সুবা উত্তর-পশ্চিমে জরিপ
জন বার্ড সাহেব বাহাদুর সুবা উত্তর-পশ্চিমে যে বন্দোবস্ত কায়েম করেন পাঠক জরুর তার কথা শুনেছেন। আখেরে কেন এই বন্দোবস্ত কামইয়াব হল না বা তার নানা খুঁটিনাটি কথা খুব কম লোকেই জানে। পাঠকদের কাছে তাই আমি শুরুতেই মাফ চাইছি এই রকম একটা নীরস বিষয় নিয়ে লেখার জন্য। আসলে আমার লক্ষ্য যত না মজার খোরাক জোগানো তার থেকে অনেক বেশি লোকেদের তালিম দেওয়া। এই সুবায় হুকুমতের কবজা কায়েম হলে যে সমস্যা দেখা দিল তা হল পাঁচ থেকে দশ বছরের মতো কম সময়ের জন্য জমির ইজারা। ঠিক কী যে করতে হবে সেটা বুঝতে বুঝতেই পার হয়ে যেত সময়। আর সরকার আর জমিদারের ঝামেলা ছিল হর রোজের কিস্সা। সরকার চাইত মাশুল বাড়িয়ে সময়ের ভিতর পুরোটা আদায় করতে। উশুল না হলে ধরে নেওয়া হত সেটা নিচু তলার নানা ফন্দিতে হয়নি। উলটো তরফের চেষ্টা হত কী করে জমির মাপ কমিয়ে দেখানো যাবে। দরকার হলে ঘুষ-জালসাজি কিছুতেই তারা পিছপা ছিল না। বন্দোবস্তে যাতে কোনও গাফিলতি না হয় তা কায়েম রাখতে বছর বছর আবার করা হত নানা বদল। বসতো রেভিনিউ বোর্ড। সাহেবান-ই- মজলিস (sahiban-i-majlis)-রা মুলুকের এধার ওধার গিয়ে পেশ করতেন তাঁদের রিপোর্ট। আসলে প্রত্যেক সুবারই ছিল নিজের নিজের কিছু-বেবন্দেজ যা সাহেবানরা বুঝতে চাইতেন না। এই কারণেই ১৮২২ সালে রেগুলেশন VII মোতাবেক সিভিল সার্ভিসে তৈরি হল সেটেলমেন্ট অফিসারদের পদ। নোকরিতে বহাল হল রেভেনিউ সার্ভেয়ার যাদের কাজ কী করে সব থেকে ভাল মতো রাজস্বের হিসাব করা যাবে তা দেখা। সেই সঙ্গে বরাবরের মতো এমন একটা বন্দোবস্ত চালু করা যাতে বন্ধ হয় মামলা- মোকদ্দমা। জমির রাজস্ব কী হবে আর ভবিষ্যতে তা কতটা বাড়ানো যাবে তার আন্দাজ করা। জমি যারা জরিপ করবে তারা আর সেটেলমেন্ট অফিসারেরা মিলে সুপারিশ করবে রাজস্বের পরিমাণ কী হবে। ২০ বা ৩০ বছরের একটা লম্বা মেয়াদে জমিদারের সঙ্গে চুক্তি করা হবে যাতে জমিদার তার মুনাফা আবার করে জমিতে লাগায়। মোদ্দা কথা হল এতদিন ধরে চলে আসা অতিরিক্ত খরচের রেওয়াজ খতম করা।
এই কাজে সব থেকে বড় গাফিলতি ছিল কর্মচারীদের বেওকুফি। স্রেফ কাজের ভার দিয়ে বলা হয়েছিল সব যেন ঠিকঠাক হয়। দরকার ছিল ছোকরা সেটেলমেন্ট অফিসারদের শুরুতে মাশুলের অ-আ-ক-খ-তে তালিম দেওয়া। জরিপের কাজ যারা করবে তাদের বলা হয়নি কালেক্টরের রেকর্ড পরখ করে তবে বানাতে হবে তাদের ফিরিস্তি। তাই পরগনার যে হিসাব সেটেলমেন্ট অফিসার আর জরিপকার আলাদা আলাদা দাখিল করল তার ভিতর রইল না কোনও তাল মিল। ফারাক দেখা দিল মহল আর মৌজার। সময় সময় কালেক্টর-সেটেলমেন্ট অফিসার আর জরিপকারের ভিতরই বেধে গেল ঝগড়া। জরিপকারদের মনে হয়েছিল তাদের কাজ হচ্ছে সবকটা হলকা (hulka) আর চক্কর (chukker) জমির মাপ নেওয়া আর সেটেলমেন্ট অফিসারদের কথা মাফিক তালুক ভাগ করা। উলটো দিকে সেটেলমেন্ট অফিসারদের কাজটা ছিল খুবই শক্ত আর প্যাঁচালো। জমির মালিকদের না চটিয়ে তাদের বাড়াতে হত সবকটা পরগনার গড়পড়তা জমার আমদানি। খাতায় কলমে তারা যে রিপোর্ট দাখিল করল তাই দেখে কর্তারা খুশ। কিন্তু সত্যি সত্যি যখন রিপোর্ট মোতাবেক কাজগুলো করা হল তখন তার নতিজা হল খুব খারাপ। জমিদারেরা হর সাল লোকসান গুনতে নারাজ। তাই তারা শুরু করল নতুন খেলা। চাষ-আবাদ কমিয়ে দিয়ে চাইল মাশুলের ছাড় পেতে। সরকার তার বকেয়া আদায় করতে বেচে দিল অনেকের তালুক। যারা সেই জমি খরিদ করল তারা আবার নতুন করে খাজনা চাইতে লাগল কিষানের কাছে। লাচার কিষানরা আর কোনও পথ না পেয়ে ভাগতে লাগল তালুক-মুলুক ছেড়ে। মাহোল গেল বিগড়ে। এবার শুরু রাজস্ব জরিপ (Revenue surveys)। তাতে বাড়ল টানা হ্যাঁচড়া। সরকারের ইচ্ছে ছিল খুলে আম ঘুষ দেওয়া-নেওয়ার রেওয়াজ যাতে খতম হয়। আন্দাজ মেলে জমির বহর আর গ্রামে কতটা দৌলত মজুদ। এই কাজের জন্য তাই চালু হল ভয়ানক রকম খোঁজ তল্লাশি। পাঠক আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম বিচারের ভার, কে হল তাকতবার! সবচেয়ে ভয়ানক কথা হল, তামাম দেশি হুজুরি তা তিনি যে পদেই থাকুন না কেন মিলল বিশাল, বিশাল তরক্কি। এই বড় বড় পদের সুয়োগ নিয়ে তারা গোছাতে লাগল আখের। বা-দৌলত সরকার (ba-daulut sircar)!
মাশুল বন্দোবস্ত নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার তো মনে হয় এর থেকে ভাল কিছু হয় না। আপনারা যদি সাবুদ চান আমি তা হলে দাখিল করব বোর্ড-অব রেভিনিউকে। এই বোর্ড তৈরি হয়েছিল কাবিল১ আদমিদের নিয়ে। এঁদের তাকত-তজরবা আর দানেশমন্দি২ নিয়ে কারও কোনও সওয়াল ছিল না। কিন্তু গলদ যেটা ছিল তা হচ্ছে ওয়াক্তের পাবন্দি। হুকুম জারি হল একটা বাঁধা সময়ের ভিতর কাম খতম করতে হবে, আর চেষ্টা চালাতে হবে কী করে সবথেকে বেশি রাজস্ব আদায় করা যায়। সেটেলমেন্ট অফিসারদের বার বার শুনতে হয়েছে বন্দোবস্ত হবে সহজ-সরল। লোকেদের যেন মনে না হয় তাদের উপর রাজস্বের বোঝা চেপে গেল। আবার বলা হয়েছে সরকারের বকেয়া যেন পড়ে না থাকে। এই সব হুকুম দেখলে একটা কথাই মনে হয়, বাবুর্চিকে বলা হল জবাই করো গোরু, তারপর আচমকাই খুব দরদি হয়ে সেই গোরুর জন্য চোখের জল ফেলা। যখন যেখানে রাজস্ব বাড়ানো বা কমানোর কথা উঠেছে তখনই পাশাপাশি চাওয়া হয়েছে এত রকম কৈফিয়ত যে অফিসারেরাও খুব হুঁশিয়ার হয়ে উঠেছিল। তারাও এমন কায়দায় রিপোর্ট দাখিল করত যাতে কোনও ফাঁক ফোঁকর খুঁজে পাওয়া না যায়। এই রিপোর্ট দেখে বড় বড় হুজুররা যে সব সময় খুশ হতেন তাও না। কিন্তু তাদের করারই বা কী ছিল! মরহুম জেমস মিউঅর (James Muir) মতো কোনও কোনও সেটেলমেন্ট অফিসার খুব ইমানদারির সঙ্গে তাঁদের কাজটা করতেন। বহু মানুষ তাঁর সেই কাজের জন্য দোয়া করেছে। বাকি অফিসারেরা কাজের থেকে বেশি মশগুল থাকতেন নিজের নিজের জেলায় শিকার করায়। শিকার খেলতে গিয়ে যে সব তালুক মুলুক তাদের নজরে পড়ত সেই বুনিয়াদের উপর ভরসা করেই তাঁরা লিখে ফেলতেন রিপোর্ট। শুরুর কথা বলতে গিয়ে আমি বহুত দূর চলে এসেছি। কাজগুলো কী ভাবে হচ্ছিল সে কথাই এবার আমি আপনাদের বলি।
একদল ভুখা আমিনকে যেন সবগুলো জেলায় ছেড়ে দেওয়া হল। তাদের কাজ, জমিদারির হদ্দ মাটির আল দিয়ে বেঁধে ফেলা। আমিনদের এই কাজের জন্য মজুরি মিলত ঠিকই তবুও তাদের ভুখ মিটত না। দু’-চার পয়সা উপরি তাই সই। তবে তাদের চেষ্টা ছিল জমিদারের কাছ থেকে আরও বড় কিছু আদায়। মর্জিমাফিক আমদানি না হলে বা জমিদার রিশবত দিতে ইনকার করলে তারা নালিশ জানাত পেশকারকে। জমির দখলদার ভুয়ো আর সে তাদের রিশবত দিতে চায়। পেশকার আবার সেই কথা জানাত সেটেলমেন্ট অফিসারকে, নতিজা জমিদারের জরিমানা। পরগনার হদ্দ দাগানোর কাজ খতম হলে তবেই চালু হত জরিপ।
শুরুতেই দেখা যেত কোনও একজন হোঁতকা টিন্ডল (Tindal) বড়সড় গ্রামগুলোতে গিয়ে হাজির। তারপর মাতব্বরদের জড়ো করে এলান করত, পয়মাশ-কা-লস্কর (Paemash-ka-Lushkur) ঠিক করেছেন সেই গ্রামে তাঁর ছাউনি ফেলবেন। ছাউনির জন্য দশ হাজার খুঁটির ইন্তেজাম করো। জোগান দাও খড় আর ছপ্পর (Chuppurs), খাড়া হবে আস্তাবল আর রসুইখানা। সাহেব লোকরা থাকবেন তার জন্য তাই বানিয়ে দিতে হবে ঘর। ইশারা বুঝতে তালুকদারের কোনও মুশকিল হত না। টিন্ডলকে তারা চাহিদা মাফিক খুশ করে দিত। শুধু তাদের আর্জি ছিল সাহেব-ই-মুশা (Saheb-i-Mussah) যেন গোস্তাখি মাফ করেন। তাদের গ্রাম তাঁর মতো লোকের ছাউনি ফেলার উপযুক্ত নয়। টিন্ডলের একথা খুব ভালই মালুম ছিল ওই গ্রাম জরিপকার বাছাই করবেন না কারণ গ্রামটা কাজের এলাকার বাইরে। তাই টাকা হাতিয়ে নিয়ে সে তখন হাঁটা দিত আর একটা কোনও গ্রামে। সেখানেও চলত তার এই কসরত। জরিপকার জায়গা বাছাই করলে যেত খালাসিরা। জরিপ চালু হওয়ার আগে যাতে তারা বন্দোবস্ত পাকা করে।
জরিপের কাজ শুরু হয় থিওডোলাইট যন্ত্র বসানো দিয়ে। এই যন্ত্র দিয়ে জমি খাড়াখাড়ি আর আড়াআড়ি মাপা হয়। দুটো যন্ত্র বসানো হয় জমির দু’ধারে। যন্ত্রগুলোর সামনে কোনও বাধা থাকলে সেগুলো হটিয়ে দিতে হয়। তা না হলে মাপ নেওয়া মুশকিল। যারা কাজটা করবে তাদের তো মহা ফুর্তি। আখের খেত, ফলন্ত আম গাছ বা বটের থান কখনও কখনও এসে যায় এই মাপজোকের মধ্যে। জমিদার রিশবত কবুল করলে আর এক ধারে সরে যায় যন্ত্র, রেহাই মেলে খেত খামারের। নারাজ হলে জমিদারের খিলাফ সেটেলমেন্ট অফিসারের কাছে দর্জ হয় রিপোর্ট। সরকারি কাম কাজে রুকাবট! তাই জরিমানা দিতে হয় গ্রামবাসীদের।
১. কাবিল: উপযুক্ত, লায়েক, যোগ্যতাসম্পন্ন
২. দানেশমন্দ: জ্ঞানী, পণ্ডিত, বিচক্ষণ