৯. আবার শেরিফ শেরউডে
বেশ কিছুদিন পরের কথা। হঠাৎ একটা গুজব কানে এলো রবিনের, শেরিফ নাকি আবার শেরউড আক্রমণের পরিকল্পনা নিয়েছেন, এবং সেই উদ্দেশ্যে বিরাট এক বাহিনীও গঠন করেছেন গোপনে।
‘ব্যাপারটা গুজব না সত্যি, জানা দরকার,’ বললো রবিন। ‘আচ্ছা, ভাল কথা… আমাদের লবের খবর পাওয়া যাচ্ছে না কেন? বেশ অনেকদিন হয়ে গেল না?’
‘ঠিকই তো!’ বললো লিটল জন। ‘বহুদিন খবর নেই ওর। এক কাজ করি, আজই ছদ্মবেশে চলে যাই আমি নটিংহামে। সব খবর নিয়ে আসি গিয়ে। সকালে বাজারে, আর সন্ধ্যায় শুঁড়িখানায় ঢুঁ মারলেই দুনিয়ার সব খবর জানা হয়ে যাবে।
‘কিন্তু সাবধান, লিটল জন, বললো রবিন। ‘খবর আনতে গিয়ে নিজেই খবর হয়ে যেয়ো না আবার। তোমাকে হারাতে চাই না আমি। দুনিয়ার সব খবর একত্র করলেও তোমার….
‘কোন চিন্তা নেই, ওস্তাদ,’ বললো লিটল জন। নিজের দিকে লক্ষ রাখবো আমি।’ সেইদিন বিকেলের দিকে নটিংহামের নগর-তোরণ দিয়ে বিশাল চেহারার এক পঙ্গু ভিখারী ঢুকলো শহরে। নোংরা ছেঁড়া জামা গায়ে, ভয়ানক ভাবে খোঁড়াচ্ছে লোকটা, এক কাঁধ অপরটার চেয়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু, মুখটা বেঁকে আছে একদিকে। তোরণ-রক্ষীরা হাসাহাসি করলো তাকে নিয়ে, কিন্তু কোনদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে গেল ভিখারী, যেন একটু বিশ্রামের জন্যে ছায়া খুঁজছে। বাজার পেরিয়ে একটা সরু গলিতে ঢুকলো ভিখারী, তারপর আরো কিছুদূর এগিয়ে আরও সরু আরেক গলিতে। ছোট্ট একটা দোকানের সামনে দাঁড়ালো লোকটা। লব নামের এক মুচির দোকান ওটা। সাধারণতঃ এই সময়ে তাকে ব্যস্ত ভাবে জুতো সেলাই করতে বা ঠুংঠাং শব্দে পেরেক ঠুকতে দেখা যায়, কিন্তু আজ দোকান বন্ধ। দোকানের পিছনে একটা ছোট্ট অন্ধকার মত ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ভিখারী। গলা বাড়িয়ে দেখলো, নোংরা এক বিছানায় শুয়ে আছে লব।
‘কি হে, লব? অসুখ করেছে নাকি?’ নিচু গলায় জানতে চাইলো ভিখারী।
গলার স্বরটা চিনতে পেরে ধড়মড় করে উঠে বসলো লব বিছানার উপর। ‘লিটল জন! তুমি! একমাস ধরে পড়ে আছি বিছানায়। এখন একটু ভালর দিকে। তোমাদের খবর কি?’
‘আমাদের সব খবর ভাল। তোমরা জন্যে চিন্তায় পড়ে গেছিল রবিন, তাই আমি এলাম খবর নিতে।’
‘অনেক ধন্যবাদ,’ বললো লব। ‘কিন্তু কাজটা কি ঠিক হলো? কিছুদিন আগে নাকি ভোজ খাইয়ে তিনশো পাউণ্ড রেখে দিয়েছো তোমরা শেরিফের কাছ থেকে? ধরতে পারলে আস্ত রাখবে সে তোমাকে?’
‘আস্ত থাকলে না টুকরো করবে!’ হাসলো লিটল জন। ‘আমি পঙ্গু এক দীনহীন ভিখারী, আমাকে ধরতেই বা যাবে কেন? যাকগে, একটা গুজব পৌঁছেচে শেরউডেঃ শেরিফ নাকি আবার একটা আক্রমণের আয়োজন করছে? সঠিক খবরটা কোথায় গেলে পাবো বলো তো?’
‘কি জানি, আমার কানে তো আসেনি কথাটা,’ বললো লব। ‘প্রকাশ্যে কিছু করছে না, এটা নিশ্চিত; যদি গোপন কোন পরিকল্পনা নিয়ে থাকে, সংবাদ বের করা সহজ হবে না।’
‘বেশ তো, এসেছি যখন, একটু চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। আমি বরং শহরটা একপাক ঘুরে আসি। তোমার এখানে শোয়ার একটু ব্যবস্থা রেখো, বাইরে থেকে খেয়েদেয়ে ফিরবো।’
লবের কুঠরী থেকে বেরিয়ে এলো ভিখারী, ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে বাজারে গিয়ে উপস্থিত হলো, মাথার তালি দেয়া নোংরা টুপিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বাজারের ক্রুশটার ধারে। কেউ একটা পয়সাও ফেললো না টুপিতে, কিন্তু পয়সার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ ভিখারীর লোকজনের কথাবার্তা শোনার প্রতি। ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে থেকে তেমন সুবিধে হলো না দেখে শুঁড়িখানার দিকে চললো সে। ওর জানা আছে, শেরিফের লোকজন নিয়মিত আসা-যাওয়া করে এইখানে। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখেই বাধা পেল সে। দোকানের ইয়া মোটা মালিক আটকে দিল তাকে।
‘ভাগো, ভাগো এখান থেকে! আমার খদ্দেরদের বিরক্ত করা চলবে না। অন্যখানে ভিক্ষা করোগে যাও।’
‘ভিক্ষা চাই না, বাবা,’ বললো ভিখারী। একপাত্র এলের পয়সাও কি নেই মনে করেছো আমার কাছে? আমিও খরিদ্দার। কি? দেখতে চাও?’ কোমরে গোঁজা একটা ছোট্ট থলি থেকে কয়েকটা পেনি বের করে দেখালো সে শুঁড়িখানার মালিককে।
‘ঠিক আছে, ঢুকতে পারো,’ বললো মোটা মালিক। তবে মাঝের ঘরে বিশিষ্ট খদ্দেরদের কাছে যেতে পারবে না। ওই যে, ওই টুলে গিয়ে বসে যা খাবার খেয়ে বিদেয় হও।’
তর্ক না করে সেই দিকেই এগোলো ভিখারী, কারণ এখানে বসেও পাশের ঘরের প্রত্যেকের প্রত্যেকটি কথা শুনতে পাবে সে পরিষ্কার। টুলে বসে পরম পরিতৃপ্তির সাথে মদের পাত্রে চুমুক দিচ্ছে, আর চোখ বুজে কান খাড়া করে রেখেছে সে। শেরিফের দু’জন লোক রয়েছে খরিদ্দারদের মধ্যে, সবার সাথে সমান তালে গল্প করছে, কিন্তু কেউ শেরউডে হানা দেয়ার ব্যাপারে কোন কথা বললো না। বেশির ভাগ লোকেরই আলোচ্য বিষয় হচ্ছে আগামী কালকের শূটিং ম্যাচ। প্রত্যেক অক্টোবরে বিরাট মেলা বসে নটিংহাম শহরে, সেই মেলায় আয়োজন করা হয় তীর-ধনুক প্রতিযোগিতার।
প্রতিযোগিতার কথা শুনে ভুরু জোড়া কুঁচকে উঠলো ভিখারীর। মনে মনে বললো, ‘একটা ধনুক জোগাড় করতে পারলে কাল আমিও যাব ওখানে, কারণ এইসব প্রতিযোগিতার সময় কারো মুখে কোন লাগাম থাকে না। এখানে ওখানে কান পেতে বেড়ালে আসল খবর কানে আসবেই।’
রাত বাড়ছে, আর বসে থাকা সমীচীন হবে না বুঝতে পেরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ফিরে এলো সে লবের কুঠরীতে। খড় বিছিয়ে বিছানা করে রেখেছে লব এককোণে, সেই বিছানায় শুয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো ভিখারী।
পরদিন দুপুরেই জমে উঠলো বাজারের কাছে লোকজনের ভিড়। ঝকঝকে জামা পরে এককোণে দাঁড়িয়ে ট্রাম্পেট বাজাচ্ছে তিনজন। গাল ফুলে আপেলের মত দেখাচ্ছে ওদের মুখ। সকাল সকাল ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা এবং অন্যান্য সব কাজ সেরে নিয়েছে লোকেরা আজ, বিকেলটা যাতে ব্যয় করা যায় আনন্দে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে ঘোষক প্রতিযোগিতার নিয়ম এবং বিজয়ীর পুরস্কার। নতুন একটা রূপোর শিঙায় ভরে বিশটা রূপোর পেনি দেয়া হবে বিজয়ীকে-শুনে সবাই বুঝলো তীব্র প্রতিযোগিতা হবে আজ, অনেক ভাল ভাল তীরন্দাজ আসবে আজকের এই প্রতিযোগিতায়।
বাজারের ক্রুশের পাশে একটা টেবিলে বসে আছে একজন কেরানি কাগজ কলম আর দোয়াত নিয়ে; একজন একজন করে প্রতিযোগীরা এগিয়ে আসছে তার কাছে, নাম লিখিয়ে চলে যাচ্ছে শূটিং ম্যাচের জন্যে নির্দিষ্ট তাঁবুতে। প্রতিযোগীদের লাইনে রয়েছে বিশাল চেহারার সেই কুৎসিত, খোঁড়া ভিখারীটা। তারও কাঁধে ঝুলছে একটা ধনুক, পিঠে তীরভর্তি তূণ, মুচি লবের এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার নিয়েছে সে এগুলো।
ভিখারীকে কেরানির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দেখে হো হো করে হেসে উঠলো দর্শকরা। ওর পিছনে দাঁড়ানো লোকটা বিরক্তির সাথে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল ভিখারীকে লাইন থেকে।
‘অ্যাই, সরো দেখি,’ বললো লোকটা। ‘এখানে ভিড় করছো কেন?:
ধাক্কা খেয়ে পিছন ফিরে চাইলো ভিখারী। লম্বা চওড়া লাল-মুখো এক লোক দাঁড়িয়ে আছে ওর পিছনে, পরনে জঙ্গল-রক্ষীর পোশাক। ‘ধাক্কা দিচ্ছেন কেন, ভাই?’ বললো ভিখারী। ‘আপনার মত আমিও তো এসেছি প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে।’
‘বলে কি ব্যাটা!’ হাস্যকর মুখ ভঙ্গি করলো লালমুখো লোকটা। ‘তুমি এসেছো শূটিং ম্যাচে অংশগ্রহণ করতে? পাগল হয়েছো নাকি? যাও, ভাগো! যে কাজ তোমাকে সাজে…গম খেতের কাকতাড়ুয়াগুলোর পোশাক চুরি করোগে যাও।’
এই কথা শুনে হাসির হুল্লোড় উঠলো দর্শকদের মধ্যে। ছিন্নবস্ত্র ভিখারীর ঠিক আঁতে ঘা দিয়ে দারুণ এক রসিকতা করেছে জঙ্গল-রক্ষী। কিন্তু সবার মুখের হাসি নিভে গেল, যখন দেখলো আশ্চর্য শক্তিশালী একটা হাত বেরিয়ে এলো ভিখারীর ছেঁড়া জামার আড়াল থেকে, তারপর, যেন তিন বছরের শিশুকে তুলে নিচ্ছে, এমনি অবলীলায় ঘাড় ধরে শূন্যে তুলে সরিয়ে দিল জঙ্গল-রক্ষীকে একপাশে। নরম গলায় বললো, ‘আমি আগে ছিলাম, আমি আগে নাম লেখাবো। আপনার স্মরণ রাখা দরকার, আজকের এই খেলা শুধুমাত্র জঙ্গল-রক্ষীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, কিংবা ভিখারীদের জন্যেও কোন বিধিনিষেধ নেই।’
রেগে আগুন হয়ে গেল জঙ্গল রক্ষী, একলাফে এগিয়ে এসে প্রচণ্ড এক ঘুসি মারলো ভিখারীর নাক লক্ষ্য করে।
‘উচিত শিক্ষা দিয়ে দাও, হ্যাল!’ চেঁচিয়ে উঠলো ওর বন্ধু-বান্ধব। ‘নাকটা ফাটিয়ে দাও ব্যাটার!’
কিন্তু হ্যালের ঘুসি স্পর্শই করতে পারলো না ভিখারীকে। বিদ্যুৎবেগে একপাশে সরিয়ে নিয়েছে সে তার মাথা, কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে ঘুসি।
‘পালাও, জলদি পালাও এখান থেকে!’ ভিখারীর কানের কাছে ফিসফিস করে উঠলো একজন নিরীহ নিম্নমধ্যবিত্ত লোক। ঘুসিয়ে ভর্তা করে দেবে হ্যাল তোমাকে!’
‘পালাবো কেন?’ বললো ভিখারী। ‘গোল হয়ে একটা রিং তৈরি করো সবাই। দেখি কেমন ঘুসিয়ে ভর্তা করে হ্যাল আমাকে।’
‘রিং বানাও!’ রিং বানাও!’ খুশি হয়ে চেঁচামেচি শুরু করলো সবাই। ‘ভিখারীর সাথে লডুক ক্রফটের হ্যাল, দেখি কে জেতে!’
হঠাৎ এই ঝগড়া বেধে গিয়ে চমৎকার একটা মারপিট দেখার সুযোগ পেয়ে গেছে শহরবাসী। আহ্লাদে আটখানা হয়ে গোল রিং তৈরি করে দিল তারা। খুশি হয়েছে হ্যালও। গায়ের ফতুয়া খুলে ফেললো সে, ধনুকটা ধরিয়ে দিল এক বন্ধুর হাতে, তারপর দুই হাতে থুথু দিয়ে শক্ত করে পাকালো মুঠি। বেয়াড়া ভিখারীকে উচিত শিক্ষাই দেবে সে আজ। সবাই জানে গোটা নটিংহাম শহরে তার সমকক্ষ মুষ্টিযোদ্ধা আর একজনও নেই।
জামা কাপড় কিছুই ছাড়লো না ভিখারী, সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টাও করলো না। হাতের ধনুকটা শুধু ধরিয়ে দিল একজন সাদামাঠা কৃষকের হাতে। তারপর এমন হাস্যকর ভঙ্গিতে রিঙের একধার থেকে আরেক ধার পর্যন্ত উঁচু-নিচু হয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটলো যে হেসে খুন হয়ে গেল দর্শকবৃন্দ, হৈ-হৈ করে উঠলো আনন্দে।
গগন বিদারী হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে শুরু হলো মারপিট। একের পর এক প্রচণ্ড ঘুসি চালিয়ে গেল ক্রফটের হ্যাল ভিখারীর নাক-মুখ-চোয়াল লক্ষ্য করে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, একটিবারও লাগাতে পারলো না সে জায়গামত। ভিখারীটা এমনই খোঁড়া, যে যখনই এক পা সামনে বা পিছনে ফেলছে, মাথাটা ওর উঠে যাচ্ছে একফুট উপরে বা একফুট নিচে। আর ব্যাপারটা এমনই বিদ্যুৎগতিতে ঘটছে যে ভালমত লক্ষ্যস্থির করাই মুশকিল হয়ে পড়েছে হ্যালের পক্ষে। প্রতিটা ঘুসি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই দড়াম করে হাতুড়ির ঘায়ের মত একটা করে ঘুসি এসে লাগছে হ্যালের পাঁজরে। ভিক্ষার ঝুলি আর ঢোলা ছেঁড়া জামা-কাপড় সহ এমনই হাস্যকর ভঙ্গিতে উঁচু-নিচু হয়ে লাফাচ্ছে আর খোঁড়াচ্ছে ভিখারী যে হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেল দর্শকদের। এমন অদ্ভুত লড়াই জীবনে দেখেনি তারা। হঠাৎ করেই শেষ পর্যায়ে চলে এলো লড়াইটা। রাগে অন্ধ হ্যাল তাড়া করে কোনায় এনে ফেললো ভিখারীকে, যেখান থেকে কোন কৌশলেই উদ্ধার নেই।
‘কোণঠাসা হয়ে পড়েছে!’ চেঁচিয়ে উৎসাহ দিল হ্যালের বন্ধু-বান্ধব তাকে। ‘এইবার! এইবার বাগে পেয়েছো, হ্যাল। দেখিয়ে দাও, জঙ্গল-রক্ষীর ঘুসি কাকে বলে।’
এমনি সময়ে, সবাই যখন বুঝতে পারছে বিখ্যাত মুষ্টিযোদ্ধা হ্যাল এবার শেষ খেলা দেখাবে, অনেকে একটু যেন দুঃখবোধ করছে দীন ভিখারীর করুণ পরিণতির কথা ভেবে-হঠাৎ বিকট এক দৈত্যের মত ঝাড়া সাত ফুট লম্বা হয়ে দাঁড়ালো ভিখারী, এবং এই প্রথম বারের মত শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রচণ্ড এক ঘুসি লাগিয়ে দিল হ্যালের পাঁজরে। কড়াৎ! পরিষ্কার শুনতে পেল সবাই শব্দটা। পাঁজরের তিনটে হাড় ভেঙে গেছে হ্যালের, ছিটকে কয়েক হাত পিছিয়ে গিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে মাটিতে। অজ্ঞান। বিস্ময়ের ধাক্কায় থ হয়ে রইলো সবাই কয়েক মুহূর্ত। তারপর কয়েকজন জঙ্গল- রক্ষী একসাথে এগিয়ে এলো লাঠি হাতে-ভিখারীকে আচ্ছামত শায়েস্তা করে ছেড়ে দেবে আজ।
জঙ্গল-রক্ষীদের এই অন্যায় আচরণে রেগে গেল দর্শকবৃন্দ। তারা চেঁচিয়ে উঠলো, ‘কি হচ্ছে! অ্যাই, কি হচ্ছে!’
একজন শহরবাসী বাধা দিল জঙ্গল-রক্ষীদের। ‘কোন রকম চোরা-গুপ্তা বেআইনী মার মারা হয়নি হ্যালকে। হ্যাল যা করতে যাচ্ছিল, ভিখারীও তাই করেছে-অন্যায় কিছুই করেনি সে।’ এই বলে প্রকাণ্ড এক লাঠি তুলে বোঁ করে মাথার উপর একপাক ঘুরালো লোকটা।
এই লোকের পিছনে সমর্থন জুটে গেল বেশির ভাগ দর্শকেরই। তাদের চিৎকারে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলো জঙ্গল-রক্ষীরা। মুখগোমড়া করে হ্যালের জ্ঞানহীন দেহটা তুলে নিয়ে চলে গেল ওরা।
‘ভিখারী,’ জানতে চাইলো সেই লোকটা যে তাকে সমর্থন করেছিল, যে-রকম ঘুসি চালাতে জানো, সে-রকম তীর ছুঁড়তে পারো না?’
‘পারি, হুজুর,’ বললো ভিখারী একগাল হেসে। তাও পারি।’
‘তাহলে চলো যাই,’ সবার উদ্দেশ্যে বললো লোকটা। মনে হচ্ছে শূটিং ম্যাচটাও জমে উঠবে আজ।’
সবাই রাজি হলো। কেরানির কাছে নাম লিখিয়ে সবাই মিলে ওকে ঘিরে নিয়ে চললো প্রতিযোগিতা-ময়দানে, যাতে একা পেয়ে আবার আক্রমণ করে না বসতে পারে জঙ্গল-রক্ষীরা।
নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হলো শুটিং। দেখা গেল তীর-ধনুকেও আশ্চর্য পারদর্শিতা রয়েছে ভিখারীর। প্রথম দফায় টার্গেট লক্ষ্য করে যতগুলো তাঁর ছোঁড়া হলো, তার মধ্যে কেন্দ্রবিন্দুর সবচেয়ে কাছে লাগলো গিয়ে তার তীরটাই। শেষ দফার জন্যে সেরা তিনজনকে রেখে বাকি সবাইকে বিদায় করে দেয়া হলো। এবার অন্য ধরনের একটা লক্ষ্য ভেদ করতে হবে তীরন্দাজদের। বহুদূরে একটা উইলোর ডাল পুঁতে দেয়া হলো মাটিতে, তীর লাগাতে হবে এই ডালে। প্রথম দু’জনের তীর পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল, কিন্তু লাগলো না ডালে। এবার ভিখারীর পালা। কয়েকটা ঘাস ছিঁড়ে ছুঁড়ে দিল সে উপর দিকে। বাতাসের গতি বুঝে নিয়ে সোজা দেখে একটা তীর বেছে বের করলো তূণ থেকে। মারলো। চড়াৎ করে দু’ভাগ হয়ে গেল উইলোর ডালটা-ঠিক মাঝখান দিয়ে চিরে বেরিয়ে গেছে তীর।
বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে পুরস্কার আনতে গেল ভিখারী। মুগ্ধ শেরিফ পুরস্কারের সাথে সাথে প্রচুর বাহবাও দিলেন তাকে। জানতে চাইলেন, ‘কি নাম হে তোমার? বাড়ি কোথায়?’
হাঁটু বাঁকা করে সম্মান দেখালো ভিখারী শেরিফকে। মুখে বললো, ‘হুজুর, আমার নাম রেনড গ্রীনলীফ, হোল্ডারনেসে জন্ম।’
‘দারুণ তীরন্দাজ তুমি, রেনড গ্রীনলীফ। এত চমৎকার তীর ছুঁড়তে জীবনে দেখিনি আমি আর কাউকে!’
‘দেখেছো, বাপ!’ মনে মনে বললো ভিখারী। আমার ওস্তাদ রবিন হুডকে দেখেছো এর চেয়ে অনেক ভাল তীর ছুঁড়তে, ‘ কিন্তু মুখে কিছুই বললো না সে। মৃদু হেসে আবার হাঁটু ভাঁজ করে সম্মান প্রদর্শন করলো।
খুশি হলেন শেরিফ। বললেন, ‘এত বড় ধনুর্বিদ তুমি-ভিক্ষার ঝুলি কেন তোমার কাঁধে?’
‘কি করবো, হুজুর। পঙ্গু মানুষকে কে দেবে চাকরি?’
‘কেউ না দেয়, আমি দেব,’ বললেন শেরিফ। ‘করবে তুমি চাকরি? বছরে বিশ মার্ক করে পাবে। করবে?’
এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল লিটল জন। যে খবরের জন্যে সে এসেছে, সেটা জানার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর আসবে না। সেইদিনই যোগ দিল সে শেরিফের চাকরিতে।
খায়-দায় ঘুমায়, কিছুদিন বেশ আরামেই কাটালো লিটল জন শেরিফের বাড়িতে, কোন কাজে হাত দেয় না। দেখে সহ্য হয় না শেরিফের গোমস্তার, প্রায়ই এটা-ওটা কাজ চাপাবার চেষ্টা করে ওর ওপর। মিটিমিটি হাসে শুধু লিটল জন। বলে, আমি তীরন্দাজ, অন্য কাজ পারি না।’
একদিন ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল লিটল জনের। উঠেই শুনতে পেল শিকারে গেছেন শেরিফ শেরউড জঙ্গলে। মনটা কেমন যেন আনচান করে উঠলো তার শেরউডে ফেরার জন্যে। স্থির করে ফেললো, আজই ফিরে যাবে সে আস্তানায়। এখানে আর করবার কিছুই নেই ওর। পরিষ্কার বুঝে নিয়েছে সে শেরউড আক্রমণের কোন পরিকল্পনা নেই শেরিফের, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুয়ো, গুজব। রাতের পর রাত জেগেছে সে, কান পেতেছে এ-দরজায় ও-দরজায়, দিনের বেলায় ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে কথাবার্তা শুনেছে সবার-কিন্তু কারো কাছ থেকে আভাস পাওয়া যায়নি কোন গোপন চক্রান্তের। কাজেই আর এখানে থাকার কোন মানে হয় না।
তৈরি হয়ে নিল লিটল জন। কিন্তু খালি পেটে রওনা হতে সায় দিল না মন। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো বাবুর্চি নেই, বাইরে কোথাও গেছে, কিন্তু একটা শেলফে থরে থরে সাজানো রয়েছে চমৎকার সব খাবার। শিকার থেকে ফিরে শোরফ ও তার দলবল খাবেন বলে তৈরি হয়েছে এসব। কালবিলম্ব না করে শুরু করে দিল লিটল জন, যা খুশি টপাটপ তুলছে আর পুরছে মুখে। গলাটা শুকিয়ে এলেই পিপে থেকে মদ ঢেলে গিলছে ঢকঢক। মনের সুখে খেয়ে চলেছে সে, এখান থেকে এক খাবলা তুলছে, ওখান থেকে আরেক খাবলা; পেট ভরে গেছে তবু থামতে পারছে না চারপাশে এত রকমের সুস্বাদু খাবার দেখে-এমনি সময়ে চড়াৎ করে বেতের বাড়ি পড়লো ওর পিঠে।
চমকে পিছন ফিরেই দেখতে পেল সে, দাঁড়িয়ে আছে বাবুর্চি, ঠক ঠক করে কাঁপছে রাগে। তার এত কষ্ট করে তৈরি করা খাবারের ডিশে ডাকাত পড়ায় এবং ডিশগুলোর তছনছ সর্বনাশ অবস্থা দেখে রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেছে বাবুর্চি, চড়াৎ করে আরেক বাড়ি কষিয়ে দিল লিটল জনের কাঁধে।
একহাত তুলে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত করলো লিটল জন লোকটাকে। ‘যাও তো, বাপু! খাবার সময় বিরক্ত করে না।’ আরেক গ্রাস তুললো সে মুখে। চিবাতে চিবাতে বললো, ‘অত রাগ কিসের? খাবার জন্যেই তো বানিয়েছো এসব, তাই না?’
তোর খাওয়ার জন্যে বানিয়েছি?’ জোরে মাটিতে পা ঠুকলো বাবুর্চি। ‘বেরো বলছি! নইলে খুন করে ফেলবো এক্ষুণি!’
‘তাই নাকি?’ হাসলো লিটল জন। ‘তা একা তো আর সেটা সম্ভব নয়, পারলে জনা দশেক লোক ডেকে নিয়ে এসো।
‘কী? তোকে শায়েস্তা করতে লোক লাগবে আমার? আয় দেখি!’ সড়াৎ করে একটানে কোমরে ঝুলানো খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ফেললো বাবুর্চি।
অগত্যা খাওয়া ফেলে নিজের তলোয়ারটা বের করতে বাধ্য হলো লিটল জন। শুরু হলো লড়াই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো লিটল জন অসি-যুদ্ধের সমস্ত কৌশলই রপ্ত আছে বাবুর্চির। পুরো একটা ঘন্টা চললো লড়াই, ঘরময় দাপাদাপিতে জিনিসপত্র ছিটকে পড়লো এদিক-ওদিক, কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত এক হাত তুলে থামতে বললো লিটল জন প্রতিপক্ষকে।
‘মাইরি বলছি,’ বললো সে। ‘দারুণ হাত তোমার তলোয়ারে! তেমনি দুর্দান্ত সাহস। এখানে এই হাঁড়ি-কুঁড়ি নাড়াচাড়া করে অন্যের পেট পূর্তির চিন্তায় কেন অপব্যয় করছো নিজেকে?
‘এছাড়া আর কি করার আছে?’ জানতে চাইলো বাবুর্চি।
‘এর চেয়ে অনেক আনন্দের, অনেক স্বাধীন আমাদের শেরউডের জীবন। তোমাকে এমন এক জীবনের সন্ধান দিতে পারি, এমন নেতার কাছে নিয়ে যেতে পারি, যার মহান হৃদয়ের স্পর্শে পরিপূর্ণ, সার্থক মনে করবে তুমি নিজেকে।’
‘কে? কার কথা বলছো তুমি?’
সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো লিটল জন, ‘রবিন হুড!’
নামটা শুনেই ভয়ানক ভাবে চমকে উঠলো বাবুর্চি। বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলো সে কিছুক্ষণ লিটল জনের মুখের দিকে, তারপর তলোয়ারটা ঢুকিয়ে দিল খাপের মধ্যে। ‘ঠিকই বলেছো, অযথা লড়ছি আমরা। আজ থেকে আমি তোমাদের একজন।’
‘এসো তাহলে,’ বললো লিটল জন। ‘এগুলো ফেলে রেখে লাভ কি? তোমার সাথে লড়তে গিয়ে খিদে লেগে গেছে আবার। এসো, দু’জনে মিলে শেষ করে রওনা হয়ে যাই শেরউডের উদ্দেশে।’
বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করলো ওরা এবার ডিশগুলোকে। দশ মিনিটের মধ্যেই চেটে পুটে শেষ করে ফেললো সব। বিরাট এক ঢেকুর তুলে বললো বাবুর্চি, ‘যাচ্ছিই যখন, খালি হাতে যাই কেন? রূপোর ডিনার সেট রয়েছে শেরিফের, কারুকাজ করা রূপোর গ্লাস, পেয়ালা, জগ-আরো কত কি! গরীব লোকেদের জরিমানা করে সেই টাকায় কিনেছে শেরিফ এসব। ইচ্ছে করলেই সাথে করে নিয়ে যেতে পারি আমরা সব।’
মস্ত এক বস্তায় শেরিফের ঘরে রূপোর বাসন-কোসন যা ছিল সব ভরে নিয়ে রওনা হয়ে গেল ওরা শেরউডের পথে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেল আস্তানায়।
লিটল জনকে দেখে ছুটে এলো রবিন হুড, দু’হাতে ওর দুই কাঁধ ধরে বললো, ‘কোথায় ছিলে তুমি, লিটল জন? এদিকে তোমার জন্যে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে রয়েছি আমরা সেই থেকে! পিঠে এত বিরাট বোঝা কিসের? সাথের এই লোকটিই বা কে?’
‘বলছি, সব বলছি,’ হাসলো লিটল জন। একে একে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলো সবিস্তারে। সব শুনে হেসে খুন হয়ে গেল দলের সবাই। কিন্তু রবিন গম্ভীর। সেটা লক্ষ্য করে জানতে চাইলো লিটল জন, ‘কোথাও কোন ভুল করে ফেলেছি, ওস্তাদ?’
‘করেছো,’ বললো রবিন। তুমি ফিরে আসতে পেরেছো, সেজন্যে খুবই খুশি হয়েছি আমি। সাথে করে শেরিফের বাবুর্চিকে নিয়ে এসেছো, ভালই করেছো, শেরউডে স্বাগত জানাচ্ছি আমরা তাকে। কিন্তু তুমি যে সাধারণ এক চোরের মত শেরিফের বাসন-পেয়ালা চুরি করে নিয়ে এসেছো, সেটা আমি কিছুতেই খুশি মনে মেনে নিতে পারছি না, লিটল জন। শেরিফকে যা শায়েস্তা করার আমি করেছি, তিনশো পাউণ্ড আদায় করে নিয়েছি ওর শয়তানীর শাস্তি হিসেবে। অপরাধ করেছিল, শাস্তি পেয়েছে, কিন্তু নতুন করে এমন কিছুই তো সে করেনি যার জন্যে তার খাবারের থালা-বাসন চুরি করে নিয়ে আসতে হবে।’
রবিনের বকা খেয়ে খুবই খারাপ লাগলো লিটল জনের। হাসি-তামাশার মধ্যে দিয়ে ব্যাপারটা হালকা করার জন্যে বলে উঠলো, ‘চুরি? চুরি কাকে বলছো তুমি, ওস্তাদ? আমার কথা বিশ্বাস না হয়, দাঁড়াও, এক্ষুণি ডেকে নিয়ে আসছি আমি শেরিফকে। সে যে ওগুলো দান করেছে আমাদের, সেই কথা ওর মুখ দিয়ে বের করে শোনাবো আমি তোমাকে।’ বলেই একছুটে অদৃশ্য হয়ে গেল সে জঙ্গলের আড়ালে, কাউকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে।
পাঁচ মাইল দূরত্ব অতিক্রম করলো লিটল জন কয়েক মিনিটের মধ্যে। এক জায়গায় দলবল নিয়ে শিকাররত শেরিফকে দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো তাঁর পাশে। মাথা থেকে টুপি খুলে এক হাঁটু ভাঁজ করলো সে। বললো, ‘কি খবর, হুজুর? শিকার মিললো কিছু?’
‘আরে! রেনড গ্রীনলীফ না? কোত্থেকে এলে তুমি? একটু আগেই একটা হরিণ মারার জন্যে তীর ছুঁড়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে তোমার কথা ভাবছিলাম।’
‘আমিও আপনার কথা ভাবতে ভাবতে চলে এসেছি, হুজুর,’ বললো লিটল জন। ‘পথে এমন এক দৃশ্য দেখলাম, যা বিশ্বাস করবে না কেউ!’
‘কি দেখেছো?’ জানতে চাইলেন শেরিফ।
‘সাত কুড়ি হরিণের একবিশাল পাল!’ চোখ বড় করে বললো লিটল জন, ‘সবুজ হরিণ!’
‘কী যা-তা বলছো!’ চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল শেরিফের। ‘পাগল হয়েছো তুমি?’
‘নিজের চোখে দেখে এসেছি, হুজুর,’ বললো লিটল জন। ‘আমার সাথে এলে আমি এখনো দেখাতে পারি। কিন্তু আপনার একা যেতে হবে। সবাই এক সাথে গেলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবে ওগুলো।’
পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো লিটল জন, পিছন পিছন চললো সবাই ঘোড়ায় চেপে। সাড়ে চার মাইলের মত গিয়ে সবাইকে থেমে দাঁড়াবার ইঙ্গিত করলো সে। অস্ফুট কণ্ঠে বললো, ‘এসে গেছি প্রায়। এবার এগোতে হবে পায়ে হেঁটে।’
সবাইকে অপেক্ষা করতে বলে ঘোড়া থেকে নেমে পড়লেন শেরিফ, পায়ে হেঁটে এগোলেন লিটল জনের সাথে। বেশ কিছুদূর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলার পর একটা বাঁক নিতেই দেখা গেল একটা বিশাল ওক গাছের ছায়ায় বসে রয়েছে রবিন তার দলবল নিয়ে। ‘ওই দেখুন, হুজুর,’ আঙুল তুলে দেখালো লিটল জন। ‘ওই যে বিশ্রাম নিচ্ছে সাত-কুড়ি সবুজ হরিণ।
ঝট্ করে ফিরলেন শেরিফ লিটল জনের দিকে। ‘তোমাকে চেনা চেনা লেগেছিল আমার, এখন বুঝতে পারছি তুমি কে। প্রতারণা করেছো তুমি আমার সাথে। আসলে তুমি দস্যু লিটল জন!’
হো হো করে হেসে উঠলো লিটল জন। ‘ঠিকই চিনেছেন, হুজুর, ঠিকই বুঝেছেন- তবে একটু দেরিতে। আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই সবুজ হরিণের নেতার সাথে।
ইতিমধ্যে এগিয়ে এসেছে রবিন হুড। আরে! আমাদের মাননীয় শেরিফ এসেছেন দেখতে পাচ্ছি! আজ আবার আরেকটা ভোজ খাবার জন্যে এসেছেন বুঝি?’
‘না, না!’ সভয়ে বললেন শেরিফ, ‘আর কোন ভোজের দরকার নেই। খিদেই নেই আমার আজ।
‘তা বেশ তো, খিদে নেই, তেষ্টা তো থাকতে পারে,’ বললো রবিন হাসতে হাসতে। ‘এই. কে আছো ভাই, আমাদের প্রিয় শেরিফের জন্যে একপাত্র অক্টোবর এল নিয়ে এসো দেখি। তেষ্টায় শুকিয়ে গেছে মাননীয়ের গলা।’
রূপোর একটা পাত্র ভর্তি করে ‘এল’ নিয়ে এলো একজন, মাথা ঝুঁকিয়ে কুর্ণিশ করে বাড়িয়ে ধরলো রূপোর তস্তরির ওপর রাখা পাত্রটা শেরিফের দিকে। হাত বাড়াতে পারলেন না শেরিফ, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলেন পাত্রটার দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তিনি, তাঁরই তস্তরির ওপর তাঁরই পাত্রে করে পরিবেশন করা হচ্ছে মদ।
‘কি হলো, মাস্টার শেরিফ?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন। আমাদের এই রূপালী পরিবেশন পছন্দ হচ্ছে না বুঝি আপনার? এক ব্যাগ ভর্তি বাসন-পেয়ালা পেয়েছি আজ আমরা।’ এই বলে লিটল জন আর বাবুর্চির আনা বস্তাটা উঁচু করে তুলে ধরে দেখালো সে শেরিফকে।
তিক্ততায় ভরে গেল শেরিফের মনটা। একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না তিনি, মুখ নিচু করে চেয়ে রইলেন মাটির দিকে। কিছুক্ষণ তাঁর হাবভাব লক্ষ্য করলো রবিন হুড, তারপর বললো, ‘শুনুন, মাননীয় শেরিফ, গতবার আপনি যখন শেরউডে এসেছিলেন তখন আপনার নিয়ত ছিল খারাপ, লোভে পড়ে ঠকাতে এসেছিলেন এক বড়লোকের নির্বোধ সন্তানকে; উল্টে ঠকে গিয়েছিলেন নিজেই। কিন্তু এবারের কথা ভিন্ন। কাউকে ঠকাতে বা কারো কোন ক্ষতি করতে আসেননি এবার আপনি। মোটা, লোভী, অর্থপিশাচ ধর্মযাজক কিংবা নিষ্ঠুর, ধনী, অত্যাচারী জমিদারের বাড়তি টাকা কেড়ে নিই আমি, বিলিয়ে দিই যাদের শুষে ওরা ওই টাকা উপার্জন করেছে তাদের মধ্যে। আপনার কোন প্রজা আছে বলে আমার জানা নেই, কারো ওপর অত্যাচার করেছেন বলেও কোন খবর আসেনি আমার কানে। কাজেই আপনার জিনিস আপনি ফেরত নিয়ে যান, ভুলে চলে এসেছিল ওগুলো আমাদের কাছে। থলি থেকে একটা পয়সাও বের করতে বলবো না আমরা আজ আপনাকে। চলুন, আপনার লোকজনের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে আসি।’
ভারি বস্তাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো রবিন, পিছু পিছু চললেন হতভম্ব শেরিফ, বাকশক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে তাঁর। শেরিফের লোকজনের থেকে একশো গজ দূরে এসে থামলো রবিন, বস্তাটা ধরিয়ে দিল শেরিফের হাতে, মুখে বললো, ‘আজকের এই ঘটনার জন্যে আমি দুঃখিত, মাননীয় শেরিফ।
পিছন ফিরে দ্রুতপায়ে অদৃশ্য হয়ে গেল রবিন জঙ্গলের মধ্যে। তাজ্জব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন শেরিফ সেই দিকে চেয়ে। তারপর ফোঁশ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারি বোঝাটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পা বাড়ালেন সামনে।
মস্ত এক বোঝা নিয়ে শেরিফকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেল তাঁর সাথের লোকজন। কিন্তু বারবার জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেল না তারা। মনে হচ্ছে যেন স্বপ্নের ঘোরে রয়েছেন শেরিফ। নীরবে ঘোড়ার পিঠে চাপালেন তিনি বস্তাটা, তারপর উঠে পড়লেন নিজেও ছুটিয়ে দিলেন ঘোড়া। সবাই চললো তাঁর পিছন পিছন।
সোজা নটিংহামে ফিরে চললেন শেরিফ। এলোমেলো চিন্তার ঝড় চলেছে তাঁর মাথার ভিতর, কিছুই পরিষ্কার বুঝতে পারছেন না তিনি, এক চিন্তা এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে অপরটির গায়ে, গুলিয়ে যাচ্ছে সব। কেমন লোক এই রবিন হুড?