১৪. ঋণ পরিশোধ

১৪. ঋণ পরিশোধ

ঠিক এক বছর একদিনের দিন রবিন হুডের ঋণ শোধ করার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন স্যার রিচার্ড অফ লী।

আগের সেই দুঃখ ভারাক্রান্ত বিষাদ-মলিন ভাবের লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না তাঁর এখনকার চেহারা বা চাল চলনে। চমৎকার একটা ঘোড়ায় চেপে আগে আগে চলেছেন তিনি, হাসি খুশি একটা ভাব চোখে-মুখে, পেছনে কয়েকটা মালবাহী ঘোড়া, তার পেছনে একদল সশস্ত্র দেহরক্ষী-বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে দলটা শেরউডের দিকে। এমেটের মোহান্তের কাছ থেকে জমিদারী ছাড়িয়ে নিয়ে একটা বছর প্রচুর পরিশ্রম করে আগের চেয়েও অনেক ভাল অবস্থায় পৌঁছে গেছেন স্যার রিচার্ড। প্রচুর ধন-সম্পদ রোজগার হয়েছে, অঢেল প্রাচুর্য এসেছে তাঁর জীবনে, রাজকীয় মহলে বেড়ে গেছে মান-সম্মান। কিন্তু এইসবের মূলে যে লোকটা, যার সময়োচিত সহায্য না পেলে আজ নিঃস্ব পথের ভিখারী হতে হতো তাঁকে, সেই রবিন হুডের কথা সর্বক্ষণ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ রেখেছেন তিনি। আজ তার ঋণ পরিশোধের নির্দিষ্ট দিন, তাই খুশি মনে চলেছেন শেরউডের উদ্দেশে।

চলতে চলতে নদীর ধারে একটা মস্ত ময়দানে বিরাট এক আনন্দমেলার আয়োজন দেখে সেতু পেরোতে গিয়েও কি মনে করে থামলেন তিনি। হাজার পদের রকমারী মাল দিয়ে ছোট ছোট দোকান সাজিয়ে বসেছে হরেক রকম দোকানী, একদিকে জমে গেছে গানের আসর, অন্যখানে চলছে ম্যাজিক; অসংখ্য লোক গিজগিজ করছে গোটা ময়দান জুড়ে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছে কুস্তির মঞ্চে। দামী পুরস্কারের আকর্ষণে দূর- দূরান্ত থেকে অনেক বড় বড় কুস্তিগীর এসেছে এই গ্রাম্য মেলায়। প্রথম পুরস্কারঃ সোনার কারুকাজ করা জিন আর লাগাম পরানো একটা ঘোড়া, দ্বিতীয় পুরস্কারঃ একটা সাদা ষাঁড়, তৃতীয় পুরস্কারঃ সুন্দর এমব্রয়ডারী করা একজোড়া দস্তানা, চতুর্থ পুরস্কারঃ একটা সোনার আংটি, এবং পঞ্চম পুরস্কারঃ এক পিপে মদ। বেলা পড়তে দেরি আছে এখনো, হাতে সময় আছে যথেষ্ট, তাই ঘন্টাখানেক এখানে থেমে কুস্তি দেখার সিদ্ধান্ত নিলেন স্যার রিচার্ড।

আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি একজন বিশাল দেহী কুস্তিগীরের নৈপুণ্য দেখে। কোন প্রতিযোগীই দু’এক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারছে না তার সামনে। এ-গ্রামের চ্যাম্পিয়ান, ও-এলাকার সেরা কুস্তিগীর, অমুক নামজাদা পালোয়ান একে একে সবাই ঢুকছে রিঙে, প্রবল বিক্রমে লড়বার চেষ্টা করছে, কিন্তু ইয়া-লম্বা সেই লোকটা অল্পক্ষণের মধ্যেই অপূর্ব কায়দায় মাথার ওপর তুলে নিচ্ছে তাদের অনায়াসে, এমন এক আছাড় মারছে যে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না ওরা।

‘কে লোকটা!’ বলাবলি করছে লোকজন। ‘এমন অদ্ভুত দক্ষতা আর দেখিনি, বাবা! কিসের প্রতিযোগিতা, এই লোকের কাছে অন্যেরা দেখছি দুগ্ধপোষ্য শিশুর মত!’

একের পর এক হার মানছে প্রতিযোগীরা বিশাল দৈত্যের মত লোকটার কাছে, প্রশংসার হর্ষধ্বনি উঠছে দর্শকদের মধ্যে থেকে; কিন্তু কিছুক্ষণ পর প্রশংসার পাশাপাশি একআধটা কঠোর বাক্যও শোনা যেতে লাগলো কারও কারও মুখ থেকে। এইসব মন্তব্য আসছে একদল জঙ্গল-রক্ষীর মুখ থেকে। ওরা রেগে গেছে বিশাল চেহারার লোকটার ওপর, কারণ প্রচুর টাকা বাজি ধরেছে ওরা হিউবার্ট বলে একজন রক্ষীর বিজয়ের আশায়; এই লোকের কাছে যদি হিউবার্টের পরাজয় হয় তাহলে খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে ওদের। থেকে থেকেই টিটকারী দিচ্ছে ওরা, দাঁড়াও, দাঁড়াও! আগেভাগেই যতো পারো দেখিয়ে নাও বাহাদুরী। আসছে হিউবার্ট, কুস্তি কাকে বলে শিখিয়ে দেবে ও তোমাকে, একটা হাড়ও আস্ত রাখবে না।’

এইসব মন্তব্যে সবাই বরং খুশিই হয়ে উঠলো ভাল একটা প্রতিযোগিতা দেখা. যাবে, এই ভেবে। সবাই আশা করছে হিউবার্ট রিঙে এলে জমে যাবে প্রতিযোগিতা। কিন্তু সত্যিই যখন সে ঢুকলো রিঙে, হতাশ হতে হলো দর্শকবৃন্দকে। প্রথম দিকে একটু দাপাদাপি করলেও কিছুতেই এঁটে উঠতে পারলো না সে দৈত্যটার সাথে, অতি সহজেই মাথার ওপর তুলে নিয়ে প্রচণ্ড এক আছাড় মারলো সে হিউবার্টকে। চারদিকে হাত-পা ছড়িয়ে উইণ্ডমিলের পাখার মত দুই পাক ঘুরে দড়াম করে মাটিতে পড়লো সে চিৎ হয়ে, আর উঠলো না।

‘ফাউল হয়েছে!’ চিৎকার করে উঠলো জঙ্গল-রক্ষীরা। ‘ফাউল ক্যাচ! ফাউল থ্রো! নো থ্রো!

‘না, না!’ বলে উঠলেন স্যার রিচার্ড। ‘ঠিকই আছে, কোন ফাউল হয়নি! নিয়মের বাইরে কিচ্ছু করেনি লম্বা লোকটা।’

জঙ্গল-রক্ষীরাও ভাল করেই জানে সেটা, কিন্তু গলাবাজি কমালো না, গোলমাল পাকিয়ে নিজেদের চ্যাম্পিয়ানের মান বাঁচাবার চেষ্টা করছে ওরা, তাছাড়া হেরে যাওয়া বাজির টাকা যাতে দিতে না হয় তার ব্যবস্থা করছে। রিঙের চারপাশে হৈ-হল্লা বেধে গেল। চিৎকার করছে সবাই, কেউ বিশাল পালোয়ানের পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। বিপক্ষেই মন্তব্য হচ্ছে বেশি, কারণ একের পর এক নামজাদা কুস্তিগীরদের পরাজিত করে তাদের সমর্থকদের অসন্তোষের কারণ হয়েছে সে, তাছাড়া স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সমর্থক হিসেবে লোকটার নিজস্ব কেউ নেই এখানে, যারা তাকে সমর্থন করছে তারা শুধু ‘ভাল খেলা’র স্বার্থেই করছে তা।

‘কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে,’ মনে মনে বললেন স্যার রিচার্ড। ‘মনে হচ্ছে দেখেছি কোথাও। কিন্তু কোথায়? কোথায় দেখেছি একে?’

একটু চিন্তা করেই হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠলেন স্যার রিচার্ড, এগোলেন সামনের দিকে। মনে পড়েছে তাঁর, এ লোককে দেখেছেন তিনি রবিন হুডের আস্তানায়। হেরিফোর্ডের লর্ড বিশপকে ধরে এনেছিল এই লোক। এই লোকই রবিনের নির্দেশে চারশো পাউণ্ড গুণে থলিতে তুলে দিয়েছিল তাঁর হাতে। সহজে ভুলে যাওয়ার মত চেহারা নয় লোকটার।

ঠিকই ধরেছেন স্যার রিচার্ড, এই বিশাল দৈত্যের মত পালোয়ান আমাদের লিটল জন ছাড়া আর কেউ নয়। আস্তানা ছেড়ে কাজে বেরিয়েছিল সে, কাজ সেরে ফেরার পথে এই আনন্দমেলার আয়োজন দেখে এবং কুস্তির কথা শুনে লোভ সামলাতে পারেনি। প্রথমে ভেবেছিল খেলাটা দেখবে শুধু, কিন্তু রিঙের ধারে এসেই মনটা কেমন যেন করে উঠলো, তার ওপর পুরস্কারের কথা শুনে নিজেকে আর কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি, গ্রেডের উইল নাম ধারণ করে খাতায় নাম লিখিয়ে নেমে পড়েছে রিঙে, একের পর এক হারিয়ে দিয়েছে সবাইকে।

‘বের করে দাও ওকে রিং থেকে!’ হুংকার ছাড়ছে জঙ্গল-রক্ষীরা। ‘প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ফাউল করে আসছে লোকটা। ওকে বের করে দিয়ে আবার শুরু হোক খেলা।’

অনেকেই প্রতিধ্বনি তুললো এই কথার সমর্থনে, কারণ তাহলে তাদের কুস্তিগীর আবার সুযোগ পাবে, কিন্তু নিরপেক্ষ দর্শকেরা প্রবল আপত্তি তুললো, কারণ তাদের মতে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত খেলা খেলেছে লম্বা দৈত্য।

হঠাৎ করেই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়ে গেল লিটল জন। রাগের মাথায় উন্মুক্ত তলোয়ার হাতে কয়েকজন জঙ্গল-রক্ষী উঠে এসেছে রিঙের মধ্যে, এক্ষুণি রিং ছেড়ে বেরিয়ে না গেলে খুন করে ফেলবে। কিন্তু ভুল লোককে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল ওরা, ভয় কাকে বলে জানা নেই লিটল জনের, কোন হুমকির তোয়াক্কা না করে বিশাল পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে গেল সে মোকাবিলার জন্যে। মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়িয়েছে লিটল জন, নিদেন পক্ষে ভয়ানক ভাবে জখম হবে, এ কথা বুঝতে পেরে দেহরক্ষীদের নিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন স্যার রিচার্ড।

‘দাঁড়াও!’ হুংকার ছাড়লেন তিনি। খবরদার, কেউ হাত তুলবে না এই লোকের গায়ে!

শেরিফের লোকজন এই কথায় কান দিত না, কিন্তু যখন দেখলো সশস্ত্র দেহরক্ষী রয়েছে স্যার নাইটের সাথে, তার ওপর প্রচুর জন সমর্থন রয়েছে তাঁর পেছনে, যারা এতক্ষণ নীরব ছিল তারাও চিৎকার করছে এখন তাদের বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে, তখন মানে মানে পিছিয়ে গেল।

‘আপনাকে আমরা চিনি,’ জনতার মধ্যে থেকে অনেকেই চেঁচিয়ে উঠলো স্যার রিচার্ডের উদ্দেশ্যে। ‘বিনা দ্বিধায় আস্থা রাখা যায় আপনার ওপর। আপনিই বিচারক হয়ে মীমাংসা করে দিন, স্যার।’

আরো দুই কদম এগিয়ে এলেন স্যার রিচার্ড। সবাই চুপ করে গেল তাঁর রায় শোনার জন্যে।

‘আপনারাই বলুন,’ উচ্চকণ্ঠে বললেন স্যার রিচার্ড, ইংরেজের ন্যায়পরায়ণতার সুনাম আছে বিশ্বজোড়া, কিন্তু এ-ই কি তার নমুনা? ব্যক্তিগত স্বার্থ বা ক্রোধের কাছে পরাজিত হবে আমাদের খেলোয়াড়ী মনোভাব? প্রত্যেকটি ধরার কৌশল, প্যাঁচ, আছাড় আমি নিজ চোখে দেখেছি, নিয়মের বাইরে কিছুই করেনি এই লোকটা-এ কথা আমি যেমন জানি, আপনারাও ঠিক তেমনি জানেন। যাকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরাজিত করতে পারবো না, রিঙের মধ্যে দাঁড়িয়ে সৎ ভাবে খেলে হারাতে পারবো না, তাকে গলাবাজি করে হটিয়ে দেব মঞ্চ থেকে, নিষ্পাপ খেলাধুলার এই কি নিয়ম?’

কলুষমুক্ত খেলাধুলোর মধ্যে ক্রোধ, স্বার্থপরতা বা অন্যায়ের স্থান নেই এটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে চুপ হয়ে গেল বিপক্ষের লোকজন। জঙ্গল-রক্ষীরা শুধু নিজেদের মধ্যে গজগজ করতে থাকলো, সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে নাইট এসে বাধা না দিলে আজকে বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিত ওরা ঢ্যাঙা দৈত্যের।

বিচারে স্থির হলো, নিঃসন্দেহে প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়েছে গ্লেডের উইল, পরবর্তী পুরস্কারের জন্যে নিজেদের মধ্যে আবার লড়বে বাকি সবাই। আবার শুরু হলো কুস্তি। শেষও হলো। পুরস্কার বিতরণের পর শেষ পুরস্কার বিজয়ীর কাছ থেকে পাঁচ মার্ক দিয়ে মদের পিপেটা কিনে নিলেন স্যার রিচার্ড, সাথে সাথেই সেটার মুখ খুলে ঘোষণা করে দেয়া হলো যার যত খুশি মদ খেতে পারে পিপে থেকে। দর্শকরা সবাই খুশি হয়ে উঠলো এই ঘোষণায়, কিন্তু শেরিফের লোকজন মোটেই খুশি হতে পারলো না, মুখ কালো করে হেরে যাওয়া বাজির টাকা শোধ করলো ওরা, ভুরু কুঁচকে কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে লিটল জনের দিকে।

ঘোড়াটা পরীক্ষা করে দেখছিল লিটল জন, খুবই পছন্দ হয়েছে ওটা ওর, এমনি সময়ে কেমন করে জানি গুজব ছড়িয়ে পড়লো দর্শকদের মধ্যে; চাপা গলায় বলাবলি করছে সবাইঃ আজকের প্রথম পুরস্কার বিজয়ী বিশাল চেহারার কুস্তিগীর আসলে রবিন হুডের লোক। স্যার রিচার্ড ছাড়াও আরো কোনো লোক হয়তো চিনে ফেলেছিল লিটল জনকে। যদিও ছদ্মবেশে রয়েছে সে, শরীরের বিশাল কাঠামো আর চওড়া কাঁধ সে লুকাবে কোথায়?

গুজবটা জঙ্গল-রক্ষীদের কানে আসতেই লাফিয়ে উঠলো ওরা। সত্য না মিথ্যে জানার দরকার নেই, এই সুযোগে গ্রেফতার করতে পারবে ওরা বেয়াড়া কুস্তিগীরকে, আর একবার পাকড়াও করতে পারলে ধরে নিয়ে গিয়ে…

‘ডাকাত! ডাকাত! ধরো, ওকে ধরো!’ হাঁক ছাড়লো ওরা, একটানে খাপ থেকে তলোয়ার বের করে ছুটলো ওর দিকে।

চিৎকারটা কানে যেতেই এদিকে ফিরলো লিটল জন, এক মুহূর্তে বুঝে নিল বিপদটা ধরা পড়লে রক্ষা নেই! লাফ দিয়ে উঠে পড়লো সে ঘোড়ার পিঠে, পায়ের গোড়ালি দিয়ে চাপ দিতেই তীরবেগে ছুটলো ওটা। রবিন হুড ও তার দলবলের জনপ্রিয়তার কথা চারণ কবিদের গানে শুনেছে লিটল জন, কিন্তু হাতে-নাতে প্রমাণ পেল আজ। সাধারণ মানুষ তাদের কতটা ভালবাসে বুঝতে পারলো সে, যখন দেখলো ওকে এগোতে দেখেই দু’পাশে সরে পথ করে দিচ্ছে লোকজন, ও এগিয়ে গেলেই আবার ভিড় করে বন্ধ করে দিচ্ছে পথটা। হাঁক ডাক করে ভিড় সরিয়ে জঙ্গল-রক্ষীরা দশ গজ এগোবার আগেই ঘোড়ার পিঠে চেপে সেতু পেরিয়ে গেল লিটল জন, কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল চোখের আড়ালে।

‘যাক, বাঁচা গেল,’ লিটল জনকে নিরাপদে চলে যেতে দেখে হাঁফ ছাড়লেন স্যার রিচার্ড। দেহরক্ষীদের নিয়ে রওনা হয়ে গেলেন তিনিও। ধীরেসুস্থে এগোচ্ছেন তিনি লিটল জন যে-পথে গিয়েছে সেই পথে।

একছুটে শেরউডে এসে হাজির হলো লিটল জনের ঘোড়া। পথে কোথাও বিশ্রামের দরকার পড়েনি ওটার। সোজা রবিন হুডের সামনে এসে থামলো ঘোড়া। জনা দশেক অনুচর নিয়ে গ্রীনউডের নিচে দাঁড়িয়ে কি যেন আলাপ করছিল রবিন তখন।

‘কি হে, লিটল জন,’ হাঁক ছাড়লো রবিন, ‘এত তাড়াহুড়ো কিসের? কার মাথায় বাড়ি দিয়ে নিয়ে এলে এত সুন্দর ঘোড়াটা?’

‘কারো মাথায় বাড়ি দিইনি,’ হাসতে হাসতে বললো লিটল জন। ‘এটা আমার। জিতে নিয়েছি লড়ে।’ এই বলে আনন্দমেলার ঘটনাটা খুলে বললো সে রবিনকে। এক জন ভাল নাইটের সহযেগিতা না পেলে যে জঙ্গল-রক্ষীদের হাতে নাস্তানাবুদ হতো, সেটাও জানালো। স্যার রিচার্ডকে সে চিনতেই পারেনি, এতই পরিবর্তন ঘটেছে তাঁর চালচলনে।

‘আচ্ছা,’ জিজ্ঞেস করলো রবিন, ‘আমাদের সেই দুখী স্যার রিচার্ডকে পথে দেখেছো কোথাও? সেই যাকে এক বছর আগে ধার দিয়েছিলাম আমরা চারশো পাউণ্ড?’

‘না তো,’ বললো লিটল জন। ‘তাঁকে আশা করছো নাকি আজ?’ হ্যাঁ। আজই সূর্যাস্তের আগে টাকাটা তাঁর ফেরত দেয়ার কথা।’

‘তাহলে ঠিকই আসবে,’ বললো লিটল জন। ‘দেরি আছে এখনও সূর্যাস্তের। যতদূর মনে আছে, ভদ্রলোকের চোখ-মুখে একটা সততার ভাব লক্ষ্য করেছিলাম। দেখো, এসে পড়বে সময় মতই।

‘দেখা যাক,’ বললো রবিন। ‘এবার কাজের কথা। আজকে আমি ঠিক করেছি অতিথি ছাড়া কিছুতেই খেতে বসবো না। ওয়াটলিং স্ট্রিটে টহল দাও গিয়ে তুমি উইল স্কারলেট আর মাচকে নিয়ে। যাকে পাবে তাকেই ধরে আনবে দাওয়াত খেতে। যদি ধনী হয়, পকেট কিছুটা হালকা করবো আমরা তার, আর যদি গরীব হয়, কিছুটা ভারি করে দেব তার পকেট।’

তীর-ধনুক নিয়ে রওনা হয়ে গেল তিনজন। টহল দিচ্ছে রাস্তায়। পুব পশ্চিম কোন দিকেই কাউকে দেখতে পেল না। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটির পর বার্ন ডেলের দিকে যে রাস্তাটা গেছে সেখানে এসে দাঁড়ালো। ডানদিকে চেয়েই চমকে উঠলো তিনজন একসাথে। বিরাট একটা দল আসছে এইদিকেই।

‘সেরেছে!’ বললো লিটল জন। ‘এত মেহমান নিয়ে হাজির হলে খাওয়া-দাওয়ার টান পড়ে যাবে আমাদের। কারা এরা?’

দু’জন কালো আলখেল্লা পরা সন্ন্যাসী রয়েছে সবার আগে দুটো দামী ঘোড়ার ওপর, তাদের ঠিক পেছনেই সাতটা মালবাহী ঘোড়া, তার পেছনে বাহান্ন জন বর্শাধারী রক্ষী।

‘সাধু দু’টোর জাঁকঝমক দেখছি বিশপদেরও হার মানায়,’ বললো মাচ। ‘প্রহরার বহর দেখে মনে হচ্ছে প্রচুর ধনসম্পদ রয়েছে ওই সাতটা ঘোড়ার পিঠে। খুবই খুশি হবে আজ রবিন।’

‘তা তো বুঝলাম,’ বললো চিন্তান্বিত লিটল জন, ‘কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমরা মাত্র তিনজন, এতগুলো লোককে সামলাই কি করে? সময়ও নেই হাতে যে আরো লোক ডাকবো। ভাবছি…’

চুপ করে থাকলো উইল স্কারলেট আর মাচ, বুঝলো, দ্রুত চিন্তা চলছে এখন লিটল জনের উর্বর মস্তিষ্কে, এখন কথা বলে উঠে তার ভাবনায় বাধা দেয়া ঠিক নয়। ‘অথচ যেমন করেই হোক, দাওয়াত কবুল করাতে হবে ওদের দিয়ে,’ নিচু গলায় বলে চলেছে লিটল জন, হঠাৎ তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললো, ‘আমরা যে মাত্র তিনজন সে-কথা ব্যাটারা জানছে কিভাবে? আরো ছয়-কুড়ি লোক যে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নেই সে নিশ্চয়তা কোথায়? কাজেই, চলো, ওই মোড়টা ঘুরেই তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি তিনজন।’

রাজি হয়ে গেল সঙ্গীরা। এক দৌড়ে রাস্তার বাঁক ঘুরেই পিছন ফিরে দাঁড়ালো ওরা একেবারে মাঝ-রাস্তায়। বাঁক ঘুরেই চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল সামনের সাধু দু’জনের- ছিলায় তীর পরিয়ে তৈরি হয়ে দাড়িয়ে রয়েছেন তিনজন ভয়ঙ্কর দস্যু!

দলের প্রথম অংশটা বাঁক নিতেই এক টানে কানের পাশে নিয়ে এলো ওরা ধনুকের ছিলা। হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে উঠলো লিটল জন, ‘খবরদার! যে যেখানে আছো দাঁড়িয়ে পড়ো! নইলে খুন হয়ে যাবে!’ সামনের দুজন সন্ন্যাসী রাশ টেনে ধরলো ঘোড়ার। থতমত খেয়ে গিয়েছে গোটা দলটা, বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ছে। ভয়ঙ্কর এক হাসি ফুটে উঠলো লিটল জনের মুখে। বললো, ‘সাধু বাবারা, সাংঘাতিক রাগিয়ে দিয়েছো তোমরা আমাদের নেতাকে। তোমাদের জন্যে সেই কখন থেকে উপোষ করে রয়েছে বেচারা। এত দেরি হলো কেন এইটুকু পথ আসতে?’

ভয়ে ও বিস্ময়ে পাথর হয়ে কিছুক্ষণ ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সাধুরা লিটল জনের মুখের দিকে, তারপর ওদের মধ্যে থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো, ‘কে তোমাদের নেতা?’

‘রবিন হুড!’ বজ্রকণ্ঠে জবাব দিল লিটল জন।

তিক্ততায় ভরে গেল সন্ন্যাসীর মুখ। বললো, ‘কে? সেই চোরটা? নিরীহ, শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে যে দস্যুটা?’

‘মিথ্যেবাদী!’ এবার সত্যিই রেগে গেল লিল জন, ‘নিরীহ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছো তোমরা! রবিন হুড পণ করেছে, তোমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে সে। যাই হোক; দাওয়াত খেতে ডেকেছে সে, যেতে হবে তোমাদের।’

যে-কোন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যে প্রস্তুত ছিল উইল স্কারলেট ও মাচ, তীর ছোঁড়ার জন্যে তৈরি; কিন্তু তার কোন দরকারই পড়লো না। যাদু আছে রবিন হুডের নামে। বর্শাধারী প্রহরীদের মধ্যে প্রথমে কিছুটা চাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেল, তারপর আশ্চর্য কায়দায় সটকে পড়লো ওরা দু’পাশের জঙ্গলে, কেউ কেউ প্রাণপণে ছুটলো যে-পথে এসেছে সেই পথ ধরে। ওরা মনে করেছে মালের কাছে থাকলে প্রচণ্ড হামলা আসবে এখুনি ওদের ওপর। ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে চেয়েই কলজে শুকিয়ে গেল দুই সাধুর— যেন যাদুমন্ত্রের বলে হাওয়া হয়ে গেছে সব রক্ষী, মালবাহী ঘোড়ার পাশে বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে শুধু দু’জন অল্পবয়েসী ভৃত্য।

‘এগোও!’ হুকুম করলো লিটল জন। ভীত-সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগোলো সাধু দু’জন, তীর-ধনুক বাগিয়ে ধরে ওদের পাহারা দিয়ে নিয়ে চললো উইল স্কারলেট আর মাচ; ভৃত্য দু’জনের সাহায্যে মালবাহী সাতটা ঘোড়া টেনে আনার ভার নিল লিটল জন।

গ্রীনউডের নিচে বসে অপেক্ষা করছিল রবিন, ওদের আসতে দেখে উঠে এসে অত্যন্ত সৌজন্যের সাথে মাথার হুড খুলে স্বাগত জানালো সে সাধুদের। প্রত্যাভিবাদনের ধার ধারলো না সাধুরা; বিরক্ত, বাঁকা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রবিনের দিকে। দেখে রেগে গেল লিটল জন।

‘দাঁড়াও, ছোটলোক কোথাকার!’ এগোচ্ছে সে সাধুদের দিকে। ‘ভদ্রতা শিখিয়ে ছেড়ে দেব আজ শালাদের!’

‘এই একটা ব্যাপারে কারো ওপর জোর খাটাতে নেই, লিটল জন,’ বললো রবিন ‘যেতে দাও, সৌজন্য ছাড়াও চলবে আমাদের। কতজন ছিল এদের সাথে?’

‘ছিল তো অনেক, সব মিলে দুই কুড়ি ষোল জন; কিন্তু তোমার নাম উচ্চারণ করবার পর সাথে নিয়ে আসার জন্যে এই চারজন ছাড়া আর কাউকে পেলাম না। সব ভেগেছে।’

‘তোমার শিঙাটায় একটু ফুঁ দাও, জন,’ বললো রবিন। ‘সবাই জানুক, মেহমান এসেছে আজ।

লিটল জনের শিঙার আওয়াজ পেয়েই হুড়মুড় করে এসে হাজির হলো রবিনের সাত-কুড়ি সশস্ত্র অনুচর। পরস্পরের মুখের দিকে চাইলো সন্ন্যাসী দু’জন, তারপর উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চাইলো একবার মালবাহী ঘোড়াগুলোর দিকে। বুঝতে কারোই অসুবিধে হলো না, প্রচুর ধনরত্ন রয়েছে ঘোড়ার পিঠে 1

খাবার তৈরি হয়ে যেতেই দস্তরখান বিছিয়ে বসে গেল সবাই। খুবই খাতির-যত্ন করে সন্ন্যাসীদের বসানো হলো, নানান রকম সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হলো তাদের পাতে, এটা খান ওটা খান বলে আদর আপ্যায়ন করা হলো। ভরপেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললো সাধুরা।

‘আপনাদের মঠটা কোথায়?’ খাওয়া-দাওয়ার শেষে জানতে চাইলো রবিন।

‘আমরা এমেট মঠের সন্ন্যাসী,’ বললো ভারিক্কি চেহারার সাধু।

কথাটা শুনেই হেসে উঠলো রবিন, তারপর জিজ্ঞেস করলো, ‘ওখানে কোন্ পদে আছেন আপনি?’

‘কোষাধ্যক্ষ,’ গুরু-গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো সাধু। শুনে আবার হেসে উঠলো রবিন। রবিনকে হাসতে দেখে ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলো সাধু, এতে হাসির কি আছে?’

‘কিছু মনে করবেন না,’ বললো রবিন। ‘হাসি এসে যাচ্ছে। অবাক লাগছে ভাবতে, এত দিন থাকতে আজকের দিনটাতেই এসে হাজির হলেন এমেট মঠের কোষাধ্যক্ষ।’

‘আজকের দিনের বিশেষত্বটা কি?’ জানতে চাইলো সাধু।

‘বিশেষত্ব এই যে, ঠিক এক বছর আগে চারশো পাউণ্ড ধার দিয়েছিলাম আমি একজনকে, টাকাটা এমেটের মোহান্তকে ফেরত দিয়ে তাঁর জমিদারী উদ্ধারের জন্যে। আমার সেই ধার শোধের তারিখ আজ। ভাবছি, সেই ধার শোধ করতেই পাঠানো হলো কিনা আপনাকে।’

‘আমাকে!’ প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো কোষাধ্যক্ষ। ‘না তো! কোন টাকা-পয়সা আনিনি আমি। এত টাকা কাকে ধার দিয়েছিলে তুমি?’

‘একজন দুখী নাইটকে।’

‘তাহলে তাকেই ধার শোধ করতে বলোগে যাও।’

‘আমি ভেবেছিলাম,’ হাসিমুখে বললো রবিন, ‘এমেটের মোহান্ত বুঝি ফেরত পাঠালেন টাকাটা।’ মালবাহী ঘোড়াগুলোর দিকে মাথা হেলিয়ে ইঙ্গিত করলো সে, ‘মনে হচ্ছে বহুত ধনরত্ন রয়েছে ওদের পিঠে?’

‘না, না!’ ব্যস্ত হয়ে উঠলো কোষাধ্যক্ষ। টাকা পয়সা কিচ্ছু নেই। কিছু পুরনো জামা-কাপড়, আর নিতান্তই সাধারণ কিছু জিনিস-পত্র।’

‘টাকা পয়সা নেই!’ ভুরুজোড়া কপালে তুলে ফেললো রবিন, ‘এত লোক-লস্কর নিয়ে চলেছেন আপনি একেবারে খালি হাতে? রাহা-খরচাও নেই আপনার সাথে?’

‘হ্যাঁ, তা অবশ্য আছে,’ ভুলটা সংশোধন করে নিল কোষাধ্যক্ষ। ‘সামান্য কিছু টাকা আছে আমার সাথে, এই ধরো, বিশ মার্কের মত হবে। এমন কিছুই নয়-মালপত্র খুলে দেখার কষ্টও পোষাবে না তোমার।’

‘বেশ তো, হাসলো রবিন। কিছু না থাকলে না-ই থাকবে। কিন্তু খুলে দেখাটা আমাদের পবিত্র কর্তব্য। বলা তো যায় না, হয়তো আপনার অজান্তেই খোদার তরফ থেকে কিছু পাঠানো হয়েছে। এমনও হতে পারে, সেই দুখী নাইটের ধারের টাকাটা তিনি পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনার মাধ্যমে। হয়তো দেখা যাবে আপনার বিশ মার্কই অলৌকিক ভাবে বেড়ে বহুগুণ বেশি হয়ে গেছে।’ লিটল জনের দিকে ফিরলো রবিন। *জন, খোলো দেখি বাক্সগুলো।’

প্রথমে ঘাসের উপর একটা কাপড় বিছালো লিটল জন, তারপরই ক্যাশ বাক্সের মত দেখতে দুটো বাক্স নিয়ে এলো ঘোড়ার পিঠ থেকে। ওগুলো খুলতে গায়ের জোর খাটাবার প্রয়োজন পড়লো। প্রথমটা খুলে উপুড় করতেই ঝর ঝর করে অনেকগুলো স্বর্ণমুদ্রা ঝরে পড়লো কাপড়ের ওপর।

‘আশ্চর্য! আশ্চর্য!’ চেঁচিয়ে উঠলো রবিন হুড। ‘দেখেছেন, কী অলৌকিক কাণ্ড! ঈশ্বরের ইচ্ছায় কী না হয়! বলিনি, বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে আপনার বিশ মার্ক?’

দ্বিতীয় বাক্সটা খুললো লিটল জন। আবার চকচকে একরাশ স্বর্ণমুদ্রা ঝরে পড়লো আগেরগুলোর ওপর ঝন ঝন শব্দ তুলে।

‘আশ্চর্য! আশ্চর্য! সত্যিই আশ্চর্য!’ চেঁচিয়ে উঠলো সবাই। হাসি চেপে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে ওদের পক্ষে। কিন্তু আঁধার হয়ে গেছে কোষাধ্যক্ষের মুখটা, ভুরু জোড়া কুঁচকে সেঁটে গেছে একটার সাথে আরেকটা।

‘চট করে গুণে ফেলো দেখি, লিটল জন,’ বললো রবিন।

গুণে দেখলো লিটল জন। বললো, ‘আটশো পাউণ্ডেরও বেশি রয়েছে, ওস্তাদ!’

‘বেশ, বেশ। সাধু বাবাজীকে ওঁর বিশ মার্ক দিয়ে দাও।’ বিশ মার্ক গুণে আলাদা করার কাজে লেগে গেল লিটল জন। কোষাধ্যক্ষের দিকে ফিরলো আবার রবিন। ‘সাধু- সন্ন্যাসী মানুষ আপনারা, নির্লোভ, সত্যবাদী মহাপুরুষ; তাই আপনাদের একটা পয়সাও ছুঁলাম না। আপনার নিজের মুখেই শুনেছি আমরা, বিশ মার্কের বেশি একটা আধলাও নেই আপনার কাছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, অলৌকিক ক্ষমতার বলে আরও আটশো পাউণ্ড ভরে দিয়েছেন ঈশ্বর ওর মধ্যে খুব সম্ভব যা ধার দিয়েছিলাম তার দ্বিগুণ ফেরত দিতে চেয়েছেন তিনি আমাকে। তাঁর দান আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করছি।’

‘চোর, গুণ্ডা, বদমাশ কোথাকার!’ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠলো কোষাধ্যক্ষ। ‘মোহান্তের সম্পদ ওসব, ভাল চাও তো এক্ষুণি ফেরত দাও বলে দিচ্ছি; তা নইলে ভয়ঙ্কর অভিশাপ নেমে আসবে তোমাদের ওপর। ঘন্টা, পবিত্র বাইবেল আর মোমবাতি নিয়ে এমন অভিশাপ দেবেন তিনি যে ইহকাল পরকাল কোথাও ঠাঁই হবে না তোমাদের।’

‘কচু হবে!’ বুড়ো আঙুল দেখালো রবিন। ‘থোড়াই কেয়ার করি আমরা তোমাদের অভিশাপের। মোহান্তের মত এতবড় একটা অর্থ-পিশাচ, এত বড় নিষ্ঠুর নীচ লোক গোটা ইংল্যাণ্ডে আর দ্বিতীয়টি নেই। গরীবকে পিষে তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা রোজগার যে ধর্মের নাম করে ছিনিয়ে নেয়, অসহায় বিধবার মুখের গ্রাস কেড়ে নিতেও যার বিন্দুমাত্র বিবেকে বাধে না, তার অভিশাপ গায়ে লাগবে না আমাদের। গিয়ে তাকে বলবেন, আমি বলেছি, শকুনের অভিশাপে গরু মরে না। লিটল জন, এঁদের ঘোড়া দুটো দিয়ে দাও, মাল-পত্রসহ বাকি ঘোড়াগুলো রেখে দেব আমরা।’

শারীরিক নির্যাতনের ভয় পেয়েছিল কোষাধ্যক্ষ, অক্ষত অবস্থায় চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে আর দেরি করলো না, রওনা হয়ে গেল অপর সাধু এবং দুই ভৃত্যকে সাথে নিয়ে।

এমেটের সাধু বাঁক নিয়ে চোখের আড়াল হতে না হতেই অন্যদিক থেকে এসে হাজির হলেন লী-র স্যার রিচার্ড তাঁর দলবলসহ। এত দেরি হওয়ার কারণ, ধীরে-সুস্থে এসেছেন তিনি-লিটল জনের মত অতটা তাড়া তাঁর ছিল না; তাছাড়া দেহরক্ষীদের অনেকেই পায়ে হেঁটে এসেছে তাঁর পিছু পিছু।

‘তোমাদের ওপর স্বর্গের শান্তি বর্ষিত হোক,’ কাছাকাছি এসে সবার উদ্দেশ্যে বললেন তিনি। ‘কেমন আছো, রবিন?’

‘ভালো,’ বললো রবিন। আসুন, স্যার নাইট, গ্রীনউডে স্বাগত জানাচ্ছি আপনাকে। এমেটের মোহান্তের ব্যাপারটা ভাল ভাবেই চুকেছিল তো?’

‘হ্যাঁ। টাকা নিয়ে হাজির হতেই কালো হয়ে গিয়েছিল মোহান্তের মুখটা। বড় আশা করেছিল বেচারী দখল করে নেবে আমার জমিদারীটা। অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে, তোমার সাহায্যে রক্ষা করতে পেরেছি সবকিছু। একটা বছর কঠোর পরিশ্রম করে আগের চেয়েও অবস্থা ভাল করে ফেলেছি, আয় বেড়ে গেছে কয়েক গুণ। কথামত হাজির হয়েছি আমি আজ।’

‘সন্ধে হয়ে আসছে দেখে ভেবেছিলাম আজ বুঝি আপনি আর এলেন না,’ বললো রবিন।

‘পথে দেরি হয়ে গেল,’ বললেন স্যার রিচার্ড। ‘কুস্তি প্রতিযোগিতা হচ্ছিল এক আনন্দমেলায়। ওখানে দেখলাম, সেরা কুস্তিগীরকে অন্যায় ভাবে রিঙ থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করছে কিছু কুচক্রী বদলোক। সেই লোকটা দেখলাম একা। মনে হলো লোকটাকে তোমার এখানে দেখেছি, তাই রয়ে গেলাম। ওকে সাহায্য করতে গিয়েই দেরি করে ফেলেছি।’

‘ঠিকই বলেছেন, স্যার নাইট,’ এগিয়ে এলো লিটল জন। ‘আমিই সেই লোক। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনার সময়োচিত সাহায্য না পেলে খুব সম্ভব জঙ্গল-রক্ষীদের হাতে খুন হয়ে যেতাম আমি আজ। কিন্তু আপনার এমন আশ্চর্য পরিবর্তন হয়েছে যে চিনতেই পারিনি আমি আপনাকে।’

‘আমারও ধন্যবাদ গ্রহণ করুন, স্যার নাইট,’ বললো রবিন। ‘আমার লোককে সাহায্য করা আর আমাকে সাহায্য করা একই কথা। লিটল জন আমার ডান হাত, ওকে হারালে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যেতাম আমি।’

‘তোমাদের কোন কাজে আসতে পেরেছি জেনে আমি খুশি। কিন্তু এ তো অতি সামান্য ব্যাপার, তোমাদের সহানুভূতি ও সাহায্যের তুলনায় কিছুই নয়। তোমাদের আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আমরা বুড়ো-বুড়ি যতদিন বেঁচে আছি, স্যার রিচার্ডের দুর্গ-তোরণ তোমাদের জন্যে সব সময় খোলা থাকবে।’ একটা মোহর ভর্তি থলে বের করলেন তিনি। ‘এই নাও তোমার চারশো পাউণ্ড। ঘোড়ার পিঠে আরও কিছু উপহার রয়েছে তোমাদের জন্যে আমার ও আমার স্ত্রীর তরফ থেকে।’

‘উপহার নিতে পারি,’ বললো রবিন, ‘কিন্তু টাকাটার আর দরকার নেই, স্যার নাইট। সেই ধারটা শোধ করে দেয়া হয়েছে।’

‘শোধ করে দেয়া হয়েছে!’ আকাশ থেকে পড়লেন স্যার রিচার্ড। ‘কী বলছো তুমি, রবিন? আমার এমন কোন বন্ধু নেই দুনিয়ায় যে আমার জন্যে এত টাকা খরচ করবে।

‘কিন্তু সত্যিই শোধ করে দেয়া হয়েছে সব টাকা,’ হাসতে হাসতে বললো রবিন। ‘শুনলে আশ্চর্য হবেন, টাকাটা এসেছে এমেটেরই মোহান্তের কাছ থেকে। যত ধার দিয়েছিলাম তার ডবল।’

‘অসম্ভব! এমেটের মোটা, লোভী, হাড় কেপ্পণ বুড়ো মোহান্ত আমার ধারের দ্বিগুণ টাকা শোধ করে দিয়েছে, এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারবো না। স্বেচ্ছায়… উঁহুঁ।’

না, ঠিক স্বেচ্ছায় নয়… হাসলো রবিন, তারপর ভেঙে বললো কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। কোষাধ্যক্ষের বিশ মার্ক আশ্চর্য অলৌকিক উপায়ে আটশো পাউণ্ডেরও বেশি হয়ে যাওয়ার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন স্যার রিচার্ড।

‘ভাল কায়দা করেছিলে, হে!’ হাসতে হাসতে বললেন স্যার রিচার্ড। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘কিন্তু তাই বলে আমাকে ঋণমুক্ত হতে বাধা দেয়া তোমার উচিত হবে না, রবিন। ধরো, পুরো চারশো পাউণ্ড আছে এতে।’

রবিন হুড বুঝতে পারলো, জোর করে কাউকে কিছু দান করতে গেলে তিক্ততারই সৃষ্টি হয়, মঙ্গল হয় না কোন পক্ষেরই; তাই এ নিয়ে আর চাপাচাপি করলো না। বললো, ‘বেশ তো, ধার নিয়েছিলেন, শোধও না হয় করবেন। কিন্তু এসবের আগে আপনাদের খাওয়া-দাওয়া দরকার, এতটা পথ চলে নিশ্চয়ই খিদে লেগে গেছে আপনার লোকজনদের। আগে খাওয়া দাওয়া হোক, তারপর লেন-দেন হবে টাকা পয়সার।’

রবিনের নির্দেশে আবার ভোজের ব্যবস্থা করা হলো। পানাহার শেষে মালবাহী ঘোড়ার পিঠ থেকে সবকিছু নিয়ে আসার হুকুম দিলেন মিষ্টভাষী নাইট। চারশো পাউণ্ডের থলেটা রবিনের হাতে দিলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশে ছোট্ট একটা ভাষণ দিলেন তিনি। ‘বন্ধুগণ, তোমরা আমার চরম বিপদে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছো, তোমাদের সাহায্যে আমার জীবনের এক মস্ত সংকট ও ভয়ঙ্কর বিপদ কাটিয়ে উঠে আজ আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছি আমি। সেদিন সেই সাহায্য না পেলে সর্বস্বান্ত হয়ে যেতাম আমি, দুর্দশার সীমা থাকতো না আমার। আমি ও আমার স্ত্রী যে তোমাদের কাছে কতটা আন্তরিক ভাবে কৃতজ্ঞ, সে কথা ভাষায় প্রকাশ করবার ক্ষমতা আমার নেই। টাকা ফেরত দিয়ে দিলেই এ ঋণ শোধ হয় না। তোমাদের প্রতি আমাদের দু’জনের ভালবাসার নমুনা হিসেবে সামান্য কিছু উপহার সাথে করে এনেছি আমি, তোমরা যদি খুশি মনে সেটা গ্রহণ করো, আমরা ধন্য মনে করবো নিজেদের।’ এই বলে প্যাকেট খোলার নির্দেশ দিলেন তিনি নিজের লোকদের।

জিনিসগুলো দেখেই প্রচণ্ড এক হর্ষধ্বনি বেরিয়ে এলো সবার মুখ থেকে। স্প্যানিশ ইউ দিয়ে তৈরি দুইশো ধনুক নিয়ে এসেছেন স্যার রিচার্ড। ঝকঝক করছে বার্ণিশ করা ধনুকের কাঠ, এক পিঠে রূপোর পাত দিয়ে এমন ভাবে চমৎকার নক্সা করা হয়েছে, যেন দেখতে সুন্দর লাগে, অথচ ধনুকের শক্তি কোনভাবে হ্রাস না পায়। এরপর বেরোলো-সোনার কারুকাজ করা দুশো চামড়ার তৃণ। প্রতিটা তূণে বিশটা করে তীর- ফলাগুলো ঝকঝক করছে রূপোর মত, ময়ূরের পালক বাঁধা হয়েছে প্রতিটা তীরে, তীরের পেছনে রূপোর রিঙ।

প্রত্যেকের হাতে একটা করে ধনুক আর একটা তীর ভর্তি তূণ তুলে দিলেন স্যার রিচার্ড। রবিনকে দিলেন সোনা দিয়ে কারুকাজ করা অপূর্ব সুন্দর এক বিশাল ধনুক, আর তেমনি সুন্দর কারুকাজ করা তীর-ভর্তি তৃণ।

এত সুন্দর অপ্রত্যাশিত উপহার পেয়ে সবাই যার-পর-নাই খুশি হলো, মাথার ওপর ধনুক-ধরা হাত তুলে প্রতিজ্ঞা করলো ওরা, স্যার রিচার্ড ও তাঁর স্ত্রীর যে-কোন বিপদে ওরা থাকবে তাঁদের পাশে, প্রয়োজন হলে মৃত্যু বরণ করতেও দ্বিধা করবে না।

বিদায় নেয়ার সময় হলো। মশাল হাতে স্যার রিচার্ড ও তাঁর লোকজনদের জঙ্গলের শেষ সীমা পর্যন্ত পৌঁছে দিল রবিন হুড ও তার দলবল। ঘোড়ার পিঠে বসেই নিচু হয়ে রবিনের দুই গালে চুমো খেলেন স্যার রিচার্ড, তারপর হাসি মুখে রওনা হয়ে গেলেন নিজ দুর্গের পথে।

‘এই রকম একজন মহৎ মানুষকে সাহায্য করেও সুখ আছে, কি বলো, জন?’

মাথা ঝাঁকালো লিটল জন।

ফিরে চললো ওরা নিজেদের আস্তানায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *