১১. সন্ন্যাসী টাক

১১. সন্ন্যাসী টাক

অ্যালান-এ-ডেলের বিয়ের বেশ কিছুদিন পরের কথা। একদিন ঘুম থেকে উঠে দিনটা এত চমৎকার লাগলো রবিনের কাছে যে সবাইকে ডেকে ঘোষণা করে দিল, ‘আজ কারও কোন কাজ নেই, ছুটি!’

ঝলমলে রোদ উঠেছে পরিষ্কার নীল আকাশে, অনেক বেশি সবুজ মনে হচ্ছে জঙ্গলটা, মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে বিশাল সব ওকের প্রকাণ্ড শাখাগুলো, নিচে সবুজ ঘাসের উপর চলেছে ঝিলিমিলি আলোছায়ার খেলা- বাচ্চা ছেলের মত নেচে উঠলো সবার মন।

খেলাধুলায় মেতে উঠলো সবাই। কেউ দৌড়াচ্ছে, কেউ লাফাচ্ছে; কেউ মেতে গেছে কুস্তিতে, কেউ লাঠি খেলায়; কেউ নাচছে, কেউ গাইছে—যার যা খুশি। কয়েকটা দল তীর-ধনুক নিয়ে বেরোলো হরিণ শিকারে। এই রকম একটা দলের সাথে বেরিয়ে পড়লো রবিনও। লিটল জন, মাচ আর উইল স্কারলেট রয়েছে এই দলে। হঠাৎ পাঁচশো ফুট দূরে একটা সবুজ মাঠে চরতে দেখা গেল একদল হরিণকে। ইচ্ছে করলেই আরো বেশ অনেকটা কাছে যাওয়া যায় হরিণগুলোর, কিন্তু কি মনে করে চ্যালেঞ্জ করে বসলো রবিন, ‘দেখি এতদূর থেকে এক তীরে হরিণ ফেলতে কে পারে।’

বলতে না বলতেই একসাথে তীর ছুঁড়লো তিনজন। একটা বাচ্চা হরিণ পড়লো উইল স্কারলেটের তীরে, মাচের তীরে পড়লো বড়সড় একটা হরিণী, কিন্তু লিটল জনের তীরে ঘায়েল হলো পৌনে দুশো গজ দূরের এক মস্ত শিংওয়ালা তাগড়া হরিণ।

প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো রবিন লিটল জনের কৃতিত্বে। ‘বাহ! দারুণ দেখিয়েছো, লিটল জন! তোমার জুড়ি নেই। যদি খবর পেতাম, একশো মাইল দূরে রয়েছে তোমার সমান এক তীরন্দাজ, আমি হেঁটে গিয়ে ডেকে আনতাম তাকে।’

কথাটা শুনে হেসে উঠলো উইল স্কারলেট।

‘হাসছো যে?’ জানতে চাইলো রবিন।

‘এক মজার লোকের কথা মনে পড়লো, তাই। লিটল জনের জুড়ি খুঁজতে একশো মাইল যাওয়ার দরকার নেই, মামা; তার চেয়ে অনেক কাছেই রয়েছে একজন।’

‘তাই নাকি? কোথায়? কে সে?’

‘ফাউন্টেন্‌স অ্যাবিতে থাকে এক মস্ত মোটা সন্ন্যাসী, নাম-সন্ন্যাসী টাক,’ বললো উইল স্কারলেট। ‘ধনুক প্রতিযোগিতায় লিটল জনকে হারাতে তো পারবেই, বলা যায় না, হয়তো তোমাকেও হারিয়ে দেবে।’

‘কথাটা জেনে বলছো, না শুনে?’ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো রবিন।

হাসছে উইল স্কারলেট। বললো, ‘জেনে। ইচ্ছে করলে তুমি নিজেও জেনে নিতে পারো। তবে, একটু উদ্ভট ধরনের লোক, তুমি ডাকলেই সুড়সুড় করে চলে না-ও আসতে পারে।’

