রায়তের উপর জবরদস্তি
টান্ডার জমি কব্জা করার পাশাপাশি মৌলভি-উকিল হাসিল করল কিবলা আর উমুলদস্তক (kibalah and umuldustuk)। কায়েম হল হক। রায়তদের নোটিশ দেওয়া হল, খাজনা বাড়ানো হচ্ছে। বাদ গেল না ভবানী সিং আর তার পঞ্চাশ বিঘার মৌরসি জোত। এতদিন সে খাজনা দিত বিঘা পিছু ১ টাকা ৮ আনা। নোটিশ মোতাবেক তার খাজনা দাঁড়াল বিঘা পিছু ৫ টাকা। ভবানী একজন জবরদস্ত রাজপুত। নোটিশকে বেপাত্তা করে দিল। মৌলভি উকিলও এত সহজে ছোড়নেওয়ালা নয়। তাই এমন একটা মাহোল পয়দা হল যাতে যখন তখন বেধে যেতে পারে কাজিয়া। এই হাল সামাল দিতে পারত কেবল সরকারি তকমার চমক। কিস্তি বাকি পড়তেই মৌলভি রুজু করল মামলা আর তা সাজিয়ে গুছিয়ে দিল এক আমলা (umlah)। শুনানি হল সাহেব সিস্টান্ট (shistant)-এর আদালতে যে হুজুর হালেই বহাল হয়েছেন।
হুজুরের সামনে যে যে নথিপত্র পেশ করা হল তার পয়লা নম্বর হচ্ছে পাটোয়ারির উসুল বাকি (putwaree’s wasil baquee)। দু-নম্বর, আসামিকে দেওয়া নোটিশ যেখানে বলা হয়েছে তাকে বিঘা পিছু ৫ টাকা করে দিতে হবে। তিন নম্বর, কালেক্টরের কিবালা নিলামের খরিদদারকে যা দেওয়া হয়। সব কিছু দেখেশুনে ভবানী সিং-এর একটাই জবাব, সরকার কোম্পানি বাহাদুর যবে থেকে মুলুকের দখল নিয়েছে সে তবে থেকে ওই জমির মৌরসি কিষান। তার কাছে খোদ সাহিব কুলান জোনাটিন ডানাকিনের (Saheb Kullan Joonateen Dunkeen) দস্তখত করা পাট্টা (pattah) আছে। সেখানে সাফ সাফ বলা হয়েছে, সরকারি আইন মোতাবেক বাড়তি খাজনা থেকে তাকে রেহাই করা হল। সব শোনার পর সাহেব সিস্টান্ট আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। মাথার ট্যারছা বিভার হ্যাট আরেকটু যেন হেলে পড়ল। মৌলভি উকিল এমন একটা ভাব করতে লাগল যেন কতই দরদ। “হুজুর! জানব-ই-আলি! শুনছেন, শুনছেন, বেয়াদবটার জবান, এইরকম কথা আগে কখনও শুনেছেন? বলছে আপনার হুকুম হলেও বাড়তি মালগুজারি দেবে না! নালায়েকের এত হিম্মত যে হাকিমকেও কেয়ার করে না!”
“ঠিক হ্যায়, ঠিক হ্যায়, খামোশ,” একটু মেজাজেই বললেন হুজুর। “মুনশি কেনা বেচার কানুনগুলো ঠিক কী?” পাঠকদের একবার ইয়াদ করতে বলি, এই মুনশি ছিল উকিলেরই শাগরেদ। দু’জনে মিলে খরিদ করে ওই তালুক। মুনশির কাজ হল মামলা আরও কী করে প্যাঁচালো করা যায়। সে খুলে ধরল ১৮১২ সালের V নম্বর রেগুলেশনের IX নম্বর ধারা। জনাব, এই হল কানুন। মৌলভি উকিল ঠিকঠাক মালগুজারি বাড়ানোর নোটিশ দেয়। ডিক্রি তো তারই পাওয়ার কথা। ফরিয়াদির তরফে ডিক্রি জারি হল। কিন্তু ভবানী সিং ভেবে নিল, বহুত আচ্ছা! ডিক্রি তো পা, লেকিন রুপিয়া তো মোর পাস বা (diggree to pah, lekin roopyea to mor pass bah)। এক মাস পর ডিক্রি মোতাবেক দখল আদায়ের তোড়জোড় শুরু হল। যে মুসকারি আদায় করতে গিয়েছিল তাকে ভবানী সিং-এর তিন বেটা ঠেঙিয়ে দিল আচ্ছা করে। পরে এই তিনজনেরই ছয় মাস করে কয়েদ হয়। ভবানী আর হিম্মত ধরে রাখতে পারল না। চলে গেল নাজিরের হেপাজতে। আবার মামলা চালু। ভবানীকে সওয়াল করা হল, সে কি বকেয়া মেটাতে রাজি? জবাব মিলল, না। পচাশ সাল আমি আর আমার বাপ বিঘা পিছু ১ টাকা ৮ আনা দিয়ে এসেছি। এখন ১ আনাও বেশি দেব না। ভবানীর হাজত হল। কিন্তু এর থেকেও তাজ্জব কী বাত, ছ’খানা তাগড়া গাই, দুটো আখ মাড়াই কল আর বস্তা বস্তা আনাজ স্রেফ ১৮ টাকায় বিক্রি হয়ে গেল! এই বেচা কেনায় কানুনি ইজাজত থাকলেও বকেয়া মিটল না। ভবানী সিং-কে পুরো মেয়াদ হাজতেই ঘানি টানতে হল।
আরেক কিস্তির সময় হলে নিলামদারেরা একই কায়দায় নতুন মামলা রুজু করল। এবারও সামনে এল না নাজির। যারা কিস্তি জমা করবে সেই ভবানী সিং আর তার তিন বেটা তো কয়েদে। তা হলে মামলা লড়বে কে? মৌলভি উকিলের তরফে জারি হল গায়েব হাজিরি ডিক্রি। নাজিরের কৈফিয়ত মতো, ডিক্রি পাওয়া মৌলভি উকিল মামলা করে। মামলায় আসামিদের জেল হাজত হয়। হাজতে আসামিরা জানায় তারা দেউলিয়া। তাই তাদের খালাস করা হয়েছে।
ভবানী আর তার বেটারা হাজত থেকে ছাড়া পেয়ে কিষান মরদের মতো শুরু করল হাল চাষ। তারা বলতে লাগল, মৌলভি যেমন তাদের হেনস্তা করেছে তেমন তাকেও ভুগতে হবে। রোয়াবি ভবানী সিং আর তার বেটারা তো এখন মুফলিস১। পুরো গ্রাম খেপে উঠল এর বদলা চাই। মৌলভি কোনও কাঁচা খেলোয়াড় নয়। তাই কোনও বেচাল করল না। স্রেফ বেপাত্তা করে দিল রাজপুতদের ভড়কানি।
সময় হলে মৌলভি তার করিন্দাকে পাঠাল তহশিলে। প্রথম রাতেই আগুন লাগল ছাউনিতে (chhownee)। বেসামাল হয়ে যখন তার আদমিরা ছুটে বেড়াচ্ছে তখন মওকা বুঝে তাদের উপর পড়ল বেধড়ক ডান্ডা।
মৌলভি উকিল তো এতদিন এরকম কোনও সুযোগেরই ইন্তেজার করছিল। এবার তার ফুর্তি কে দেখে! নানা শোচ বিচার চলতে লাগল কী করে গুনাহগারদের শায়েস্তা করা যায়। দৌলত সিং আর তার ওস্তাদ বেটারা আর সেই সঙ্গে ভবানী সিং আর তার বেটারা এই কারবারে ফেঁসে এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে তারা গ্রাম ছেড়েই চম্পট দিল। ম্যাজিস্ট্রেট হুজুরের সামনে দর্জ হল এক লম্বা চওড়া রিপোর্ট। মামলা এমনই গহরা যে জরুরত হল না রং চড়ানোর। যারা জখম হয় তাদের পাঠানো হয়েছিল হাসপাতাল। এক হপ্তা কাটতে না কাটতেই রেহাই মিলল মরিজদের। ফেরার বলে এলান করায় নিজেরাই এসে ধরা দিল আসামিরা। মামলা রুজু হল তাদের খিলাফ আর রায় মোতাবেক সাত সাল করে সাজা হয়ে গেল। আখেরে পুরো তালুক কব্জা করে নিল মৌলভি উকিল। স্রেফ কয়েকজন খিদমতগারের মাথা ফাটল আর কোনও খরচই হল না।
এই মামলার নতিজা দেখে আমি খুব মায়ুস হয়ে পড়েছিলাম। আমার কিস্সা তো এর মোকাবিলায় নেহাতই মামুলি। এই মামলায় জমিদার আর পুরনো ইস্তিমরারি পাট্টাদারকে (istimraree puttadars) যে স্রেফ জমি থেকে বেদখল করা হয়েছিল, তাই নয় তারা একদম বরবাদ হয়ে যায়। আর যে তাদের এই হাল করল সে তো নানা ফন্দিফিকির করে উকিল হয়ে বসেছে। আলবাত তাকে তার কায়দাকানুনের জন্য বহুত বড় শোহদা১ বলতে হয়। বেশক সরকার অনেক আচ্ছা কানুন তৈরি করছে। কিন্তু চাইলে তার গলত তফসির২ বা গলত ইস্তেমালও করা যায়। কে কী ইরাদা থেকে করছে সেটাই হল আসল। হাকিমরা তা হলে আছেন কেন? হায়! আমার মনে হয়েছে তাঁরা সবাই হলেন আমাদেরই হাতের পুতুল। এত কাজের চাপ, আর সব কাজই একটার সঙ্গে আরেকটা এমন জড়িয়ে যে চাইলেও সবকিছু ঠিকঠাক হয় না।
গুনাহর তো অন্ত হয়! মৌলভি উকিল পুরো তালুক কবজা করার পাশাপাশি লালা মুনশিকে বাতিল করে। মুনশি চালাক আদমি সে আর কোনও বখেড়া খাড়া করেনি। তার ভয় ছিল মামলাটা নিয়ে বেশি হইচই করলে সে নিজেও ফেঁসে যেতে পারে। কারণ বজ্জাতিতে তো সে খোদ শামিল। শিকারের তল্লাশে এই দুই বজ্জাত হাত মিলিয়েছিল। এখন যার তাকত বেশি সে আরেক তরফকে হটিয়ে দিয়ে পুরো শিকারই দখল করল।
১. মুফলিস: দরিদ্র, নিঃসম্বল, দেউলিয়া
১. শোহদা: বদমাশ, গুন্ডা
২. তফসির: ব্যাখ্যা