শাশ্বত বঙ্গ (নির্বাচিত প্রবন্ধ) – কাজী আবদুল ওদুদ
শাশ্বত বঙ্গ / নির্বাচিত প্রবন্ধ – কাজী আবদুল ওদুদ
নিবেদন
শাশ্বত বঙ্গের অনেকগুলো লেখা পূর্বে বেরিয়েছিল এইসব বইতেঃ নবপর্যায় (১৩৩৩ সাল), রবীন্দ্রকাব্যপাঠ (১৩৩৪ সাল), নব-পর্যায় দ্বিতীয় খণ্ড (১৩৩৬ সাল), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১ সাল), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৩৪৩ সাল), আজকার কথা (১৩৪৮ সাল), নজরুল-প্রতিভা (১৩৫৫ সাল)। সূচীপত্রে সে-সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ দেখতে পাওয়া যাবে। এর প্রথম ৭৯ পৃষ্ঠার লেখাগুলো এর পূর্বে বই আকারে বেরোয়নি, তবে তার অল্প কয়েকটি দিয়ে কয়েক মাস পূর্বে ‘স্বাধীনতা-দিনের উপহার’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর শেষের দিকের ‘গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ’ লেখাটিও পূর্বে কোনো বইতে প্রকাশ করা হয়নি। দেশ-বিভাগের পরের লেখাগুলো বইয়ের প্রথম দিকে দেখতে পাওয়া যাবে।
এর অন্তর্ভুক্ত ‘হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ’ ১৯৩৬ খৃষ্টাব্দে বিশ্বভারতীতে প্রদত্ত নিজাম-বক্তৃতা-স্বত্বাধিকার বিশ্বভারতীর। এটি শাশ্বত-বঙ্গে প্রকাশের অনুমতি দিয়ে বিশ্বভারতীর কর্তৃপক্ষ লেখককে অচ্ছেদ্য কৃতজ্ঞতা-পাশে আবদ্ধ করেছেন। ‘রস ও ব্যক্তিত্ব’ লেখাটি এর অন্তর্ভুক্ত দিয়ে অল ইন্ডিয়া রেডিও-র কর্তৃপক্ষও তুল্যরূপে লেখকের কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন।
১৩৩২ সালে ১৯২৬ খৃষ্টাব্দের সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজ’ নামে একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়, তার মূলমন্ত্র ছিল ‘বুদ্ধির মুক্তি’। কয়েকজন মুসলমান অধ্যাপকের উপরে ন্যস্ত হয়েছিল এর পরিচালনার ভার–শাশ্বত বঙ্গের লেখক তাঁদের অন্যতম। বুদ্ধির মুক্তি, অর্থাৎ বিচার-বুদ্ধিকে অন্ধ সংস্কার ও শাস্ত্রানুগ থেকে মুক্ত দান বাংলার মুসলমান সমাজে (হয়ত বা ভারতের মুসলমান সমাজে) এ ছিল এক অভূতপূর্ব ব্যাপার। কিন্তু সেদিনে বিস্ময়কর হয়েছিল বাংলার শিক্ষিত মুসলিম তরুণের উপরে এর প্রভাব–একটি জিজ্ঞাসু ও সহৃদয়-গোষ্ঠীর সৃষ্টি সম্ভবপর হয়েছিল এর দ্বারা। দৃশ্যত এর প্রেরণা এসেছিল মুস্তফা কামালের উদ্যম থেকে, কিন্তু তারও চাইতে গূঢ়তর যোগ এর ছিল বাংলার বা ভারতের একালের জাগরণের সঙ্গে আর সেই সূত্রে মানুষের প্রায় সর্বকালের উদার জাগরণ-প্রয়াসের সঙ্গে। শাশ্বত বঙ্গের অনেক লেখায় রয়েছে সেই স্মরণীয় দিনগুলির স্বাক্ষর, বিশেষ করে ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আর তার আনুষঙ্গিক ‘ব্যাপক মানব-হিত’ মানুষের সভ্য জীবনের এই মহাপ্রয়োজনের কষ্টিপাথরে বারবার সেসবে যাচাইয়ের চেষ্ট হয়েছে বাংলার ও ভারতের একালের জাগরণের মূল্য ও মর্যাদা, আর বারবার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হয়েছে দেশের শিক্ষিত-সমাজের অনবধানতার জন্য সেই অমূল্য প্রচেষ্টার বিড়ম্বনা-ভোগের সম্ভাবনা সম্বন্ধে।
দুর্ভাগ্যক্রমে এই আশঙ্কিত বিড়ম্বনা-ভোগ এড়িয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সবপর হয় নি। দেশের একালের জাগরণের এক পরিণতিরূপেই আমাদের লাভ হলো রাজনৈতিক স্বাধীনতা, কিন্তু সেই স্বাধীনতা-লাভের পুণ্যক্ষণে দেশের (ভারতবর্ষে ও পাকিস্তানের) অগণিত লোকে যে আত্মিক অপঘাত ঘটলো তাতে সেই অশেষপ্রতিশ্রুতিপূর্ণ স্বাধীনতাও আজো হয়ে আছে রাহুগ্রস্ত।
তবে এমন লাঞ্ছনা শুধু আমাদের দেশের ভাগ্যেই ঘটেনি, বৃহত্তর জগতেও কোলে চলেছে এক অত বিপর্যয়, যার ফলে দেশে দেশে ব্যাপক প্রবণতা জেগেছে কঠিন অপ্রেম আর সংঘর্ষের দিকে; একালের বুদ্ধিজীবীদেরও অনেকের পক্ষপাত সংঘবদ্ধতা, অধিকার-ঘোষণা, আর প্রচারবহুলতার দিকেই-বিচার, প্রেমপ্রীতি, আত্মবিকাশ, এসব আজ তাদের চোখে অনেকখানি অবিশ্বাস্য চিন্তাধারা।
এই পরিবেশে ‘বুদ্ধির মুক্তি’র কথা সমাদৃত হবে সে-সম্ভাবনা অল্প। আজ বরং মুষ্টিমেয়ের বুকে অনির্বাণ থাকুক এই প্রত্যয় যে তাইই মানুষের জন্য পথ, চিরন্তন ধর্ম, যা পূর্ণরূপে সত্যাশ্রয়ী আর সবার জন্য কল্যাণবাহী,-আর সব বড়জোর আপদ্ধর্ম, অন্য কথায়, বিপথ। মানুষ অপ্রেম চিন্তার আবিলতা থেকে রক্ষা পাক, এই হোক আজ প্রত্যেক দায়িত্ববোধসম্পন্ন নর ও নারীর অন্তরতম প্রার্থনা।
অগ্রহায়ণ, ১৩৫৮
.
ভূমিকা
কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০) প্রথম জীবনে উপন্যাস ও ছোটগল্প রচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করলেও যুক্তিধর্মী প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। শ্বাশতবত’ (১৯৫১) তাঁর বিখ্যাত গদ্য রচনাগ্রন্থ। তার জন্য ফরিদপুর জেলার বাগমারা গ্রামে। তিনি ১৯১৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯১৫ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ ও ১৯১৭ সালে বি.এ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ পাস করেন ১৯১৯ সালে। ১৯২০ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে তিনি বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার পর তিনি কলকাতায় বদলি হন এবং সেখানে শিক্ষা বিভাগের ডিরেক্টরের অধীনে টেক্স বুকস কমিটির সম্পাদকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনকল্পে ১৯২৬ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের অন্যতম স্তম্ভ ও নেতা। এই সংগঠনের পত্রিকা ‘শিখা’য় (১৯২৭) তাঁর মুক্তচিন্তা ও যুক্তিভিত্তিক বিভিন্ন লেখার জন্যে ঢাকার নবাব পরিবার কর্তৃক নিগৃহীত হয়ে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করেন কলকাতায়। রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জার্মান কবি গ্যেটেকে তার জীবন চেতনার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের জীবনদর্শন ও সাহিত্যকর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, অনুশীলন ও অনুসরণ এবং সেই সঙ্গে বাংলার পশ্চাৎপদ মুসলিম সমাজে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণা জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে সাহিত্যসাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শ্বাশত গ্রন্থের বিন্নি রচনায় এসব চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটেছে।
জীবনের প্রাথমিক পর্বে মুক্তচিন্তার অধিকারী কাজী আবদুল ওদুদের সাহিত্যিক আদর্শ ছিলেন গ্যেটে, যার কাব্যের ধ্রুপদী আদর্শ, গঞ্জর ভাবমূলক রচনাকৌশল, শুভবোধ, মনন ও বিশ্বাত্মচেতনা তাঁকে প্রগাঢ়রূপে আকৃষ্ট করেছিল। পরবর্তী সময়ে তার সাহিত্য-প্রেরণা ছিল রবীন্দ্র-কাব্যজগৎ। রবীন্দ্র-জীবনদর্শন তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। কবি গুরুর জীবন ছিল তার কাছে পরম আকর্ষণের বন্ধু, রবীন্দ্র-কাব্য ছিল তার প্রাণের শান্তি, মনের আরাম। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দুই বাংলা এবং দুই বাংলার অধিবাসীদের মধ্যে যে ব্যাপক সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি, তার নিশ্চিত সমাধান-সূত্র নিহিত রয়েছে রবীন্দ্র-সাহিত্যদর্শনে। ‘শ্বাশতবঙ্গ’ সহ তাঁর অনেক রচনায় এ চেতনা জমাট বেঁধে আছে।
কাজী আবদুল ওদুদ রচিত প্রবন্ধাবলির বিষয় ছিল গভীর ও গীর, ভাষা ও তদনুসারী। যুক্তিতন্ময়তা, রচনাশৈলীর মনোরম ভঙ্গিমা, ভাষার সাধু আকর্ষণীয়তায় তার প্রবন্ধগুলো পাঠকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং সেই সঙ্গেই রসিকচিত্তে আনে পাঠ্যান্তের পরম তৃপ্তি। বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তার যে নিবিড় পরিচয় ছিল, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর প্রবন্ধগুলো। কেবল বাংলার সাহিত্য বা সংস্কৃতিই নয়, বিদেশি সাহিত্য ও সংস্কৃতিতেও ছিল তার সমান পাণ্ডিত্য, যার ফলে উভয় ধারার সাহিত্য ও সংস্কৃতির তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে তিনি বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরেছেন পাঠক সমীপে, এখানেই কাজী আবদুল ওদুদের কৃতিত্ব সর্বাধিক। এই কৃতিত্বের একটা বড় অংশের দাবিদার তার শ্বাশতবঙ্গ’ গ্রন্থখানি।
‘নদীবক্ষে’ (১৯১৮) কাজী আবদুল ওদুদের বিখ্যাত উপন্যাস ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘মীর পরিবার’ (১৯১৮)। রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৯২৭), নবপর্যায় দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২৯), সমাজ ও সাহিত্য (১৯৩৪), হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ (১৯৩৬), আজকার কথা (১৯৪১), কবিগুরু গ্যেটে (১৯৪৬), শ্বাশতবঙ্গ (১৯৫১), স্বাধীনতা দানের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-প্রথম খণ্ড (১৯৫৫), বাংলার জাগরণ (১৯৫৬), হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম (১৯৬৬), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৬৯) প্রভৃতি তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ। তাঁর সম্পাদিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ একখানি জনপ্রিয় বাংলা অভিধান।
উনিশ শতকে বাংলায় যে নবজাগরণ সূচিত হয়েছিল তার যথার্থ মূল্যায়ণ পাওয়া যায় কাজী আবদুল ওদুদের প্রবন্ধে। বাংলার জাগরণ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত হয়েছে এভাবে–তারপর রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার যে রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্কীর্ণতা ভেঙে তাকে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শের অনুপ্রেরণা এ পর্যন্ত বাংলার জাতীয় জীবনে কমই অনুভূত হয়েছে। এখন পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়ত্বের আদর্শই দেশের জনসাধারণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কবি, তাও আবার সৃ-শিল্পী গীতিকবি, তাই যে মহামানবতার গান তিনি গেয়েছেন আমাদের দেশের সুল-প্রকৃতি জনসাধারণের জীবনে কত দিকে তার স্পন্দন জাগবে তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর।
সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন কাজী আবদুল ওদুদ। মানবতার উপাসক ছিলেন তিনি, কোনো রকমের ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা ও গোঁড়ামি তাঁর মধ্যে ছিল না। বাংলা সাহিত্য ও সাহিত্য রচয়িতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল হার্দিক সম্পর্ক। বিশ শতকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি একজন সজাগ বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদ ও লেখক হিসেবে সমাজ ও সাহিত্য বিষয়ে নিজের প্রজ্ঞা এবং সংবেদনশীলতাকে সক্রিয় রেখেছিলেন। তাঁর গদ্য রচনা প্রাঞ্জল ও বিশ্লেষণধর্মী। মুক্ত বুদ্ধি ও চিন্তাশীলতার ছাপ তার প্রত্যেকটি রচনায় বিদ্যমান। এর দৃষ্টান্ত হিসেবে তার ‘শ্বাশতবঙ্গ’ গ্রন্থখানি অনন্য।
রুহুল আমিন বাবুল
বি.এ (অনার্স), এম.এ.
বাংলাভাষা ও সাহিত্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা
১ জুলাই ২০০৯
Leave a Reply