আর্দালি পাঁচকড়ি খানের ঝাঁকিদর্শন – সম্পাদনা ও অনুবাদ: অরিন্দম দাশগুপ্ত
প্রথম সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৯
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: প্রবীর সেন
.
তর্জমা নিয়ে দু’-চার লব্জ
কোনও লেখক যখন ইচ্ছে করে নিজের নাম গোপন করেন তখন তিনি না চাইলে ছদ্মনামের পিছনে আসল মানুষটির সন্ধান মেলা বড়ই মুশকিল। কিন্তু বইটি মনোমতো হলে পাঠক তো লেখকের পরিচয় জানতে ব্যাকুল হয়ে উঠবেই! ছদ্মনাম থেকে প্রকৃত নাম উদ্ধারের কাজটা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে সময়ের ব্যবধানে। ঔপনিবেশিক ভারতে সরকারি দুর্নীতির কিস্সা মিয়াজান দারোগার একরারনামা ও মিয়া মিঠ্ঠু খানের জবানবন্দি এমনই দুটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় দলিল যার লেখকদের প্রকৃত পরিচয় আজও অজ্ঞাত। একই গোত্রের আরেকটি রচনা বর্তমান গ্রন্থ আর্দালি পাঁচকড়ি খান-এর ঝাঁকিদর্শন আমাদের জানা এ জাতীয় দুর্নীতি রোজনামচার মধ্যে সব থেকে আগে প্রকাশিত হলেও সৌভাগ্যক্রমে এটির লেখকের প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করা গেছে।
মফস্সলি আদালতের দুর্নীতির রসালো রোজনামচা The Revelations of An Orderly বা ঝাঁকিদর্শন যখন ১৮৪৯ সালে কিস্তিতে কিস্তিতে ‘বেনারস রেকর্ডার’-এ প্রকাশিত হয় তখন পাঠকমহলে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে কোনও তথ্য আমরা সংগ্রহ করতে পারিনি। ওই বছরই ১ সেপ্টেম্বর ‘বম্বে টাইমস’ একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে যার বিষয় ছিল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের অপদার্থতা। সরকারি অপদার্থতা আলোচনার পিছনে ঝাঁকিদর্শনের কতটা প্রভাব ছিল এ কথাও জোর দিয়ে বলার জায়গায় আমরা নেই। কিন্তু ১৮৫৮ সালে The Sepoy Revolt: Its Causes and Its Consequences শিরোনামে প্রকাশিত বইটি থেকে পাঁচকড়ি খান-এর আসল পরিচয় ও মর্মান্তিক পরিণতির কথা জানা যায়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ওই বইটির লেখক হেনরি মিড লিখছেন:
When the mutiny was complete an artillery subadar was made commander-in-chief of Rahilcund, and a rajah was found in the person of a retired company’s judge, Khan Bahadoor. This man, who was in receipt of a considerable pension turned to account, like the sepoys, the knowledge he had obtained whilst in the service of Government. He seized Messrs. Raikes and Robertson, the judges of Bereilly, and having tried them in due form, had them found guilty of heinous offences, and hung. The same fate was inflicted on Mr. Wyatt, the deputy collector, author of ‘Panch Kouri Khan’, the Indian Gil Blas, and upon many others.
পাঁচকড়ি খান কে তা জানার জন্য এই সূত্রটা পাওয়াই ছিল অসম্ভব জরুরি। এর সাহায্যে লেখককে খোঁজা আর চিহ্নিত করার কাজটা এরপর অনেক সহজ হয়ে যায়।
উনিশ শতকের গোড়ায় বেনারস শহরের শাসনভার পরিচালনার দৈনন্দিন দায়িত্ব সামলাত ভারতীয়রাই। ১৮৩৩ সালের পর ব্রিটিশ সরকার স্থির করল প্রশাসনের কর্তাদের মাইনে বাড়াবে। এর ফলে ইউরোপীয় ও ইউরেশীয়দেরও এইসব কাজে যোগ দেওয়ার আগ্রহ দেখা দিল। কাজে যাদের বহাল করা হল বিশেষ করে জেলার হাকিমদের তাদের গোড়ার দিকটা কেটে গেল শুধু রাজস্ব সংগ্রহের কাজ সামাল দিতে দিতেই। সরকারও যে এই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না এমনটা নয়। তারা তাই তৈরি করল ডেপুটি কালেক্টরের পদ। আশা করা হয়েছিল এতে করে কালেক্টরের কাজের বোঝা যেমন কমবে তেমন আবার তার সুযোগ হবে নিজের জেলাটা ঘুরে দেখে একটা ধারণা করার। আমাদের লেখক মিস্টার ওয়েট ওরফে পাঁচকড়ি খান ছিলেন তেমনই এক ডেপুটি কালেক্টর।
এই ডেপুটি কালেক্টর জর্জ ওয়েট সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন সমাজ বিজ্ঞানী বার্নার্ড এস কন। ১৯৬২ সালে ‘কম্প্যারেটিভ স্টাডিজ ইন সোসাইটি অ্যান্ড হিস্ট্রি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় বার্নার্ড কন-এর প্রবন্ধ; ‘দ্য ব্রিটিশ ইন বেনারস: এ নাইটিন্থ সেঞ্চুরি কলোনিয়াল সোসাইটি।’ ওই প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, জর্জ ওয়েট বলে একজন ইউরেশীয় ডেপুটি কালেক্টর ও ম্যাজিস্ট্রেট বেনারসে কার্যভার সামলেছিলেন ১৮৪১ থেকে ১৮৫৩ সাল পর্যন্ত। সেই সময় তিনি বহু গুরুত্বপূর্ণ মামলার সুষ্ঠু সমাধান করেন। ওয়েটের ঊর্ধ্বতন ও’ ম্যানি তাঁর কাজের প্রশংসা করে কর্তৃপক্ষের কাছে যে রিপোর্ট পেশ করেন তাতে বলা ছিল:
From none of my subordinates have I derived more important assistance than from my Deputy Collector and Magistrate Mr. Wyatt, who has been indefatigable in performance of his duties. He has great experience with the natives and the courtry visits the locale of the disputes and spares no pain or labour to attain the truth and afford satisfaction.
ওয়েট ওরফে পাঁচকড়ি শুধু যে তাঁর প্রশাসনিক কাজেই দক্ষ ছিলেন এটুকু বলা মনে হয় না যথেষ্ট। একটা কোনও বিষয়কে গভীরে গিয়ে দেখা ও তার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তাঁকে তাঁর সমসাময়িক আর পাঁচজন আমলার থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আর তির্যক মন্তব্য থেকে রেহাই মেলার উপায় ছিল না কারও। দুর্নীতিবাজ উকিল-মোক্তার হোক কিংবা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আসীন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা কাউকেই তিনি রেয়াত করেননি। চাকরি করতে করতে ক’জন পারে উপরওয়ালার খোলাখুলি সমালোচনা করতে কিংবা হিম্মত দেখাতে পারে তাদের ভুলত্রুটি দেখানোর! এরপরেও কিন্তু ১৮৫৭ সালের ডামাডোলে খয়ের খাঁ বলে চিহ্নিত হয়ে গেলেন পাঁচকড়ি। মুড়ি মিছরির একই দর ঠিক করে নিয়ে কোতল করা হল তাঁকেও। সেদিনের সেই অস্থির মুহূর্তে বিদ্রোহীরা না হয় মূল্যায়ন করতে ভুল করেছিল, কিন্তু একুশ শতকে এসেও কী সেই একই ভুল করবেন ঐতিহাসিকেরা, উপেক্ষিতই থেকে যাবেন পাঁচকড়ি?
সমসাময়িক কালে ঝাঁকিদর্শনকে যে পুরোপুরি আলোচনার বাইরে রাখা হয়েছিল এ কথা বলা যাবে না। বইটির দুটি সমালোচনা বর্তমান বইটির পরিশিষ্টে যোগ করা হয়েছে। একটি প্রকাশিত হয় ১৮৪৯ সালে The Calcutta Review-তে অন্যটি একই বছর Chamber’s Edinburgh Journal-এ। সমালোচকেরা যে এই ছোট বইটিকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। গুরুত্বপূর্ণ না হলে ক্যালকাটা রিভিউ সমালোচনার নামে প্রায় পুরো বইটাই ছেপে দিত না। প্রায় কথাটি বলার একটাই কারণ, খুব সুকৌশলে এই সমালোচনা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে আঠেরো নম্বর পরিচ্ছেদ (Conspiracy of overturning the British government which ended in a state trial and an acquittal of the suspected guilty party) আর উনিশ নম্বর পরিচ্ছেদটি (Proceedings against the conspirators)।
পাঁচকড়ির লেখা একটি কোনও ঘটনার ধারাবাহিক বিবরণ নয়। কেমন করে এক মামুলি কিষান অবস্থার ফেরে ঘুষ কবুল করে হয়ে ওঠে আর্দালি এ দিয়ে শুরু। তারপর দুর্নীতির আঁচে তেতে পুড়ে পোক্ত হয়ে দুনিয়াদারি শিখে সে পাল্টাতে থাকে একের পর এক দপ্তর। সেই সঙ্গে আমাদেরও জানা হয়ে যায় দপ্তরগুলির নতুন, নতুন কিস্সা। প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতো বেরিয়ে আসে ভূরি ভূরি দুর্নীতির নজির। ইংরেজ হুকুমত খতম করার যে গভীর চক্রান্ত চালিয়েছিল কিছু ষড়যন্ত্রকারী তার অনুপুঙ্খ বিবরণ মেলে পাঁচকড়ির লেখায়। এইসব ঘটনার কথা ইতিহাস বইতেও হয়তো মিলবে কিন্তু যা মিলবে না তা হল এই কুচক্রীদের পরিণাম। জবরদস্ত সব এনক্যুয়ারি কমিটি আর কমিশনকে পুরোপুরি অকেজো করে দিয়ে কখনও কোনও বিশিষ্ট ‘ইংরেজ লেডি’ আবার কখনও একদল ‘সুরেলা কোয়েলিয়া’ কী করে হয়ে উঠল নীতি নির্ধারক তা জানতে পাঁচকড়ি ছাড়া গতি নেই। অভিযুক্তরা যে কেবল বেকসুর খালাস হয়েছিল তাই নয়, ফিরে পেয়েছিল তাদের হারানো পদও। দেড়শো বছরেরও বেশি এই পুরনো ঘটনা পড়তে পড়তে হালফিলের বহু কিস্সার সঙ্গে মিল পাবেন পাঠক, এখানেই সম্ভবত পাঁচকড়ির ঝাঁকিদর্শনের সার্থকতা। ক্যালকাটা রিভিউয়ের সমালোচক অবশ্য তেমন কোনও সুযোগই সেকালের পাঠকের জন্য ছাড়তে তৈরি ছিলেন না। Revelations Concerning The Police and Courts বলে যে সমালোচনাটি প্রকাশিত হয় সেখানে সমালোচক হাতে তুলে নেন সেন্সারের কাঁচি। অস্বাক্ষরিত সেই সমালোচনাটির লেখকের নাম আমরা জানতে পারি Classified Subject Index to Calcutta Review 1844-1920 বইটি থেকে। বইটির সম্পাদকেরা লেখা ও লেখকের যে নামের তালিকা প্রস্তুত করেছেন তার থেকে জানা যায় সমালোচনাটি লিখে ছিলেন ডব্লিউ থিয়োবল্ড। স্বজাতির করা দুর্নীতি সম্পর্কে নিশ্চয় থিয়োবল্ড খুব স্পর্শকাতর ছিলেন। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিল ভারতীয়দের বজ্জাতিটা বেশি গুরুত্ব দিয়ে জানানো দরকার, বিশেষ করে তাদের কাছে যারা এই দেশি মানুষগুলোকে শাসন করবে। শাসকেরা কী করল বা করে থাকে সে সব কথা সবার জানার দরকারটাই বা কী?
দ্য ক্যালকাটা রিভিউ-তে আবার ঝাঁকিদর্শন সম্পর্কে আরেক রকমের প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায়। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় A Manual of Surveying For India নামে অন্য একটি বইয়ের অস্বাক্ষরিত সমালোচনা। সেখানেও উল্লেখ ছিল ঝাঁকিদর্শনের। সমালোচক বলছেন, পাঁচকড়ি খানের লেখায় যে বলা হয়েছে কম্পাসওয়ালারা তাদের কম্পাসের কাঁটার জাদু দেখিয়ে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে পয়সা আদায় করত তাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখাই ভাল। জরিপের কাজের মতো এমন বিশাল কর্মকাণ্ডে এই রকম এক-আধটা ঘটনাতো ঘটতেই পারে। কাজগুলো করার জন্য যাদের বহাল করা হত তাদের মজুরি ছিল নেহাতই কম। আসল বজ্জাত হল গ্রামের জমিদার আর তার কর্মচারীরা। তারাই পয়সা করার নানা ফিকির খুঁজত। এই সমালোচনাটিকে তাই বলা যায় পাঁচকড়ি খানের লেখা বা অভিযোগকে সরাসরি উড়িয়ে দিতে না পেরে, ঘুরপথে জবাব দেওয়ার চেষ্টা।
পাঁচকড়ির লেখা পড়লে মনে হয় তিনি জমি জরিপ বন্দোবস্তের শুরুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। জরিপের খুঁটিনাটি বিষয়ে তাই তিনি এতটা ওয়াকিবহাল। ইংরেজরা ভারতে জমি জরিপ চালু করতে না করতেই সেটাকে ঘিরে শুরু হয়ে যায় নানা ফেরেব্বাজি আর পয়সা কামানোর ফিকির। পাঁচকড়ি যেমন তাই নিয়ে বিশদভাবে লিখেছেন তেমনই তাঁর নিজের উপলব্ধি থেকে বলেছেন কী করে আরও নিখুঁত করা যেত এই বন্দোবস্ত। তাঁর লেখার একটা বড় গুণ তিনি বদমাইশির পরদা ফাঁস করেই নিজের দায়িত্ব খতম করেননি। সেই সঙ্গে নিয়েছেন এক জন বিবেকের ভূমিকাও। উনিশ নম্বর পরিচ্ছেদে তিনি তাঁর নিজস্ব ঢঙে লিখেছিলেন কী ভাবে শুরু হয় জরিপের কাজে অবক্ষয়। ঝাঁকিদর্শন প্রকাশিত হওয়ার বেশ কিছু বছর বাদে ১৮৭১ সালে ক্লেমেন্ট আর মারখাম তাঁর ‘মেমোয়ার অন দ্য ইন্ডিয়ান সার্ভে’-তে বলছেন:
The topographical details of these surveys were tolerably well executed until 1834 when a conference of surveyors was held at Allahabad, by order of Lord W. Bentinck. A new phase was therefore adopted introducing economy, rapidity and sacrificing quality for quantity.
এখানে আমরা যেন খুঁজে পাই হুবহু পাঁচকড়ির কণ্ঠস্বর।
ঝাঁকিদর্শনকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে আরেক ধরনের বিতর্কের সূত্রপাত হয়। গবেষক, সমালোচক শুভেন্দু মুণ্ড দাবি করে বসেন, ইংরেজি ভাষায় প্রথম কোনও ভারতীয়র লেখা উপন্যাস হল পাঁচকড়ি খানের বইটি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাজমোহনস ওয়াইফ’-কে যে আসন দেওয়া হয় তথ্য হিসাবে তা ঠিক নয়। পাঁচকড়িকে নিয়ে শুভেন্দুর এই বক্তব্য অন্য অনেক সমালোচকই মেনে নিতে তৈরি নন। তাঁদের বিরোধিতার মূল কথা, কোনও ভাবেই পাঁচকড়ি খানের বইকে উপন্যাসের তকমা দেওয়া চলে না।
বইটি সম্পর্কে বলার কথা এখানেই শেষ নয়। নানা প্রকাশক আলাদা আলাদা সময়ে বইটি প্রকাশ করেছে। কলকাতা থেকেও ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল একটি সংস্করণ। বলা ছিল, Reprinted by J. F. Bellamy, Englishmen Press। এই সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১০৮। তর্জমার জন্য আমরা বেছে নিয়েছি ১৮৬৬ সালে E. J. Lazarus & Co. প্রকাশিত সংস্করণটি যার পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৮। আগের সংস্করণগুলিতে পরিচ্ছেদের আলাদা আলাদা শিরোনাম ছিল। ল্যাজারাস সংস্করণে যা ছিল না। পরিচ্ছেদ চিহ্নিত করা হয় রোমান সংখ্যার সাহায্যে। কিন্তু এই সংস্করণে যোগ করা হয়েছিল ২৬ পাতার শব্দার্থের একটা বিশদ তালিকা। খুব সম্ভব এই তালিকার গুরুত্ব আর প্রামাণিকতা বিবেচনা করেই ‘হবসন জবসন’-এর মতো দুনিয়া খ্যাত অভিধানও তার ঋণ স্বীকার করেছে The Revelations of An Orderly-র কাছে। যথারীতি সেই তালিকাও বইয়ের শেষে যোগ করা হয়েছে। বহু সময় শব্দের অর্থ খুঁজতে গিয়ে নির্ভর করতে হয়েছে ঝাঁকিদর্শনের সমসাময়িক সময়ে প্রকাশিত অভিধানের উপর। এগুলির মধ্যে উল্লেখ করতে হয়:
An English Oordoo Dictionary in Roman Characters, 1852
Glossary of Judicial and Revenue Terms, By H. H. Wilson, 1885
English Hindi Vocabulary of 3000 words for Higher Standard and Proficiency Candidates By Lieutenant Colnel D. C. Phillotic, Calcutta, 1911
বাংলা অভিধানের মধ্যে সব থেকে বড় সহায় ছিল কাজী আবদুল ওদুদ ও অনিলচন্দ্র ঘোষ-এর ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ।’ সময় ও মানসিকতা কেমন করে শব্দের অর্থ ও প্রয়োগ পাল্টে দেয় সেই অভিজ্ঞতাও তর্জমার কাজটি করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ধরা যাক ‘অঘোরপন্থী’ শব্দটি। তৎকালের সাহেব অভিধানকারেরা অঘোরপন্থীদের সরাসরি চিহ্নিত করেছেন man eater বা নরখাদক বলে। পাঁচকড়ি খানের সংজ্ঞাও প্রায় এরই কাছাকাছি, ‘a class of mendicants who eat every thing filthy, ever human carcases’. কিন্তু বাংলা অভিধানে অঘোরপন্থীর সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এই বলে যে তাঁরা হলেন, আচার-পরায়ণ শিবোপাসক সন্ন্যাসী বিশেষ। শব্দের এই চলনের মজাটা যাতে পাঠক পান তার জন্য ইংরেজি শব্দার্থের পাশাপাশি রইল বাংলা অভিধানের ব্যাখ্যাও। অধিকাংশ শব্দেরই হদিশ মিলেছে ব্যবহারিক শব্দ কোষ থেকে যা পাওয়া যায়নি সেগুলি বাদ রাখা হয়েছে। ব্যবহারিক শব্দকোষ আরেকটি বিষয়কেও প্রতিষ্ঠা করেছে তা হল বাংলা ভাষাতেও এক সময় এই শব্দগুলির ব্যবহার ছিল। মাঝে মাঝে তর্জমার কাজটি করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে মিস্টার ওয়েট লেখাতে প্রচুর পরিমাণে দেশি শব্দ ব্যবহার করলেও ভাষাটির উপর তাঁর যে পুরোপুরি দখল ছিল এমনটা নয়। অনেক শব্দই মনে হয় তিনি ব্যবহার করেছেন কানে শোনার ভিত্তিতে। ইংরেজি অক্ষরে যখন তিনি সেই দেশি শব্দটি লিখেছেন তখন সবসময় ব্যাকরণ-বিধি মেনে কাজটা হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। আমরা যেমন তাঁর ব্যবহার করা Bhutearahs শব্দটির সন্ধান পাইনি, যার মানে করেছেন পাঁচকড়ি Inn Keepers those who dress the victuals of travellers putting up at seraes। আবার ধরা যাক Macheree-i-paeemash শব্দটি, বলা হয়েছে এর মানে professional survey। বাংলা অভিধানে পয়মাইস-এর অর্থ হল জরিপ। Macheree মনে হয় measure শব্দের অপভ্রংশ। অনেক ক্ষেত্রেই তাই তর্জমা অনুমান নির্ভর।
এই রকম একটি বইয়ের তর্জমা প্রকাশে আগ্রহ দেখানোর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য আনন্দ পাবলিশার্স সংস্থার। একই সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ে বইটির বিষয়ে উৎসাহ প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ শ্রীসিদ্ধার্থ দত্ত ও শ্রীপ্রবীর সেনকে। কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই স্নেহোৎপল দত্তকে পাণ্ডুলিপিটি পড়ে যিনি বেশ কয়েকটি মূল্যবান মতামত দিয়েছেন। গোবিন্দ বসাক সংগ্রহ করে দিয়েছেন ফ’রহঙ্গ-ই-রব্বানী অভিধান। এর থেকে হদিশ মিলেছে বেশ কয়েকটি শব্দের। কাজটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার সহায় ছিলেন ঈশিতা চক্রবর্তী। তাঁকে আলাদা করে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার অজানা।
.
কৈফিয়ত
আপনারা যে বইটি পড়তে চলেছেন, তা আসলে ছাপা হয়েছিল ‘বেনারস রেকর্ডার’ পত্রিকায়। লেখকের উদ্দেশ্য ছিল সহজ-সরল ভাষায় তিনি যা দেখেছেন তা বলা। একইসঙ্গে আদালতের নিচুতলায় যে বজ্জাতি চলে এবং যা সর্বজনস্বীকৃত তা লোকচক্ষুর সামনে নিয়ে আসা। একুশ বছর ধরে নানা সরকারি দপ্তরে কাজ করে লোকজনের স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে তাঁর বেশ কিছুটা অভিজ্ঞতা হয়। তিনি চান সেই অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে; বিশেষ করে নতুন যারা কাজে যোগ দেবে তাদের সঙ্গে যাতে তারা সজাগ হতে পারে কীভাবে এ দেশের মানুষ ইউরোপীয় প্রভুদের চোখে ধুলো দিয়ে তাদের আখের গোছায়।
লেখকের আরেকটা ইচ্ছে হল রাজস্ব এবং পুলিশি ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো কর্তৃপক্ষের সামনে তুলে ধরা। তিনি যেহেতু এই কাজটা স্বনামে করতে অক্ষম তাই তাঁকে আর্দালির ভেক ধরতে হয়েছে।
কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর এই লেখা পড়ে আহত হন তবে তার জন্য লেখক ক্ষমাপ্রার্থী। তাঁর লেখার উদ্দেশ্য কাউকে আঘাত করা নয়। তিনি নিজের অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন বলেই কলম ধরেছেন।
Leave a Reply