জাল চেক
প্রথম পরিচ্ছেদ
মানুষের মন কিছুতেই সন্তুষ্ট নয়। আজ দারুণ গ্রীষ্মের প্রকোপে, রৌদ্রের অসহ্য উত্তাপে উৎপীড়িত হইয়া জেল জল’ বলিয়া চীৎকার করিতেছি। জল আর হয় না, আকাশ মেঘশূন্য, যেন আর কস্মিনকালেও বৃষ্টি হইবে না। কিন্তু যখন সেই বহুকালের আশার সামগ্রী, গ্রীষ্ম-প্রপীড়িত মানবের শান্তি-প্রদায়িনী বর্ষা আসিল,—যখন আকাশমণ্ডল নবনীরদজালে আবৃত হইয়া অনবরত গর্জ্জন করিতে লাগিল, যখন অবিশ্রান্ত ধারাপাতে মেদিনী সুশীতল হইল, মানব কি তখন সন্তুষ্ট হইল? মানুষ কি তখনও তৃপ্তিলাভ করিল? না, না-মানব যেমন ছিল, তেমনই রহিল। সে বলিল ‘রোজ রোজ বৃষ্টি ভাল লাগে না, শীত আসিলে বাঁচা যায়।’ আবার যখন সেই শীত আসিল, মানব তখনও তুষ্ট হইল না। সে বলিল ‘এ হাড়ভাঙ্গা শীতে কেমন করিয়া বাঁচিব? তাত সয় ত বাত সয় না।’ তাই বলিতেছি, মানবের মন কিছুতেই তৃপ্ত নহে।
আশ্বিন মাসের প্রায় অর্দ্ধেক অতীত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু গ্রীষ্মের ভয়ানক প্রাদুর্ভাব। মধ্যে মধ্যে প্রায়ই বৃষ্টি হইতেছিল বটে কিন্তু তাহাতেও গরম কমিতেছিল না। একে সেই ভয়ানক গ্রীষ্ম, তাহার উপর ঘণ্টায় তিন চারিবার বৃষ্টি হইতেছিল, কাজেই আমার মন বড় ভাল ছিল না।
প্রাতে শয্যা ত্যাগ করিয়াই দেখিলাম, মুষলধারে বৃষ্টি হইতেছে। বেলা আটটার সময় বৃষ্টি ধরিয়া গেল বটে, কিন্তু আকাশ ঘনঘটাচ্ছন্ন হইয়া রহিল। সূর্য্যের প্রখর রশ্মিও সেই নিবিড় নীরদমণ্ডল ভেদ করিতে পারিল না। জগৎপ্রাণ যেন সেই নবঘনচ্ছটায় ভীত হইয়াই বৃক্ষশিরে পলায়ন করিল। বাতাসের নামমাত্রও নাই। ভয়ানক গুমোট। শরীর হইতে অনর্গল ঘৰ্ম্ম নির্গত হইতে লাগিল। আমি বিরক্ত হইয়া অফিস-ঘরে প্রবেশ করিলাম।
গ্রীষ্মাতিশয্যবশতঃ পূর্ব্বদিনের অনেক লেখা পড়ার কাজ বাকী ছিল। অত্যন্ত বিরক্তির সহিত আমি সেই সকল কার্য্য আরম্ভ করিলাম। একটা ভয়ানক দাঙ্গার অনুসন্ধানে গিয়াছিলাম, তাহারই অবস্থা বিশদরূপে লিখিয়া রাখিলাম। সেই দাঙ্গার রিপোর্ট লিখিতে বেলা দশটা বাজিয়া গেল। আকাশ অনেকটা পরিষ্কার হইল। সঙ্গে সঙ্গে সূৰ্য্যদেবও দেখা দিলেন। কিছুক্ষণের জন্য মনে এক প্রকার অভূতপূর্ব্ব আনন্দ অনুভব করিলাম।
আহারাদি শেষ করিয়া বেলা এগারটার পূর্ব্বেই আবার অফিস-ঘরে বসিলাম। এমন সময়ে টেলিফেনের ঘণ্টা বাজিয়া উঠিল। ব্যস্তসমস্ত হইয়া যন্ত্রের নিকট গমন করিলাম। শুনিলাম, সাহেবের জরুরি কাজ, আমাকে তখনই তাঁহার নিকট যাইতে হইবে।
সাহেবের ঘরে গিয়া দেখিলাম, আরও দুইজন সাহেব বসিয়া আছেন। দুইজনের মধ্যে একজন পরিচিত, কোন একটি ব্যাঙ্কের ম্যানেজার—হেনেরি ম্যাক্লিন্। অপর ব্যক্তি আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত।
আমাকে দেখিয়াই সাহেব শশব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন “ব্যাঙ্কে কতকগুলি জাল চেক বাহির হইয়াছে। তোমাকে এখনই তাহার সন্ধানে যাইতে হইবে।
আমি কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া, তিনি আবার বলিলেন, “ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ম্যালিন সাহেবকে তুমি বেশ জান। উঁহার সহিত তোমার পরিচয়ও আছে।”
আমি সম্মতিসূচক উত্তর দিলাম। সাহেব তখন অপর ব্যক্তিকে দেখাইয়া বলিলেন “ইহার নাম জোন্স; ব্যাঙ্কে ইহার নামে অনেক টাকা জমা আছে। সম্প্রতি ইনি জানিতে পারিয়াছেন যে, ব্যাঙ্কের হিসাব ও উহার নিজের হিসাবে প্রায় লক্ষ টাকার গোলমাল। হিসাবের ভুল হইয়াছে মনে করিয়া, ইনি ব্যাঙ্কে আসিয়াছিলেন; ব্যাঙ্কের খাতা-পত্র দেখিয়া জানিতে পারিয়াছেন যে, হিসাবের কোন ভুল নাই। তাঁহার নামে কতকগুলি জাল চেক ভাঙ্গান হইয়াছে। চেকগুলি ব্যাঙ্কেই আছে। তোমার দেখিবার আবশ্যক হইলে সেখানে গিয়া দেখিয়া আসিতে পার।”
দ্বিরুক্তি না করিয়া সাহেবের নিকট বিদায় হইলাম এবং ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ও জোন্স সাহেবকে সঙ্গে লইয়া তখনই ব্যাঙ্কে গমন করিলাম। ম্যানেজার সাহেবের গাড়ি বাহিরেই অপেক্ষা করিতেছিল, পনের মিনিটের মধ্যেই আমরা সেখানে উপস্থিত হইলাম।
ব্যাঙ্কে পঁহুছিয়া যে পুস্তকে জোন্স সাহেবের হিসাব আছে, প্রথমেই সেই পুস্তকখানি দেখিতে চাহিলাম। আমাদিগকে যে কার্য্য করিতে হয়, তাহাতে সকল প্রকার বিদ্যারই প্রয়োজন। যদি বাস্তবিকই হিসাবে কোন ভুল থাকে, এই আশঙ্কায় জোন্স সাহেবের হিসাব দেখিতে ইচ্ছা হইল।
যে খাতায় জোন্স সাহেবের হিসাব ছিল, তাহা তখনই আমার নিকট আনীত হইল। আমি হিসাবটা তন্ন তন্ন করিয়া দেখিলাম। জোন্স সাহেবের নিজের হিসাবে তাঁহার নামে তিন লক্ষ দশ হাজার টাকা জমা থাকা উচিত। কিন্তু ব্যাঙ্কের খাতায় দেখিলাম, তাঁহার নামে মোট দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার মাত্র রহিয়াছে। আশি হাজার টাকার গোল। আমি তখন জোন্স সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি এই ব্যাঙ্কের নামে শেষ চেক কবে দিয়াছিলেন?”
জো। প্রায় দুই মাস পূৰ্ব্বে।
আ। কত টাকার?
জো। পঞ্চাশ হাজার।
আ। কাহার নামে চেক কাটিয়াছিলেন?
জো। লরেন্স কোম্পানির নামে।
আ। তাহার পর আরও তিনখানি চেক ভাঙ্গান হইয়াছে দেখিতেছি। দুইখানি ত্রিশ হাজার করিয়া, একখানি বিশ হাজার। এই আশি হাজার টাকারই গোলযোগ হইয়াছে। আপনার ঠিক মনে আছে যে, শেষ তিনখানি চেকে আপনার স্বাক্ষর নাই?
জো। না – সেই স্বাক্ষর তিনটিই জাল। চেকের নম্বর দেখিলেই, আপনি বুঝিতে পারিবেন। শেষ তিনখানি চেকের যে যে নম্বর দেওয়া হইয়াছে, সেই সেই নম্বরের চেক এখনও আমার কাছে আছে। যদি প্রয়োজন হয়, আমার অফিসে চলুন, দেখাইয়া দিব।
আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম “আজ্ঞে না—আপনার কথায় আমার অবিশ্বাস করিবার কোন কারণ নাই। যদি ভবিষ্যতে দরকার হয়, দেখিয়া আসিব। এখন দেখিবার বিশেষ প্রয়োজন নাই।”
এই বলিয়া আমি ম্যানেজার সাহেবের দিকে চাহিলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “জোন্স সাহেবের হিসাব কাহার হাতে থাকে? তিনি লোক কেমন?”
ম্যাক্লিন্ সাহেব অতি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলেন “রণেন্দ্রনাথ মিত্র নামে একেজন ভদ্র বাঙ্গালীর হাতে জোন্স সাহেবের হিসাব। যতদূর দেখা যায়, তাহাতে তাঁহাকে অতি সৎ লোক বলিয়াই বিবেচেনা হয়।”
আ। তিনি কোথায়? একবার এখানে আসিতে বলুন।
ম্যা। তিনি আজ অফিসে আইসেন নাই। শরীর অসুস্থ বলিয়া তিন দিনের ছুটী লইয়াছেন।
আ। আজ কি জোন্স সাহেবের ব্যাঙ্কে আসিবার কথা ছিল?
ম্যা। কই না—আমি তা জানিতাম না।
আ। রণেন্দ্রবাবুর পরিচিত কোন লোক এখানে চাকরী করেন? ম্যা। কই না—আমার ত জানা নাই।
আ। রণেন্দ্রের পত্র কে দিয়া গেল?
ম্যা। পত্র ডাকে আসিয়াছিল।
আমি তখন জোন্সকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “আজ যে আপনি ব্যাঙ্কে আসিবেন, এ কথা কাহাকেও বলিয়াছিলেন? কেহ কি জানিত যে, আপনি আজ এখানে সন্ধান লইতে আসিবেন?”
জো। আজ্ঞে না। আসিব কি না, আমি নিজেই জানিতাম না, অপরে কোথা হইতে জানিতে পারিবে?
আ। সে কি?
জো। কাল রাত্রি নয়টার পর হিসাব মিলাইতে গিয়া দেখিতে পাই, প্রায় লক্ষ টাকার গোল। তাই আজ প্রাতে আসিয়াছি।
আ। কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন যে, হিসাবে লক্ষ টাকার গোলযোগ। ব্যাঙ্কের হিসাব পাইলেন কোথায়? জো। আমার নামে কত টাকা জমা আছে জানিতে ইচ্ছা করিয়া পরশ্ব ব্যাঙ্কে একখানি পত্র লিখি। কাল সন্ধ্যার পর সে পত্রের উত্তর পাই।
আ। সে পত্রে কাহার স্বাক্ষর ছিল?
জো। সহকারী ম্যানেজার লরেন্সের সই ছিল।
যে তিনখানি চেক জাল বলিয়া সন্দেহ হইয়াছিল, আমি সেইগুলি দেখিতে চাহিলাম। ম্যাকলিন সাহেব তখনই একজন কেরাণীকে চেক তিনখানি আনিতে আদেশ করিলেন।
চেক তিনখানি হস্তগত হইলে আমি জোন্স সাহেবের সহিত সেই চেকগুলির স্বাক্ষর মিলাইয়া দেখিলাম। সইগুলি একই প্রকার, কোনরূপ তারতম্য নাই। অপরাপর চেকগুলিতে তিনি যেমন সই করিয়াছিলেন, এইগুলিতেও সেইরূপ স্বাক্ষরই রহিয়াছে; কোন প্রভেদ দেখিতে পাইলাম না।
ম্যানেজার ম্যাকলিন সাহেবকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, যে যে কেরাণীর সহিত জোন্স সাহেবের হিসাবের কোনরূপ সংস্পর্শ আছে, তাহাদের সকলেই উপস্থিত; কেবল রণেন্দ্রবাবুই অনুপস্থিত। সুতরাং তাহার উপরেই প্রথম সন্দেহ হইল। আমি তখন সাহেবের নিকট হইতে রণেন্দ্রের বাড়ীর সন্ধান জানিয়া লইলাম এবং জোন্স সাহেবকে আশ্বাস দিয়া তথা হইতে বহির্গত হইলাম।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রণেন্দ্রনাথের বাড়ী হাবড়ায়। ব্যাঙ্ক হইতে বাহির হইয়া একখানি গাড়ি ভাড়া করিলাম এবং সাধারণ বেশে হাবড়ায় গমন করিলাম। রণেন্দ্র বড় লোকের সন্তান। সন্ধানে জানিতে পারিলাম, তাঁহার পিতার নাম গোপালচন্দ্ৰ মিত্ৰ। এক সময়ে তিনি হাইকোর্টের একজন বড় উকীল ছিলেন। সুতরাং রণেন্দ্রনাথের বাড়ী খুঁজিয়া লইতে আমার বিশেষ কোন কষ্ট হইল না।
চারি বৎসর হইল রণেন্দ্রনাথের পিতা পরলোক গমন করিয়াছেন। তাঁহার আর কোন ভ্রাতা ছিল না। তিনিই এখন বাড়ীর কর্তা। বাড়ীগুলি প্রকাণ্ড দ্বিতল। লোকজনও অনেক। রণেন্দ্রের একটি পুত্র ও একটি কন্যা। বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র একজন ভৃত্য আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল “কাহাকে খুঁজিতেছেন, মহাশয়?”
আমি গম্ভীরভাবে উত্তর করিলাম “রণেন্দ্রবাবুর সহিত আমার বিশেষ প্রয়োজন। আমি তাঁহারই সহিত দেখা করিতে আসিয়াছি। বড় জরুরি কাজ—শীঘ্র ডাকিয়া দাও।”
ভৃত্য উত্তর করিল “তিনি আজ প্রাতে দেশে গিয়াছেন, দুই তিন দিনের মধ্যেই ফিরিয়া আসিবেন?”
আ। দেশে গিয়াছেন! সে কোথায়?
ভৃ। দেবীপুর—বর্দ্ধমান ষ্টেসন হইতে পাঁচ মাইল দূরে।
আ। সেখানে না যাইলে এখন আর দেখা হইবার সম্ভাবনা নাই?
ভৃ। আজ্ঞে না।
আ। তোমার কথায় বিশ্বাস হইতেছে না। কাল তিনি অফিসে গিয়াছিলেন, কেহ তাঁহাকে পীড়িত দেখেন নাই। আজ তিনি অফিসের ম্যানেজারের নিকট পত্র লিখিয়াছেন যে, তিনি পীড়িত। আবার তুমি বলিতেছ, তিনি দেশে গিয়াছেন। কোন্ কথা বিশ্বাস করিব?
ভৃ। আমি ত জানি, তিনি দেশে গিয়াছেন। গত রাত্রি হইতে তাঁহার জ্বরভাবও হইয়াছিল।
আ। কি জন্য দেশে গিয়াছেন জান?
ভৃ। আজ্ঞে না, আমরা চাকর–বাবুর কোথায় কি দরকার, আমরা জানিব কি প্রকারে?
আ। রণেন্দ্রবাবুর পরিবার কোথায়?
ভৃ। তিনিও তাঁহার সঙ্গে গিয়াছেন।
ভৃত্য যেভাবে আমার প্রশ্নের উত্তর দিল, তাহাতে তাহার উপর কোনরূপ সন্দেহ হইল না। আমার বিশ্বাস হইল, রণেন্দ্রবাবু দেশেই পলায়ন করিয়াছেন। যখন অফিসের আর আর কেরাণিগণ উপস্থিত আছেন, তখন তাঁহারই উপর সন্দেহ হইবার কথা। কিন্তু তিনি বাস্তবিক দোষী কি না, সে কথা জানিতে পারি নাই। কেবল সন্দেহ করিয়াই রণেন্দ্রবাবুর সন্ধান লইতেছিলাম। অপরাপর কেরাণিগণ উপস্থিত ছিল বলিয়াই যে তাহারা নির্দোষী, তাহা বলা যায় না। হয় ত তাহাদেরই মধ্যে প্রকৃত অপরাধী আছে। এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি রণেন্দ্রের বাড়ী হইতে বাহির হইলাম। মনে করিলাম, একবার ব্যাঙ্কে গিয়া ম্যালিন্ সাহেবকে অপর কেরাণিদের উপর নজর রাখিতে অনুরোধ করিব।
এই স্থির করিয়া আমি ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময়ে শ্যামলালবাবুর সহিত আমার দেখা হইল। শ্যামলালবাবু আমার বিশেষ পরিচিত বন্ধু—হাবড়া কোর্টের একজন উকীল।
শ্যামলালের সহিত আমার যখন সাক্ষাৎ হইল, তখন বেলা প্রায় একটা। সেদিন তিনি একটা বহুকালের পুরাতন মোকদ্দমায় জয়লাভ করিয়া প্রায় শতাধিক টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলেন। সেই আনন্দে এবং সেদিন কোন কাজ না থাকায়, তিনি সকাল সকাল বাড়ী ফিরিতেছিলেন, এমন সময়ে পথে তাঁহার সহিত আমার সাক্ষাৎ।
আমাকে অনেক দিনের পর দেখিয়া শ্যামলাল আন্তরিক প্রীত হইলেন। হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন “বাবু যে এদিকে? কি মনে করিয়া?”
আমিও হাসিতে হাসিতে উত্তর করিলাম “কাজ না থাকিলে বেলা দুপুরের পর কলিকাতা ছাড়িয়া হাবড়া আসিব কেন? তোমার সংবাদ ভাল ত?”
শ্যা। হাঁ ভাই, আপাততঃ সব ভাল। এখানে কোথায় আসিয়াছিলে?
আ। এই তোমারই প্রতিবেশী রণেন্দ্রবাবুর বাড়ী।
“যদি এতদূরে আসিয়াছ, তবে একবার আমার বাড়ীতে পায়ের ধূলা পড়িবে না?” এই বলিয়া শ্যামবাবু আমার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিলেন। আমি দ্বিরুক্তি করিলাম না।
পূর্ব্বে আর একবার শ্যামলালের বাড়ী আসিয়াছিলাম, কিন্তু সে অনেকদিনের কথা। শ্যামলালের বাড়ীখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নহে—দ্বিতল। বাহিরে একটা ছোট খাট উঠান। বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র ছেলেদের কোলাহল আমার কর্ণ গোচর হইল। দেখিলাম, চারি পাঁচটি বালক বালিকা সেই উঠানে খেলা করিতেছে।
আমরা উপস্থিত হইবামাত্র বালকদিগের কোলাহল থামিয়া গেল। কে কোথায় পলায়ন করিল তাহা বুঝিতে পারিলাম না। শ্যামলাল একজন ভৃত্যকে বৈঠকখানা খুলিয়া দিতে বলিলেন।
ঘর খোলা হইলে আমরা ভিতরে গিয়া এক একখানি চেয়ারে বসিয়া পড়িলাম। কিছুক্ষণ পরেই সেই ভৃত্য তামাকু সাজিয়া আনিল।
তামাকু সেবন করিতে করিতে শ্যামলাল আমায় জিজ্ঞাসা করিলেন “রণেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে আসিয়াছিলে?” আমি উত্তর করিলাম “হাঁ ভাই! তিনি যেখানে কর্ম্ম করেন, সেখানে অনেক টাকার গোল হইয়াছে। তাহারই সন্ধানের ভার আমার হাতে পড়িয়াছে। তাই একবার রণেন্দ্রের বাড়ীতে আসিয়াছিলাম।”
শ্যা। কেন? তিনি আজ অফিসে যান নাই?
আ। না ভাই! সেই জন্যই ত তাঁহার উপর সন্দেহ হইয়াছে।
শ্যা। তিনি বাড়ীতে আছেন?
আ। না–শুনিলাম, দেশে গিয়াছে।
যে ভৃত্য তামাক সাজিয়া জানিয়াছিল, সে আমার কথায় হাসিয়া ফেলিল। আমি তাহার হাসির কোন কারণ দেখিতে পাইলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম “কেন হে বাপু! আমার কথায় হাসিতেছ কেন? ব্যাপার কি?”
ভৃত্য সে কথার কোন উত্তর করিল না। বলিল “না মহাশয়! আমি আপনার কথায় হাসি নাই।”
শ্যামবাবু ভৃত্যের দিকে তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন। পরে বলিলেন “দেখ রাম! যদি কিছু জানিস্ স্ত বল্। এই বাবুকে চিনি না—ইনি পুলিসের ইনস্পেক্টার। শেষে কি মারা পড়বি। রণেন্দ্রবাবুর চাকরের সঙ্গে তোর আলাপ আছে জানি। যদি তার মুখে কিছু শুনিয়া থাকিস্ বল্–তোর ভাল হবে।”
শ্যামবাবুর কথায় আমিও সায় দিলাম। বলিলাম “হাঁ বাপু! তোমার মনিব যাহা বলিতেছেন, তাহা সম্পূর্ণ সত্য। যদি কিছু জানিয়া থাক বল, আমি এখনই তোমায় পুরস্কার দিব।”
আমাদের উভয়ের কথায় ভৃত্যের মন খুলিয়া গেল। সে বলিল “রণেন্দ্রবাবু রেঙ্গুন যাইবেন বলিয়া জাহাজে উঠিয়াছেন। তাঁহার সঙ্গে একজন চাকরও আছে।”
আ। কে তোমায় এ কথা বলিল?
ভৃ। সেই চাকরের ভাই।
আ। সে কোথায় থাকে?
ভৃ। কেন, রণেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে। তাহারা দুই ভায়েই সেখানে কর্ম্ম করে।
আ। রণেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে কয়জন চাকর আছে জান?
ভৃ। আজ্ঞে জানি বৈ কি—ওই দুই ভাই ছাড়া আর কোন চাকর নাই। তবে একজন দাসী আছে বটে।
আ। চাকর দুইজন কি পরস্পরের সহোদর ভাই?
ভৃ। আজ্ঞে হাঁ—কেবল সহোদর নয় যমজ। দুজনের আকৃতির অনেক সাদৃশ্য আছে।
আ। আজ বুধবার–বর্ম্মা মেলের দিন। জাহাজ ত কলিকাতা হইতে আজই ছাড়িবে?
ভৃ। আজ্ঞে হাঁ, আমিও শুনিয়াছি, বেলা তিনটার সময় জাহাজ ছাড়িবে।
বেলা তখন দেড়টা বাজিয়া গিয়াছে, আর দেড় ঘণ্টা পরেই জাহাজ ছাড়িবে। এই ভাবিয়া সেখানে আর বিলম্ব করিলাম না। শ্যামবাবুকে গোপনে সকল কথা প্রকাশ করিয়া তখনই সেখান হইতে বাহির হইলাম এবং শীঘ্রই থানায় ফিরিয়া আসিলাম। পরে সাহেবকে সমস্ত কথা বলিয়া, টিকিট কিনিয়া, তখনই রেঙ্গুনে যাইবার জাহাজে আরোহণ করিলাম।
জাহাজখানি প্রকাণ্ড। ইতিপূৰ্ব্বেই সেখানে অনেক লোক উপস্থিত হইয়াছিল। আমি যখন জাহাজে উপস্থিত হইলাম তখন বেলা আড়াইটা। জাহাজ ছাড়িতে তখনও অৰ্দ্ধঘণ্টা সময় ছিল। ভাবিলাম, যদি কোনরূপে এই আধঘণ্টার ভিতর রণেন্দ্রনাথকে বাহির করিতে পারি, তাহা হইলে আর আমাকে বৃথা রেঙ্গুন যাইতে হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ অনেক চেষ্টা করিয়াও রণেন্দ্রনাথের কোন সন্ধান পাইলাম না।
জাহাজে সৰ্ব্বশুদ্ধ প্রায় পঞ্চাশজন বাঙ্গালী। সকলেই প্রায় এক একটি ক্ষুদ্র কামরা ভাড়া লইয়াছিল। জাহাজ ছাড়িবার পূর্ব্বে সকলেই জাহাজের পাটাতনের উপর আসিয়াছিল। আমি সকলকেই ভাল করিয়া দেখিলাম, কিন্তু রণেন্দ্রবাবুর কোন ফটো না থাকায় আমি তাঁহার সন্ধান পাইলাম না।
রণেন্দ্রের বাড়ীতে যে ভৃত্য আমার সহিত কথা কহিয়াছিল, তাহার মত কোন লোকও তখন দেখিতে পাইলাম না।
ক্রমে অৰ্দ্ধঘণ্টা অতীত হইল, জাহাজের নঙ্গর তোলা হইল, চারিদিকের বাঁধন খুলিয়া দেওয়া হইল। অবশেষে ভয়ানক গৰ্জ্জন করিতে করিতে জাহাজখানি বেগে রেঙ্গুনের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। কিন্তু ব্যাঙ্কের যে লোকের আমার সহিত যাইবার কথা ছিল, তখনও পর্যন্ত তিনি আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিলেন না।
যতক্ষণ আলোক ছিল, যতক্ষণ দূরের বস্তু দেখা যাইতেছিল, আরোহিগণ ততক্ষণ জাহাজের পাটাতন হইতে নড়িল না। ক্রমে যখন সন্ধ্যা সমাগত হইল, পৃথিবী ঘোর তমসাচ্ছন্ন হইল, জাহাজে বৈদ্যুতিক আলোক প্রজ্বলিত হইল, তখন একে একে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া সকলেই আপন আপন নিদ্দিষ্ট কামরায় গমন করিল।
সে রাত্রে আর কিছু হইল না। আমিও নির্দিষ্ট কক্ষে গমন করিলাম এবং অতি কষ্টে রাত্রিযাপন করিলাম। পরদিন প্রাতেই শয্যা ত্যাগ করিলাম। দেখিলাম, আরোহিগণের অনেকেই বমি করিতেছে, প্রায় কেহই কামরা ছাড়িয়া বাহির হইতে পারে নাই।
কলিকাতা হইতে রেঙ্গুন যাইতে সচরাচর চারিদিন লাগে। কিন্তু যদি তুফান হয়, তাহা হইলে ছয় দিনেও যাওয়া যায় না। এই কয়দিনেই যাত্রীদিগের মধ্যে পরস্পরের বেশ আলাপ পরিচয় হইয়া থাকে।
সেই দিন বৈকালে আমি জাহাজের উপরের পাটাতনে বসিয়া আরোহিগণকে লক্ষ্য করিতেছি, এমন সময় একটি ভদ্রলোক আমার নিকট আসিয়া বসিয়া পড়িলেন। তখন বেলা প্রায় পাঁচটা, সূর্য্যদেব পাটে বসিবার উদ্যোগ করিতেছেন, আকাশমণ্ডল নানা বর্ণে চিত্রিত হইয়াছে, মৃদুমন্দ পবন ধীরে ধীরে প্রবাহিত হইতেছে। সেই নীলাম্বুস্নাত জগৎপ্রাণের স্পর্শে শরীর স্নিগ্ধ হইতেছিল। প্রকৃতির সেই অপরূপ শোভা সন্দর্শন করিয়া রোমাঞ্চিত হইলাম। যে কাৰ্য্যে আসিয়াছিলাম, তাহা ভুলিয়া গেলাম। একমনে জগৎপিতা জগদীশ্বরের মাহাত্ম্য কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলাম।
সেই যুবকের বয়স কুড়ি বৎসরের অধিক হইবে না, কিন্তু দেখিবামাত্র বোধ হয়, তাঁহার বয়স ত্রিশের অধিক। তাঁহাকে দেখিতে গৌরবর্ণ, দোহারা, নাতি দীর্ঘ, নাতি খৰ্ব্ব, মুখশ্রী অতি সুন্দর। দেখিলেই বড় ঘরের সন্তান বলিয়া বোধ হয়।
জাহাজে কোন পরিচিত লোক না থাকায়, আমার বড়ই কষ্ট হইতেছিল। ভদ্রলোকটিকে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে দেখিয়া, আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “মহাশয়ের নাম কি? রেঙ্গুনেই যাইতেছেন?”
আমার কথায় তিনি আপ্যায়িত হইলেন। বলিলেন “হাঁ মহাশয়, রেঙ্গুনেই যাইতেছি। আমার নাম খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী।”
আ। কলিকাতা হইতে আসিতেছেন?
খ। আজ্ঞে হাঁ-কলুটোলায় আমার বাড়ী।
আ। রেঙ্গুনে আপনার কোন আত্মীয় আছে না কি?
খ। আজ্ঞে না—আত্মীয় কোথায় পাইব?
আ। তবে কি জন্য সেখানে যাইতেছেন?
খ। ডাক্তারি করিতে।
আ। আপনি ডাক্তার?
খ। আজ্ঞে হাঁ-একজন হোমিওপ্যাথ। কলিকাতায় আমার মত অনেক আছে। তাঁহাদেরই অন্ন জোটা দায়। আমি সবে পাশ করিয়াছি, আমায় এখন কে বিশ্বাস করিয়া ডাকিবে? তাই কলিকাতা ছাড়িয়া দূরদেশে যাইতেছি। শুনিয়াছি, রেঙ্গুনে ভাল ডাক্তার নাই।
আ। জাহাজের কোনদিকে আপনার কামরা?
খ। পশ্চাৎ দিকে।
আ। আপনার সঙ্গে আর কেহ আছে?
খ। না মহাশয়, আমার সঙ্গী কেহ নাই, কিন্তু এখানে আসিয়া আমি এক বিপদে পড়িয়াছি। আমার কামরার ঠিক পার্শ্বে একজন জরাগ্রস্ত বৃদ্ধের ঘর। বৃদ্ধ প্রায় ঘরের ভিতর থাকে, এক-আধবার বাহির হয় মাত্র। বৃদ্ধের নানা রোগ-এখন আমারই চিকিৎসাধীনে রহিয়াছেন।
আ। তিনি কি একাই জাহাজে আসিয়াছেন?
খ। একজন চাকর তাঁহার সঙ্গে আছে। কিন্তু সে সদাই তাঁহার ভয়ে ভীত। সাহস করিয়া একা তাঁহার ঘরের ভিতর যাইতে পারে না। কাল বৈকালে বৃদ্ধ না কি একবার তাহাকে একটা তেলের বোতল ছুড়িয়া মারিয়াছিল, ভৃত্য সেই ভয়ে আর একা তাঁহার নিকটে যায় না।
আ। বৃদ্ধের আহারের কিরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছে?
খ। তিনি যে রোগে ভুগিতেছেন, তাহা এ বয়সে আরোগ্য হইবার সম্ভাবনা নাই। জরাগ্রস্ত পরিণতবয়স্ক ব্যক্তিগণের যে যে রোগের সম্ভাবনা, এই বৃদ্ধেরও সেই সেই রোগ। সুতরাং তাঁহার অন্নাহারই ব্যবস্থা করিয়াছি। কিন্তু জাহাজের ব্রাহ্মণে তাঁহার নিকট অন্ন দিয়া আইসে না, সে কাজও আমায় করিতে হয়। শুনিলাম, বৃদ্ধ তাহাকেও মারিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি বৃদ্ধকে ঔষধ দিয়াছিলাম। এই আমার অপরাধ, এই জন্যই আমার এত নিগ্রহ। সেই অবধি আমি ভিন্ন আর কোন লোকে তাঁহার সেবা করিলে তিনি বিরক্ত ও রাগান্বিত হন, কখনও কখনও প্রহার করিতেও চেষ্টা করেন।
এইরূপ নানা কথায় রাত্রি অধিক হইল। আমি আমার কক্ষে প্রস্থান করিলাম। পরে আহারাদি সমাপন করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলাম। আমি নিজেই আমার আহারের বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম। কতকগুলি উৎকৃষ্ট ফলমূলাদি, মুড়কী, চিড়া, জমাট দুগ্ধ ইত্যাদি আহারীয় সমাগ্রী আমি সঙ্গে লইয়াছিলাম।
পরদিন বেলা প্রায় আটটার পর নিদ্রাভঙ্গ হইল। যখন শয্যা ত্যাগ করিলাম, তখনও যেন ঊষা। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। আকাশ ভয়ানক মেঘাচ্ছন্ন, বাতাসের নাম মাত্র নাই, সমুদ্র স্থির। জাহাজখানি অটলভাবে দ্রুতগতি রেঙ্গুনাভিমুখে ছুটিতেছিল।
কাপ্তেন হইতে অধস্তন কর্মচারী পর্যন্ত বিষণ্ন – চিন্তান্বিত, যেন ভাবী বিপদের আশঙ্কার সম্ভব। যাহারা প্রায়ই হাস্য পরিহাস করিয়া মনের আনন্দে দিনপাত করিত, সেদিন তাহারাও কাহারও সহিত কথা কহিল না। সকলেই ব্যস্ত, যেন একটা মহোৎসবের আয়োজনে নিযুক্ত।
আমি উপরের পাটাতনের একটি নিরাপদ স্থানে দাঁড়াইয়া ওই ব্যাপার লক্ষ্য করিতেছিলাম, এমন সময় জাহাজের পশ্চাৎ দিকে একখানি চেয়ারের উপর একটি বৃদ্ধকে দেখিতে পাইলাম। গত রাত্রে ওই বৃদ্ধেরই কথা খগেন্দ্রবাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম। উহার অদ্ভুত আচরণ শুনিয়া আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়াছিলাম। তাঁহাকে ভাল করিয়া দেখিতে ইচ্ছা হইল। আমি ধীরে ধীরে সেইদিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম।
বৃদ্ধ একদৃষ্টে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়াছিলেন সুতরাং তাঁহার অজ্ঞাতসারে আমি অনেক নিকটবর্ত্তী হইলাম। দেখিলাম, বৃদ্ধের বয়স প্রায় সত্তর বৎসর। তাঁহার সর্বাঙ্গের মাংস শিথিল হইয়া গিয়াছে। অতি কষ্টে তিনি সেই চেয়ারের উপর বসিয়া সমুদ্র দেখিতেছিলেন। তাঁহার কিছু দূরে একজন ভৃত্য দাঁড়াইয়াছিল। ওই ভৃত্যকে দেখিবামাত্র আমার মনে ভয়ানক সন্দেহ জন্মিল। ভাবিলাম, তাহাকে আর কোথাও দেখিয়াছি।
ভৃত্য একদৃষ্টে সেই বৃদ্ধের দিকে চাহিয়াছিল। বোধ হয়, পাছে বৃদ্ধ কাহারও উপর কোনরূপ অত্যাচার করেন কিম্বা তাহার নিজের কোনপ্রকার অনিষ্ট হয়, এই ভয়েই সে নির্নিমেষ নয়নে বৃদ্ধের দিকে চাহিয়াছিল।
ভৃত্য এইরূপে থাকায় আমি তাহাকে ভাল করিয়া দেখিবার সুবিধা পাইলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমার স্মরণ হইল, লোকটার ভাইকে রণেন্দ্রনাথের বাড়ীতে দেখিয়াছিলাম। শুনিয়াছিলাম, রণেন্দ্রই ইহাকে সঙ্গে লইয়াছেন। কিন্তু লোকটা ত একজন বৃদ্ধের সেবায় নিযুক্ত দেখিতেছি।
এ কি রহস্য? উকীলের চাকর আমাকে মিথ্যা বলিবে কেন? সে যাহা শুনিয়াছে, তাহাই বলিয়াছে। এই লোকটা দেখিতে ঠিক রণেন্দ্রনাথের বাড়ীর চাকরের মত, তাহাকে দেখিবামাত্র বোধ হইয়াছিল, যেন তাহাকে আর কোথাও দেখিয়াছি। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে; আমি তাহাকে আর কখনও দেখি নাই, তাহার যমজ ভ্রাতাকে রণেন্দ্রনাথের বাড়ীতে দেখিয়াছিলাম।
যদি সত্য সত্যই রণেন্দ্রনাথ তাহাকে লইয়া পলাইয়া থাকেন, আর যদি তিনি এই জাহাজে থাকেন, তাহা হইলে ওই বৃদ্ধকেই রণেন্দ্র বলিতে হয়। শুনিয়াছি, রণেন্দ্রনাথ একজন যুবা পুরুষ, বৃদ্ধ নহে। এ কি রহস্য! তবে কি রণেন্দ্রনাথ বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছেন?
আশ্চর্য্য নয়। যে ব্যক্তি জাল করিয়া আশি হাজার টাকা আত্মসাৎ করিতে পারে, সে নিতান্ত সহজ লোক নয়। আমি পুনঃ পুনঃ বৃদ্ধের দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলাম, কিন্তু তাঁহাকে ছদ্মবেশী বলিয়া বোধ হইল না। কেবল সেই ভৃত্যকে দেখিয়াই তাহার উপর সন্দেহ হইয়াছিল।
অনেকক্ষণ দেখিয়াও আমি তাঁহার ছদ্মবেশ ধরিতে পারিলাম না। আরও কিছু অগ্রসর হইলাম, সেদিকে বেশী লোক ছিল না। তাহারা প্রভু ও ভৃত্য ব্যতীত আর দুইজন মাত্র বসিয়াছিলেন, আরও কিছুদূর অগ্রসর হইলে পর বৃদ্ধ হঠাৎ আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন। দেখিলাম, তাঁহার মাংস শিথিল বটে, কিন্তু বর্ণ যেন অস্বাভাবিক, যেন মৃত-মনুষ্যের মত। দূর হইতে একপ্রকার দেখিয়াছিলাম, নিকটে আর এক প্রকার। তাঁহার চক্ষের দৃষ্টি বৃদ্ধের মত নহে। যৌবনে চক্ষু যেমন চঞ্চল থাকে, এই বৃদ্ধের চক্ষুরও ঠিক সেই ভাব। এই চক্ষু দেখিয়া আমার ভয়ানক সন্দেহ হইল। ভাবিলাম, এ সন্দেহ কিরূপে দূর করা যায়। একবার মনে করিলাম, খগেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলে হয়ত এ রহস্য ভেদ করিতে পারিব। যদি জানিতে পারি যে, বৃদ্ধ ছদ্মবেশী, তাহা হইলে উহাকে রণেন্দ্র বলিয়া গ্রেপ্তার করিব।
খগেন্দ্রনাথের সহিত দুই একবার মাত্র আলাপ করিয়া এত বন্ধুত্ব হইয়াছিল, যেন তিনি অনেকদিনের আমার পরিচিত বন্ধু। খগেন্দ্রনাথ যদি এ বিষয়ে কিছু অবগত থাকেন, তাহা হইলে তিনি নিশ্চয়ই আমায় সে কথা বলিবেন।
এই মনে করিয়া খগেন্দ্রনাথের অন্বেষণে জাহাজের অপর দিকে গমন করিলাম। কিন্তু তখন তাঁহাকে কোথাও দেখিতে পাইলাম না। একজন খালাসীর মুখে শুনিলাম, তিনি আপন কামরায় শয়ন করিয়া আছেন। দত্ত রোগের ভয়ানক যাতনায় না কি অস্থির হইয়াছেন।
আমি অগত্যা ফিরিয়া আসিলাম। পূর্ব্বে যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলাম, সেখানে আসিয়া দেখিলাম, বৃদ্ধ ইতিপূৰ্ব্বেই চলিয়া গিয়াছে। ভৃত্যও আর সেখানে দাঁড়াইয়া নাই। ভৃত্যের সহিত দেখা করিয়া দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিবার ইচ্ছা হইল। যেদিকে বৃদ্ধের কামরা ছিল, সে কথা আমি খগেন্দ্রনাথের মুখেই শুনিয়াছিলাম, সেই দিকে যাইতে লাগিলাম। দেখিলাম, দুইটি পাশাপাশি কামরাই ভিতর হইতে আবদ্ধ। একটির দ্বারে সেই ভৃত্য।
আমি অতি সন্তর্পণে ভৃত্যের নিকটে যাইলাম। সঙ্কেত করিয়া তাহাকে নিকটে ডাকিলাম। সে ঘাড় নাড়িল। বুঝিলাম, সে আসিতে পারিবেন। তখন আস্তে আস্তে দুই একটা মিষ্ট কথায় তাহাকে বশ করিলাম এবং কিছুদূরে ডাকিয়া লইয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “তোমার নাম কি?”
পরে হাসিতে হাসিতে বলিলাম “তুমি ত বেশ সুখে আছ?”
ভৃত্য আমায় ভদ্রলোক দেখিয়া এবং আমার ধনী লোকের মত পোষাক দেখিয়া, আমার হাসিতে গলিয়া গেল। সেও ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিল “আজ্ঞে হাঁ, আমার বড় সুখের চাকরী; আমায় হয় পাগল করিবে, না হয় একদিন উঁহারই হাতে আমার প্রাণ যাইবে। কাল বৈকালে একটা তেলের বোতল ছুড়িয়াছিলেন। যদি মাথায় লাগিত, তাহা হইলেই মরিয়া যাইতাম।”
আ। এ চাকরী তোমার কতদিনের?
ভৃ। আজ্ঞে বেশী দিনের নয়-আট দশদিন মাত্র। বাবু বায়ু পরিবর্তনের জন্য রেঙ্গুন যাইতেছেন। ভৃত্যের প্রয়োজন, আমি নিষ্কর্ম্মা ছিলাম, কাজেই এই ভয়ানক কাজে নিযুক্ত হইয়াছি।
নাম গোপন করিল দেখিয়া, আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার নাম কি?”
ভৃ। হরিদাস।
আ। নিবাস?
ভৃ। রাণাঘাট।
আ। তোমার মা বাপ বৰ্ত্তমান?
ভৃ। আজ্ঞে না।
আ! ভাই আছে?
ভৃত্য এবার আর তখনই উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর বলিল “আজ্ঞে না।”
উত্তর দিতে বিলম্ব দেখিয়া আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইল। কিন্তু সে বিষয় কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলাম না। ভৃত্যের সহিত তাহার পারিবারিক কথা কহিতে লাগিলাম।
এইরূপে নানা কথায় বেলা প্রায় এগারটা বাজিল, কিন্তু আমার অভিপ্রায় সিদ্ধ হইল না। কৌশলে ভৃত্যকে অনেকবার তাহার প্রভুর কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু হয় সে অত্যন্ত চতুর, আমার চক্ষেও ধূলি দিল,—না হয় বৃদ্ধ রণেন্দ্রনাথ নহে। ভৃত্যকে বুদ্ধের নাম জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, তাঁহার নাম ‘অনাথবন্ধু’। যে লোক এত কাণ্ড করিতে পারে সে যে নাম লুকাইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি?
খগেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলেই প্রকৃত কথা জানিতে পারিব, এই মনে করিয়া আমি আমার কামরায় ফিরিয়া আসিলাম এবং সত্বর আহারাদি শেষ করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলাম।
বেলা চারিটার সময় কামরা হইতে বাহিরে যাইলাম। দেখিলাম, আকাশের অবস্থা আরও ভয়ানক। মেঘ ক্ৰমে ঘন হইতে লাগিল, অন্ধকার ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। জাহাজের ভিতর বেলা চারিটার সময়েই বৈদ্যুতিক আলোক প্রজ্বলিত হইল।
বাহিরে আসিয়া কিছুক্ষণ আকাশের অবস্থা লক্ষ্য করিতেছি, এমন সময় কোথা হইতে সহসা খগেন্দ্রনাথ সেখানে উপস্থিত হইলেন। বিনা ক্লেশে তাঁহার দর্শন পাওয়ায় আমি যৎপরোনাস্তি আনন্দিত হইলাম; এবং তখনই তাঁহার যন্ত্রণার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। আমার প্রশ্নে পরম আনন্দিত হইয়া তিনি বলিলেন, অনেকটা সুস্থ হইয়াছেন!
অন্যান্য অনেক কথার পর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “খগেন্দ্রবাবু! আপনি ত বৃদ্ধের সহিত খুব ঘনিষ্ঠতা করিয়াছেন, উহার মধ্যে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করিয়াছেন কি?”
আমার কথায় খগেনবাবু আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিলেন। পরে বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ, দেখিয়াছি; কিন্তু সে বিষয় আমি অগ্রাহ্য করিয়াছিলাম। আপনি এখন জিজ্ঞাসা করাতে আমার স্মরণ হইল। আপনি বৃদ্ধের চক্ষের জ্যোতির কথা বলিতেছেন ত?”
খগেন্দ্রনাথের কথায় আমার বড়ই আনন্দ হইল। আমি দুই হস্তে তাঁহার দুটি হাত ধারণ করিয়া বলিয়া উঠিলাম “মনের কথা টানিয়া বাহির করিয়াছ ভায়া! আমিও ওই চোখের কথাই বলিতেছিলাম।”
খগেনবাবু হাসিয়া বলিলেন “আমারও সন্দেহ হইয়াছিল।” আমি বৃদ্ধকে ভাল করিয়া লক্ষ্য করিলাম, বিশেষ নজর রাখিলাম, কিন্তু কিছুই ধরিতে পারিলাম না। ওই চোখেই বৃদ্ধের কিছু বিশেষত্ব আছে।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
যখন খগেন্দ্রবাবুর সহিত এইরূপ কথাবার্তায় নিযুক্ত ছিলাম, ঠিক সেই সময়ে জাহাজের কাপ্তেন একখানি সংবাদপত্র লইয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হইলেন। জাহাজে অনেকগুলি লোক ছিল বটে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে অধিকাংশই অজ্ঞ। আমরা সামান্য লিখিতে ও পড়িতে পারি জানিয়া, কাপ্তেন আমার হাতে সেই সংবাদপত্র দিয়া বলিলেন “দেখুন, একজন বাঙ্গালীর কার্য্য দেখুন। জাল চেকের সাহায্যে প্রায় লক্ষ টাকা লইয়া লোকটা কোথায় সরিয়া পড়িয়াছে।” দেখিলাম, আমরা যেদিন জাহাজে উঠিয়াছি, ওই সংবাদপত্রখানিও সেইদিন বৈকালে বাহির হইয়াছে।
বলা বাহুল্য, সে কথা আমি অনেক পূৰ্ব্বেই জানিতাম এবং দোষীকে ধরবার জন্যই আমি তখন জাহাজে ছিলাম। কিন্তু সাহেবের মুখে ওই কথা শুনিয়া আমি যেন স্তম্ভিত হইলাম। বলিলাম “সে কি! এত টাকা ভাঙ্গিয়া লোকটা পলায়ন করিয়াছে?”
এই বলিয়া তাঁহার হাত হইতে সংবাদপত্রখানি লইলাম এবং খগেন্দ্রনাথের সমক্ষে সেই অংশ পাঠ করিলাম। দেখিলাম, খগেন্দ্রনাথ যেন বিমর্ষ হইলেন। কিন্তু সে কেবল মুহূর্ত্তের জন্য। চক্ষের পলক পড়িতে না পড়িতে তিনি আত্মসংবরণ করিলেন।
আমি এইরূপ ভাব দেখাইলাম, যেন তাঁহার বিমর্ষ মুখখানি আমি লক্ষ্য করি নাই। খগেন্দ্রনাথ আমার মুখের দিকে চাহিয়া হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন “লোকটার নাম কি?”
আমি বলিলাম “ রণেন্দ্রনাথ মিত্র, ব্যাঙ্কের একজন কেরাণী।”
খ। কবে এ কাণ্ড হইয়া গিয়াছে?
আ। যেদিন আমাদের জাহাজ ছাড়ে, সেই দিনেই জানা গিয়াছিল। কবে যে জাল হইয়াছিল, সে কথা সংবাদপত্রে লেখা নাই।
খ। তবে ত সে আজ দুই তিনদিনের কথা; হয় ত ইতিমধ্যে অপরাধী ধৃত হইয়াছে।
আ। সে কথা বলা যায় না। এ রকম লোক যে সহজে ধরা পড়িবে, এমন বোধ হয় না।
খ। কত টাকা জাল করিয়াছিল?
আ। প্রায় লক্ষ টাকা।
খ। লোকটা যে রাতারাতি ধনবান হইয়া পড়িয়াছে?
আ। যেমন রাতারাতি বড়মানুষ হইয়াছে, তেমনি আবার রাতারাতি ফকির হইয়া যাইবে। ঈশ্বরের রাজ্যে পক্ষপাত নাই। যে যেমন কাজ করে, সে সেই মতই ফল পাইয়া থাকে।
আমার শেষ কথায় খগেন্দ্রনাথ হাস্য করিলেন। কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না।
ক্রমে অন্ধকার আরও গাঢ় হইয়া আসিল, মেঘমণ্ডল যেন স্তরে স্তরে সজ্জিত হইতে লাগিল। বাতাসের লেশ মাত্র ছিল না। তাহার উপর যতই রাত্রি বাড়িতে লাগিল, ততই যেন আরও গুমোট হইতে লাগিল।
রাত্রি নয়টার পর খগেন্দ্রবাবু নিজ কামরায় চলিয়া গেলেন। আমিও সমস্ত দিন ভয়ানক চিন্তায় এত পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, রাত্রে যৎসামান্য জলযোগ করিয়া শয্যায় শুইয়া পড়িলাম। এবং অনতিবিলম্বে গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম।
যখন আমার ঘুম ভাঙ্গিল, তখনও ভয়ানক অন্ধকার। জাহাজের প্রত্যেক কামরায় বৈদ্যুতিক আলোক জ্বলিতেছিল। সে আলোকে ঘড়ী দেখিলাম, রাত্রি দুইটা বাজিয়া গিয়াছে। চারিদিকের ভয়ানক কোলাহল, বাতাসের ভয়ানক গৰ্জ্জন এবং তাহার উপর আরোহিদিগের আর্তনাদে আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, ঝড় আরম্ভ হইয়াছে।
যে ঝড়ের আশঙ্কা করিয়া কাপ্তেন হইতে খালাসী পৰ্য্যন্ত এতক্ষণ বিষণ্ণ ভাবে সময়াতিপাত করিতেছিল, যাহার ভয়ে এতক্ষণ তাহারা পরস্পর কথাটি পর্য্যন্ত কহে নাই, এখন সেই ঝড় যেন দ্বিগুণ বেগে সমুদ্রের তরঙ্গের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিল।
সেই ভয়ানক ঝড় বর্ণনা করা আমার সাধ্য নহে। এক একবার ঝড়ের প্রকোপে জাহাজখানি টলমল করিতেছিল। বোধ হইল, যেন পরক্ষণেই উহা আরোহিগণ সমেত জলমগ্ন হইবে। আমি কামরা হইতে বাহির হইলাম। আমাকে দেখিয়া একজন সাহেব বলিলেন, “বাবু, ঘরের ভিতর যান। শেষে কি এই ঝড়ে প্রাণ দিবেন?”
সাহেবের কথা শুনিয়া আমার মনে রাগ হইল। বলিলাম “সাহেব! বাঙ্গালীরা কি এতই ভীরু যে, ঝড়ের সময় বাহিরে আসিতে পারে না?”
আমার কথায় সাহেব অপ্রস্তুত হইলেন। বলিলেন “না মহাশয়! আমি সেরূপ মনে করি না। আপনার মঙ্গলের জন্যই আমি ওই কথা বলিয়াছি। যদি আপনি এই বাতাসের বেগ সহ্য করিতে পারেন, ভালই ত। তবে ওখানে দাঁড়াইয়া আছেন কেন? আসুন, এইখানে বসিয়া দেখা যাউক।”
সাহেব যে স্থানটি নির্দ্দেশ করিলেন, বাস্তবিক উহা নিরাপদ। সাহেব একখানি চেয়ার লইয়া সেই স্থানে বসিয়া পড়িলেন এবং আমাকেও তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিতে বলিলেন। আমি তাঁহার অনুরোধ রক্ষা করিলাম।
প্রবলবেগে ঝড় বহিতে লাগিল, পৰ্ব্বত প্রমাণ তরঙ্গগুলি যেন জাহাজকে চাপিয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিবে বোধ হইতে লাগিল। ইতিপূৰ্ব্বেই জাহাজের পালগুলি নামাইয়া রাখা হইয়াছিল, পাছে ঝড়ে জাহাজের কল খারাপ হইয়া যায়, সেই ভয়ে পূৰ্ব্ব হইতেই জাহাজ বন্ধ করা হইয়াছিল। ঝড়ের প্রকোপে জাহাজখানি পিছু হটিতে লাগিল।
ক্রমে পাঁচটা বাজিল। ঝড় স্থগিত হওয়া দূরে থাক, উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইতে লাগিল। আমি একবার খগেন্দ্রনাথের সন্ধানে বাহির হইলাম। কিন্তু অন্ধকারে জাহাজের সেইদিকে যাইতে পারিলাম না। যেখানে বসিয়াছিলাম, সেইখানেই বসিয়া রহিলাম।
আরও একঘণ্টা অতীত হইল। অল্প অল্প আলোক দেখা দিল। সেই আলোকে আমি দেখিলাম, দূরে সেই বৃদ্ধ একস্থানে নিশ্চল নিস্পন্দবৎ দণ্ডায়মান রহিয়াছেন।
বৃদ্ধকে দূর হইতে দেখিতে পাইয়া তাঁহার নিকট যাইবার জন্য আমার ইচ্ছা হইল। কিন্তু যে সাহেব আমার নিকট বসিয়াছিলেন, তিনি নিষেধ করিলেন। বলিলেন, ঝড়ের এত বেগ যে, হয়ত খগেনবাবুর নিকট যাইতে যাইতে আপনি নিজেই সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হইবেন।
সাহেবের কথা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বোধ হইলেও আমি চেয়ার ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া উঠিলাম। পরক্ষণেই একটা ভয়ানক দমকা বাতাস আসিল, জাহাজ যেন টলমল করিয়া উঠিল। যে সকল আরোহী এতক্ষণ বাহিরে পাটাতনের উপর ছিল, তাহারা আপন আপন কামরায় পলায়ন করিল। সেই সময় খগেন্দ্রবাবু চীৎকার করিয়া উঠিলেন, বৃদ্ধ ঝড়ের বেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া সমুদ্রগর্ভে পতিত হইয়াছে। এই কথা শুনিয়া কাপ্তেন সাহেব সেই ঝড়ের সময়েও জাহাজের ছোট নৌকা নামাইয়া দিলেন, চারিজন খালাসীর সহিত একজন ইংরাজ কর্মচারী উহাতে সেই সময়ে সেই ভয়ানক সমুদ্রের মধ্যে গমন করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তরঙ্গের মধ্যে ওই নৌকা আর দেখিতে পাওয়া গেল না। কিন্তু প্রায় এক ঘণ্টা পরে আরোহীর সহিত ওই নৌকা জাহাজে আসিয়া লাগিল। তাহারা একটি বৃদ্ধের ছদ্মবেশ মাত্র লইয়া উপস্থিত হইলেন, কিন্তু কোন মনুষ্যকে প্রাপ্ত হইলেন না।
এই অবস্থা দেখিয়া আমার মনে ধারণা হইল যে, রণেন্দ্রনাথ বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া পলায়ন করিতেছিলেন, কিন্তু কোনরূপে তিনি বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আমি তাঁহাকে ধরিবার নিমিত্ত তাঁহারই সহিত এক জাহাজে গমন করিতেছি, সুযোগ পাইলেই তাঁহাকে ধরিব। এই ভাবিয়া তিনি অপমানের ভয়ে সমুদ্রে আত্মবিসর্জ্জন করিয়া নিজের মান-সম্ভ্রম রক্ষা করিয়াছেন। সেই সময় তাঁহার ছদ্মবেশ ভালরূপ পরা ছিল না, সুতরাং উহা তাঁহার অঙ্গচ্যুত হইয়া ভাসিয়াছে, কিন্তু রণেন্দ্র সেই অগাধ সমুদ্র করলে কবলিত হইয়াছেন।
এই সংবাদ তখনই জাহাজের চারিদিকে রাষ্ট্র হইল। সকলেই বৃদ্ধকে দেখিয়াছিল, বৃদ্ধের অদ্ভুত আচরণ ও নানাপ্রকার জটিল রোগের কথাও অনেকেই শুনিয়াছিল। বুদ্ধের অপঘাত মৃত্যুতে সকলেই দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল।
আরও দুই ঘণ্টা অতীত হইল। ক্রমেই বাতাসের বেগ কমিতে লাগিল। বেলা দশটার সময় ঝড় থামিল। এগারটার পর সূর্য্যদেব আকাশমার্গে দেখা দিলেন। বেলা একটার মধ্যেই প্রকৃতি শান্তমূর্তি ধারণ করিল, সমুদ্র স্থির হইল, আকাশমণ্ডল নীলবর্ণ ধারণ করিল। স্তরে স্তরে সজ্জিত নবঘননীরদমালা যেন কোথায় অদৃশ্য হইল। রৌদ্রে কাঠ ফাটিতে লাগিল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
সেইদিন সন্ধ্যার সময় আমি খগেন্দ্রনাথের নিকট গমন করিলাম। দেখিলাম, তিনি বৃদ্ধের জিনিষপত্র কাপ্তেনকে বুঝাইয়া দিতেছেন। আমাকে দেখিয়া অতি দুঃখিতভাবে বলিলেন “বৃদ্ধের অপঘাত মৃত্যুর কথা নিশ্চয়ই শুনিয়া থাকিবেন। তাঁহাকে যিনি যাহাই বলুন, আমার সহিত তিনি কখনও অন্যায়াচরণ করেন নাই। জানি না, কেন তিনি দুইজন নিরীহ লোককে প্রহার করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। যাহা হউক, তিনি আমার চিকিৎসাধীনে ছিলেন, আমি প্রায়ই তাঁহার কামরায় আসিতাম; সুতরাং তাঁহার কোথায় কি জিনিষপত্র আছে, তাহা আমার জানা আছে। পাছে তাঁহার ভৃত্য ওই সকলের কোনটি আত্মসাৎ করিতে চেষ্টা করে, এই জন্য জাহাজের কাপ্তেন আমারই সাক্ষাতে তাঁহার দ্রব্যগুলির ভার লইতে ইচ্ছা করেন। আমি উঁহারই অনুরোধে বৃদ্ধের জিনিষপত্র দেখাইয়া দিতেছি।
কাপ্তেন বৃদ্ধের একটি ট্রাঙ্ক, একটা চামড়ার ব্যাগ, খানকয়েক কাপড়, তিনটা জামা, একটা ছাতা ইত্যাদি লইয়া প্রস্থান করিলে পর, আমি খগেনবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম “বৃদ্ধের বাড়ী কোথায় জানেন?”
খগেন্দ্রনাথ উত্তর করিলেন “আজ্ঞে না। আশ্চর্য্য এই যে, একসঙ্গে থাকিয়া কত কথাই কহিয়াছি, কিন্তু তাঁহার পারিবারিক কোন কথাই জিজ্ঞাসা করি নাই। কেবল তাঁহার রোগের কথা লইয়াই থাকিতাম।”
খগেন্দ্রনাথ যেরূপে শেষোক্ত কথাগুলি বলিলেন, তাহাতে আমার কেমন অবিশ্বাস জন্মিল। এতাবৎ কাল তাঁহার উপর কোন বিষয়ে আমার সন্দেহ হয় নাই; কিন্তু এই কথায় কেন অবিশ্বাস হইল বলিতে পারি না।
বৃদ্ধের ভৃত্যের উপরেও সন্দেহ হইল। সে এখন খগেনবাবুর সহিত এরূপভাবে কথাবার্তা করে, যেন সে তাঁহার বহুদিনের চাকর। কেন এমন হইল? যে ছয় ঘণ্টা পূর্ব্বে অপরের ভৃত্য ছিল, সে এখন খগেনবাবুর এত পরিচিত হইল কিরূপে? তবে কি তাহারা পূর্ব্ব হইতেই পরস্পরের পরিচিত? রণেন্দ্রের বয়স প্রায় খগেন্দ্রনাথের মত। ভৃত্য কি তবে খগেন্দ্রনাথেরই? যদি তাহাই হয়, তবে সে এই দুইদিন বৃদ্ধের চাকর বলিয়া পরিচয় দিল কেন? পুলিসের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিবার জন্য কি? যদি কেহ সন্দেহ করে, তাহা হইলে সে ওই বৃদ্ধকেই ধরিবে। খগেন্দ্রনাথ তবে কে? যদি এই ভৃত্য খগেন্দ্রনাথের হয়, তাহা হইলে ইনিই রণেন্দ্র। রেঙ্গুনে পঁহুছিবামাত্র তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিব। কিন্তু রণেন্দ্রের আকৃতির যেমন বর্ণনা শুনিয়াছি, খগেন্দ্রের আকৃতি তেমন নয়। যদি ভৃত্য স্বীকার করে যে, সে খগেন্দ্রনাথের বেতনভোগী, তবেই খগেনকে গ্রেপ্তার করিতে পারিব।
এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি হাসিতে হাসিতে খগেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করিলাম “বৃদ্ধকে পূর্ব্বে আর কোথাও দেখিয়াছিলেন?”
খগেন্দ্রনাথও ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন “না ভাই, তাহা হইলে আগেই আপনাকে বলিতাম। এই দেখুন না, চাকরটাকে একটি টাকা দিয়া তবে বশ করিতে পারিয়াছি। আরও কতদিন সমুদ্রে থাকিতে হইবে, বলা যায় না। ঝড়ে আমাদের জাহাজখানি কোথায় আসিয়া পড়িয়াছে, তাহাও এখন জানা যায় নাই। এ অবস্থায় একজন চাকর সঙ্গে থাকিলে বিশেষ উপকারের সম্ভাবনা। এই মনে করিয়া হরিদাসকে আমার চাকর স্বরূপ রাখিতে ইচ্ছা করিয়াছি। বিশেষতঃ উহার মনিবের অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। এখানে এমন কোন লোক নাই, যিনি উহাকে কিছুদিন ভৃত্যস্বরূপ রাখিবেন। সেইজন্য আমিই উহাকে আপাততঃ আমার কর্ম্মে নিযুক্ত করিয়াছি।”
আ। হরিদাসের সহিত আপনার প্রথম আলাপ হয় কোথায়?
খ। এই জাহাজে, পূর্ব্বে উহাকে চিনিতাম না, হরিদাসও আমাকে চিনিত না।
আ। আপনার মত চতুর লোক আজকাল অতি অল্পই দেখিত পাওয়া যায়। দুই তিন দিন আপনার সহিত কথাবার্তা কহিলেই কেমন আপনার বশীভূত হইয়া পড়িতে হয়। এই ক্ষমতা সাধারণ নহে।
খগেন্দ্রনাথ আমার কথায় আন্তরিক বিরক্ত হইলেন, কিন্তু কোন উত্তর করিলেন না। হাসিতে হাসিতে জিজ্ঞাসা করিলেন “মহাশয় ব্রাহ্মণ, বলুন দেখি, এখন বৃদ্ধের শ্রাদ্ধাদি কোথায় কিরূপে ও কাহার দ্বারা সম্পন্ন হওয়া উচিত?”
আ। বৃদ্ধের অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। এ অবস্থায় অশৌচ তিন দিন মাত্র। শ্রাদ্ধাদি কার্য্য তাঁহার আত্মীয় স্বজনের দ্বারাই হওয়া উচিত।
খ। কেই বা সেখানে সংবাদ দিবে? ভৃত্যটি যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে তাহার দ্বারা এ কার্য্য হওয়া অসম্ভব।
আ। কেন? হরিদাস ত বেশ চতুর লোক।
খ। স্বীকার করি; কিন্তু সে এই দুঃসংবাদ প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে না।
আ। সে ত বৃদ্ধের বাড়ী জানে?
খ। আমি ত সেইরূপই জানিতাম। কিন্তু তাহার মুখে আজ শুনিলাম যে, সেও বৃদ্ধের বাসস্থান জানে না। আ। সে কি! নিশ্চয়ই হরিদাস আপনার নিকট মিথ্যা বলিয়াছে। ভৃত্য হইয়া প্রভুর বাড়ী জানে না? অসম্ভব। হরিদাস কি বলে?
খ। সে বলে, যেদিন সে বৃদ্ধের সহিত জাহাজে আরোহণ করে, তাহারই পূর্ব্বদিন তিনি তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছিলেন।
আ। আমি ত এ রহস্য কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। হরিদাসের মুখে শুনিলাম, তাহার বাড়ী রাণাঘাটে। সে কি তবে বৃদ্ধকে রাণাঘাটেই দেখিয়াছিল? সেইখানেই কি বৃদ্ধ তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছিল?
খ। সে কথা ঠিক জানি না। হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলেই জানিতে পারিবেন।
খগেন্দ্রনাথের কথার উত্তর না দিয়া আমি হরিদাসের অন্বেষণ করিতে লাগিলাম। দেখিলাম, সে কিছুদূরে দাঁড়াইয়া আর একজন ভৃত্যের সহিত কি কথা কহিতেছে। আমি তখনই তাহার নিকট গমন করিলাম এবং ইঙ্গিত করিয়া হরিদাসকে নিকটে ডাকিলাম।
আমার নিকট উপস্থিত হইলে আমি হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম “হরিদাস, তোমার অবস্থা দেখিয়া বোধ হইতেছে, তুমি নিতান্ত গরিব। অর্থাভাবেই তোমাকে পরের চাকরী করিতে হইতেছে। কেমন, এ কথা সত্য কি?”
হরিদাস অতি বিনীত ভাবে উত্তর করিল, আজ্ঞে হাঁ, আপনার অনুমান সম্পূর্ণ সত্য।”
আ। যদি কোন উপায়ে কিছু অর্থ পাও, তাহা হইলে এ চাকরী ছাড়িয়া দিতে পার?
হ। কেন পারিব না। পয়সা পাইলে, যাবজ্জীবন ভরণ-পোষণ চলিতে পারে, এমন অর্থ পাইলে, আমি আর চাকরী করিব কেন?
আ। আমি যদি অর্থোপার্জ্জনের কোন উপায় দেখাইয়া দিই, তাহা হইলে তুমি তাহা করিবে কি?
হ। নিশ্চয়ই করিব। তবে চুরি করিতে পারিব না। ও কার্য্য আমার দ্বারা হয় নাই এবং হইবার সম্ভাবনাও নাই।
আ। আমি এত নীচ নহি যে, তোমাকে চুরি করিতে পরামর্শ দিব। তবে উপায়টি অতি গোপনীয়; তুমি ভিন্ন আর কোন লোক জানিতে পারিবে না।
হ। বেশ কথা, আমি সম্মত হইলাম। আপনি বলুন, আমায় কি করিতে হইবে।
আ। আমি ব্রাহ্মণ, আমার কাছে প্রতিজ্ঞা কর যে, যদিও আমার কথা তোমার মনঃপূত না হয়, তাহা হইলেও তুমি সে কথা প্রকাশ করিবে না?
হ। আজ্ঞে না। আমি আপনার পা ছুঁইয়া শপথ করিতেছি যে, আপনার কথায় আমি স্বীকৃত হই বা না হই, আমার দ্বারা কোন কথা প্রকাশিত হইবে না। বলুন, কি করিতে হইবে?
আ। আগে আমি যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিব, তাহার যথাযথ উত্তর দাও, পরে সেই উপায় ব্যক্ত করিব। হরিদাস সম্মত হইল। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “সত্য করিয়া বল দেখি, তোমার সহিত খগেন্দ্রবাবুর পূর্ব্বে আলাপ ছিল কি না?”
হরিদাস উত্তর করিল “আমি আপনার পা স্পর্শ করিয়া বলিতেছি যে, খগেন্দ্রবাবুর সহিত আমার আলাপ ছিল না। আমি জাহাজে উঠিয়া জানিতে পারি যে, উহার নাম খগেনবাবু।”
হরিদাস যেভাবে উত্তর করিল, তাহাতে তাহার কথায় আমার অবিশ্বাস হইল না; আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম ‘বুদ্ধের সহিত তোমার কতদিনের আলাপ?”
হ। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, পূর্ব্বে আমি তাঁহাকে চিনিতাম না। জাহাজে উঠিবার পূর্ব্ব দিন হইতে তাঁহার সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল।
আ। বৃদ্ধের বাড়ী কোথায় জান?
হ। আজ্ঞে না।
আ। সত্য করিয়া বল, যখন তুমি তাহার চাকরী গ্রহণ করিয়াছিলে, তখন তাঁহার কি নাম, কোথায় নিবাস, এ সকল না জানিয়াই কার্য্যে নিযুক্ত হইয়াছ?
হ। মনিবেরাই চাকরের নাম, নিবাস জানিয়া, এমন কি, জামিন পর্য্যন্ত লইয়া চাকরী দিয়া থাকেন। যে ব্যক্তি ভৃত্যের কর্ম্ম করিবে, সে কোন্ লজ্জায় প্রভুর নাম, নিবাস জিজ্ঞাসা করিবে? আপনি আমার প্রতি অন্যায় সন্দেহ করিতেছেন।
আ। না হরিদাস, সন্দেহ করিতেছি না। তোমার কথায় আমার অবিশ্বাস নাই। কিন্তু বৃদ্ধের নিবাস জানিতে না পারিলে তাঁহার আত্মীয় স্বজনের নিকট কিরূপে তাঁহার মৃত্যু-সংবাদ পাঠাইয়া দিব?
হ। আজ্ঞে, সে কথা সত্য বটে, কিন্তু বাস্তবিকই আমি তাঁহার সন্ধান জানি না।
আ। তুমি কি তাঁহার বাড়ীতে পর্য্যন্ত যাও নাই? পথে পথে তিনি তোমায় চাকরী দিলেন? না হরিদাস, সত্যই আমার এখনও সন্দেহ যাইতেছে না। আমি তোমাদের রহস্য বুঝিতে পারিতেছি না।
হরিদাস কিছুক্ষণ চিন্তা করিল। পরে উত্তর করিল “আজ্ঞে, আমি সমস্তই সত্য বলিয়াছি। বৃদ্ধ আমাকে যে বাড়ীতে লইয়া গিয়াছিলেন, সে বাড়ী তাঁহার নিজের নয় আর তিনি সে বাড়ীতেও থাকিতেন না। বাড়ীখানি একটা হোটেল বলিলেও হয়। প্রায় কুড়িজন কেরাণী মিলিয়া ওই হোটেলটি করা হইয়াছিল।”
আ। বৃদ্ধ কোন্ সূত্রে তোমায় সেখানে লইয়া গিয়াছিলেন? সেখানে তাঁহার কি কোন পরিচিত লোক আছেন? হ। আজ্ঞে হাঁ, শুনিলাম, সেখানে তাঁহার দূর-সম্পর্কের এক ভাই থাকেন। বৃদ্ধ তাঁহারই ঘরে সেদিন আশ্রয় লইয়াছিলেন।
আ। সে বাড়ীখানি কোথায়?
হ। কলুটোলায়।
আ। তুমি দেখাইয়া দিতে পারিবে?
হ। পারিব।
আ। বৃদ্ধের নাম কি জান?
হ। আজ্ঞে না। চাকর হইয়া মনিবের নাম জিজ্ঞাসা করিব কেমন করিয়া?
আ। তাঁহার ভাই তাঁহাকে কি বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিলেন, তোমার মনে আছে?
হ। আজ্ঞে হাঁ। — দাদা বলিয়া ডাকিয়াছিলেন। কোন নাম বলেন নাই।
হরিদাসকে আর কোন প্রশ্ন করিলাম না। যাহার জন্য সেই করিতেছিলাম, যে কার্য্যের জন্য এতক্ষণ হরিদাসের সহিত বচসা করিতেছিলাম, তাহাতে নিষ্ফল হইয়া আমি একেবারে হতাশ হইলাম না, মনে মনে আর এক উপায় উদ্ভাবন করিলাম।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতঃকালে আমি কাপ্তেনের নিকট গমন করিলাম। সাহেব বড় অমায়িক লোক। তাঁহার নিষ্ট কথায় সকলেই সন্তুষ্ট। আমাকে দেখিবামাত্র সাদরে অভ্যর্থনা করিলেন। আমিও তাঁহাকে নমস্কার করিয়া পরম আপ্যায়িত করিলাম। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম যে, আমরা ওই কয় ঘণ্টার ঝড়ে বিপরীতদিকে একদিনের পথ হাটিয়া গিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, যেরূপ প্রচণ্ডবেগে ঝড় বহিয়াছিল, তাহাতে ওই পথ অতি সামান্য বলিয়া বিবেচিত হইল; অমনি তখন তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “যদি ঝড় না হইত, তাহা হইলে কালই আমরা বন্দরে উপস্থিত হইতাম? ঝড় হওয়ায় কবে সেখানে পঁহুছিব?”
কাপ্তেন হাসিয়া উত্তর করিলেন “কল্য বেলা এগারটার সময় তীরে পঁহুছিতেন, কিন্তু এখন আর তাহা হইবে না। পরশু বেলা দশটার পূর্ব্বে যাইতে পারিব।”
সাহেবের সহিত আরও কিছুক্ষণ অন্যান্য অনেক কথা কহিয়া, শেষে সেই ব্যাঙ্কের চুরির কথা তুলিলাম। রণেন্দ্রের উপর তাঁহারও সন্দেহ হইল।
আমি তখন সাহেবকে আমার পরিচয় দিলাম। কি জন্য সেই জাহাজে উঠিয়াছি, তাহাও বলিলাম। যাহার উপর আমার সন্দেহ হইয়াছে, তাহাও প্রকাশ করিলাম। অবশেষে তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলাম।
তিনি আশ্চর্যান্বিত হইলেন। প্রথমে আমার কথা কোনক্রমেই বিশ্বাস করিলেন না। আমি তখন গুপ্ত পকেট হইতে ডিটেকটিভের ব্যাজ’ বা কার্ডখানি প্রদর্শন করিলাম। তিনি উহা দেখিয়া এবং কার্য্যে আমার ঐকান্তিক যত্ন ও অধ্যবসায় দেখিয়া, আন্তরিক প্রীত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন “বাবু! আমার দ্বারা আপনার কি এমন সাহায্য হইবে? তবে যদি কোন লোক আপনার অনিষ্ট কামনা করিতেছে জানিতে পারি, তাহা হইলেই আমি সাহায্য করিতে পারিব, নচেৎ নহে।”
আমি উত্তর করিলাম “আপনি যদি আমার কথামত কার্য্য করেন, তাহা হইলেই আমি আপনার নিকট হইতে যথেষ্ট সাহায্য পাইব।”
কা। কি করিতে হইবে বলুন?
আ। আপনার নিকট বৃদ্ধের যে সকল কাপড় আছে, অনুগ্রহ করিয়া পরীক্ষা করিতে দিন।
কা। কাপড়ে কি পরীক্ষা করিবেন?
আ। মাপ করিবেন- -সে কথা এখন বলিব না।
কাপ্তেন সাহেব আমার কথায় ঈষৎ হাস্য করিয়া তখনই বৃদ্ধের কাপড় জামা ইত্যাদি আনিতে আদেশ করিলেন। একজন খালাসী সেগুলি আমার নিকট আনয়ন করিল। আমি একবার ভাল করিয়া পরীক্ষা করিয়া তাহাদিগকে যথাস্থানে রাখিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, কাপ্তেনের শয়নগৃহে অতি গোপনেই এই সকল কাৰ্য্য সমাধা হইয়াছিল।
কাপ্তেনের সহিত আরও কিছুক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়া আমি সেখান হইতে খগেন্দ্রের নিকট যাইলাম। তিনি একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছেন। আমাকে দেখিয়া হাসিমুখে সম্ভাষণ করিলেন। আমি তাঁহার কামরার ভিতর প্রবেশ করিলাম এবং নানা কথায় তাঁহাকে অন্যমনস্ক রাখিয়া ভিতরে ভিতরে তাঁহার কাপড় চোপড়গুলি পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। অনেকক্ষণ পরে কার্য্য সিদ্ধ হইল। আমার সন্দেহ বৃদ্ধি হইল। খগেন্দ্রনাথ কে? এই প্রশ্ন মনোমধ্যে উদয় হইতে লাগিল।
আরও কিছুক্ষণ খগেন্দ্রনাথের সহিত গল্প করিয়া, আমি আমার কামরায় গমন করিলাম। যৎকিঞ্চিৎ আহার করিয়া ভাবিতে লাগিলাম, খগেন্দ্রনাথ কে? বৃদ্ধের কাপড় পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, তাহার জামাগুলি নূতন, তাহাতে এখনও রজকের চিহ্ন পড়ে নাই। কাপড় কয়খানি পুরাতন বটে, কিন্তু একখানি ছাড়া আর সকলগুলির এক রকম চিহ্ন, অপরখানির চিহ্ন স্বতন্ত্র। জামার পকেটে একখানি রুমাল ছিল, কেবল তাহার চিহ্নের সহিত সেই কাপড়ের চিহ্নের মিল ছিল। খগেন্দ্রনাথের সমুদায় কাপড় চোপড়ের একই প্রকার চিহ্ন এবং এই চিহ্ন বৃদ্ধের রুমাল ও একখানি কাপড়ের উপর যে চিহ্ন দেয়িাছিলাম, ঠিক সেইরূপ। ইহার অর্থ কি? কেন এমন হয়? যদি একই রজকে উভয়ের কাপড় কাচিয়া থাকে, তাহা হইলে বৃদ্ধের সমস্ত পোষাকের চিহ্ন খগেন্দ্রনাথের কাপড়ের চিহ্নের মত হইত। কিন্তু তাহা না হইয়া বৃদ্ধের একখানি কাপড় ও একখানি রুমালের চিহ্ন খগেন্দ্রনাথের সহিত মিলে কেন? নিশ্চয়ই কাপড় ও রুমালখানি খগেন্দ্রনাথের এবং হয় খগেন্দ্রনাথ তাঁহাকে ওই কাপড় ও রুমালখানি ব্যবহার করিতে দিয়াছিলেন, না হয় খগেন্দ্ৰনাথ ভুলক্রমে উহা বৃদ্ধের ঘরে রাখিয়া আসিয়াছিলেন। যদি শেষোক্ত কথাই সত্য হয়, তাহা হইলে যখন তিনি কাপ্তেনকে বৃদ্ধের পোষাক দেখাইয়া দিতেছিলেন, সেই সময়ে ত ওই দুইখানি দেখিতে পাইয়াছিলেন? কেন তিনি তখন উহা গ্রহণ করেন নাই?
আবার সেই সন্দেহ! তবে কি বৃদ্ধ ও খগেন্দ্রনাথ একই ব্যক্তি? যদি তাহাই হয়, তবে যিনি জলমগ্ন হইলেন, তিনি কে? না, উভয়ে এক ব্যক্তি হইতে পারে না। তবে কি রণেন্দ্রনাথই ছদ্মবেশে ছিলেন, তিনিই কি জলমগ্ন হইয়াছেন? এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়াও কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। রহস্য ক্রমেই জটিল হইতে লাগিল। আমার বোধ হইল, সেই ভৃত্য হরিদাস ওই বিষয়ের সমস্ত কথা জানে। সে আমাকে যাহা যাহা বলিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা। ভৃত্যকে আর একবার পরীক্ষা করিতে হইবে। কিন্তু এবার আমি একা থাকিলে হইবে না, কাপ্তেন সাহেবকে পৰ্য্যন্ত এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট করিতে হইবে।
এই স্থির করিয়া, আমি অতি গোপনভাবে কাপ্তেন সাহেবের নিকট যাইলাম এবং তাঁহাকে আমার মনের কথা প্রকাশ করিলাম। তিনি তখনই হরিদাসকে নিজের নাম করিয়া তাঁহারই প্রকোষ্ঠে ডাকিয়া পাঠাইলেন।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
যথাসময়ে হরিদাস কাপ্তেন সাহেবের ঘরে আসিল। আমাকে সেখানে দেখিয়া তাহার মুখ মলিন হইয়া গেল। আমি কোন কথা বলিলাম না; কেবল একেদৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া রহিলাম।
হরিদাসকে উপস্থিত দেখিয়া সাহেব আগে নিজের কামরার দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। পরে হরিদােেসর দিকে চাহিয়া বলিলেন “এই বাবু তোমাকে যে যে কথা জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহার যথাযথ উত্তর দাও। কিন্তু সাবধান, যদি তোমার মিথ্যা কক্ষ ধরা পড়ে, তাহা হইলে তোমায় জেলে দিব।”
সাহেবের কথায় ভীত হইয়া হরিদাস আমার দিকে চাহিল এবং জিজ্ঞাসা করিল “মহাশয়! কি জিজ্ঞাসা করিবেন করুন। আমি পূর্ব্বেই আপনাকে যাহা বলিয়াছি, তাহার মধ্যে একটিও মিথ্যা কথা নাই।”
আমি গম্ভীর ভাবে উত্তর করিলাম “সে কথা আমায় বলিলে কি হইবে? সাহেব সমস্ত কথা জানিতে পারিয়াছেন। যদি নিজের মঙ্গল চাও, তাহা হইলে এখনও সত্য কথা প্রকাশ করিয়া বল। নতুবা পরে তোমাকে এই জন্য ভয়ানক অনুতাপ করিতে হইবে।”
হরিদাস কোন উত্তর করিল না, স্থির হইয়া দণ্ডায়মান রহিল। আমি তখন তাহাকে মিষ্ট ভাবে বলিলাম “পূৰ্ব্বে তুমি আমাকে বলিয়াছিলে যে, তুমি খগেন্দ্রনাথকে চেন না। এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তুমি নিশ্চয়ই খগেন্দ্রনাথকে চেন এবং তাঁহার অনেক কথা অবগত আছ।”
আমার কথা শেষ হইতে না হইতে হরিদাস বলিয়া উঠিল “দোহাই ধর্ম্ম! আমি আপনার সমক্ষে মিথ্যা বলি নাই। খগেন্দ্রনাথ নামে কোন লোকের সহিত আমার আলাপ ছিল না এবং এখনও নাই।”
হরিদাসের কথার অর্থ প্রথমে বুঝিতে পারি নাই। এখন তাহার কথার ভাব কতকটা বুঝিতে পারিলাম, বলিলাম “বেশ কথা, খগেন্দ্র নামে কোন বাবুকে তুমি চেন না। কিন্তু যাহাকে আমরা খগেন্দ্রনাথ বলিয়া জানি, তাহার সহিত কি তোমার পূর্ব্বে পরিচয় ছিল?”
হ। আজ্ঞে হাঁ।
আ। তবে তাঁহার প্রকৃত নাম খগেন্দ্রনাথ নয়, কেমন?
হ। আজ্ঞে না।
আ। তবে কি?
হরিদাস কোন উত্তর করিল না। আমি পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলাম “যদি তাহার প্রকৃত নাম খগেন্দ্র না হয়, তবে তাঁহার নাম কি?”
হরিদাস এবার আন্তরিক ভীত হইল। বলিল “ সেকথা ত আপনারা সমস্তই অবগত। কেন আর এই গরিবের অন্ন মারিতেছেন?”
আমি ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তবে কি তিনিই রণেন্দ্রবাবু?”
হ। আজ্ঞে হাঁ।
আ। তবে বৃদ্ধ কে?
হ। তিনিই।
আ। যিনি সমুদ্রে ডুবিয়া গেলেন, তিনি কে?
হ। তিনি মানুষ বা কোন জীব নহে—একটা পোষাক মাত্ৰ।
আ। সে কি! সকল কথা পরিষ্কার করিয়া উত্তর দাও। তোমার হেঁয়ালি বুঝিতে পারিতেছি না। হ।রণেন্দ্রনাথ যখন পলাইয়া আসেন, তখন একটি বৃদ্ধের ছদ্মবেশ সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন; ওই ছদ্মবেশ পরিয়াই তিনি জাহাজে উঠেন। কারণ তিনি জানিতেন যে, জাহাজে হয় ত তাঁহার অনুসন্ধান হইতে পারে, নিজ বেশে থাকিলে তিনি ধৃত হইবেন, এই ভয়েই তিনি ওইরূপ পোষাক পরিধান করিয়াছিলেন। তিনি দুইটি কামরা ভাড়া লন, কারণ যদি কখনও তাঁহাকে তাঁহার গুপ্ত বেশ পরিত্যাগ করিতে হয়, তাহা হইলে তিনি প্রথম কামরায় বাস করিবেন। আর যখন বৃদ্ধের পোষাক পরিধান করিবেন, তখন দ্বিতীয় কামরায় বাস করিবেন। আমাকে বৃদ্ধের চাকর বলিয়াই পরিচিত করিয়াছিলেন।
প্রথমতঃ তিনি বৃদ্ধের বেশেই থাকিয়া জাহাজের সমস্ত লোকের অবস্থা উত্তমরূপে দেখিয়া লইয়াছিলেন, ও জানিতে পারিয়াছিলেন যে, তাঁহার পরিচিত বা তাঁহাকে দেখিলে চিনিতে পারিবে এরূপ কোন লোক সেই জাহাজে নাই। এই অবস্থা জানিতে পারিলে তিনি সময় সময় বৃদ্ধের পোষাক পরিত্যাগ করিতেন।
তিনি আরও বুঝিতে পারিয়াছিলেন যে, আপনি পুলিসের কর্ম্মচারী ও আপনি রণেন্দ্রনাথের অনুসন্ধানে গমন করিতেছেন। আরও জানিয়াছিলেন, তাঁহাকে চিনিতে পারে এরূপ কোন লোক আপনার সহিত নাই।
তিনি আরও জানিতে পারিয়াছিলেন, আপনি ওই বৃদ্ধকে ছদ্মবেশী রণেন্দ্রনাথ বলিয়া সন্দেহ করিয়াছেন, সুতরাং যদি তাঁহাকে ধৃত করেন, তাহা হইলে সকল কথা বাহির হইয়া পড়িবে; এই ভয়ে তিনি বৃদ্ধের ছদ্মবেশ সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করিয়া বৃদ্ধ ডুবিয়া মরিয়াছে বলিয়া প্রকাশ করেন। কারণ এই উপায়ে তিনি আপনার চক্ষে ধূলি প্রদান করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কারণ তিনি নিশ্চয় জানিতেন যে, এই কার্য্যে আপনি স্থির করিয়া লইবেন যে, রণেন্দ্র ছদ্মবেশে ছিল, পুলিসের হাতে না পড়িতে হয়, এই ভয়ে, তিন সমুদ্রগর্ভে পতিত হইয়া আপন জীবন নষ্ট করিয়াছেন। এইরূপ অবস্থায় আপনি খগেন্দ্রনাথের উপর আর কোনরূপেই সন্দেহ করিবেন না। জাহাজ বন্দরে উপস্থিত হইলে কোনরূপে তিনি আপনার দৃষ্টির বাহির হইয়া যদৃচ্ছা পলায়ন করিতে পারিবেন।
হরিদাসের কথা শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। সাহেবও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি তখন বলিলাম “খগেন্দ্রনাথই রণেন্দ্রবাবু, ইহাকে গ্রেপ্তার করিলেই আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে।”
সাহেব সম্মত হইলেন। বলিলেন “আপাততঃ জাহাজেই বন্দী করা যাউক। পরে রেঙ্গুনে পঁহুছিলে স্থানীয় পুলিসের হাতে দিলেই আপনার কার্য্য শেষ হইবে।”
আমিও তাহাই করিলাম। সাহেবও তাঁহার জনকয়েক কৰ্ম্মচারী লইয়া খগেন্দ্রনাথের নিকটে যাইলাম। দেখিলাম, তিনি একজন খালাসীর সহিত কি গল্প করিতেছেন।
আমাকে কাপ্তেন ও আরও কতকগুলি লোকের সহিত তাঁহার নিকট যাইতে দেখিয়া, তিনি সমস্তই বুঝিতে পারিলেন এবং তখনই সমুদ্রে লম্ফ দিয়া পড়িবার অভিপ্রায় করিলেন। আমিও সেইরূপ অনুমান করিয়াছিলাম, তখনই তাঁহার হাত ধরিয়া ফেলিলাম এবং তাঁহাকে বন্দী করিয়া সমস্ত কথা প্রকাশ করিলাম। তিনি সমস্তই স্বীকার করিলেন
পরদিন বেলা দশটার সময় রেঙ্গুনে উপস্থিত হইলাম এবং রণেন্দ্রনাথকে স্থানীয় পুলিসের জিম্মায় রাখিয়া পরবর্ত্তী জাহাজে কলিকাতায় আগমন করিলাম।
তাহার কিছুদিন পরে রণেন্দ্রও কলিকাতায় আনীত হইলেন। অনতিবিলম্বেই তাঁহার বিচার হইয়া গেল। বিচারে তাঁহার সাত বৎসর কারাদণ্ড হইল। আশি হাজার টাকার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা রণেন্দ্রের নিকট পাওয়া গিয়াছিল। অবশিষ্ট টাকা পাওয়া যায় নাই।
সম্পূর্ণ
[ আশ্বিন, ১৩১৫ ]