নোমাজি চোর
বৃদ্ধ গোলাম রহমানের বয়ঃক্রম এখন ষাট বৎসর উত্তীর্ণ হইয়াছে। লম্বা লম্বা দাড়িগুচ্ছ পরিষ্কার সাদা রং ধারণ করিয়াছে। এই ষাট বৎসরের মধ্যে কত বৎসর সে যে জেলের ভিতর বাস করিয়াছে, এখন তাহার হিসাব করিয়া লওয়া নিতান্ত সহজ নহে। জেলের কঠোর পরিশ্রমের সহিত বৃদ্ধাবস্থা সম্মিলিত হওয়ায়, ইহার শরীর কৃশ, মেরুদণ্ড বক্র ও হস্তপদ ক্রমে দুৰ্ব্বল হইয়া আসিয়াছে। যষ্টি সাহায্য ভিন্ন এখন আর তাহার চলিবার উপায় নাই। এই বৃদ্ধ বয়সেও কিন্তু গোলাম রহমান তাহার চির-অভ্যস্ত স্বভাবের কিছুমাত্র পরিবর্তন করিতে সমর্থ হয় নাই।
গোলাম রহমান আজকাল অসমর্থ বৃদ্ধ হইয়াও, প্রকাশ রূপে ধর্ম্মের সবিশেষ ভান করিয়া আপনার চিরাভ্যস্ত দুষ্কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়া, সেইরূপ অসদ উপায়ে উপার্জিত অর্থে আপনার জীবনধারণ করিতেছে।
গোলাম রহমান জাতিতে মুসলমান, তাহাতে অতিশয় বৃদ্ধ। সুতরাং সর্ব্বসমক্ষেও প্রকাশ্যরূপে নোমাজ করিয়া, লোক ভুলাইবার একটি নূতন উপায়, ইহা হইতেই এই সহরে আবিষ্কৃত হইয়াছে। যেখানে দশজন মুসলমান দেখিতে পায়, যেখানে একটু খালি স্থান তাহার নয়নগোচর হয়, নোমাজের সময় হউক, আর না হউক, কাছা খুলিয়া সেই স্থানেই নোমাজ করিতে বসিয়া যায়। কিন্তু ইহার নোমাজের উদ্দেশ্য যে অন্যতর, এ কথা আমি পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি। বাস্তবিক ধৰ্ম্ম-কৰ্ম্ম সাধন করা দূরে থাক, চুরি করিবার পথ প্রশস্ত করাই তাহার এই নোমাজের প্রধান উদ্দেশ্য। সকল কাৰ্য্য নিজ হস্তে সম্পন্ন করিবার ক্ষমতা এখন আর তাহার নাই। বার্দ্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে তাহার পূর্ব্ব সামর্থ্য এখন তাহার ক্রমেই অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে। চুরি করিতে হইলে বেশ সাহস ও পরাক্রমের আবশ্যক, তাহার কিছুই আর এখন বলতে নাই, অন্যের সাহায্য ব্যতীত এখন আর সে কোন কার্য্যই করিয়া উঠিতে পারে না। সুতরাং আন্তরিক ইচ্ছা না থাকিলেও, অন্যান্য লোকের সাহায্য তাহাকে গ্রহণ করিতে হইয়াছে। বাছিয়া বাছিয়া তাহার মনের মত সাকরেদ নিযুক্ত করিয়া, এখন তাহাদিগের উপর সম্পূর্ণরূপ নির্ভর করিতে হইয়াছে।
বৃদ্ধ বয়সে ওস্তাদ গোলাম রহমান সবিশেষ রূপ ধর্ম্মের ভান করিয়া সারেদের (শিষ্যের বা ছাত্রের) সাহায্যে কিরূপ জুয়াচুরি করিতে আরম্ভ করিয়াছে, এই স্থানে তাহার একটিমাত্র দৃষ্টান্ত দিলেই, পাঠকগণ অনায়াসেই বুঝিতে পারিবেন যে, এই গোলাম রহমান কিরূপ চরিত্রের লোক।
গ্রীষ্মকাল, বেলা অপরাহ্ণ হইয়া আসিয়াছে, মুসলমানদিগের সায়ংকালীন নোমাজের সময় প্রায় নিকটবর্ত্তী হইয়া আসিয়াছে। এমন সময় গোলাম রহমান পরিষ্কার সাদা পা-জামা ও চাপকান পরিধান করিয়া, মস্তকে একটি সাদা টুপি দিয়া, একগাছি যষ্টি হস্তে আপনার সাদে সমভিব্যাহারে হাবড়া রেলওয়ে ষ্টেশনের সন্নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহারা সেই স্থানে গমন করিবার কিয়ৎক্ষণ পরেই ষ্টেশনের ভিতর হইতে ঘণ্টাধ্বনি উত্থিত হইল। সেই ঘণ্টাধ্বনি শ্রবণ করিয়া সে বুঝিতে পারিল যে, পশ্চিমপ্রদেশ হইতে যে ট্রেণ সায়ংকালে আগমন করে, সেই ট্রেণ নিকটবৰ্ত্তী হইয়াছে। দেখিতে দেখিতে ট্রেণ আসিয়া ষ্টেশনে উপস্থিত হইল। আরোহীগণও ক্রমে ট্রেণ গাড়ির ভিতর হইতে বাহির আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল।
গোলাম রহমান দেখিল, যাত্রীগণ ষ্টেশনের ভিতর হইতে ক্রমে ক্রমে বাহিরে আসিতে আরম্ভ করিয়াছে, অমনি সে ষ্টেশনের সন্নিকটবর্ত্তী ভাগীরথীর কূলে, অথচ যে রাস্তা দিয়া যাত্রীগণ গমন করিবে, সেই রাস্তার পার্শ্বে, একখানি কাপড় বিছাইয়া নোমাজ করিতে বসিল।
ষ্টেশনে গাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলে আরোহীগণ গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল, এবং ক্রমে আপনাপন গন্তব্য স্থানে প্রস্থান করিতে লাগিল।
সেই যাত্রীগণের মধ্যে যে সকল মুসলমান “নোমাজি” যাত্রী ছিল, তাহারা তাহাদিগের সায়ংকালীন নোমাজের সময় উপস্থিত হইয়াছে দেখিয়া, তদুপযোগী স্থানের নিমিত্ত এদিক ওদিক দেখিতে লাগিল। দেখিল, ষ্টেশনের সন্নিকটে, অথচ ভাগীরথী তীরে একটি প্রবীণ মুসলমান নোমাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। ইহা দেখিয়া নোমাজ-অভিলাষী মুসলমানগণ ক্রমে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল।
মুসলমানগণের মধ্যে এইরূপ নিয়ম প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় যে, এক স্থানে যদি কেহ নোমাজ করিতে আরম্ভ করেন, তাহা হইলে সেই স্থানের উপস্থিত মুসলমান মাত্রেই সেই নোমাজকারীর নিকট গমন করিয়া একত্র নোমাজ করিতে আরম্ভ করেন। সেই ব্যক্তি যদি সম্পূর্ণরূপেও তাহাদিগের নিকট অপরিচিত হন, তাহা হইলেও তাঁহারা তাঁহার নিকট নোমাজ উপলক্ষে গমন করিতে কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হন না।
যেস্থানে গোলাম রহমান নোমাজ করতে প্রবৃত্ত হইয়াছিল, নোমাজকরণার্থী মুসলমান যাত্রীগণ সেই স্থানে গমন করিয়া তাহাদিগের সঙ্গের দ্রব্য সামগ্রী সেই স্থানে রাখিয়া সকলেই গঙ্গাজলে “ওজু” করিলেন, এবং একে একে সকলেই গোলাম রহমানের নিকট উপস্থিত হইয়া কেহবা তাহার দক্ষিণে, কেহবা বামে এবং কেহবা পশ্চাতে দণ্ডায়মান হইয়া আপনাপন সায়ংকালীন প্রার্থনায় নিযুক্ত হইলেন।
গোলাম রহমান বিলক্ষণ বুঝিয়াছিল যে, এইরূপ ট্রেণে আগত বা প্রত্যাগত ব্যক্তিমাত্রেরই নিকটে, তৈজসপত্রাদি, কিম্বা অল্প মূল্য বা বহুমূল্য বস্ত্রাদি, অথবা অলঙ্কার বা মুদ্রাদি, কোন না কোন পদার্থ থাকিবেই থাকিবে; সুতরাং সে এক স্থানে এককালে সামান্য চেষ্টায় বহুতর উপার্জ্জন করিতে সমর্থ হইবে। বিশেষতঃ সেই গাড়ি খানি বহুদূর পশ্চিমপ্রদেশ হইতে আসিতেছিল। সুতরাং ইহার আরোহীগণের অধিকাংশের সহিতই নানাপ্রকার দ্রব্যাদি ছিল। দূরদর্শী অভিজ্ঞ চতুর বৃদ্ধ ‘ঝোপ বুঝিয়াই কোপ’ মারিয়াছিল। চৌর্য্য-নিপুণ সাকরেদগণের কার্য্য-কৌশলের দ্বারা “কাজ হাসিলও” হইয়া গেল।
যে সময় যাত্রীগণ একমনে ঈশ্বর উপাসনায় নিযুক্ত, সেই সময় গোলাম রহমানের সাকরেদগণও তাহাদিগের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিবার উপযুক্ত সুযোগ প্রাপ্ত হইল। তখন সেই সকল নোমাজি মুসলমানগণের “ব্যাগ বোঁচকা” প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য সেই স্থানে রক্ষিত ছিল, সতর্ক সারেদগণ সুবিধামত সেই সকল দ্রব্যাদি গ্রহণ করিয়াছে একে একে দ্রুতপদে যাত্রীস্রোতের ভিতর গিয়া মিলিত হইল, এবং সেই সব দ্রব্যাদি রাখিবার নিমিত্ত পূর্ব্বে যে স্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল, সেই স্থানে সেই সকল দ্রব্যাদি রাখিয়া পুনরায় সেই নোমাজের স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। নোমাজকারীগণ নোমাজ সমাপনান্তে যখন সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল, তখন দেখিল যে, তাহাদিগের ব্যাগ বোঁচকা প্রভৃতি কিছুই নাই। তখন তাহারা নিতান্ত দুঃখিত হৃদয়ে আপন আপন দ্রব্যাদির অনুসন্ধান করিতে লাগিল। গোলাম রহমান ও তাহার সাকরেদগণও তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া, সেই সকল দ্রব্যাদি যাহাতে পাওয়া যায়, এইরূপ ভান করিয়া, তাহাদিগের সহিত অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইল। কিন্তু অনুসন্ধান মাত্রই হইল, কাৰ্যে সেই সকল দ্রব্যের কোন সন্ধান হইল না, বা কোন্ ব্যক্তি দ্বারা সেই সকল দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, তাহারও কোন সন্ধান যাত্রীগণ জানিতে পারিল না। তখন যাত্রীগণ আপনাপন বুদ্ধির উপর দোষারোপ করিতে করিতে ভগ্নমনে সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিল। বলা বাহুল্য, যাত্রীগণ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলে পর, গোলাম রহমান আপন সাকরেদগণের সহিত মিলিত হইয়া, যে স্থানে সেই সকল অপহৃত দ্রব্য রক্ষিত ছিল, সেই স্থানে গমন করিল। সেই স্থানে যে সকল দ্রব্যাদি লুক্কায়িত ছিল, তাহা বাহির করিয়া, আপনাপন অংশমত বণ্টন করিয়া লইল। তৎপরে সকলে নিজ নিজ স্থানে প্রস্থান করিল।
এই উপায়ে কিছু দিবস আপন ব্যবসা চালাইতে চালাইতে, পরিশেষে গোলাম রহমান একবার ধৃত হয়, এবং কঠিন পরিশ্রমের সহিত তাহার দীর্ঘকাল কারাবাসের আদেশ হয়। কিন্তু সেই আদেশের পর তাহাকে আর অধিক দিবস কারা কষ্ট সহ্য করিতে হয় নাই। জেলের মধ্যেই সে মানবলীলা সাধন করে।
জুয়াচুরির এই নূতন কৌশল অবলম্বন করিয়া ইহার পর অনেকেই উক্তরূপে জুয়াচোর হইয়াছে বটে; কিন্তু তাহাদের কার্য-প্রণালী সকলেরই একরূপ। সুতরাং সে সকল পৃথক ভাবে উল্লেখ করিলে পাঠকগণের বিরক্তি উৎপাদন করিবে। অতএব উহার পুনরুল্লেখে বিরত রহিলাম।
সম্পূর্ণ
[ ভাদ্র, ১৩০৫ ]