দারোগার দপ্তর ৩ (তৃতীয় খণ্ড) – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়
সম্পাদনা – অরুণ মুখোপাধ্যায়
সহযোগিতা – সোমনাথ দাশগুপ্ত
প্রথম প্রকাশ – আগস্ট ২০২১
.
ভূমিকা
নিখিল সরকার অর্থাৎ লেখক শ্রীপান্থ একদিন আমাকে তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। গেলাম। বললেন, ‘শোনো, তুমি তো পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রন্থাগার নিয়ে কাজ করেছ, তুমি জানো ‘দারোগার দপ্তর’ ক’টি সংখ্যা বেরিয়েছিল?’ আমি বললাম, ‘শুনেছি ২০৬টি সংখ্যা।’ ধমক দিলেন। বললেন, ‘শোনা কথা নয়। তুমি ক’টা দেখেছ?’ আমি মাথা নিচু করে বলি, ‘একটাও দেখিনি।’
বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা। স্নেহের সুরে বললেন, “তুমি যত লাইব্রেরি ঘুরেছ, সেই লাইব্রেরির বই-এর ক্যাটালগ দেখে দেখে ‘দারোগার দপ্তর’-এর তালিকা তৈরি করো। সাজিয়ে ফেলো। ‘দারোগার দপ্তর’ আমরা ছাপব। কাজটা তুমি করবে। ‘দারোগার দপ্তর’ কপি করার ব্যবস্থা করো। এরপর যেদিন আসবে যেন কাজে অগ্রগতি দেখি।’
হয়ে গেল নির্দেশ। এই বই যে ছাপবে তার সঙ্গেও আলাপ হয়ে গেছে। ‘পুনশ্চ’-র সন্দীপ নায়ক। ততদিনে সন্দীপ আমার বন্ধু হয়ে গেছে। সন্দীপ জানাল, ‘তোমার কিছু অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে।’ ব্যস্। একদিকে নিখিলদার নির্দেশ, অন্যদিকে সন্দীপের আন্তরিক সহযোগিতায় কাজ এগিয়ে চলল। মূলত চৈতন্য লাইব্রেরি ও হিরণ লাইব্রেরির দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ দেখার সুযোগ পেলাম। এ তো অমূল্য রত্ন। ‘দারোগার দপ্তর’। লেখকের নাম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়।
দুটি লাইব্রেরি মিলিয়ে একশোটি ‘দারোগার দপ্তর’ দেখলাম, পড়লাম। কিছু কপি করলাম। তারপর একদিন সন্ধ্যায় নিখিলদার বাড়িতে গিয়ে সব জানালাম। বললাম, ‘একশোটি দারোগার দপ্তর পাওয়া যাবে এই দুটি প্রাচীন পাঠাগারের সৌজন্যে।’ নিখিলদার খুব আনন্দ হল। উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখ। বললেন, ‘একশোটাই ছাপব। তুমি পাণ্ডুলিপি তৈরি করো।’
কাজ শুরু হয়ে গেল। লাইব্রেরিতে যাই। যখনকার কথা বলছি, তখন লাইব্রেরি দুটি খুলত সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ। আমি সব কাজ মিটিয়ে সন্ধ্যে ৬.৩০ নাগাদ লাইব্রেরির দরজায় দাঁড়িয়ে পড়তাম। কাঁটায় কাঁটায় ৭টায় হিরণ লাইব্রেরির গোপালদা ও চৈতন্য লাইব্রেরির বিশ্বনাথদা দরজা খুলতেন। আমি গিয়ে কাজ করতাম। নোট নিতাম। দারোগার দপ্তর কপি করতাম। একদিন যেতাম হিরণে, পরের দিন চৈতন্যয়। রবিবারের সকালটা লাইব্রেরি খোলা থাকায় ওই দিনটাও কাজে লাগাতাম।
এই দুটি গ্রন্থাগারের অকৃপণ সাহায্যে ধীরে ধীরে ‘দারোগার দপ্তর’-এর একশোটি সংখ্যার কপি ধীরে ধীরে এল। নিখিলদাকে দিলাম। নিখিলদা আমার সামনে সন্দীপকে ডেকে তার হাতে একশোটি ‘দারোগার দপ্তর’ তুলে দিলেন। বললেন, ‘দুখণ্ডে যাবে। পঞ্চাশটি করে দুটি খণ্ডে মোট একশোটি। সামনের বইমেলায় যেন বই বেরোয়।’
যে সময় আমি লাইব্রেরিতে বসে কাজ করছি, তখন ২০০০ সাল। বছর দুয়েক লাগল কাজটি করতে। তারপর ২০০৪-এর বইমেলায় পুনশ্চ প্রকাশিত দু’খণ্ড ‘দারোগার দপ্তর’ বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সেমিনার মঞ্চে উদ্বোধন হল। সেই মঞ্চে তৎকালীন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুজয় চক্রবর্তী, বিশিষ্ট লেখক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ ও বরেণ্য ঐতিহাসিক ড. বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। খবরের কাগজে, সাময়িক পত্রিকায় ‘দারোগার দপ্তর’ প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রচুর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপন দেখে অনুষ্ঠান মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক তপন রায়চৌধুরী ও প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্কিত আত্মীয়া অনুরাধা মুখোপাধ্যায়। তপনবাবু ও অনুরাধা দেবী আসায় অনুষ্ঠানটি অন্য মাত্রা পেল। আমরা অতিথিদের ও চৈতন্য, হিরণ লাইব্রেরির কর্মকর্তাকে বই উপহার দিয়েছিলাম। সন্দীপ সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটির সুচারু নেতৃত্ব দিয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানেই তপন রায়চৌধুরী জানিয়েছিলেন, তিনি প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক সূত্রে আত্মীয় হন।
‘দারোগার দপ্তর’প্রকাশ পেল। খুব জনপ্রিয়তা অর্জন করল। বিক্রিও হল দারুণ। দারোগার দপ্তর প্রকাশের পরদিন পুনশ্চর প্রকাশক সন্দীপ নায়ক তার গাড়িতে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে উপস্থিত হল সল্টলেকে নিখিলদার বাড়িতে। সন্দীপ আর আমি নিখিলদার হাতে তুলে দিলাম তাঁর পরিকল্পিত স্বপ্নের বই ‘দারোগার দপ্তর’। নিখিলদা খুব আনন্দ পেলেন।
কিন্তু এই আনন্দ বেশিদিন স্থায়ী হল না। নিখিলদা অসুস্থ হলেন। দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা চলল। ১৭ আগস্ট ২০০৪ সালে আমাদের প্রিয় শ্রদ্ধেয় নিখিল সরকার পরপারে চলে গেলেন। নিখিলদার ইচ্ছা ছিল, দারোগার দপ্তর-এর সব কটি সংখ্যাই ধীরে ধীরে প্রকাশ পাক।
তারপর চলে গেছে ষোলোটি বসন্ত। আমাদেরও বয়স বেড়েছে। লাইব্রেরির কর্মকর্তাদেরও নিশ্চয় বদল ঘটেছে। হিরণ লাইব্রেরির গোপালদাও ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেছেন।
এসে হাজির হয়েছে করোনা ভাইরাস। তার মারণ লীলা শুরু হয়েছে। ২০২০ সাল কোভিড-১৯ এর ঝোড়ো আক্রমণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠাগার, অফিস, আদালত সব বন্ধ হয়ে গেল। কঠোর লকডাউন, কার্ফ, কন্টেন্টমেন্ট জোন ইত্যাদি শব্দের আড়ালে আমরা গৃহবন্দি।
এমনই একদিন গৃহবন্দি অবস্থায় রয়েছি, একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। ফোনের ওপার জানান দিল, তাঁর নাম সোমনাথ দাশগুপ্ত। তিনি ‘দারোগার দপ্তর’-এর আরও বেশ কিছু সংখ্যা সংগ্রহ করেছেন। তিনি এই সংখ্যাগুলি ছাপাতে চান। আমাকেও সেই কর্মযজ্ঞে সামনে থাকতে বলেন। আমি রাজি হই।
সোমনাথ দাশগুপ্ত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র। পেশাও ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত। অথচ দারোগার দপ্তরকে ভালোবেসে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ওপর পরম আগ্রহে তিনি ‘দারোগার দপ্তর’-এর আরও কিছু সংখ্যা জোগাড় করেছেন এবং সম্পূর্ণ’দারোগার দপ্তর’-এর তালিকা তৈরি করেছেন। খবরটা পাওয়া মাত্রই সন্দীপ নায়ককে জানালাম। ই-মেল মারফত দারোগার দপ্তরের বাকি সংখ্যা, যেগুলি আগের দুটি খণ্ডে প্রকাশ পায়নি, সোমনাথ পাঠিয়ে দিল সন্দীপের কাছে। তারপর করোনা মহামারির ভয়নক অবস্থা। প্রেসে লোক কম। তার মধ্যেই ধীরে ধীরে দারোগার দপ্তর কম্পোজ হয়। এবার পাঠকের মুখোমুখি আসার প্রস্তুতি।
.
তৃতীয় খণ্ড ‘দারোগার দপ্তর’ শুরু হচ্ছে ‘বেওয়ারিশ লাস’ দিয়ে। এই আখ্যানটি সম্পর্কে লেখা আছে ‘অর্থাৎ পথ-পার্শ্বস্থ পুলিন্দার ভিতরে প্রাপ্ত লাসের অদ্ভুত রহস্য!’ শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘দারোগার দপ্তর’-এর ৭৩তম সংখ্যা হল ‘বেওয়ারিশ লাস’। কিছু ক্ষেত্রে প্রিয়নাথ মূল কাহিনীকে চুম্বকের মতো কয়েকটি শব্দে ধরে দিতেন। যেমন এই সংখ্যাটিতে হয়েছে। সিকদার বাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রীবাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত ১৩০৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসের সংখ্যাটিই ‘বেওয়ারিশ লাস’। মুদ্রণের স্থান গ্রেট টাউন প্রেস, ৬৮ নিমতলা স্ট্রিট, কলকাতা। মুদ্রকের নাম শশিভূষণ চন্দ্র।
এই সংখ্যায় ‘প্রকাশকের মন্তব্য’ রয়েছে। কিছুটা উদ্ধার করি। আজ ‘দারোগার দপ্তর’ সপ্তম বৎসরে পদার্পণ করিল। এদেশে সাময়িকপত্র নিয়মিত রূপে এত অধিক দিন একাদিক্রমে প্রচলিত থাকা বড় অনেকের ঘটে না; সুতরাং ইহা গৌরবের কথা, তাহার আর সন্দেহ নাই। গ্রাহকগণের উপরেই সাময়িক পত্রের জীবন ও উন্নতি নির্ভর করে। আমাদের সেইরূপ অনুগ্রাহক গ্রাহক, যথেষ্ট আছেন বলিয়া, আজ আমরা গৌরবান্বিত হইতেছি। আজ তাই এই আনন্দের দিনে নূতন বর্ষারম্ভে সেই সকল গ্রাহকের নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাইতে আসিয়াছি। তাঁহাদের এইরূপ অনুগ্রহ ও সাহায্য পাইলে অন্ততঃ আমাদের জীবনকাল পর্যন্ত এই দারোগার দপ্তরের অস্তিত্ব থাকিবে।’
প্রকাশক জানাচ্ছেন, দারোগার দপ্তর সাময়িক পত্রিকা। এই পত্রিকার গ্রাহকও আছেন যথেষ্ট। আর এমন অনুগ্রহ ও সাহায্য পেলে দারোগার দপ্তর দীর্ঘায়ু হবে এমন আশা স্বভাবতই প্রকাশক মশাই করেছেন।
প্রকাশক জানাচ্ছেন, ‘কেহ কেহ এইরূপ বলিয়া থাকেন যে, এই দারোগার দপ্তরের দ্বারা জুয়াচোর, বদমায়েসদিগের নূতন জুয়াচুরি বৃদ্ধির পথ প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু জানি না, ইহা দ্বারা জুয়াচোরগণ সাহায্য প্রাপ্ত হয়, কিম্বা সাধারণ লোকে সেই জুয়াচোরগণ কৃত কার্য্যের বিপক্ষে বাধা দিবার জন্য উপায় শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। কারণ, আমরা কল্পনার অতিরঞ্জিত কোন চিত্র এই পুস্তকে দিই না; যাহা বাস্তবিক ঘটনা, এ দেশীয় জুয়াচুরি বুদ্ধির আয়ত্তাধীন, তাহাই ইহাতে লেখা হইয়া থাকে। তাহার পর সামান্য জুয়াচোর, বদমায়েস লোক পুস্তক পাঠ করে না; শিক্ষিত জুয়াচোরগণ পুস্তক পাঠ করে বটে, কিন্তু এরূপ পুস্তক দ্বারা তাহাদের বৃদ্ধি-বৃত্তির বিশেষ সাহায্য হইয়া থাকে, তাহা যদি মানিয়া লওয়া হয়, তবে আমাদের দারোগার দপ্তর অপেক্ষা ভয়ানক ঘটনা পূর্ণ বিলাতী ডিটেকটিভ গল্প পুস্তক হইতে তাহারা অনেক অধিক সাহায্য পাইতে পারে।’
শ্রী বাণীনাথ নন্দী, ‘দারোদার দপ্তর’-এর প্রকাশক বলছেন, প্রশ্ন তুলছেন। …..যখন কল্পনার অতিরঞ্জিত ঘটনা-পূর্ণ নভেলাদি পড়িয়া এ দেশীয় স্ত্রী-বালকগণ বিকৃত-বুদ্ধি ও বিজাতীয় প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়, তখন ত কেহ কোন কথা কহেন না, সেরূপ নভেলাদি সম্বন্ধে এইরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন না! ইহার কারণ কি, কেহ কি বলিতে পারেন?’
‘দারোগার দপ্তর’সাহিত্যের কোন ধারায় পড়ে? বাণীনাথ নন্দী সে কথাও তাঁর মতো করে বুঝিয়েছেন। লিখছেন, ‘দারোগার দপ্তর’ একবারে সম্পূর্ণ রূপ নূতন ধরণের পুস্তক। এরূপ পুস্তক ইতিপূর্বে বাঙ্গালা ভাষায় প্রচারিত হয় নাই। সুতরাং ইহা কোন্ শ্রেণীর পুস্তক, ইহা ‘কাব্য বা উপন্যাস’ তাহা অনেকে ঠিক করিতে পারেন না। তবে ইহা গল্প ধরণে লেখা হইলেও, ইহাকে কাল্পনিক ঘটনা-পূর্ণ উপন্যাস বলা যাইতে পারে না।’ প্রকাশক নিজেই সংশয়ে আছেন দারোগার দপ্তরের লেখক ‘উপন্যাসিক’ পদ-বাচ্য কিভাবে হবেন, তা বলতে পারছেন না। অথচ কোন লেখক যখন দারোগার দপ্তরের লেখককে ‘কবি-উপন্যাসিক’ বলে বিদ্রূপ বাণ বর্ষণ করেন, তখন প্রকাশকমশাই এর কারণ বুঝতে পারেন না। অথচ অনেক সমালোচক দারোগার দপ্তরের ঘটনা সমাবেশের বৈচিত্র্য ও পুস্তক-গত ভাষা সম্বন্ধে প্রশংসা করেছেন একথা জানাতে তাঁর আনন্দ হয়।
বাণীনাথ নন্দী একটি গুরুতর কথার অবতারণা করেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘গত বৎসর বৈশাখ মাসে দারোগার দপ্তরে’মাংসভোজন’ নামে যে পুস্তকখানি বাহির হইয়াছিল, সেই সম্বন্ধে ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় শ্রদ্ধাস্পদ বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় আমাকে সমাজ-দ্রোহী বলিয়া প্রচার করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন। তবে যদি মাংস ভোজন পুস্তকের ঘটনার যথার্থ নাম ধামাদি এবং কার্য্যকলাপ যথার্থ বলিয়া অক্ষয়বাবুর নিকট প্রমাণ করিয়া দিতে পারি, তবে আমার উক্ত কলঙ্কের স্খালন হইবে।’ বাণীনাথ নন্দীর অত্যন্ত সম্মানে লেগেছিল ‘সমাজ-দ্রোহী’ শব্দটি। তাই তিনি প্রশ্ন করেন, ‘কিন্তু বিজ্ঞ, ভূতপূর্ব ‘সাধারণী’ পত্রের উপযুক্ত সম্পাদক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করি যে, আমরা যে সকল সমাজ-কালিমার প্রচার করি, সেই কালিমার প্রকৃত নিয়োক্তার নাম ধাম প্রভৃতি প্রকাশ করা কি আমাদের কর্তব্য?”
প্রকাশক এই কথা বলেই থামেননি। যেন ঘটনাপ্রবাহকে আরও স্পষ্ট করে দিচ্ছেন। ‘বিশেষতঃ উক্ত ঘটনার নায়ক, একজন সম্ভ্রান্ত উচ্চপদস্থ ব্যক্তি (বোধ হয় (!) মুন্সেফ)। আর অক্ষয়বাবু যে সময় সংবাদপত্র পরিচালন করিতেন, বোধহয়, উক্ত ঘটনা সেই সময়ে বাঙ্গালাদেশের মধ্যেই ঘটিয়াছিল। (অবশ্য কলিকাতার লোকে যে স্থানকে ‘বাঙ্গাল’ দেশ বলিয়া থাকেন।) অতএব অক্ষয়বাবুর পক্ষে উক্ত ঘটনাকে কাল্পনিক বলিয়া ধারণা করা কি বিজ্ঞতার কার্য্য হইয়াছে? অপর লোক হইলে আমরা এ বিষয়ে কিছুমাত্র উল্লেখই করিতাম না।’ বোঝা যাচ্ছে, অক্ষয়চন্দ্র সরকারের মন্তব্য বাণীনাথ নন্দী ভালো চোখে নেন নি। আর দারোগার দপ্তরের পক্ষ অবলম্বন করে নিজেদের বক্তব্য রাখতে দ্বিধা করেননি। শেষে কারুণিক ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছেন যেন তাঁর অনুকম্পায় পূর্ব পূর্ব বৎসরের মতো সেই বছরেও গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি হয়। দারোগার দপ্তর আরও উন্নতির পথে অগ্রসর হয়।
‘দারোগার দপ্তর’-এর ৭৪, ৭৫, ৭৬ সংখ্যা জুড়ে রয়েছে ‘ঘর-পোড়া লোক’। যার আর এক ব্যাখ্যা ‘অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!’ ১৩০৫ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ মাস তিন মাস ধরে ‘ঘর-পোড়া লোক’ প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশক বাণীনাথ নন্দী। মুদ্রণের কাজ করেছিল গ্রেট টাউন প্রেস। ৭৭ তম সংখ্যা ‘দারোগার দপ্তর’-এর বিষয় ‘দুইটী জুয়াচুরি’ বা ‘অর্থাৎ কলিকাতার ভিতর নিত্য নিত্য যে সকল জুয়াচুরি হইতেছে, তাহার দুইটী দৃষ্টান্ত!’ সন ১৩০৫, ভাদ্র মাস।
১৩০৫ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ‘দারোগার দপ্তর’-এর সপ্তম বর্ষ চলছে। ৭৯ তম সংখ্যা ‘ছেলে-ভুল’ বা ‘অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!’ প্রকাশ পেল। এটা কার্তিক সংখ্যা। দেখছি, টাইটেল পেজে প্রকাশক বাণীনাথ নন্দীর স্বাক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে। ৮০তম সংখ্যা, ১৩০৫-এর অগ্রহায়ণ ‘রাণী-না খুনি?’-র প্রথম অংশে ‘অর্থাৎ অপরিচিত ব্যক্তিকে বিশ্বাস করিবার চূড়ান্ত ফল!’ – এও রয়েছে বাণীনাথ নন্দীর স্বাক্ষর। ৮১ তম সংখ্যা ‘রাণী না খুনি’-র শেষ অংশ। পৌষ মাসের সংখ্যা। ‘শ্রীবাণীনাথ নন্দী’ স্বাক্ষর আর থাকছে না। অথচ তিনি প্রকাশক। ৮২ তম সংখ্যা। মাঘ, ১৩০৫-এ প্রকাশ পেল ‘রকম রকম’ (অর্থাৎ জুয়াচুরির অদ্ভুত বৃত্তান্ত!) -এই সংখ্যাও বাণীনাথের স্বাক্ষর বিহীন। অথচ তাঁর নাম রয়েছে প্রকাশক হিসেবে।
বঙ্গাব্দ ১৩০৬, বৈশাখের ১ তারিখে দারোগার দপ্তরের প্রকাশক বাণীনাথ নন্দী লিখলেন, ‘আমাদের এক্ষণে এরূপ ভরসা আছে যে, প্রিয়নাথবাবু ও আমার জীবিতকাল পর্যন্ত ইহার অস্তিত্ব লোপ হইবে না; তবে ইতিমধ্যে অন্য কোন অনিবার্য দৈব-দুর্ঘটনার সংঘটন হইলে আমরা নাচার।’ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কী যে দৈব দুর্ঘটনা ঘটল জানি না, বাণীনাথ নন্দী আর প্রকাশক রইলেন না। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ৩২ জ্যৈষ্ঠয় বিশেষ দ্রষ্টব্য শিরোনামে দারোগার দপ্তরের সম্পাদকও স্বত্বাধিকারী রূপে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, ‘বিশেষ দুঃখের সহিত প্রকাশ করিতে হইতেছে, দারোগার দপ্তরের সহিত এত দিবস পর্য্যন্ত শ্রীযুক্তবাবু বাণীনাথ নন্দী মহাশয়ের যে সংস্রব ছিল। অদ্য হইতে তাঁহার সেই সংস্রব বিলুপ্ত হইল।’ কতকগুলি কারণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কারণগুলির উল্লেখ নেই, বাণীনাথের হাত থেকে দারোগার দপ্তরের সমস্ত ভার গ্রহণ করে সেইদিন থেকে নতুন কার্য্যাধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী মহাশয়ের হাতে সেই গুরুভার অর্পণ করেন প্রিয়নাথ। এমনও লেখেন, ‘অদ্য হইতে দারোগার দপ্তরের সহিত বাণীবাবুর আর কোনরূপ সংস্রব রহিল না।’
দারোগার দপ্তরের দায়িত্ব নিলেন উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী। তিনি লিখেছেন, ‘অদ্য হইতে আমি দারোগার দপ্তরের কার্য্যাধ্যক্ষের গুরুভার গ্রহণ করিলাম। এখন হইতে টাকাকড়ি, চিঠিপত্র, বিনিময়-পত্রিকা প্রভৃতি আমার নামে নিম্নলিখিত ঠিকানায় পাঠাইবেন।’ ঠিকানা লেখা ছিল, ৭৯/৩/২ নং কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট, কলকাতা। পরে ১৬২ নং বহুবাজার স্ট্রিট। বৈঠকখানা, দারোগার দপ্তরের কার্যালয় ও ১৪ নং হুজুরিমলস লেন, বৈঠকখানা এবং ৮৮/১ কেরানি বাগান ইস্ট লেন থেকে দারোগার দপ্তর প্রকাশ পেত।
১৩০৭ সাল, পৌষ মাস। দারোগার দপ্তরের ১০৫ সংখ্যা বেরোল ‘মেলায় চুরি’ (অর্থাৎ কলিকাতার মহামেলায় প্রকাণ্ড চুরির অদ্ভুত রহস্য।) ছাপা হয়েছিল হিন্দুধর্ম প্রেস, ৬৬, আহিরীটোলা স্ট্রিট কলকাতা থেকে। মালিকের নাম ডি. এন. ঘোষ। ১০৬ সংখ্যা মাঘ-এ ‘মেলায় চুরি’র শেষাংশ, ১০৭-এ ‘লাসের অন্তর্দ্ধান’ (অর্থাৎ পুলিস প্রহরীর পাহারা হইতে মৃতদেহের হঠাৎ অন্তর্ধানের অদ্ভুত রহস্য!), ১০৮-এ ‘তারা রহস্য’ (অর্থাৎ তারা নাম্নী জনৈক স্ত্রীলোকের যেমন কৰ্ম্ম তেমনি ফল)। চৈত্র মাস শেষ হল। ১৩০৭ বঙ্গাব্দ শেষ হল ‘তারা রহস্য’ প্রকাশে। এদিকে দারোগার দপ্তরের নবম বর্ষও শেষ হয়ে গেল।
এবার পাচ্ছি ১৩১১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ ১৩৩ সংখ্যা। ‘মতিয়া বিবি’ (অর্থাৎ মতিয়া নামক জনৈক বিবিজানের লাসের অদ্ভুত অন্তর্দ্ধান) প্রকাশ পেয়েছে। প্রকাশক রয়েছেন শ্রীউপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী। ‘দারোগার দপ্তর’ কার্যালয় বদলেছে ১৪ নং হুজুরিমল্স লেন, কলিকাতায়। ছাপা হচ্ছে হিন্দু ধর্ম প্রেস থেকে। মুদ্রাকরের নামে বদল ঘটেছে। এবার মুদ্রাকর হলেন বি. এইচ. পাল। ‘মতিয়া বিবি’ প্রকাশ পেল দারোগার দপ্তরের দ্বাদশ বর্ষের প্রথম সংখ্যা রূপে। এই সংখ্যায় ছাপা হয়েছে প্রকাশকের নিবেদন। প্রয়োজনীয় অংশ উদ্ধার করি। শ্রীউপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী, দারোগার দপ্তরের কার্য্যাধ্যক্ষ, লিখেছেন, ‘দারোগার দপ্তর একাদশ বৎসর অতিক্রম করিয়া আজ দ্বাদশ বৎসরে পদার্পণ করিল। এই বঙ্গদেশে একখানা বাঙ্গালা মাসিক পত্রিকা বাঙ্গালি পাঠকগণ কর্তৃক বিশেষরূপ সমাদৃত হইয়া এত দিবস পর্য্যন্ত যে সমভাবে চলিয়া আসিতেছে, ইহা অপেক্ষা দারোগার দপ্তরের ন্যায় মাসিক পত্রিকার বিশেষ গৌরব আর কি হইতে পারে?’
‘দারোগার দপ্তর’ যে পাঠকদের হৃদয়কে বিশেষ রূপে আকৃষ্ট করেছিল এই দীর্ঘজীবনই তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। বারো বছরে যখন দারোগার দপ্তর পা দিয়েছে, সেই সময় পত্রিকার গ্রাহকসংখ্যা সীমাবদ্ধ। উপেন্দ্রভূষণ লিখছেন, ‘কিন্তু বলিতে কি, সরকারি কার্য্যের গুরুভার বহন করিয়া তাহার উপর যদি প্রিয়নাথবাবুকে এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে না হইত, অর্থাৎ তাঁহার সমস্ত সময় যদি তিনি এই দারোগার দপ্তরের উপর নির্ভর করিতে পারিতেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, এই দারোগার দপ্তর অসংখ্য পাঠকের মনস্তুষ্টি করিত।’
দারোগার দপ্তরের লেখক একজন। তাঁর নাম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। উপেন্দ্রভূষণ একথাই লিখছেন, ‘যে কোন প্রদেশে বা যে কোন ভাষায় মাসিক পত্রিকা বাহির হইয়া থাকে, তাহাতে ভিন্ন ভিন্ন লেখকের লেখনি-প্রসূত ভিন্ন ভিন্ন প্রবন্ধ সকল স্থান পায়; কিন্তু দারোগার দপ্তরে কেবল প্রিয়নাথবাবু ভিন্ন অপর কোন লেখকের কোন প্রবন্ধ স্থান পায় না বলিয়াই, সময় সময় পত্রিকা বাহির হইতে বিলম্ব হয়।’
আরও কিছু কথা বলা দরকার। উপেন্দ্রভূষণের বক্তব্য হল, মাসিক পত্রিকা ঠিক মাসে মাসে বের না হলে বিশেষ দোষের বিষয় সত্য কিন্তু পাঠকরা তা অতটা লক্ষ্য করেন না। বলছেন, ‘ইহাও লেখক ও কার্য্যাধ্যক্ষের পক্ষে কম সৌভাগ্যের বিষয় নহে। সে যাহা হউক, মাসিক পত্রিকা নিয়মিত রূপে বাহির করিতে হইলে লেখকের কৰ্ত্তব্য যে, প্রবন্ধটী যাহাতে প্রত্যেক মাসে নিয়মিতরূপে লেখা হয়, তাহার দিকে বিশেষরূপে দৃষ্টি রাখাও প্রকাশকের কর্তব্য, –যাহাতে প্রবন্ধটী ঠিক সময়মত প্রকাশিত হয় তাহার পক্ষে বিশেষরূপে সচেষ্ট থাকা। প্রিয় পাঠক, আমরা এর আগেই দেখেছি দারোগার দপ্তরের লেখককে কবি-উপন্যাসিক অভিধায় ভূষিত করায় পূর্বতন প্রকাশক বাণীনাথ নন্দী রীতিমত প্রকাশকের নিবেদনে বেশ কিছু কথা খরচ করেছিলেন। এই সংখ্যায় তো উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী দারোগার দপ্তরকে প্রবন্ধ হিসেবে স্পষ্ট উল্লেখ করে দিলেন।
‘দারোগার দপ্তর’ সেই সময় বিলম্বে প্রকাশ পেত। স্বীকারোক্তি, ‘গত বৎসর লেখক ও প্রকাশক কেহই তাঁহাদিগের কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্ম ঠিক প্রতিপালন করিয়া উঠিতে পারেন নাই বলিয়া, আমরা গ্রাহকগণের নিকট বিশেষরূপে লজ্জিত আছি ও যাহাতে এক মাসের দপ্তর অপর মাসে গ্রাহকগণের হস্তগত না হয়, তাহার নিমিত্তই এক বৎসর বাদ দিলাম, উহা কেবল কাগজ কলম বাদ হইল মাত্র।’ গ্রাহকদের তাতে কিছুমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। সংখ্যায় সংখ্যায় যে নম্বরটি লেখা থাকে তারও কোনও ব্যতিক্রম নেই। কেবলমাত্র কাজের সুবিধার জন্য ও দেরিতে দারোগার দপ্তর বের হচ্ছে একথা যাতে গ্রাহকরা আর বলতে না পারেন তার জন্য এই উপায় অবলম্বন করা হয়েছিল। প্রকাশক মশাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘কিন্তু এবার আমাদিগের সম্পূর্ণ ভরসা আছে যে, দারোগার দপ্তর বাহির হইতে সেইরূপ বিলম্ব আর ঘটিবে না।
আরও জানিয়েছেন, প্রিয়নাথবাবু তাঁকে কথা দিয়েছেন যে তাঁর ওপর সরকারি কাজের যতই গুরুভার ন্যস্ত হোক না কেন তারই মধ্যে যেমন হয় ‘মাসে মাসে তিনি একটা প্রবন্ধ লিখিয়া দিবেন’ ও প্রকাশকও ঠিক সময়মত তা প্রকাশ করে গ্রাহকদের মনস্তুষ্টি করতে রীতিমত চেষ্টা করবেন। ওই সংখ্যাতেই উপেন্দ্রবাবু পাঠকদের ভরসা দিয়েছেন, ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত দারোগার দপ্তর প্রস্তুত এবং প্রতি মাসে মাসে তা গ্রাহকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এখানেও দারোগার দপ্তরকে ‘প্রবন্ধ’ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
গ্রাহকরা যেভাবে দারোগার দপ্তরকে আদরপূর্বক গ্রহণ করেছেন তাতে প্রীত হয়ে লেখক ও প্রকাশক মিলে ঠিক করেছেন পাঠকদের কিছু উপহার দেওয়ার প্রয়োজন। উপহার সবচেয়ে ভালো বই ছাড়া আর কি হতে পারে? অগত্যা-’উপহারের পুস্তক কেবলমাত্র দুইখানি হইলেও উহা পাঠে যে গ্রাহকগণ বিশেষরূপ সন্তোষ লাভ করিবেন, তাহা আমাকে বলিয়া দিতে হইবে না।’ সগর্বে জানাচ্ছেন উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী।
দারোগার দপ্তরের গ্রাহক-পাঠক সম্পর্কে ধারণা পাই। ‘দারোগার দপ্তরের গ্রাহকগণ সম্বন্ধে এইখানে একটা কথা বোধ হয়, বিশেষরূপে আবশ্যক হইয়া পড়িয়াছে। দারোগার দপ্তর মাসে মাসে প্রেরিত হইলে ও তাহার কোন সংখ্যা প্রাপ্ত হইয়াছেন কি না, তাহার কিছুই তাঁহারা প্রথমে বলেন না; অনেক সময় তাঁহাদিগের অনবধানে অনেক সংখ্যা হারাইয়াও গিয়া থাকে। কিন্তু যখন বৎসর শেষ হয়, সেই সময় তাঁহারা সংখ্যাগুলি মিলাইয়া দেখেন ও অনেকগুলি সংখ্যা যখন প্রাপ্ত হন না, তখন আমাদিগকে পত্র লিখিয়া জানান যে, ঐ সকল সংখ্যা তাঁহারা প্রাপ্ত হন নাই। আমরাও সাধ্যমত তাঁহাদিগকে ঐ সকল সংখ্যাগুলির মধ্যে যতদূর পারি, পুনরায় প্রেরণ করিয়া থাকি। ইহাতে আমাদিগের যে কতদূর ক্ষতি হয়, তাহার দিকে গ্রাহকগণের একটু বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন, ইহাই আমার অনুরোধ।
১৩১২ বঙ্গাব্দ। জ্যৈষ্ঠ মাস। দারোগার দপ্তরের ত্রয়োদশ বর্ষ চলছে। ১৪৬ সংখ্যার বিষয় ‘পাহাড়ে মেয়ে’। দারোগার দপ্তরের ঠিকানা ১৪ নং হুজুরিমলস লেন, বৈঠকখানা, কলকাতা। প্রকাশক উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী। ছাপাখানার নাম বাণী প্রেস, ৬৩ নং নিমতলা ঘাট স্ট্রীট, কলকাতা। মুদ্রাকরের নাম এম. এন. দে। সাল ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ।
১৮১ সংখ্যার নাম ‘বাইজী’। দারোগার দপ্তরের ষোড়শ বর্ষ। ১৩১৫ বঙ্গাব্দ। বৈশাখ মাস। প্রকাশক, তাঁর ঠিকানা, মুদ্রণ ও মুদ্রাকরের ঠিকানা অপরিবর্তিত। মুদ্রণের সাল খ্রিস্টাব্দে ১৯০৮ লেখা আছে। ১৮২ সংখ্যক দারোগার দপ্তর হল ‘রাস্তায় খুন’। সাল ১৩১৫ বঙ্গাব্দ, জ্যৈষ্ঠ। ইংরাজি ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দ। ১৮৩ সংখ্যক—’হত ভৃত্য’ (আষাঢ়), ১৮৪–’স্ত্রী না রাক্ষসী’ (শ্রাবণ), ১৮৫–’গোঁসাইঠাকুর’ (ভাদ্র), ১৮৬–’জাল চেক’ (আশ্বিন), ১৮৭———ছেলে ধরা’(কার্তিক), ১৮৮–’বিবাহ-সমস্যা’ (অগ্রহায়ণ), ১৮৯–’পূজারি বামুন বা পুরোহিত’ (পৌষ), ১৯০–’সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত’ (মাঘ) ও ১৯১ –’সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত’ (ফাল্গুন)। মাঘে প্রথম অংশ, ফাল্গুনে দ্বিতীয় অংশ মুদ্রিত। ‘সেকেলে পশ্চিমে ডাকাত’-এর প্রথম অংশের সূচনার পূর্বে প্রকাশক ভূমিকা লিখেছেন। ভূমিকা অংশটি উদ্ধার করি।
‘ঠগিবিভাগের সুপারিন্টেডেন্ট কর্ণেল ডব্লু. এইচ. শ্লিম্যান (Colonel W. H. Sleeman General Superintendent of Operations for the Suppression of Thuggee) ১৮৪৮ খৃষ্টাব্দের ২৪ নভেম্বরে লিখিত যে রিপোর্ট ইন্ডিয়া গভর্ণমেন্টের সেক্রেটরি শ্রীযুক্ত এইচ্. এম. ইলিয়ট (H. M. Elliot Esq’ Secy. to the Government of India) সাহেবকে প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা হইতে কয়েকজন ডাকাত সর্দ্দারের ইতিহাস সংগ্রহ করিয়া এই পুস্তক লিখিত হইল। ইহাতে ১৮১৮ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৮৩৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত কয়েকটা ডাকাতির বিবরণ আছে মাত্র।’
১৩১৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র, ১৯২ সংখ্যা ‘বিষম জাল’। ১৯৩–’খুন না চুরি?’ সন ১৩১৬-র বৈশাখ। সপ্তদশ বর্ষ। জ্যৈষ্ঠয় ‘গুম খুন’। দারোগার দপ্তরের ১৯৪ সংখ্যা। আষাঢ় ১৩১৬, ১৯৫ সংখ্যা ‘অদ্ভুত ফকির’। শ্রাবণে বেরোল ‘লুকোচুরি’, ১৯৬ সংখ্যা। ভাদ্র (১৯৭) – ‘প্রেমের খেলা বা খুনে প্রেমিক’। আশ্বিন (১৯৮)——প্রেম পাগলিনী’, কার্তিক (১৯৯)–’মরণে মুক্তি’, অগ্রহায়ণ (২০০)–’মরণে মুক্তি (দ্বিতীয় অংশ)। এবারে দ্বিতীয় অংশে মুদ্রাকরের নাম পাচ্ছি জে. এন. দে, বাণী প্রেস, ৬৩ নং নিমতলা ঘাট স্ট্রীট, কলকাতা, ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ।
দারোগার দপ্তরের ২০১ সংখ্যা ‘দুই শিষ্য’ (পৌষ, ১৩১৬), ২০২-’জ্ঞাতিশত্রু’ (মাঘ), ২০৩ – ‘বিদায় ভোজ’ (ফাল্গুন), ২০৪–’জোড়াপাপী’ (চৈত্র ১৩১৬), ২০৫–’ভূতের বিচার’ (১৮ বর্ষ ১৩১৭, আশ্বিন)।
২০৩ সংখ্যা ‘বিদায় ভোজ’ থেকে প্রকাশকের নাম অপরিবর্তিত থাকলেও দারোগার দপ্তরের কার্যালয় দেখছি বদলে গেছে। ৯ নং সেন্ট জেমস্ লেন হয়েছে নতুন ঠিকানা। মুদ্রাকর ও মুদ্রণস্থান অপরিবর্তিত। ২০৪ সংখ্যায় দারোগার দপ্তরের কার্যালয় ছাপা হয়েছে ৯ নং সেন্ট জেমস স্কোয়ার। ‘লেন’-এর স্থলে ‘স্কোয়ার’ হয়েছে।
‘দস্যুর প্রতিহিংসা’,’মাণিক চোর’,’স্ত্রীবুদ্ধি’,’গণ্ডগোল’,’মানবী-না-দেবী?’, ‘অদৃষ্ট ফল’,’নবাবী বুদ্ধি’,’সয়তানি বুদ্ধি’ ডিটেকটিভ গল্প হিসেবে স্থান পেয়েছে। ‘মানবী-না-দেবী’ থেকে মুদ্রকের স্থান নিয়েছেন কে. বি. পট্টনায়ক, ঠিকানা—উৎকল প্রেস, ৮, সেন্ট জেমস স্কোয়ার, কলকাতা।
আমরা যেমন যেমন পেয়েছি, তেমনভাবেই দারোগার দপ্তরকে সাজিয়েছি। সোমনাথ দাশগুপ্ত ক্রমিক সংখ্যা অনুসারে দারোগার দপ্তরের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। যা এই খণ্ডে ছাপা হল। সোমনাথ দাশগুপ্তর আগ্রহ ছাড়া ‘দারোগার দপ্তর’ তৃতীয় খণ্ড প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না—একথা আবার স্বীকার করি। যদি আরও দারোগার দপ্তর পাওয়া যায় তাহলে ভবিষ্যতে চতুর্থ খণ্ড হবার দাবি রাখে। এই সংকলনে সামান্য কিছু কিছু অংশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেখানে (…) এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে।
‘পুনশ্চ’-র প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধেয় শ্রীশংকরীভূষণ নায়ককে আমার প্রণাম। তাঁর ইচ্ছায় এত বড়ো কাজে আমরা হাত দিয়েছিলাম। বন্ধু প্রকাশক সন্দীপ নায়ককে শুভেচ্ছা জানাই। সে আগ্রহী হয়ে এই কাজে নেমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ভাই সপ্তর্ষি নায়ককেও শুভেচ্ছা। পুনশ্চ-র প্রত্যেক কর্মীকে আমার পক্ষ থেকে শুভকামনা জানাই। ‘দারোগার দপ্তর’ তৃতীয় খণ্ড আমরা উৎসর্গ করলাম এই গ্রন্থের পরিকল্পক বিশিষ্ট লেখক শ্রীপান্থকে। নিখিল সরকার নামে যিনি পরিচিত। নিখিলদার স্নেহসান্নিধ্য সন্দীপ ও আমি উভয়েই পেয়েছি। তাঁর স্মৃতিতে প্রণাম। আমরা নিশ্চিত, নিখিলদা আকাশে উজ্জ্বল তারা হয়ে আমাদের এই কাজকে দেখছেন।
অরুণ মুখোপাধ্যায়
চন্দননগর, হুগলি
২৫ বৈশাখ, ১৪২৮ / ৯ মে, ২০২১
.
‘দারোগার দপ্তর’ বিষয়ক গোয়েন্দাগিরি
‘দারোগার দপ্তর’-এর গল্পগুলি যথাসম্ভব স্বল্পপরিসরে একত্রে গ্রন্থবদ্ধ করার যে প্রয়াস ‘পুনশ্চ’র তরফে গত দুটি খণ্ডে নেওয়া হয়েছে, তাতে পাঠকের পক্ষে মূল গল্পের স্বতন্ত্র সাবলীল পাঠ সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন সংখ্যায় লেখক বা প্রকাশকের মন্তব্য বা বিজ্ঞাপনগুলির মূলকথাটুকু সম্পাদক উদ্ধৃত করে দিয়েছেন। এগুলোই কিন্তু হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভবিষ্যৎ গবেষণার সূত্র ও তথ্যের আকর। ১২৯৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে বা তার পরে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যা থেকে অন্তত ১৩১৯ আষাঢ় মাসের ২১৯ সংখ্যা অবধি ২১ বছর ধরে প্রকাশিত হয়েছিল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় রচিত দারোগার দপ্তর। প্রায় প্রতি বছরের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশকের মন্তব্য বা নিবেদন দেখা যায়, যা মূলত বিজ্ঞাপন বা আত্মপ্রশস্তি হলেও সমকালীন ঘটনা পরম্পরার অনেক কিছুই আমাদের জানায়। এগুলির পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন আরো নানা সুপ্ত সম্ভাবনাময় তথ্যের উৎস হয়ে উঠতেই পারে। পরবর্তীতে সমস্ত দারোগার দপ্তরের সম্পাদকীয় ও বিজ্ঞাপন পূর্ণাঙ্গরূপে পাঠকের দরবারে নিয়ে আসার একটি দায়বদ্ধতা তাই প্রকাশনার তরফে থেকেই যায়।
তাছাড়া, আগের দুই খণ্ডের গল্পগুলি দারোগার দপ্তরের কোন কোন সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল সেই ক্রমিক সংখ্যা গ্রন্থিত হয়নি। প্রকাশের সাল তারিখ যদিও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রতি গল্পের শেষে দেওয়া ছিল। সাধারণ পাঠকের পক্ষে গল্পের রসাস্বাদন ব্যাহত না হলেও হয়তো তা গবেষকেদের কাজের প্রতিবন্ধক হতেও পারে। বিভিন্ন সূত্রে যে বিপুল সংখ্যক দারোগার দপ্তরের গল্পসংখ্যার কথা জানা যায়, তার অর্ধেকেরও কম গ্রন্থবদ্ধ হওয়ায় বাকি গল্পের খোঁজ পাওয়ার জন্য প্রথমেই দারোগার দপ্তরের সমস্ত রচনার শিরোনাম ক্রমানুসারে তালিকাবদ্ধ করা খুবই জরুরী বোধ করেছিলাম। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই এই কাজে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়া শুরু করি ২০১৯ সালের জুলাই মাস নাগাদ। তবে তারও একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। গুরুচন্ডালি নামের একটি ওয়েবসাইটে দীর্ঘকাল আড্ডার সূত্রে সৈকত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে আলাপ, যাঁর পাঠবিস্তার আমার কাছে শ্রদ্ধার জায়গা। ২০১৯-এর জুন মাসে তিনি সেখানে একটি আলোচনা শুরু করেন ‘প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনিগুলো’ শিরোনামে। আলোচনাটির মূলসূত্র, তাঁর শব্দচয়নে অনেকটা এরকম, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, হয়ত নিজেরই অজান্তে, সমসময়েই ঘটে যাওয়া আলোকপ্রাপ্তির তলায় তলায়, উনিশ শতকের শেষ দুই দশক আর অন্তত বিংশ শতকের প্রথম দশকের, শুধু অপরাধকেই কেন্দ্র করে কলকাতা কেন্দ্রিক অন্য এক তৎকালীন সামাজিক বর্তমানের ইতিহাস লিখে উঠতে পেরেছিলেন।’পুনশ্চ’ প্রকাশিত দুখণ্ডের ‘দারোগার দপ্তর’ পড়ে তারই কিছু গল্পের আলোচনার মাধ্যমে সৈকত লেখাটি এগিয়ে নিয়ে যান। প্রস্তাবনা করেন, এই কাহিনিগুলো থেকে সেকেলে কলকাতার একটা অপরাধকেন্দ্রিক মানচিত্র তৈরি করে ওঠা সম্ভব যা শহর হিসেবে কলকাতার বৃদ্ধির সাথে সাথে আশপাশের গ্রাম বা রাজ্য থেকে আসা বিভিন্ন অভিবাসী মানুষের, মূলত ব্যবসার সুবিধের জন্য, নিজেদের জাত-ধর্ম অনুযায়ী আবাস খুঁজে নেওয়ার সামাজিক ইতিহাসেরও খোঁজ দেয়। সময়ের সাথে এগোতে এগোতে লেখাতে তাঁর নানা জিজ্ঞাসা, সংশয় ও সন্দেহ লিপিবদ্ধ হতে থাকে আর উৎসাহী সাহায্যকারী হিসেবে সেসবের নিরসনে জুলাই মাসে সেই প্রথম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ও দারোগার দপ্তর বিষয়ে আমি ইন্টারনেটের দ্বারস্থ হয়ে খোঁজাখুজি শুরু করি।
প্রথমে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল আর্কাইভে সংরক্ষিত শ্রাবণ, ১৩০১ সালে চুঁচুড়া থেকে প্রকাশিত ‘বাসনা’ পত্রিকার ১ম খণ্ড ৪র্থ সংখ্যায় ‘দারোগার দপ্তর’-এর একটি বিজ্ঞাপনের খোঁজ পাওয়া যায় যেখানে বলা হয়েছিল, “দারোগার দপ্তর কি? – সুপ্রসিদ্ধ লেখক শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক লিখিত মাসিক উপন্যাস। অর্থাৎ মাসে মাসে এক একখানি নূতন উপন্যাস পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়, বার মাসে বারখানি নূতন উপন্যাস গ্রাহকগণ পাইয়া থাকেন। মধুর কথা, মধুরভাব; –মানবচিত্র উজ্জ্বল রঙে চিত্রিত, বীররৌদ্র-করুণ-বীভৎস-রসে পূর্ণ, জাল জুয়াচুরি খুনের কথা, – ধর্মের ভয়, অধর্মের ক্ষয়, —সতী রমণীর চিত্র, কুলকলঙ্কিনীর আখ্যান, -সাধু-লম্পট শঠের কাহিনি, –এ সমস্তই ইহাতে দেখিতে পাইবেন। এক কথায় দারোগার দপ্তরকে মহাভারত বলিলে অত্যুক্তি হয় না। সতী রমণীর একান্ত পাঠ্য। প্রত্যেক গৃহস্তের গৃহে ইহা বিরাজিত হউক। ‘দারোগার দপ্তরের’ মূল্য মায় ডাকমাশুল বার্ষিক দেড়টাকা মাত্র। আজ তাহার উপর আবার প্রায় দুইটাকা মূল্যের সারবান, মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় নিম্নলিখিত তিনটি উপহার অতিরিক্ত আট আনা মূল্যে প্রদত্ত হইবে।’ এক্ষেত্রে উপহার ছিল মোট দেড়টাকা মূল্যের ‘ঠগী কাহিনি’ ১ম ও ২য় খণ্ড এবং চার আনা মূল্যের ‘পঞ্চস্তোত্র’। কার্যাধ্যক্ষ বাণীনাথ নন্দীর ঘোষণায় “উপহারপ্রার্থী গ্রাহকমাত্রকেই উপহারের মূল্য, উপহার পাঠাইবার পোস্টেজ দুই আনা এবং ভি. পি. খরচা দুই আনা, মোট আট আনা অধিক দিতে হইবে। কিন্তু যিনি আফিসে আসিয়া টাকা জমা দিবেন ও হস্তে উপহার গ্রহণ করিবেন, তাঁহাকে কেবল সাত সিকা দিলেই চলিবে।’ জনপ্রিয় বই বিক্রির সাথে উপহার হিসেবে ডিসকাউন্টে অনামী বই বিক্রি করে দেওয়ার ব্যবস্থা বেশ কৌতূহলোদ্দীপক এবং প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় অরুণবাবু উল্লিখিত বিনামূল্যে উপহার বিতরণের ব্যবস্থার থেকেও এ খানিক আলাদা।
পশ্চিমবঙ্গ পাবলিক লাইব্রেরি নেটওয়ার্কের ডিজিটাল সংগ্রহে রক্ষিত ‘দপ্তর’-এর নিজস্ব বইয়ের পিছনের বিজ্ঞাপনে নিজের পরিচয়, “প্রত্যেক বর্ষেই ১২টি লোমহর্ষণকারী ভয়ঙ্কর খুন, জাল, জুয়াচুরি, চুরি, ডাকাতির গল্প আছে। প্রতি বর্ষ একত্রে বাঁধান, সোনার জলে নাম লেখা।” এখান থেকে আরো জানা যায়, ইতিপূর্বে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ‘ডিটেকটিভ পুলিশ’ নামে ছয় খণ্ডের জনপ্রিয় বই লিখেছেন। প্রথম কাণ্ড—’ডাক্তারবাবু’, দ্বিতীয় কাণ্ড—’দশটি গল্প’, তৃতীয় কাণ্ড-’পঞ্চবালিকা’, চতুর্থ কাণ্ড –’রাজা সাহেব’, পঞ্চম কাণ্ড –’পাহাড়ে মেয়ে’, ষষ্ঠ কাণ্ড—’আদরিণী বা ছোট আদালতের জাল মকৰ্দ্দমা’ (উপন্যাস, সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখিত নারীচরিত্র)। এই সিরিজের শেষ ‘আদরিণী’-র প্রকাশকাল ১৮৮৭ অর্থাৎ ১২৯৩, লেখক স্বাক্ষর করছেন ৯ চৈত্র, ১৮০৮ শকাব্দ। আর সিরিজের প্রথম বই ডাক্তারবাবু (২য় সং, ১৩০০ সাল) বইয়ের শুরুতে বলা হয়েছে “ ডিটেকটিভ পুলিশ’ ইতিপূর্বে ‘বিজলী’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকায় সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত হইত।” স্বাক্ষরকারী শ্রীপ্রিয়নাথ শৰ্মা, জয়রামপুর, ২৫শে কার্তিক, ১৮০৯ শকাব্দ। দ্বিতীয় সংস্করণ অগ্রহায়ণ, ১৮১৫ শকাব্দ, তখনও লেখকের ঠিকানা জয়রামপুর, তাঁর জন্মস্থান। ৯ জুলাই ১৮৯৬ প্রকাশিত হয় তাঁর উপন্যাস ‘মানিনী”। তবে পরে আমরা দেখব এ-বইগুলির বেশিটাই, হয়ত সবই, ক্রমশ ‘দপ্তর’-এর নানা সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। এই বিজ্ঞাপনে জানা গেল প্রিয়নাথ বাবুর লেখা অন্যান্য বইয়ের নাম–১) ‘প্রসিদ্ধ দস্যুদলপতি তান্তিয়া ভীল বা প্রতিমূর্তি সহিত তান্তিয়া ভীলের বিস্তৃত জীবনী’ (১২৯৬ সাল, ২২ নভেম্বর ১৮৮৯), ২) ‘সেনাপতি (টিকেন্দ্রজিৎ, তিনখানি প্রতিমূর্তি সহিত)’, ৩) ‘ঠগী-কাহিনী’ (দুই খণ্ডে, সুন্দর বাঁধান, সোনার জলে নাম লেখা, ২৭ মে ১৮৯৪), ৪) ‘অভয়া’ (সামাজিক উপন্যাস, ২০ জুন ১৮৯৫), ৫) ‘পারসীক গল্প’ (পুরাতন উর্দু গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও অনুবাদিত, ১৩০৪ সাল, ১৮৯৭)। প্রকাশকালগুলি পরে পাওয়া। এছাড়া পরবর্তীকালে তাঁর লেখা গল্পের বেশ কিছু সংকলন গ্রন্থের উল্লেখও পাওয়া যায়- ১) ‘প্রিয়নাথ গ্রন্থাবলী’ (১৯১০), ২) ‘পাপের ভরা’ (১৩১৮ সাল, ২৯ আগস্ট ১৯১১), ৩) ‘একাদশ রহস্য’ (১৩১৮ সাল, ২৪ এপ্রিল ১৯১২), ৪) ‘পঞ্চপ্রদীপ’ (২৪ এপ্রিল ১৯১২)। ‘ডিটেকটিভ পুলিশ’-এর দ্বিতীয় কাণ্ড ‘দশটি গল্প’ বইয়ের গল্পগুলির শিরোনাম (১) ‘জুয়াচোরের জমিদারী বন্ধক’, (২) ‘চোর টেলিগ্রাফ বাবু’, (৩) ‘সহরে চোরও পাড়াগেঁয়ে চোর’, (৪) ‘জুয়াচোরের জুয়াচুরি অফিস’, (৫) ‘সাহেবী জুয়াচুরি’, (৬) ‘চোরের ব্রাহ্মণ ভোজন’, (৭) ‘একখানি নোট দুখানি করা’, (৮) ‘জুয়াচুরির চোরামাল’, (৯) ‘এ মেয়ে পুরুষের বাবা’, (১০) ‘ব্যবসায়ীর আত্মকথা’ জানা গেল ব্রিটিশ লাইব্রেরির ডিজিটাল আর্কাইভে রাখা ‘কুলসম’ বইটির শেষের বিজ্ঞাপন থেকে। ১৮৯২ সালে সংস্কৃত প্রেস থেকে প্রকাশিত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, এম. এ. প্রণীত ‘ধর্মপ্রবন্ধ’ বা জগদীশ দাসাধিকারী এবং প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় সংকলিত প্রকাশকালের উল্লেখবিহীন ‘প্রাচীন নদীয়ার অবস্থিতি মীমাংসা’, ১৮৮২ সালে প্রকাশিত অনুবাদ ‘বিলাতী সতী’, ১২৮৪ (১৮৭৭) সালে রাজকীয় যন্ত্রে মুদ্রিত ‘নগেন্দ্ৰবালা’ নাটক বা ১২৮৪ সালে ‘রাজশাহী সম্বাদ’ পত্রের সম্পাদক শ্রীযুক্ত জগচ্চন্দ্র সরকার চৌধুরীর উৎসাহে অকালবিলুপ্ত ‘হিন্দুহিতাকাঙ্ক্ষিণী’ পত্রিকার লেখক শ্রীপ্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত রাজশাহী প্রেসে মুদ্রিত ‘বিলাপ পদ্য’ প্রথম খণ্ড (দুটি কবিতা) নামক কবিতার বইয়ের উল্লেখ পেলেও তাদের দারোগাবাবুর রচনা হিসেবে নিশ্চিত করে উঠতে পারিনি।
সতেরো বছর আগে যে সুবিধা ছিল না, বর্তমানে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী উদ্যোগে দেশী-বিদেশী গ্রন্থাগার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদান্যতায় দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকাদি ডিজিটাইজেশন এবং আর্কাইভিং-এর সুবাদে, ঘরে বসেই নানা সূত্র থেকে এই দারোগার দপ্তরের অনেকগুলি সংখ্যা সংগ্রহ করা ছিল আগে থেকেই। বাকিগুলি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেল ব্রিটিশ লাইব্রেরির ডিজিটাইজ করা স্বাধীনতাপূর্ব ভারতের বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ থেকে। ডিজিটাইজ করা ‘দি ক্যালকাটা গেজেট’-এর ত্রৈমাসিক অ্যাপেন্ডিক্স ও বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ খুঁজে কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক মাসের মধ্যেই অন্তত ২১৯ টি দারোগার দপ্তরের সংখ্যা প্রকাশের উল্লেখ পাই, যার মধ্যে দশটির (১২৩-১৩২) নাম জানা যায়নি ক্যাটালগে নামগুলির এন্ট্রি না থাকার কারণে। বৈশাখ ১৩১১ সংখ্যায় ১৩৩ নং দারোগার দপ্তর ‘মতিয়া বিবি’ গ্রন্থে প্রকাশক তথা কার্যাধ্যক্ষ উপেন্দ্রভূষণ চৌধুরী যে ‘প্রকাশকের নিবেদন’ লিখেছেন, তা থেকে বোঝা যায় ওই সংখ্যাগুলির প্রকাশ খুবই অনিয়মিত ভাবে হয়েছিল। বর্তমান খণ্ডের ভূমিকায় অরুণবাবু বক্তব্যটি উদ্ধৃত করেছেন। মনে হয় ওই দশটি সংখ্যা ১৩০৯ আষাঢ় থেকে ১৩১০ চৈত্র অবধি অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হওয়ায় দু বছরে ২৪ টি সংখ্যার বদলে মোট ১২ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়।
যে সংখ্যাগুলির ডিজিটাল কপিগুলি সংগ্রহ করা গেছে, তা থেকে গল্পটির পূর্ণাঙ্গ নাম, অর্থাৎ বন্ধনী ভুক্ত কাহিনির বিষয়-পরিচায়ক বাক্যটি সহ উদ্ধার করা সম্ভব হল। এমনকি প্রতি সংখ্যার শেষে পরবর্তী সংখ্যার পুরো শিরোনামটি ‘যন্ত্রস্থ’ হিসেবে ছাপা হত বলে আরো কিছু সংখার শিরোনাম মূল বইটি হস্তগত না হলেও জানা গেছে। আবার কিছু বইয়ের ক্ষেত্রে মূল গল্পটির নাম ছাড়া কোনো বন্ধনীভুক্ত বিবরণ বইতেই মুদ্রিত হয়নি। অন্য বইগুলির ক্ষেত্রে ক্যাটালগে শুধু নামটুকুর উল্লেখ থাকায়, সেটুকুই জানানো গেল। সব বই খুঁজে পাওয়া গেলে এই অসম্পূর্ণতাও ভবিষ্যতে পূরণ করার দায় থেকে গেল। স্থানাভাবে এখানে তালিকাটি সংক্ষিপ্তভাবে শুধু ক্রমিক সংখ্যা, প্রকাশকাল ও নাম হিসেবে রইল। কোন সংখ্যা কত কপি ছাপা হয়েছিল, বইয়ের আকার কেমন ছিল, প্রেস থেকে রিলিজের তারিখ কত, দামের উল্লেখ, এমনকি অনেকক্ষেত্রে ডেসক্রিপটিভ ক্যাটালগে ইংরিজিতে গল্পের নির্যাস ইত্যাদি তথ্যও লাইব্রেরি ক্যাটালগে মজুত থাকায়, এসবের যেটুকু জানা গেছে সেটুকুর খতিয়ান পরবর্তী কোনো সময় তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার ইচ্ছে রইল।
‘বনমালী দাসের হত্যা’ একক বই হিসেবে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯১ সালের ২৬ জুন (ক্যাটালগের ৪৬৮ নং এন্ট্রি) ১২mo dy. সাইজের ৪৮ পাতার এই বইটি ১০০০ কপি ছাপা হয়। দাম ছিল চার আনা। চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, ৮, টেমার’স লেন, কলকাতা বইটির মুদ্রক ও প্রকাশক। কপিরাইটের অধিকারী তথা লেখক প্রিয়নাথ মুখার্জীর ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ২৮৮, বৌবাজার স্ট্রীট, কলকাতা। ‘The Murder of Banamali Das’ বইটির বিষয় – ‘Banamali Das was a jeweller (sic) at Radha Bazar. He was murdered by three Musalmans of bad character who came from Lucknow. The writer is a well known detective officer and he gives a faithful description of how he got a clue to the murder. ‘ কিন্তু বইটি প্রথম প্রকাশের সময় এটি ‘দারোগার দপ্তর’ হিসেবে নামাঙ্কিত আদৌ ছিল কিনা হাতে নিয়ে না দেখে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া মুশকিল। কারণ, ১৮৯৩ সালের ১৭ মে সংখ্যার The Calcutta Gazette-এর অ্যাপেন্ডিক্স হিসেবে ১৮৯২ এর চতুর্থ কোয়ার্টারের, অর্থাৎ ১৮৯২ এর ৩১ ডিসেম্বর অবধি বেঙ্গল লাইব্রেরির বইয়ের যে ক্যাটালগ ছাপা হয়, তার ১১৫৪ নং এন্ট্রি (বাংলা ফিকশন ক্যাটেগরির দ্বিতীয় এন্ট্রি) হিসেবে প্রথম আবির্ভাব দারোগার দপ্তর-১ এর। জানা যাচ্ছে একত্রে চারটি গল্প নিয়ে ১৭১ পাতার এই গ্রন্থটি ১০০০ কপি ছাপা হয় ২০ জুলাই ১৮৯২ তে। দাম ১ টাকা। মুদ্রক উমেশ চন্দ্র সামন্ত, ২, ক্যারি’স চার্চ লেন, প্রকাশক, প্রমথ নাথ মুখার্জি, ৮৮/১, কেরানী বাগান ইস্ট লেন। size 8vo 12, বিষয়ের পরিচিতি হিসেবে লেখা রয়েছে—‘contains accounts of four criminal cases in Calcutta detected by one of the Detective officers of Calcutta police, Babu Priya Nath Mukherjee, the author. It is an interesting work as giving much valuable information about the low life in Calcutta and the facility the numerous brothels, coffee houses &c., afford for commission of crime.’
১৮৯৩ সালের ২১শে মে, দারোগার দপ্তরের ৫ থেকে ১২ সংখ্যা একত্রে ১৪৪ পাতার বই হিসেবে প্রকাশিত হয়, ১২mo dy সাইজে, ১০০০ কপি, এক টাকা দামে। ‘contains harrowing accounts of murder and theft committed in different parts of the country.’ মুদ্রক পালটে হয়েছে এ. টি. চক্রবর্তী, ১০, আপার চিৎপুর রোড। লেখক প্রিয়নাথ মুখার্জির ঠিকানা তখন ৮৮-১, কেরানী বাগান ইস্ট লেন। একই ঠিকানার প্রমথ নাথ মুখার্জি এই বইটিরও প্রকাশক। তবে কি তিনি প্রিয়নাথের নিকটাত্মীয়, ১৩০৭ সালে যে প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়, বি. এ.-এর সাথে যুগ্মভাবে প্রিয়নাথ লিখবেন ‘বুয়র ইতিহাস’? ‘কুল্সম’-এর শেষে বিজ্ঞাপনে প্রমথনাথের নামে ঘোষণা করা হয়েছে—”প্রথম বৎসরের দারোগার দপ্তর আমার নিকট অথবা ১২ নং সিকদার বাগান স্ট্রীটে শ্রীযুক্ত বাবু বাণীনাথ নন্দীর নিকট পাওয়া যায়।” এবং “পূর্বোক্ত গ্রন্থকারের নিম্নলিখিত পুস্তকগুলিও আমার নিকট ও পূর্বোক্ত ঠিকানায় প্রাপ্তব্য”। “প্রিয়নাথ জীবনী’ পড়ে আমরা জানতে পারি প্রমথনাথ প্রিয়নাথের প্রথম পুত্র। প্রিয়নাথের জন্ম ১২৬২, তখন বয়স ৩৬। পুত্রের জন্ম প্রিয়নাথের পিতার মৃত্যুর (১২৮০) তিন বছর পরে, অর্থাৎ ১২৮৩ সালে। সেসময় পুত্রের বয়স সুতরাং পনের বছর। বোঝাই যাচ্ছে ‘দারোগার দপ্তর’-এর প্রকাশক প্রাথমিকভাবে প্রথম বছরে ছিলেন প্রিয়নাথ নিজেই, ব্যবহার করেছিলেন নাবালক পুত্রের নাম।
দেখা যাচ্ছে, প্রথম বর্ষের দারোগার দপ্তরের একক বইগুলি ১২৯৮ (১৮৯১) তে প্রকাশের পরের বছর ১৮৯২ তে প্রথম চারটি গল্প একত্রে ও তার পরের বছর ১৮৯৩ তে বাকি ৮ টি গল্প একত্রে বই হিসেবে প্রকাশিত হল। মূল দারোগার দপ্তর কিন্তু থেমে নেই। পাশাপাশি প্রকাশিত হয়ে চলেছে তার বিভিন্ন সংখ্যা। ১৩ এপ্রিল ১৮৯৩ প্রকাশিত হয়েছে ১৩ নং দপ্তর ‘কুল্সম’, প্রকাশক বাণীনাথ নন্দী, সিকদারবাগান, মুদ্রক হরিদাস দে, ৬১, আহিরিটোলা স্ট্রীট। এই প্রকাশক দীর্ঘদিন চলবেন দারোগার দপ্তরের সঙ্গে। সুতরাং মনে হওয়া স্বাভাবিক, প্রথম ১২ টি সংখ্যা প্রকাশ হতে প্রায় দুবছর (১৮৯১ জুন – ১৮৯৩ মার্চ) সময় লেগেছিল, প্রতি মাসে ধারাবাহিকভাবে বেরোয়নি এই বইগুলোর প্রথম ১২ টি সংখ্যা। ‘কুল্সম’ প্রকাশের সময় দারোগার দপ্তর-১ (চারটি গল্প একত্রে এক টাকা মূল্যে) এর সাথে একক ভাবে কিনতে পাওয়া যাচ্ছিল ‘বনমালী দাসের হত্যা’ বাদে বাকি তিনটি গল্পও প্রতিটি চার আনা মূল্যে।
বই প্রকাশের ইতিহাস ঘাঁটার সূত্রে কিছু মজার ব্যাপার জানা হয়ে যায়। চারটি গল্প নিয়ে দারোগার দপ্তরের প্রথম খন্ডের প্রকাশক চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী হয়তো খুব পরিচিত নাম নন। কিন্তু জানা গেল তিনি প্রকাশক হিসেবে এর এক সপ্তাহ আগেই দুর্গাদাস লাহিড়ির ‘চুরি, জুয়াচুরি, জাল ও খুন’ বইটি প্রকাশ করছেন। দুর্গাদাস লাহিড়ির বইটির নাম আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে। ক্রাইম স্টোরি হিসেবে এর পরিচয় গ্রন্থের নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে। কে এই লেখক? তিনি ছিলেন ‘অনুসন্ধান’ নামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ, যার কার্যালয় ১৮৯, বৌবাজার স্ট্রীট। এই পত্রিকাটি গুরুত্বপূর্ণ কেন? কারণ, এখানে ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত হত নানা ক্রাইম স্টোরি যার গুরুত্বপূর্ণ লেখক তালিকায় ছিলেন শরচ্চন্দ্র সরকার এবং হ্যাঁ, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, তদুপরি আরও বিস্ময়কর, বাণীনাথ নন্দী, যাঁকে ভবিষ্যতে আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য দারোগার দপ্তরের প্রকাশক হিসেবে দেখতে পাব। দারোগার দপ্তরের বিভিন্ন সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার আগে, প্রিয়নাথবাবুর এই গল্পগুলি প্রকাশিত হত ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকার পাতাতেই। প্রথম বর্ষের গল্পগুলির ক্ষেত্রে এই পূর্বপ্রকাশের তথ্য আগ্রহোদ্দীপক হতে পারে ভেবে, যেটুকু জানতে পেরেছি, তালিকায় নথিভুক্ত রাখা গেল। যেহেতু গল্পের সাথে লেখকের নাম থাকত না, আর অনুসন্ধানে প্রকাশিত গল্প পরে নাম পরিবর্তন করেও ‘দারোগার দপ্তর’-এ প্রকাশের নজির আছে, তাই সমস্ত গল্প ভালো করে পড়ে মিলিয়ে না দেখে বলা যায় না ‘দপ্তর’-এর আরো কোন কোন গল্প ‘অনুসন্ধান’-এ পূর্বপ্রকাশিত।
এই পূর্বপ্রকাশের ইতিহাস জানারও আরেকটা মজা আছে। ‘অনুসন্ধান’ ছিল নিজেই একটি পাক্ষিক পত্রিকা। ‘অনুসন্ধান সমিতি’র মুখপত্র। সমিতি স্থাপনের পরের বছর থেকে এর যাত্রা শুরু। পত্রিকার ঘোষিত নীতি যা জানা যাচ্ছে ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা – ১৩ শ্রাবণ ১২৯৪ সংখ্যাতে, তা এইরকম, “এতদিন সমিতির বিবরণী প্রভৃতি প্রচার জন্য কেবল দেশের সম্পাদকগণই সহায় ছিলেন; তাহাতে দেশের অনেক উপকার হইয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহারা নানা কার্যে লিপ্ত থাকায় সকল সময় তাঁহাদের দ্বারা আমরা আশানুরূপ ফল প্রাপ্ত হইতে পারি নাই। অনুসন্ধান সমিতি গুরুভার বুঝিয়া জুয়াচোরগণের সন্ধানে সর্বদাই তটস্থ আছেন; জুয়াচোরগণ কখন কিরূপভাবে কার্য করিতেছে, সে দিকে নিয়তই তাঁহার লক্ষ্য। আর, সে দিকে লক্ষ্য রাখিতে যাইলে কখন কোন ব্যক্তি কিরূপভাবে কার্য করিতেছে সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়া তাহা সাধারণকে জানানো কর্তব্য। কিন্তু সকল সংবাদপত্র দ্বারা ঠিক সময়ে সে কার্য হওয়া অসম্ভব; আমরা যে সময়েই রিপোর্ট পাঠাই না কেন, নানা কার্যে লিপ্ত সংবাদপত্রে ঠিক সময়ে তাহার আলোচনা হয় না। আর বিলম্বে আলোচনা হেতু তাহাতে অনেকে ঠকিয়া যান ও জুয়াচোর সাবধান হয়। তাছাড়া বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপিত দ্রব্যের গুণাগুণ-বিচার অনেক সময় আবশ্যক; কিন্তু সংবাদপত্রে সকল সময় তাহারও স্থান মিলে না। এই সকল কারণেই, লোকে যাহাতে আর সামান্যরূপেও না ঠকেন, এই আশায় সমিতির মুখপত্ররূপে ‘অনুসন্ধান’ প্রকাশিত হইতে চলিল।” তার পাতায় তাই খুবই সংক্ষেপে প্রাথমিকভাবে ঘটনা বা গল্পগুলিকে স্থান করে নিতে হয়েছিল। পরে ‘দারোগার দপ্তর’ হিসেবে প্রিয়নাথ সেগুলিকে যথোপযুক্তভাবে বাড়িয়ে নেন। সেক্ষেত্রে তার রসবোধ আর আত্মপ্রক্ষেপণ তথা প্রশস্তি বড় ভূমিকা নেয়। ধরা যাক ৩য় বর্ষে ২৭ নং দপ্তর, আষাঢ়, ১৩০১, অর্থাৎ ১৮৯৪ সালে প্রকাশিত ‘বাঃ গ্রন্থকার (অর্থাৎ পুস্তক-প্রণেতার অদ্ভুত জুয়াচুরি রহস্য)’ গল্পটির কথা। ১৫ অগ্রহায়ণ ১২৯৫ (১৮৮৮)-তে অনুসন্ধানের পাতায় এর প্রথম প্রকাশ। পূর্ণানন্দ ভক্ত তার স্বলিখিত ‘চিরণ্মদা’ বিক্রির জন্য বইয়ের দোকানদারের কাছে যে ফর্দ দেয়, তা ‘দারোগার দপ্তর’ অনুযায়ী, বিদ্যাসাগরের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১০০ ও ৫০ খন্ড), বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী ও বিষবৃক্ষ (৫ খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের মাধবী-কঙ্কণ (৪ খন্ড), ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারত-উদ্ধার (৩ খন্ড), অক্ষয়চন্দ্র সরকারের গোচারণের মাঠ (৩ খণ্ড), দামোদর মুখোপাধ্যায়ের মৃন্ময়ী (৩ খন্ড), মধুসুদনের মেঘনাদ-বধ (৩ খন্ড), রবীন্দ্রনাথের মালিনী (৩ খন্ড), রাজকৃষ্ণ রায়ের ঘোড়ার ডিম (৩ খন্ড), তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বর্ণলতা (২ খন্ড), প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যয়ের তান্তিয়া ভীল (২ খণ্ড) (!!) এবং পূর্ণানন্দ ভক্ত প্রণীত চিরন্মদা (১০০ খন্ড)। ‘দারোগার দপ্তর এর যেহেতু সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখার ট্রাডিশন বা মিথ আছে, এই হিচকক বা সুভাষ ঘাইয়ের সিনেমার মত সেলফ অ্যাপিয়ারেন্সকে সত্য ভাবলে প্রিয়নাথ দারোগার লেখা বইয়ের বঙ্কিমের সমতুল্য সমসাময়িক কাটতি বিষয়ে পাঠকের বিস্ময় স্বাভাবিক। কিন্তু ‘অনুসন্ধান’এ প্রকাশিত একই গল্পের ক্ষেত্রে এই তালিকা ছিল, বিদ্যাসাগরের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ (১০০ ও ৩০ খন্ড), বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী (৫ খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের মাধবী-কঙ্কণ (৪ খন্ড), অক্ষয়কুমার সরকারের গোচারণের মাঠ (৫ খণ্ড), রাজকৃষ্ণ রায়ের ঘোড়ার ডিম (২ খন্ড), রবীন্দ্রনাথের মালিনী (৩ খন্ড), ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভারত-উদ্ধার (৩ খন্ড) এবং পূর্ণানন্দ ভক্ত প্রণীত চিরন্মদা (১০০ খন্ড)। দেখাই যাচ্ছে সেখানে প্রিয়নাথের বইয়ের নাম নেই। কারণ শুধু এটা নয় যে জনপ্রিয়তার প্রাবল্যে লেখক হিসেবে আত্মবিশ্বাসে তখনও প্রিয়নাথ দারোগা শিখরে ওঠেন নি, আসলে তান্তিয়া-ভীল বইটাই প্রকাশ পাবে ‘অনুসন্ধান’এ এই গল্প প্রকাশের পরের বছর অর্থাৎ ১২৯৬ তে (২২ নভেম্বর, ১৮৮৯)।
শুধু দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বিবরণীতেই ‘দারোগার’ দপ্তর-এর কার্যকলাপ শেষ হত না। ৩৪ সংখ্যক ‘দপ্তর এর শেষে ক্রোড়পত্র হিসেবে দু-পৃষ্ঠার ‘প্রাপ্তি-স্বীকার ও সমালোচন’ অংশে দেখতে পাই–”আমরা ‘দারোগার দপ্তরের’ বিনিময়ে গত মাসে নিম্নলিখিত পত্রিকাগুলি প্রাপ্ত হইয়া কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।” এই বিজ্ঞপ্তির সাথে ৬৫ টি পত্রিকার নাম তালিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছে। পরের পাতায় জ্ঞানেন্দ্রমোহন মৈত্র প্রণীত উপন্যাস ‘কুসুমাঞ্জলী’, প্রথম খণ্ড; বহরমপুর গোরাবাজার থেকে প্রকাশিত মাসিকপত্র ও সমালোচন ‘সৎসঙ্গ’ এবং ‘সাবিত্রী লাইব্রেরীর ৮ম হইতে ১৪শ বার্ষিক বিবরণী ও পুস্তকের তালিকা’-র সংক্ষিপ্ত সমালোচনা করা হয়েছে। মনে হয় বাণীনাথ নন্দী, সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার এর কাজকর্মকে এভাবে ‘দারোগার দপ্তর এর পরিচালনার সাথে মিশিয়ে নিচ্ছিলেন।
তবে এই তালিকা করার পরেও একটা ধাঁধা থেকেই গেল। আমরা জানি সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার কিছুকাল ‘তদন্ত’ নামে একটি সাপ্তাহিক ডিটেকটিভ পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯৫২ সালের সম্ভবত অগাস্টের শেষ (সপ্তাহ গুনে সেরকমই দাঁড়ায়) থেকে ১২ ডিসেম্বর অবধি পত্রিকাটির ১৪ টি সংখ্যা প্রকাশ পায়। আমি নবম সংখ্যাটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। ৩১ অক্টোবর ১৯৫২ তারিখের সেই সংখ্যাটিতে পৃষ্ঠা ৪২২-৪২৭ এ ছাপা ছিল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের দারোগার দপ্তর ‘আইন বুদ্ধি’ গল্পের তৃতীয় ও চতুর্থ পরিচ্ছেদ। সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে—”পাঠক, বুঝিলাম ‘দারোগার দপ্তর’-এর জন্য আপনি অত্যন্ত উদ্গ্রীব হইয়াছেন, আপনার আর্জি যে উহা এককালীন ছাপান হইতেছে না কেন? পাঠক, দারোগার দপ্তর এককালে ছাপাইতে হইলে, আমাদের নির্ধারিত পৃষ্ঠার সকল পৃষ্ঠাই দপ্তরে পরিণত হয়। ফলে, উহা একটু একটু করিয়া দিতে হইতেছে, ইহাতে আমাদের কষ্টও বড় কম নহে। একটু একটু করিয়া পড়িলে গল্পের সাধারণত ঘটনাই লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, সুধীজন যাহাকে আর্ট বলেন, তাহার কথঞ্চিৎও ইহাতে দেখা দেয় না। আর্ট অতি ভীরু বস্তু, বড়ই লাজুক, এতটুকু ইতর বিশেষে তাহার মন্দা হয়। অবশ্য এখানে কি গুরু অপরাধ হইতেছে তাহা জানি না, কারণ, পূর্ব উল্লেখে এই মনে হয় যে, দারোগার দপ্তরকে আর্টের পর্যায়ে ফেলা হইতেছে। গুণী সুধী অপরাধ লইবেন না। ‘জেন্টলমেন ইন যুরোপীয়ান ড্রেস’ দেখা সত্ত্বেও ল্যাংট পরিয়া নিরক্ষররাই ঢুকে — আমরা তাহা করিব না।” অর্থাৎ এর আগে ও পরের সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে দারোগার দপ্তরের এক বা একাধিক গল্প ছাপা হয়েছিল। ধরে নেওয়া যায় ‘তদন্ত’-এ ‘দারোগার দপ্তর’ পুনর্মুদ্রণ চলছিল। কিন্তু ‘আইন বুদ্ধি’ শিরোনামের গল্প ‘দপ্তর’-এর ২১৯টি নামের তালিকায় পাইনি। হতে পারে যে দশটি সংখ্যার নাম আমি পাইনি এটি তারই একটা গল্প। অথবা ২১৯ এর পরেও ‘দারোগার দপ্তর’ বেরিয়েছিল যার একটি সংখ্যায় এটি প্রকাশ পায়। কিংবা কোনো ‘দপ্তর’-এর নাম পরিবর্তিত করে এই ধারাবাহিক পুনর্মুদ্রণ চলছিল। অথবা, যেমন মনে করা হয়, ‘তদন্ত’ পত্রিকার জন্যে কমলকুমার নিজে অন্য নামে গোয়েন্দা গল্প লিখতেন, হতে পারে এটিও তেমনি প্রিয়নাথ দারোগার নামে লেখা কমলকুমারের একটি সৃষ্টি। দারোগার দপ্তরের সমস্ত সংখ্যা খুঁজে না পাওয়া অবধি এ ধাঁধাটিও অমীমাংসিতই থেকে যাবে মনে হয়।
সোমনাথ দাশগুপ্ত
কলকাতা
রথযাত্রা, ১৪২৮ ১২ জুলাই, ২০২১
Rima Saha
Please complete the series .
somnath dasgupta
অসম্পূর্ণ কেন?আর কতটা বাকি?
বাংলা লাইব্রেরি
আরও কিছু গল্প বাকি আছে। অর্ধেকের মত। প্রুফ দেখার কাজ হয়ে গেলে দিয়ে সম্পূর্ণ করে দেব।
Rima Saha
Thank you so much for completing the series.