ক্রোক করার কমিশনার
গ্রামে খুম তহসিল (Khum Tuhseel) চালু হলে সব থেকে বেশি আমদানি কানুনগোর। জমিদারের পাওনা বাকি পড়েছে। কেউ সেই বাকি মেটাতে রাজি নয়। তখনই চালু হয় এই বন্দোবস্ত। কালেক্টর নিজের হেপাজতে জমিদারের জায়গায় কাউকে বসায়। এদের বলে সাজোয়াল (suzawul)। খাজনা আদায় করাটাই হল কাজ। দেখা যাবে কাজটা আসলে করছে কানুনগো। শুরুতে সে গিয়ে গ্রামে একটা জমায়েত করবে। তারপর সরকারের নাম করে চাইবে নজরানা। চাঁদির রুপিয়া ছাড়া আর কিছুই কবুল করা হবে না। সাজোয়ালকে দিতে হবে একটা নধর খাসির দাম। খানাপিনা খতম হলে আবার তলব করা হবে আসামিদের। নতুন করে যাতে জমাবন্দি বা-মুজিব-হো-হুকুম সাহেবান ব্রুড (jumma bundee ba-moojib-hoo-koom Saheban Broud) চালু করা যায়। ব্রাহ্মণদের বাদ দিয়ে আর সব জাতের লোকেদের থেকেই জবরদস্তি আদায় করা হয় বিঘা পিছু চার থেকে আট আনা। ব্রাহ্মণদের ছাড় দেওয়া হয় যাতে তারা মনের সুখে লালাকে গালিগালাজ করতে পারে। এই জবরদস্তি আদায়টা হচ্ছে সাজোয়ালের আমদানি। সে যখন হিসাব লিখতে বসে তখন এই আমদানির কথা তার আর মনেই থাকে না। সরকারের বেনামদারের কাজ হল জমিদারের বকেয়া উসুল। গোয়ালারা ভেট চড়াবে কচি পাঁঠা। হাজামরা বিনা মজুরিতে তার চুল-দাড়ি কামিয়ে দেবে আর সকাল-রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে পরে করবে নাজুক মালিশ; দরকার মতো নাপিতের জায়গায় বহাল হবে নায়েন (ঔরত) যাতে সাজোয়ালের আরাম-আয়েশের কোনও কসুর না হয়। রাত ভর বাতি জ্বালানোর জন্য তেলিরা জোগাবে তেল। তালুকের হেপাজত করবে যে সাজোয়াল, তার যে তসবির আমাদের নজরে আসে তা হল একজন খুশ নসিব আদমি। গ্রামে বসেই যে চালিয়ে যেতে পারে সবরকম মৌজ-মস্তি। ইচ্ছা মাফিক সে তার দোস্তদের পয়গম পাঠায় দাওয়াতের। কারণ খরচ তো দেবে দেহাতিরা। খরচ যখন নেই তখন কেন খাও-পিও মস্ত জিয়ো হবে না? কখনও কখনও কালেক্টর সাহেবের নজরে পড়ে যায় এই সব কারবার। তলব পড়ে কানুনগোর। তখন সে লাপাতা। কাঁহা হ্যায়? কারও কাছে কোনও জবাব নেই। নাজির আমার দিকে ফিরে তুজুকে ওঠেন, “পাঁচকড়ি পাকড় কে লাও ওই নিমকহারাম-শুয়োরকে। জরুরত পড়লে বজ্জাতটার কুঠিতে তল্লাশি চালাও! না হলে সিধা চলে যাও সন্দেহ গাঁও যেখানে সাজোয়াল হয়ে বসে আছে ব্যাটা।”
দেহাতি লব্জে একটা কহাবত চালু, “সুঝবুঝই বেয়াকুবকে সমজদার বানায়।” নোকরিতে যখন বহাল হই তখন হলে আমি তুরন্ত উর্দি চাপিয়ে সাজোয়ালের তল্লাশি করতে বেরিয়ে পড়তাম। আমি খেয়াল করেছি হড়বড় করলে কোনও কাজ হাসিল হয় না। হুকুম হলে তাই আমি শুরুতে গেলাম নিজের ঘর। তারপর ভরপেট খানা খেয়ে টানা ঘুম। সকাল হলে চললাম সাজোয়ালের তল্লাশি করতে। ব্যাটার ঘরে গিয়ে খবর মিলল দু’-চার রোজ সে বেপাত্তা। এবার সিধা সন্দেহ (sundaha)। ছাউনিতে পৌঁছনোর আগেই শুনতে পেলাম সারেঙ্গির ধুন আর রামজানির (Ramzanee) সুরেলা আওয়াজ। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই ঢুকে পড়লাম মজলিশে। দেখি ব্যাটা হোঁতকা সাজোয়াল লম্পটটা বসে গড়গড়ায় টান দিচ্ছে আর লচকদার (lacakdar) নাচনেওয়ালি ছুকরির খুবসুরতি মাপছে। তারিফ জানাতে মাঝে মাঝে হেলিয়ে দিচ্ছে মাথাটা। দেখে তো মনে হয় ভাং-এর নেশায় বা রামজানির তেরছা নজরের ঝলকানিতে পুরো বুঁদ হয়ে আছে। সবে দোপহর, তখনই ব্যাটার বোল বন্ধ। “বাহঃ! কানুনগোজি; কাল থেকে হুজুর তোমার তলাশ করছেন আর তুমি বেপাত্তা! আমার হুজুর নাজির সাহেবের হুকুম তোমাকে হামেহাল তাঁর দরবারে পেশ করতে হবে। ইনসাল্লা! তোমাকে কোন হালতে পেয়েছি সেটাও জানাতে বলেছেন হুবহু। এমন খবর তাঁকে দেব যে জিন্দেগি ভর তুমি ইয়াদ করবে।” যতই বেএক্তিয়ার হোক না কেন দেখলাম ঝটপট সাজোয়ালের হুঁশ-ঠিকানা ফিরে এল। আমাকে ঠুকতে লাগল লম্বা, লম্বা সেলাম। খাড়া হয়ে আমাকে খোশামোদ করতে লাগল। হাতে ধরিয়ে দিল একটা ছিলিম। পোলাও আনাতে পাঠাল একটা বাচ্চাকে। বুঝলাম এই মাহোলের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে আমারই লোকসান। ধীরে ধীরে হালকা হল আমার কোমর বন্ধ, মাথার থেকে নেমে এল পাগড়ি, টান দিলাম ছিলিমে। একটা সময় দেখলাম আমিও নাচনেওয়ালি ছুকরির তারিফ করতে বসে গেছি। সেদিন সন্ধেয় আর কী কী করেছিলাম তার উপর একটা পরদা টানাই ভাল। স্রেফ এটুকু কবুল করলেই চলবে যে বুঝেছিলাম সরকারের রাজস্ব দপ্তরের সাজোয়াল হওয়া কোনও সহজ কথা নয়।
পরদিন আমি আর সাজোয়াল গিয়ে হাজির হলাম কাছারিতে। নাজিরকে বলা হল, সাজোয়াল পুরো দিন সরকারের রাজস্ব আদায় করছিল। তাই জলদি হাজির হওয়া মুমকিন ছিল না।
এই দুনিয়ায় আরও বেশি চমৎকার খেল যে দেখিয়ে থাকে তার নাম হচ্ছে কমিশনার ক্রোক। আমি খুব কাছ থেকে এই কাজ দেখেছি। কালেক্টরের দপ্তরে যারা মোক্তার আর মুহুরি তারাই বলেছে এই ফরমানদারেরা যে কাজটা করে তা আসলে আমিনের কাজ। এদের হেপাজতে আছে শুধু মাল বেচা আর ক্রোক করা। কোনও মাল বেচলে তার দশ শতাংশ হচ্ছে দস্তুরি। ধরা যাক যারা কিনবে তাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া হয়ে গেল, বন্ধ হল বিক্রি। তা হলেও ক্রোক হওয়া সম্পত্তির মোট দামের পাঁচ শতাংশ তাদের দস্তুরি বাবদ দিতেই হবে। এক একজন ফরমানদারের দস্তুরি বাবদ সালিয়ানা আমদানিই হল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। কমিশনার সাহেবকে একটা ঢঙের কাছারি বসানোর জন্য ভাড়া গুনতে হয়। মুহুরিকে বেতন দিতে হয় মাসে ৭ টাকা। এ ছাড়াও আছে কমসে কম ছ’জন চাপরাশি যাদের বেতন মাথা পিছু ৩ টাকা। তা হলেই বুঝুন এই রকম একজন ভারী অফিসারের জন্য কতটুকুই বা পড়ে থাকে! এঁদের আবার ঘরে বিবি-বাচ্চারা আছে। রাখতে হয়েছে একটা ঘোড়া বা পালকি। বহাল হয়েছে কয়েকজন নোকর আর নোকরানি। এসব বহাল রাখতেও তো জরুরত পড়ে টাকার যার জোগান আসে বেমালুম নানা কেরামতি থেকে। আমি পাঠকদের এসব খুঁটিনাটি বলে বেজার করতে চাই না তাই আমদানির আরও কিছু নমুনা পেশ করা যাক।
ধরুন ‘এ’ একটা মামলা দায়ের করল, মালগুজারি বাবদ সে ‘বি’-র কাছ থেকে ১০০ টাকা পাবে। যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা তার বাজার দর হবে ৫০ টাকা। কিন্তু ঠিক হল দাম ধরা হবে ২৫ টাকা। কানুনি কারবার যা করার ছিল সবই হল আর সম্পত্তি বিক্রি হয়ে গেল ২৫ টাকায়। কমিশনার তার দস্তুরি বাবদ ১০ শতাংশ কেটে নিল। তাকে বলে জোর দাবা (zur-dawee) এই সম্পত্তির মামলায় সেটা দাঁড়াল ১০ টাকা। আসলে কমিশনারের পাওয়ার কথা ২ টাকা ৮ আনা কিন্তু সে আদায় করল ১০ টাকা। এই বজ্জাতি এত দিন ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল কম সে কম হিসাব নিকাশে এর কোনও নাম নিশান থাকত না। তাই সেই সময়টাকে আংরেজি লব্জে বলা যায়, “good old days.”
আবার ধরুন ‘এ’ একটা মামলা রুজু করল ‘বি’-এর খিলাফ। সে চায় সম্পত্তি ক্রোক করে তার ১০০ টাকা মেটানো হোক। কিন্তু সম্পত্তির দর ঠিক হল স্রেফ ১০ টাকা। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া হয়ে যাওয়ায় ঠিক হল সম্পত্তি বেচার দরকার নেই। বেচা হলে কমিশনার আইন মাফিক ১০ টাকার উপর দস্তুরি পেত। মানে তার জুটত ১ টাকা। বেচা কেনা না হলেও আইন মোতাবেক সে পায় আট আনা। কিন্তু কমিশনার এবার সরাসরি হেঁকে বসল তার চাই ৫ টাকা। পুরো মামলাটা আপনারা সাফ নজরে বিচার করুন; দেখবেন কোনও কাজ না করেই কমিশনার দশগুণ বেশি দস্তুরি চাইছে!
কোনও একজন আসামিকে হুকুম দেওয়া হল সে খারিফ ফসল কাটতে পারবে কিন্তু সে তখনও সরকারের খাজনা মেটায়নি। এমনিতেই তার ছিল দেনা। তাই ফসলের বেশিটাই গেল মহাজনের হাতে। উল্টে সে দেখল যে আড়াই বিঘা জমিতে সে আখের চাষ করেছিল সেই জমি ক্রোক করা হয়েছে। জারি হয়েছে বিক্রির ফরমান। যদি সে গুড় বানানোর সময় পেত তা হলে কম সে কম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা তার আমদানি হত। কিন্তু জমিদারের ইচ্ছা তাকে বরবাদ করা। বেচারা রায়ত তাই ছুটল কালেক্টর বা ডিপটি সাহেবের কাছে দরবার করতে। তাকে বলা হল মালজমিনি (mal zaminee) দাও আর বেজা ক্রোকের বন্দোবস্ত কর। ফসল সে বাঁধা রাখল মহাজনের কাছে আর সেই মহাজনই হল তার মামলার জামিনদার। কানুনি রেওয়াজ সব খতম হলে শুনানি হল মামলার। সওয়াল-জবাবের মুখে রায়ত স্বীকার করল খাজনা মেটানো হয়নি তবে তাকে যদি আরও কিছুটা সময় মঞ্জুর করা হয় তবে জরুর সে তার বকেয়া খাজনা শোধ করবে। সেই সঙ্গে রেহাই মিলবে তার বরবাদির হাত থেকে। সাহেব জবাব দিলেন, ওয়াজিব হ্যায় (wajib hae)। মোক্তার এবার সওয়াল করতে বসল, জমিদার কি তা হলে জমির ফসল আর তার মালগুজারির হকদার নয়? রায়ত তো খরিফ ফসল ঘরে তুলেও জমিদারকে খাজনা মেটায়নি। এখন যদি সাহেব বাহাদুর এই মামলায় দখল আন্দাজি করেন তবে জমিদার কী করে সরকারের পাওনা শোধ করবে। মুনশিজি আবার চুপচাপ তার ইলতিমাস (iltimas) পেশ করল। তার বয়ান মাফিক ফসলের দাম ঠিক হয় লোকেদের কতটা দরকার তাই দিয়ে। মামলা খারিজ হল। জারি হল বিক্রির হুকুম। বেচারা রায়তের সামনে এবার খোলা রইল দুটো রাস্তা। হয় তাকে তার কাঁচা ফসল জমিদারের কাছে বিক্রি করতে হবে ( যে পারলে বেনামে সেই ফসলই আসলের এক ভাগ দামে কিনে নেবে) না হলে ফসল বাঁধা রাখতে হবে মহাজনের কাছে (যে সালিয়ানা ৭৫ টাকা হারে সুদ আদায় করবে)।
ইনসাল্লা! আমি দেখলাম কোম্পানি কা রাজ হচ্ছে দায়াদি আর বেচারা গরিব রায়তদের জন্য হচ্ছে এতিম রাজ।
শোনো বলি জমি নিয়ে করলে হুড়োহুড়ি লোকসান হবে কার,
দৌলতমন্দের বাড়বে দৌলত আর মৌত হবে বাকি সবার।
জৌলুস তো বাড়তেই পারে রাজা মহারাজার
তবে যখন নামে ধস তখন তো সব মিলেমিশে হয় একাকার।
ফৌলাদি কিষান হল সিয়াসতের অহংকার,
একবার খতম করলে ফিরবে না তারা আর।