বাংলার জাগরণ

বাংলার জাগরণ

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির ধারণা এই যে বাংলার জাগরণ পাশ্চাত্য প্রভাবের ফল। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু পুরোপুরি সত্যও যে নয় সে-দিকটা ভেবে দেখবার আছে। যারা এই জাগরণের নেতা তারা কি উদ্দেশ্য-আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, ও এই জাগরণের ফলে দেশের যা লাভ হয়েছে তার স্বরূপ কি, এই সমস্ত চিন্তা করলে হয়ত আমাদের কথা ভিত্তিশূন্য মনে হবে না। রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মজ্ঞান প্রচার থেকে আরম্ভ করে বাজনা ও গোহত্যা নিয়ে হিন্দু মুসলমানের দাঙ্গা পর্যন্ত আমাদের দেশে চিন্তা কর্মধারা, আর ডিইষ্ট এনসাইক্লোপিডিষ্ট থেকে আরম্ভ করে বোশেভিজ্বম পর্যন্ত পাশ্চাত্য চিন্তা ও কর্মধারা, এই দুইয়ের উপর চোখ বুলিয়া গেলেও বুঝতে পারা যায় আমাদের দেশ তার নিজের কর্মফলের বোঝাই বহন করে চলেছে, পাশ্চাত্যের সঙ্গে তার পার্থক্য যথেষ্ট লক্ষ্যযোগ্য। এই পার্থক্য একই সঙ্গে আমাদের জন্য আনন্দের ও বিষাদের। আনন্দের এই জন্য যে এতে করে আমাদের একটা বিশিষ্ট সত্তার পরিচয় আমরা লাভ করি– অসভ্য বা অর্ধসভ্য জাতির মত আমরা শুধু ইয়োরোপের প্রতিধ্বনি মাত্র নই; আর বিষাদের এই জন্য যে আমাদের জাতীয় চিন্তা ও কর্ম-পরম্পরার ভিতর দিয়ে আমাদের যে ব্যক্তি সুপ্রকট হয়ে ওঠে সেটি অতীতের অশেষ অভিজ্ঞতাপুষ্ট অকুতোভয় আধুনিক মানুষের ব্যক্তিত্ব নয়, সেটি অনেকখানি অল্প পরিসর শাস্ত্রশাসিত মধ্যযুগীয় মানুষের ব্যক্তিত্ব।

এই সঙ্গে আর একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার যে রামমোহন থেকে আমাদের দেশে যে নবচিন্তা ও ভাবধারার সূচনা হয়েছে পরে পরের চিন্তা ও কর্মধারা কেবল যে তার পরিপেতষক হয়েছে তা নয়, এমন কি প্রবল ভাবে তার বিরুদ্ধাচারীই হয়েছে বেশী। আর উদ্দেশ্য-আদর্শের এই সমস্ত একটা বীর্যবন্ত সামঞ্জস্য লাভ করে আমাদের জাতীয় জীবন ও কর্মের যে একটা বিশিষ্ট ধারা সূচিত করবে তা থেকেও আমরা এখনো দূরে।

(২)

বাংলার নবজাগরণের প্রভাত-নক্ষত্র যে রাজা রামমোহন রায় সে সম্বন্ধে কোনো মতভেদ নেই। কিন্তু তাঁকে জাতীয় জাগরণের প্রভাত-নক্ষত্র না বলে প্রভাত-সূর্য বলাই উচিত; কেননা, জাতীয় জীবনে কেবলমাত্র একটি নব চৈতন্যের সাড়াই তার ভিতরে অনুভূত হয় না, সেই দিনে এমন একটি বিরাট নব আদর্শ তিনি জাতির সামনে উপস্থাপিত করে গেছেন যে এই শত বৎসরেও আমাদের দেশে আর দ্বিতীয় ব্যক্তি জন্ম গ্রহণ করেননি যার আদর্শ রামমোহর আদর্শের সঙ্গে তুলিত হতে পারে। এমন কি, এই শত বৎসরে আমাদের দেশে অন্যান্য যে সমস্ত ভাবুক ও কর্মী জন্মেছেন তাঁদের প্রয়াসকে পাদপীঠ-রূপে ব্যবহার করে তার উপর রামমোহনের আদর্শের নব প্রতিষ্ঠা করলে দেশের জন্য একটা সত্যকার কল্যাণের কাজ হবে–এই আমাদের বিশ্বাস।

এই রামমোহন যে পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, পাশ্চাত্য জীবনাশ ইত্যাদির দিকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তবু একথা সত্য যে এই পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সংস্রবের তিনি এসেছিলেন পূর্ণ যৌবনে। তার আগে আরবী ফারসী ও সংস্কৃত-অভিজ্ঞ রামমোহন পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে পিতা ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে বাদানুবাদ করেছেন, গৃহ ত্যাগ করে তিব্বত উত্তর ভারত ভ্রমণ করেছেন, আর সেই অবস্থায় নানক কবীর প্রভৃতি ভক্তদের ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন যারা হিন্দু-চিন্তার উত্তরাধিকার স্বীকার করেও পৌত্তলিকতা অবতারবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। এই সব ভেবে দেখলে ও তাঁর চিত্তের উপর মোতাজেলা সুফি প্রভৃতির প্রভাবের কথা স্মরণ করলে বলতে ইচ্ছে হয়, ভারতে মধ্যযুগে হিন্দু-মুসলমানের সভ্যতা ও ধর্মের সংঘর্ষ থেকে উদ্ভুত হয়েছিলেন যে নানক কবীর দাদু আকবর আবুল ফজল দারাশেকো প্রভৃতি ভক্ত ভাবুক ও কর্মীর দল, অষ্টাবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদের রামমোহন তাঁদেরই অন্যতম। অবশ্য মধ্যযুগের সমস্ত খোলস চুকিয়ে দেওয়া একেবারে আধুনিক কালের এক পরম শক্তিমান মানুষের চিত্ত ক্রমেই আমরা তার ভিতরে বেশী করে অনুভব করতে পারছি। কিন্তু সেটি হয়ত তার উপর আধুনিক কালের ইয়োরোপের প্রভাবের জন্যই নয়, আধুনিক ইয়োরোপ যেমন করে মধ্যযুগেরই কুক্ষি থেকে উপাত হয়েছে রামমোহনের বিকাশও হয়ত সেই ধরনেরই ব্যাপার।

এই একটি লোক রামমোহন হিন্দুর সঙ্গে তর্ক করেছেন বেদ উপনিষৎ রামায়ণ মহাভারত পুরাণ তন্ত্র সংহিতা ও সেই সমস্তের টীকা নিয়ে, মুসলমানের সঙ্গে তর্ক করেছেন কোরআন হাদিস ফেকা মন্তেক ইত্যাদি নিয়ে, আর খ্রিষ্টানের সঙ্গে তর্কে ব্যবহার করেছেন ইংরেজি গ্রীক ও হিব্রু বাইবেল ও বড় বড় খ্রিষ্টান পণ্ডিতের মতামত। এই লোকটিই আবার সতীদাহ নিবারণের জন্য লড়েছেন– মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা চীনের সঙ্গে অবাধ বাণিজ্য, নারীর অধিকার, বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজের শাসনের সমালোচনা ও সেই ক্ষেত্রে পথনির্দেশ, এই একটি লোকেরই কর্মের প্রেরণা যুগিয়েছে। এই বিরাট পুরুষের জীবন-কথা ও বিভিন্ন রচনার আলোকে-পথের পথিক দেশের তরুণ-সম্প্রদায়ের নিত্য-সঙ্গি হবার যোগ্য। কিন্তু এই আলোচ্য প্রবন্ধে আমাদের দ্রষ্টব্য-দেশের সামনে কি নির্দেশ তিনি রেখে গেলেন। সেই সম্পর্কে মোটামুটি ভাবে বলতে পারা যায়, ধর্মের ক্ষেত্রে তাঁর নির্দেশ এক নিরাকার পরমব্রহ্মের উপাসনা, লোকশ্রেয়ঃ ও বিচার বুদ্ধির দ্বারা পরিশোধিত শাস্ত্র, সেইজন্য পরে পরের উপশাস্ত্ৰসমূহ প্রত্যাখ্যান করে প্রত্যাবর্তন মূল শাস্ত্রসমূহে; শিক্ষার ক্ষেত্রে-ইয়োরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ অনুশীলন; সমাজের ক্ষেত্রে-লোকহিতকর অনুষ্ঠানসমূহের প্রবর্তনা, যা অনিষ্টকর তা প্রাচীন হলেও বর্জনীয়; আর রাজনীতির ক্ষেত্রে Dominion Status এর মতো একটা কিছুর আশা রাখা। এমনিভাবে নানা আন্দোলনে সমগ্র দেশ আন্দোলিত করে ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন বিলাত যাত্রা করেন সেই যাত্রা তাঁর মহাযাত্রা। [দ্রঃ রামমোহন রায়]

(৩)

রামমোহন জাতীয় জীবনে যে সমস্ত কর্মের প্রবর্তনার সঙ্কল্প করেছিলেন তার মধ্যে শিক্ষার ক্ষেত্রে হিন্দু কলেজ অনতিবিলম্বে ফল প্রসব করতে আরম্ভ করে। হিন্দু কলেজের সঙ্গে ডিরোজিওর নাম চিরদিনের জন্য এক সূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে। এই ডিরোজিও যে গুরুর শিষ্য ফরাসী-বিপ্লবের চিন্তার-স্বাধীনতা-বহ্নি তাঁর ভিতরে প্রজ্জ্বলিত ছিল। ডিরোজিওর সেই বহ্নি-দীক্ষা হয়েছিল। অল্প বয়সে যথেষ্ট বিদ্যা অর্জন করে কবি ও চিন্তাশীল রূপে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। বিশ বৎসর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের চতুর্থ শিক্ষক রূপে নিয়োজিত হন, আর তিন বৎসর শিক্ষকতা করার পর সেখান থেকে বিতাড়িত হন। এরই ভিতরে তাঁর শিষ্যদের চিত্তে যে আগুন তিনি জ্বালিয়ে দেন তার কলেজ পরিত্যাগের বহুদিন পর্যন্ত তার তেজ মন্দীভূত হয় নি। শুধু তাই নয়, নব্যবঙ্গের গুরুদের ভিতরে এই ডিরোজিওর এক বিশিষ্ট স্থান আছে। এর শিষ্যেরা অনেকেই চরিত্র বিদ্যা সত্যানুরাগ ইত্যাদির জন্য জাতীয় জীবনে গৌরবের আসন লাভ করেছিলেন এরই সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু সমাজের আচার-বিচার বিধি-নিষেধ ইত্যাদির লঙ্ঘন দ্বারা সুনাম বা কুনাম অর্জন করে সমস্ত সমাজের ভিতরে একটা নব মনোভাবের প্রবর্তনা করেন।

ডিরোজিওর দলকে আমাদের কোনো কোনো সাহিত্যিক প্রতিপন্ন করতে প্রয়াস পেয়েছেন রামমোহনের বিরুদ্ধ দল বলে; কেননা এই দল ধর্ম বিষয়ে উদাসীন তো ছিলেনই অনেক সময় নাস্তিকতাবাপন্ন ছিলেন, আর “if we hate anything from the bottom of our heart it is Hinduism” একথা তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যভাবেই ঘোষণা করতেন। তবু এই ডিরোজিওর দল প্রকৃত প্রস্তাবে হয়ত রামমোহনের ব্রহ্মসমাজের নেতা ও ডিরোজিওর দলের অনেকে উত্তরকালে রামমোহনের ব্রহ্মসমাজের নেতা ও কর্মী হয়েছিলেন, আর বিদ্যা চরিত্রবল জনহিতৈষণা ইত্যাদি গুণে এঁরা যেভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছেন তাতে রামমোহনের বিদেহআত্মার স্নেহাশিষই হয়ত তারা লাভ করেছিলেন।

রামমোহন ইয়োরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চমৎকারিত্বের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু সেই জ্ঞানের স্বাদ বাঙালি প্রকৃত প্রস্তাবে পায় ডিরোজিওর কাছ থেকে। এই স্বাদের চমৎকারিত্ব কত তা এই থেকে বোঝা যাবে যে বাংলার চির-আদরের মধুসূদন এই ডিরোজিও-প্রভাবের গৌণ ফল। তা ছাড়া সাধারণত বিদ্যানুরাগী বাঙালি হিন্দু এই ডিরোজিওর প্রদর্শিত পথে উনবিংশ শতাব্দীতে ইয়োরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন তা বাস্তবিকই প্রশংসনীয়। আজো বাঙ্গালি হিন্দুর বিদ্যানুরাগ কমে নি, কিন্তু ডিরোজিওর শিষ্য-প্রশিষ্যদের সেই আন্তরিকতার লালিমা একটু কেমনতর হয়ে গেছে বৈ কি।।

কিন্তু এত গুণ ও কার্যকারিতা সত্বেও, স্বীকার করতে হবে, ডিরোজিওর দল দুই এক পুরুষের বেশী প্রাণ ধারণ করে থাকতে সমর্থ হন নি, আর আজ তাঁরা বাস্তবিকই নির্মূল হয়ে গেছেন। কেন এমন হয়েছে তা ভাবতে গিয়ে হয়ত বলতে পারা যায়, তারা দেশের ইতিহাসকে একটুও খাতির করতে চান নি–পবননন্দনের মতো আস্তো ইয়োরোপ-গন্ধমাদন এদেশে বসিয়ে দিতে তারা প্রয়াস পেয়েছিলেন। তবে অন্য একটি কথাও ভাববার আছে। তারা যাই কেন করুন না দীনচিত্ত তারা ছিলেন না তাদের কামনা ভাবনা বাস্তবিকই রূপ নিয়েছিল তাদের জীবনে। আর সেই ডিরোজিওর শিষ্য প্রশিষ্যদের চাইতে আধুনিক শিক্ষিত হিন্দু যে সারাংশে উন্নততর জীব তাও হয়ত সত্য নয়।—তবু সেই ব্যক্তিত্ব ও সুরুচি সমন্বিত প্রাণবান সারবান অপেক্ষাকৃত সরল-চিত্ত ডিরোজিও-দল আমাদের নিকট থেকে বিদায় গ্রহণ করেছেন। অবশ্য চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন কিনা কে জানে।–কে জানে এত জাতি-সম্প্রদায় বিখণ্ডিত এত শাস্ত্র–উপশাস্ত্র-ভার-ক্লিষ্ট এত পূর্ণাবতার-খণ্ডাবতার নিপীড়িত বাঙালি-জীবন আবার কোনোদিন বলবে কি না– Derozio, Bengal hath need ot thee!

(৪) রামমোহনের শ্রেষ্ঠ দান কি তা নিয়ে আগেও বাংলাদেশে তর্কবিতর্ক হয়েছে, ভবিষ্যতের জন্যও যে সে-তর্কবিতর্কের প্রয়োজনীয়তা চুকে গেছে তা নয়। তবে যে সমস্ত বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে তার মধ্যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অক্ষয়কুমার দত্তের বাদানুবাদই সুবিখ্যাত। দেবেন্দ্রনাথ ঈশ্বর-প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। হাফিজের যে সব লাইন তা অতিপ্রিয় ছিল তার একটি এই– হরগিজম মোহর তু আজ লওহে দিল ও জন রওদ;[তোমার ছাপ আমার চিত্ত-ফলক থেকে কিছুতেই মুছবে না] তাঁর জীবনের সমস্ত সম্পদ-বিপদের ভিতর দিয়ে তার এই প্রেমের পরিচয় তার দেশবাসীরা পেয়েছেন। প্রথম জীবনেই যে পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতে হয়েছিল তা কঠোর সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সর্বস্ব দানে তিনি পিতৃঋণ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। সত্যের যাত্রাপথ “মহান মৃত্যুর”র এমনিভাবে সম্মুখীন হওয়া সমস্ত বাঙালি-জীবনে এক মহা-ঘটনা যাকে বেষ্টন করে বাংলার ভাবস্রোতের নৃত্য চলতে পারে হয়ত চলেছে। কিন্তু গুহাপথের যাত্রী হয়েও দেবেন্দ্রনাথ গভীরভাবে জ্ঞানানুরাগী ও সৌন্দর্যানুরাগী ছিলেন। তবু সংসারনিষ্ঠা জ্ঞানানুশীলন সৌন্দর্যহা সমস্তের ভিতরে ঈশ্বর-প্রেমই ছিল তার অন্তরতম বস্তু। তাই তিনি যে রামমোহনকে মুখ্যত ব্রহ্মজ্ঞানের প্রচারকরূপে দেখবেন এ স্বাভাবিক। কিন্তু অক্ষয়কুমার ছিলেন। জ্ঞানপিপাস; সে-পিপাসা এমন প্রবল যে এত দিনেও বাংলাদেশে সে রকম লোক অতি অল্পই জন্মগ্রহণ করেছেন। এই অক্ষয়কুমার মত প্রকাশ করেছেন যে রাজার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল দেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচার। জ্ঞানানুশীলন অক্ষয়কুমারের কাছে এত বড় জিনিস ছিল যে এ ভিন্ন অন্য রকমের প্রার্থনার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন না। তার সেই সুবিখ্যাত সমীকরণ বাংলার চিন্তার ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে আছে। শুধু প্রার্থনার যে কিছুমাত্র কার্যকারিতা নেই তা প্রতিপন্ন করবার জন্য তিনি লিখেছেন কৃষক পরিশ্রম করে শস্য উৎপাদন করে প্রার্থনা করে নয়। একেই তিনি একটি সমীকরণের রূপ দিয়েছেন এইভাবে :

প্রার্থনা + পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম = শস্য
অতএব, প্রার্থনা = ০

অক্ষয়কুমারের এই মনোভাব কিছুদিন ব্রাহ্ম সমাজে ও সেইদিনের ছাত্র-মহলে কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রভাব ব্রাহ্ম সমাজে অক্ষুণ্ণ হয় নি– হয়তো বা দেশের বৃহত্তর জ্ঞানের ক্ষেত্রেও তেমন ফলপ্রসূ হয় নি।

শেষ পর্যন্ত মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যানই রামমোহনের পরে ব্রাহ্মসমাজ গ্রহণ করেছিল; আর নানা বিপর্যের পর আজো তাঁর নির্দেশই হয়তো অধিকাংশ ব্রাহ্মের মনোজীবনে কার্যকর রয়েছে।

কারো কারো বিশ্বাস দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজের যে রূপ দিয়েছিলেন তা রামমোহনের উদ্দেশ্য আদর্শ থেকে পৃথক বস্তু। কিন্তু তা সত্য নয় এই জন্য যে যে দ্বৈতবাদের উপর দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম সমাজের ভিত্তি পত্তন করেছিলেন রামমোহনের জীবনে তারই প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। সত্য বটে তিনি বেদান্তের শাঙ্কর ভাষ্য অবলম্বন করেছিলেন; কিন্তু শঙ্করাচার্যের সঙ্গে তাঁর মতভেদ বিস্তর; এমন কি, অধিকাংশ হিন্দু সাধক ও দার্শনিকের অবলম্বিত Pantheistic God-এর চাইতে হিব্রু প্রফেটদের ব্যক্তিতু-সমন্বিত, পাপ পুণ্য ভাল-মন্দের নিয়ামক, ঈশ্বরের দিকেই তার চিত্তের প্রবণতা হয়তো বেশী ছিল। তবে রামমোহনের চিত্তের প্রসার ছিল অনেক বেশী তাই ভক্ত দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মের যে রূপ দিয়েছিলেন, কর্মী জ্ঞানী ও অন্তঃ প্রবাহী ভক্তিরস সমন্বিত রামমোহনের বিরাট ইচ্ছাধারা তাতে অবলীলাক্রমে প্রবাহিত হতে পারবে তা আশা করা সঙ্গত নয়। কোনো বড় স্রষ্টাই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে পুরোপুরি ধরা পড়েন নি; রামমোহনের সূচিত ব্রাহ্মসমাজ যদি তার বিরাট বিত্তের প্রতিচ্ছবি হয়ে না থাকে তবে তাতে দুঃখ করবার বিশেষ কিছু নেই।

কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মের যে রূপ দিয়েছিলেন তাতে যে শুধু তাঁর ভক্তি উচ্ছলিত চিত্তের তরঙ্গাভিঘাতই বুঝতে পারা গেছে তা সত্য নয়। ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তিভূমি নির্ণয়ে তিনি যে মনীষার পরিচয় দিয়েছেন তাতে দেশের চিত্ত-বিকাশের ক্ষেত্রে তার একটি বড় আসন লাভ হয়েছে। প্রথমে বেদকে ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তি রূপে গ্রহণ করতে চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল বেদের সব কিছু আশানুরূপ সুন্দর নয়। তারপর তিনি নির্ভর করতে গেলেন উপনিষদের উপরে। সেখানেও মুশকিল যে উপনিষৎ বহু বহু রকমের, তার উপর শুধু দ্বৈতবাদের প্রতিপাদক বচনই নয় অদ্বৈতবাদের প্রতিপাদক বচনের সংখ্যাও তাতে কম নয়। এই সঙ্কটে জ্ঞানবীর অক্ষয়কুমারের পরামর্শ মতো “আত্ম-প্রত্যয়-সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বলিত বিশুদ্ধ হৃদয়” এর উপর ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তি স্থাপন করা হলো। এই ভাবে মানুষের চিত্তকে যে নূতন করে এক গরীয়ান আসন দেওয়া হলো, তার অর্থ কত, ইঙ্গিত কি বিপুল, দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলার জাতীয় জীবনের সামনে থেকে আজ সেসব চিন্তা দূরে স্থিত। তাই জাতীয় জীবনে অক্ষয়কুমার-দেবেন্দ্রনাথের এই দানের জন্য তাঁদের প্রাত তাদের স্বদেশবাসীদের অন্তরের শ্রদ্ধা-নিবেদন আজো তেমন পযাপ্ত নয়।

(৫)

আমরা বলেছি বাংলায় এ পর্যন্ত যে চিন্তা ও কর্মধারার বিকাশ হয়েছে তাতে মধ্যযুগীয় প্রভাব বেশী। দেবেন্দ্রনাথের কার্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তিনি মানুষের চিত্তকে ব্রহ্ম পাদপীঠ বলে সম্মান দিয়েছেন, শুধু প্রাচীন ঋষিদের যে কেবল সে অধিকার ছিল তা তিনি মানেন নি। কিন্তু এই আবিষ্কৃত সত্যের পুরো ব্যবহারে তিনি যেন কেমন সঙ্কোচ বোধ করেছেন। এই “আত্ম-প্রত্যয়-সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জলিত বিশুদ্ধ হৃদয়” কথাটি তিনি পেয়েছিলেন উপনিষৎ থেকে নিজের জীবনের ভিতরে এ কথার সায় তিনি নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন। কিন্তু অনন্ত প্রয়োজনতাড়িত মানুষকে এই অমৃতের সাধনা জীবনের সমস্ত কর্ম সমস্ত অবসর সমস্ত প্রার্থনা সমস্ত অপ্রার্থনার ভিতর দিয়ে করতে হবে, শুধু বিধিবদ্ধ প্রার্থনার ভিতর দিয়েই নয়- এতটা অগ্রসর হতে তিনি যেন পশ্চাৎপদ হয়েছেন। হয়তো বৃহত্তর মনীষা নিয়ে তিনি যদি অক্ষয়কুমারকে আত্মসাৎ করতে পারতেন তা হলে ব্রাহ্মসমাজ তার হাতে যে রূপ লাভ করত তা দেশের পক্ষে আরো কল্যাণদায়ক হতো।

দেবেন্দ্রনাথের এই যে অন্তরে অন্তরে সেই ব্রহ্মোল্লাস অনুভব করা, সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যে তার দৈনন্দিন জীবনে জ্ঞান ও কর্মের ভিতর দিয়ে শ্রেয়ের অন্বেষণ করে যাবে, যে-অন্বেষণ মুখের প্রার্থনার প্রয়োজন সে অনুভব করতে পারে, নাও পারে, অনন্ত কর্ম-ও প্রেম পুলকিত মানুষের জীবনে তার আরাধ্য হয়তো তারই জীবনের সুরভি, হয়তো তার জ্ঞানক্ষেত্রে বিশ্বজগতের নিয়মক, হয়তো বিশ্বজগতের জন্য তার প্রেমের বন্ধন, হয়তো কর্মক্ষেত্রে তার চিরজাগ্রত নেতা, অক্ষয়কুমারের ভিতর দিয়ে উৎসারিত এই আধুনিক মনোভাবকে তিনি তেমন শ্রদ্ধার চক্ষে দেখতে পারেন নি, এইখানেই তার মধ্যযুগীয়ত্ব; এবং আধুনিক জীবনোযোগী জ্ঞানানুরাগ সুমার্জিত জীবন-যাপন ইত্যাদি সত্ত্বেও তিনি যে বৃদ্ধবয়সে ভাবের আতিশয্যে নৃত্য করতে পেরেছিলেন হয়তো তার এই প্রগলভা মধ্যযুগীয় ভক্তিই তার কারণ। অবশ্য মধ্যযুগীয় বলে সে জিনিসটি যে তাচ্ছিল্য বা অসম্ভ্রমের চক্ষে আমরা দেখতে প্রয়াস পাচ্ছি সে কথা মনে করলে আমাদের প্রতি অবিচার করা হবে। এখানে শুধু এই কথাটি আমার বলতে চাচ্ছি। যে এত চেষ্টা সত্ত্বেও আধুনিক অগ্রসর জাতিদের সঙ্গে সমানতালে পা ফেলে চলবার সামর্থ্য যে আমাদের হচ্ছে না তার এক বড় কারণ আমাদের যারা নেতৃস্থানীয় তাঁরাও খুব কমই আধুনিক জীবনের দিকে তাকিয়েছেন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রৌঢ় বয়সে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজের নেতা হন। তাঁর উপর খ্রিস্টের জীবন ও বাইবেলের প্রভাব বিশেষরূপে কার্যকর হয়েছিল। কেশবচন্দ্রের প্রকৃতির সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের প্রকৃতির যে বিশেষ পার্থক্য ছিল অনেকেই সে কথা বলেছেন। কিন্তু এক জায়গায় বড় গভীর মিলও ছিল, সেখানে হয়তো কেশবচন্দ্র দেবেন্দ্রনাথেরই মানস-পুত্র–সেটি, প্রগলভা ভক্তি। দেবেন্দ্রনাথ রাশভারী লোক ছিলেন, তাই তাঁর অন্তরের এই প্রগলভা ভক্তি তাঁর বাইরের চেহারা কৃচিৎ আলুথালু করতে পেরেছে। কিন্তু কেশবচন্দ্র আজন্ম “অগ্নিমন্ত্রের”র উপাসক। এই প্রগলভা ভক্তি তাঁকে প্রায় সব ধর্মের অনুষ্ঠান ইত্যাদির দিকে নিয়ে গেছে, নিত্য নূতন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছে, আর শেষে জগতের সমস্ত ধর্মের সার সংগ্রহ করে এক “নব বিধান” বা নব ধর্মের পত্তনে অনুপ্রাণিত করেছে। কেশবচন্দ্র যে শেষ বয়সে পরমহংস রামকৃষ্ণের প্রভাব বিশেষ ভাবে অনুভব করেছিলেন সেটি কিছুমাত্র আশ্চর্য বা অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। বাংলার চির-পরিচিত প্রগলভা ভক্তি উনবিংশ শতাব্দীর বাংলার এই এক অদ্ভুত পুরুষ রামকৃষ্ণের জীবনে আশ্চর্য পরিণতি লাভ করেছিল। যার প্রেরণায় কেশবচন্দ্র আজীবন নানা পথে ছুটাছুটি করেছেন তা এমন পর্যাপ্ত পরিমাণে কারো ভিতরে সঞ্চিত দেখতে পেলে সেখানে তিনি যে নিজেকে বিকিয়ে দেবেন এ যেমন স্বাভাবিক তেমনি সঙ্গত।

(৬)

সব ধর্মই কি সত্য? এ প্রশ্নের মীমাংসায় রামমোহন বলেছিলেন–বিভিন্ন ধর্মের ভিতরে পরস্পপ্রবিরোধী অনেক নিত্যবিধি বর্তমান, তাই সব ধর্মই সত্য একথা মানা যায় না, তবে সব ধর্মের ভিতরেই সত্য আছে। দেবেন্দ্রনাথ রামমোহনের এই মীমাংসা মেনে চলেছিলেন বলতে পারা যায় যদিও উপনিষদের দিকে তিনি বেশী ঝুঁকে পড়েছিলেন। কিন্তু কেশবচন্দ্রের ভক্তি প্রধান প্রকৃতির কাছে রাজার এ মীমাংসা ব্যর্থ হলো। তিনি বললেন– Our position is not that there are truths in all religions, but that all established religions of the world are true. এই কথাই রামকৃষ্ণ আরো সোজা করে বললেন–যত মত তত পথ।–যত মত তত পথ তো। নিশ্চয়ই; কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–সে সব কথা একই গন্তব্য স্থানে নিয়ে যায় কিনা। রামকৃষ্ণ বললেন হাঁ তাই যায়, তিনি সাধনা করে দেখেছেন শক্তি বৈষ্ণব বেদান্ত সুফী খ্রিস্টান ইত্যাদি সব পত্রই এক “অখণ্ড সচ্চিদানন্দের অনুভূতিতে নিয়ে যায়। এ সব কথার সামনে তর্ক বৃথা। তবে এই একটি কথা বলা যেতে পারে যে মানুষ অনেক সময়ে বেশী করে যা ভাবে চোখেও সে তাই দেখে। [যত মত তত পথ-এ কথাটির ভিতরে চিন্তার কিছু শিথিলতা আছে। পথ বহু নিশ্চয়ই, কিন্তু যে চলতে চায় তার জন্য একটি বিশেষ পথই পথ, আর অজ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে থোক সেই পথটি সে নির্বাচন করে বহু পথের ভিতর থেকে।] রামকৃষ্ণ পরমহংসকে কেউ বলেছেন অবতার, কেউ বলেছেন উন্মাদ। কিন্তু যিনি যাই বলুন বাংলার হিন্দু চিত্তের উপর তাঁর কথার প্রভাব যে অত্যন্ত বেশী তাতে সন্দেহ নেই। পৌরাণিক ধর্মকে সরিয়ে দিয়ে তার স্থানে রামমোহন প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন উপনিষদের ব্রাহ্মজ্ঞান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিন্দু জনসাধারণের কাছে প্রতিপন্ন হয়েছে–পৌরাণিক ধর্মের কিছুই বাজে নয়, তাই পরতে পরতে রয়েছে উপনিষদের ব্রহ্মবাদ, হয়তো বা তার চাইতেও ভাল কিছু।

(৭)

বাংলার উনবিংশ শতাব্দীর ধর্মচর্চার উপরে যে একটা মধ্যযুগীয় ছাপ মারা রয়েছে তা আমরা দেখেছি। কিন্তু বাংলার নববিকশিত সাহিত্যে যেন এই ক্রটির ক্ষালণের চেষ্টা প্রথম থেকেই হয়ে আসছে। বাংলার নবসাহিত্যের নেতা মধুসূদন আশ্চর্য উদার চিত্ত নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; জাতি ধর্ম ইত্যাদি সঙ্কীর্ণতা যেন জীবনে ক্ষণকালের জন্যও তাকে স্পর্শ করতে পারে নি; আর এই উদারচিত্ত কবি ইয়োরোপের ও ভারতের প্রাচীন কাব্য কলার শ্রেষ্ঠ সম্পদ যেভাবে অবলীলাক্রমে আহরণ করে তাঁর স্বদেশবাসীদের উপহার দিয়েছেন সে কথা বাঙালি চিরদিনই বিষয় ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। তার পরে সাহিত্যের যে নেতা বাঙালি জীবনের উপর একটা অক্ষয় ছাপ রেখে গেছেন তিনিও প্রথমজীবনে শিল্পী, সুতরাং সাম্প্রদায়িকতার দ্বারা অস্পষ্ট। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভিতরে কবিজনসুলভ স্বপ্ন কম। তিনি বরং নিপুণ চিত্রকর ও বাস্তববাদী স্বদেশপ্রেমিক। তাই তাঁর যে অমরকীর্তি “আনন্দমঠ” তাতে হয়ত নায়ক নায়িকার গূঢ় আনন্দ-বেদনার রেখাপাত তেমন নেই,* হয়ত এমন কোনো সৌন্দর্য-মূর্তি আঁকা হয় নি যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের নয়নে প্রতিভাত হবে a thing of beauty আর সেই জন্য a joy for ever. কিন্তু তবু এটি অমর এইজন্য যে এতে যেন লেখক কি এক আশ্চর্য ক্ষমতায় পাঠকের সামনে প্রসারিত করে ধরেছেন দেশের-দুর্দশা-মথিত তার রক্তাক্ত হৃদয়– যে হৃদয় তার সুগভীর বাস্তবতার জন্যই সৌন্দর্যের রহস্যময় খনি।

কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র শেষ পও শিল্পের ক্ষেত্রে এক পাশে নিশে এসে ধর্মের ক্ষেত্রে তিনি অবতরণ করেছিলেন। এর চবিখ্যায়ক। গলে, আত্মীয়বিয়োগে অধীর হয়ে তিনি ধর্মে মনোনিবেশ করেন। কিও ধর্ম ও ও কৃষ্ণচরিত্রে বঙ্কিমচন্দ্র যে শ্রমস্বীকার করেছেন, যে সুবৃহৎ আদর্শ স্বজাতির সামনে দাঁড় করাতে চেয়েছেন তাকে আর্তের কর্ম না বলাই সঙ্গত। বঙ্কিমচন্দ্রের এই ধর্মালোচনায়ও দেখতে পাওয়া যায় তার দেশহিতৈষণা। তবু বঙ্কিমচন্দ্রের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত দেশের অগ্রগতিকে খানিকটা সাহায্য করলেও বেশী সাহায্য করতে পারে নি, কেননা দেশ বলতে কেমন করে তিনি বুঝেছিলেন দেশেও হিন্দু তাও আবার সকল হিন্দু নয় সমসাময়িক শাসক ও সংস্কারকদের হাতে যে হিন্দু কিছু দিশেহারা হয়ে পড়েছিল সেই হিন্দু। এখানেও তাঁর সেই স্বদেশ-প্রেম; কিন্তু এ প্রেম খুব গম্ভীর হলেও কিছু একখা, তাই শেষ পর্যন্ত জাতির ত্রাণকর্তার বড় আসন তাঁর স্বদেশবাসীরা হয়ত তাকে দিতে পারবেন না।

জাতির সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধনায় রামমোহনের সুর শেষ পর্যন্ত তাঁর পশ্চাদবর্তীরা রাখতে পারেন নি” সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তেমনি মধুসূদন যে গ্রামে সুর ধরেছিলেন তা নেমে গেল। বঙ্কিমচন্দ্রই যখন নিজেকে দেশের কল্যাণের রাজপথে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলেন না “অন্যে পরে কা কথা”। তাই তার সমসাময়িক সাহিত্যিকদের রচনার পরিমাণ যতই বেশী হোক, দশের করতালিতে যতই তাদের সাহিত্যিক জীবন মুখরিত হয়ে থাকুক, বাংলার চিত্তের সাধনে সাহায্য তারা কিছুই করতে পারেন নি বললে চলে; বরং ধর্মের ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় ভাবোন্মত্ততা সুপ্রকট হয়ে উঠল, নানা ভাবে তাকেই তারা প্রদক্ষিণ করেছেন।

———
*সব সাধনা এক বিশেষ অনুভূতিতে নিয়ে যায়–এ কথাটির চারপাশেও কিছু স্থূলতা আছে। কাব্য সন্ধে যেমন একটি নির্বিশেষ সিই একমাত্র কথা নয়, তেমনিভাবে সব ধর্মই সত্য বা সব ধর্মেরই লক্ষ্য এক এসব কথার উপরে বেশি জোর দিলে মানুষের অনেকখানি চেষ্টার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে। তাই এসব কথা থেকে জীবন পর্যন্ত প্রেরণাদাভ সবপর না হবারই কথা। রামকৃষ্ণের এই সব উক্তি ভিত্তি করে তাকে একালের এক বড় সমাচাৰ্যৰূপে দাঁড় করার চেষ্টা আমাদের কোনো কোনো শিক্ষিত ব্যক্তি করেছেন তাঁদের সেই চেষ্টা সরে পাথে নিম্ন আছে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়া সময় কথ:”টাও একটু করে “ দরকার। সমন্বয় সাধারণত দুই ভাবে দেখা যেতে পারে মতবাদের সময় ও ‘রে সময়। বলা বাহুল্য জীবনের সময়ই বড় কথা, নুরে? নেই : মাহাত্মের পরিমাপ এই থেকে। এই জীবনের বিরাটত্বের দিকে রামকৃথষ্ট :: :: চেয়েছিলেন এ কথা বললে তার প্রতি বোধ হয় অসতে আরোপ করা হবে : ৫ সম্বন্ধে বোধ হয় এইই সত্য যে তাঁর অন্তরে সঞ্চারিত হয়েছিল মানুষের জন্য এক : স্নেহ, তাই মানুষকে তিনি শুনিয়েছিলেন কিছু আশ্বাসের বাণী। তাই তিনি ৩ সে একজন বড় শিক্ষক-বন্ধু। কিন্তু আমাদের কোনো এক সঙ্কেই এতিত? ধারণা থাকা আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য অকল্যাণক (রামমোহন দ্র: ৭৮. স্বল্প পরিসরে তাবানন্দের অন্তু মনে বঙ্কিমচন্দ্র এশ, সধারা? “ দিয়েছেন

(৮)

কিন্তু বাংলাদেশ এমনিতর একটা প্রতিক্রিয়ার ভিতর দিয়েই চলেছে, বৃহত্তর জীবনের দিকে তার গতি রুদ্ধ, এতটা বলতে গেলে সত্যের অপলাপ করা হবে। রামমোহন যে কর্ম ও চিন্তার সূচনা করে গেলেন ও তার পরে কেশবচন্দ্র বঙ্কিমচন্দ্র-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভিতর দিয়ে তার যে একটি প্রতিক্রিয়া হলো, এসব বিরোধ কোনো এক বীর্যবন্ত সামঞ্জস্যে উপনীত হয় নি, ও তার জন্য বাঙালির জাতীয় চরিত্র ও কর্মধারা একটা সুদর্শন বৈশিষ্ট্য অর্জন করে নি, এ সত্য; কিন্তু এ বিরোধ চুকিয়ে দিয়ে একটা উদার বীর্যন্ত জাতীয়তার দিকে চোখ দেবার চেষ্টা যে কারোই নেই তা সত্য নয়। জাতির এ নব প্রয়োজন দুইজন চিন্তা ও কর্মবীরের জীবনের ভিতর দিয়ে ফুটেছে–একজন বিবেকানন্দ অপরজন রবীন্দ্রনাথ। বিবেকানন্দ পরমহংস রামকৃষ্ণের ৬ি শি; ছিলে, একে সাধনা ও সিদ্ধি ব্যাপারটি আমরা বুঝি আর নাই বুঝি কিন্তু এ সত্য যে তিনি বার বার জোর দিয়েছেন জগৎ-হিতের উপরে। এ উপেক্ষা করে বিবেকানন্দ মুক্তির প্রার্থী হয়েছিলেন, তার জন্য তিনি তাঁকে ধিক্কার দিয়েছিলেন। বিবেকানন্দের ভিতরে দোষ কম নয়, প্রথমত রবীন্দ্রনাথের “গোরার মতো সব সময়ে তিনি যেন বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে লড়বার জন্য তৈয়ার, দ্বিতীয়ত সন্ন্যাস বেদান্তের তিনি গোঁড়া, তৃতীয়ত ব্রাহ্মদের যে তিনি নিন্দা করেছেন তাদের, ঐতিহাসিক বোধ নেই বলে সে অভিযোগটি তাঁর সম্বন্ধেও খাটেব্রাক্ষদের সংস্কারের প্রয়াসের কোনো অর্থ তিনি যেন খুঁজে পান নি, অথচ তিনি নিজে একজন ছোটখাট সংস্কারক ছিলেন না; চতুর্থত ভারত আধ্যাত্মিক ইয়োরোপ জড়বাদী ভারতকে ইয়োররাপের আচার্য হতে হবে এই ধরনের কতকগুলো কথা প্রচার করে স্বজাতির অন্তঃসারশূন্য দম্ভের সহায়তাই তিনি বেশী করেছেন; তবু মোটের উপর এই বীরহৃদয় সন্ন্যাসী সত্যকার স্বদেশপ্রেমিক ছিলেন মানব প্রেমিকও ছিলেন। তাই সেবাশ্রম প্রভৃতির সূচনা করে জাতীয় জীবনে তিনি যে বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র রচনা করেছেন জাতির চিত্তপ্রসারের জন্য বাস্তবিকই তা অমূল্য, এবং জাতীয় জীবনের দৈন্যের জন্য নানা ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও এই সব প্রতিষ্ঠান বাংলার হিন্দু যুবককে দেশের সত্যকার সন্তান হতে অনেকখানি সাহায্য করছে তাতে সন্দেহ নেই।

তারপর রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তার যে রূপ দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্কীর্ণতা ভেঙে তাকে বৃহত্তর করতে প্রয়াসী হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শের অনুপ্রেরণা এ পর্যন্ত বাংলার জাতীয় জীবনে কমই অনুভূত হয়েছে; এখন পর্যন্ত বঙ্কিমচন্দ্রের জাতীয়ত্বের আদর্শই দেশের জনসাধারণের উপর প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে, বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ কবি, তাও আবার সূক্ষ্ম-শিল্পি গীতিকবি, তাই যে মহা-মানবতার গান তিনি গেয়েছেন আমাদের স্কুল-প্রকৃতি জন সাধারণের কত দিনে তার স্পন্দন জাগবে তা ভেবে পাওয়া দুষ্কর।

(৯)

হিন্দুর নিজের ভিতরেই মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগের সগ্রামের যখন এই চেহারা, তখন আর এক সমস্যা দেখা দিয়েছে হিন্দু-মুসলমান সমস্যা। হিন্দু মুসলমান সমস্যা যেভাবে উঠেছে তা একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলমানের দুর্দশার প্রমাণ। মুসলমানের দুর্দশা এই জন্য যে এ সংগ্রামে সে যেভাবে জয়ী হবার স্বপ্ন দেখে তা থেকে বুঝতে পারা যায় তার স্বপ্ন দেখারই অবস্থা। বাস্তবিকই মুসলমানের অবস্থা খুবই বিস্ময়কর এতদিন ধরে পরিবর্তিত অবস্থায় বাস করেও তার ঘোরে দুই একটি প্যানইসলামী বোলচাল দেওয়া ভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে কোনরূপ জাগ্রত চিত্ততার পরিচয় সে আজ পর্যন্ত দেয় নি। আর হিন্দুর জন্য আফসোসের এই জন্য যে তার এত সংস্কার চেষ্টা এত সাধনা সত্ত্বেও এই সমস্যার একটা মীমাংসা করবার সামর্থ্য তার হলো না। এই হিন্দু-মুসলমান সমস্যা যে হিন্দু-মুসলমান উভয়েরই আচ্ছন্ন দৃষ্টির সামনে বিধাতার জ্বালা এক তীব্র আলো, এরই ঔজ্জ্বলে আমরা দেখে নিতে পারছি বর্তমান জগতের জ্ঞান ও কর্মের উৎসবে আমাদের স্থান কোথায়।

বাংলার যে প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ করা হয়েছে তা অনেক সময় এমন সামান্য কারণে হয়েছে যা থেকে বুঝতে পারা যায় প্রাচীন সংস্কার বাঙালির জীবনে কত বদ্ধমূল- চোখ খুলে জগতকে দেখতে সে কত নারাজ। এরই সঙ্গে কথাটি স্মরণ রাখা দরকার যে বাঙালি এ পর্যন্ত তার চোখ খোলার সাধনার বড় সাধক রামমোহনকে মোটের উপর প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। এই প্রত্যাখ্যানের কারণ সম্বন্ধে দুটি কথা বলে যেতে পারে, প্রথমত বাঙালি সাধারণত ভাবপ্রবণ, আর রামমোহন লোকটি যেমন আগা-গোড়া নিরেট কাণ্ডজ্ঞান, দ্বিতীয়ত বাঙালি হিন্দুর পরম আদরের প্রতিমাপূজার বিরুদ্ধে তিনি বেশ উঁচু গলায় কথা বলেছেন। এই প্রতিবাদকারী অথচ মহাপ্রাণ রামমোহনকে বাঙালি হিন্দু শেষ পর্যন্ত কি ভাবে গ্রহণ করবে বলা সহজ নয়। কিন্তু বিশ্ব জগতের দিকে বাস্তবিকই যদি তার চোখ পড়ে তাহলে সে হয়ত দেখবে এই প্রতিবাদকারীর কথার ভিতরেই সত্যের পরিমাণ বেশী, তাই তার পথ নির্দেশই অনেক পরিমাণে কল্যাণ পথের নির্দেশ। তাছাড়া রামমোহনকে গ্রহণ করা বাঙালি হিন্দুর জন্য যে শুধু আয়াসসাধ্যই হবে এটি সঙ্গত নয় এই জন্য যে রামমোহনও বাঙালি-সন্তান, শুধু তাই নয়, তার বিশাল দেহের ভিতরে যে চিত্তটি ছিল সমস্ত অভিনবত্ব সত্ত্বেও তা বাঙালিরই কোমল চিত্ত।

মনে হয়, বাঙালির রামমোহনকে গ্রহণ করার সব চাইতে বড় অন্তরায় এইখানে যে সে সাধারণত ঘরমুখো আর রামমোহন আবাল্য ঘরমুখো ছিলেন

। এই বাহির-মুখো হওয়ার সাধনাই হয়ত বর্তমান বাঙালি জীবনে বড় সাধনা –হয়ত এরই সাহায্যে সবলতর কাণ্ডজ্ঞান শ্রেষ্ঠতর পৌরুষ ইত্যাদি কল্যাণ পথের সম্বল আহরণ তার পক্ষে সহজ হবে। আর এই বাহির-মুখো হওয়ার উপায়ও তার অতি নিকটে। দৈব ঘটনায় বহু জাত বহু সম্প্রদায় দেশের বুকে এক জায়গায় মিলেছে, সেই মিলনকে অন্তরের দিক দিয়ে সার্থক করে তোলাই হচ্ছে বাহির মুখো হওয়ার বড় উপায় বাঙালির সৌভাগ্য-রূপী তার এ যুগের কবি বার বার একথা বলেছেন।

এরই সঙ্গে মুসলমানের জাগরণ যদি সত্য হয়, তাহলে কিছু বেশী সুফল লাভের সম্ভাবনা। যে গুরু তাকে উপদেশ দিয়েছেন ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নামাজ পড়ো, তার অনুবর্তিতায় বস্তুতন্ত্র তার পক্ষে স্বাভাবিক। আবার সেই জন্যই বস্তুর শিকলে বন্দী হওয়াও তার পক্ষে কম স্বাভাবিক নয়। ফলে মুসলমানের হয়েছে। তাই।–এই মনের বন্ধন সহজভাবে চুকিয়ে দিয়ে মুসলমান নব মানবতার ধ্বজা বহন করবার যোগ্য হবে কিনা, অথবা কতদিনে হবে, জানি না। যদি হয়, তবে বাংলার ধর্ম ও চিন্তার ক্ষেত্রে তার দান কম হবে না; তাহলে স্বাপ্নিক হিন্দু ও বস্তুতন্ত্র মুসলমান এ দুয়ের মিলনে বাংলার যে অভিনব জাতীয় জীবন গঠিত হবে– তার কীর্তি কথা বর্ণনা করবার ভার ভবিষ্যত সাহিত্যিকদের উপর থাকুক।

“মুসলিম সাহিত্য-সমাজের” দ্বিতীয় বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত।

ফাল্গুন, ১৩৩৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *