মেলায় চুরি – ১
প্রথম পরিচ্ছেদ
ইংরাজী ১৮৮৩-৮৪ খৃষ্টাব্দে এই কলিকাতা মহানগরীতে যে মহামেলা হইয়া ছিল তাহা পাঠকগণের মধ্যে বোধ হয় কেহই এখনও বিস্মৃত হয়েন নাই। এই মহামেলার নিমিত্ত চৌরঙ্গী রাস্তার পার্শ্বে স্থান প্রস্তুত হয়। চৌরঙ্গীর যে বৃহৎ অট্টালিকায় মৃত জীব জন্তু সকল রক্ষিত আছে এবং যাহা ইণ্ডিয়ান মিউসিয়ম (Indian Museum) নামে অভিহিত, সেই বৃহৎ অট্টালিকা ও তাহার পার্শ্ববর্ত্তী আরও কয়েকটি অট্টালিকা একত্রিত ও তাহার স্থানে স্থানে নূতন গৃহ সকল প্রস্তুত করিয়া ওই মহামেলার নিমিত্ত স্থান প্রস্তুত করা হয়। তদ্ব্যতীত, ওই বৃহৎ অট্টালিকার সম্মুখস্থিত ময়দানের মধ্যে সুবিস্তৃত একখণ্ড ভূমির চতুষ্পার্শ্ব উচ্চ প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত করিয়া লওয়া হয়। দর্শকমণ্ডলীর ওই স্থানে গমনাগমন করিবার নিমিত্ত ওই অট্টালিকা হইতে চৌরঙ্গী রাস্তায় উপর একটি মনোহর সেতু প্রস্তুত করা হয়।
পৃথিবীর মধ্যে এরূপ কোন দ্রব্য নাই, যাহা এই মহামেলায় প্রদর্শিত হয় নাই! সামান্য কৃষিকার্য্যোপযোগী দ্রব্য সামগ্রী হইতে আরম্ভ করিয়া পৃথিবীর মধ্যে যে বহু প্রকার শস্য উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহার সমস্তই এই মহামেলায় প্রদর্শিত হইয়াছিল। পৃথিবীর মধ্যে যত জাতীয় মনুষ্য আছে, তাহার প্রতিমূর্তি, যত ফল পুষ্প আছে, তাহা ও তাহার অবিকল প্রতিকৃতি, সকলেই সেই স্থানে দেখিয়াছেন। পৃথিবীর নানাস্থানীয় স্বাভাবিক দৃশ্য, অনুচ্চ পাহাড় ও উচ্চ পর্বতশ্রেণী। নির্ঝর হইতে প্রবলবেগে জলরাশি পতিত হইয়া কি রূপে বেগবতী স্রোতস্বতীর সৃষ্টি হইয়া থাকে, আগ্নেয়গিরি হইতে কিরূপে অগ্নি উদ্গম হয়, সমতলক্ষেত্রেও পর্ব্বতোপরি কৃষকগণ কিরূপে কৃষিকার্য্য করিয়া, পশ্বাদি চরাইয়া থাকে, সভ্য ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণের বাসস্থান হইতে নিতান্ত দরিদ্র কুটীরবাসিগণ যেরূপ বাসস্থনে বাস করিয়া থাকেনও অসভ্য পাৰ্ব্বতীয় জাতি সকল পৰ্ব্বতপার্শ্বে যে ভাবে আপনাদিগের বাসস্থান সংস্থাপিত করিয়া থাকে, তাহার সমস্ত দৃশ্যই এই মহামেলার একস্থানে দৃষ্টিগোচর হইয়াছিল। পৃথিবীর সমগ্র সভ্যজাতিগণের মধ্যে বহুপূর্ব্বে যে সকল কীর্তি বর্ত্তমান ছিল, ও এখন বিজ্ঞানবলে সকলে যতদূর উৎকর্ষ লাভ করিয়া নব নব অত্যাশ্চর্য্য বিষয় সকল উদ্ভাবিত বা আবিষ্কৃত করিয়াছেন, যে সকল বিষয় কেবলমাত্র শ্রবণ করিয়া কোনরূপে কেহ বিশ্বাস করিতে চাহেন না, তাহা এই মহামেলায় সকলে স্বচক্ষে পরিদর্শন করিয়াছেন। শিল্প, কৃষি, প্রভৃতি বাণিজ্যের মধ্যে যাহা কিছু এ পৰ্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা স্বচক্ষে দর্শন করিয়া সকলেই চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিয়া লইয়াছেন। পৃথিবীর যে স্থানে যে সকল দ্রব্য উৎপন্ন বা বিক্রয় হইয়া থাকে, তাহার সমস্তই সকলে এই স্থানে দেখিতে পাইয়াছেন। এসিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার মধ্যে যাহা কিছু মূল্যবান অলঙ্কার রত্নাদি আছে, তাহার সমস্তই এই স্থানে প্রদর্শিত হইয়াছিল। আধুনিক ও পুরাতন রত্ন ও প্রবালাদি রাখিবার নিমিত্ত একটি স্বতন্ত্র ও দুর্ভেদ্য স্থান নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল। তদ্ব্যতীত, আর একটি স্থান সংস্থাপিত হইয়াছিল। যে বিষয় অবলম্বন করিয়া অদ্য আমরা এই প্রবন্ধ লিখিতে প্রবৃত্ত হইতেছি, তাহার প্রদর্শন এই শেষোক্ত স্থান হইতেই হইতেছিল।
এই স্থানে ইংরাজ-জহুরীর কয়েকটি দোকান সংস্থাপিত হয়। বিলাত হইতে বহুমুল্য-অলঙ্কারসহ এই স্থানে আসিয়া তাঁহারা তাঁহাদিগের জহরতের দোকান সংস্থাপিত করেন। ওই সকল অলঙ্কার যে কেবল তাঁহারা প্রদর্শনীর নিমিত্ত আনিয়া ছিলেন তাহা নহে; যে সকল অলঙ্কার বিক্রয় হইয়া যাইতেছিল, তাহা বিক্রয় করিয়া সেই প্রকারের আর একখানি অলঙ্কার সেই স্থানে স্থাপিত করিয়া ওই স্থান পূর্ণ করিয়া রাখিতেছিলেন। দোকানের অবস্থা দেখিয়া কেহই অনুমান করিতে পারিতেছিলেন না, যে ওই সকল স্থান হইতে কোন দ্রব্য স্থানান্তরিত হইয়াছে, বা তাহার স্থানে অপর কোন দ্রব্য স্থাপিত হইয়াছে।
এই সকল দোকানে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার সমস্তই দেখিতে অতিশয় মনোহর। দুই চারিখানি রৌপ্যালঙ্কার থাকিলেও প্রায় সমস্তই সুবর্ণ-নির্ম্মিত ও মূল্যবান প্রস্তরখণ্ড সকলের দ্বারা খচিত। ওই সকল অলঙ্কার কিন্তু আমাদিগের দেশের উপযোগী নহে, অর্থাৎ আমাদিগের দেশের স্ত্রীলোকগণ যেরূপ অলঙ্কার প্রায়ই ব্যবহার করিয়া থাকেন, উহা সেই রূপের অলঙ্কার নহে। সাহেব ও সাহেব-পত্নীগণ যেরূপ অলঙ্কারের আদর করিয়া সর্ব্বদা তাঁহাদিগের অঙ্গে স্থান প্রদান করিয়া থাকেন, ওই সকল দোকান সেইরূপ অলঙ্কাররাজির দ্বারা শোভিত ছিল।
দর্শকমণ্ডলীর দেখিবার নিমিত্ত প্রদর্শনীর সমস্ত স্থানই প্রাতঃ ৬টা হইতে খোলা হইত ও সমস্ত দিবস উহা খোলা থাকিয়া রাত্রি ৯টার সময় পুনরায় প্রদর্শনী বন্ধ হইত; ইহা প্রাত্যহিক নিয়মের মধ্য পরিগণিত ছিল। রবিবারে কিন্তু প্রদর্শনী খোলা হইত না, সেই দিবস ওই স্থান একেবারে বন্ধ থাকিত। অল্পমূল্যের বা বহুমূল্যের কোন দ্রব্য প্রদর্শনী হইতে কোন প্রদর্শক বাহির করিয়া লইয়া যাইতে পারিতেন না। উহার মধ্যেই তিনি তাঁহার সুবিধামত স্থানে বা লোহার সিন্ধুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়া রাত্রি ৯টার পর সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতেন, ও পরদবিস প্রাতঃ ৬টার সময় পুনরায় তিনি আগমন করিয়া দ্রব্যাদি সকল যথাস্থানে স্থাপিত করিতেন।
এইরূপ নিয়মের বশবর্তী হইয়া প্রদর্শনীর সকলেই সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন। কাহার কাহার সামান্য দুই একটি দ্রব্য সময় সময় অপহৃত হইয়াছিল বটে, কিন্তু ওই সকল দ্রব্যাদির সহিত অনেকে ধৃত হইয়া কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন; কিন্তু বিশেষ মূল্যবান কোন দ্রব্য সেই স্থান হইতে অপহৃত হয় না। যে কয়েকমাস এই মহামেলা সংস্থাপিত ছিল, সেই কয়েকমাস অনেক পুলিস-কৰ্ম্মচারীকে ওই স্থানে থাকিয়া শান্তিরক্ষা ও যাহাতে কাহার কোনরূপ দ্রব্যাদি অপহৃত না হয়, তাহার দিকে বিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিতে হইয়াছিল। বলা বাহুল্য, ওই সকল পুলিস-কৰ্ম্মচারীগণের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৪ খৃষ্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তারিখে মহামেলা বন্ধ হইবার পর রাত্রি ১০টার সময় আমরা আপনাপন স্থানে প্রত্যাগমন করিলাম। আমার যতদূর মনে আছে, সেইদিবস শনিবার ছিল। তাহার পর দিবস রবিবার। রবিবারে মেলা বন্ধ থাকিত; সুতরাং, সেই দিবস আর আমাদিগকে এই মহামেলায় গমন করিতে হইল না। যে সকল প্রহরী ওই মহামেলার বাহির হইতে পাহারা দিতেছিল, কেবল তাহারাই সেই স্থানে থাকিল মাত্র। সোমবার প্রাতঃকালেই পুনরায় আমাদিগকে সেই স্থানে গমন করিতে হইল। যাঁহাদিগের দ্রব্যাদি ওই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হইত, আমাদিগের পূৰ্ব্বেই তাঁহার আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইয়াছিলেন।
