১৯. রাজা এলেন শেরউডে

১৯. রাজা এলেন শেরউডে

বেশ কিছুদিন পর রবিন হুডের সাথে দেখা করার আশায় রাজা নিজেই চলে এলেন নটিংহাম শহরে। কয়েকজন নাইটকে সাথে নিয়ে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালেন রাজা, সবুজ মাঠে চরে বেড়ানো হরিণ দেখলেন, বিশাল ওক-ডালের দোলন দেখলেন, মুগ্ধ হয়ে গেলেন পাখির মিষ্টি গান শুনে, আমোদিত হলেন বুনো ফুলের গাঢ় সুবাসে কিন্তু রবিন হুডকে খুঁজে পাওয়া তো দূরের কথা এক টুকরো লিংকন গ্রীনও দেখতে পেলেন না শেরউডের কোথাও।

দিনের পর দিন লোক-লস্কর নিয়ে রাজা যান শেরউডে, দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন রবিন হুডের, ঘুরে ঘুরে বিফল হয়ে ফিরে আসেন নটিংহামে। ‘বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার,’ বললেন একদিন রাজা। ‘শুনেছিলাম এদের চোখ এড়িয়ে জঙ্গলের এইসব রাস্তা দিয়ে একজন ভিখারীরও পার হয়ে যাবার উপায় নেই…কোথায়? গেল কোথায় ওরা? দেখতে পাচ্ছে না আমাদের?’

রাজা জানেন না, আসলে দেখতে ওরা ঠিকই পাচ্ছে; রবিনের কড়া নির্দেশ দেয়া আছে সবার ওপর, যেন রাজার বিরুদ্ধে কেউ কিছু করে না বসে, যেন আত্মগোপন করে থাকে জঙ্গলের আড়ালে। সিংহ হৃদয় রাজা রিচার্ডকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে রবিন হুড। প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে মরণপণ লড়াই করে হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তিনি রবিনের। নেতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে সবাই; বহুবার দলবলসহ রাজাকে আসতে দেখে চট্ করে সরে গেছে ওরা ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে, হাসিমুখে দেখেছে রাজার খোঁজাখুঁজি, আওতার মধ্যে পেয়েও একটা তীর পরায়নি কেউ ধনুকের ছিলায়।

একদিন রাজাকে দুঃখ করতে শুনে বুড়ো এক জঙ্গলরক্ষী হেসে বললো, ‘এভাবে খোঁজাখুঁজি করে ভুল করছেন আপনি, ইয়োর ম্যাজেস্টি। ওর সাথে দেখা করার অন্য উপায় আছে।’

‘তাই নাকি? কি উপায়?’

‘খুবই সহজ উপায়, হুজুর। ধনী মোহান্তের ছদ্মবেশে যদি কয়েকটা মালবাহী ঘোড়া নিয়ে জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যান, দেখবেন মাটি ফুঁড়ে আপনার চারপাশে হাজির হয়ে যাবে দস্যু রবিনের দলবল।’

কথাটা মনে ধরলো রাজার। এই ধরনের দুঃসাহসিক অভিযানে তাঁর দারুণ উৎসাহ। পরদিনই মোহান্তের ছদ্মবেশ পরে নিলেন তিনি, জনা ছয়েক অনুসারীকে পরতে বললেন সন্ন্যাসীর পোশাক; গোটা দুই ঘোড়ার ওপর মালপত্র চাপিয়ে গোপনে রওনা হয়ে গেলেন শেরউডের উদ্দেশে।

জঙ্গলের মধ্যে মাইল তিনেক যেতে না যেতেই বাধা পেলেন তিনি। রাস্তার একটা বাঁক নিয়েই দেখলেন ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো লিংকন গ্রীনের পোশাক পরা সুদর্শন এক যুবক, হাতে বিশাল এক ধনুক, পিঠে তীর-ভর্তি তূণ। এগিয়ে এসে রাজার ঘোড়ার রাশ ধরলো লোকটা, চকচকে চোখে কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে আপাদমস্তক দেখলো তাঁকে, তারপর বিনীত ভঙ্গিতে বললো, ‘স্যার মোহান্ত, কিছু যদি মনে না করেন, আমাদের সাথে একটু খাওয়া-দাওয়া করতে হবে আজ আপনাদের।’ কথাটা বলেই মাথার ওপর ধনুক তুলে ইশারা করলো লোকটা। সাথে সাথেই চারপাশ থেকে এক কুড়ি প্রাণ-চঞ্চল, বলিষ্ঠ যুবক ঘিরে ধরলো রাজার দলটাকে। এদের মধ্যে বিরাট লম্বা-চওড়া দৈত্যের মত এক লোকের ওপর চোখ পড়তেই চিনতে পারলেন রাজা-লিটল জন।

‘শাঁসালো শিকার মনে হচ্ছে, ওস্তাদ!’ হাসিমুখে বললো লিটল জন।

যাকে ওস্তাদ সম্বোধন করে এই কথাটা বলা, সেই প্রথম যুবকের দিকে ফিরলেন রাজা, বুঝতে পারলেন, শেষ পর্যন্ত রবিন হুডের দেখা পেয়েছেন তিনি।

‘কে তুমি?’ গুরু গম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন রাজা। আমার পথ আটকেছো কেন?’

মোহান্তের কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন কর্তৃত্বের সুর টের পেয়ে একটু চমকে গিয়ে ভাল করে তাঁর চেহারাটা দেখার চেষ্টা করলো রবিন, কিন্তু মস্ত টুপি আর হুড থাকায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না মুখটা। জবাব দিল, ‘আমরা এই জঙ্গলেই থাকি, গাছের নিচে ঘুমাই, রাজার হরিণ মেরে খাই। টাকা পয়সার বড়ই অভাব আমাদের, তাই আপনাদের মত ধনী মোহান্ত বা সন্ন্যাসী পেলে আদর করে ডেকে নিয়ে যাই আমাদের আস্তানায়। সেখানে ভোজ খাওয়ানো হয় অতিথিদের, সেইসাথে কিছু চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে; সব শেষে খরচ-খরচা বাবদ আমরা কিছু পেয়ে থাকি। আমার নাম রবিন হুড।

‘কিন্তু আমার কাছে চল্লিশ পাউণ্ডের বেশি যে নেই,’ বললেন রাজা। ‘রাজা রিচার্ড এসেছেন নটিংহামে, শুনেছো নিশ্চয়ই। তাঁর সম্মানে ভোজ দিয়ে আমার সব টাকা শেষ হয়ে গেছে।’

‘রাজাকে সত্যিই ভালবাসেন আপনি? মানেন তাঁকে?’ জিজ্ঞেস করলো রবিন।

‘আমার সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসি,’ বললেন রাজা রিচার্ড। ‘মেনেও চলি। তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে এক কদম ফেলি না ডাইনে বা বাঁয়ে। ‘

‘ঠিক আছে, এই এক কথায় অর্ধেক টাকা বেঁচে গেল আপনার, স্যার মোহান্ত। বিশটা পাউণ্ড দিলেই চলবে। চলুন, রওনা হওয়া যাক।’

একটু অবাক হলেন রাজা। বললেন, ‘রাজাকে ভালবাসি বা তাঁকে মান্য করি, তাতে তোমার কি? তুমি আইন অমান্যকারী দস্যু, তুমি কেন ছেড়ে দেবে অর্ধেক টাকা?’

‘চলুন, স্যার মোহান্ত, হাসি মুখে বললো রবিন। ‘চলতে চলতেই আপনার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো।’ মনে মনে গুছিয়ে নিল সে কথাগুলো, কঠিন একটা প্রশ্ন করে বসেছেন আজ আপনি আমাকে। আমি অত্যাচারী শেরিফকে মানি না, তার অন্যায়, অবিচার আর দুঃশাসনে বাধ্য হয়েছি আমরা আইন অমান্য করতে। গরীবের রক্তচোষা, নীচ, ধনী, লোভী ধর্ম-ব্যবসায়ীদের আমি পছন্দ করি না, তাদের টাকা কেড়ে নিয়ে বিলিয়ে দিই গরীব-দুঃখীদের মধ্যে, তাই আমি দস্যু। যাদেরই স্বার্থহানি ঘটছে তারাই আমাকে আইন অমান্যকারী দস্যু বলছে। বলুক। তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। কিন্তু আমি নিজের মনের মধ্যে জানি, এদেশে অন্যায় অবিচার অত্যাচার যদি না থাকতো, দস্যু হওয়ার প্রয়োজন পড়তো না আমার। রাজার দোষ দিই না আমি, রাজাকে আমি ভালবাসি, শ্রদ্ধা করি-রাজ্যের খুঁটিনাটি সব কাজ তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব নয়, লোক দিয়ে করাতে হবে; সেই লোকগুলো যদি খারাপ হয়, রাজার খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। আমাদের রাজা নিশ্চয়ই চান না তাঁর প্রতিনিধিরা নির্যাতনে জর্জরিত করে তুলুক জনসাধারণকে। কিন্তু এদের মজ্জায় ঢুকে গেছে দুর্নীতি, হুট করে একদিনেই শুধরে দেয়া যায় না সবার অন্তর; এদের নিয়েই চলতে হবে তাঁকে। এদিক থেকে আমি রাজার চেয়েও অনেক স্বাধীন। এদের ওপর আঘাত হানতেও দ্বিধা করছি না, রাজাকে ভালবাসতেও আমার বাধছে না কোথাও। আমাদের মহান রাজা রিচার্ডকে যে সত্যিই ভালবাসে, সে অন্যায় করতে পারে না, সেজন্যে তার কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করার কোন দরকার নেই আমার; শুধু খরচ বাবদ বিশটা পাউণ্ড রাখবো আমরা আপনার কাছ থেকে।’ আশ্চর্য সুন্দর একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো রবিনের মুখে। বললো, ‘আমি আমার বক্তব্য পরিষ্কার ভাবে বোঝাতে পেরেছি, স্যার অ্যাবট?’

অবাক হয়ে রবিনের মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন রাজা রিচার্ড, কোন জবাব দিলেন না, গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্যে। এ কী কথা শুনছেন তিনি সাধারণ এক দস্যুর মুখে? এই লোক দস্যু, না দার্শনিক? এসব কথার আর কোন জের টানলো না রবিন, আস্তানায় পৌঁছেই শিঙা বাজিয়ে সবাইকে ডেকে উৎসব আর ভোজের আয়োজন করার নির্দেশ দিল।

রাজা দেখলেন, সবাই এসে হাঁটু ভাঁজ করে সৌজন্য প্রকাশ করছে নেতার প্রতি, প্রত্যেকের চেহারায় ফুটে রয়েছে সপ্রতিভ একটা ভাব, সেই সাথে চোখে-মুখে উজ্জ্বল বুদ্ধির দীপ্তি। কই, দূর থেকে এদের সম্বন্ধে যা শুনেছিলেন বা ভেবেছিলেন তা তো নয় এরা! সেনা বাহিনীর শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, দায়িত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণতা… কোনটারই তো অভাব দেখা যাচ্ছে না এদের মধ্যে।

যথেষ্ট সম্মানের সাথে গ্রীনউড গাছের নিচে সবুজ ঘাসের উপর সতরঞ্চি পেতে বসানো হলো অতিথিদের। এদের কুস্তি, লাঠি আর তলোয়ার খেলা দেখে মুগ্ধ হলেন রাজা। এবার শুরু হলো তীর-ধনুকের খেলা। বহুদূরে একটা লাঠি গেড়ে তীরন্দাজদের আদেশ দিল রবিন সেটা চিরে দেখাতে। তারপর আরো দূরে একটা লতাপাতা আর ফুলের তৈরি মালা ঝুলিয়ে দেয়া হলো ওকের শাখায়, ফুল বা পাতা স্পর্শ না করে তীর লাগাতে হবে মালার ভেতর।

‘সর্বনাশ!’ বললেন রাজা রিচার্ড, ‘দেখছি অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা করছো তোমরা! আমার মনে হচ্ছে টার্গেটটা পঞ্চাশ কদম কাছে টাঙানো উচিত ছিল।

‘সহজ টার্গেট প্র্যাকটিস করে কি লাভ?’ হাসলো রবিন। অতদূরেই দেখবেন ঠিক লক্ষ্য-ভেদ করবে এরা। চড়ের ভয় আছে না?’

‘চড়ের ভয়? মানে?’

তিনটে করে তীর ছুঁড়বে প্রত্যেকে। একটা তীর যার মালার বাইরে লাগবে প্রচণ্ড এক থাবড়া খেতে হবে তাকে।’

‘এই ধরনের শাস্তির ফলে তোমার লোকজনের মধ্যে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না?’

‘হতে পারতো, হাসলো রবিন। কিন্তু হয় না। আসলে এটাকে খোদার মার মনে করে এরা।

‘কি রকম?’

‘চাপড়টা খেতে হয় আমাদের হোলি ফাদার সন্ন্যাসী টাকের হাতে। এতে কেউ কিছু মনে করে না। ফাদার টাক, তৈরি হয়ে দাঁড়ান, শুরু হচ্ছে খেলা।’

প্রথমে তীর ছুঁড়লো ডংকাস্টারের ডেভিড। তিনটে তাঁরই জায়গা মত বিঁধলো। ‘বাহ্, ভাল মেরেছো ডেভিড!’ বললো রবিন। রোজ তোমাকে দিয়েই শুরু হয়, আজ বড় বাঁচা বেঁচে গেলে!’ এরপর মারলো মিজ দ্য মিলার। সে-ও উতরে গেল সহি সালামতেই। এরপর মার্চের পালা; দুটো তীর ঠিকমতই লাগলো, কিন্তু তৃতীয় তীর লাগলো গিয়ে মালার বাইরে। অপরাধীর ভঙ্গিতে সন্ন্যাসী টাকের সামনে এসে দাঁড়ালো মাচ, চোখ-মুখ এমন ভাবে কুঁচকে রেখেছে, যেন এখনই ভোঁ-ভোঁ করছে কাটা। আস্তিন গুটালো সন্ন্যাসী টাক, পেশীবহুল হাতটা দেখে মনে হচ্ছে যেন জায়গায় জায়গায় গিঠ পড়া প্রাচীন ওকের গুঁড়ি। চড়াৎ করে পড়লো চড়। কয়েক ডিগবাজি খেয়ে উঠে বসলো মার্চ ঘাসের উপর, এক হাতে কান ডলছে, মিটমিট করছে চোখ, দেখে মনে হচ্ছে এইমাত্র আকাশ থেকে পড়েছে সে, কোথায় পড়েছে জানে না। হো হো করে হেসে উঠলো সবাই।

হাসতে হাসতে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে গেল রাজার। একের পর এক আসছে তীরন্দাজ, কেউ বেকসুর খালাস পাচ্ছে, কেউ বা থাবড়া খেয়ে গড়াচ্ছে মাটিতে। কপাল খারাপ লিটল জনের, প্রথম তীরটাই তার আজ হঠাৎ হাত খানেক বাইরে গিয়ে পড়লো মালা থেকে। তীর-ধনুক ফেলে পালাবার তাল করছিল লিটল জন, সবাই মিলে ঠেসে ধরে নিয়ে এলো ওকে সন্ন্যাসী টাকের সামনে। অতবড় দৈত্যটা যখন চড় খেয়ে সটান শুয়ে পড়লো মাটিতে, হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। সবশেষে রবিনের পালা। সবাই জানে, কোনদিন হয়নি, আজও একটা তীরও লক্ষ্যভ্রষ্ট হবে না রবিনের। কিন্তু তারও তৃতীয় তীরটা যখন কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে মালার এক ইঞ্চি বাইরে লাগলো, তুমুল হর্ষধ্বনিতে কেঁপে উঠলো জঙ্গল। যারা দাঁড়িয়ে ছিল, হাসতে হাসতে বসে পড়লো, যারা বসে ছিল তারা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে হাসির দমকে।

যুক্তিতর্ক দেখাবার চেষ্টা করলো রবিন, বোঝাবার চেষ্টা করলো যে ত্রুটি ছিল তীরটায়, কিন্তু কে শোনে কার কথা, ঠেসে ধরে নিয়ে আসা হলো তাকে সন্ন্যাসী টাকের সামনে।

যদি খোদার তরফ থেকে শাস্তি পেতেই হয়,’ বললো রবিন হাসতে হাসতে। ‘ধর্মীয় পোশাক পরা আরো মানুষ আজ উপস্থিত আছেন এখানে, আমাকে অন্ততঃ বাছাই করার সুযোগ দেয়া উচিত। আমার শাস্তিটা আমি স্যার মোহান্তের হাত থেকে নিতে চাই।’

ওসব ধানাই-পানাই ছাড়ো, বস!’ হাতের তালুতে খানিক থুতু দিয়ে দুই হাত ঘষে নিল সন্ন্যাসী টাক। লক্ষ্মী ছেলের মতো এখানে এসে দাঁড়াও। ওই মোটা মোহান্ত কি মারবে? চড় মারতে গিয়ে নিজের হাতটাই ভেঙে বসবে শেষে। ও তো ননীর পুতুল!’

অত বড়াই করো না, ফ্রায়ার,’ বললেন রাজা রিচার্ড। ‘তোমার চেয়ে কম জোর নেই আমার গায়ে।

‘বলে কি ব্যাটা!’ বিচিত্র মুখভঙ্গি করলো সন্ন্যাসী টাক। ‘তোমার চড় খেলে আমি তো টেরই পাব না মেরেছো কি মারোনি।’

‘তাই নাকি!’ উঠে দাঁড়ালেন রাজা। ‘বেশ তো, দেখা যাক তুমি আমাকে মাটিতে গড়াগড়ি খাওয়াতে পারো, নাকি আমি পারি তোমাকে।’

আগে আমাকে মারতে দেবে তো?’ উদগ্রীর কণ্ঠে জানতে চাইলো সন্ন্যাসী টাক।

‘বেশ, তুমিই মারো আগে।’

খুশিতে বাগে বাগ হয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়ালো সন্ন্যাসী টাক। ছদ্মবেশী মোহান্ত এসে দাঁড়ালেন তার সামনে। চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়ালো আর সবাই মজা দেখার জন্যে। দড়াম করে প্রাণপণ শক্তিতে মারলো সন্ন্যাসী টাক। আশ্চর্য! যেমন ছিলেন, পাথরের মূর্তির মত তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন মোহান্ত মাথা থেকে টুপিটা শুধু ছিটকে গিয়ে পড়লো বিশ গজ দূরে।

হৈ-হৈ করে উঠলো সমস্ত লোকজন, পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো প্রশংসায়। এই প্রথম একজন লোক সন্ন্যাসী টাকের ভয়ংকর চাপড় খেয়েও দু’পায়ে খাড়া রইলো। হাঁ হয়ে গেছে সন্ন্যাসী টাকের মুখটা। ‘এবার আমার দান, ব্রাদার,’ বললেন মোহান্ত। বিনা বাক ব্যয়ে সামনে এসে দুই পা ফাঁক করে শক্ত হয়ে দাঁড়ালো সন্ন্যাসী টাক।

রাজা যখন আস্তিন গুটালেন, তাঁর হাতের থোকা থোকা পেশী দেখে বিস্ময়ের গুঞ্জ উঠলো সবার মধ্যে। চাপড় যখন পড়লো, বাজ পড়লো যেন-চড়াৎ আওয়াজের সাথে সাথেই বিশাল মোটা সন্ন্যাসী টাক তিন ডিগবাজি খেয়ে চিৎ হয়ে পড়লো মাটিতে। হা হা করে হেসে উঠলো সবাই, বিশেষ করে যারা এতদিন সন্ন্যাসী টাকের হাতে চাপড় খেয়েছে তাদের আন্তরিক উল্লাসে কোন খাদ নেই আনন্দে নাচতে শুরু করেছে তারা। হাসি নেই শুধু রবিনের মুখে।

‘এবার তুমি এসো,’ তর্জনী নেড়ে ডাকলেন রাজা রবিনকে।

‘কি ভুলটাই যে করলাম!’ বিড়বিড় করে বললো সে। এ দেখছি হোলি ফাদারের চেয়ে দ্বিগুণ ভয়ংকর!’ মোহান্তের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে চোখ-মুখ বিকৃত করে ফেললো সে। বাবা রে…!’

শরীরটাকে মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে মারলেন রাজা। এতই জোরে মারলেন যে তাঁর মাথার হুডটা সরে গেল পিছনে। বলা বাহুল্য, ততক্ষণে ঘাসের উপর সটান শুয়ে নিজের দৈর্ঘ্য মাপছে রবিন হুড। উঠে বসে ফ্যাল ফ্যাল করে চাইলো চারপাশে। হো হো করে হাসছে সবাই, কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছে না ও। চোখের সামনে ঝিলমিল করছে অসংখ্য নক্ষত্র। কানটা একবার ছুঁয়ে দেখলো সত্যিই ওটা জায়গা মত আছে কিনা। তারপর উঠে দাঁড়ালো। এতক্ষণে অনুচরদের হাসির আওয়াজ কিছু কিছু কানে আসছে তার।

স্যার মোহান্তের দিকে চাইলো রবিন। অপূর্ব সুন্দর দেখতে মানুষটা, নীল চোখ দুটো দেখলে বোঝা যায় দুর্দান্ত সাহস রয়েছে এঁর বুকে, ঠোঁটের কোণে লেগে রয়েছে ছোঁয়াচে হাসি দেখলে হাসি এসে যায় নিজের মুখেও। অবাক হয়ে ভাবলো সে, এই রকম একজন সুপুরুষ কি সত্যিই কোন মঠের মোহান্ত হতে পারে? আরও অবাক হলো সে, যখন দেখলো ছুটে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে লিটল জন স্যার মোহান্তের সামনে।

‘ক্ষমা, ক্ষমা চাই, হুজুর!’ বলছে লিটল জন।

‘কিসের ক্ষমা, লিটল জন?’ এগিয়ে এলো রবিন। ‘তোমার শাস্তি তো হয়ে গেছে সন্ন্যাসী টাকের হাতেই। আবার এঁর হাতে চাপড় খেতে হবে, সেই ভয় পাচ্ছো? না, না, সে-ভয় নেই।

রবিনের কথা লিটল জনের কানে ঢুকলো কিনা বোঝা গেল না, আবার চেঁচিয়ে উঠলো সে, ‘আমাদের সবার হয়ে ক্ষমা চাইছি আমি, মাই লর্ড!’

ওর এই বিচিত্র ব্যবহারে অবাক হলো সবাই। বোকা হয়ে চেয়ে রয়েছে লিটল জন আর মোহান্তের দিকে। হঠাৎ দেখা গেল ঘোড়ায় চেপে এইদিকেই আসছেন লী-র স্যার রিচার্ড। কাছাকাছি এসেই মোহান্তকে দেখে রাশ টেনে ঘোড়া থামালেন তিনি, তারপর এক লাফে ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন লিটল জনের পাশে।

‘মহামান্য রাজার অনুগত নাইটের প্রতি কোন আদেশ থাকলে শুধু মুখে একটু উচ্চারণ করুন, মাই লর্ড! আপনার যে-কোন আদেশ আমার শিরোধার্য।’

‘রাজা!’ অবাক হয়ে গেল রবিন হুড।

‘সত্যিই তো!’ চেঁচিয়ে উঠলো মাচ, ‘ইনিই তো মহামান্য রাজা রিচার্ড!’

মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে রাজা রিচার্ডের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়লো রবিন, দেখাদেখি তার সাতকুড়ি অনুচর। মাথা হেঁট করে বললো রবিন, আপনার দয়া প্রার্থনা করছি আমি, মহামান্য লর্ড! আমাদের সবার হয়ে আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করছি!’

‘বেশ। ক্ষমা করে দিলাম,’ বললেন রাজা রিচার্ড। ‘তোমাদের মত সাহসী, সুশৃঙ্খল একদল যুবককে আবিষ্কার করবো এখানে, তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। কি বলো, রবিন হুড? তোমার লোকজন নিয়ে যোগ দেবে আমার সেনাদলে? তোমাদের পেলে আমি খুবই খুশি হবো।’

‘আপনার আদেশ শিরোধার্য, ইয়োর ম্যাজেস্টি,’ বললো রবিন হুড। ‘আজ থেকে আমরা যোগ দিলাম আপনার সশস্ত্র বাহিনীতে। আশা করি, আমাদের যোগ্যতা প্রমাণ করে সন্তুষ্ট করতে পারবো আপনাকে।

সবাই সমস্বরে সমর্থন করলো রবিনের ঘোষণা।

‘বেশ,’ হাসলেন রাজা। কিন্তু তোমাদের ভোজের কতদূর? খিদেয় যে নাড়ীভুঁড়ি হজম হয়ে যাবার জোগাড় হয়েছে!’ রবিনকে ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখে বললেন, আর শোনো, এই পুরোহিতের পোশাক বড়ই বিচ্ছিরি লাগছে, বাড়তি লিংকন গ্রীন আছে তোমাদের কাছে?’

‘অনেক, অনেক আছে, মাই লর্ড! আমি এক্ষুণি ব্যবস্থা করছি।’

ছুটলো রবিন। জঙ্গলের সবুজ রঙের পোশাক পরানো হলো রাজাকে, দারুণ লাগছে দেখতে। দস্তরখান বিছানো হতেই খেতে বসলো সবাই মিলে। পেট পুরে খেলেন রাজা, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন ওদের প্রিয় অক্টোবর এল-এর। খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই বিশ্রামের ব্যবস্থা হলো রাজার। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রাজা অ্যালান-এ-ডেলের অপূর্ব কণ্ঠে প্রেম, বীরত্ব আর মহিমার গান শুনে।

বিকেলে রাজার পিছন পিছন জয়ধ্বনি দিতে দিতে রওনা হয়ে গেল সবাই নটিংহামের দিকে।

শেরিফ প্রথমে ভেবেছিলেন, রাজাকে হত্যা করে নটিংহাম শহর দখল করে নিতে আসছে রবিন হুড তার দলবল নিয়ে। যখন আসল ঘটনা জানলেন, মুখটা কালো হয়ে গেল তাঁর রবিন হুডের সাথে রাজার সখ্যতা দেখে। সেই রাতে মস্ত এক ব্যাংকোয়েটের আয়োজন করলেন রাজা রিচার্ড শেরউডের দস্যুদের সম্মানে। চমৎকার খাওয়াদাওয়া হলো। অ্যালান-এ-ভেলের গান শুনে পানি এসে গেল নিষ্ঠুর শেরিফের চোখেও। ছোট্ট একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপাধি দেয়া হলো রবিন হুডকে আর্ল অফ হান্টিংডন।

দলবল সহ চলে গেল রবিন হুত রাজার সাথে লণ্ডনে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *