পাহাড়ে মেয়ে (দ্বিতীয় অংশ)

পাহাড়ে মেয়ে (দ্বিতীয় অংশ) 

দশম পরিচ্ছেদ – বিবাহ 

‘একদিন দুইদিন করিয়া ক্রমে দিন গত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে বিবাহের দিন নিকট হইয়া আসিল। বিবাহের কেবলমাত্র চারিদিবস বাকি আছে, তখন গণেশবাবু বরযাত্রীর লোকের নিকট হইতে আবশ্যক খরচপত্রের নিমিত্ত এক শত টাকা আনিলেন, এবং বিবাহের তিনদিবস বাকী থাকিতে বরের গাত্রে হরিদ্রা দেওয়ার ব্যবস্থা করিয়া দিলেন। আর তাহারাও বুঝিলেন যে, সেইদিবস কন্যার গাত্রেও হরিদ্রা দেওয়া হইল। কিন্তু কাৰ্য্যে তাহার কিছুই হইল না। সেই এক শত টাকার মধ্য হইতে পঞ্চাশ টাকা আমরা সকলে নিয়মমত অংশ করিয়া লইলাম এবং বক্রী পঞ্চাশ টাকার দ্বারা বিবাহের আবশ্যক দ্রব্যাদি ক্রয় এবং বরযাত্রী ও অন্যান্য নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণের আহারাদির বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। 

“দেখিতে দেখিতে বিবাহের দিন উপস্থিত হইল। বাড়ীর ভিতর মহা ধূমধাম পড়িয়া গেল। যাঁহার যাঁহার সহিত আমাদিগের সবিশেষ বন্ধুত্ব ছিল, তাঁহারা সকলেই নিমন্ত্রিত হইলেন। সোণাগাছি হইতে আমার সমবয়স্কা স্ত্রীলোকগণ, যাহাদের সহিত আমার সবিশেষ বন্ধুত্ব ছিল, তাহারাও আমাদিগের এই নূতন বাড়ীতে আসিয়া সকলেই প্রয়োজন-অনুযায়ী কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইল। ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিল। তখন নাপিত ও পুরোহিত মহাশয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগকে পূর্বে কখনও দেখি নাই, বা তাহাদিগের সহিত আমাদিগের পরিচয়ও ছিল না। কিন্তু তাঁহারা সকলকে দেখাইতে লাগিলেন, যেন আমরা তাঁহাদের বহুদিবসের পরিচিত। 

“ধন্য মুদ্রা!- তোমার দ্বারা না হয়, এমন কার্য্যই নাই। আর ধন্য কলিকাতাবাসী!—তোমরাও পয়সার লোভে না করিতে পার, এমন কৰ্ম্মই দেখি নাই! ভট্টাচাৰ্য্য মহাশয় সামান্য লোভের বশবর্তী হইয়াই আপন ধর্ম্মনষ্ট করিলেন, এবং আমাদিগকে ভাল ব্রাহ্মণ পরিচয় দিয়া বেশ্যার বিবাহ দিতেও কিছুমাত্র পরাঙ্মুখ হইলেন না। 

“সেই বাড়ীর ভিতর একস্থানে বরের বসিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট হইল। তাহাতে উত্তমরূপ বিছানা পড়িল; এবং আমাদিগের নিয়ন্ত্রিত ও স্বদলস্থ ব্যক্তিগণ আমাদিগের ষড়যন্ত্রের বিষয় উত্তমরূপ অবগত হইয়া, বরযাত্রীর প্রতীক্ষায় সেই স্থানে যাইয়া উপবেশন করিলেন। তথায় পরস্পরে ঠাট্টা-তামাসা এবং আমোদ-প্রমোদ চলিতে লাগিল। সেই সময় দুইখানি ঘোড়ার গাড়ি আসিয়া দরজার সম্মুখে উপনীত হইল। তদ্দর্শনে সকলেই উঠিয়া সেই দিকে গমন করিলেন; বরের পরিধানে পীতাম্বরী ধুতি, এবং তাহার কাল-অঙ্গও লাল ‘দোবজা’ দ্বারা আচ্ছাদিত। কপালে অৰ্দ্ধচন্দ্রাকৃতি চন্দনের রেখা, হস্তে দর্পণ এবং মস্তকে টোপর। কেহ বরের হস্ত ধরিয়া, কেহ বরযাত্রীগণকে পথ দেখাইয়া, কেহবা পুরোহিত মহাশয়কে অগ্রে লইয়া বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলেন। পরে তাহাদিগকে নির্দ্দিষ্ট স্থান দেখাইয়া দিলে, সকলেই সেই স্থানে উপবেশন করিলেন। 

“এদেশে বিবাহের সভামাত্রেরই অলঙ্কার – বালকের কোলাহল, বিবাদ ও পরস্পরের পরীক্ষা গ্রহণ। কিন্তু এ সভায় একটিমাত্রও বালককে না দেখিয়া, এবং কন্যাযাত্রীর সহিত আলাপ পরিচয় করিয়া, শুনিলাম নাকি, একজন বৃদ্ধ বরযাত্রী আস্তে আস্তে তাহাদের পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, ‘এ বিবাহ আমার কেমন কেমন বোধ হইতেছে। কলিকাতার ভিতর অনেক প্রকার জুয়াচুরি হয়; ভাল করিয়া দেখিয়া শুনিয়া এ সম্বন্ধ হইয়াছে ত? আর তাহাতে তাঁহাদের পুরোহিত মহাশয়ও তাঁহাকে নাকি উত্তর দিয়াছিলেন, “ইহা আমারও কেমন কেমন বোধ হয় বটে; তবে যিনি এ সম্বন্ধের মূল, তিনি একজন অতি প্রবীণ এবং দক্ষ লোক। সুতরাং ইহাতে আমাদের আর কোন প্রকার সন্দেহ করাই অন্যায়।’যাহা হউক, আমাদের পুরোহিত মহাশয় কিন্তু ইহার কিছু আভাস পাইয়া তখনই শশব্যস্তে বলিলেন— ‘বিবাহের লগ্ন হইয়াছে,– আর বিলম্ব করিয়া নিরর্থক লগ্ন ভ্রষ্ট করা কোন মতে উচিত নহে।’ শুভকৰ্ম্ম যতশীঘ্র সম্পন্ন হয়, ততই ভাল। আর একটি কথা, আমার প্রথমেই বলা উচিত। কারণ, আপনারা কলিকাতার নিয়ম সম্যকরূপে অবগত আছেন কি না, জানি না। এখানকার নিয়ম এই যে, দেনা-পাওনা-সম্বন্ধীয় আপনাদিগের কোনপ্রকার বন্দোবস্ত থাকে, তবে সেটি বিবাহের অগ্রেই মিটাইয়া দেওয়া উচিত।” 

“বরকর্তা এই কথা শুনিয়া যাহা কিছু প্রণামী প্রভৃতির বন্দোবস্ত ছিল, তৎক্ষণাৎ তাহা মিটাইয়া দিলেন। পরে পুরোহিত মহাশয় বাড়ীর ভিতর হইতে ফিরিয়া আসিয়া যখন শুনিতে পাইলেন যে, সমস্ত দেনা-পাওনা মিটিয়া গিয়াছে, তখন সভাস্থ ব্যক্তিবর্গের অনুমতি-অনুযায়ী বরকে লইয়া বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন। 

“ক্রমে চেলির কাপড় পরাইয়া, পিঁড়ির উপর বসাইয়া, কন্যাকে বিবাহের স্থানে আনা হইল। সকলে কন্যা দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন; বরের আর আহ্লাদের সীমাই রহিল না। ক্রমে স্ত্রী-আচার, সাতপাক, শুভদৃষ্টি, প্রভৃতি বিবাহের সমস্ত অঙ্গই শেষ হইয়া গেল। আহারের বিষয়টিও বাকী থাকিল না; বরযাত্রী এবং কন্যাযাত্রী প্রভৃতি সকলেই উপস্থিতমত জলপান করিলেন। পরে কন্যাযাত্রীগণ একে একে চলিয়া গেলেন এবং বরযাত্রীগণ সেই স্থানেই সেই রাত্রির মত শয়ন করিয়া রহিলেন। বর বাসরঘরে রাত্রি কাটাইলেন। পরদিবস প্রাতঃকালে আমি একজনের নিকট শুনিয়াছিলাম যে, বর নাকি তাহার সমবয়স্ক অন্য আর একটি বরযাত্রীর কাণে কাণে বলিয়াছিল ‘ভাই! কলিকাতার ভদ্রলোকের ঘরের মেয়েরা যে এত বেহায়া, তাহা আমি স্বপ্নেও জানিতাম না।’ 

“প্রাতঃকালে শয্যাতোলানি, বারইয়ারি প্রভৃতি বিবাহের আনুষঙ্গিক ‘বাব’-গুলিও একে একে মিটিয়া গেল। তখন কন্যা বিদায়ের সময় হইল। বিবাহের পরই কন্যা বিদায় করিতে হইলে, যে যে প্রকার আয়োজনের আবশ্যক হয়, তাহার সমস্তই যোগাড় হইল। বরকর্তা তাহাদের আনীত অলঙ্কারগুলি নিজে কন্যার অঙ্গে পরাইয়া দিলেন। পরে গাড়ি আনাইয়া সকলে আনন্দিত মনে ষ্টেসন অভিমুখে গমন করিলেন। কন্যার সহিত তাহার মামা এবং একটি ঝি এখান হইতে গমন করিলেন। বলা বাহুল্য যে, কন্যার মামা আর কেহই নহেন, তিনি আমাদের সেই কালীবাবু, আর ঝি সেই কন্যারই মাতা। 

একাদশ পরিচ্ছেদ – কন্যার প্রত্যাগমন 

“বরযাত্রীগণের গমনের পরদিবস গণেশবাবু কন্যাটিকে আনিবার নিমিত্ত বরের দেশে গমন করিলেন। আমিও নূতন বাটি পরিত্যাগ পূর্ব্বক আমার নিজ বাটিতে গিয়া অবস্থান করিতে লাগিলাম। ক্রমে দশদিবস অতীত হইয়া গেল। কালীবাবু বা কন্যার কোনপ্রকার সংবাদ না পাইয়া বসিয়া বসিয়া ভাবিতেছি, এমন সময় একখানি গাড়ি আসিয়া আমাদিগের দরজায় উপস্থিত হইল। গাড়ির শব্দ পাইয়া আমি তাড়াতাড়ি বাহিরের বারান্দায় গিয়া দেখি, কালীবাবু, গণেশবাবু, বিধু এবং দিগম্বরী আসিয়াছেন; সকলেই আমার বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেন, গাড়োবান্ চলিয়া গেল। গণেশবাবু সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। কন্যার গায়ের অলঙ্কারগুলি আমি তখন সমস্ত খুলিয়া লইলাম, ও একজন পোদ্দারকে ডাকাইয়া সমস্তগুলি বিক্রয় করিয়া ফেলিলাম। পোদ্দার নানাপ্রকার ওজর-আপত্তি করিয়া সেই পাঁচ শত টাকা মূল্যের অলঙ্কারের দাম তিন শত পঞ্চাশ টাকামাত্র দিল। আমরা আর কি করিব! তাহাতেই সম্মত হইলাম। কারণ, ভবিষ্যতে কোন গোলযোগ হইলে, সেই ব্যক্তি কখন স্বীকার করিবে না যে, আমরা তাহার নিকট অলঙ্কার বিক্রয় করিয়াছি। বিশেষতঃ সেই সকল দ্রব্যাদির চিহ্নমাত্রও ঘরে রাখা কোনক্রমেই যুক্তিসঙ্গত নহে। তখন সেই টাকা নিয়মমত আমরা সকলে মিলিয়া অংশ করিয়া লইলাম। 

“সন্ধ্যার সময় আমি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম ‘বরের দেশে গমন করিলে, তাহারা তোমাদের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিয়াছিল? এবং বিবাহের পর প্রথমবার বরের বাড়ী হইতে কন্যার একাকী আসিবার নিয়ম এদেশে নাই, তবে কেন জামাই এই সঙ্গে আসিল না?” 

“কালীবাবু কহিলেন ‘আমরা এখান হইতে বরের বাড়ী গমন করিলে সেই গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ সকলেই আমাদিগের সহিত যেরূপ সদ্ভাবে ব্যবহার করিয়াছিলেন, এবং আমাদিগকে লইয়া যেরূপ আমোদ-আহ্লাদে দিন কাটাইয়াছিলেন, সেরূপ আমি আর কখনও দেখি নাই। পরে ‘পাকস্পর্শ’ পৰ্য্যন্ত হইয়া গেল, কন্যার হাতের অন্ন গ্রামস্থ ব্রাহ্মণমণ্ডলী মাত্রেই আহার করিলেন, – বেশ্যার ভাত খাইতে আর কাহারও বাকী থাকিল না। পরে যখন গণেশবাবু গিয়া উপস্থিত হইলেন, তখন কন্যা পাঠাইবার বন্দোবস্ত হইতে লাগিল। দিন স্থির হইল, সকলে সেই গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া কলিকাতা অভিমুখে রওনা হইলাম, জামাইবাবুও আমাদিগের সঙ্গে আসিলেন। এইরূপে যখন সকলে কলিকাতায় আসিয়া রেলগাড়ি হইতে অবতীর্ণ হইলাম, তখন গণেশবাবু জামাইবাবুকে কহিলেন ‘মহাশয়! এখান হইতে আমাদিগের বাড়ী অনেক দূর। সুতরাং এই স্থান হইতে কিছু জলযোগ করিয়া গেলেই ভাল হয়।’ আমি গণেশবাবুর অভিপ্রায় বুঝিলাম ও তাঁহার প্রস্তাবে মত দিলাম। তখন পকেট হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া আমি জামাইবাবুর হস্তে প্রদান করলাম। গণেশবাবু তাঁহাকে একটি মেঠাইয়ের দোকান দেখাইয়া দিয়া বলিয়া দিলেন ‘আপনি এই লোকের সঙ্গে ওই দোকান হইতে কিছু আহারীয় দ্রব্য ক্রয় করিয়া আনুন।’ ব্যাচারা জামাইবাবু গূঢ় কথা কিছুই না বুঝিয়া সেই দোকান-উদ্দেশে গমন করিলেন। আর সেই অবকাশে আমরা একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া তাহার ভিতর উপবেশন করিলাম, ও দরজা বন্ধ করিয়া গাড়োবাকে গাড়ি হাঁকাইতে আদেশ করিলাম। সে গাড়ি হাঁকাইয়া দিল। এইরূপে জামাইবাবুকে তাঁহার অজ্ঞাত স্থানে পরিত্যাগ করিয়া আমরা আপনার বাড়ীতে চলিয়া আসিলাম।’ 

“কালীবাবুর কথা শুনিয়া আমার মনে একটু কষ্ট হইল। একে একজন গরিব-ব্রাহ্মণের সর্ব্বনাশ করিলাম, বিবাহের খরচপত্রের নিমিত্ত তাহার যথা সৰ্ব্বস্ব বিক্রীত হইয়া গেল, তাহাতে আবার তাহার জাতি গেল; গ্রামস্থ লোকেরও প্রায়শ্চিত্তের আবশ্যক হইল। তাহার উপর আবার সেই গরিব নিরীহ জামাইবাবুকে এই অপরিচিত কলিকাতায় একাকী পরিত্যাগ করা হইল! স্ত্রীকে পাওয়া ত দূরের কথা, এখন তিনি পুনরায় দেশে গমন করিবেন কি প্রকারে? এই সকল ভাবিয়া আমার মনে একটু কষ্ট হইল সত্য; কিন্তু টাকার কথা যখন মনে হইল, তখন সে কষ্ট দূর হইল। 

“উঃ! এই সকল মহাপাপের কথা মনে হইলে এখন হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যায়; চক্ষু দিয়া জলধারা পড়িতে থাকে; পাপের বিভীষিকাময়ী মূৰ্ত্তি আসিয়া হৃদয় অধিকার করে! মনে মহা আতঙ্ক আসিয়া উদিত হয়! হে জগদীশ্বর! আমি কবে এই পাপের উপযুক্ত দণ্ড পাইব! 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – আবার বিয়ে 

“ছয় মাস পর্যন্ত জামাইবাবুর আর কোন সন্ধান পাইলাম না। তাহার পর একদিন হঠাৎ চারি পাঁচজন লোক আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কালীবাবু সেই সময় আমার বাড়ীতেই ছিলেন, তাঁহাকে দেখিবামাত্রই তাহারা সকলেই কালীবাবুকে চিনিতে পারিলেন। কালীবাবু তাঁহাদিগের কাহাকেও চেনেন না, বা তাঁহাদিগের সম্বন্ধে কখনও কোন বিষয় অবগত নহেন, এইরূপ ভাণ করিলেন সত্য, কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই তাহা শুনিলেন না। তাহারা কালীবাবুকে গালি প্রদান করিতে লাগিলেন এবং যেরূপ উপায়ে হউক, তাহাকে রাজদ্বারে লইয়া গিয়া, এইরূপ গর্হিত কার্য্যের নিমিত্ত যাহাতে তাঁহাকে সবিশেষ রূপে দণ্ড প্রদান করিতে পারেন, সর্ব্বতোভাবে তাহার চেষ্টা দেখিবেন বলিয়া, কালীবাবুকে ভয় প্রদর্শন করিতে করিতে, কি জানি, কি ভাবিয়া, তাঁহারা সেইদিবস তথা হইতে চলিয়া গেলেন। তাহার পর তাঁহাদিগকে আর দেখিতে পাইলাম না। 

“যাহা হউক, কিছুদিবস অপেক্ষা করিয়া বুঝিতে পারিলাম যে, কালীবাবুর অথবা আমার বিপক্ষে তাঁহারা আর কোনরূপ নালিশ করিবেন না। কিন্তু তাহারও কিছুদিবস পরে শুনিতে পাইয়ছিলাম যে, তাঁহারা আমাদিগের সমস্ত কথাই জানিতে পারিয়াছেন, এবং এই বিবাহে আমাদিগের মধ্যে যে সকল চক্রান্ত ছিল, তাহার সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছেন। তদ্ব্যতীত এখন কন্যাটি যে নাচগাওনা ও বেশ্যাবৃত্তি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তাহাও তাঁহারা উত্তমরূপে জানতে পারিয়াছেন। তখন বুঝিতে পারিলাম যে, তাহারা এই সকল বিষয় জানিতে পারিয়া, আর কাহাকেও কিছু না বলিয়া বা আমাদিগের সহিত আর কোনরূপ গোলযোগ না করিয়া, আস্তে আস্তে আপন দেশে প্রস্থান করিয়াছেন এবং সেই স্থানে গিয়া আপন আত্মীয়-স্বজন, কুটুম্ব-সাক্ষাৎ ও সমাজের মধ্যে প্রকাশ করিয়া দিয়াছেন যে, বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া কন্যাটি মরিয়া গিয়াছে। সুতরাং গ্রামস্থ লোকজনদিগের মধ্যে কেহই আর অধিক কিছু জানিতে পারিলেন না। তবে যিনি ‘কাণা-ঘুষায়’ কিছু কিছু শুনিলেন, তিনিও আর তাহা প্রকাশ করিয়া গ্রামস্থ সমস্ত লোকের ধর্মনাশের কারণ হইলেন না। আর যাঁহারা বিবাহ কার্য্যে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁহাদের ত কথাই নাই; তাহারা একবারে যেন বোবা হইয়া রহিলেন, মুখ দিয়া একটি কথাও বাহির করিলেন না। 

“আমরা এইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া ক্রমে আরও চারি পাঁচজন ভদ্রলোকের সর্বনাশ করিলাম। এইরূপে ক্রমান্বয়ে আরও চারি পাঁচ স্থানের চারি পাঁচজন ব্রাহ্মণকে প্রবঞ্চনা পূর্ব্বক তাহাদিগের সহিত সেই কন্যার বিবাহ দিয়া, কেবল যে আমাদিগের দুরভিসন্ধি পূর্ণ ও কিছু কিছু অর্থের সংস্থান করিলাম, তাহা নহে; আমাদিগের কর্তৃকই সেই চারি পাঁচখানি পল্লীগ্রামের ব্রাহ্মণমণ্ডলীর জাতি নষ্ট হইল। মহাশয়! আমার এখন যে অবস্থা দেখিতেছেন, তাহা সেই সকল পাপেরই ফল! 

“যাহা হউক, দেখিতে দেখিতে সেই কন্যাটি ক্রমে বড় হইয়া আসিল, যৌবনে পদার্পণ করিবার লক্ষণ সকল ক্রমে পরিস্ফুট হইতে লাগিল। সুতরাং তাহাকে অবিবাহিতা কন্যা সাজাইয়া, কোন পাত্রের সহিত তাহার বিবাহ দিবার পথ ক্রমে বন্ধ হইয়া আসিল। অপর দিকে অনেক অনুসন্ধান করিয়া, সেইরূপ বালিকা আর কোনরূপে সংগ্রহ করিয়া উঠিতে পারিলাম না। সুতরাং অনন্যোপায় হইয়া আমাদিগের সেই ব্যবসা বন্ধ করিতে হইল। 

“অমাদিগের এই ব্যবসা বন্ধ হইয়া গেল সত্য; কিন্তু কালীবাবু তাহার প্রখর বুদ্ধির তেজে ও আমার সাহায্যে শীঘ্রই অপর আর একপ্রকার নূতন ব্যবসা আরম্ভ করিলেন। সেই ব্যবসা অবলম্বনে আমরা আরও কিছুদিবস সুখে কাটাইলাম। সেই ব্যবসা যে কি, তাহা পাঠক শুনুন।– 

“এই কলিকাতা সহরের সর্ব্ব স্থানেই অনেক লোকের বাসস্থান। সুতরাং যথায় তথায় বালক-বালিকাও অনেক দেখিতে পাওয়া যায়, এবং ছোট ছোট বালক-বালিকাগণ রাস্তার উপর খেলা করিতে করিতে ক্রমে স্থানান্তরে গমন করে, ও আপনাপন বাড়ীতে গমন করিবার রাস্তা প্রায়ই হারাইয়া ফেলে। যাঁহাদিগের পুত্র-কন্যাগণ এইরূপে খেলা করিতে করিতে রাস্তা হারাইয়া থাকে, তাঁহারা প্রায়ই অবগত আছেন যে, এইরূপে বালক-বালিকাগণ রাস্তা হারাইলে, প্রায়ই পুলিসের সাহায্যে তাহাদিগের অনুসন্ধান করা হয়, এবং প্রায়ই তাহাদিগকে পাওয়া যায়। তবে কোন বালক-বালিকার অঙ্গে মূল্যবান্ অলঙ্কারাদি থাকিলে, সময় সময় সেই সকল অলঙ্কার অপহৃত হয় বটে, কিন্তু বালক-বালিকার সন্ধান পাইতে প্রায়ই বাকী থাকে না। এই নিয়মই বহুদিবস হইতে চলিয়া আসিতেছিল; কিন্তু আমাদিগের এই নূতন ব্যবসা অবলম্বন করিবার পর হইতেই শুনা যাইত, গাত্রে মূল্যবান্ অলঙ্কার না থাকিলেও, যে সকল বালিকা হারাইয়া গিয়াছে, তাহাদিগের সকলকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইত না। কি কারণে পাওয়া যাইত না, তাহার কারণ অপর কেহ অবগত ছিলেন না, কেবল আমি, কালীবাবু ও গণেশবাবুই জানিতেন। 

“সেই সময় কোন বালিকাকে রাস্তায় একাকী দেখিতে পাইলে, আমরা তাহাকে আমাদিগের বাড়ীতে লইয়া আসিতাম এবং খুব যত্ন করিতাম। ছেলে মানুষ অধিক যত্ন পাইলেই ক্রমে আপনার পিতামাতাকে ভুলিয়া যাইত, ও আমাদিগকেই পিতামাতা জ্ঞান করিয়া, আমাদিগের গৃহেই কিছুদিবস পরিবর্তিত হইত। উহাদিগকে যতদিবস পৰ্য্যন্ত আমরা আমাদিগের বাড়ীতে রাখিতাম, তাহার মধ্যে যদি কাহারও পিতামাতা কোনরূপে সন্ধান পাইয়া আমাদিগের বাড়ীতে আগমন করিত, তাহা হইলে তাহাদিগের কন্যাকে তৎক্ষণাৎ তাহাদিগের হস্তে প্রদান করিতাম, এবং পারিতোষিক প্রভৃতির ভাণ করিয়া, যাহার নিকট যতদূর সম্ভব, তাহা গ্রহণ করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইতাম না। আর যে সকল বালিকার পিতামাতা তাহাদিগের কন্যার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিতেন না, আমরা তাহাদিগের বিবাহের সম্বন্ধ করিতাম। 

“বোধ হয়, অনেকেই জানেন যে, পূৰ্ব্ব-বঙ্গ প্রভৃতি স্থানে অশিক্ষিত গরিব ব্রাহ্মণের গৃহে কন্যার বিবাহ দিতে প্রায় কেহই সহজে স্বীকৃত নহেন। সুতরাং সুবিধামত কন্যা পাইলে, সেই গরিব ব্রাহ্মণগণ অবস্থানুযায়ী পণ দিয়া কন্যা গ্রহণ করিয়া থাকেন। আমরা অসৎ উপায়ে যে সকল বালক-বালিকা সংগ্রহ করিতাম, তাহাদিগকে প্রায়ই সেই সকল স্থানে লইয়া গিয়া, যাঁহারা সেই সকল কন্যা গ্রহণ করিতে সম্মত হইতেন, তাঁহাদিগের নিকট হইতে পণ গ্রহণ করিয়া সেই সকল কন্যার বিবাহ দিতাম। 

“প্রথমতঃ আমি, কালীবাবু ও গণেশবাবু এই তিনজনে বালিকাগণকে লইয়া, কলিকাতা হইতে সেই সকল প্রদেশে গমন করিতাম। সেখানে আমি প্রায়ই সেই সকল বালিকার মাতা হইতাম, কালীবাবু তাহার পিতা বলিয়া পরিচয় দিতেন, এবং গণেশবাবু যখন যেরূপ আবশ্যক বিবেচনা করিতেন, তখন সেইরূপ পরিচয় প্রদান করিয়া সেই বালিকার বিবাহ কাৰ্য্য সম্পন্ন পূর্ব্বক পণের টাকা বুঝিয়া লইয়া কলিকাতায় চলিয়া আসিতেন। বালিকা তাহার শ্বশুরালয়েই থাকিত, আমরাও সুযোগমত তাহাদিগের খোঁজ-খবর লইতে ভুলিতাম না। যাহারা আমাদিগের মায়ায় অভিভূত হইত, যাহারা আমাদিগের কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই বালিকাকে আমাদিগের সহিত পুনরায় তাহাদিগের প্রদত্ত অলঙ্কারের সহিত কলিকাতায় পাঠাইয়া দিত, তাহারা তাহাদিগের সর্ব্বনাশের পথ একবারেই পরিষ্কার করিত। তাহাদিগের প্রদত্ত অলঙ্কারপত্রের কথা দূরে থাকুক, তাহারা সেই কন্যার আর কোনরূপ সন্ধান পর্যন্ত প্রাপ্ত হইত না। আমরা উহাকে কন্যা সাজাইয়া, অপর কোন স্থানে পুনরায় উহার বিবাহ দিতাম, এবং সেই বালিকাকে উপলক্ষ করিয়া, পুনরায় আরও কিছু অর্থের সংস্থান করিয়া লইতাম। 

“আমাদিগের এই ব্যবসা কিছুদিবস পর্য্যন্ত উত্তমরূপে চলিলে পর হঠাৎ উহা একবারে বন্ধ করিতে হইল। কারণ, উক্তরূপে অনেকগুলি বালিকাকে অনুসন্ধান করিয়া না পাওয়ায়, সহরের ভিতর ভয়ানক গোলযোগ হইয়া উঠিল। সেই সকল বালিকা কাহা কর্তৃক অপহৃত হইতেছে এবং তাহারা কোথায় বা যাইতেছে, তাহার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত ঘরে ঘরে ডিটেকটিভ ঘুরিতে আরম্ভ করিল। এই সংবাদ পাইবামাত্র আমাদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হইল। সেই ব্যবসা চালাইতে আর আমরা সাহসী হইতে পারিলাম না। সুতরাং সেই কার্য্য আমরা একবারেই বন্ধ করিয়া দিলাম। এই সকল অসৎ উপায় অবলম্বন করিয়া, এতদিবস পর্য্যন্ত আমরা যে সকল অর্থ উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, এখন বসিয়া বসিয়া ক্রমে তাহা ব্যয় করিতে লাগিলাম।” 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কালীবাবুর পরামর্শ ও পরিণাম 

পুলিস এ বিষয়ে সবিশেষরূপে হস্তক্ষেপ করাতে আমাদিগের এই সকল জুয়াচুরি একবারে বন্ধ করিতে হইল। জুয়াচুরি-উপলব্ধ অর্থ সকল যেরূপ সহজ উপায়ে উপার্জ্জিত হইয়াছিল, সেইরূপ সহজ উপায়েই অল্পদিবসের মধ্যেই ব্যয়িত হইয়া গেল। পুনরায় সংসারে কষ্ট আসিয়া উপস্থিত হইল, পুনরায় কালীবাবু অপর কোন নূতন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।” 

“একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি নির্জ্জনে বসিয়া আমার জীবনের ঘটনাগুলি পর্যালোচনা করিতেছি, এরূপ সময় হঠাৎ কালীবাবু কোথা হইতে আগমন করিলেন। আসিয়াই আমাকে ডাকিলেন, ডাকিবামাত্র আমিও আমার চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া তাঁহার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলাম। তিনি আমার হস্তে একগোছা নোট দিয়া কহিলেন ‘এখন ইহা রাখ। যদি আবশ্যক হয়, তবে ইহার কতক আমাকে প্রত্যর্পণ করিতে হইবে। আমি একটি নূতন কার্য্যের নূতন উপায় উদ্ভাবন করিতেছি। যদি একটু সতর্কতার সহিত কার্য্য করিতে পারি, তাহা হইলে আর আমাদিগের কোন কষ্ট থাকিবে না, আমরা যতদিন বাঁচিব, বুঝিয়া চলিতে পারিলে, ততদিন তাহাতেই আমরা আমাদিগের জীবন কাটাইতে পারিব।” 

“আমি নোটের গোছা খুলিয়া দেখিলাম, ইহাতে দশখানি নোট ছিল; তাহার প্রত্যেকখানি এক শত টাকা মূল্যের; সুতরাং তাহাতে মোট হাজার টাকার নোট ছিল। তখন আমি কালীবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘এখন আমার হাতে যে এই হাজার টাকার নোট দিলেন, ইহা হঠাৎ আপনি কোথায় পাইলেন, এবং আর যে একটি নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়াছেন বলিতেছেন, তাহাই বা কি?” 

“আমার কথা শেষ হইতে না হইতেই কালীবাবু কহিলেন ‘আমি যে নূতন উপায় বাহির করিয়াছি, তাহার ফল আমাদিগের আশাতিরিক্ত। সেই নূতন উপায়ে যে কেবলমাত্র হাজার টাকা পাইয়াছি, তাহাও নহে উহা কেবল বায়নামাত্র। কাৰ্য্য সম্পন্ন করিতে পারিলে, ইহাতে আট দশ হাজার টাকা লাভের সম্ভাবনা আছে। অথচ এবার আর অপর কোন লোককে অংশীদার করাইবার প্রয়োজন হইবে না; যাহা পাইব, তাহা আমদিগেরই থাকিবে। কিন্তু একজন স্ত্রীলোকের সাহায্য ব্যতীত আমি একাকী যে সেই কার্য্য সম্পন্ন করিয়া উঠিতে পারিব, এমন বোধ হয় না। তবে বাহিরের অপর স্ত্রীলোকের পরিবর্তে তুমি আমাকে একটু সাহায্য করিলেই, আমি সেই কাৰ্য্য অনায়াসেই সম্পন্ন করিয়া লইতে পারিব, আর তাহাতে সৰ্ব্বদিকেই ভাল হয়।” 

“কালীবাবুর এই কথা শুনিয়া আমি কহিলাম ‘আমার সাহায্যে যদি এই কার্য্য সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা হইলে আর ভাবনা কি? আমাকে কি করিতে হইবে বলুন, আমার সামর্থ্যমত আমি কার্য্য করিতে প্রস্তুত আছি।”

“আমার কথা শুনিয়া কালীবাবু আমার কাণে কাণে সমস্ত কথা বলিলেন। তাঁহার ভয়ানক পরামর্শ শুনিয়া প্রথমতঃ আমার শরীর শিহরিয়া উঠিল; কিন্তু পরক্ষণেই আমি তাহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়া সৰ্ব্বতোভাবে তাহাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলাম।” 

“এবার কালীবাবুর সহিত সে ভয়ানক কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করলাম, তাহার পরিণামে আমি ও কালীবাবু পরিশেষে এক হত্যাপরার্ধে ধৃত হইয়াছিলাম। আমি পুলিসের হস্ত হইতে সেই সময় নিষ্কৃতি লাভ করিয়াছিলাম; কিন্তু সেই মোকদ্দমায় কালীবাবু চরমদণ্ডে দণ্ডিত হন।”* 

[* এই মোকদ্দমার আনুপূর্ব্বিক বিবরণ পুলিসের অনুসন্ধান এবং কালীবাবুর পরিণাম ৭ম বৎসরের ৮০ম সংখ্যক দারোগার দপ্তরে বিস্তৃতরূপে বিবৃত আছে।]

“মোকদ্দমার প্রথম অবস্থায় পুলিসের হস্ত হইতে আমি পরিত্রাণ পাইলাম সত্য; কিন্তু কালীবাবুর পুত্র হরির রোদন শুনিয়া ও কালীবাবুর ভবিষ্যৎ অবস্থা স্মরণ করিয়া আমার চক্ষে জল আসিল। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলাম, যেরূপেই পারি, আমি কালীবাবুকে বাঁচাইব। যে মোকদ্দমায় কালীবাবু আসামী হইয়াছেন, উহাতে আমরা যত অর্থ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, তাহার সমস্ত, তদ্ব্যতীত অলঙ্কারপত্র, ঘর-বাড়ী প্রভৃতি আমার যাহা কিছু ছিল, তাহার সমস্ত বিক্রয় করিয়া, কালীবাবুকে বাঁচাইবার নিমিত্ত সেই মোকদ্দমায় খরচ করিলাম; কিন্তু কোনরূপেই তাঁহাকে বাঁচাইতে পারিলাম না। হাইকোর্টে জুরির বিচারে কালীবাবুর ফাঁসির হুকুম হইয়া গেল, লাভের মধ্যে আমি পথের ভিখারী হইলাম। এমন কি, এক সপ্তাহকাল আমার আহারের সংস্থান হইতে পারে, বাস্তবিক এরূপ অর্থও আমার নিকট রহিল না। 

“যে দিবস কালীবাবুর ফাঁসি হইবে, তাহার পূর্ব্বদিবস আমি তাহাকে জেলের ভিতর দেখিতে গেলাম। সেইদিবস কালীবাবু আমাকে কহিলেন ‘তুমি আমাকে বাঁচাইবার নিমিত্ত তোমার সাধ্যমত যত চেষ্টা হইতে পারে, তাহার কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই, বরং কোন বিষয়ে সাধ্যাতীত কার্য্যও করিয়াছ। আমারই নিমিত্ত তুমি তোমার যথাসর্বস্ব হারাইয়াছ, তাহাও দেখিতে পাইতেছি। জগদীশ্বর আমার অদৃষ্টে যাহা লিখিয়াছেন, তাহা বোধ করিতে পারে, এরূপ ক্ষমতা এ জগতে কাহারও নাই। সুতরাং অর্থ ব্যয় করিয়া আমাকে কিরূপে বাঁচাইতে পারিবে? আমার অদৃষ্টে যাহা ছিল, তাহা হইল। এখন যাইবার সময় তোমার নিকট একটি শেষ অনুরোধ করিয়া যাইতেছি, আমার হরি তোমার নিকট রহিল, তাহাকে দেখিও, এবং তাহাকে প্রতিপালন করিও। এখন আমি চলিলাম, আমার জন্য কোনরূপ দুঃখ বা কষ্ট করিও না। এই জগতে তুমি যতদিবস জীবিত থাকিবে, ততদিন তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎ হইবে না সত্য, কিন্তু পরিশেষে আমরা উভয়েই পুনরায় মিলিত হইব। আমি এখন আর কোন কথা বলিতে পারিতেছি না। এখন হইতে তোমার সহিত এই আমার শেষ বিদায়!” এই কথা বলিতে বলিতে কালীবাবুর কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল, আমিও তাঁহার দিকে পুনর্ব্বার দৃষ্টিপাত করিতে অসমর্থ হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে একান্ত ক্ষুণ্নমনে সেই স্থান হতে বহির্গত হইয়া আসিলাম।

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – গুরুদর্শনের উপায় 

“কালীবাবুর ফাঁসী হইয়া গেল; কিন্তু এ যাত্রা আমি রক্ষা পাইলাম। আমি মনুষ্যের হস্ত হইতে এ যাহা রক্ষা পাইলাম সত্য, কিন্তু প্রকৃত দণ্ডদাতার হস্ত হইতে যে আমায় নিষ্কৃতি পাইবার উপায় নাই, তাহা একবারের নিমিত্তও মনে সদয় হইল না। এই ঘটনার পর কিছুদিবস পর্য্যন্ত কালীবাবুর অবস্থা ভাবিয়া ভাবিয়া এবং শোকে রাত্রিদিবস কাঁদিয়া কাঁদিয়া দিন যাপন করিলাম। এই সময় দুইটি মিষ্ট কথা বলিয়া আমার শোকাবেগ নিবৃত্ত করিতে চেষ্টিত হয়, এরূপ একজনকেও আর দেখিতে পাইলাম না। কালীবাবুর মোকদ্দমার সময় যে সকল ব্যক্তি সর্ব্বদা আমার বাড়ীতে আসিত এবং ‘আজ এই খরচের আবশ্যক, আজ এত টাকার দরকার’ বলিয়া আমার নিকট হইতে ক্রমান্বয়ে অর্থ গ্রহণ করিত, তাহাদিগের একজনকেও আর এ সময়ে খুঁজিয়া পাইলাম না। আমার অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে আর কেহই ফিরিয়া চাহিত না। এখন বন্ধুবান্ধব বলুন, আত্মীয়-স্বজন বলুন, আর শত্রু-মিত্রই বলুন, ভরসার মধ্যে কেবলমাত্র আমার সেই কালীবাবুর পুত্র হরি। 

“ক্রমে আমার অবস্থা এরূপ শোচনীয় হইয়া পড়িল যে, তাহা বলিলে, হয় ত অনেকে আমার কথায় বিশ্বাস করিবেন না। আমার অত বড় নিজ বাড়ীতে চাকর-চাকরাণী দ্বারা পরিবেষ্টিত ও দ্বারবাদিগের দ্বারা পরিরক্ষিত হইয়া বাস করা দূরে থাকুক, অপরের সামান্য একখানি পাকা ভাড়াটিয়া বাড়ীতে থাকা পর্য্যন্ত এখন ঘুচিয়া গিয়াছে। এখন আমার থাকিবার স্থান হইয়াছে একখানি সামান্য খোলার বাড়ীর একখানি অতি সামান্য ও ক্ষুদ্র ঘর। সেইরূপ একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতে লাগিলাম সত্য, কিন্তু তাহারও অতি সামান্য ভাড়া সকল সময় নিয়মিতরূপে দিয়া উঠিতে পারিতাম না। নিয়মিতরূপ ভাড়া প্রদান করা ত দূরের কথা, হয়ত কোন কোন দিবস দুইবেলা সামান্য আহারের সংস্থান করিয়া উঠিতে পারিতাম না। 

“এইরূপে অতি কষ্টে আরও কিছুদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। ক্রমে ক্রমে ভুলিয়া গেলাম; কিন্তু দিনপাতে। আর কোনরূপ স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। আমার রূপ-যৌবন না হইয়া গিয়াছিল, অহঙ্কারে মত্ত হইয়া, পরপুরুষকে আদর-যত্ন করা অনেক পূর্ব্ব হইতেই পরিত্যাগ করিয়াছিলাম। সুতরাং ভাল লোক আর আমার নিকট আসিবে কেন? নিতান্ত সামান্য ও দরিদ্র লোকের মধ্যে কেহ কেহ কখন কখন আমার ঘরে আসিত। তাহাদিগের নিকট হইতে এখন যে দুই চারি আনার সংস্থান করিতে পারিতাম, তদ্দ্বারা কোনরূপে ঘরের ভাড়া দিয়া, আমার ও হরির পেটের ভাতের যতদূর সংকুলান করিতে পরিতাম, তাহাই করিতাম। 

“এই সময়ে কোন ভদ্রলোকের বাড়ীতে দাসীবৃত্তি অবলম্বন করিয়াও যদি জীবনের অবশিষ্ট অংশ অতিবাহিত করিতে মানস করিতাম, তাহা হইলে আজ আমার অদৃষ্টে এরূপ দুর্ঘটনা কখনই ঘটিত না। কিন্তু যাহার মনের গতি একবার অসৎপথ অবলম্বন করিয়াছে, সে কখনই আর সৎপথ অবলম্বন করিতে পারে না। সামান্য ইচ্ছায় সে তাহার মনের গতি আর কখনই ফিরাইতে সক্ষম হয় না। সৎ ইচ্ছাকে সে কখনই আর বলবতী রাখিতে সক্ষম হয় না। 

“কালীবাবুর মৃত্যুর পর হইতে অনেক দিবস পর্যন্ত আমি আর কোনরূপ অসৎকার্য্য করি নাই; কিন্তু পুনরায় আমার মনের গতি ফিরিতে আরম্ভ হইল, পুনরায় ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিলাম। আমি যে কি প্রকার ভয়ানক কার্য্য করিতে এবার প্রবৃত্ত হইলাম, তাহা শুনিয়া পাঠকগণ চমকিত হইবেন, স্ত্রীলোকের দ্বারা যে এরূপ কার্য্য সকল সম্পন্ন হইতে পারে, তাহা সহজে আপনাদের বিশ্বাস হইবে না। 

‘সেই সময় আমি অন্য স্থানে একখানি নিতান্ত সামান্য ঘরে বাস করিতাম সত্য, কিন্তু আমার সেই পূর্ব্বপরিচিত সোণাগাছিতে প্রত্যহ একবার বেড়াইতে যাইতে ভুলিতাম না, উহা যেন আমার একপ্রকার নিত্য কর্ম্মের মধ্যেই ছিল।

“একদিবস আমি সেণাগাছিতে কুসুমনাম্নী একটি স্ত্রীলোকের বাড়ীতে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। তাহার সহিত আমার পূর্ব্ব হইতেই পরিচয় ছিল। পূর্ব্বে মধ্যে মধ্যে আমি তাহার বাড়ীতে গমন করিতাম; কিন্তু ইদানীং অনেক দিবস তাহার বাড়ীতে গমন করি নাই। প্রায় ছয় মাস পরে আজ আমি তাহার বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। অন্যান্য দিবস কুসুমের বাড়ীতে গমন করিলে, সে যেমন মনের আনন্দে প্রাণ খুলিয়া আমার সহিত কথা কহিত, আজ সেরূপ দেখিলাম না। তাহাকে দেখিয়া বোধ হইল, তাহার হৃদয়ে যেন ভয়ানক দুঃখ প্রবেশ করিয়াছে, তাহার মনে সুখের লেশমাত্রও নাই। এই ব্যাপার দেখিয়া আমি তাহাকে কহিলাম, “দিদি! আজ তোমাকে এমন দেখিতেছি কেন?’ 

“আমার কথা শুনিয়া কুসুম যেন একবারে গলিয়া গেল, এবং তাহার মনের কপাট আমার নিকট খুলিয়া দিল, কহিল ‘দিদি! আর বলিবই বা কি, আমি বুঝিতে না পারিয়া, নিজের পায়ে নিজে কুঠারাঘাত করিয়াছি! আমি আমার গৃহদেবতাকে পদাঘাতে দূর করিয়া দিয়াছি, তাই আমার কষ্টের আর পরিসীমা নাই। আমি বুঝিতে না পারিয়া, যখন আমার পুরাতন বাবুকে পদাঘাত করিয়া আমার গৃহ হইতে বহির্গত করিয়া দিয়াছিলাম, তখন ভাবিয়াছিলাম, ইহাকে পরিত্যাগ করিলে, আবার কত নূতন বাবু আসিয়া আমার পদানত হইবে; কিন্তু ভাই, আমার এমনই দূরদৃষ্ট যে, তিনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া যাইবার পর, আর কেহই আমার দিকে তাকাইয়া দেখিল না, ভুলক্রমেও আমার গৃহে আর কেহ পদার্পণ করিল না। সুতরাং আমার উপার্জ্জনের উপায় বন্ধ হইয়া গেল, দিন দিন নানাপ্রকার কষ্ট আসিয়া আমাকে আশ্রয় করিতে লাগিল। এখন আমি যেরূপ কষ্টে পড়িয়াছি, তাহা বলিবার নয়, বলিলেও সহজে কেহ বিশ্বাস করিবে না। আমার হস্তে নগদ যাহা কিছু ছিল তাহার সমস্তই ব্যয়িত হইয়া গিয়াছে। এমন কি, বাজার খরচের সংস্থান পর্যন্তও আর আমার নাই। ভরসার মধ্যে গহনা কয়েকখানি, কিন্তু যেরূপ সময় দেখিতেছি, তাহাতে তাহাও যে আর রাখিতে পারিব, সে ভরসাও আর আমার নাই। এরূপ অবস্থায় আমার কি করা কর্তব্য, তাহার কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া, এবং অন্য কোনরূপ উপায় না দেখিয়া, আমি পুনরায় আমার সেই পুরাতন বাবুকে এখানে আসিবার নিমিত্ত বারে বারে সংবাদ পাঠাইয়া দিই। কিন্তু তাহাতেও তিনি আমার বাড়ীতে না আসায়, গত কল্য আমি নিজেই তাঁহার বাড়ীতে গমন করিয়াছিলাম। তাঁহাকে সেই স্থানে দেখিতে পাইয়া তাঁহার নিকট আমার কত কষ্ট জানাইলাম, কত তোষামোদ করিলাম, অবশেষে তাঁহার পা পর্যন্ত ধরিয়া কত কাঁদিলাম, কিন্তু তিনি একবারের নিমিত্তও আমার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না। অধিকন্তু সেই স্থান হইতে উঠিয়া স্থানান্তরে প্রস্থান করিলেন। এই ত দিদি আমার বিপদ, এই বিপদ হইতে উদ্ধার হইবার কি কোনরূপ উপায় নাই দিদি? এখন কি উপায় অবলম্বন করিলে, পুনরায় তিনি আমার উপর প্রসন্ন হন, তাহার কি কোন উপায় বলিয়া দিতে পার বোন্?’ 

“কুসুমের কথা শুনিয়া আমি কপট দুঃখ প্রকাশ করিয়া আমার চক্ষু দিয়া ফোঁটা দুই জল বাহির করিলাম, ও কহিলাম, “দিদি! তোমার এত কষ্ট হইয়াছে, তাহা আমাকে একদিবসের নিমিত্তও ইতিপূৰ্ব্বে বল নাই কেন? আমাকে এ কথা পূৰ্ব্বে বলিলেই এতদিবস যে তোমার সমস্ত কষ্ট দূর হইয়া যাইত। তোমার বাবু তোমার উপর পূর্ব্ব অপেক্ষাও অধিক পরিমাণে সন্তুষ্ট হইতেন, তোমার খরচের টাকার পরিমাণ তিনি দ্বিগুণ বাড়াইয়া দিতেন। তদ্ব্যতীত যখন যাহা চাহিতে, দেখিতে দেখিতে তাহা আনিয়া তোমার হস্তে তিনি সমর্পণ করিতেন। তিনি ব্যতীত তোমার উপর আরও ভাল ভাল লোকের নজর পড়িত। তোমার এখন যে সকল অলঙ্কার আছে, দেখিতে দেখিতে সে সকল দ্বিগুণ হইয়া যাইত। তুমি কি জান না, আমার একজন গুরুদেব আছেন! তিনি প্রসন্ন হইলে না করিতে পারেন, এমন কার্য্যই এ জগতে নাই। তিনি সমস্তই করিতে পারেন, নিমেষ মধ্যে তোমার সমস্ত দুঃখ ঘুচাইয়া দিতে পারেন। তোমার মত অবস্থায় পড়িয়া আরও দুই তিনটি স্ত্রীলোক আমাকে তাহাদিগের দুঃখের বিষয় জানাইয়াছিল। আমি তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া আমার সেই গুরুদেবের নিকট গমন করিয়াছিলেন, তিনি আমার কথা শুনিয়া ও তাহাদিগের দুঃখ দেখিয়া, তাহাদিগকে একটু একটু ঔষধ প্রদান করিয়াছিলেন। বলিব কি বোন্! সেই ঔষধের গুণেই তাহারা তাহাদিগের পূর্ব্ব ধন পুনঃ প্রাপ্ত হইয়া পূর্ব্বের অপেক্ষা আরও অধিক পরিমাণে মনের সুখে কালযাপন করিতেছে, এবং মধ্যে মধ্যে তাহারাও এখন গুরুদেবের নিকট গমন করিয়া তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিয়া আসিতেছে।”আমার কথা শুনিয়া কুসুম যেন একেবারে গলিয়া গেল। সে যেন হস্তে স্বর্গ পাইল। তখন সে আমার সহিত আমার গুরুদেবের নিকট গমন করিয়া, তাঁহার পাদপদ্ম দর্শন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল, ও কহিল, ‘বোন্! এতদিবস আমাকে এ কথা বল নাই কেন? তাহা হইলে এতদিবস আমি তোমার সহিত গমন করিয়া, তোমার গুরুদেবকে দর্শন করিয়া আসিতাম, আর আমাকে এতদিবস পর্যন্ত এ দারুণ কষ্ট ভোগ করিতে হইত না। চল না বোন্, এখনই যাইয়া তাঁহার পাদপদ্ম দর্শন করিয়া আসি। তাঁহার আহারার্থ, বা তাঁহার মনোরঞ্জনার্থ কোন দ্রব্য-সামগ্রী সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে হইবে কি?” 

“কুসুমের কথার উত্তরে আমি তাহাকে কহিলাম, ‘দেখ বোন্! এ ব্যস্ত হইবার বিষয় নহে, বা এখন তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবার সময়ও নহে; তাঁহার নিমিত্ত কোনরূপ দ্রব্য লইয়া যাইবার প্রয়োজন নাই। কারণ, তিনি কোন দ্রব্যেরই প্রয়াসী নহেন। তিনি কিছু আহার করেন বলিয়া আমার বোধ হয় না। কারণ, আমি যতদিন তাঁহার নিকট গমন করিয়াছি, তাহার মধ্যে একদিবসও তাঁহাকে আহার করিতে দেখি নাই, বা আহারের কোনরূপ যোগাড়ও দেখি নাই। অধিকন্তু তাঁহার আহারার্থ দুই একবার কোন কোন দ্রব্য লইয়া গিয়াছিলাম, তাহাতে সন্তুষ্ট হওয়া দূরে থাকুক বরং একটু অসন্তোষ ভাবই প্রকাশ করিয়াছিলেন। সেই পর্যন্ত তাঁহার নিমিত্ত আর কখনও কোন দ্রব্যাদি লইয়া যাই নাই। গুরুদেবের কথা শুনিয়া তুমি যেরূপ অধীর হইয়া পড়িয়াছ দেখিতেছি, তাহাতে আমার বোধ হইতেছে, তুমি এ কথা সকলের নিকট প্রকাশ করিয়া ফেলিবে। এ কথা প্রকাশিত হইয়া গেলে, সকলেই যাইয়া তাঁহাকে বিরক্ত করিবে, তাহা হইলে হয় ত তিনি তাঁহার থাকিবার স্থান পরিত্যাগ করিয়া, স্থানান্তরে চলিয়া যাইবেন। তাহা হইলে যাহারা প্রকৃতই বিপদগ্রস্ত, তাহাদিগের কোন কার্য্যই আর হইবে না। সাবধান, এ কথা যেন আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিও না। আর যে কথা, ক্রমে অধিক কাণে প্রবেশ করে, তাহার ফলও ক্রমে নিতান্ত সামন্য হইয়া পড়ে। তিনি কিছু নিকটেও থাকেন না যে, এখনই যাইয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিবে। তাঁহার থাকিবার স্থান একটি নির্জ্জন বাগানে। সেই বাগান এখান হইতে অনেক দূরে। যদি তুমি একান্তই তাহাকে দেখিতে যাইবার বাসনা করিয়া থাক, তাহা হইলে এ কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ না করিয়া কল্য অতি প্রত্যূষে তুমি একাকী বাড়ী হইতে বহির্গত হইবে, ও একবারে মাণিকতলার পুলের উপর গমন করিবে। সেই স্থানে আমার সহিত তোমার সাক্ষাৎ হইবে। তুমি যদি অগ্রে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হও, তাহা হইলে আমার প্রতীক্ষা করিবে। আমি অগ্রে সেই স্থানে গমন করিলে, তোমার নিমিত্ত অপেক্ষা করিব। ‘পরে উভয়েই একত্র সেই স্থান হইতে গুরুদেবের নিকট গমন করিব। আমাকেও লুকাইয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়া আসিতে হইবে। কারণ আমার হরি যদি একবার জানিতে পারে, তাহা হইলে আমার সেই স্থানে যাওয়া একবারে সুকঠিন হইয়া পড়িবে। আর এক কথা তোমাকে বলিয়া দিই, গুরুদেবের সহিত প্রথম সাক্ষাৎ হইবার সময়েই তিনি এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া থাকেন যে, তোমার ইহার দ্বিগুণ অলঙ্কার হউক। অর্থাৎ সেই সময় প্রথম সাক্ষাৎকারীর অঙ্গে যে মূল্যের অলঙ্কার থাকে গুরুদেবের আশীর্ব্বাদে তাহার দ্বিগুণ মূল্যের অলঙ্কার অতি অল্প দিবসের মধ্যেই হইয়া থাকে। এরূপ অবস্থায় যদি তুমি কোনরূপ অলঙ্কারাদি পরিধান করিয়া গুরুদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইতে চাহ, তাহা হইলে তোমার যেরূপ অভিরুচি হয়, সেইরূপ অলঙ্কার পরিধান করিয়া, মাণিকতলা পুলের উপর গিয়া আমার সহিত মিলিত হইও।’ 

“মূর্খ কুসুম আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া, আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। পরদিবস অতি প্রত্যূষে মাণিকতলা পুলের উপর আমাদিগের উভয়ের সাক্ষাৎ হইবে, ইহাও স্থিরীকৃত হইয়া গেল। আমিও পরিশেষে সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া আমার গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। 

“রাত্রিকালে আমি আমার হরিকে লইয়া, আমার গৃহে শয়ন করিলাম বটে; কিন্তু আমার নিদ্রা হইল না। নানারূপ চিন্তা আসিয়া আমার মনকে আলোড়িত করিতে লাগিল। 

“আমার প্রথম চিন্তা -কুসুম ত আমার প্রস্তাবে সম্মত হইল। যে সে তাহার অলঙ্কারগুলি লইয়াও গমন করিবে, তদ্বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। কিন্তু কিরূপ উপায়ে তাহার অলঙ্কারগুলি হস্তগত করিতে সমর্থ হইব? – এখন তাহার সম্বলের মধ্যে গহনা কয়খানি। সেই গহনা কয়খানি আমি আত্মসাৎ করিলে সে যে চুপ করিয়া থাকিবে, তাহা আমার বোধ হয় না। জীবন থাকিতে সে তাহার গহনার মায়া পরিত্যাগ করিতে পারিবে না; সুতরাং আমার সম্পূর্ণরূপ বিপদের সম্ভাবনা এরূপ অবস্থায় কুসুমকে হত্যা করিয়া, তাহার অলঙ্কারগুলি আত্মসাৎ না করিতে পারলে আর কোনরূপ উপায় নাই। 

“দ্বিতীয় চিন্তা—কুসুমকে হত্যা করিব কি প্রকারে? হত্যা করিবার কালে যদি কেহ দেখিতে পায়, তাহা হইলে আমার উপায় কি হইবে? আর যদি কেহ দেখিতে না পায়, তাহা হইলেই বা অলঙ্কারগুলি বিক্রয় করিব কিরূপে? – কোন স্থানে যদি কুসুমের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ডাক্তারের পরীক্ষায় যদি জানিতে পারা যায়, যদি উহার মৃত্যুর কারণ হত্যা, অর্থাৎ কেহ উহাকে অস্ত্রাঘাতে বা আর কোনরূপ উপায়ে হত্যা করিয়াছে, বা গলা টিপিয়া মারিয়া ফেলিয়াছে, তাহা হইলে পুলিস সবিশেষরূপে উহার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবে।—তাহা হইলে উহা যে কাহার মৃতদেহ, তাহাও হয় ত প্রকাশ হইয়া পড়িবে। — কুসুমের মৃতদেহ জানিতে পারিলে, উহার অঙ্গে কি কি অলঙ্কার ছিল, তাহাও জানিতে বাকী থাকিবে না।—এরূপ অবস্থায় সেই সকল অলঙ্কার বিক্রয় করিবার নিমিত্ত যে ব্যক্তি বাজারে বাহির করিবে, সে-ই হত্যাপরাধে ধৃত হইবে। সুতরাং এখন এরূপ কোন একটি উপায় বাহির করার প্রয়োজন, যাহাতে ডাক্তারের পরীক্ষায় উহা কোন প্রকার হত্যা বলিয়া সাব্যস্ত না হয়। তাহা হইলে পুলিসেরও সবিশেষ অনুসন্ধান হইবে না। আর এদিকে অলঙ্কারগুলি অনায়াসেই বিক্রয় করিয়া আমি আত্মসাৎ করিতে সমর্থ হইব। 

“এইরূপে সমস্ত রাত্রি ভাবিয়া পরিশেষে আমার মনের মত একটি সুন্দর উপায় বাহির করিলাম। সাবধান হইয়া কার্য্য করিতে পারিলে, আমার এই নূতন উদ্ভাবিত উপায়ে যে হত্যা করিব, ডাক্তারের পরীক্ষায় তাহা হত্যা বলিয়া কখনই স্থিরীকৃত হইবে না। সুতরাং পুলিসেরও সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিবার প্রয়োজন হইবে না। আমি কিছুকাল পৰ্য্যন্ত এই নূতন উপায়ে আমার নূতন ব্যবসা চালাইয়া, পুনরায় বেশ দুই পয়সার সংস্থান করিয়া লইতে সমর্থ হইব। এই নব উদ্ভাবিত উপায় যে কি, তাহা পাঠকগণ আমার কার্য্য দেখিয়া, ক্রমে অবগত হইতে পারিবেন।” 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – পৈশাচিক কাণ্ড 

“পরদিবস অতি প্রত্যূষে আমি একাকী বাটী হইতে বহির্গত হইলাম। মাণিকতলা পুলের উপর গিয়া দেখি, কুসুম বেশ ভাল একখানি কাপড় ও তাহার সমস্ত অলঙ্কারগুলি পরিয়া পূৰ্ব্ব হইতেই সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া, আমার প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহার সহিত অপর লোকজন আর কেহই নাই।” 

“মাণিকতলা পুলের উপর হইতে আমরা উভয়েই পদব্রজে আমার সেই গুরুর উদ্দেশে চলিলাম। ক্রমে বহু বাড়ী, পুষ্করিণী বাগান ও জঙ্গল প্রভৃতি অতিক্রম করিয়া, জঙ্গল-পরিপূর্ণ বহু পুরাতন একটি বাগানের ভিতর গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই বাগানের নিকটবর্ত্তী কোন স্থানে কোন লোকজনের সংস্পর্শ নাই, বা কেহ যে কখনও সেই স্থানে গমন করিয়া থাকে, বাগানের অবস্থা দেখিয়া তাহা বিবেচনা হয় না। সেই বাগান বা জঙ্গলের মধ্যে একটি পুষ্করিণী আছে। আমরা উভয়ে সেই পুষ্করিণীর একটি বাঁধা ঘাটের উপর গিয়া উপবেশন করিয়া পথশ্রান্তি কিয়ৎ পরিমাণে দূর করিলাম। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত সেই স্থানে বসিয়া রহিলাম, তাহার মধ্যে কোন লোকজন, বা পশ্বাদি সেই স্থানে দেখিতে পাইলাম না। সেই স্থানে যে কখনও মানবাদির গমন হয়, তাহাও বোধ হইল না।’ 

“এই সময় আমি কুসুমকে সম্বোধন করিয়া কহিলাম ‘ভগিনি! যে বাগানে আমার গুরুদেব অবস্থিতি করেন, আমরা সেই বাগানের প্রায় নিকটবর্তী হইয়াছি, এই বাগানের সংলগ্ন ওই যে বাগান দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, তিনি ওই স্থানেই আছেন। আমার উপর তাঁহার এই আদেশ আছে যে, যে ব্যক্তি কোনরূপ কামনা করিয়া, আমার সহিত একত্র তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে যাইবে, তাহাকে পূর্ব্বে এই পুস্করিণীতে স্নান করিয়া আর্দ্র বসনে তাঁহার নিকট গমন করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলে, অবিলম্বেই তাহার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইবে। আইস বোন, আমরা এই স্থানে স্নান করি। তোমার পরিধানে যে সকল অলঙ্কার আছে, জল লাগাইয়া নষ্ট করিবার প্রয়োজন নাই। গহনাগুলি খুলিয়া এই স্থানে রাখিয়া দাও, স্নানান্তে পুনরায় উহা পরিধান করিও।’ এই বলিয়া, অগ্রেই আমি গাত্রোত্থান করিলাম, এবং ভগ্ন সোপানগুলি ক্রমে অবতরণ করিলাম।” 

‘কুসুম আমার দুরভিসন্ধির বিষয় কিছুমাত্র বুঝিতে না পারিয়া, তাহার অঙ্গস্থিত অলঙ্কারগুলি এক একখানি করিয়া খুলিয়া সেই স্থানের একটি সোপানের উপর রাখিয়া দিল, এবং ক্রমে ক্রমে সোপানাবলী অবতরণ করিয়া, আমার সহিত একত্র সেই পুষ্করিণীতে অবগাহন করিল। সেই সময় আমি কুসুমের পৃষ্ঠদেশের ময়লা উঠাইয়া দেওয়ার ভাণ করিয়া, তাহার স্কন্ধদেশ দৃঢ়রূপে চাপিয়া ধরিলাম ও সেই পুষ্করিণীর জলের ভিতর তাহাকে ডুবাইয়া রাখিলাম। সে ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল; কিন্তু কিছুতেই আমি তাহাকে ছাড়িলাম না, বা জলের ভিতর হইতে আর তাহাকে উঠিতেও দিলাম না। দেখিতে দেখিতে তাহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া গেল। তখন আমি তাহার মৃতদেহ সেই পুষ্করিণীর জলের ভিতর রাখিয়া দিয়া, আস্তে আস্তে উপরে উঠিলাম এবং তাহার পরিত্যক্ত অলঙ্কারগুলি গ্রহণ পূর্ব্বক আপন গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলাম।’ 

“আমি সেই সকল গহনা লইয়া আপনার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং সুযোগমত ক্রমে ক্রমে এক একখানি করিয়া বিক্রয় পূর্ব্বক আপন জীবনধারণ ও হরিকে প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। সেই সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় ওই পয়সা সংস্থানের একটি উপায়ও হইল।” 

আমি ইতিপূর্বে সোণাগাছিতে যেরূপ ভাবে বেড়াইতে যাইতাম, এখনও সময় সময় সেইরূপ ভাবে যাইতে লাগিলাম। পূর্ব্বোক্ত ঘটনার দুই একদিবস পরেই, কুসুমের অনুপস্থিতিতে সেই বাড়ীর অপরাপর সকলে কিরূপ ভাবিয়াছে, তাহা জানিবার নিমিত্ত বেড়াইবার ভাণে আমি পুনরায় সেই বাড়ীতে গমন করিলাম। শুনিলাম, আমার . সহিত সাক্ষাৎ হইবার পরদিবসই সে কোথায় চলিয়া গিয়াছে। কেহ বলিল, গঙ্গাস্নান করিতে গিয়া সে হয় ত ডুবিয়া মরিয়াছে। কেহ বলিল, কোন বাবু হয় ত তাহাকে লইয়া স্থানান্তরে গমন করিয়াছে। কেহবা কহিল, ইদানীং তাহার অবস্থা নিতান্ত মন্দ হওয়ায় ও বাড়ীওয়ালীর নিকট তাহার কতকগুলি ঋণ হওয়ায়, বাড়ীওয়ালীকে ফাঁকি দিবার মানসে সে তাহার গহনা পত্র ও মূল্যবান দ্রব্যাদি লইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া, এই স্থান হইতে চুপি চুপি প্রস্থান করিয়াছে। এইরূপে যাহার মনে যাহা উদয় হইতে লাগিল, সে তাহাই বলিতে লাগিল। প্রকৃত কথা যে কি, তাহা কিন্তু কেহই অবগত হইতে পারে নাই, ইহা বেশ বুঝিতে পারিলাম। লোক দেখাইয়া কুসুমের নিমিত্ত আমিও একটু কপট দুঃখ প্রকাশ করিলাম এবং আমিও তাহার অনুসন্ধানে রহিলাম, বাড়ীওয়ালীকে এই কথা বলিয়া, সেই স্থান হইতে আস্তে আস্তে প্রস্থান করিলাম।” 

“পাঁচ সাতদিবসকাল কুসুম সম্বন্ধে কোনরূপ উচ্চ-বাচ্য আর কাহারও নিকট শুনিতে পাইলাম না। আটদিবস পরে আমাদিগের বাড়ীর একটি ভাড়াটিয়া একখানি বাঙ্গালা সংবাদ-পত্র পাঠ করিতেছিল, আমরা কেহ কেহ উহা শুনিতেছিলাম। সেইদিবস দেখিলাম, সেই সংবাদপত্রে একটি সংবাদ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহার মর্ম্ম এইরূপ; 

“কলিকাতার মাণিকতলা নামক স্থান হইতে কিছু দূরবর্তী একটি পুরাতন বাগানের মধ্যস্থিত পুষ্করিণীর ভিতর একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে। উহা যে কাহার দেহ, তাহা জানিতে পারা যায় নাই; কিন্তু ডাক্তারের পরীক্ষায় প্রকাশ হইয়াছে যে, জলে ডোবাই তাহার মৃত্যুর কারণ। বিবেচনা হয়, কোন স্ত্রীলোক সেই পুষ্করিণীতে ডুবিয়া আত্মঘাতী হইয়াছে।” এই সংবাদের প্রকৃত বৃত্তান্ত কেবল আমিই বুঝিলাম; বুঝিয়া চুপ করিয়া রহিলাম, আর কাহাকেও কোন কথা বলিলাম না। 

‘এইরূপে ক্রমে যত দিন গত হইতে লাগিল, আমার পাপরাশিও ততই শাখা-প্রশাখায় বিস্তারিত হইয়া আমাকে আচ্ছন্ন করিতে লাগিল। আমিও ততই অনাথিনীগণের সর্ব্বনাশ ও জীবননাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। আমি যেরূপ ভয়ানক কার্য্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, সেই কার্য্য সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন করা সবিশেষ কষ্টসাধ্য। সুতরাং সেই সময় আমার একজন সহযোগীর প্রয়োজন হইল। অনুসন্ধান করিতে করিতে আমার মনের মত একটি সহযোগিনীও জুটিয়া গেল; খুঙ্গীনাম্নী একটি স্ত্রীলোক আমায় সহায়তা করিতে প্রবৃত্ত হইল। তাহাকে আমি আপনার বাড়ীতে রাখিলাম, এবং সবিশেষ যত্ন করিয়া তাহাকে প্রতিপালন করিতে লাগিলাম। উহার সহায়তা না পাইলে, আমি বোধ হয়, এরূপ কার্য্যে আর সহজে হস্তক্ষেপ করিয়া উঠিতে পারিতাম না। উহার সহায়তা পাওয়ায় আমার আর একটি মহৎ লাভ এই হইল যে, যদি কখনও তাহার সহিত আমার মনের অমিল হয়, তাহা হইলে ইচ্ছা করিলেও, সে কখনও আমার অনিষ্ট করিতে সমর্থ হইবে না। কারণ, তাহার কথা কহিবার ক্ষমতা ছিল না।” 

“খুঙ্গীর সাহায্যে তিন বৎসরের মধ্যে পূর্ব্বোক্তরূপ উপায়ে একটি একটি করিয়া ক্রমে আমি পাঁচ পাঁচটি স্ত্রীহত্যা করিলাম, এবং সেই পাঁচটি স্ত্রীলোকের যথাসর্বস্ব অপহরণ করিয়া, ক্রমে আমার অবস্থার পরিবর্তন করিয়া তুলিলাম! একটি একটি করিয়া ক্রমে পাঁচ পাঁচটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ সেই পুষ্করিণীতে পাওয়া গেল, এবং ডাক্তারের পরীক্ষায় সেই পাঁচটি স্ত্রীলোকই জলে ডুবিয়া মরিয়াছে, ইহাই সাব্যস্ত হইয়া গেল।” 

‘পাপ কার্য্য চিরকাল চাপা থাকে না, একদিন না একদিন নিশ্চয়ই তাহা প্রকাশ হইয়া পড়ে। আমার যে সকল পাপ কাৰ্য্য এতদিবস অপ্রকাশ ছিল, আজ তাহা প্রকাশিত হইয়া পড়িল। পূৰ্ব্বকথিত উপায়ে অপর আর একটি স্ত্রীলোককে ভুলাইয়া আনিয়া সেই পুষ্করিণীর ভিতর ডুবাইবার সময় আমি ধৃত হইলাম। সেই সময় পুষ্করিণীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে একটি পুরুষমানুষ কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলেন। তিনিই সেই স্থান হইতে আমার এই কার্য্য দেখিতে পাইলেন, এবং আমার অভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া, আমাকে ধরিয়া থানায় লইয়া গেলেন। যে থানায় আমাকে ধরিয়া লইয়া গেলেন, সেই সময় জনৈক বৃদ্ধ কর্মচারীর উপর সেই থানার ভার ছিল। তিনি সেই লোকটির নিকট হইতে সমস্ত কথা শুনিয়া কিরূপ অবস্থায় আমি সেই স্ত্রীলোকটিকে সেই পুষ্করিণীতে আনিয়াছিলাম, ও তাহার উপর কিরূপ ব্যবহার করিয়াছিলাম, তাহাও তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন। উত্তরে যাহা ঘটিয়াছিল, তিনি তাহাও কহিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করায়, আমি কিন্তু তাহার সমস্ত কথা অস্বীকার করিলাম। জানি না, কর্ম্মচারী মহাশয় কি ভাবিয়া আমার কথায় বিশ্বাস করিলেন, এবং উহাদিগের অভিযোগ না শুনিয়া সকলকেই থানা হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। আমি আমার বাসায় প্রত্যাবর্তন করিলাম; কিন্তু সেই স্ত্রীলোকটি আর আমার সহিত আগমন করিল না। ইহার পর দুই চারিদিবস আর কোন প্রকার কথা শুনিতে পাইলাম না। তাহাতে ভাবিলাম, সকল গোলযোগ মিটিয়া গিয়াছে। কিন্তু কিছুদিবস পরে জানিতে পারিলাম যে, এই ঘটনার প্রায় আটদিবস পরে সেই স্ত্রীলোকের কোন একজন আত্মীয় আপনার নিকট গমন করিয়া আপনাকে ইহার সমস্ত ব্যাপার বলিয়া দিয়াছে। আপনি তাহাদিগের সমস্ত কথা বিশ্বাস করিয়া ইহার অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন। 

“যাহা হউক, পরিশেষে আপনি অনুসন্ধান পূর্ব্বক, হত্যা করিবার চেষ্টা করা অপরাধে আমাকে ধৃত করিয়া সেই মোকদ্দমার বিচারার্থ আমাকে মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রেরণ করিলেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্ম্মচারী আমার এই মোকদ্দমা যে পূৰ্ব্বে গ্রহণ করেন নাই, অনুসন্ধান-কালীন তাহাও প্রকাশিত হইয়া পড়িল। সুতরাং সেই কৰ্ম্মচারীও আমার ন্যায় বিষম বিপদে পতিত হইলেন। তাঁহার হস্ত হইতে তাহার সমস্ত কার্যভার প্রত্যাহার পূর্ব্বক, সেই থানার কার্য্য নির্ব্বাহের নিমিত্ত অপর আর একজন কর্মচারীকে সেই স্থানে পাঠাইয়া দেওয়া হইল এবং উপর হইতে এইরূপ আদেশ হইল যে, এই মোকদ্দমায় যদি আমার দণ্ড হয়, তাহা হইলে তিনিও সবিশেষরূপে দণ্ডিত হইবেন। কর্মচারীর উপর এইরূপ আদেশ-প্রচার আমার পক্ষে সবিশেষরূপ মঙ্গলজনক হইয়া পড়িল। কারণ, সেই মোকদ্দমায় আমাকে কোনরূপ প্রতিকারের উদ্যোগ করিতে হইল না, বা আমার নিকট হইতে একটিমাত্র পয়সাও বাহির করিতে হইল না, সমস্ত ব্যয়ই কর্ম্মচারী মহাশয় নিজকোষ হইতে প্রদান করিলেন। মাজিষ্ট্রেট সাহেবও উপস্থিতমত প্রমাণাদি গ্রহণ করিয়া আমার বিচারার্থ এই মোকদ্দমা দায়রায় পাঠাইয়া দিলেন। সেই স্থানে জুরির বিচারে, ইংরাজ আইনের গুণে ও সেই পুলিস কর্ম্মচারীর রায়ে আমি সে যাত্রা পরিত্রাণ পাইলাম। আহা! দৈবও কি আমার পূঞ্জ পুঞ্জ পৈশাচিক পাপকার্য্যে সহায় হইল। 

“সেই যাত্রা আমি পরিত্রাণ পাইলাম সত্য; কিন্তু আমার সেই ব্যবসা একেবারে বন্ধ হইয়া গেল। সকলেই আমার ব্যবহারের কথা অবগত হইলেন; সকলেই জানিতে পারিলেন যে, আমি গুরু প্রভৃতির যে সকল কথা বলিতাম, তাহার সমস্তই মিথ্যা। এই সময় হইতে আমি সকলের নিকট একরূপ অবিশ্বাসিনী হইয়া পড়িলাম।” 

ষোড়শ পরিচ্ছেদ –  শেষ প্রায়শ্চিত্ত 

“আমি যে স্থানে বাস করিতাম, যখন দেখিলাম, সেই স্থানের সমস্ত লোক আমার চরিত্রের বিষয় উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিয়াছে, তখন আমাকে সেই স্থান পরিত্যাগ করিতে হইল। সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া আমি পাঁচু ধোপানির গলির মধ্যে একখানি ঘরে আমার পুত্র হরির সঙ্গে বাস করিতে লাগিলাম। সেই বাড়ীর অপর আর একটি ভাড়াটিয়া ‘প্রিয়র’ সহিত আমার সবিশেষ সৌহৃদ্য স্থাপিত হইল। সেই সময় তাহারই পরামর্শমত রাজকুমারী নাম্নী সেই বাড়ীর অপর আর একটি ভাড়াটীয়াকে হত্যা করিলাম। সেই হত্যাই আমার জীবনের শেষ লীলা। যেরূপ আমি এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করিয়াছিলাম, যেরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আপনি আমাকে ধৃত করেন, তাহা আর এই স্থানে আপনাকে বলিবার প্রয়োজন নাই। যাহা আপনি নিজ হস্তে করিয়াছেন, তাহা আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন।* এবং সেই মোকদ্দমায় আমার যে দণ্ডের আদেশ হইয়াছে, তাহাও আপনি জানেন।** সুতরাং এ সম্বন্ধে আমার এই স্থানে কোন কথা বলিবার প্রয়োজন নাই। 

[* ‘মহাশয়! আমার জীবনের ঘটনাগুলি আমি প্রথম হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পর্য্যন্ত যতদূর মনে করিতে পারিলাম, তাহা আপনার নিকট আনুপূর্ব্বিক বিবৃত করিলাম। যে সকল ভয়ানক ভয়ানক কার্য্য আমার দ্বারা সম্পন্ন হইয়াছে, তাহার সমস্তই যেরূপে ত্রৈলোক্য রাজকুমারীকে হত্যা করে, এবং যেরূপ ভাবে সেই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করা হয়, তাহার বিস্তৃত বিবরণ শ্রীযুক্ত বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত, ৭ম বৎসরের দারোগার দপ্তরের ৭৮ম সংখ্যায় ‘শেষ লীলা’ নামক প্রবন্ধে বিস্তৃতরূপে বর্ণিত আছে। (প্রকাশক) 

** ত্রৈলোক্য সর্ব্বশেষ যেরূপ দণ্ডে দণ্ডিত হয়, তাহার বিস্তৃত বিবরণ প্রকাশ করিবার এই স্থলে প্রয়োজন নাই। বিচারকালে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, এবং বিচারফল যাহা হইয়াছিল, তাহা তৎকাল-প্রকাশিত একখানি সংবাদপত্র হইতে নিম্নে কর পক্তি উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। পাঠকগণ তাহা পাঠ করিলেই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারিবেন। 

Fifth Criminal Se’ssions,-
SEPTEMBER 2. 
(Before the Hon’ble Mr. Justice Naarris)
SECOND DAY. 

EMPRESSUS TROYLUCKO RAUR—Prisoner was indicated for murder, and is being tried by a special jury. 

Mr. Phillips with Mr. Dunne, prosecuted. 

Mr. G. L. Fagan defended the prisonel. 

Mr. Phillips, in opening the case to the jury, said that it was certainly a singular one. He would first relate to them the external circumstances. The deceased Rajcoomaree Raur, as woman of the town, lived in the same house as the prisoner, where other women of similar character also lived, in Panchoo Dhobani’s gully. On the evening of the 9th August, the prisoner asked the deceased to procure for her certain food–perched rice and goor, and that she would pay her later. The prisoner was expecting the man in whose keeping she was, and she intended paying for the artioeles when he come. He came and left, and after midnight prisoner paid the deceased. They that is, the prisoner, the deceased and a woman named Preco Raur, then procured other food; and while the prisoner and Preco Raur ate from one cup, the deceased ate from another. After eating the food, the deceased complained of being unwell, and went downstairs to her own room, the other two women going with her. And here the story ended. It was not until they came to a later stage at night, that one of the women, seeing the prisoner, coming out of the room of the deceased, questioned her and the prisoner replied that she had gone there to get some food which Rajcoomaree had purchased for her. The evidence would show that she was the person seen coming out of the room of the deceased. Matters stood thus till the following morning, when one of the women, seeing the door of Rajcoomare’s room open… 

[ আষাঢ়, ১৩১২ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *