ব্যর্থতার প্রতিকার
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ আমাদের সামনে যে-রূপ নিয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের দেশের অনেক চিন্তাশীল ব্যক্তি তাকে অবিশ্বাস করেন। তারা বলেন–হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বহুরকমের পার্থক্য আছে, তার জন্য তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য কম, এসব কথা মানা যায়, কিন্তু তাদের যে উৎকট বিরোধ আজ দেশে জেগেছে তার যথেষ্ট কারণ এই ধরনের মনোমালিন্যই নয়, তাদের বিরোধের যা কারণ রাজনীতির ক্ষেত্রে তা সনাতন, তার ইংরেজি নাম Divide and Rule এর উত্তর বহুবৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন এ ভাবে সমস্যাটাকে দেখলে এর কোনো মীমাংসা খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেননা আমরা, অর্থাৎ দেশের হিন্দু ও মুসলমান, বড় দুর্বল আর যারা Divide and Rule করেছেন তারা অত্যন্ত সবল, বিচ্ছিন্ন কোনো দিন মিলিতের সঙ্গে বিরোধে জয় লাভ করতে পারে না।
কিন্তু সম্প্রতি তাঁরও মতের পরিবর্তন হয়েছে মনে হয়। অন্তত তার “রাশিয়ার পত্রে” এই কথাই বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে ভারতের সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য মুখ্যত দায়ী ভারতের শাসকবর্গ। রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়ায় তখন ঢাকায় দাঙ্গা হয়। পরজাতির সামনে তাঁর স্বদেশবাসীদের সেই মূঢ়তা ও বর্বরতা তার যে গভীর লজ্জার কারণ হয়েছিল, মনে হয়, তারই জন্য এমন একটি ক্ষোভের সৃষ্টি তার মধ্যে হয়েছিল।
যাঁরা বলেন সরকারী Divide and Rule নীতি দেশের সাম্প্রদায়িক বিরোধের জন্য দায়ী তাদের মোট বক্তব্য এই– ভারতে এখন হিন্দু কিছু প্রবল হয়েছে, তাকে দমিয়ে দেওয়া রাজনীতির দিক দিয়ে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু এই নীতি যদি বাস্তবিকই দেশের পরিচ্ছন্ন শাসন নীতি হতো তাহলে সাম্প্রদায়িক বিরোধ এক পক্ষেরই বেশি জয়ী হওয়া স্বাভাবিক হতো। তা অবশ্য হয়নি। খবরের কাগজের কথা যদি বিশ্বাস করতে হয় তবে বলতে হয়, এই সব বিরোধে কোনো কোনো স্থানে মুসলমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এমন ধরনের দাঙ্গা অনেক সময় হয়ে ওঠে হাটের মারামারির মতো; হাটে মারামারি লাগলে কে যে কার শত্রু অনেক সময়ে সেই জ্ঞানই পায় লোপ, কেবল চলে অন্ধ আঘাত আর প্রতিঘাত; কেউ নিরপেক্ষও থাকতে পারে না; সেইভাবে কোনো কোনো সরকারী কর্মচারীও কখনো কোনো পক্ষে ভিড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। আর নারদমনোবৃত্তিসম্পন্ন কর্মচারীও একান্ত দুর্বল না হতে পারেন। রাজশক্তির তরফ থেকে দেশের অনুন্নত শ্রেণীর লোকদের অকৃত্রিম উন্নতিচেষ্টা দেশের উন্নত অসম্প্রদায়ের লোকদের মনোদুঃখের কারণ হলেও প্রকৃত রাজনীতিভেদনীতি নয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিরোধে স্পষ্ট ভেদ-নীতির দোষ শাসকদের না থাকলেও অন্য রকমের দোষ থেকে তারা মুক্ত নন। সেটি হচ্ছে এদেশের সমাজ ও ধর্ম-সংক্রান্ত ব্যাপারে হস্তক্ষেপে তাঁদের ভীতি। সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতি হয়ত তারা মন থেকে মুছে ফেলবার প্রয়োজন অনুভব করেন নি। সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ভারতবাসীর মনোভাবে যতটা অন্ধতা ছিল তার প্রভাব তাদের উপরে যে কম হয়েছে এ কথা স্বীকার করাও তারা হয়ত সুবিবেচনা মনে করেন না। কিন্তু অন্ধতার প্রতিকার অন্ধতার দ্বারা হয় না। এদেশ যদি আচার-প্রধান হয়, অর্থাৎ বিচার এদেশের লোকদের কাছে সমাদৃত না হয়, তবে দেশের শাসন কার্যের লক্ষ্য হবে সেই সব বিচিত্র আচারকে শুধু বিবদমান হতে না দেওয়া এ নীতিতে বুদ্ধির পরিচয় থাকলেও দৃষ্টি ও শক্তির পরিচয় নেই। সেই জন্য এ নীতি শান্তির প্রার্থী হলেও পায় অশান্তিই; কেননা, বিবাদের অবসানরূপে যে শান্তি জীবনে তা লাভ করা সম্ভবপর নয়। জীবনে শুধু লাভ করা যায় সৃষ্টিধর্মের যে শান্তি অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর পরস্পরের প্রতি বর্ধমান শ্রদ্ধা, তাই।
কাজেই যারা ভেদনীতিকে দেশের সমস্ত ব্যাধির মূল কারণ বলে বুঝেছেন তাঁদের মত বদলাবার ক্ষমতা আমাদের না থাকলেও তাদের মতের বিরুদ্ধে যে যুক্তি আছে সে কথা বলবার অবসর আমাদের আছে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের যত কারণই থাকুক তাদের নিজেদের বহুকালের বিকৃত বুদ্ধি যে তার মূলে এ কথাটা সূত্রস্বরূপ ধরে নেওয়া সঙ্গত বৈ অসঙ্গত নয়, কেননা শুধু ইতিহাস নয় বিচার ও আত্মবিশ্বাস এর অনুকূলে। পল্লীর খড়ের ঘরে যে আগুন লাগে তার আও-কারণ হয়ত আগুন ও গৃহস্থের অসাবধানতা, কিন্তু যিনি এর প্রতিকারে অগ্রসর হবেন তার কাজ হবে সহজদাহ্য এই গৃহগুলির সংস্কার। আর এ সংস্কারে গৃহস্থের আগ্রহাতিশয্যই স্বাভাবিক।
হিন্দু ও মুসলমানের বিকৃত বুদ্ধিই যে তাদের বিরোধের মূলে এ চিন্তা আমাদের দেশের গত কয়েক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠদেরও। তারা এর নিরাকরণের চেষ্টাও কম করেন নি। তাদের সেই সব চেষ্টার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।
হিন্দু ও মুসলমানের সংঘর্ষ এদেশে যখন হয়েছে তাদের মিলনের চেষ্টাও প্রায় তখন থেকে হয়ে আসছে। পাঠান-যুগের অনেক সাধু-সন্তের বাণীতে তার পরিচয় রয়েছে। কিন্তু এ-চেষ্টা বেশ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে কবীর ও আকবরের মধ্যেই। আকবরের হিন্দু মুসলমানের মিলনের চেষ্টার মূল্য তেমন দেওয়া হয়নি। তাতে অন্যায় তেমন হয়েছে মনে হয় না, কেননা আকবর অপূর্ব প্রতিভার অধিকারী হলেও তার হিন্দু-মুসলমানের সময় চেষ্টায় খেয়ালিত্ব রয়েছে ঢের। তিনি যে বিভিন্ন ধর্মের কিছু কিছু আচার গ্রহণ করেছিলেন সে-সময় তাঁর নিজেরই জন্য, সেটি সকলের হোক এ কামনা তিনি করেছিলেন ভাবা কঠিন। আকবরের ভিতরে কবি-প্রকৃতি ছিল, বিভিন্ন রূপের পূজায় মুখ্য ব্যক্তিগত ব্যাপার বলেই মনে হয়। হিন্দু-মুসলমান বিরোধ সম্পর্কে তাঁর বড় কীর্তি হচ্ছে অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী প্রচার মধ্য যুগের শ্রেষ্ঠদের বা সর্বযুগের প্রেমিকদের যা সাধারণ ধর্ম।
মধ্যযুগের সমন্বয়কারীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান বোধ হয় কবীরের ও তাঁর পরে দাদু ও রজ্জবজীর। এক হিসাবে হিন্দু-মুসলমান বিরোধের শ্রেষ্ঠ সময় এদের চিন্তায়ই রয়েছে। মানুষকে এঁরা সব স্থল আবরণ উন্মোচিত করে দেখেছেন, আর সেই দেখাই যে সত্যকে দেখা সে-কথা পরম মনোহর ভাষায় প্রকাশ করে গেছেন। তাই তাঁদের চিন্তা সমসাময়িকরূপে যা পেয়েছিলেন তাইই সে সবের চরম রূপ নয়। সব বিক্ষোভের ভিতরে সত্যকে শান্ত হয়ে দেখবার সঙ্কেত এসবে আর্যভাবে সঞ্চিত আছে।
কিন্তু এদের চেষ্টায় যে আশানুরূপ ফল ফলেনি তার কারণ শুধু জনসাধারণের অক্ষমতাই নয়। এই ব্যর্থতার কারণ এঁদের বাণীর ভিতরেই নিহিত আছে মনে হয়। হিন্দু ও মুসলমানের যে বিরোধ দেশে জাগলো তা শুধু চিন্তাধারার বিরোধ নয়, সেই বিরোধের সামাজিক ও রাষ্ট্রক রূপও প্রবল। কিন্তু সে সবের মীমাংসায় এই জ্ঞানীদের দৃষ্টি তেমনভাবে আকৃষ্ট হয়নি। কবীর বললেন- বেদ ও কোরআন ভব-বন্ধন স্বরূপ, ও সবের ভিতরে তুমি কেবল ঘুরপাক খেয়ে মরবে। তার এ কথায় হিন্দু ও মুসলমানের আচার–পূজা যোগ্যভাবেই তিরস্কৃত হলো। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ জীবনে আচার অর্থাৎ নিয়ম-কানুন বিসর্জন সম্ভবপর নয়, তাই বেদ ও কোরআনের প্রবর্তিত আচার যদি গ্রহণ না করা হয় তবে অন্য কি আচার গ্রহণ করতে হবে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশ আবশ্যক। বলা বাহুল্য, মানুষের বৃহত্তর সমাজ জীবনের প্রয়োজন এই জ্ঞানীদের বাণীতে মেটেনি বলে এদের বাণীর বিদ্যুচ্ছটায় মানুষের অন্তর আলোকিত হয়েছে কিন্তু বিদ্যুতের মতোই ক্ষণকালের জন্য। সে উপলব্ধিকে সমাজ জীবন সার্থক করা যাবে কি উপায়ে সে-সম্বন্ধে তেমন কোনো নির্দেশ না পাওয়ার ফলে প্রাচীন চিরাচরিত পন্থাই তাদের জন্য পন্থা রয়ে গেছে।
উচ্চচিন্তার এই যে সামাজিক রূপ গ্রহণে কুণ্ঠা, মনে হয় এ ভারতীয় চিন্তার মজ্জাগত দুর্বলতা। একে যদি কেউ ভারতীয় চিন্তার বৈশিষ্ট্য বলতে চান তিনি তা বলতে পারেন। এর স্বপক্ষেও কিছু বলা যে না যায় তা নয়। কিন্তু এ দুর্বলতাই কেননা, শুধু সুবিবেচনা নয় ভয়ও এর সঙ্গে সমাবেশ ঘটেছিল তার ফলে আচার প্রাধান্যের সাহায্যে দেশে শৃঙ্খলা বিধানের চেষ্টা হওয়া বিচিত্র নয়। সেই থেকে আচার ধর্ম এদেশে যে বড় ধর্ম হয়ে আছে তা বার বার কিছু কিছু আঘাত পেলেও মোটের উপর বিশেষ প্রতিপত্তিই সম্ভোগ করে আসছে। মধ্যযুগের জ্ঞানীরাও এদেশের সমাজ জীবনে হস্তক্ষেপ করতে সঙ্কুচিত হয়েছেন এ কথা বলা যায়। এই আচার প্রাধান্যের জন্যই দেশের উচ্চচিন্তা যে মানসলোক থেকে কর্ম-লোকে পদার্পণ করতে এমন সঙ্কোচ বোধ করছে সেজন্য অদ্ভুতত্ত্বের সঙ্গে এসবের সংস্রব দুর্লভ হয়নি। চৈতন্যচরিতামৃতে আছে–একদিন মহাপ্রভু চিন্তিত হলেন এই কথা ভেবে যে যবনজাতি “গ্রোব্রাহ্মণ” হিংসা করে মহাদুরাচার, তাদের উদ্ধারের কোনো উপায় দেখা যায় না; তখন হরিদাস বলেন তাদেরও মুক্তি অনায়াসে হবে, কেননা হারাম হারাম বলে তারা প্রকারান্তরে রাম নাম উচ্চারণ করবে– নৃহিংস পুরাণে আছে “দ্রংষ্ট্ৰীদ্রংষ্ট্ৰাহতে স্নেচ্ছো হারামেতি পুনঃ পুনঃ উজাপি মুক্তিমাপ্নোতি কিং পুনঃ শ্ৰদ্ধয়া গৃণন”, (অন্তলীলা, তৃতীয় পরিচ্ছেদ)। এ প্রসঙ্গ বাস্তবিকই চৈতন্যদেবের সঙ্গে হয়েছিল, না নাম-মাহাত্ম সম্বন্ধে এটি ভক্তদের অতি রঞ্জিত, তা শক্ত; তবে “চৈতন্যচরিতামৃতের মতো একখানি প্রামাণিক গ্রন্থে এ কথা যে স্থান পেয়েছে এই থেকে অনেকটা বোঝা যাচ্ছে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠদের চিন্তা ভাবনার ধারা। সত্যকে নানা রকমে বার বার পরীক্ষা না করে পূর্ণ সত্য বলে গ্রহণ করার যে মনোবৃত্তি মোটের উপর তা অজ্ঞানতার সঙ্গে আপোষ। আর সত্যের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক রূপ লাভ না হলে না বলা যায়।
উনবিংশ শতাব্দীতে দেশে যে জাগরণ এলো মধ্যযুগের মতন মুখ্যত তা ধর্মান্দোলন একথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। কিন্তু সেদিক দিয়ে মধ্যযুগের চাইতে এযুগের আন্দোলন দুর্বল কেননা ব্যাপকভাবে মানুষের আত্মিক উৎকর্ষের কথা এ যুগের নায়করা যতটা ভেবেছেন তার চাইতে বেশি ভেবেছেন নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকদের পারমার্থিক ও আর্থিক উৎকর্ষের কথা। (ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র বলেছিলেন বটে, ব্রাহ্ম হিন্দুর অংশ মাত্র নয়, কিন্তু সেটি এক অমূল্য মুহূর্তের প্রেরণার ফল, নিজেকে হিন্দু বলে পরিচিত করবার আগ্রহ তারও ভিতরে কম নয়)। হিন্দু-মুসলমানবিরোধের মীমাংসা-চেষ্টা এযুগে হয়েছে গৌণভাবে মুখ্যভাবে নয়। তবু এই গৌণ চেষ্টার মূল্যও কম নয়। দেশের একটি স্থানে যদি প্রকৃত উন্নতি চেষ্টা চলে তবে তার প্রভাব সর্বত্র সঞ্চারিত হওয়া স্বাভাবিক। উনবিংশ শতাব্দীর জাগরণ-চেষ্টা যে সমাজধর্মী হয়েছিল এজন্য দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতির ক্ষেত্রে তার মর্যাদা মধ্যযুগের সাধনার চাইতে কম নয় বরং বেশি। সেই চেষ্টা কিভাবে রাজনৈতিক মরীচিকায় বিভ্রান্ত হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাস্তবিক, দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতরে যে প্রকৃত সংস্কার চেষ্টা আরম্ভ হয়েছিল এইই হয়ত হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ বলতে যা বোঝায় দেশের সেই দুরবস্থা উত্তরোত্তর অপনোদন করে চলত। এতেই এ সমস্যার মীমাংসা হয়ত হতো না, তবু বর্তমানে এ বিরোধ ঘৃণিত রূপ ধারণ করছে তা থেকে দেশ রক্ষা পেত।
দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আত্ম-অন্বেষণ চেষ্টা অনেকটা রুদ্ধ হলেও হিন্দু মুসলমান-বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা বরাবরই হয়ে আসছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সে-চেষ্টা অপ্রবল, কিন্তু চিন্তার ক্ষেত্রে তার প্রাবল্য কম নয়। এই চিন্তার ক্ষেত্রে একালের দুজনের চেষ্টাই বিশেষ শ্রদ্ধার্য হয়েছে রামকৃষ্ণের ও রবীন্দ্রনাথের।
রামকৃষ্ণ দেবের “যত মত তত পথ” বাণী জগতের বিরোধ সামঞ্জস্যের এক বড়ো মন্ত্র বলে কোনো কোনো মনীষী মত প্রকাশ করেছেন। সে চিন্তা-পদ্ধতিতে সত্য দৃষ্টির চাইতে শুভ ইচ্ছা যে বড়ো একথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি; কেননা পথ নির্দিষ্ট আছে এ সত্য নয়, পথ বারবার আবিষ্কার করতে হয় এইই সত্য রামকৃষ্ণ দেবের পথও চিরাচরিত পথ নয়, আবিষ্কৃত পথ।[দ্রঃ রামমোহন রায়] তবে দেশের লোকদের যে অবস্থা তাতে এ চিন্তারও বিশেষ মূল্য আছে। দেশের লোকে যদি অন্তত এই কথাটা বুঝতে পারে যে মানুষ বিচিত্র, মানুষের মতও বিচিত্র, সব এক ছাঁচে ঢালাই সম্ভবপর নয়, তাহলেও বিরোধ-শান্তির অনেকটা সহায়তা হয়। “যত মত তত পথ” কথাটিতে নবসৃষ্টি-প্রবণতা যতখানি তার চাইতে সমাজ ও ধর্মের প্রাচীন রূপের পূজার আগ্রহ বেশি। এর মধ্যে যে কাব্যসৌন্দর্য আছে তাতেই আকৃষ্ট হয়েছে অনেক ভাবুক ব্যক্তির চিত্ত, কিন্তু মানুষ আজ এত কাছাকাছি এসে হাজির হয়েছে যে তাদের দেশকালের পটে সাজিয়ে সাজিয়ে কল্পনার চোখে না দেখে সহজভাবে ভোলা চোখে দেখবার প্রয়োজন বেশি হয়ে পড়েছে।
রবীন্দ্রনাথের সমন্বয়-বাদের দুইটি ধারা। একদিকে, তাকেও বলা যায় “যত মত তত পথ” বাদী বিভিন্ন শ্রেণীগত ও দেশগত বৈশিষ্ট্যের দিকে তাঁর দৃষ্টি শ্রদ্ধাপূর্ণ; আর একদিকে তিনি বিশেষভাবে সৃষ্টিধর্মী-মানুষকে দেশ কালে বিভক্ত
দেখে এক অখণ্ড বিকাশমান সমাজের সভ্যরূপে দেখেছেন, সমাজ-জীবনে উৎকর্ষ লাভ যার জন্য পরম সত্য। তাঁর Religion of Man গ্রন্থে তার এই মত বিশদভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে। এই যে বিকাশ-ধর্মী মানুষ সমাজ জীবনে অক্লান্তভাবে সৃষ্টিশীল হয়ে চলা যার জন্য সার্থকতার পথ, এর অভ্যুদয় দেশে না হলে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ বলতে আমাদের যে দুঃখ বোঝায় তা দূর হবে না। এইই আমাদেরও প্রধান নিবেদন।
এই বিকাশ-ধর্ম অথবা সৃষ্টিধর্ম কি? খুব ঘোরালো না করে সহজভাবে বলা যায় জ্ঞান ও কর্মের ক্ষেত্রে মানুষের যে অন্তহীন কৌতূহল সেইটি তার সৃষ্টিধর্ম। শুধু নতুন কিছু করবার ঝোঁককে সৃষ্টি-ধর্ম বলা অসার্থক, কেননা, জ্ঞান সেখানে তেজোহীন। যুগে যুগে মানুষ যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখেছে, নূতন নূতন কর্মের উদযাপনে প্রাণপাত করেছে, সে-সব তার সৃষ্টিধর্মেরই প্রেরণায়। এর অর্থ অবশ্য এ নয় যে সৃষ্টিধর্মের প্রভাবে মানুষ রাতারাতি আগাগোড়া বদলে গিয়ে অদ্ভুত কিছু হয়ে ওঠে। হয়ত অন্তরের নতুন উপলব্ধির গাঢ়তার দিক দিয়ে সে বদলেই যায়; কিন্তু আসলে, মানুষ জীবনের পথে ধীরে ধীরেই চলে, একেবারে নতুন হয়ে ওঠা তার শক্তির বাইরে। চারপাশের জীবনের সঙ্গে মানুষ যে নিবিড় যোগে যুক্ত সৃষ্টিধর্ম তাকে কখনো অস্বীকার করে না, বরং পূর্ণভাবে স্বীকার করে তাকে ফুটিয়ে তোলে নতুন সম্ভাবনা–আর ক্রমাগত চলে এর কাজ।
এই যে মানুষের ক্ষমতা পরিবেষ্টনকে নিয়ে নতুন হয়ে ফুটে ওঠা– এ শুধু পরমাশ্চর্য নয় অত্যাবশ্যক, যেমন অত্যাবশ্যক দেহের কোষাণুসমূহের অক্সিজেন সংস্পর্শে প্রতিমুহূর্তে দগ্ধ ও পুনর্গঠিত হওয়া। আর যে-কারণে দেহ-শুদ্ধির এই প্রক্রিয়ার ব্যাঘাত জন্মে অর্থাৎ স্বাস্থ্যরক্ষায় অমনোযোগ অথবা ব্যাপক অমনোযোগ– সেই কারণেই ব্যাহত হয় সমাজজীবনে সৃষ্টিধর্ম। সমাজ-জীবনে এই অমনোযোগ বহুরূপে আত্মপ্রকাশ করে, এত রূপে যে সে-সবের নামকরণ। অসম্ভব– যেমন স্বাস্থ্যের এক নাম, কিন্তু ব্যাধির নামের অন্ত নেই– তবে আমাদের দেশে এর বড় পরিচয় স্থল হয়েছে ধর্ম সম্বন্ধে আমাদের ধারণা। সে ধারণায় অমনোযোগ, অন্য কথায় চারদিকের জীবনের সঙ্গে সংসবের অভাব এবং মোহের প্রভাব, এমন আশ্চর্য পরিণতি লাভ করেছে যে তার প্রাচীনত্ব রীতিমত সমের সামগ্রী হয়ে উঠেছে।
হিন্দু জাগরণ সম্বন্ধে আমাদের আরো আলোচনা করবার আছে। সেই জাগরণ-তত্ত্বেও দেখা যাবে, সেই প্রাচীন অমনোযোগর প্রভাব। হিন্দু-সমাজে সূচিত হয়েছিল এই জাগরণ এজন্য যদি একে হিন্দু জাগরণ বলতে হয় তবে জ্ঞান ও মনুষ্যত্বের সাধনার সাম্প্রদায়িক রূপকে অসঙ্গতভাবে বড় করে দেখা হয়। তার চাইতে, এ জাগরণে হিন্দুত্ব কতখানি অহিন্দুত্বই বা কতখানি তা বোঝা যাবে যারা জাগ্রত হয়েছিলেন তাঁদের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলে। যে সব কর্ম, যে সব চিন্তা এমন কি যে সব ব্যক্তি থেকে তারা প্রেরণা লাভ করেছিলেন সে সবে হিন্দুত্ব যতখানি আছে অহিন্দুত্ব তার চাইতে মোটেই কম নেই; আর যারা প্রেরণা লাভ করেছিলেন, প্রগাঢ় স্বজনপ্রীতি সত্ত্বেও, কোনটি হিন্দু কোনটি অহিন্দু এই বিবেচনার দ্বারা তারা প্রেরণালাভের পথে চালিত হননি। বাস্তবিক, যারা সৃষ্টিধর্মী, সত্য ও সৌন্দর্যের প্রেরণা তাঁরা যে জগতের যে কোনো স্থান থেকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন, দেশ জাতি কাল এর কোনো ব্যবধান তাদের জন্য ব্যবধান হয় না, এই দিনের আলোর মতো সুস্পষ্ট কথা আমাদের দেশের অনেক সৃষ্টিধর্মী ব্যক্তিও যে মাঝে মাঝে কেমন করে বিস্মৃত হয়েছেন একথা ভাবলে বিষয়ে বিহ্বল হতে হয়। এর মুখ্য কারণ বোধ হয় এই যে সৃষ্টি-প্রবণতা তাদের মধ্যে স্বল্পক্ষণস্থায়ী হয়েছে, আর দেশের উচ্চশ্রেণীর ভিতরেও অজ্ঞানতার বহু বিস্তারের জন্য বিচারের পথ তাদের মনে হয়েছে দুস্তর।
দেশের একালের এই জাগরণের মূলে যত বিচিত্র প্রভাবের ক্রিয়া আছে সেসব বিস্মৃত হয়ে এবং সমস্ত দেশের জন্য এ জাগরণ কত অর্থপূর্ণ সেই বৃহৎ দায়িত্বের পাশ কাটিয়ে হিন্দু-সমাজে আর জাগরণ যে শুধু হিন্দু জাগরণ নাম পেল এই মোহ অথবা অমনোযোগ ধর্ম– মোহ না পাবারই যোগ্য। ধর্মের যে গোড়ার কথা মনুষ্যত্ব-বোধ তার সঙ্গে মোহের নিত্য-বিরোধ; এ-ধর্ম হচ্ছে দীর্ঘকালের বিচারহীন আচারপ্রিয়তা–সাংসারিক জীবনের প্রচ্ছন্ন ব্যর্থতা-বোধ এই আচার মোহকে অথবা ধর্ম মোহকে এমন মধুর করেছে মনে হয়। ধর্ম-মোহই যে এদেশে মানুষের অন্তর্নিহিত সৃষ্টি ধর্মের ব্যর্থতার প্রতিরূপ তার একটি বড় পরিচয় এই যে হিন্দু-জাগরণের প্রতিক্রিয়ায় দেশের মুসলমানদের ভিতরে বিশেষভাবে জাগলো সাম্প্রদায়িক ধর্ম-বুদ্ধি।
কিন্তু ধর্মকে যারা আগাগোড়া মোহ বলেন তাদের মত আমরা গ্রহণ করি না, কেননা জীবনের সার্থকতা ধর্ম-বোধে, অর্থাৎ, সত্যে অথবা কোনো আদর্শে সমর্পিত চিত্ততায়। প্রচলিত ধর্ম-সম্প্রদায়গুলোর মধ্যেও এরূপ সমর্পিত চিত্তদের জন্ম হয়েছে। কাজেই এই প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতে হয়, প্রত্যেক ধর্ম সম্প্রদায়কে মোহ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত ধর্ম-প্রীতিতে প্রতিষ্ঠিত করাই কি দেশের চিন্তাশীল কর্মীদের শ্রেষ্ঠ কাজ নয়। এই ভাবেই কি মানুষের সৃষ্টি ধর্ম বা বিকাশ-ধর্ম সক্রিয় করে তোলা হবে না।
বলা বাহুল্য আমাদের দেশে এতদিন প্রধানত এই চেষ্টাই হয়েছে। তাতে ফল যে হয়নি সে-কথা না বললেও চলে। কিন্তু ফল হয়নি চেষ্টার দোষও বটে; দেশের বিভিন্ন ধর্মকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার না করে শুধু এই বিশ্বাসকে পাথেয়রূপে অবলম্বন করা হয়েছে যে সব ধর্মের ভিতরেই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সত্য নিহিত রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের অর্থাৎ ধর্ম-বিধানের জীবন নিয়ন্ত্রণের অধিকার পুরোপুরি স্বীকৃত হয়েছে।
এ-অনর্থের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়া সম্ভবপর হয় যদি ধর্মকে চিরস্থির বিধানরূপে গণ্য না করে আবিষ্কার বিষয় বলে ভাবা যায়, তাহলে ধর্মগ্রন্থ ও মহাপুরুষ হবেন জগতের চিন্তাশীল ও তাঁদের বাণীর মতো মানুষের শ্রদ্ধার বস্তু–তার পূজা আরতির বস্তু নয়। কিন্তু ধর্ম-বিধানের পূজারি যারা তারা তাদের সাধ্যানুসারে উদারতম হয়েও এতে স্বীকৃত হবেন মনে হয় না। ধর্ম বিধানের উপরে বিচার-বুদ্ধির স্থান দান তাঁদের চোখে ঘোর অধর্ম বলে বিবেচিত হওয়াই স্বাভাবিক, যদিও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তারা প্রতিনিয়ত বিচার-বুদ্ধিকে বিধানের উপরে স্থান দান করছেন, কেননা বিধানের ব্যাখ্যার পরিবর্তন নিয়তই হচ্ছে।
আমাদের দেশে ধর্মের যা প্রকৃতি তাতে নিছক আচার-পূজা না বলে উপায় নেই, সৃষ্টি-ধর্ম তাই তার তরফ থেকে বাধাই বিশেষভাবে পায়। এহেন ধর্মকে জীবননিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া বাস্তবিকই বিপত্তিকর। কতখানি বিপত্তিকর তা বোঝ গেছে মহাত্মা গান্ধীর চেষ্টা থেকে। তিনি প্রত্যেক ধর্মকে এমন পূর্ণাঙ্গ জানেন যে ধর্মান্তর-গ্রহণ তাঁর চিন্তার অতীত। তিনি সজাগভাবেই এ-মত প্রকাশ করেছেন। ধর্ম বলতে তিনি যা বোঝেন তার ভিতরে আমার প্রিয়তা থাকলেও প্রবল বিচার বুদ্ধি বেশি করে আছে; তাই তাকে জীবন নিয়ন্ত্রণের ভার দেওয়া অসঙ্গত বা অশোভন হয় না। কিন্তু তাঁর চিন্তার সেই অভিনবত্বের দিকে জনসাধারণের দৃষ্টি তেমনভাবে আকৃষ্ট না করে তিনি যে তাদের হতে বলেছেন স্বধর্মে নিষ্ঠাবান এতে প্রকৃত ধর্ম-ভাব নয় ধর্মমোহই দেশে প্রবল হবার সুযোগ পেয়েছে। একালের বিবর্ধিত হিন্দু-মুসলমান বিবোধের জন্য তিনি আংশিকভাবে দায়ী একথা তাই বলা। যায়। অসাবধানতা জীবনের সর্বক্ষেত্রেই বিপজ্জনক। ধর্মের ক্ষেত্রে যারা তাকে মনে করে সার্থকতার পথ, এত অভিজ্ঞতার পরে আমাদের বলতেই হবে, তারা ভুল করেন।
কাজেই এই যে সুপরিচিত সিদ্ধান্ত যে হিন্দু হিন্দুত্বে নিষ্ঠাবান হলে এবং মুসলমান মুসলমানত্বে নিষ্ঠাবান হলে তাদের মিলন সম্ভবপর হবে এর উপরে যাদের নির্ভর তারা সাধু-উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়েও অন্ধকারে পা বাড়ান। এ সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পূর্বে তাদের যাচাই করা উচিত–হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব বলতে তারা কি বোঝেন। কিন্তু তেমনভাবে যাচাই করতে গেলে তাদের অবলম্বন হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব হবে না, হবে এই দুয়ের অন্তর্নিহিত সৃষ্টিধর্ম। অন্যভাবে কথাটা বললে দাঁড়ায়, হিন্দুত্ব ও মুসলমানত্ব অতীতে ও বর্তমানে যে রূপ পরিগ্রহ করেছিল ও করছে তাইই সে-সবের প্রকৃত রূপ একথা অর্থহীন, তার পরিবর্তে এই সব ধর্ম ভবিষ্যতে কিভাবে মানুষের জ্ঞান ও কর্ম শক্তির সূতিকাগার হবে এইই হওয়া চাই হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের লোকদেরই বিশেষ সাধনার বিষয়। এই কথাই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই বাণীতে– যা শাস্ত্র তাই বিশ্বাস্য নয়, যা বিশ্বাস্য তাই শাস্ত্র। [পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীও এই অভিমত প্রকাশ করেন; লিখিত শাস্ত্রই পূর্ণাঙ্গ ধর্মশাস্ত্র নয়, ধর্ম হচ্ছে চিরন্তন বিবেক।]
এই সৃষ্টি-ধর্ম অদ্ভুত বা দুঃসাধ্য কিছু যে নয় প্রতিদিন তা আমরা প্রত্যক্ষ করছি। মানুষ আরো বড় হবে আরো সুন্দর হবে এ-বিশ্বাস মানুষের মর্মমূলে। এত যে ধর্ম জগতে প্রবর্তিত হয়েছে, এত বিচিত্র সভ্যতার বিকাশ হয়েছে, এত জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার হচ্ছে, সৃষ্টি-ধর্ম বা বিকাশ-ধর্ম ভিন্ন এসবের মূলে আর কিসের প্রেরণা থাকতে পারে! তবে, মানুষ সৃষ্টিধর্মী হলেও জাগ্রতভাবে নয়। জগতের মানুষ একালে প্রায় এক পরিবারভুক্ত হয়ে পড়েছে, তাদের সজাগ চেষ্টার পরিমাণ তাই যথেষ্ট বাড়াবার প্রয়োজন।
সৃষ্টিধর্মী না হলে দেশের যুগযুগান্তরের সংগৃহীত আচারের দাসত্বই যে দেশের লোকদের জন্য বড় হয়ে থাকবে, এদেশের মানোজীবন ও সমাজ জীবনের নব নব সম্ভাবনা তাদের মনে হতে থাকবে দুরাশামাত্র, একথাটা আরো মহামূল্য জ্ঞান করি বলেই যে-সব চিন্তাশীল বলেন, ভারতের যে বিশেষ প্রকর্ষ-ধারা জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক তারই হওয়া উচিত ভারতবাসীর জীবনের নিয়ামক, তাঁদেরও কথা আমাদের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক করে। এই চিন্তাধারা যাদের তারা খুব বড় এই কথাটি বলেন যে দেশের যে বহুকালের ভৌগোলিক পরিস্থিতি ও জীবন-ধারা তা সেই দেশের লোকদের স্বভাবের অঙ্গীভূত হয়ে যায়, সেই স্বভাবের দিকে দৃষ্টি রেখে না চললে স্বভাব সময়ে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নেয়। এঁরা আহার-বিহার পোষাক পরিচ্ছদ থেকে আরম্ভ করে বিশেষ বিশেষ আদর্শের অনুসরণ পর্যন্ত জীবনের সর্ব ব্যাপারে দেশের লোকদের যে দেশের প্রকৃতির দিকে লক্ষ্য রেখে চলতে বলেন এ খুব সঙ্গত কথাই বলেন। কিন্তু এই চিন্তাধারার ভিতরে দুর্বলতা এই যে স্বভাব যে সৃষ্টিশীল আর সেই সৃষ্টিশীলতা মন্দ গতি হলেও অশ্রান্ত-গতি, মানুষের কোনো দুর্বলতার প্রতি তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যেমন তার স্বভাব নয় তেমনি কোনো দুর্বলতাকে বরং দুর্বলতা জ্ঞান করাও তার স্বভাব নয়– এই বড় কথাটা এর শ্রদ্ধার বিষয় তেমন নয়। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, এই চিন্তার অধিনায়করা বেশ একটি সাবধানতার বাণী উচ্চারণ করলেও মোটের উপর নির্দেশহীন এদের বাণী। ভারতীয় সংস্কৃতি বলতে কোন সংস্কৃতি বোঝা হবে– বৈদিক, বৌদ্ধ, পৌরাণিক, মরমী, মোগল অথবা ব্রিটিশ? যদি এসবের মিশ্রণ হয় তবে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সে-মিশ্রণ কি কি ধরনের হবে কেন হবে? এসব প্রয়োজনীয় কথা সম্বন্ধে এঁদের কোনো সদুত্তর নেই। আসলে, এসব কথা যারা বলেন তাঁদের শ্রেষ্ঠরা সৃষ্টিধর্মী, সেই সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁরা ভারতের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কিছু কিছু প্রেরণা গ্রহণ করেন। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত তাদের মতো সবাই যে কেবল ভারতের ইতিহাস থেকে প্রেরণা লাভ করবেন এ সম্ভবপর নয়, অপ্রয়োজনীয় এবং কতকটা অসম্ভবও বটে। তারাও কেবল ভারতের ইতিহাস থেকে প্রেরণা গ্রহণ করেননি। শুধু বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় নয় জীবনের অনেক ব্যাপারে বিশ্বজোড়া একাকারত্ব একালে যেমন অপরিহার্য তেমনি বাঞ্ছনীয়। এরপরও বৈচিত্র্যের সৌন্দর্য মানুষের জন্য দুর্লভ হবে না, যেমন এক পরিবারে বহু রুচির লোকের জন্ম হয়, একই ভাষায় বহু মতের সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে।
একালের হিন্দু চিন্তাশীলদের (ভারতীয় না বলে হিন্দু বলাই সঙ্গত কেননা এক্ষেত্রে মুসলমান চিন্তাশীলরা হিন্দু চিন্তাশীলদের অনুকারী মাত্র) এই যে বৈশিষ্ট্য প্রীতি এটি ভাল করে বুঝে দেখবার সময় এসেছে। কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞান, অর্থাৎ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে না যাওয়ার ভাবটি, যে এর মধ্যে আছে সেটি অবশ্য ভাল, কিন্তু এ ভিন্ন এর বাকি সবটাই মনে হয় প্রচ্ছন্ন অভিমান, আরো সংকীর্ণ করে বলা যায়, প্রচ্ছন্ন জাতি-অভিমান অথবা ব্রাহ্মণত্বের অভিমান। যাদের রাজনৈতিক ভাগ্য মন্দ তাদের পক্ষে এমন অভিমানও মন্দ নয় কারো কারো এই মত, কিন্তু অভিমানের জন্য যে মন্দভাগ্য অচল হয় তা যথার্থ, কেননা অভিমান ও সৃষ্টি-ধর্ম পরস্পর-বিরোধী। এই অভিমান হিন্দুর জীবনী-শক্তির এক পরিচয়-চিহ্ন এই মত দেশে প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু হিন্দুর জীবনী-শক্তি বলতে যে ব্যাপারটার প্রতি আঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় সেটি এত প্রশংসাই কি না তাও ভাবা দরকার। হিন্দু বেঁচে আছে এ যতটা সত্য, নিজের চোখে ও জগতের চোখে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে বেঁচে আছে এ তার চাইতে কম সত্য নয়। তার চাইতে গ্রীক মরে গেছে কিন্তু মরে গিয়েও সে জগতের প্রেরণা-স্থল হয়ে আছে, এর গৌরব হয়ত বেশি। শুধু বেঁচে থাকাই অবশ্য গৌরবের নয়, তাহলে সে-গৌরব হিন্দুর প্রাপ্য নয়। হিন্দুর গৌরব এই জন্য যে এক সময়ে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছিল তাঁদের প্রভাব আজো তাদের জীবনে সক্রিয়। কিন্তু তাইই যদি সত্য হয় তবে অভিমানের অবকাশ নেই, কেননা শ্রেষ্ঠদের প্রভাব সক্রিয় হয় তাদের পূজা প্রদক্ষিণে বা গৌরব কীর্তনে নয় তাঁদের মতো সৃষ্টিশীলতায়–আর সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে একান্ত যোগ বিনয় ও সত্যানুসন্ধিৎসারই। ভারতীয় সংস্কৃতিবাদ প্রভৃতি চিন্তা জীবনের দায়িত্ব পূর্ণভাবে স্বীকার না করারই নামান্তর বলে মনে হয়। পরিবেষ্টনের সঙ্গে নিবিড় যোগের বাণী যে এতে প্রচারিত হয়েছে সেটি মহামূল্য সন্দেহ নেই, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে স্বদেশ বিদেশ সবই উপকরণের ক্ষেত্র একথাও পুরোপুরি স্বীকার করতে হবে। যে সৃষ্টিধর্মী সে স্বদেশ-দেবতার অর্চনা করে বিশ্বজ্ঞান ও বিশ্বসৌন্দর্যের আলোকে।
পরিবেষ্টনের সঙ্গে নিবিড় যোগ এই কথাটি দেশের হিন্দু ও মুসলমানদের দুইভাবে বুঝবার প্রয়োজন আছে মনে হয়। মুসলমান-সমাজের নিম্ন অংশ সহজেই দেশের সঙ্গে নিবিড় যোগে যুক্ত। এই বাংলাদেশে তাদের সেই যোগের অনবদ্য পরিচয় রয়েছে লোক-সাহিত্যে ও লোক সঙ্গীতে। কিন্তু মুসলমান-সমাজের উচ্চ বা সম্ভ্রান্ত অংশ সম্বন্ধে একথা তেমন ভাবে বলা যায় না। অথচ অল্প কিছুকাল পূর্বেও এই সম্ভ্রান্ত অংশ নিজেদের পূর্ণভাবে স্বধর্মনিষ্ঠ জেনেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে দান, অতিথী-সঙ্কার, দেশের গুণীদের সমাদর, ইত্যাদি ব্যাপারে পরাঙ্মুখ ছিলেন না। তাদের বর্তমান আর্থিক অস্বচ্ছল্য এর একটি বড়ো কারণ তা সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু তার চাইতেও বড়ো কারণ যে তাঁদের পরিবর্তিত মনোভাব বা “ওহাবী প্রতিক্রিয়া” সে কথা আমরা বলতে প্রয়াস পেয়েছি। তা কারণ যাইই হোক দেশের সঙ্গে সহজ প্রীতির যোগের অভাব তাঁদের মধ্যে যে ঘটেছে, এ শুধু তাদের জন্য লজ্জার কথা নয় শঙ্কার কথাও বটে, কেননা, এ তাঁদের জীবনের ব্যর্থতার এক নিদারুন পরিচয়-চিহ্ন। আর হিন্দুর জন্য এই পরিবেষ্টনের সঙ্গে যোগ অনেকটা স্বাভাবিক মনে হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে তা নয়। হিন্দু সমাজ জীবনে উচ্চ ও নিচের ভিতরে যে ঘোর ব্যবধান তাইই তার জন্য প্রিয় করেছে রক্ষণশীলতা বিচিত্র ধরনের আত্মসম্পূর্ণতায় যার প্রকাশ। সে-রক্ষণশীলতায় জীবন কোনো রকমে রক্ষা পেলেও তার বিকাশ অথবা সৃষ্টি-ধর্ম যে কেবলই বাধা পায় সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শিক্ষিত হিন্দুর অপারগতা শিক্ষিত মুসলমানের দেশাত্মবোধের অভাবের মতনই ভয়ঙ্কর। এক হিসাবে ভারতের যুগযুগান্তরের ইতিহাস ব্রাহ্মণ শূদ্রের ইতিহাস। হিন্দু, মুসলমান, ইংরেজ, সব যুগেরই এই রূপ-ব্রাহ্মণ বা সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায় রাজশ্রিত আর জনসাধারণ ভারবাহী। এমন ব্যাপার প্রাচীনকালে অবশ্য সব দেশেই ঘটেছে; কিন্তু এ-ব্যবস্থা ভারতে যে এমন চিরস্থায়ী হবার উপক্রম করেছে, মনে হয়, তার মূলে দেশের সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের উল্কট রক্ষণশীলতাই পরিবেষ্টনের সঙ্গে যোগ যেখানে বিকৃত।
এই দুই ভাগ্য বিড়ম্বিত দলের বিরোধ বর্তমানে এমন দশায় এসে পৌঁছেছে যে একটিকে নির্মূল করে বিরোধ শান্তির কথা ভাবা অপরটির পক্ষে বিচিত্র নয়। এটি আসুরিক অতএব নিন্দনীয় এই কারো কারো মত। কিন্তু আসলে এ সম্ভবপর নয়। দেশের হিন্দু ও মুসলমান কারো গায়ে এত জোর নেই যে অপরকে পর্যুদস্ত করতে পারে। তাই সে-চেষ্টায় অগ্রসর হলে কিছুকাল মারামারি ও তারপর রেষারেষি এই হবে সার। যারা বলেন এমন মারামারিতে দেশের লোকদের ক্ষাত্ৰতেজ বাড়বে তাঁদের মহাতেজা ক্ষত্রিয়দের কুরুক্ষেত্রে সম্মিলিত হওয়ার কথা স্মরণ করা ভাল। শুভ ও শুভ ইচ্ছা চিরদিনই অশ্রান্ত সাধনার অপেক্ষা রাখে।
কিন্তু এমন সাধনার দিকে দেশের লোকদের মন রুজু হতে পারার অবস্থায় আছে কি না সেটিও অবশ্য জিজ্ঞাসা। দেশের কর্ম-ও চিন্তানেতা যে ভগ্নোৎসাহ হয়ে পড়েছেন তা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু সে-নৈরাশ্য তাঁদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা বলে ভাবাই ভাল। হিন্দু-মুসলমান-বিরোধ-ব্যাধি থেকে দেশকে মুক্ত করাবার চেষ্টা যথেষ্ট হয়নি এ মিথ্যা নয়। মধ্যযুগ থেকে একাল পর্যন্ত এই বিরোধ-মীমাংসার যত চেষ্টা দেশে হয়েছে সেসব থেকে নূতন প্রেরণাই আমরা লাভ করে’ চলব যদি সে সবের সত্যকার মূল্যের দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি থাকে, আর এই জ্ঞানের অভাব আমাদের ভিতরে না হয় যে দেশকে সুন্দর ও সার্থক করতে আমাদের অক্ষমতা আমাদের জীবনের চরম অসার্থকতার নামান্তর।
এইখানেই বড় প্রয়োজন সৃষ্টিধর্মী নব নেতাদের। অতীতের প্রতি তারা হবেন শ্রদ্ধান্বিত, তার পূজারি কখনো নয়– তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হবে বর্তমান ও ভবিষ্যত। সেইজন্য সুপ্রাচীন হিন্দু ও মুসলমান” এর মিলন তাঁদের কাম্য হবে, কেননা তা অসত্য ও অসম্ভব, তাঁদের কাম্য হবে একটি নব জাতি গঠন যার সূচনা নানাভাবে বহুকাল ধরে দেশে হয়েছে, দেশের একালের জীবনের জন্য যার প্রয়োজনের অন্ত নেই। মনোজীবন ও রাষ্ট্রজীবন দুই ক্ষেত্রেই অশ্রান্তভাবে চলবে। তাঁদের সৃষ্টির কাজ। একালের যে ধর্ম সম্প্রদায়গত রাষ্ট্রজীবন সেটি কদাচ তাঁদের সমর্থনের বিষয় হবে না, কেননা, তার ফলে এদেশের অভিশাপ-রূপ জাতি-ভেদ নব নব সম্ভাবনা লাভ করে’ চলবে; তাঁদের সাধনার বিষয় হবে দেশের রাষ্ট্র জীবনের, অথবা জীবনের, সত্যকার বিকাশ সম্ভাবনা।
আমাদের দেশের এক শ্রেণীর রাজনীতিজ্ঞের অভিমত কতকটা এই। তবে মনে হয় তারা বেশি খেয়ালী। তারা যে বলেন যে বৈদেশিক শাসনের ফলে দেশের আর্থিক ও অন্যান্য বহুবিধ দুঃখ যত বেড়ে গেছে সেসব থেকে দেশকে মুক্ত করে তবে তার শ্রীবৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে, এ মোটের উপর চমকপ্রদ কথাই বেশি। এর পরিবর্তে সৃষ্টিধর্মী কর্মীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া উচিত জাপানের দিকে। মাঝে মাঝে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ক্ষতি-স্বীকার তার নিয়তি কিন্তু সেই নিষ্ঠুর নিয়তি স্বীকার করে চলছে তার উন্নতি চেষ্টা। মহাত্মা গান্ধী তাঁর কোনো এক কর্ম-পদ্ধতি সম্বন্ধে একবার বলেছিলেন, One step is enough for me এক পা বাড়াতে পারলেই আমি খুশী-কর্মের ক্ষেত্রে এ পাকা কথা। কোনো রকমের মোহ নয়, সত্যাশ্রয়িতা, প্রতিপদে সৃষ্টিধর্মী কর্মীদের অবলম্বন।
ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা নয় জ্ঞান ও জাতীয়তা দেশের লোকের শরণ্য হবে, নিঃসন্দেহে; কিন্তু জাতি বলতে কি বোঝা হবে? বাঙালী, মান্দ্রাজী, পাঞ্জাবী?–না ভারতীয়? ভারতবর্ষ বহুকাল ধরে একটি দেশ। ভৌগোলিক পরিস্থিতির জন্য ভারতীয় না হয়ে ভারতবাসীর পরিত্রাণও নেই। তবু আপাতত বাঙালী, মাম্ৰাজী ও পাঞ্জাবী হওয়াই বেশি ভাল মনে হয়; কেননা তা বেশি স্বাভাবিক ও কম কষ্টসাধ্য। অবশ্য ভারতীয়ত্বের বিরোধী যে বাঙালীত্ব মাদ্ৰাজীত্ব বা পাঞ্জাবীত্ব তা কদাচ কাম্য নয়।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন–ভারতীয় জাতীয়ত্বের রূপ হবে ইসলাম-দেহ ও বেদান্ত-মস্তিষ্ক। তার চাইতে এই কথা বলাই ভাল, ভারতীয় জাতীয়ত্বের রূপ হবে পূর্ণাঙ্গ মানব-দেহ ও পূর্ণাঙ্গ মানব-মস্তিষ্ক, সৃষ্টিশক্তির প্রকাশ যার ভিতরে হবে অবাধ। ইসলাম ও বেদান্ত মানুষের সৃষ্টিশক্তিরই পরিচয় চিহ্ন। মানুষের সেই সৃষ্টিশক্তি কোনো দিন নিঃশেষিত হবে না, চিরদিন অক্লান্ত ও অম্লান থাকবে, এইই তার জন্ম-অধিকার। সে-অধিকার সত্য হোক।
২৮ মার্চ, ১৯৩৫।