২. লিটল জন
নটিংহামের শেরিফের কানে পৌঁছলো সব কথা। কালবিলম্ব না করে বিরাট এক রক্ষীদল পাঠালেন তিনি দস্যুদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্যে। লব নামের এক মুচির মুখে এই বিরাট সশস্ত্র বাহিনীর খবর পেয়ে গেল ওরা আগে ভাগেই। এত লোকের সাথে পেরে ওঠা যাবে না বুঝতে পেরে শেরউড ছেড়ে সরে গেল ওরা ইয়র্কশায়ারের জঙ্গলে। সেখানে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে যখন জানা গেল বিফল হতোদ্যম হয়ে ফিরে গেছে শেরিফের লোকজন, তখন আবার শেরউডে এসে ডেরা বাঁধলো রবিন হুড।
এবার দল গঠনে মন দিল রবিন। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে, শক্তি অর্জন করতে হবে নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থেই। টিকে থাকতে হলে বাহুবল চাই। কাজেই সাহসী, শক্তিশালী, বিশ্বাসী লোক খুঁজে বের করার কাজে লেগে গেল সে। অনেকেই ওর দলে যোগ দিতে আগ্রহী, কিন্তু ভালমত পরীক্ষা করার পর সন্তুষ্ট না হয়ে কাউকে দলে নিল না সে। উপযুক্ত লোকের খোঁজ পেলে তাকে দলে নেয়ার চেষ্টায় যেমন কোন ত্রুটি করতো না সে, তেমনি অনুপযুক্ত, নির্বোধ লোককে ফিরিয়ে দিতেও দ্বিধা করতো না বিন্দুমাত্র। ফলে ক্রমে ক্রমে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠলো ওর দলটা, লোকসংখ্যা বাড়তে বাড়তে গিয়ে দাঁড়ালো পাঁচ-কুড়িতে।
একদিন এক সুন্দর সকালে ঘুম থেকে উঠে চঞ্চল ঝর্ণার পানিতে হাত-মুখ ধুচ্ছে রবিন, গাছের ডালে পাতার আড়ালে বসে মিষ্টি মধুর গান শোনাচ্ছে পাখিরা, চারদিকে ভোরের তাজা একটা ভাব এমনি সময়ে হঠাৎ মনটা বিগড়ে গেল ওর।
‘চললাম,’ আস্তানায় ফিরেই ঘোষণা করলো রবিন। ‘দু’-দু’টো সপ্তাহ পেরিয়ে যাচ্ছে, কোন ঘটনা নেই, শিকার নেই, রোমাঞ্চ নেই-একঘেয়ে জীবন আর ভাল্লাগছে না। কেউ যখন কোন মেহমান আনতে পারছে না, আমি বেরোবো। আজ যদি মোটাসোটা কোন অ্যাবট কিংবা ধনী নাইট বা ব্যারনের কোমরে গোঁজা থলি হালকা না করতে পারি, তাহলে আমার নামই নেই।’
কথা শুনে আরো দু’চারজন তৈরি হচ্ছিল সাথে যাওয়ার জন্যে, হাত তুলে ওদের নিরস্ত করলো রবিন।
‘আমি একা যাবো। তৈরি থেকো, যদি কোন বিপদে পড়ি, কিংবা শাঁসালো কোন শিকারের সন্ধান পাই, তিনবার শিঙা বাজাবো। আওয়াজ পেলেই বুঝবে তোমাদের সাহায্য দরকার পড়েছে আমার।’
হাঁটছে তো হাঁটছেই, হাঁটতে হাঁটতে শেরউডের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে হাজির হলো রবিন, কিন্তু এমন কিছুই ঘটলো না যাতে একটু নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। এ- রাস্তা ও-রাস্তা, এ-গলি ও গলি ধরে হাঁটছে সে, মাঝে মাঝে দেখা হচ্ছে মানুষজনের সাথে। কিন্তু সবাই শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ। মোটা এক সন্ন্যাসী চলে গেল পাশ কাটিয়ে, ঘোড়ায় চেপে চলে গেল এক মহিলা- মাথার হুড খুলে সম্মান দেখালো তাকে রবিন, একটা অন্ধকার মত বন-পথে দেখা পেল এক পল্লী বালার দু’একটা টুকরো সম্ভাষণের পর রওনা হলো যে-যার পথে, বর্শা আর, ঢাল হাতে এক বর্ম-পরা নাইটের সাক্ষাৎ পাওয়া গেল, লাল উর্দি পরা এক পরিচারক ছুটে চলে গেল পাশ দিয়ে। নাহ্, দিনটাই বুঝি মাটি হয় ভাবতে ভাবতে অন্য পথ ধরলো আবার রবিন। এইভাবে এলোপাতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে বেশ বড়সড় একটা ঝর্ণার ধারে এসে পৌছলো সে। একটা গাছের কাণ্ড ফেলে পারাপারের ব্যবস্থা হয়েছে। একজন একজন করে পার হতে হয়, দু’জনের জায়গা হয় না। সেতুর ওপর পা রাখতে যাবে, এমনি সময় দেখতে পেল ওপার থেকে বিশাল চেহারার এক ঢ্যাঙা লোক উঠছে সেতু পেরোবার জন্যে।
‘অ্যাই, দাঁড়াও,’ বললো রবিন। ‘পথ ছাড়ো। আমাকে আগে পার হতে দাও।’
‘কেন?’ শান্ত গলায় জানতে চাইলো আগন্তুক।
‘দেখতে পাচ্ছো না, দু’জন পার হওয়ার জায়গা নেই? সরে দাঁড়াও, আমি আগে পার হবো।’
‘কেন? আমি আগে পার হলে ক্ষতি কি? তুমিই একটু সরে দাঁড়াও না।’
‘বেশি বকবক করবে না, খবরদার!’ রেগে গেল রবিন। হয় পথ ছাড়ো, নয়তো বুকের মধ্যে সেঁধিয়ে দেব তীর!’ কথাটা বলেই ধনুক নামালো সে কাঁধ থেকে।
‘খবরদার!’ গর্জে উঠলো ওপারের লোকটা। ছিলাটা ছুঁয়েছো কি এই লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তোমার গায়ের রঙ পাল্টে দেব। দেখেছো লাঠিটা?’
সাত ফুট লম্বা প্রকাণ্ড লাঠিটার দিকে চাইলো রবিন, তারপর হাসলো। ‘গাধার মত কথা বলছো তুমি, উল্লুক। তিন কদম এগোবার আগেই কলজে ফুটো হয়ে যাবে তোমার।’
‘আর তুমি কথা বলছো কাপুরুষের মত, ঘৃণা প্রকাশ পেল লোকটার কণ্ঠে। তীর- ধনুক থাকলে যে-কোন ভীতুর ডিমও ওরকম বড়াই করতে পারে। লজ্জা করে না তোমার সাধারণ এক লাঠির বিরুদ্ধে ধনুকের হুমকি দিতে? কাপুরুষ কোথাকার!’
‘তবে রে, ব্যাটা!’ বলেই রেগেমেগে তীর ধনুক নামিয়ে রাখলো রবিন মাটিতে। ‘আমি কাপুরুষ? ঠিক আছে, সাহস থাকে তো দাঁড়াও ওখানে। এক্ষুণি একটা লাঠি কেটে নিয়ে আসছি আমি।’
‘বেশ, বেশ,’ বললো দৈত্যের মত লোকটা। মস্ত লাঠিটার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ালো। নিয়ে এসো। খুশি মনে অপেক্ষা করছি আমি।’
দ্রুত পায়ে ঝোপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল রবিন। সোজা দেখে গ্রাউণ্ড ওকের ঝাড়া ছয় ফুট লম্বা একটা ডাল কেটে নিয়ে ফিরে এলো ছোট ছোট শাখাগুলো ছাঁটতে ছাঁটতে। এদিকে সেই একই ভঙ্গিতে লাঠির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত মনে শিস দিচ্ছে, আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে লোকটা। শাখাগুলো ছাঁটার ফাঁকে ফাঁকে আড়চোখে লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করছে রবিন, আর ভাবছে এতবড় জোয়ানটার সাথে লাগতে যাওয়া কি ঠিক হলো? এমনিতে রবিন হুড লম্বা, কিন্তু এ লোক তার চেয়েও কমপক্ষে একহাত বেশি লম্বা, সাত ফুটের কম তো নয়ই। নিজের চওড়া কাঁধের জন্যে গর্ব অনুভব করতো রবিন, কিন্তু এ লোকের কাঁধ তার চেয়েও এক বিঘৎ বেশি চওড়া। আর কোমরের বেড় কম করেও পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি।
‘যাই হোক,’ মনে মনে বললো রবিন। ‘যত বড় পালোয়ানই হও না কেন, বাছা, পিটিয়ে হাতের সুখ মিটিয়ে নেব আজ।’ মুখে বললো, ‘এই যে ঢ্যাঙা বীরপুরুষ, লাঠিটা দেখতে পাচ্ছো? এগোও দেখি যদি সাহস থাকে। ঝর্ণার মাঝখানে এই গাছের ওপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ হবে, একজন আরেকজনকে পিটিয়ে পানিতে না ফেলা পর্যন্ত চলবে যুদ্ধ, যে জয়ী হবে সেই পার হবে প্রথম।’
‘ঠিক আছে, কোন আপত্তি নেই আমার,’ বললো লোকটা। বোঁ করে মাথার ওপর লাঠিটা একপাক ঘুরিয়ে নিয়ে এগোলো সামনে।
শুরু হলো যুদ্ধ। প্রথম কিছুক্ষণ চললো পাঁয়তারা দু’জনেই লাঠি ঘুরাচ্ছে, একদিকে আঘাত করার ভান করে চট করে অন্যদিকে আঘাত করার চেষ্টা করছে, অপরজন সে- আঘাত ঠেকিয়ে দেয়া মাত্র অন্য ধরনের আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, বুঝে নেয়ার চেষ্টা করছে একে অন্যের দুর্বলতা। কয়েক মিনিটের মধ্যে দুজনই টের পেয়ে গেল প্রতিপক্ষকে কাবু করা সহজ হবে না, দুজনই ওস্তাদ লাঠিয়াল। প্রথম আঘাতের সুযোগ বের করে নিল রবিনই। মাথায় মারার ভান করলো সে, ঠেকাবার জন্যে প্রতিপক্ষ লাঠিটা উঁচু করে ধরতেই আশ্চর্য দ্রুতবেগ লাঠি ঘুরিয়ে মেরে দিলো ওর পাঁজরে।
রেগে গিয়ে ছোট্ট একটা গর্জন ছাড়লো দৈত্যটা, তারপর এমন জোরে লাঠি চালালো যে সেটা ঠেকাতে গিয়ে সারা শরীরে তীব্র ঝাঁকুনি অনুভব করলো রবিন। কিন্তু বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে দ্বিতীয় আঘাতের আগেই চড়াৎ করে একটা বাড়ি লাগিয়ে দিল লোকটার পিঠে। এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল লোকটা, বাড়িটা সহ্য করে নিয়েছে সে রবিনের মাথাটা অরক্ষিত অবস্থায় পাওয়ার জন্যেই, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রচণ্ড এক আঘাত হানলো সে ওর মাথা লক্ষ্য করে। এই এক আঘাতেই যে-কোন মানুষের চিৎ হয়ে পড়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে ঠেকিয়ে দিল রবিন আঘাতটা, পুরোপুরি সফল হলো না যদিও। তেরছা ভাবে চাঁদি ছুঁয়ে গেল প্রতিপক্ষের লাঠি, কুল কুল করে রক্ত নামলো রবিনের গাল বেয়ে। হাসি ফুটে উঠেছে ঢ্যাঙা দৈত্যের মুখে।
মার খেয়ে খেপে গেল রবিন। ক্ষিপ্র বেগে বেশ কিছুক্ষণ আঘাতের পর আঘাত করে গেল সে। এই প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে সম্পূর্ণ আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা নিতে বাধ্য হলো প্রতিপক্ষ, একের পর এক মার ঠেকিয়ে গেল শুধু, মারার সুযোগ পেল না।
বিদ্যুৎ চমকের মত এদিক-ওদিক থেকে নানা রকম মার মারলো রবিন, কিন্তু আশ্চর্য দক্ষতার সাথে সব রকমের আঘাতই ঠেকিয়ে দিচ্ছে ঢ্যাঙা লোকটা, ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ মত একটু আধটু আঘাত করতেও ছাড়ছে না। এইভাবে চললো পুরো একটা ঘন্টা। এক ইঞ্চি পিছালো না দুজনের কেউই, শরীরের শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে, কিন্তু কেউ একটিবার বললো না-হয়েছে, থাক। ছোটখাট অসংখ্য পিট্টি খেয়েছে দুজনেই, এখানে ওখানে ফুলে গেছে বাড়ি খেয়ে, শরীরে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য লাল-নীল-সবুজ দাগ, কিন্তু হার মানলো না কেউই।
হঠাৎ এক সুযোগে প্রচণ্ড এক আঘাত হানলো রবিন ঢ্যাঙা লোকটার পাঁজরে, আগে যেখানে মেরেছিল ঠিক সেইখানটায়। পড়ে যাচ্ছিল লোকটা, কিন্তু পড়তে পড়তেও সামলে নিয়ে খটাশ করে বাড়ি লাগিয়ে দিল রবিনের মাথায়, ঠিক আগে যেখানে মেরেছিল সেইখানেই। পর মুহূর্তে সামলে নেয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে কষে এক বাড়ি লাগিয়ে দিল সে রবিনের পিঠে। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না রবিন হুড, ধড়াশ করে ডিগবাজি খেয়ে পড়লো পানিতে। কয়েক ঢোক পানি খেয়ে ভেসে উঠলো ওপরে।
হা-হা করে হেসে উঠলো ঢ্যাঙা দৈত্য। ‘কি খবর, তীরন্দাজ সাহেব! কোথায় হাবুডুবু খাওয়া হচ্ছে?’
‘কোথায় আবার-পানিতে,’ বললো রবিন নির্বিকার কণ্ঠে। ডাঙার দিকে এগোলো সে। ‘জিতলে তুমিই। বাপ্স, মাথার মধ্যে ভন ভন করছে, যেন জুন-সকালের মৌচাক একটা।’ কথা বলতে বলতে হাঁটু পানিতে চলে এলো রবিন। পায়ের ফাঁক দিয়ে ইতি- উতি পালাচ্ছে ছোট ছোট মাছগুলো। শিঙাটা মুখে তুলে তিনটে ফুঁ দিলো সে, তারপর তীরের একটা ঝোপ আঁকড়ে ধরে উঠে এলো ওপরে।
‘জিতেছি বটে,’ বললো দৈত্য, ‘কিন্তু তুমিও কম দেখাওনি, বাপু। লড়েছো বীরের মত। এত দুর্দান্ত লেঠেল আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি আমার।’
‘আমারও না,’ বললো রবিন।
এমনি সময়ে কাছাকাছি শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দ পাওয়া গেল, খশ খশ আওয়াজ আসছে ঝোপ-ঝাড় নড়ার, ‘দু’একটা শুকনো ডাল মট মট করে ভাঙছে যেন কাদের পায়ের চাপে, তারপর প্রায় একসাথে জঙ্গলের আড়াল থেকে উঁকি দিলো বিশ- ত্রিশজন সবুজ পোশাক পরা শক্ত সমর্থ লোক। সবার আগে মাচ, ওয়াট আর উইল
‘আরে, ওস্তাদ! ভিজে যে একেবারে চুপসে গেছো দেখছি!’ বললো মাচ।
‘ভিখারীর কাথার মত সারা শরীরে এত লাল নীল সবুজ বেগুনি রঙ কেন?’ জানতে চাইলো উইল। ‘এই হাল হলো কি করে তোমার?’
‘ওই যে,’ আঙুল তুলে ঢ্যাঙা দৈত্যকে দেখালো রবিন, ‘ওই লোক প্রথমে আচ্ছা মত পিটিয়েছে, তারপর পানিতে ফেলেছে আমাকে।’
‘কী! এতবড় সাহস!’ গর্জন করে উঠলো কয়েকজন।
একসাথে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছিল লোকটার ওপর, হাসলো রবিন, একটা আঙুল তুলে থামতে বললো ওদের। ‘ওর গায়ে হাত তুলো না কেউ। সাহসী আর গুণী লোকের ওপর কোন অন্যায় অত্যাচার করি না আমরা। ওর সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছিলাম, হেরে গেছি-ব্যাস, খতম। ওর ওপর কোন রাগ নেই আমার। সত্যিকার বীরের মত লড়াই করে জিতেছে ও।’ লোকটার দিকে ফিরলো এবার রবিন। ‘তোমাকে পেলে খুব খুশি হবো আমরা। আসবে? যোগ দেবে আমাদের দলে?’
‘তোমার দলে?’ মাথা নাড়লো ঢ্যাঙা দৈত্য। উঁহুঁ। আমার চেয়ে অযোগ্য কারও নেতৃত্ব আমি মানতে পারি না
‘কি দিয়ে মাপ নেবে তুমি যোগ্যতার?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো রবিন, হাত তুলে দলের সবাইকে দেখালো, ‘তুমি কি মনে করো এরা সবাই আমার চেয়ে সবদিক থেকে অযোগ্য? মোটেও না। কেউ বুদ্ধিতে আমার চেয়ে বেশি, কেউ বিদ্যায়; কেউ গায়ের জোরে, কেউ ক্ষিপ্রতায়, কেউ লাঠি খেলায়, কেউ তলোয়ারে, কেউ অভিজ্ঞতায়, কেউ…’
‘তাহলে কেন মেনে নিচ্ছে ওরা তোমাকে নেতা হিসেবে?’
‘আমি এদের মধ্যে সেরা তীরন্দাজ।’
‘তাই বুঝি?’ হেসে উঠলো দৈত্য। তা এসো না, সে ব্যাপারেও হয়ে যাক একহাত?’
‘তীর-ধনুকেও ভাল হাত বুঝি তোমার?’
‘পরীক্ষা প্রার্থনীয়,’ কপট বিনয়ে পিঠ বাঁকিয়ে মাথা ঝুঁকালো ঢ্যাঙা।
‘বেশ,’ মুচকি হাসলো রবিন। আচ্ছা ত্যাদোড় লোক মনে হচ্ছে! ঠিক আছে, উইল, চার আঙুল লম্বা আর চার আঙুল চওড়া এক টুকরো গাছের ছাল কেটে আনো। উল্টো দিকটা যেন সাদা হয়।’ এক মিনিটের মধ্যেই কাছের উইলো গাছ থেকে এক টুকরো ছাল নিয়ে এলো উইল। দূরের একটা ওক গাছের দিকে আঙুল তুললো রবিন। ‘আশি গজ দূরের ঐ ওক গাছের গায়ে সেঁটে দিয়ে এসো ওটা।’ ঢ্যাঙা দৈত্যের দিকে ফিরলো সে, ‘খুব বেশি দূর হয়ে যায় এটা?’
‘মোটেও না, মোটেও না,’ উত্তর দিলো সে খুশি মনে। ভাল দেখে একটা ধনুক আর তাঁর দাও, যদি লাগাতে না পারি, ঐধনুকের ছিলা দিয়ে পিটিয়ে আমার পিঠের ছাল তুলে নিয়ো।
সবার বাড়িয়ে ধরা ধনুকগুলো থেকে নিজের পছন্দসই শক্তপোক্ত একটা ধনুক বেছে নিল লোকটা, অনেক দেখে শুনে বাছাই করলো একটা নিখুঁত সোজা তীর, তারপর দাঁড়ালো গিয়ে দাগের ওপর, যেখান থেকে ছুঁড়তে হবে তীর। বাকি সবাই, কেউ বসে, কেউ নরম ঘাসের গালিচায় শুয়ে অপেক্ষা করছে উইলের ফিরে আসার।
ফিরে এলো উইল। ডান পা-টা পিছিয়ে নিয়ে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়ালো দৈত্যটা, ধনুকে তীর জুড়ে একটানে কানের পাশে নিয়ে এলো ছিলাটা; লক্ষ্যস্থির করেই ছুঁড়লো তাঁর। আশ্চর্য! সোজা গিয়ে লাগলো তীর ছোট্ট বাকলটার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে। হা হা করে হেসে উঠলো দৈত্য। ফিরলো রবিনের দিকে, ‘ঠিক কেন্দ্রবিন্দুটা দখল করে নিয়েছি আমি। দেখা যাক তোমার তীর কোথায় লাগে।’
লোকটার আশ্চর্য হাতের টিপ দেখে প্রশংসার গুঞ্জন উঠলো সবার কণ্ঠে, কেউ কেউ হাততালি দিয়ে উঠলো খুশিতে। কিন্তু রবিনকে দাগের ওপর এসে দাঁড়াতে দেখে মুখ শুকিয়ে গেল সবার। এইবার? পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো ওরা। কি করবে রবিন? এর চেয়ে ভাল আর কি করতে পারে সে?
ধনুকে তীর যোজনা করলো রবিন, অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লক্ষ্যস্থির করে ছুঁড়লো তীর। অকল্পনীয় ব্যাপার! রবিনের তীরটা সোজা গিয়ে ঢুকলো কেন্দ্রবিন্দুতে সেঁধিয়ে থাকা তীরের পিছন দিকটায়, চড় চড় করে সেটাকে দু’ফাঁক করে চিরে দিয়ে থামলো গিয়ে ফলার কাছে। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সবাই, আকাশ কেঁপে উঠলো ওদের প্রাণখোলা হর্ষধ্বনিতে।
হাঁ হয়ে গিয়েছিল ঢ্যাঙা দৈত্যের মুখটা। চট্ করে মাথা থেকে টুপি খুলে কুর্নিশের ভঙ্গিতে অভিবাদন করলো সে রবিনকে। ‘আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য! এমন কাণ্ড জীবনে দেখিনি আমি! ধনুকের জাদুকর দস্যু রবিনও হার মানবে তোমার কাছে!’
‘চেনো তুমি রবিন হুডকে?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো রবিন
‘চিনি না। তবে তার নাম শুনেই এসেছি আমি বহুদূর থেকে। খুঁজছি তাকে।’
‘কেন খুঁজছো তাকে বলো তো?’
‘তার দলে যোগ দেব বলে।’
খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো রবিনের মুখ। একটা হাত বাড়িয়ে দিল সামনে। ‘তুমি পেয়েছো তাকে খুঁজে, লোকটার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া মুখের দিকে চেয়ে হাসলো সে। ‘রবিন হুডকেই পিটিয়ে পানিতে ফেলেছো তুমি আজ।’
সাগ্রহে চেপে ধরলো লোকটা রবিনের বাড়িয়ে ধরা হাত। ছি, ছি! আগেই পরিচয় দেয়া উচিত ছিল তোমার।’
তাহলে কি তোমার গুণের পরিচয় পেতাম? হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলাম, সেটাই ভালো হলো না? তোমার মত গুণী লোকের দরকার আছে আমাদের। আজ থেকে তুমি আমাদের একজন হলে, আমাদের সুখ-দুঃখের ভাগীদার। ভাল কথা, কি নামে ডাকবো তোমাকে?’
‘আমার নাম জন লিটল।’
‘জন লিটল?’ হা হা করে হেসে উঠলো উইল স্টিউটলি। ‘চেহারাটা লিটল-ই বটে।’ আবার হাসলো এক পেট। উঁহু, ও নামে চলবে না। তুমি নতুন ঢুকছো দলে, নতুন ভাবে নামকরণ হবে তোমার। আমি রাখবো তোমার নাম।
‘কি নাম রাখবে ভাবছো?’ জানতে চাইলো মাচ।
‘উল্টে দেব নামটা। এখন থেকে ওর নাম হবে লিটল জন, মানে, ছোট্ট জন। দেখতে পাচ্ছো না কি রকম ছোটখাট পাহাড়টা?’
হো হো করে হেসে উঠলো সবাই। এই বিশাল দৈত্যের মত লোকটাকে ‘লিটল জন’ বলে ডাকার কথা ভেবে প্রচুর মজা পেল সকলে। তখনও ওরা কেউ জানে না, রবিন হুডের একান্ত বিশ্বস্ত নির্ভীক অনুচর হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত হতে চলেছে এই লিটল জন।
আজকের মত রোমাঞ্চের সাধ মিটে গেছে রবিনের। সবাই মিলে ফিরে চললো ওরা নিজেদের গুহার দিকে। পথে দুটো হরিণ মেরে সাথে নিল। লিটল জনের সম্মানে ভুরি-ভোজের আয়োজন হবে আজ।