কানুনের রখওয়ালা
একটা রেওয়াজ বহু দিন থেকে চালু, যে সব জনাবরা রেভেনিউ কালেক্টরের নোকরিতে কামইয়াবি হাসিল করতে পারবে না তাদের সরফরাজি১ দিয়ে জজের কুর্সিতে বসিয়ে দাও। পাঠকরাও হয়তো তেমন কাউকে কাউকে জানেন। আমি একজনের কথা বলতে পারি যে তার সেরেস্তাদারের ইশারায় চলে ফেরে। প্রত্যেক দিন সকাল হলেই সেরেস্তাদার একটা ফর্দ নিয়ে হুজুরের সামনে হাজির। সে দিন যে মামলার ফয়সালা হতে চলেছে এটা হচ্ছে তারই ফর্দ। তার ইশারায় জজ সাহেব বিচার করতেন কোন মামলা খারিজ হবে আর কে পাবে ডিক্রি। ভরা আদালতে স্রেফ নাটক হত। শুনানি খতম হলে জজ সাহেব দিতেন রায় যা আগেই ঠিক হয়ে আছে। হতে পারে সেরেস্তাদার মহা বদমাশ কিন্তু তার কেরামতির তারিফ করতে হয়। সাহেবকে মজবুর হয়ে রায় পালটাতে হচ্ছে এমন কখনও হয়নি। সদর আদালতের কোনও একজন হুজুরের নাপসন্দ ছিল জজ সাহেবের এ হেন কারবার। তিনি কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারতেন না কী করে একজন মামুলি সেরেস্তাদার তার ইউরোপীয় মনিবের উপর খবরদারি চালায়। একবার এক জবরদস্ত আংরেজ আবাদির একটা মামলা এল আদালতে। যাতে জলদি জলদি ফয়সালা হয় তাই খোদ আবাদি হাজির। মহামান্য জজ সাহেব তাকে দেখে তো খাফা। জানতে চাইলেন, কী দরকার? জবাব মিলল, আদালতের দরজা কি সবার জন্য খোলা নয়?, না, খোলা নয়। আপনি এখান থেকে দফা হয়ে যান আর আপনার ভাড়া করা উকিলকে পাঠান!
সেই একই জজ সাহেবের আদালতে আর একটা মামলা উঠল। এবার মামলা এমন একটা গ্রাম নিয়ে যে গ্রামের হদিশ কারও জানা নেই। কিন্তু আমাদের মহামান্য জজ সাহেব জেনে গেলেন সেই গ্রামের চৌহদ্দি নাকি ৭৫ বিঘা। তাঁর সেই হিসাব মাফিক তিনি ডিক্রি দিলেন। আর কালেক্টরকে বলা হল ডিক্রিওয়ালাকে গ্রামের দখল নিতে যেন মদত করা হয়। কালেক্টর হুজুর আবার তার পালটা জবাবে লিখলেন, মহামান্য, যদি কাউকে হুকুম দেন এলাকার হদিশ দিতে তা হলে তিনি জরুর ডিক্রিওয়ালা যাতে দখল পায় তার বন্দোবস্ত করবেন। এবার জজ সাহেব জানালেন, তাঁর কাজ হুকুম করা। কী করে সেই হুকুম তামিল হচ্ছে সেটা দেখা তাঁর কাজ নয়। এবার যা হওয়ার তাই হল। মুলতবি হয়ে রইল হুকুম। এই জজ সাহেবকে সলোমন (Solomon) ছাড়া আর কী বলবেন!
এক নীলকর তার পাশের জেলার কিছুটা জমি দখল নিল চাষ করবে বলে। এই নীলকরের নাম স্মিথ, ব্রাউন বা টমাস কিছু একটা হবে। আমরা বলব টমাস। কারণ এই নামটা শুনতে ভাল আর অনেক সাহেবেরই থাকে। নীলের বীজ পোঁতার সময় টমাস সাহেবকে কোনও ঝামেলায় পড়তে হল না। গাছগুলো যখন বেশ বড় হয়েছে তখন কোনও এক রামদিহুল সিং এসে হাজির। দাবি, ওই জমি তার তাই ভাড়া দিতে হবে। জনাব টমাস সোচ বিচার করে দেখল ভাড়া সে গুনতে নারাজ। তাই ফয়সালা হোক আদালতে। জমির দখল সে নেয় ফরেব সিং-এর কাছ থেকে। চুক্তি মোতাবেক কিছু আগামও সে কবুল করেছিল। সময় মাফিক রামদিহুল সিং আদালতে মামলা দায়ের করল। বেশক রামদিহুল ওই জমিটার মালিক। তাই মিলল ডিক্রি। জনাব টমাসের যে খাস মুহুরি বা গোমস্তা তার ভাই ছিল আদালতের ডিক্রি নবিশ (decree nuvees)। নীলগাছ উপড়ে ফেললে জনাব টমাসের বহুত লোকসান, সে কথাই জানানো হল সেরেস্তাদারকে। নীলগাছ কাটা হলে তবেই হবে ডিক্রি জারি জবাব দিল সেরেস্তাদার। আঠেরো মাস ইন্তেজার করল রামদিহুল সিং!
চালু রেওয়াজ হল লেখক তার পাঠকদের জানাবে এবার তার কলম থামল। আমিও আমার পাঠকদের বলব শুক্রিয়া। আমি লাগাতার চেষ্টা করেছি কী করে তাদের লজ্জত (lazzat) দেওয়া যায়। পাবন্দি থাকায় আমি মজবুর হয়েছি আর্দালির নকাব পরতে। তা না হলে আদালতের বজ্জাতি আর খেয়ানত কিছুতেই ফাঁস করা যেত না। আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনও পথের হদিশ ছিল না যা দিয়ে এই বজ্জাতদের কাবু করা যায়। এখন আমার খোয়াহিশ বড় বড় হুজুররা যদি কোনও বন্দোবস্ত করেন। কোনও একজন খাস আদমি আমার নিশানা নয়। আমি কোনও বদলাও নিতে চাই না। আমার লেখা যদি কোনও রায়তের বোঝা হালকা করে, যদি মেলে তার কোনও সুরাহা, তা হলে সেটাই হবে আমার ইনাম। অলবিদা, খোদা হাফিজ।
পাঁচকড়ি খান
১. সরফরাজি: বাহাদুরি, মোড়লি