ছেলে-ভুল (অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!)
DETECTIVE STORIES No. 79. দারোগার দপ্তর ৭৯ম সংখ্যা।
ছেলে-ভুল
(অর্থাৎ অপহৃত বালক উদ্ধারের অদ্ভুত রহস্য!)
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত।
সিকদারবাগান বান্ধব পুস্তকালয় ও সাধারণ পাঠাগার হইতে শ্রী বাণীনাথ নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত।
All Rights Reserved.
সপ্তম বর্ষ। সন ১৩০৫ সাল। কার্তিক।
Printed By Shashi Bhusan Chandra, at the GREAT TOWN PRESS, 68, Nimtola Street, Calcutta,
ছেলে-ভুল।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
ছেলে-ভুল, এই কথা শুনিয়া পাঠকগণ ত একবারেই চমকাইয়া উঠিবেন, পাঠিকাগণের ত কথাই নাই। ছেলে কুল, কি ভয়ানক কথা! যাহার পুত্র আছে, যাহার হৃদয়ে পুত্রস্নেহ একদিবসের নিমিত্তও প্রবেশ লাভ করিয়াছে, তাহাকেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতে হইবে, ছেলেকে কি কখন ভুল হইতে পারে? আপন পুত্রকে পিতামাতা কি কখনও ভুল করিতে পারেন। তবে এক কথা এই হইতে পারে যে, কোন পিতামাতার পুত্র নিতান্ত শৈশবকালে যদি কাহারও দ্বারা অপহৃত হয়, বা সংসারচক্রের দুষ্পরিহার্য ঘটনাবলীর মধ্যে পড়িয়া, যদি কেহ আপনার প্রাণের রত্নকে হারান, এবং বহু বৎসর পরে যদি সেই পুত্রকে হঠাৎ দেখিতে পান, তাহা হইলে হয় ত পিতামাতা আপনার সেই প্রাণধনকে সহজে চিনিয়া উঠিতে পারেন না। কিন্তু একবারেই যে চিনিয়া উঠিতে পারেন না, তাহাও আমি মুক্তকণ্ঠে বলিতে সাহসী হই না। যে ছেলে-ভুলের বৃত্তান্ত আজ আমি পাঠকগণের সম্মুখে উপস্থিত করিতেছি, উহা কি তবে সেই প্রকারের ছেলে-ভুল? না, তাহা নহে। এ ছেলে-ভুলের অবস্থা যেরূপ, তাহা পাঠক-পাঠিকাগণ সহজে বিশ্বাস করিতে চাহিবেন না, টিটকারী দিয়া আমার কথা উড়াইয়া দিবেন, এবং আপনা দিগের মধ্যে পরস্পর বলাবলি করিবেন, ইহা কখনই হইতে পারে না; সম্পূর্ণরূপে ইহা অসম্ভব।
ইহা সম্ভবপর হউক, বা না হউক, পাঠক-পাঠিকাগণ আমার কথায় বিশ্বাস করুন, বা না করুন, যাহা ঘটিয়াছে, যাহা দেখিয়াছি, যাহা অনুসন্ধান করিয়াছি, তাহাই আজ সকলের সম্মুখে বলিতেছি। যাহার ইচ্ছা হয়, বিশ্বাস করিবেন, যাহার ইচ্ছা না হয়, তিনি বিশ্বাস না করিতে পারেন; কিন্তু যাহারা এই ঘটনা বিশ্বাস না করিবেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার একটা কথা জিজ্ঞাস্য আছে। তিনি বাল্যকাল হইতে এ পর্যন্তু বর্তমান মানব-চরিত্র অধ্যয়ন করি। আসিতেছেন কি? বিশেষতঃ এতদঞ্চলের মানবগণের আচার কবহার, কাৰ্য-কলাপ প্রভৃতি আপনি বাল্যকালে যেরূপ দেখিয়া আসিয়াছিলেন, এখন আপনি তাহার কিছুমাত্র পরিবর্তন বুঝিয়া উঠিতে পারিয়াছেন কি? বলুন দেখি, পূর্বকালে সন্তান প্রতিপালনের ভার কাহার উপর ছিল? সন্তান জন্ম গ্রহণের পর হইতে তাহার মনুষ্যত্ব প্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত, কাহার দ্বারা সে লালিত-পালিত হইত? কাহার যত্নে বর্জিত হইত? যতদিবস পৰ্য্যন্ত বালক স্তনদুগ্ধ পান করিত, ততদিবস পৰ্য্যন্ত মাতা কি তাহাকে আপন ক্রোড়ের বহির্ভাগে গমন করিতে দিতেন? অপরের স্তনদুগ্ধ কোন্ মাতা শিগুগণের উদরে সহজে প্রবেশ করাইতে সম্মত হইতেন? সে সময়ের জননীমাত্রেই অশিক্ষিত ছিলেন, পাশ্চাত্য-শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদিগের হৃদয়ে পাশ্চাত্যভাব তখন প্রবেশ করিয়াছিল না। সুতং তাঁহারা অশিক্ষিতা ছিলেন, তাহাদিগের বুদ্ধির লেশমাত্রও ছিল না, তাই তাঁহারা সামান্য ধাত্রীর কাৰ্য করিয়া, আপন আপন পুত্রকে প্রতিপালন করিতেন; তাই তাঁহারা আপন সন্তানকে ক্রোড়ের বাহির হইতে দিতেন না; তাই তাঁহারা দাসদাসীগণের উপর বিশ্বাস করিয়া, তাহাদিগের হস্তে আপন আপন বহুমূল্য রত্ন কখনই প্রদান করিতে সাহসী হইতেন না। সুতরাং ছেলে-ভুল এ কথা কখনও শুনিতে পাওয়া যাইত না।
আর এখন পাশ্চাত্য-সভ্যতা আমাদিগের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছে। স্ত্রীগণ শিক্ষিত (?) হইয়া, বা শিক্ষিত হইয়াছেন এই ভান করিয়া দেশের মুখোজ্জল করিতেছেন! তাই মধ্যে মধ্যে এখন ছেলে-ভুল হইয়া থাকে। তাহাদিগের বিবেচনায় এখন গর্ভধারণের অন্যরূপ ব্যবস্থা হইলেই ভাল হইত; কিন্তু স্বভাবের নিয়ম একবারে পরিবর্তিত হইবার সম্ভাবনা নাই বলিয়াই, এই ভয়ানক যন্ত্রণা হা দিগকে সহ্য করিতে হইতেছে! তবে সন্তান প্রসুত হইবার পর, আর তাঁহাদিগের কোনরূপ কষ্ট থাকে না। সন্তান ভূমিষ্ট হইল, তিনিও তাহাকে চাকর-চাকরাণীর হস্তে সৰ্পণ করিয়া, যাহাতে নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখিতে পারেন, তাহার চেষ্টায় নিযুক্ত হইলেন। ভৃত্যগণই সন্তানের লালনপালনে নিযুক্ত হইল। মাতৃ-স্তনদুগ্ধের পরিবর্তে গর্দভীদুগ্ধে তাহাদের জীবন রক্ষা হইতে লাগিল। মাতৃ স্নেহের পরিবর্তে নীচ-বংশোদ্ভাবা অসচ্চরিত্রা পরিচারিকার স্নেহের সন্তান পরিবর্ধিত হইতে লাগিল। এরূপ অবস্থায় স্নেহময়ী জননী, তাঁহার স্নেহময় পুত্রকে ভুল না করিবেন ত কাহাকে ভুল করিবেন? অবশ্য এরূপ অবস্থা এখন পর্যন্ত সকলের গৃহে প্রবেশ করে নাই। পূৰ্বে নিয়মানুসারে এখনও কোন কোন প্রসূতি আপন আপন সন্তান প্রতিপালন করিয়া থাকেন সত্য; কিন্তু আরও কিছুদিবস পরে, বা তাহাদের অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আরও যে কি হইবে, তাহা ভাবিয়া উঠিতে পারি না। এখন যাঁহাদের অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে, যাহারা পাশ্চাত্য-শিক্ষার অভিমানে অভিমানী হইয়াছেন, কমলা যাহার উপর কৃপানেত্রে দৃষ্টি করিয়াছেন, এক কথায় আজকাল যাঁহারা সভ্য এবং বড়মানুষ, তাহাদিগের মধ্যে অধিকাংশের গৃহেই এইরূপ ঘটনা ঘটিতেছে। তাহাদিগের ছেলে যদি ভুল না হইবে, তবে আর কাহাদিগের হইবে?
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
একদিবস বৈকালে আমাদিগের পুলিসের সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত একখানি পত্ৰ আসিয়া আমার হস্তে পতিত হইল। তাঁহারই একজন চাপরাশী সেই পত্রখানি আনিয়া, আমার হস্তে প্রদান করিয়া চলিয়া গেল। খামখানি খুলিয়া দেখিলাম, উহার ভিতর একখানি টেলিগ্রাম। সেই টেলিগ্রামের উপর সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ,—ইহা পাঠমাত্র কলিকাতার যে ঘাটে তমলুকের জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হয়, সেই ঘাটে, গমন করিয়া, টেলিগ্রামে লিখিত বালকের অনুসন্ধান কর, এবং কোনরূপ সন্ধান পাওয়া যায় কি না, তাহা সন্ধ্যার পর আমাকে রিপোর্ট করিও।
টেলিগ্রামের উপর সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ পাঠ করিয়া, তাহার পরে টেলিগ্রামখানি পাঠ করিলাম। দেখিলাম, কলিকাতার একজন সম্রান্ত লোক মফঃসল হইতে এই টেলিগ্রাম পুলিসের সর্ব প্রধান কর্ম্মচারীর নিকট প্রেরণ করিয়াছেন। সেই টেলিগ্রামের মৰ্ম্ম এইরূপ —আমরা সপরিবারে একখানি জাহাজে তমলুক হইতে উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হই। জাহাজ হইতে নামিবার পর দেখিলাম, আমার এক বৎসর বয়স্ক পুত্রকে জাহাজে ভ্ৰম ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি। সেই সময় জাহাজও উলুবেড়িয়া হইতে ছাড়িয়া দিয়াছিল। সুতরাং সেই জাহাজ ধরিয়া আমরা আমার পুত্রকে কোনরূপে আনিতে সমর্থ হইলাম না। আমার পুত্রটীর অঙ্গে প্রায় দুই সহস্র মূল্যের অলঙ্কার আছে। কোনরূপ সুযোগ করিয়া আমি এই টেলিগ্রামখানি আপনার নিকট পাঠাইতেছি, জাহাজে অনুসন্ধান করিলেই, আমার বালকটীর অনুসন্ধান হইবার সম্ভাবনা। আমরাও যতশীঘ্র পারি, কলিকাতায় গিয়া উপস্থিত হইয়া আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিব।
টেলিগ্রামের মর্ম অবগত হইয়া আমি আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিতে পারিলাম না। একখানি গাড়ি আনাইয়া তৎক্ষণাৎ আর মানি ঘাটাভিমুখে প্রস্থান করিলাম। ঘাটে উপস্থিত হইয়া জানিতে পারিলাম, এখন পর্যন্ত তমলুকের জাহাজ আসিয়া কলিকাতায় উপস্থিত হয় নাই।
আমি আরও কয়েকজন লোক সংগ্রহ করিয়া আরমানিঘাটে অপেক্ষা করিতে লাগিলাম। জাহাজ সম্বন্ধীয় কর্ম্মচারীগণ যাহারা সেই সময় সেই ঘাটে উপস্থিত ছিল, তাঁহারাও আমার সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইলেন।
ক্রমে জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হইল। জেটিতে জাহাজ ভিড়া ইয়া নঙ্গর করা হইলে, আমরা সর্বাগ্রে গিয়া জাহাজে উঠিলাম। জাহাজে যে সকল আরোহী ছিল, তাঁহারাও ক্রমে জাহাজ হইতে অব তরণ করিতে আরম্ভ করিল। যে সকল আরোহীর সহিত ছোট ছোট বালক ছিল, তাহাদিগকে প্রথমে আমরা জাহাজ হইতে অবতরণ করিতে দিলাম না। যাহাদিগের সহিত কোন শিশুসন্তান ছিল না, তাঁহারাই প্রথমে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া গেল। উঁহাদিগকে যতদূর সম্ভব অলঙ্কার-ভূষিত সেই বালকের কথা জিজ্ঞাসা করিলাম; কিন্তু কেহই কোনরূপ সন্তোষজনক উত্তর প্রদান করিতে পারিল না। এইরূপে যাহাদিগের নিকট শিশুসন্তান ছিল না, তাহার জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, যাহাদিগের সহিত শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগকে এক এক করিয়া যাইতে দেওয়া হইল। তাহাদের গমন করিবার সময় তাহাদিগের সমভিব্যাহারে যে সকল শিশুসন্তান ছিল, তাহাদিগের সম্বন্ধে যতদূর জানিয়া লইবার সম্ভাবনা, তাহা জানিয়া লইয়া, এবং উঁহারা উঁহাদিগের যে সকল থাকিবার ঠিকানা প্রদান করিল, তাহা লিখিয়া লইয়া উঁহাদিগকেও যাইতে দিলাম। এক এক করিয়া তাঁহারা সকলেই প্রস্থান করিল। কিন্তু যে বালকের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি সেই স্থানে গমন করিয়া ছিলাম, সেই বালক সম্বন্ধে কোন ব্যক্তিই কোন কথা বলিতে পারিল না, বা যে সকল বালককে লইয়া তাহাদিগের পিতামাতা আমাদিগের সম্মুখে জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গেল, তাহাদিগের কোন শিশুর অঙ্গে কোনরূপ মূল্যবান্ অলঙ্কারও দেখিতে পাইলাম না।
এইরূপে সমস্ত আরোহী জাহাজ হইতে প্রস্থান করিলে পর, আমরা জাহাজের সমস্ত স্থান উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিলাম। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরার ভিতর খুঁজিয়া দেখিলাম, যে সকল স্থানে জাহাজের খালাসিদিগের জিনিষপত্র থাকে, বা জাহাজের যে সকল স্থানে তাহাদিগের যাতায়াত আছে, সেইসকল স্থানওউত্তমরূপে অ সন্ধান করিলাম; কিন্তু কোন স্থানে সেই এক বৎসর বয়স্ক বালকের বা তাহার পরিহিত অলঙ্কারের কোনরূপ সন্ধান পাইলাম না। তখন আর কি করি, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে না পারিয়া, জাহাজের সারেংকে ডাকাইলাম। সে আমাদিগের নিকট আগমন করিলে, তাহাকে সেই টেলিগ্রাম দেখাইলাম, এবং তাহাকে সমস্ত কথা বুঝাইয়া বলিলাম। বৃদ্ধ সারেং জাতিতে মুসলমান হইলেও, তাহাকে বেশ ভদ্রলোক বলিয়া অনুমান হইল। সে তাহার অধীনস্থ সমস্ত খাসি বা জাহাজের অপরাপর ভৃত্যগণকে একত্র করিয়া আমাদিগের সম্মুখেই অনুসন্ধান আরম্ভ করিল। তাহার অনুসন্ধানে আমরা নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অবগত হইতে পারিলাম।
১ম। দাসদাসী ও পরিবারবর্গ লইয়া দুই তিনটী ভদ্রলোক তমলুকে এই জাহাজে আরোহণ করেন।
২য়। তাঁহাদিগের সহিত একটী পরিচারিকার ক্রোড়ে একটা এক বৎসর বয়স্ক বালক ছিল।
৩য়। উহার অঙ্গে অনেকগুলি অলঙ্কার ছিল।
৪র্থ। তাঁহারা প্রথম শ্রেণীর একখানি কামরা ভাড়া করেন।
৫ম। সেই কামরার ভিতর স্ত্রীলোকগণ ছিলেন।
৬ষ্ঠ। চাকর-চাকরাণী কয়েকজন সেই কামরার বাহিরে ছিল।
৭ম। বাবুরা সকলে প্রথম শ্রেণীর খোলা জায়গায় এক এক খানি চেয়ার ও মোড়া লইয়া বসিয়াছিলেন।
৮ম। তাঁহারা কে, কোথা হইতে আসিতেছেন, তাহা কেহই অবগত নহে। কেবল এইমাত্র জানিতে পারা গেল যে, উঁহারা তমলুকে জাহাজে উঠিয়াছিলেন।
৯ম। তাঁহারা সকলে উলুবেড়িয়ার ঘাটে অবতরণ করেন।
১০ম। সেই সময় তাঁহারা অলঙ্কার-ভূষিত বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়াছিলেন কি না, কেহ বলিতে পারেনা।
জাহাজের সারেংয়ের সাহায্যে এই কয়েকটামাত্র বিষয় অবগত হইয়া, ক্ষুণ্ণ মনে আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম; এবং আদেশমত আমার সর্বপ্রধান কৰ্মচারীর নিকট গমন করিয়া, যতদূর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহা তাহার নিকট আদ্যোপান্ত বর্ণন করিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই, এবং যেরূপ অবস্থা, তাহাতে সহজে যে উহার কোনরূপ অনুসন্ধান হইবে, তাহার সম্ভাবনাও নিতান্ত অল্প। তথাপি যাহাতে আমি সেই বালকের কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি, এবং তাহার পরি হিত বহুমূল্য অলঙ্কারগুলির কোনরূপ উদ্ধার করিতে যাহাতে আমি সমর্থ হই, তাহার নিমিত্ত আমার উপর আদেশ প্রদান করিলেন। আমিও তাহার আদেশ শিরোধার্য্য করিয়া, সেই স্থান হইতে নিজ স্থানে প্রত্যাবর্তন করিলাম। আসিবার সময় তাহাকে কেবলমাত্র ইহাই বলিয়া আসিয়াছিলাম যে, টেলিগ্রাম পাঠে যেরূপ বুঝিতে পারা যাইতেছে, তাহাতে বোধ হয়, যাহার পুত্র পাওয়া যাইতেছে না, তিনি যতশীঘ্র পারেন, কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হইবেন। প্রথমতঃ, তিনি যদি আপনার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হন, তাহা হইলে অনুগ্রহ পূর্বক তাঁহাকে যেন আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। প্রধান কর্ম্মচারী মহাশয় আমার প্রস্তাবে সম্মত হইলেন ও কহিলেন, আসিবামাত্রই তাঁহাকে আমি তোমার নিকট পাঠাইয়া দিব। তিনি আরও কহিলেন, কেহ যে আপনার শিশুসন্তানকে কখন ভুলক্রমে পরিত্যাগ করিতে পারে, তাহা কিন্তু আমি ইতিপূৰ্বে আর কখনও দেখি নাই, বা শুনিও নাই। না জানি, ইনি কিরূপ পিতা?
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
সে রাত্রিতে আর কোনরূপ অনুসন্ধান হইল না। পরদিবস প্রত্যূষে আমি সেই বালকের অনুসন্ধান করিবার মানসে খানা হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একখানি পত্র-সহ এক ব্যক্তি একথানি জুড়ি গাড়িতে আমার থানায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গাড়ি হইতে নামিয়াই তিনি আমার অনুসন্ধান করিলেন। সম্মুখে আমি উপস্থিত ছিলাম, একজন প্রহরী আমাকে দেখাইয়া দিল। আমাকে দেখিয়া তিনি আমার নিকট আগমন করিলেন, এবং পত্রখানি বাহির করিয়া আমার হস্তে প্রদান করিলেন। আমি পত্রখানি খুলিলাম; দেখিলাম, উহা আমার সেই সৰ্ব্বপ্রধান কর্ম্মচারীর স্বহস্তলিখিত। লেখাও অধিক নহে, দুইটী ছত্র মাত্র। উহাতে লেখা ছিল,-আপনি যে বালকের অনুসন্ধান করিতেছেন, এই পত্রবাহক সেই বালকের পিতা।
তাঁহার পোষাক-পরিচ্ছদ, গাড়ি-ঘোড়া দেখিয়া এবং তাহার কথাবার্তা শুনিয়া বেশ বুঝিতে পারিলাম, তিনি একজন বড় মানুষ। পাশ্চাত্য-শিক্ষায় ইনি উত্তমরূপে শিক্ষিত। ইনি আসিয়া হঠাৎ উপস্থিত হওয়ায়, সেই সময় আর আমাকে বাহিরে যাইতে হইল না। তাঁহার সমভিব্যাহারে আমি আমার আফিস গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম, এবং সেই স্থানে নির্জনে উভয়ে উপবেশন করিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনিই কি একখানি টেলি গ্রাম করিয়াছিলেন?
বড়লোক। হাঁ মহাশয়।
আমি। দেখুন দেখি, এই টেলিগ্রাম কি?
বড়লোক। হাঁ মহাশয়। আমিই এই টেলিগ্রাম পঠাইয়াছিলাম।
আমি। এই টেলিগ্রামে যে বালকের কথা উল্লেখ আছে, সে কি আপনার পুত্র?
বড়লোক। হুঁ, সেই শিশু আমার সন্তান। আপনার সাহেবের নিকট হইতে অবগত হইলাম, আপনিই সেই শিশুর অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছেন; ইহা কি প্রকৃত?
আমি। উহার অনুসন্ধানের ভার আমারই উপর ন্যস্ত হইয়াছে।
বড়লোক। উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারিয়া ছেন কি?
আমি। না, এ পর্যন্ত আমি উহার কোনরূপ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। আজ উহার সন্ধানে গমন করিতেছিলাম, এমন সময় আপনি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
বড়লোক। উহার সন্ধান পাইবার কোনরূপ আশা আছে কি?
আমি। আশা না থাকিলে কি কখনও এই জগতের অস্তিত্ব থাকিত? আশা নাই, এ কথা আমি বলিতে পারি না। ৪
বড়লোক। আপনি অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত গমন করিতে ছিলেন; চলুন, আমিও আপনার সহিত গমন করি।
আমি। আমার সহিত আপনার গমন করিবার প্রয়োজন এখন নাই। যখন প্রয়োজন হইবে, তখন আপনি আমার সহিত গমন করিবেন। এখন কতকগুলি কথা আপনার নিকট আমার জিজ্ঞাস্য আছে, সেইগুলির যথাযথ উত্তর প্রদান করুন; তাহা হইলে কিরূপ ভাবে কোথায় ইহার অনুসন্ধান করিতে হইবে, তাহা বুঝিতে পারিব।
বড়লোক। আমাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে চাহেন?
আমি। টেলিগ্রামে যে নাম আছে, সেই নামই বোধ হয়, আপনার নাম? :
বড়লোক। হাঁ উহাই আমার নাম।
আমি। আপনার বাসস্থান কোথায়?
বড়লোক। এই শহরেই আমার বাসস্থান।
আমি। আপনি যে কলিকাতাবাসী, তাহা আমি পূর্বেই বুঝিতে পারিয়াছি; কিন্তু কলিকাতার কোন্ স্থানে আপনার বাসস্থান, তাহা আমাকে বলিয়া দিবেন কি? কারণ, যখন আপনাকে আবশ্যক হইবে, তখন আমি আপনাকে কোথায় পাইব?
আমার কথার উত্তরে তিনি তাঁহার প্রকৃত পরিচয় আমাকে প্রদান করিলেন, এবং যে স্থানে তাহার বাসস্থান তাহাও আমাকে বলিলেন। আমি কিন্তু তাহার নাম ও পরিচয় পাঠকগণের নিকট সবিশেষ কোন কারণ বশতঃ প্রকাশ করিতে পারিলাম না।
আমি। কিরূপ অবস্থায় আপনি আপনার শিশুসন্তানটীকে হারাইয়াছেন, তাহার আদ্যোপান্ত বৃত্তান্ত আমার নিকট সবিশেষ করিয়া বলুন দেখি।
বড়লোক। আমি পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমার বাসস্থান এই কলিকাতায়; কিন্তু আমার শ্বশুরালয় কলিকাতায় নহে। মেদিনী পুর জেলার মধ্যে একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে আমার শ্বশুরালয়। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, ষ্টীমারে তমলুক পৰ্য্যন্ত গমন করিতে হয়। তমলুক হইতে আমার শ্বশুরালয় কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধান। তমলুক হইতে সেই স্থানে গমন করিতে হইলে পাল্কী বা শকট ভিন্ন গমন করিবার আর কোন উপায় নাই। আমার বিবাহের পর আমার স্ত্রী কেবলমাত্র একবার তাহার পিত্রালয়ে গমন করিয়া ছিলেন; তাহা বহুদিবসের কথা। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে বলিয়া, আমি আমার স্ত্রীকে সেই স্থানে যাইতে দেই না। আমার শ্বশুর মহাশয় আসিয়া মধ্যে মধ্যে, তাহাক আবাকে দেখিয়া যান। কিন্তু পাড়াগাঁয়ের নিয়ম-অনুসারে আমার শ্বাশুড়ীঠাকুরাণী আমাদিগের বাটীতে আসিতে পারেন না। সুতরাং তাহার কন্যার সহিত প্রায় একরূপ দেখা-সাক্ষাৎ নাই। আমার স্ত্রী বহুদিবস হইতে তাহার মাতাকে দেখিতে না পাইয়া, বড়ই দুঃখিতা থাকিতেন, এবং সেই স্থানে গমন করিয়া একবার তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিবেন, এই ইচ্ছা মধ্যে মধ্যে প্রকাশ করিতেন। সুযোগ মত আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া তাহার মাতার সহিত সাক্ষাৎ করা ইয়া আনিব, এই কথা মধ্যে মধ্যে বলিয়া তাহাকে সান্ত্বনা করিতাম।
ক্রমে আমার সেই পুত্ৰটী জন্মগ্রহণ করিল। সেই পুত্র জন্মাইবার পর হইতে আমার স্ত্রী তাহার পিত্রালয়ে অভাবপক্ষে দুই একদিবসের নিমিত্তও গমন করিবার জন্য আমাকে সবিশেষরূপে অনুরোধ করিতে লাগিল। আমি প্রথমতঃ তাহার প্রস্তাবে অসম্মত হইলাম; কিন্তু কোনরূপেই তাহাকে শান্ত করিতে পারিলাম না। অনোপায় হইয়া ক্রমে তাহার মতে আমাকে মত দিতে হইল, এবং শ্বশুরালয়ে গমন করিবার দিন স্থির করিয়া শ্বশুর মহাশয়কে পত্র লিখিলাম। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে, যে স্থানে যেরূপ করিবার প্রয়োজন, তাহার সমস্তই ঠিক হইল। প্রায় এক সপ্তাহ হুইল, আমি আমার স্ত্রী ও পুত্রের সহিত আমার শ্বশুর বাড়ী গমন করিবার নিমিত্ত কলি কাতা পরিত্যাগ করিলাম। আমাদিগের সঙ্গে আমার দুইজন বন্ধু, একজন পাচক ব্রাহ্মণ, দুইটী দ্বারবান, চারিজন পরিচারক এবং দুইজন পরিচারিকামাত্র গমন করিল। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভাল নহে, এ কথা আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি; সুতরাং সেই স্থানে গমন করিয়া, সেই নে অনহিতি করিবার ও সেই স্থান হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিবার কে সকল ব্যর এবং যেরূপ বন্দোবস্তের প্রয়োজন, তাহা সমস্ত আমিই নির্ব্বাহ করিলাম।
কলিকাতার আরমানিঘাট হইতে জাহাজে আরোহণ করিয়া আমরা তমলুকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে পাল্কীর বন্দোবস্ত ছিল। সুতরাং শশুরবাড়ী পৌঁছিতে আমার বা আমার সমভিব্যাহার সমস্ত লোকের কোনরূপ কষ্ট হইল না। সেই স্থানে। কয়েকদিবসকাল অতিবাহিত করিয়া গত পরশু তারিখে আমরা তমলুকে আসিয়া উপস্থিত হই। সেই স্থানে রাত্রিযাপন করিয়া, পরদিবস জাহাজে আমোহণ করি। আমাদিগের ইচ্ছা ছিল, তমলুক হইতে আমরা একবারে কলিকাতায় আগমন করিব না; উলুবেড়িয়ার কয়েকখানি গ্রাম ব্যবধানে আমার স্ত্রীর এক ভগিনীর শ্বশুরবাড়ী আছে। ইচ্ছা ছিল, উলুবেড়িয়ায় নামিয়া, আমরা সেই স্থানে গমন করিব; সেই স্থানে দুই একদিবস থাকিয়া, আমরা কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিব। মনে মনে আমরা যেরূপ স্থির করিয়াছিলাম, কাৰ্যেও আমরা সেইরূপ বন্দোবস্ত করিয়াছিলাম। সেই স্থানে গমন করিবার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক ছিল, জাহাজ উলুবেড়িয়ায় আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমরা সকলে সেই স্থানে অবতরণ করিলাম। জাহাজ জেটিতে থাকিয়া নিয়মিত সময়ে কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিল।
জাহাজ ছাড়িয়া যাইবার পর দেখিলাম, আমার সমভি বাহারী লোজন ও দ্রব্যসামগ্রী সমস্তই জাহাজ হইতে নামাইয়া আনা হইয়াছে, কেবল আমায় শিশুসন্তানটীকে দেখিতে পাইলাম না। তাহাকে দেখিতে না পাইয়া, প্রথমত আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলাম; তিনি কহিলেন, আমার নিকটে তামার সন্তান নাই, কোন না কোন চাকর-চাকরাণীর কাছে থাকিবে। তখন এক এক করিয়া চাকর-চাকরাণী, দ্বারা ব্ৰাহ্মণ প্রতি যে সফল ব্যক্তি আমাদিগের সঙ্গে ছিল; তাহাদিগের প্রত্যেককেই জিজ্ঞাসা করি লাম। সকলেই কহিল, তাঁহারা কেহই জাহাজ হইতে বালককে নামাইয়া আনে নাই। অধিকন্তু প্রত্যেকে প্রত্যেকের সহিত বিবাদ আরম্ভ করিল, পরিচারিকাদ্বয়ের মধ্যে মহাগোলযোগ উপস্থিত হইল।
একজন কহিল, বালক তোর জিম্মায় ছিল, তুই আনিস নাই কেন? অপর আর একজন কহিল, জাহাজের ভিতর তুই বালককে ক্রোড়ে করিয়া রাখিয়াছিলি, তোরই নিকট সেই বালক ছি, তুই তাহাকে কিরূপে পরিত্যাগ করিয়া আসিলি! চাকর গণের মধ্যে পরস্পর হাতাহাতি আরম্ভ হইল। একজন কহিল, তোর দোষ। আর একজন কহিল, তোর দোষ। একজন কহিল, জাহাজ হইতে নামিবার সময় তোক বলিয়াছিলাম, কোন স্ত্রব্য ভুল ক্রমে ফেলিয়া আসিয়াছি কি না, দেখিয়া আয়। অপর ন্যূক্তি কহিল, এ কার্যের ভার তোর উপর ছিল, তুই আপন কাৰ্য্য করিস্ নাই বলিয়াই ত এই সর্বনাশ ঘটিল। আমার সমভিব্যাহারে অপর যাহারা ছিলেন, তাঁহারা চুপ করিয়া এদিক ওদিক অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন, আমার স্ত্রী উচ্চৈঃস্বরে কাদিতে আরম্ভ করিল। এই সকল ব্যাপার দেখিয়া আমি যে কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। ওদিকে দেখিলাম, জাহাজখানি আর ঘাটে নাই, কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিতেছে; আর এত দূরবর্তী হইয়া পড়িয়াছে যে, জাহাজের কোন লোক আমাদিগের উচ্চরবও শুনিতে পায় না।
তখন অনন্যোপায় হইয়া, কি করিব, তাহার কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া, আপনাদিগের সাহেবের নিকট টেলিগ্রাম করিলাম, এবং অপর যে সকল স্থানে সেই জাহাজ পড়াইবার সম্ভাবনা আছে, সেইসকল স্থানে অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত লোজন সমভিব্যাহারে আমি নিজেই রওনা হইলাম। স্থানীয় পুলিসকেও সেই সময় সংবাদ দেওয়া হইয়াছিল, তাঁহারাও আমাদিগকে সবিশেষরূপ সাহায্য করিলেন; কিন্তু কোন স্থানেই তাহার কোনরূপ সন্ধান করিতে পারিলাম না।
আমি। যখন আপনারা তমলুক হইতে জাহাজে আরোহণ করেন, সেই সময় বালকটীকে জাহাজে আনা হইয়াছিল ত?
বড়লোক। সে সময় ভুল হয় নাই।
আমি। জাহাজের উপর আপনি আপনার পুত্রটীকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছিলেন কি?
বড়লোক। জাহাজের মধ্যে আমি যে তাহাকে নিজ চক্ষে দেখিয়াছি ইহা কিন্তু আমার ঠিক স্মরণ হয় না; কিন্তু বালকটীকে যে জাহাজে আনা হইয়াছিল, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।
আমি। আপনি কিরূপে বলিতেছেন যে, জাহাজে তাহাকে আনা হইয়াছিল? কারণ, আপনি নিজে ত তাহাকে দেখেন নাই।
বড়লোক। আমি নিজে দেখি নাই সত্য। কিন্তু পরিশেষে এ বিষয়ে আমি অনুসন্ধান করিয়াছিলাম। যে চাকরাণী ক্রোড়ে করিয়া তাহাকে জাহাজে উঠাইয়াছিল, সে-ই আমাকে বলিয়াছে। তদ্ব্যতীত আমার স্ত্রীও তাহাকে জাহাজের ভিতর দেখিয়াছেন।
আমি। যে সময় উলুবেড়িয়ায় আপনারা সকলে জাহাজ হইতে অবতরণ করেন, সেই সময় সেই বালক কাহার নিকট ছিল, তাহার কিছু অনুসন্ধান করিয়াছেন কি?
বড়লোক। করিয়াছি, সেই সময় সেই বালক কাহারও ক্রোড়ে ছিল না। জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার কিছু পূর্বেই সে নিদ্রিত হইয়া পড়ে, কামরার মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপর তাহাকে শোয়াইয়া রাখা হয়। পরিশেষে নামিবার সময় ভুলক্রমে আর কেহই তাহাকে লইয়া নাবেন নাই। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার সেই স্থানেই রহিয়া যায়।
আমি। আমি বিস্তর বিস্তর ভুল দেখিয়াছি; কিন্তু এরূপ মহা ভুল আমি কখনও দেখি নাই; দেখা ত দূরের কথা, কখনও শুনি নাই।
বড়লোক। নিদ্রিত অবস্থায় বালক আমার এই কলিকাতায় আসিয়া উপস্থিত হয় নাই ত?
আমি। জাহাজ ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্বেই আমি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম। আমার সম্মুখেই জাহাজ আসিয়া ঘাটে উপস্থিত হয়। জাহাজের ভিতর ও আরোহীগণের মধ্যে আমি নিজে উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি। বালক কলি কাতা পর্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হয় নাই।
বড়লোক। জাহাজের কোন লোক সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা বলিতে পারে নাই?
আমি। তাহাও আমি প্রায় প্রত্যেকেকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি; কিন্তু সেই বালক যে কোথায় গেল, বা কে তাহাকে লইয়া গেল, এ সংবাদ আমাকে কেহই প্রদান করিতে পারিল না। কেবল জাহাজের খালাসিগণের নিকট হইতে এইমাত্র অবগত হইতে পারি লাম যে, আপনারা তমলুকে উঠিয়াছিলেন, এবং উলুবেড়িয়ায় নামিয়া গিয়াছেন।
বড়লোক। মহাশয়। এখন উপায় কি বলুন দেখি?
আমি। উপায় ঈশ্বরের হস্ত। আমরা বালকের সন্ধান করিবার নিমিত্ত সাধ্যমত চেষ্টা করি মাত্র। সেই বালকের অঙ্গে কি কি অলঙ্কার ছিল বলিতে পারেন কি?
বড়লোক। কি কি অলঙ্কার ছিল, ঠিক তাহা আমি বলিতে পারি না। কেবল এইমাত্র বলিতে পারি যে, বালকের অঙ্গে সোণার যে সকল অলঙ্কার থাকিতে পারে, তাহার সমস্তই ছিল। আবশ্যক হয়, তাহার একটা বিস্তারিত তালিকা আমি পরে পাঠাইয়া দিব।
আমি। আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি,–যে সকল চাকর-চাকরাণী বা লোজন আপনার সহিত ছিল, তাহা দিগের মধ্যে কাহাকেও কোনরূপে আপনার সন্দেহ হয় কি?
বড়লোক। সকলেই পুরাতন চাকর। তাহাদিগের কাহারও দ্বারা যে কোনরূপ অনিষ্ট হইবে, কিন্তু আমার মনে স্থান পায় না; তবে বলিতে পারি না। কিন্তু তাঁহারা সকলেই ত আমাদিগের সহিত ছিল, কাহাকেই সেই সময় অনুপস্থিত পাই নাই।
আমি। অলঙ্কারের লোভ, ভয়ানক লোভ। এ লোভ সম্বরণ করা সামান্য লোকের পক্ষে বড়ই কঠিন।
বড়লোক। উঁহাদিগের মধ্যে কেহ যদি অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিত, তাহা হইলে অলঙ্কার-শূন্য বালকটাকে ত কোন প্রকারে পাওয়া যাইত?
আমি। পাওয়া ত উচিত ছিল; কিন্তু যদি অলঙ্কারগুলি অপ হরণ করিয়া বালককে গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিয়া থাকে, তাহা হইলে কিরূপে বালককে পাওয়া যাইতে পারে।
বড়লোক। যখন আমরা সকলেই সেই স্থানে উপস্থিত, তখন চাকর-চাকরাণীগণের মধ্যে কাহারও কি এতদুর সাধ্য হইতে পারে? যদি তাহাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে আপনার বিবেচনায় বালককে কি হত্যা করিয়া তাহার অলঙ্কারগুলি অপহরণ করিয়াছে বুলিয়া, আপনার অনুমান হয়?
আমি। অনুমান হয় না। চাকর-চাকরাণীগণ কর্তৃক শিশু হত্যা না হইবারই খুব সম্ভাবনা। এ কথা আমি তচ্ছলে বলিতেছি মাত্র। আমি আপনাকে আরও দুই একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
বড়লোক। কি?
আমি। যে কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ও আপনার শিশু সন্তান ছিল, আপনিও কি সেই কামরার ভিতর ছিলেন?
বড়লোক। না মহাশয়! আমি সেই স্থানে ছিলাম না, অপর স্থানে ছিলাম।
আমি। সেই কামরার ভিতর আপনার স্ত্রী ব্যতীত অপর আর কে ছিল?
বড়লোক। দুইজন পরিচারিকা ছিল।
আমি। তাঁহারা এখন কোথায়?
বড়লোক। তাঁহারা এখন আমার বাড়ীতেই আছে।
আমি। আমি তাহাদিগকে দুই চারিটী কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করি।
বড়লোক। উত্তম, আপনি আমার সহিত আমাদিগের বাড়ীতে চলুন। সেই স্থানে চাকর-চাকরাণীগণ যাহারা আমাদিগের সহিত ছিল, সকলেই উপস্থিত আছে, আপনি যাহাকে যাহা ইচ্ছা হয়, তাহা জিজ্ঞাসা করিয়া লইতে পারেন।
আমি। সে-ই ভাল, চলুন আমি আপনার সহিত গমন করি তেছি। আপনাকে আরও একটা কথা জিজ্ঞাসা করিতে চাই।
বড়লোক। কি?
আমি। আপনার অবস্থা দেখিয়া ও আপনার কথাবার্তা শুনিয়া আমার বেশ অনুমান হইতেছে, আপনি বড়লোক, এবং আপনার বিষয়-আশয় যথেষ্ট আছে।
বড়লোক। আপনি যাহা বলিতেছেন, সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমার এই মহৎ কাৰ্য্য যদি আপনার দ্বারা সাধিত হয়, তাহা হইলে আপনার খরচপত্র ত দূরের কথা, যাহাতে আপনি সন্তুষ্ট হন, এরূপ পুরস্কার আমি আপনাকে প্রদান করিব।
আমি। আমি পুরস্কার বা খরচপত্রের কথা বলিতেছি না। আমি যাহা বলিতেছি, তাহা অগ্ৰে শুনিয়া তাহার উত্তর প্রদান করুন। আমি যাহা অনুমান করিতেছি, তাহা ত প্রকৃত? আপনার যথেষ্ট বিষয় আছে কি? আমার এ জিজ্ঞাসার উদ্দেশ্য, আপনাকে পরে বলিতেছি।
বড়লোক। হাঁ, কিছু আছে।
আমি। আপনার পুত্রের জীবনের উপর আপনার বিষয় উপ লক্ষে কাহারও শুভাশুভ কিছু নির্ভর করে কি?
বড়লোক। আমি আপনার এ কথার ঠিক প্রকৃত অর্থ বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।
আমি। আপনার যদি সেই পুত্র জন্মগ্রহণ না করিত, বা সেই পুত্রের কোনরূপে যদি মৃত্যু হয়, তাহা হইলে আপনার মৃত্যুর পর আপনার অগাধ বিষয়ের স্বত্বাধিকারী অপর কেহ হইতে পারে কি?
বড়লোক। না, আমি সেরূপ দেখিতেছি না। আমার এই পুত্রের মৃত্যুতে আমার এই বিষয়ের কোনরূপ ক্ষতি-বৃদ্ধি হইবে না। কারণ, এই বিষয় এখন আমার নহে, আমার পিতার। তিনি এখনও বর্তমান; তদ্ব্যতীত আমিই কেবল তাহার একমাত্র পুত্র নহি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
সেই বড়লোকের সহিত আমার এই সকল কথাবার্তা হইবার পর, আমি তাহার সহিত তাহার গাড়িতেই আরোহণ করিয়া তাহার বাড়ীতে গমন করিলাম। তাঁহার বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া যে পরিচারিকাদ্বয় তাহার স্ত্রীর সহিত গমন করিয়াছিল, তাহাদিগকে ডাকাইলাম; ডাকিবামাত্রই তাঁহারা আমার সম্মুখে আসিল। তাহা দিগের মধ্যে প্রথমে যে আমার নিকট আগমন করিল, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তমলুক হইতে যখন তোমরা জাহাজে উঠিয়াছিলে, তখন বালকটীকে তোমরা ক্রোড়ে করিয়া আনিয়াছিলে ত?
১ম পরিচারিকা। আমি তাহাকে ক্রোড়ে করিয়া জাহাজে উঠিয়াছিলাম।
আমি। এ কথা তোমার বেশ মনে আছে?
১ম পরিচারিকা। বেশ মনে আছে। তদ্ব্যতীত জাহাজে উঠিয়া আমি সেই বালককে একবার তাহার মাতার ক্রোড়ে দিয়াছিলাম। তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা প্রকৃত কি না।
আমি। উলুবেড়িয়ায় নামিবার সময় বালকটীকে নামাইতে ভুল হইল কি প্রকারে?
১ম পরিচারিকা। তাহার মাতার ক্রোড় হইতে অপর ওই চাকরাণী সেই বালককে গ্রহণ করে, এবং তাহার ক্রোড়েই ক্রমে সেই বালক নিদ্রিত হইয়া পড়ে। নিদ্রিত হইবার পর সেই কামরার মধ্যে একখানি বেঞ্চের উপর একটা ছোট বিছানা করিয়া বালকটীকে সেই বিছানার উপর শয়ন করাইয়া রাখে। পরিশেষে উলুবেড়িয়ার ঘাটে জাহাজ আসিয়া উপস্থিত হইলে, আমি প্রথমেই আমার কর্তৃঠাকুরাণীর সঙ্গে জাহাজ হইতে অবতরণ করি। কারণ, তাঁহার সহিত আমাদিগের মধ্যে কোন পরিচারিকা না থাকিলে তিনি জাহাজ হইতে একাকী অবতরণ করিতে কখনই সমর্থ হইতেন না বলিয়াই, আমি তাঁহার সহিত গমন করি। যে সময় আমি ও আমার কর্তৃ ঠাকুরাণী জাহাজ হইতে নামিয়া আসি, সেই সময় অপর চাকরাণী জাহাজের উপরেই ছিল। আমরা ভাবিয়াছিলাম, সে জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার সময় বালকটীকে ক্রোড়ে করিয়া আনিবে; কিন্তু পরে দেখিতে পাইলাম, সে তাহা করে নাই, ভুল করিয়া বালকটীকে জাহাজেই পরিত্যাগ করিয়া আসিয়াছে।
তখন আমি দ্বিতীয় পরিচারিকাকে সম্বোধন করিয়া বলিলাম, এ বড় বিষম ভুল! তুমি বালকটীকে জাহাজে পরিত্যাগ করিয়া আসিলে কেন?
২য় পরিচারিকা। কঠাকুরাণীর গহনা ও অপরাপর জিনিষ পত্র আমি পূর্বেই গুছাইয়া রাখিয়াছিলাম। অপর চাকরাণীর সহিত কর্তৃঠাকুরাণীকে জাহাজ হইতে বহির্গত হইতে দেখিয়া সেই সকল দ্রব্যাদি লইয়া আমিও তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ জাহাজ হইতে অবতরণ করি। আমি ভাবিয়াছিলাম, কর্তৃঠাকুরাণী বা অপর পরিচারিকা বালকটীকে নিশ্চয় ক্রোড়ে করিয়া লইয়া গিয়াছেন। কারণ, আমি সেই সময় ভাবিয়াছিলাম, যখন গহনা ও জিনিষপত্র নামাইবার ভার আমার উপর পড়িয়াছে, তখন নিশ্চয়ই তাঁহারা বালকটাকে লইয়া গিয়াছেন। আমার কেবলমাত্র দোষ যে, দ্রব্যাদির সহিত দ্রুতপদে জাহাজ হইতে বাহির হইবার সময় আমি সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই যে, বালকটীকে লইয়া গিয়াছে, কি তখন পর্যন্ত সে সেই স্থানেই শয়ন করিয়া আছে।
আমি। তোমরা জাহাজ হইতে বাহিরে আসিলে পর, সেই কামরার ভিতর কোন দ্রব্য পরিত্যক্ত হইয়াছে কি না, তাহা দেখি বার নিমিত্ত তোমাদিগের কোন লোক সেই কামরার ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল কি?
২য় পরিচারিকা। তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার বোধ হয়, কেহই যায় নাই। কারণ, কেহ যদি উহার ভিতর গমন করিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সে সেই বালকটীকে বেঞ্চের উপর নিদ্রিত অবস্থায় দেখিতে পাইত।
আমি। তোমরা যে কামরার ভিতর ছিলে, তাহার ভিতর অপর আর কোন লোক ছিল?
২য় পরিচারিকা। আমরা দুইজন পরিচারিকা ও আমাদিগের কর্তৃঠাকুরাণী ভিন্ন অপর আর কেহই সেই কামরার ভিতর ছিল না।
আমি। যে সময় তোমরা জাহাজ হইতে অবতরণ কর, সেই সময় তোমাদিগের সেই কামরার সম্মুখে আর কোন ব্যক্তি বসিয়াছিল?
২য় পরিচারিকা। না, অপর কোন ব্যক্তিকে সেই স্থানে বসিতে দেখি নাই। তবে দুই একজন লোক সেই স্থান দিয়া যাতায়াত করিতেছিল, তাহা আমি দেখিয়াছি।
আমি। সেই লোক কে? ২য় পরিচারিকা। তাহা আমি জানি না।
আমি। উঁহারা জাহাজের খালাসি প্রভৃতি, কি আবোহী? ২য় পরিচারিকা। দুই একজন খালাসিকেও দেখিয়াছি, এবং অপর আরোহীগণের মধ্যেও দুই একজন সেই স্থান দিয়া যাতায়াত করিয়াছে।
আমি। তুমি তাহাদিগকে দেখিলে চিনিতে পারিবে? ২য় পরিচারিকা। না।
আমি। কেন?
২য় পরিচারিকা। তাহাদিগকে কেবল একবার দেখিয়াছি মাত্র, তাহাও সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।
আমি। যে কামরায় তোমরা ছিলে, তাহার পার্শ্ববর্তী কামরায় আর কোন আরোহী ছিল কি?
২য় পরিচারিকা। ছিল, আমাদিগের কামরার ঠিক পার্শ্বের কামরায় কয়েকটী স্ত্রীলোক ছিল দেখিয়াছি।
আমি। সেই স্ত্রীলোকদিগকে দেখিয়া কি মনে হয়? উঁহারা কি কোন গৃহস্থের পরিবার?
২য় পরিচারিকা। উঁহাদিগকে দেখিয়া কোন ভদ্র-বংশীয় স্ত্রীলোক বলিয়াই বোধ হয়।
আমি। উঁহাদিগের সহিত অপর আর কোন পুরুষ মানুষ ছিল কি?
২য় পরিচারিকা। সেই কামরার ভিতর কোন পুরুষ মানুষকে দেখি নাই; কিন্তু কয়েকজন পুরুষ মানুষ আসিয়া মধ্যে মধ্যে উহা দিগের খোজ-তল্লাস লইয়া গিয়াছে, তাহা আমি দেখিয়াছি।
আমি। তুমি জান, উঁহারা কাহারা?
২য় পরিচারিকা। না, তাহা আমরা জানি না।
আমি। উঁহারা কোথায় নামিয়া গিয়াছে?
২য় পরিচারিকা। তাহা বলিতে পারি না। কারণ, যখন আমরা জাহাজ হইতে উলুবেড়িয়ায় অবতরণ করি, সেই সময় তাঁহারা জাহাজেই ছিলেন। পরে কোথায় নামিয়াছেন, তাহা আমি জানি না।
আমি। তাহাদিগকে দেখিলে তুমি চিনিতে পারিবে?
২য় পরিচারিকা। তাহা আমি এখন ঠিক বলিতে পারিতেছি না। দেখিলে বুঝিতে পারি, চিনিতে পারি কি না।
আমি। তোমাদিগের সহিত পরিচারক ও দ্বারবান্ প্রভৃতি যাহারা ছিল, তাঁহারা তোমাদিগের কামরার ভিতর কখনও কোন কাৰ্য্যের নিমিত্ত প্রবেশ করিয়াছিল কি?
২য় পরিচারিকা। অপর কেহই আমাদিগের কামরায় প্রবেশ করে নাই। এমন কি, বাবু নিজেও সেই কামরার ভিতর প্রবেশ করেন নাই।
আমি। তুমি জাহাজ হইতে অবতরণ করিবার পূৰ্ব্বে, তোমা দিগের সমভিব্যাহারী কোন্ কোন্ ব্যক্তি জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়াছিল?
২য় পরিচারিকা। তাহা আমি সবিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।
আমি। তুমি নামিবার পর কে নামিয়াছিল, তাহা বলিতে পার?
২য় পরিচারিকা। তাহাও আমি বলিতে পারি না। সেই গোলযোগের ভিতর কে অগ্রে নামিল, কে পশ্চাৎ নামিল, তাহা আমি লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই।
পরিচারিকাদ্বয়ের নিকট হইতে এই কয়টী কথা জিজ্ঞাসা করিয়া লইবার পর, আমি সেই বাবুটীকে কহিলাম, আপনি আপনার স্ত্রীকে একবার জিজ্ঞাসা করিয়া আসুন, আপনার পরিচারিকাদ্বয় যাহা কহিল, তাহা প্রকৃত কি না। যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে সেই পরিচারিকাদ্বয়ের মধ্যে কেহ বালকটীকে লইয়া কোনও সময় জাহাজের বাহিরে আসিয়াছিল কি না? যদি আসিয়া থাকে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করিবেন, কোন্ চাকরাণী বাহিরে আসিয়াছিল, এবং কেনই বা আসিয়াছিল।
আমার কথা শুনিয়া বাবুটী অন্তঃপুরের ভিতর প্রবেশ করিলেন, ও কিয়ৎক্ষণ পরে বাহিরে আসিয়া কহিলেন, চাকরাণীদ্বয় যাহা বলিয়াছে, তাহা প্রকৃত। উঁহারা যে পর্যন্ত জাহাজে ছিল, সেই পর্যন্ত কেহই কামরার বাহিরে যায় নাই।
এই সকল কথা অবগত হইয়া আমি সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলাম। যাইবার সময় বাবুকে বলিয়া গেলাম, অনুসন্ধান করিয়া আমি যাহা যাহা অবগত হইতে পারিব, পরে তাহার সমস্ত ব্যাপার আপনাকে বলিব।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ।
সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া গমন করিবার পর দুইটা বিষয় আমার মনে উদিত হইল।
১ম। বালকটীকে পরিত্যাগ করিয়া তাহার পিতামাতা গমন করিলে পর, যদি সেই বালক জাহাজের কোন দুশ্চরিত্র খালাসি বা আরোহীগণের মধ্যে কোন অসচ্চরিত্র লোকের নয়নগোচর হইয়া থাকে, তাহা হইলে অর্থলোভে তাহাকে বিনষ্ট করিয়া অনায়াসেই তাহার দেহ সে গঙ্গার্গর্ভে নিক্ষেপ করিতে পারে। যদি আমার এই অনুমান সত্য হয়, তাহা হইলে বালকের অনু সন্ধান ত দূরের কথা, অলঙ্কার গুলিরও অনুসন্ধান হওয়া নিতান্ত সহজ হইবে না।
২য়। উলুবেড়িয়া ও কলিকাতার মধ্যবর্তী কোন স্থানে কোন আবোহী যদি সেই বালকটীকে লইয়া জাহাজ হইতে অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়া থাকে, তাহা হইলে বালক ও তাহার অলঙ্কারের কিছু না কিছু সন্ধান হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা আছে। এরূপ অবস্থায় সেই পন্থাই অবলম্বন করিয়া অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া এক্ষণে আমার কর্তব্য।
মনে মনে এইরূপ অনুমান করিয়া, আমি চাদপালঘাটে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সেই স্থানে একখানি ডিঙ্গি ভাড়া করিয়া প্রথমে মেটিয়াব্রুজে এবং পরিশেষে বজবজে গিয়া সেই বালক সম্বন্ধে সবিশেষরূপ অনুসন্ধান করিলাম। কিন্তু সেই দুই স্থানে সেই বালকের কোনরূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, রাজগঞ্জ ও অপরাপর কয়েকস্থানে গমন করিলাম। সেই সকল স্থানেও বালকের কোন রূপ অনুসন্ধান না পাইয়া, তিন চারিদিবস পরে নিতান্ত ক্ষুণ্ণ মনে কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিলাম। আমার উর্দ্ধতন কর্ম্মচারী ও বালকের পিতামাতা প্রভৃতি সকলেই জানিতে পারিলেন যে, আমার দ্বারা সেই বালকের অনুসন্ধান হইবার আর কোনরূপ সম্ভাবনা নাই। তথাপি আমি যে সেই বালকের অনুসন্ধান একবারে পরিত্যাগ করিলাম, তাহাও নহে।
যে কামরার ভিতর বালকটীকে ভ্ৰম-ক্রমে পরিত্যাগ করিয়া আসা হইয়াছিল, তাহার পার্শ্ববর্তী কামরার ভিতরে আরও একজন ভদ্রলোক তাঁহার পরিবারকে লইয়া আসিয়াছিলেন, এ কথার একটু আভাস পাঠকগণ ইতিপূৰ্ব্বে পাইয়াছেন। আর ইহাও জানিতে পারিয়াছেন যে, তাঁহারা কলিকাতা পৰ্যন্ত আগমন করেন নাই। কলিকাতার বন্দরে জাহাজ আসিবার পূর্বেই অপর কোন স্থানে তাঁহারা অবতরণ করিয়া চলিয়া গিয়াছেন। সবিশেষ কষ্ট ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়া এক সপ্তাহকাল পরে আমি সেই ভদ্র পরিবারের অনুসন্ধান পাইলাম, এবং তাহাদিগের গ্রাম পর্যন্ত গমন করিয়া জানিতে পারিলাম, তাঁহারা সেই বালক সম্বন্ধে কোন কথা অবগত নহেন, বা তাঁহারা সেই বালককে তাহাদিগের সঙ্গে আনেন নাই। সুতরাং নিতান্ত নিরাশ হইয়া আমাকে সেই স্থান হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে হইল। ক্রমে সেই অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া আমি অন্য কার্যে নিযুক্ত হইলাম। বালকের পিতামাতাও ক্রমে আপনাপন হৃদয় হইতে তাঁহাদিগের সেই সন্তানের মায়া পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।
এই ঘটনার প্রায় একমাস পরে একখানি নোটের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমাকে রাজগঞ্জে গমন করিতে হয়। যে মোক জমা সম্বন্ধে আমি নোটের অনুসন্ধান করিতে গিয়াছিলাম, সেই মোকদ্দমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদান করা আমি তত আবশ্যক মনে করি না। কারণ, এরূপ মোকদ্দমা সম্বন্ধে একটী ঘটনা ডিটেকটিভ পুলিস দ্বিতীয় কাও পুস্তকে আমি প্রকাশ করি, ইহাও ঠিক সেইরূপ ঘটনা। সেইরূপ উপায়ে জুয়াচেরগণ জুয়াচুরি করিয়া কুমারটুলির জনৈক দোকানদারের নিকট হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট গ্রহণ করে; কিন্তু সেই দিবস করেসি আফিস খোলা না থাকায়, তাঁহারা সেই নোট করেনসি আফিসে বদলাইয়া লইবার অবকাশ পায় নাই। পরদিবস প্রাতঃকালেই প্রতারিত ব্যক্তি জানিতে পারে যে, সে জুয়াচোরগণ কর্তৃক প্রতারিত হইয়াছে। সুতরাং প্রথমেই সে করেসি আফিসে গিয়া সেই নোটের নম্বর প্রদান করে, এবং সেই স্থানে এইরূপ লিখাইয়া আইসে যে, তাহার গৃহ হইতে একখানি পাঁচশত টাকার নোট চুরি গিয়াছে।
এদিকে জুয়াচারগণ যখন জানিতে পারে যে, করেসি অফিসে সেই নোট ভাঙ্গাইতে গেলে তাঁহারা ধৃত হইবে, তখন তাঁহারা করেসি আফিসে নোট ভাঙ্গাইবার আশা পরিত্যাগ করিয়া অপর আর এক উপায় অবলম্বন করে। শালিখার কোন ধান্তের আড়তে গমন করিয়া তাঁহারা পাঁচশত টাকা মূল্যের ধান্য খরিদ করে, ও তাহার মূল্যস্বরূপ উঁহারা সেই পাঁচশত টাকার নোট প্রদান করে। ধান্যের মহাজন সেই নোট অপরকে প্রদান করেন, সে পুনরায় উহা আর এক ব্যক্তিকে প্রদান করেন। এইরূপে ক্রমে সেই নোট বেঙ্গল ব্যাঙ্কে আসিয়া উপস্থিত হয়। বেঙ্গল ব্যাঙ্ক হইতে সেই নোট করেসি আফিসে পাঠাইয়া দেওয়া হয়। করেসি অফিসের হস্তে সেই নোট গিয়া উপস্থিত হইলে, তাঁহারা জানিতে পারেন, সেই নোট পূৰ্বে অপহৃত হইয়াছিল। সুতরাং তাঁহারা পুলিসে এই সংবাদ প্রদান করেন, এবং সেই সময় হইতে ইহার অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। অনুসন্ধানের ভার আমার হস্তে পতিত হইলে, আমি ইহার সমস্ত ব্যাপার অবগত হইতে পারি; কিন্তু কোন্ কোন্ ব্যক্তি যে ধান্য খরিদ করিয়া লইয়া গিযাছে, তাহার কিছুমাত্র স্থির করিতে না পারিয়া, অত টাকার ধান্য যে কোথায় গেল, তাহারই অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। পরে জানিতে পারিলাম, পূৰ্ব্ব-কথিত আড়তদারের আড়ত হইতে ধান্য সকল প্রথমতঃ বাহির করিয়া একখানি নৌকা মেটিয়াব্রুজের নিকট লইয়া গিয়া, অপর দুইখানি পাসিতে সেই সকল ধান্য পাল্টাইয়া লওয়া হয়, এবং সেই স্থান হইতে বড় নৌকাখানিকে বিদায় করিয়া দেওয়া হয়। জুয়াচোরগণ সেই ধান্য গুলি সেই ছোট নৌকা দুইখানিতে করিয়া রাজগঞ্জের বাজারে লইয়া যায়। সেই স্থানে সেই সকল ধান্য অল্প মূল্যে বিক্রয় পূৰ্ব্বক যতদূর সম্ভব অর্থ সংগ্রহ করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করে।
আমিও সন্ধানে সন্ধানে ক্রমে রাজগঞ্জের বাজারে গিয়া উপ স্থিত হই, এবং সেই স্থানে অনুসন্ধান করিয়া, এই সমস্ত বিষয় অবগত হইতে পারি। যে সকল ব্যক্তি সেই ধান্য ক্রয় করিয়াছিল, তাহাদিগের অনেককে খুঁজিয়া বাহির করিয়া, পরিশেষে জুয়াচোর গণের অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই। এই অনুসন্ধান উপলক্ষে পাঁচ সাতদিবস আমাকে রাজগঞ্জের বাজারে অবস্থিতি করিতে হয়।
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ।
রাজগঞ্জের বাজারের মধ্যে একটা দোকানে আমার বাসা। অবশ্য সেই সময়ে অনেকেই অবগত নহেন যে, আমি পুলিস কর্ম্মচারী। কারণ, সেই সময় পুলিসের পরিচ্ছদাদি কিছুই আমার সহিত ছিল না, বা আমিও পুলিসকর্ম্মচারী বলিয়া কাহারও নিকট আমার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলাম না।
একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি সেই দোকানে বসিয়া আছি, এমন সময় একটী স্ত্রীলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল, এবং সেই দোকান হইতে কিছু দ্রব্যাদি খরিদ করিবার মানসে সেই স্থানে উপবেশন করিল। কিয়ৎক্ষণ পরে আর একটী স্ত্রীলোক আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল ও পূৰ্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকটীকে দেখিয়া তাহার নিকট আসিয়া উপবেশন করিল, এবং উভয়ে নানারূপ গল্প করিতে আরম্ভ করিল। তাহাদিগের কথাবার্তার ভাবে অনুমান হইল, উঁহারা উভয়েই নিকটবর্তী কোন গ্রামে বাস করে, এবং দ্রব্যাদি খরিদ করিবার নিমিত্ত উভয়েই, সেই বাজারে আগমন করিয়াছে।
উভয়ের মধ্যে সেই স্থানে নানারূপ গল্প আরম্ভ হইল। নিজের কথা, সংসারের কথা, গ্রামের কথা প্রভৃতি কত কথার যে অব তারণা ও আলোচনা হইল, তাহার সংখ্যা নাই। সেই সকল কথা বাৰ্তার বিবরণ এই স্থানে লিপিবদ্ধ করা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু আমার আবশ্যক যে দুই চারিটী কথা আমি জানিতে পারিলাম, তাহারই সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই স্থানে প্রদত্ত হইতেছে মাত্র।
১ম স্ত্রীলোক। কেমন ভাই উহার মা বাপ, তাহার কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এরূপ শিশুসন্তানের নিমিত্ত কেহ এক বার অনুসন্ধান ও করিল না!
২য় স্ত্রীলোক। আমিও তাই দেখিতেছি; কিন্তু ভাই বালকটীর চেহারা দেখিয়া বোধ হয়, সে যেন কোন বড় ঘরের সন্তান।
১ম স্ত্রীলোক। চেহারা সেইরূপই বটে।
২য় স্ত্রীলোক। আচ্ছা ভাই! ও কিরূপে সেই বালকটা পাইল?
১ম স্ত্রীলোক। তাহা ঠিক করিয়া সে কিছু বলে না। কখন বলে, সে রাস্তায় পড়িয়াছিল, সেইখানে উহাকে পাইয়াছে; কখন বলে, উহার মা বাপ নিতান্ত দরিদ্র বলিয়া, তাহাকে প্রতিপালন করিতে অসমর্থ, তাই তাঁহারা উহাকে অর্পণ করিয়া উহার নিকট হইতে কিছু অর্থ গ্রহণ করিয়াছে; কখন বলে, সে তাহার কোন আত্মীয়ের পুল, উহাকে প্রতিপালন করিবার নিমিত্ত সেই আত্মীয় তাহাকে প্রদান করিয়াছে। এইরূপে উহার মনে যখন যেরূপ কথার উদয় হইতেছে, তখনই সে সেইরূপ বলিতেছে। প্রকৃত কথা যে কি, তাহা কিন্তু কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারা যাইতেছে না।
২য় স্ত্রীলোক। আমরা যতদূর অবগত আছি, তাহাতে জানি যে, উহার এরূপ কোন আত্মীয় নাই যে, সে তাহার পুত্রের প্রতি পালনের ভার উহার উপর ন্যস্ত করিতে পারে, বা উহার এরূপ সঙ্গতিও নাই যে, তাহার দ্বারা সে এই বালকটীকে ক্রয় করিয়া লইয়া নিজে উহাকে প্রতিপালন করিতে সমর্থ হয়।
১ম স্ত্রীলোক। আমারও বিশ্বাস তাহাই। আমিও ভাই ইহার কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথাগুলি শ্রবণ করিয়া আমার মনে জাহাজে পরিত্যক্ত সেই বালকের কথা উদয় হইল। আমি তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, হ্যাঁ গা! তোমরা কোন্ বালকের কথা বলিতেছ?
১ম স্ত্রীলোক। আমাদিগের গ্রামের একটী স্ত্রীলোক একটা বালক পাইয়াছে, তাহারই কথা বলিতেছি।
আমি। যে বালকটী পাইয়াছে, তাহার নাম কি গা?
১ম স্ত্রীলোক। তাহার নাম সোনা।
আমি। সোনা সেই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছে, তাহা কিছু বলিতে পার কি?
১ম স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আপনি সেই বালকটীর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
আমি। আমার একটী বালক হারাইয়া গিয়াছে, তাই আমি জিজ্ঞাসা করিতেছি।
১ম স্ত্রীলোক। আপনার ব্রলকটী কোথা হইতে হারাইয়া গিয়াছে?
আমি। সে আমার সহিত এই স্থানেই আসিয়াছিল, সেই সময় গোলমালে যে কোথায় চলিয়া গিয়াছে, তাহার কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারি নাই। অনেক স্থানে আমি তাহার অনু সন্ধান করিয়াছি, কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার সন্ধান করিয়া উঠিতে পারি নাই। এখন তোমাদের কথা শুনিয়া মনে আশা হইতেছে। তোমাদিগের সন্ধান মতে আমি যদি সেই বালকটীকে পাইতে পারি, তাহা হইলে আমি তোমাদিগকে একশত টাকা পারি তোষিক দিতে প্রস্তুত আছি।
২য় স্ত্রীলোক। সেই বালকটাকে যদি আমরা দেখাইয়া দিতে পারি, তাহা হইলে আমাদিগকে একশত টাকা আপনি প্রদান করিবেন?
আমি। সেই বালকটী যদি তোমরা আমাকে দেখাইয়া দেও, তাহা হইলেই যে আমি একশত টাকা প্রদান করিব, তা নয়। সেই বালকটা যদি আমার হয়, তাহা হইলে তৎক্ষ ২ জাম তোমাদিগকে একশত টাকা প্রদান করিব।
১ম স্ত্রীলোক। আর যদি সেই বালকটী আপনার ন, তাহা হইলে আমরা কি কিছুই পাইব না?
আমি। তোম যে একবারেই কিছু পাইবে না, তাহা আমি বলিতে পারি না। যদি সেই বালকটী আমার হয়, তাহা হইলে তোমাদিগকে একশত টাকা নিশ্চয়ই প্রান করিব। আর যদি সেই বালকটা আমার না-ও হয়, তাহা হইলেও সেই বালকটাকে দেখাইয়া দিবার নিমিত্ত আমি তোমাদিগকে পাঁচ টাকা করিয়া প্রদান করিতেছি।
এই বলিয়া আমি উভয় স্ত্রীলোকের হস্তে পাঁচ টাকা প্রদান করিলাম। বিনা-পরিশ্রমে পাঁচ টাকা পাইয়া তাঁহারা অতিশয় সন্তুষ্ট হইল ও কহিল, আপনি সেই বালকটীকে দেখিবার নিমিত্ত কোন্ সময় গমন করিবেন?
আমি। যখন বলিবে, আমি সেই সময়ই গমন করিব। এখনই আমি তোমাদিগের সহিত গমন করিতে প্রস্তুত আছি।
স্ত্রীলোকদ্বয়। সে-ই উত্তম; আপনি এখনই আমাদিগের সহিত আগমন করুন। আমরা এখনই সেই বালকটীকে, এবং যে সেই বালকটীকে আনিয়াছে, তাহাকে, দেখাইয়া দিতেছি।
স্ত্রীলোকদ্বয়ের কথা শুনিয়া আমি আর কোনরূপ দ্বিরুক্তি করিলাম না। কেবলমাত্র একটী লোক সমভিব্যাহারে তাহা দিগের সহিত তখনই প্রস্থান করিলাম।
বাজার হইতে বহির্গত হইয়া একটী ময়দান দেখিলাম। সেই ময়দানের মধ্য দিয়া এক ক্রোশ পথ গমন করিবার পর, একখানি গ্রাম দেখিতে পাইলাম। সেই গ্রাম অতিক্রম করিয়া অপর আর একখানি গ্রামে উপস্থিত হইলে সেই স্ত্রীলোক আমাকে কহিল, এই গ্রামেই সেই স্ত্রীলোকের বাস। আরও কহিল, আপনারা এই স্থানে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা গিয়া দেখিয়া আসি, সেই স্ত্রীলোকটা এখন বাড়ীতে আছে কি না, এবং সেই বালকটীই বা এখন কোথায়। তাহাদিগের প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম, উঁহারা উভয়েই সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। অতি অল্প ক্ষণ পরেই উঁহাদিগের একজন প্রত্যাবর্তন করিয়া কহিল, আসুন মহাশয়! আমার সহিত আসুন, সেই স্ত্রীলোকটী এবং বালকটী এখন বাড়ীতেই আছে। আমি তাহাদিগকে স্বচক্ষে দেখিয়া আসিয়াছি, ও আমার সমভিব্যাহারী সেই স্ত্রীলোকটীকে আমি সেই স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি।
আমি তাহার কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহার নির্দেশমত তাহার সহিত গমন করিলাম। কিয়দ্দূর গিয়া সে আমাকে একখানি সামান্য খড়ের ঘর দেখাইয়া দিয়া কহিল, ইহাই সেই স্ত্রীলোকটীর বাড়ী, এবং এই বাড়ীতে সেই বালকটীও আছে। আপনি এখন এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলেই সেই বালকটীকে দেখিতে পা ইবেন। তখন আপনি জানিতে পারিবেন যে, সেই বালকটী আপনার কি না।
সেই স্ত্রীলোকটীর কথা শুনিয়া আমি আস্তে আস্তে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, একটী স্ত্রীলোক একটী বালককে ক্রোড়ে করিয়া তাহার ঘরের দাওয়ায় বসিয়া আছে। তাহার সম্মুখে, আমার সহিত যে স্ত্রীলোকদ্বয় গমন করিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে অপর স্ত্রীলোকটী বসিয়া তাহার সহিত গল্প করিতেছে।
আমি ও আমার সমভিব্যাহারী লোকটী একবারে সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলে, আমাদিগকে দেখিয়া সেই স্ত্রীলোকটী যেন একটু ভীত হইল।
আমি দেখিলাম, যে বালকটী উহার নিকট রহিয়াছে, তাহার আকৃতি প্রকৃতি সমস্তই সেই জাহাজে-ভুল-ক্রমে পরিত্যক্ত বালকের সদৃশ। এক কথায় আমি বেশ বুঝিতে পারিলাম, এই বালকটাই কলিকাতার সেই বড়লোকটীর পুত্র।
সেই স্ত্রীলোক কোন কথা বলিতে না বলিতেই আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, এ বালকটীকে তুমি কোথায় পাইলে?
স্ত্রীলোক। ইটি আমার পুত্র।
আমি। তোমার নিজের সন্তান?
স্ত্রীলোক। না, আমার নিজের সন্তান নহে; আমার ভগিনীর সন্তান। কিন্তু যখন আমি উহাকে প্রতিপালন করিতেছি, তখন আমারই সন্তান নয় ত কি?
আমি। আমি ওসকল মিথ্যা কথা শুনিতে চাহি না। তুমি জান আমি কে? তোমাকে আমি পূৰ্বেই সতর্ক করিয়া দিতেছি, তুমি মিথ্যা কথা কহিও না। মিথ্যা বলিলে তোমার সবিশেষরূপ অনিষ্ট ভিন্ন কখনই ইষ্ট হইবার সম্ভাবনা নাই। আমি পুর্বে সকল কথা জানিতে পারিয়াছি, তাঁহার পর তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। প্রকৃত কথা না বলিলে, আমি তোমাকে ধরিয়া লইয়া যাইব।
স্ত্রীলোক। আপনি কে?
আমি। আমি পুলিস-কর্ম্মচারী। তুমি এই বালকটীকে অপ হরণ করিয়া লইয়া আসিয়াছ। তোমার নামে বালক-চুরির নালিশ হইয়াছে, তাই আমি তাহার অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছি, এবং মাল, আসামী, উভয়ই পাইয়াছি। এখন তুমি আমার নিকট প্রকৃত কথা বলিবে কি?
স্ত্রীলোক। আমি প্রকৃতই বলিতেছি, আমি এই বালককে চুরি করিয়া আনি নাই।
আমি। যদি চুরি করিয়া না আনিলে, তাহা হইলে তুমি ইহাকে পাইলে কোথায়?
স্ত্রীলোক। কোন স্থানে পড়িয়াছিল, দেথিয়া আমি উহাকে উঠাইয়া আনিয়া যত্নে প্রতিপালন করিতেছি। আমি চুরি করিয়া আনিব কেন?
আমি। যদি তুমি ইহাকে অপহরণ করিয়া আন নাই, তাহা হইলে ইহার পিতামাতার নিকট তুমি ইহাকে লইয়া যাও নাই কেন?
স্ত্রীলোক। আমি জানি না উহার পিতামাতা কে?
আমি। থানায় গিয়া ইহাকে জমা দেও নাই কেন?
স্ত্রীলোক। বালক পাইলে যে থানায় গিয়া জমা দিতে হয়, তাহা আমি জানি না। আমি মনে করিয়াছিলাম, যাহার বালক, সে আসিয়া লইয়া যাইবে।
আমি। এই বালকটী পড়িয়াছিল, আর তুমি যে ইহাকে পাইয়াছ, এই কথা কাহাকেও বলিয়াছ?
স্ত্রীলোক। না।
আমি। কেন বল নাই?
স্ত্রীলোক। ভয়ে বলি নাই।
আমি। তুমি এই বালকটীকে কোথায় পাইয়াছিলে?
স্ত্রীলোক। যে স্থানে পাইয়াছিলাম, সেই স্থানের নাম আমি অবগত নহি। আমার সহিত চলুন, আমি দেখাইয়া দিব।
আমি। কোন্ স্থানে পড়িয়াছিল?
স্ত্রীলোক। একটী ময়দানের মধ্যে।
আমি। মিথ্যা কথা। তুমি ইহাকে ময়দানের মধ্যে পাইয়াছ, তাহা আর কে অবগত আছে?
স্ত্রীলোক। আর কেহই জানে না।
আমি। এখন আর মিথ্যা কথা বলিও না। কোন একখানি জাহাজের মধ্য হইতে তুমি ইহাকে উঠাইয়া আনিয়াছ, আর এখন মিথ্যা করিয়া বলিতেছ, একটী ময়দানে এ পড়িয়াছিল।
স্ত্রীলোক। না, আমি জাহাজ হইতে আনি নাই। আমি জাহাজে কি করিতে যাইব?
আমি। ইহার অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, সেই সকল অলঙ্কার কোথায়?
স্ত্রীলোক। ইহার অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না।
আমি। আমি তোমাকে এখনও সতর্ক করিয়া দিতেছি যে, তুমি এখনও প্রকৃত কথা বল। অলঙ্কারের সহিত তুমি ইয়াকে জাহাজ হইতে আনিয়াছ কি না?
স্ত্রীলোক। না মহাশয়! আমি ইহাকে জাহাজ হইতে আনি নাই।
আমি। আমি এখনই তোমার ঘর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিব। তোমার ঘর হইতে যদি কোন অলঙ্কার বাহির হয়, তাহা হইলে তুমি জানি যে, কোনরূপেই তোমার নিষ্কৃতি নাই।
স্ত্রীলোক। অনায়াসেই আপনি আমার ঘর অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে পারেন।
স্ত্রীলোকের শেষ কথাটী শুনিয়া আমার মনে একটু সন্দেহ হইল। একবার ভাবিলাম, হয় ত প্রকৃতই এ অলঙ্কারের সহিত জাহাজ হইতে এই বালকটীকে আনয়ন করে নাই। অপর কোন ব্যক্তি জাহাজ হইতে ইহাকে আনিয়া উহার অঙ্গ হইতে অলঙ্কার গুলি অপহরণ করিয়া ইহাকে কোন স্থানে নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। পরিশেষে এই স্ত্রীলোকটী ইহাকে সেই অবস্থায় দেখিতে পাইয়া উঠাইয়া আনিয়াছে।
মনে মনে এইরূপ একবার ভাবিলাম সত্য; কিন্তু উহার কথায় আমি একবারে বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। উহার ঘরের ভিতর প্রবেশ করিয়া উহার ঘর অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হইলাম।
সেই স্ত্রীলোকটী যখন দেখিল যে, আমি উহার ঘর অনু সন্ধান করিতে কোনরূপেই নিবৃত্ত হইলাম না, তখন সে আমার দুইখানি পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, আমি প্রকৃত কথা বলিতেছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আর মিথ্যা কথা বলিব না, আমি জাহাজ হইতে ইহাকে আনয়ন করিয়াছি।
আমি। অলঙ্কারগুলি?
স্ত্রীলোক। আমার ঘরে আছে।
আমি। বাহির করিয়া আন।
আমার কথা শুনিয়া সেই স্ত্রীলোকটী আপন ঘরের ভিতর প্রবেশ করিল ও মৃত্তিকা নির্মিত একটী পুরাতন হাঁড়ির মধ্য হইতে কতকগুলি মূল্যবান্ অলঙ্কার বাহির করিয়া আনিয়া আমার হস্তে প্রদান করিল। সেই বালকের অঙ্গে যে সকল অলঙ্কার ছিল, তাহার একটা তালিকা তাহার পিতা পূৰ্বেই আমাকে প্রদান করিয়াছিলেন, এবং তালিকার নকল আমার পকেট বহিতে লেখা ছিল। তাহার সহিত আমি গহনাগুলি মিলাইয়া দেখিলাম। দেখিলাম, কেবলমাত্র একখানি ছোট গহনা ব্যতীত আর সমস্ত গুলিই উহাতে আছে। সেই গহনাখানির কথা জিজ্ঞাসা করায়, সে কহিল, ওই গহনাখানি উহার অঙ্গে ছিল না, আমি উহা পাই নাই। যখন আমি সমস্ত গহনাই বাহির করিয়া দিতে পারিলাম, তখন সেই সামান্য গহনাখানি লইয়া আমি কি করিব?
সেই স্ত্রীলোকের এ কথা কিন্তু আমি বিশ্বাস করিলাম না। আমার মনে সন্দেহ হইল, সেই ছোট গহনাখানি সে কোথায় বিক্রয় করিয়া তাহার দ্বারা নিজের ও বালকের আহারের খরচের সংস্থান করিতেছে। সুতরাং সেই সামান্য একখানি গহনার নিমিত্ত আমি তাহাকে লইয়া আর সবিশেষ পীড়াপীড়ি করিলাম না। গহনা গুলি ও বালকটীকে সঙ্গে লইয়া আমি পূর্ব-কথিত সেই বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যে দুইটী স্ত্রীলোকের নিকট হইতে আমি এই সন্ধান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম, যাইবার সময় তাহাদিগকে বলিয়া গেলাম যে, তৎপরদিবস বৈকালে তাঁহারা যেন আমার সহিত সেই বাজারে সাক্ষাৎ করে। সেই সময় তাহাদিগের প্রাপ্য পারিতোষিকের টাকা তাহাদিগকে প্রদান করিব। উঁহারা আমার কথায় বিশ্বাস করিয়া সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। আমিও সেই স্থান হইতে বালক, অলঙ্কার প্রভৃতি লইয়া বাজারে গিয়া উপস্থিত হইলাম। বাজারে পৌঁহুছিয়া সেই বালকের পিতা সেই বড় মানুষটীকে তথায় আনিবার নিমিত্ত দ্রুতগতি একটী লোক পাঠাইয়া দিলাম।
পরদিবস অতি প্রত্যূষেই বালকের পিতা লোকজনের সহিত তোয় আসিয়া উপস্থিত হইলেন, এবং বালকটীকে দেখিয়াই ক্ৰন্দন করিয়া ফেলিলেন। পূৰ্ব্ব-কথিত স্ত্রীলোকদ্বয়কে আমি যে পারিতোষক প্রদান করিতে স্বীকার করিয়াছিল, তাহা তাঁহার নিকট বলিবা মাত্র তিনি সেই টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। পূর্বদিনের কথামত বৈকালে সেই স্ত্রীলোকদ্বয় আগমন করিলে, আমি সেই অর্থ তাহাদিগকে প্রদান করিলাম। বালকের পিতা উভয়কে আরও পঞ্চাশ টাকা প্রদান করিলেন, এবং বে স্ত্রীলোকটীর নিকট হইতে বালকটী ও গহনাগুলি পাওয়া গিয়াছিল, তাহার পারিতোধিক স্বরূপ তিনি দুইশত টাকা আমার হস্তে প্রদান করিলেন। কিন্তু আমি কহিলাম, এই স্ত্রীলোকটী যে অপরাধ করিয়াছে, তাহার নিমিত্ত ইহার দণ্ড হইবে, কি ইহাকে পারি তোযিক প্রদান করা যাইবে? উত্তরে তিনি কহিলেন, ও যে অপরাধ করিয়াছে, আইনে তাহার দও থাকিলে, উহার দণ্ড হওয়া উচিত; কিন্তু আমার পুত্রীকে যে জীবিত অবস্থায় রাখিয়া এ পর্যন্ত উহাকে খাওয়াইয়াছে, পরাইয়াছে, তাহার নিমিত্ত উহাকে দুইশত টাকা পারিতোষিক প্রদান করিতেছি।
তাঁহার নিকট হইতে আমি সেই দুইশত টাকা গ্রহণ করি লাম সত্য; কিন্তু এরূপ অবস্থায় আমার সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর আদেশ ব্যতীত আমি তাহাকে অব্যাহতি প্রদান করিতে সাহসী হইলাম না।
যে একখানি সামান্য অলঙ্কার পাওয়া গেল না, বালকের পিতামাতা, চাকর-চাকরাণী প্রভৃতি কেহই স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না, যে সময় ভুল-ক্রমে বালকটীকে পরিত্যাগ করা হইয়া ছিল, সেই সময় সেই অলঙ্কারখানি তাহার অঙ্গে ছিল কি না?
কিরূপে সেই স্ত্রীলোকটী বালককে পাইল, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায় সে কহিল যে, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে দুই তিনদিবস পূর্বে সে উলুবেড়িয়ায় গমন করিয়াছিল। সেই স্থান হইতে প্রত্যা বৰ্তন করিবার সময় যে জাহাজ হইতে বড়লোকটী সপরিবারে উলুবেড়িয়ায় অবতরণ করেন, সে উলুবেড়িয়া হইতে সেই জাহাজে উঠিয়া আপনার গ্রামে আগমন করিতেছিল। জাহাজে উঠিয়া যে কামরায় ওই বালকটী ছিল, সে সেই দিকে গমন করে, এবং দেখিতে পায়, সেই কামরায় একখানি বেঞ্চের উপর ওই বালকটিী অলঙ্কার-ভূষিত হইয়া নিদ্রিত রহিয়াছে। বালকটীর এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, কিয়ৎক্ষণ সে সেই স্থানে অপেক্ষা করে; কিন্তু সেই স্থানে উহার কোন লোকজনকে দেখিতে না পাইয়া, ভুল-ক্রমে কেহ তাহাকে ফেলিয়া গিয়াছে, এই ভাবিয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে লইয়া যায়।
বালক, বালকের পিতা, অলঙ্কার ও সেই স্ত্রীলোকটীকে লইয়া আমি কলিকাতায় আসিলাম, এবং আমার সর্বপ্রধান কর্ম্মচারীর নিকট উপস্থিত হইয়া তাহাকে সকল কথা বললাম। সেই স্ত্রীলোকের উপর মোকদ্দমা চালান যাইতে পারে, আইনে এরূপ কোন বিধান না পাওয়ায়, তাহাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল, এবং বালকের পিতার ইচ্ছানুযায়ী প্রদত্ত পূৰ্ব্ব-কথিত দুইশত টাকাও তাহাকে প্রদান করা হইল। সে হাসিতে হাসিতে আপন গৃহাভি মুখে প্রস্থান করিল।
বলা বাহুল্য যে, এই বালকের অনুসন্ধানের নিমিত্ত আমিও আমার সমস্ত খরচ-পত্রাদি ও উপযুক্ত পারিতোষিক যথাসময়ে প্রাপ্ত হইয়াছিলাম।
। সম্পূর্ণ ।