আমরা প্রদর্শনীর ভিতর পদক্ষেপ করিবামাত্রই অবগত হইতে পারিলাম, যে একটি বিলাতী অলঙ্কারের দোকানে ভয়ানক চুরি হইয়া গিয়াছে। এই কথা শুনিবামাত্র দ্রুতপদে আমরা সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, যে দোকান হইতে অলঙ্কার সকল অপহৃত হইয়াছে, তাহা অপর কয়েকটি দোকানের মধ্যে সংস্থাপিত; অর্থাৎ উহার চতুষ্পার্শ্বে আরও কয়েকটি জহরতের দোকান আছে। এই দোকানগুলি মিউসিয়মের দক্ষিণদিকস্থ বারান্দার উপর স্থাপিত ছিল। দোকান বন্ধ হইলেই দোকানদারগণ আপনাপন দোকানের চতুষ্পার্শ্ববর্তী পর্দা সকল ফেলিয়া রাখিতেন, ইহা একরূপ নিয়মের মধ্যে পরিগণিত ছিল।
আমরা যে সময় সেই দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলাম, সেই সময় পৰ্য্যন্ত দোকানের পর্দাগুলি উত্থিত করা হয় নাই। পর্দা ঠেলিয়া দোকানের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম দোকানের মালিক সেই দোকানের মধ্যে উপস্থিত আছেন। দোকানের কর্মচারীগণের মধ্যে আর কেহই আগমন করেন নাই। দোকানের অধিকারী আমাদিগকে দেখিয়াই কহিলেন, “আমার সর্ব্বনাশ হইয়াছে; আমার, যথাসর্ব্বস্ব অপহৃত হইয়া গিয়াছে।” এই কথা বলিয়া তিনি আমাদিগকে তাঁহার দোকানের মধ্যে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে কহিলেন। আমরা দেখিলাম, যে সকল সো-কেস বা কাচের আলমারির মধ্যে অলঙ্কারগুলি রক্ষিত থাকিত, তাহার সমস্তগুলিই খোলা। উহা বিশেষরূপে পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কিন্তু উহা খুলিবার সময় যে কোনরূপ বলপ্রয়োগ হইয়াছে, এরূপ বিবেচনা হইল না। বোধ হইল, ওই সকল আলমারির চাবি দিয়াই উহা খোলা হইয়াছে। বিলাতী অলঙ্কার মাত্রই প্রায় সেই অলঙ্কারের পরিমাণমত ছোট ছোট চামড়ার বাক্সে স্থাপিত থাকে। ওই সমস্ত চামড়ার বাক্স শূন্য অবস্থায় সেই দোকানের মধ্যে পড়িয়া রহিয়াছে। উহার একটির মধ্যেও কোনরূপ অলঙ্কারের চিহ্নমাত্রও নাই, সমস্তই স্থানান্তরিত হইয়াছে। যে পরিমিত বাক্স হইতে অলঙ্কার সকল লওয়া হইয়াছে, বা যে পরিমিত বাক্স শূন্য অবস্থায় সেই স্থানে পতিত আছে, তাহা দেখিবামাত্রই সহজে অনুমান হয়, যে এই কার্য্য করিতে, বিস্তর সময়ের আবশ্যক হইয়াছে। কারণ,প্রত্যেক অলঙ্কার বৃহৎ ও বহুমূল্য না হইলেও উহার সমষ্টি কিন্তু নিতান্ত অল্পমূল্যও নহে। অপহৃত গহনার সংখ্যা অত্যন্ত অধিক; সুতরাং, সেই স্থানে পরিত্যক্ত অলঙ্কারশূন্য বাক্সের সংখ্যাও অত্যন্ত অধিক। উহার প্রত্যেক বাক্স খুলিয়া তাহার মধ্য হইতে অলঙ্কার বাহির করিয়া লইতে হইলে অভাবপক্ষে দুই ঘণ্টার কম এক ব্যক্তির দ্বারা কখনই তাহা সম্পন্ন হইতে পারে না। একাধিক মনুষ্য থাকিলে অবশ্য অল্প সময়ের মধ্যে ওই কার্য্য সমাপ্ত হইতে পারে। যে সকল অলঙ্কার বাক্সের মধ্যে ছিল, তাহার প্রত্যেকের মূল্য তাহার বাক্সের উপর লেখা ছিল। ওই সমস্ত বাক্স সংগ্রহ করিয়া সেই দোকানের অধিকারীর সাহায্যে একটি তালিকা প্রস্তুত করিতে আরম্ভ করিলাম। বলা বাহুল্য, ইহাই আমাদিগের সেই অনুসন্ধানের প্রধান কার্য্য; ও এই কাৰ্য্য শেষ করিতে অনেক সময়ও অতিবাহিত হইয়া গেল। ওই সকল বাক্স দেখিয়া উহার ভিতর কি কি অলঙ্কার ছিল, তাহা সেই দোকানের অধিকারী সাহেব আমাদিগকে বলিতে লাগিলেন। আমরা একে একে তাহা লিখিয়া লইতে আরম্ভ করিলাম ও সেই সকল পরিত্যক্ত বাক্স হইতে অপহৃত কোন্ দ্রব্যের কত মূল্য তাহাও স্থির করিয়া লইলাম। এইরূপে আমাদিগের মালের তালিকা প্রস্তুত হইয়া গেলে দেখিতে পাইলাম, ১৭,৯৮৫ টাকা মূল্যের অলঙ্কার ওই স্থান হইতে অপহৃত হইয়াছে।
ওই সকল অপহৃত মালের তালিকা প্রস্তুত করিতে আমাদিগের যে সময় অতিবাহিত হইয়া গেল, সেই সময়ের মধ্যে ওই দোকানের সমস্ত কর্ম্মচারীগণ একে একে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিলেন। দেখিলাম, শনিবারে দোকান বন্ধ হইবার পূর্ব্বে যে যে কর্ম্মচারী ওই দোকানে কার্য্য করিয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহই অনুপস্থিত হইলেন না, সকলেই যথাসময়ে আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন।
কর্ম্মচারীগণের নিকট হইতে ও দোকানের মনিবের নিকট হইতে তখন আমরা অবগত হইতে পারিলাম যে, শনিবারে সন্ধ্যার পরেই তাঁহারা ওই দোকান বন্ধ করিয়াছিলেন। কেবলমাত্র শনিবারেই যে ওইরূপ নিয়মে দোকান বন্ধ হইয়াছিল, তাহা নহে, প্রায় প্রত্যহই ওইরূপ নিয়মে ওই দোকান বন্ধ হইয়া থাকে। কেবল ওই দোকানই যে ওইরূপ নিয়মে বন্ধ হয় তাহাও নহে; ওই স্থানের সমস্ত দোকানই ওই নিয়মে বন্ধ করা হয়। কারণ, মিউসিয়মের নিম্নতলস্থিত বারান্দার উপর ওই সকল দোকান স্থাপিত। অথচ সন্ধ্যার পরই ওই স্থানের প্রাঙ্গণে ছায়াবাজী আরম্ভ হয় ও রাত্রি ৯টা না বাজিলে আর উহা বন্ধ করা হয় না। কাজেই সন্ধ্যার পর ওই স্থানে লোকের অতিশয় ভিড় হইয়া থাকে। এই নিমিত্তই ওই স্থানের দোকান, ছায়াবাজী আরম্ভ হইবার পূর্ব্ব হইতেই বন্ধ করিয়া উহার পর্দ্দা সকল ফেলিয়া দেওয়া হয়। শনিবারেও ঠিক ওইরূপ নিয়মে দোকান বন্ধ করা হয়, ও দোকানের কর্মচারীগণ তাঁহাদিগের মনিবের সম্মুখেই ওই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। কিন্তু এ কথা অপর কেহ বলিতে পারেন না যে, ছায়াবাজী আরম্ভ হইবার পূর্ব্বেই তাঁহারা সকলে সেই প্রদর্শনী হইতে একেবারে বহির্গত হইয়া গিয়াছিলেন, কি অপর স্থানে থাকিয়া ছায়াবাজী বন্ধ হইবার পর সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়াছিলেন। কর্ম্মচারীগণ দোকান হইতে বহির্গত হইবার পরই, যাঁহার দোকান তিনি ওই দোকানের চাবি সকল লইয়া প্রদর্শনী হইতে বহির্গত হইয়া যান। সেইদিবস রাত্রিতে বা তাহার পরদিবস অর্থাৎ রবিবারের রাত্রিদিনের মধ্যে আর তিনি সেই স্থানে পদার্পণ করেন না। সোমবার প্রত্যুষে তিনি সেইস্থানে আসিয়া উপস্থিত হন, ও সেইস্থানে আসিয়া যাহা দেখিতে পান, তাহা পাঠকগণও অবগত হইয়াছেন।
গ্লাসকেসগুলি সমস্তই চাবি দ্বারা খোলা হইয়াছিল, কিন্তু দোকানদারের নিকট হইতে জানিতে পারা গেল যে, শনিবার সন্ধ্যার সময় ওই দোকান হইতে গমন করিবার পর, ও সোমবার দোকানে আগমন করিবার পূর্ব্বে ওই সকল চাবি অপর কাহারও হস্তে পতিত হয় নাই। সমস্ত সময়ই তাঁহার নিকট ছিল। এরূপ অবস্থায় ওই চাবি অপরের গ্রহণ করা ও সেই চাবির দ্বারা ওই সকল গ্লাসকেস খুলিয়া ফেলা একেবারেই অসম্ভব।
এই সকল অবস্থা দেখিয়া ও ফরিয়াদীর নিকট সমস্ত কথা শ্রবণ করিয়া এখন আমরা অনুসন্ধানের কোন্ পন্থা অবলম্বন করিব,তাহাই স্থির করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। নিম্নলিখিত প্রশ্ন সকল ক্রমে ক্রমে আমাদিগের মনে উদিত হইতে লাগিল ও ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহার কোনটি সম্ভব ও কোটি অসম্ভব, তাহাই স্থির করিতে লাগিলাম।
১ম প্রশ্ন। শনিবারে দোকান বন্ধ হইবার পূর্ব্বে ওই দোকানের কোন কর্মচারীর দ্বারা কি এই কার্য্য সম্পন্ন হইবার সম্ভাবনা?
উত্তর। না, তাহা হইতে পারে না; কারণ, যাঁহার দোকান তাঁহার সম্মুখেই সকলে স্ব স্ব কার্য্য সম্পন্ন করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। দোকানদারের এই কথা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে দোকান বন্ধ হইবার পূর্ব্বে এ কাৰ্য্য কখনই সম্পন্ন হয় নাই।
২য় প্রশ্ন। কর্মচারীগণ দোকান হইতে বহির্গত হইয়া প্রদর্শনীর বাহিরে না গিয়া, ছায়াবাজী দেখিবার ভাণে একস্থানে অপেক্ষা করিতে পারে, ও দোকানদার দোকান বন্ধ করিয়া দোকানের চাবি লইয়া গমন করিবার পর, ওই কর্মচারীগণের মধ্যে কেহ আসিয়া ওই দোকানে প্রবেশপূর্ব্বক এই কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে সমর্থ হন না?
উত্তর। ইহা অসম্ভব নহে, কিন্তু দোকানদার যখন বলিতেছেন যে, দোকানের চাবি তাহার নিকটই ছিল, অপর কাহারও হস্তগত হয় নাই, অথচ যখন দেখা যাইতেছে যে, চাবি দিয়া আলমারি খোলা হইয়াছে; তখন এ কার্য্য কিরূপে সম্পন্ন হইতে পারে? তবে যদি উহারা পূর্ব্ব হইতেই ওই রকম আলমারির চাবি প্রস্তুত করিয়া রাখে, ও সময় পাইয়া সেই চাবি দ্বারা যদি গ্লাসকেস খুলিয়া থাকে, তাহা হইলে কৰ্ম্মচারীগণের মধ্যে কাহারও দ্বারা যে ওই কার্য্য না হইতে পারে, তাহা বলা যায় না। কিন্তু দোকানের এতগুলি গ্লাসকেসের চাবি প্রস্তুত করিয়া লওয়া নিতান্ত সহজ নহে। তাহা হইলে একজনের দ্বারা এই কার্য্য সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব; অপর কর্ম্মচারীগণের মধ্যে কেহ না কেহ তাহা অনায়াসেই অবগত হইতে পারিবে; কারণ, এরূপ কোন সময় দেখিতেছি না, যে সময় কেবলমাত্র একজন কর্ম্মচারী ওই দোকানে উপস্থিত থাকেন। তিন চারিজনের কম এক সময়ে প্রায়ই কেহ এই স্থানে থাকেন না, ও সকলকেই প্রায় সৰ্ব্বদা ব্যস্ত থাকিতে হয়।
৩য় প্রশ্ন। ইহা ত হইতে পারে, যে দোকান বন্ধ করিবার সময় মনিবের সম্মুখে কোন কর্মচারী গ্লাসকেসের তালা বন্ধ করিয়া দেন, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে চাবি বন্ধ না করিয়া উহা খুলিয়া রাখিয়া দেন, ও ওই সকল চাবি দোকানদারের হস্তে প্রদান করিয়া তাঁহারা দোকানের বাহিরে আসিয়া ছায়াবাজী দেখিতে আরম্ভ করেন। গ্লাসকেসের চাবি বন্ধ আছে ‘এই বিবেচনা করিয়া মনিব পরিশেষে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করেন। গ্লাসকেস সকল উন্মুক্ত অবস্থাতেই রহিয়া যায়। দোকানদার গমন করিবার পরে সেই কৰ্ম্মচারী অনায়াসেই ওই দোকানের ভিতর প্রবেশ করিয়া আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হন, ও পরিশেষে অপরাপর দর্শকমণ্ডলীর সহিত অনায়াসেই প্রদর্শনীর বাহিরে গমন করিতে পারেন।
উত্তর। এ অনুমান একেবারে অসম্ভব নহে; কিন্তু দোকানদার নিজে বলিতেছেন যে, তাঁহার কর্ম্মচারীগণ প্রস্থান করিবার পর তিনি স্বহস্তে গ্লাসকেসের চাবি সকল বন্ধ করিয়া চলিয়া যান। ইহা যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে আমাদিগের এই অনুমান ঠিক নহে।
৪র্থ প্রশ্ন। বাহিরের কোন লোকের দ্বারা ত এই কার্য্য হয় নাই?
উত্তর। অসম্ভব নহে; আজ কাল দেখিতে পাওয়া যায়, বড় বড় চোরের নিকট অনেক প্রকারের বিস্তর চাবি থাকে। এ সকল চোরের মধ্যে যদি কেই ইহার ভিতর প্রবেশপূর্ব্বক তাহার আনীত চাবির দ্বারা ওই সকল গ্লাসকেস খুলিয়া ফেলিতে সমর্থ হয়, তাহা হইলে তাহার দ্বারা এই কার্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন হইতে পারে। যদি তাহাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে এ কাৰ্য্য কখন হইতে পারে? ছায়াবাজীর সময় সেইস্থান লোকে পূর্ণ ছিল। বাহিরের চোর কিছু অবগত ছিল না যে, ওই দোকানের কর্মচারীগণ সকলেই প্রদর্শনীর বাহির হইয়া গিয়াছে, আর কেহই প্রত্যাগমন করিবে না। এরূপ অবস্থায় তাহার মনে এরূপ ভয় হইবার কথা, যদি হঠাৎ কেহ সেই স্থানে আগমন করে, তাহা হইলে তাহাকে সে নিশ্চয়ই দেখিতে পাইবে, ও তাহাকে অনায়াসেই ধৃত হইতে হইবে; কারণ ওই প্রদর্শনী হইতে বহির্গত হইবার কেবল একটি ভিন্ন পথ ছিল না; তাহাও সৰ্ব্বদা বন্ধ থাকিত, সেই স্থানে পুলিস ও পল্টনের পাহারা থাকিত। একটু গোলযোগ হইলেই প্রদর্শনীর কোন লোকে আর বাহিরে গমন করিতে পারিত না; সুতরাং, সেই চোর অনায়াসেই সেই স্থানে ধৃত হইত। তবে এক হইতে পারে-রবিবারে অর্থাৎ যে দিবস প্রদর্শনী বন্ধ ছিল, সেইদিবস কোন গতিকে সে ওই প্রদর্শনীর ভিতর প্রবেশ করিয়া এই কার্য করিয়াছে। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে তাহাকে অনেক কষ্ট করিয়া বাহির হইতে চাবি সকল সংগ্রহ করিয়া আনিবার প্রয়োজন কি ছিল? সামান্য গ্লাসের সো-কেস ভাঙ্গিয়া ফেলিতে একজন চোরের কত সময় আবশ্যক হয়? তাহাতে সেই সময় প্রদর্শনীর মধ্যে কেহই থাকে না!
৫ম প্রশ্ন। যে সকল পুলিস বা পল্টন প্রদর্শনীর বাহিরে পাহারায় নিযুক্ত আছে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা এই কাৰ্য্য হয় নাই?
উত্তর। হইতে যে পারে না, তাহাই বা বলি কি প্রকারে? পুলিস ও পল্টন বিভাগে যাঁহারা কার্য্য করিয়া থাকেন, তাঁহারা যে সকলেই সৎ, তাহা বা বলি কি প্রকারে? তাঁহাদিগের মধ্যে অসৎ চরিত্রের লোক কি কেহই নাই? সময় সময় অনেক চুরি ইহাদিগের দ্বারা হইয়াছে, তাহাও দেখিয়াছি; কিন্তু বৰ্ত্তমান ক্ষেত্রে ইহা একটু অসম্ভব; কারণ, রবিবারে প্রদর্শনীর মধ্যে প্রায়ই পাহারা থাকে না, সমস্ত পাহারাই বাহিরে থাকে। এরূপ অবস্থায় চুরি করিবার উদ্দেশ্য ভিন্ন, উহার মধ্যে প্রবেশ করিবার আর বিশেষ সুযোগ ঘটিতে পারে না।
৬ষ্ঠ প্রশ্ন। বিলাত হইতে যিনি এই জহরতের দোকান লইয়া এখানে আসিয়াছেন, তিনি ভিন্ন ওই দোকানে সেই দেশের আর কোন লোক নাই। যে সকল কর্মচারী ওই দোকানে কর্ম্ম করিতেছেন, তাঁহারা সকলেই এই প্রদেশীয়। এরূপ অবস্থায় ওই দোকানের আভ্যন্তরীণ অবস্থার সংবাদ সংগ্রহ করাও নিতান্ত সহজ নহে। যিনি দোকানের অধিকারী বলিয়া আমাদিগের নিকট পরিচয় প্রদান করিতেছেন, যিনি ফরিয়াদী হইয়া এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমাদিগকে সৰ্ব্বতোভাবে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, হয় ত তিনি নিজেই দোকানের অধিকারী নহেন, অপর কোন ধনী ব্যক্তির ইনি একজন কর্ম্মচারী মাত্র। সেই ধনীর নিকট হইতে ইনি এই মহামেলায় মূল্যবান অলঙ্কার সহিত আগমন করিয়া উহা প্রদর্শন করাইতেছেন। আমাদিগের এই অনুমান যদি প্রকৃত হয়, প্রকৃতই ইনি যদি দোকানের মালিক না হইয়া কেবল একজনমাত্র কর্মচারী হন, তাহা হইলে সমস্ত অলঙ্কার সুযোগমতে স্থানান্তরিত করিয়া মনিবকে ফাঁকি দিবার নিমিত্ত এই কার্য্য ইনি করেন নাই ত! ও আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করিবার মানসে দোকান হইতে সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা করিয়া আমাদিগকে সংবাদ প্রদান করেন নাই ত?
উত্তর। ইহাও যে একেবারে অসম্ভব, তাহাও একেবারে বলা যায় না। অনেক বড় বড় দোকানের বড় বড় কর্ম্মচারীকে এই কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে আমি দেখিয়াছি। দুই একজন আমার হস্তে ধৃতও হইয়াছেন, দুই একজনকে শ্রীঘরে প্রেরণ করিতেও সমর্থ হইয়াছি। পাঠকগণ তাহার দুই একটি ঘটনা অবগতও আছেন। “ইংরাজ ডাকাইত” প্রভৃতি পুস্তকের বিষয় বোধ হয়, এখনও অনেক পাঠকের মনে জাগরূক আছে। তাঁহারা অনায়াসেই অনুমান করিতে পারিবেন যে, এ কার্য্য ফরিয়াদীর নিজের দ্বারা সম্পন্ন হওয়াও একেবারে অসম্ভব নহে।
আমরা মনে মনে এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিতেছি, সেই সময় ফরিয়াদী কহিলেন “আমি আপনাদিগকে একটি কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি। যে বিষয় লইয়া আপনারা আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, তাহাই সে সময় আমার মনে উদয় হয় নাই। এখন হঠাৎ তাহা আমার মনে আসিয়া উদয় হইল। আমার এই দোকানের চাবি অন্য লোকের পাওয়া যে একেবারে অসম্ভব, তাহা এখন বোধ হইতেছে না; কারণ, এই দোকান সম্বন্ধীয় যতগুলি চাবি আছে, তাহা একটি রিং এর মধ্যে আবদ্ধ থাকে। প্রায় একমাস অতীত হইল রিং সহিত সমস্ত চাবিগুলিই দোকান হইতে কিরূপে খোয়া যায়। অনেক অনুসন্ধান করিয়া কোনরূপেই সেই চবির কোন সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। দোকানের কর্ম্মচারীগণের মধ্যে সকলকেই এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হইয়াছিল, কিন্তু কেহই তাহার উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হন না। দোকান খুলিবার পর ওই চাবিগুচ্ছ একটি আলমারীর সহিত সংলগ্ন থাকিত। সেই স্থান হইতে উহা যে কোথায় যায়, তাহা কেহই স্থির করিয়া উঠিতে পারেন না। অনেক অনুসন্ধান করিবার পর, ওই চাবির যখন কোনরূপ সন্ধানই করিয়া উঠিতে পারা যায় না, তখন অনন্যোপায় হইয়া অপর চাবি আমাকে বাহির করিতে হয়। প্রত্যেক আলমারি বা গ্লাসকেসের দুই প্রস্থ চাবি ছিল। তাহার এক প্রস্থ সৰ্ব্বদা ব্যবহৃত হইত, অপর এক প্রস্থ আমার নিকট থাকিত। ব্যবহৃত প্রস্থ যখন অনুসন্ধানে আর পাওয়া গেল না, তখন আমার নিকট যে প্রস্থ থাকিত, তাহা বাহির করিয়া দিলাম। সেই প্রস্থের দ্বারাই এখন কাৰ্য্য চলিতেছে। যে প্রস্থ হারাইয়া গিয়াছিল, তাহা যদি কাহারও হস্তে পতিত হইয়া থাকে, তাহা হইলে সে ব্যক্তি তাহার দ্বারা অনায়াসেই যে এই সকল গ্লাসকেস খুলিয়া ওই সকল অলঙ্কার অপহরণ করিতে সমর্থ হবে।”
