নজরুল ইসলাম

নজরুল ইসলাম

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

কবি নজরুল ইসলামের সাহিত্যিক জীবনের চারিটি স্তর নির্দেশ করা যেতে পারে।

প্রথম স্তর– তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূচনা থেকে বিদ্রোহী’ প্রকাশের পূর্ব পর্যন্ত।

দ্বিতীয় স্তর– ‘বিদ্রোহী’ প্রকাশের পর থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অবসান পর্যন্ত।

তৃতীয় স্তর– তাঁর সঙ্গীত রচনার, বিশেষ করে, গজল রচনার যুগ।

চতুর্থ স্তর– তাঁর যোগী-জীবন। [এটি পঠিত হয়েছিল কবির ৪৩তম জন্মোৎসবে- ১৩৪৮ সালে। তার পরের বৎসর থেকে কবি দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন।]

প্রথম স্তর শরৎচন্দ্রের মতো নজরুল ইসলামও অতি অল্পদিনে বাংলার সাহিত্য জগতে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। বিদ্রোহী’ প্রকাশের পূর্বেই তার নবীনতা অথবা উদ্মমতা আর ছন্দ-সামর্থ্যের প্রতি বাংলার সাহিত্যিকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। সাহিত্য-ক্ষেত্রে তার প্রবেশ আর বিদ্রোহী’ রচনা এর মধ্যে তার সাহিত্যিক জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর ভাব-জীবনের এই স্তরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবার প্রয়োজন আছে। ‘বিদ্রোহী’ থেকে তাঁর মানসজীবনের গতি যে- মুখী হলো তার সঙ্গে তার পূর্বের ভাব-জীবনের সঙ্গতি অসঙ্গতি দুইই রয়েছে। তাঁর এই যুগের একটি বিশিষ্ট রচনা তার বাঁধন-হারা’ পত্রোপন্যাস। এতে কবি যে তাঁর তরুণ জীবন কিছু পরিমাণে চিত্রিত করেছেন, অনেকে বোধ হয় তা জানেন। এই রচনায় দেখা যাচ্ছে কবি একজন অসাধারণ ভাববিলাসী ও অভিমানী, ব্যর্থপ্রেমের বেদনায় গভীরভাবে আহত। কিন্তু এই আঘাত যত বড়ই হোক এতে মুহ্যমান তিনি হননি। এই নিষ্করুণ আঘাতে তাঁর অন্তর থেকে উৎসারিত হয়েছে একটি মধু-স্রোত; কিন্তু এতে লাঞ্ছিত এমন কি ম্রিয়মাণও তিনি হননি। তবে তিনি অবলম্বন করেছেন এক দায়িত্বহীন ভবঘুরের জীবন-সেই দায়িত্বহীনতায় তার সুনিবিড় আনন্দ।

এই যুগের ভাবে-ভোলা কবি ছিলেন রবীন্দ্র-সঙ্গীত, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের যৌবনের প্রেমসঙ্গীতে আত্মহারা: রবীন্দ্রনাথের পরে সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর প্রিয় কবি; আর তাঁর প্রিয় ছিলেন ইরানী-কবিতিলক হাফিজ তার সুফী তত্ত্বের জন্যে নয় তাঁর প্রেমের উন্মাদনার জন্যে।

আর এক শ্রেণীর ভাবুকদের প্রতিও কবির গভীর শ্রদ্ধা ছিল তাঁরা বাংলার সন্ত্রাসবাদীর দল।

দ্বিতীয় স্তর

রবীন্দ্রনাথের যেমন নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অথবা এবার ফিরাও মোরে নজরুলের তেমনি বিদ্রোহী’। জীবনে হঠাৎ একটি বৃহৎ চেতনার আবির্ভাবের গৌরব এসবে বিধৃত কিন্তু এই দুই কবির জীবন ধারার উপরে তাঁদের এই ভাবোচ্ছাসের প্রভাবে কিছু পার্থক্য দেখা যায়। নিঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ অথবা এবার ফিরাও মোরে’ রবীন্দ্রনাথের কবি চিত্তে যত বড় দোলা-ই দিক, এ-সবের প্রভাবে তাঁর জীবনের সাধারণ ধারায় যে পরিবর্তন এসেছে তা লক্ষ্যযোগ্য হয়নি দীর্ঘ দিন। মনে হয়, কবি যেমন সর্বংসহা প্রকৃতি যত বড় ঝড়-বৃষ্টিই সেই প্রকৃতির বুকের উপরে তান্ডব জমিয়ে তুলুক, পরদিন সূর্যোদয়ের হাসিমুখে জেগে উঠতে তার বাধে না। নজরুল ইসলামও বিদ্রোহী’ রচনার পরে যে একেবারে বদলে গিয়েছিলেন ঠিক তা নয়; বিদ্রোহী’ কবিতাতেও দেখা যাচ্ছে, একদিকে তিনি। যেমন নিজের ভিতরে অনুভব করছেন সাইক্লোনের শক্তি অন্যদিকে তেমনি তিনি মুগ্ধ চপল মেয়ের কাঁকন চুড়ির কনকনে’র ছলনায়। তবু এ কথা সত্য যে, বিদ্রোহী’র আকর্ষণ কবিকে বাস্তবিকই ঘর ছাড়া করেছিল। সেই দিনে তাঁর সাম্যবাদ প্রচার আর বেপরোয়া শিকল ভাঙ্গার গানের কথা যাদের মনে আছে তাঁরা স্মরণ করতে পারেন প্রচণ্ড ধূমকেতুর মতো কি এক ভীষণ মনোহর জীবন কবির ভিতরে সূচিত হয়েছিল।

১৩২৬ সালে ইংরেজি ১৯১৯ সালে- নজরুল কলকাতায় সাহিত্যিক সমাজে পরিচিত হন তখনই এক হিসাবে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। সেদিন বাংলার সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ছিল সে কথা বলা হয়েছে; সেই সঙ্গে এই কথাও স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিদ্রোহী’ প্রকাশের পূর্বেই শাতিল আরব’ ‘মোহররম’ ‘কোরবানী’ প্রভৃতি যে-সব জনপ্রিয় কবিতা তিনি লিখেছিলেন সে সবে ব্যক্ত হয়েছিল মুসলমান সমাজের গতানুগতিক জীবনের প্রতি ধিক্কার, এক বলিষ্ঠ নব জীবনারম্ভের জন্য তীব্র কামনা, আর অস্ত্রশস্ত্রের শক্তি ও মহিমায় তার প্রত্যয়। এটি ছিল ভারতীয় মুসলমানদের জন্য খেলাফত যুগ। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ওহাবী-বিদ্রোহ দমনের [দ্রঃ বাংলার মুসলমানের কথা] পর থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের স্বদেশী আন্দোলন পর্যন্ত বাংলার মুসলমানের ইতিহাস মোটের উপর এক গভীর নৈরাশ্যের ইতিহাস। সেই নৈরাশ্যের কালোমেঘ তাদের চোখের সামনে খানিকটা কেটে গেলে স্বদেশী আন্দোলনের যুগে যখন আধুনিক শিক্ষার দিকে তাদের মন স্পষ্টভাবেই ঝুঁকে পড়লো। সেই দিনে বাংলার মুসলমানের জন্য-অন্তত শিক্ষিত মুসলমানের জন্য-আদর্শ-স্থানীয় ছিল বাংলা শিক্ষিত হিন্দু-সমাজ যদিও স্বদেশী আন্দোলনে পুরোপুরি ঝুঁকে পড়া এই শিক্ষিত মুসলমানদের অনেকের পক্ষে সম্ভবপর হয়নি। মনে পড়ে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে অর্থাৎ স্বদেশী আন্দোলনের কিছু পরে, কলকাতায় সদ্য-আগত তরুণ নজরুল ইসলামকে মোহম্মদ এয়াকুব আলি চৌধুরীর মতো একজন চরিত্রবান ও ধর্মনিষ্ঠ মুসলমান সাহিত্যিক বলেছিলেন : “আপনাকে মুসলমান বারীন ঘোষ হতে হবে।” স্বদেশী আন্দোলনে বাংলার হিন্দুর যে সাফল্য, মুখ্যত তাইই প্রেরণা জুগিয়েছিল মুসলমানের এই খেলাফত আন্দোলন। কিন্তু হিন্দুর আয়োজনের ব্যাপকতা তাঁদের ছিল না, ফলে সফলতা তাঁদের জন্য হচ্ছিল সুদূরপরাহত। তাদের কেবল লাভ হচ্ছিল দিগদেশবিহীন এক বিক্ষুব্ধ মানসিকতা। তরুণ নজরুল, অর্থাৎ বিদ্রোহী, রচনার পূর্বের নজরুল, এক হিসাবে ছিলেন এই খেলাফত যুগের প্রতিনিধি স্থানীয় কবি আর ‘মোহররম’ কবিতায় অধুনা-পরিত্যক্ত শেষ দুটি চরণ এই সম্পর্কে স্মরণ করা যেতে পারে–

দুনিয়াতে দুর্মদ খুনিয়ারা ইসলাম–
লহু লাও, নাহি চাই নিষ্কাম বিশ্রাম।

কিন্তু বিদ্রোহী’তে তার মানসিক কুয়াসা এতখানি কেটে যায় যে, তিনি যেন এক নূতন জীবন নিয়ে জেগে ওঠেন, নিজেকে ও জগৎকে দেখতে আরম্ভ করেন। এক নতুন দৃষ্টিতে।

বাংলাদেশে এক শ্রেণীর সাহিত্যরসিক আছেন যারা নজরুল ইসলামকে জ্ঞান করেন একজন যুগ-প্রবর্তক কবি। আজকার দিনে তাদের সংখ্যা-শক্তি কেমন জানি না, তবে নজরুলের পরিচয় আছে। তাদের প্রতিপাদ্যের প্রধান অবলম্বন এই ‘বিদ্রোহী’। তাঁদের ধারণা, এমন একটা ওজস্বিতা নজরুলের এই বিদ্রোহী কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে যা বাংলা সাহিত্যে, সম্পূর্ণ নূতন-বাংলার দার্শনিক আবহাওয়া এ চিত্তালেশহীন ভাস্বর ললাট তারুণ্য, এই দ্বিধাহীন দুর্মদ তারুণ্যই বাংলা সাহিত্য নজরুল প্রতিভার চিরগৌরবময় দান।

যাদের এই মত, মনে হয় না নজরুলের এই তারুণ্য বাস্তবিকই তারা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। প্রথমেই স্মরণ করা দরকার, রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র যুগে নজরুল-প্রতিভার উন্মেষ।

আমরা চলি সম্মুখ পানে
কে আমাদের বাধবে,
 রইল যারা পিছুর টানে
কাঁদবে তারা কাঁদবে

অথবা

ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে অবুঝ, ওরে সবুজ,
আধ-মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা

অথবা

শিকল দেবীর ঐ যে পূজা-দেবী
চিরকাল কি রইবে খাড়া,
পাগলামি তুই আয় রে দুয়ারে ভেদি’।
ঝড়ের মতন বিজয়-কেতন নেড়ে
অট্টহাস্যে আকাশখানা ফেড়ে
ভোলানাথের ঝোলাঝুলি তেড়ে
ভুলগুলো সব আন রে বাছা বাছা
আয় প্রমত্ত, আয় রে আমার কাঁচা

ইত্যাদি ছত্র সে যুগের বাংলার শিক্ষিত তরুণ-সমাজে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল- এক হিসাবে বাংলার তরুণ-আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই ‘বলাকা’ কাব্যের সাহায্যে। দ্বিতীয়ত, নজরুলের লেখনীতে যে-তারুণ্য রূপ পেয়েছে তার সাহিত্যিক মর্যাদা কেমন সেটিও একটি বড় অনুধাবনের বিষয়। একটু মনোযোঙ্গী হলেই চোখে পড়ে, নজরুলের রচনা, বিশেষ করে তার ‘বিদ্রোহী’ যুগের রচনা, অনবদ্য নয়। শ্রেষ্ঠ কবিদের বিশেষ বিশেষ কবিতায় কবি কল্পনার যে পূর্ণাঙ্গতা প্রকাশ পায় নজরুলের রচনায় সেটির অভাব মাঝে মাঝে প্রায় বেদনাদায়ক হয়েছে। নজরুল যে পূর্ণাঙ্গ কবিতার রচয়িতা তেমন নন, তাঁর কবি-প্রতিভা বং প্রকাশ পেয়েছে উৎকৃষ্ট চরণের রচনায়, এ উক্তি করা যেতে পারে। অবশ্য এমন সাহিত্য-রসিক আছেন যারা কোনো কবিতার, বিশেষ করে দীর্ঘ কবিতার, সগ্রতার সৌন্দর্যে মনোযোগী হওয়া তেমন প্রয়োজনীয় বিবেচনা করেন না; তাঁদের কাছে কবিতা বরং উৎকৃষ্ট চরণের অথবা বাক্যাংশের সমষ্টি মুক্তার মালা যেমন মুক্তার সমষ্টি। এই শ্রেণীর সাহিত্য-সমঝদারদের যুক্তির সারবত্তা স্বীকার করেও বলা যায়, কবিতার বিভিন্ন চরণ অথবা বাক্যাংশ যখন একত্র গ্রথিত করবার প্রয়োজন হয় তখন তাদের একত্র-সমাবেশ যাতে অদ্ভুতদর্শন বা হয় সেদিকে মনোযোগী হওয়া কবির জন্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ যুগের অনেক কবিতায় দেখা যাবে- ‘বিদ্রোহী’ ও সে-সবের অন্তর্গত বিভিন্ন ভাবের একত্র সমাবেশের সঙ্গতি সুষমা অথবা যৌক্তিকতা বিষয়ে কবি বেশ উদাসীন হয়েছেন। কিন্তু এত ক্রটি সত্ত্বেও এমন একটা প্রাণশক্তির ছাপ তাঁর ‘বিদ্রোহী’ যুগের অনেক কবিতায় মুদ্রিত হয়েছে যার জন্য তাঁর ভয়ভাবনাহীন তারুণ্যের তিনি স্রষ্টা পুরোপুরি না হলেও লালায়িত। কিন্তু সাহিত্য-শিল্পী হিসাবে এই যুগে তাঁর রেখাপাতে অপরিচ্ছন্নতাও এতখানি প্রকাশ পেয়েছে যে তাঁর সাহচর্য রসিক পাঠককে আনন্দ যা দেয় দুঃখও সেই তুলনায় কম দেয় না।

এই যে নজরুলের অত্যাশ্চর্য শক্তি, অথচ সাহিত্যে তার অনবদ্য প্রকাশের অভাব, এটি তাঁর সাহিত্যের পাঠকদের দুঃখের বা ক্ষোভের কারণ না হোক এটি বরং তাদের অন্তরে সঞ্চারিত করুক তীক্ষ্ণতার জিজ্ঞাসা। সেই জিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হলে দেখা যাবে, কবি তিনি নিঃসন্দেহ- অনুভূতির গোপন আয়োজন তার জগতে কখনো কখনো ঘটায় বাণীর অপূর্ব বিদ্যুৎ-দীপ্তি–কিন্তু কবি তিনি যত বড় তার চাইতেও বড় তিনি যুগ মানব। যুগের বেদনা ও উন্মাদনা তাতে এত প্রবল যে, কবির কল্পনা লোকে অবস্থান তার পক্ষে যেন দুসাঃধ্য। এর দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায় তার শ্রেষ্ঠ ইসলামী কবিতা ‘খালেদ’। খালেদের মহিমা উদাত্ত কণ্ঠে গাইবার চেষ্টাই তিনি করেছেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে খালেদের বীরমূর্তি পূর্ণভাবে রূপায়িত করার চাইতে তাঁর মনে প্রবলতর তার সমসাময়িক মুসলমান সমাজের জন্য বেদনা অথবা অস্থিরতা। অবশ্য কবির সৃষ্টি আকাশ কুসুম নয় কখনো, কবির কাব্য ফুল মাটির গাছেরই ফুল, অন্য কথায়, যুগধর্মের বেদনায় কবি-মানস লালিত ও গঠিত। তবু গাছ আর ফুল যেমন এক জিনিস নয়, কোনো যুগের জীবন ও সেই যুগের কাব্যও ঠিক এক জিনিস নয়। Literature is joumalism that lasts (যে সাংবাদিকতা টিকে যায় তার নাম সাহিত্য) সাহিত্যের এই এক চমৎকার সংজ্ঞা একজন সাহিত্য-রসিক দিয়েছেন। [Robert Lund] কিন্তু এই যে শেষের কথা that lasts যা টিকে যায়, এরই মধ্যে রয়েছে সাহিত্যের মূল তত্ত্ব। সাংবাদিকতা স্থায়ী হয় না, কিন্তু সাহিত্য স্থায়ী হয়, এই জন্য যে, সাংবাদিকতা প্রতিদিনের জীবনের মতো অস্থির, অপূর্ণাঙ্গ, নিয়ত পরিবর্তনশীলতার-তা যেন প্রতিদিনের জীবনের ফটোগ্রাফ। কিন্তু সাহিত্য ঠিক তা নয়, তা অনেকখানি অচঞ্চল, অনেকখানি পূর্ণাঙ্গ, কেননা, ঠিক বাস্তব-লোকে নয় কল্পনা-লোকে বা সৌন্দর্য-লোকে প্রতিষ্ঠিত হবার অবসর যেন নজরুলের নেই, রুচিও যেন তাঁর তাতে নেই প্রতিদিনের জীবনের তাড়নার তীব্রভাবে তাড়িত হয়েই তিনি চলেছেন, আর এই জন্যই নজরুলকে এ যুগের একজন অসাধারণ কবি ভাবা কঠিন, [দ্রঃ ‘আমি আপনারে ছাড়া করিনা কাহারে কুর্ণিশ’] কিন্তু এ যুগের একজন অসাধারণ ব্যক্তি তিনি অবিসংবাদিতরূপে।

বলা হয়েছে, প্রতিদিনের জীবনের তীব্র তাড়নায় তাড়িত হয়ে চলায় কবি নজরুলের বেশ আনন্দ। কথাটি আর একটু বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন আছে। প্রতিদিনের হাসি-কান্নার জীবন চিরদিনই মানুষকে আনন্দ দিয়ে এসেছে। নইলে জগৎ শ্মশানে পর্যবসিত হতো। কিন্তু প্রকৃত মানুষের মনোভাব যাইই হোক শিক্ষিত মানুষ প্রতিদিনের জীবনকে সব সময়ে যে শ্রদ্ধার চক্ষে দেখেছেন তা নয়। বরং মধ্যযুগ বলতে মানুষের ইতিহাসের যে স্তর নির্দেশ করা হয় তাতে দেখা যায়, সংসারের প্রতিদিনের জীবনের প্রতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতেই শিক্ষিতেরা তাকিয়েছেন। আধুনিক যুগ এক হিসাবে তার প্রতিবাদ আর এই প্রতিবাদ আরম্ভ হয়েছে আজকে থেকে নয়। আমাদের দেশেও এই প্রতিবাদ আরম্ভ হয়েছে ইংরেজ রাজত্বের প্রায় সূচনায়। কিন্তু আমাদের সাহিত্যে এই প্রতিবাদ পূর্ণাঙ্গ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের যৌবনকালে। এই প্রতিবাদ আজ আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির এক creed, ধর্ম বিশ্বাস, এক সময়ে যেমন তাদের ধর্ম-বিশ্বাস ছিল বৈরাগ্য। নজরুল একালের তেমনি প্রত্যয়শীল এক ব্যক্তি। তবে তাঁর বিশেষত্ব এই যে, এই প্রত্যয় তাতে অনেকের চাইতে বলবত্তর-এতখানি প্রবলতা তার এই বিশ্বাসে বিদ্যমান যে, আপাতদৃষ্টিতে যে-সব মনে হয় অদ্ভুত খেয়াল-খুশী সে সবকেও মহত্তর মর্যাদা দিতে তাঁর বাধে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে তার আলেয়া’ নাটক। নরনারীর প্রেমের সম্বন্ধের যথার্থ নিরূপণ এ-ক্ষেত্রে তাঁর একটি সমস্যা। অবশ্য তীব্র সমস্যা নয়। সমাধান এই দাঁড়ালো যে, কার মন যে কখন কোন দিকে ঝুঁকে পড়বে তার কিছুই ঠিক-ঠিকানা নেই। আরো একটি সমাধান দাঁড়ালো যে, শক্তিমান জীবন ভোগ করে যাবেন, সে-ভোগ যদি অন্যের জন্যে হয় দুর্ভোগ তবু চলবে তাঁর ভোগের অভিযান। কথাটি যে আপত্তিকর কবি সে-বিষয়ে সজাগ, কিন্তু এই বলে তিনি কথাটি চুকিয়ে দিচ্ছেন যে, যৌবন বেগের এইত ধারা। বলা বাহুল্য যে-সমস্যার অবতারণা কবি করেছিলেন তার কোনো ভালো সমাধান তিনি দিতে পারলেন না ভোগের পথও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। কিন্তু সমস্ত অকৃতকার্যতার মধ্যে কবি এ বিষয়ে আশ্চর্যভাবে কৃতকার্য হলেন। সহজ সরল কণ্ঠে তিনি ঘোষণা করতে পারলেন, জীবন তার কাছে মধুময়; আরো ঘোষণা করতে পারলেন এত সুষমাময় চমৎকারিত্বময় যে জীবন তার মায়ায় চিত্ত তাঁর বন্দী হয়ে পড়েছে না, ভুল-ভ্রান্তি, ভোগ দুর্ভোগ, সমস্তের ভিতর দিয়ে চলেছেন তিনি সামনের দিকে একালের জীবন-বাদ ও গতি-বাদের যারা শ্রেষ্ঠ কবি, যেমন Walt Whitman ও রবীন্দ্রনাথ, তাদের বাণীর সঙ্গে তুলনায় নজরুলের বাণীর ত্রুটি অনেকক্ষেত্রে চোখে পড়ে; কিন্তু সেই সঙ্গেই চোখে পড়ে বাণীর ক্রটি তাতে যতই থাকুক জীবনের উপলব্ধি তার সুগভীর। তাঁর বিখ্যাত কবিতা-সমষ্টি “সাম্যবাদী সম্বন্ধেও এ-কথা খাটে। এতে তার যুক্তিতর্ক যেমন প্রচুর তেমনি দুর্বল। কিন্তু সে সবের মধ্য দিয়ে যে বেদনাময় চিত্তের প্রকাশ ঘটেছে তা পরম শ্রদ্ধার্য।

নজরুলের কবি প্রকৃতি সম্বন্ধে আরো একটি বড় ব্যাপার লক্ষ্য করবার আছে। নজরুলের ভিতরে তারুণ্য চমৎকার, জীবনের আনন্দ তিনি সহজভাবে অনুভব করতে পারেন, নানা দিকে তিনি একজন সহজ মানুষ এ-সবের কিছুই মিথ্যা নয়। কিন্তু এই সঙ্গে এ-কথাও আছে যে, অন্তরের গোপনতম প্রদেশে তিনি তাত্ত্বিক আর সেই তাত্তিকতা তাঁর যেন জন্মগত। তার এই পরম প্রিয় গোপনতম প্রদেশে তিনি তাত্ত্বিক আর সেই তাত্ত্বিকতা তার যেন জন্মগত। তার এই পরম প্রিয় তত্ত্বের নাম দেওয়া যেতে পারে লীলাবাদ-ইংরেজিতে যা সাধারণত Pantheism নামে পরিচিত। এই দৃষ্টিতে ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য শেষ পর্যন্ত নেই-ভালো-মন্দ, পাপ পুণ্য, জন্ম-মৃত্যু উত্থান-পতন, সব কিছুই ভগবানের লীলা। এই তত্ত্বকে বলা যায় একই সঙ্গে অদ্বৈতবাদ ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। হিন্দু-চিন্তার এটি যে মর্মকথা তা না বললেও চলে, সুফী-চিন্তারও এটি মর্মকথা-এক-হিসাবে প্রাচীনকালের ভাবুকদের এটি পরম আশ্রয়। এই হিন্দু-মুসলমানের মাথা ভাঙ্গাভাঙ্গির দিনেও নজরুল যে অবলীলাক্রমে শ্যামাসঙ্গীত ও বৃন্দাবন গাথা রচনা করে চলেছেন, তৌহীদেরও (একেশ্বর-তত্ত্বের) শক্তিশালী ব্যাখ্যা দিতে পারছেন, তার রহস্য নিহিত রয়েছে তার এই মূল বিশ্বাসের ভিতরে। কিন্তু এই বিশ্বাস যে তার কাব্যদৃষ্টিতে কিঞ্চিত বিঘ্নও ঘটিয়েছে সেইটিই আমাদের প্রধান বক্তব্য। কবিদের অথবা শিল্পীদের কেউই হয়ত সর্বপ্রকারে বিশ্বাস বর্জিত নন, কিন্তু তাদের বিশেষত্ব এই যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু বা ঘটনার যথার্থ উপলব্ধির আশ্চর্য ক্ষমতা তাদের থাকে সেই উপলব্ধির সময়ে তারা যেন সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত রাগদেষবর্জিত ও অপূর্বভাবে সহানুভূতি সম্পন্ন হয়ে ওঠেন। এই যে পূর্ণ আত্মবিশ্বরণ ও বিষয়-নিষ্ঠতা এটি নজরুলের পক্ষে তার শ্রেষ্ঠ মুহূর্তেও প্রায় অসম্ভব হয়েছে লীলাবাদে তার অপরিসীম আনন্দের জন্যে। এই লীলাবাদ তার জন্য এক ধরনের আত্মবিস্মৃতি এনে দিয়েছে, তাঁকে আশ্চর্যভাবে নিরহঙ্কার ও সৌন্দর্য পিপাসু করেছে, কিন্তু কবিত্বের পূর্ণ বিকাশের পথে এটি এই বাধা উপস্থিত করেছে যে এর ফলে বহির্মুখী না হয়ে অন্তর্মুখী তিনি হয়েছেন অনেক বেশি; রুপ বৈচিত্র অঙ্কনের চাইতে Type বা প্রতীক সৃষ্টির দিকে তার মন ঝুঁকেছে।

“বিদ্রোহী” কবিতাটি সম্পর্কে আরো একটু আলোচনা হয়ত অসঙ্গত নয়! প্রাক ‘বিদ্রোহী’ ও ‘বিদ্রোহী’ যুগের পার্থক্য সম্বন্ধে ইঙ্গিত করা হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’তেই দুইটি ধারা-এক দিকে তাঁর অন্তরে জাগে অপরিসীম আত্মপ্রত্যয়, অন্যদিকে তিনি নিজেকে জ্ঞান করেন জাতিধর্ম নির্বিশেষে দুঃস্থ মানবতার অগ্রনায়ক।

এর ‘বিদ্রোহী’ নামকরণ সঙ্গত হয়েছে বলা যায়, কেননা হঠাৎ যে গভীর উন্মাদনা কবির অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছে তা গতানুগতিকার বিরুদ্ধে এর তীব্র বিদ্রোহই বটে। কিন্তু বাস্তবপক্ষে এ এক অপূর্ব উন্মাদনারই কবিতা, কোনো বিদ্রোহীবাণী এতে বিঘোষিত হয়নি। এর যে বিখ্যাত চরণ আমি বিদ্রোহী ভণ্ড ভগবান-বুকে একে দিই পদচিহ্ন এটিও ঠিক বিদ্রোহ-বাণী নয় বরং এক হিসাবে গভীর ঈশ্বর-নির্ভরতার বাণী। এ সম্পর্কে তার এই কালেরই রচনা দুর্দিনের যাত্রীর এই কথাগুলো অর্থপূর্ণ :

এমন যার কোনো গুরু বা বিধাতা নেই যাকে ভয় বা ভক্তি করে সে নিজের আত্মাকে ফাঁকি দেয় শুধু সেই সত্য স্বাধীন, মুক্ত স্বাধীন। এই অহম-জ্ঞান আত্মজ্ঞান-অহঙ্কার-নয়, এ হচ্ছে আপনার ওপর নিজের বিপুল শক্তির ওপর অটল বিরাট বিশ্বাস।

অন্যত্র :

……’যার অন্তরে আপন সত্য আপন ভগবান সহজে জাগে না তাদের ভগবান এমনি করে বুকে লাথি খেয়ে তাবে জাগে।’

অন্যত্র :

……’বিদ্রোহের মতো বিদ্রোহ যদি করতে পার, প্রলয় যদি আনতে পার তবে নিদ্রিত শিব জাগবেই-কল্যাণ আসবেই।

দুর্বল, এমন কি অনাবশ্যক, চরণ থেকে বিদ্রোহী’ মুক্ত নয়। এ ক্রটি মারাত্মক। কিন্তু এত ক্রটি সত্ত্বেও বাংলা কাব্যে বিদ্রোহী’র জন্য যে একটি সম্মানিত স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে তা নিঃসন্দেহ। সমস্ত অদ্ভূতত্ত্ব সত্ত্বেও এর উন্মাদনা অপূর্বভাবে প্রাণপূর্ণ।

যে-লীলাবাদে বিশ্বাস কবির মজ্জাগত বলেছি, তারও সঙ্গে আমাদের প্রথম স্পষ্ট পরিচয় হচ্ছে এতে, বিশেষ করে এই এই সব চরণে

জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তায়া তাথিয়া নথিয়’ ফিরি এ
স্বর্ণ পাতাল মত।
আমি উন্মাদ আমি উন্মাদ–
আমি চিনেছি আমারে আজিকে আমার
খুলিয়া গিয়েছে সব বাঁধ।

‘বিদ্রোহী’ তে কবির ঈশ্বর-বিদ্রোহ প্রকাশ পায়নি বটে, কিন্তু এর পরের ‘ধুমকেতু’ কবিতায় সে-বিদ্রোহ পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে

জানি ঐ ভূয়ো ঈশ্বর দিয়ে হয়নি যাহাও হবে তাও,
তাই বিপ্লব আনি বিদ্রোহ করি…………..

ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য, রাশিয়ার সাম্যবাদের দিকে কবি এখানে বিশেষভাবে ঝুঁকেছেন বোধ হয় তাঁর এই সময়ের প্রধান বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদের প্রভাবে। তার বিদ্রোহী’ যুগের প্রায় সমস্ত কবিতায় এই সাম্যবাদের প্রভাব সুস্পষ্ট। কিন্তু পুরোপুরি সাম্যবাদী নজরুল কখনো হননি, হলে তার এই সাম্যবাদ প্রচারের দিনে ‘খালেদ’ ওমর ‘জগলুল’ প্রভৃতি প্যান ইসলামী ভাবের কবিতা লেখা তার পক্ষে সম্ভবপর হতো না। সাম্যবাদের প্রভাবে তার ভিতরে ঘনীভূত হয়েছে দুঃস্থ ও বঞ্চিত মানবতার জন্য তাঁর দরদ। তাঁর ঈশ্বর-দ্রোহ মানব সমাজের দুর্বল ন্যায় অন্যায়-বোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-অভিমানের ভঙ্গিতে; তার বেশি কিছু বলে মনে হয় না।

তৃতীয় স্তর

‘বিদ্রোহী’–যুগ নজরুল সাহিত্যের আলোচনায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কেননা তার জনপ্রিয়তার মূলে এই যুগের রচনা। কিন্তু এই যুগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এই ‘বিদ্রোহী’ যুগের উদ্দীপনা পূর্ণ-পরিণতি লাভ করবার পূর্বেই বিস্মিত দেশবাসী তার কণ্ঠে শুনতে পেলো ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ অথবা আমারে চোখ-ইশারায় ডাক দিলে হায় কে গো দরদি ইত্যাদি গজল।

‘বিদ্রোহী’–যুগ নজরুলের জন্য জনপ্রিয়তা আনলেও তাঁর কাব্য সাধনা ব্যাপক সার্থকতা লাভ করেছে তার গানে, এ বিষয়ে বাংলার কাব্যরসিকরা বোধ হয় একমত। রেখাপাতের যে অপরিচ্ছতা বিদ্রোহী’- যুগের অনেক রচনায় লক্ষ্য করা গেছে, তা যে গানের যুগে প্রায় অর্ন্তহিত হয়েছে, শুধু অনবদ্য চরণ নয় অনবদ্য কবিতা তার কলম থেকে উৎরেছে, তা মিথ্যা নয়। তাঁর রচিত গান সম্বন্ধে একটি উপভোগ্য রচনা তার বুলবুল সঙ্গীত-গ্রন্থের ভূমিকা রূপে ব্যবহার করা হয়েছে তাতে নজরুলের অনেক চরণের সৌন্দর্য সমন্ধে যে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে তা সমর্থনযোগ্য। শুধু একটি ব্যাপার তিনি লেখানে লক্ষ্য করেন নি, সেটি এই যে, নজরুলের এই সব সুন্দর প্রেমের কবিতা সংখ্যায় কম আর শীগগিরই পুনরুক্তি দোষ তাঁকে ঘটেছে। Type বা প্রতীক সৃষ্টির দিকে তাঁর যে বিশেষ ঝোঁক তারও প্রমাণ এই সব গানে রয়েছে।

যিনি খ্যাতি লাভ করলেন বিদ্রোহী রূপে, কাব্য-লক্ষ্মীর প্রসাদ অজস্র ভাবে তিনি লাভ করলেন প্রেম-সঙ্গীতের রচয়িতা রূপে! বাংলা সাহিত্যে এ ব্যাপারটি কিন্তু নতুন নয়। বীররস, মহাকাব্য, এসব বাংলার ধাতে যেন সহ্য হয় না। মধুসূদন বিরাট আয়োজন করলেন, কিন্তু সে-চেষ্টায় বীররস যতখানি সৃষ্টি হলো তার চাইতে অনেক বেশি হলে করুণ রস। হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্র তো নাস্তানাবুদ হলেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলার এই ধাত বুঝে এ পথে পা দিলেন না, তবে নিজের বিরাট জীবন সাধনার গুণে অজানিতভাবে বীররসের সৃষ্টি করলেন কোনো কোনো কবিতায় যেমন বর্ষশেষ’। হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম রণ-দামামা আর লেফট রাইট মার্চের ধ্বনি কানে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। এর সঙ্গে তার নতুন উত্তেজনা ও উন্মাদনা লাভ হলো রাশিয়ার লাল পল্টনের রণ-হুঁঙ্কারে। এই বিপুল উত্তেজনা ও উন্মাদনা যে তার কাব্য-প্রয়াসে ব্যর্থ হলো তা বলা যায় না, কিন্তু সার্থকতা যা লাভ হলো চেষ্টার অনুপাতে তা কম! অথচ করুণ রস, বিরহ, এ-সব বাংলায় জমে ওঠে যেন সহজে। সেকালে চণ্ডীদাস অমর বিরহ-গাথা রচনা করে গেছেন, বাংলার মাঠে বাটে আজো তার ধুয়া শোনা যায়। এর কারণ মনে হয় বাংলার বিশেষ জীবন-ধারা। বৃহত্তর জীবন সৃষ্টির চেষ্টা বাংলার যে না হয়েছে তা নয়, কিন্তু কেমন করে যেন সে-সব শেষ পর্যন্ত জমে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত বাঙালির অবলম্বন হয়েছে তার নগণ্য গৃহ, তার বহতা নদী, তার সবুজ গাছপালা, ফসল ক্ষেত আর নীল আকাশ, আর তার প্রেমময়ী নারী। এই পরিবেষ্টনে আর মহাকাব্য যদি না জমে তবে দুঃখ করা চলে না। এই প্রসঙ্গে লক্ষ্য করা যেতে পারে যে, বাংলার যে আবহমান প্রাণ-ধারা তার সঙ্গে নজরুলের যোগ আশ্চর্যভাবে নিবিড়।

নজরুল যে প্রেম-সঙ্গীত রচনা করেছেন তা বুঝতে গেলে সহজেই চোখে পড়ে, তার ‘বাধন-হারা’ পত্রোপন্যাসে তার প্রথম জীবনের যে ব্যর্থ প্রেমের ছবি তিনি অঙ্কিত করেছিলেন সেইটিই হয়ে রয়েছে তার সারা জীবনের ধুয়া। কিন্তু তার প্রেম যেমন রাধিকার নতুন-মন-ধন জীবন যৌবন তব পায়ে সমর্পণের প্রেম নয়, তার বিহরও তেমনি রাধিকার বুক-ভাঙা বিরহ নয়। যে-বিরহচ্ছবি তাকে মুগ্ধ করেছে সেটি সংসার অনভিজ্ঞ, অবুঝ, কিশোর-কিশোরীর বিরহ। এ বিরহে তাদের জীবন যে ব্যর্থতায় তিক্ত হয়ে উঠেছে ঠিক তা নয়, হয়ত দৈনন্দিন জীবন তাদের চলেই যাচ্ছে, কিন্তু এ বিরহ বোধ তাদের জন্য হয়েছে যেন জীবনের এক অতুলীয় অভিজ্ঞতা-জীবন যেন পরম সমৃদ্ধ হয়েছে এই বিরহের স্পর্শমণির ছোঁয়ায়। ভাব-বিলাসিতা বলে এই বিরহ-ছবি আজকের মতো এতখানি মনোরম না-ও হতে পারে; কিন্তু এই সত্য যে কবির সমসাময়িকেরা কবির এই বিরহ সঙ্গীত নিবিড়ভাবে উপভোগ করেছেন ও করছেন; এই প্রভাব বাংলার সমসাময়িক গানের উপরেও অসামান্য।

এইসব প্রেমসঙ্গীত রচনার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলামী সঙ্গীত, শ্যামাসঙ্গীত ও বৈষ্ণব সঙ্গীত রচনায় মন দেন। ইসলামী সঙ্গীতের অধিকাংশ প্রচলিত উর্দু গজল ও নাতিয়া’র (প্রশস্তি) ভঙ্গিতে রচিত। কবির নিজের কাছে এই সব সঙ্গীত যথেষ্ট মূল্যবান, কেননা এই সব সঙ্গীতের ভিতর দিয়েই বাংলার মুসলিম জনসাধারণের চিত্তের তিনি প্রবেশ পথ পেয়েছেন। মুসলিম জনসাধারণও এতে যে কিছু প্রীত না হয়েছে তা নয়। কিন্তু আমরা এ-বিষয়ে কবির সঙ্গে একমত হতে নারাজ। এক শ্রেণীর সুফীর যে উৎকট গুরুভক্তি, মুখ্যত তাই রূপ পেয়েছে এই সব গানে। ভাব বিলাসিতাও। এ-সবে প্রচুর। কিন্তু মনে হয়, ধর্ম সম্পর্কে এই ভাব-বিলাসিতার দিন উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এর চাইতে হজরত মোহাম্মদের সবল কাণ্ডজ্ঞান, চরিত্র মাহাত্ম, এ-সব কেন্দ্র করে যদি গান রচনা সম্ভবপর হতো তবে তার সার্থকতা হতো অনেক বেশি। ইসলাম এক হিসাবে ধর্ম-জগতে এক বিদ্রোহের সূচনা করেছে প্রতীক-চর্চায় আপত্তি জানিয়ে; আর বিদ্রোহী যে তার সত্যকার মহিমা নিরন্তর বিদ্রোহে।

ইসলামী সঙ্গীতের চাইতে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় নজরুল সার্থকতা অর্জন করেছেন অনেক বেশি। বাংলার শ্যামাসঙ্গীত বাংলা সাহিত্যের এক গৌরবের বস্তু, বিশেষ করে রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত। কিন্তু বাংলার প্রচলিত শ্যামাসঙ্গীতের মধ্যে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতে একটা বিশিষ্টতা ফুটেছে। কাব্যে রূপ বর্ণনা একই সঙ্গে রূপ ও অরূপের বর্ণনা। কিন্তু অধিকাংশ শ্যামাসঙ্গীতে-যেমন অনেক ধর্ম সঙ্গীতে রূপ স্কুল হয়ে উঠেছে, অরূপের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছে বড় বেশি। কিন্তু নজরুলের কোনো কোনো শ্যামাসঙ্গীতে উপভোগ্য কবিতা হয়েছে।

বৈষ্ণব সঙ্গীতে শ্যামাসঙ্গীতের মতো সাফল্য সাধারণত নজরুলের লাভ হয়নি। তার কারণ বোধ হয় তাঁর অনুভূত প্রেমের চাঞ্চল্য। বৈষ্ণব পদকর্তারা এক্ষেত্রে এত বড় সাফল্য অর্জন করে গেছেন যে, তাঁদের পরে তাঁদেরই ভঙ্গিতে তাঁদের সেই গান জমানো সুকঠিন। কিন্তু সম্প্রতি নজরুল যে অনুভূতির ভিতর দিয়ে চলেছেন তার ফলে তার এখনকার বৈষ্ণব সঙ্গীত অপরিসীম মাধুর্য মণ্ডিত হয়ে দেখা দিয়েছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা যায় তাঁর সম্প্রতি রচিত “অভিসার” সঙ্গীত-সমষ্টি। [কলিকাতা বেতারকেন্দ্রে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল।] প্রেমের চাঞ্চল্য, দেহ, চেতনা, এ-সব আশ্চর্য ভঙ্গিতে উঠে গেছে এক উন্নততর স্তরে। তাঁর এখনকার প্রেমের গান পূর্ণ আত্মনিবেদনের গান হয়ে উঠেছে, এবং মনে হয়, তার পূর্বের অনেক শ্রেষ্ঠ প্রেমসঙ্গীত তার এখনকার ভাবধারার আলোকে নূতন মহিমা লাভ করেছে।

তবে তাঁর আধুনিক জীবনের পরিণতি কোথায়, বলা সোজা নয়। এর ফলে তার কবি জীবনের অবসান ঘটাও বিচিত্র নয়- যে তাত্ত্বিকতা তাঁর জীবনের মর্মমূলে আমরা দেখেছি তাই হয়ত জয়ী হবে পূর্ণভাবে। অথবা, এর ফলে সমৃদ্ধতর চিত্ত তীক্ষ্ণতর দৃষ্টি নিয়ে তিনি নূতন করে জীবনে ও সাহিত্যে প্রবেশ করতে পারেন।

কবি নিঃসঙ্গ নন- কোনো সমাজের বা জাতির তিনি প্রতিনিধি। নজরুল এ যুগের বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন প্রধানত জড়তার বিরুদ্ধে বারবার সংগ্রাম ঘোষণা করে’ ও নির্যাতিত জনসাধারণের পক্ষ সমর্থন করে’; আর মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তাদের মন নব নব আশা-উদ্দীপনার সঞ্চার করে, বিশেষ করে বাংলার বা ভারতের আবহমান প্রাণ ধারার সঙ্গে তাদের প্রেমের নিবিড় যোগ স্থাপন করবার আহ্বান জানিয়ে।

কবি একই সঙ্গে জ্ঞানী ও প্রেমিক। জ্ঞানী যদি তিনি কিছু কম হন তবু খুব ক্ষতি হয় না, কিন্তু প্রেমিক হওয়া চাই তার পুরোপুরি। সেই প্রেমের সাধনাই মুখ্যত নজরুলের সাধনা হয়েছে। দেশ ও জাতির প্রতি সেই প্রেমে সেই পূর্ণ আত্মনিবেদনে নজরুলের এ কালে মুসলমানদের মধ্যে অথবা হিন্দু-মুসলমান সবার মধ্যে, এক সম্মানিত ব্যক্তি যে বৃহৎ জীবনের অথবা জাতীয় জীবনের চেতনা দেশে অনুভূত হয়েছে তাতে তাঁরও প্রতিভার স্পর্শ লেগেছে। এই জনজাগরণের দিক দিয়ে দেখলে সহজেই চোখে পড়ে নজরুলের ঐতিহাসিক মর্যাদা কত বড়।

১৩৪৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *