বাইজী

বাইজী 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

ফাল্গুন মাস। বেলা আটটি বাজিয়া গিয়াছে। আকাশ কুঞ্ঝাটিকায় আচ্ছন্ন। সূর্য্যের প্রখর কিরণজাল সেই ভয়ানক কুাটিকা ভেদ করিতে পারে নাই। এত অন্ধকার যে, কোলের মানুষ পৰ্য্যন্ত দেখা যায় না। 

আমি অফিস-ঘরে বসিয়া আছি; এমন সময় একজন কনেষ্টবল আমার নিকট দৌড়িয়া আসিল; বলিল “বড় সাহেব আসিতেছেন।” 

আমি তখনই ঘর হইতে বাহির হইলাম। সাহেব গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া আমার নিকটে আসিলেন। আমি অতি সমাদরে তাঁহার অভ্যর্থনা করিলাম। তিনি সহাস্যবদনে বলিলেন “মেছুয়াবাজারে মালতীবাইয়ের প্রিয় ভৃত্য সুন্দরলাল খুন হইয়াছে। তাহার মৃতদেহ খিদিরপুরের পোলের নিকট পাওয়া গিয়াছে। আমার গাড়িতে বাইজীর লোক আছে, তুমি তাহাকে লইয়া সত্বর সেই স্থানে যাও, এবং সাধ্যমত অনুসন্ধান করিয়া হত্যাকারীকে ধৃত করিবার চেষ্টা কর।” এই বলিয়া সাহেব প্রস্থান করিলেন। 

বাইজীর সেই লোককে লইয়া আমি খিদিরপুরে পোলের নিকট উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম, কয়েকজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী ও কতকগুলি লোক সেই মৃতদেহ বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। 

আমাকে দেখিয়া কনেষ্টবলগণ জনতা সরাইয়া দিল। আমি সেই মৃতদেহ পরীক্ষা করিতে লাগিলাম; দেখিলাম, যুবকের বয়স প্রায় বাইশ বৎসর; তাহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, হৃষ্টপুষ্ট ও বলিষ্ঠ; তাহার হস্তদ্বয় আজানুলম্বিত, বক্ষ উন্নত, চক্ষু আয়ত, মুখশ্রী অতি সুন্দর। ভৃত্যের কার্য্য করিলেও তাহাকে ভদ্রসন্তান বলিয়া বোধ হইল। তাহার পরিধানে একখানি নরুণপেড়ে দেশী ধুতি, গায়ে একটি লংক্লথের পাঞ্জাবী জামা, মস্তকে একটি সাদা স্কুল ফুল কাটি কাপড়ের টুপী, জামার ভিতরে গোলাপী রঙের গেঞ্জি, পায়ে একজোড়া বার্ণিস করা পাম্প-সু। তাহার পার্শ্বেই একখানা বাইসিকেল পড়িয়া ছিল। তাহার বাম বক্ষে একটি ছিদ্র, সেই ছিদ্র দিয়া রক্তস্রোত প্রবাহিত হইয়া, সেই স্থান প্লাবিত করিয়াছিল। তাহার সর্ব্বশরীর বরফের ন্যায় শীতল; দেখিয়া বোধ হইল, অনেক পূর্ব্বে তাহার মৃত্যু হইয়াছে! 

ভৃত্যের মৃতদেহ ও তাহার বাইসিকেল বিশেষরূপে পরীক্ষার পর আমি সে স্থানটি ভাল করিয়া অনুসন্ধান করতঃ বাইজীর লোককে সঙ্গে লইয়া বাইজীর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। 

মেছুয়াবাজারের মালতীবাই একজন প্রসিদ্ধ নর্তকী ও গায়িকা। কলিকাতার প্রায় সকল বড় লোকই মালতীবাইয়ের নাম শুনিয়াছেন। 

বাইজীর বাড়ী দ্বিতল ও প্রকাণ্ড। দ্বিতলের বারান্দার চিক ফেলা। দরজায় একজন দরোয়ান ছিল। আমাকে বাইজীর সেই লোকের সঙ্গে উপস্থিত দেখিয়া, সে অতি সমাদরে আমাকে বাইজীর নিকট লইয়া গেল। 

বাইজীর নাম শুনিয়াছিলাম বটে, কিন্তু তাঁহার সহিত এপর্য্যন্ত সাক্ষাৎ হয় নাই। বাইজীকে দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, এমন রূপ ত কখনও দেখি নাই। 

বাইজীর বয়স প্রায় আঠার বৎসর, কিন্তু সহসা দেখিলে আরও কম বলিয়া বোধ হয়। তাঁহাকে দেখিতে রক্তিমাভ গৌরবর্ণ, তাঁহার মুখশ্রী ও অঙ্গসৌষ্ঠব সাধারণ রমণীগণের অপেক্ষা অনেক সুন্দর। 

বাইজীর আদব কায়দা আরও চমৎকার। ভদ্র ও বড় ঘরের সন্তানদিগের সহিত বসবাস করিয়া, বাইজীর চাল-চলন, কথাবার্তা সকলই সুন্দর। দূর হইতে আমাকে দেখিয়া বাইজী বিমর্ষভাবে আমার নিকট আসিয়া এক সুদীর্ঘ সেলাম করিলেন এবং যত্ন সহকারে আমাকে এক সুসজ্জিত প্রকোষ্ঠে লইয়া গেলেন। 

সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া আমি একখানি চেয়ারে উপবেশন করিলাম। বাইজীও আমার নিকট আর একখানি চেয়ার আনাইয়া তাহার উপর বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার অবস্থা দেখিয়া আমার স্পষ্টই প্রতীয়মান হইল যে, তিনি ভৃত্যের অকালমৃত্যুতে কাতর হইয়া পড়িয়াছেন। তাঁহার চক্ষুও গণ্ডস্থল দেখিয়া বোধ হইল, তিনি সমস্ত রাত্রি রোদন করিয়াছেন। 

কিছুক্ষণ পরে আমি বাইজীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ভৃত্যটি আপনার নিকট কতদিন চাকরী করিতেছে?” 

অতি বিমর্ষভাবে বাইজী উত্তর করিলেন, “প্রায় ছয় বৎসর সুন্দরলাল আমার নিকট চাকরী করিতেছে।” যদিও আমি সাহেবের মুখে ওই নাম শুনিয়াছিলাম, তবুও জিজ্ঞাসা করিলাম, “সুন্দরলাল কে?” 

বা। আমার ভৃত্য, যে গত রাত্রে খুন হইয়াছে। 

আ। কাল কখন সে এ বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিল? 

বা। বৈকালে—বেলা তখন বোধ হয় চারিটি বাজিয়া গিয়াছিল। 

আ। কোথায় গিয়াছিল? 

বা। গার্ডেনরিচে আমার একখানা বাগান আছে। সম্প্রতি সেখানে আমার কনিষ্ঠ ভগ্নী বসন্ত বাইজী বাস করিতেছেন। সুন্দরলাল তাঁহারই নিকট আমার এক পত্র লইয়া গিয়াছিল। 

আ। গত রাত্রেই কি সুন্দরলালের ফিরিবার কথা ছিল? 

বা। হ্যাঁ। পত্রখানি বসন্তের হাতে দিয়াই তাহাকে ফিরিয়া আসিতে পালন করিয়াছিলাম। 

আ। সুন্দরলালের কোন শত্রু আছে আপনি জানেন? 

বা। সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। 

আ। কাল কত রাত্রে সুন্দরলালের এখানে পঁহুছিবার কথা ছিল। 

বা। অনুমান রাত্রি নয়টা। 

আ। কেন? 

বা। একজন ভৃত্যের মুখে শুনিলাম, গত রাত্রে কুয়াসা হইয়াছি। চারিদিক ভয়ানক অন্ধকার। সুন্দরলালের সন্ধানে লোক পাঠাইতে ইচ্ছা করিলে, সেই ভৃত্য বলিল, হয় ত সেই কুয়াসার জন্যই সুন্দরলালের আসিতে বিলম্ব হইতেছে। বিশেষতঃ সে বাইসিকেল করিয়া গিয়াছিল, ভ্রম বশতঃ তাহার লণ্ঠনটি লইয়া যায় নাই। তাই ভাবিলাম, সুন্দরলাল হয় ত বাড়ী ফিরিতে পারিবে না। 

আ। আজ প্রাতে লোক পাঠাইয়াছিলেন? 

বা। হাঁ, ভোর পাঁচটির সময় আমার দরোয়ানকে বাগানে পাঠাইয়াছিলাম। শুনিলাম, সুন্দরলাল গতরাত্রেই বাগান হইতে, চলিয়া আসিয়াছে। 

আ। তখন রাত্রি কত? 

বা। প্রায় এগারটি। 

আ। সে কি একাই সেখান হইতে বাহির হইয়াছিল? 

বাইজী ক্ষণকাল কি চিন্তা করিলেন; পরে বলিলেন, “আজ্ঞে হাঁ, একাই বাহির হইয়াছিল। কিন্তু তাহার কিছু পরেই বিনয়বাবু সেই বাগান হইতে বহির্গত হন।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “বিনয়বাবু কে?” 

বাইজী ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলেন, “তিনি আমার ভগ্নীর বন্ধু। আমার ভগ্নী গার্ডেনরিচের বাগান বাড়ীতে বাস করিতেছেন শুনিয়া, তিনি পরশ্ব রাত্রে সেখানে গিয়াছিলেন। বিনয়বাবু একজন নামজাদা লোক; তাঁহার বাড়ীর কেহ কখনও চাকরী করেন নাই। কলিকাতায় তাঁহার যথেষ্ট ভূ-সম্পত্তি আছে। তাঁহার বিষয়-সম্পত্তি অগাধ। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

বাইজী যেভাবে বিনয়বাবুর পরিচয় দিতে লাগিলেন, তাহাতে আমার কেমন সন্দেহ হইল। জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার সহিত কি বিনয়বাবুর আলাপ নাই?” 

ঈষৎ হাসিয়া বাইজী উত্তর করিলেন, “আলাপ আছে বই কি। তবে আমার ভগ্নী বসন্তের সহিত তাঁহার যেমন সদ্ভাব, আমার সহিত তেমন নাই।” 

আ। আপনার ভগ্নী কোথায় থাকেন? 

বা। এই বাড়ীতে। 

আ। তাহা হইলে বিনয়বাবুও এখানে আসিয়া থাকেন? 

বা। হাঁ, আসেন বই কি? আজ প্রাতেও তিনি এখানে আসিয়াছিলেন। 

আমি তাঁহার কথায় চমৎকৃত হইলাম, ভাবিলাম, বাইজীর উদ্দেশ্য কি? বিনয়বাবুর উপরই কি তাঁহার সন্দেহ হইয়াছে? সুন্দরলাল বাগান হইতে বাহির হইবার কিছু পরে বিনয়বাবুও বাগান হইতে বহির্গত হন। সুন্দরলাল বাইসিকেল করিয়া কলিকাতায় ফিরিতেছিল, তাহার কিছুক্ষণ পরে বাহির হইয়া বিনয়বাবু যে সুন্দরলালকে পথে দেখিয়াছিল, তাহা বিশ্বাসযোগ্য নহে। তবে যদি বিনয়বাবুও বাইসিকেল করিয়া ফিরিয়া থাকেন, তাহা হইলে হয় ত সাক্ষাৎ হইতে পারে। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি বাইজীকে জিজ্ঞাসা করিলাম “বিনয়বাবু এখানে আজ প্রাতে আসিয়াছিলেন কেন? তিনি কি সুন্দরলালের কোন সংবাদ জানেন? পথে কি উভয়ের সাক্ষাৎ হইয়াছিল?” 

আবার বাইজী আমার দিকে কটাক্ষপাত করিয়া ঈষৎ হাসিলেন। সে হাসি আমার বড় ভাল লাগিল না। আমি উত্তরের অপেক্ষায় তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলাম। 

কিছুক্ষণ পরে তিনি উত্তর করিলেন “আজ্ঞে হাঁ, পথে উভয়ের সাক্ষাৎ হইয়াছিল। বিনয়বাবু সুন্দরলালের হস্তে নিগৃহীত হইয়াছিলেন, সুন্দরলাল তাঁহাকে অপমান করিয়াছে, এই অভিযোগ করিবার জন্যই আজ প্রাতে তিনি আমার নিকট আসিয়াছিলেন।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া আপনাআপনি বলিলাম “তিনি কি বলিয়া গিয়াছেন, জানিতে পারিলে আমার সন্ধানের অনেক সুবিধা হইতে পারে।” 

পরে বাইজীকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “কাহার উপর আপনার সন্দেহ হয়?” 

বাইজী হাসিয়া উত্তর করিলেন “কেমন করিয়া বলিব? তবে বিনয়বাবু নিজে আমাকে যে সকল কথা বলিয়া গিয়াছেন, আমি তাহাই বলিতে পারি। তাঁহার কথা শুনিয়া আপনিই বিচার করিবেন। তাঁহার কথায় কাহারও উপর সন্দেহ হয় কি না, আপনি নিজেই বুঝিতে পারিবেন।” 

আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম; বলিলাম “তবে বলুন, বিনয়বাবু কি অভিযোগ করিতে আসিয়াছিলেন?” বাইজী ঈষৎ হাসিয়া আবার আমার দিকে কটাক্ষপাত করিলেন; বলিলেন, “রাত্রি দশটির পর তিনি আমার উদ্যান হইতে বাহির হন। সুন্দরলাল বাগানে গিয়াছিল কি না, এ সংবাদ তিনি রাখিতেন না। তিনিও বাইসিকেল করিয়া বাড়ী ফিরিতেছিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হইলে খিদিরপুরের পোলের নিকট একজন লোককে বাইসিকেলে চড়িয়া যাইতে দেখিলেন। তাহার গাড়িতে আলোক না থাকায় বিনয়বাবুর বাইসিকেলের সহিত তাহার বাইসিকেলের ধাক্কা লাগে। তিনি জানিতেন না যে, আমার প্রিয়তম ভৃত্য বাগানে গিয়াছিল এবং সেই রাত্রে বাইসিকেল করিয়া বাড়ীতে ফিরিতেছিল। একে তখন ভয়ানক কুয়াসা, তাহার উপর সুন্দরলালের গাড়িতে আলো ছিল না, সুতরাং বিনয়বাবু প্রথমে তাহাকে চিনিতে পারেন নাই। সেও বিনয়বাবুকে চিনিতে পারে নাই। অপর কোন লোক মনে করিয়া সে বিনয়বাবুকে উপহাস করিয়াছিল। বিনয়বাবু সে কথায় রাগান্বিত হন। কথায় কথায় কলহ উপস্থিত হয়। তখন উভয়ে উভয়কে চিনিতে পারে। জানি না, উভয়ের মধ্যে কোনরূপ বিবাদ ছিল কি না। কিন্তু আমার ভৃত্যের কথায় রাগান্বিত হইয়া বিনয়বাবু সুন্দরলালকে প্রথমে প্রহার করেন। সুন্দরলালও ছাড়িবার পাত্র ছিল না, সেও বিনয়বাবুর সম্মান রক্ষা না করিয়া তাঁহাকে প্রহার করে। বিনয়বাবু বলিলেন, সেই প্রহারে তিনি এতদূর অপমানিত হন যে, তাহাকে আর কোন কথা না বলিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন।” 

এই বলিয়া বাইজী আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি কোন কথা কহিলাম না দেখিয়া, তিনি পুনরায় বলিলেন “বিনয়বাবু আমাকে যে কথা বলিয়া গিয়াছেন, আপনাকে তাহাই বলিলাম। তাহার পর যাহা কৰ্ত্তব্য আপনিই বিবেচনা করুন?” 

বাইজীর শেষ কথা শুনিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি বিনয়বাবুকে কোন কথা বলিয়াছিলেন?” 

বা। তিনি আসিবার ঠিক পূর্ব্বেই আমি সুন্দরলালের মৃত্যু সংবাদ পাইয়াছিলাম। সুন্দরলাল আমার প্রিয় ভৃত্য, সমস্ত কার্য্যই সে করিত। বলিতে কি, অন্য লোকে আমার কার্য্য করিলে সেও রাগান্বিত হইত, আমারও তাহা মনোমত হইত না। বিনয়বাবুর মুখে বিবাদের কথা শুনিয়া আমি তাঁহাকেই কতকগুলি তিরস্কার করিয়াছি, এবং তিনিই আমার ভৃত্যকে হত্যা করিয়াছেন এ কথাও বলিয়াছি। 

আ। বিনয়বাবু কি উত্তর করিলেন? 

বা। তিনিও আমায় যৎপরোনাস্তি গালাগালি দিলেন। উভয়ের মধ্যে বিলক্ষণ বচসা হইল, শেষে বিনয়বাবু অপমানিত, লজ্জিত ও তিরস্কৃত হইয়া এখান হইতে প্রস্থান করিলেন। 

আ। বিনয়বাবুর বাড়ী কোথায়? 

বা। ঠিক জানি না-বোধ হয় বাগবাজারে। 

আ। তাঁহার অভিভাবক কেহ বর্তমান আছেন? 

বা। শুনিয়াছি, তিনিই বাড়ীর কর্তা, তাঁহার পিতা বহুদিন পূর্ব্বে মারা গিয়াছেন। 

আ। আপনি কাহার নিকট হইতে আপনার ভৃত্যের মৃত্যুসংবাদ পাইয়াছিলেন? 

বা। যে দরোয়ানকে তাহার অনুসন্ধানের নিমিত্ত বাগানে পাঠাইয়াছিলাম, সেই বাগান হইতে ফিরিয়া আসিবার কালীন তাহার মৃতদেহ দেখিতে পায় ও সেই আসিয়া আমাকে সংবাদ প্রদান করে। 

আ। তাহার পর আপনি কি করিলেন? 

বা। আমি একজন লোক মারফত এই সংবাদ আপনাদের সাহেবের নিকট প্রেরণ করি। 

আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া, আমি বিনয়বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম এবং তদুদ্দেশে গাড়িতে উঠিলাম। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

বেলা দশটির পর আমি বিনয়কৃষ্ণের বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও ত্রিতল। বাড়ীতে লোকজন অনেক। দেখিলেই বড় লোকের বাড়ী বলিয়া বোধ হয়। 

আমাকে দ্বারে দেখিয়া একজন দরোয়ান আমার আসিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিল। আমি বিনয়বাবুর সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলাম। 

দরোয়ান বাড়ীর ভিতর চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে একজন সম্ভ্রান্ত যুবককে সঙ্গে লইয়া আমার নিকট আগমন করিল। 

তিনি শশব্যস্তে আমার নিকট অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহাশয়, আপনি কাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চান?” 

আ। বিনয়কৃষ্ণবাবু। আপনারই নাম কি বিনয়বাবু? 

বি। আজ্ঞে হাঁ, আমারই নাম বিনয়কৃষ্ণ। 

আ। বোধ হয় আপনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি পুলিস-কৰ্ম্মচারী, আমি আপনাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। 

বি। আপনি অনায়াসে জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। 

আ। মেছুয়াবাজারের মালতী বাইয়ের সহিত আপনার কি সদ্ভাব আছে? 

বি। আজ্ঞে আলাপ ছিল বটে, সম্প্রতি বিবাদ হইয়াছে। এখন আমরা পরস্পর পরস্পরের শত্রু। 

আ। কি জন্য বিবাদ, আমাকে আদ্যোপান্ত বলুন? বাইজীর সন্দেহ- 

বাধা দিয়া বিনয়কৃষ্ণ উত্তর করিলেন, “আমি যে তাহার প্রেমের চাকরকে হত্যা করিয়াছি, বাইজী আমার মুখের উপরই সে কথা বলিয়াছিল। মনে করিয়াছিলাম, সে মৌখিক ভয় দেখাইতেছিল, কিন্তু এখন দেখিতেছি, কেবল মৌখিক নয়, আমার উপর সন্দেহ করিয়া পুলিসে পর্যন্ত সংবাদ দিয়াছে। ভাল, আপনি অনুসন্ধান করিয়া দেখুন, আমি দোষী কি না? দোষী হই, উপযুক্ত দণ্ড লইতে প্রস্তুত আছি।” 

আমি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলাম, “যখন বাইজী আপনাকে সন্দেহ করিয়াছেন এবং আমাকে সকল কথা বলিয়াছেন, তখন আমাকে দেখিতে হইবে যে, আপনি দোষী কি না? দোষী হইলে আপনার কোনরূপ অব্যাহতি নাই।” 

অতি বিনীতভাবে বিনয়কৃষ্ণ উত্তর করিলেন “আপনি যাহা ভাবিতেছেন, বাইজীর মুখে যাহা শুনিয়াছেন, বাস্তবিক তাহা সত্য নহে। আপনারা অনেক খুনী আসামী দেখিয়াছেন, দোষী দেখিলেই আপনারা চিনিতে পারেন; সত্য করিয়া, ধৰ্ম্ম সাক্ষী করিয়া বলুন দেখি, আপনি আমাকে দেখিয়া বাস্তবিকই কি হত্যাকারী বলিয়া মনে করেন? যদি তাহাই হয়, তবে চলুন, আমি এখনই আপনার সহিত যাইতেছি। কিন্তু যদি আমার মুখে সকল কথা শোনেন এবং বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে আপনার ধারণা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইবে।” 

আমি বলিলাম, “বলুন–আপনার কি বক্তব্য বলুন। তাহার পর যাহা কর্ত্তব্য করা যাইবে। প্রথমতঃ বাইজীর সহিত আপনার কত দিনের আলাপ?” 

বি। প্রায় দুই বৎসর। 

আ। আর তাঁহার ভগ্নী বসন্ত বাইজীর সহিত? 

বি। প্রায় একমাস। 

আ। এইবার আপনি আদ্যোপান্ত সমস্ত ব্যাপার বলুন? 

বি। গতকল্য প্রাতে সুন্দরলাল আমাকে একখানি পত্র আনিয়া দেয়। পত্র পাঠ করিয়া বুঝিলাম, মালতী গার্ডেনরিচের বাগানে গিয়াছে এবং আমাকে সেখানে যাইবার জন্য অনুরোধ করিয়াছে। 

আ। আপনি কি জানিতেন না যে, বসন্তবাই সম্প্রতি সেই বাগানে বাস করিতেছেন? 

বি। না–তাহা হইলে আমি পূৰ্ব্বেই ওই কথা সুন্দরলালকে জিজ্ঞাসা করিতে পারিতাম। বাইজীর পত্র পাইয়া আমি আন্তরিক পুলকিত হইলাম। 

আ। কেন? আপনার আনন্দের কারণ কি? 

বি। কোন সামান্য কারণে বাইজী আমার উপর রাগ করিয়াছিল, – আমার সহিত ভাল করিয়া কথা কহিত না। দেখা হইলে মুখ ফিরাইয়া লইত। 

আ। কি কারণে আপনাদের মনোমালিন্য ঘটিয়াছিল? 

বিনয়কৃষ্ণ লজ্জিত হইলেন। লজ্জায় তাঁহার মুখ রক্তিমাভ ধারণ করিল দেখিয়া আমি বলিলাম “ইহাতে লজ্জা করিলে চলিবে না। যদি আপনি বাস্তবিকই নিরপরাধী হন, তাহা হইলে সমস্ত কথা আমার জানা চাই। সকল কথা না জানিলে আমি আপনাকে রক্ষা করিতে পারিব না।” 

বিনয়কৃষ্ণ মুখ অবনত করিয়া উত্তর করিলেন “পিতার মৃত্যুর পর আমার চরিত্রদোষ ঘটে। আমি কলিকাতার অনেক বাইজীর সহিত আলাপ করিলাম এবং মধ্যে মধ্যে তাহাদের বাড়ী গিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিতাম। অকাতরে অজস্র অর্থ ব্যয় করিতাম বলিয়া সকল স্থানেই আমার যথেষ্ট আদর ছিল। এইরূপে কিছুদিন অতীত হইল। এই সময় মালতী বাই কলিকাতায় আগমন করে এবং মেছুয়াবাজারের একটি বাড়ী ভাড়া করিয়া বসবাস করিতে আরম্ভ করিল। একদিন মালতীকে অপর একজন বাইজী নিমন্ত্রণ করিল। আমি প্রত্যহই সেখানে যাইতাম; সুতরাং আমিও নিমন্ত্রিত হইলাম। শুনিয়াছিলাম, মালতী একজন বিখ্যাত গায়িকা। তাহার গান শুনিবার জন্যই তাহাকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল। আমি সকলের অগ্রে সেখানে উপস্থিত হই। মালতী তাহার কিছু পরেই আগমন করে। অন্যান্য নিমন্ত্রিত লোক সকল তখন উপস্থিত হয় নাই, সুতরাং তখন গান আরম্ভ হইল না। মালতী আমারই নিকট বসিয়া ছিল। তাহার রূপ দেখিয়া আমি মুগ্ধ হইলাম। ইতিপূৰ্ব্বে আমি অনেক বাইজীকে দেখিয়াছিলাম, কলিকাতার প্রায় সকল বাইজীর সহিতই আমার সদ্ভাব ছিল; কিন্তু মালতীর মত অলৌকিক রূপলাবণ্যসম্পন্না রমণী পূর্ব্বে আমার নয়নগোচর হয় নাই। আগেই বলিয়াছি, আমার তখন চরিত্রদোষ জন্মিয়াছিল, সুতরাং মালতীর রূপ দেখিয়া তাহার সহিত আলাপ করিতে ইচ্ছা হইল। কথায় কথায় আলাপ হইল। মালতী আমায় পরদিন তাহার বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করিল। সেই অবধি আমাদের সদ্ভাব হইল। আমি মালতীর রূপে মজিলাম, মালতীও আমাকে যথেষ্ট ভালবাসিতে লাগিল।” 

এই বলিয়া বিনয়কৃষ্ণ একবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন এবং আমাকে ঈষৎ হাসিতে দেখিয়া, স্বয়ং হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আপনার বিশ্বাস হইতেছে না? কিন্তু বাস্তবিকই মালতী আমাকে বড় ভালবাসিত। আমি প্রত্যহই মালতীর বাড়ীতে যাইতে লাগিলাম; যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করিলাম। এইরূপে প্রায় দুই বৎসর কাটিয়া গেল। প্রায় দুই মাস পূর্ব্বে তাহার ভগ্নী বসন্ত বাই কলিকাতায় আসিল। বসন্ত মালতীর ছোট ভগ্নী, শুনিয়াছি সহোদরা, কিন্তু মালতী অপেক্ষাও রূপবতী। যতকাল বসন্ত আমার দৃষ্টিপথে পতিত হয় নাই, ততকাল আমি মালতীকেই সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দরী মনে করিতাম, কিন্তু যেদিন বসন্তকে দেখিলাম, সেইদিন হইতেই তাহার রূপের জ্যোতিতে পতঙ্গবৎ পুড়িয়া মরিলাম। কিসে বসন্তের সহিত সদ্ভাব হইবে, কি করিয়া তাহার ঘরে যাইব, তাহারই চেষ্টা করিতে লাগিলাম। মালতী আমায় যথেষ্ট ভালবাসিত, সে আমার মনোভাব স্পষ্টই বুঝিতে পারিল; কিন্তু মুখে কোন কথা না বলিয়া, আমার সর্ব্বনাশের উপায় অন্বেষণ করিতে চেষ্টা করিল। আমি কিন্তু তাহার মনোভাব বুঝিতে পারিলাম না। সে যখন হাসি হাসি মুখে আমাকে বসন্তের নিকট লইয়া গিয়া তাহার সহিত আলাপ করাইয়া দিল, তখন আমি তাহার মুখে মধু, হৃদয়ে গরল বুঝিতে পারিলাম না।” 

বিনয়কৃষ্ণকে বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বসন্ত এতদিন কোথায় ছিল? যখন মালতীর সহিত আপনার বিশেষ সদ্ভাব ছিল, তখন আপনি কি কখনও তাহার মুখে বসন্তের কথা শোনেন নাই?” 

বিনয়কৃষ্ণ লজ্জার হাসি হাসিয়া উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না, মালতী একদিনের জন্যও বসন্তের নাম করে নাই। শুনিয়াছি, বসন্ত লক্ষ্ণৌ সহরে গীতবিদ্যা শিক্ষা করিতেছিল। শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ায় সে অর্থোপার্জ্জনের জন্য কলিকাতায় আসিয়াছিল।” 

আমি বলিলাম “বসন্তকে অনুগ্রহ করায় মালতী নিশ্চয়ই ঈর্ষান্বিত হইয়াছিল?” 

বি। নিশ্চয়ই। সেই হিংসারই ফলে আমায় আজ বন্দী হইতে হইয়াছে। মালতী দেখিল যে, আমি আর তাহার বাড়ীতে যাই না, যদি বা যাইতাম, বসন্তের সহিতই কথাবার্তা কহিতাম।”

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বসন্ত কি মালতীরই বাড়ীতে বাস করিত?” 

বি। হাঁ। মালতীর বাড়ীতে এজন ভাড়াটিয়া ছিল, সে উঠিয়া গিয়াছিল। সুতরাং তাহার ঘরখানি খালি ছিল। বসন্ত সেই ঘরে বাস করিতে লাগিল। 

আ। বাড়ীখানি কি মালতীর নিজের সম্পত্তি? 

বি। হাঁ। আমিই মালতীর দেনা শোধ করি। 

বাধা দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “দেনা? মালতীর দেনা কি জন্য?” 

বিনয়বাবু হাসিতে হাসিতে বলিলেন “বাড়ী কিনিয়া মালতী দেনাদার হইয়া পড়িয়াছিল। প্রায় ছয় হাজার টাকা দেনা ছিল। কিন্তু আমার নির্বুদ্ধিতায় সেই সমস্ত দেনা পরিশোধ হইয়া গিয়াছে।” 

আ। আপনি কেমন করিয়া জানিলেন যে, মালতী আপনার উপর রাগ করিয়াছেন? 

বি। বসন্তের সহিত আলাপ হইবার পর, আমি আর প্রত্যহ মালতীর বাড়ী যাইতাম না। বোধ হয় মালতী আমার মনের কথা বুঝিতে পারিল, সে কৌশলে বসন্তকে গার্ডেনরিচের বাগানে পাঠাইয়া দিল এবং প্রত্যহই আমাকে ডাকিয়া পাঠাইতে লাগিল, আমিও প্রত্যহ বাধ্য হইয়া তথায় যাইতে লাগিলাম। বসন্তের কথা পাড়িলে হয় সে হাসিয়া অন্য কথা পাড়িত, না হয় একটি কোন উত্তর দিত। আমি ভাবিলাম, সে লক্ষ্ণৌ সহরে ফিরিয়া গিয়াছে। আর বসন্তের কথা তুলিতাম না। এইরূপে দিন কাটিতে লাগিল। পরশ্ব প্রাতে আমি মুখ প্রক্ষালন করিতেছি, এমন সময় মালতীর এক ভৃত্য আসিয়া একখানি পত্র দিল। পত্রখানি গ্রহণ করিয়া পাঠ করিলাম, বুঝিলাম, মালতী সে রাত্রে গার্ডেনরিচের বাগানে আমোদ-আহ্লাদ করিবে, বৈকালে আমাকে সেইখানে যাইতে হইবে। পত্রের কথামত আমি বৈকালে বাগানে গেলাম। কিন্তু মালতীবাই সেখানে ছিল না; দেখিলাম, তাহার পরিবর্তে তাহার কনিষ্ঠা ভগ্নী বসন্ত। আমাকে দেখিয়া বসন্ত অত্যন্ত আনন্দিত হইল। আমিও তাহাকে দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। সেখানে সে কেমন করিয়া আসিল জিজ্ঞাসা করিলাম। বসন্ত বলিল, সে অনেক দিন হইতে বাগানে বাস করিতেছে। আমি তখন তাহাকে সেই পত্রখানি দেখাইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম, তুমি উহা পাঠাইয়াছ কি না? বসন্ত হাসিয়া বলিল, আমি ত লেখা পড়া জানি না। আমি ভাবিয়াছিলাম, বসন্তই কৌশলে আমাকে পত্র পাঠাইয়া দিয়াছে। কিন্তু তাহার কথা শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। পত্রখানি তবে কে পাঠাইল? মালতীবাইএর নাম দিয়া, তাহার মত স্বাক্ষর করিয়া আমার সহিত আমার মনের মানুষ বসন্তের কে মিলন করাইয়া দিল? এমন সুহৃদ কে? অনেকক্ষণ এই বিষয়ে চিন্তা করিলাম, কিন্তু কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। 

সেদিন আমোদ-প্রমোদে অতিবাহিত হইল। পরদিন গত কল্য সমস্ত দিবস সেখানে থাকিয়া, রাত্রি এগারোটির সময় বাগান হইতে বাহির হইলাম। 

আমি তাঁহাকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এত রাত্রে কেন? কল্য রাত্রিও সেখানে বাস করিলেন না কেন?”

বি। বিশেষ কার্য্যের জন্য আমায় বাড়ীতে আসিতে হইয়াছিল। বসন্ত কোনরূপেই ছাড়িয়া দিতে চাহিল না। অনেক বাদানুবাদের পর, অনেক হাসি-কান্নার পর কিছু রাত্রি সেখানে থাকিবার পর তবে সে আমায় ছাড়িয়া দেয়। সেই জন্যই রাত্রি এগারটির পর বাগান হইতে বাহির হইয়াছিলাম। পথে আসিতে আসিতে সুন্দরলালের সহিত দেখা হইল। আমি ধৰ্ম্ম সাক্ষী করিয়া বলিতে পারি, সুন্দরলালের বাগানে যাইবার কথা কিম্বা তাহার বাগান হইতে প্রত্যাগমনের কথা ঘুণাক্ষরেও জানিতাম না। দুর্ভাগ্য বশতঃ তাহার বাইসিকেলে আলোক ছিল না। সুতরাং অন্ধকারে আমি তাহার বাইসিকেলের উপর গিয়া পড়িলাম, তাহাতে সে আমাকে অপমানিত করিল। আমার ক্রোধ হইল, আমি তাহাকে তিরস্কার করিলাম। সে আমাকে চিনিতে পারিল। আমার নাম ধরিয়া নানাপ্রকার বিদ্রূপ করিল। পরশ্ব যে পত্র পাইয়াছিলাম, তাহার উল্লেখ করিল। আমি মালতীবাইএর স্বাক্ষরিত পত্র পাইয়া, তাহার নিমন্ত্রণ লইয়া হঠাৎ বসন্তের সাক্ষাৎ পাইয়াছিলাম, সে কথাও বলিতে ছাড়িল না। সে এ সকল কথা কোথা হইতে জানিতে পারিল, বুঝিলাম না। কিন্তু তাহার কথায় ও বিদ্রূপবাণে আমরা পা হইতে মাথা পৰ্য্যন্ত জ্বলিয়া উঠিল। আমি ক্রোধে অন্ধ হইয়া তাহাকে সজোরে চপেটিঘাত করিলাম, সে ঘুরিয়া পড়িল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ লম্ফ দিয়া উঠিয়া আমাকে আক্রমণ করিল। আমি পরাস্ত হইলাম। সে আমাকে প্রহার করিল, এবং সত্বর বাইসিকেলে আরোহণ করিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও লজ্জিত ও অপমানিত হইয়া বাড়ীর দিকে আসিতে লাগিলাম। আজ প্রাতে বাইজীর নিকট গিয়া তাহার ভৃত্যের পূর্ব্ব রাত্রের ব্যবহারের কথা বলিলাম। সুন্দরলাল যেরূপে আমায় অপমানিত করিয়াছিল, অবশেষে যেরূপ তিরস্কার ও প্রহার পর্য্যন্ত করিয়াছিল, সমস্ত কথাই বলিলাম, আমরা কথাও বলিলাম। আমিই যে তাহাকে প্রথমে চপেটিঘাত করিয়াছিলাম, তাহাও বলিতে ভুলিলাম না। সুন্দরলাল বাইজীর প্রিয়তম ভৃত্য। শুনিয়াছি, এক সময়ে বাইজীর উপর তাহার বিশেষ প্রাধান্য ছিল। কিন্তু যে দিন হইতে বাইজীর সহিত আমার আলাপ হইয়াছে, সেই দিন হইতে বাইজী আমাকেই সকলের অপেক্ষা অধিক ভালবাসিত। জানি না, কেন সে আজ প্রাতে আমার সহিত এরূপ নীচ ব্যবহার করিল। 

এই বলিয়া বাইজী যে যে কথা বলিয়াছিল, বিনয়কৃষ্ণও সেই সেই কথা বলিলেন। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

বিনয়কৃষ্ণের মুখে সমস্ত কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, রহস্য ক্রমেই জটিল হইয়া উঠিতেছে। বাইজীর মুখে যেরূপ শুনিয়াছিলাম, তাহাতে বিনয়বাবুকেই হত্যাকারী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিলাম। কিন্তু এখন বিনয়বাবুর কথা শুনিয়া আমার সে ধারণা ভুল বলিয়া বিশ্বাস হইল। বিনয়কৃষ্ণ যে সত্য কথা বলিয়াছেন, তাহা আমার বেশ ধারণা হইল। কিন্তু কি করিব, যিনি সুন্দরলালের অভিভাবক, তিনিই যখন বিনয়বাবুর উপর সন্দেহ করিয়াছেন, তখন তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতেই হইবে। আমি সেই কথা বিনয়বাবুকে বলিলাম। তিনি বলিলেন, তাহাতে তাঁহার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি নাই। তবে আমি যে তাঁহাকে নিরপরাধী বলিয়া বিশ্বাস করিয়াছি, ইহাতেই তিনি বিশেষ আনন্দিত হইলেন। 

ভাবিলাম, সুন্দরলাল কেমন করিয়া সেই জাল পত্রের কথা অবগত হইল? যদি সে পত্র সত্য সত্যই বাইজী লিখিয়া থাকিতেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই বাইজী গার্ডেনরিচের বাগানে থাকিতেন। যাহার সহিত সাক্ষাৎ হইবার ভয়ে বাইজী নিজ কনিষ্ঠা ভগিনীকে গোপনে বাগানে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, তিনি স্বয়ং তাঁহাদের মিলন করিয়া দিবেন, এ কথা বিশ্বাসযোগ্য নহে। বাইজী নিশ্চয়ই সে পত্রের বিষয় জানিতেন না। তবে কে সেই পত্র লিখিল? বসন্তবাই বিনয়বাবুর প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী। সেই তাঁহাকে পত্র লিখিতে পারে। কিন্তু শুনিলাম, সে আদৌ লেখা পড়া জানে না। যদি জানিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই পূর্ব্বে পত্র লিখিতে পারিত। প্রায় দুই মাস কাল সেই নিৰ্জ্জনে বাস করিয়া, এতদিন পরে তাহার পত্র লিখিবার কারণ কি? বিশেষতঃ, বসন্ত যখন বিনয়বাবুকে সেই বাগানে দেখিতে পাইয়াছিল, তখন সে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিল। যদি বাস্তবিকই সে পত্র লিখিত, তাহা হইলে সে পূব্বেই বিনয়কৃষ্ণকে সেখানে আসিয়া দেখা করিতে পত্র লিখিতে পারিত। বসন্ত নিশ্চয়ই সে পত্র লিখে নাই। তবে কে লিখিল? সুন্দরলাল সেই পত্রের কথা কোথা হইতে জানিতে পারিল? তবে কি সেই সে পত্র লিখিয়াছে? তাহার স্বার্থ কি? এরূপ পত্র সে লিখে কেন? যখন বিনয়বাবুকে বাইজী ভালবাসিতেন এবং যে দিন হইতে বিনয়বাবুর সহিত বাইজীর সাক্ষাৎ হইয়াছিল, সেইদিন হইতে সুন্দরলাল পূর্ব্বের মত বাইজীর আর প্রিয়পাত্র ছিল না, তখন সেই বা কেন বিনয়বাবুর এই উপকার করিবে? পত্র না লিখিয়া মুখেই বা সে কথা বলিল না কেন? পত্র লিখিয়া উভয়ের মিলন করিয়া দেওয়ায় তাহার স্বার্থ কি? 

এইরূপ কিছুক্ষণ চিন্তার পর ভাবিলাম, সুন্দরলালই সেই পত্র লিখিয়াছে। তাহারই স্বার্থ আছে দেখিতেছি। কারণ বিনয়কৃষ্ণকে বাইজীর বাড়ী হইতে দূর করিতে পারিলে, সেই বাইজীর প্রিয়পাত্র হইতে পারিবে। পূর্ব্বের মত বাইজীর উপর প্রাধান্য করিতে পারিবে। যতকাল বিনয়কৃষ্ণ বাইজীর বাড়ীতে যাতায়াত করিবেন, ততকাল সে কিছুই করিতে পারিবে না, এই স্থির করিয়া বিনয়কৃষ্ণকে বাগানে পাঠাইয়া দিবার জন্যই ওই পত্রখানি লিখিয়াছিল। 

এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইলে পর, বিনয়বাবু বলিলেন “চলুন, আমায় কোথায় লইয়া যাইবেন। আমি প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছি। কিন্তু আমি আপনার সমক্ষে ধর্ম্ম সাক্ষী করিয়া বলিতেছি যে, আমি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে সম্পূর্ণ নির্দোষী। আমি উহার কিছুই জানি না। 

আমি আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। পরে বিনয়কৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি যে পত্র পাইয়া গার্ডেনরিচের বাগানে গিয়াছিলেন, সে কথা বাইজী জানে কি?” 

বি। না। সে কথা বলিতে সাহস করি নাই। 

আ। তবে আপনি হঠাৎ বাগানে গিয়াছিলেন কেন, এ কথা কি তিনি জিজ্ঞাসা করেন নাই? 

বি। করিয়াছিল। কিন্তু আমার নিকট প্রকৃত উত্তর পায় নাই। আমি বলিয়াছিলাম, কোন বিশেষ কাৰ্য্য উপলক্ষে গার্ডেনরিচে গিয়া বসন্তকে সেই বাগানে দেখিতে পাই। বসন্ত আমায় দেখিয়া তাহার নিকট যাইতে অনুরোধ করে। আমি তাহার কথামত সেই বাগানে গিয়াছিলাম। 

আ। আপনার কথা শুনিয়া বাইজী বিশ্বাস করিয়াছিল কি? 

বি। বোধ হয়, না। সে আমার কথা শুনিবা মাত্র অট্টহাস্য করিয়া উঠিল। বলিল, বিনয়বাবু, আজকাল এত সত্যবাদী হইলেন কেমন করিয়া? আমি সে কথা গ্রাহ্য করিলাম না; হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম। 

আ। আমার বোধ হয়, বাইজী আপনার সেই পত্রের কথা জ্ঞাত আছেন।

বি। আপনার অনুমান সত্য হইতে পারে। কিন্তু সেই বা জানিল কিরূপে? 

আ। আমার বোধ হয় সুন্দরলালই সে কথা বলিয়াছে। 

বি। সুন্দরলাল সে কথা কেমন করিয়া জানিতে পারিল? 

আ। সুন্দরলাল স্বয়ংই সে পত্র লিখিয়াছে। বাইজীর স্বাক্ষর তাহার বেশ জানা ছিল। সেই জন্য তাহার উপর আমার সন্দেহ হইতেছে। কিন্তু এখন এ সন্দেহ নিষ্পত্তি করিবার উপায় নাই। কেন না, সুন্দরলাল আর এ জগতে নাই। 

বি। পত্রের কথা ছাড়িয়া দিন–এখন সুন্দরলালকে হত্যা করিল কে? আর কি উদ্দেশ্যেই বা সে এ কাজ করিল? আমি সহসা কোন উত্তর করিলাম না। আমি একজনের উপর সন্দেহ করিয়াছিলাম বটে, কিন্তু যতক্ষণ না ভাল করিয়া জানিতে পারি, ততক্ষণ সে কথা প্রকাশ করিতে পারিব না। বিনয়কৃষ্ণ আমার উত্তর না পাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। 

কিছুক্ষণ চিন্তার পর আমি উত্তর করিলাম “কে যে সুন্দরলালকে খুন করিয়াছে এবং কেনই বা সে এই ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছে, তাহা শীঘ্রই জানিতে পারিবেন। আপাততঃ আমি একটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই। সুন্দরলাল আপনাকে অপমানিত ও প্রহার করিয়া পলায়ন করিলে পর, আপনি আর তাহার কোন সংবাদ রাখিয়াছিলেন?” 

বিনয়কৃষ্ণ আমার কথা শুনিয়া কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিলেন; পরে বলিলেন “পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি যে, সে প্রস্থান করিলে পর আমিও বাইসিকেলে চড়িয়া বাড়ীর দিকে আসিয়াছিলাম, বাড়ীর দিকে আসিতে আসিতে দেখিলাম, একখানি বাইসিকেল পুনরায় পোলের দিকে দৌড়িতেছে। কে যে তাহার উপর ছিল, বলিতে পারি না, কিন্তু সে বাইসিকেলেও আলোক ছিল না। আমার সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, সুন্দরলালই ফিরিয়া আসিতেছে। এই ভাবিয়া স্বয়ং গাড়ি হইতে নামিলাম ও বাতিটি নিভাইয়া বৃক্ষতলে বাইসিকেল রাখিয়া অতি ধীরে ধীরে পোলের ধারে গেলাম।” 

বিনয়বাবুকে বাধা দিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এ সকল কথা আপনি পূর্ব্বে আমার নিকট বলেন নাই কেন?” লজ্জার হাসি হাসিয়া বিনয়বাবু উত্তর করিলেন, “যাহা বলিয়াছিলাম, তাহাতেই আপনারা আমার উপর সন্দেহ করিয়াছেন; যদি এ সকল বলিতাম, তাহা হইলে কি আর রক্ষা ছিল? এখন আপনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি সত্য সত্যই নির্দোষী- সেই জন্যই আপনার নিকট এ সকল কথা বলিতে সাহস করিয়াছি।” 

আমি গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞাসা করিলাম, “পোলের ধারে গিয়া কি দেখিলেন?” 

বি। দেখিলাম, বাইসিকেলখানি ভূমির উপর ফেলিয়া আরোহী কি যেন অন্বেষণ করিতে লাগিল। আমার চপেটাঘাতে সুন্দরলাল যেখানে পড়িয়া গিয়াছিল, সেই লোকটি ঠিক সেই স্থানেই কি যেন অন্বেষণ করিতে লাগিল। পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে, কুয়াসার জন্য চারিদিকে অন্ধকার ছিল। সুতরাং সে মধ্যে মধ্যে আলোক জ্বালিতেছিল। আমি কিছু দূরে ছিলাম বলিয়া প্রথমে তাহাকে দেখিতে পাই নাই। কিন্তু ভাল করিয়া না দেখিয়াও সেখান হইতে নড়িতে ইচ্ছা হইল না। আমি অতি সন্তর্পণে অগ্রসর হইলাম; এবং একটি গাছের তলায় আশ্রয় লইলাম। ঠিক এই সময় সেই ব্যক্তি একটি দিয়াশলাই জ্বালিল, সেই আলোকে আমি তাহাকে চিনিতে পারিলাম। দেখিলাম, সুন্দরলাল। ভাবিলাম, সুন্দরলাল আবার ফিরিয়া আসিল কেন? এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময় সুন্দরলাল সেই স্থান হইতে কি যেন তুলিয়া লইল। আমার তখন বোধ হইল, পড়িয়া যাওয়ায় সুন্দরলাল সেখানে কোন বস্তু ফেলিয়া গিয়াছিল। সেই বস্তুর অন্বেষণের জন্যই সে সেখানে ফিরিয়া আসিয়াছিল। যখন দেখিলাম, সুন্দরলাল আবার বাইসিকেলে আরোহণ করিল, তখন আমিও আর অপেক্ষা করিলাম না। বাড়ী ফিরিবার চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সহসা এই সময় একটি বন্দুকের শব্দ আমার কর্ণ গোচর হইল। শব্দের গতি লক্ষ্য করিয়া সেইদিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। দেখিলাম, একজন অশ্বারোহী দ্রুতবেগে প্রস্থান করিতেছে। 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কি পূর্ব্বে এই অশ্বারোহীকে দেখিতে পান নাই?” 

বি। আজ্ঞে না। কোথা হইতে কখন যে সে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল, তাহা বুঝিতে পারিলাম না। 

আ। বন্দুকের শব্দ শুনিয়া আপনি কি সেই দিকে গিয়াছিলেন? 

বি। আজ্ঞে না। অশ্বারোহীকে দ্রুতবেগে যাইতে দেখিয়া ভাবিলাম, অন্ধকারে যাইতেছেন বলিয়া ওইরূপ শব্দ করিতে করিতে যাইতেছেন। 

আ। কতবার বন্দুকের শব্দ শুনিয়াছিলেন? 

বি। তিন চারিবার। 

আ। পথে কি তখন কোন লোক ছিল না? একজন কনেষ্টবলও কি সেখানে উপস্থিত ছিল না? 

বি। আজ্ঞে না। অশ্বারোহী চলিয়া যাইলে আমিও সেখানে হইতে সরিয়া পড়িলাম। 

আ। আপনি ভাল করিয়া দেখিয়াছিলেন? অশ্বারোহীকে কি চিনিতে পারেন নাই? সত্য কথা না বলিলে আপনাকে রক্ষা করা নিতান্ত কঠিন হইবে। সমস্ত কথা খুলিয়া বলুন। আমি শীঘ্রই প্রকৃত অপরাধীকে গ্রেপ্তার করিয়া আপনাকে মুক্ত করিব। 

বিনয়বাবু অতি বিনীতভাবে উত্তর করিলেন “না মহাশয়, আমি আর কোন কথা গোপন করি নাই। আমি অশ্বারোহীকে চিনিতে পারি নাই। বিশেষতঃ তাহার সর্বাঙ্গ কৃষ্ণবর্ণ পরিচ্ছদে আবৃত ছিল।” 

বিনয়কৃষ্ণের কথা সত্য বলিয়া আমার ধারণা হইল। আমি তখনই একখানি গাড়ি আনিতে বলিলাম। গাড়ি আনীত হইলে, বিনয়বাবুকে লইয়া, তাহাতে আরোহণ করিলাম। গাড়ি থানাভিমুখে ছুটিল। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যখন থানায় ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা প্রায় দুইটি। বিনয়কৃষ্ণকে হাজতে রাখিয়া আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলাম। ভাবিলাম, সেই রাত্রে অশ্বে আরোহণ করিয়া কে সুন্দরলালকে খুন করিল? কেনই বা সে এমন ভয়ানক কার্য্য করিল? বিনয়কৃষ্ণের মুখে যে সমস্ত কথা শুনিয়াছিলাম, তাহাতে বোধ হইল, সুন্দরলালের কোন গুপ্ত শত্রু ছিল। বোধ হয়, সুন্দরলালকে হত্যা করিবার জন্য সে ওই পোলের নিকট গুপ্ত ভাবে অপেক্ষা করিতেছিল। কে সেই লোক? সুন্দরলালের শত্রু কে? বাইজী সুন্দরলালকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন। তিন হয়ত বলিতে পারেন, সুন্দরলালের শত্রু কে? কিন্তু তাঁহাকেও এ কথা জিজ্ঞাসা করা যুক্তিসঙ্গত নহে। কেন না, যখন তিনি বিনয়কৃষ্ণকেই হত্যাকারী বলিয়া সন্দেহ করিয়াছেন, তখন অপর কোন লোক সুন্দরলালের শত্রু হইলেও তিনি বলিবেন না। রহস্য ক্রমেই ভয়ানক হইয়া উঠিল। সেই অশ্বারোহী কে? কি উপায়ে তাহার সন্ধান পাওয়া যায়? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আর একবার বাইজীর সহিত সাক্ষাৎ করিতে মনস্থ করিলাম। বিনয়কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার করিয়া হাজতে রাখিয়াছি, এই সংবাদ দিবার অভিপ্রায়ে আমি মেছুয়াবাজারে বাইজীর বাড়ীতে গমন করিলাম। 

বাইজী তখন বেশভূষা করিতেছিলেন, সুতরাং তখনই দেখা হইল না। একজন চাকর আমাকে অতি সমাদরে উপরের বৈঠকখানায় লইয়া গেল। আমি সেইখানে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

প্রায় আধঘণ্টা অতীত হইল, বাইজী তখনও আসিলেন না। বেশভূষাই যাহাদের একমাত্র উপজীবিকার উপায়, বেশভূষার পারিপাট্যে যাহারা মুনির মনও বিচলিত করেন, বেশভূষা করিতে তাহাদের যে যথেষ্ট সময় লাগিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? 

আমি যে ঘরে বসিয়াছিলাম, হঠাৎ সেখানে একজন রমণী প্রবেশ করিল। কি জন্য যে সে সেখানে আসিয়াছিল, তাহা বলিতে পারিলাম না। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করিয়া প্রায় সকল দ্রব্যেই এক একবার হাত দিল। সে যে বিশেষ কোন কাৰ্য্যে আসিয়াছিল, তাহা বোধ হইল না। 

ঘরে প্রবেশ করিয়া সে এক-একবার আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল এবং চারিচক্ষু মিলিত হইবা মাত্র হাসিয়া মুখ অবনত করিতে লাগিল। আমি তাহার উদ্দেশ্য ভাল বুঝিতে পারিলাম না। তবে সে যে আমার সহিত কথা কহিতে অভিলাষী, তাহা স্পষ্টই জানিতে পারিলাম। 

রমণীর বয়স প্রায় বাইশ বৎসর। তাহাকেও দেখিতেও মন্দ নহে। তাহাকে দেখিয়া প্রথমে দাসী বলিয়াই বোধ হইয়াছিল। কিন্তু নিকটে আসিলে বুঝিলাম, সে দাসী নহে–হয় ত বাইজীর সঙ্গিনী। 

রমণীর কথা কহিবার বাসনা দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বাইজীর এখানে আসিতে আর কত বিলম্ব হইবে?” আমার কথায় রমণী যেন বিশেষ পুলকিত হইল। একগাল হাসিয়া বলিল “এই ত সবে চুল বাঁধিতেছেন। তাহার পর গাত্র মার্জ্জনা করিবেন, পরে বেশভূষা করিবেন, তবে আসিবেন। এখনও প্রায় ঘণ্টা খানেক বিলম্ব হইবে।” 

প্রায় অৰ্দ্ধঘণট অতীত হইয়া গিয়াছে, আরও এক ঘণ্টা পরে বাইজীর সহিত সাক্ষাৎ হইবে ভাবিয়া, আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। কিন্তু কি করিব? উপায় নাই। যে কার্য্যের জন্য সেখানে গিয়াছিলাম, তাহা শেষ না করিয়া ফিরিতে পারিলাম না। মনে করিলাম, রমণীর সহিত কথাবার্তায় সময়াতিবাহিত করিব। এই ভাবিয়া যেমন তাহার দিকে দৃষ্টিপাত করিব, অমনই তাহাকে ঘরের একটি জানালার দিকে যাইতে দেখিলাম। 

বাইজীর সহিত প্রথম সাক্ষাতের সময় যে গৃহে বসিয়াছিলাম, এটি সে গৃহ নহে। ঘরটি পূর্ব্বদৃষ্ট গৃহ হইতে অনেক বড়, আরও উত্তমরূপে সজ্জিত। ঘরখানি দৈর্ঘ্যে প্রায় ষোল হাত, প্রস্থেও বার হাতের কম নহে। ঘরের মেজের উপর ঢালা বিছানা। বিছানার চারিদিকে স্প্রিংয়ের কৌচ ও চেয়ার সাজানো। দেওয়ালে কতকগুলি ভাল ভাল ছবি–অধিকাংশই নগ্ন। একটি দেওয়ালে একখানি প্রকাণ্ড আয়না ফ্রেমগুলি সোনালী কাজ করা। আয়নার উপরিভাগে একটি হাতীর দাঁতের ব্র্যাকেট; তাহার উপর এক অতি সুন্দর ঘড়ী। ঘরের মধ্যে তিনটি বেলোয়ারী ঝাড়। ভিতরের ছাদে তিনখানি টানা পাখা দোদুল্যমান। ঘরের আটটি জানালা ও দুইটি দরজা। জানালাগুলি বন্ধ ছিল বলিয়া গৃহে বেশী আলোক ছিল না। 

রমণী জানালার নিকট গিয়া জানালা খুলিল। ঘরের অন্ধকার অনেকটা দূর হইল। কিন্তু সেখানে যাইবার পূর্ব্বেই সেই রমণী জানালা হইতে “নাজির” “নাজির” বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। 

যেদিকে চাহিয়া রমণী চিৎকার করিতেছিল, সেইদিক হইতে উত্তর আসিল, “নাজির এখানে নাই।” 

উত্তর পাইয়া রমণী জানালা বন্ধ করিতেছিল, আমি নিষেধ করিলাম; বলিলাম “যদি বাধা না থাকে, তাহা হইলে জানালাটি খোলাই থাকুক; ঘরে বেশ আলোক আসিতেছে।” 

আমার কথায় হাসিয়া রমণী উত্তর করিল “কেন, যতক্ষণ আপনি আছেন, ততক্ষণ আর অন্য আলোকের প্রয়োজন কি? আপনার রূপেই ত ঘর আলো হইয়াছে।” 

আমি দেখিলাম, রমণী বড় মুখরা। কথার উত্তর না দিলে সে সন্তুষ্ট হইবে না। বলিলাম “যতক্ষণ আমি একা ছিলাম, ততক্ষণ ঘরটি অন্ধকারময় ছিল, তুমি আসিবামাত্র আলোকিত হইয়াছে। তুমি চলিয়া যাইতেছ বলিয়াই আমি জানালা খুলিয়া রাখিবার কথা বলিয়াছিলাম। যদি তুমি এখানে থাক, তাহা হইলে কেবল জানালা কেন, দরজা পর্যন্ত বন্ধ করিয়া দিলেও ঘরটি আলোকিত থাকিবে। ভাল কথা, নাজির কে? তুমি এই কতক্ষণ যাহাকে ডাকিতেছিলে সে কে?” 

রমণী আমার কথায় অত্যন্ত আনন্দিত হইল। ভাবিল, শিকার বুঝি জালে পড়িল। আমার নিকট কিছু অগ্রসর হইয়া, হাসিতে হাসিতে আমার মুখের দিকে চাহিয়া উত্তর করিল “নাজির বাইজীর প্রধান কোচম্যান।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “বাইজীর আস্তাবল কি ওইদিকে?” 

র। হাঁ-এই জানালা দিয়া দেখা যায়। 

আ। আস্তাবলের দরজা কোন্ দিকে? 

র। এই বাড়ীর পশ্চাতে। 

আ। বাইজীর প্রধান কোচম্যানের নাম নাজির? সর্ব্বশুদ্ধ বাইজীর ক’জন কোচম্যান আছে? 

র। তিনজন। 

আ। আর সহিস? 

র। সাতজন। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। বাইজীর সাতজন সহিস! তাহা হইলে নিশ্চয়ই তাঁহার সাতটি ঘোড়া আছে। সচরাচর লোকে, যতগুলি ঘোড়া, ততগুলি সহিস রাখিয়া থাকে। যখন সাতজন সহিস আছে, তখন তাঁহার সাতটি ঘোড়াও আছে। রমণীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বাইজীর গাড়ি ক’খানা?” 

র। দুইখানি। 

আ। দুইখানি গাড়িতে সাতটি ঘোড়া? 

রমণী হাসিল, কোন উত্তর করিল না। আমার সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, বাইজী এতগুলি ঘোড়া লইয়া কি করেন? কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বাইজীর সহিত তোমার সম্বন্ধ কি?” 

র। বিশেষ কিছুই নয়—তবে তিনি আমায় বড় ভালবাসেন। 

আ। কতদিন বাইজীর কাছে রহিয়াছ? 

র। প্রায় তিন বৎসর। 

এই বলিয়া রমণী সেখান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল; বলিল “বাইজীর কথা শুনিতে পাইতেছি, বোধ হয় তিনি এইদিকেই আসিতেছেন।” 

রমণী প্রস্থান করিল। কিছুক্ষণ পরেই বাইজী সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; বলিলেন, “মহাশয়, আপনাকে অনেকক্ষণ কষ্ট দিয়াছি। একা বসিয়া থাকিতে আপনার বিশেষ কষ্ট হইয়াছে সন্দেহ নাই।” 

আমি মিষ্ট কথায় উত্তর করিলাম “আমার কোন কষ্ট হয় নাই।” তাহার পর বলিলাম “বিনয়কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। তিনি এখন হাজতে, কথাবার্তায় বোধ হয়, তিনিই হত্যাকারী। কিন্তু যতক্ষণ না ইহা প্রমাণ করিতে পারিব, ততক্ষণ তাহাকে শাস্তি দিতে পারিব না। কি করিয়া প্রমাণ করিব, তাহার উপায় বলিতে পারেন?” 

বাইজী গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলেন “সে কি! আপনারা পুলিসের লোক; আপনাদিগকে আমি কি উপায় বলিয়া দিব? আমি সামান্যা রমণীমাত্র।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “রমণী সামান্যা নহে। আমাদের দেশের রাণীও একজন রমণী।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

তোষামোদ করিলে ভগবানও সন্তুষ্ট হন, মানুষ কোন ছার! আমার তোষামোদপূর্ণ কথায় বাইজী আন্তরিক আহ্লাদিত হইলেন; বলিলেন “যখন ধরা পড়িয়াছে, তখন বিনয়বাবুকে সমস্তই স্বীকার করিতে হইবে। পথে তাঁহার সহিত সুন্দরলালের সাক্ষাৎ হইল, উভয়ের ভয়ানক বচসা হইল, বিনয়বাবু আমার ভৃত্যকে ভয়ানক প্রহার করিলেন, সুন্দরলালও তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি অপমানিত ও প্রহার করিল। তাহার পর কি বিনয়বাবু আমার ভৃত্যকে ছাড়িয়া দিলেন? তিনি কি তাহাকে কোন কথা না বলিয়া, অপমানের প্রতিশোধ না তুলিয়া, বাড়ীতে ফিরিয়া গেলেন? এ কথা কি সম্ভবপর হইতে পারে? নিশ্চয়ই না; তিনি আমার ভৃত্যহস্তে লাঞ্ছিত হইয়া, তাহাকে খুন করিয়া গাত্রদাহ নিবারণ করিয়াছেন। আপনি তাঁহাকে এ সকল কথা বলিবেন, তাহা হইলে তিনি সমস্তই স্বীকার করিবেন! “ 

আমি বাইজীর কথায় সায় দিলাম; বলিলাম “আমারও সেইরূপ ধারণা। লোকটিকে বাহ্যিক দেখিলে বড় শিষ্ট শান্ত বলিয়া বোধ হয়। কিন্তু তাঁহার অন্তর সরল নহে। তিনি আমার সমক্ষে যে সকল কথা বলিয়াছেন, তাহার একবর্ণও সত্য নহে।” 

আমার কথায় বাইজী বড়ই সন্তুষ্টা হইলেন। নানাপ্রকারে আমায় সমাদর ও সম্মান প্রদর্শন করিতে লাগিলেন। আমি তখন অন্য কথা তুলিলাম, তাঁহার বিষয়-সম্পত্তির কথা কহিলাম, তাঁহার ভাড়াটিয়া বাড়ী কয়খানি জিজ্ঞাসা করিলাম। এইরূপ কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনার গাড়ি ক’খানি?” 

গাড়ির কথা শুনিয়া বাইজীর মুখ হঠাৎ গম্ভীর হইল। কিন্তু সে ক্ষণকালের জন্য; বাইজী তখনই আত্মসংবরণ করিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন “আমার গাড়ি-ঘোড়ার বড় সখ। গাড়ি দুইখানা আছে বটে কিন্তু তাহাতেও আমার তৃপ্তি হয় না। সুবিধামত ভাল গাড়ি পাইলে আমি আরও দুই একখানি কিনি।” 

আমি হাসিয়া জিজ্ঞাসিলাম “গাড়ি ত দুখানা, ঘোড়া কটি?” 

বা। সাতটি ঘোড়া আছে। 

আ। কেন? এতগুলি ঘোড়া কেন? 

বাইজী গম্ভীর হইলেন—কোন উত্তর দিতে পারিলেন না। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন “ভাল ঘোড়া পাইলে আরও কিনি।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “সাতটি ঘোড়ার মধ্যে কি একটিও ভাল নাই? ঘোড়াগুলি একবার দেখিতে পাই না? আমার একটু ঘোড়ার সখ আছে।” 

কিছুক্ষণ পরে বাইজী অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া উত্তর করিলেন “যদি আপনার দেখিবার ইচ্ছা হইয়া থাকে, দেখুন না। আমার আস্তাবলে গিয়া নাজিরকে বলুন, সে আপনাকে ঘোড়াগুলি দেখাইবে।” 

আমি আর কালবিলম্ব করিলাম না। তখনই বাইজীর নিকট বিদায় লইয়া, তাঁহার আস্তাবলে গমন করিলাম। বাইজীর বাড়ীখানি যেমন পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন, আস্তাবলটিও সেইপ্রকার। দেখিলেই বোধ হয়, যেন কোন ইংরাজের আস্তাবল। সেখানে যাইবামাত্র পূর্ব্বকথিত রমণীর সহিত সাক্ষাৎ হইল। আমি তাহাকে সেখানে দেখিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম; বলিলাম “তুমি এখানে?” 

রমণী হাসিল; বলিল “বাইজীর সহিত যখন আপনার কথাবার্তা হইতেছিল, আমি বাহিরে দাঁড়াইয়া সে সমস্তই শুনিয়াছি। যখন আপনি ঘোড়াগুলি দেখিবার জন্য বাইজীর অনুমতি লইলেন, তখন আমিও গোপনে আস্তাবলে আসিয়াছি।” 

রমণীর কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আমি ত ঘোড়া দেখিতে আসিয়াছি, তুমি এখানে কি করিতে আসিয়াছ?”

র। আপনি কি দেখেন, আমি তাহাই দেখিতে আসিয়াছি।” 

রমণীর কথা শুনিয়া আমি আমার পকেট হইতে একখানি দশটাকার নোট বাহির করিয়া রমণীর হস্তে দিলাম; বলিলাম “এই লও, তোমার পারিশ্রমিক। যদি কাৰ্য্যসিদ্ধ হয়, তবে আরও কিছু দিব।” 

রমণী নোটখানি গ্রহণ করিল বটে, কিন্তু কি জন্য যে তাহাকে পুরস্কার দিলাম, সে তাহা বুঝিতে পারিল না। আমি তখন জিজ্ঞাসা করিলাম “এতক্ষণ তোমার সহিত কথাবার্তা হইল, কিন্তু এ পর্য্যন্ত তোমার নাম জানিতে পারিলাম না।” 

রমণী হাসিয়া উত্তর করিল, “আমার নাম শঙ্করী। আমি বাইজীর প্রধানা দাসী।” 

আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। ভাবিলাম, এই রমণীর দ্বারাই আমার কার্য্য সিদ্ধ হইবে। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “কোচম্যান ও সহিসগুলির মধ্যে বাইজীর প্রিয়পাত্র কে?” 

রমণী আমার কথা ভাল বুঝিতে পারিল না; বলিল, “সকলেই বাইজীর প্রিয়পাত্র, বাইজী সকলকেই ভালবাসেন।”

আ। তবুও সকলের অপেক্ষা কাহাকে ভালবাসেন? 

র। আমেদ আলিকে। 

আ। কোথায় সে? 

র। দেশে গিয়াছে, নাজিরই এখন তাহার কাজ করিতেছে। 

আ। নাজিরকে বাইজী কেমন ভালবাসেন? 

র। দেখিতে পারেন না। আমেদের লোক বলিয়া সে এখনও চাকরী করিতেছে। অন্য লোক হইলে এতদিন সে দূরীভূত হইত। 

আ। তবে তুমি যাও—আমি নাজিরের সহিত দুই একটি কথা কহিব। কেহ দেখিলে সন্দেহ করিতে পারে। রমণী ঈষৎ হাসিয়া সেখান হইতে সরিয়া গেল। আমি তখন নাজিরকে ডাকিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরেই নাজির আমার নিকট উপস্থিত হইল। তাহার সঙ্গে সঙ্গে আরও তিন চারিজন লোক সেখানে আসিল দেখিয়া, আমি তখন তাহাকে কোন কাজের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। দুই একটি অন্য কথা জিজ্ঞাসা করিয়া কৌশলে তাহাকে গোপনে দেখা করিবার কথা বলিলাম। সে সম্মত হইয়া অপর সকলকে লইয়া চলিয়া গেল। আমিও আস্তাবল হইতে বাহির হইলাম। নিকটেই একটি মুদীর দোকান। দোকানদারের সহিত পূর্ব্ব হইতে আমার আলাপ ছিল; আমি সেই দোকানে গিয়া একটি গোপনীয় স্থানে লুকাইয়া রহিলাম। নাজির জানিত, আমি সেইখানে তাহার জন্য অপেক্ষা করিব। 

কিছুক্ষণ পরেই নাজির সেখানে উপস্থিত হইল। আমি তাহাকে প্রথমে অন্যান্য অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিয়া পরে বলিলাম “বাইজীর ঘোড়া কয়টির মধ্যে সকলগুলি তো গাড়ি টানিবার উপযুক্ত নহে। উহার মধ্যে দুইটি ঘোড়া বোধ হয় একেবারেই গাড়ি টানিতে অক্ষম। উহারা চড়িবার ঘোড়া। বাইজীর কোন লোক কি ঘোড়ায় চড়িয়া থাকে?” 

নাজির সহসা কোন উত্তর করিল না। সে ইতস্ততঃ করিতে লাগিল দেখিয়া, আমি পকেট হইতে একখানি নোট বাহির করিয়া তাহার হাতে দিলাম। বলিলাম “আমি পুলিসের লোক। কোন বিশেষ কার্য্যের জন্য তোমায় গোটা কতক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি। তুমি সকল কথার যথাযথ উত্তর দাও, যদি আমি কৃতকার্য্য হই, তাহা হইলে, আরও দশ টাকা পুরস্কার দিব।” 

আমার কথায় নাজির গম্ভীর ভাবে উত্তর করিল “সকল কথা বলিলে যদি আমার চাকরী যায়?” 

আ। চাকরীর অভাব কি? আমি তোমার চাকরী করিয়া দিব। 

নাজির সন্তুষ্ট হইল। বলিল “বাইজী স্বয়ং অশ্বারোহণ করিয়া থাকেন।” 

আমি নাজিরের কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “প্রমাণ করিতে পারিবে?” 

না। কেন পারিব না? কে না জানে যে, বাইজী কোন কোন দিন ঘোড়ায় চড়িয়া মাঠে বেড়াইয়া থাকেন। মেমেদের মত পোষাক পরিয়া সেই সাদা ঘোড়ার উপর চড়িয়া তিনি মধ্যে মধ্যে মাঠে গিয়া থাকেন। 

আ। কাল রাত্রে বাইজী ঘোড়ায় চড়িয়াছিল? 

না। আজ্ঞে হাঁ, -কিন্তু- 

আ। কিন্তু কি? 

না। কিন্তু তাঁহার বেশ তখন মেমসাহেবের মত ছিল না। 

আ। তিনি পুরুষবেশে ঘোড়ায় চড়িয়াছিলেন, কেমন? 

নাজির স্তম্ভিত হইল। বলিল “আপনি এ কথা জানিলেন কিরূপে?” 

আ। যেমন করিয়াই জানি না, কথাটি সত্য কি না? 

না। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। কত রাত্রে? 

না। রাত্রি দশটির পর 

আ। তুমি কিছু জিজ্ঞাসা কর নাই? তিনি আর কোন দিন বোধ হয় রাত্রি দশটির পর ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হন নাই? 

না। কোন কথা জিজ্ঞাসা করা বাইজীর নিয়মবিরুদ্ধ। তাঁহার আদেশ পালন করিতেই হইবে। বিশেষতঃ আমার উপর তিনি অত্যন্ত বিরক্ত, কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে আমার চাকরী যাইবার সম্ভাবনা, সে জন্য আমি কিছু জিজ্ঞাসা করি না। 

আ। তিনি কখন ফিরিয়া আইসেন? 

না। রাত্রি একটার কিছু পূৰ্ব্বে।

আ। তখন তুমি জাগিয়া ছিলে? 

না। না থাকিলে আর রক্ষা আছে। 

আ। তিনি কি রঙ্গের পোষাক পরিয়া ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হইয়াছিলেন? 

না। কাল কাপড়ের পোষাক। 

আ। এ কথা আদালতে বলিতে পারিবে? 

না। নিশ্চয়ই পারিব। এতক্ষণ আপনার উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিয়াছি। আপনি যদি আমার একটি চাকরী যোগাড় করিয়া দিতে পারেন, তাহা হইলে আমি এ সম্বন্ধে যাহা কিছু জানি, সমস্তই বলিব। 

আমি আনন্দিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “শঙ্করী নামে একটি রমণী বাইজীর প্রধানা দাসী। সে কি এ বিষয়ের কিছুই জানে না?” 

না। বোধ হয় জানে। কেন না, সেই বাইজীকে পোষাক পরাইয়া দেয়, পোষাক খুলিয়া দেয়; কাপড়চোপড় গুছাইয়া রাখে। তাহাকে হাত করিতে পারিলে আপনি শীঘ্রই কার্য্য উদ্ধার করিতে পারিবেন। 

আ। সুন্দরলালের সহিত মালতী বাইজীর কেমন সদ্ভাব ছিল? 

না। বিনয়বাবুই বলুন বা অপর কোন বাবুই বলুন, তাঁহাদের সহিত বাইজীর কেবল পয়সার সম্বন্ধ। মুখে দেখাইতেন, বিনয়বাবুকে তিনি অন্তরের সহিত ভালবাসেন, কিন্তু আসল প্রণয়ী ছিল সুন্দরলাল। সুন্দরলাল চাকর হইলেও বাইজীর হৃদয়ের মাণিক ছিল। যেদিবস হইতে বাইজীর ভগ্নী বসন্ত বাই এখানে আসিয়াছেন, সেইদিন হইতেই সুন্দরলাল আর মালতীর নহে, তাঁহার ভগ্নীর। বাইজীর ভয়ে প্রকাশ্য ভাবে সুন্দরলাল বসন্তের ঘরে যাইত না, গোপনে অধিক রাত্রে তাঁহাদের পরস্পর সাক্ষাৎ হইত। মালতী বুঝিতে পারিয়া বসন্তকে তাঁহার গার্ডেনরিচের বাগানে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু এমন দিবস ছিল না, যেদিন সুন্দরলাল সেই বাগানে না গিয়াছে। সুন্দরলাল বাইসিকেলে করিয়া বাগানে যাইত, এবং চক্ষের নিমযে তথা হইতে ফিরিয়া আসিত। গোপনে এই কাৰ্য্য হইলেও বাইজী সমস্ত জানিতে পারিয়াছিলেন, সেই জন্যই এই সৰ্ব্বনাশ ঘটিয়াছে। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

নাজিরের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম, সুন্দরলালকে হত্যা করিয়াছে কে, এবং তাহার হত্যা হইবারই বা কারণ কি? এই অবস্থা বুঝিতে পারিবার পরই উপযুক্ত পুলিস-কর্ম্মচারী সঙ্গে লইয়া আমি বাইজীর বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। পুলিস নীচে রাখিয়া আমি উপরে উঠিলাম, দেখিলাম, বাইজী তখন পাঁচজন ভদ্রলোকের নিকট বসিয়া নাচ-গান আমোদ-আহ্লাদে মত্ত রহিয়াছেন, আমাকে দেখিয়াও দেখিলেন না। আমার ইঙ্গিত পাইবামাত্র বাইজী ধৃত হইলেন; ও তাঁহার ঘর খানাতল্লাসি করিয়া একটি কাল রঙ্গের পুরুষের পোষাক ও একটি পাঁচনলা পিস্তল পাওয়া গেল। যে সকল ভদ্রলোক সেখানে আমোদ-আহ্লাদ করিতেছিলেন, বেগতিক দেখিয়া তাঁহারা সকলেই পলায়ন করিলেন। 

বাইজীকে বলিলাম “একজন নিরীহ ব্যক্তিকে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলাইবার জন্য যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলে, তাহা এখন প্ৰকাশ পাইয়াছে। তুমিই সুন্দরলালকে হত্যা করিয়াছ।” 

বাইজী তখনও স্বীকার করিলেন না। বলিলেন “আপনি অন্যায় করিয়া গ্রেপ্তার করিতেছেন, কিন্তু প্রমাণ করিতে না পারিলে আপনার কি অবস্থা হইবে ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি? 

আমি উচ্চহাস্য করিয়া উত্তর করিলাম “সকল দিক না ভাবিয়া কি আমরা কোন কার্য্য করিতে পারি? যে পোষাক পরিয়া সুন্দরলালকে খুন করিয়াছিলে, যে পিস্তলের সাহায্যে রমণী হইয়া নরহত্যা করিয়াছ, তাহা এখন তোমার ঘর হইতেই বাহির হইল।” 

আমার কথায় বাইজী স্তম্ভিত হইলেন। ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সুন্দরলাল আমার প্রিয় ভৃত্য। আমি তাহাকে হত্যা করিব কেন? বিচারক এ কথা বিশ্বাস করিবেন কেন?” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “বিশ্বাস না করিবার কোন কারণ নাই। সুন্দরলাল তোমার হৃদয়ের অধিষ্ঠাতা দেবতা ছিল। তুমি তাহার প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী ছিলে। কিন্তু পরিশেষে সে তোমাকে বঞ্চনা করিয়া তোমার ভগ্নীর হৃদয় অধিকার করিল। এদিকে বিনয়বাবুও তোমাকে ছাড়িয়া তোমার ভগ্নীর প্রতি আকৃষ্ট হইল। তুমি জানিতে, বিনয়বাবু তোমার ভগ্নী বসন্তকেই অধিক ভালবাসেন। সেই জন্য এবং সুন্দরলাল হইতে তাহাকে দূরে রাখিবার জন্য তুমি বসন্তকে আপনার বাড়ী হইতে কৌশলে বাগানে পাঠাইয়াছিলে। বিনয় তাহার ঠিকানা জানিত না সুতরাং একেবারে দুইটি পক্ষী মারিবার নিমিত্ত তুমি বিনয়কৃষ্ণকে সেই বাগানে পাঠাইয়াছিলে ও সুন্দরলালকেও সেই স্থানে পাঠাইয়া আপন উদ্দেশ্য পূর্ণ করিয়া লইলে। দুজনের উপরই তোমার ক্রোধ হইয়াছিল। প্রথম সুন্দরলালের উপর। দ্বিতীয় বিনয়কৃষ্ণের উপর। তুমি সুন্দরলালকে রাত্রে এক পত্র দিয়া বাগানে বসন্তের নিকট পাঠাইয়া দিলে। বলিয়া দিলে, সে যেন সেই রাত্রেই ফিরিয়া আইসে। সৌভাগ্যক্রমে কাল রাত্রে ভয়ানক কুয়াসা পড়িয়াছিল। তুমি পুরুষবেশে পিস্তল লইয়া অশ্ব আরোহণ করতঃ খিদিরপুরের পোলের নিকট গিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলে। সেইরূপ সুবিধাও হইয়াছিল। বিনয়বাবুর সহিত সুন্দরলালের বিবাদ ও শেষে মারামারি পর্যন্ত হইল। অপদস্থ হইয়া বিনয়কৃষ্ণ বাড়ীতে পলায়ন করেন, আর তোমার ভৃত্যও বাড়ীর দিকে আসিতে থাকে। তুমি সেই সুযোগে সুন্দরলালের সম্মুখে উপস্থিত হও এবং কোন কথা না বলিয়া তাহাকে হত্যা কর। কেমন, এ কথা সত্য কি না?” 

সমস্ত কথা শুনিয়া বাইজী স্তম্ভিত হইলেন। প্রকাশ্যে বলিলেন “আপনি মানুষ না দেবতা? আমি ভাবিয়াছিলাম, এ সকল কথা কেহ জানিতে পারিবে না। কিন্তু আপনার কথায় ও কার্য্যে আমার সে ভ্রম দূর হইয়াছে।” 

বাইজীর কথায় আমি হাসিয়া উঠিলাম এবং বিলম্ব না করিয়া তখনই তাঁহাকে লইয়া থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। থানায় গিয়া মালতি সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত স্বীকার করিলেন। আমরা যাহা অনুমান করিয়াছিলাম, দেখিলাম, সেই অনুমান বর্ণে বর্ণে মিলিল। 

বিনয়কৃষ্ণ সেই রাত্রেই অব্যাহতি পাইলেন। 

বাইজী যে সকল কথা আমাদের নিকট স্বীকার করিল, তাহার পোষকতা করিবার নিমিত্ত যতদূর সম্ভব প্রমাণ পাওয়া গেল, কিন্তু তাহার নিজের কথা বাদ দিলে সেই প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া হত্যাকারীর দণ্ড ইংরাজ আইনে হয় না। বিচারকালে ব্যবহারজীবিগণের পরামর্শ অনুযায়ী সে তাহার সমস্ত দোষ অস্বীকার করিল, ও বিচারে অব্যাহতি পাইল। কিন্তু ওই মোকদ্দমায় তাহার যাহা কিছু বিষয়-সম্পত্তি ও অর্থ ছিল সমস্তই ব্যয় হইয়া গেল। তিনিও পরিশেষে কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া লক্ষ্ণৌ অভিমুখে প্রস্থান করিলেন, যাইবার সময় বসন্তকেও সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলেন। সম্পূর্ণ 

[ বৈশাখ, ১৩১৫ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *