ইকবাল

ইকবাল

[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]

ইকবালের যে প্রধান মতবাদ- আত্মতত্ত্ব বা আমিত্ব-তত্ত- তার বিবৃতি পাওয়া যাবে তাঁর আসরার-ই-খুদী নামক পার্সী গ্রন্থে। ডক্টর নিকলসন Secrets of tle self নাম দিয়ে এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেছেন। বাংলাতেও এ গদ্যানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে।

ইকবালের জন্ম ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইয়োররাপে গমনের পূর্বেই তিনি উর্দু-কবি-সমাজে একজন শক্তিমান নবীন কবিরূপে আদৃত হন। কেম্ব্রিজে তিনি দর্শন অধ্যয়ন করেন ও কৃতী ছাত্ররূপে পরিগণিত হন, আর জার্মানীর মানিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর উপাধি লাভ করেন তার The Development of the Metaphysics in Persia সন্দর্ভের দ্বারা। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে প্রত্যাগমন করেন প্যান-ইসলাম-বাদে দীক্ষিত হয়ে আর কবিতা রচনায় বীতস্পৃহ হয়ে। বন্ধুদের আগ্রহে তিনি পুনরায় কবিতা রচনায় মন দেন। তাঁর আসরার-ই-খুদী প্রকাশিত হয় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে।

আসরার-ই-খুদী সম্পর্কে তাঁর কেব্রিজের গুরু ও বন্ধু দার্শনিক Mac Taggart এর এই চিঠিখানা অর্থপূর্ণ :

তোমার কবিতাগুলো (Secrets of the Self) পড়ে বড় গুণী হচ্ছি সে কথা জানাবার জন্য এই চিঠি লিখছি। তোমার চিন্তাধারা আগের তুলনায়। অনেক বদলে যায়নি কি? সেদিনে আমরা দুজনে যখন একত্রে দর্শন আলোচনা করতাম তখন তুমি অনেক বেশি মরমিয়া ও সক্ষ, বাদী (Pantheist) ছিলে। আমি নিজে বলবং আহি আমার পূর্বের প্রত্যয়ে যে ব্যক্তিসত্তা-সমূহ (Selves) হচ্ছে চরম সত্তা (ultimate reality), তাদের প্রকৃত অর্থ ও সার্থকতা বোঝা যাবে অনন্তকালে (পূর্বেও আমার এ ধারণা ছিল।), কালক্রমে নয়, এবং কর্মে তত নয় যত প্রেমে। হয়ত আমাদের এই পার্থক্য বেশির ভাগ মাত্রাগত আমাদের বিভিন্ন দেশের কি কি প্রয়োজন সেইটি হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের প্রধান ভাবনার বিষয়। তুমি ঠিকই বলেছ যে ভারতবর্ষ বড় বেশি ধ্যানী। কিন্তু ইংল্যান্ড ও ইয়োরোপ- যে যথেষ্ট ধ্যানী নয় সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। এই শিক্ষা তোমাদের কাছ থেকে আমাদের নেবার আছে, আমাদের কাছ থেকেও যে তোমাদের কিছু শিখিবার আছে তাতে ভুল নেই। [The post of the East-by Abdullah Beg]

মরমীবাদ ও সক্ষ-বাদ থেকে ব্যক্তিত্ববাদে, অর্থাৎ চরম সত্তায় বা ভগবানে বা আল্লাহয় ব্যক্তিত্ব–বিসর্জন-তত্ত্ব থেকে সেই চরম সত্তার সাহায্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশ তত্ত্বে কেমন করে’ ইকবালের পরিবর্তন ঘটলো তারা কাব্যের ভিতরে তার কিছু কিছু পরিচয় থাকলেও বিস্তারিত পরিচয় নেই, তাঁর কাব্যে বিস্তারিত পরিচয় আছে তাঁর ব্যক্তিত্ববাদেরই। তবে বাইরের কোন কোন ঘটনার প্রভাবে (Mac Taggart এর ভাষায় তাঁর দেশের কি প্রয়োজনে) তার মধ্যে এমন পরিবর্তন ঘটে তা বোঝা কঠিন নয়।

নবীন কবি ইকবালের অন্তরে স্বদেশানুরাগ যথেষ্ট প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছিল তাঁর হিমালয়’ বুদ্ধ নানক’ নূতন শিবালয়’ প্রভৃতি কবিতায় রয়েছে তাঁর সেই অনুরাগের পরিচয়। কিন্তু স্বদেশের দুঃখমূর্তি তাঁর চোখে প্রকট হলো বেশি। এ সম্বন্ধে তাঁর তসবীর-ই-দর্দ (ব্যথার ছবি) নামক কবিতা (১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে রচিত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার কয়েকটি চরণ এই :

আমার কাহিনীর এ প্রার্থনা নয় যে ধৈর্য ধরে তোমরা শুনবে।
স্তব্ধতাই আমার বাণী, ভাষাহীনতাই আমার ভাষা।।

হায় হিন্দুস্থান, তোমাকে দেখে কেবল উদ্গত হয় আমার অশ্রু।
সব কাহিনীর মধ্যে তোমার কাহিনী স্মরণ করায় অপরাধ।।

আকাশের আস্তিনে সুকানো রয়েছে বজ্র।
এই বাগানের বুলবুলিরা তাদের কুলায়ে নিশ্চিন্ত না থাকুক।।

তাঁর স্বদেশবাসীদের তিনি বলেন “ছিন্ন জপমালা” সেই জপমালা তিনি আবার দেখতে চান গ্রথিত; অদূরদর্শী ভারতবাসীকে তিনি বলেন সমস্ত অভিমান বিসর্জন দিতে একতার পথে অগ্রসর হতে।

ইয়োরোপে গিয়ে মুসলমান দেশসমূহের দুর্দশা ও বিপদ সম্বন্ধে তিনি বেশি সচেতন হন ও স্যার আবদুল্লাহ সুহরাওয়ার্দি প্রভৃতির সঙ্গে Pan Islam Society গঠন করেন।

দেখা যাচ্ছে ভারতের দুর্দশা, আর বিশেষ করে মুসলমান-দেশসমূহের বিপদ, তাঁকে পরিচালিত করেছে তার আমিত্ব-তত্ত্বের পানে। একালের মুসলমান চিন্তাশীলদের মধ্যে সৈয়দ জামালুদ্দিন আফগানীর কাছে তিনি বিশেষভাবে ঋণী। আফগানী উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের লোক। ধ্বংসশীল মুসলিম জগতের কানে তিনি দেন বিজ্ঞান অনুশীলনের ও রাষ্ট্রশক্তি লাভের মন্ত্র। তাঁর মন্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম-দেশসমূহে ফলপ্রসূ হয়েছে। কিন্তু এই মনীষী প্রধানত গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক প্রচারকের ব্রত। ইকবাল আরো গভীর করে উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেন মুসলমানের পতনের কারণ। তিনি বুঝলেন, তাদের পতনের মূলে সুফীমতের আত্মবিসর্জন ও বৈরাগ্য বাদ–সেই আত্মবিসর্জন ও বৈরাগ্য-বাদ পরিহার করে তাদের হতে হবে আত্মবিকাশশীল ও সংসারে বরেণ্য।

এই ধরনের আত্ম-তত্ত্বের সন্ধান তিনি যে পান জার্মান দার্শনিক নীটশের কাছ থেকে একথা ডক্টর নিকলসন বলেছেন। তাঁর কথা মিথ্যা নয়। তবে নীটশের শক্তিবাদে ও ইকবালের শক্তিবাদে বড় রকমের পার্থক্যও রয়েছে। নীটশে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী এবং নারী ও জনসাধারণের মূল্য ও মর্যাদায়ও অবিশ্বাসী; ইকবাল ঈশ্বরে বিশ্বাসী আর পুরোপুরি গণতান্ত্রবাদী না হলেও জনসাধারণের মহত্তর সম্ভাবনায় আস্থাবান; নারীকে তিনি নরের সমকক্ষ জ্ঞান করেন, তবে নারী-প্রকৃতির মাধুর্য ও সৌন্দর্য তাঁর শ্রদ্ধার সামগ্রী, নারীকে তিনি দেখতে চান সুগৃহিণী ও জননী রূপে।

আমাদের মনে হয়েছে ইকবালের শক্তিবাদ নীটশের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও এর লালনে বিশেষ সাহায্য করেছে গ্যেটের ব্যক্তি ও চিন্তাধারা। গ্যেটের প্রতি ইকবাল যথেষ্ট শ্রদ্ধাবান; তাঁর “প্রতীচ্য-প্রাচ্য-দিউয়ানের স্মরণে ইকবাল লিখেছেন পায়াম-ই-মশরেক (প্রাচ্যের বার্তা), তাঁর বিখ্যাত Six Lectures- এ তিনি উদ্ধৃত করেছেন গ্যেটের কবিতা। মানুষের আমিত্ব যে লালনের ও বিকাশের সামগ্রী, বিসর্জন দেবার জন্য নয়, এই মত যেমন ব্যক্ত হয়েছে গ্যেটের বহু লেখায় তেমনি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্বে। এ সম্পর্কে কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ করা হচ্ছে :

(১) গ্যেটে তার ছেলেবেলায় এক অভিনব পদ্ধতিতে ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর পিতা অনেক খনিজ দ্রব্য সগ্রহ করেছিলেন। একদিন চুপে চুপে সে-সব তিনি একখানি সুদর্শন কাষ্ঠখণ্ডের উপরে সাজালেন। এসব হলো প্রকৃতির বৈচিত্র্যের প্রতীক; আর সেই খনিজ দ্রব্যের স্তূপের উপরে প্যাসটেল’ পেন্সিল রেখে তাতে আগুন ধরালেন উদীয়মান সূর্যের দিকে আতস-কাঁচ ধরে–উদ্দেশ্য, এইভাবে প্যাসটেলে আগুন ধরে যে ধুম কুন্ডলী পাকিয়ে উঠবে তা হবে প্রকৃতির বৈচিত্র্যের উপরে মানুষের মনের স্তরের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু প্যাসটেল পেন্সিল পুড়ে নিচে কাষ্ঠখণ্ডে আগুন ধরে ও তা নষ্ট হয়ে যায়। এই ঘটনার উপরে গ্যেটে এই মন্তব্য করেছেন : এই ধরনের ঈশ্বরলাভের বাসনায় সর্বদা যে বিপদ বিদ্যমান এই দুর্ঘটনাকে গণ্য করা যেতে পারে সে-সম্বন্ধে এক সঙ্কেত ও সাবধানবাণীর তুল্য। ইকবাল বলেছেন, ব্যক্তিত্ব ঈশ্বরের বিসর্জন দেবার জন্য নয় বরং পরম-ব্যক্তি ঈশ্বরের গুণ আত্মস্থ করে বিকশিত হবার জন্য।

(২) গ্যেটে তাঁর বিখ্যাত ‘নরদেবতা’ (Divine) কবিতায় বলেছেন; সমস্ত প্রকৃতি অন্ধ নিয়মের দ্বারা শাসিত, কেবল মানুষের মধ্যেই আছে বিবেক, এর দ্বারা সে ভালমন্দের বিচার করে, যা মহৎ তাকে লালন করে, দেবতা বলতে যে মহিমার ধ্যান তারা করে সেই মহিমার প্রতিমূর্তি তারা হোক।

(৩) গ্যেটে নিরঙ্কুশ যুক্তিবাদের বিরোধী ছিলেন; তিনি বলেছেন : যাতে ভাবের মুক্তি আনে কিন্তু সেই অনুপাতে আত্মজয় এনে দেয় না তা অনিষ্টকর। তাঁর ‘ফাউসট’ নাটকে শয়তানকে বলা হয়েছে অস্বীকৃতিপরায়ণ আত্মা– The sprit that denies- অর্থাৎ মানুষের বা জগতের মহৎ সম্ভাবনায় সে অবিশ্বাসী, সে শুধু পরিচ্ছন্ন বুদ্ধির অধিকারী। ইকবাল আমিত্বের সাধনায় প্রেমের স্থান দিয়েছেন বুদ্ধির উপরে।

(৪) গ্যেটে দেখতেও ছিলেন অসাধারণ। যৌবনে তাঁকে বলা হতো Apollo আর বার্ধক্যে বলা হতো Jupiter’ নেপোলিয়ন তাঁকে দেখে বলেছিলেন Voila un hornme! (একটা মানুষ বটে!)।

(৫) ধর্মজীবন সম্বন্ধে গ্যেটে বলেছেন নিজেকে শ্রদ্ধা করাই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, অবশ্য এই শ্রদ্ধা অহমিকা দুরাকাঙ্ক্ষা বর্জিত।

(৬) গ্যেটের একটি বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি চরণ এই :

কেউ পড়তে পারেনা নাস্তি’তে;
অব্যয় বাস করে সবার মধ্যে।
ধন্য হও তাই সত্তায়।
সত্তা চিরন্তন, নির্ধারিত নিয়মে
রক্ষা পায় তার চিরজীবন্তু সম্পদ;
তাতেই বিশ্বের মহিমময় রূপায়ণ।

নীটশে ছিলেন জরাথুস্ত্র, সীজার, হজরত মোহাম্মদ, গ্যেটে, মিরাবো প্রভৃতির ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। হজরত মোহাম্মদের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তার এক সঙ্গী বলেছেন যে, তাঁর মুখের পানে তারা চাইতে সাহস করতেন না। আমাদের মনে হয়েছে হজরত মোহাম্মদের যে বিখ্যাত বাণী “আল্লাহর গুণে বিভূষিত হও,” আর মনসুর হাল্লাজের যে বিখ্যাত উক্তি “আনাল হক’ (সোেহহম), এ-সবের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইকবালের নীটশে গ্যেটে-অনুপ্রাণিত ও লালিত শক্তিবাদ, আর শেষে তার অবলম্বন হয়েছেন হজরত মোহাম্মদ, তাকে তিনি বলেছেন “ইনসান, ই কামেল” পূর্ণমানুষ Superman.

প্রাচ্যে আমিত্বকে সাধারণত ভাগ করা হয়েছে দুইভাগে– রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়- “পাকা-আমি” আর “কাঁচা-আমি। কাঁচা-আমি অজ্ঞান তাড়িত দুর্বল উদব্যস্ত ‘আমি’, আর পাকা–আমি ঈশ্বরে বা সত্যে সমর্পিতচিত্ত প্রশান্ত আমি’। সেই ‘আমি’ সম্পর্কে

বুদ্ধদেব বলেছেন :

তোমরা নিজেরা নিজেদের প্রদীপ হও; নিজেরা নিজেদের আশ্রয়স্থল হও;

গীতা বলেছেন :

নিমিত্ত মাত্র হও– ভগবানের হাতের যন্ত্র হও;

বাইবেল বলেছেন :

জগতের অধিস্বামী হবে সহিষ্ণরা;

কোরআন বলেছেন :

আল্লাহতে বিশ্বাস করো ও ভাল কাজ করো…..আল্লাহর পথে সগ্রাম করে চলো;

সুফীরা বলেছেন :

মরার আগে মরে যাও। এসবের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই ঠিক তা নয়, এসব কথা মানুষের ইতিহাসকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে সেদিকে তাকালে বরং যথেষ্ট পার্থক্যই চোখে পড়ে। তবে এসবের মধ্যে খুব মিল এইখানে যে সর্বত্রই মানুষকে বলা হয়েছে বিক্ষুব্ধ প্রাত্যহিক জীবনের উর্দ্ধে উঠতে, আর প্রশান্তিকে জ্ঞান করা হয়েছে বিশেষ কাম্য।

ইকবালের যে ‘আমি’ সেটি কি প্রাচ্যের এই পরিচিত পাকা-আমি? শোনা যাক ইকবাল কি বলেন :

আমিত্বের স্বরূপ হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা;
প্রতি কণায় ঘুমিয়ে আছে আমিত্বের বীর্য।
জীবন লুকিয়ে আছে অন্বেষণে,
এর মূল নিহিত রয়েছে চাই-মন্ত্রের মধ্যে।
জ্ঞান হচ্ছে জীবন রক্ষার একটি উপায়,
জ্ঞানের কাজ আমিতুকে শক্তিমান করা।
আমি-রূপ যে আলো-কণিকা
তা এই মাটির তলায় লুকানো স্ফুলিঙ্গ।
প্রেমের দ্বারা বর্ধিত হয় এর বায়ু–
আরো তাজা হয়, আলো জ্বলে, আরো ঝলমল করে।

ইকবালের যে ‘আমি’, বোঝা যাচ্ছে, তা বিকাশের তাড়নায় চঞ্চল– প্রশান্ত ঠিক নয়। কিন্তু এই ‘আমি’ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন :

এক মুঠা ধূলি দিয়ে করো সোনা তৈরি,
পূর্ণ মানুষের দ্বারের ধূলি কর চুম্বন।
ওরে বেহুশ, অনুগত হতে শেখ,
আনুগত্য থেকে জন্ম হয় কর্তৃত্বের।
যার নিজের উপরে কর্তৃত্ব নেই
তার উপরে কর্তৃত্ব করবে অন্য জন।
আল্লাহর জন্য ভিন্ন যে তলোয়ার খোলে,
সেই তলোয়ারের খাপ হয় তার বুক।
সংসারে সর্বশক্তিমানের প্রতিনিধি হওয়া আনন্দের,
প্রকৃতির উপরে স্বামিত্ব লাভ করা আনন্দের।

এসব থেকে, বিশেষ করে, শেষ চারিটি ছত্র থেকে, বোঝা যাচ্ছে প্রাচ্যের পরিচিত প্রশান্তি আর ইকবালের আমিত্বের মধ্যে যে পার্থক্য তা ঠিক শ্রেণীগত নয় মাত্রাগত। প্রশান্তি, ব্রাহ্মিস্থিতি, এসব যে কর্মহীন নয় তার প্রমাণ বুদ্ধ শিষ্যের প্রচার-ব্রত গ্রহণ, অর্জনের আত্মীয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ, সুফীর সৃষ্টির সেবা (খেদমতে খলক)–তবে প্রাচ্যের এই সুপরিচিত প্রশান্তির প্রবণতা সাধারণত দাঁড়িয়েছে কর্মহীনতার দিকে, সেই দিক দিয়ে ইকবালের সদা সক্রিয় আনন্ত্য লোলুপ আমিত্বের সাধনা এ যুগের প্রাচ্যে–শুধু মুসলমান-জগতে নয়– বিশেষভাবে অর্থপূর্ণ, এবং সেই দিক দিয়ে তিনি–এযুগের প্রাচ্যের এক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। এশিয়া আফ্রিকার সব চাইতে বড় প্রয়োজন যেটি সেটি হচ্ছে তার জড়তা বিসর্জন আর প্রাত্যহিক জীবনকে সুন্দরতর মহত্তর করবার আগ্রহ। এ-আগ্রহ ব্যক্ত হয়েছে এ কালের প্রাচ্যের বহু কর্মী ও ভাবুকের বাণীতে। সেই আগ্রহ ইকবালের কাব্যে ধারণ করেছে এক প্রবল, অগ্নিশিখার মতো মোহন, রূপ। তাই তিনি যে এ যুগের তরুণ-সমাজের আপাতত মুসলিম তরুণের প্রাণের মানুষ হয়েছেন, এ অনেকটা অপরিহার্য।

কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই পর্যন্তই আমি ইকবালের সাহচর্য উপভোগ করতে পারি। এর পরে সেই আমিত্বের সাধনায় যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, সেখানে ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা, ঐতিহ্যের মূল্য নিরূপণ, ইত্যাদি গুরু ও জটিল বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পার্থক্য তা হয়ত মূলগত মনে হয় তিনি বিশ্বাস করেন প্রাচীন ধর্ম ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন সম্ভবপর ও কাম্য, আমার ধারণায় তা এক অসম্ভব ব্যাপার “যে কাল যা সৃষ্টি করে তাতে মেটে সেই কলেরই প্রয়োজন”[১৬] –অতীত থেকে পাওয়া যেতে পারে কিছু প্রেরণা যদি সংকল্প সাধু হয়। সেজন্য কবি-ইকবালের সঙ্গে তুলনায় চিন্তানেতা ইকবাল আমার কাছে কিছু স্বল্পমূল্য[১৭] এবং আমার এমন আশঙ্কাও আছে যে চিন্তানেতা নীটশে যেমন পরোক্ষভাবে ইয়োরোপের বর্তমান ধ্বংসলীলার কারণ হয়েছেন তেমনি ইকবালের চিন্তাধারারও এমন অপব্যাখ্যা সম্ভবপর–এমন অপব্যাখ্যা বঙ্কিমচন্দ্রের চিন্তাধারায় হয়েছে যার ফলে তার মনুষ্যত্ব ও প্রতিভা তার স্বদেশীয়দের আনন্দের কারণ না হয়ে দুঃখের কারণ হতে পারে দীর্ঘদিনের জন্য। –শক্তিবাদ ও শান্তি-বাদ দুই থেকেই সময় সময় যে কুফল ফলে সে সম্বন্ধে Religion of Mar গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের এই দুটি উক্তি স্মরণীয় :

শক্তিবাদ সম্পর্কে–

সংগ্রামশীল ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে স্বভাবতযুক্ত দৈহিক বলবিক্রম–সেই ইচ্ছা শক্তি যখন তার পূর্ণ দায়িত্ব ও সার্থকতা থেকে বঞ্চিত হয় তখন থেকে জন্মলাভ করে দুর্দমনীয় লোভ, সূচনা হয় অন্তরে বস্তুর দাসত্ব, আর শেষে বিচিত্র স্বার্থবুদ্ধির ঘাত-প্রতিঘাতে দুরাকাতক্ষার সৌধচূড়া ধূলি-ধূসরিত হয়।

শান্তিবাদ সম্পর্কে–

প্রবল প্রাণশক্তির কর্মধারা যেমন পরিণত হতে পারে অর্থহীনতায় যার ফলে আত্মা নিপীড়িত হয় বস্তুসমারোহে, তেমনি ইচ্ছালোপের যে শান্তি তা পরিণত হতে পারে মৃত্যুর শান্তিতে, আমাদের আন্তর্লোক তখন হয়ে ওঠে অসংলগ্ন স্বপ্নের রাজ্য।

ইকবালের অর্থপূর্ণ প্রভাবকে এই অবাঞ্ছিত পরিণতি থেকে রক্ষা করা প্রত্যেক চিন্তাশীল কর্মীর কর্তব্য; তাঁর ভক্তদের উপরে তো এই দায়িত্ব বিশেষভাবেই ন্যস্ত। এই উদ্দেশ্যে ইকবালের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উদযাপিত জীবন স্মরণে রাখার যোগ্য। আকাক্ষা (আরজুর) মহিমা কীর্তন তিনি একান্তভাবে করেছেন, কিন্তু নিজেকে বারবার বলেছেন ফকীর–নিঃস্ব–আর তার এই নিঃস্বতা নিলোভ, পদস্থ ও বিত্তশালীর দ্বারস্থ তিনি হননি কোনোদিন, অযাচিত সাহায্যও তিনি করেছেন প্রত্যাখ্যান। বারবার তিনি বলেছেন– আমিত্বের বিকাশ ব্যহত হয় যাঞ্চার দ্বারা আর সমদ্ধ হয় আকতক্ষার দ্বারা। অন্য কথায়, তার এই ‘আকাভার অর্থ হচ্ছে মহত্তের পথে অতন্দ্রিত প্রয়াস, গ্যেটে যেমন বলেছেন :

জীবন আর স্বাধীনতা তারই লভ্য ও ভোগ্য
যে প্রত্যহ নতুন করে জয় করে এদুটি।

আর সেই সঙ্গে দরকার এই তিনটি বড় বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা : প্রথমত, তিনি মুসলমানের উন্নতি প্রাণভরে চেয়েছেন–

প্রভু, মুসলমানের অন্তরে এক জাগ্রত আকাক্ষা দাও,

কিন্তু বুঝতে হবে, সমস্ত মানুষের, সমস্ত জগতের, উন্নতি উপেক্ষা করে তিনি মুসলমানের উন্নতি চাইতে পারেন না, চাইলে তার সত্যপ্রীতি ও আল্লাহ-প্রীতি হয় অর্থহীন। তিনি কবি, তাই বিশিষ্ট, concrete তাঁর প্রিয়, মানুষের কথা তত না ভেবে মুসলমানের কথা বেশি ভাবা সেজন্য তাঁর পক্ষে কতকটা অপরিহার্য, বিশেষ করে তাঁর চারপাশের মুসলমানের এমন পতিত দশায়। দ্বিতীয়ত, আমিত্বের যে-বিকাশ তিনি চেয়েছেন তা রাতারাতি হবার মতো ব্যাপার নয়। তাই সাধনাহীন হয়ে তাড়াতাড়ি ফল চাইতে গেলে এ-ক্ষেত্রে অনর্থ ভিন্ন আর কিছুই সম্ভবপর নয়। এ সম্বন্ধে বাউল-কবির সতর্কবাণী চির শ্রদ্ধেয় :

নিঠুর গরজী, তুই মানুষ-মুকুল ভাজবি আগুনে!
তুই ফুল ফুটাবি বাস ছুটাবি সবুর বিহনে!
চেয়ে দ্যাখ মোর পরম শুরু সাঁই,
তিনি যুগ যুগান্তে ফুটান কমল তার তাড়াহুড়া নাই।

তৃতীয়ত, বর্তমান ইয়োরোপীয় সভ্যতা থেকে তিনি যে মুখ ফিরিয়েছেন তাকে ধ্বংসেম্মুখ জ্ঞান করে তাঁর শেষ বয়সের একটি লেখায় ইয়োরোপ সম্পর্কে তিনি বলেছেন “এই সওদাগরের মৃগ নাভিও কুকুরের নাভি ভিন্ন আর কিছু নয়”[১৮], আর বরণীয় জ্ঞান করেছেন প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা, সেক্ষেত্রে দৃষ্টির পরিচয় না দিয়ে দৃষ্টি বিভ্রমেরই পরিচয় তিনি দিয়েছেন বেশি, কেননা, সমস্ত ত্রুটি বিচ্যুতি সত্ত্বেও, ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি অকুণ্ঠিত মানব-কল্যাণ-জিজ্ঞাসা মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ আত্মিক সম্পদ প্রাচ্যের আমিত্ব সাধনের বা প্রশান্তি সাধনের চাই তার পরিপূরক, প্রতিদ্বন্দ্বী নয়।

ইকবালের মহৎ বেদনা মহৎ সার্থকতা লাভ করুক।

১৩৪৯, ইকবাল স্মৃতিবার্ষিকী রাজশাহী কলেজ।

—————

১৬. গ্যেটে-ফাউস্ট-প্রথম দৃশ্য।

১৭. ইকবালের ইংরেজি জীবনী “The poet of the East” এ ভূমিকায় ডক্টর নিকলসন বলেছেন : The assinities with Neitzsche and Bergson need not be emphasised. It is less clear, however, why Iqbal identifies his ideal society with Mohammed’s conception of Islam, or why membership of that society should be a privilege reserved for Moslems. Here the religious enthusiast seems to have knocked out the philosopher- a result which is logically wrong but poeti cally right.

১৮. মুষকে ইনসওদাগর নাফে সগস্তু

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *