নাচার রায়তের মামলা
আমার তরফে লালা শীতলপ্রসাদের লিখে দেওয়া পিটিশনটা ছিল খুবই নাড়া দেওয়ার মতো। শুরু হচ্ছে এইভাবে: “জুলুম হ্যায় লায়েক ইনসাফ, ও জোর হ্যায় কাবিল ইলতিফাত” (zoolm hae layek insaf, wuh jour hae kabil iltifat)। শুরুতেই কবুল করেছি যে আমি হচ্ছি একজন মৌরসি আসামি আর কানুনি সরকার (Qawaneen-i-sircar) আমাকে তেমন কোনও আপদ মনে করেনি যাতে খাজনা বাড়ানো চলে। মুবারকপুর মৌজাতে আমার একটা বিঘা পাঁচেকের জোত ছিল। পুরনো জমিদারকে আমি কোনওদিনই বিঘা পিছু দু’টাকা বা সালিয়ানা দশ টাকার বেশি মালগুজারি দিয়েছি বলে মনে পড়ে না। এখন অবধি আমি আধা মানে পাঁচ টাকা কবুল করেছি আর হিসাব মাফিক বাকিটাও সময় হলেই মিটিয়ে দেব। কাবালাদার বলভদ্র সিং আমাকে জবরদস্তি একটা নোটিশ ধরিয়েছে। বলছে আমাকে বিঘা পিছু চার টাকা করে দিতে হবে। হুজুরের ইনসাফ-ই-নওশেরওয়ানি (insaf-i-nausherwanee) মোতাবেক এই নোটিশ বেআইনি। জনাব তো বলভদ্র সিং-এর জুলুম আর বদমাইশির ব্যাপারে আচ্ছা রকম ওয়াকিফ। তবুও সে জবরদস্তি আমার কাছ থেকে এই বাড়তি টাকা আদায় করেছে। আমি চাই এর সুরাহা হোক।
বলভদ্র সিং-এর মোক্তার লালা দেবীপ্রসাদ এবার শুরু করল সওয়াল। সে বলল, তার মক্কেল ওই গ্রামটা খরিদ করেছে আর ১৮১২-র রেগুলেশন V মোতাবেক পাঠিয়েছে আসামিদের কাছে নোটিশ। নানা নজির তুলে ধরে দেবীপ্রসাদ প্রমাণ করতে চাইল, তার মক্কেল জমি থেকে যে খাজনা পায় তা বড়ই কম হচ্ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবার গঙ্গাপ্রসাদ পাটোয়ারি আদালতের সামনে হলফ করে বলতে বলল, জমা-উসুল-বাকির হিসাব তারই লেখা। সেই বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করেই পাঁচকড়ির জমির খাজনা ঠিক হয়েছে। বিঘা পিছু চার টাকা হারে যে খাজনা ধরা হয় তাতে কোনও ভুলচুক নেই। যে বকেয়া খাজনা তাই চাওয়া হয়েছে, মানে ১০ টাকা ২ আনা ৬ পাই সেটাও ন্যায্য। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে বলে উঠলাম, “জনাব-ই-আলি! এই আদমি একটা ঠগ! একজন পাটোয়ারি আর জেনে রাখবেন পাটোয়ারি মানেই ঠগবাজ। জমিদারেরা এই পাটোয়ারিদের গলায় চাঁদির পাট্টা লাগিয়ে রাখে আর যেমন মর্জি তেমন ঘোরায়।” সাহেব এবার পাটোয়ারির কাছে জানতে চাইলেন, “পাঁচকড়ির কাছ থেকে কি সালানা দশ টাকার বেশি আদায় করা হয়েছে কখনও?” জবাব মিলল, না। “তা হলে তুমি কেন বেশি চাইলে?” পাটোয়ারি এবার কবুল করল, সে দেবীপ্রসাদের হুকুম মোতাবেক করেছে। ডিপটি সাহেব ডিক্রি জারি করলেন, আমার যা খরচ হয়েছে সেটা তাদের মিটিয়ে দিতে হবে। আমাকে বাড়তি খাজনার জন্য জবরদস্তি করাটাও বেআইনি। লালা দেবীপ্রসাদ এই ডিক্রি শুনে নাখুশ হল। সে পাল্টা সওয়াল করতে ছাড়ল না, মহামান্য হাকিমদের সনদ থেকে সে নজির তুলে তুলে দেখাচ্ছিল, হুজুর কি মনে করেন তাঁরা কানুনের সমজদার নন? কী করে তিনি এত অনায়াসে তাঁদের বিচার বাতিল করেন? লালা দেবীপ্রসাদ এবার এত বেশি কনট্রাকশন (kantractions) আর সারকুলার চিট্টির (surkoolar chitees) নজির পেশ করতে লাগল যে আমি তো বেবাক। কিন্তু সাহেব তাকে বললেন, খামোশ। আর আমার জন্য সন্দেশ, যাও গিয়ে মন লাগিয়ে হাল চাষ কর। আমি তো নিজেকে খুশ নসিব ভেবে নিয়ে মনে করলাম বলভদ্র আর পাটোয়ারিকে আচ্ছা সবক শেখানো গেছে।
হায়! এক মাস পার হতে না হতেই মুনসেফ আদালত থেকে একটা নোটিশ এসে হাজির। বলভদ্র আমার খিলাফ সালানা মালগুজারি জমা করা নিয়ে নালিশ রুজু করেছে। তার খায়েশ আদালত হুকুম করুক যাতে সালিয়ানা বিঘা পিছু চার টাকা হিসাবে আমার কাছ থেকে ২০ টাকা আদায় করতে পারে। আমি আবার গিয়ে ধরলাম শীতলপ্রসাদকে যাতে একটা আর্জি লেখে। কিন্তু সে বলল এবার এটা লম্বরি মুকদ্দমা (lumburee moquddumma) আমাকে অনেক খরচের জন্য তৈরি থাকতে হবে। একজন হুঁশিয়ার উকিলের জরুরত পড়বে। আমি তখন মরিয়া। হাতে নেই একটাও টাকা। বলদ জোড়া মহাজনের কাছে বাঁধা রেখে তৈরি হলাম মুকদ্দমা লড়তে। আমি ভরসা করেছিলাম হাকিমান-ই-আদালত (Hakiman-i-Adawlut)-এর ইনসাফ আর খোদাতায়ালার মেহেরবানির উপর।
আমার উকিল আদালতের সামনে আবার করে ডিপটি সাহেবের সওয়াল জবাবের কথা আর সেই সঙ্গে নানা রেগুলেশন আর কনট্রাকশনের নজির তুলে ধরল। কিন্তু মুনসেফ তাকে বেপাত্তা করে দিয়ে পাটোয়ারির কাছে শুধু জানতে চাইলেন ১৮১২ সনের রেগুলেশন V মোতাবেক পাঁচকড়িকে এত্তেলানামা (itilanamah) দেওয়া হয়েছিল তো? পাটোয়ারি জবাবে জানাল, জরুর। আমি তাতে নারাজি হলাম না কিন্তু তাঁর সামনে পেশ করলাম ডিপটি হুজুরের রুবকারি (roobukaree) যেখানে সাফ সাফ বলা ছিল বেশি খাজনা চাওয়াটা বেআইনি। মুনসেফ তাতে ভয়ানক খেপে উঠলেন। ছুড়ে ফেললেন রুবকারি। কৌন ডিপটি কালেক্টর আউর কৌন হাকিম-ই-আদালত-দিওয়ানি! (kuon Dipty kulluctur our kuon Hakim-i-Adawlut Dewanee) হায়! মেরি কিসমত, ব্যাটা দেখছি ডিপটি কালেক্টরের শোচ বিচারের সঙ্গে আমারটা গুলিয়ে ফেলছে! মুনসেফ আবার পাটোয়ারিকে সওয়াল করলেন, “পাঁচকড়ির জোত থেকে কী বিঘা পিছু চার টাকা হাসিল করা যায়? জেলায় কী হারে হাসিল হয়?” পাটোয়ারি জবাব দিল, “জনাব আলবাত দেওয়া যায়। গ্রামের আর সবাই তো ওই হারেই দিয়ে থাকে।” ডিক্রি মিলল বলভদ্রর। আমাকে বলা হল, আয়েন্দা বিঘা পিছু চার টাকা হারেই খাজনা দিতে হবে। উকিল আমাকে সলা দিল আবার করে আর্জি পেশ করার। কিন্তু তার চেহারা দেখে মালুম হল সেও বুদ্ধু বনে গেছে। সে আবার বলতে লাগল, আমার কথাটা একবার ভেবে দেখ দোস্ত; সাহেব জজ বাহাদুরের কাছে আর্জি জানালে তিনি তোমাকে জরুর ইনসাফ দেবেন। বলভদ্র তো মুনসেফকে এমন ভয় দেখিয়েছে সে উল্টো গাইতে বাধ্য। জজ সাহেবের কাছে গেলে দেখবে তিনি ওই ডিক্রি দিয়েছেন। আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। জবাব দিলাম, “আরে উকিল! আল্লার কসম! আমার কাছে আর একটাও টাকা নেই। বলভদ্রর খিলাফ মামলা লড়ব কি দিয়ে? হাল-বলদ বেচে দিয়েছি, হেরে গেছি মামলা এবার আমার জমি-বাড়ি সব বরবাদ হবে আর তুমি বলছ আর্জি জানাতে! আমার মতো বেচারা রায়তের আর্জি মানেই তো ট্যাঁক খালি হওয়া। তাতেও ইনসাফ মেলে না। আসলে যারা তাকতবার তারাই আমাদের মতো গরিবের মাথায় চড়ে বসে।”
আমার নজরে পড়েছিল মুনসেফের আদালতে বলভদ্র দাঁড়িয়ে আছে উকিলের পাশে। কোনও কিছু বেচাল দেখলেই চেপে ধরছিল উকিলের গর্দান। আর মুনসেফের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই আরেকটা হাত আড়াআড়ি রাখছিল গলার উপর। তাই দেখে মুনসেফ কেমন ঘাবড়ে গিয়ে সরিয়ে নিচ্ছিলেন নজর। এইসব ইশারার কী মানে আমি জানি না। মামলাটাই যেখানে হেরে গেলাম সেখানে ইশারা বুঝে আর কী হবে।
দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি হাসিল করে বলভদ্র গেল ডিপটি সাহেবের কাছে। ইরাদা আমার কাছ থেকে বকেয়া খাজনা আদায়। আমি সাহেবকে জানালাম মুনসেফের ডিক্রি পাওয়ায় সে এখন অনেক শক্ত বুনিয়াদের উপর খাড়া। এই নিয়ে আর কোনও আর্জি জানাতে চাই না। হাল ছেড়ে দিয়েছি। আমি চাই আমার জোত আর কাউকে দিয়ে দেওয়া হোক। বলভদ্র যদি তার সব দাবি থেকে আমাকে রেহাই দেয় তবে আমিও আমার জোত ছেড়ে দিতে তৈরি। আল্লাতালা জানেন সাহেবান আলিসানরা কেমন আজব তরিকায় তাঁদের কারবার চালিয়ে থাকেন। হাকিমের কোনও একটা হুকুম মর্জি হলেই আরেকজন হাকিম পাল্টে দিতে পারেন। দেখে শুনে মনে হয় এই আইনগুলো এক একটা হেঁয়ালি। না হলে কারও মর্জি মাফিক এগুলো কেমন করে উলটেপালটে যায়! আমাদের মতো গরিব রায়তের ভরসা তো সেই আল্লাতালার মেহেরবানি।