কোরআনের আল্লাহ
[ওসিআর ভার্সন, প্রুফ্ররিড করা হয়নি]
বিষয়টি বিরাট। বিজ্ঞেরা জানেন এটি কোরআন-তত্তের গোড়ার কথা; উৎকট অদৃষ্ট বাদ, মোতাজেলা যুক্তি-বাদ, সুফীর অন্তর্জোতি-বাদ, ইত্যাদি মুসলিম দার্শনিক মতামতের উৎপত্তি-কেন্দ্রও প্রায় এইটি। কিন্তু এসব জটিল ব্যাপার ত্যাগ করে আমরা বরং দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি মানুষের প্রতিদিনের জীবন-যাত্রার দিকে। মানুষের সেই প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে কোরআন-বর্ণিত আল্লাহর কি যোগ?
কোরআনের পাঠকদের সহজেই চোখে পড়ে আল্লাহর স্বরূপ-নির্দেশ সম্পর্কে বাগবিস্তারে কোরআনের আপত্তি। কোরআনের এই ধরনের যে সব উক্তি মানুষকে জ্ঞান সামান্যই দেয়া হয়েছে (১৭:৮৫). আল্লাহ মানুষকে যেটুকু জানান তার বেশি তার সম্বন্ধে ধারণা করবার শক্তি মানুষের নেই (২:২৫৫) –এ সব থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, আল্লাহর স্বরূপ–জিজ্ঞাসা কোরআনের অনভিপ্রেত। অথচ কোরআনে যদি কোনো একটি ব্যাপার অত্যুত্র হয়ে থাকে সেটি হচ্ছে আল্লাহর কথা– আল্লাহর মহিমার অন্ত নেই, করুণার অন্ত নেই, চিরজাগ্রত তিনি, অন্যায়ের কঠোর শাস্তিদাতা তিনি এসব কথা বারংবার কোরআনে উচ্চারিত হয়েছে। অর্থাৎ, আল্লাহ যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভালমন্দের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত, এ বিষয়ে কোরআন নিঃসন্দেহ যেমন নিঃসন্দেহ, তিনি দুয়ে, সে-সম্বন্ধে।
আর শুধু কোরআন নয়, জগতের অন্যান্য বিখ্যাত ধর্মগ্রন্থ ও জগতের অনেক মনীষীও ‘আল্লাহ’ সম্বন্ধে এই মনোভাবেরই পরিচয় দিয়েছেন আল্লাহ যে স্বরূপ দুৰ্জ্জেয় অথচ এই দুর্জেয় আল্লাহর সঙ্গেই মানুষের প্রতিদিনের জীবন নিবিড়ভাবে যুক্ত এ সব তাঁদের অন্তরতম কথা।
কিন্তু প্রশ্ন এই দাঁড়ায় : যাঁকে জানা যায় না অথবা অতি সামান্যই জানা যায় তিনি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অবলম্বন হবেন কেমন করে? এই কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েই যোগী সুফী প্রভৃতি রহস্যবাদীরা অবলম্বন করেছেন কৃচ্ছসাধনা, কল্পনাকুশলীরা প্রশ্রয় দিয়েছেন প্রতীক-চৰ্চা, আর সমাজ-শৃংখলা-বাদীরা জোর দিয়েছেন বিধি-নিষেধ পালনের উপরে।
এর কোনটির কি মূল্য সে-সব তর্কও আপাতত আমাদের পরিত্যাজ্য; আমরা তাকাতে চাচ্ছি কোরআনের একটি বিশেষ উক্তির দিকে: সব চাইতে ভাল ভাল নাম আলুহর (৭:১৮০)। অন্য কথায়, কোরআনের মতে, সব চাইতে শ্রেষ্ঠ গুণসমূহে আল্লাহ বিভূষিত; আর কোরআন নির্দেশ দিচ্ছেন এই সব শ্রেষ্ঠ নামে তাকে ডাকতে, অর্থাৎ তার শ্রেষ্ঠ গুণসমূহ স্মরণে রাখতে। বলা বাহুল্য এই থেকেই ধর্মভীরু মুসলমানের তসবীহ পাঠ। কিন্তু আল্লাহর এই সব শ্রেষ্ঠ গুণ স্মরণ করার প্রকৃত অর্থ কি, তার নির্দেশ রয়েছে হজরতের এই বিখ্যাত বাণীতে : আল্লাহর গুণাবলীতে ভূষিত হও, অর্থাৎ আল্লাহ বলতে যেসব শ্রেষ্ঠ গুণ তোমার চিন্তায় আসে সে-সব নিজের ভিতরে সৃষ্টি কর। কোরআনে মানুষকে বলা হয়েছে জগতে আল্লাহর প্রতিনিধি, সূৰ্য্য চন্দ্র দিবস রজনী এ সব প্রাকৃত ব্যাপারও মানুষের অধীন (১৪:৩৩) নিশ্চয় সেখানে সেই মানুষের কথা বলা হয়েছে যে আল্লাহর গুণে গুণান্বিত অর্থাৎ যে বহু সদগুণসমন্বিত শক্তিমান ব্যক্তি।।
ধর্মভীরু মুসলমানেরা প্রতিদিন আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নাম বা গুণসমূহ স্মরণ করেন। তারা তাঁকে ৯৯ নামে ডাকেন, যেমন, তিনি করুণাময়, মহিমাময়, সুন্দর, কঠোর শাস্তি দাতা ইত্যাদি। বলা বাহুল্য তার শ্রেষ্ঠ নামের শেষ নেই (৫:২৩)। কিন্তু এই স্মরণ করার অর্থ যে শুধু মুখে উচ্চারণ করা নয়, মন দিয়ে উপলব্ধি করা ও চরিত্রে এ-সবের প্রভাব ফুটিয়ে তোলা, সেই বড় কাজটাই চাপা পড়ে গেছে। ফলে আপ্নাহর এই শ্রেষ্ঠ নামসমূহ স্মরণ ও শুষ্ক আদেশ-পালনের পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছে।
কিন্তু চিন্তা করলে বোঝা যাবে কোরআনের এই যে বাণী ও হজরতের এই যে নির্দেশ এর মধ্যে এমন একটি ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে যা উপলব্ধি করতে পারলে দুয়ে আল্লাহর সঙ্গে আমাদের এমন একটি যোগ স্থাপিত হয় যাতে আমাদের প্রতিদিনের জীবনে শক্তি-সঞ্চার হয়–আমাদের জানার আকাক্ষা খানিকটা তৃপ্ত হয়, আমাদের অনুভূতিকেও খানিকটা সজীব করে তোলা হয়।
দৃষ্টান্ত থেকে বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ধরুন–আল্লাহকে বলা হয়েছে সুন্দর সেই ব্যাপারটি। আল্লাহ স্বরূপত কি, তা কে বলবে? কিন্তু তিনি সুন্দরের চরম এই কথা ভাবতে তার ভাবনা একটা অবলম্বনযোগ্য আদর্শের মতো আমার মনের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেল। সেই আদর্শ মনোগত, বস্তুগত নয়, কাজেই সেটির উৎকর্ষ হচ্ছে আমার বুদ্ধি বিবেচনার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। আর সব চাইতে বড় কথা এই যে এটি আমার সৌখীন কল্পনা নয়, এটিকে আমি অবলম্বন করেছি আমার জীবনের লক্ষ্য হিসাবে আল্লাহ পরম সুন্দর এই ভাবনা আমার ভিতরে দিন দিন এনে দিচ্ছে আমার নিজের সমস্ত কাজে ও চিন্তায় সুন্দর হবার তাগিদ। তেমনি ধরুন–তাঁর করুণাময় নাম। তাকে করুণার শ্রেষ্ঠ আদর্শরূপে বুঝে আমি চেষ্টা করছি সেই করুণার ভাব আমার মধ্যে সঞ্জীবিত করে তুলতে। এমনিভাবে বোঝা যেতে পারে তার অন্যান্য শ্রেষ্ঠ নাম ও আমাদের জীবনের বিকাশের উপরে সে সবের শক্তি। আল্লাহ সম্বন্ধে এই সব ধারণায় আমাদের জ্ঞান ও অনুভূতি কিছু তৃপ্ত হচ্ছে এই জন্য যে, আল্লাহ দুয়ে এই কথা বলে আমরা হৃদয় ও মনে সমস্ত দাবিতে স্তব্ধ করে দিতে চেষ্টা করছি না, বরং আমরা আবিষ্কার করেছি এই দুয়ের চরিতার্থতার একটি পথ– আল্লাহ বলতে আমরা বুঝছি জীবনের এক অন্তহীন অগ্রগতির তাগিদ, সেই তাগিদে ও চলার পথের বিচিত্র সৌন্দর্যে আমাদের মস্তিষ্ক ও হৃদয় দুইই সচেতন ও আনন্দিত।
আল্লাহকে যদি এইভাবে শ্রেষ্ঠ গুণের সমষ্টি বোঝা যায়, তবে আল্লাহ বাস্তবিকই আমাদের আকর্ষণ-স্থল হয়ে দাঁড়ান–আমাদের বহু ব্যর্থতাময় দৈনন্দিন জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন গভীরভাবে অর্থপূর্ণ। তখন মুসলমানেরা এই যে প্রতিদিনের বহুবারের প্রার্থনা–আমাদের সোজা পথে চালাও–সেটি প্রার্থনাকারীর হৃদয়-মনকে সত্যকারভাবে উদবোধিত করে, কেননা সোজা পথ বলতে কি বোঝা হচ্ছে, গতি হয়েছে আমাদের কোন দিকে, সে-বিষয়ে অনেক কথা পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। জীবনের অর্থ এইভাবে অনেকখানি পরিষ্কার হয়ে উঠলে ধর্মের বিধি-বিধানের তাৎপর্যও স্পষ্ট হয়ে ওঠে; তখন বুঝতে দেরী হয় না যে, ধর্মের বিধি-নিষেধ কোনো নিষ্ঠুর প্রভুর কষ্টদায়ক হুকুম নয়, বরং সে-সব হচ্ছে জীবনকে উন্নতির দিকে পরিচালনার নিয়মশৃঙ্খলা– নদীর ধারাকে পরিচালনা করার জন্য যেমন তার দুই তীর। তখন আরো বোঝা যায়, তাই ধর্ম যা জীবনের বিকাশের সহায়ক আর তাই অধর্ম যা তেমন সাহায্য করে না, যেমন তাই খাদ্য যা বল দেয়, তা খাদ্য নয় যা বল দেয় না। সুবিজ্ঞ বিচারক যেমন বিচিত্র ও জটিল আইনের মধ্যে দেখেন জীবনের প্রয়োজন ও সেই দৃষ্টি দিয়ে দেখে তার সুব্যাখ্যার চেষ্টা করেন, কখনো কখনো করেন নূতন ক্ষেত্রে তার নূতন প্রয়োগ, আল্লাহর অভিমুখে যাত্রীও ধর্মের মর্মের সন্ধান পান ও জীবনের প্রয়োজনে নূতন নূতন ক্ষেত্রে তার নূতন নূতন প্রয়োগ ও পরীক্ষা করে চলেন।
পরম দুর্জ্ঞেয় আল্লাহকে কোরআন যে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এমন ব্যবহারযোগ্য করেছেন এ মানুষের এক বড় লাভ।