গ্যেটে
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
সুবিখ্যাত দার্শনিক ক্রোচে গ্যেটে সম্বন্ধে যে বইটি লিখেছেন তাতে গ্যেটের মনীষা ও কাব্য সম্বন্ধে নানা বিচার বিশ্লেষণের পর বলেছেন–সাহিত্যের ক্রমবর্ধনের ধারায় গ্যেটের স্থান কি তা নির্দেশ করতে তিনি অক্ষম। বলা বাহুল্য, এ অক্ষমতার অন্য নাম আপত্তি, কারণ তাঁর মতে প্রত্যেক কবি হচ্ছেন এক একজন স্বতন্ত্র স্রষ্টা, আর তাঁর সৃষ্টির বিষয় হচ্ছে তাঁর নিজের ব্যক্তিত্ব, তাঁর জীবনের সঙ্গে যার অবসান; পরে পরে যারা আসেন তারা যদি সত্যকার কবি হন তবে নূতন-কিছু সৃষ্টি করেন, আর তা না হলে অনুকরণ করেন, কিন্তু অনুকারীর স্থান কাব্যের ইতিহাসে সত্যই নেই। তবু তিনি স্বীকার করেছেন–
…in Goethe’s poetry, in his rich, varied, impressionable and highly intelligent mind were mirrored for the first time in conspicuous fashion many sides of the modem spirit. [গ্যেটের কাব্যে, তার সারবান বৈচিত্র-বিলাসী রূপগ্রাহী ও প্রখরবুদ্ধি মনে প্রথম স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় আধুনিকতার বহু দিক।]
অনেক সাহিত্যিকই গ্যেটের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু তার সম্বন্ধে সব চাইতে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা বোধ হয় কার্লাইলের। তিনি তাঁর Hero and Hero worship গ্রন্থে Hero as iman of letters অধ্যায় গ্যেটের কথা দিয়ে শুরু করেছেন, এবং গ্যেটের প্রতিভা যে জগতে এক নূতন বিস্ময়ের সামগ্রী, যে-হজরত মোহাম্মদের তিনি অত্যন্ত প্রশংসা করেছেন তাঁর প্রতিভার চাইতেও যে গ্যেটের প্রতিভা উচ্চতর গ্রামের, ইত্যাদি কথা বলবার পর বলেছেন– গ্যেটের কথা থাকুক, কেউ আপাতত তাকে বুঝবে না। এই বলে তিনি রুসো বার্ণস প্রমুখ সাহিত্যিকদের মাহাত্ম কীর্তনে মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু ক্রোচে যে গ্যেটের প্রতিভাকে modern spirit-এর (আধুনিকতার) এক বড় প্রতীক বলেছেন সেইটি ভাল করে বুঝতে পারলে গ্যেটের সঙ্গে আমাদের সত্যকার পরিচয় হয়ত খানিকটা হবে।
গ্যেটের ভিতরে এই যে সুবৃহৎ নূতন মন, বলা যেতে পারে, Renaissance (নবজাগরণ)–সূচিত মানসিকতার তা এক বড় পরিণতি। শিক্ষিত ব্যক্তিরা জানেন, ইয়োরোপের Renaissance কয়েক শতাব্দীব্যাপী ব্যাপার, বহু লক্ষণের দ্বারা জটিল, আর তা শুধু সৌন্দর্য ও আনন্দের কাহিনীই নয়, সেই সৌন্দর্য ও আনন্দের সঙ্গে মিশে রয়েছে অনেকখানি কদর্যতাও টলষ্টয় তাঁর শেষ বয়সের কতগুলো রচনায় যার দিকে তাঁর বলিষ্ঠ তর্জনী নির্দেশ করেছেন। তবু এ সত্য যে Renaissance কাহিনী মোটের উপর মানুষের উষর চিত্তক্ষেত্রে পল্লবিত করবার কাহিনী, মানুষের জাগতিক জীবনের সুখ-সম্ভোগের এক করুণ মধুর কাহিনী। — কিন্তু এই Renaissance পুষ্পের সৌরভে ফ্রান্স ইতালি ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ আমোদিত হলেও তুহিনাবৃত জার্মানী বহু দিন পর্যন্ত তা থেকে বঞ্চিত ছিল। ষোড়শ শতাব্দীতে সেখানে দেখা দিল ধর্মান্দোলন Reformation, আপাতদৃষ্টিতে যা বহুদিক দিয়ে Renaissance-এর আত্মীয়তা বেশী। কিন্তু জার্মেনীর classicism–তার পূর্ববর্তী Reformation-এর বিপরীতধর্মী। অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানীর যে Classicism- প্রাচীন গ্রীক শিল্প ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় লাভের চেষ্টা– তার সঙ্গেই বরং Renaissance এর আত্মীয়তা বেশী। কিন্তু জার্মেনীর Classicism তার পূর্ববর্তী Reformation-এর বিপরীতধর্মী বোধ হলেও বাস্তবিকপক্ষে এটি Renaissance ও Reformation-এর বেশ এক সমন্বয়। এই Classicism-এর প্রবর্তকদের সৌন্দর্যানুরাগ Renaissance–এর, কিন্তু তাঁদের সত্য ও স্বদেশানুরাগ, অন্য কথায়, কল্যাণানুরাগ, Reformation-এর। এই classicism–এর এক শ্রেষ্ঠ নায়ক lessing এর একটি উক্তি খুব প্রণিধানযোগ্য। সৌন্দর্যতত্ত্ব বোঝাবার জন্য তিনি লিখেছেন aokoon, এক জগদবিখ্যাত বই, যদিও আকারে ক্ষুদ্র; তিনিই বলেছেন–ঈশ্বর যদি এক হাতে পূর্ণজ্ঞান অপর হাতে প্রয়াসের অনন্ত দুঃখ এই দুটি নিয়ে বলেন, কোনটি নেবে বলো, তাহলে বলব, পিতঃ, প্রমাদহীন পূর্ণজ্ঞান তোমাকেই সাজে, আমাকে দান কর অনন্ত প্রয়াস। [If God were to hold in his right hand all truth, and in his left hand the single everactive impulse to seek after Truth, even though with the condition that I must eternally rentain in error, and say to me. “Choose”. I would with humility fall before luis leli hand and say. “Father, Give! For pure thoughts belong thee alone.”]
জার্মেনীর এই অষ্টাবিংশ শতাব্দীর Classicism –এর শ্রেষ্ঠ প্রতীক গ্যেটে। সত্য বটে তিনি নিজেকে খ্রীস্টান বলে পরিচিত করবার জন্য ব্যগ্রতা দেখেন নি, বরং বলেছেন, “আমি পেগ্যান” (Pegan). প্রকৃতির পূজারি, (মুসলমানী ভাষায় “কাফের”), সেই পরমসৌন্দর্য প্রেমিক গ্যেটের ভিতরেও সত্যান্বেষণের বীরত কতখানি ছিল তা তার এই উক্তি থেকেই বোঝা যাবে।
“In religious scientific and political matters. I generally brought troubles upon myself because I was no Hypocrite and had the courage to experss what I selt.” [ধর্ম বিজ্ঞান ও রাজনীতি-সম্পর্কিত ব্যাপারে হু সময়ে আমি নিজের উপর বিপদ ডেকে এনেছি, তার কারণ ভন্ডামি আমার পোষাত না, আর যা মনে প্রাণে বুঝতাম তা প্রকাশ করে, বলবার সাহস আমার ছিল।]
একটা জাতির জাগরণে প্রতিবিম্বিত যেন বসন্ত ও বর্ষার নৈসর্গিক প্রাচুর্য। বসন্তের আগমনে দেখা দেয় গাছে নূতন পাতা, ডালে ডালে লাখো পাখির আনন্দ-গান; বর্ষায় দেখতে দেখতে নদী নালা ভরে ওঠে উপরের নিরন্তর বর্ষণে,–একটা জাতির জাগরণ সময়ে তিন একই সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু কর্মীর আবির্ভাব ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মান জাগরণে দেখতে পাই-চিত্রের ক্ষেত্রে Oeser. Winckelmann; সাহিত্যে Klopstock, Herder, Wieland, Goethe, Schiller, দর্শনে Kant, Schelling, Hegel, Schopenhauer; সমালোচনায় Schlegel; সঙ্গীতে Mozart, Beethoven ….. ইত্যাদি এ যেন দেখতে দেখতে গগন বিদীর্ণ করে দাঁড়ালো বিচিত্ৰশীর্ষ এক বিরাট পর্বত! বিশেষজ্ঞরা বলেন– এই শৃঙ্গমালার উচ্চতম মহত্তমটির নাম গ্যেটে।
গ্যেটের চরিতখ্যায়ক Lewes বলেছেন–
…..of all the failings usually attributed to literary men Goethe had the least of what could be called jealuosy; of all the qualities which sit gracefully on greatness he had the most of magnanimity. [সাহিত্যিকজনসুলভ দুর্বলতার মধ্যে ঈর্ষাততে ছিল না বলেই চলে; মহত্তের শোভাবর্ধক গুণাবলীর মধ্যে মহানুভবতা তাঁতে ছিল অপর্যাপ্ত।]
এ আদৌ অতিরঞ্জন নয়। এই অসাধারণ প্রতিভা তার প্রতিভার ভারে আদৌ টলটলায়মান হন নি। কত সহজভাবে তিনি বলেছেন
……Even the greatest genius won’t go far is he tried to owe everything to his own internal sell. But many very good men do not comprehend that and they grope in darkness for half a life with their dream of originality…..I by no means owe my work to my wisdom alone, but a thousand things and persons around me who provided me with material. There were fools and sages, minds enlightened and narrow, childhood, youth and mature age-all told me what they felt, what they thought, how they lived and worked and what experience they had gained; and I had nothing further than to put out my hand and reap what others had sown for me. [শুধু অন্তর-সত্তার উপরে নির্ভর করে শ্রেষ্ঠতম প্রতিভাও বেশি দূর অগ্রসর হতে পারবেন । কিন্তু অনেক সাধু সঞ্চয় ব্যক্তি একথা বুঝে উঠতে পারেন না, আর তার ফলে তাঁদের মৌলিকতার স্বপ্ন নিয়ে অর্ধেক জীবন তারা অন্ধকারে হাড় কাটান।…..আমি যা করতে পেরেছি তা শুধু আমার নিজের জ্ঞানের ফলে কখনো নয়, আমার চারপাশের শত সহস্র বন্ত ও ব্যক্তি আমাকে যে-সব উপকরণ যুগিয়েছে তারও ফলে। মৃর্থ ও পণ্ডিত, উদারমনা ও সংকীর্ণমনা, বালক যুবক ও প্রবীণ–সবাই আমার কাছে ব্যক্ত করেছে কি তারা অনুভব করেছে চিন্তা করেছে, কেমন করে তারা জীবন নির্বাহ করেছে কাজ করেছে, ও কি অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছে; আমার কাজ হয়েছিল এরা যা আবাদ করেছে হাত বাড়িয়ে তাই সংগ্রহ করা।]
অন্যত্র তার পূর্ববর্তী Winckelmann, Lessing. Herder প্রভৃতির নিকট তার ঋণ তিনি বার বার স্বীকার করেছেন। কিন্তু তবু এ সত্য যে গ্যেটে যদি অপরিসীম কীর্তি মণ্ডিত গ্যেটে না হতেন তাহলে তার পূর্ববর্তীদের মাহাত্ম্য অমন পরিকীর্তিত হবার সম্ভাবনা কম ঘটত –যেমন, কোনো পরিবারকে লোকচক্ষুতে গৌরবমণ্ডিত করেন তার বহু স্বল্পকীর্তি সন্তান নন, তার একজন অতুলকীর্তি সন্তান। তাই গ্যেটে নিজে তার মাহাত্ম্য বিশ্লেষণে উদাসীন হলেও তাকে যারা বুঝতে চান তাদের পক্ষে সে-ঔদাসীন্য অসার্থক।
১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে Frankfort নগরে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারে গ্যেটের জন্ম হয়। তাঁর আত্মচরিতে তিনি তাঁর বাল্যজীবনের ছবি নিপুণ হস্তে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর সেই বাল্য-কাহিনীতে বেশী করে চোখে পড়ে দুইটি ব্যাপার তার স্বভাবদত্ত প্রতিভা আর তাঁর পিতার শিক্ষা-ব্যবস্থা। তিনি যখন সাত আট বৎসরের বালক তখন এক প্রচণ্ড ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। তিনি তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেন, এই ঘটনা তার বালক-মনের উপরে গভীর রেখাপাত করে। সবারই মুখে যিনি দয়াল প্রেমময় ইত্যাদি নামে পরিকীর্তিত তারই সামনে এমন ধ্বংস কি করে সম্ভবপর, সেই চিন্তায় তাঁর চিত্ত কিছুদিন ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে। কিন্তু তার স্বভাবত সৌন্দর্যানুরাগী মনে এ দুশ্চিন্তার ভার স্থায়ী হয় নি। তার উপর ধর্ম সম্বন্ধে বহু বাদানুবাদ তিনি অনেক সময়েই শুনতেন। এইসব থেকে ইহুদি-পুরাণের দোর্দণ্ডপ্রতাপ ক্রোধপরায়ণ ঈশ্বরে অপ্রত্যয় ও প্রকৃতির অধীশ্বর শান্ত সুন্দর ঈশ্বরে প্রত্যয় তাঁর বালক-মনে প্রবল হতে থাকে। কিন্তু এই ঈশ্বরকে তিনি কেমন করে তার অন্তরের পূজা নিবেদন করবেন। তাঁর পিতা বহু খনিজ দ্রব্য সগ্রহ করেছিলেন, তিনি ঠিক করলেন সেইসব খনিজ দ্রব্য প্রকৃতির বৈচিত্র্যের প্রতীকরূপে একখানি সুদর্শন কাষ্ঠখণ্ডের উপরে সাজাবেন। কিন্তু কেমন করে মানুষের মনের স্তব পরিব্যক্ত হবে? শেষে ঠিক হলো তাঁর ছবি আঁকার Pastel পেন্সিল সেই সব ধাতুদ্রব্যের উপরে দাঁড় করিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন, তা থেকে যে ধূম কুন্ডলী পাকিয়ে উঠবে সেই হবে মানুষের মনের স্তরের প্রতিচ্ছবি। –এক প্রভাতে তিনি এইভাবে ঈশ্বরের প্রতি স্তুতি নিবেদন করলেন Pastel পেন্সিলে আগুন ধরালেন উদীয়মান সূর্যের দিকে আতস-কাঁচ ধরে। কিন্তু এই স্তব নিবেদনের এক মন্দ ফল ফলেছিল–Pastel পেন্সিল পুড়ে গিয়ে সেই সুদর্শন কাঠখণ্ডে আগুন ধরেছিল, আর তাতে তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এর উপরে গ্যেটে একটি সুগভীর মন্তব্য করেছেন
The accident might almost be considered a hint and waming of the danger there always is in wishing to approach the Deity in such a way. [এইভাবে ঈশ্বরের উপলব্ধি-চেষ্টায় যে বিপদ এই দুর্ঘটনাকে গণ্য করা যেতে পারে সেই সম্বন্ধে সঙ্কেত ও সাবধান-বাণীর তুল্য।]
তাঁর বাল্য-জীবনের অপর একটি লক্ষ্যযোগ্য ঘটনা এই : একদিন স্কুলে তাঁর সহপাঠীরা এই বলে তাঁকে জব্দ করতে চেষ্টা করে যে তাঁর পিতা তাঁর পিতামহের ছেলে নন, অন্য কোনো বড় লোকের ছেলে (তাঁর পিতামহ দর্জি ব্যবসায়ী ছিলেন)। সঙ্গীদের এই নির্মম কথার উত্তরে বালক গ্যেটে শান্তকণ্ঠে বলেছিলেন এ যদি সত্য হয় তাতেই বা এমন কি ক্ষতি, জীবন এমন এক মহা দান যে এর জন্য কার কাছে কে ঋণী সে কথা না ভেবেও পারা যায়, কেননা এতটুকু তো সত্য যে ঈশ্বরের কাছ থেকেই তা’ এসেছে, আর তার সামনে সবাই সমান।
তাঁর পিতা উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি ছিলেন; কিন্তু নিজে জীবনে বেশী কিছু করতে পারেন নি। তাঁর ব্যর্থ জীবন তাঁর পুত্রের ভিতর দিয়ে সার্থকতা লাভ করুক এই ছিল তাঁর সাধনা। পুত্রকে প্রায় সর্ববিদ্যাবিশারদ করবার আয়োজন তিনি করেছিলেন। কলেজে প্রবেশের পূর্বে চৌদ্দ পনের বৎসর বয়সে গ্যেটে মাতৃভাষা ভিন্ন ল্যাটিন, ইতালীয়, হিব্রু, গ্রীক, ফরাসী, ও ইংরেজি শিখেছিলেন এর উপর চিত্রাঙ্কন, নৃত্যগীত, অসিচালনা, উদ্যানরচনা ইত্যাদিতেও অভ্যস্ত হয়েছিলেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন করেন। কিন্তু প্রথমে Leipsig এ গিয়ে তিনি তা করেন নি। পরে Strasburg এর তিনি আইন অধ্যয়ন করেছিলেন। কিন্তু তার প্রাণের সামগ্রী বারবারই ছিল কাব্যচর্চা ও চিত্রাঙ্কন।
গ্যেটের সাহিত্যিক গুরুদেব কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের সাহায্যে তার জ্ঞান দিন দিন গভীরতর হচ্ছিল। কিন্তু তাঁর কাব্যের সত্যকার উৎস তাঁর এই গুরুদেব প্রেরণা তত নয় যত তার নিজের প্রণয় ব্যাপার। সেই প্রেমের দহন তিনি সারাজীবন ভোগ করেছেন। বাস্তবিক, গ্যেটের ভিতরে একই সঙ্গে দুই অদ্ভুত ধারা যথেষ্ট লক্ষ্যযোগ্য একটি জ্ঞানান্বেষণ, অপরটি প্রেমবিধুরতা।
গ্যেটের প্রণয়-কাহিনী তাঁর জীবন ও কাব্যের ইতিহাসে খুব বড় জায়গা দখল করে আছে। কিন্তু এখানে তাঁকে ভুল বুঝা এতই স্বাভাবিক যে তার স্বদেশবাসীরাও বহুকাল পর্যন্ত তাঁকে এ ব্যাপারে নিকৃষ্ট রঙ্গে রঞ্জিত করে এসেছেন। আমাদের জন্য ব্যাপারটি আরো কঠিন এইজন্য যে আমাদের সংস্কার বিভিন্ন, তা যতই কেন আমরা ইয়োরোপের প্রতি প্রীতি-সম্পন্ন না হই।
দৃষ্টান্তস্বরূপ ধরা যেতে পারে Frau von Stein এর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘকালব্যাপী সম্বন্ধ। তার চরিতাখ্যায়কদের কেউ কেউ বলেছেন, গ্যেটে ও Von Stein পত্নীর সম্বন্ধ মোটের উপর একটি প্রগাঢ় বন্ধুত্বের সম্বন্ধ, তার বেশ কিছু নয়; অপরে এ মত আদৌ গ্রাহ্য করেন নি। তেমনিভাবে জটিল বৃদ্ধবয়সে যুবতী বন্ধুপত্নী Marianne Von Willemer সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ– যা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল হাফিজের অনুসরণে তার সুবিখ্যাত West-Eastem Divan কিন্তু এর জন্য যাঁরা তাঁকে ইন্দ্রিয়পরতন্ত্র বলতে চান তাদের মত গ্রহণ করতে আমাদের বাধে এইজন্য যে কবির অন্তরাত্মা প্রতিবিম্বিত হয় যাতে সেই কাব্যে গ্যেটে যে প্রেমের ছবি অঙ্কিত করেছেন তাতে ফুটে রয়েছে এক আশ্চর্য পবিত্রতা। তাঁর Sorrows of Werther এ ভোর্টের Albert এর বিবাহিতা Charlotte-র প্রেমে আত্মহারা; সে এক জার্মান “মজনু” কিন্তু সেই Werther ই এক জায়গায় বলেছেন– “Is not me love for her the purest. most holy has my soul ever been sullied by a single sen sual desire?” [তাঁর প্রতি আমার প্রেম পরম শুদ্ধ পরম পবিত্র নয় কি?…. আমার অন্তরাত্মা কি কখনো একটি ভোগাতক্ষার দ্বারাও কলুষিত হয়েছে।]
তার “Elective affinities” গ্রন্থে নায়ক Eduard তাঁর স্ত্রীকে বিস্মৃত হয়ে Ottile-র প্রেমে পাগল হয়েছেন; কিন্তু Ottile তাঁর কাছে দেববিগ্রহের মতো পবিত্র, Ottile –এর একটু ইঙ্গিতে কঠোরতম সংযমে তিনি নিজেকে বাধছেন। ক্রোচে বলেছেন, Faust প্রথম খণ্ডে Margaret এর সঙ্গে Faust এর সম্বন্ধ ইন্দ্রিয়পরতন্ত্রতা বেশী প্রকাশ পেয়েছে, Faust তার সমস্ত জ্ঞানান্বেষণ বিস্মৃত হয়ে বৃদ্ধা দূতীর সাহায্যে Margaret কে আয়ত্ব করেছেন। দূতীর মধ্যবর্তীতাই যদি ক্রোচের কাছে প্রধান আপত্তিকর ব্যাপার হয় তবে সেই কালের দোহাই দিয়ে সহজেই তাঁকে অনেকখানি নিরুত্তর করা যেতে পারে। তাছাড়া, প্রথম কয়েক দৃশ্যের সেই বিশ্বজ্ঞানের পিপাসু সুন্দর ও সবল-চিত্ত Faust যে পরে বদলে কামুক হয়ে গেছেন তা সত্য নয়। Margaret-র প্রেমে বাস্তবিকই তিনি আত্মহারা: Margaret এর কক্ষে গোপন প্রবেশ করে তিনি তার নিজের ভিতরে এক রহস্যের পরিবর্তন অনুভব করেছেন :
…And I? What drew me here with power?
How deeply am I moted, this hour!
What seek? Why so full my heart and sore?
Miscrable Faust! I Know thee now no more.
Is there a magic vapour here?
I came with lust of instant pleasure,
And lie dissolved in dream of love’s sweet liesure…”
[আর আমি? কিসের সবল আকর্ষণ আমাকে এখানে এনেছে?
কি প্রবল ভাবেই না আন্দোলিত হচ্ছে আমার অন্তর!
কি আমি চাই? কেন এখন হৃদয় আমার এমন উদ্বেলিত ও ব্যথিত?
হায় ফাউস্ট! তোমাকে আর চেনা যায় না।
এখানে কি কোনো যাদু বাষ্প আছে?
আপাত তৃপ্তির কামনা নিয়ে আমি এসেছিলাম:
কিন্তু প্রেমের স্বপ্নরসে আমি এখন নিমজ্জিত।]
তাঁর Tasso. lphigenie, প্রভৃতি গ্রন্থ থেকেও এই ধরনের প্রমাণ দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু এমনি করে তাঁর পক্ষ সমর্থন করলেও আমাদের দেশের সর্বসাধারণের কথা ছেড়ে দিয়ে শিক্ষিত-সাধারণকে নিয়েও নরনারীর এমন সম্বন্ধ কল্পনা করা খুব সহজ কি? এই সুন্দর স্বেচ্ছাচার আমাদের দেশে হিন্দু দেবদেবীর লীলায় বেশ আছে, মুসলমানের বেহেশতের প্রচলিত ধারণায় খানিকটা আছে, কিন্তু এরই ভিতর দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে শ্রেয়ে পৌঁছানো– এ আজো আমাদের সহজ ধারণার বহির্ভূত।[তবে ব্যাপারটি অন্য দিকে দিয়েও ভাবা যেতে পারে। নারীর ব্যক্তিত্ব আমরা স্বীকার করি ; সেই ব্যক্তিত্ব স্বীকার করলে গ্যেটের জীবন ও প্রয়াস হয়ত মানুষের স্বাভাবিক জীবনের ব্যাপার বলেই আমরা ধারণা করতে পারবে।]–কেউ কেউ বলেছেন, গ্যেটের ভিতরে ‘পাপ বোধ অন্যায় বোধ এসব ছিল না, মানুষের জন্য বিশেষ কোনো দরদ তিনি অনুভব করতেন , যেমন Aniel বলেছেন–
““He is a Greek of the great time, to whom the inward crises of the religious consciousness are unknown… he takes no more interest than Nature herself in the disinherited, the feeble, and the oppressed..”. [তিনি হচ্ছেন গৌরব-যুগের একজন গ্রীক ‘ধর্মবোধের’র অন্তর-বেদনা যার কাছে অজ্ঞাত। জগতের বঞ্চিত দুর্বল ও অত্যাচারিতদের প্রতি প্রকৃতির মতোই তিনি উদাসীন।]
কিন্তু এ মত যে সত্য নয় তা Amiel নিজেই সেই দিনের ডায়রীর শেষের দিকে ব্যক্ত করেছেন–
“One must never be too hasty in judging these complex natures” [এই জটিল প্রকৃতির লোকদের সম্বন্ধে তাড়াতাড়ি কোনো মত প্রকাশ করা অসঙ্গত। Amiel’s Journal-P. 187]
প্রকৃতির সমস্ত ভাঙচুর ছাপিয়ে জাগে প্রাণের সবুজ উৎসব, আমাদের মনে হয় গ্যেটের প্রতিভা ছিল প্রকৃতির মতো অপরিসীম বীর্যবন্ত, তাই তাঁর ভিতরকার সমস্ত দুঃখ-বিপত্তি বেদনা বিক্ষোভ আত্মগোপন করেছিল এক পরম রমণীয় প্রফুল্লতার অন্তরালে। এই সম্পর্কে গ্যেটে নিজেও বলেছেন
Only he who has been the most sensitive can become the hardest and coldest of men, for he has to encase himself in triple steel…and often his coat of mail oppresses him. [যিনি সব চাইতে অনুভূতিপ্রবণ কেবল তিনিই হতে পারেন সব চাইতে কঠিন ও নির্বিকার; কেননা তার পক্ষে প্রয়োজন হয় নিজেকে বহুস্তর বর্মে আবৃত করা….আর অনেক সময় এই বৰ্ম হয় তার জন্য পীড়াদায়ক।]
গ্যেটের ভিতরে একই সঙ্গে প্রেমবিধুরতা ও জ্ঞানান্বেষণ বিদ্যমান এর ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ সম্বন্ধে বহু কথা বলবার আছে– গ্যেটে সম্বন্ধে জিজ্ঞাসুদের এটি বিশেষ অনুধাবনের বিষয়। প্রেমে তিনি যেন একেবারে আত্মহারা হয়ে পড়েন আর তার আর একটি চেতনা যেন বসে বসে তার মত্ততার কাহিনী সংগ্রহ করতে থাকে। এই আশ্চর্য বাস্তবপ্রীতি, এই যেন গ্যেটে প্রতিভার সবখানি কথা। তাঁর গুরু ও বন্ধু Merk তাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন– বাস্তব (সত্য) যা তুমি তাকে দাও কাব্য-রূপ you give poet ic from to the real. তাঁর কাব্যের এর চাইতে সুন্দরতম পরিচয় হয়ত আর দেওয়া যায় না। অথচ তাঁর এই বাস্তব-প্রীতি কেন তথাকথিত realism এ (বস্তুতন্ত্রতায়) পরিণত হলো না সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন :
প্রকৃতির সঙ্গে শিল্পীর সম্বন্ধ দ্বিবিধ; তিনি একই সঙ্গে তার প্রভুত্ব ও দাস। দাস এই কারণে যে পার্থিব সামগ্রীর সাহায্যে তাঁকে কাজ করতে হয় নিজেকে বোঝাবার জন্য; আর প্রভু এই কারণে যে এইসব পার্থিব সামগ্রী তিনি উপায়ম্বরূপ ব্যবহার করেন তার উচ্চতর উদ্দেশ্য ফুটিয়ে তুলতে। সমগ্রতার সাহায্যে শিল্পী তার মনোভাব ব্যক্ত করেন। এই সমগ্রতা কিন্তু প্রকৃতিতেই নেই; এটি তার নিজের চিত্তের ফল, অথবা বলা যায়, ফল সঞ্চারী ঐশ্বরিক প্রেরণা। [The artist has a twofold relation to nature; he is at once her master and her slave.He is her slave in as much as he must work with carthly things in order to he understood. but lec is her master, in as much as he subjects these earthly mcans to his higher intentions and rnders thein subservienl. The artist would speak to the world through an entirety: however. he does not lind this entirety in nalure: but it is the snuit of his own mind, or il you like it, of the aspiration of a fructifying divine breathi.]
গ্যেটের এই ধরনের মতামত অনুসরণ করে Dr. Rudolf Steiner একটি বই লিখেছেন, তার নাম তিনি দিয়েছেন Goethe as the founder of a new Science of Esthetics. তার মূল কথা কতকটা এই প্রকৃতির ভিতরে বুঝতে পারা যায় এক উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত, মানুষের জীবনে রয়েছে তারও চাইতে বৃহত্তর উদ্দেশ্যের ইঙ্গিত, শিল্পীর রচনায় তারই প্রকাশ; যেমন গ্যেটে বলেছেন :
In that Man is placed on Nature’s pinnacle, he regards himself as another whole Nature, whose task is to bring forth inwardly yet another Pinnacle. For this purpose he heightens his powers imbuing himself with all perfections and virtues, calling on choice. order. harmony, and meaning, and finally rising to the production of the work of art, which takes a prominent place by the side of his other actions and works. Once it is brought forth, once it stands before the world in its ideal reality. it produces a permanent effect-it produces the highest effect-for as it develops itself spiritually out of a unison of forces, it gathers into itself all that is glorious and worthy of devotion and love, and thus breathing life into the human form uplifts man above himself, completes the cycle of his life and activity, deifies him for the present in which the past and future are included… [প্রকৃতির চূড়ায় অধিষ্ঠিত মানুষ নিজেকে জ্ঞান করে আর-এক পূর্ণাঙ্গ প্রকৃতি বনে, তার কাজ হচ্ছে অন্তর্লোকে আর-এক চূড়ার সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্যে সে তার ক্ষমতার উল্কর্য সাধন করে–সমস্ত সৌষ্ঠব ও গুণপণায় সে নিজেকে করে ভূষিত, নির্বাচন শৃখলা সামঞ্জস্য অবোধ, এ-সবের হয় তার বিশেষ প্রয়োজন, অবশেষে লাভ হয় তার শিল্প সৃষ্টির যোগ্যতা যা তার অন্যান্য কর্ম ও কীর্তির পাশে লাভ করে বিশেষ মর্যাদার স্থান। একবার যদি এর সৃষ্টি হয়, একবার যদি এই শিল্পসৃষ্টি জগতের সামনে দাঁড়ায় মানস-সত্য রূপে, তা হলে এর লাভ হয় এক স্থায়ী প্রভাব-শ্রষ্ঠতম প্রভাব; কেননা বহু শক্তির সম্মিলন-ক্ষেত্রে আত্মিক শক্তিরূপে এ যে নিজেকে বিকশিত করে তোলে এই জন্য জীবনে যা-কিছু শ্রেয় প্রেয় ও গৌরবের সে-সবই নিজের ভিতরে সঞ্চিত করে, আর এইভাবে মনুষ্যমূর্তিতে (নৃতনভাবে) প্রাণ সঞ্চার করে মানুষকে করে মহত্তর, তার জীবন ও কর্মের পরিধিকে করে পূর্ণাঙ্গ, আর অতীত-ও-ভবিষ্যৎ-সমন্বিত বর্তমানে তাকে দান করে দেব। Dr. R. Steiner তার বইখানিতে শেষ মন্তব্য করেছেন এই :- Beauty is nol the divine in a cloak to physical reality; no, it is physical reality in a cloak that is divine. সৌন্দর্য পার্থিব আবরণে এক দিব বস্তু নয় বরং দিব্য আবরণে পার্থিব সত্য। (তিনি এখানে দার্শনিক schelling-এর সৌন্দ-তত্ত্বের প্রতিবাদ করেছেন।)]
এ সম্বন্ধে গ্যেটের আরো কয়েকটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য
……..Occasional poems (are) the first and most genuine of all kinds of poetry..
……. The first and last demanded os genius is love of truth…
…… I seek in everything a point from which much may be develop…ba.
[সাময়িক কবিতাই আদি ও অকৃতিম কবিতা।
প্রতিভার সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ কর্তব্য-সত্যপ্রীতি।
প্রত্যেক বিষয়ে আমি এমন একটি স্থান খুঁজি যা থেকে প্রভূত বিকাশ সম্ভবপর।]
Theodore Watts Dunton Encyclopaedia Britannica! Poetry শীর্ষক লেখায় কবি দৃষ্টিকে দুইভাগে ভাগ করেছেন- Absolute Vision শুদ্ধদৃষ্টি ও Relative Vision আপেক্ষিক দৃষ্টি। সেই Absolute Vision –এর দৃষ্টান্ত তিনি দেখেছেন Shakespeare এ ও Homer এ। Absolute Vision বলতে তিনি বুঝেছেন বস্তুর নিজস্বতার বিবৃতি; কবি নিজের রাগ-দ্বেষ একেবারে ভুলে গিয়ে কোনো বস্তুর বা কোনো ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করে তাকে বিশ্লেষণ করছেন; রূপময় করছেন। এইভাবে সম্পূর্ণভাবে আত্মবিস্মৃত হয়ে Absolute Vision লাভ করা মানুষের পক্ষে সম্ভবপর কি না, অর্থাৎ শেকসপীয়র ও হোমর তাদের Absolute Vision এর মুহূর্তেও শেকসপীয়র ও হোমর বিবর্জিত হয়েছিলেন কি না, সে বিষয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতে পারে। তবে এই আত্মবিলোপ কবির পক্ষে মানুষ হিসাবে যতখানি সম্ভবপর সেদিক দিয়ে দেখলে হয়ত বোঝা যাবে, সত্যকার Absolute Vision অর্থাৎ মানুষের মনের বহু স্তরের বহু গ্রামের অবস্থা সম্বন্ধে Vision গ্যেটের চাইতে শেকস্পীয়রে ও হোমরে বেশী নয়। কিন্তু সাহিত্যের প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে এ হয়ত blasphemy “ কাফেরী কালাম” –তাই বেশী কিছু না বলাই শোভন।
অল্প বয়সেই গ্যেটে বলেছিলেন–আমি প্রকৃতির মতো অকৃত্রিম হব, ভাল হব, মন্দ হব, তোমাদের কোনো আদর্শ আমাকে বাধা দিতে পারবে না। (All your ideals shall not prevent me from being genuine, and good and bad-like Nature).
এই যাঁরা সাধনা প্রচলিত কথায় যাকে বলা হয় কবিত্ব, কাব্য-সৌন্দর্য, তাতেই যে তিনি সন্তুষ্ট থাকবেন তা সম্ভবপর নয়। ঘটেছেও তাই; গ্যেটে শুধু কবি নন, তিনি বিজ্ঞানবিৎ (বিজ্ঞানে তার দান স্বীকৃত হয়েছে), চিত্র-সমঝদার, শেষ বয়সে সঙ্গীত, সমঝদার, ধর্ম-তত্ত্বজ্ঞ, এমন-কি মরমী-সাধনার সঙ্গেও সুপরিচিত তাঁর চিত্তের এই বিরাটত্ত্বের জন্যই জনৈক লেখক তাঁকে আধুনিক জগতের সমস্ত চিন্তাশীলের গুরু বলেছেন :
….. we are all disciples of Goethe whether we know it or not, and any liberal mind has but to be brought into contact with the master to realise that inevitable discipleship….” John Macy-The Story of the World’s Literature. [আমরা বাই গ্যেটের শিষ্য তা আমরা জানি আর নাই জানি যে-কেন উদারচিত্ত ব্যক্তি এই গুরুর সংস্পর্শে এলেই সেই অবশ্যম্ভাবী শিষ্যত্বের কথা বুঝবেন।]
গ্যেটে নিজেও বলেছেন– যিনি প্রকৃতই আমার রচনা ও চরিত্রের মর্মগ্রাহী হয়েছে তাঁকে স্বীকার করতে হবে যে তার ফলে তিনি এক প্রকার চিত্তের অবন্ধন লাভ করেছেন। [“…..And any one who has really leamt to understand niy works and niy character is bound to acknowledge that the has thereby allained to a certain sreedom of the spirit।”]
প্রচলিত ধর্মে আস্থাবান না হয়েও ঈশ্বর সম্বন্ধে যে সব কথা তিনি বলেছেন বাস্তবিকই বিস্ময়কর ভাবুকের জন্য আনন্দের অফুরন্ত প্রস্রবণ। তাঁর Faust এর সেই who dare express Him” [“মার্গারেটের মনে সন্দেহ জেগেছে হয়ত ফাউস্ট ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন; তার প্রশ্নের উত্তরে ফাউস্ট বলেছেন : Who dare express Hiin? And who prosess Him? Saying: I believe in Hiin! Who. secling, seeing. Deny His being. Saying: I believe Ilim not! The All-upholding. The All-sustaining, Folds and upholds He not Thee, me Himsell? Arches there not the sky above us? Lies not beneath us firm the earth? And rise not, on us shining. Friendly, the everlasting stars? Look I not, eye to eye, on thee. And Iceľ st not, thronging To head and heart, the force. Still wcaving its elernal secert? Invisible, visible, round the lise? Vast as it is. lill with what force thy heart. And wlien thou in the lecling wholly blessed art. Call it then, what thou will. Call it Bliss! Heart! Love! God! I have no naine to give it! Fecling is all in all: The Name is sound and smoke. :i!). (liring heaven’s clear glow. স্পর্ধা কার তাঁকে ব্যক্ত করবে। বলবে কে-তাকে জানি, তাতে বিশ্বাস রাখি! অনুভূতি ও দৃষ্টি অব্যাহত রেখে অস্বীকার করবে কে তাকে! বলবে কোবিশ্বাসী তাকে নই! সর্বধর সর্বাশ্রয়। ধারণ কি করছেন না তিনি তোমাকে, আমাকে, নিজেকে? মাথার উপরে নেই কি আকাশের খিলান? পায়ের নিচে শান্ত ধরনী? সামনে জ্বলজ্বল-করা বন্ধুর-মতো-চেয়ে-থাকা চিরদিনের তারা? চোখ কি আমার দেখছে না তোমাকে অনুভব কি করছ না তুমি, মনে প্রাণে, তোমার জীবন ঘিরে চলেছে কি রহস্যময় শক্তির শীলা? –কখনো দৃশ্য কখনো অদৃশ্য! বিরাটের দ্বারা তোমার হৃদয় পূর্ণ কর নিঃশেষে। আর যখন তুমি ভাগ্যবতী এই অনুভূতি-ধনে। তখন নাম দিয়ে এর পরমা শান্তি, হৃদয়, প্রেম, ঈশ্বর–যা খুশী! আমি অক্ষম এর নাম দিতে। অনুভূতিই আমার সব। নাম শুধু কোলাহল ও কুহেলী। আকাশের প্রোজ্জ্বলতা তাতে হয় আচ্ছন্ন।] ইত্যাদি সুবিখ্যাত, এভিন্ন অন্যান্য সুন্দর উক্তিও আছে, যেমন
“….what know we of the idea of the Divinity?’ ind what can our narrow ideas toll of the flighest Being? Should, I, like a Turk, name it with a hundred names, I should still fall short and it comparison with the infinite attributes, have said nothing.”
“Let men continue to worship llim Who gives the ox his pasture and to man food and drink, according to his need. But I worship Him Who has filled the world with such a productive energy, that is only the millionth part became embodied in living existences the globe world so swarm with them that War, Pestilence, Flood, and Fire would be powerless to diminish them. That is my Good.”90.
ঈশ্বরের ধারণা সম্বন্ধে আমাদের কিইবা জ্ঞান আছে। আমাদের সংকীর্ণ পরিসর ভাবনা সেই পরমপুরুষের সম্বন্ধে কতটুকুই বা ব্যক্ত করতে পারে। যদি মুসলমানের মতো শতনামে আমি তাঁকে ডাকি তবু অকথিত থাকবে বহু, আর তার মহিমার কথা ভাবলে বুঝব–কিছুই বলা হয়নি। অন্যেরা পূজা করুন তাঁকে যিনি আঁড়কে দিয়েছেন চরবার মাঠ আর মানুষকে দিয়েছেন তার প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পানীয়। কিন্তু আমি পূজারী তাঁর যিনি জগৎকে পূর্ণ করেছেন এমন প্রাণশক্তিতে সে যদি তাঁর অযুততম অংশও সক্রিয় হয় তবে জগত তার দ্বারা এমনভাবে পূর্ণ হবে যে যুদ্ধ মড়ক বন্য প্রভৃতির সাধ্য হবে না তার শক্তি হ্রাস করতে। এই আমার ঈশ্বর।।
অথবা—
তাঁর আর একটি উক্তিও প্রণিধানযোগ্য– যারা ধর্মপ্রাণ সৃষ্টি শুধু তাঁদের দ্বারাই সম্ভবপর Only religious men can be creative.
গ্যেটের ভিতরে স্বজাতিপ্রেমের তীব্রতা ছিল না। এজন্য তাঁকে কম নিন্দা ভোগ করতে হয় নি। কিন্তু দার্শনিক ক্রোচে এতে মহা আনন্দিত হয়েছেন–
“… I consider it singularly fortunate that among all the sublime poets, perennial sources of deep consolation, there should yet be one who, possessing a knowledge of human nature in all its aspects, such as no other poets ever possessed, nevertheless keeps his mind above and beyond political sympathies and the inevitable quarrels of nations. [মহাকবিরা হচ্ছেন আশা ও আনন্দের অফুরন্ত প্রস্রবণ, সেই মহাকবিদের মধ্যে এমন একজনও যে আছেন যিনি মানব-প্রকৃতির সর্ব ক্ষেত্রের জ্ঞানে সর্বাগ্রগণ্য হয়েও রাজনৈতিক পক্ষপাত ও জাতিতে অবশ্যম্ভাবী দ্বন্দ্বের বহু উর্কে নিজের চিত্ত স্থাপন করতে পেরেছেন, এ এক মহা সৌভাগ্য বলে আমি জ্ঞান করি।]
এ সম্বন্ধে গ্যেটে নিজে বহু কথা বলেছেন,
“National literature is now rather an unmeaning term: the epoch of world literature is at hand, and each one must try to hasten its approach.” [জাতীয় সাহিত্য এখন বরং এক অর্থহীন কথা। বিশ্বসাহিত্যের যুগ আসন্ন হয়েছে আর প্রত্যেকেরই উচিত একে এগিয়ে আনা।]
অন্যত্র
Altogether national hatred is something peculiar. You will always find it strongest and most violent where there is the lowest degree of cultuer. But there a degree where it vanishes altogether and where one stands to a certain extent above nations and feels the weal or woe of a neighbouring people as if it had happened to one’s own. This degree of culture was conformable to my nature, and I had become strengthened in it long before I had reached my sixtieth year. [মোটের উপর বিজাতিবিদ্বেষ অদ্ভুত ব্যাপার। যেখানে চিত্তোকর্ষের যত অল্পতা সেখানে এর তীব্রতা তত বেশি। কিন্তু চিত্তোকর্ষের এমন স্তর আছে যেখানে এর সম্পূর্ণ বিলোপ ঘটে, ফলে এর অনুভাবকের স্থান লাভ হয় জাতীয়তার উর্দ্ধে। পরজাতির দুঃখবিপত্তি তখন তার মনে হয় নিজের জাতির দুঃখ-বিপত্তির মতো। চিত্তোকর্ষের এই স্তরের সঙ্গে আমার প্রকৃতির সহজ যোগ ছিল, আর ষাট বৎসর বয়সের বহু পূর্বেই এতে আমার স্থিতিলাভ হয়েছিল।]
গ্যেটে সম্বন্ধে যে ক’জন আলোচকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে তাদের কেউই কয়েক শত পৃষ্ঠার.কমে তাঁদের বক্তব্য শেষ করতে পারেন নি। তবু তাদের লেখা ফেলানো লেখা নয়। তাঁর সুদীর্ঘ জীবন-কাহিনী, তাঁর কাব্যের কিছু কিছু পরিচয়, আপাতত অকথিতই রইল। [কবিগুরু গ্যেটে প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড দ্রঃ।]
গ্যেটে-সমুদ্রের হাওয়া মান স্বাস্থ্যের জন্য অমূল্য, এই একটি কথাই বলতে চেষ্টা করেছি হয়ত।
মুসলিম সাহিত্য-সমাজের চতুর্থ বার্ষিক অধিবেশনে পঠিত। চৈত্র, ১৩৩৬