কথাটা শুনেই মনস্থির করে ফেললো রবিন হুড-যেমন করে হোক, এই লোককে ভিড়াতে হবে নিজের দলে। কিছুদিন থেকে মনে মনে একটা অভাব অনুভব করছিল সে, উইল স্কারলেটের কথায় হঠাৎ পরিষ্কার বুঝতে পারলো অভাবটা ঠিক কিসের। ওদের আস্তানায় উপাসনার কোন ব্যবস্থা নেই। ধরা পড়ার ভয়ে শহরের গির্জাতেও যেতে পারে না ওরা। এই রকম চলতে থাকলে ক্রমে অধর্ম ঢুকবে ওদের মধ্যে। নিজেদের একজন পুরোহিত থাকলে এই সেদিন অ্যালান-এ-ডেলের বিয়েতে এত হাঙ্গামা করার কোন দরকারই পড়তো না। সত্যিই একজন পুরোহিত দরকার ওদের, আর সে-লোক যদি লডুয়ে মেজাজের হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। যেমন করে হোক সন্ন্যাসী টাককে তার চাই।

তৈরি হয়ে নিল রবিন। আর দেরি না করে আজই খুঁজে বের করবে সে মোটা সন্ন্যাসীকে। ইস্পাতের কর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে রওনা হয়ে গেল সে ফাউন্টেনস অ্যাবির উদ্দেশে, কয়েকজন অনুচরকে সাথে নিল। উইল স্টিউটলির হাতে দিয়ে গেল ওর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্বের ভার।

হাঁটতে শুরু করলো ওরা জংলা পথ ধরে। মাঝে মাঝে ছোট ঝর্ণা পড়ছে পথে, হঠাৎ দেখা হয়ে যাচ্ছে একদল হরিণের সাথে, ভয় পেয়ে ছুটে চলে যাচ্ছে তারা শুকনো পাতা মাড়িয়ে; কখনো ঘন হয়ে আসছে জঙ্গল, আবার কখনো হালকা। হাসি, গল্প আর গানে মশগুল হয়ে চলেছে ওরা, কখন দুপুর গড়িয়ে গেছে খেয়াল নেই।

বিকেলের দিকে শান্ত একটা রূপালী নদীর ধারে এসে পৌঁছলো ওরা। তীর ঘেঁষে সরু একটা রাস্তা তৈরি হয়েছে গুণ-টানা ঘোড়ার পায়ের চাপে। সুদূর পল্লী অঞ্চল থেকে মস্ত সব মালবাহী নৌকো টেনে নিয়ে যায় ওরা শহরের বাজারে। কিন্তু এখন গোটা এলাকা নির্জন, নিশ্চুপ। হাঁটছে ওরা, দু’চোখ ভরে দেখছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। মৃদু বাতাসে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে পানিতে, ফড়িংগুলো স্থির হয়ে বাতাসে ভেসে থাকতে থাকতে হঠাৎ তীর বেগে ছুটছে যেদিক খুশি, ঝুপ করে পানিতে পড়ছে মাছরাঙা- পরমুহূর্তে ছোট্ট একটা মাছ ঠোঁটের ফাঁকে নিয়ে উড়ে গিয়ে বসছে কোনও ডালে।

ফাউন্টেনস অ্যাবির কাছাকাছি পৌঁছে সঙ্গীদের অপেক্ষা করতে বলে একা এগিয়ে চললো রবিন হুড। কিন্তু প্রথম বাঁকটা নিয়েই থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। কথা বলছে যেন কারা। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো রবিন। কাছেই কোথাও সরস কথোপকথন হচ্ছে দু’জনের মধ্যে, কিন্তু অবাক হয়ে গেল সে দু’জনের কণ্ঠস্বরের আশ্চর্য মিল দেখে। আওয়াজটা আসছে নদীর তীরের কয়েকটা ছোট-ছোট ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে।

‘আশ্চর্য! ব্যাপারটা কি একটু দেখতে হয়!’ মনে মনে ভাবলো রবিন, তারপর পা টিপে নদীর খাড়া পাড়ের কাছে এসে শুয়ে পড়লো ঘাসের উপর; একটা ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিল নিচের দিকে।

মস্ত এক ওয়াটার-উইলো গাছ দাঁড়িয়ে আছে নদীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে, চমৎকার ছায়া পড়েছে তার নিচে। সেই ছায়ায় সবুজ ঘাসের ওপর বসে গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে রয়েছে বিশাল মোটা বেঁটে-খাটো এক লোক। দ্বিতীয় লোকটিকে দেখা গেল না কোথাও। মোটা লোকটার মাথাটাও প্রকাণ্ড, এবং ঠিক একটা ফুটবলের মত গোল। এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত কপালের উপর আর ঘাড়ের পিছনটায় কোঁকড়া কালো চুল, কিন্তু চাঁদিটা হাতের তালুর মত পরিষ্কার। মুখ ভর্তি কালো কোঁকড়া দাড়ি। বিশাল মোটা ঘাড়টা রয়েছে তেমনি বিশাল এক কাঁধের উপর। ঢোলা পোশাক, খুলে রাখা মঠবাসীর টুপি, জপমালা আর মাথার টাকটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে লোকটা একজন সন্ন্যাসী, এ ছাড়া চেহারা-সুরতের আর কোথাও ধর্মীয় কিছুর ছাপ নেই-যে-কেউ দেখলে এক কথায় বলবে ভয়ঙ্কর এক ডাকাত। ঘন কালো একজোড়া ভূর নিচে ক্ষুদে একজোড়া চঞ্চল চোখ, দেখে মনে হয় প্রতিমুহূর্তে মজার কিছু ঝিলিক দিচ্ছে ওর মাথার ভেতর। ইস্পাতের শিরস্ত্রাণটা পাশে খুলে রেখে পা ছড়িয়ে বসে আছে লোকটা, দুই হাঁটুর ওপর রাখা মস্ত এক পাত্র থেকে বাম হাতে বড় বড় মাংসের টুকরো তুলছে আর টপাটপ মুখে পুরছে, ডান হাতে ধরা পাঁউরুটিতে মাঝে মাঝে একটা করে কামড় বসাতে ভুলছে না। খানিক পর পর বড়সড় একটা মদের বোতল মুখে তুলে ভিজিয়ে নিচ্ছে গলাটা।

‘সর্বনাশ!’ মনে মনে বললো রবিন। ‘এ যে আস্ত এক রাক্ষস দেখছি! আর কি তৃপ্তির সঙ্গেই না খাচ্ছে! যতদূর মনে হয় আর কেউ নেই, এই লোকই কথা বলছিল নিজের সাথে নিজে। একে জিজ্ঞেস করলে হয়তো জানা যাবে কোন্ দিকে থাকে সন্ন্যাসী টাক।’

চুপচাপ শুয়ে লক্ষ রাখলো রবিন সন্ন্যাসীর ওপর, আর আপন মনে হাপুস-হুপুস খেয়ে চললো সন্ন্যাসী। হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে কথা বলে উঠলো সন্ন্যাসী। ‘ছি ছি, তুমি দেখছি মোটেই খাচ্ছো না! এভাবে কদিন শরীর টিকবে বলো? কদিন বাঁচবে? দাও দেখি, রুটিটা এবার আমার হাতে দাও, তুমি বরং খানিক মাংস মুখে তোল।’ বলেই ডান হাত থেকে বাম হাতে নিল সে রুটিটা, মুক্ত ডান হাত চালালো মাংসের পাত্রে। মুখে বললো, ‘ধন্যবাদ, বন্ধু, দু’জনের রুটি একা খেতে পারছিলাম না, এবার খানিক মাংস খেয়ে স্বাদ পাল্টানো যাক।’

বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল রবিনের চোখ। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হাসি ফুটে উঠলো ওর মুখে। বেশি খাওয়া ভাল না, তাই নিজেকে দুই ভাগ করে নিয়েছে সাধুটা; সাধাসাধি করে একে অন্যকে খাওয়াচ্ছে পুরো একজনের খাবার। খাওয়া-দাওয়া শেষ হতেই নরম লতাপাতায় হাত মুছে মদের বোতলটা তুলে নিল সে একহাতে।

‘দেখো, যুবক, বলছে সন্ন্যাসী নিজেকে, ‘তোমার মত চমৎকার মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। যেমন সুন্দর তুমি দেখতে, তেমনি সুন্দর তোমার মন। তোমাকে ভালবাসি আমি, বিশ্বাস করো, দুনিয়ার কোন প্রেমিক তার প্রিয়াকে এতটা ভালবাসতে পারবে না।…এই নির্জনে এসব কথা বলে কেন মিছেমিছি লজ্জায় ফেলছো, ভাই! তবে, কেউ যখন কাছেপিঠে নেই, আমার মনের কথাটাও জানিয়ে দিই এই ফাঁকে : আমিও তোমাকে ভালবাসি, ঠিক তুমি যতটা ভালবাসো ততটাই। …তা বেশ তো, এই কথার ওপর দু’ঢোক পান করা যাক। কি বলো? না, না, কোনো কথা শুনছি না, আগে তুমি। তোমার পর খাবো আমি।’ এই বলে ডান হাত থেকে বাম হাতে নিল সে বোতলটা। …ঠিক আছে, তুমি যখন ছাড়বেই না, কি আর করা! তোমার সুস্বাস্থ্য আর দীর্ঘায়ু কামনা করছি।’ বড় করে দু’ঢোক খেয়ে বোতলটা প্রায় অর্ধেক করে ফেললো সাধু, তারপর বললো, ‘এবার ভাই, তুমি।’ আবার ডান হাতে চলে এলো বোতলটা। …আমিও মন-প্রাণ দিয়ে তোমার সুস্বাস্থ্য আর দীর্ঘায়ু কামনা করছি। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।’ এই বলে বোতলের বাকি মদটুকু দুই ঢোকে শেষ করে বোতলটা মাটিতে নামিয়ে রাখলো মোটা সন্ন্যাসী।

নিঃশব্দে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল রবিন হুডের। এক হাতে চেপে ধরে রেখেছে নিজের মুখ, পাছে শব্দ বেরিয়ে সচকিত করে দেয় লোকটাকে। উপুড় হয়ে শুয়ে ভূমিকম্পের মত কাঁপছে ওর সর্বশরীর।

আবার শুরু করলো সন্ন্যাসী, খাওয়া-দাওয়া তো হলো, এবার একটা গান শুনতে পেলে বেশ হতো। গাও না, ভাই, একটা গান? আরে, না। গান জানি না আমি। তাছাড়া গলাটা আজ ভাল নেই। দেখছো না কেমন কোলা ব্যাঙের মত আওয়াজ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে?—কে বলেছে ব্যাঙের আওয়াজ? আমার কাছে তো মনে হচ্ছে ফিঞ্চ পাখির মিষ্টি সুর। গাও, ভাই, শোনাও একটা গান। তোমার ওই গলার গান শুনলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতে পারবো আমি। প্লীজ, ধরো একটা গান।—তোমার নিজের এমন চমৎকার গলা, তোমার সামনে গাইতে কিন্তু সত্যিই লজ্জা করছে আমার, ভাই। ঠিক আছে, ধরেছো যখন, শোনাচ্ছি। কিন্তু তার চেয়ে ভাল হয়, যদি দুজনে একসাথে গাই।…বেশ তো, তুমি পুরুষের অংশটা গাও, আমি মেয়েদের অংশটা ধরবো। হ্যাঁ, সেই ভাল।’ এই বলে প্রথমে মোটা হেঁড়ে গলায় এক লাইন গাইলো, তারপর গলাটাকে যতটা সম্ভব চিকন করে উঁচু পর্দায় নিজেই ধরলো দ্বিতীয় লাইন।

নিজেকে আর সামলাতে পারলো না রবিন, হো হো করে হেসে উঠে পাড় বেয়ে নেমে এলো নিচে। কিন্তু কোনো দিকে খেয়াল নেই সন্ন্যাসীর, দুই চোখ বুজে গরুর মত চেঁচাচ্ছে সে—অর্থাৎ গান গাইছে। পুরো গানটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চোখ খুললো না। চোখ খুলেই রবিনকে হাসতে দেখে ঘন কালো ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠলো সন্ন্যাসীর। চট্ করে শিরস্ত্রাণটা মাথায় পরে নিয়ে গর্জে উঠলো সে, ‘অত হাসির কি হয়েছে শুনি?’

‘হাসি আসছে আপনার দুরবস্থার কথা ভেবে,’ বললো রবিন

‘দুরবস্থা?’

‘সে কথায় পরে আসছি, আগে বলুন দেখি, হোলি ফাদার, এদিকের এলাকাটা ভালমত চেনা আছে আপনার?’

‘আছে, মোটামুটি। কেন?’

‘ফাউন্টেনস অ্যাবি বলে একটা জায়গা কি চেনা আছে আপনার?’

‘আছে, মোটামুটি। কেন?’

‘ওই ফাউন্টেনস অ্যাবির সন্ন্যাসী টাককে খুঁজছি আমি। তার সাথে পরিচয় আছে আপনার?’

‘আছে, মোটামুটি। কেন?’

‘বলতে পারবেন, তাঁকে কোথায় পাবো? নদীর এপারে, না অপর পারে?’

‘তোমার হয়তো জানা নেই, বৎস, অপর পার ছাড়া নদীর আর কোন পার হয় না।’

‘তাই নাকি?’ অবাক হলো রবিন, ‘প্রমাণ করতে পারবেন?’

‘পানির মত,’ হাসলো সন্ন্যাসী। আঙুল তুলে অপর পারটা দেখালো। ‘ওই দিকটা যে অপর পার, মানো?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘অথচ ওই দিকটা হচ্ছে নদীর এক পার। কি, ঠিক বলেছি?’

‘এক্কেবারে ঠিক।’

‘কিন্তু ওটা যদি এক পার হয়, এদিকটা অপর পার। অথচ আগেই মেনে নিয়েছো যে ওই দিকটা অপর পার। অতএব, নদীর দুই পারই অপর পার। ইহাই প্রতিপাদ্য বিষয়, হুঁহ।’

‘চমৎকার!’ বললো রবিন। কিন্তু, ফাদার, আপনার এই যুক্তিতর্কে আমার কোন লাভ হচ্ছে না। আমি যে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়েছি। ঠিক আছে, প্রশ্নটা অন্যভাবে ঘুরিয়ে করছি। সন্ন্যাসী টাককে কি আমরা যে-পারে দাঁড়িয়ে আছি সেই পারে পাবো, না এই মুহূর্তে আমরা যে-পারে দাঁড়িয়ে নেই সেই পারে?’

এইবার বুদ্ধিমানের মত প্রশ্ন করেছো। কথার কারসাজি দিয়ে তোমার প্রশ্ন এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। তাকে এই মুহূর্তে কোন্ পারে পাবে তা বলতে পারবো না, তবে এটুকু বলতে পারি, তার মঠে যেতে হলে তোমাকে নদীটা পেরোতে হবে।’

‘আমিও তাই ভেবেছিলাম,’ বললো রবিন।

‘এবার বলো, হাসছিলে কেন?’

‘হাসছিলাম আপনার দুরবস্থার কথা ভেবে। এত চমৎকার পানাহার আর গান বাজনার পর কাপড় ভিজিয়ে নদী পেরোতে কি আপনার ভাল লাগবে?’

‘বুঝলাম না।

‘দেখতেই পাচ্ছেন, হোলি ফাদার, কি সুন্দর জামা-কাপড় পরে আছি আমি,’ বললো রবিন হুড। ‘এই কাপড় ভিজিয়ে নদী পেরোনো কি উচিত হবে? তাই আমি ঠিক করেছি, আপনার কাঁধে চড়ে পার হবো নদীটা।’

‘কী! এত বড় সাহস!’ কথা শুনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন জ্বলে গেল সন্ন্যাসীর। ‘এত বড় স্পর্ধা তোমার! আমাকে বলে কিনা…কি মনে করেছো তুমি নিজেকে? দাঁড়াও তোমাকে আমি, তোমাকে আমি…’

সড়াৎ করে তলোয়ারটা বের করলো রবিন খাপ থেকে। মুহূর্তে বোবা হয়ে গেল মোটা সন্ন্যাসী। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো রবিনকে। তারপর নিরুপায় অবস্থা বোঝাতে নাক-চোখ-মুখ কুঁচকে এমন বিদঘুটে ভঙ্গি করলো যে হাসি চেপে রাখা দায় হলো রবিনের পক্ষে।

বিনা বাক্যব্যয়ে নিচু হয়ে বসলো সন্ন্যাসী, খুশি মনে খোলা তলোয়ার হাতে তার বিশাল কাঁধে চড়ে বসলো রবিন। নদীর কোথাও কোমর পানির বেশি নেই, কিন্তু এখানে ওখানে পিচ্ছিল পাথর পড়ে থাকায় সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগোলো সন্ন্যাসী।

ওপারে পৌঁছে তড়াক করে নামলো রবিন সন্ন্যাসীর কাঁধ থেকে। ধন্যবাদ দেয়ার জন্যে ঘুরতে যাবে, এমন সময় ইস্পাত-কঠিন একটা হাত জড়িয়ে ধরলো ওকে, পরমুহূর্তে দেখতে পেল, ক্ষুরধার এক ছোরা ধরা রয়েছে ওর গলায়।

‘আরে! এ কি করছেন, হোলি ফাদার!’ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। ‘পাদ্রীদের রক্তপাত ঘটানো নিষেধ, জানা নেই আপনার?’

‘রক্ত যদি ঝরে, তুমি নিজেই দায়ী থাকবে তার জন্যে, বৎস,’ শান্ত গলায় বললো সন্ন্যাসী। ‘আমার কথা মত কাজ করলে একফোঁটা রক্ত বেরোবে না। কথা না শুনলে ঠিক তিন আঙুল ফাঁক করে দেব গলাটা।’

‘কি করতে হবে?’ জানতে চাইলো রবিন।

‘আমার জিনিসপত্র সব ওপারে রয়ে গেছে,’ বললো সন্ন্যাসী। ‘হাঁপিয়ে গেছি বড়ো, তোমার সাহায্য ছাড়া তো, বাছা, যেতে পারছি না ওপারে।’

এই বিশাল ধড় কাঁধে নিয়ে নদী পেরোবার কথা ভাবতেই গলাটা শুকিয়ে এলো রবিনের। কিন্তু পরিষ্কার বুঝতে পারছে, এ থেকে উদ্ধার পাওয়ারও কোন উপায় নেই। তীক্ষ্ণ ছোরাটা ঠেকে রয়েছে ওর কণ্ঠনালীতে। জোরাজুরি করে কোন লাভ নেই, শুধু গলার স্বরই নয়, সন্ন্যাসীর গায়ের জোরও ঠিক ষাঁড়ের মত।

বাধ্য হয়ে কাঁধে তুলে নিলো রবিন ভয়ঙ্কর রকমের ভারি সন্ন্যাসীকে। মড় মড় শব্দে প্রতিবাদ জানাচ্ছে পিঠের হাড়গুলো। বাঁকা হয়ে যেতে চাইছে শরীরটা। তার ওপর নদীর কোথায় খানা-খন্দ আর পিচ্ছিল পাথর রয়েছে জানা নেই ওর। টালমাটাল অবস্থায় এগোলো সে, পিছলে পড়ে যেতে গিয়ে অল্পের জন্যে বেঁচে গেল বারকয়েক। দরদর ঘাম ছুটলো ওর, হাঁ করে শ্বাস টানছে, মনে হচ্ছে প্রতি সেকেণ্ডে কয়েক পাউণ্ড করে বেড়ে যাচ্ছে সন্ন্যাসীর ওজন।

এদিকে রবিনের কাঁধে মহানন্দে বসে আছে সন্ন্যাসী। এক হাতে ধরে রেখেছে ওর চুলের মুঠি, পায়ের গোড়ালি দিয়ে পেটের কাছে খোঁচাচ্ছে, আর মুখে বলছে, ‘হ্যাট…হ্যাট, চু চু চু!’ শিশুর মত হাসছে প্রাণখোলা হাসি।

সব কষ্টেরই শেষ আছে। লাল হয়ে গেছে রবিনের মুখ, চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছলো সে অপর পারে। লাফ দিয়ে নামলো সন্ন্যাসী রবিনের কাঁধ থেকে। তীর বেয়ে ওপরে উঠতে যাবে, এমন সময় চট করে ওর একটা পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারলো রবিন। দড়াম করে মাটিতে আছড়ে পড়লো সন্ন্যাসী- এতই জোরে, যে মাথা থেকে ছিটকে ছয় হাত দূরে গিয়ে পড়লো শিরস্ত্রাণটা। একটানে তলোয়ারটা বের করলো রবিন আবার।

‘এই বার?’ তর্জনী দিয়ে কপাল আর ভুরু থেকে ঘাম ঝরিয়ে জানতে চাইলো রবিন, আবার আমাকে ওপারে দিয়ে আসবে, নাকি এক কোপে ফাঁক করে দেব টাকটা।’

‘দেবো, দেবো!’ চেঁচিয়ে উঠলো সন্ন্যাসী। রবিনের রুদ্রমূর্তি আর ঝকঝকে তলোয়ার দেখে মনে হলো রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছে সে।

আবার উঠলো রবিন সন্ন্যাসীর কাঁধে। পানিতে নামলো সন্ন্যাসী। নদীর মাঝামাঝি গিয়ে একটু থামলো মোটা সন্ন্যাসী। হাসি ফুটে উঠলো রবিনের মুখে, ভাবলো পিচ্ছিল পাথর পাশ কাটাবার জন্যেই এই বিরতি। কিন্তু হাসিটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁধ থেকে শূন্যে ছুঁড়ে দিল সন্ন্যাসী রবিনকে। ডিগবাজী খেয়ে হড়াশ করে পড়লো সে পানিতে। মাঝ-নদীতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে রবিন, কিন্তু সেটা দেখা কিংবা সাহায্য করার জন্যে দাঁড়ালো না সন্ন্যাসী, ফিরে গেল নিজের পারে।

সামলে নিয়ে রবিন যখন আবার দু’পায়ে খাড়া হলো দেখলো তীরে দাঁড়িয়ে হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে মোটা সন্ন্যাসী ওর চুপচুপে ভেজা করুণ অবস্থা দেখে। রাগে অন্ধ হয়ে গেল রবিন হুড। ‘দাঁড়াও! দেখাচ্ছি মজা! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন!’ বলে খোলা তলোয়ার হাতে পানির মধ্যে দিয়ে মাতালের মত টলতে টলতে এগোলো সে সন্ন্যাসীর দিকে।

রবিনের এই অগ্নিমূর্তি দেখে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না সন্ন্যাসী। ধীরে সুস্থে মাটি থেকে তুলে শিরস্ত্রাণটা পরে নিল মাথায়, তারপর ঢোলা কাপড়ের মধ্যে থেকে বের করলো মস্ত এক তলোয়ার, আর ছোটোখাটো একটা ঢাল। কোন কথাবার্তা বিনিময় হলো না, রবিন তীরে এসে পৌছুতেই শুরু হয়ে গেল তুমুল লড়াই।

লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে, একবার পার বেয়ে উঠে যাচ্ছে, আবার নেমে আসছে; দু’জনই খুঁজছে একে অন্যের দুর্বলতা, ঝনঝন শব্দ হচ্ছে ঢাল তলোয়ারের সংঘর্ষে-কন্তু কেউ কাউকে কাবু করতে পারা তো দূরের কথা স্পর্শই করতে পারছে না। পুরো একটা ঘন্টা সমানে সমান লড়ে গেল দু’জন। কখনো পানিতে নেমে, কখনো ডাঙায়; বিপুল বিক্রমে লড়ে চললো দু’জন; মারছে, ঠেকাচ্ছে, একদিকে আক্রমণের ভান করে অন্য দিকে আক্রমণ করছে। শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে যে-যার তলোয়ারের ওপর ভর দিয়ে বিশ্রামের জন্যে থামলো ওরা।

‘একটা সন্দেহ জাগছে আমার মনে, হোলি ফাদার,’ বললো রবিন।

‘কি সন্দেহ, প্রিয় বৎস?’ হাসিমুখে জানতে চাইলো সন্ন্যাসী।

‘আপনি নিজেই কি ফ্রায়ার টাক, মানে, ফাউন্টেনস অ্যাবির সন্ন্যাসী টাক?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন। কসম খোদার, এমন দাঙ্গাবাজ সন্ন্যাসী জীবনে আর দেখিনি আমি!’

হা হা করে হেসে উঠলো সন্ন্যাসী। দাঙ্গার আর কি দেখেছো, বাছা! থাকতো যদি তীর ধনুক,দেখতে কি রকম চমকে দিতাম তোমার পিলেটা!’

‘আমার প্রশ্নের কিন্তু জবাব দেননি এখনও আপনি।’

‘কেন দেব? তোমাকে চিনি আমি যে নিজের পরিচয় দেব? কে তুমি? নিজের পরিচয় দাও আগে।’

‘পরিচয় দেয়ার আগে আমার শিঙাটা একটু বাজাবার অনুমতি দেবেন?’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ জবাব দিলো সন্ন্যাসী। ‘যত খুশি শিঙা ফোঁকো, আমার কোন আপত্তি নেই।’

রবিনের শিঙার শব্দ পেয়ে ছুটে এলো ওর চার-সঙ্গী। ভয়ঙ্কর দর্শন চারজন সশস্ত্র তাগড়া জোয়ান লোককে ছুটে আসতে দেখে বিস্ফারিত হয়ে গেল মোটা সন্ন্যাসীর ক্ষুদ্র চোখ দুটো। মনে হলো যেন ভয় পেয়েছে। বললো, ‘আশ্চর্য! মাটি ফুঁড়ে হাজির হলো নাকি? কারা এরা? তুমিই বা কে? ‘

‘এরা আমার অনুচর। আমি রবিন হুড।’

‘তাই নাকি!’ বিস্মিত দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখলো সন্ন্যাসী রবিনকে। ‘তোমার মহত্ত্ব আর বীরত্বের কথা লোকের মুখে মুখে অনেক শুনেছি আমি।’

‘এবার তাহলে, হোলি ফাদার, আপনার পরিচয়টা…

‘পরিচয় দেয়ার আগে আমার বাঁশীটা একটু বাজাতে চাই,’ বললো সন্ন্যাসী।

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,’ জবাব দিল রবিন। ‘যতবার খুশি।’

গলায় ঝুলানো একটা হুইসেল মুখে তুলে ফুঁ দিল সন্ন্যাসী। সাথে সাথেই প্রচণ্ড গর্জন করে কোত্থেকে যেন ছুটে এলো বিশাল চেহারার চারটে ভয়ঙ্কর-দর্শন হাউণ্ড। সন্ন্যাসীর দু’পাশে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল ওরা, চোখ গরম করে চাইছে রবিন ও তার দলবলের দিকে।

‘এরা আমার অনুচর। আমি সন্ন্যাসী টাক,’ রবিনের সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তরে বললো সন্ন্যাসী। ‘এবার বলে ফেলো, বৎস, কি উদ্দেশ্যে খোঁজ করছো তুমি আমাকে?’

‘আপনাকে আমাদের দরকার,’ সোজা সাপ্টা বললো রবিন। শহরের গির্জায় যেতে পারি না আমরা। উপাসনার কোন ব্যবস্থা নেই আমাদের শেরউডে। যাতে অধার্মিক হয়ে না যাই, সেজন্যে একজন পুরোহিত একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমাদের জন্যে। কিন্তু যাকে-তাকে তো আর শেরউডে ডাকা যায় না। আপনি যদি আমাদের সাথে যান, আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে মাথায় তুলে রাখবো আপনাকে।’

দুই কান পর্যন্ত বিস্তারিত হলো সন্ন্যাসীর হাসি। সত্যি কথা বলতে কি, তোমাদেরকে আমার খুব পছন্দ। অনেকদিন ভেবেছি, যাই, শেরউডে গিয়ে খুঁজে বের করি মহানহৃদয় রবিন হুডকে; ওকে বলি, দলে নাও আমাকে, তোমাদের ধর্মকর্মের দিকটা দেখবো আমি। ভালই হলো। তুমি নিজেই যখন এসে হাজির হয়েছো, আমি এক্ষুণি প্রস্তুত। চলো, এগোনো যাক।’

এইভাবে যোগ দিল বিখ্যাত সন্ন্যাসী টাক রবিন হুডের দলে। পরবর্তীকালে অসংখ্য গাথা রচনা হয়েছিল তার কীর্তিকলাপ নিয়ে। এতবড় জ্ঞানী, যুদ্ধবাজ, মহৎ সন্ন্যাসী সে-যুগে আর ছিল কিনা সন্দেহ।

শেরউডের সবাই দারুণ খুশি হলো সন্ন্যাসী টাককে পেয়ে। মস্ত এক ভোজের আয়োজন করে সম্মানিত করলো ওরা সন্ন্যাসী টাকের পদার্পণের দিনটিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *