ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ) (দারোগার দপ্তর ৭৫ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ
পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All
Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। আষাঢ়।
Printed
By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68,
Nimtola Street, Calcutta.
ঘর-পোড়া লোক।
(মধ্যম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
হোসেনের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনি কি অবস্থা শুনিয়াছেন বলুন দেখি, আমিও শ্রবণ করি।
বোগা সাহেবের কথার উত্তরে হোসেন কহিল, ওসমানের চরিত্র আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন, এবং তাহার চরিত্র সম্বন্ধে আপনি যাহা কহিলেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। যে মৃতদেহ গোফুর খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, সেই কন্যাটা বেশ রূপবতী ছিল। তাহার রূপের কথা জমে ওসমানের কর্ণগোচর হইল। যুবতী রূপবতী স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া তিনি আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, তাহার নিকট ক্রমে লোকের উপর লোক পাঠাইয়া, তাহাকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ওসমানের প্রস্তাবে সে কোনরূপেই প্রথমে স্বীকৃত হয় নাই; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর অর্থের লোভে ক্রমে সে আপন ধৰ্ম্ম বিক্রীত করিতে সম্মত হইল। যে সময় হেদায়েৎ কাৰ্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়া
ছিলেন, সেই সময় একরাত্রিতে ওসমান একখানি পাকী পাঠাইয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে আনয়ন করেন। প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার বৈঠকখানায় মাখিয়া, অতি অলমাত্র রাত্রি অবশিষ্ট থাকিতে, সেই পাল্কী করিয়া তাহাকে পুনরায় আপন বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন। পরদিবস রাত্রিতে পুনরায় পাল্কী করিয়া
তাহাকে আপন বৈঠকখানায় আনয়ন করেন। সেই সময় গোফুর খাঁ বাড়ীতে ছিলেন না, কানপুরে ছিলেন। যে সময় ওসমান সেই স্ত্রীলোকটাকে লইয়া আপন বৈঠকখানায় আমোদ প্রমোদে উন্মত্ত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গোফুর খাঁ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। পাছে পিতা তাঁহার এই সকল বিষয় জানিতে পারেন, এই ভয়ে ওসমান তাঁহার বৈঠকখানার সম্মুখে একটা কুঠারীর ভিতর উহাকে লুকায়িত ভাবে রাখিয়া দিয়া সেই গৃহের তালাবদ্ধ করিয়া দেন। তৎপরে তাহার একজন অনুচরকে কহেন যে, তাঁহার পিতা যেমন এদিক ওদিক করিবেন, বা বাড়ীর ভিতর গিয়া শয়ন করিবেন, সেই সময় সেই স্ত্রী লোকটীকে সেই গৃহ হইতে বাহিরে আনিয়া, পাক্কী করিয়া তাহার বাড়ীতে যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এবং পাঠাইবার সময় সেই স্ত্রীলোকটাকে যেন বলিয়াও দেওয়া হয় যে, বৃদ্ধ কানপুরে গমন করিলে পুনরায় তাহাকে আনয়ন করা বাইবে।
অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হন, এবং কহেন যে, একটু অবকাশ পাইলেই তিনি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু কাৰ্যে তাহা করিয়া উঠিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে ওসমান তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন।
তিনি যে তাহাকে পাঠাইতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এ কথা না। ধলিয়া, কহিলেন যে, গত রাত্রিতেই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অনুচর যে তাহার কোনরূপ অভিসন্ধি বশতঃ এইরূপ মিথ্যা কথা কহিলেন, তাহা নহে; মনে করিলেন, উহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয় নাই, এই কথা জানিতে পারিলে, পাছে ওসমান তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, যেরূপ উপায়ে হউক, এখনই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। সেই সময় ওসমান অপর একটী কাৰ্য্যোপলক্ষে তাহাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। তিনিও সেই কাৰ্যোপলক্ষে এ দিকের কাৰ্য একবারে ভুলিয়া যান। অথচ ওসমানের বিশ্বাস যে, সেই স্ত্রীলোকটী তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছে; সুতরাং সেই স্ত্রীলোকটী গৃহের ভিতর যে বদ্ধ আছে, এ কথা আর কাহারও মনে হয় নাই, বা সেই ঘর খুলিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এইরূপে অনাহারে এবং তৃষ্ণায় উহার মৃত্যু ঘটে। পরিশেষে আপনি বাড়ীর সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে, যখন সেই ঘরের দরজা খোলেন, তখন সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। এই ব্যাপার দেখিয়া তখন ওমানের সমস্ত কথা স্মরণ হয়, এবং বুঝিতে পারেন যে, তাহার অনুচরের মিথ্যা কথার নিমিত্ত তাহার কি সর্বনাশ ঘটিল! গোফুর খাঁ ইহার ভাল মন্দ কিছুই জানেন না; সুতরাং এই অবস্থা দেখিয়া তিনি একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়েন। আমি যতদুর শুনিয়াছি, ইহাই প্রকৃত ঘটনা। আমি অকপটে আপনার নিকট যাহা বলিলাম, তাহা কিন্তু এখন অন্যরূপ ঘটনা হইয়া পড়িয়াছে।
দারোগা। ইহাই যদি প্রকৃত ঘটনা হয়, তাহা হইলে এখন যেরূপ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা কি?
হোসেন। তাহা যে কি, তাহা আপনি আপন মনে বেশ অবগত আছেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
দারোগা। এই মোকদ্দমার যেরূপ প্রমাণ হইয়াছে, তাহা আপনি সমস্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?
হোসেন। তাহা সমস্তই জানিতে না পারিলে, আর আপনার নিকট আসিব কেন?
দারোগা। আপনি আমাকে যে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন, তাহার পরিবর্তে আমি এখন যে কোন উপকার করিতে পারি, তাহা বোধ হয় না।
হোসেন। মনে করিলে এখনও বিস্তর উপকার করিতে পারেন।
দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আর কি উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে, বলুন। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, সেই উপকার করিতে আমি কত দুর সমর্থ।
হোসেন। সময় মত বলিব। তখন আপনার যতদূর সাধ্য, সেইরূপ উপকার করিবেন; কিন্তু এখন যাহাতে অন্য কোন সাক্ষীর যোগাড় না হয়, তাহা করিলেই যথেষ্ট হইবে। আরও একটা বিষয়ের অনুরোধের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা ওসমানের জ্বালায় সবিশেষ জ্বালাতন হইয়া, এইরূপে আমাদিগের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছে। তাঁহারা যে কথা বলিয়াছে, পুনরায় যে তাহার অন্যথাচরণ করিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি অর্থ প্রলোভনে আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারি। আপনি তাহাতে প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবেন না, ইহা আমার একটা প্রধান অনুরোধ।
দারোগা। তাহা কিরূপে হইবে? সাক্ষিগণ একবার যেরূপ কথা বলিয়াছে, এখন যদি তাহার অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিপদে পড়িতে হইবে, তাহা কি তাঁহারা জানে না? বিশেষতঃ একথা যদি তাঁহারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা হইলে আমি কখনই বলিতে পারিব না যে, তোমরা পূর্বে যেরূপ বলিয়াছ, এখন অনায়াসেই তাহার বিপরীত বলিতে পার। আর সাক্ষীগণ যদি এখন অন্যরূপ বলে, তাহা হইলে তাহাদিগের ত বিপদ হইবেই; তদ্ব্যতীত আমাদিগের উপরও নানারূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবে, আর হয় ত আমাকেও বিপদাপন্ন হইতে হইবে।
হোসেন। যাহাতে আপনাকে বিপদাপন্ন হইতে হইবে, এরূপ কাৰ্যে আমি কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। আর যাহা কিছু করিতে হইবে, আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া, এবং সেই বিষয়ে আপনার মত লইয়া সেই কাৰ্য্য করিব। আপনার অমতে কোন কাৰ্য্য করিব না।
এই বলিয়া হোসেন, সেই দিবস দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
হোসেন চলিয়া গেলে, দয়োগা সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা গ্রহণ করিয়াছি। আরও যদি কিছু পাই, তাহাও লইব। অধিকন্তু হোসেনের সাহায্যে সেই স্ত্রীলোকটীকেও পুনরায় আনাইয়া লইব। কিন্তু আসল কাৰ্য কোনরূপেই ছাড়িব না; যাহাতে গোফুর এবং ওসমানকে ফঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারি, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিব।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
হেদায়েতের কন্যাকে হত্যার অপরাধে, গোফুর খাঁ এবং তাহার পুত্র ওসমান খাঁ মাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। দারোগা সাহেবও প্রাণপণে সেই মোকদ্দমার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পিতা পুত্র উভয়েই হাজতে রহিলেন। পুলিসের নিকট যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, যাহাতে তাঁহারা মাজিস্ট্রেটের নিকট অন্যরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহার নিমিত্ত হোসেন অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া, অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। বরং পুলিসের নিকট তাঁহারা যেরূপ বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেটের নিকট তাহা অপেক্ষা আরও অনেক অধিক কথা কহিল।
সমস্ত সাক্ষীর এজাহার হইয়া যাইবার পর, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দেখিলেন যে, আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাকরা অপরাধ উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং চুড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত তিনি এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করিলেন।
এই মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত যখন দায়রায় দিন স্থির হইল, সেই সময় বিচারক মফঃস্বল পরিভ্রমণ উপলক্ষে, জেলা হইতে সুদূর মফঃস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন। যখন যে গ্রামে বিচারক উপস্থিত হইতেছিলেন, সেই সময় সেই গ্রামেই আপন কাছারি করিয়া মোকদ্দমার বিচারও করিয়া আসিতেছিলেন।
যে দিবস গফুর খাঁ এবং তাঁহার পুত্র ওসমানের এই হত্যাপরাধ-বিচার আরম্ভ হইল, সে দিবস একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র পলিগ্রামের ভিতর জজসাহেবের তাম্বু পড়িয়াছিল। সুতরাং সেই স্থানেই এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট হইতে উকীল কৌন্সলি আনাইয়া এই মোকদ্দমায় দোষ-ক্ষালনের যতদূর উপায় হইতে পারে, হোসেন প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। সরকারী উকীল মোকর্দমার অবস্থা জজসাহেবকে উত্তমরূপে সর্বপ্রথম বুঝাইয়া দিবার পর হইতেই, জজসাহেবের মনে কেমন এক বিশ্বাস হইয়া গেল যে, আসামী পক্ষীয় উকীল কৌশলি অনেক চেষ্টা করিলেও, তাহার মন হইতে সেই বিশ্বাস অপনোদন করিতে পারিলেন না। তিন দিবস পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমার সাক্ষিগণের এজাহার গৃহীত হইল। তাহাদিগের উপর যথেষ্ট জেরা হইল। উভয় পক্ষীয় উকীল কৌন্সলিগণ স্বপক্ষে সাধ্যমত বক্তৃতাদি করিতে ক্রটি করিলেন না; কিন্তু কিছুতেই আসামীদ্বয়ের পক্ষে কোনরূপ উদ্ধারের উপায় লক্ষিত হইল না।
জজসাহেব এই মোকদ্দমার রায় প্রদান করিবার কালীন কহিলেন, আসামীগণ! তিন দিবস পর্যন্ত বিশেষ যত্ন ও মনো–যোগের সহিত, এই মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার আমি উত্তম রূপে শ্রবণ করিয়াছি, এবং তোমাদিগের পক্ষীয়, সুশিক্ষিত উকীল কৌন্সলিগন সবিশেষ যত্নের সহিত তোমাদিগের পক্ষসমর্থন করিয়া, তোমাদিগের স্বপক্ষে যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা অপেক্ষাও অনেক কথা বলিয়াছেন; কিন্তু উভয় পক্ষের সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং সাক্ষিগণের সাক্ষ্য দিবার কালীন, তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, তোমাদিগের বিপক্ষে তাঁহারা বিন্দুমাত্রও মিথ্যা কথা কহে নাই। অবশ্য, অনেক সাক্ষ্যের অনেক স্থান অপর সাক্ষিগণের সাক্ষ্যের সহিত এক মিল হয় নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহারা যে, একবারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, এ কথা আমি কখনই স্বীকার করিতে পারিব না। তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর তালা বন্ধ গৃহের মধ্যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ যে পাওয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় নাই। বিশেষতঃ তোমাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা সকলেই তোমাদিগের জমিদারীর প্রজা। প্রজাগণ তাহা দিগের জমিদারের বিপক্ষে কখনই মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতে সম্মত হয় না। আর নিতান্ত সত্যের অনুরোধে যদি কোন প্রজাকে তাহার জমিদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই প্রজা যতদূর সম্ভব, তাহার জমিদারকে বাঁচাইয়া যাইতে চেষ্টা করে, ইহাই এদেশীয় নিয়ম। তোমাদের প্রজাগণ তোমাদিগের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, আমার বিশ্বাস, তাঁহারা তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক কথা অবগত আছে। কোনরূপে যদি আপনাদের জমিদারের উপকার করিতে পারে, এই ভাবিয়া সকল কথা তাঁহারা বলে নাই। সেই সকল সাক্ষী ওসমানের অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া, তোমাদিগকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে মিথ্যা কথা কহিতেছে, এ কথা সময় সময় মোদিগের কৌন্সলি উখাপিত করিলেও, তাঁহারা সেই সকল কথা একবারে অস্বীকার করে। অথচ তোমরাও তাহার সত্যাসত্য প্রমাণ করতে সমর্থ হও নাই, বা তাহার চেষ্টাও কর নাই। এইরূপ নানা কারণে আমি সাক্ষিগণের সাক্ষ্য কোনরূপেই একবারে অবিশ্বাস করিতে পারি না।
সাক্ষিগণের দ্বারায় বেশ প্রমাণিত হইয়াছে যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে, তাহার অবর্ত মানে তাহার যুবতী কন্যাকে তোমরা বলপূৰ্ব্বক তাহার পরদার বাহিরে আনিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাকে যেরূপ অবমাননা করিয়াছ, সেরূপ কাৰ্য ভদ্রবংশীয় কোন লোকের দ্বারা কোনরূপেই সম্ভব না। কেবল মাত্র সামান্য খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে তোমরা সেই যুবতীর উপর কেবল যে এইরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছ, তাহা নহে। আমার অনুমান হয় যে, তোমাদিগের এরূপ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার অপর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এইরূপে যুবতীর উপর ভয়ানক অত্যাচার করিয়াই যে, তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ, তাহা নহে। সৰ্বসমক্ষে সেই অবলাকে বিনাদোয়ে ধৃত করিয়া, বিশেষরূপে অবমাননার সহিত কয়েক খানি গ্রামের মধ্য দিয়া তোমরা তোমাদিগের বাটী পৰ্যন্ত তাহাকে লইয়া গিয়াছ। এ কথা গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিত সকলেই একবাক্যে কহিতেছে। অবলা স্ত্রীলোকের উপর বিনা দোষে এরূপ অত্যাচার করা নিতান্ত পিশাচের কাৰ্য ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারা যায় না। এইরূপ অত্যাচার করিয়াই কি তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি লিয়াছ? তোমাদিগের নিজের অনুচর এবং ভৃত্যরর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই হতভাগিনীকে অনশনে রাখিয়া হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর একটা নির্জন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলে। অনশনে যে লোকের মৃত্যু ঘটে, তাহা কি তোমরা জান না? ক্ষুৎপিপাসা সন্থ করিতে কোন্ ব্যক্তি কয়দিবস সমর্থ হয়, তাহা কি তোমাদিগের মনে একবারের নিমিত্তও উদয় হয় নাই? কেবল তাহাই নহে, তোমাদিগের নিজের পরিচারক কি বলিতেছে, তাহা একবার শোন। এক দিবস কোন গতিতে আমি সেই গৃহের চাবি সংগ্রহ করিয়া ঘর খুলিয়া দেখিলাম যে, ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় যুবতী মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এই অবস্থা দেখিয়া আমার কঠিন হৃদয়েও দয়ার উদ্রেক হইল। ঘরবানের সহিত পরামর্শ করিয়া আমি কিছু আহারীয় এবং পানীয় আনিয়া উহাকে দিবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময়ে ওসমান সাহেব তাহা জানিতে পারিয়া, সেই সকল দ্রব্য আমার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন, ও আমাকে যৎপয়োনান্তি গালি দিয়া পুনরায় সেই গৃহের তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। আমি গিয়া গোফুর মিঞার নিকট এই কথা বলিলে, কোথায় তিনি তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিবেন, না তাঁহার পরিবর্তে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিয়া, তাঁহাদিগের বিনা, অনুমতিতে আমি সেই গৃহের দরজা খুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে চাকরী হইতে জবাব দিলেন, এবং তদখেই আমাকে তাঁহা, লিগের বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।
কি ভয়ানক! কি পৈশাচিক ব্যবহার! এই ব্যক্তি ও তাহার পোষকতাকারী ঘরবানের সাক্ষ্য যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই যুবতীকে অনশনে রাখিয়া, ইচ্ছা-পূৰ্ব্বক তাহাকে যে হত্যা করিয়াছ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাদিগের দ্বারা এরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে, তাঁহারা কোনরূপেই দয়ার পাত্র নহে। আমার বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট লোকের উপর দয়া প্রকাশ করিলে ঈশ্বর তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। গোফুর খাঁ! তোমার বৃদ্ধ বয়স দেখিয়া, এবং তোমার পূর্ব-চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমি পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, এরূপ মোকদ্দমায় যদি কেহ দয়ার পাত্র হয়, তাহা তুমি। কিন্তু এখন আমি দেখিতেছি, দস্যু তস্করকে দয়া করা যাইতে পারে, মনুষ্য হত্যাই যাহাদিগের জীবিকা, তাহাদিগকেও দয়া করা যাইতে পারে, তথাপি তোমার উপর সে দয়া প্রকাশ করিতে নাই। তোময়া ইচ্ছা করিয়া যেরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রকৃত দণ্ড আমাদিগের আইনে নাই। তোমাদিগের জাতীয় রাজার রাজত্বকালে যেরূপ কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ও ক্ষতস্থানে লবণ নিক্ষিপ্ত করিয়া মারিয়া ফেলিবার নিয়ম ছিল, আমার বিবেচনায় তোমরা সেইরূপ দণ্ডের উপযুক্ত। কিন্তু সেরূপ দণ্ড যখন আমাদিগের আইনে নাই, তখন আমাদিগের আইনের চরম দণ্ড আমি তোমাদিগের উপর বিধান করিলাম। যে পর্যন্ত তোমরা না মরিবে, সেই পৰ্য্যন্ত তোমাদিগের উভয়কেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটুকাইয়া রাখা হইবে।
জজসাহেবের মুখে বিষম দণ্ডের কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ আর দাড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মূর্হিত অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয় গেলেন। প্রহরীগণ তাঁহার মুখে জল সিঞ্চন করাতে তাঁহার সংজ্ঞা হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেল। ওসমান স্থিরভাবে এই দণ্ডাজ্ঞা সহ করিলেন, কোন কথা কহিলেন না; কেবল দারোগা সাহেবের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন মাত্র।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
এই ভয়ানক দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া হোসেনের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। অপূর্ণ-লোচনে তিনি আদালতের বাহিরে আসিলেন। যে সময় এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেল, তখন অপরাহ চারিটা। জজসাহেবের সঙ্গে একজন কোর্ট-ইনস্পেক্টার ছিলেন; যে আসামীদ্বয়ের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগকে লইয়া তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। কিরূপে সেই আসামীদ্বয়কে তিনি জেলায় পাঠাইয়া দিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই স্থান হইতে পদব্রজে আসামীগণকে পাঠাইয়া দিলে, তিন চারিদিবসের কম তাঁহারা সরে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে না। বিশেষতঃ গোফুর খাঁর আর চলিবার ক্ষমতা নাই; তাহার উপর পয়ে বিপদের সম্ভাবনাও আছে।
কোর্ট-ইন্স্পক্টার সাহেব এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া হোসেনকে তাকাইয়া পাঠাইলেন ও কহিলেন, আপনার মনিবদ্বয়ের অদৃষ্ট্রে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু যে পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন শেষ না হয়, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। এখন, ইহাদিগকে অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইবে; কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, হটিবার শক্তি ওসমানের থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু গোফুর খাঁর সে শক্তি নাই। আর উঁহাদিগকে কোন যানে আরোহণ করাইয়া লইয়া যাইবার খরচার ব্যবস্থাও সরকার হইতে নাই। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি কিছু অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইলে যাহাতে উঁহারা কষ্ট না পান, কোনরূপে আমি সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উহা দিগকে এই স্থান হইতে পাঠাইতে পারি।
হোসেন। আমাকে কিরূপ অর্থ সাহায্য করিতে হইবে?
ইনস্পেক্টার। অধিক অর্থের সাহায্য করিতে হইবে না। ইহারা দুইজন, এবং ইহাদিগের সহিত যে কয়জন প্রহরী গমন করিবে, তাহাদিগকে সদর পর্যন্ত লইয়া যাইতে হইলে গাড়ি প্রভৃতির যাহা কিছু খরচ পড়িবে, তাহাই কেবল তোমাকে দিতে হইবে।
হোসেন। তাহা আমি দিতে সম্মত আছি, যদি আমাকেও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে দেন।
ইনস্পেক্টার। আপনিও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে পারেন। কিন্তু একত্র নহে। উঁহারা যে গাড়িতে গমন করি বেন, আপনি সেই গাড়িতে গমন করিতে পারিবেন না। অপর গাড়ি লইয়া উঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলে, কেহ আপত্তি করিবে না। কিন্তু কেন আপনি উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে চাহেন?
হোসেন। আমি যে কয়দিবস উঁহাদিগের সহিত থাকিতে পারিব, সেই কয়দিবস যাহাতে উঁহাদিগের কোনরূপ আহারাদিন কষ্ট না হয়, তাহা আমি দেখিতে পারিব তথ্যতীত যখন উভয়েই ফঁসি খাইতেছেন, তখন ইহাদিগের এই অগাধ জমিদারীর কিরূপ বন্দোবস্ত করিব, বা তাঁহারা ইহা কাহাকে প্রদান করিয়া যাইবেন, এবং পরিবারবর্গেরই বা কিরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে, প্রভৃতি আবশ্যক বিষয় সকল সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব, তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া বা লিখাইয়া লইব।
ইনস্পেক্টার। আপনি উঁহাদিগের সহিত এখন গমন করিতে পারেন, আর তাহাদিগের আহারাদি সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিতেও কিছুমাত্র নিষেধ নাই। কিন্তু বিষয়-আদি-সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিবার সময় এখন নহে। জেলায় গমন করিবার পর জেলের মধ্যে উঁহারা যে কয়দিবস পাকিবেন, তাহার মধ্যে জেল কর্ম্মচারীর সম্মুখে সে সমস্ত বন্দোবস্ত আপনারা করিয়া লইতে পারিবেন।
হোসেন। জেলায় গমন করিতে উঁহাদিগের কয়দিবস লাগিবে?
ইনস্পেক্টার। তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। ইহাদিগের সহিত যে সকল প্রহরী গমন করিবে, তাঁহারা যে কয়দিবসে সুবিধা বিবেচনা করিবে, সেই কয়দিবসে তাঁহারা উঁহাদিগকে লইয়া যাইবে।
হোসেন। মহাশয়! আর একটা কথা। রাত্রিকালে উহার যে যে স্থানে অবস্থিতি করিবে, সেই সেই স্থানে রাত্রিযাপন উপযোগী কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে কি?
ইনস্পেক্টার। না, রাত্রিযাপন সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়াজন নাই। কারণ, থানা ভিন্ন অপর কোন স্থানে উঁহারা রাত্রিযাপন করিবেন না। সমস্ত দিবস গমন করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে যে থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবেন, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিবেন, ও পরদিন প্রত্যুষে সেই থানা হইতে প্রস্থান করিবেন। এইরূপে গমন করিয়া যে কয়দিবসে সম্ভব, সদরে গিয়া উপস্থিত হইবেন।
কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, তাহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভার হোসেন গ্রহণ করিলেন। সেই দিবস অপরাহ হইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, ইনস্পেক্টার সবিশেষরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া আসামীদ্বয়কে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন। আর ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস অতি প্রত্যুষে আসামী দ্বয়কে সেই স্থান হইতে পাঠাইয়া দিবেন। আসামীদ্বয় এবং প্রহরীগণকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কয়েকখানি, একার প্রয়োজন হইল, তাহাও সেই রাত্রিতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখা হইল। হোসেন এবং তাহার দুইজনমাত্র ভৃত্যও সেই সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। তাঁহারাও নিজের গমনোপোযোগী একা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যুষে প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া একারােহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। হোসেনও তাঁহার অনুচরদ্বয়ের সহিত অপর এক্কায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। প্রহরী গণের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্ব প্রধান ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্বে কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব তাহাকে হোসেনের সহিত পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন ও বলিয়া দিয়াছিলেন, হোসেন তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবে। যে স্থানে যে কোন খরচের প্রয়োজন হইবে, তাহা হোসেনই দিবেন। আসামীদ্বয়কে আহারাদি করাইবার নিমিত্ত যে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হইবে, হোসেন তৎক্ষণাৎ সেই সকল সাহায্য করিবেন। একা প্রভৃতির যখন যেরূপ ভাড়া লাগিবে, হোসেনকে বলিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা প্রদান করিবেন।
কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশ পাইয়া, প্রহরী আর কোন কথা কহিল না। কারণ, সে উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, যদি হোসেন বা অপর কোন ব্যক্তি এক্কা প্রভৃতির ভাড়া প্রদান না করে, তাহা হইলে যে কয়দিবসে হউক, তত পথ তাহা দিগকে পদব্রজে গমন করিতে হইবে।
প্রহরী-সর্দারের মনে মনে একটু দুরভিসন্ধি ছিল। কোর্ট ইনস্পেক্টারের সম্মুখে কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিল না। তখন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আসামীদ্বয় ও হোসেনের সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইল।
কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, পথের এক স্থানে একটা জলাশয় দৃষ্টিগোচর হইল। প্রহরী-সর্দ্দার সেই স্থানে একা থামাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হইল। একা হইতে অবতরণ করিয়া সকলে সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করি লেন, এবং প্রহরীগণ একে একে আপনাপন হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া লইলেন। তাঁহাদিগের সকলের হস্তমুখাদি প্ৰক্ষালিত হইলে, প্রহরী-সর্দ্দার হোসেনকে কহিলেন, মহাশয়! আসামী স্বয়কে লইয়া সদরে উপস্থিত হইতে এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যে সকল খরচ পড়িরে, তাহা আমাদিগকে মিটাইয়া দিন।
হোসেন। একা-ভাড়া প্রভৃতির জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। যখন আমি আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, তখন সমস্তই আমি প্রদান করিব।
সর্দ্দার-প্রহরী। আপনি যে উহা প্রদান করিবেন, তাহা কোর্ট ইনস্পেক্টার সাহেব বলিয়াই দিয়াছেন; কিন্তু বারে বারে আপনার নিকট চাহিয়া লওয়া অপেক্ষা একবারেই উহা আমাদিগকে প্রদান করা উচিত নহে কি?
হোসেন। যখন আমাকে দিতে হইবে, তখন আপনি একবারেই লউন, বা বারে বারেই লউন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই।
সঃ প্রহরী। তাহা হইলে উহা আমাকে অগ্ৰেই প্রদান করুন।
হোসেন। কত খরচ পড়িবে, তাহা আমি এখন পর্যন্ত জানিতে পারিতেছি না; সুতরাং অগ্রে আমি আপনাকে উহা কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি? আপনাদিগের সহিত যে সকল একা আছে, উঁহারা কি একবারে সদর পর্যন্ত গমন করিতে পারিবে?
সঃ প্রহরী। উঁহারা এতদূর কিরূপে গমন করিবে? এক এক থানায় গমন করিবার পর উঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিব ও সেই স্থান হইতে অন্য এক্কা গ্রহণ করিব।
হোসেন। তাহা হইলে আপনাদিগকে কত টাকা গাড়িভাড়া দিতে হইবে, তাহা আমি এখন কিরূপে জানিতে পারিব? যেমন যে একা ছাড়িয়া দিবেন, অমনি তাহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে চলিবে না?
সঃ প্রহরী। তাহা কিরূপে হইবে? সে সময় যদি আপনি উপস্থিত না থাকেন, তাহা হইলে কিরূপে ভাড়া প্রদান করিবেন?
হোসেন। আমি ত আপনাদিগের সহিত উপস্থিত আছি। যখন যাহা বলিবেন, তখনই তাহা প্রদান করিব।
সর্দ্দার-প্রহরী। এখন ত উপস্থিত আছেন দেখিতেছি; কিন্তু রাস্তা হইতে যদি আপনি চলিয়া যান, তাহা হইলে তখন আমি কি করিব? ও সকল গোলযোগেরই এখন প্রয়োজন নাই। আমার নিকট কিছু অর্থ আপনি প্রদান করুন, তাহা হইতে আমি ভাড়া প্রদান করিব। খরচ-পত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা পরিশেষে আমি আপনাকে ফিরাইয়া দিব।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়, তাহাই হউক। যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই কুড়িটী টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন।
সঃ প্রহরী। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে বসি নাই! এখন যদি আপনি পঞ্চাশ টাকা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিব; নতুবা আমি আসামীদ্বয়কে হাঁটাইয়া লইয়া যাইব।
হোসেন। হাঁটাইয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি পঞ্চাশ টাকাই আপনাকে প্রদান করিতেছি, তাহা হইতে আপাততঃ যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হয়, আপনি করুন। পরে যদি আরও কিছু আবশ্যক হয়, তাহাও আমি প্রদান করিব।
এই বলিয়া হোসেন পঞ্চাশটী টাকা বাহির করিয়া সেই সর্দ্দার প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন, ও অপর প্রহরীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, চল ভাই! আর দেরী করিবার প্রয়োজন নাই।
সর্দ্দার-প্রহরীর এই কথা শুনিয়া হোসেন কহিলেন, মহাশয়। আপনারা হস্ত মুখ প্রক্ষালনাদি সকল কার্য শেষ করিয়া লইলেন; কিন্তু ইহারা হস্ত মুখাদি ধুইবে কি না, তাহা ত কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন।
সর্দ্দার-প্রহরী। সে কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। কোন বিষয়ের আবশ্যক হইলে ইহারা আপনারাই আমাদিগকে বলিবেন। তখন বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে যে, উঁহাদিগের প্রার্থনা শ্রবণ-যোগ্য কি না।
হোসেন। আপনারা যদি কোন কথা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা না করেন, তাহা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।
সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার তোমার কোন অধিকার নাই। হত্যাপরাধে যাহাদিগের প্রাদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া, তুমি আমাদিগের চাকরী লইতে চাও?
হোসেন। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিলে, আপনাদিগের চাকরী যাইবে কি প্রকারে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।
সঃ প্রহরী। চাকরী যাউক, আর না যাউক, উঁহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে তোমাকে কথা কহিতে দিব না।
হোসেন। আপনার অনভিমতেই আমি কথা কহিব কেন? কিন্তু আমি ইহাদিগকে যদি কোন কথাই বলি, তাহা মন্দ কথা নহে। তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।
সঃ প্রহরী। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হউক, বা না হউক, তাহা দেখিবার তোমার কিছুমাত্র আবক নাই। মূল কথা, তুমি উঁহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতে পারিবে না।
হোসেন। যদি আমি ইহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতেই না পারিব, তাহা হইলে আপনাদিগের সহিত আমার আসিবার কি প্রয়োজন ছিল?
সর্দ্দার-প্রহরী। প্রয়োজন ত আমি কিছুই দেখি না। না আসিলেই পারিতে।
হোসেন। আমি না আসিলে, আপনাদিগকে কে গাড়ির ভাড়া প্রদান করিত?
সঃ প্রহরী। গাড়ি ভাড়া কিছু আমাদিগের উপকারের নিমিত্ত দেও নাই। তোমারই মনিবদ্বয় হাঁটিয়া যাইতে অপারক, তাই তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ির ভাড়া প্রদান করিয়াছ। গাড়ি ভাড়া প্রদান না করিলে, আমরা অনায়াসেই উঁহাদিগকে আঁটাইয়া লইয়া যাইতে পারিতাম।
হোসেন। বলি, জমাদার সাহেব! ও সকল কথা থাক, এখন আপনাদিগের মনের কথা কি বলুন দেখি। আপনারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাতেই প্রস্তুত আছি।
সঃ প্রহরী। খুনী আসামীর সহিত কথা কহিতে দেওয়া যে কতদুর ঝুঁকির কাৰ্য, তাহা ত আপনারা জানেন না। যদি আমাদের কোনরূপ সাধ্য না থাকে, তাহা হইলে আমরা সেই ঝুকি কেন গ্রহণ করিব? আপনি বুদ্ধিমান, আপনাকে অধিক আর কি বলিব?
হোসেন। আমাকে আর বলিতে হইবে না, এ কথা আমাকে পূর্বে বলিলেই পারিতেন। আপনারা কিছু প্রার্থনা করেন, বুঝিয়াছি। বলুন, এখন আমাকে কি দিতে হইবে।
সঃ প্রহরী। আপনি বড় মানুষ, আপনাকে আমরা আর কি বলিব? আপনি আপনার বিবেচনামত কাৰ্য্য করিলেই চলিবে।
হোসেন। এখন আর আমার বুদ্ধি-মুদ্ধি কিছুই নাই, ভাল মন্দ বুঝিবার ক্ষমতা এখন দুর হইয়া গিয়াছে। এই সামান্য কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমাকে কয়টা টাকা দিতে হইবে, তাহা স্পষ্ট করিয়া আমাকে বলুন। আমার সাধ্য হয়, আমি প্রদান করি। আর আমার ক্ষমতার অতীত হয়, তাহা হইলে এই স্থান হইতেই আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।
সর্দ্দারপ্রহরী। আপনাকে কিছু অধিক প্রদান করিতে হইবে। আমরা পাঁচজন বই আর নয়। আমাকে কুড়ি টাকা ও অপর চারিজনকে দশ টাকা করিয়া চল্লিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা, কেবল ষাট টাকা বৈত নয়!
হোসেন। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা; কিন্তু আমার পক্ষে ইহা খুব অধিক হইতেছে। আমি অত টাকা দিতে পারি না। আমি আপনাদিগের সম্মান রক্ষার নিমিত্ত ত্রিশ টাকা প্রদান করিতেছি।
সঃ প্রহরী। এ কাৰ্য ত্রিশ টাকায় হইতে পারে না। আপনার ইচ্ছা হয়, ষাট টাকা দিন, ইচ্ছা না হয়, এক টাকা দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি অধিক করিয়া বলি নাই, আমি যেরূপ:এক কথার লোক, সেইরূপ এক কথাই বলিয়াছি।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! আমি ষাট টাকাই প্রদান করিতেছি। ইহার পর আমাকে ত আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না?
সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আপ নাকে আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না। কিন্তু আমাদিগের কাহারও সম্মুখে ব্যতীত নির্জনে আপনি উঁহাদিগের সহিত কোন রূপ কথা বলিতে পারিবেন না।
এইরূপ কথাবার্তার পর হোসেন ষাট টাকা প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার আদেশ পাইলেন। কিন্তু সেই সময় সবিশেষ কোনরূপ কথা কহিবার অবকাশ পাইলেন না। তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ এক্কার উপর আরোহণ করিতে হইল। হোসেনও আপন একায় গিয়া আরোহণ করিলেন। এক্কায় আরোহণ করিবার সময় হোসেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে কহিলেন, জজসাহেব আপনাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছেন বলিয়া যে, আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইবেই, তাহা আপনারা মনে করিবেন না। আপনার উপার্জিত বিষয়ের এক পয়সামাত্র অবশিষ্ট থাকিতে, কোনরূপেই আমি আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইতে দিব না। টাকাব যথেষ্ট সংগ্রহ করিয়া আমি সঙ্গেই রাখিয়াছি। হাইকোর্ট হইতে যেরূপ উপায়ে হউক, এই হুকুম রদ করাইবু। ঈশ্বর যদি একান্তই বিমুখ হন, হাইকোর্ট হইতে যদি কিছু করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিয়া হউক, বড় লাটকে ধরিয়া হউক, বিলাত পর্যন্ত গড়িয়া হউক, কোন না কোনরূপে আপনাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করাইব।
হোসেনের কথা শুনিয়া গোফুর ও ওসমান কেবল এইমাত্র কহিলেন, দেখুন, ভরসার মধ্যে ঈশ্বর?
ইহার পরেই এক্কা সকল সেই স্থান হইতে চলিল। একা, চালক অশ্বগণকে সবলে কষাঘাত করিতে লাগিল। প্রহারের ভয়ে অশ্বগণ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার পথ একঘণ্টায় চলিতে লাগিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, এক্কা সকল একটী সরাইয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ সেই স্থানে অবতরণ করিয়া সেই সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই স্থানে কোন দ্রব্যেরই অভাব ছিল না। সরাইয়ের মধ্যেই শীতল জল-পূর্ণ একটা প্রকাণ্ড ইদারা। সরাইয়ের মধ্যস্থিত একখানি ঘরের মধ্যেই বেনিয়ার দোকান; উহাতে আটা, চাউল, ধৃত ও তরকারি প্রভৃতি আবশ্যক আহারীয় দ্রব্য এবং হড়ী, কাষ্ট, কঁচা সালপাতা প্রভৃতি সমস্তই পাওয়া যায়। প্রহরীগণ সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিয়াই তাহার মধ্যে যে সকল সারি সারি ঘর ছিল, তাহার একখানির মধ্যে আসামীদ্বয়কে রাখিয়া দিল। সেই ঘরের কেবলমাত্র একটী দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা আর কিছুই ছিল না; সুতরাং সেই ঘরকে একরূপ হাজত-গৃহ বলিলেও চলে। সেই ঘরের সম্মুখে দৌড় বারান্দার উপর সারি সারি পাচ খানি চারিপায়া আসিয়া পড়িল। প্রহরীগণ সেই স্থানে আপনাপন পোষাক পরিচ্ছদাদি রাখিয়া, সেই চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল; কেহ বা লম্বা হইয়া শয়ন করিল। প্রহরীগণকে শয়ন করিতে দেখিয়া, দুই জন নাপিত (নাউ) আসিয়া তাহাদিগের পদসেবায় প্রবৃত্ত হইল, এবং দুইজন বারকনিতা আসিয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইল। উঁহারা এইরূপ সমাগত পথিকগণের সেবা-সুশ্রুষা করিয়া আপনাপন উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। নাপিতগণের থাকিবার স্থান সেই সরাইয়ের ভিতর না থাকিলেও, দিনরাত্রি তাঁহারা সকলেই প্রায় সেই স্থানে অবস্থিতি করে; কিন্তু বার-বনিতাগণ সেই সরাইয়ের ভিতরেই একটা একটা ঘর লইয়া, তাহাতেই অবস্থিতি করিয়া থাকে।
আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ যেস্থানে অবস্থান করিল, তাহার পার্শ্ববর্তী অপর আর একটা কামরাতে হোসেন এবং তাহার ভৃত্যদ্বয় স্থান করিয়া লইলেন।
হোসেন একজন প্রহরীকে কহিলেন, আসামীদ্বয়কে যদি দুইখানি চারিপায়া আনাইয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?
প্রহরী। আসামী! তাহাতে খুনী মোকদ্দমার আসামী। তাঁহারা চারিপায়ার উপর উপবেশন বা শয়ন করিবে! একথা ইতিপূর্বে আমরা আর কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই, দর্শন করা ত দূরের কথা!
হোসেন। আসামীদ্বয়কে চারিপায়ার উপর বসিতে দিবার নিয়ম নাই বলিতেছেন; কিন্তু যদি চারিপায়া দেওয়া যায়, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি আছে কি?
প্রহরী। ক্ষতি থাক বা না থাক, যদি ইহাদিগকে চারি পায়া দেওয়া যায়, তাহার ভাড়া কে দিবে?
হোসেন। চারিপায়ার ভাড়া যাহা লাগিবে, তাহা আমি দিব।
প্রহরী। আর আমাদিগকে?
হোসেন। ইহার নিমিত্ত আপনাদিগকে কিছু দিতে হইবে কি?
প্রহরী। না দিলে চারিপায়া দিতে দিব কেন?
হোসেন। আচ্ছা তাহাই হইবে। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত আমি আপনাদিগকে একটা টাকা প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। এক টাকায় হইবে না, যদি আমাদিগের প্রত্যেক কেই একটী করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে চারি পায়ার উপর বসিতে অনুমতি দিতে পারি।
হোসেন। আচ্ছা, তাহাই দিতেছি।
গোফুর। হোসেন! তুমি এরূপ ভাবে অনর্থক অর্থ ব্যয় করিতেছ কেন?
হোসেন। এ ব্যয় অনর্থক নহে। বলুন দেখি, ইতিপূর্বে আর কখনও আপনার মৃত্তিকায় বসিয়াছেন কি?
গোফুর। এখন আর আমি সেই জমিদার গোফুর খাঁ নহি যে, চারিপায় ভিন্ন বসিতে পারি না।
হোসেন। আপনি এখনও সেই গোফুর খাঁ আছেন, ইহা বেশ জানিবেন।
গোফুর। তাহা হইলে আমাদিগকে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় আর ফাঁসি যাইতে হইত না।
হোসেন। আপনি ভাবিবেন না। উপরে কি ভগবান নাই? আপনাদিগকে কখনই ফাঁসি যাইতে হইবে না। আপনার মনকে স্থির করুন, দেখুন, আপনাদিগকে বাঁচাইয়া লইয়া যাইতে পারি কি না। দুই তিন দিবস আপনাদিগের স্নান হয় নাই, আজ স্নান করিবেন কি?
গোঁফুর। আর স্নান করিয়াই বা কি হইবে?
হোসেন। স্নান করিয়া অনেক ফল হইবে। স্নান করিলে শরীরের অনেক গ্লানি দূর হইবে, মস্তিষ্ক শীতল হইবে, তখন একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে সমর্থ হইবেন। এক মনে ঈশ্বরকে ডাকিতে পারিলে কোন বিপদ হয় কি?
গোফুর। প্রহরীরা আমাদিগকে স্নান করিতে দিবে কি?
হোসেন। সে ভার আমার উপর। মেরূপে হয়, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছি। কেমন গো প্রহরীসাহেব। আপনা দিগের আসামীদ্বয় যদি স্নান করেন, তাহাতে আপনাদিগের, বোধ হয়, কোনরূপ আপত্তি নাই।
প্রহরী। আসামীদ্বয় স্নান করিবে! তাহা কি কখনও হইতে পারে?
হোসেন। কেন হইতে পারিবে না? এখানে আর কে তাহা দেখিতে পাইবে বা কেই বা তাহা শুনিতে পাইবে? ইহার জন্য আপনাদিগের প্রত্যেককে আট আনা এবং স্নানের পরে কিছু জল খাইরার নিমিত্ত, আট আনা করিয়া আমি প্রদান করিতেছি। ইহাতে, এখন বোধ হয়, আপনাদিগের আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।
প্রহরী। কোথায় স্নান করিবে? ইদারার নিকট ইহাদিগকে লইয়া যাইতে দিব না। কারণ, কি জানি যদি ইহার ইদারার ভিতর আত্ম-বিসর্জন করে, তাহা হইলে আমাদিগকে কয়েদ হইতে হইবে।
হোসেন। না, ইহাদিগকে ইদারার নিকট লইয়া যাইব না। যে স্থানে বলিবেন, সেই স্থানে বসিয়াই উঁহারা গান করিবেন।
প্রহরী। জল কোথায় পাইকেন, বা কে আনিয়া দিবে?
হোসেন। আমার সহিত দুইজন পরিচালক রহিয়াছে, এবং আমি নিজে আছি। তদ্ব্যতীত দুই চারি পয়সা দিলেই জল আনিয়া দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় যেস্থানে বলিবেন, সেই স্থানে জল আনাইয়া দিয়া, উঁহাদিগকে স্নান করাইয়া দিব।
প্রহরী। আর আমাদিগকে যাহা দিতে চাহিলেন, তাহা কখন দিবেন?
তাহা আমি এখনই দিতেছি, হোসেন এই বলিয়া চারিপায়া পাইবার, স্নান করিবার এবং কিছু জল খাবার খাইতে পাইবার অনুমতির নিমিত্ত প্রহরীর হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর উক্ত কয়েকটা বিষয়ের নিমিত্ত প্রহরীগণ আর কোনরূপ আপত্তি করিল না। ভৃত্যগণ ইদারা হইতে জল উঠাইয়া আনিয়া প্রহরীগণের সম্মুখে তাহাদিগকে স্নান করাইয়া দিল। স্নান করিবার পর হোসেন কিছু জল খাবার আনাইলেন; কিন্তু প্রহরীগণ সে জল খাবার উঁহাদিগকে খাইতে না দিয়া কহিল, ইহার ভিতর আপনারা কোনরূপ বিষ প্রদান করিয়াছেন কি না, আমরা তাহা জানি না। সুতরাং আপনাদিগের আনীত জল খাবার ইহাদিগকে কখনই আহার করিতে দিব না। যাহা আনিতে হইবে, তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিন এবং তাহার মূল্য আমাদিগকে প্রদান করুন। আমরা নিজে তাহা খরিদ করিয়া আনিয়া, আসামীদ্বয়কে প্রদান করিব।
প্রহরীগণের প্রস্তাবে হোসেন সম্মত হইলেন, এবং জল খাবার আনিবার নিমিত্ত, উঁহাদিগের একজনের হস্তে একটী টাকা প্রদান করিলেন। তাহাতে যে কিছু আহারীয় দ্রব্য আনিয়া আসামীদ্বয়কে প্রদান করা হইল, আসামীদ্বয় তাহা হইতে অতি অল্পই আহার করিলেন। অবশিষ্ট আহারীয় ও পূর্ব-আনীত আহারয় সমুদায়ই প্রহরীদিগের হইল। সেই সকল দ্রব্য আহার করিবার সময়, বিষের কথা আর প্রহরীদিগের মনে উদিত হইল না।
আমি পূর্বেই বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইতেছিল, তাঁহারা সকলেই মুসলমান।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
প্রহরীগণ যেরূপ ভাবে সেই সরাইতে বিশ্রাম করিতে লাগিল, তাহাতে তাঁহারা যে শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, এরূপ অনুমান হইল না। একা-চালকগণ তাহাদিগের একার ঘোড়া একা হইতে খুলিয়া দিয়া ঘাস-দানার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া হোসেন সেই সর্দ্দার-প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কি আপনারা এই স্থানে অবস্থান করিবেন?
প্রহরী। রাত্রিযাপন আমরা এই স্থানে করিব না। এই স্থান হইতে দুই ক্রোশ ব্যবধানে একটা খানা আছে, রাত্রিকালে সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে হইবে।
হোসেন। এক-চালকগণ যেরূপ ভাবে একা চালাইয়া আসি তেছে, তাহাতে দুই ক্রোশ পথ গমন করিতে অতি অল্প সময়েরই প্রয়োজন হইবে।
প্রহরী। এই স্থান হইতে বাহির হইলে, একঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেই থানায় গিয়া অনায়াসেই উপস্থিত হইতে পারি।
হোসেন। আপনারা এই স্থান হইতে কখন রওনা হইতে চাহেন?
প্রহরী। একটু বিশ্রাম করিবার পরই, আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
হোসেন। আপনাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত কোথায় হইবে?
প্রহরী। থানায় গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই স্থানেই আহারাদি করিব, এরূপ বিবেচনা করিতেছি।
হোসেন। এই স্থানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। এই স্থান হইতে আহারাদি করিয়া, থানায় গমন করিলে হইত না কি?
প্রহরী। তাহা হইলে আমরা কখন থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারি?
হোসেন। আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া যদি আমরা এই স্থান হইতে রওনা হই, তাহা হইলে সন্ধ্যার পূৰ্বেই দুই ক্রোশ পথ অনায়াসেই অতিক্রম করিতে পারি। সন্ধ্যার পূর্বেই যদি আপনারা আসামীর সহিত থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
প্রহরী। ক্ষতি কিছুই নাই; কিন্তু এখানে থাকিয়া আমা দিগের লাভ কি?
হোসেন। লাভ আর কিছুই নহে, কেবল সময় মত আহার করিয়া লইতে পারিবেন।
প্রহরী। এখানে আহারাদি করিবার কি সুবিধা হইবে?
হোসেন। না হইবে কেন? এখানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়।
প্রহরী। এখানে আহারাদি প্রস্তুত করার পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা হইবে।
হোসেন। কিসে?
প্রহরী। মোটে আমরা পাঁচজন বই প্রহরী নই। আমরা সকলেই এখন পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। ইহার মধ্যে আসামী দ্বয়কে পাহারাই বা কে দিবে, আহারাদির আয়োজনই বা কে করিবে?
হোসেন। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরাই সমস্ত আয়োজন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।
প্রহরী। কে রন্ধন করিবে?
হোসেন। আমি আছি, আমার দুইজন পরিচারকও রহি আছে। অনুমতি পাইলে আহারীয় প্রস্তুত করিতে আর কত বিলম্ব হইবে?
প্রহরী। তোমাদিগের প্রস্তুত করা আহারীয় দ্রব্য আমরা কিরূপে আহার করিতে পারি?
হোসেন। কেন?
প্রহরী। আমি শুনিয়াছি, বহুদিবস হইল, এইরূপ একটী ঘটনা ঘটিয়াছিল। একজন কয়েদী-আসামীকে লইয়া দুইজন প্রহরী গমন করিতেছিল। যাইতে যাইতে পথে অপর আর একজন লোক আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হয়। সেই ব্যক্তি সেই আসামীর দলস্থিত একজন; কিন্তু এ পরিচয় সে পূর্বে সেই প্রহরীদ্বয়ের নিকট প্রদান করে নাই। ক্রমে তাঁহারা এইরূপ একটী সরাইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই ব্যক্তিই সকলের আহারীয় প্রস্তুত করে। প্রথমে আসামীকে আহার করান হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার কোনরূপ অসুখ হয় না। পরিশেষে প্রহরীদ্বয় আহার করিতে বসে, কিন্তু আহার করা শেষ হইতে না হইতেই উভয়েই হতজ্ঞান হইয়া পড়ে। পরে সরাইয়ের লোজন যখন জানিতে পারে যে, দুইজন প্রহরী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তখন তাঁহারা সেই স্থানে গমন করে; কিন্তু সেই কয়েদী-আসামী এবং আহার-প্রস্তুতকারীকে আর তাঁহারা দেখিতে পায় না। এই সংবাদ ক্ৰমে থানায় গিয়া উপ স্থিত হয়। প্রহরীদ্বয়কে হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। থানাদার নিজে আসিয়া এই ঘটনার সবিশেষ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই পাওয়া যায় না। উভয় ব্যক্তির মধ্যে কেহই ধৃত হয় না। অধিকন্তু প্রহরীগণ চৈতন্য লাভ করিলে জানিতে পারা যায় যে, তাহাদিগের নিকট যে সকল টাকা-পয়সা ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। ইহা যখন প্রকৃত ঘটনা বলিয়া সকলেই অবগত আছেন, তখন বলুন দেখি, আমরা কিরূপে আপনাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে রন্ধন করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারি?
হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আপনারা আমাকে পূর্ব হইতে জানেন কি না, বলিতে পারি না। যদি আমাকে পূর্ব হইতে জানিতেন, তাহা হইলে আপ
আমাকে বোধ হয়, এতদূর অবিশ্বাস করিতে পারিতেন না। সে যাহা হউক, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করিতেই
পারেন, তাহা হইলে অপর আর কোনরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে না কি? অপর যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে বলেন, আমরা সেইরূপ করিতেই প্রস্তুত আছি।
প্রহরী। আর কি বন্দোবস্ত হইতে পারে?
হোসেন। আমরা আর সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি, আপনা দিগের এক ব্যক্তি অনায়াসেই পাক করিয়া লইতে পারেন।
প্রহরী। আমরা সকলেই অতিশয় ক্লান্ত। সুতরাং আমা দিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সেই কাৰ্য যে সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহা আমি বোধ করি না।
হোসেন। যদি এ কাৰ্য্য আপনাদিগের দ্বারা না হয়, তাহা হইলে আপনাদিগের মধ্যে একজন যদি রন্ধনশালার নিকট উপস্থিত থাকিতে পারেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী একজন লোকের দ্বারা আমি কাৰ্য্য করাইয়া লইতে পারি। আপনাদিগের সম্মুখে যদি আহারীয় প্রস্তুত হয়, তাহা হইলে আমরা উহাতে কিরূপে বিষ মিশ্রিত করিতে পারিব?
প্রহরী। অত গোলযোগে কায নাই। আমরা একরূপ জলযোগ করিয়াছি, এখন আর আহার করিবার ইচ্ছা নাই। সুতরাং আহারীয় প্রস্তুত করিবার আর প্রয়োজন কি? আপ নারা ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আহারাদি প্ৰস্তুত করিয়া অনায়াসেই আহার করিতে পারেন।
হোসেন। আমি আমাদিগের আহারের নিমিত্ত বলিতেছি না। আপনারা যে আসামীদ্বয়ের সহিত আসিয়াছেন, তাঁহাদিগের আজ কয়েকদিবস হইতে আহার হয় নাই; কোন দিন অনাহারে, কোন দিন জলাহারে, দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন। ইহাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা পরে হইবে; কিন্তু এখন আমাদিগের ইচ্ছ, উঁহাদিগকে কিছু আহার করাই। এই নিমিত্ত আপনাদিগকে এত অনুরোধ করিতেছি।
প্রহরী। উঁহারা ত এখনই আহার করিলেন?
হোসেন। বাজারের মিষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন করিয়া কোন্ ব্যক্তি কয় দিবস জীবনধারণ করিতে পারে?
প্রহরী। যখন আপনারা আহারাদি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত এতই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন আমার সম্মুখে আপনারা আমা দিগের সকলের আহারীয় প্রস্তুত করুন। আহারীয় প্রস্তুত করি বার সময় আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, ইহাতে আপনা দিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি আছে কি না।
হোসেন। এ উত্তম কথা।
উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, হোসেন নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া সকলের আহারাদির উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
একজন প্রহরীর তত্ত্বাবধানে সময়মত আহারীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত হইল। তখন হোসেন কহিলেন, এখন আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছে, অনুমতি হইলে সকলেই ভোজন করিয়া লইতে পারেন।
প্রহরী। সকলের ভোজন একবারে হইতে পারে না। প্রথমে তোমরা ভোজন কর, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। আমরা অগ্রে ভোজন করিব কেন? আপনাদিগের আহারাদি হইয়া গেলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
প্রহরী। তাহা হইতে পারিবে না। তোমরা অগ্রে ভোজন করিলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। যদি আপনারা নিতান্তই অগ্রে ভোজন না করেন, তাহা হইলে সকলেই এক সময় ভোজন করা যাউক। আপনারা থাকিতে আমরা কিরূপে অগ্রে খাইতে পাক্সি?
প্রহরী। তাহাও হইতে পারে না।
হোসেন। কেন?
প্রহরী। তোমরা ভোজন করিলে, তাহার পর তোমাদিগের কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা অগ্রে দেখিয়া, পরিশেষে আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। আপনার এ কথার অর্থ ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
প্রহরী। বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, আমি বুঝাইয়া দিতেছি। আমাদিগের তত্ত্বাবধানে আপনারা আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমাদিগের অলক্ষিতে আপনারা উহার সহিত অনায়াসেই বিষ মিশ্রিত করিয়া দিতে পারেন। প্রথমে আপনারা আহার করিলেই, আমরা জানিতে পারি যে, সেই সকল আহারীয় দ্রব্যের সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না। আহারান্তে যদি আপনাদিগের কোনরূপ বৈলক্ষণ না ঘটে, তাহা হইলে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারিব যে, উহার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত ব্য মিশ্রিত নাই। ইহার পর আর আপনাদিগকে আহারীয় দ্রব্যের নিকট গমন করিতে দিব না। আমরা নিজ হস্তে সেই সকল দ্রব্য পরিবেশন করিয়া আহার করিব।
হোসেন। আপনার এ কথায় আমাদিগের কোন উত্তর নাই। আমরা আহারীয় দ্রব্যর নিকট আর গমনই করিব না। আপনারা উহা হইতে কিছু কিছু আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা দূরে বসিয়া আহার করি। আমরা আপনাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিব মাত্র। কিন্তু আপনাদিগকে এবং মনিবদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া, পরিতুষ্টির সহিত কখনই আহার করিয়া উঠিতে পারিব না।
ইহার পর হোসেনের প্রস্তাব-মতই কাৰ্য্য হইল। হোসেন ও তাহার পরিচারকদ্বয় দূরে আহার করিতে বসিলেন; একজন প্রহরী তাহাদিগকে পরিবেশন করিলেন। প্রহরীগণ যখন দেখিল, হোসেন বা তাহার পরিচারকদ্বয় সেই সকল দ্রব্য আহার করিয়া সুস্থ শরীরে রহিলেন, তখন তাঁহারা তাহাদিগের নিজের আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু আসামীদ্বয় আহার করিবে কি না, সে সম্বন্ধে কোন কথাই কহিল না। তখন হোসেন কহিলেন, আপনাদিগের আহারের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু আসামীদ্বয় কখন আহার করিবেন?
প্রহরী। আসামীদ্বয়েরও কি আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছেন?
হোসেন। উঁহারাই আহার করিবেন বলিয়া, সকলের নিমিত্ত আহারীয় আমরা প্রস্তুত করিয়াছি। নতুবা আমাদিগের আহারীয় প্রস্তুত করিবার কোনরূপ প্রয়োজনই ছিল না।
প্রহরী। উহার ফাঁসি যাইবার আসামী। উঁহাদিগকে আমরা কিরূপে আহার করিতে অনুমতি দিতে পারি?
হোসেন। যাহাদিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হয়, ফাঁসির পূর্বে যে কয় দিবস তাঁহারা বাঁচিয়া থাকে, সে কয় দিবস কি তাহাদিগকে আহার করিতে দেওয়া হয় না। যদি সরকারের এরূপ কোন নিয়ম থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। বরং লোক-পরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায়, ফঁসি যাইবার পূর্বে ফাঁসির আসামী যাহা খাইতে চাহে, সরকার হইতে তাহাই তাহাকে খাইতে দেওয়া হয়। সে যাহা হউক, এত পরিশ্রম করিয়া যখন আমরা আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছি, তখন উঁহাদিগকে কিছু আহার করিতে দিয়া আমাকে সবিশেষরূপ অনুগৃহীত করুন।
প্রহরী। উঁহারা আহার করুন, বা না করুন, তাহাতে আপনার ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?
হোসেন। ক্ষতি নাই? খুব ক্ষতি আছে। যিনি আমার অন্নদাতা, তিনি আহার করিতে পাইবেন না, আর আমরা আহার করিয়া বসিয়া আছি! ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? আমি আপনাদিগকে সবিশেষরূপ অনুবোধ করি তেছি, উঁহাদিগের আহার করিতে দিবার পক্ষে কোনরূপ প্রতি। বন্ধক হইবেন না। উঁহারা যেরূপ মনঃকষ্টে আছেন, তাহাতে যে আহার করিতে পারিবেন, সে ভরসা আমার নাই; তবে আহার করিতে বসিয়াছেন, ইহা দেখিলেই আমার মনটা একটু সন্তুষ্ট হইবে, এই মাত্র। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত যদি আপনাদিগের আরও কিছু লইবার প্রত্যাশা থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন।
প্রহরী। যখন আপনি এরূপ ভাবে অনুরোধ করিতেছেন, তখন আপনার অনুবোধই বা রক্ষা না করি কি প্রকারে? তবে জানেন কি, আমরা পেটের দায়ে চাকুরী করিতে আসিয়াছি, তাই আপনাকে বলিতেছি।
হোসেন। ইহার জন্য এত গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? আপনারা যখন যাহা চাহিতেছেন, আমি তখনই তাহা আপনা দিগকে প্রদান করিতেছি। প্রথমেই এ কথা আমাকে বলিতে পারিতেন! আপনাদিগের প্রস্তাবে যদি আমি সম্মত হইতে পারি তাম, তাহা হইলে উঁহাদিগের নিমিত্ত আহারীয় প্রস্তুত করিতাম, আর যদি সেই প্রস্তাব আমার সাধ্যাতীত হইত, তাহা হইলে আপনাদিগকে সেলাম করিয়া আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতাম। আচ্ছা, এখন বলুন দেখি, উঁহাদিগকে আহার করিবার অনুমতি দিবার নিমিত্ত আপনারা কি প্রার্থনা করেন?
প্রহরী। পঁচিশ টাকা।
হোসেন। আপনারা পাচজন আছেন, আপনাদিগের প্রত্যেক কেই পঁচিশ টাকা করিয়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে?
প্রহরী। না, মোট পচিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে।
হোসেন। পঁচিশ টাকা আমি প্রদান করিতে পারিব না। আপনারা পাঁচজন আছেন, প্রত্যেককে দুই টাকা হিসাবে মোট আপনাদিগকে আমি দশ টাকা প্রদান করিতেছি। ইহাতে আপ নারা সম্মত হইয়া আসামীদ্বয়কে আহার করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করেন ভালই, নতুবা আমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করি তেছি, আপনাদিগের মনে যাহা উদয় হয়, তাহা করিবেন।
প্রহরী। আপনাকে আর প্রস্থান করিতে হইবে না। দশ টাকা নিতান্ত অল্প হইতেছে, আর পাঁচটী টাকা বাড়াইয়া দিন।
হোসেন। পাঁচ টাকা ত দূরের কথা, দশ টাকার উপর আমি আর পাঁচটা পয়সাও, বাড়াইয়া দিতে পারিব না। ইহাতে আপনা দিগের যাহা অভিরুচি হয়, তাহা করিতে পারেন।
প্রহরী। যে কাৰ্যে আপনারা অসন্তুষ্ট হন, সে কাৰ্য্য আমা দিগের কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। আচ্ছা, আপনার প্রস্তাবেই আমরা সম্মত হইলাম। টাকা দশটী কথন প্রদান করিবেন?
হোসেন। যখন আপনাদিগের আবশ্যক হইবে, তখনই আপনারা লইতে পারেন। এখনই চাহেন, তাহাও আমাকে বলুন, এখনই আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। সেই ভাল। আমি একাকী নহি, পাঁচজনের কাৰ্য্য, অগ্রে দেওয়াই ভাল।
প্রহরীর কথা শুনিয়া হোসেন আর কোন কথা কহিলেন, দশটী টাকা বাহির করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন।
হোসেন টাকা প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু মনে মনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন। মনে করিলেন, এরূপ অত্যাচার করিয়া টাকা লওয়া নিতান্ত অন্যায়। আসামীর সহিত কথা কহিবার প্রয়োজন হইলে টাকা ভিন্ন হইতে পারিবে না! স্নানের নিমিত্ত টাকা, জলপানের নিমিত্ত টাকা, আহারের নিমিত্ত টাকা, এবং বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া প্রদান করিতে হইলেও টাকা! কি ভয়ানক অত্যাচার! এই সকল অত্যাচারের নিমিত্তই পুলিসের এত দুর্নাম।
হোসেন মনে মনে এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা কহিতে পারিলেন না।
গোফুর খাঁ ও ওসমান, প্রথমতঃ কিছুতেই আহার করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু কোন প্রকারেই হোসেনের অনুরোধ লম্বন করতে না পারিয়া, আহার করিবার নিমিত্ত একবার বসিলেন মাত্র; ফলতঃ আহার করিতে পারিলেন না, চক্ষু-জলে আহারীয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
আহারান্তে প্রহরীগণ আপনাপন চারিপায়ার উপর শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। কেবল একজন মাত্র প্রহরী আসামীদ্বয়কে পাহারা দিতে লাগিল। আসামীদ্বয় সেই গৃহের ভিতর কয়েদী অবস্থায় বিষন্ন মনে বসিয়া রহিলেন।
এইরূপে প্রায় সমস্ত দিবস সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সন্ধ্যা হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, সেই সময় একজন প্রহরী এক্কা-চালকগণকে ডাকিল ও কহিল, বেলা প্রায় অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকদূর আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। একা সকল শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া আন, আমরা এখনই এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
প্রহরীর কথা শুনিয়া এক্কা-চালকগণ তখনই এ প্রস্তুত করিয়া আনিল। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়ের সহিত উহাতে আরোহণ করিল, হোসেনও আপনার দুইজন পরিচারকের সহিত আপন একায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের এক্কার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। এক্কা-চালকগণ অখে কষাঘাত করিতে করিতে বেগে একা চালাইতে আরম্ভ করিল।
সন্ধ্যার অল্প পরেই সকলে একটী থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে সকলে একা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। থানায় সেই সময় দারোগা উপস্থিত ছিলেন না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে হোসেন জানিতে পারিলেন যে, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী অর্থাৎ দারোগাও একজন মুসলমান বংশ-সম্ভূত।
যে সকল এক্কায় আরোহণ করিয়া আমাশয়, প্রহরীগণ ও হোসেন প্রভৃতি গমন করিয়াছিলেন, এখন সেই সকল এক বিদায় করিয়া দিবার প্রয়োজন হইল। কারণ, তাঁহারা অনেকদূর আগমন করায়, তাহাদিগের অশ্বগণ সবিশেষরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তদ্ব্যতীত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই স্থানে যতগুলি একার প্রয়োজন হইবে, ততগুলিই অনায়াসে পাওয়া যাইবে।
এইরূপ বন্দোবস্ত দেখিয়া, যে এক্কায় হোসেন তাহার ভৃত্য দ্বয়ের সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাহাকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন। সেই এক্কা-চালককে যে পরিমিত ভাড়া দিবার নিমিত্ত প্রহরীগণ বলিয়া দিল, হোসেন তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই দিয়া দিলেন। একা-চালক আপনার ভাড়া পাইয়া থানার বাহিরে গিয়া উপবেশন করিল।
কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিতে দেখিয়া একজন প্রহরী কহিল, আপনি কেবলমাত্র একখানি একার ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন দেখিতেছি। আর অপর এক্কা তিনখানি, যাহাতে আপনার মনিবদ্বয় এবং আমরা আসিয়াছি, তাহার ভাড়াও ওই সঙ্গে দিলেন না কেন?
হোসেন। আপনাদিগের একা-ভাড়া প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহার নিমিত্ত আমি এককালীন আপনাদিগকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিয়াছি। তাহা হইতে একা-ভাড়া প্রদান করিতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?
প্রহরী। আপত্তি আর কিছুই নাই, তবে এখন আপনি দিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই।
হোসেন। আমি একবার প্রদান করিয়াছি। বলেন না হয়, আর একবার প্রদান করি। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আপনাদিগের হাতে পড়িয়াছি, তখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে হইবে।
প্রহরী। আপনি অসন্তুষ্ট হইবেন না। একা-ভাড়া এখন আপনি প্রদান করুন, বা আমরা প্রদান করি, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি নাই। কারণ, আমাদিগের নিকট আপনার যে পঞ্চাশ টাকা আছে, খরচ-পত্ৰ বাদে তাহা হইতে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আপনারই। আর যদি উহাতে সমস্ত খরচের সঙ্কুলান না হয়, তাহা হইলে আর যাহা লাগিবে, তাহা আপনাকে দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় সামান্য একা-ভাড়ার নিমিত্ত এত গোলযোগ করিতেছেন কেন?
হোসেন। আমি কোনরূপ গোলযোগই করিতেছি না। যে টাকা আপনাদিগের নিকট আছে, তাহা হইতে এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে যদি আপনাদিগের কোনরূপ অসুবিধা হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। অসুবিধা আর কিছুই নয়। তবে টাকাগুলি যেরূপ ভাবে বাঁধিয়া রাখা আছে, তাহা হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া লইতে হইলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই যাহাতে এক্কা ওয়ালাগণের আর বিলম্ব না হয়, সেই নিমিত্ত ভাড়াটা এখন আপ, নাকে দিতে বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই।
হোসেন। সামান্য টাকার নিমিত্ত আর অধিক কথার প্রয়ো জন নাই। আমি এখন উহা প্রদান করিতেছি, যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, পরিশেষে আপনারা তাহা করিবেন।
এই বলিয়া হোসেন আর তিনখানি একার ভাড়াও আপনার নিকট হইতে উঁহাদিগকে দিয়া দিলেন।
আপনাপন ন্যায্য মজুরি বুঝিয়া লইয়া একাওয়ালাগণ সেই স্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিল।
প্রহরীগণের ব্যবহার দেখিয়া হোসেন মনে মনে ভাবিলেন, উঁহাদিগের খরচের নিমিত্ত যে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা পাইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। অথচ আরও যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহার সমস্তই তাঁহাকে বহন করিতে হইবে।
এই সময় গোফুর খাঁ হোসেনকে তাহার নিকট ডাকিলেন। হোসেন তাহার নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, হোসেন। আমি দেখিতেছি, তুমি নিরর্থক অনেক অর্থ নষ্ট করিতেছ।
হোসেন। আপনাদিগের জীবন অপেক্ষা কি অর্থের মূল্য অধিক? যে আপনাদিগের নিমিত্ত আমি সেই অর্থ ব্যয় করিব না?
গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু এইরূপ নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিয়া কি আমাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিবে?
হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারি না সত্য; কিন্তু আপাততঃ আপনাদিগের কষ্টের অনেক লাঘব করিতে সমর্থ হইব।
গোফুর। যাহাদিগের জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই, দুই চারিদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের শারীরিক কষ্ট নিবারণ করিয়া ফল কি? মানসিক কষ্টের নিকট শারীরিক কষ্ট কিছুই নহে। যে ব্যক্তি সর্বদা মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহার যতই কেন শারীরিক কষ্ট হউক না, তাহার দিকে তাহার লক্ষ্যই হয় না।
হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আমাদিগের সম্মুখে আপনি শারীরিক কষ্ট ভোগ করিবেন, অর্থ থাকিতে আমরা কিরূপে উহা দেখিতে সমর্থ হইব? আর আপনাদিগের জীবনের আশা নাই, এ কথাই বা আপনারা কিরূপে অনুমান করিলেন?
গোফুর। যাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার আর জীবনের আশা কি?
হোসেন। এখনও অনেক আশা আছে। যে বিচারালয় হইতে আপনাদিগের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার উপর বিচারালয় আছে। সেখানে আপীল করিব, যেরূপ ভাবে ও যত অর্থ ব্যয় করিয়া চেষ্টা করিতে হয়, তাহা করিব। ইহাতে কি কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব না? ঈশ্বর না করুন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিব; আবশ্যক হইলে বড় লাটের নিকট পর্যন্ত গমন করিব। পরিশেষে বিলাত পর্যন্ত চেষ্টা করিব। ইহাতেও কি সুবিচার হইবার সম্ভাবনা নাই? যদি ইহাতেও না পারি, তাহ হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে ক্রটি করিব না। আপনি আপনার মনকে স্থির করিয়া রাখুন। দেখিবেন, যেরূপ উপায়েই হউক, কখনই আপনাদিগকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে দিব না।
গোফুর। তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা সম্পূর্ণরূপ অসম্ভব। ইহা কখনই হইতে পারে না।
হোসেন। জগতে অসম্ভব কিছুই নাই; অর্থে না হইতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। দেখিবেন, যাহা মুখে বলিতেছি, কাৰ্যে তাহা পরিণত করিতে পারি কি না!
গোফুর। আমার বিবেচনায় তুমি আর নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিও না। আমাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ভাবে যে অর্থ ব্যয় করিবে, তাহা আমাদিগের নামে দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করিও। তাহা হইলে আমাদিগের পরকালের অনেক উপকার করা হইবে। ইহকালে যাহা হইবার, তাহা হইল।
হোসেন। গরিব-দুঃখীকে আপনারা যেরূপ ভাবে অর্থ দান করিতে কহিবেন, তাহা আমরা করিব। তদ্ব্যতীত আপনাদিগের জীবন-রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতে ক্রটি করিব না। বিশেষ–
গোফুর। বিশেষ কি?
হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ আমি যে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতেছি, তাহা নহে। আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সকলেই আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত তাহাদিগের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ও তাঁহাদিগের সমস্ত অলঙ্কার-পত্র পর্যন্ত আমার হস্তে প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এবং বলিতেছেন, যদি কোনরূপে আমি আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাঁহারা সকলেই বিষপান করিয়া আপনাপন জীবন নষ্ট করিবেন। আমি যদিচ এখন তাঁহাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থ গ্রহণ করি নাই, তথাপি যদি আমি এইরূপ ব্যয় করিয়া আপনাদিগের জীবন রক্ষার কোনরূপ উপায় না করি, তাহা হইলে কি সর্বনাশ ঘটিবে, একবার মনে করিয়া দেখুন দেখি? : গোফুর। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যখন আমাদিগের জীবনের নিমিত্ত এত উৎসুক, তাঁহাদিগের নিমিত্ত কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?
হোসেন। সে সম্বন্ধে আমি এ পর্যন্ত কিছুই মনে ভাবি নাই। কারণ, আমার বিশ্বাস, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না!
গোফুর। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না কেন?
হোসেন। যখন আমার বিশ্বাস যে, যেরূপে পারি, আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিব, তখন আমার সেই সকল দিকে এখন দৃষ্টি করিবার কোনরূপ প্রয়োজন নাই। যেরূপ ভাবে এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, এখন সেইরূপ ভাবেই চলুক। পরিশেষে আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যখন বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন, সেই সময় আপনার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিবেন।
গোফুর। সে বহুদূরের কথা।
হোসেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি, উহা দূরের কথা নহে।
গোফুর। সে পরের কথা। আমাদিগকে বাঁচাইতে পারিবে, এরূপ লুব্ধ আশ্বাসের উপর একবারে নির্ভর করিয়া থাকিও না। আমাদিগকে খালাস করিবার যতদূর চেষ্টা করিতে হয়, কর; অথচ অপরাপর বন্দোবস্তের দিকেও সবিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিও। কারণ, যদি আমাদিগের জীবন রক্ষাই না হয়, তাহা হইলে আমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে আমার ইচ্ছামত বিষয়-আদির বন্দোবস্ত করার আবশ্যক। জমিদারী সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিতেছ?
হোসেন। এখনও কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। যেরূপ আদেশ করিবেন, সেইরূপ ভাবেই বন্দোস্ত করিব।
গোফুর। মোকদ্দমা খরচের নিমিত্ত যে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছ, সেই টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ নষ্ট করিতে হইয়াছে কি?
হোসেন। টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ আমি নষ্ট করি নাই, বা উহা বন্ধক দিতেও হয় নাই। সরকারী তহবিলের যে যে স্থানে যে যে টাকা মজুত ছিল, তাহাই সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি মাত্র। যদি কিছু দেনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত বিষয়-আদি কিছুই বন্ধক দিতে হইবে না। সমস্ত জমিদারী এ পর্যন্ত যেরূপ ভাবে ছিল, এখনও সেইরূপ ভাবেই আছে।
হোসেন ও গোফুর খাঁর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া আসামীদ্বয়কে হাজতের ভিতর বদ্ধ করিয়া দিল। সুতরাং উভয়ের কথাবার্তা সেই সময়ের নিমিত্ত শেষ হইয়া গেল। আসামীদ্বয় সবিশেষ দুঃখিত অন্তঃকরণে হাজতের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
সম্পূর্ণ।
(দারোগার দপ্তর ৭৫ম সংখ্যা)
(অর্থাৎ পুলিসের অসৎ বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। আষাঢ়।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta.
ঘর-পোড়া লোক।
(মধ্যম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
হোসেনের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, আপনি কি অবস্থা শুনিয়াছেন বলুন দেখি, আমিও শ্রবণ করি।
বোগা সাহেবের কথার উত্তরে হোসেন কহিল, ওসমানের চরিত্র আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন, এবং তাহার চরিত্র সম্বন্ধে আপনি যাহা কহিলেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। যে মৃতদেহ গোফুর খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, সেই কন্যাটা বেশ রূপবতী ছিল। তাহার রূপের কথা জমে ওসমানের কর্ণগোচর হইল। যুবতী রূপবতী স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া তিনি আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, তাহার নিকট ক্রমে লোকের উপর লোক পাঠাইয়া, তাহাকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ওসমানের প্রস্তাবে সে কোনরূপেই প্রথমে স্বীকৃত হয় নাই; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর অর্থের লোভে ক্রমে সে আপন ধৰ্ম্ম বিক্রীত করিতে সম্মত হইল। যে সময় হেদায়েৎ কাৰ্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়া
ছিলেন, সেই সময় একরাত্রিতে ওসমান একখানি পাকী পাঠাইয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে আনয়ন করেন। প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার বৈঠকখানায় মাখিয়া, অতি অলমাত্র রাত্রি অবশিষ্ট থাকিতে, সেই পাল্কী করিয়া তাহাকে পুনরায় আপন বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন। পরদিবস রাত্রিতে পুনরায় পাল্কী করিয়া
তাহাকে আপন বৈঠকখানায় আনয়ন করেন। সেই সময় গোফুর খাঁ বাড়ীতে ছিলেন না, কানপুরে ছিলেন। যে সময় ওসমান সেই স্ত্রীলোকটাকে লইয়া আপন বৈঠকখানায় আমোদ প্রমোদে উন্মত্ত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গোফুর খাঁ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। পাছে পিতা তাঁহার এই সকল বিষয় জানিতে পারেন, এই ভয়ে ওসমান তাঁহার বৈঠকখানার সম্মুখে একটা কুঠারীর ভিতর উহাকে লুকায়িত ভাবে রাখিয়া দিয়া সেই গৃহের তালাবদ্ধ করিয়া দেন। তৎপরে তাহার একজন অনুচরকে কহেন যে, তাঁহার পিতা যেমন এদিক ওদিক করিবেন, বা বাড়ীর ভিতর গিয়া শয়ন করিবেন, সেই সময় সেই স্ত্রী লোকটীকে সেই গৃহ হইতে বাহিরে আনিয়া, পাক্কী করিয়া তাহার বাড়ীতে যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এবং পাঠাইবার সময় সেই স্ত্রীলোকটাকে যেন বলিয়াও দেওয়া হয় যে, বৃদ্ধ কানপুরে গমন করিলে পুনরায় তাহাকে আনয়ন করা বাইবে।
অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হন, এবং কহেন যে, একটু অবকাশ পাইলেই তিনি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু কাৰ্যে তাহা করিয়া উঠিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে ওসমান তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন।
তিনি যে তাহাকে পাঠাইতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এ কথা না। ধলিয়া, কহিলেন যে, গত রাত্রিতেই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অনুচর যে তাহার কোনরূপ অভিসন্ধি বশতঃ এইরূপ মিথ্যা কথা কহিলেন, তাহা নহে; মনে করিলেন, উহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয় নাই, এই কথা জানিতে পারিলে, পাছে ওসমান তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, যেরূপ উপায়ে হউক, এখনই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। সেই সময় ওসমান অপর একটী কাৰ্য্যোপলক্ষে তাহাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। তিনিও সেই কাৰ্যোপলক্ষে এ দিকের কাৰ্য একবারে ভুলিয়া যান। অথচ ওসমানের বিশ্বাস যে, সেই স্ত্রীলোকটী তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছে; সুতরাং সেই স্ত্রীলোকটী গৃহের ভিতর যে বদ্ধ আছে, এ কথা আর কাহারও মনে হয় নাই, বা সেই ঘর খুলিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এইরূপে অনাহারে এবং তৃষ্ণায় উহার মৃত্যু ঘটে। পরিশেষে আপনি বাড়ীর সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে, যখন সেই ঘরের দরজা খোলেন, তখন সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। এই ব্যাপার দেখিয়া তখন ওমানের সমস্ত কথা স্মরণ হয়, এবং বুঝিতে পারেন যে, তাহার অনুচরের মিথ্যা কথার নিমিত্ত তাহার কি সর্বনাশ ঘটিল! গোফুর খাঁ ইহার ভাল মন্দ কিছুই জানেন না; সুতরাং এই অবস্থা দেখিয়া তিনি একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়েন। আমি যতদুর শুনিয়াছি, ইহাই প্রকৃত ঘটনা। আমি অকপটে আপনার নিকট যাহা বলিলাম, তাহা কিন্তু এখন অন্যরূপ ঘটনা হইয়া পড়িয়াছে।
দারোগা। ইহাই যদি প্রকৃত ঘটনা হয়, তাহা হইলে এখন যেরূপ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা কি?
হোসেন। তাহা যে কি, তাহা আপনি আপন মনে বেশ অবগত আছেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
দারোগা। এই মোকদ্দমার যেরূপ প্রমাণ হইয়াছে, তাহা আপনি সমস্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?
হোসেন। তাহা সমস্তই জানিতে না পারিলে, আর আপনার নিকট আসিব কেন?
দারোগা। আপনি আমাকে যে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন, তাহার পরিবর্তে আমি এখন যে কোন উপকার করিতে পারি, তাহা বোধ হয় না।
হোসেন। মনে করিলে এখনও বিস্তর উপকার করিতে পারেন।
দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আর কি উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে, বলুন। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, সেই উপকার করিতে আমি কত দুর সমর্থ।
হোসেন। সময় মত বলিব। তখন আপনার যতদূর সাধ্য, সেইরূপ উপকার করিবেন; কিন্তু এখন যাহাতে অন্য কোন সাক্ষীর যোগাড় না হয়, তাহা করিলেই যথেষ্ট হইবে। আরও একটা বিষয়ের অনুরোধের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা ওসমানের জ্বালায় সবিশেষ জ্বালাতন হইয়া, এইরূপে আমাদিগের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছে। তাঁহারা যে কথা বলিয়াছে, পুনরায় যে তাহার অন্যথাচরণ করিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। তথাপি অর্থ প্রলোভনে আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি কোনরূপে কৃতকার্য হইতে পারি। আপনি তাহাতে প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবেন না, ইহা আমার একটা প্রধান অনুরোধ।
দারোগা। তাহা কিরূপে হইবে? সাক্ষিগণ একবার যেরূপ কথা বলিয়াছে, এখন যদি তাহার অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিপদে পড়িতে হইবে, তাহা কি তাঁহারা জানে না? বিশেষতঃ একথা যদি তাঁহারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা হইলে আমি কখনই বলিতে পারিব না যে, তোমরা পূর্বে যেরূপ বলিয়াছ, এখন অনায়াসেই তাহার বিপরীত বলিতে পার। আর সাক্ষীগণ যদি এখন অন্যরূপ বলে, তাহা হইলে তাহাদিগের ত বিপদ হইবেই; তদ্ব্যতীত আমাদিগের উপরও নানারূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবে, আর হয় ত আমাকেও বিপদাপন্ন হইতে হইবে।
হোসেন। যাহাতে আপনাকে বিপদাপন্ন হইতে হইবে, এরূপ কাৰ্যে আমি কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। আর যাহা কিছু করিতে হইবে, আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া, এবং সেই বিষয়ে আপনার মত লইয়া সেই কাৰ্য্য করিব। আপনার অমতে কোন কাৰ্য্য করিব না।
এই বলিয়া হোসেন, সেই দিবস দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
হোসেন চলিয়া গেলে, দয়োগা সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা গ্রহণ করিয়াছি। আরও যদি কিছু পাই, তাহাও লইব। অধিকন্তু হোসেনের সাহায্যে সেই স্ত্রীলোকটীকেও পুনরায় আনাইয়া লইব। কিন্তু আসল কাৰ্য কোনরূপেই ছাড়িব না; যাহাতে গোফুর এবং ওসমানকে ফঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইতে পারি, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিব।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
হেদায়েতের কন্যাকে হত্যার অপরাধে, গোফুর খাঁ এবং তাহার পুত্র ওসমান খাঁ মাজিস্ট্রেটের নিকট প্রেরিত হইলেন। দারোগা সাহেবও প্রাণপণে সেই মোকদ্দমার আয়োজন করিতে লাগিলেন। পিতা পুত্র উভয়েই হাজতে রহিলেন। পুলিসের নিকট যে সকল সাক্ষী সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছিল, যাহাতে তাঁহারা মাজিস্ট্রেটের নিকট অন্যরূপ সাক্ষ্য প্রদান করে, তাহার নিমিত্ত হোসেন অনেক অর্থ ব্যয় করিয়া, অনেক চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। বরং পুলিসের নিকট তাঁহারা যেরূপ বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেটের নিকট তাহা অপেক্ষা আরও অনেক অধিক কথা কহিল।
সমস্ত সাক্ষীর এজাহার হইয়া যাইবার পর, মাজিষ্ট্রেট সাহেব দেখিলেন যে, আসামীদ্বয়ের বিরুদ্ধে হত্যাকরা অপরাধ উত্তমরূপে প্রমাণিত হইয়াছে। সুতরাং চুড়ান্ত বিচারের নিমিত্ত তিনি এই মোকদ্দমা দায়রায় প্রেরণ করিলেন।
এই মোকদ্দমার বিচারের নিমিত্ত যখন দায়রায় দিন স্থির হইল, সেই সময় বিচারক মফঃস্বল পরিভ্রমণ উপলক্ষে, জেলা হইতে সুদূর মফঃস্থলে অবস্থান করিতেছিলেন। যখন যে গ্রামে বিচারক উপস্থিত হইতেছিলেন, সেই সময় সেই গ্রামেই আপন কাছারি করিয়া মোকদ্দমার বিচারও করিয়া আসিতেছিলেন।
যে দিবস গফুর খাঁ এবং তাঁহার পুত্র ওসমানের এই হত্যাপরাধ-বিচার আরম্ভ হইল, সে দিবস একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র পলিগ্রামের ভিতর জজসাহেবের তাম্বু পড়িয়াছিল। সুতরাং সেই স্থানেই এই মোকদ্দমার বিচার আরম্ভ হইল।
এলাহাবাদ হাইকোর্ট হইতে উকীল কৌন্সলি আনাইয়া এই মোকদ্দমায় দোষ-ক্ষালনের যতদূর উপায় হইতে পারে, হোসেন প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করিলেন; কিন্তু কিছুতেই আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে সমর্থ হইলেন না। সরকারী উকীল মোকর্দমার অবস্থা জজসাহেবকে উত্তমরূপে সর্বপ্রথম বুঝাইয়া দিবার পর হইতেই, জজসাহেবের মনে কেমন এক বিশ্বাস হইয়া গেল যে, আসামী পক্ষীয় উকীল কৌশলি অনেক চেষ্টা করিলেও, তাহার মন হইতে সেই বিশ্বাস অপনোদন করিতে পারিলেন না। তিন দিবস পৰ্য্যন্ত এই মোকদ্দমার সাক্ষিগণের এজাহার গৃহীত হইল। তাহাদিগের উপর যথেষ্ট জেরা হইল। উভয় পক্ষীয় উকীল কৌন্সলিগণ স্বপক্ষে সাধ্যমত বক্তৃতাদি করিতে ক্রটি করিলেন না; কিন্তু কিছুতেই আসামীদ্বয়ের পক্ষে কোনরূপ উদ্ধারের উপায় লক্ষিত হইল না।
জজসাহেব এই মোকদ্দমার রায় প্রদান করিবার কালীন কহিলেন, আসামীগণ! তিন দিবস পর্যন্ত বিশেষ যত্ন ও মনো–যোগের সহিত, এই মোকদ্দমার সমস্ত ব্যাপার আমি উত্তম রূপে শ্রবণ করিয়াছি, এবং তোমাদিগের পক্ষীয়, সুশিক্ষিত উকীল কৌন্সলিগন সবিশেষ যত্নের সহিত তোমাদিগের পক্ষসমর্থন করিয়া, তোমাদিগের স্বপক্ষে যাহা কিছু বলিবার আছে, তাহা অপেক্ষাও অনেক কথা বলিয়াছেন; কিন্তু উভয় পক্ষের সমস্ত ব্যাপার শ্রবণ করিয়া এবং সাক্ষিগণের সাক্ষ্য দিবার কালীন, তাহাদিগের ভাব-ভঙ্গি দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, তোমাদিগের বিপক্ষে তাঁহারা বিন্দুমাত্রও মিথ্যা কথা কহে নাই। অবশ্য, অনেক সাক্ষ্যের অনেক স্থান অপর সাক্ষিগণের সাক্ষ্যের সহিত এক মিল হয় নাই। কিন্তু তাহা বলিয়া তাঁহারা যে, একবারে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, এ কথা আমি কখনই স্বীকার করিতে পারিব না। তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর তালা বন্ধ গৃহের মধ্যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ যে পাওয়া গিয়াছে, সে সম্বন্ধে কোন আপত্তি উত্থাপিত হয় নাই। বিশেষতঃ তোমাদিগের বিরুদ্ধে যে সকল ব্যক্তি সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাঁহারা সকলেই তোমাদিগের জমিদারীর প্রজা। প্রজাগণ তাহা দিগের জমিদারের বিপক্ষে কখনই মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করিতে সম্মত হয় না। আর নিতান্ত সত্যের অনুরোধে যদি কোন প্রজাকে তাহার জমিদারের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিতে হয়, তাহা হইলেও সেই প্রজা যতদূর সম্ভব, তাহার জমিদারকে বাঁচাইয়া যাইতে চেষ্টা করে, ইহাই এদেশীয় নিয়ম। তোমাদের প্রজাগণ তোমাদিগের বিপক্ষে যে সকল সাক্ষ্য প্রদান করিতেছে, আমার বিশ্বাস, তাঁহারা তাহা অপেক্ষাও অনেক অধিক কথা অবগত আছে। কোনরূপে যদি আপনাদের জমিদারের উপকার করিতে পারে, এই ভাবিয়া সকল কথা তাঁহারা বলে নাই। সেই সকল সাক্ষী ওসমানের অত্যাচারে অত্যাচারিত হইয়া, তোমাদিগকে বিপদাপন্ন করিবার মানসে মিথ্যা কথা কহিতেছে, এ কথা সময় সময় মোদিগের কৌন্সলি উখাপিত করিলেও, তাঁহারা সেই সকল কথা একবারে অস্বীকার করে। অথচ তোমরাও তাহার সত্যাসত্য প্রমাণ করতে সমর্থ হও নাই, বা তাহার চেষ্টাও কর নাই। এইরূপ নানা কারণে আমি সাক্ষিগণের সাক্ষ্য কোনরূপেই একবারে অবিশ্বাস করিতে পারি না।
সাক্ষিগণের দ্বারায় বেশ প্রমাণিত হইয়াছে যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার মানসে, তাহার অবর্ত মানে তাহার যুবতী কন্যাকে তোমরা বলপূৰ্ব্বক তাহার পরদার বাহিরে আনিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে তাহাকে যেরূপ অবমাননা করিয়াছ, সেরূপ কাৰ্য ভদ্রবংশীয় কোন লোকের দ্বারা কোনরূপেই সম্ভব না। কেবল মাত্র সামান্য খাজানা আদায় করিবার অভিপ্রায়ে তোমরা সেই যুবতীর উপর কেবল যে এইরূপ ভয়ানক অত্যাচার করিয়াছ, তাহা নহে। আমার অনুমান হয় যে, তোমাদিগের এরূপ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার অপর কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এইরূপে যুবতীর উপর ভয়ানক অত্যাচার করিয়াই যে, তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি দিয়াছ, তাহা নহে। সৰ্বসমক্ষে সেই অবলাকে বিনাদোয়ে ধৃত করিয়া, বিশেষরূপে অবমাননার সহিত কয়েক খানি গ্রামের মধ্য দিয়া তোমরা তোমাদিগের বাটী পৰ্যন্ত তাহাকে লইয়া গিয়াছ। এ কথা গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিত সকলেই একবাক্যে কহিতেছে। অবলা স্ত্রীলোকের উপর বিনা দোষে এরূপ অত্যাচার করা নিতান্ত পিশাচের কাৰ্য ভিন্ন আর কিছুই বলিতে পারা যায় না। এইরূপ অত্যাচার করিয়াই কি তোমরা তাহাকে নিষ্কৃতি লিয়াছ? তোমাদিগের নিজের অনুচর এবং ভৃত্যরর্গের দ্বারা প্রমাণিত হইতেছে যে, সেই হতভাগিনীকে অনশনে রাখিয়া হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে তাহাকে তোমাদিগের বাড়ীর ভিতর একটা নির্জন গৃহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়া দিয়াছিলে। অনশনে যে লোকের মৃত্যু ঘটে, তাহা কি তোমরা জান না? ক্ষুৎপিপাসা সন্থ করিতে কোন্ ব্যক্তি কয়দিবস সমর্থ হয়, তাহা কি তোমাদিগের মনে একবারের নিমিত্তও উদয় হয় নাই? কেবল তাহাই নহে, তোমাদিগের নিজের পরিচারক কি বলিতেছে, তাহা একবার শোন। এক দিবস কোন গতিতে আমি সেই গৃহের চাবি সংগ্রহ করিয়া ঘর খুলিয়া দেখিলাম যে, ক্ষুধায় এবং তৃষ্ণায় যুবতী মৃত্যুশয্যায় শায়িতা। এই অবস্থা দেখিয়া আমার কঠিন হৃদয়েও দয়ার উদ্রেক হইল। ঘরবানের সহিত পরামর্শ করিয়া আমি কিছু আহারীয় এবং পানীয় আনিয়া উহাকে দিবার উদ্যোগ করিতেছি, এরূপ সময়ে ওসমান সাহেব তাহা জানিতে পারিয়া, সেই সকল দ্রব্য আমার হস্ত হইতে কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিলেন, ও আমাকে যৎপয়োনান্তি গালি দিয়া পুনরায় সেই গৃহের তালা বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ব্যাপার দেখিয়া আমার মনে নিতান্ত কষ্ট হইল। আমি গিয়া গোফুর মিঞার নিকট এই কথা বলিলে, কোথায় তিনি তাহার প্রতিবিধানের চেষ্টা করিবেন, না তাঁহার পরিবর্তে আমাকে সহস্র গালি প্রদান করিয়া, তাঁহাদিগের বিনা, অনুমতিতে আমি সেই গৃহের দরজা খুলিয়াছিলাম বলিয়া আমাকে চাকরী হইতে জবাব দিলেন, এবং তদখেই আমাকে তাঁহা, লিগের বাড়ী হইতে বাহির করিয়া দিলেন।
কি ভয়ানক! কি পৈশাচিক ব্যবহার! এই ব্যক্তি ও তাহার পোষকতাকারী ঘরবানের সাক্ষ্য যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই যুবতীকে অনশনে রাখিয়া, ইচ্ছা-পূৰ্ব্বক তাহাকে যে হত্যা করিয়াছ, তাহাতে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। যাহাদিগের দ্বারা এরূপ কাৰ্য্য হইতে পারে, তাঁহারা কোনরূপেই দয়ার পাত্র নহে। আমার বিবেচনায় এরূপ প্রকৃতি-বিশিষ্ট লোকের উপর দয়া প্রকাশ করিলে ঈশ্বর তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। গোফুর খাঁ! তোমার বৃদ্ধ বয়স দেখিয়া, এবং তোমার পূর্ব-চরিত্র শ্রবণ করিয়া আমি পূর্বে মনে করিয়াছিলাম, এরূপ মোকদ্দমায় যদি কেহ দয়ার পাত্র হয়, তাহা তুমি। কিন্তু এখন আমি দেখিতেছি, দস্যু তস্করকে দয়া করা যাইতে পারে, মনুষ্য হত্যাই যাহাদিগের জীবিকা, তাহাদিগকেও দয়া করা যাইতে পারে, তথাপি তোমার উপর সে দয়া প্রকাশ করিতে নাই। তোময়া ইচ্ছা করিয়া যেরূপ ভয়ানক অপরাধ করিয়াছ, তাহার প্রকৃত দণ্ড আমাদিগের আইনে নাই। তোমাদিগের জাতীয় রাজার রাজত্বকালে যেরূপ কুকুর দিয়া খাওয়াইয়া ও ক্ষতস্থানে লবণ নিক্ষিপ্ত করিয়া মারিয়া ফেলিবার নিয়ম ছিল, আমার বিবেচনায় তোমরা সেইরূপ দণ্ডের উপযুক্ত। কিন্তু সেরূপ দণ্ড যখন আমাদিগের আইনে নাই, তখন আমাদিগের আইনের চরম দণ্ড আমি তোমাদিগের উপর বিধান করিলাম। যে পর্যন্ত তোমরা না মরিবে, সেই পৰ্য্যন্ত তোমাদিগের উভয়কেই ফাঁসিকাষ্ঠে লটুকাইয়া রাখা হইবে।
জজসাহেবের মুখে বিষম দণ্ডের কথা শুনিয়া গোফুর খাঁ আর দাড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না, মূর্হিত অবস্থায় সেই স্থানে পড়িয় গেলেন। প্রহরীগণ তাঁহার মুখে জল সিঞ্চন করাতে তাঁহার সংজ্ঞা হইলে, তাঁহারা তাঁহাকে সেই স্থান হইতে বাহির করিয়া লইয়া গেল। ওসমান স্থিরভাবে এই দণ্ডাজ্ঞা সহ করিলেন, কোন কথা কহিলেন না; কেবল দারোগা সাহেবের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিলেন মাত্র।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
এই ভয়ানক দণ্ডাজ্ঞা শুনিয়া হোসেনের মুখ দিয়া আর কোন কথা বাহির হইল না। অপূর্ণ-লোচনে তিনি আদালতের বাহিরে আসিলেন। যে সময় এই মোকদ্দমার বিচার শেষ হইয়া গেল, তখন অপরাহ চারিটা। জজসাহেবের সঙ্গে একজন কোর্ট-ইনস্পেক্টার ছিলেন; যে আসামীদ্বয়ের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগকে লইয়া তিনি বিষম বিপদে পড়িলেন। কিরূপে সেই আসামীদ্বয়কে তিনি জেলায় পাঠাইয়া দিবেন, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। সেই স্থান হইতে পদব্রজে আসামীগণকে পাঠাইয়া দিলে, তিন চারিদিবসের কম তাঁহারা সরে গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবে না। বিশেষতঃ গোফুর খাঁর আর চলিবার ক্ষমতা নাই; তাহার উপর পয়ে বিপদের সম্ভাবনাও আছে।
কোর্ট-ইন্স্পক্টার সাহেব এইরূপ গোলযোগে পড়িয়া হোসেনকে তাকাইয়া পাঠাইলেন ও কহিলেন, আপনার মনিবদ্বয়ের অদৃষ্ট্রে যাহা ছিল, তাহা ঘটিয়াছে; কিন্তু যে পর্যন্ত তাহাদিগের জীবন শেষ না হয়, সে পর্যন্ত তাহাদিগকে কষ্ট দেওয়া কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। এখন, ইহাদিগকে অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটিয়া যাইতে হইবে; কিন্তু আমি দেখিতেছি যে, হটিবার শক্তি ওসমানের থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু গোফুর খাঁর সে শক্তি নাই। আর উঁহাদিগকে কোন যানে আরোহণ করাইয়া লইয়া যাইবার খরচার ব্যবস্থাও সরকার হইতে নাই। এরূপ অবস্থায় যদি আপনি কিছু অর্থ প্রদান করেন, তাহা হইলে যাহাতে উঁহারা কষ্ট না পান, কোনরূপে আমি সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উহা দিগকে এই স্থান হইতে পাঠাইতে পারি।
হোসেন। আমাকে কিরূপ অর্থ সাহায্য করিতে হইবে?
ইনস্পেক্টার। অধিক অর্থের সাহায্য করিতে হইবে না। ইহারা দুইজন, এবং ইহাদিগের সহিত যে কয়জন প্রহরী গমন করিবে, তাহাদিগকে সদর পর্যন্ত লইয়া যাইতে হইলে গাড়ি প্রভৃতির যাহা কিছু খরচ পড়িবে, তাহাই কেবল তোমাকে দিতে হইবে।
হোসেন। তাহা আমি দিতে সম্মত আছি, যদি আমাকেও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে দেন।
ইনস্পেক্টার। আপনিও উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে পারেন। কিন্তু একত্র নহে। উঁহারা যে গাড়িতে গমন করি বেন, আপনি সেই গাড়িতে গমন করিতে পারিবেন না। অপর গাড়ি লইয়া উঁহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিলে, কেহ আপত্তি করিবে না। কিন্তু কেন আপনি উঁহাদিগের সহিত গমন করিতে চাহেন?
হোসেন। আমি যে কয়দিবস উঁহাদিগের সহিত থাকিতে পারিব, সেই কয়দিবস যাহাতে উঁহাদিগের কোনরূপ আহারাদিন কষ্ট না হয়, তাহা আমি দেখিতে পারিব তথ্যতীত যখন উভয়েই ফঁসি খাইতেছেন, তখন ইহাদিগের এই অগাধ জমিদারীর কিরূপ বন্দোবস্ত করিব, বা তাঁহারা ইহা কাহাকে প্রদান করিয়া যাইবেন, এবং পরিবারবর্গেরই বা কিরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে, প্রভৃতি আবশ্যক বিষয় সকল সম্বন্ধে যতদূর সম্ভব, তাহাদিগের নিকট হইতে জানিয়া বা লিখাইয়া লইব।
ইনস্পেক্টার। আপনি উঁহাদিগের সহিত এখন গমন করিতে পারেন, আর তাহাদিগের আহারাদি সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিতেও কিছুমাত্র নিষেধ নাই। কিন্তু বিষয়-আদি-সম্বন্ধীয় বন্দোবস্ত করিবার সময় এখন নহে। জেলায় গমন করিবার পর জেলের মধ্যে উঁহারা যে কয়দিবস পাকিবেন, তাহার মধ্যে জেল কর্ম্মচারীর সম্মুখে সে সমস্ত বন্দোবস্ত আপনারা করিয়া লইতে পারিবেন।
হোসেন। জেলায় গমন করিতে উঁহাদিগের কয়দিবস লাগিবে?
ইনস্পেক্টার। তাহা আমি এখন বলিতে পারিতেছি না। ইহাদিগের সহিত যে সকল প্রহরী গমন করিবে, তাঁহারা যে কয়দিবসে সুবিধা বিবেচনা করিবে, সেই কয়দিবসে তাঁহারা উঁহাদিগকে লইয়া যাইবে।
হোসেন। মহাশয়! আর একটা কথা। রাত্রিকালে উহার যে যে স্থানে অবস্থিতি করিবে, সেই সেই স্থানে রাত্রিযাপন উপযোগী কোনরূপ বন্দোবস্ত করিতে হইবে কি?
ইনস্পেক্টার। না, রাত্রিযাপন সম্বন্ধে কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়াজন নাই। কারণ, থানা ভিন্ন অপর কোন স্থানে উঁহারা রাত্রিযাপন করিবেন না। সমস্ত দিবস গমন করিয়া সন্ধ্যার পূর্বে যে থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিবেন, সেই থানাতেই রাত্রিযাপন করিবেন, ও পরদিন প্রত্যুষে সেই থানা হইতে প্রস্থান করিবেন। এইরূপে গমন করিয়া যে কয়দিবসে সম্ভব, সদরে গিয়া উপস্থিত হইবেন।
কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের সহিত এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, তাহাদিগকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কিছু ব্যয় হইবে, তাহার সমস্ত ভার হোসেন গ্রহণ করিলেন। সেই দিবস অপরাহ হইয়া আসিয়াছিল বলিয়া, ইনস্পেক্টার সবিশেষরূপ পাহারার বন্দোবস্ত করিয়া আসামীদ্বয়কে সেই স্থানেই রাখিয়া দিলেন। আর ইহাই সাব্যস্ত হইল যে, পরদিবস অতি প্রত্যুষে আসামী দ্বয়কে সেই স্থান হইতে পাঠাইয়া দিবেন। আসামীদ্বয় এবং প্রহরীগণকে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যে কয়েকখানি, একার প্রয়োজন হইল, তাহাও সেই রাত্রিতে বন্দোবস্ত করিয়া রাখা হইল। হোসেন এবং তাহার দুইজনমাত্র ভৃত্যও সেই সঙ্গে গমন করিতে প্রস্তুত হইল। তাঁহারাও নিজের গমনোপোযোগী একা বন্দোবস্ত করিয়া রাখিলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যুষে প্রহরীগণ আসামীদ্বয়কে লইয়া একারােহণে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলেন। হোসেনও তাঁহার অনুচরদ্বয়ের সহিত অপর এক্কায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। প্রহরী গণের মধ্যে যে ব্যক্তি সর্ব প্রধান ছিল, সেই স্থান হইতে বহির্গত হইবার পূর্বে কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেব তাহাকে হোসেনের সহিত পরিচয় করিয়া দিয়াছিলেন ও বলিয়া দিয়াছিলেন, হোসেন তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিবে। যে স্থানে যে কোন খরচের প্রয়োজন হইবে, তাহা হোসেনই দিবেন। আসামীদ্বয়কে আহারাদি করাইবার নিমিত্ত যে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হইবে, হোসেন তৎক্ষণাৎ সেই সকল সাহায্য করিবেন। একা প্রভৃতির যখন যেরূপ ভাড়া লাগিবে, হোসেনকে বলিলে তৎক্ষণাৎ তিনি তাহা প্রদান করিবেন।
কোর্ট-ইনস্পেক্টার সাহেবের আদেশ পাইয়া, প্রহরী আর কোন কথা কহিল না। কারণ, সে উত্তমরূপে অবগত ছিল যে, যদি হোসেন বা অপর কোন ব্যক্তি এক্কা প্রভৃতির ভাড়া প্রদান না করে, তাহা হইলে যে কয়দিবসে হউক, তত পথ তাহা দিগকে পদব্রজে গমন করিতে হইবে।
প্রহরী-সর্দারের মনে মনে একটু দুরভিসন্ধি ছিল। কোর্ট ইনস্পেক্টারের সম্মুখে কিন্তু সে তাহা প্রকাশ করিল না। তখন তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া আসামীদ্বয় ও হোসেনের সমভিব্যাহারে সেই স্থান হইতে বহির্গত হইল।
কিয়দ্দূর গমন করিবার পর, পথের এক স্থানে একটা জলাশয় দৃষ্টিগোচর হইল। প্রহরী-সর্দ্দার সেই স্থানে একা থামাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। আদেশ প্রতিপালিত হইল। একা হইতে অবতরণ করিয়া সকলে সেই স্থানে একটু বিশ্রাম করি লেন, এবং প্রহরীগণ একে একে আপনাপন হস্তমুখাদি প্রক্ষালন করিয়া লইলেন। তাঁহাদিগের সকলের হস্তমুখাদি প্ৰক্ষালিত হইলে, প্রহরী-সর্দ্দার হোসেনকে কহিলেন, মহাশয়! আসামী স্বয়কে লইয়া সদরে উপস্থিত হইতে এক্কা-ভাড়া প্রভৃতি যে সকল খরচ পড়িরে, তাহা আমাদিগকে মিটাইয়া দিন।
হোসেন। একা-ভাড়া প্রভৃতির জন্য আপনার ব্যস্ত হইবার কোন প্রয়োজন নাই। যখন আমি আপনাদিগের সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতেছি, তখন সমস্তই আমি প্রদান করিব।
সর্দ্দার-প্রহরী। আপনি যে উহা প্রদান করিবেন, তাহা কোর্ট ইনস্পেক্টার সাহেব বলিয়াই দিয়াছেন; কিন্তু বারে বারে আপনার নিকট চাহিয়া লওয়া অপেক্ষা একবারেই উহা আমাদিগকে প্রদান করা উচিত নহে কি?
হোসেন। যখন আমাকে দিতে হইবে, তখন আপনি একবারেই লউন, বা বারে বারেই লউন, তাহাতে আমার কিছুমাত্র ক্ষতি নাই।
সঃ প্রহরী। তাহা হইলে উহা আমাকে অগ্ৰেই প্রদান করুন।
হোসেন। কত খরচ পড়িবে, তাহা আমি এখন পর্যন্ত জানিতে পারিতেছি না; সুতরাং অগ্রে আমি আপনাকে উহা কি প্রকারে প্রদান করিতে পারি? আপনাদিগের সহিত যে সকল একা আছে, উঁহারা কি একবারে সদর পর্যন্ত গমন করিতে পারিবে?
সঃ প্রহরী। উঁহারা এতদূর কিরূপে গমন করিবে? এক এক থানায় গমন করিবার পর উঁহাদিগকে ছাড়িয়া দিব ও সেই স্থান হইতে অন্য এক্কা গ্রহণ করিব।
হোসেন। তাহা হইলে আপনাদিগকে কত টাকা গাড়িভাড়া দিতে হইবে, তাহা আমি এখন কিরূপে জানিতে পারিব? যেমন যে একা ছাড়িয়া দিবেন, অমনি তাহার ভাড়া মিটাইয়া দিলে চলিবে না?
সঃ প্রহরী। তাহা কিরূপে হইবে? সে সময় যদি আপনি উপস্থিত না থাকেন, তাহা হইলে কিরূপে ভাড়া প্রদান করিবেন?
হোসেন। আমি ত আপনাদিগের সহিত উপস্থিত আছি। যখন যাহা বলিবেন, তখনই তাহা প্রদান করিব।
সর্দ্দার-প্রহরী। এখন ত উপস্থিত আছেন দেখিতেছি; কিন্তু রাস্তা হইতে যদি আপনি চলিয়া যান, তাহা হইলে তখন আমি কি করিব? ও সকল গোলযোগেরই এখন প্রয়োজন নাই। আমার নিকট কিছু অর্থ আপনি প্রদান করুন, তাহা হইতে আমি ভাড়া প্রদান করিব। খরচ-পত্র বাদে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা পরিশেষে আমি আপনাকে ফিরাইয়া দিব।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়, তাহাই হউক। যদি আপনারা আমাকে অবিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই কুড়িটী টাকা আপনার নিকট রাখিয়া দিন।
সঃ প্রহরী। আমি আপনার নিকট ভিক্ষা করিতে বসি নাই! এখন যদি আপনি পঞ্চাশ টাকা প্রদান করেন, তাহা হইলে আমি উহা গ্রহণ করিব; নতুবা আমি আসামীদ্বয়কে হাঁটাইয়া লইয়া যাইব।
হোসেন। হাঁটাইয়া লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি পঞ্চাশ টাকাই আপনাকে প্রদান করিতেছি, তাহা হইতে আপাততঃ যে সকল খরচ-পত্রের প্রয়োজন হয়, আপনি করুন। পরে যদি আরও কিছু আবশ্যক হয়, তাহাও আমি প্রদান করিব।
এই বলিয়া হোসেন পঞ্চাশটী টাকা বাহির করিয়া সেই সর্দ্দার প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন। তিনি উহা গ্রহণ করিয়া আপনার নিকট রাখিয়া দিলেন, ও অপর প্রহরীগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, চল ভাই! আর দেরী করিবার প্রয়োজন নাই।
সর্দ্দার-প্রহরীর এই কথা শুনিয়া হোসেন কহিলেন, মহাশয়। আপনারা হস্ত মুখ প্রক্ষালনাদি সকল কার্য শেষ করিয়া লইলেন; কিন্তু ইহারা হস্ত মুখাদি ধুইবে কি না, তাহা ত কিছু জিজ্ঞাসা করিলেন।
সর্দ্দার-প্রহরী। সে কথা জিজ্ঞাসা করিবার আমাদিগের কোন প্রয়োজন নাই। কোন বিষয়ের আবশ্যক হইলে ইহারা আপনারাই আমাদিগকে বলিবেন। তখন বিবেচনা করিয়া দেখা যাইবে যে, উঁহাদিগের প্রার্থনা শ্রবণ-যোগ্য কি না।
হোসেন। আপনারা যদি কোন কথা তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা না করেন, তাহা হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।
সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার তোমার কোন অধিকার নাই। হত্যাপরাধে যাহাদিগের প্রাদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত কথা কহিয়া, তুমি আমাদিগের চাকরী লইতে চাও?
হোসেন। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিলে, আপনাদিগের চাকরী যাইবে কি প্রকারে, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছি না।
সঃ প্রহরী। চাকরী যাউক, আর না যাউক, উঁহাদিগের সহিত আমি কোনরূপে তোমাকে কথা কহিতে দিব না।
হোসেন। আপনার অনভিমতেই আমি কথা কহিব কেন? কিন্তু আমি ইহাদিগকে যদি কোন কথাই বলি, তাহা মন্দ কথা নহে। তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই।
সঃ প্রহরী। আমাদিগের কোনরূপ অনিষ্ট হউক, বা না হউক, তাহা দেখিবার তোমার কিছুমাত্র আবক নাই। মূল কথা, তুমি উঁহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতে পারিবে না।
হোসেন। যদি আমি ইহাদিগের সহিত কোন কথা কহিতেই না পারিব, তাহা হইলে আপনাদিগের সহিত আমার আসিবার কি প্রয়োজন ছিল?
সর্দ্দার-প্রহরী। প্রয়োজন ত আমি কিছুই দেখি না। না আসিলেই পারিতে।
হোসেন। আমি না আসিলে, আপনাদিগকে কে গাড়ির ভাড়া প্রদান করিত?
সঃ প্রহরী। গাড়ি ভাড়া কিছু আমাদিগের উপকারের নিমিত্ত দেও নাই। তোমারই মনিবদ্বয় হাঁটিয়া যাইতে অপারক, তাই তাঁহাদিগের নিমিত্ত গাড়ির ভাড়া প্রদান করিয়াছ। গাড়ি ভাড়া প্রদান না করিলে, আমরা অনায়াসেই উঁহাদিগকে আঁটাইয়া লইয়া যাইতে পারিতাম।
হোসেন। বলি, জমাদার সাহেব! ও সকল কথা থাক, এখন আপনাদিগের মনের কথা কি বলুন দেখি। আপনারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাতেই প্রস্তুত আছি।
সঃ প্রহরী। খুনী আসামীর সহিত কথা কহিতে দেওয়া যে কতদুর ঝুঁকির কাৰ্য, তাহা ত আপনারা জানেন না। যদি আমাদের কোনরূপ সাধ্য না থাকে, তাহা হইলে আমরা সেই ঝুকি কেন গ্রহণ করিব? আপনি বুদ্ধিমান, আপনাকে অধিক আর কি বলিব?
হোসেন। আমাকে আর বলিতে হইবে না, এ কথা আমাকে পূর্বে বলিলেই পারিতেন। আপনারা কিছু প্রার্থনা করেন, বুঝিয়াছি। বলুন, এখন আমাকে কি দিতে হইবে।
সঃ প্রহরী। আপনি বড় মানুষ, আপনাকে আমরা আর কি বলিব? আপনি আপনার বিবেচনামত কাৰ্য্য করিলেই চলিবে।
হোসেন। এখন আর আমার বুদ্ধি-মুদ্ধি কিছুই নাই, ভাল মন্দ বুঝিবার ক্ষমতা এখন দুর হইয়া গিয়াছে। এই সামান্য কাৰ্য্যের নিমিত্ত আমাকে কয়টা টাকা দিতে হইবে, তাহা স্পষ্ট করিয়া আমাকে বলুন। আমার সাধ্য হয়, আমি প্রদান করি। আর আমার ক্ষমতার অতীত হয়, তাহা হইলে এই স্থান হইতেই আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করি।
সর্দ্দারপ্রহরী। আপনাকে কিছু অধিক প্রদান করিতে হইবে। আমরা পাঁচজন বই আর নয়। আমাকে কুড়ি টাকা ও অপর চারিজনকে দশ টাকা করিয়া চল্লিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা, কেবল ষাট টাকা বৈত নয়!
হোসেন। আপনার পক্ষে ইহা অতি সামান্য টাকা; কিন্তু আমার পক্ষে ইহা খুব অধিক হইতেছে। আমি অত টাকা দিতে পারি না। আমি আপনাদিগের সম্মান রক্ষার নিমিত্ত ত্রিশ টাকা প্রদান করিতেছি।
সঃ প্রহরী। এ কাৰ্য ত্রিশ টাকায় হইতে পারে না। আপনার ইচ্ছা হয়, ষাট টাকা দিন, ইচ্ছা না হয়, এক টাকা দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি অধিক করিয়া বলি নাই, আমি যেরূপ:এক কথার লোক, সেইরূপ এক কথাই বলিয়াছি।
হোসেন। আচ্ছা মহাশয়! আমি ষাট টাকাই প্রদান করিতেছি। ইহার পর আমাকে ত আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না?
সঃ প্রহরী। উঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার নিমিত্ত আপ নাকে আর কিছু প্রদান করিতে হইবে না। কিন্তু আমাদিগের কাহারও সম্মুখে ব্যতীত নির্জনে আপনি উঁহাদিগের সহিত কোন রূপ কথা বলিতে পারিবেন না।
এইরূপ কথাবার্তার পর হোসেন ষাট টাকা প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের সহিত কথা কহিবার আদেশ পাইলেন। কিন্তু সেই সময় সবিশেষ কোনরূপ কথা কহিবার অবকাশ পাইলেন না। তাহাদিগকে তৎক্ষণাৎ এক্কার উপর আরোহণ করিতে হইল। হোসেনও আপন একায় গিয়া আরোহণ করিলেন। এক্কায় আরোহণ করিবার সময় হোসেন কেবলমাত্র তাহাদিগকে কহিলেন, জজসাহেব আপনাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ প্রদান করিয়াছেন বলিয়া যে, আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইবেই, তাহা আপনারা মনে করিবেন না। আপনার উপার্জিত বিষয়ের এক পয়সামাত্র অবশিষ্ট থাকিতে, কোনরূপেই আমি আপনাদিগের প্রাণদণ্ড হইতে দিব না। টাকাব যথেষ্ট সংগ্রহ করিয়া আমি সঙ্গেই রাখিয়াছি। হাইকোর্ট হইতে যেরূপ উপায়ে হউক, এই হুকুম রদ করাইবু। ঈশ্বর যদি একান্তই বিমুখ হন, হাইকোর্ট হইতে যদি কিছু করিয়া উঠিতে না পারি, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিয়া হউক, বড় লাটকে ধরিয়া হউক, বিলাত পর্যন্ত গড়িয়া হউক, কোন না কোনরূপে আপনাদিগকে অব্যাহতি প্রদান করাইব।
হোসেনের কথা শুনিয়া গোফুর ও ওসমান কেবল এইমাত্র কহিলেন, দেখুন, ভরসার মধ্যে ঈশ্বর?
ইহার পরেই এক্কা সকল সেই স্থান হইতে চলিল। একা, চালক অশ্বগণকে সবলে কষাঘাত করিতে লাগিল। প্রহারের ভয়ে অশ্বগণ দ্রুতবেগে গমন করিতে লাগিল। দুই ঘণ্টার পথ একঘণ্টায় চলিতে লাগিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
দিবা দ্বিপ্রহরের সময়, এক্কা সকল একটী সরাইয়ের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলে, আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ সেই স্থানে অবতরণ করিয়া সেই সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিল। সেই স্থানে কোন দ্রব্যেরই অভাব ছিল না। সরাইয়ের মধ্যেই শীতল জল-পূর্ণ একটা প্রকাণ্ড ইদারা। সরাইয়ের মধ্যস্থিত একখানি ঘরের মধ্যেই বেনিয়ার দোকান; উহাতে আটা, চাউল, ধৃত ও তরকারি প্রভৃতি আবশ্যক আহারীয় দ্রব্য এবং হড়ী, কাষ্ট, কঁচা সালপাতা প্রভৃতি সমস্তই পাওয়া যায়। প্রহরীগণ সরাইয়ের ভিতর প্রবেশ করিয়াই তাহার মধ্যে যে সকল সারি সারি ঘর ছিল, তাহার একখানির মধ্যে আসামীদ্বয়কে রাখিয়া দিল। সেই ঘরের কেবলমাত্র একটী দরজা ভিন্ন অপর জানালা দরজা আর কিছুই ছিল না; সুতরাং সেই ঘরকে একরূপ হাজত-গৃহ বলিলেও চলে। সেই ঘরের সম্মুখে দৌড় বারান্দার উপর সারি সারি পাচ খানি চারিপায়া আসিয়া পড়িল। প্রহরীগণ সেই স্থানে আপনাপন পোষাক পরিচ্ছদাদি রাখিয়া, সেই চারিপায়ার উপর উপবেশন করিল; কেহ বা লম্বা হইয়া শয়ন করিল। প্রহরীগণকে শয়ন করিতে দেখিয়া, দুই জন নাপিত (নাউ) আসিয়া তাহাদিগের পদসেবায় প্রবৃত্ত হইল, এবং দুইজন বারকনিতা আসিয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হইল। উঁহারা এইরূপ সমাগত পথিকগণের সেবা-সুশ্রুষা করিয়া আপনাপন উদরান্নের সংস্থান করিয়া থাকে। নাপিতগণের থাকিবার স্থান সেই সরাইয়ের ভিতর না থাকিলেও, দিনরাত্রি তাঁহারা সকলেই প্রায় সেই স্থানে অবস্থিতি করে; কিন্তু বার-বনিতাগণ সেই সরাইয়ের ভিতরেই একটা একটা ঘর লইয়া, তাহাতেই অবস্থিতি করিয়া থাকে।
আসামীদ্বয়ের সহিত প্রহরীগণ যেস্থানে অবস্থান করিল, তাহার পার্শ্ববর্তী অপর আর একটা কামরাতে হোসেন এবং তাহার ভৃত্যদ্বয় স্থান করিয়া লইলেন।
হোসেন একজন প্রহরীকে কহিলেন, আসামীদ্বয়কে যদি দুইখানি চারিপায়া আনাইয়া দেওয়া হয়, তাহাতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?
প্রহরী। আসামী! তাহাতে খুনী মোকদ্দমার আসামী। তাঁহারা চারিপায়ার উপর উপবেশন বা শয়ন করিবে! একথা ইতিপূর্বে আমরা আর কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই, দর্শন করা ত দূরের কথা!
হোসেন। আসামীদ্বয়কে চারিপায়ার উপর বসিতে দিবার নিয়ম নাই বলিতেছেন; কিন্তু যদি চারিপায়া দেওয়া যায়, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি আছে কি?
প্রহরী। ক্ষতি থাক বা না থাক, যদি ইহাদিগকে চারি পায়া দেওয়া যায়, তাহার ভাড়া কে দিবে?
হোসেন। চারিপায়ার ভাড়া যাহা লাগিবে, তাহা আমি দিব।
প্রহরী। আর আমাদিগকে?
হোসেন। ইহার নিমিত্ত আপনাদিগকে কিছু দিতে হইবে কি?
প্রহরী। না দিলে চারিপায়া দিতে দিব কেন?
হোসেন। আচ্ছা তাহাই হইবে। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত আমি আপনাদিগকে একটা টাকা প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। এক টাকায় হইবে না, যদি আমাদিগের প্রত্যেক কেই একটী করিয়া টাকা দেন, তাহা হইলে উঁহাদিগকে চারি পায়ার উপর বসিতে অনুমতি দিতে পারি।
হোসেন। আচ্ছা, তাহাই দিতেছি।
গোফুর। হোসেন! তুমি এরূপ ভাবে অনর্থক অর্থ ব্যয় করিতেছ কেন?
হোসেন। এ ব্যয় অনর্থক নহে। বলুন দেখি, ইতিপূর্বে আর কখনও আপনার মৃত্তিকায় বসিয়াছেন কি?
গোফুর। এখন আর আমি সেই জমিদার গোফুর খাঁ নহি যে, চারিপায় ভিন্ন বসিতে পারি না।
হোসেন। আপনি এখনও সেই গোফুর খাঁ আছেন, ইহা বেশ জানিবেন।
গোফুর। তাহা হইলে আমাদিগকে এই মিথ্যা মোকদ্দমায় আর ফাঁসি যাইতে হইত না।
হোসেন। আপনি ভাবিবেন না। উপরে কি ভগবান নাই? আপনাদিগকে কখনই ফাঁসি যাইতে হইবে না। আপনার মনকে স্থির করুন, দেখুন, আপনাদিগকে বাঁচাইয়া লইয়া যাইতে পারি কি না। দুই তিন দিবস আপনাদিগের স্নান হয় নাই, আজ স্নান করিবেন কি?
গোঁফুর। আর স্নান করিয়াই বা কি হইবে?
হোসেন। স্নান করিয়া অনেক ফল হইবে। স্নান করিলে শরীরের অনেক গ্লানি দূর হইবে, মস্তিষ্ক শীতল হইবে, তখন একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে সমর্থ হইবেন। এক মনে ঈশ্বরকে ডাকিতে পারিলে কোন বিপদ হয় কি?
গোফুর। প্রহরীরা আমাদিগকে স্নান করিতে দিবে কি?
হোসেন। সে ভার আমার উপর। মেরূপে হয়, আমি তাহার বন্দোবস্ত করিয়া লইতেছি। কেমন গো প্রহরীসাহেব। আপনা দিগের আসামীদ্বয় যদি স্নান করেন, তাহাতে আপনাদিগের, বোধ হয়, কোনরূপ আপত্তি নাই।
প্রহরী। আসামীদ্বয় স্নান করিবে! তাহা কি কখনও হইতে পারে?
হোসেন। কেন হইতে পারিবে না? এখানে আর কে তাহা দেখিতে পাইবে বা কেই বা তাহা শুনিতে পাইবে? ইহার জন্য আপনাদিগের প্রত্যেককে আট আনা এবং স্নানের পরে কিছু জল খাইরার নিমিত্ত, আট আনা করিয়া আমি প্রদান করিতেছি। ইহাতে, এখন বোধ হয়, আপনাদিগের আর কোনরূপ আপত্তি হইবে না।
প্রহরী। কোথায় স্নান করিবে? ইদারার নিকট ইহাদিগকে লইয়া যাইতে দিব না। কারণ, কি জানি যদি ইহার ইদারার ভিতর আত্ম-বিসর্জন করে, তাহা হইলে আমাদিগকে কয়েদ হইতে হইবে।
হোসেন। না, ইহাদিগকে ইদারার নিকট লইয়া যাইব না। যে স্থানে বলিবেন, সেই স্থানে বসিয়াই উঁহারা গান করিবেন।
প্রহরী। জল কোথায় পাইকেন, বা কে আনিয়া দিবে?
হোসেন। আমার সহিত দুইজন পরিচালক রহিয়াছে, এবং আমি নিজে আছি। তদ্ব্যতীত দুই চারি পয়সা দিলেই জল আনিয়া দেওয়ার লোকও পাওয়া যায়। এরূপ অবস্থায় যেস্থানে বলিবেন, সেই স্থানে জল আনাইয়া দিয়া, উঁহাদিগকে স্নান করাইয়া দিব।
প্রহরী। আর আমাদিগকে যাহা দিতে চাহিলেন, তাহা কখন দিবেন?
তাহা আমি এখনই দিতেছি, হোসেন এই বলিয়া চারিপায়া পাইবার, স্নান করিবার এবং কিছু জল খাবার খাইতে পাইবার অনুমতির নিমিত্ত প্রহরীর হস্তে দশ টাকা প্রদান করিলেন। বলা বাহুল্য, ইহার পর উক্ত কয়েকটা বিষয়ের নিমিত্ত প্রহরীগণ আর কোনরূপ আপত্তি করিল না। ভৃত্যগণ ইদারা হইতে জল উঠাইয়া আনিয়া প্রহরীগণের সম্মুখে তাহাদিগকে স্নান করাইয়া দিল। স্নান করিবার পর হোসেন কিছু জল খাবার আনাইলেন; কিন্তু প্রহরীগণ সে জল খাবার উঁহাদিগকে খাইতে না দিয়া কহিল, ইহার ভিতর আপনারা কোনরূপ বিষ প্রদান করিয়াছেন কি না, আমরা তাহা জানি না। সুতরাং আপনাদিগের আনীত জল খাবার ইহাদিগকে কখনই আহার করিতে দিব না। যাহা আনিতে হইবে, তাহা আমাদিগকে বলিয়া দিন এবং তাহার মূল্য আমাদিগকে প্রদান করুন। আমরা নিজে তাহা খরিদ করিয়া আনিয়া, আসামীদ্বয়কে প্রদান করিব।
প্রহরীগণের প্রস্তাবে হোসেন সম্মত হইলেন, এবং জল খাবার আনিবার নিমিত্ত, উঁহাদিগের একজনের হস্তে একটী টাকা প্রদান করিলেন। তাহাতে যে কিছু আহারীয় দ্রব্য আনিয়া আসামীদ্বয়কে প্রদান করা হইল, আসামীদ্বয় তাহা হইতে অতি অল্পই আহার করিলেন। অবশিষ্ট আহারীয় ও পূর্ব-আনীত আহারয় সমুদায়ই প্রহরীদিগের হইল। সেই সকল দ্রব্য আহার করিবার সময়, বিষের কথা আর প্রহরীদিগের মনে উদিত হইল না।
আমি পূর্বেই বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি যে, যে পাঁচজন প্রহরী আসামীদ্বয়কে লইয়া যাইতেছিল, তাঁহারা সকলেই মুসলমান।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
প্রহরীগণ যেরূপ ভাবে সেই সরাইতে বিশ্রাম করিতে লাগিল, তাহাতে তাঁহারা যে শীঘ্র সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবে, এরূপ অনুমান হইল না। একা-চালকগণ তাহাদিগের একার ঘোড়া একা হইতে খুলিয়া দিয়া ঘাস-দানার বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।
এই ব্যাপার দেখিয়া হোসেন সেই সর্দ্দার-প্রহরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আজ কি আপনারা এই স্থানে অবস্থান করিবেন?
প্রহরী। রাত্রিযাপন আমরা এই স্থানে করিব না। এই স্থান হইতে দুই ক্রোশ ব্যবধানে একটা খানা আছে, রাত্রিকালে সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতে হইবে।
হোসেন। এক-চালকগণ যেরূপ ভাবে একা চালাইয়া আসি তেছে, তাহাতে দুই ক্রোশ পথ গমন করিতে অতি অল্প সময়েরই প্রয়োজন হইবে।
প্রহরী। এই স্থান হইতে বাহির হইলে, একঘণ্টার মধ্যেই আমরা সেই থানায় গিয়া অনায়াসেই উপস্থিত হইতে পারি।
হোসেন। আপনারা এই স্থান হইতে কখন রওনা হইতে চাহেন?
প্রহরী। একটু বিশ্রাম করিবার পরই, আমরা এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
হোসেন। আপনাদিগের আহারাদির বন্দোবস্ত কোথায় হইবে?
প্রহরী। থানায় গিয়া উপস্থিত হইবার পর, সেই স্থানেই আহারাদি করিব, এরূপ বিবেচনা করিতেছি।
হোসেন। এই স্থানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়। এই স্থান হইতে আহারাদি করিয়া, থানায় গমন করিলে হইত না কি?
প্রহরী। তাহা হইলে আমরা কখন থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারি?
হোসেন। আহারাদির পর একটু বিশ্রাম করিয়া যদি আমরা এই স্থান হইতে রওনা হই, তাহা হইলে সন্ধ্যার পূৰ্বেই দুই ক্রোশ পথ অনায়াসেই অতিক্রম করিতে পারি। সন্ধ্যার পূর্বেই যদি আপনারা আসামীর সহিত থানায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারেন, তাহা হইলে বোধ হয়, কোনরূপ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা নাই।
প্রহরী। ক্ষতি কিছুই নাই; কিন্তু এখানে থাকিয়া আমা দিগের লাভ কি?
হোসেন। লাভ আর কিছুই নহে, কেবল সময় মত আহার করিয়া লইতে পারিবেন।
প্রহরী। এখানে আহারাদি করিবার কি সুবিধা হইবে?
হোসেন। না হইবে কেন? এখানে দেখিতেছি, সমস্ত দ্রব্যই পাওয়া যায়।
প্রহরী। এখানে আহারাদি প্রস্তুত করার পক্ষে নিতান্ত অসুবিধা হইবে।
হোসেন। কিসে?
প্রহরী। মোটে আমরা পাঁচজন বই প্রহরী নই। আমরা সকলেই এখন পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। ইহার মধ্যে আসামী দ্বয়কে পাহারাই বা কে দিবে, আহারাদির আয়োজনই বা কে করিবে?
হোসেন। আপনি যদি অনুমতি করেন, তাহা হইলে আমরাই সমস্ত আয়োজন করিয়া দিতে প্রস্তুত আছি।
প্রহরী। কে রন্ধন করিবে?
হোসেন। আমি আছি, আমার দুইজন পরিচারকও রহি আছে। অনুমতি পাইলে আহারীয় প্রস্তুত করিতে আর কত বিলম্ব হইবে?
প্রহরী। তোমাদিগের প্রস্তুত করা আহারীয় দ্রব্য আমরা কিরূপে আহার করিতে পারি?
হোসেন। কেন?
প্রহরী। আমি শুনিয়াছি, বহুদিবস হইল, এইরূপ একটী ঘটনা ঘটিয়াছিল। একজন কয়েদী-আসামীকে লইয়া দুইজন প্রহরী গমন করিতেছিল। যাইতে যাইতে পথে অপর আর একজন লোক আসিয়া তাহাদিগের সহিত মিলিত হয়। সেই ব্যক্তি সেই আসামীর দলস্থিত একজন; কিন্তু এ পরিচয় সে পূর্বে সেই প্রহরীদ্বয়ের নিকট প্রদান করে নাই। ক্রমে তাঁহারা এইরূপ একটী সরাইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, এবং সেই ব্যক্তিই সকলের আহারীয় প্রস্তুত করে। প্রথমে আসামীকে আহার করান হয়, কিন্তু তাহাতে তাহার কোনরূপ অসুখ হয় না। পরিশেষে প্রহরীদ্বয় আহার করিতে বসে, কিন্তু আহার করা শেষ হইতে না হইতেই উভয়েই হতজ্ঞান হইয়া পড়ে। পরে সরাইয়ের লোজন যখন জানিতে পারে যে, দুইজন প্রহরী অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, তখন তাঁহারা সেই স্থানে গমন করে; কিন্তু সেই কয়েদী-আসামী এবং আহার-প্রস্তুতকারীকে আর তাঁহারা দেখিতে পায় না। এই সংবাদ ক্ৰমে থানায় গিয়া উপ স্থিত হয়। প্রহরীদ্বয়কে হাসপাতালে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। থানাদার নিজে আসিয়া এই ঘটনার সবিশেষ অনুসন্ধান করেন। কিন্তু অনুসন্ধানে কোন ফলই পাওয়া যায় না। উভয় ব্যক্তির মধ্যে কেহই ধৃত হয় না। অধিকন্তু প্রহরীগণ চৈতন্য লাভ করিলে জানিতে পারা যায় যে, তাহাদিগের নিকট যে সকল টাকা-পয়সা ছিল, তাহার সমস্তই অপহৃত হইয়াছে। ইহা যখন প্রকৃত ঘটনা বলিয়া সকলেই অবগত আছেন, তখন বলুন দেখি, আমরা কিরূপে আপনাদিগকে বিশ্বাস করিয়া আপনাদিগকে রন্ধন করিতে অনুমতি প্রদান করিতে পারি?
হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আপনারা আমাকে পূর্ব হইতে জানেন কি না, বলিতে পারি না। যদি আমাকে পূর্ব হইতে জানিতেন, তাহা হইলে আপ
আমাকে বোধ হয়, এতদূর অবিশ্বাস করিতে পারিতেন না। সে যাহা হউক, আপনারা যদি আমাকে বিশ্বাস করিতেই
পারেন, তাহা হইলে অপর আর কোনরূপ বন্দোবস্ত হইতে পারে না কি? অপর যেরূপ বন্দোবস্ত করিতে বলেন, আমরা সেইরূপ করিতেই প্রস্তুত আছি।
প্রহরী। আর কি বন্দোবস্ত হইতে পারে?
হোসেন। আমরা আর সমস্ত ঠিক করিয়া দিতেছি, আপনা দিগের এক ব্যক্তি অনায়াসেই পাক করিয়া লইতে পারেন।
প্রহরী। আমরা সকলেই অতিশয় ক্লান্ত। সুতরাং আমা দিগের মধ্যে কাহারও দ্বারা সেই কাৰ্য যে সম্পন্ন হইতে পারিবে, তাহা আমি বোধ করি না।
হোসেন। যদি এ কাৰ্য্য আপনাদিগের দ্বারা না হয়, তাহা হইলে আপনাদিগের মধ্যে একজন যদি রন্ধনশালার নিকট উপস্থিত থাকিতে পারেন, তাহা হইলে আমার সমভিব্যাহারী একজন লোকের দ্বারা আমি কাৰ্য্য করাইয়া লইতে পারি। আপনাদিগের সম্মুখে যদি আহারীয় প্রস্তুত হয়, তাহা হইলে আমরা উহাতে কিরূপে বিষ মিশ্রিত করিতে পারিব?
প্রহরী। অত গোলযোগে কায নাই। আমরা একরূপ জলযোগ করিয়াছি, এখন আর আহার করিবার ইচ্ছা নাই। সুতরাং আহারীয় প্রস্তুত করিবার আর প্রয়োজন কি? আপ নারা ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আহারাদি প্ৰস্তুত করিয়া অনায়াসেই আহার করিতে পারেন।
হোসেন। আমি আমাদিগের আহারের নিমিত্ত বলিতেছি না। আপনারা যে আসামীদ্বয়ের সহিত আসিয়াছেন, তাঁহাদিগের আজ কয়েকদিবস হইতে আহার হয় নাই; কোন দিন অনাহারে, কোন দিন জলাহারে, দিন অতিবাহিত করিয়া আসিতেছেন। ইহাদিগের অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহা পরে হইবে; কিন্তু এখন আমাদিগের ইচ্ছ, উঁহাদিগকে কিছু আহার করাই। এই নিমিত্ত আপনাদিগকে এত অনুরোধ করিতেছি।
প্রহরী। উঁহারা ত এখনই আহার করিলেন?
হোসেন। বাজারের মিষ্ট দ্রব্যাদি ভোজন করিয়া কোন্ ব্যক্তি কয় দিবস জীবনধারণ করিতে পারে?
প্রহরী। যখন আপনারা আহারাদি প্রস্তুত করিবার নিমিত্ত এতই ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন, তখন আমার সম্মুখে আপনারা আমা দিগের সকলের আহারীয় প্রস্তুত করুন। আহারীয় প্রস্তুত করি বার সময় আমি অনায়াসেই বুঝিতে পারি যে, ইহাতে আপনা দিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি আছে কি না।
হোসেন। এ উত্তম কথা।
উভয়ের মধ্যে এইরূপ কথাবার্তা হইবার পর, হোসেন নিজের অর্থ ব্যয় করিয়া সকলের আহারাদির উদ্যোগ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
একজন প্রহরীর তত্ত্বাবধানে সময়মত আহারীয় দ্রব্য সকল প্রস্তুত হইল। তখন হোসেন কহিলেন, এখন আহারীয় প্রস্তুত হইয়াছে, অনুমতি হইলে সকলেই ভোজন করিয়া লইতে পারেন।
প্রহরী। সকলের ভোজন একবারে হইতে পারে না। প্রথমে তোমরা ভোজন কর, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। আমরা অগ্রে ভোজন করিব কেন? আপনাদিগের আহারাদি হইয়া গেলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
প্রহরী। তাহা হইতে পারিবে না। তোমরা অগ্রে ভোজন করিলে, তাহার পর আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। যদি আপনারা নিতান্তই অগ্রে ভোজন না করেন, তাহা হইলে সকলেই এক সময় ভোজন করা যাউক। আপনারা থাকিতে আমরা কিরূপে অগ্রে খাইতে পাক্সি?
প্রহরী। তাহাও হইতে পারে না।
হোসেন। কেন?
প্রহরী। তোমরা ভোজন করিলে, তাহার পর তোমাদিগের কিরূপ অবস্থা হয়, তাহা অগ্রে দেখিয়া, পরিশেষে আমরা ভোজন করিব।
হোসেন। আপনার এ কথার অর্থ ত আমি কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
প্রহরী। বুঝিতে না পারিয়া থাকেন, আমি বুঝাইয়া দিতেছি। আমাদিগের তত্ত্বাবধানে আপনারা আহারীয় দ্রব্য প্রস্তুত করিয়াছেন সত্য; কিন্তু আমাদিগের অলক্ষিতে আপনারা উহার সহিত অনায়াসেই বিষ মিশ্রিত করিয়া দিতে পারেন। প্রথমে আপনারা আহার করিলেই, আমরা জানিতে পারি যে, সেই সকল আহারীয় দ্রব্যের সহিত কোনরূপ বিষাক্ত দ্রব্য মিশ্রিত আছে কি না। আহারান্তে যদি আপনাদিগের কোনরূপ বৈলক্ষণ না ঘটে, তাহা হইলে আমরা সহজেই অনুমান করিতে পারিব যে, উহার সহিত কোনরূপ বিষাক্ত ব্য মিশ্রিত নাই। ইহার পর আর আপনাদিগকে আহারীয় দ্রব্যের নিকট গমন করিতে দিব না। আমরা নিজ হস্তে সেই সকল দ্রব্য পরিবেশন করিয়া আহার করিব।
হোসেন। আপনার এ কথায় আমাদিগের কোন উত্তর নাই। আমরা আহারীয় দ্রব্যর নিকট আর গমনই করিব না। আপনারা উহা হইতে কিছু কিছু আমাদিগকে প্রদান করুন, আমরা দূরে বসিয়া আহার করি। আমরা আপনাদিগের আদেশ প্রতিপালন করিব মাত্র। কিন্তু আপনাদিগকে এবং মনিবদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া, পরিতুষ্টির সহিত কখনই আহার করিয়া উঠিতে পারিব না।
ইহার পর হোসেনের প্রস্তাব-মতই কাৰ্য্য হইল। হোসেন ও তাহার পরিচারকদ্বয় দূরে আহার করিতে বসিলেন; একজন প্রহরী তাহাদিগকে পরিবেশন করিলেন। প্রহরীগণ যখন দেখিল, হোসেন বা তাহার পরিচারকদ্বয় সেই সকল দ্রব্য আহার করিয়া সুস্থ শরীরে রহিলেন, তখন তাঁহারা তাহাদিগের নিজের আহারের উদ্যোগ করিতে লাগিল। কিন্তু আসামীদ্বয় আহার করিবে কি না, সে সম্বন্ধে কোন কথাই কহিল না। তখন হোসেন কহিলেন, আপনাদিগের আহারের উদ্যোগ হইতেছে; কিন্তু আসামীদ্বয় কখন আহার করিবেন?
প্রহরী। আসামীদ্বয়েরও কি আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছেন?
হোসেন। উঁহারাই আহার করিবেন বলিয়া, সকলের নিমিত্ত আহারীয় আমরা প্রস্তুত করিয়াছি। নতুবা আমাদিগের আহারীয় প্রস্তুত করিবার কোনরূপ প্রয়োজনই ছিল না।
প্রহরী। উহার ফাঁসি যাইবার আসামী। উঁহাদিগকে আমরা কিরূপে আহার করিতে অনুমতি দিতে পারি?
হোসেন। যাহাদিগকে ফাঁসি দিবার হুকুম হয়, ফাঁসির পূর্বে যে কয় দিবস তাঁহারা বাঁচিয়া থাকে, সে কয় দিবস কি তাহাদিগকে আহার করিতে দেওয়া হয় না। যদি সরকারের এরূপ কোন নিয়ম থাকে, তাহা আমি অবগত নহি। বরং লোক-পরম্পরায় শুনিতে পাওয়া যায়, ফঁসি যাইবার পূর্বে ফাঁসির আসামী যাহা খাইতে চাহে, সরকার হইতে তাহাই তাহাকে খাইতে দেওয়া হয়। সে যাহা হউক, এত পরিশ্রম করিয়া যখন আমরা আহারীয় প্রস্তুত করিয়াছি, তখন উঁহাদিগকে কিছু আহার করিতে দিয়া আমাকে সবিশেষরূপ অনুগৃহীত করুন।
প্রহরী। উঁহারা আহার করুন, বা না করুন, তাহাতে আপনার ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?
হোসেন। ক্ষতি নাই? খুব ক্ষতি আছে। যিনি আমার অন্নদাতা, তিনি আহার করিতে পাইবেন না, আর আমরা আহার করিয়া বসিয়া আছি! ইহা অপেক্ষা দুঃখের বিষয় আর কি হইতে পারে? আমি আপনাদিগকে সবিশেষরূপ অনুবোধ করি তেছি, উঁহাদিগের আহার করিতে দিবার পক্ষে কোনরূপ প্রতি। বন্ধক হইবেন না। উঁহারা যেরূপ মনঃকষ্টে আছেন, তাহাতে যে আহার করিতে পারিবেন, সে ভরসা আমার নাই; তবে আহার করিতে বসিয়াছেন, ইহা দেখিলেই আমার মনটা একটু সন্তুষ্ট হইবে, এই মাত্র। এই অনুগ্রহের নিমিত্ত যদি আপনাদিগের আরও কিছু লইবার প্রত্যাশা থাকে, তাহাও আমাকে স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারেন।
প্রহরী। যখন আপনি এরূপ ভাবে অনুরোধ করিতেছেন, তখন আপনার অনুবোধই বা রক্ষা না করি কি প্রকারে? তবে জানেন কি, আমরা পেটের দায়ে চাকুরী করিতে আসিয়াছি, তাই আপনাকে বলিতেছি।
হোসেন। ইহার জন্য এত গোলযোগ করিবার প্রয়োজন কি? আপনারা যখন যাহা চাহিতেছেন, আমি তখনই তাহা আপনা দিগকে প্রদান করিতেছি। প্রথমেই এ কথা আমাকে বলিতে পারিতেন! আপনাদিগের প্রস্তাবে যদি আমি সম্মত হইতে পারি তাম, তাহা হইলে উঁহাদিগের নিমিত্ত আহারীয় প্রস্তুত করিতাম, আর যদি সেই প্রস্তাব আমার সাধ্যাতীত হইত, তাহা হইলে আপনাদিগকে সেলাম করিয়া আমি ধীরে ধীরে প্রস্থান করিতাম। আচ্ছা, এখন বলুন দেখি, উঁহাদিগকে আহার করিবার অনুমতি দিবার নিমিত্ত আপনারা কি প্রার্থনা করেন?
প্রহরী। পঁচিশ টাকা।
হোসেন। আপনারা পাচজন আছেন, আপনাদিগের প্রত্যেক কেই পঁচিশ টাকা করিয়া আমাকে প্রদান করিতে হইবে?
প্রহরী। না, মোট পচিশ টাকা প্রদান করিলেই হইবে।
হোসেন। পঁচিশ টাকা আমি প্রদান করিতে পারিব না। আপনারা পাঁচজন আছেন, প্রত্যেককে দুই টাকা হিসাবে মোট আপনাদিগকে আমি দশ টাকা প্রদান করিতেছি। ইহাতে আপ নারা সম্মত হইয়া আসামীদ্বয়কে আহার করিবার নিমিত্ত অনুমতি প্রদান করেন ভালই, নতুবা আমি এ স্থান হইতে প্রস্থান করি তেছি, আপনাদিগের মনে যাহা উদয় হয়, তাহা করিবেন।
প্রহরী। আপনাকে আর প্রস্থান করিতে হইবে না। দশ টাকা নিতান্ত অল্প হইতেছে, আর পাঁচটী টাকা বাড়াইয়া দিন।
হোসেন। পাঁচ টাকা ত দূরের কথা, দশ টাকার উপর আমি আর পাঁচটা পয়সাও, বাড়াইয়া দিতে পারিব না। ইহাতে আপনা দিগের যাহা অভিরুচি হয়, তাহা করিতে পারেন।
প্রহরী। যে কাৰ্যে আপনারা অসন্তুষ্ট হন, সে কাৰ্য্য আমা দিগের কোনরূপেই কৰ্তব্য নহে। আচ্ছা, আপনার প্রস্তাবেই আমরা সম্মত হইলাম। টাকা দশটী কথন প্রদান করিবেন?
হোসেন। যখন আপনাদিগের আবশ্যক হইবে, তখনই আপনারা লইতে পারেন। এখনই চাহেন, তাহাও আমাকে বলুন, এখনই আমি উহা আপনাদিগের হস্তে প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। সেই ভাল। আমি একাকী নহি, পাঁচজনের কাৰ্য্য, অগ্রে দেওয়াই ভাল।
প্রহরীর কথা শুনিয়া হোসেন আর কোন কথা কহিলেন, দশটী টাকা বাহির করিয়া তৎক্ষণাৎ সেই প্রহরীর হস্তে প্রদান করিলেন।
হোসেন টাকা প্রদান করিলেন সত্য; কিন্তু মনে মনে বড়ই অসন্তুষ্ট হইলেন। মনে করিলেন, এরূপ অত্যাচার করিয়া টাকা লওয়া নিতান্ত অন্যায়। আসামীর সহিত কথা কহিবার প্রয়োজন হইলে টাকা ভিন্ন হইতে পারিবে না! স্নানের নিমিত্ত টাকা, জলপানের নিমিত্ত টাকা, আহারের নিমিত্ত টাকা, এবং বিশ্রাম করিবার নিমিত্ত একখানি চারিপায়া প্রদান করিতে হইলেও টাকা! কি ভয়ানক অত্যাচার! এই সকল অত্যাচারের নিমিত্তই পুলিসের এত দুর্নাম।
হোসেন মনে মনে এইরূপ ভাবিতে লাগিলেন সত্য; কিন্তু প্রকাশ্যে কোন কথা কহিতে পারিলেন না।
গোফুর খাঁ ও ওসমান, প্রথমতঃ কিছুতেই আহার করিতে সম্মত হইলেন না। কিন্তু কোন প্রকারেই হোসেনের অনুরোধ লম্বন করতে না পারিয়া, আহার করিবার নিমিত্ত একবার বসিলেন মাত্র; ফলতঃ আহার করিতে পারিলেন না, চক্ষু-জলে আহারীয় ভাসিয়া যাইতে লাগিল।
আহারান্তে প্রহরীগণ আপনাপন চারিপায়ার উপর শয়ন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিল। কেবল একজন মাত্র প্রহরী আসামীদ্বয়কে পাহারা দিতে লাগিল। আসামীদ্বয় সেই গৃহের ভিতর কয়েদী অবস্থায় বিষন্ন মনে বসিয়া রহিলেন।
এইরূপে প্রায় সমস্ত দিবস সেই স্থানে অতিবাহিত হইয়া গেল। সন্ধ্যা হইতে অতি অল্পমাত্র বাকী আছে, সেই সময় একজন প্রহরী এক্কা-চালকগণকে ডাকিল ও কহিল, বেলা প্রায় অবসন্ন হইয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকদূর আমাদিগকে গমন করিতে হইবে, আর বিলম্ব করিবার প্রয়োজন নাই। একা সকল শীঘ্র প্রস্তুত করিয়া আন, আমরা এখনই এই স্থান হইতে প্রস্থান করিব।
প্রহরীর কথা শুনিয়া এক্কা-চালকগণ তখনই এ প্রস্তুত করিয়া আনিল। প্রহরীগণ আসামীদ্বয়ের সহিত উহাতে আরোহণ করিল, হোসেনও আপনার দুইজন পরিচারকের সহিত আপন একায় আরোহণ করিয়া তাহাদিগের এক্কার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিলেন। এক্কা-চালকগণ অখে কষাঘাত করিতে করিতে বেগে একা চালাইতে আরম্ভ করিল।
সন্ধ্যার অল্প পরেই সকলে একটী থানায় গিয়া উপস্থিত হইল। সেই স্থানে সকলে একা হইতে অবতরণ করিয়া থানার ভিতর প্রবেশ করিলেন। থানায় সেই সময় দারোগা উপস্থিত ছিলেন না, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে তিনি স্থানান্তরে গমন করিয়াছিলেন। অনুসন্ধানে হোসেন জানিতে পারিলেন যে, সেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী অর্থাৎ দারোগাও একজন মুসলমান বংশ-সম্ভূত।
যে সকল এক্কায় আরোহণ করিয়া আমাশয়, প্রহরীগণ ও হোসেন প্রভৃতি গমন করিয়াছিলেন, এখন সেই সকল এক বিদায় করিয়া দিবার প্রয়োজন হইল। কারণ, তাঁহারা অনেকদূর আগমন করায়, তাহাদিগের অশ্বগণ সবিশেষরূপ ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। তদ্ব্যতীত সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার সময় সেই স্থানে যতগুলি একার প্রয়োজন হইবে, ততগুলিই অনায়াসে পাওয়া যাইবে।
এইরূপ বন্দোবস্ত দেখিয়া, যে এক্কায় হোসেন তাহার ভৃত্য দ্বয়ের সহিত আগমন করিয়াছিলেন, তাহাকে ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন। সেই এক্কা-চালককে যে পরিমিত ভাড়া দিবার নিমিত্ত প্রহরীগণ বলিয়া দিল, হোসেন তাহাতে দ্বিরুক্তি না করিয়া তাহাই দিয়া দিলেন। একা-চালক আপনার ভাড়া পাইয়া থানার বাহিরে গিয়া উপবেশন করিল।
কেবলমাত্র একখানি এক্কার ভাড়া দিতে দেখিয়া একজন প্রহরী কহিল, আপনি কেবলমাত্র একখানি একার ভাড়া দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন দেখিতেছি। আর অপর এক্কা তিনখানি, যাহাতে আপনার মনিবদ্বয় এবং আমরা আসিয়াছি, তাহার ভাড়াও ওই সঙ্গে দিলেন না কেন?
হোসেন। আপনাদিগের একা-ভাড়া প্রভৃতি যাহা কিছু ব্যয় হইবে, তাহার নিমিত্ত আমি এককালীন আপনাদিগকে পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিয়াছি। তাহা হইতে একা-ভাড়া প্রদান করিতে আপনাদিগের কোনরূপ আপত্তি আছে কি?
প্রহরী। আপত্তি আর কিছুই নাই, তবে এখন আপনি দিয়া দিলেও কোন ক্ষতি নাই।
হোসেন। আমি একবার প্রদান করিয়াছি। বলেন না হয়, আর একবার প্রদান করি। যখন আমরা সম্পূর্ণরূপে আপনাদিগের হাতে পড়িয়াছি, তখন যাহা বলিবেন, তাহাই করিতে হইবে।
প্রহরী। আপনি অসন্তুষ্ট হইবেন না। একা-ভাড়া এখন আপনি প্রদান করুন, বা আমরা প্রদান করি, তাহাতে কোনরূপ ক্ষতি নাই। কারণ, আমাদিগের নিকট আপনার যে পঞ্চাশ টাকা আছে, খরচ-পত্ৰ বাদে তাহা হইতে যাহা অবশিষ্ট থাকিবে, তাহা আপনারই। আর যদি উহাতে সমস্ত খরচের সঙ্কুলান না হয়, তাহা হইলে আর যাহা লাগিবে, তাহা আপনাকে দিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় সামান্য একা-ভাড়ার নিমিত্ত এত গোলযোগ করিতেছেন কেন?
হোসেন। আমি কোনরূপ গোলযোগই করিতেছি না। যে টাকা আপনাদিগের নিকট আছে, তাহা হইতে এক্কা-ভাড়া প্রদান করিতে যদি আপনাদিগের কোনরূপ অসুবিধা হয়, তাহা হইলে এখনই আমি উহা প্রদান করিতেছি।
প্রহরী। অসুবিধা আর কিছুই নয়। তবে টাকাগুলি যেরূপ ভাবে বাঁধিয়া রাখা আছে, তাহা হইতে কিছু টাকা বাহির করিয়া লইতে হইলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। তাই যাহাতে এক্কা ওয়ালাগণের আর বিলম্ব না হয়, সেই নিমিত্ত ভাড়াটা এখন আপ, নাকে দিতে বলিয়াছিলাম। ইহাতে আমাদিগের কোনরূপ দুরভিসন্ধি নাই।
হোসেন। সামান্য টাকার নিমিত্ত আর অধিক কথার প্রয়ো জন নাই। আমি এখন উহা প্রদান করিতেছি, যেরূপ ভাল বিবেচনা হয়, পরিশেষে আপনারা তাহা করিবেন।
এই বলিয়া হোসেন আর তিনখানি একার ভাড়াও আপনার নিকট হইতে উঁহাদিগকে দিয়া দিলেন।
আপনাপন ন্যায্য মজুরি বুঝিয়া লইয়া একাওয়ালাগণ সেই স্থান হইতে তখনই প্রস্থান করিল।
প্রহরীগণের ব্যবহার দেখিয়া হোসেন মনে মনে ভাবিলেন, উঁহাদিগের খরচের নিমিত্ত যে পঞ্চাশ টাকা দেওয়া হইয়াছে, তাহা পাইবার আর কোনরূপ উপায় নাই। অথচ আরও যাহা কিছু খরচ হইবে, তাহার সমস্তই তাঁহাকে বহন করিতে হইবে।
এই সময় গোফুর খাঁ হোসেনকে তাহার নিকট ডাকিলেন। হোসেন তাহার নিকট গমন করিলে তিনি কহিলেন, হোসেন। আমি দেখিতেছি, তুমি নিরর্থক অনেক অর্থ নষ্ট করিতেছ।
হোসেন। আপনাদিগের জীবন অপেক্ষা কি অর্থের মূল্য অধিক? যে আপনাদিগের নিমিত্ত আমি সেই অর্থ ব্যয় করিব না?
গোফুর। আমাদিগের জীবন রক্ষার নিমিত্ত অর্থ ব্যয় করিতে আমাদিগের কিছুমাত্র আপত্তি নাই। কিন্তু এইরূপ নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিয়া কি আমাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারিবে?
হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবন রক্ষা করিতে পারি না সত্য; কিন্তু আপাততঃ আপনাদিগের কষ্টের অনেক লাঘব করিতে সমর্থ হইব।
গোফুর। যাহাদিগের জীবনের আর কিছুমাত্র আশা নাই, দুই চারিদিবসের নিমিত্ত তাহাদিগের শারীরিক কষ্ট নিবারণ করিয়া ফল কি? মানসিক কষ্টের নিকট শারীরিক কষ্ট কিছুই নহে। যে ব্যক্তি সর্বদা মানসিক কষ্ট ভোগ করিতেছে, তাহার যতই কেন শারীরিক কষ্ট হউক না, তাহার দিকে তাহার লক্ষ্যই হয় না।
হোসেন। আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা প্রকৃত। কিন্তু আমাদিগের সম্মুখে আপনি শারীরিক কষ্ট ভোগ করিবেন, অর্থ থাকিতে আমরা কিরূপে উহা দেখিতে সমর্থ হইব? আর আপনাদিগের জীবনের আশা নাই, এ কথাই বা আপনারা কিরূপে অনুমান করিলেন?
গোফুর। যাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার আর জীবনের আশা কি?
হোসেন। এখনও অনেক আশা আছে। যে বিচারালয় হইতে আপনাদিগের ফাঁসির হুকুম হইয়াছে, তাহার উপর বিচারালয় আছে। সেখানে আপীল করিব, যেরূপ ভাবে ও যত অর্থ ব্যয় করিয়া চেষ্টা করিতে হয়, তাহা করিব। ইহাতে কি কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব না? ঈশ্বর না করুন, যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে ছোট লাটকে ধরিব; আবশ্যক হইলে বড় লাটের নিকট পর্যন্ত গমন করিব। পরিশেষে বিলাত পর্যন্ত চেষ্টা করিব। ইহাতেও কি সুবিচার হইবার সম্ভাবনা নাই? যদি ইহাতেও না পারি, তাহ হইলে অর্থ ব্যয় করিয়া, আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত অসৎ উপায় অবলম্বন করিতে ক্রটি করিব না। আপনি আপনার মনকে স্থির করিয়া রাখুন। দেখিবেন, যেরূপ উপায়েই হউক, কখনই আপনাদিগকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিতে দিব না।
গোফুর। তুমি যাহা মনে করিতেছ, তাহা সম্পূর্ণরূপ অসম্ভব। ইহা কখনই হইতে পারে না।
হোসেন। জগতে অসম্ভব কিছুই নাই; অর্থে না হইতে পারে, এরূপ কোন কাৰ্য্যই নাই। দেখিবেন, যাহা মুখে বলিতেছি, কাৰ্যে তাহা পরিণত করিতে পারি কি না!
গোফুর। আমার বিবেচনায় তুমি আর নিরর্থক অর্থ ব্যয় করিও না। আমাদিগের নিমিত্ত এইরূপ ভাবে যে অর্থ ব্যয় করিবে, তাহা আমাদিগের নামে দরিদ্র ব্যক্তিকে দান করিও। তাহা হইলে আমাদিগের পরকালের অনেক উপকার করা হইবে। ইহকালে যাহা হইবার, তাহা হইল।
হোসেন। গরিব-দুঃখীকে আপনারা যেরূপ ভাবে অর্থ দান করিতে কহিবেন, তাহা আমরা করিব। তদ্ব্যতীত আপনাদিগের জীবন-রক্ষা করিবার নিমিত্ত প্রাণপণে চেষ্টা করিতে ক্রটি করিব না। বিশেষ–
গোফুর। বিশেষ কি?
হোসেন। এরূপ ভাবে অর্থ আমি যে নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতেছি, তাহা নহে। আপনার বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ সকলেই আপনাদিগের জীবনের নিমিত্ত তাহাদিগের সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ও তাঁহাদিগের সমস্ত অলঙ্কার-পত্র পর্যন্ত আমার হস্তে প্রদান করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এবং বলিতেছেন, যদি কোনরূপে আমি আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিতে সমর্থ না হই, তাহা হইলে তাঁহারা সকলেই বিষপান করিয়া আপনাপন জীবন নষ্ট করিবেন। আমি যদিচ এখন তাঁহাদিগের নিকট হইতে কোন অর্থ গ্রহণ করি নাই, তথাপি যদি আমি এইরূপ ব্যয় করিয়া আপনাদিগের জীবন রক্ষার কোনরূপ উপায় না করি, তাহা হইলে কি সর্বনাশ ঘটিবে, একবার মনে করিয়া দেখুন দেখি? : গোফুর। বাড়ীর স্ত্রীলোকগণ যখন আমাদিগের জীবনের নিমিত্ত এত উৎসুক, তাঁহাদিগের নিমিত্ত কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিয়াছেন?
হোসেন। সে সম্বন্ধে আমি এ পর্যন্ত কিছুই মনে ভাবি নাই। কারণ, আমার বিশ্বাস, এ সম্বন্ধে আমার কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না!
গোফুর। কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার প্রয়োজন হইবে না কেন?
হোসেন। যখন আমার বিশ্বাস যে, যেরূপে পারি, আপনা দিগের জীবন রক্ষা করিব, তখন আমার সেই সকল দিকে এখন দৃষ্টি করিবার কোনরূপ প্রয়োজন নাই। যেরূপ ভাবে এ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে, এখন সেইরূপ ভাবেই চলুক। পরিশেষে আপনারা নিষ্কৃতি লাভ করিয়া যখন বাড়ীতে প্রত্যাবর্তন করিবেন, সেই সময় আপনার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ করিবেন।
গোফুর। সে বহুদূরের কথা।
হোসেন। আমি দিব্য চক্ষে দেখিতে পাইতেছি, উহা দূরের কথা নহে।
গোফুর। সে পরের কথা। আমাদিগকে বাঁচাইতে পারিবে, এরূপ লুব্ধ আশ্বাসের উপর একবারে নির্ভর করিয়া থাকিও না। আমাদিগকে খালাস করিবার যতদূর চেষ্টা করিতে হয়, কর; অথচ অপরাপর বন্দোবস্তের দিকেও সবিশেষরূপ দৃষ্টি রাখিও। কারণ, যদি আমাদিগের জীবন রক্ষাই না হয়, তাহা হইলে আমি বাঁচিয়া থাকিতে থাকিতে আমার ইচ্ছামত বিষয়-আদির বন্দোবস্ত করার আবশ্যক। জমিদারী সম্বন্ধে কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছা করিতেছ?
হোসেন। এখনও কোনরূপ বন্দোবস্ত করিবার চেষ্টা করি নাই। যেরূপ আদেশ করিবেন, সেইরূপ ভাবেই বন্দোস্ত করিব।
গোফুর। মোকদ্দমা খরচের নিমিত্ত যে টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছ, সেই টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ নষ্ট করিতে হইয়াছে কি?
হোসেন। টাকার নিমিত্ত জমিদারীর কোন অংশ আমি নষ্ট করি নাই, বা উহা বন্ধক দিতেও হয় নাই। সরকারী তহবিলের যে যে স্থানে যে যে টাকা মজুত ছিল, তাহাই সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছি মাত্র। যদি কিছু দেনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার নিমিত্ত বিষয়-আদি কিছুই বন্ধক দিতে হইবে না। সমস্ত জমিদারী এ পর্যন্ত যেরূপ ভাবে ছিল, এখনও সেইরূপ ভাবেই আছে।
হোসেন ও গোফুর খাঁর সহিত এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময়ে একজন প্রহরী আসিয়া আসামীদ্বয়কে হাজতের ভিতর বদ্ধ করিয়া দিল। সুতরাং উভয়ের কথাবার্তা সেই সময়ের নিমিত্ত শেষ হইয়া গেল। আসামীদ্বয় সবিশেষ দুঃখিত অন্তঃকরণে হাজতের ভিতর প্রবেশ করিলেন।
সম্পূর্ণ।