ফরিয়াদীর এই কথা শুনিয়া আমরা নিতান্ত আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। যে সকল গ্লাসকেসের চাবি পূর্ব্বেই খোয়া গিয়াছিল, তাহা যে তিনি কেন অপরিবর্তিত অবস্থায় রাখিয়াছিলেন, তাহা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করায়ও তিনি কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে সমর্থ হইলেন না। যাহা হউক, ইতিপূর্ব্বে চাবি খোয়া গিয়াছিল, এ কথা জানিতে পারিয়া আমাদিগের কতকগুলি সন্দেহ মিটিয়া গেল। তখন আমরা এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ফরিয়াদীর দোকানের পার্শ্বে অপর এজন ইংরাজ জহুরীর দোকান ছিল। ওই দোকানেও অনেকগুলি কৰ্ম্মচারী ছিলেন। ওই সকল কর্মচারীর মধ্যে প্রায় সকলেই এ দেশজ ফিরিঙ্গী ও মুসলমান। নিয়মিত সময়ে এক এক করিয়া ওই দোকানের প্রায় সকল কৰ্ম্মচারীই আগমন করিল, কিন্তু কেবলমাত্র একটি মুসলমান কর্ম্মচারী আসিল না। বিনা সংবাদে সেই মুসলমান কর্ম্মচারী হাসান কার্য্যে না আসায়, আমাদিগের সকলের মনেই কেমন একরূপ সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। দোকানের কোন লোকই তাহার বাটী জানিত না; সুতরাং, অনুন্ধান করিয়া তাহাকে বাহির করা নিতান্ত সহজ হইল না। অনেক অনুসন্ধান করিয়া তাহার ঠিকানা করিতে সমর্থ হইলাম বটে, কিন্তু ওই কার্য্যের নিমিত্ত সেই দিবসের অধিকাংশ সময়ই অতিবাহিত হইয়া গেল। আমরা যাহার অনুসন্ধান করিতেছিলাম, সে একজন মুসলমান যুবক, কিন্তু অনুসন্ধানে তাহাকে একটি ফিরিঙ্গীর বাড়ীতে প্রাপ্ত হইলাম। বহুবাজার থানার অন্তর্গত গুমোব লেনে ওই ফিরিঙ্গী যুবক তাহার মাতার বড়িতে বাস করিত। ওই মুসলমান যুবকের সহিত তাহার বিশেষরূপ বন্ধুত্ব ছিল। ওই ফিরিঙ্গী ও মুসলমানের সহিত যে কি কারণে বিশেষরূপ বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা আমরা পূর্ব্বে কিছুমাত্র বুঝিয়া উঠিতে পারিয়াছিলাম না, কিন্তু পরে তাহা বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম। মুসলমান যুবকের পিতামাতা ছিল বটে, কিন্তু তাহাদিগের সহিত উহার কিছুমাত্র সংস্রব ছিল না। সে যাহা উপার্জ্জন করিত, তাহা সে তাহার ফিরিঙ্গী বন্ধুর ইচ্ছানুরূপ খরচ করিত। একটিমাত্র পয়সা দিয়াও সে তাহার পিতামাতাকে কখন সাহায্য করিত না, বরং সুযোগ পাইলে তাঁহাদিগের নিকট হইতে কিছু কিছু আনিয়া আপনার ফিরিঙ্গী বন্ধুর ইচ্ছানুরূপ অযথা খরচপত্রে ব্যয় করিয়া ফেলিত। কৃষ্ণকায় ফিরিঙ্গী যুবকও কখনও কখনও কিছু কিছু উপার্জ্জন করিত, কিন্তু সেও তাহার মাতাকে কখনও কপদকও প্রদান করিত না। তাহার বৃদ্ধা মাতার হস্তে কিছু পয়সাও ছিল। তাহা হইতেওসে সময় সময় কিছু কিছু গ্রহণ করিতে ত্রুটি করিত না।
যে স্থানে সেই ফিরিঙ্গী যুবক বাস করিত, তাহার কিয়দ্দূর ব্যবধানে একখানি খোলার বাড়ীতে আরও কতকগুলি ফিরিঙ্গীর বাসা ছিল। উহাতে অনেকগুলি স্ত্রীলোক ও পুরুষ থাকিত। কিন্তু ওই সকল স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে কেহ বা সৎ চরিত্রা কেহ বা চরিত্রহীনা তাহা আমরা সেই সময় বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। এখনও সম্পূর্ণরূপে পারি নাই। কোন কোন ফিরিঙ্গী যুবক স্বামী-পরিবাররূপে তাহাদিগের সঙ্গে বাস করিত, অথচ অপর যুবকগণকেও তাহাদিগের ঘরে বসিতে উঠিতে প্রায়ই দেখিতে পাইতাম। ওই বাড়ীর একটি স্ত্রীলোকের ঘরে আমাদিগের পূর্ব্বকথিত ফিরিঙ্গী ও মুসলমান যুবককে প্রায়ই দেখা যাইত। যে সময় আমরা সেই মুসলমান যুবককে দেখিতে পাই, সেই সময় সে সেই ফিরিঙ্গী যুবকের সহিত রাস্তার দিকে গমন করিতেছিল। যে দোকানে সেই মুসলমান যুবক কৰ্ম্ম করিত, সেই দোকানের অপর একজন কর্ম্মচারী সেই সময় আমাদিগের সঙ্গেই ছিলেন। তিনি ওই মুসলমানকে দেখিতে পাইয়াই আমাদিগকে যেমন দেখাইয়া দিলেন, অমনি আমরা তাহাকে ধৃত করিলাম। সমভিব্যাহারী সেই ফিরিঙ্গী যুবক তাহার বন্ধুর অবস্থা দেখিয়া আমাদিগের উপর নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইল, ও আমাদিগকে নানারূপ ভয় প্রদর্শন করিতে লাগিল ও ফিরিঙ্গী সুলভ নানারূপ তৰ্জ্জন গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিল। ওই ফিরিঙ্গীকে যে আমরা ধৃত করিব, তাহা আমরা ইতিপূর্ব্বে একবারও ভাবি নাই; কিন্তু তাহার তজ্জন গর্জ্জন ও আস্ফালন শুনিয়া আমাদিগের মনে ক্রোধের উদয় হইল। পরিশেষে যাহা হয় হউক ভাবিয়া তাহাকেও ধৃত করিলাম। ও উভয়ের অঙ্গ উত্তমরূপে তল্লাস করিয়া দেখিলাম। মুসলমানের নিকট কোন দ্রব্য পাওয়া গেল না, কিন্তু সেই ফিরিঙ্গীর পকেট হইতে একখানি রুমাল বাহির হইল। রুমালখানি দেখিয়া অনুমান হইল, উহা মূল্যবান; বিশেষ সেই ফিরিঙ্গীর পরিধানে যেরূপ কোট পেন্টলেন ছিল, তাহাতে ওইরূপ রূমাল কোনরূপেই শোভা পায় না। ওই রুমালের কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে কহিল, “এই রুমাল আমার, আমি বাজার হইতে খরিদ করিয়াছি। কোথা হইতে খরিদ করিয়াছি, তাহা তোমাদিগকে বলিব না। যখন মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট যাইব, তখন তাঁহাকে বলিব।” বলা বাহুল্য, গ্রেপ্তার হইবার পরও ফিরিঙ্গীর সেই তেজ কমে নাই; কিন্তু পরে সামান্য চৌকিদার হইতে আরম্ভ করিয়া ঊর্দ্ধতন কর্ম্মচারী পর্য্যন্ত যাহার পায়ে সে না ধরিয়াছে, এরূপ কোন লোকই পুলিসে নাই।
ওই রূমালের কথা সেই মুসলমানকে জিজ্ঞাসা করায়, সে কহিল, “আমি ইহার কিছুই অবগত নহি।”
দোকানের যে কর্মচারী আমাদিগের সহিত ছিলেন, তিনি ওই রুমালখানি উত্তমরূপে দেখিয়া কহিলেন, “এইরূপ কয়েকখানি রুমাল আমাদিগের দোকানে আছে। তাহার মধ্য হইতে ইহা অপহৃত হইয়াছে কিনা, বলিতে পারি না।”
এই কথা শুনিয়া উহাদিগকে লইয়া আমরা ওই প্রদর্শনীর মধ্যে পুনরায় প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম ওইরূপ আরও কয়েকখানি রুমাল বাস্তবিকই সেই দোকানে আছে। কিন্তু পূর্ব্বে যে কয়খানি ছিল ও এখন তাহা হইতে কিছু অপহৃত বা স্থানান্তরিত হইয়াছে কি না, তাহা কেহই বলিয়া উঠিতে পারিলেন না। কিন্তু সকলেরই যেন অনুমান হইল, ওই রুমালখানি ওই দোকানেরই। আরও অনুমান হইল, ওই মুসলমান কর্ম্মচারী কোন গতিকে ওই রুমালখানি দোকান হইতে অপহরণ করিয়া তাহার বন্ধুকে ব্যবহার করিতে প্রদান করিয়াছে। কারণ ওই দোকান হইতে ওই রুমাল স্থানান্তরিত করা ফিরিঙ্গীর পক্ষে একেবারে অসম্ভব। আমাদিগের সকলের মনে হঠাৎ ওইরূপ সন্দেহ হইল সত্য, কিন্তু প্ৰমাণে কোন বিষয় প্রাপ্ত হওয়া গেল না।
ওই ফিরিঙ্গীকে দেখিয়া দোকানের এক ব্যক্তি কহিলেন, “আজ কয়েকদিবস হইল, এই ফিরিঙ্গীকে আমরা এখানে দেখিয়াছি। সে আমাদিগের দোকানের নিকট আসিয়া এই মুসলমান কর্ম্মচারীর সহিত অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত কথাবার্ত্তা কহিয়াছিল। সেই সময় উহার সহিত একটি মেমও ছিল; তাহাকে দেখিলেও আমি চিনিতে পারি।”
এই কথা শুনিয়া ফরিয়াদীকে সেই মেমের কথা জিজ্ঞাসা করায়, তিনি সেই মেম সম্বন্ধীয় সমস্ত কথাই অস্বীকার করিলেন। এই অনুসন্ধানে যেমন আমরা নিযুক্ত হইয়াছিলাম, সেইরূপ কয়েকজন ইংরাজ পুলিস-কৰ্ম্মচারীও নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ওই ফিরিঙ্গীর সহিত যখন আমাদিগের কথা হইতেছিল, সেই সময় সেই স্থানে দুইজন ইংরাজ পুলিস-কৰ্ম্মচারী দণ্ডায়মান থাকিয়া আমাদিগের সমস্ত কথা শ্রবণ করিতেছিলেন। ওই ফিরিঙ্গী যেরূপভাবে আমাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিতেছিল, তাহা শুনিয়া ওই ইংরাজ কর্মচারীদ্বয়ের অতিশয় ক্রোধের উদ্রেক হয়। তাঁহারা উভয়েই আমাদিগের নিকট আগমন করিয়া কহেন, “এই জাতিহীন ফিরিঙ্গীকে লইয়া অনুসন্ধান করা আপনাদিগের কার্য্য নহে, উহা আমাদিগের কার্য্য। এই বলিয়াই কাহারও বিনা অনুমাতিতে ওই ফিরিঙ্গীর হস্তের বন্ধন খুলিয়া দেন ও তাহাকে তাঁহাদিগের অগ্রে অগ্রে যাইতে কহেন। তাঁহাদিগের কথা শুনিয়া ওই ফিরিঙ্গী যেমন একটু ইতস্ততঃ করিল, অমনি তাহার পৃষ্ঠদেশে বুট সহিত ইংরাজ-পদ সজোরে স্পর্শ করিল। অমনি আর কোন কথা না বলিয়া সে দ্রুতগতি তাঁহাদিগের অগ্রে অগ্রে গমন করিল। ইংরাজ কর্মচারীদ্বয় তাহাকে যে কোথায় লইয়া গেলেন, তাহা আমরা বেশ বুঝিতে পারিলাম। কিন্তু তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারে আর আমরা কেহই গমন করিলাম না। দশ পনর মিনিটের মধ্যেই ইংরাজ কৰ্ম্মচারীদ্বয় তাহাকে আনিয়া আমাদিগের সম্মুখে উপস্থিত করিলেন ও কহিলেন “এখন আপনারা ইহাকে যে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, এ তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিবে। এখন আপনারা ইহাকে লইয়া অনুসন্ধানে গমন করিতে পারেন, ও আবশ্যক হয়, আমরাও আপনাদিগের সহিত গমন করিতেছি।”
ইংরাজ কর্মচারীদ্বয়ের কথা শুনিয়া আমরা মনে করিলাম, অনুসন্ধানের সময় ইহারা যদি আমাদিগের সঙ্গে থাকেন, তাহা হইলে মন্দ হয় না; কারণ সময় সময় যে সকল কার্য্যের আবশ্যক হইয়া পড়ে, ও যে সকল কার্য্য আমাদিগের দ্বারা সম্পন্ন হওয়া একেবারে অসম্ভব বলিয়া অনুমান হয়, সেই সকল কার্য্য ইহাদিগের দ্বারা অনায়াসেই দেখিতে দেখিতে সম্পন্ন হইতে পারিবে। মনে মনে এইরূপ ভবিয়া ইংরাজ কর্মচারীদ্বয়কে সঙ্গে লইয়া আমরা পুনরায় সেইস্থান হইতে বহির্গত হইলাম। আমাদিগের ইচ্ছা, যে স্ত্রীলোকটি বা মেম সাহেব উহাদিগের সহিত ইতিপূৰ্ব্বে সেই মহামেলায় আগমন করিয়াছিল, তিনি কে তাহা অগ্রে অবগত হওয়া; কারণ, যে যুবক অবিবাহিত বলিয়া আমরা অবগত হইতে পারিয়াছি, সেই যুবক যদি কোন স্ত্রীলোকের প্রণয়ে আসক্ত হইয়া থাকে, ও এই সকল অলঙ্কার যদি সেই যুবকের দ্বারা অপহৃত হইয়া থাকে, তাহা হইলে উহার মধ্যে দুই একখানি অলঙ্কার সেই স্ত্রীলোককে দেওয়া অসম্ভব নহে। মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া আমরা সকলে পুনরায় সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। বলা বাহুল্য, এবার সেই ইংরাজ কৰ্ম্মচারীদ্বয় আমাদিগের সঙ্গেই রহিলেন।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সেই ফিরিঙ্গী যুবক এবার বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদিগের সকলকে সঙ্গে লইয়া বহুবাজার থানার অন্তর্গত একটি অপরিসর গলির মধ্যে প্রবেশ করিল। ওই গলির মধ্য দিয়া কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, আর একটি নিতান্ত সঙ্কীর্ণ গলির মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া একটি বাড়ীর ভিতর গমন করিল। আমরাও সকলে উহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। উহা পাকা বাড়ী নহে, খাপরেলের। উহার ভিতর অনেকগুলি ঘর বা কামরা আছে, – তাহার সমস্তগুলিই ফিরিঙ্গী যুবক ও রমণীর দ্বারা অধিকৃত। যে ফিরিঙ্গী যুবক আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, সে ওই বাড়ীর প্রাঙ্গণে উপস্থিত হইয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান হইল; তাহার মুখ দিয়া কোনরূপ বাক্য নির্গত হইল না। কোন স্ত্রীলোককে সে দেখাইয়া দিল না, বা কাহারও ঘরের ভিতর সে প্রবিষ্টও হইল না; কিন্তু, সেই বাড়ী হইতে অনেক স্ত্রীপুরুষ বহির্গত হইয়া সেই প্রাঙ্গণে আসিয়া উপস্থিত হইল। এতগুলি পুলিস কর্মচারী সেই বাড়ীর ভিতর আসিয়া হঠাৎ যে কেন উপস্থিত হইল, তাহা জানিবার নিমিত্ত সকলেই অতিশয় ব্যস্ত হইয়া পড়িল। স্ত্রীলোকগণের মধ্যে কেহ কেহ বা বিশেষ বিরক্তিভাব প্রকাশ করিয়া অর্দ্ধেক হিন্দি ও অর্ধেক ইংরাজী মিশ্রিত ভাষায় আমাদিগকে কহিতে লাগিল, “তোমরা কাহার আদেশে আমাদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে? আমরা চোর, না খুনি? এরূপ ভাবে স্ত্রীলোকদিগের বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করা অন্যায়। আমরা তোমাদিগকে কিছুতেই ছাড়িব না। কমিশনারও মাজিষ্ট্রেটের কাছে তোমাদিগের নামে নালিশ করিব, তোমাদিগের নামে দরখাস্ত দিব।” এইরূপ নানাপ্রকার তৰ্জ্জন গর্জ্জন করিতে করিতে অনেকেই আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। আমরা তাহাদিগের কথায় কিছুমাত্র কর্ণপাত না করিয়া সেই ফিরিঙ্গী যুবককে কহিলাম, “তুমি এরূপ ভাবে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলে যে? যাহাকে দেখাইবার নিমিত্ত আমাদিগকে এখানে আনয়ন করিলে, তাহাকে দেখাইয়া দিতে এত বিলম্ব করিতেছ কেন?” আমাদিগের কথা শুনিয়াও সেই ফিরিঙ্গী যুবক কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না, কেবলমাত্র এদিক ওদিক চাহিতে লাগিল। উহার এই অবস্থা দেখিয়া ও ফিরিঙ্গী-রমণীগণের কথা শুনিয়া ইংরাজ-কর্মচারীদ্বয় অতিশয় ক্রোধান্বিত হইয়া পড়িলেন। দেখিতে দেখিতে বুট সহিত তাঁহাদিগের একটি পদ ওই ফিরিঙ্গী যুবকের পৃষ্ঠ পুনরায় স্পর্শ করিল। ওই পদস্পর্শসুখ অনুভব করিবামাত্র সে ওই বাড়ীর একটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। রমণীগণ যেরূপ ভাবে আমাদিগের উপর তর্জন গর্জ্জন করিতেছিল, সাহেবদ্বয়ের মূর্তি দেখিয়া তাহারাও মুখ বন্ধ করিয়া আপনাপন ঘরের দিকে গমন করিতে লাগিল।
ফিরিঙ্গী যুবক যে ঘরের মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, আমরাও সেই ঘরের মধ্যে গমন করিলাম। দেখিলাম, সেই ঘরের মধ্যে সেই সময় কেহই নাই। ওই ঘরে কে বাস করে, তাহা জিজ্ঞাসা করাতে বাড়ীর কেহই প্রথমতঃ আমাদিগের কথার উত্তর প্রদান করিল না। কেহ কেহ কহিল, “আমরা জানি না।” এইরূপ কথা শুনিলে সহজেই ক্রোধের উদয় হইয়া থাকে; কিন্তু আমরা সেই ক্রোধ সংবরণ করিয়া যাহাতে আমাদিগের কার্য্য সহজে সম্পন্ন করিয়া লইতে পারি, তাহার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। যে সকল ফিরিঙ্গী সেই সময় সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাদিগের একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ বাড়ী কাহার?” উত্তরে সে কহিল, “আমি জানি না, আমি আপনাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ এই বাড়ীর ভিতর আসিতেছি।” আর একজনকে ওই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করায় সেও সেইরূপ উত্তর প্রদান করিল। ওই বাড়ীর একটি স্ত্রীলোককে পুনরায় ওই কথা জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল, “আমি জানি না, আমি অল্পদিন হইল এই বাড়ীতে উঠিয়া আসিয়াছি।” এইরূপ যাহাকে যাহা জিজ্ঞাসা করিলাম, সে তাহাই অবগত নহে বলিয়া, উত্তর প্রদান করিতে লাগিল।
উহাদিগের এরূপ অবস্থা দেখিয়া তাহাদিগকে আমরা আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করা নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া নিকটবর্ত্তী থানা হইতে কয়েকজন কনেষ্টবল আনাইলাম, ও সেই বাড়ীর সকলকে ভয় প্রদর্শন করিবার মানসে তাহাদিগকে আদেশ প্রদান করিলাম, “এই বাড়ীর ভিতর স্ত্রী কি পুরুষ যে সকল লোক আছে, তাহাদিগের প্রত্যেককে ধৃত করিয়া থানায় লইয়া যাও। যে পৰ্যন্ত তাহারা আমাদিগের কথার যথাযথ উত্তর প্রদান না করিবে, সেই পৰ্য্যন্ত তাহারা থানাতেই কয়েদ থাকিবে।” আমাদিগের এই আদেশ পাইবামাত্র দুই একজন প্রহরী দ্রুতগতি গমন করিয়া দুই একটি ফিরিঙ্গী রমণীর হস্ত ধারণ করিল, ও ঘর হইতে তাহাদিগকে বাহির করিয়া আমাদিগের সম্মুখে আনিয়া উপস্থিত করিল।
আমাদিগের এই অবস্থা দেখিয়া তাহাদিগের অনুমান হইল যে, তাহাদিগের উপর প্রকৃতই আমরা অত্যাচার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। তখন তাহারা সেই ফিরিঙ্গী মূর্ত্তি পরিত্যাগ করিয়া নিতান্ত ভীত অন্তঃকরণে কহিল, “আমাদিগের উপর কেন এরূপ অত্যাচার করিতেছেন? আমাদিগকে কি করিতে হইবে, বা কি কহিতে হইবে, তাহা বলুন; যাহা কিছু আমরা অবগত আছি, তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিতেছি।”
উহাদিগের এই কথা শুনিয়া আমরা কহিলাম, “যে ঘরে ওই ফিরিঙ্গী যুবক প্রবেশ করিয়াছে, সেই ঘরে কোন্ স্ত্রীলোক থাকে? সে কোথায়, তাহাকে দেখাইয়া দেও, ও তাহাকে বল যে, সে যদি প্রকৃত কথা না বলিয়া আমাদিগের সহিত তোমরা যেরূপ ব্যবহার করিয়াছ, সেইরূপ ব্যবহার করে, তাহা হইলে তাহাকে বিশেষরূপ কষ্ট ভোগ করিতে হইবে।”
যে কয়েকটি স্ত্রীলোক ইতিপূর্ব্বে কনেষ্টবলগণ কর্তৃক ধৃত হইয়া আমাদিগের সম্মুখে আনীত হইয়াছিল, আমাদিগের কথা শুনিয়া তাহাদিগের মধ্য হইতে একটি স্ত্রীলোক কহিল, কেন, কি হইয়াছে, আমি ওই ঘরে থাকি।”
আমি। তুমি ওই ঘরে থাক, তাহা এতক্ষণ পর্য্যন্ত বলিতেছ না কেন?
স্ত্রীলোক। আমাকে আপনারা এ পর্যন্ত কোন কথা ত জিজ্ঞাসা করেন নাই?
আমি। তোমাকে আমরা যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তুমি তাহার প্রকৃত উত্তর প্রদান করিবে কি?
স্ত্রীলোক। কেন করিব না।
আমি। আমরা তোমাকে পূর্ব্ব হইতেই সতর্ক করিয়া দিতেছি, আমাদিগের প্রশ্নের যদি তুমি প্রকৃত উত্তর প্রদান না কর, তাহা হইলে জানিও, যে তোমার কষ্টের পরিসীমা থাকিবে না।
স্ত্রীলোক। আমি মিথ্যা কথা কহিব না।
আমি। ওই ঘর তোমার?
স্ত্রীলোক। হাঁ, আমি ওই ঘরেই থাকি।
আমি। এই ফিরিঙ্গী যুবক তোমার কে হয়?
স্ত্রীলোক। ও আমার কেহ হয় না।
আমি। তোমার নিকট ও কত দিবস হইতে পরিচিত?
স্ত্রীলোক। আমি উহাকে চিনি না।
স্ত্রীলোকটির এই কথা শুনিয়া আমরা সেই ফিরিঙ্গী যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তুমি যাহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছ, তাহাকেই দেখাইবার নিমিত্ত কি তুমি আমাদিগকে এই স্থানে আনিয়াছ?”
সেই ফিরিঙ্গী যুবক আমাদিগের এই কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। তখন আমরা মনে করিলাম, “তবে কি এই ফিরিঙ্গী আমাদিগকে এই বাড়ীতে আনিয়া ইহাদিগকে মিথ্যা কষ্ট দিতেছে। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে আমরা ইহাদিগকে কষ্ট দিয়া নিতান্ত অন্যায় কার্য্য করিয়াছি। যাহা হউক, এখন দেখিতেছি, এই ফিরিঙ্গী যুবকের এখনও বদমাইসি অন্তর্হিত হয় নাই।” মনে মনে এইরূপ ভাবিতেছি ও এখন কি করা কর্তব্য, তাহাই স্থির করিতেছি, এরূপ সময়ে সেই ইংরাজ কর্মচারীদ্বয় কহিলেন, “এই অনুসন্ধান করা আপনাদিগের কর্ম্ম নহে। এই ফিরিঙ্গী যুবক আমাদিগের হস্তে দস্তুরমত শিক্ষা প্রাপ্ত না হইলে এই মোকদ্দমার প্রকৃত অনুসন্ধান হইবে না। এই বলিয়া আমাদিগের উত্তরের অপেক্ষা না করিয়াই তাঁহারা ওই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন, ও দুই একটি অর্দ্ধচন্দ্র প্রদান পূৰ্ব্বক তাহাকে সেই ঘর হইতে বাহির করিয়া আনিলেন। ইংরাজ কর্মচারীদ্বয়ের সেই মূর্ত্তি দেখিয়া ফিরিঙ্গী যুবক অতিশয় ভীত হইয়া পড়িল, ও কাঁপিতে কাঁপিতে কহিল, “আমি যে ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলাম, উহার উত্তর পার্শ্বের ঘরে সে থাকে।” তাহার কথার উত্তরে কৰ্ম্মচারীদ্বয় কহিলেন, “এখন আর তোমার অধিক কথা আমরা শুনিতে চাহি না। যাহাকে দেখাইবার নিমিত্ত তুমি আমাদিগকে সঙ্গে করিয়া এখানে আনিয়াছ, এখন তাহাকে দেখাইয়া দিবে কি না, তাহাই আমরা জানিতে চাহি। তোমার অপর কোন কথা আমরা এখন শুনিতে চাহি না।”
কর্ম্মচারীদ্বয়ের ক্রোধ সংযুক্ত এই কথা শুনিয়া, সে আর কোন কথা কহিল না। একটি স্ত্রীলোককে দেখাইয়া দিয়া কহিল, “যাহার কথা আমি বলিতেছিলাম, তিনি এই।” সেই স্ত্রীলোকটিও প্রহরিগণ কর্তৃক সেই স্থানে ধৃত অবস্থায় অবস্থিতি করিতেছিল। তখন আমরা সেই স্ত্রীলোকটিকে আমাদিগের নিকট আনিলাম ও কহিলাম, “কেমন এ যাহা বলিতেছে, তাহা প্রকৃত ত!”
স্ত্রীলোক। ও কি কথা বলিতেছে?
আমি। তোমার নিকট উহার যাতায়াত আছে।
স্ত্রীলোক। না, ও মিথ্যা কথা। ও আমার নিকট আসিবে কেন?
আমি। ও তোমার স্বামী?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। তোমার উপপতি?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। তবে ও তোমার কে হয়?
স্ত্রীলোক। কেহই নহে।
আমি। তোমার নিকট ও কতদিবস হইতে পরিচিত?
স্ত্রীলোক। আমি উহাকে চিনি না।
আমি। মিথ্যা কথা কহিও না। সকলেই জানে যে, ও তোমার উপপতি। তুমি কষ্ট পাইবে বলিয়া কি মিথ্যা কথা কহিতেছ?
স্ত্রীলোক। আমি মিথ্যা কথা কহিব কেন? আমার স্বামী বর্তমান। ও আমার উপপতি হইবে কি প্রকারে?
আমি। তোমার স্বামী বর্তমান?
স্ত্রীলোক। হাঁ।
আমি। তোমার স্বামী কোথায়?
স্ত্রীলোক। পশ্চিম।
আমি। পশ্চিমে তিনি কি করেন?
স্ত্রীলোক। রেলের মধ্যে কি কার্য্য করেন, তাহা আমি জানি না।
আমি। কতদিবস হইতে তিনি পশ্চিমে আছেন?
স্ত্রীলোক। এক বৎসর হইতে।
আমি। এই এক বৎসরের মধ্যে তিনি এখানে আসিয়া ছিলেন কি?
স্ত্রীলোক। কর্ম্ম হওয়ার পর তিনি আর এখানে আসেন নাই।
আমি। তোমার খরচপত্র কে দিয়া থাকে?
স্ত্রীলোক। আমার স্বামী।
আমি। তিনি কি টাকা পাঠাইয়া থাকেন?
স্ত্রীলোক। তিনি টাকা না পাঠাইলে আমার চলে কি প্রকারে?
আমি। মাসে মাসে তিনি কত টাকা করিয়া দিয়া থাকেন?
স্ত্রীলোক। কোন মাসে পাঁচ টাকা, কোন মাসে সাত টাকা ও কোন মাসে দশ টাকাও দিয়া থাকেন।
আমি। ফি মাসে টাকা দেন, কি দুই এক মাস অন্তর একেবারে টাকা পাঠাইয়া দেন?
স্ত্রীলোক। কখন মাসে মাসে দেন, কখন বা দুই এক মাস অন্তর পাঠাইয়া দেন।
আমি। সৰ্ব্বশেষ তুমি তোমার স্বামীর নিকট হইতে কবে টাকা পাইয়াছ?
স্ত্রীলোক। প্রায় তিন মাস হইবে।
আমি। যখন তিনমাস কাল তোমার খরচের টাকা আসিয়া পৌঁছায় নাই, তখন তুমি তোমার খরচপত্র চালাইতেছ কি প্রকারে?
স্ত্রীলোক। হাওলাত বরাৎ করিয়া।
আমি। তুমি মহামেলা দেখিতে কয়দিবস গমন করিয়াছিলে?
স্ত্রীলোক। আমি মহামেলা দেখিতে গমন করি নাই—–না, গিয়াছিলাম।
আমি। কয়দিবস গিয়াছিলে?
স্ত্রীলোক। একদিবস, না–-দুইদিবস।
আমি। এই ফিরিঙ্গী যুবকের সহিত তুমি কোন্ দিবস গমন করিয়াছিলে? প্রথম দিবস, না দ্বিতীয় দিবস।
স্ত্রীলোক। আমি ইহার সহিত গমন করিব কেন? যাহাকে আমি চিনি না, তাহার সহিত আমি কোথায় গমন করিব?
আমি। মিথ্যা কথা কহিও না। ইহার সহিত মহামেলায় তোমাকে অনেক লোক দেখিয়াছে।
স্ত্রীলোক। আমি যখন ইহার সহিত গমন করি নাই, তখন উহার সহিত আমাকে কে দেখিবে?
আমি। যাহারা তোমাকে দেখিয়াছে, তাহারা যখন তোমার সম্মুখে বলিবে, তখন দেখিব তোমার উত্তর কি?
স্ত্রীলোক। আমি বলিতেছি, আমি ইহার সহিত কখনও গমন করি নাই।
আমি। এই বাড়ীর সকলেই যখন ইহাকে চিনে, তখন তুমি কিরূপে বলিতেছ যে, তুমি ইহাকে চিন না?
স্ত্রীলোক। আমি ইহাকে চিনি না, এ কথা আমি বলিতেছি না। আমি ইহার সহিত মহামেলা দেখিতে যাই নাই, তাহাই বলিতেছি।
আমি। তাহা হইলে আমার শুনিবার ভুল হইয়া থাকিবে। তুমি ইহাকে কত দিবস হইতে চিন?
স্ত্রীলোক। প্রায় ৭/৮ মাস হইতে।
আমি। তুমি ইহাকে কিরূপে চিন? কি সূত্রে তোমার সহিত ইহার আলাপ পরিচয়?
স্ত্রীলোক। আলাপ পরিচয় কিছুই নাই। আমাদিগের বাড়ীতে ও সময় সময় আসিয়া থাকে, তাহাই উহাকে দেখিয়াছি।
আমি। কাহার নিকট আসিয়া থাকে?
স্ত্রীলোক। তাহা আমি জানি না, কিন্তু সকলের সহিতই আলাপ আছে, সকলের ঘরেই গমন করে, তাই দেখিতে পাই।
আমি। যখন সকলের ঘরেই গমন করিয়া থাকে, ও সকলের সহিতই আলাপ আছে, তখন তোমার ঘরেও গমন করিয়া থাকে, ও তোমার সহিতও আলাপ আছে?
স্ত্রীলোক। না, আমার সহিত উহার আলাপ নাই, বা আমার ঘরে ও কখনও আসে না।
আমি। তোমার গলায় যে একটি পিন দেখিতেছি, উহা কাহার?
স্ত্রীলোক। আমার।
আমি। উহা কিসের? সোণার না পিতলের।
স্ত্রীলোক। সোণার।
আমি। উহার উপর যে একখানি সাদা পাথর বসান আছে দেখিতেছি, ওখানি কি?
স্ত্রীলোক। ওখানি কাচ।
আমি। না উহা তো কাচ নহে, উহা হীরকখণ্ড। ইহা তুমি কোথায় পাইলে?
স্ত্রীলোক। উহা আমার।
আমি। উহা তো দেখিতেছি একেবারে নূতন। এই নূতন অলঙ্কার তুমি কোথায় পাইলে?
স্ত্রীলোক। আমি কিনিয়াছি।
আমি। কোথা হইতে কিনিয়াছ?
স্ত্রীলোক। চুণাগলির মোড়ে যে পোদ্দারের দোকান আছে, সেই দোকান হইতে আমি উহা খরিদ করিয়াছি।
আমি। কত মূল্যে তুমি উহা খরিদ করিয়াছ?
স্ত্রীলোক। দশ টাকায়।
আমি। উহাতে যে একখানি হীরক দেখিতেছি, তাহার মূল্য ৫০ টাকার কম নহে। তদ্ব্যতীত, ছোট ছোট আরও কয়েকখানি হীরক ও চুনি উহাতে আছে; সোণাও আছে। যাহার মূল্য কোন প্রকারেই একশত টাকার কম হইতে পারে না, তাহা তুমি দশ টাকায় কিরূপে খরিদ করিলে তাহা আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। যে দোকানদারের নিকট হইতে তুমি উহা খরিদ করিয়াছ, তাহাকে আমায় দেখাইতে পার?
স্ত্রীলোক। সে দোকানদারকে আমি চিনি না।
আমি। তবে কিরূপে বলিলে যে চুণাগলির মোড়ে যে পোদ্দারের দোকান আছে, সেই দোকান হইতে তুমি উহা খরিদ করিয়াছ?
স্ত্রীলোক। আমাকে যিনি খরিদ করিয়া দিয়াছিলেন, তাঁহার নিকট হইতে আমি যাহা শুনিয়াছিলাম, তাহাই আমি আপনাকে বলিয়াছি।
আমি। কে তোমাকে উহা খরিদ করিয়া দিয়াছিলেন?
স্ত্রীলোক। আমার একজন বন্ধু।
আমি। তোমার সেই বন্ধুর নাম কি? তিনি থাকেন কোথায়?
স্ত্রীলোক। তাঁহার নাম আমি জানি না, ও এখন তিনি কোথায় আছেন, তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারি না।
আমি। তুমি যাহাকে বন্ধু বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছ, তাহার নাম জান না ও তিনি কোথায় থাকেন, তাহাও বলিতে পার না, এ কিরূপ কথা হইল? তুমি স্ত্রীলোক, বিশেষতঃ মেমসাহেব বলিয়া তোমার পরিচয়ও প্রদান করিয়া থাক। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি এইরূপ ভাবে মিথ্যা কথা কহিবে, তাহা হইলে তোমার বিশেষ অনিষ্ট হইবে। তদ্ব্যতীত, বিশেষরূপে অবমানিত হইয়া, পরিশেষে জেলে পর্য্যন্ত গমন করিবে। এখনও আমি তোমাকে বলিতেছি, তুমি প্রকৃত কথা কহ। এই ফিরিঙ্গী যুবক তোমাকে ওই অলঙ্কার দেয় নাই কি?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। তবে কে দিয়াছে?
স্ত্রীলোক। আমার স্বামী।
আমি। মিথ্যা কথা, তুমি চোর। ইহা তুমি যেস্থান হইতে চুরি করিয়া আনিয়াছ, তাহা আমরা অবগত আছি ও সেই চুরি মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমরা এতগুলি পুলিস কর্ম্মচারী এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। তুমি দেখিতেছি পাকা চোর, তোমার নিকট হইতে সহজে কোন কথা পাওয়া যাইবে না। তোমাকেই অগ্রে থানায় লইয়া যাওয়ার প্রয়োজন দেখিতেছি।
ওই স্ত্রীলোকটিকে এই কথা বলিয়া আমাদিগের সমভিব্যাহারী একজন দেশীয় কনেষ্টবলকে কহিলাম “ইহাকে থানায় লইয়া গিয়া যে পর্য্যন্ত আমরা না আসি, সেই পৰ্য্যন্ত ইহাকে হাজতে বন্ধ করিয়া রাখ।”
আদেশ পাইবামাত্র সেই প্রহরী ওই স্ত্রীলোকটির হস্ত ধারণ পূর্ব্বক আমাদিগের সম্মুখ হইতে দুই এক পদ অগ্রসর হইবামাত্রই, সেই স্ত্রীলোকটি চিৎকার করিয়া উঠিল ও কহিল, “বাড়ীর অনেকেই অলঙ্কার পাইল, আর আমি একাকীই কেবল অবমানিত হইলাম।”
এই কথা শুনিবামাত্রই আমরা সেই কনেষ্টবলের নিকট হইতে তাহাকে পুনরায় আমাদিগের সম্মুখে আনিলাম ও কহিলাম “এই বাড়ীর মধ্যে কোন্ কোন্ স্ত্রীলোক কি কি অলঙ্কার পাইয়াছে, তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দেও, নতুবা তোমার অদৃষ্টে যাহা ঘটিতে বসিয়াছে, তাহা এখনি দেখিতে পাইবে।”
স্ত্রীলোক। আমাকে কি বলিতে হইবে?
আমি। তুমি যেন অলঙ্কার পাইয়াছ, সেইরূপ আর কে কে অলঙ্কার পাইয়াছে?
স্ত্রীলোক। এই বাড়ীর সকলকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখুন, তাহারা সকলেই আপনাপন কথা বলিবে, আমি আর কার নাম করিব।
ওই স্ত্রীলোকটির কথা শুনিয়া ক্রোধে আপাদমস্তক জ্বলিতে লাগিল, কিন্তু স্ত্রীলোক বলিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেই ক্রোধ সম্বরণ করিতে হইল। দেখিলাম উহার সহিত নিরর্থক আর বাবিতণ্ডা করা কর্ত্তব্য নহে। বাড়ীর অপরাপর স্ত্রীলোকগণকে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া দেখা যাউক, তাহারাই বা কি বলে। মনে মনে এই কথা ভাবিয়া জনৈক প্রহরীর জিম্মায় ওই স্ত্রীলোকটিকে সেই স্থানে বসাইলাম। ওই বাড়ীর এগ্রিমেন্ট ছিল–আর একটি স্ত্রীলোকের; তাহাকেই সকলে বাড়ীওয়ালী বলিত। তাহাকে ডাকিলে সে আমাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইল। পূর্ব্বে আমরা যখন ওই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলাম, তখন উহার মুখ দিয়া লম্বা লম্বা কথা বাহির হইতেছিল; কিন্তু এখন আর তাহার সেই রূপ অবস্থা ছিল না। তাহাকে ডাকিবামাত্রই সে আমাদিগের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাকে যে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম, সে তাহার যথাযথ উত্তরও প্রদান করিতে আরম্ভ করিল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
সেই বাড়ীওয়ালীর সহিত আমাদিগের যে সকল কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহা বর্ণন করিবার পূৰ্ব্বে, ওই বাড়ীওয়ালী যে কে, তাহার একটু পরিচয় এই স্থানে প্রদান করা কর্তব্য। ইহার পিতা মাতা কোন্ কুল পবিত্র করিয়াছিলেন, তাহা আমরা অবগত নহি; কিন্তু যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহাতে এইমাত্র বুঝিতে পারিয়াছিলাম যে, তাহার পিতা কোন নীচ হিন্দু-বংশ-সম্ভূত একজন যুবক ছিলেন। কোন এক দুর্ভিক্ষের সময় আপনার উদরান্নের সংস্থান করিতে না পারিয়া পাদরিগণের সাহায্য গ্রহণ করেন, ও তাঁহাদিগেরই অনুকম্পায় নিজ ধৰ্ম্ম পরিত্যাগপূর্ব্বক নবধর্ম্ম গ্রহণ করেন। খৃষ্টধর্ম্ম অবলম্বন করিবার পরই জনৈক খৃষ্টধর্ম্মাবলম্বী সাঁওতাল কন্যার সহিত তাঁহার পরিণয় হয়। এই বাড়ীওয়ালীর পিতামাতা তাঁহারাই। যখন বাড়ীওয়ালীর বয়ঃক্রম ১২/১৩ বৎসর সেই সময় কোন একজন নীলকরের আয়াগিরি কর্ম্ম করিতে সে নিযুক্ত হয়, ও পরিশেষে সেই সাহেবের সহিত সে কলিকাতায় আগমন করে। কলিকাতায় আসিবার দুই এক বৎসর পরে সেই নীলকর সাহেব স্বদেশ যাত্রা করেন; সুতরাং, বর্তমান বাড়ীওয়ালীকে কলিকাতাতেই থাকিতে হয়। কলিকাতায় কিছুদিবস অবস্থিতি করিতে করিতে চুণাগলির জনৈক ফিরিঙ্গী যুবকের সহিত তার পরিণয় হয়। কিছুদিবস পর্য্যন্ত তাহারা একত্রে চুণাগলির একখানি খোলার ঘরে বাস করে। তাহার স্বামী কোন জাহাজে একটি সামান্য কৰ্ম্ম করিত। ওই সামান্য কৰ্ম্মে যাহা কিছু উপার্জ্জন হইত, তাহার দ্বারাই উভয়ের ভরণপোষণ ও মদ্যাদির খরচের একরূপ সংস্থান হইত; কিন্তু সেইরূপ ভাবে তাহাদিগের অধিক দিবস অতিবাহিত হইল না। বিবাহের পর দুই বৎসর অতীত হইতে না হইতেই, তাহার স্বামী জাহাজ হইতে গঙ্গাগর্ভে পতিত হইয়া জলমগ্ন হয়। বিধবা হইবার পর হইতে বাড়ীওয়ালীর আর কোনরূপে দিন যাপনের সংস্থান থাকে না; সুতরাং রাত্রিকালে সে ফ্রী-স্কুল ষ্ট্রীটের কোন এক ‘খালি কুঠিতে’গিয়া বসিতে আরম্ভ করে। কেহ কেহ বলেন, তাহার স্বামী বর্তমান থাকিতেও তাহার সেই খালি কুঠিতে যাওয়া আসা ছিল, কিন্তু তাহার বিশেষ কোনরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় না। যে সময় বাড়ীওয়ালী খালি কুঠিতে গমন করিতে আরম্ভ করে, সেই সময় সে ইংরাজী কহিতে পারিত। এইরূপে কিছুদিবস অতিবাহিত হইবার পর, একজন পেন্সন প্রাপ্ত বিলাতী-সৈনিক তাহার প্রণয়ে মুগ্ধ হইয়া পড়েন। তিনি ইহাকে পুনরায় বিবাহ করিয়াছিলেন কি না, তাহা আমরা অবগত নহি; কিন্তু উভয়েই যে স্ত্রী পুরুষের ন্যায় একত্রে বাস করিতেছিলেন, তাহা প্রায় সকলেই অবগত আছেন। এই সময় হইতেই বৰ্ত্তমান খোলার বাড়ীখানি তিনি এগ্রিমেন্ট করিয়া লন ও বাড়ীওয়ালী নামে পরিচিত হইয়া পড়েন। সেই সৈনিক ইহার সহিত প্রায় ১৫/১৬ বৎসর একত্রে অতিবাহিত করিয়া কালগ্রাসে পতিত হন; সেও আজ ১০/১২ বৎসরের কথা। এই ১০/১২ বৎসরের মধ্যে বাড়ীওয়ালী আর কাহারও সহিত পুনরায় পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয় নাই, বিশেষ পুনরায় বিবাহ করিবার বয়সও আর তাহার ছিল না। এখন তিনি কেবলমাত্রই বাড়ীওয়ালী। তাহার বাড়ীতে যে কয়েকটি কামরা আছে, কেবলমাত্র তাহার একখানিতে সে বাস করিয়া থাকে, অপর ঘরগুলি ভাড়াটিয়াগণ দ্বারা অধিকৃত। ভাড়াটিয়াগণের মধ্যে সকলেই ফিরিঙ্গী কুলোদ্ভবা, ও যেরূপ চরিত্রের লোক, তাহার পরিচয় পাঠকগণ কিছু কিছু অবগত হইতে পারিয়াছেন, ও ক্রমে পারিবেন।
বাড়ীওয়ালী আমাদিগের নিকট আগমন করিলে আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এই বাড়ীতে তোমার কতগুলি ভাড়াটিয়া আছে?”
বাড়ীওয়ালী। এই বাড়ীতে যতগুলি ঘর আছে দেখিতেছেন, তাহার সমস্তগুলিতেই ভাড়াটিয়া আছে; কেবলমাত্র একখানি ঘরে আমি আছি।
আমি। তোমার ঘর ব্যতীত আর কয়খানি ঘর আছে?
বাড়ী। পাঁচখানি।
আমি। ওই পাঁচখানি ঘরের ভাড়াটিয়াগণের নাম তুমি বলিতে পার কি?
বাড়ী। বেলা, লুসি, এমি, মেরী ও এলি।
আমি। বেলা কাহার নাম?
বাড়ী। যাহাকে এতক্ষণ পর্য্যন্ত আপনারা নানা কথা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন ও যাহাকে আপনারা ধরিয়া রাখিয়াছিলেন, তাহার নাম বেলা।
আমি। বেলা কতদিবস হইতে তোমার বাড়ীতে বাস করিতেছে?
বাড়ী। প্রায় ৯ মাস হইতে।
আমি। উহার আর কে আছে?
বাড়ী। শুনিয়াছি, উহার স্বামী আছে, পশ্চিমে কোথায় কার্য্য করে; কিন্তু তাহাকে কখনও দেখি নাই।
আমি। উহার স্বামী কখনও এখানে আসে না?
বাড়ী। আমি ত কখনও আসিতে দেখি নাই।
আমি। উহার খরচপত্র কি কখনও সে পাঠাইয়া দেয়?
বাড়ী। তাহাও আমি ঠিক বলিতে পারি না। কখনও টাকা কড়ি আসিতে দেখি নাই, কিন্তু উহার নিকট কখনও কখনও শুনিতে পাই যে, তাহার স্বামী মধ্যে মধ্যে কিছু কিছু পাঠাইয়া উহাকে সাহায্য করিয়া থাকে।
আমি। তোমার ঘরের ভাড়া কে দেয়?
বাড়ী। ওই দেয়।
আমি। টাকা সে কোথা হইতে পায়?
বাড়ী। আমি তাহা জানি না, কিন্তু উহাদিগের অর্থের কোনরূপ অভাব প্রায়ই হয় না। যুবতী ফিরিঙ্গী-কন্যা যদি মনে করে, তাহা হইলে নানা উপায়ে সে অর্থ উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হয়।
আমি। এই যে ফিরিঙ্গী যুবক আমাদিগের সহিত আসিয়াছে, ইহাকে তুমি চিন?
বাড়ী। চিনি।
আমি। ইনি কে?
বাড়ী। ইহার মাতা আছেন। তাঁহার একখানি নিজের বাড়ী আছে। সময় সময় কৰ্ম্মকার্য করিয়া এও দুই পয়সা উপার্জ্জন করিয়া থাকে। ও আমাদিগের পাড়ার ছেলে, উহাকে আর আমি চিনি না? উহার বাল্যকাল হইতে আমি উহাকে জানি!
আমি। তোমার বাড়ীতে উহার যাতায়াত আছে?
বাড়ী। আছে।
আমি। কাহার নিকট বা কাহার ঘরে সে আসিয়া থাকে?
বাড়ী। সকলের সঙ্গেই তাহার আলাপ পরিচয়, সকলের ঘরেই তাহার যাতায়াত আছে, কিন্তু বেলার সহিত তাহার ভালবাসা অধিক, উহার ঘরেই প্রায় সে সৰ্ব্বদা থাকে।
আমি। বেলা যুবতী স্ত্রীলোক, বিশেষ তাহার স্বামী বিদেশে, এরূপ অবস্থায় এই ফিরিঙ্গী যুবক রাত্রিদিন উহার ঘরে অবস্থিতি করাতে কেহ কোন কথা কহে না?
বাড়ী। তাহা আর কে বলিবে? আমরা স্বাধীন জাতি, পর পুরুষের সহিত কথা কহিলে বা তাহাদিগকে ঘরে স্থান প্রদান করিলে আমাদিগের মধ্যে কোনরূপ অপযশ হয় না, ইহা আমরা অনেকেই করিয়া থাকি। আমি যদি কাহাকে ভালবাসি, ও তাহাকে যদি আমার ঘরে সদাসর্বদা উপবেশনাদি করিতে দি, তাহা হইলে আমার স্বামী আমার উপর কোনরূপ অসন্তুষ্ট হইতে পারেন না, আর যদি নিতান্ত অসন্তুষ্ট হন, তাহা হইলে তিনি না হয় আমাকে পরিত্যাগ করিবেন। আমি তখনই অপরের সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইব।
আমি। তোমাদিগের এ মন্দ আচার ব্যবহার নহে। সে যাহা হউক, এই যে মুসলমান যুবককে দেখিতেছ, এও কি এই বাড়ীতে সদাসৰ্ব্বদা আসিয়া থাকে?
বাড়ী। ফিরিঙ্গী যুবকের সহিত ইহার অতিশয় বন্ধুত্ব আছে; সুতরাং, তাহার সহিত সেও সময় সময় বেলার ঘরে আসিয়া থাকে, কখনও কখনও রাত্রিও অতিবাহিত করে।
আমি। বেলার অঙ্গে যে হীরা সংযুক্ত সুবর্ণ পিন রহিয়াছে, তাহা সে কোথায় পাইয়াছে, তাহা কিছু বলিতে পার?
বাড়ী। না।
আমি। লুসি কে?
বাড়ী। যাহাকে লইয়া আপনারা সর্ব্বপ্রথম টানাটানি করিতেছিলেন, তাহাকেই সকলে লুসি বলিয়া ডাকে।
আমি। উহার কে আছে?
বাড়ী। উহার স্বামী আছে।
আমি। সে থাকে কোথায়?
বাড়ী। এই বাড়ীতেই থাকে।
আমি। সে কি করে?
বাড়ী। সে জাহাজে কি কায করে।
আমি। সে এখন কোথায়?
বাড়ী। সে তাহার কার্য্যে গমন করিয়াছে।
আমি। কোন্ সময় সে তাহার কার্য্য হইতে আসিবে?
বাড়ী। তাহার কার্য্যে গমন করিবার ও আসিবার কিছুমাত্র স্থিরতা নাই, কখনও সমস্ত দিবস কৰ্ম্ম করে রাত্রিতে বাড়ীতে থাকে, কখনও বা সমস্ত রাত্রি কার্য্যে আবদ্ধ থাকে, পরদিবস দিবাভাগে তাহাকে আর বাহির হইতে হয় না। কখনও কখনও বা দুই তিন দিবস ক্রমাগত তাহাকে এখানে দেখিতে পাই না।
আমি। ইহার স্বামী ব্যতীত আর কেহ ইহার ঘরে যাতায়াত করিয়া থাকে?
বাড়ী। কেহ কেহ আসে বৈকি। তদ্ব্যতীত লুসি প্রায়ই তাহার ঘরে থাকে না, বাহিরে বাহিরেই সে দিন অতিবাহিত করে, সে যে কোথায় যায় ও কি করে, তাহা আমি বলিতে পারি না।
আমি। এমি কিরূপের স্ত্রীলোক?
বাড়ী। সেও যুবতী, তাহার স্বামী আছে শুনিয়াছি।
আমি। তাহার স্বামী কোথায়?
বাড়ী। আমি তাহাকে কখনও দেখি নাই, শুনিয়াছি আসাম অঞ্চলে সে কি কার্য্য করিয়া থাকে।
আমি। এমির খরচপত্র সে মাসে মাসে পাঠাইয়া দেয় কি?
বাড়ী। আমি কখন খরচ পাঠাইতে শুনি নাই।
আমি। তাহা হইলে তাহার চলে কি প্রকারে?
বাড়ী। পূর্ব্বে তাহার অতিশয় কষ্টই ছিল, দুই এক মাস হইল, তাহার সেই কষ্ট গিয়াছে।
আমি। সেই কষ্ট হইতে সে কিরূপে পরিত্রাণ পাইল?
বাড়ী। একটী চিনা এখন তাহার ঘরে আসিয়া থাকে। সেই সময় সময় আবশ্যকীয় অর্থাদি দিয়া তাহাকে সাহায্য করিতেছে।
আমি। তাহার নাম কি?
বাড়ী। তাহাকে উইনসু বলিয়া সকলে ডাকিয়া থাকে, তাহার ঠিক নাম কি, তাহা আমরা অবগত নহি।
আমি। সে এখন কোথায়?
বাড়ী। তাহাকে আজ দুইদিবস দেখি নাই।
আমি। সে কি এমির ঘরেই রাত্রিবাস করিয়া থাকে?
বাড়ী। এমির ঘরেই যে কেবল সে রাত্রি অতিবাহিত করে, তাহা নহে, আহারাদি পর্যন্তও সে তাহার ঘরে করিয়া থাকে।
আমি। তাহার আহারাদি প্রস্তুত করে কে?
বাড়ী। এমি।
আমি। এমি খৃষ্টান, আর সে চিনা; এরূপ অবস্থায় সে কিরূপে এমির প্রস্তুত দ্রব্যাদি ভক্ষণ করে?
বাড়ী। সে চিনা সত্য, কিন্তু তাহাকে দেখিয়া চিনা সাহেব বলিয়া অনুমান হয় না। সে সাহেবের ন্যায় পোষাক পরিধান করে, ইংরাজীতে কথাবার্তা কহিয়া থাকে, তাহাকে দেখিয়া ঠিক খৃষ্টান বলিয়া অনুমান হয়।
আমি। সে কি করে বলিতে পার?
বাড়ী। না তাহা আমি বলিতে পারি না, তবে শুনিয়াছি কোন সাহেবের নিকট সে কর্ম্ম করে।
আমি। এখন সে কোথায়?
বাড়ী। তাহা আমি জানি না, এ কথা পূৰ্ব্বেই আমি আপনাকে বলিয়াছি। শনিবারের রাত্রিতে তাহাকে এই বাড়ীতে দেখিয়াছিলাম, তাহার পর সে কোথায় গিয়াছে, বা কখন এই বাড়ী পরিত্যাগ করিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র আমি অবগত নহি।
আমি। তাহা বোধ হয়, এমি বলিতে পারিবে।
বাড়ী। অসম্ভব নহে, বলিলেও বলিতে পারে। কারণ আমি শুনিয়াছি, উহারা সকলেই তাহার সহিত কোথায় গমন করিয়াছিল।
আমি। উহারা কাহারা?
বাড়ী। বেলা, লুসি, এমি ও মেরী।
আমি। ইহারা চারিজনেই? বাড়ী। হাঁ।
আমি। কখন গিয়াছিল?
বাড়ী। তাহা আমি বলিতে পারি না। শনিবার রাত্রি ১০টার পর উইনসু আমার বাড়ীতে আসে, যখন সে আমার বাড়ীতে প্রবেশ করে, তখন আমি আমার ঘরের সম্মুখেই বসিয়াছিলাম। সে আসিয়াই এমির ঘরে গমন করে। তাহার পর আমি গিয়া শয়ন করি। রবিবার প্রত্যূষে উঠিয়া দেখিতে পাই, বেলা, লুসি, এমি ও মেরী এবং উইনসু প্রভৃতি কেহই বাড়ীতে নাই। কেবলমাত্র এলি ও তাহার স্বামী বাড়ীতে আছে। তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করায় বলিল, উহারা ইহাদিগের কোন কথা বলিতে পারে না। সমস্ত রবিবারের মধ্যে উহারা আর প্রত্যাগমন করে নাই। রাত্রি ১২টার পর উহারা একখানি গাড়ি করিয়া আসিয়া উপস্থিত হয়, কিন্তু উইনসুকে দেখিতে পাই নাই। উহারা কোথায় গিয়াছিল; জিজ্ঞাসা করায় আমাকে এইমাত্র কহে যে, উহারা উইনসুর সহিত বেড়াইতে গিয়াছিল। নানাস্থানে বেড়াইয়া ও আমোদ আহ্লাদ করিয়া উহারা ফিরিয়া আসিতেছে।
আমি। উইনসুকে কোথায় রাখিয়া আসিয়াছে, তাহা কিছু বলিয়াছিল?
বাড়ী। না।
আমি। এমির সহিত উইনসু একত্রে বসবাস করিয়া থাকে; সুতরাং, সে না হয় তাহার সহিত আমোদ আহ্লাদ করিতে গমন করিয়াছিল, কিন্তু অপরাপর স্ত্রীলোকগণ তাহার সহিত এমন করিল কেন?
বাড়ী। ওরূপ ভাবে আমরা প্রায়ই গমন করিয়া থাকি; ওরূপ ভাবে গমন করিতে আমাদিগের কোন প্রতিবন্ধক নাই।
আমি। তোমাদিগকেও ধন্যবাদ ও তোমাদিগের আচার ব্যবহারকেও ধন্যবাদ। তোমরা সাহেব বলিয়া পরিচয় দিয়া থাক; সুতরাং, তোমরা যাহা কর, তাহাতেই তোমাদিগের শোভা পায়।
সম্পূর্ণ
[ পৌষ, ১৩০৭ ]