্তায় ফিরে এসে হাঁটতে শুরু করলো তিনজন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *