১৭. গাই অফ গিসবোর্ন

১৭. গাই অফ গিসবোর্ন

এত চেষ্টা করেও রবিন হুড বা তার কোন অনুচরকে ধরতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ফিরে গেল রাজার সৈন্য। এই ধরতে না পারার পেছনে আসল কারণ অক্ষমতা নয়, নেতৃত্বের অভাব। রবিনের হাতে শায়েস্তা হয়ে হেরিফোর্ডের বিশপ ভয় পেয়ে সমস্ত দায়-দায়িত্ব ফেলে সেই যে পালিয়ে চলে গেলেন নিজের মঠে, আর এলেন না। সৈন্যদের সঠিক ভাবে পরিচালনা করবার আর কেউ রইলো না। ওদিকে কুমন্ত্রণা দেবার লোকটা সরে যেতেই রানী এলেনর স্যার রবার্ট লী-র সহযোগিতায় রাজাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন যে কাজটা খুবই অন্যায় হয়ে গেছে, শপথের অমর্যাদা করে এভাবে রবিন হুডকে তাড়া করা ঠিক হচ্ছে না। হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপের রণে ভঙ্গ দেয়ার সংবাদও পৌঁছলো এসে রাজধানীতে। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই সমস্ত সৈন্য ফেরত নিয়ে আসার আদেশ দিলেন রাজা দ্বিতীয় হেনরী।

তবু আরও অনেকদিন পর্যন্ত খুবই সাবধানে চলাফেরা করলো রবিন ও তার দলবল, জঙ্গল ছেড়ে খুব একটা বেরোলো না। অবশ্য জঙ্গলের মধ্যেই আনন্দের কোন অভাব নেই তাদের; হাসি, গল্প, ভুরিভোজ, নানান ধরনের খেলাধুলো, গান ইত্যাদি নিয়ে সুন্দর কাটছে ওদের সময়। ধীরে ধীরে অবস্থাটা স্বাভাবিক হয়ে আসতেই আবার মুক্ত স্বাধীন ভাবে চলাফেরার অধিকার পেয়ে আনন্দের পরিমাণ বেড়ে গেল আরও।

অনেকদিন কেটে গেল এইভাবে। বাইরের জগতে পরিবর্তন ঘটে গেল অনেক। রাজা হেনরী মারা গেলেন, ইংল্যাণ্ডের সিংহাসনে বসলেন সিংহ হৃদয় রাজা রিচার্ড অনেক কান ঘুরে সব খবরই শেষ পর্যন্ত শেরউডে এসে পৌঁছায় বটে, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার এইসব সংবাদে খুব একটা আলোড়িত হয় না জঙ্গলবাসীরা, যেমন চলছিল তেমনি ঢিমে তেতালায় চলে ওদের জীবন যাত্রা।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরেই লিটল জনকে ডাকলো রবিন, ‘চলো হে, বেরিয়ে পড়ি। শুয়ে-বসে ঘুণ ধরে গেছে হাড়ে। কিছু একটা ঘটাতে না পারলে একঘেয়ে লাগছে জীবনটা।’

‘তা তো বুঝলাম, ওস্তাদ,’ বললো লিটল জন, কিন্তু তোমার সাথে কোথাও গেলেই তো কপালে হয় পিট্টি, নয়তো দাবড়ানি জোটে।’

‘ঠিক আছে, যেয়ো না তাহলে, ‘ উঠে পড়তে গেল রবিন হুড।

‘আরে, আরে! রাগ করছো কেন!’ লাফিয়ে এসে ওর হাত ধরলো লিটল জন। ‘ঠাট্টা করছিলাম, ওস্তাদ। তোমার সাথে গিয়ে পিট্টি আর তাড়া খেয়েও তৃপ্তি আছে। চলো বেরিয়ে পড়ি।’

বেরিয়ে পড়লো দু’জন। কোমরে ঝুলিয়ে নিয়েছে তলোয়ার, পিঠে তীর-ধনুক। মনটা খুঁতখুঁত করছে রবিনেরঃ সত্যিই কি ওর সাথে গেলে বিপদ হয় লিটল জনের? মনে পড়লো মিজ দ্য মিলারের হাতে পাইকারী পিট্টি খাওয়ার কথা, রানীর সম্মানে লণ্ডনে গিয়ে বেমক্কা তাড়া খাওয়ার কথা। ভাবলো, দু’জন আলাদা গেলে কি হয় দেখা যেতে পারে। চলতে চলতে রাস্তা যেখানটায় দুই ভাগ হয়ে গেছে সেখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। বললো, ‘এক কাজ করা যাক, লিটল জন। আমার সাথে গেলে তোমার কপালে পিট্টি জোটে, নাকি তোমার সাথে গেলে আমার এই ব্যাপারটার আজ নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া দরকার। এসো, দু’জন দুই পথ ধরে হাঁটতে শুরু করি, আলাদা আলাদা। দেখা যাক আজ কার কপালে কি জোটে।

তুমি এখনও রেগে আছো, ওস্তাদ। আমি কিন্তু ওভাবে কথাটা বলিনি।’

‘বেশ তো,ওভাবে বলোনি, ভাল কথা,’ বললো রবিন। ‘কিন্তু কথাটা শোনার পর থেকে মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করছে। দেখাই যাক না, দু’জন দু’পথে গেলে কি হয়।

‘ঠিক আছে,’ রাজি হলো লিটল জন। ‘তুমি ডানদিকের পথ ধরে চলে যাও, আমি যাচ্ছি বামদিকের রাস্তায়। দেখা যাক কি আছে কার কপালে।’

দু’জন রওনা হয়ে গেল দুই রাস্তায়। কিছুদূর এগিয়েই একে অন্যের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল—দুই রাস্তার মাঝখানে দুর্ভেদ্য ঘন জঙ্গল, দৃষ্টি চলে না।

হাঁটছে রবিন। বিভোর হয়ে হাঁটছে জঙ্গলের শোভা দেখতে দেখতে। ডালে বসে মনের সুখে ডাকছে পাখি, পাতার ফাঁক গলে পথের ওপর ঝিলমিল করছে সকালের রোদ। মনোরম পরিবেশ। হঠাৎ একটা বিশাল ওক গাছের নিচে অদ্ভুত পোশাক পরা এক লোক দেখে থমকে দাঁড়ালো সে। লোকটা ওকে দেখতে পায়নি বুঝতে পেরে অনেকক্ষণ ধরে গভীর আগ্রহের সাথে দেখলো সে লোকটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। আশ্চর্য! এমন উদ্ভট পোশাক জীবনে দেখেনি সে। লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘোড়ার চামড়া দিয়ে ঢাকা। চামড়ার ওপর থেকে লোমগুলো সরানো হয়নি। মাথার কান-ঢাকা টুপিটাও ঘোড়ার লোমশ চামড়া দিয়ে তৈরি। এমন ভাবে টেনে দিয়েছে টুপিটা যে লোকটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। কোমরে বাঁধা রয়েছে একটা বড়সড় তলোয়ার, পিঠে তীর-ভরা তৃণ। ধনুকটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রাখা।

‘কে হে ভাই, তুমি?’ এগিয়ে গেল রবিন, ‘গায়ে কি পরেছো ওটা? কসম খোদার, এমন উদ্ভট পোশাক জীবনে দেখিনি আমি! প্রথমে তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম নরক থেকে বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন যমরাজ নিকোলাস, ডাকতে এসেছো আমাকে!’

কথার কোন জবাব দিল না লোকটা, টুপিটা শুধু খানিকটা ঠেলে দিল পিছনে। দেখা গেল, ভুরু কুঁচকে কটমট করে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে শকুনের ঠোঁটের মত বাঁকা নাকওঅলা ভয়ঙ্কর চেহারার এক লোক। গালের কিছু ভাঁজ আর সরু, চাপা ঠোঁট দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারলো রবিন, লোকটা অত্যন্ত নীচ, বদ ও নিষ্ঠুর। মুখের দিকে চাইলে শিরশির করে ওঠে গা।

ইতর কোথাকার! তুমি কে?’ কর্কশ কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লো লোকটা।

‘আহা-হা, চটছো কেন, ভাই?’ বললো রবিন, ‘সেরকায় ভিজিয়ে বিছুটি পাতা খেয়েছো নাকি সকালের নাস্তা? এত ঝাল কেন কথায়?’

‘আমার কথা পছন্দ হচ্ছে না বুঝি?’ বললো লোকটা, ‘ভালো চাও তো কেটে পড়ো মানে মানে। কারণ, আমার কাজ দেখলে আরও অপছন্দ হবে তোমার।’

‘কে বললো পছন্দ হচ্ছে না,’ আরো দু’পা এগিয়ে বসে পড়লো রবিন লোকটার সামনে, ‘এমন চাঁছাছোলা, কর্কশ, দুর্বিনীত, প্রায়-অভদ্র কথাবার্তা আমার খুবই ভাল লাগে। আরও বলো, শুনি।’

যেন এক্ষুণি ঝাঁপিয়ে পড়ে গলা কামড়ে ধরবে, এমনি ভঙ্গিতে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো লোকটা রবিনের চোখের দিকে। রবিনও সহজ, সরল, নিষ্পাপ, ড্যাবডেবে দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো লোকটার চোখের দিকে-হাসির লেশমাত্র চিহ্ন নেই ওর চোখে- মুখে। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো দু’জন দু’জনের চোখের দিকে, তারপর নীরবতা ভঙ্গ করলো লোকটা। ‘কি নাম তোমার?’

‘বাহ্!’ বললো রবিন, ‘মুখ দিয়ে কথা বেরোলো তাহলে! আমি ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাকে দেখে ভয়ে জবান বন্ধ হয়ে গেছে বুঝি তোমার। যাই হোক, নাম জিজ্ঞেস করছো, বলবো, কিন্তু বাপু, তোমার নিজের পরিচয়টা আগে দাও; এই অঞ্চলে আমি নতুন লোক, কিন্তু তুমি আমার চেয়েও নতুন। সবচেয়ে আগে শোনা যাক, এত সুন্দর চেহারাটা অমন বিচ্ছিরি পোশাক পরে কদাকার করেছো কেন।’

কথা শুনে কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠলো লোকটা। বললো, ‘তোমার দুঃসাহস দেখে না হেসে পারছি না। কেন যে এক চড়ে তোমার দাঁত ক’টা খসিয়ে দিচ্ছি না এখনও বুঝতে পারছি না ঠিক। জীবনে এত বড় কথা উচ্চারণ করে কেউ পার পায়নি আমার হাত থেকে। ঠিক দুইদিন আগে নটিংহাম শহরে এর অর্ধেক বলার জন্যে একজনকে শিক- কাবাব বানিয়ে রেখে এসেছি। যাই হোক, এই পোশাকে শরীরটা তো গরম থাকেই, বর্মেরও কাজ দেয় অনেকটা। নামটা জানতে চাইছো, ভয় পেয়ো না আবার, আমার নাম গাই অফ গিসবোর্ন। হেরিফোর্ডশায়ারের জঙ্গলে আমার বাস। আমি দস্যু। ভয়ঙ্কর এক দস্যু। কিছুদিন আগে হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপ আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন, নটিংহামশায়ারের শেরিফের হয়ে যদি আমি সামান্য একটা কাজ করে দিই, আমার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ তুলে নিয়ে আমাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে, এবং সেই সাথে পুরস্কার দেয়া হবে দুইশো পাউণ্ড। কাজেই সোজা চলে এলাম আমি নটিংহাম শহরে, দেখা করলাম মাননীয় শেরিফের সাথে। কি কাজ দিলেন তিনি আমাকে জানো? অতি সাধারণ একটা কাজঃ শেরউডে এসে রবিন হুড বলে একটা লোককে খুঁজে বের করে হয় তাকে মেরে রেখে, নয়তো ধরে নিয়ে যেতে হবে। এই লোকটাও নাকি একটা দস্যু। শেরিফ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছেন আর কি। রাজি হয়ে গেলাম এক কথায়। কারণ, এর অর্ধেক টাকা পেলে নিজের ভাইয়ের গলায় ছুরি চালাতেও আপত্তি নেই আমার। চলে এসেছি। এই জঙ্গলের দক্ষিণ সীমান্তে কিংস হেড বলে এক সরাইখানায় লোকজন নিয়ে অপেক্ষা করছেন শেরিফ আমার জন্যে।’

চুপচাপ শুনলো রবিন লোকটার কথা, রাগে ফুঁসছে ভিতরটা, কিন্তু হাবভাবে প্রকাশ পেল না কিছুই। ভাল করেই চেনে সে গাই অফ গিসবোর্নকে, এর ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুরতার অনেক খবরই এসে পৌঁছেছে ওর কানে; এর মত এত নীচ, জঘন্য চরিত্রের লোক গোটা ইংল্যাণ্ডে আর আছে কিনা সন্দেহ। গা-টা রি-রি করে উঠলো রবিনের, কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘তোমার অনেক সু-কীর্তির কথা শুনেছি আমি। শুনেছি তলোয়ার খেলায় নাকি তোমার জুড়ি নেই। আমার মনে হয় রবিন হুডের সাথে তোমার সাক্ষাৎ হওয়া দরকার। তাহলে দেখা যেত কে কার চেয়ে বড়।’

‘কে বড় সেটা দেখার কিছু নেই,’ বললো লোকটা। ‘ও আমার জানাই আছে। আমার সাথে সাক্ষাতের দশ মিনিটের মধ্যে যে ওর মৃত্যু ঘটবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।’

‘কিন্তু যদি উল্টোটা হয়ে যায়?’ অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো রবিন। যদি দেখা যায় সে-ই পিটিয়ে লাশ করে ফেললো তোমাকে, তখন? শুনেছি তার মত শক্তিশালী লোক এই অঞ্চলে নেই।’

‘সেটা হতে পারে,’ বললো গাই অফ গিসবোর্ন। এই অঞ্চলের সেরা হতে পারে সে। কিন্তু জেনে রাখো, এই অঞ্চলের বাইরে গোটা একটা দুনিয়া পড়ে রয়েছে। তলোয়ারে তো পারবে না-ই, আমার বিশ্বাস অনায়াসে টেক্কা দিতে পারবো আমি ওকে তীর-ধনুকেও।’

‘উঁহু,’ এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লো রবিন। ‘এটা আমি বিশ্বাস করি না। নটিংহামের আমরা এই একটা ব্যাপারে অন্তত গর্ব করতে পারি। তীর-ধনুকে আমাদের জুড়ি নেই। রবিন হচ্ছে আমাদের মধ্যে আবার সেরা। ওর কথা ছেড়েই দাও, আমি যে এক সাধারণ লোক, আমার সাথেই পারবে না তুমি।’

বিস্মিত দৃষ্টিতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো রবিনকে গাই অফ গিসবোর্ন, তারপর হা হা করে কর্কশ কণ্ঠে হেসে উঠলো। ‘তোমার দুঃসাহস দেখে হাসবো না কাঁদবো বুঝে উঠতে পারছি না। বিশ্বাস করো, এই ধরনের কথা বলে আমার হাত থেকে পার পেয়েছে খুব কম লোকই। ঠিক আছে, একটা মালা বানিয়ে টাঙাও দেখি, প্রথমে তোমার সাথেই হয়ে যাক আমার এক হাত।’

‘মালা-টালার যুগ পার হয়ে এসেছি আমরা বহু আগেই,’ বললো রবিন। ‘আজকাল বাচ্চা ছেলেরা ছাড়া এই অঞ্চলের কেউ ওই রকম টার্গেট ব্যবহার করে না। বড়দের টার্গেট কাকে বলে দেখাচ্ছি তোমাকে।’ বলে উঠে গিয়ে কাছের একটা হেজেল-ঝাড় থেকে দু’আঙুল মোটা একটা ডাল কেটে নিয়ে ছাল ছাড়াতে শুরু করলো রবিন। তারপর একদিক চোখা করে আশি কদম দূরে একটা ওক গাছের সামনে কাঠিটা গেড়ে দিল মাটিতে। ফিরে এসে বললো, ‘সত্যিকার তীরন্দাজ যদি হও, তিনবার সুযোগ পাবে তীর ছোঁড়ার, লাগাও ওই ডালে।

‘ওরেব্বাপ!’ উঠে দাঁড়ালো গাই অফ গিসবোর্ন, ‘সাক্ষাৎ শয়তানও তো লাগাতে পারবে না ওটায়!’

হয়তো পারবে, কিংবা পারবে না,’ বললো রবিন। ‘যতোক্ষণ না তুমি তীর ছুঁড়ছো, ততক্ষণ বোঝার উপায় নেই।’

কথা শুনে ভুরু কুঁচকে রবিনের দিকে চাইলো গাই অফ গিসবোর্ন। ওর সরল হাবভাব দেখে মনে করলো, অর্থ না বুঝেই বলেছে ও কথাটা; তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ছিলা পরালো নিজের ধনুকে। পরপর তিনবার তীর মারলো সে ডালটা লক্ষ্য করে, কিন্তু একটাও লাগলো না। হেসে উঠলো রবিন। বললো, ‘দেখা যাচ্ছে, সাক্ষাৎ শয়তানের পক্ষে সত্যিই এই লক্ষ্য ভেদ করা সম্ভব নয়। মিঞা, তলোয়ারেও যদি এই পদের ওস্তাদ হও, তাহলে নির্ঘাৎ মারা পড়বে তুমি রবিনের হাতে।’

ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করলো গাই অফ গিসবোর্ন, দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘কি! যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! সাবধান বলে দিচ্ছি, এখনও সাবধান হও, নইলে টেনে ছিঁড়ে নেব জিভ।’

রাগে আর ঘৃণায় কাঁপছে রবিনের বুকের ভিতরটা। ইচ্ছে করছে এক্ষুণি টান দিয়ে তলোয়ারটা বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাষণ্ডটার ওপর, কিন্তু তার আগে, ভাবলো, ধনুকের জাদু দেখিয়ে দেয়া দরকার হারামজাদাকে। কোন কথা না বলে একটা তীর বেছে নিয়ে পরালো ছিলায়, তারপর যেন নিতান্তই অবহেলা ভরে মারলো ডালটা লক্ষ্য করে।

চড়াৎ করে দু’ফাঁক হয়ে গেল হেজেলের কাঠি। প্রতিপক্ষকে বিস্ময় প্রকাশের সুযোগ না দিয়েই ধনুকটা ছুঁড়ে ফেলে দিল রবিন মাটিতে। তারপর একটানে তলোয়ারটা বের করে জ্বলন্ত চোখে চাইলো গাই অফ গিসবোর্নের দিকে। ‘আয় দেখি, বদমাশ! মরণ বাড় বেড়েছে তোর, আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন! আমিই রবিন হুড!

কিছুক্ষণ থ হয়ে চেয়ে রইলো গাই অফ গিসবোর্ন রবিনের মুখের দিকে। কিন্তু বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে তার বেশি সময় লাগলো না, ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠলো তার চেহারায়। ‘ও, তুমিই রবিন হুড! বেশ, মৃত্যুর জন্যে তৈরি হয়ে যাও। ইষ্টনাম জপ করে নাও এখুনি, পরে সময় পাবে না আর।’ সড়াৎ করে খাপ থেকে টেনে তরবারী বের করে ফেললো সে।

শুরু হলো যুদ্ধ। এমন ভয়ঙ্কর অসি-যুদ্ধ আর শেরউডে হয়নি কোনদিন। প্রবল বিক্রমে আক্রমণ করলো একে অপরকে। দু’জনেই জানে যতক্ষণ না একজনের মৃত্যু ঘটছে ততক্ষণ থামবে না এই লড়াই। একবার সামনে এগিয়ে গিয়ে, একবার পিছনে হটে এসে, একবার ডাইনে সরে, একবার বামে ঘুরে লড়ছে দুজন, পায়ের চাপে সবুজ ঘাসগুলো দুমড়ে সমান হয়ে গেল মাটির সাথে, তার ওপর টপ টপ ঝরছে তাজা রক্তের ফোঁটা। ইতিমধ্যে শরীরের কয়েক জায়গায় রবিনের তরবারীর খোঁচা খেয়েছে গাই অফ গিসবোর্ন, কিন্তু একটি বারের জন্যেও নিজেরটা ছোঁয়াতে পারেনি রবিনের গায়ে, অকল্পনীয় ক্ষিপ্রতার সাথে এড়িয়ে গেছে সে প্রতিটা আঘাত। হঠাৎ গাই অফ গিসবোর্নের এক প্রচণ্ড আক্রমণ এড়াবার জন্যে হালকা পায়ে লাফিয়ে পিছনে সরে আসতে গিয়ে একটা শিকড়ে পা বেধে পড়ে গেল রবিন চিত হয়ে। অসি-যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী কেউ পড়ে গেলে তাকে আক্রমণ করা উচিত নয়, কিন্তু সুযোগ বুঝে লাফিয়ে এগিয়ে এলো গাই অফ গিসবোর্ন, রবিনের বুক লক্ষ্য করে চালালো তলোয়ার। উপায়ান্তর না দেখে খালি হাতেই ধরে ফেললো রবিন ক্ষুরধার তরবারীটা। যদিও হাতের তালু কেটে গেল বেশ খানিকটা, ঠেলা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারলো সে তলোয়ারের আগাটা; ঘ্যাঁচ করে আধ হাতের মত ঢুকে গেল ওটা মাটির ভেতর। সাথে সাথেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো রবিন, তলোয়ারটা মাটি থেকে টেনে বের করবার আগেই প্রচণ্ড জোরে মারলো গাই অফ গিসবোর্নের ডান বাহুতে। হাত থেকে তলোয়ার খসে যেতেই ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেল পাষণ্ডটার মুখ, টলতে টলতে দু’পা পিছিয়ে গেল সে, কিন্তু আর কোন সুযোগ দিল না ওকে রবিন, তলোয়ারের এক খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল ওর হৃৎপিণ্ড। দুই হাত দু’দিকে ছড়িয়ে ভয়ঙ্কর এক মরণ-চিৎকার দিল গাই অফ গিসবোর্ন, তারপর একপাক ঘুরে দড়াম করে পড়লো মাটিতে মুখ থুবড়ে।

তলোয়ারের রক্ত মুছে ওটা খাপে পুরে দু’হাতে বুক বেঁধে চেয়ে রইলো রবিন গাই অফ গিসবোর্নের মৃতদেহের দিকে। মনে মনে ভাবছে, ‘আবার একটা মানুষ খুন করলাম। জীবনের প্রথম সেই যে রক্ষী প্রধানকে মেরেছিলাম, তারপর এতদিন পর আবার খুন করতে বাধ্য হলাম আরেকজনকে। সেদিন ভয়ানক খারাপ লেগেছিল, মনে মনে বড় দুঃখ হয়েছিল লোকটার স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কথা চিন্তা করে কিন্তু আজ? আজ মনে হচ্ছে, ভয়ঙ্কর, নীচ এক পিশাচের হাত থেকে রক্ষা করলাম দেশের আর সব মানুষকে। ফসল বিনষ্টকারী বন্য শূয়োর মারতে পারলে যেমন হয়, তেমনি আনন্দ হচ্ছে। যাই হোক, এর কথা থেকে বোঝা গেল, যথেষ্ট শিক্ষা হয়নি শেরিফের, এখনও আমাকে ধ্বংস করার ফিকিরে রয়েছে-এর একটা বিহিত করা দরকার। দেখা যাক, আজই খানিকটা ধার শোধ করে দেয়া যায় কিনা।’

ঘোড়ার চামড়ার রক্তমাখা পোশাক খুলে ফেললো রবিন গাই অফ গিসবোর্নের শরীর থেকে, নিজের কাপড়ের ওপর পরে নিল ওগুলো। ওর তলোয়ার আর ড্যাগারটা ঝুলিয়ে নিল নিজের কোমরে, তীর-ভরা তূণ বেঁধে নিল পিঠে, ধনুকটা ঝুলিয়ে নিল কাঁধে, তারপর ঘোড়ার চামড়ার মুখঢাকা টুপিটা সামনের দিকে টেনে দিয়ে নিজের অস্ত্রশস্ত্র আর শিঙাটা হাতে নিয়ে রওনা হলো কিংস হেড সরাইখানার উদ্দেশে। পথে গাই অফ গিসবোর্নের ছদ্মবেশে যে-ই দেখলো ওকে, ছুটে পালালো সামনে থেকে-এত দূরেও এসে পৌঁছেছে লোকটার কুখ্যাতি।

ওদিকে এসব ঘটনার কিছুই জানে না লিটল জন, হাঁটতে হাঁটতে শেরউডের বাইরে চলে এলো সে, রাজপথ ধরে আরো কিছুদূর এগিয়ে ছোট একটা জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলো। হেরিফোর্ডের বিশপের হাত থেকে রবিনকে যে বিধবা বুড়িটা বাঁচিয়েছিল, তার পর্ণ কুটিরটা চোখে পড়লো ওর। লম্বা পা ফেলে পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছিল লিটল জন, হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো-কে ফোঁপায়? কান খাড়া করে কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করতেই আবার শুনতে পেল সে শব্দটা, সত্যিই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ। মনে হচ্ছে কুটির থেকেই আসছে আওয়াজটা।

পা টিপে কুটিরের দরজার কাছে চলে এলো লিটল জন। দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখলো, সেই বুড়িটাই, দুই হাতে চোখ ঢেকে রেখেছে, প্রবল বেগে কাঁপছে ওর পিঠটা।

বিশাল দৈত্যের মত চেহারা হলে কি হবে, কারও দুঃখ সহ্য করতে পারে না লিটল জন, কাউকে কাঁদতে দেখলে নিজের চোখেও পানি এসে যায় তার। ঘরের ভেতর ঢুকে এলো সে, বুড়ির পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, আর বলছে, ‘কি হয়েছে, বুড়ি মা, কি হয়েছে বলো আমাকে। কিসের এত দুঃখ? আমি আছি না, শুধু একবার মুখ ফুটে বলো কি সাহায্য দরকার।

প্রথম দিকে মাথা নেড়ে বোঝাবার চেষ্টা করলো বুড়ি, যে ওকে সাহায্য করার সাধ্য কারও নেই; কিন্তু লিটল জনের নরম কণ্ঠের আশ্বাস আর সান্ত্বনার বাণী শুনে কিছুটা শান্ত হলো সে,কান্না থামিয়ে শোনালো ওর মহাবিপদের কথা। তিনটি ছেলে ছাড়া কেউ নেই ওর দুনিয়ায়, ওরাই ওর কলজের টুকরো, ওরাই ওর সব। হ্যাল, হব আর ডিকন। ক্ষুধার তাড়নায় বড় ছেলেটা গতকাল রাতে হরিণ মেরেছিল একটা, আজ সকালে রক্তের দাগ ধরে ধরে এসে হাজির হয়েছে কয়েকজন জঙ্গল-রক্ষী, তিনজনকেই ধরে নিয়ে গেছে ওরা কিংস হেড সরাইখানায় বিশ্রামরত শেরিফের কাছে, আজই ঝুলিয়ে দেয়া হবে ফাঁসীতে।

‘কিংস হেড সরাইখানায় ধরে নিয়ে গেছে ওদের, ঠিক জানো?’ জানতে চাইলো লিটল জন।

‘হ্যাঁ, বাবা,’ বললো বুড়ি। ওরা বলছিল, রবিন হুডকে খুন করার জন্যে নাকি একজনকে পাঠানো হয়েছে শেরউডে, তারই অপেক্ষায় ওই সরাইখানায় বসে আছেন নটিংহামের শেরিফ।’

‘হুম!’ গম্ভীর হয়ে গেল লিটল জন। ‘রবিন হুডকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই, নিজেকে রক্ষা করার ক্ষমতা তার আছে। আমি ভাবছি, এখনও হয়তো সময় আছে, হয়তো এক্ষুণি রওনা হয়ে গেলে তোমার ছেলেদের রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। একা যাব, নাকি দলবল সঙ্গে নেয়ার জন্যে ফিরে যাব শেরউডে… কিন্তু ওদিকে সময়ও তো নেই। ইশশ! এখন রবিন থাকলে বলে দিতে পারতো কি করা উচিত।’ নিজের মাথায় জোরে জোরে তিনটে টোকা দিল সে আঙুলের গিঠ দিয়ে, তারপর বললো, ‘নাহ্, এক্ষুণি আমার রওনা হওয়া দরকার কিংস হেড সরাইখানার দিকে। আচ্ছা, বুড়ি মা, তোমার কাছে কিছু জামা কাপড় আছে? এই লিংকন গ্রীন ছেড়ে কোন ছদ্মবেশ না নিলে কাছেই ভিড়তে পারবো না শেরিফের।’

এই কথা শুনে পুরানো ট্রাঙ্ক থেকে মৃত স্বামীর কিছু জামা-কাপড় বের করে দিল বুড়ি। লিংকন গ্রীন ছেড়ে সেগুলো পরে নিল লিটল জন। উল দিয়ে নকল দাড়ি আর পরচুলা বানিয়ে পরে নিতেই তার খয়েরী চুল-দাড়ি ঢাকা পড়লো। এবার মাথার ওপর মস্ত এক টুপি চাপিয়ে পিঠে তীর-ধুনক আর হাতে লাঠি নিয়ে রওনা হয়ে গেল সে কিংস হেড সরাইখানার উদ্দেশে।

শেরউড জঙ্গলের দক্ষিণ সীমান্ত থেকে সামান্য কিছুটা দূরেই বিখ্যাত কিংস হেড সরাইখানা। মহা হৈ-চৈ চলেছে আজ সরাইখানায় সকাল থেকেই। জনা কুড়ি কনস্টেবল নিয়ে গাই অফ গিসবোর্নের ফিরে আসার অপেক্ষা করছেন শেরিফ এখানে। ভাল ভাল রান্না চড়ানো হয়েছে চুলোয়, ভালো মদ বের করা হয়েছে সেলার থেকে। একটা টেবিলে বসে খাচ্ছেন শেরিফ, কাছেই কয়েকটা বেঞ্চিতে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প- গুজব করছে আর মদ খাচ্ছে শেরিফের লোকজন, বাইরে এখানে-ওখানে বাঁধা রয়েছে ঘোড়াগুলো—লেজ নাড়াচ্ছে, আর পা ঠুকছে ওগুলো মাটিতে। এমনি সময়ে বিধবা বুড়ির তিন ছেলেকে নিয়ে হাজির হলো কয়েকজন জঙ্গল-রক্ষী। পিছমোড়া করে ছেলেগুলোর হাত বেঁধেই ক্ষান্ত হয়নি ওরা, গলায় দড়ির ফাঁস পরিয়ে বেঁধেছে একজনের সাথে আরেকজনকে। ভোজনরত শেরিফের সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে শুরু করলো ছেলেগুলো তাঁর ভ্রুকুটির বহর দেখে।

সব শুনে হুঙ্কার ছাড়লেন শেরিফ, ‘রাজার হরিণ মেরে খাওয়া হচ্ছে, না? বড় বাড় বেড়ে গেছে তোমাদের! অনেকদিন কাউকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি দেখে ভেবেছো স্বরাজ মিলে গেছে! দাঁড়াও, তোমাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেব আমি আজ। এ রকম অরাজকতা আর চলতে দেয়া যায় না। গেরস্ত যেমন অন্য কাকদের ভয় দেখাবার জন্যে দু’তিনটেকে মেরে ঝুলিয়ে দেয়, ঠিক তেমনি ঝুলিয়ে দেব আমি আজ তোমাদের।’

কিছু বলার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিল বড় ছেলেটা, প্রচণ্ড এক ধমকে তাকে থামিয়ে দিলেন শেরিফ। জঙ্গল-রক্ষীদের আদেশ দিলেন যেন ওদের বাইরে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে, খাওয়া-দাওয়া সেরেই ওদের সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করবেন তিনি তিনজনকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। হতাশ হৃদয়ে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করলো ওরা, যতক্ষণ না খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলেন শেরিফ। ওদের আশা ছিল, হয়তো শেরিফ ওদের বক্তব্য শুনতে চাইবেন; কেন ওরা হরিণ মারতে বাধ্য হয়েছে সেটা ব্যাখ্যা করে বলবার সুযোগ দেবেন, ক্ষমা প্রার্থনার একটা সুযোগ হয়তো ওরা পাবে। কিন্তু ওসবের ধার দিয়েও গেলেন না শেরিফ। বেরিয়ে এসে নিজ অনুচরদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই তিন বদমাশকে ফাঁসী দিতে হবে এক্ষুণি। কিন্তু এখানে নয়, ওই যে দেখা যাচ্ছে, শেরউড জঙ্গল, ওখানে নিয়ে গিয়ে একটা গাছে ঝুলিয়ে দেব আমরা ওদের। এর ফলে ওই জঙ্গলের দুস্যগুলো টের পাবে, ধরা পড়লে কি শাস্তি অপেক্ষা করছে ওদের জন্যে

কথাটা বলেই নিজের ঘোড়ায় চেপে বসলেন শেরিফ, অন্যেরাও চড়লো যে-যার ঘোড়ায়, গলায় বাঁধা দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো বিধবার তিন ছেলেকে শেরউড জঙ্গলের ধারে। ঝপট্ গলায় ফাঁস পরিয়ে দড়ির অপর প্রান্তগুলো বিশাল এক ওক গাছের মোটা ডালের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হলো। চোখে পানি এসে গেল ছেলেদের, হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে দয়া প্রার্থনা করলো শেরিফের কাছে। শুনে হা-হা করে হেসে উঠলেন শেরিফ টিটকারির হাসি।

দিয়া বা ক্ষমার ধার ধারি না,’ বললেন তিনি। আমার কাজ আইন সংরক্ষণ। ক্ষুধার জ্বালায় মেরেছি, বা ওই রকম কোন আহ্লাদের কথা আমি শুনতে চাই না; দোষ করেছো শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু…’ একটু যেন চিন্তায় পড়ে গেলেন তিনি, ‘মরার আগে তোমাদের পাপ স্বীকার করে মুক্তির কোন ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এখানে পাদ্রী পাবো কোথায়? উপায় নেই, পাপের বোঝা পিঠে নিয়েই রওনা দিতে হবে তোমাদের; সেন্ট পিটারের কাছে কাকুতি মিনতি করে দেখো, তাঁর দয়া হলে স্বর্গের গেট খুলে দিতেও পারেন।’

কথা শুনে হেসে উঠলো শেরিফের কয়েকজন কর্মচারী।

এইসব যখন চলছে, তখন কোত্থেকে এক বুড়ো এসে লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো একপাশে। ধবধবে সাদা কোঁকড়ানো চুল-দাড়ি, পিঠে ইউ-ডালের বিশাল এক ধনুক- দেখলেই বোঝা যায়, যৌবনের স্মৃতি পিঠে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে বুড়ো, আসলে এখন এই ধনুকে ছিলা পরাবার সাধ্যও তার নেই। দড়ি টেনে ছেলেগুলোকে শূন্যে তোলার হুকুম দিতে গিয়ে চারপাশে একবার চাইলেন শেরিফ, চট্ করে চোখ পড়লো বুড়োর ওপর। হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন তিনি তাকে। এদিকে এসো দেখি, তোমার সাথে দুটো কথা আছে।’

কাছে এসে দাঁড়ালো বুড়োর ছদ্মবেশে লিটল জন। ‘বলুন, হুজুর।’

বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে কেমন চেনা চেনা মনে হলো শেরিফের, মনে হলো কোথায় যেন দেখেছেন। কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে স্মরণ করবার চেষ্টা করে বললেন, ‘তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে? কি নাম তোমার?’

কাঁপা কাঁপা ভাঙা গলায় বললো লিটল জন, ‘আমার নাম, হুজুর, গাইস হব্‌ল্। কিছু বলবেন আমাকে?’

‘গাইল্‌স্ হব্‌ল্‌, গাইলস্ হল, বিড়বিড় করলেন শেরিফ। কিন্তু এই নামের কাউকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না। বললেন, ‘নাহ্, মনে আসছে না। শুধু মনে হচ্ছে দেখেছি কোথাও। যাই হোক, এই সুন্দর সকালে খুব কম খাটুনিতে ছয় পেন্স রোজগার হয়ে গেলে কেমন হয় বলো তো?’

‘খুবই ভাল হয়, হুজুর,’ গদ গদ কণ্ঠে বললো লিটল জন। ‘অভাবে আছি, সৎ পথে যদি ছয় পেন্স উপার্জনের কোন সুযোগ পাই, সে সুযোগ হাতছাড়া করবো না। বলুন, হুজুর, কি খেদমত করতে পারি আপনার?’

‘ব্যাপারটা হচ্ছে, এই তিন ছোকরাকে ফাঁসীতে লটকে দেয়া খুবই দরকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি আমার বাহিনীর কাউকে জল্লাদে পরিণত করতে চাইছি না। তুমি কি পারবে কাজটা? একেক জনের জন্যে দুই পেন্স করে পাবে…করবে?’

‘সত্যি কথা বলতে কি, হুজুর,’ বুড়ো মানুষের কাঁপা গলায় বললো লিটল জন, ‘এ কাজ জীবনে করিনি আমি কখনও। কিন্তু ছয় পেন্সের বিনিময়ে এটা করতে আমার কোন আপত্তি নেই। তবে, একটা কথা, হুজুর, এই শয়তানগুলোর পাপের স্বীকারোক্তি নেয়া হয়েছে?’

‘না। তুমি ইচ্ছে করলে স্বীকারোক্তি নিতে পারো। কিন্তু যা করবার তাড়াতাড়ি করতে হবে, এক্ষুণি ফিরতে হবে আমার সরাইখানায়।’

এগিয়ে গেল লিটল জন কম্পমান তিন ভাইয়ের দিকে। বড় ছেলেটার গালে গাল ঠেকিয়ে, যেন ওর পাপের স্বীকারোক্তি শুনছে, এমনি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বললো, ‘চুপচাপ থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো, ভায়া! হাতের বাঁধন কেটে দিচ্ছি, কিন্তু আগেভাগেই নড়ে উঠো না। যখন দেখবে আমি আমার নকল চুল দাড়ি খসিয়ে ফেলেছি, ঠিক তক্ষুণি গলা থেকে ফাঁস খুলে ঝেড়ে দৌড় দেবে জঙ্গলের দিকে।’ এই বলে সবার অলক্ষ্যে ক্ষুরধার ছোরার দুই পোঁচে কেটে দিল সে ওর হাতের বাঁধন। যেন এখনও বাঁধা রয়েছে, এমনি ভঙ্গিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ছেলেটা। একই কথা বললো সে দ্বিতীয় ছেলেটার কানে কানে, তারপর কেটে দিল বাঁধন। আর এক মিনিটের মধ্যে বাঁধন-মুক্ত হলো তৃতীয় ছেলেটাও। ঘোড়ার ওপর বসে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছে সবাই, কেউ খেয়াল করলো না কি ঘটে গেল ওদের অলক্ষ্যে।

কাজ সেরে শেরিফের দিকে ফিরলো লিটল জন। বললো, ‘হুজুর, যদি অনুমতি দেন, এবার আমি আমার ধনুকটায় ছিলা পরাতে চাই। বুড়ো মানুষ তো, মনটা আমার বড্ডো নরম; বেশি কষ্ট যেন না হয়, সেজন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় একটা করে তীর ঢুকিয়ে দিতে চাই ওদের বুকের খাঁচায়।’

‘বেশ তো,’ বললেন শেরিফ। ‘অতি উত্তম প্রস্তাব! কিন্তু বাপ, যা করবার জলদি করো, সময় নেই আমার হাতে

ধনুকের এক মাথা পায়ের কাছে মাটিতে বাধিয়ে চাপ দিয়ে বাঁকিয়ে ছিলা পরিয়ে নিল লিটল জন। সবাই একটু অবাক হলো ওর গায়ের জোর দেখে। পিঠের তূণ থেকে একটা তীর চলে এসেছে বুড়োর ডান হাতে। তীরটা ছিলায় পরিয়ে চারপাশে তাকিয়ে পালাবার রাস্তাটা দেখে নিল সে, তারপর হঠাৎ একটানে নকল চুল-দাড়ি খসিয়ে প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো, ‘দৌড়াও!’

চোখের পলকে গলা থেকে ফাঁস খুলেই তীরবেগে খিঁচে দৌড় দিল ছেলে তিনটে ফাঁকা ময়দানের ওপর দিয়ে সোজা জঙ্গলের দিকে। কালবিলম্ব না করে লিটল জনও ছুটলো ওদের পিছু পিছু। তাজ্জব হয়ে চেয়ে রয়েছে সবাই ওদের দিকে, এই অপ্রত্যাশিত আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ব হয়ে গেছে একেবারে। শেরিফই সবার আগে সংবিৎ ফিরে পেলেন। ধরো! ধরো ওকে!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। পরিষ্কার চিনতে পেরেছেন শেরিফ এবার লিটল জনকে।

শেরিফের কণ্ঠস্বর কানে গেল লিটল জনের। বুঝতে পারলো, ঘোড়ায় চেপে তাড়া করলে তিনজনকেই ধরে ফেলবে ওরা জঙ্গলে পৌঁছবার আগেই। ছেলেগুলোকে আগে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্যে থমকে দাঁড়িয়ে পাঁই করে ঘুরলো সে, তীর- ধনুক বাগিয়ে ধরে গর্জন ছাড়লো, ‘খবরদার! কেউ এক পা সামনে বাড়লে মারা পড়বে। ধনুকের ছিলা স্পর্শ করা মাত্র খুন হয়ে যাবে আমার হাতে!’

নড়ে চড়ে উঠছিল লোকগুলো, কিন্তু লিটল জনের হুমকি কানে যেতেই পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেল সবাই। লিটল জনের অব্যর্থ লক্ষ্যের কথা জানা আছে ওদের, জানে অবাধ্যতা করতে গেলেই এখন ঘটবে অবধারিত মৃত্যু। ধমক দিলেন ওদের শেরিফ, কাপুরুষ বলে লজ্জা দেয়ার চেষ্টা করলেন, সবাইকে একসাথে এগোবার নির্দেশ দিলেন, কিন্তু এক ইঞ্চি নড়লো না কেউ, মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছে লিটল জনের তীর-ধনুক বাগিয়ে ধরে ধীরে ধীরে জঙ্গলের দিকে পিছিয়ে যাওয়া। নিষ্ফল আক্রোশে চেঁচিয়ে উঠলেন শেরিফ, শিকার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে দিশা হারিয়ে ফেললেন রাগে, কি করছেন ভালমত না বুঝেই জিনের রেকাবের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ঝড়ের বেগে ছুটলেন তিনি লিটল জনের দিকে। উপায়ান্তর না দেখে একটানে কানের পাশে নিয়ে এলো লিটল জন ধনুকের ছিলা। কিন্তু হায়! তীর ছোঁড়ার আগেই এতদিনের বিশ্বস্ত ধুনকটা হঠাৎ মড়াৎ করে ভেঙে গেল মাঝখান থেকে, তীরটা খসে পড়লো ওর পায়ের কাছে।

লিটল জনের ধনুক ভেঙে যেতেই চিৎকার করে উঠলো শেরিফের লোকজন, ঘোড়া ছুটিয়ে দিল ওর দিকে। সবার আগে পৌঁছে গেলেন শেরিফ, সামনের দিকে ঝুঁকে সাঁই করে চালালেন তরবারী ওর মাথা লক্ষ্য করে। চট্ করে মাথা নিচু করে নিল লিটল জন; ফলে খানিকটা ঘুরে গেল শেরিফের তলোয়ার-ধরা হাত, ফলার চওড়া দিকটা খটাং করে লাগলো ওর চাঁদির ওপর। মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল সে মাটিতে।

‘ভাগ্যিস মেরে ফেলিনি,’ লোকজন এসে পৌঁছতে বললেন শেরিফ। ‘এই হারামজাদাকে গাছের ডালে না লটকাতে পারলে খেদ থেকে যেত মনে। যাও তো, উইলিয়াম, ওই ঝর্ণা থেকে পানি এনে ঢালো এর মাথায়।’

মাথায় পানি ঢালা হতেই চোখ মেললো লিটল জন, ঘোর কাটেনি এখনও, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে চারপাশে। হাত দুটো ওর পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হলো, কয়েকজন মিলে ধরে তুলে দেয়া হলো একটা ঘোড়ার পিঠে লেজের দিকে মুখ করে, ঘোড়ার পেটের নিচ দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হলো পা দুটো। তারপর ওকে নিয়ে ফিরে এলো সবাই কিংস হেড সরাইখানায়।

শেরিফের আনন্দ আর ধরে না। মদের অর্ডার দিয়ে বসলেন তিনি টেবিলে। এতদিনে হাতের মুঠোয় পেয়েছেন তিনি লিটল জনকে। উহ্, বড় জ্বালান জ্বালিয়েছে লোকটা তাঁকে। ‘নটিংহামের গেটের সামনে ঝুলিয়ে দেব কাল একে গাছের ডালে, ‘ ভাবলেন তিনি, ‘রবিন হুডের ডানহাতটা গুঁড়িয়ে দেব আমি এইভাবে।’

কিন্তু ক্যানারির পাত্রে লম্বা করে একটা চুমুক দিয়েই মত পরিবর্তন করে ফেললেন তিনি। হঠাৎ একটা চিন্তা ঢুকেছে তাঁর মাথায়। চট্ করে পাত্রটা নামিয়ে রেখে বিড় বিড় করে বললেন, ‘কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি উচিত হবে? উইল স্টিউটলির বেলায় ওরা যা করেছিল…নাহ, যদি গাই অফ গিসবোর্নের হাতে ব্যাটা মারা না পড়ে? নিজের প্রিয় অনুচরকে বাঁচাবার জন্যে লোকটা কি বুদ্ধি বের করে কি অঘটন ঘটিয়ে বসবে কেউ বলতে পারে? উঁহু, দেরি করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে না।’ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, ত্রস্ত পায়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। লোকজনদের ডেকে বললেন, ‘শোনো, ভুল করেছি আমরা! তক্ষুণি ওই গাছের ডালেই ঝুলিয়ে দেয়া উচিত ছিল একে। যাই হোক, আর দেরি করবো না আমরা, চলো, এক্ষুণি একে নিয়ে গিয়ে লটকে দেব ফাঁসীতে, যেখান থেকে ও উদ্ধার করেছিল ছোকরাদের, সেইখানেই।’

আবার রওনা হলো সবাই। সেই বিশাল ওক গাছটার নিচে এসে থামলো। লিটল জনকে নামানো হলো ঘোড়া থেকে। হঠাৎ ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, ‘কে লোকটা? ঐযে, এইদিকেই আসছে…গাই অফ গিসবোর্ন না?’

কপালে হাত ঠেকিয়ে রোদ আড়াল করে তাকালেন শেরিফ, তারপর চিৎকার করে উঠলেন, ‘তাই তো! ফিরে আসছে গাই অফ গিসবোর্ন। বদমাশটাকে মেরে রেখে আসতে পারলো কিনা কে জানে!’

উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে অগ্রসরমান লোকটার দিকে চাইলো লিটল জন। দূর থেকেই লোকটার বিচিত্র পোশাকে রক্তের দাগ দেখে মনটা দমে গেল ওর, আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো বুকটা-রবিনের রক্ত নয় তো? পরমুহূর্তে লোকটার হাতে রবিনের ধনুক, তলোয়ার আর শিঙা দেখে ওর মনে হলো আস্ত একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ ওর বুকের মধ্যে।

‘কি খবর?’ গাই অফ গিসবোর্নের ছদ্মবেশে রবিন হুড কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন শেরিফ, ‘দেখা পেয়েছিলে ওর? জামা-কাপড়ে এত রক্ত কেন?’

‘আমার জামা কাপড় পছন্দ হচ্ছে না বুঝি আপনার!’ গাই অফ গিসবোর্নের কর্কশ কণ্ঠ অনুকরণ করে চড়া গলায় বললো রবিন। রক্ত ভালো না লাগলে চোখ বুজে থাকতে পারেন। এ রক্ত ভালো লাগার কথাও নয়, দুনিয়ার সেরা বদমাশের রক্ত এগুলো, খুন করে রেখে এসেছি আমি ওকে।’

হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো লিটল জন। ধরা পড়ার পর এই প্রথম মুখ খুললো সে, ‘ওরে, নীচ দুরাচার! কাকে খুন করেছিস তুই? তোর মত পাপিষ্ঠ, পিশাচের হাতেই নিভলো আজ রবিনের মত এতবড় এক মহান হৃদয়ের জীবন-প্রদীপ! হায়রে! খোদা, আর বাঁচার সাধ নেই আমার, আমাকে তুলে নাও তুমি এই নিষ্ঠুর দুনিয়া থেকে!’ দুই গাল বেয়ে দর দর করছে ওর তপ্ত নোনা অশ্রু।

রবিনের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠলেন নটিংহামের শেরিফ। ‘বাহ্, সাবাশ, গাই অফ গিসবোর্ন! এত আনন্দ আমি রাখবো কোথায়! যা বলছো তা যদি সত্য হয়, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন!’

‘যা বলছি সব সত্য,’ ককশ কণ্ঠে বললো রবিন। মিথ্যা কথা বলি না আমি। চেয়ে দেখুন, এগুলো রবিন হুডের তলোয়ার, ধনুক আর শিঙা না? আপনি বলতে চান আমি চাইতেই খুশি মনে আমার হাতে তুলে দিয়েছে এসব রবিন হুড?’

হা-হা করে হেসে উঠলেন শেরিফ। আনন্দ আর নিজের মধ্যে ধরে রাখতে পারছেন না তিনি। কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আজ ভোরে! কল্পনাও কি করতে পেরেছিলাম, একই দিনে রবিন হুড আর তার প্রধান চেলাকে খতম করতে পারবো আজ? যা চাইবে তাই পাবে আজ তুমি আমার কাছে, গাই অফ গিসবোর্ন…যা খুশি!’

লিটল জনের দিকে ফিরলো রবিন হুড, পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো ওকে, তারপর বললো, ‘এই লোক রবিন হুডের ডান হাত বুঝি? ভাল, ভাল। আমাকে দু’শো পাউণ্ড দেয়ার কথা ছিল না আপনার?’

‘ছিল,’ বললেন শেরিফ। একটা থলি বাড়িয়ে দিলেন রবিনের দিকে, এই নাও, তোমার পুরস্কার।’

‘লাগবে না,’ শেরিফকে অবাক করে দিয়ে বললো রবিন। ‘টাকা লাগবে না আমার। তার বদলে এই লোকটাকে খুন করার অনুমতি চাই। নেতাকে শেষ করেছি, চেলাটাকেও নিজ হাতে পার করে দিতে চাই ওপারে।’

টাকা ক’টা বেঁচে যাচ্ছে দেখে আরো খুশি হয়ে উঠলেন শেরিফ, চট্ করে রাজি হয়ে গেলেন উদ্ভট চরিত্রের গাই অফ গিসবোর্নের কথায়। ‘বেশ তো, আমার কোনো আপত্তি নেই, যেমন ভাবে খুশি খুন করতে পারো তুমি ওকে।’

‘ধন্যবাদ,’ বললো রবিন। তাহলে এই বদমাশকে ওই গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করাতে বলুন আপনার লোকদের। আমাদের ওদিকে নিষ্ঠুর জবাই বলতে কি বোঝায় দেখাচ্ছি আমি আপনাদের।’

অসমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো শেরিফের বেশ কিছু লোক। লিটল জনকে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিতে কারও কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু ওকে ঠাণ্ডা মাথায় নিষ্ঠুর ভাবে জবাই করার প্রস্তাবে বিচলিত হয়ে উঠলো ওরা। তবে মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস পেল না কেউ, শেরিফের হুকুম পেয়ে গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল হাত-পা বাঁধা লিটল জনকে।

ওরা যখন এই কাজে ব্যস্ত, সবার অলক্ষ্যে দুটো ধনুকেই ছিলা পরিয়ে ফেললো রবিন হুড, তারপর কোমরে গোঁজা গাই অফ গিসবোর্নের ড্যাগারটা বের করে ধীর পায়ে মারাত্মক ভঙ্গিতে এগোলো লিটল জনের দিকে। কর্কশ কণ্ঠে ধমক দিল সে শেরিফের লোকদের, ‘অ্যাই! সরে দাঁড়াও। আরও, আরও দূরে!’ ধমক খেয়ে বেশ অনেকটা পিছিয়ে গেল লোকগুলো, কেউ কেউ আবার মুখ ফিরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে-এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখতে চায় না বলে।

‘আয়, হারামজাদা! আয়!’ হাঁক ছাড়লো লিটল জন, ‘তোর ওই ছোরাকে আমি ডরাই না! আমার প্রাণের বন্ধুকে তুই মেরেছিস, আমার জীবনের আর কোন অর্থ নেই, যে মহান নেতার একটা মুখের কথায় প্রাণ দিতে পারতাম হাসিমুখে, যার একটা আদরের ডাকে ধন্য হয়ে যেত জীবন, তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিস তুই চিরতরে, তোর টুটিটা ছিঁড়ে ফেলে তারপর যদি মরতে পারতাম, তাহলে শান্তি পেতাম!’

লিটল জনের চোখে জ্বলন্ত ঘৃণার দৃষ্টি আর দুই গালে অশ্রুধারা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পারলো রবিন কতখানি ভালবাসে মানুষটা ওকে। আশ্চর্য এক কৃতজ্ঞতা-বোধে ছেয়ে গেল ওর মনটা। কাছাকাছি গিয়ে নিচু গলায় বললো, ‘তোমার জ্বালায় মরেও তো শান্তি পাব না দেখছি, উলুক কোথাকার! জ্যান্ত মানুষের জন্যে এত কাঁদাকাটি, সত্যিই মরে গেলে তখন কি করবে? ওর গলার স্বর চিনতে পেরে লিটল জনের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে উঠতে যাচ্ছে বুঝতে পেরে চট্ করে বললো রবিন, ‘আমার ধনুক, তৃণ আর তলোয়ার রাখছি তোমার পায়ের কাছে, বাঁধন কেটে দেয়ার সাথে সাথেই তুলে নেবে ওগুলো।’ ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে একবার সামনে বাড়ছে, আবার পিছিয়ে আসছে রবিন ছোরা হাতে, বার দুই পাক খেলো লিটল জনের চারপাশে। এরই ফাঁকে কখন যে লিটল জনের হাত-পায়ের বাঁধন কাটা হয়ে গেছে টের পেল না কেউ। হঠাৎ চমকে উঠলো উপস্থিত সবাই লিটল জনের হেঁড়ে গলার চিৎকার শুনে। চেয়ে দেখলো, না, মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর আর্তচিৎকার নয়, ঝাঁপিয়ে পড়ে মাটি থেকে তীর-ধনুক তুলে নিচ্ছে লিটল জন। আরও অবাক কাণ্ড, মুখের সামনে থেকে টুপিটা সরিয়ে দিয়েছে গাই অফ গিসবোর্ন, পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে গাইয়ের ছদ্মবেশ পরা রবিন হুডের মুখ। একটা তীর লাগিয়ে বাঁকা করে ফেলেছে সে ধনুকটা।

‘সাবধান!’ বললো রবিন হুড, এক পা এগোবে না কেউ। ধনুকে হাত দিলেই মারা পড়বে নির্ঘাৎ। আপনার ভাড়াটে খুনী খুন হয়ে গেছে আমার হাতে, মাননীয় শেরিফ দেখবেন, আপনারও না আবার সেই রাস্তা ধরতে হয়!’ আড়চোখে চেয়ে দেখলো ও প্রস্তুত হয়ে গেছে লিটল জন, অমনি শিঙাটা মুখে তুলে তিনবার ফুঁ দিল তাতে।

তীক্ষ্ণ শিঙাধ্বনি অন্তর কাঁপিয়ে দিল শেরিফের। গাই অফ গিসবোর্নের পোশাকে সাক্ষাৎ যমদূতকে দেখছেন যেন তিনি। চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে তাঁর। ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন তিনি, ‘রবিন হুড!’ পরমুহূর্তে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে ছুটিয়ে দিলেন ঘোড়া। মনিবকে পালাতে দেখে কাল বিলম্ব না করে তাঁর পিছু নিল বিশজন অনুচর।

পিছন থেকে অনেক ডাকাডাকি করলো লিটল জন, ‘এই যে শেরিফ সাহেব, কোথায় যান? আমরা তো মাত্র দু’জন। ফাঁসীটা দিয়েই না হয় যেতেন!’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! পিছনে ধুলোর ঝড় তুলে তুমুল বেগে ছুটেছেন শেরিফ নটিংহামের দিকে।

খুবই দ্রুত চলেছেন তিনি, কিন্তু তীরের চেয়ে তো আর দ্রুত নয়-কান পর্যন্ত ছিলা টেনে একটা তীর মেরে দিল লিটল জন। সোজা গিয়ে তীরটা বিধলো শেরিফের নিতম্বে। ফলে নটিংহামের গেট দিয়ে যখন তিনি ঢুকলেন, পিছনে বিঁধে থাকা তীরটা দেখে মনে হলো লাফাতে লাফাতে চলেছে এক লেজ তোলা কাঠবিড়ালী। শোনা যায়, কয়েক মাস নাকি অত্যন্ত নরম গদি ছাড়া শক্ত কিছুর ওপর বসতেই পারেননি নটিংহামের শেরিফ।

শিঙাধ্বনি শুনে উইল স্টিউটলির নেতৃত্বে রবিন হুডের দশ-বারোজন অনুচর যখন এসে পৌছলো, তখন ময়দান ফাঁকা; বহুদূরে ধুলোর পাহাড় ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না ওরা।

সবাই মিলে ফিরে গেল ওরা জঙ্গলে। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বসে ছিল বুড়ির তিন ছেলে, ছুটে এসে চুমো খেলো ওরা লিটল জনের হাতে। ওদেরকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্যে চললো সবাই।

জঙ্গলের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল বুড়ি। হ্যাল, হব্ আর ডিকনকে সুস্থ শরীরে ফিরে আসতে দেখে আবার অশ্রু নামলো তার গাল বেয়ে। এবারে আনন্দের অশ্রু। লিটল জন ও রবিন হুডের মাথায় হাত রেখে হাজার হাজার বার আশীর্বাদ করলো সে।

‘কিন্তু, বুড়ি মা,’ বললো রবিন, ‘তোমার এখানে এদের রাখা আর নিরাপদ বলে মনে করি না। তুমি যদি অনুমতি দাও, আমি এদের নিয়ে যেতে পারি আমার আস্তানায়।’

‘তাহলে আমি বেঁচে যাই, বাবা,’ বললো বুড়ি। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।’

আস্তানার পথে রওনা হয়ে গেল সবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *