মরণে মুক্তি (দ্বিতীয় অংশ)

মরণে মুক্তি (দ্বিতীয় অংশ) 

নবম পরিচ্ছেদ 

পথে আসিয়া কোন নিভৃতস্থানে গমন করিলাম, এবং ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়া ভাবিলাম, একবার মঙ্গলার সন্ধান লওয়া উচিত। সে যদি ফিরিয়া আসিয়া থাকে, তাহা হইলে অহীন্দ্রনাথের বর্ত্তমান সন্ধান পাওয়া যাইতে পারে। আর যদি এখনও ফিরিয়া না আসিয়া থাকে, তাহা হইলে অগ্রে তাহারই সন্ধান লওয়া উচিত। এই স্থির করিয়া আমি একবার হরিদাসের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। 

আমাকে দেখিয়া হরিদাস আনন্দিত হইল। পরে জিজ্ঞাসা করিল “বড় দাদাবাবু আর কতকাল জেলে থাকিবেন? বৌ দিদি যে কাঁদিয়া কাটিয়া অনর্থ করিতেছেন। আপনি তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া যাইলেও তিনি আবার অস্থির হইয়া পড়িয়াছেন।” 

হরিদাসের কথা শুনিয়া আমি দুঃখিত হইলাম। কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলাম “যতকাল তাঁহার অদৃষ্টে কষ্টবোধ আছে ততকালই তাঁহাকে জেলে থাকিতে হইবে। কিন্তু ইহা স্থির জানিও যে, এ দিন থাকিবে না। প্রকৃত হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিতে না পারিলে তিনি কেমন করিয়া মুক্তিলাভ করিবেন? তুমি তাঁহার স্ত্রীকে বুঝাইয়া বলিও। এখন আর আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিব না।” 

হরিদাস কোন কথা কহিল না দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “মঙ্গলার কোন সংবাদ পাইয়াছ?” 

হ। আজ্ঞে না—তবে শুনিয়াছি, সেদিন রাত্রে সে না কি দমদম ষ্টেসনের দিকে যাইতেছিল। 

আ। কে এ কথা বলিল? 

হ। আমাদেরই এক প্রতিবেশীর দাসী। 

আ। তখন রাত্রি কত? 

হ। প্রায় দুপুর 

আ। সে কি একাই যাইতেছিল? 

হ। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। কারণ কিছু শুনিয়াছ? 

হ। কারণ জিজ্ঞাসা করিয়াছিল বটে, কিন্তু মঙ্গলা হয় ত সে কথা শুনিতে পায় নাই, না হয় শুনিয়াও উত্তর দেয় নাই। 

আ। দমদমের ষ্টেসন মাষ্টার কি মঙ্গলার পরিচিত? 

হ। আজ্ঞে হাঁ–তিনি এ বাড়ীর সকলকেই চেনেন। 

আ। তাহা হইলে তিনি মঙ্গলার খবর বলিতে পারিবেন। 

এই বলিয়া আর কিছুমাত্র বিলম্ব না করিয়া তখনই দমদম ষ্টেসনে গমন করিলাম। সৌভাগ্যের বিষয় স্টেসন মাষ্টারের সহিত আমার পরিচয় ছিল। তিনি আমাকে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া সেখানে যাইতে দেখিয়া কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমিও সকল কথা ব্যক্ত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে দিন রাত্রে মঙ্গলা এখানে আসিয়াছিল কি?” 

ষ্টেসন মাষ্টার কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ—রাত্রি প্রায় দ্বিপ্রহরের পর মঙ্গলা তাড়াতাড়ি ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন এখানকার শেষ গাড়ি প্লাটফরমে আসিয়াছিল। মঙ্গলা নৈহাটীর টিকিট চাহিল। কিন্তু সে সময় টিকিট আনিতে হইলে গাড়ি চলিয়া যায় দেখিয়া বিনা টিকিটেই তাহাকে গাড়িতে তুলিয়া দিলাম এবং সত্বর একখানি পত্র লিখিয়া তাহার হাতে দিলাম এবং উহা নৈহাটীর ষ্টেসন মাষ্টারকে দিতে বলিলাম। তাহার পর কি হইয়াছে বলিতে পারি না। মঙ্গলা নৈহাটী হইতে এখনও ফিরে নাই কেন জানি না।” 

ষ্টেসন মাষ্টারের কথা শুনিয়া আমি নৈহাটী যাইতে মনস্থ করিলাম এবং পুনরায় ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া পরবর্তী গাড়িতে উঠিয়া নৈহাটী যাত্রা করিলাম। 

বেলা এগারটার সময় নৈহাটী উপস্থিত হইলাম। ষ্টেসন মাষ্টারের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, সে রাত্রে শিয়ালদহ হইতে যে শেষ গাড়ি আসিয়াছিল, তাহাতে মঙ্গলা নামে কোন রমণী ছিল কি না?” 

আমার কথা শুনিয়া ষ্টেসন মাষ্টার হাসিয়া উঠিলেন। পরে বলিলেন “কত শত মঙ্গলা আসিয়াছে, কাহার কথা বলিব?” 

আমি তাঁহার কথায় বিরক্ত অথচ অপ্রতিভ হইলাম। বলিলাম “দম্দমার ষ্টেসন মাষ্টারের পত্র লইয়া কোন রমণী বিনা টিকিটে সে রাত্রের শেষ গাড়িতে কি এখানে আসিয়াছিল?” 

আমার কথায় স্টেসন মাষ্টারের মুখের হাসি মুখেই মিলাইয়া গেল। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তার পর বলিলেন “আজ্ঞে হাঁ—আসিয়াছিল বটে কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ যেমন ষ্টেসন হইতে দ্রুতপদে প্রস্থান করিবে, অমনই পড়িয়া গেল এবং সাংঘাতিকরূপে আহত হইল। বেচারা এখানকার হাসপাতালে রহিয়াছে। আজ একটু ভাল আছে শুনিয়াছি।” 

আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া আমি তখনই তথা হইতে বাহির হইলাম, এবং কিছুক্ষণ পরে হাসপাতালে গমন করিলাম। আমি ডাক্তারের ছদ্মবেশে ছিলাম, সকলেই আমাকে ডাক্তার মনে করিয়াছিল; সুতরাং কেহই কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। আমি অনায়াসে মঙ্গলার সন্ধান পাইলাম এবং যে ডাক্তার তাহাকে দেখিতেছিলেন, তাঁহার সহিত সদ্ভাব করিয়া মঙ্গলার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। 

কিছুক্ষণ পরীক্ষা করিয়া হাসপাতালের ডাক্তার ঔষধ ও পথ্য ব্যবস্থা করিয়া চলিয়া গেলেন। আমি একটা অছিলা করিয়া মঙ্গলার ঘরে রহিলাম। 

সরকারী ডাক্তার প্রস্থান করিলে পর, আমি মঙ্গলাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “এখন কেমন আছ মঙ্গলা?” 

আমার মুখে তাহার নাম শুনিয়া মঙ্গলা যেন চমকিত হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কে? আপনাকে ত চিনিতে পারিতেছি না। আপনি আমার নাম জানিলেন কিরূপে?” 

আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম “আমি তোমার মনিব-বাড়ী হইতে আসিতেছি। তাঁহারা যে তোমার সংবাদ না পাইয়া বড় ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছেন। তুমি না বলিয়া এখানে আসিলে কেন?” 

আমার কথায় মঙ্গলার ভয়ানক ক্রোধ হইল। সে রাগে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিল “সেই দুর্বৃত্ত দস্যুই ত সকল অনিষ্টের মূল। কে জানে সে জেলের ফেরৎ। 

আ। সত্য না কি? অহীন্দ্রনাথ তবে সহজ লোক নন? 

ম। সহজ লোক! ডাকাত, খুনে! গাড়ি হইতে যেরূপে লম্ফ দিয়া পড়িল তাহাতে আমি ভাবিয়াছিলাম, মরিয়া যাইবে, কিন্তু মরিল না, তখনই উঠিয়া একখানি ভাড়াটিয়া গাড়িতে আরোহণ করিল। পরে কোচম্যানকে বলিল, পনর নম্বর সাতকড়ি দত্তের গলি। আমিও তখনই আর একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ি দেখিলাম। কিন্তু যেমন দৌড়িয়া তাহাতে আরোহণ করিতে যাইব, অমনই হোঁচট খাইয়া পড়িয়া গেলাম, এবং ভয়ানকরূপে আহত হইলাম। 

আ। তুমি নৈহাটীতে আসিলে কেন? অহীন্দ্রবাবু এখানে আসিয়াছে বলিয়াই কি তুমি আসিয়াছ? 

ম। সেও একটা কারণ বটে, কিন্তু ইহা ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। 

আ। কি? 

ম। নগেন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিতে। 

আ। তিনি ত একটি দিন মাত্র বাড়ীতে ছিলেন। 

ম। সত্য, কিন্তু সেই একদিনেই আমার মনিব-বাড়ীর অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। 

আ। কি? 

ম। কর্তাবাবুর শালী না কি তাহাকে বিবাহ করিতে ইচ্ছা করেন। কর্তাবাবুও সম্মত হইয়াছিলেন। 

আমি স্তম্ভিত হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি ত বিধবা –বিধবা হইলে কি হিন্দু মহিলার আর বিবাহ হয়?” 

মঙ্গলা ঈষৎ হাসিয়া বলিল “কি এক নূতন মতে না কি বিবাহ হইতে পারে? আমি তাঁহাদের কথা ভাল বুঝিতে পারি নাই। তবে বিবাহ করিবার পরামর্শ শুনিয়াছিলাম।” 

আ। তাহাতেই বা তোমার ক্ষতিবৃদ্ধি কি? 

ম। বলেন কি? যাহা শুনিয়াছি, তাহাতে তাহাকেও জেলের আসামী বলিয়া বোধ হয়। 

আমি হাসিয়া উঠিলাম, বলিলাম “তাহা হইলে তোমাদের গৃহিণী তাহাকে বাড়ীতে আনিবেন কেন? বিশেষত, আমি শুনিয়াছি, তিনি না কি গিন্নীর দূর-সম্পৰ্কীয় ভগিনী। 

মঙ্গলা কিছুক্ষণ কোন কথা কহিল না। পরে কি ভাবিয়া বলিল “আগে সেই কথাই বিশ্বাস করিতাম, কিন্তু এখন বুঝিতেছি, সে সমস্তই মিথ্যা। আমি প্রথম হইতেই তাহার উপর সন্দেহ করিয়াছিলাম, কিন্তু কাহাকেও কোন কথা বলিতে সাহস করি নাই। এখন দেখিতেছি, আমার ধারণাই সত্য হইল।” 

আমি বলিলাম “তোমার মতে তাহা হইলে অহীন্দ্রনাথ ও বাবুর শালী উভয়েই জেলের আসামী। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে বড় ভয়ানক ব্যাপার দেখিতেছি।” 

মঙ্গলা কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিল। পরে জিজ্ঞাসা করিল “আপনি কি আমার মনিব-বাড়ী হইতেই আসিতেছেন?” আ। হাঁ—কিন্তু তাহা হইলেও আমি তোমার মাসীর সংবাদ জানি, আর যে রমণীকে উদ্ধার করিয়া তাহার বাড়ীতে রাখিয়া আসিয়াছ, তাহাও জানি। রমণী এখন অনেকটা সুস্থ হইয়াছে। সে শতমুখে তোমার প্রশংসা করিতেছে। 

ম। আমার একটি অনুরোধ আছে। 

আ। কি বল? তাহাকে কিছু বলিতে হইবে? 

ম। আজ্ঞে না, আপনি সেই ডাকাতকে গ্রেপ্তার করিতে চেষ্টা করুন। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, সে এখনও ওই ঠিকানায় আছে। 

আ। যাহাতে তোমার মনোভিলাষ পূর্ণ হয়, তাহার চেষ্টা এখনই করিব। আর কিছু কার্য্য আছে? 

ম। আজ্ঞে না। কেবল মাসীকে বলিবেন, আমি আরোগ্য হইলেই তাঁহার সহিত দেখা করিব। 

এই কথা শুনিয়া আমি আর বিলম্ব করিলাম না। হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া সম্মুখেই একখানি ভাড়াটীয়া গাড়ি দেখিতে পাইলাম এবং তখনই তাহাতে আরোহণ করিয়া কোচম্যানকে সাতকড়ি দত্তের গলিতে যাইতে আদেশ করিলাম। 

পনর নম্বর বাড়ীতে আসিয়া দেখিলাম, সেটা একটা বাসাবাড়ী। প্রায় দশ বারজন লোক তথায় বাস করিতেছেন। একজন স্থূলকায় কৃষ্ণবর্ণ ব্রাহ্মণ সে বাসার স্বত্বাধিকারী 

বাসায় আসিবামাত্র সেই ব্রাহ্মণ আমার সহিত দেখা করিল। আমি তাহাকে অহীন্দ্রনাথের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। আমার কথা শুনিয়া সে কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিল। পরে বলিল, “আজ্ঞে হাঁ—ওই নামের একজন ভদ্রলোক সেদিন রাত্রি প্রায় দুইটার সময় বাসায় আসিয়াছিলেন। বোধ হয় তিনি এখনও আছেন।” 

আমি উত্তর করিলাম “যদি একবার তাহার সহিত সাক্ষাৎ করাইয়া দেন, বড় উপকার হয়। আমি বহুদূর হইতে এখানে আসিয়াছি।” 

ব্রাহ্মণ উত্তর করিল “আপনি ভিতরে গিয়া অন্বেষণ করুন। আমার কোন আপত্তি নাই।” 

অহীন্দ্রনাথকে আমি পূর্ব্বে আর কখনও দেখি নাই, সুতরাং একা যাইলে তাহাকে চিনিতে পারিব না স্থির করিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। পরে সেই ব্রাহ্মণকে অনেক অনুরোধ করিয়া আমার সঙ্গে লইলাম। তিনি অগ্রে অগ্রে ভিতরে প্রবেশ করিলেন, আমি অনুসরণ করিলাম। 

দশম পরিচ্ছেদ 

ব্রাহ্মণ দূর হইতে অহীন্দ্রনাথের ঘরটি প্রদর্শন করিয়া ফিরিয়া গেল। আমি সেই ঘরের দ্বারের নিকট গিয়া কৌশলে অহীন্দ্রনাথকে ভাল করিয়া দেখিয়া লইলাম। দেখিলাম, তাঁহার বয়স প্রায় ত্রিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে বেশ সুপুরুষ, তাঁহার দেহ দীর্ঘ, বক্ষ উন্নত, চক্ষু আয়ত, হস্তপদ সুগোল ও বলিষ্ঠ। দূর হইতে তাঁহাকে দুৰ্দ্দান্ত দস্যু বলিয়া বোধ হইল না। কিন্তু তাহা হইলেও আমি একা এবং বিনা অস্ত্রে তাহার সম্মুখীন হইতে সাহস করিলাম না। 

সামান্য অছিলা করিয়া আমি ব্রাহ্মণের নিকট বিদায় লইলাম এবং তখনই স্থানীয় থানায় গিয়া দারোগাবাবুকে সকল কথা খুলিয়া বলিলাম এবং অহীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করিবার জন্য তাঁহাকে সাহায্য করিতে অনুরোধ করিলাম। তিনি অবিলম্বে আমার সাহায্যার্থে কনেষ্টবলকে পাঠাইয়া দিলেন। 

দুইজন কনেষ্টবল লইয়া আমি সেই বাসায় আগমন করিলাম এবং তাহার স্বত্বাধিকারী সেই ব্রাহ্মণকে কোন নিভৃতস্থানে ডাকিয়া বলিলাম “অহীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করিবার প্রয়োজন হইয়াছে ও আমি তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতেছি। যদি গোলযোগ করেন, আপনারই অনিষ্টের সম্ভাবনা।” 

ব্রাহ্মণ চমকিত হইলেন। তিনি বলিলেন, “কি সৰ্ব্বনাশ! এ আপদ আবার কোথা হইতে আসিল? এখান হইতে গ্রেপ্তার করিলে আর কোন লোক ভয়ে এ বাসায় আসিবে না।” 

আ। আমি সেই জন্যই আপনাকে গোপনে এই সকল কথা বলিতে আসিয়াছি। আপনার বাসাবাড়ীর আর কোন পথ আছে? 

ব্রা। আজ্ঞে আছে। পশ্চাতে একটি খিড়কী দ্বার আছে। 

আ। ভালই হইয়াছে। আমরা অহীন্দ্রনাথকে সেই পথ দিয়া বাহিরকরিয়া লইয়া যাইব। তাহা হইলে আপনার বাসার আর কোন লোক এই ব্যাপার জানিতে পারিবে না। 

ব্রাহ্মণ সম্মত হইল। আমি তখন কনেষ্টবলকে সেই পথে অপেক্ষা করিতে বলিয়া স্বয়ং পুনরায় অহীন্দ্রনাথের গৃহদ্বারে উপনীত হইলাম এবং অতি সন্তর্পণে তাঁহার গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। 

ঘরখানি অতি ক্ষুদ্র, ভিতরে একটি জানালা ও একটি দরজা ছিল। আসবাবের মধ্যে একখানা ছোট তক্তাপোষ, তাহার উপরে একখানি সতরঞ্চ। সতরঞ্চের উপর একটিমাত্র বালিস। অহীন্দ্রনাথ সেই শয্যার উপর বসিয়া একখানি পুস্তক পাঠ করিতেছিলেন, এমন সময়ে আমি প্রবেশ করিলাম। 

অহীন্দ্রনাথ এত মনোযোগের সহিত পাঠ করিতেছিলেন যে, আমার পদশব্দ শুনিয়াই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “কেও, ঠাকুর মহাশয়! এখন এখানে কি প্রয়োজন?” 

এই বলিয়া তিনি আমার দিকে ফিরিলেন এবং বাসার স্বত্বাধিকারীকে না দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি কে? কি জন্যই বা এখানে আগমন করিয়াছেন?” 

কোন উত্তর না করিয়াই আমি একবারে তাঁহাকে হঠাৎ আক্রমণ করিলাম এবং এরূপে গ্রেপ্তার করিলাম যে, তিনি নড়িতেও পারিলেন না। ইত্যবসরে অপর দুইজন কনেষ্টবল খিড়কী দ্বার দিয়া তথায় আসিয়া উপস্থিত হইল এবং আমার সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া বন্দীর পোষাক ভাল করিয়া অন্বেষণ করিল। কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় যে, কোনপ্রকার অস্ত্র তাঁহার নিকটে পাওয়া গেল না। 

এতক্ষণ অহীন্দ্রনাথ কোন কথা বলেন নাই। কিন্তু যখন তাঁহাকে উত্তমরূপে বন্ধন করা হইল, তখন তিনি অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি জন্য আমায় গ্রেপ্তার করিলেন? আপনি কে?” 

আ। আমি একজন পুলিস-কৰ্ম্মচারী, কাশীপুরে রাধামাধববাবুকে খুন করিয়া পলায়ন করিয়াছেন, তাহা কি আপনার মনে নাই? 

অ। কে দেখিয়াছে? 

এই বলিয়া তিনি যেন আপনা আপনিই বলিতে লাগিলেন “কেহ নিশ্চয়ই দেখিয়াছে। তাহা না হইলে ইনি একেবারে এখানে আসিবেন কেন?” 

অহীন্দ্রনাথের প্রথম প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কে দেখিয়াছে, আপনি কি জানেন না?” 

অ। আমি যখন ছোরা মারিয়াছিলাম, তখন ত কাহাকেও নিকটে দেখি নাই। কিন্তু আমার নজরে না পড়িলেও কোন লোক গোপনে লুকাইয়াছিল, তাহা আপনাদের কার্য্য দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইতেছে। 

আ। আপনার বিরুদ্ধে আরও অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। রক্তাক্ত ছোরাখানিও পাওয়া গিয়াছে। 

অ। আমিও তাহাই মনে করিয়াছিলাম। যখন দেখিলাম, ছোরাখানি নাই, তখনই ভাবিয়াছিলাম, পুলিসের লোক সেই সূত্র ধরিয়া এখানে আসিবে। 

আ। নিশ্চয়ই—তাহা ছাড়া পুলিসের লোক দাগী লোককেই আগে সন্দেহ করে। 

চমকিত হইয়া অহীন্দ্র জিজ্ঞাসা করিলেন “দাগী লোক কি?” 

ঈষৎ হাসিয়া আমি উত্তর করিলাম “দাগী কি না আপনি সে কথা ভালই জানেন। এখন আর আপনার কোন কথা লুকাইবার প্রয়োজন নাই। আপনার সকল বিদ্যারই পরিচয় পাইয়াছি।” 

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া অহীন্দ্রনাথ বলিয়া উঠিলেন, “বুঝিয়াছি, এ সেই কটা চক্ষুর কাজ। তিনি আমারই পরিচয় দিয়াছেন বটে কিন্তু নিজে কি ছিলেন তাহা বলিয়াছেন কি? মনে করিবেন না, তিনি সত্য সত্যই রাধামাধববাবুর শ্যালিকা। আমি যতদূর জানিতে পারিয়াছি, তাহাতে তাঁহার সহিত রাধামাধবাবুর কিম্বা তাঁহার স্ত্রীর কোন সম্বন্ধই নাই।” 

অহীন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া আমি প্রথমে কিছুটা বুঝিতে পারিলাম না। আমি ভাবিয়াছিলাম, তিনি যে রমণীকে হত্যা করিতে মনস্থ করিয়া খালে ফেলিয়া দিয়াছিলেন, সেই রমণীর উপরই দোষারোপ করিবেন। কিন্তু তাহা না করিয়া যখন কটা চক্ষু রমণীর নামে অভিযোগ করিলেন, তখন আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। 

যে রমণী রাধামাধববাবুর শ্যালিকা বলিয়া পরিচয় দিয়া তাহাদের বাড়ীতে বাস করিতেছেন “তাঁহাকে দেখিলে ভদ্র ঘরের মহিলা বলিয়াই বোধ হয়। কিন্তু অহীন্দ্রনাথের শেষ কথাগুলি শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, এ জগতে বাহ্যিক অবস্থা দেখিয়া কোন লোকের চরিত্র অবগত হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব। 

অহীন্দ্রনাথের কথায় কোন উত্তর করিলাম না দেখিয়া তিনি পুনরায় বলিলেন “অনেকদিন গত হইল, ওই রমণী আমার আশ্রিতা ছিল। উহার তৎকালীন নাম কুসুম, বয়স আঠার বৎসর। এখনকার আকৃতি দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারা যায়, কুসুম সে বয়সে কেমন ছিল। আমরা স্ত্রী পুরুষের মত বাস করিতেছিলাম। এইরূপে দিন কাটিতে লাগিল। কিছুদিন পরে আমাদের অর্থের অভাব হইতে লাগিল। কুসুম তখন নূতন উপায় উদ্ভাবন করিল। লোভ দেখাইয়া অপর পুরুষকে বাড়ীতে আনিতে লাগিল; এবং কিছুক্ষণ আমোদ-আহ্লাদ করিয়া অহিফেন মিশ্রিত মদ্যপান করিতে দিত। পরে সে হতচেতন হইয়া পড়িলে, তাহার নিকট হইতে সমস্ত দ্রব্য কাড়িয়া লইত। এইরূপে কিছুদিন অতীত হইলে পুলিসের লোকে আমাদের উভয়ের উপর সন্দেহ করিল এবং তিন চারি মাস পরে আমাদিগকে গ্রেপ্তার করিল। বিচারে আমার পাঁচ বৎসর, কুসুমের তিন বৎসর জেল হইল। জেলে গিয়াও কুসুম নিশ্চিন্ত ছিল না। কারাধ্যক্ষকে বশীভূত করিয়া একবৎসর পরে কুসুম পলায়ন করিল এবং তাহারই কৌশলে পরবৎসর আমিও পলায়ন করিলাম। কিন্তু কুসুমের কোন সন্ধান পাইলাম না। অনেক অনুসন্ধানের পর জানিতে পারিলাম, কুসুম রাধামাধববাবুর স্ত্রীর সহিত আলাপ করিয়া তাঁহারই ভগ্নীরূপে সেখানে বাস করিতেছে। এই সংবাদ শুনিয়া আমি রাধামাধববাবুর বাড়ীর খোঁজ করিতে লাগিলাম। কিছুদিন পরে শুনিলাম, রাধামাধববাবুর স্ত্রী মারা পড়িয়াছেন। কুসুম কৰ্ত্তাকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়াছে। এমন কি, ব্রাহ্মমতে বিবাহ করিবার অভিলাষ প্রকাশ করিয়াছে। কুসুম প্রথমে আমায় যেন চিনিতেই পারে নাই। অবশেষে একদিন গোপনে লইয়া গিয়া সকল কথা ব্যক্ত করিলাম। সেই দিন হইতে আমি কুসুমের বিষ-নয়নে পতিত হইলাম। 

অহীন্দ্রনাথের মুখে এই সকল কথা শুনিয়া আমার চক্ষু ফুটিল। আমি কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ পরে অহীন্দ্রনাথের দিকে চাহিয়া বলিলাম “এখন আপনাকে জেলে যাইতে হইবে। ভবিষ্যতে নির্দোষী প্রমাণিত হইলে মুক্তি লাভ করিবেন। রক্তাক্ত ছোরাখানিতে সত্যেন্দ্রনাথের নাম লেখা থাকিলেও শুনিয়াছি, সেখানি আপনাকে ব্যবহার করিতে দিয়াছিলেন। যদি তাহা সত্য হয়, তাহা হইলে আপনিই রাধামাধববাবুকে হত্যা করিয়াছেন। 

এই বলিয়া আমি কনেষ্টবলদ্বয়কে ইঙ্গিত করিলাম। তাহারা অহীন্দ্রনাথের হস্ত ধরিয়া নীরবে খিড়কী ধারে আসিল। বাসার অধ্যক্ষ পূর্ব্বে একখানি গাড়ি ভাড়া করিয়া রাখিয়াছিলেন। আমরা সকলেই গাড়িতে উঠিলাম এবং স্থানীয় থানায় গমন করিলাম। পরে সেখানকার কার্য্য শেষ করিয়া অহীন্দ্রনাথকে লইয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। 

একাদশ পরিচ্ছেদ 

যখন আসামীকে লইয়া কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্রনাথকে হাজতে পাঠাইয়া আমি থানায় প্রত্যাগমন করিলাম। প্রাতঃকাল হইতে কঠোর পরিশ্রম করিয়া আমি এত ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম যে, সে রাত্রে আর কোন কার্য্য করিতে পারিলাম না। আহারাদি সমাপন করিয়া বিশ্রাম করিতে নিযুক্ত হইলাম। 

পরদিন প্রাতঃকালে অহীন্দ্রনাথের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। তিনি আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “এখনও আপনি আমায় দোষী মনে করেন? আমি রাধামাধববাবুকে হত্যা করি নাই।” 

অহীন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া আমি হাসিয়া উঠিলাম; কোন কথা কহিলাম না। কিছুক্ষণ পরে গম্ভীর ভাবে বলিলাম “রাধামাধববাবুকে হত্যা করিবার অপরাধে আরও একজন লোক গ্রেপ্তার হইয়াছে। আমি তাঁহার বন্ধু বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। আমি বেশ জানি, তিনি সম্পূর্ণ নিদোষী, কেবল দুর্ভাগ্য বশতঃ তাঁহাকে এই নিগ্রহ ভোগ করিতে হইতেছে। আমি তাঁহার নির্দোষিতা প্রমাণ করিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিব।” 

অহীন্দ্রনাথ বলিলেন “বেশ কথা। আপনি যখন একজনের জন্য এত করিবেন, তখন আমার জন্য যেন সামান্যমাত্র চেষ্টা করেন এই আমার অনুরোধ।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম, “তিনি প্রকৃত নিদোষী।” 

অ। আমিও ঈশ্বরের শপথ করিয়া বলিতেছি-আমি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপরাধী। 

আ। ছোরাখানি সত্যেন্দ্রনাথ আপনাকে দিয়াছিলেন কি? 

অ। আজ্ঞে হাঁ, মিথ্যা বলিব না। 

আ। সেই ছোরারই আঘাতে রাধামাধববাবু আহত হইয়াছেন। সরকারী ডাক্তারে ইহা পরীক্ষা করিয়াছেন। অ। আশ্চৰ্য্য নহে, ছোরাখানি আমি পথে কোথাও ফেলিয়া দিয়াছিলাম। 

আ। তবে কি হত্যাকারীই সেখানি কুড়াইয়া পাইয়াছিল বলিতে চান? 

অ। আজ্ঞে হাঁ, তাহা না হইলে কেমন করিয়া সেই ছোরার আঘাতে তিনি মারা পড়িলেন! 

অ। সত্যেন্দ্রনাথের হাতেই ছোরাখানি পাওয়া গিয়াছিল। 

আ। তবে ত তাঁহাকেই লোকে দোষী বলিবে। 

আমি কোন উত্তর করিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি যদি সত্য সত্যই নির্দোষী হন, তাহা হইলে সে রাত্রে পলায়ন করিলেন কেন?” 

অহীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ কোন কথা কহিলেন না। গম্ভীর ভাবে কি চিন্তা করিতে লাগিলেন। পরে অতি মৃদু ভাবে বলিলেন “যদি আমার কথা আর কাহারও নিকট ব্যক্ত না করেন, তাহা হইলে সকল কথাই বলিতে সম্মত আছি।” আমি বলিলাম -”আমিও প্রতিজ্ঞা করিতেছি, আপনার কথা শুনিয়া আমিও কোনরূপে আপনার অনিষ্ট করিব না। কিন্তু যদি সে কথায় সত্যেন্দ্রনাথের নির্দোষীতা প্রমাণ করিবার সুবিধা ঘটে, তাহা হইলে উহা ব্যক্ত করিতে বাধ্য হইব।” 

অহীন্দ্রনাথ সম্মত হইলেন। তিনি বলিলেন “রাত্রি এগারটার সময় আমি রাধামাধববাবুর বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া খালের ধারে গমন করি।” 

বাধা দিয়া আমি বলিলাম, “ও সকল কথা আমার জানা আছে।” 

অহীন্দ্রনাথ প্রথমে আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। পরে কি ভাবিয়া ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিলেন “বুঝিয়াছি, সেই দাসীই আপনাকে এ সকল কথা বলিয়াছে।” 

আমি সে কথার উত্তর না দিয়া বলিলাম, “যে রমণীকে আপনি ছোরার আঘাত করিয়া খালে ফেলিয়া দিয়াছিলেন, তাহারই মুখে সকল কথা শুনিয়াছি। আপনি তাহাকে হত্যা করিতে চেষ্টা করিলেও ঈশ্বরের ইচ্ছায় সে এখনও জীবিত এবং শীঘ্রই সুস্থ হইয়া উঠিবে।” 

অহীন্দ্রনাথ আমার মুখের দিকে নির্নিমেষ নয়নে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার মুখের ভাব দেখিয়া আমি স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিতেছেন না। আমি তাঁহার মনোগত ভাব বুঝিতে পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি অমন করিয়া চাহিয়া রহিলেন কেন, আমার কথায় বিশ্বাস হইতেছে না? আমি এখনও বলিতেছি, সেই বালিকা মারা পড়ে নাই। সে জীবিত আছে।” 

আমার কথায় অহীন্দ্রনাথ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন “আপনি জানেন না, আপনার কথায় আমার আন্তরিক অবস্থার কত পরিবর্ত্তন হইল। সে জীবিতা আছে শুনিয়া আমি যে কত আনন্দিত হইয়াছি, তাহা মুখে বলিতে পারা যায় না। কেন পলায়ন করিয়াছিলাম এখন বুঝিতে পারিলেন? আমি ভাবিয়াছিলাম, বুঝি আমার ছোরার আঘাতে সে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে।” 

আমার পূর্ব্ব অনুমান সম্পূর্ণ সত্য হইল দেখিয়া আমি আন্তরিক আনন্দিত হইলাম। কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “রমণীকে আঘাত করিয়া যখন রাধামাধবাবুর বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলেন, তখন তিনি জীবিত ছিলেন কি না?” 

অহীন্দ্রনাথ বলিলেন “ফটক পার হইয়া যখন বাগানে আসিলাম, তখন আমার বোধ হইল, যেন কে আমার পিছু লইয়াছে। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিলাম কিন্তু পথে পড়িয়া গেলাম; সেই সময়ে ছোরাখানি কোথায় হারাইয়া গেল। যখন আমি ঘরে গিয়া উপস্থিত হই, তখন সহসা যেন কিসের গোলযোগ আমার কর্ণ গোচর হইল। উপরে যেন কোন লোক বেগে যাতায়াত করিতেছিল, কে যেন কথা কহিতেছিল। আমার ভয় হইল। এখন আমি সমস্তই বুঝিতে পারিতেছি, আমার বোধ হয়, তখন তাহারা রাধামাধববাবুকে আহত অবস্থায় দেখিয়া ওই প্রকার করিতেছিল; তখন ত এ কথা জানিতাম না। আমি দাগী, আমার ভয় হইল। তাহার পর বিছানার চাদর দুইখানির সাহায্যে জানালা দিয়া ঘরের বাহির হইলাম।” 

অহীন্দ্রনাথের কথাগুলি সত্য বলিয়া বোধ হইল। আমিও পূর্ব্বে ওই প্রকারই অনুমান করিয়াছিলাম। কিন্তু অদ্য কতকগুলি কারণবশত তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। প্রথমতঃ তাঁহারই ছোরায় রাধামাধববাবুর মৃত্যু হইয়াছে; দ্বিতীয়তঃ, তিনি যেরূপ অদ্ভুত উপায়ে বাড়ী হইতে পলায়ন করিয়াছিলেন, তাহা বড়ই সন্দেহজনক। বিশেষতঃ, যখন তিনি হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে সেই রমণীকে ছোরার আঘাত করিয়াছিলেন, তখন তাঁহাকে গ্রেপ্তার করা নিতান্ত অন্যায় হয় নাই; এবং যতদিন না বিচার শেষ হয়, ততকাল তাঁহাকে মুক্ত করা অসম্ভব। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি যেমন সেখান হইতে বিদায় লইব, সেই সময় অহীন্দ্রনাথ আমার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমি যখন এ বিষয়ে নিদোষী, তখন আমায় কেন মুক্তি দিলেন না? আপনি যে অন্যায় সন্দেহ করিয়া আমায় গ্রেপ্তার করিয়াছেন, তাহা ত এখন বেশ বুঝিতে পারিলেন।” 

আমি গভীর ভাবে বলিলাম “মুক্তির কথা ছাড়িয়া দিন। রাধামাধববাবুর হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত না থাকিলেও আপনি যখন সেই রমণীকে হত্যা করিবার অভিপ্রায়ে ছোরা মারিয়াছিলেন, তখন আমি কেমন করিয়া আপনার মুক্তির বিষয় প্রতিশ্রুত হইব।” 

আমার কথায় অহীন্দ্রনাথ একেবারে হতাশ হইয়া পড়িলেন; কিছুক্ষণ তাঁহার মুখ দিয়া কোন কথা বাহির হইল না। পরে অতি মৃদুস্বরে বলিলেন “আপনি ত সে কথা আর কাহারও নিকট ব্যক্ত করিবেন না, অঙ্গীকার করিলেন। তবে আপনারা পুলিসের লোক, আপনাদের কথায় বিশ্বাস করা মূর্খের কার্য্য।” 

ঈষৎ হাসিয়া আমি বলিলাম “পুলিসের লোক বলিয়া কি আমাদের কথার ঠিক নাই? যে কথা বলিয়াছি, তাহার আর অন্যথা হইবে না। আমার দ্বারা আপনার কোন অপকার হইবার সম্ভাবনা নাই। কিন্তু যতদিন না রাধামাধববাবুর প্রকৃত হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিতে পারিতেছি, ততদিন আপনি মুক্তি পাইবেন না। কেন না, তাহা হইলে অপর বন্দী সত্যেন্দ্রনাথও মুক্তি পাইতে পারেন। আমি জানি, তিনি সম্পূর্ণ নিৰ্দ্দোষী।” হাসিয়া অহীন্দ্রনাথ বলিলেন “যদি তাঁহার নিদোষীতা সম্বন্ধে আপনি দৃঢ়নিশ্চয় হইয়া থাকেন, তবে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিলেন কেন?” 

আমি বলিলাম “সে সময় আমি উপস্থিত থাকিলে এ কাৰ্য্য হইত না। স্থানীয় থানার দারোগোবাবু তাঁহাকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া গ্রেপ্তার করিয়াছেন। যতক্ষণ না তিনি মুক্ত হন, ততক্ষণ আমি নিশ্চিত হইতে পারিব না। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ 

বেলা নয়টার সময় থানায় ফিরিয়া আসিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলাম। পরে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলাম। ভাবিলাম, তিনজনের উপর সন্দেহ করা যাইতে পারে। প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় অহীন্দ্রনাথ এবং তৃতীয় রাধামাধববাবুর শ্যালিকা। সত্যেন্দ্রনাথকে নির্দোষী বলিয়া আমার ধারণা হইয়াছিল। অহীন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া তাঁহাকেও এই ব্যাপারে নিরপরাধী বলিয়া বোধ হইতেছে। আর কর্ত্তার শ্যালিকা—তিনি যখন কর্তার মৃত্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছেন, তখন তাঁহার উপর সন্দেহ করা নিতান্ত অন্যায়। তবে দোষী কে? 

বাড়ীতে পুরুষ-মানুষের মধ্যে রাধামাধববাবুর দুই ভ্রাতুষ্পুত্র ও অহীন্দ্রনাথ। তিনজনের মধ্যে দুইজনকে নিদোষী বলিয়াই বোধ হয়। অপর ব্যক্তি নগেন্দ্রনাথ সে রাত্রে বাড়ীতেই ছিলেন না। সুতরাং তাহার উপর কোনরূপেই সন্দেহ করা যায় না। 

বাড়ীর দাস-দাসী সকল কর্তার এত বশীভূত যে তাহাদের দ্বারা এ কার্য্য কখনও সম্ভবে না। তবে কে রাধামাধববাবুকে হত্যা করিল? 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি গাত্রোত্থান করিলাম এবং একখানি ভাড়াটীয়া গাড়িতে আরোহণ করিয়া সত্বর রাধামাধববাবুর বাড়ীতে গমন করিলাম। 

যে গৃহে কৰ্ত্তাবাবু খুন হইয়াছিলেন, সেই ঘর হইতে তাঁহার মৃতদেহ বাহির করিবার পর ঘরটি তালা বন্ধ করিয়াছিলাম। পাছে আমার অজ্ঞাতসারে সে ঘরে আর কোন লোক প্রবেশ করে, এই ভয়ে ঘরের চাবিটা নিজের কাছেই রাখিয়াছিলাম। 

বাড়ীতে উপস্থিত হইবামাত্র হরিদাস নানা কথা জিজ্ঞাসা করিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমি তাহার একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিলাম না। হরিদাস অত্যন্ত দুঃখিত হইল বটে কিন্তু কোন কথা বলিতে সাহস করিল না। 

পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে, রাধামাধবাবুর ঘরের চাবি আমারই নিকটে ছিল। সেই চাবির সাহায্যে আমি ঘরটি খুলিয়া ফেলিলাম। হরিদাস আমার সঙ্গে প্রবেশ করিতেছিল, নিষেধ করিলাম; সে অপ্রতিভ হইয়া দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়া রহিল। 

গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া আমি ঘরের মেঝেটি তন্ন তন্ন করিয়া পরীক্ষা করিলাম। তখন সেখানে যাহা কিছুর নিদর্শন পাইলাম, সংগ্রহ করিলাম। 

কর্তার ঘর পরীক্ষা করিয়া বাড়ীর অপরাপর ঘরগুলিও উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। পরে হরিদাসের নিকট বিদায় লইয়া একবার রাধামাধববাবুর উকিলের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। সৌভাগ্য বশতঃ তাঁহার সহিত আমার বিশেষ আলাপ ছিল। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিলাম, রাধামাধবাবু নগেন্দ্রনাথকেই অত্যন্ত ভালবাসিতেন, তিনি যে শেষ উইল করিয়া গিয়াছেন, তাহাতে নগেন্দ্রনাথকে তাঁহার সমুদায় সম্পত্তির বার আনা এবং সত্যেন্দ্রনাথকে চারি আনা দিয়াছেন। আরও শুনিলাম, সত্যেন্দ্রনাথ অত্যন্ত অমিতব্যয়ী। তিনি ইতিমধ্যে অনেক টাকা কর্জ্জ করিয়াছেন। 

এই সকল সংবাদ শুনিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। আমার মনে এক নূতন সন্দেহ জন্মিল। কিছুক্ষণ পরে আমি উকীলবাবুর নিকট হইতে বিদায় লইলাম। 

থানায় ফিরিয়া আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। এতক্ষণ যাহা সন্দেহ করিয়াছিলাম, তাহাই সত্য বলিয়া ধারণা হইল। তখন আর বিলম্ব না করিয়া একজন কনেষ্টবলকে ডাকিলাম এবং একখানি পত্র লিখিয়া তাহার হস্তে প্রদান করতঃ পত্রখানি নগেন্দ্রনাথকে দিতে আদেশ করিলাম। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ 

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। প্রগাঢ় অন্ধকার ক্রমে ক্রমে সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করিতেছে। বিহঙ্গমকুল একে একে বাসায় ফিরিয়া গিয়াছে, কেবল পেচকাদি নিশাচর পক্ষীগণ অন্ধকার দেখিয়া মনের আনন্দে চারিদিকে আহার অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে। ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। কৃষ্ণপক্ষ, –চন্দ্র তখনও উদিত হয় নাই। ক্ষুদ্রপ্রাণ তারকারাজি চন্দ্রকে দেখিতে না পাইয়াই যেন আপন আপন রূপের জ্যোতিঃ প্রদর্শন করিতেছে। আমি একটি নিভৃত কক্ষে বসিয়া নগেন্দ্রনাথের অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। 

রাত্রি ঠিক আটটার সময় একজন কনেষ্টবল আসিয়া সংবাদ দিল, নগেন্দ্রনাথ আসিয়াছেন। আমি তাঁহাকে আমার নিকট আনিতে বলিয়া কনেষ্টবলকে বিদায় দিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই নগেন্দ্রনাথ সেই গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিলেন। আমি অতি সমাদরে তাঁহার অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে সম্মুখে বসিতে অনুরোধ করিলাম। নগেন্দ্রনাথ আমার অনুরোধ রক্ষা করিলে আমি উঠিয়া গৃহদ্বার ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিলাম। 

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলে পর আমি নগেন্দ্রনাথকে বলিলাম, “এতকাল পরে প্রকৃত হত্যকারীকে গ্রেপ্তার করিতে সমর্থ হইব।” 

নগেন্দ্রনাথ যেন প্রফুল্ল হইলেন। তিনি আমার মুখের দিকে চাহিয়া বলিলেন “মহাশয়, “তবে কি অহীন্দ্রনাথই প্রকৃত হত্যাকারী?” 

আ। আজ্ঞে না—তিনিও সম্পূর্ণ নিদোষী। 

ন। তবে দোষী কে? 

আ। সে কথা পরে বলিতেছি। অগ্রে কেমন করিয়া তাঁহাকে হত্যাকারী বলিয়া স্থির করিলাম তাহাই বলিতেছি। নগেন্দ্রনাথ ক্রমশই যেন মলিন হইতে লাগিলেন। আমার কথায় তিনি কোন উত্তর করিলেন না- আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “যখন আমি কর্তাবাবুর ঘরটি পরীক্ষা করি, তখন সেই ঘরের মেজের উপর লাল সুরকীর গুঁড়া দেখিতে পাই। আমি সেই সুরকীর গুঁড়াগুলি তুলিয়া লই। আপনি জানেন, আমি অহীন্দ্রনাথকেই দোষী বলিয়া মনে করিয়াছিলাম; কিন্তু যখন তাঁহার গৃহ পরীক্ষা করি, তখন সে ঘরের মেজেয় ওই প্রকার লাল গুঁড়া দেখিতে পাই নাই। তখন আমার চৈতন্য হইল, ভাবিলাম, কর্তার ঘরে ওই গুঁড়া কেমন করিয়া আসিল! আমি ভাবিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে বুঝিলাম, যে ব্যক্তি ওই গুঁড়া ঘরে আনিয়াছে, সেই প্রকৃত হত্যাকারী। তাহার পর সমস্ত ঘরগুলিই পরীক্ষা করিলাম এবং কোথা হইতে কেমন করিয়া ওই লাল গুঁড়া কর্তার ঘরে গেল, তাহাও জানিতে পারিলাম।” 

আমার কথায় নগেন্দ্রনাথ আরও মলিন হইয়া পড়িলেন। কিন্তু কোন কথার উত্তর করিলেন না দেখিয়া পুনরায় বলিলাম “কর্তাবাবুর শেষ উইল দেখিয়া জানিতে পারি যে, তাঁহার মৃত্যুর পর আপনিই সমস্ত বিষয়ের বার আনা পাইবেন। আরও অনুসন্ধান করিয়া বুঝিলাম, ইতিমধ্যেই আপনি দেনদার হইয়া পড়িয়াছেন। আপনার অনেক টাকা দেনা দাঁড়াইয়াছে, এবং পাওনাদারেরা টাকার জন্য আপনাকে বিরক্ত করিতেছে। এই সকল সংবাদ জানিতে পারিয়া আপনার উপরেই আমার সন্দেহ হইল। কিন্তু তখনই মনে হইল, আপনি সে রাত্রে বাড়ীতেই ছিলেন না. আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম।” 

আমার শেষ কথা শুনিয়া নগেন্দ্রনাথ দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তাঁহার মুখ যেন প্রফুল্ল হইল। কিন্তু তিনি কোন কথাই বলিলেন না। 

তাঁহাকে নীরব দেখিয়া আমি পুনরায় বলিলাম “আপনি সে দিন বেলা দুইটার সময় নৈহাটী যাইবার নাম করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিলেন বটে কিন্তু তখন নৈহাটী যান নাই-দিবাভাগ কোথাও অতিবাহিত করিয়া অনেক রাত্রে পুনরায় ওই বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়াছিলেন এবং কোন নিভৃতস্থানে লুকাইয়া সুযোগ অন্বেষণ করিতেছিলেন।” এই কথা শেষ হইতে না হইতে নগেন্দ্রনাথ সহসা দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং যেমন দ্বারের দিকে গমন করিবেন, অমনিই পড়িয়া গেলেন। আমি তখনই তাঁহাকে ধরিয়া ফেলিলাম বটে, কিন্তু তিনি তখন হতচেতন হইয়া পড়িয়াছিলেন। 

কিছুক্ষণ পরেই নগেন্দ্রনাথের জ্ঞান সঞ্চার হইল। তিনি অতি কোমলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন “আপনি মানুষ না দেবতা? যে কৌশল অবলম্বন করিয়া আমি এ কার্য্য শেষ করিয়াছি, তাহা সহজে কেহ ব্যর্থ করিতে পারিবে না ইহাই আমার ধারণা ছিল। আর আপনাকে কোন কথা বলিতে হইবে না। আমি সমস্তই বুঝিয়াছি। যখন ঈশ্বর বাদী হন, তখন মানুষে কিছুতেই রক্ষা করিতে পারে না। অহীন্দ্রনাথ যখন সেই রাত্রে দ্রুতবেগে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলেন, তখন তিনি পড়িয়া যান। সৌভাগ্য বশতঃ সেইখানে তাঁহার ছোরাখানি পড়িয়া যায়। আমার হাতে অস্ত্র ছিল না, কি উপায়ে কার্য্যসিদ্ধ করিব তাহাই ভাবিতেছিলাম। ভগবান সে উপায় দেখাইয়া দিলেন। আমি তখনই সেই ছোরা তুলিয়া লইলাম এবং কার্য্য শেষ করিয়া সকলের অগোচরে বাড়ী হইতে বহির্গত হইলাম। পরে একেবারে গঙ্গাতীরে গমন করিয়া নৌকারোহণে নৈহাটী যাত্রা করিলাম।” 

এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ নিস্তব্ধ হইলেন। তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা নির্গত হইতে লাগিল, তিনি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন “কেন যে এ কাজ করিলাম বুঝিতে পারি না। জ্যেঠামহাশয় আমাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন; যখন যাহা চাহিয়াছি, তাহাই পাইয়াছি। কেন আমি তাঁহাকে হত্যা করিলাম। যে রাত্রে এ কার্য্য করিয়াছি, সেই রাত্রি হইতে আমার মনে সুখ নাই, চক্ষে নিদ্ৰা নাই, সদাই আমি সশঙ্কিত, এরূপ জীবনভার বহন করা অপেক্ষা যাহাতে শীঘ্রই আমার ফাঁসী হয়, তাহার উপায় করিয়া দিন।” 

এই বলিয়া নগেন্দ্রনাথ আমার পদতলে পতিত হইয়া বালকের ন্যায় ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। পুলিসের কার্য্য করিয়া আমার হৃদয় কঠিন হইয়াছে সত্য, কিন্তু নগেন্দ্রনাথকে আন্তরিক অনুতপ্ত দেখিয়া আমি স্বয়ং চক্ষের জল রোধ করিতে পারিলাম না। আমায় কেমন দয়া হইল। আমি নগেন্দ্রনাথের মন পরীক্ষার জন্য বলিলাম “যদি আমি আপনাকে গ্রেপ্তার না করি।” 

হাত জোড় করিয়া অতি বিনীতভাবে তিনি উত্তর করিলেন ‘আর আমায় লোভ দেখাইবেন না। আমার আর এক মিনিট বাঁচিতে ইচ্ছা হয় না। যতক্ষণ না আমার ফাঁসী হইতেছে, যতদিন আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হইতেছে, ততদিন আমি নিশ্চিন্ত হইব না। আপনি যতশীঘ্র পারেন আমার ফাঁসীর ব্যবস্থা করিয়া দিউন। এ আমার জ্যান্তে মরা।” 

আমি আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। পরে বলিলাম “একখানি কাগজে সকল কথা একজন অনারারি মাজিষ্ট্রেটের সম্মুখে লিখিয়া স্বাক্ষর করিয়া দিন, তাহা হইলে আর কেহ আপনাকে বিরক্ত করিবে না।” 

এই বলিয়া আমি ঘরের দ্বার খুলিলাম এবং তাঁহাকে তৎক্ষণাৎ একজন অনারারি মাজিষ্ট্রেটের নিকট লইয়া গেলাম ও নগেন্দ্রনাথকে তাঁহার সম্মুখে রাখিয়া আমি বাহিরে আসিলাম। 

নগেন্দ্রনাথ আমার আদেশ মত কার্য্য করিলেন। সমস্ত কথা অনারারি মাজিষ্ট্রেটের নিকট স্বীকার করিয়া লিখাইয়া দিলেন। আমি সেই দোষ স্বীকার-পত্র লইয়া তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিলাম। 

পরদিন প্রাতে সকলেই জানিতে পারিল, নগেন্দ্রনাথই রাধামাধববাবুকে হত্যা করিয়াছেন। সত্যেন্দ্রনাথ ও অহীন্দ্রনাথ মুক্তিলাভ করিলেন। 

সত্যেন্দ্রনাথ আমার নিকট চিরকৃতজ্ঞ রহিলেন। আমি তাঁহাকে অহীন্দ্রনাথ ও কুসুমের কথা প্রকাশ করিলাম। সে সকল কথা শুনিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন এবং বাড়ীতে ফিরিয়া অগ্রেই সেই দুষ্টা রমণীকে বিদায় করিয়া দিলেন। হরিদাস এবং বাড়ীর অন্যান্য দাস-দাসীগণ যখন জানিতে পারিল যে, সে কর্তাবাবুর শ্যালিকা নহে, কেবল কৌশল করিয়া এতকাল সে বাড়ীতে গৃহিণীর মত বাস করিতেছিল, তখন তাহারাও তাহাকে নানাপ্রকারে অপমানিতা করিয়া বাড়ী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিল। সরযূবালা স্বামীকে ফিরিয়া পাইয়া পরম পরিতুষ্টা হইল এবং আমার নিকট যাবজ্জীবন কৃতজ্ঞ হইয়া রহিল। 

নগেন্দ্রনাথকে অধিকদিন হাজতে থাকিতে হয় নাই; শীঘ্রই বিচার হইয়া গেল। নগেন্দ্রনাথ পূর্ব্বেই সমস্ত স্বীকার করিয়াছিলেন। বিচারে তাঁহার ফাঁসী হইয়া গেল। তিনি মরিয়া মুক্তি পাইলেন। 

অহীন্দ্রনাথ ও কুসুম দুইজনই জেলের আসামী। আমি ইচ্ছা করিলে উভয়কে পুনরায় কারাগারে পাঠাইতে পারিতাম; কিন্তু যখন অহীন্দ্রনাথকে কথা দিয়াছি এবং যখন তাহাদিগকে বন্দী করিবার কোন আদেশ পাই নাই, তখন আর তাহাদিগকে কোন কষ্ট দিতে ইচ্ছা হইল না। বিচারের পর তাহারা যে কোথায় গেল, তাহার আর সন্ধান পাইলাম না। 

সম্পূর্ণ 

[ অগ্রহায়ণ, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *